Friday 28 August 2015

মাহানের থিওরি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন

২৮ আগস্ট ২০১৫

কিছুদিন আগে মার্কিন জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট আলফ্রেড মাহানের থিওরির উপরে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম যে বঙ্গোপসাগরে একটি ম্যারিটাইম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব হতে চলেছে। এখন প্রশ্ন এসে পড়ে যে সেটা কিভাবে হবে? কিভাবে হবে, সেটা নিয়ে কথা বলার আগে কিছু কথা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা রাখা জরুরি। মাহান তার চিন্তাতে এনেছিলেন যে, মানুষের চিরাচরিত চিন্তার ফসল আন্তর্জাতিক পরিসরে কিভাবে প্রয়োগ হতে পারে। এক্ষেত্রে যেহেতু ঐতিহাসিক কারণে তিনি পুঁজিবাদী বিশ্বের বাইরে চিন্তা করতে পারেননি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বিশ্বে এখন শুধু পুঁজিবাদই বিরাজ করছে, তাই মাহানের থিওরি এসময়ে অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারছে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে কারো পক্ষেই হলফ করে বলা যায় না যে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যাবস্থা চিরস্থায়ী হবে। বিশেষ করে পুঁজিবাদের স্পন্সর পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলি এখন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সামরিক দিক থেকে বিশ্বের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে। এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি বেশ দ্রুতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, যা কিনা ভবিষ্যতে বিশ্ব নেতৃত্বতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। তখন পুঁজিবাদ সহ বা পুঁজিবাদ ছাড়া বিশ্বের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, সেটা এখন বলা দুষ্কর। চীন এখন তার সমাজতন্ত্রকে ছেড়ে দিয়ে পুঁজিবাদ থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো কিছু সুবিধা নিয়ে দেশকে গড়ার চেষ্টায় রয়েছে। চীন, জাপান এবং জার্মানি-সহ অনেক দেশ এখন মার্কেন্টিলিস্ট ইকনমি অনুসরণ করছে, যার অর্থ হচ্ছে, রপ্তানির পিছনে সর্বশক্তি নিয়োগ, অথচ আমদানি নিরুতসাহিত করা। এই নীতি ইউরোপিয়রা অনুসরণ করেছিল কয়েকশ’ বছর, যখন তারা উপনিবেশগুলিকে নিজেদের তৈরি পণ্যের বাজারে পরিণত করেছিল এবং একেবারে বেসিক কাঁচামাল ছাড়া উপনিবেশের তৈরি যেকোন জিনিসের উপরে উচ্চ কর আরোপ করেছিল। মুক্ত বাজার অর্থনীতির অগ্রপথিক ব্রিটেন এবং আমেরিকা নিজেরাও নিজেদের কৃষকদের ভর্তুকি দেয়, যা কিনা মুক্ত বাজারের নীতি-বিরূদ্ধ। যাইহোক, সামনের দিনগুলিতে মাহানের থিওরি পুরোপুরি কাজ করবে, সেটা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক মাহানের থিওরির কিছু ব্যাপার মানুষের জন্মগত কিছু চাহিদাকে ঘিরে, যেকারণে সমাজব্যাবস্থা এবং সরকার নির্বিশেষে সেগুলি বাস্তবে রূপ নেবার সম্ভাবনা প্রচুর। উদাহরণস্বরূপ, যেকোন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে সে কিন্তু শক্তভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করে – ঠিক যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এমন অবস্থায় এদেশের মানুষ সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট কাজে লাগিয়ে বঙ্গোপসাগরে (এবং বঙ্গোপসাগর পার হয়ে) পাড়ি জমাবে।

বহিঃবাণিজ্য-নির্ভরতা বাংলাদেশকে ঠেলে দিচ্ছে এমন একদিকে যেখানে অনেকেরই পা মাড়াতে বাধ্য হবে দেশ। এমতাবস্থায় শক্ত নেতৃত্ব না দিতে পারলে দেশ মহা বিপদে পড়বে




পুঁজিবাদ এবং পরিবর্তিত বাংলাদেশ

ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া বহিঃবাণিজ্য-নির্ভর বাংলাদেশ তার বিশাল জনসংখ্যার চাপেই বঙ্গোপসাগরকে নিজেদের সাগর হিসেবে দেখতে শুরু করবে। বহিঃবাণিজ্যের উপরে ব্যাপক নির্ভরশীলতার কারণে বাণিজ্য রক্ষা করাকে সে তার বেঁচে থাকার প্রধান কর্মকান্ডের সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। বিশ্বে পুঁজিবাদ না থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ এদিকেই এগুবে, কারণ ব্রিটিশদের চিন্তা এবং কর্মকান্ডের (প্রধাণত ভৌগোলিক সীমা নির্দেশ সংক্রান্ত কর্মকান্ড) কারণে ভবিষ্যতে কখনো এদেশের মানুষের পুরোপুরি স্বনির্ভর হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বেঁচে থাকার জন্যে জরুরি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বেসিক কাঁচামালের উতস এখন বাংলাদেশে নেই এবং ভবিষ্যতেও সেটার তৈরি হবার সম্ভাবনা কম। এখন এটা বলাই বাহুল্য যে সরকারের নীতি এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রাখবে; কিন্তু কিছু ব্যাপার সংঘটিত হবে মানুষের প্রকৃতিগত চাপে, যা কিনা সরকারের পক্ষে আটকানো কঠিন, অথবা সরকারই বাধ্য হবে মানুষের দেখভালের অংশ হিসেবে কিছু পদক্ষেপ নিতে, যা কিনা সে আগে কখনো নেয়নি। এসব পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করবে সরকারের আন্তরিকতার উপরে এবং বহিঃশক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়ে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার উপরে। প্রথম কারণটি অবশ্য অনেকাংশেই দ্বিতীয়টির উপরে নির্ভরশীল থাকবে জিওপলিটিক্সের কারণে। এদেশের মানুষ সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট কাজে লাগিয়ে যেসব কাজ করবে, তা বঙ্গোপসাগর, তথা ভারত মহাসাগর, তথা এশিয়া, তথা পুরো বিশ্বের স্ট্র্যাটেজিক ব্যালান্সে প্রভাব ফেলবে। আর সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বশক্তিদের ব্যাপক আগ্রহের কারণ হবে। এরকম বাস্তবতায় শক্তিশালী এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বের অভাব ঘটলে দেশ মহাবিপদে পতিত হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর যাই হোক, মানুষকে নিজের স্বার্থ জ্বলাঞ্জলি দিতে শেখায় না। নেতৃত্বের দৃঢ়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। নির্ভরশীলতার উপরে স্বাধীনতা দাঁড়িয়ে থাকে না।

