Friday 30 September 2022

ইতালির ডানে মোড়… ইউরোপের জন্যে এটা কেমন বার্তা?

৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
ইতালির নির্বাচনে জেতার পর কট্টর ডানপন্থী কোয়ালিশনের তিন নেতা মাত্তেও সালভিনি, সিলভিও বারলুসকোনি এবং জর্জিয়া মেলোনি। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি কোন না কোন ফর্ম্যাটে চলেছে। নব্য-ফ্যাসিস্টরা তাদের কথাগুলি পরিবর্তন করেছে। কিন্তু তাদের কথার কেন্দ্রে ছিল অভিবাসী নীতি; যেটাকে তারা ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যতার মাঝে সকল সমস্যার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মেলোনির সরকার কতদিন টিকবে সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের উপর এর বিরূপ প্রভাব যে বাড়বে, তা নিশ্চিত।

সেপ্টেম্বরের ইতালির নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীরা বিশাল বিজয় পেয়েছে। নির্বাচনের সর্বশেষ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, জর্জিয়া মেলোনির ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’, মাত্তেও সালভিনির ‘লেগা নর্ড’ এবং সিলভিও বারলুসকোনির ‘ফোর্তসা ইতালিয়া’ দলের ডানপন্থী কোয়ালিশন প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এর মাঝে মেলোনির দল পেয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ ভোট। ইতালির সকল পত্রিকাই মেলোনির দলের বিজয়ের ব্যবধান নিয়ে হেডলাইন করে। কেউ কেউ বলে যে, মেলোনি ইতালির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। তবে মাত্র ৬৪ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়ার কারণে অনেকেই এই ভোটের গুরুত্বকে কিছুটা হলেও কম হিসেবে দেখছেন বলে বলছে ‘ডয়েচে ভেলে’। যারা ডানপন্থী দলের পক্ষে ভোট দেয়নি, তারা আশা করছেন দেশের বাকি জনগণকে সাথে নিয়েই যেন সরকার কাজ করে। তবে এই মুহুর্তে জীবনযাত্রার খরচ মারাত্মক বেড়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ চলমান থাকায় প্রথম দিন থেকেই মেলোনির সরকার চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়বে। নির্বাচিত হবার পর জর্জিয়া মেলোনি তার প্রথম ভাষণে বলেন যে, তিনি ইতালিকে একত্রিত করার চেষ্টা করবেন।

ইতালিতে ডানপন্থী রাজনীতির ইতিহাস

৪৫ বছর বয়স্ক মেলোনির দল ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা পেলেও আগের কিছু ইতিহাসের সাথে দলটার সম্পর্ক রয়েছে বলে বলছেন অনেকে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ১৯২২ সালে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ‘ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি’ ক্ষমতা দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি প্রথমে নাজি জার্মানির পক্ষে থাকলেও মুসোলিনির পতনের পর তারা মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের চিফ অব স্টাফ গিওরগিও আলমিরান্তের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় নব্য-ফ্যাসিস্ট দল ‘ইতালিয়ান সোশাল মুভমেন্ট’ বা ‘এমএসআই’। বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ফ্যাসিস্ট সমর্থকরা এই দলে যোগদান করতে থাকে। প্রায় তিন দশক ধরে চলা এর রাজনীতিতে তারা ১০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। তবে ইতিহাসবিদ পল জিনসবর্গ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এই দল যে এতকাল টিকে থেকেছিল, সেটাই বড় বিষয়। ইতালির দক্ষিণের জনগণ, শহরাঞ্চলের গরীব মানুষেরা এবং নিম্ন মধ্যবিত্তরা অনেকেই এদের পক্ষে ভোট দিয়েছে। জিয়ানফ্রাঙ্কো ফিনির অধীনে ১৯৯০এর দশকে এই দলে পরিবর্তন আসে। তিনি দলের বক্তব্যগুলিকে পরিবর্তন করেন এবং ১৯৯৩ সালে রোমের মেয়র নির্বাচনে ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সকলকে অবাক করে দেন। পরের বছরেই তিনি তার দলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’। এই সময়টাতেই রোমের খেটে খাওয়া একজন মহিলার সন্তান জর্জিয়া মেলোনি ‘এমএসআই’তে যোগদান করেন এবং পরে ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’এর যুব দলের নেতা হয়ে যান।