নেতৃত্ব ও নীতি

উপরে বর্ণিত ব্যাপারগুলি বুঝেই বাংলাদেশকে এগুতে হবে। বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারা থেকে শুরু করে সামনের দিনগুলিকে কি কি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলি চিন্তা করেই প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশ্বরাজনীতি এবং বিশ্বঅর্থনীতিতে সম্ভাব্য পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চলার মতো মানসিকতা তৈরি এবং প্রস্তুতি নেবার দায়িত্বও নেতৃত্বের। এক্ষেত্রে মানুষের বৃহত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাক্তি এবং বহিঃস্বার্থকে পিছনে ফেলে নীতি নির্ধারণের মাঝেই আসল সাফল্য নিহিত থাকবে। ম্যারিটাইম দেশ গঠনে কেন, দেশের যেকোন নীতি নির্ধারণেই এই বিষয়গুলি প্রাধাণ্য পাওয়া উচিত। আর দেশের ভেতরে যা কিছু ঘটবে, তার সবকিছুই ম্যারিটাইম ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, দেশের নদনদী সঠিকভাবে ড্রেজিং-এর পরে এর প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে, এবং সেটার কারণে বহিঃবাণিজ্য থেকে শুরু করে জাহাজ নির্মাণ, কূটনীতি, এমনকি সামরিক প্রস্তুতিতেও আসবে পরিবর্তন। এসব বিভিন্ন ক্ষেত্রে আগাম প্রস্তুতি নিতে পারার ক্ষমতা শুধু সেধরণের নেতৃত্বেরই থাকবে, যারা কিনা আলফ্রেড মাহান এবং অন্যান্য বিখ্যাত থিওরিস্টরা যেসব বেসিক প্রশ্নের উপরে নির্ভর করে তাদের চিন্তাভাবনাকে এগিয়েছিলেন, সেসব প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর খুঁজে পাবেন, এমনকি দরকার বিশেষে ব্যাকরণ পরিবর্তন করার সক্ষমতা এবং সাহস রাখবেন।

যারা এর আগের লেখাটি পড়ে মনে করছেন যে বাংলাদেশ নিয়ে এরকম চিন্তা করাটা অবান্তর, তাদের জন্যে শুধু এটাই বলতে চাই যে তারা খুব সম্ভবত ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং আরও কিছু জিনিসের সমন্বয়ে তৈরি খিচুরির স্বাদ নেননি; এই খিচুরির নামই হচ্ছে জিওপলিটিক্স। হল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং পর্তুগালের মতো ছোট্ট দেশগুলিও একসময় ঔপনিবেশিক শক্তি ছিলো। ব্রিটিশ ভারতে মাত্র কয়েক হাজার ব্রিটিশ শাসন করতো কোটি কোটি ভারতীয়কে। আসলে যারা এগুলির গভীরতা বুঝতে অক্ষম, তারা সামনের দিনগুলিতে এদেশের নীতি তৈরিতেও অক্ষমতার পরিচয় দেবেন। সঠিক দূরদর্শী নীতিতে অনেক কিছুই থাকতে পারে, যার সবকিছু একবারে লিখে শেষ করা কঠিন। এই লেখার মাধ্যমে এ ধরণের পদক্ষেপগুলির উপরে আলোচনা শুরু করতে পারি কেবল। আজ শুরু করে সামনের দিনগুলিতে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলার প্রয়াস রাখছি।
 
ম্যারিটাইম দেশ হবার জন্যে বাংলাদেশের কাছে তার সবচাইতে বড় সম্পদ হলো বিরাট জনসংখ্যা। সামনের দিনগুলিতে এই জনসম্পদকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়াটা জরুরি


জনসংখ্যা সমস্যা, নাকি জনসম্পদ?