একসময় মুসোলিনিকে বিংশ শতকের সেরা রাজনীতিবিদ বলে আখ্যা দিলেও জিয়ানফ্রাঙ্কো ফিনি তার মতামতকে পরিবর্তন করেন এবং ২০০৩ সালে ইস্রাইল সফর করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যার শিকার ইহুদিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইতালির ইহুদী বিদ্বেষী আইনের সমালোচনা করেন। জর্জিয়া মেলোনিও ২০০৯ সালে সিলভিও বারলুসকোনির সরকারের মন্ত্রী থাকার সময় ইস্রাইল সফর করে একই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ২০১১ সালে ইইউএর প্রভাবে ইতালিতে গঠিত সরকারে মেলোনি যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। এবং ২০১২ সালে ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার দলকে ‘পুরোনো ঐতিহ্যের জন্যে নতুন দল’ হিসেবে পরিচিত করান। তবে ২০২২ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তার দল ১০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি।

মেলোনির ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’র লোগো হলো ইতালির জাতীয় পতাকার তিন রঙের আগুন। এর আগের ‘এমএসআই’ এবং ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’এর লোগোও সেটাই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ‘রুটগার্স ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর কোরি ব্রেনান ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, রাজনীতিতে লোগোটা ব্র্যান্ডিংএর মতো গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এটাকে খোঁজে এবং অনুসরণ করে। ইতালিতে মুসোলিনির তৈরি করা অনেক কিছুই এখনও টিকে আছে। বড় বড় স্থাপত্য ছাড়াও রোমের ম্যানহোলের ডাকনার এক-চতুর্থাংশের উপরে লেখা রয়েছে ‘এসপিকিউআর’। যার অর্থ হলো, ‘রোমের সিনেট এবং জনগণ’। মুসোলিনি তার সাম্রাজ্যকে প্রাচীন রোমের সাথে তুলনা দিতে এটা ব্যবহার করতেন। অনেক ম্যানহোলে ফ্যাসিট লোগোটাও রয়েছে। যদিও ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্যাসিস্ট দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তথাপি ডানপন্থীরা এখনও ফ্যাসিস্ট স্যালুট ব্যবহার করে।

বড় বড় স্থাপত্য ছাড়াও রোমের ম্যানহোলের ডাকনার এক-চতুর্থাংশের উপরে লেখা রয়েছে ‘এসপিকিউআর’। যার অর্থ হলো, ‘রোমের সিনেট এবং জনগণ’। মুসোলিনি তার সাম্রাজ্যকে প্রাচীন রোমের সাথে তুলনা দিতে এটা ব্যবহার করতেন। অনেক ম্যানহোলে ফ্যাসিট লোগোটাও রয়েছে। ইউরোপে ডানপন্থী রাজনীতি কখনোই বন্ধ করা হয়নি। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা লিবারাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাঝেই তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে অভিবাসী সংকটের পর থেকে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থীদের উত্থান হয়েছে। যেকারণে ইতালির এই নির্বাচন পুরো ইউরোপের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ।

 ডানপন্থীরা কিভাবে ইতালির নির্বাচনে জিততে পারলো?

রোমে ‘ইইউ’এর পররাষ্ট্র বিষয়ক কাউন্সিলের প্রকল্প ব্যবস্থাপক টেরেসা কোরাটেলা ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, মেলোনির এই অবস্থানে আসার সবচাইতে বড় কারণ হলো, ২০১৮ সাল থেকে ইতালিতে যতগুলি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে, তিনি সেগুলির কোনটারই অংশ ছিলেন না। আর দ্বিতীয়তঃ তার কোয়ালিশন সহযোগী মাত্তেও সালভিনি এবং সিলভিও বারলুসকোনি এই মুহুর্তে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবচাইতে খারাপ সময় পার করছেন। ইতালির আগের সরকার প্রধানদের অনেকেই প্যারিস এবং বার্লিনের নেতৃত্বের সাথে যেমন সমঝোতা করে চলতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি হয়তো সেই পথে নাও হাঁটতে পারেন। অন্ততঃ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তিনি হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডের ডানপন্থী নেতৃত্বের সাথে বেশি কাছের সম্পর্ক রেখেছিলেন।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে রোমের ‘ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স’এর ডিরেক্টর নাথালি টচ্চি ডানপন্থীদের জয়কে ইতালির রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সাথে যুক্ত করেন। ডানপন্থীরা জিতেছে, এর অর্থ এই নয় যে, ইতালিয়রা ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছে। এদের জয়ের মূল কারণ হলো, জনগণ ইতালির রাজনীতির ব্যাপারে যারপরনাই ক্ষুব্ধ; তারা পরিবর্তন চাইছে। তারা ভিন্ন একটা দলকে ভোট দিতে চাইছিল।

তবে ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ডানপন্থীরা ভোট পাবার জন্যে এমন কিছু ইস্যুকে বেছে নিয়েছে, তা চিন্তা করার মতো। মাত্তিও সালভিনির নির্বাচনী এলাকা ফেরারা কিভাবে বামপন্থী থেকে ডানপন্থী হয়ে গেলো তার উত্তর খুঁজতে ‘বিবিসি’ বলছে যে, সেখানকার জনগণ মনে করছে যে, অভিবাসীদের কারণে তাদের শহরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এবং সাধারণ ইতালিয়রা অর্থনৈতিক সমস্যা পড়েছে। অথচ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই অঞ্চলটা ইতালির অনেক অঞ্চলের চাইতে অধিকতর সমৃদ্বশালী। এখানকার সমস্যা হলো এখানকার স্থবির জনসংখ্যা; যেটার কারণে এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন আসছে না; তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি হচ্ছে না। ডানপন্থীরা বলছে যে, এখানকার অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে অভিবাসীদের কারণেই; আর সেটাই অনেক মানুষ সমর্থন করছে। অথচ একসময় এই শহরে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অপরাধে অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে; যাদের মাঝে কেউ কেউ এখনও বেঁচে আছেন। তাদের জীবদ্দশাতেই তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, ইতালি আবারও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

অনেকেই ডানপন্থীদের জয়ের পিছনে কিছু ষড়যন্ত্র থিউরির কথা বলছেন; যা মানুষ বিশ্বাস করছে। ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি’র প্রফেসর লরেন্স রোজেনথাল ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, মেলোনি বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন; যার মাঝে রয়েছে নারীবাদী ইস্যুগুলি। তিনি ইতালির পরিবারগুলির স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছেন; শরণার্থী থামাতে সীমানা পাহাড়া দেবার কথা বলেছেন। তিনি সেই থিউরির কথা বলে জনগণকে ক্ষেপিয়েছেন, যেখানে বলা হচ্ছে যে, ‘গ্লোবাল এলিট’রা পশ্চিমা দেশগুলির আদিবাসীদেরকে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসী দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাইছে। এই থিউরিটাই জনগণের ক্রোধের কেন্দ্রে রয়েছে; যা তিনি ব্যবহার করেছেন। সবগুলি পশ্চিমা দেশেই এই চিন্তাটা ঘনীভূত হচ্ছে এবং এরা সকলেই অশ্বেতাঙ্গদেরকে তাদের সমস্যার কারণ হিসেবে দেখছে।

মেলোনি কিছুদিন আগেই এক বক্তব্যে বলেছেন যে, বামপন্থীরা রক্ষণশীলদের সকল বিশ্বাসের উপরে হামলা করেছে। তিনি সিসিলির উপকূলে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ও মেক্সিকোর সীমানার তুলনা করেন। তিনি বলেন যে, হাজারো অভিবাসী শহরের বস্তিগুলি ভরে ফেলছে; এবং তাদের কারণে ইতালির জনগণের পারিশ্রমিক কমে গেছে; এই অভিবাসীরা অনেকেই বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। মেলোনি ইউরোপের অন্যান্য দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে যখন কথা বলছেন, তখন তার কথাগুলি বেশ স্পস্ট। স্পেনের কট্টর ডানপন্থী ‘ভোক্স’ পার্টির এক র‍্যালিতে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, তিনি স্বাভাবিক পরিবারের পক্ষে; সমকামি লবির পক্ষে নন। মানুষের লিঙ্গ পরিচয়ের ব্যাপারে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করলেও লিঙ্গ নিয়ে আদর্শের বিরোধী।

 
জর্জিয়া মেলোনির পিছনে 'ব্রাদার্স অব ইতালি'র লোগো; যেখানে রয়েছে ইতালির পতাকার তিন রঙের আগুন। এর আগের নব্য-ফ্যাসিস্ট দল ‘ইতালিয়ান সোশাল মুভমেন্ট’ বা ‘এমএসআই’ এবং ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’এর লোগোও ছিল এটাই। রাজনীতিতে লোগোটা ব্র্যান্ডিংএর মতো গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এটাকে খোঁজে এবং অনুসরণ করে।

ডানপন্থীদের নীতি কি ইইউএর সাথে সাংঘর্ষিক হবে?