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলির ভেতরে সবচাইতে বড় সম্পদ হচ্ছে এর জনসংখ্যা। একসময় বাইরে থেকে প্রচুর ডলার এসেছে এদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। অথচ এখন জনসংখ্যার কারণেই বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের অনেকগুলি দেশ এখন সামনের দিনগুলিতে শক্তিশালী দেশরূপে আবির্ভাব হতে যাচ্ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ফল হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলি এখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রন হারাতে বসেছে এবং নিজেদের সম্ভুক গতির অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সারা বিশ্ব থেকে জনশক্তি আমদানি করে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকে ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জনশক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে উপলব্ধি করাটা জরুরি। মাহান ডাচদের উদাহরণ দিয়েছিলেন - কিভাবে তারা একটা ম্যারিটাইম দেশে পরিণত হয়। ডাচদের চিন্তাশীল লোকেরা হিসেব করে বের করেছিলেন যে হল্যান্ডের ভূখন্ডের পক্ষে তাদের জনসংখ্যার মাত্র আট ভাগের এক ভাগের ভরণপোষণ যোগান দেওয়া সম্ভব। ডাচরা প্রথমে সাগরে মাছ ধরতে বের হলো। এরপরে তার মাছ প্রসেসিং করতে শিখলো এবং সেই প্রসেস করা মাছ ইউরোপের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করতে শুরু করলো। এক্ষেত্রে ইউরোপের উপকূলের ঠিক মাঝামাঝি হওয়ায় এবং রাইন নদীর মোহনায় অবস্থিত হওয়ায় গোটা ইউরোপের সাথে চমতকার যোগাযোগ ব্যবস্থা তাদের সাহায্য করেছিল। খুব শিগগিরই ডাচরা নাবিকের জাতি হয়ে উঠলো। একসময় স্প্যানিশ রাজের বেশিরভাগ জাহাজই ডাচরা চালাতো। নিজেদের দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পও গড়ে উঠতে থাকলো বাণিজ্যের সাফল্যের সাথে সাথে। এভাবে ডাচদের বিরাট এক বাণিজ্য নৌবহর গড়ে উঠলো, যা কিনা ইউরোপে বাণিজ্য করতে গিয়ে অন্যান্য শক্তিশালী দেশের স্বার্থের রোষানলে পড়লো এবং জলদস্যুদের কবলেও পড়তে থাকলো। এভাবেই ডাচরা তৈরি করলো তাদের নৌবাহিনী এবং নৌ-নিরাপত্তা, যা কিনা পরবর্তীতে তাদেরকে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব আবিষ্কারের স্পৃহা যোগায় এবং এক ঐপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত করে। এখানে ডাচদের দ্রুত বর্ধনশীল জনস্ংখ্যা এবং দেশে অভাবের কারণে জাহাজের নাবিক হবার জন্যে অনেক মানুষ পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় বেশি জনসংখ্যার চাপেই তারা বাণিজ্য জাহাজ তৈরিতে মনোনিবেশ করে। জনসংখ্যা একেবারে কম থাকলে কিন্তু ডাচরা সমুদ্রে আধিপত্য লাভের চেষ্টাই করতে পারতো না। সমুদ্র তাদেরকে কর্মসংস্থান এবং নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছে। সমুদ্র দেখে তারা ভয় পায়নি; বরং এই নতুন এডভেঞ্চারকে তারা তাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে।


ডাচদের উত্থানের পিছনে তাদের ফিশিং ইন্ডাস্ট্রি একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। সমুদ্রের দিকে ডাচদের আগ্রহী করে তোলার জন্যে মাছ আহরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল

মাছ থেকে উপনিবেশ – ডাচদের উত্থান

ডাচদের জনশক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে মূলত জাহাজ, জাহাজ-নির্মাণ, মাছ আহরণ, সমুদ্র-বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন কারখানা, নৌবাহিনী, ইত্যাদিতে সেক্টরে। অনেকেই আবার বিশ্বব্যাপী ডাচদের স্থাপিত ব্যবসাকেন্দ্রগুলিতে জীবিকা খুঁজে নিয়েছে। এই প্রতিটা সেক্টরেই বিপুল জনসম্পদের দরকার ছিল তাদের। ডাচদের কাছ থেকে শেখার রয়েছে বাংলাদেশেরও। রাইনের সবগুলি শাখানদী হল্যান্ডের মাঝ দিয়ে সমুদ্রে পড়ায় ডাচরা এমনিতেই পানির দেশের মানুষ ছিল। নদীপথে ডাচরা জার্মানিসহ এবং ইউরোপের অন্য দেশের সাথে বাণিজ্য করতো; এখনও ডাচরা নদী এবং খাল ব্যবহার করে নিজেদের বেশিরভাগ পণ্য পরিবহণ করে এবং জার্মানিতে রপ্তানি করে। বাংলাদেশের দু’টি বিশাল নদী গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র ব্রিটিশরা মানচিত্রে কেটে দিয়ে গেছে, যাতে এখানে রাইনের মতো কোন শক্তিশালী নদীপথের উত্থান না হয়। ব্রিটিশরা চলে যাবার পরে তাদের মিত্র ভারত সরকার গঙ্গা নদীতে বাঁধ দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে, যা নিয়ে এর আগের লেখায় বিস্তারিত লিখেছি। নদীপথে ডাচদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরাট লাভবান হলেও আমরা এই উদাহরণটুকু কাজে লাগাতে পারছি না। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথকে কাজে লাগাতে মনোনিবেশ করতে পারি।

ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার মাধ্যমে পুরাতন নদীপথগুলিকে জীবন দিতে পারি আমরা। ড্রেজার এবং এর আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং বালুবাহী জাহাজ তৈরি করতে গিয়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্প চাঙ্গা হবে। রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, চাপাই নবাবগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেট, ইত্যাদি শহরকে নদীপথে পুণরায় যুক্ত করতে পারলে দেশের ভেতরে শিল্প এবং বাণিজ্যের বিকেন্দ্রীকরণ হবে এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্প আরও একটা অণুপ্রেরণা পাবে। ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল সরকারীভাবে একটা তৈরি করা হলেও আরও দরকার নদনদীর পাশে। এখন পর্যন্ত এসব টার্মিনালে ব্যবহৃত হবে বলে অনেক কনটেইনাল জাহাজ দেশীয় শিপইয়ার্ডগুলিতে তৈরি হচ্ছে। এই জাহাজগুলি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার ঢাকার আশেপাশের জায়গায় পরিবহণ করবে এবং ব্যয়বহুল ও যনজটপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েকে বাইপাস করবে। নদীপথগুলি উন্মুক্ত করা গেলে দেশের অনেকস্থানে নদীর তীরে খাদ্যশস্য, জ্বালানি তেল এবং রাসায়নিক সারের গুদাম তৈরি করা যাবে; এতে দেশীয় জাহাজ আরও দেখা যাবে। যাত্রীবাহী জাহাজের সংখ্যাও বাড়বে একইসাথে; মানুষ ব্যয়বহুল সড়কপথের উপরে নির্ভর না করে সাশ্রয়ী নৌপথের দিকেই যাবে। একই সাথে ছোট-বড় সকল ধরনের পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণের জন্যে ফিশিং ট্রলার তৈরি করা শুরু হয়েছে কেবল; এর সংখ্যা সামনের দিনগুলিতে আরও বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশে জাহাজ শিল্পের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে রয়েছে লাইটার জাহাজ; এরকম হাজার খানেক জাহাজ চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর থেকে তেল এবং অন্যান্য পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়। এই নৌ-পরিবহণ শিল্প যেন অটুট থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখাটা জরুরি। কোন ধরনের সরকারী বা বেসরকারী প্রজেক্ট যদি এই নৌপরিবহণের বিকল্প তৈরি করতে চায়, সেটা প্রতিরোধ করাটা দেশের ম্যারিটাইম ভবিষ্যতকে চিন্তা করে জরুরী কর্তব্য।