ইইউ পার্লামেন্টে জার্মানির ক্ষমতাসীন সোশালিস্ট দলের প্রতিনিধি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাটারিনা বারলি ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, মেলোনি ক্ষমতায় যাবার পরে তার পূর্বের নীতির মতোই চলবেন, নাকি পরিবর্তিত হবেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, অর্থনৈতিক এবং আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি রক্ষণশীল ভূমিকা নেবেন; আর মানবাধিকার, নারীর অধিকার, এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের মতো আদর্শিক বিষয়ের ক্ষেত্রে খুবই কঠোরভাবে জনমতের উপরে চলবেন। ইউরোপের খারাপ সময়ে তার জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাগুলি ইউরোপকে একত্রিত করবে না। ক্যাটারিনা বারলি বলছেন যে, তাদের অভিজ্ঞতায় এধরনের সরকারগুলির ইইউএর মাঝে ছাড় দেয়ার প্রবণতা থাকে না। অথচ ইইউএর নীতি তখনই তৈরি করা সম্ভব, যখন সেখানে একেকটা দেশের ছাড় দেয়ার প্রবণতা থাকে। যদি একেকটা দেশ মাঝে মাঝে নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সেটা যদি চলতেই থাকে, তাহলে ইইউ আর ইইউ থাকবে না; তা হয়ে যাবে কিছু স্বার্থপর মানুষের ক্লাব। বারলি বলছেন যে, এখন পর্যন্ত মেলোনি ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে কথা বললেও তার কোয়ালিশন সহযোগী মাত্তেও সালভিনি এবং সিলভিও বারলুসকোনি ভ্লাদিমির পুতিনের সমর্থক বলে পরিচিত। কাজেই এখনই বলা যাচ্ছে না যে, ইউক্রেন যুদ্ধে ইতালির অবস্থান কি হবে। তবে ইইউএর জ্বালানি সংকটের মাঝে ইতালি খুব সম্ভবতঃ রুশ জ্বালানির উপরে নির্ভরশীল দেশগুলির জন্যে কোন ছাড় দিতে রাজি হবে না।

মেলোনির ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ দলের সংসদ সদস্য ইলেনিয়া লুকাসেলি ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইতালির জনগণ রক্ষণশীল; তাদের দলও সেইরকমই। অভিবাসী, সমকামিদের অধিকার, গর্ভপাতের অধিকার ইত্যাদি আদর্শিক বিষয় এই মুহুর্তে তাদের দলের কাছে অর্থনৈতিক সমস্যার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইতালির রক্ষণশীল জনগণ প্রকৃতপক্ষে শরণার্থীদের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত নয়। লুকাসেলি বলছেন যে, তাদের দলের সাথে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দলের কোন সম্পর্ক নেই। এই দলের সাথে সম্পর্কিত কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে সোশাল মিডিয়াতে কোন উগ্রপন্থী কথা বলে থাকে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন; কারণ এই দলটা অনেক বড়। প্রতিটা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে দলের কোন নীতির মাঝে উগ্রতা নেই।

ডানপন্থীদের বিজয়কে কে কিভাবে দেখছে?

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানির ক্ষমতাসীন বামপন্থী সোশালিস্ট সরকার ইতালির নির্বাচনের ব্যাপারে রয়েসয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। তবে উগ্র ডানপন্থী ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’ দল ইতালির নির্বাচনে খুশি। তারা বলছে যে, সুইডেন এবং ইতালিতে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির বিজয় প্রমাণ করছে যে, বামপন্থী রাজনীতি এখন অতীতের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্স এবং স্পেনের ডানপন্থী বিরোধী দলগুলিই মেলোনির বিজয়ে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছে। এছাড়াও ইইউএর মাঝে ‘ইউরোস্কেপটিক’ পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির সরকারও তাদের উৎফুল্লতা প্রকাশ করেছে। তবে ইইউএর বাকি দেশগুলি মেলোনির ব্যাপারে একেবারেই আশাবাদী নয়; কারণ তিনি এতদিন তার নীতিতে ইতালির স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবার কথা বলেছেন। যদিও ইইউএর পক্ষ থেকে নীতিগত কারণে ইতালির নির্বাচন নিয়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি, তথাপি ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন বলেছেন যে, যেসব দেশ ইইউএর আদর্শকে সন্মান করবে না, সেসব দেশকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পদ্ধতি ইইউএর জানা রয়েছে।

জার্মানির ‘গ্রিন পার্টি’র সংসদ সদস্য টোবিয়াস বাখেরলে ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়া এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ চালিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ইতালির ডানপন্থী দলের নীতি কি হবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউএর অন্যান্য দেশের ডানপন্থী সরকারগুলির সাথে ইতালির এই সরকার তাল মেলাবে। বাখেরলে পুরো ইউরোপ জুড়ে ডানপন্থী দলগুলির জয়জয়কারে যথেষ্ট চিন্তিত। তিনি মনে করছেন না যে, ডানপন্থীদের উত্থানের ব্যাপারে শুধুমাত্র তার দলের মতো বামপন্থী দলগুলিরই চিন্তা করতে হবে। তিনি বিশেষ করে উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়াটা সকলের কর্তব্য বলে মনে করেন; কারণ এই চিন্তাগুলি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, পশ্চিমা দেশগুলিতে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীরা কিছু ইস্যুতে একমত হচ্ছে; যার মাঝে রয়েছে অভিবাসী ইস্যু, গর্ভপাতের অধিকার, সমকামিদের অধিকার; এবং এর সাথে কিছু ইস্যু, যেগুলিকে ডানপন্থীরা ‘গ্লোবালিস্ট’ ইস্যু বলে আখ্যা দিচ্ছে; অর্থাৎ তারা বলছে যে, সেগুলি দুনিয়ার সমস্যা হলেও তাদের দেশের সেখানে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এই চিন্তগুলি যুক্তরাষ্ট্রেও অনেকেই সমর্থন করেন; যারা মূলতঃ রিপাবলিকান দলের সমর্থক। রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ এবং টম কটন; কংগ্রেস সদস্য মারজোরি টেইলর গ্রিন, এবং প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও সকলেই ইতালির ডানপন্থী নেতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কংগ্রেস সদস্য লরেন বুবার্ট এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, বামপন্থীরা শুধু ধ্বংসই করেছে; যা সারা দুনিয়ার মানুষ বুঝতে পারছে। রিপাবলিকানপন্থী মিডিয়া ‘ফক্স নিউজ’এর প্রভাবশালী সাংবাদিক টাকার কার্লসন ইতালিতে ডানপন্থীদের বিজয়কে একটা বিপ্লব হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

 
ফ্যাসিস্ট স্যালুট দিচ্ছে ইতালির ফুটবল ক্লাব 'লাতসিও'র সমর্থকেরা। ইতালিতে মেলোনির জয় বাকি ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে চরম ডানপন্থীদের শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে জার্মানির উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলি এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও অনুপ্রাণিত হবে। এমতাবস্থায় সবচাইতে বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে জার্মানির রাজনৈতিক লক্ষ্য; যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে মিত্রশক্তিই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

ইউরোপে উগ্রপন্থীদের পুনরুত্থান

ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত ইতালিয় সাংবাদিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অব মায়ামি’র প্রফেসর রুলা জেব্রীল ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, ইতালিতে মেলোনির জয় বাকি ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে চরম ডানপন্থীদের শক্তিশালী করবে। ডানপন্থী এই কর্মকান্ডগুলি যথেষ্ট সংগঠিত এবং এদের বিচরণ এখন বিশ্বব্যাপী। একসময় মেলোনিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার ফলে তিনি ডানপন্থীদের ক্রোধের শিকার হন। ইতালিতে নির্বাচনের পর থেকে তার এবং তার মতো ডানপন্থীদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে প্রাণনাশের হুমকি আসতে শুরু করেছে।

২০১৯এর এপ্রিলে ইতালির ফুটবল ক্লাব ‘লাতসিও’র কিছু সমর্থক মিলানে একটা খেলা শুরুর আগে রাস্তায় ‘বেনিতো মুসোলিনির প্রতি সন্মান’ লেখা একটা ব্যানার তুলে ধরে। প্রায় ৭০ জনের মতো সমর্থক ফ্যাসিস্ট সঙ্গীত গায় এবং ফ্যাসিস্ট স্যালুট দেখায়। ‘সিএনএন’ বলছে যে, ব্যানারটা যে যায়গায় দেখানো হয়, তার কাছেই ১৯৪৫ সালে মুসোলিনি, তার স্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ ফ্যাসিস্ট নেতাদের হত্যা করে তাদের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়া রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, দিনটাও ছিল ‘লিবারেশন ডে’র আগের দিন; যে দিনটা ইতালিতে ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে ইতালির মুক্ত হওয়ার দিন হিসেবে পালন করা হয়। অবশ্য ইতালিতে ফুটবল মাঠে ডানপন্থীদের স্যালুট এবং অন্যান্য প্রতীকের দৃশ্যমান হওয়াটা নতুন নয়। বহুবার এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলেও তা চলছে। তৎকালীন ডানপন্থী উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি ফুটবল মাঠে ফ্যাসিস্ট স্যালুটের সমালোচনা করলেও এর বাইরে তিনি তেমন কিছু করেননি।

ডানপন্থীরা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে?