বাংলাদেশের বাণিজ্য জাহাজের ক্ষুদ্র বহর যেভাবে কমছে, তাতে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। দেশের নেতৃত্ব ম্যারিটাইম দেশের স্বপ্ন দেখতে চাইলে মার্চেন্ট নেভি নিয়ে ভাবতে হবে এখনই।



বাংলাদেশের মার্চেন্ট নেভির গুরুত্ব

তবে এইসকল জাহাজই হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপথের জন্যে জাহাজ (ফিশিং ট্রলার বাদে)। এগুলি জাহাজে কর্মসংস্থান হতে কাউকে সমুদ্রের সাথে অভ্যস্ত হতে হয় না। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ছিল ২৪টি। ওই বছর দেশে সমুদ্রগামী জাহাজ নিবন্ধন সহজ করা হয় এবং শুল্ক কমানো হয়।এর ফলশ্রুতিতে চার বছরে নতুন যুক্ত হয় ৪৭টি জাহাজ। কিন্তু বিশ্বমন্দায় পড়ে জাহাজ মালিকেরা তাদের জাহাজগুলি স্ক্র্যাপ করে ফেলতে থাকেন। যেখানে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮-এ, সেটা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি কমে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৩৮-এ; এবং সামনের দিনগুলিতে সেটা আরও কমতে যাচ্ছে। সরকারী বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ এখন মাত্র ৫টি, যা ’৯০-এর আগে ছিল ৩৮টি! ২০১২ সালে যেখানে দেশী জাহাজে নাবিক এবং অফিসার ছিল ১,৬০০, সেটা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি মাত্র ৮০০-তে এসে ঠেকেছে।২০১৪ সালের এক হিসাব অনুযায়ী দেশে ৮৫০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাবিক ও অফিসার বেকার রয়েছে। নৌ একাডেমিগুলা প্রতিবছরই আরও নাবিক প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। সরকারী এবং বেসরকারী প্রায় সব জাহাজই অনেক পুরোনো। পুরোনো জাহাজ পশ্চিমা দেশগুলির বন্দরগুলিতে ভিড়তে পারেনা; তাই এই জাহাজগুলি শুধু এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু দেশগুলিতেই যেতে পারে। আর পুরোনো বিধায় জাহাজগুলির মেইনটেন্যান্স খরচ বেশি, যা কিনা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে কঠিন। এরই মধ্যে বিশ্বমন্দার কারণে শিপিং কোম্পানিগুলির লোকসান আরও বেড়ে যায়। এসব জাহাজের প্রায় সবই বাল্ক কার্গো ক্যারিয়ার; কনটেইনার জাহাজ একটাও নেই। অর্থাৎ প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দর যে ১৬ লক্ষ টিইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে, তার পুরোটাই বিদেশী জাহাজে পরিবহণ করা হয়। বিদেশী জাহাজের শিপিং চার্জ ব্যয়বাবদ বাংলদেশ প্রতিবছর ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, যা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারের সামনে সিদ্ধান্ত – বাংলাদেশ কি সব সামুদ্রিক বাণিজ্য জাহাজ হারাবে, নাকি এই নৌবহরকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে? সরকার সবকিছুতে টাকা-পয়সার লাভ-লোকসানের হিসাব করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, সরকার লাভ-লোকসান চিন্তা করলে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য চিন্তা থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেবার কথা; কৃষিতে ভর্তুকি দেবার চিন্তাও সরকার করতো না কখনো। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার শুধু টাকার চিন্তা করবে কেন? ম্যারিটাইম দেশ গড়াটা বাংলাদেশের মানুষের জন্যে সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট। এখানে সরকার যদি মানুষিকে ঠিকমতো পথপ্রদর্শন না করে, তাহলে দেশের বিপদ আসন্ন। আর ম্যারিটাইম দেশ গড়ার পেছনে একটা বিশাল অবদান থাকবে এই বাণিজ্যিক নৌবহর বা মার্চেন্ট নেভির। বঙ্গোপসাগরে যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ জিওপলিটিক্যাল ঘটনা বাংলাদেশের বিরূদ্ধে যায়, তাহলে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ উড়ানো মার্চেন্ট জাহাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ সরকার বিপদের সময়ে অন্য কোন দেশ, সংস্থা বা মানুষের উপরে নির্ভর করতে পারে না, যেখানে এই বাণিজ্যপথের সাথে দেশের মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। এধরনের একটা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় সরকার উপেক্ষা করতে পারে না কোনভাবেই।
https://en.wikipedia.org/wiki/SS_Canberra
ফকল্যান্ড যুদ্ধ। সিভিলিয়ান লাইনার 'ক্যানবেরা'-কে এসকর্ট করছে রয়্যাল নেভির ফ্রিগেট 'এন্ড্রোমিডা'। ক্যানবেরা ৩,০০০ সৈন্য পরিবহণ করে ফকল্যান্ডে নিয়ে যায়। একটা দেশের জাতীয় নিরাপত্তায় বেসামরিক জাহাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এটি।

বেসামরিক জাহাজ এবং জাতীয় নিরাপত্তা

১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনের নৌবাহিনীর কাছে সৈন্য পরিবহণের জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক জাহাজ ছিল না। তখন তারা ‘কুইন এলিজাবেথ-২’ নামের একটা যাত্রীবাহী ক্রুজ লাইনার ব্যবহার করে ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ৩,০০০ সৈন্যকে পরিবহণ করতে। এই উদাহরণ যদি একমাত্র উদাহরণ হতো তাহলেও হতো। আসলে বেসামরিক জাহাজ ব্যবহার করে সামরিক সরঞ্জাম এমনকি সৈন্য পরিবহণের ঘটনা বহু রয়েছে। আর শুধু সামরিকই বা কেন? একটা দেশকে সমুদ্র অবরোধের মধ্যে ফেললে সেই জনগোষ্ঠী যদি না খেয়ে মারা যেতে থাকে, সেটা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় বৈকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশরা আশংকাজনকভাবে জার্মান সাবমেরিনের কাছে তাদের বাণিজ্য জাহাজগুলি হারাতে থাকে। যে হারে জাহাজ বানানো যাচ্ছিল, তার চাইতে আরও বেশি গতিতে জাহাজ চলে যাচ্ছিল আটলান্টিকের নিচে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভর্তি হয়ে আসা এই জাহাজগুলি কোন রকমে ব্রিটেনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। জার্মান সাবমেরিনগুলি ব্রিটেনকে না খাইয়ে মারার চেষ্টায় ছিল; সামরিক-বেসামরিকের কোন বাছ-বিচার ছিল না সেখানে। যুদ্ধের সময়ে এই বাছ বিচার নিয়ে সর্বদাই সমস্যা হয়। বাণিজ্যিক অবরোধের কথা বললে কোন পণ্য বেসামরিক আর কোনটা সামরিক সেটাও তো আলাদা করা সম্ভব হয় না। একই পণ্যের সামরিক এবং বেসামরিক ব্যবহার থাকতে পারে। আবার বেসামরিক পণ্যের মাঝে সামরিক পণ্যও থাকতে পারে। এসব বিষয় চিন্তাতে আনার অর্থই হচ্ছে - বাণিজ্যিক অবরোধে আসলে কেউই পার পায় না। নিজেদের দেশের উপরে অন্য কোন বহিঃশক্তি বাণিজ্যিক অবরোধ দিয়ে দয়া দাক্ষিণ্য দেখাবে – এটা চিন্তা করাটা যতটা অবান্তর, ঠিক তেমনিভাবে বাণিজ্যিক অবরোধে পরার ভয়ে দেশের জাতীয় সত্তা বিকিয়ে দিয়ে বহিঃশক্তিকে তোয়াক করাটাও দেশদ্রোহিতার শামিল। পশ্চিমা দেশগুলি আর যাই হোক এসব বাস্তবতা পার হয়ে এসেছে। তাদের তাত্ত্বিক চিন্তা তাদেরকে অনেক গভীরে নিয়েছে। গভীর থেকে চিন্তা করার ফলেই তাদের জাতীয় নীতি সকল ক্ষেত্রে একই পথ অনুসরণ করেছে। অপরদিকে এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলি পশ্চিমাদের অধীনে থাকার ফলে চিন্তাগত দিক থেকে কোন গভীরতাতেই পৌঁছাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রীতি, পার্শ্ববর্তী দেশের চোখ-রাঙ্গানি, পরাশক্তির-সমর্থিত সাহায্য সংস্থার বৈরি আচরণ ইত্যাদি কথা চিন্তা করে এই দেশগুলি জাতীয় স্বার্থকে জ্বলাঞ্জলি দিয়েছে সময়ে সময়ে।


সান ফ্রান্সিস্কো-এর কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'ন্যাশনাল ডিফেন্স রিজার্ভ ফ্লীট'এর একাংশ। পুরোনো এই জাহাজগুলি রেখে দেওয়া হয় বছরের পর বছর - যদি কখনো কাজে লেগে যায়।