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, ইতালিতে যখন ১৯৪৮ সালের পর থেকে একেকটা সরকারের গড় আয়ু মাত্র ১৪ মাস, সেখানে ডানপন্থী কোয়ালিশনের প্রতিশ্রুত ৫ বছর উচ্চাকাংক্ষাই বটে। আর দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে নীতি নিয়ে কোয়ালিশনের সদস্য দলগুলির মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমাতে আগের সরকার ৪০ বিলিয়ন ইউরোর প্রণোদনা দিয়েছে। এখন মেলোনির শরীক দলের প্রধান বারলুসকোনি চাইছেন আরও ৩১ বিলিয়ন ইউরো ঋণ করে প্রতি মাসে ১ হাজার ইউরো পেনসনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ইতালির বর্তমান রাষ্ট্রীয় ঋণ ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ইউরো, যা কিনা দেশটার জিডিপির দেড় গুণ! এমতাবস্থায় উচ্চ সুদে ইতালি কতটা অর্থ ঋণ করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অপরদিকে মেলোনির উপদেষ্টারা বলছেন যে, তারা হয়তো দারিদ্র্য বিমোচনে অর্থায়ন কমিয়ে দিয়ে কর কমাবার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু মেলোনির শরীক দলগুলি যদি তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বেশি আগ্রহী হয়, তাহলে তার নীতি বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে না পারলে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোম্পানি এবং ৩ লক্ষ ৭০ হাজার কর্মসংস্থান ঝুঁকির মাঝে পড়বে।

ইউরোপে ডানপন্থী রাজনীতি কখনোই বন্ধ করা হয়নি। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা লিবারাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাঝেই তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে অভিবাসী সংকটের পর থেকে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থীদের উত্থান হয়েছে। যেকারণে ইতালির এই নির্বাচন পুরো ইউরোপের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে নাজি পার্টির সকল স্তম্ভ দূরীকরণের যে প্রচেষ্টা চলেছে, তা ইতালিতে হয়নি। কিন্তু তারা বলছে না যে, জার্মানিতে এতকিছু করার পরেও নব্য-নাজিরা এখনও সক্রিয় এবং উগ্র ডানপন্থী দল ‘এএফডি’ আইনগতভাবেই রাজনীতিতে রয়েছে। অপরদিকে ইতালিতে নব্য-ফ্যাসিস্ট দলের রাজনীতি করার ব্যাপারটা অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি যতটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছে, ইতালিতে সেটা তেমন বড় কোন বিষয় ছিল না কখনোই। মোটকথা ইতালিতে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি কোন না কোন ফর্ম্যাটে চলেছে। নব্য-ফ্যাসিস্টরা তাদের কথাগুলি পরিবর্তন করেছে। কিন্তু তাদের কথার কেন্দ্রে ছিল অভিবাসী নীতি; যেটাকে তারা ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যতার মাঝে সকল সমস্যার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মেলোনির সরকার কতদিন টিকবে সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের উপর এর বিরূপ প্রভাব যে বাড়বে, তা নিশ্চিত। আর ইউরোপের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে জার্মানির উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলি এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও অনুপ্রাণিত হবে। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থীদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ইইউএর কর্মসম্পাদনকে আরও চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলে দেবে। একেকটা দেশ যখন জাতীয় স্বার্থকে ইউরোপের উপরে স্থান দিচ্ছে, তখন ইইউএর অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সবচাইতে বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে জার্মানির রাজনৈতিক লক্ষ্য; যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে মিত্রশক্তিই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।



সূত্রঃ
‘Why Republicans are elated by ‘triumph’ of Italy’s Giorgia Meloni’ in Al-Jazeera, 27 September 2022
‘Italy’s right-wing winners inherit poison chalice’ in Reuters, 26 September 2022
‘How a party of neo-fascist roots won big in Italy’ in Associated Press, 26 September 2022
‘Lazio fans hang pro-Mussolini banner, make fascist salutes ahead of Liberation day’ in CNN, 24 April 2019
‘Why is Italy swinging to the far right?’ in BBC News, (https://www.youtube.com/watch?v=BNRQTSfAR1o)
‘How extremist is Italy's designated far-right government?’ in DW News, 27 September 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=4S89Iuz1I7E)

No comments:

Post a Comment