ওল্ড ইজ গোল্ড

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশরা চিন্তা করে শুধুমাত্র একটা ডিজাইনের জাহাজ বানানোর, কিন্তু তাদের শিপইয়ার্ডগুলি তখন প্রচন্ড চাপের মুখে। তাই মার্কিনীরা এই জাহাজগুলি বানাবার দায়িত্ব নিল। ১৮টা আমেরিকান শিপইয়ার্ড ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মোট ২,৭১০টা জাহাজ তৈরি করে, যেগুলি ‘লিবার্টি শিপ’ নামে পরিচিত ছিল। ১০,০০০ টন ক্যাপাসিটির এই জাহাজগুলি ১৩৪ মিটার লম্বা ছিল। এসময় বিশাল জাহাজ তৈরি করাটা তেমন সমীচিন ছিল না; কারণ যুদ্ধের মাঝে ডুবে গেলে বড় জাহাজের ক্ষতি পুষানো বেশি কঠিন ছিল। এই জাহাজগুলি তৈরিতে ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে মার্কিনীরা। প্রথম জাহাজটা তৈরি করতে ২৩০ দিন লাগলেও পরবর্তীতে গড় সময় নেমে এসেছিল মাত্র ৪২ দিনে! অর্থাৎ প্রতি ৪২ দিনে একটি করে নতুন জাহাজ তারা ডেলিভারি দিয়েছিল। পাবলিসিটি করার জন্যে একটা জাহাজ মাত্র ৪ দিন ১৫ ঘন্টায় পানিতে ছাড়া হয়েছিল! লিবার্টি শিপ-এর একটু ইম্প্রুভড ভার্সনের ৫৩৪ খানা ‘ভিক্টোরি শিপ’-ও তৈরি করা হয়েছিল ১৯৪৪-৪৫ সালের মাঝেই। এই ধরনের জাহাজগুলি প্রধানত মালামাল পরিবহণ করলেও বেশকিছু জাহাজ সৈন্য পরিবহণেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরে কয়েক হাজার জাহাজ পুরোপুরি বেকার হয়ে যায়। কিছু কিছু জাহাজ নৌবাহিনী বিভিন্ন টেকনিক্যাল কাজে ব্যবহার করেছিল। ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত মার্কিন সরকার ৫০০ জাহাজ স্টোর করে রাখে। এই জাহাজগুলিকে এমনভাবে রেখে দেওয়া হয় যেন সর্বনিম্ন ক্ষয়ের মধ্যে এই জাহাজগুলি অনেকদিন টিকে থাকতে পারে। ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স রিজার্ভ ফ্লীট’ নামে এই নৌবহরে বেশিরভাগ জাহাজই ছিল বাণিজ্যিক জাহাজ। যদি ভবিষ্যতে কোন ইমার্জেন্সি কাজে দরকার লাগে – এই কথা ভেবে এগুলিকে রেখে দেওয়া হতো। কোরিয়ার যুদ্ধের সময়ে ৫৪০টা জাহাজ কাজে লাগানো হয়েছিল। ১৯৫১-৫৩ সালে কয়লা এবং খাদ্যশস্য পরিবহণের জন্যে ৬০০ জাহাজ ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৪-এর মাঝে ৬০০ জাহাজ ব্যবহার করা হয়েছিল খাদ্যশস্যের ভাসমান মজুদ হিসেবে। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে গেলে ২৫২টা জাহাজ ব্যবহার করা হয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে ব্যবহার করা হয়েছিল ১৭২টা জাহাজ। তবে ১৯৫০ সালে এই ফ্লীটে ২,২৭৭টা জাহাজ থাকলেও ২০০৭ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ২৩০-এ নেমে আসে। এই পুরোনো ‘অদরকারি’ জাহজগুলি রেখে দেওয়ার অর্থ মার্কিন সরকার চিন্তা করতে পারতো বলেই অনেক অর্থ খরচ করে হলেও জাহাজগুলিকে রিজার্ভে রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ধনী দেশ বলে এটা পেরেছে – এটা অনেকেই বলবেন। কিন্তু আসল কথা তো শুধু সেখানে নয়; তারা যে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোথাও ছাড় দেয়নি, এটা তার প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ। তারা তাদের অনেক জাহাজই বহু বছর রেখে দিয়েছে – অর্ধশত বছর পেরিয়েও – আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেনি।

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার চিন্তায় বাণিজ্যিক জাহাজের বহর এবং পুরোনো জাহাজের বহর আসা উচিত। অভ্যন্তরীণ জাহাজ তৈরি দেশের জাহাজ শিল্পকে এগিয়ে নেবে, কিন্তু দেশকে ম্যারিটাইম দেশে রূপ দিতে হলে সমুদ্রগামী জাহাজের বহরের বিকল্প নেই। দেশের শিপইয়ার্ডগুলি এখন সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরিতে যথেষ্ট পারঙ্গম। এটাই সময় সরকারের নীতি নিয়ে ভাবনার। আলফ্রেড মাহান যে পথের কথা বলেছেন, সে পথে অনেক কাঁটা থাকবে। শক্ত নেতৃত্ব না হলে দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য সবল নীতি নির্ধারণ করা সম্ভবপর হবে না।

Tuesday 25 August 2015

আলফ্রেড মাহান এবং বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ

২৫শে অগাস্ট ২০১৫


বিখ্যাত মার্কিন জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট এবং জিওপলিটিশিয়ান আলফ্রেড থেয়ার মাহান (Alfred Thayer Mahan, 1840-1914) আজকাল আবার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে তার থিওরিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিবর্তন করেছিল। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট (Theodore Roosevelt, 1858-1919; president 1901-1909) দেশের স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করেছিলেন। তখন থেকেই আমেরিকা হয়ে উঠতে থাকে একটা বিশ্বশক্তি বা গ্লোবাল পাওয়ার। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে পাল্লা দিয়ে সমুদ্রে টিকে থাকার মাঝেই যে আমেরিকার ভবিষ্যত শক্তি নিহিত, সেটা মাহান-ই প্রথম বলেন। যদিও মাহানের থিওরি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্ম দিয়েছিল এবং সেজন্য তিনি বেশ সমালোচিত ছিলেন কিছু মহলে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মাহানের দেখিয়ে দেয়া পথ অনুসরণ করেই আমেরিকা দুনিয়ার রাজা বনেছে; যদিও সেটাতে সময় লেগেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো একটা যুদ্ধকে সংগঠিত হতে হয়েছে। যাই হোক, এখনকার দুনিয়াতে অনেক দেশ সমুদ্রের দিকে ঝুঁকছে বলেই এখন ২১শতকে এসে আবারও মাহানের কথাই মনে করতে হচ্ছে।
মাহান ভূরাজনীতির প্রথম দিককার চিন্তাবিদ। শীতল যুদ্ধের সময় সবাই তাকে ভুলে গেলেও নপুন বাস্তবতায় তার নাম আবারো উচ্চারিত হচ্ছে।


মাহানের পূণরুত্থান

মাহান নৌ-শক্তির সাথে অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি এবং সর্বোপরি ভৌগোলিক সত্যগুলিকে একত্রিত করেছিলেন। তারই সমসাময়িক ব্রিটিশ জিওপলিটিশিয়ান হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার (Halford Mackinder, 1861-1947) এবং এদের কিছু পরের ডাচ বংশোদ্ভূত মার্কিন চিন্তাবিদ নিকোলাস স্পাইকম্যান (Nocholas J. Spykman, 1893-1943) জিওপলিটিক্স নামে নতুন এক ক্ষেত্রের জন্ম দেন। এদেরকে অনুসরণ করে আরও অনেকেই চিন্তায় অগ্রসর হয়েছেন। এসব চিন্তাবিদদের বেশিরভাগই পশ্চিমা দেশের। অপশ্চিমা দেশগুলিতে এরকম জিওপলিটিক্স নিয়ে চিন্তা করতে পারার মতো মানুষ তেমন একটা নেই, তবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। কয়েকশ’ বছর পশ্চিমা শাসনে বিশ্ব শাসিত হবার ফলে চিন্তার ক্ষেত্রেও এরকম মেরুকরণ হয়েছে। তবে গত দুই-তিন দশকে অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে অগ্রগতি হবার কারণে অনেক দেশ বিশ্ব রাজনীতিতে এগিয়ে এসেছে। ঠিক যেভাবে মাহান শতবর্ষ আগে মার্কিন নেতৃত্বকে বলেছিলেন যে বিশ্ব-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের মাঝেই মার্কিন বিশ্ব-নেতৃত্ব নিহিত, ঠিক একই পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। মাহান বলেছিলেন যে বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের মাঝেই একটা দেশ উঠবে এবং একই সাথে তার নৌ-শক্তির বিকাশ ঘটবে, যা কিনা বিশ্বব্যাপী তার শক্তিকে ধরে রাখতে সাহায্য করবে। মাহানের থিওরির কারণে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের মাঝে ব্যাপক বাণিজ্য এবং নৌ-প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা কিনা দু’টি বিশ্বযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কয়েক দশক ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মাহানের থিওরি সবাই ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রের পতনের পরে পুঁজিবাদের ব্যাপক প্রসারের কারণে এখন আবার সেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

ইউরোপ থেকে এশিয়া

পশ্চিমা বিশ্ব তাদের ঔপনিবেশিকতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশকেই করেছে বিশ্ববাণিজ্য-নির্ভর। যেসময় ইউরোপের মানুষ বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল, সেসময় যুদ্ধের কারণে বাণিজ্যের ক্ষতি হলে না খেয়ে থাকার অবস্থা হতো তাদের, ঠিক যেমনটা ডাচদের ক্ষেত্রে হয়েছিল ইংল্যান্ডের সাথে আঠারো মাস যুদ্ধের পরে (১৬৫৩-৫৪)। ঔপনিবেশিক যুগের আগে এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ বহিঃবাণিজ্যের উপরে তেমন একটা নির্ভরশীল ছিল না; অন্তঃত বাণিজ্য বন্ধ হলে না খেয়ে থাকার অবস্থা ছিল না। ইউরোপিয়ানরা এসে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আজ এশিয়াতে বিশ্বের বিরাট এক জনগোষ্ঠীর বসবাসের কারণে দুনিয়ার বেশিরভাগ উতপাদন আবারও এশিয়াতে ফেরত এসেছে। তবে এবার এই উতপাদন এসেছে বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে। এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপে যেমন বাণিজ্য রক্ষার কাজকে জীবন রক্ষার সম-গুরুত্ব দেওয়া হতো, ঠিক একই অবস্থা এখন এশিয়াতে বিরাজ করতে যাচ্ছে। গত দুই-তিন দশকে এশিয়ার অনেক দেশের কাছে এই উতপাদন-রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যের কারণে বিপুল সম্পদ এসে পড়েছে। এই সম্পদ যেমন তাদের অর্থনীতিকে করেছে বেগবান, একইসাথে তাদের সমাজকে করেছে শিক্ষিত। এই অর্থ এবং শিক্ষা জন্ম দিয়েছে এক জাতীয়তাবাদের, যা কিনা তাদের বেঁচে থাকার জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বহিঃবাণিজ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই উদ্বিগ্নতা বা অস্থিরতা তাদেরকে জাতীয় নিরাপত্তার দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করছে। বাণিজ্যের বাজার, কাঁচামালের উতস এবং বাণিজ্যপথগুলিকে নিরাপদ রাখতে সবাই নৌ-শক্তিবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করছে। পূর্ব চীন সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর অঞ্চল পার হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এই অবস্থাই বিরাজ করছে। ছোট ছোট অনেক দেশের হাতে এখন বেশ ক্ষমতা, তবে তারা সবাই ছোট ছোট দেশে বিভক্ত এবং রাজনৈতিক হিংসার কারণে এদের একত্রে কাজ করার সম্ভাবনা খুবই কম; তাই শক্তিধর দেশগুলি এটা ভেবে চিন্তিত নয়; বরং এক দেশকে অপরের বিরূদ্ধে লাগিয়ে রাখাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। আর এরকম আঞ্চলিক সমস্যা বৃহত শক্তিগুলিকে নাক গলানোর সুযোগ দেবে। তবে এরকম আঞ্চলিক সমস্যার সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেলে আবার সেটা শক্তিধর দেশগুলির পক্ষেও ম্যানেজ করাটা কঠিন হয়ে যাবে, যেমনটি হয়েছে আমেরিকার ক্ষেত্রে ইরাক, আফগানিস্তান-সহ আরও বিভিন্নস্থানে একযোগে জড়িয়ে গিয়ে।

মাহানের থিওরি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে নৌ-শক্তির সম্পর্ক নিয়ে। ভারত মহাসাগরে নিজেদের বাণিজ্যের নিরাপত্তায় চীনের আবির্ভাব অনেক হিসেবই পালটে দিয়েছে।

চীন – পূর্ব থেকে পশ্চিমে


পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং ভারত মহাসাগর অবশ্য অন্য হিসেবে পড়েছে। এখানে চীনকে একপেশে করার জন্যে অনেকেই সাধারণ (কমন) কারণ খুঁজে পেয়েছে। তবে একটি চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে সকলের চিন্তাতেই নিজেদের বহিঃবাণিজ্য সবচাইতে বড় স্থান অধিকার করে রয়েছে। মাহানীয় থিওরিতে চীনের উত্থানকে ব্যাখ্যা করা যায় – চীনের স্থলসীমানা আজ আর বিপদসংকুল নয়, তাই চীন সমুদ্রে পাল তুলতে পারছে সহজেই। চীনের বাণিজ্যিক এবং নৌ-শক্তির উত্থানের কারণে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধি করছে। এই অবস্থাটাই উপচে পড়ে (ওভারফ্লো) ভারত মহাসাগরে এসে হাজির হয়েছে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বহুদিনের সামরিক সরবরাহকারী চীন; আর পাকিস্তান এবং শ্রীলংকায় ডীপ-সী পোর্ট তৈরি করেছে চীন। এসব ব্যাপার ভারতের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করতে মিয়ানমারের উপকূলে চীন তেলবাহী জাহাজের জন্যে ডীপ-সী পোর্ট করেছে এবং সেই পোর্টের সাথে চীনের ভূখন্ড পর্যন্ত তেলের পাইপলাইন করেছে গ্যাস পাইপলাইনের পাশাপাশি। ঠিক একইভাবে পাকিস্তানে গোয়াদর পোর্ট থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত ইকনমিক করিডোর করা হচ্ছে বিশাল এক প্রজেক্টের মাধ্যমে। মিয়ানমারের পাইপলাইন এবং পাকিস্তানের ইকনমিক করিডোর সাফল্য পাবে যদি বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে চীনা বাণিজ্য জাহাজ ভিড়তে পারে কোন সমস্যা ছাড়াই। কিন্তু এই নিষ্কন্টক ভ্রমণের নিশ্চয়তা তো চীনকে কেউ দেয়নি। কাজেই ভারত মহাসাগরে চীনা যুদ্ধজাহাজ দেখা যাবে – এটা ধরেই নেয়া যায়। একইসাথে চীন চাইবে ভারত মহাসাগরে তার বন্ধুরাষ্ট্র তৈরি করতে, যাদের সাথে চীন শুধু বাণিজ্যই করবে না, তার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলি দেখভাল করবে। পূর্ব চীন সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে বেশ কয়েকটি দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে সরাসরি বিরোধ থাকলেও হিমালয় পর্বতের কারণে ভারত মহাসাগরের দেশগুলির সাথে তাদের ততটা বিরোধ নেই, শুধু ভারত ছাড়া। যদিও মিয়ানমারের সাথে সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটা বিবাদ রয়েছে, সেটা ভারতের সাথে চীনের বিরোধের কাছে নস্যি। চীনের প্রতিটি পদক্ষেপ ভারত বিরোধিতা করার চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে্র ডীপ-সী পোর্ট প্রজেক্টে চীনের আগ্রহ ঠিক একইভাবে ভারতের কাছে বিপজ্জনক ঠেকবে। এমনকি ভারতের আশেপাশের দেশে চীনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ভারতের কাছে হুমকিস্বরূপ দেখা যাওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ এতে ভারত শুধু তার পণ্যের বাজারই হারাবে না, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারাবে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভারতের অখন্ডতার জন্যেও সেটা হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দিতে পারে। যেহেতু এটা জানা কথা যে সৃষ্টির পর থেকেই ভারতের অখন্ডতা বজায় রাখার চিন্তা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার চিন্তাকে আগলে রেখেছে, চীনের এরকম ‘এগ্রেসিভ এপ্রোচ’ ভারতের কাছে তাই ভয়ঙ্কর হিসেবে দেখা দেবে। ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দেশ নিজেদের সমুদ্র-বাণিজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিলে সেটাও ভারতের কাছে সন্দেহের উদ্রেক করবে। একজনের বাণিজ্যের নিরাপত্তা আরেকজনের বাণিজ্যের প্রতি হুমকি।

মধ্যপ্রাচ্য একাধারে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্যান্য দেশের জন্যে জ্বালানী তেলের প্রধান উতস হওয়াতে ভারত মহাসাগরে চীনের যুদ্ধজাহাজের আনাগোনা বাড়ার সাথেসাথে জাপান এবং কোরিয়ার নৌবাহিনীকেও দেখা যাবে শিগগিরই। আপাতত জাপান বঙ্গোপসাগরে ‘বিগ-বি’ প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এই প্রজেক্টের পিছনে পিছনে জাপানী নৌবাহিনীও ভারত মহাসাগরে আসবে। মাহানের থিওরি এখানে একেবারে চমতকারভাবে ফলতে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি এরকম নৌশক্তির জন্ম দেবে - এটা আলফ্রেড মাহান চিন্তা করতে পেরেছিলেন বলেই তার থিওরি এখন আবার নতুন করে অনেকেই পড়া শুরু করেছেন।

প্রবাহ না দেখলে ভারতীয় উপমহাদেশে আসল শক্তির উতস যেমন নিরূপণ করা যাবে না, ঠিক তেমনি বর্তমান ভারতের কৌশলগত শক্তি বা এর দুর্বলতাও সঠিকভাবে হিসেব করা যাবে না।

 ভারত – দুর্বল রাষ্ট্র?

ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিকে আলাদাভাবে দেখলে যে বিষয়গুলি চোখে পড়বে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলের বৈচিত্র্য। এই উপকূলের সবচাইতে বড় স্থান জুড়ে রয়েছে ভারত। তবে উলটা ত্রিভুজ আকৃতির হবার কারণে ভারতের নৌবহরকে প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করতে হচ্ছে। কাজেই বিশাল শক্তিধর নৌবাহিনী হওয়া সত্তেও ভারতের নৌবহর প্রকৃতপক্ষে আলাদা দু’টি ফ্লীট হিসেবে অপারেট করবে; এদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। এই অবস্থান ভারতের নৌবাহিনীর জন্যে বিরাট দুর্বল একটা দিক। আবার তাদের উপকূলের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে কোলকাতা ছাড়া বাকি বন্দরগুলি নদীপথে দেশের গভীরের সাথে সংযুক্ত নয়। এটা একদিকে যেমন অধিকতর ব্যয়বহুল রেলপথ এবং স্থলপথের উপরে ভারতকে নির্ভরশীল হতে বাধ্য কাছে, তেমনি আবার নদীপথের মুখের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব থেকে তাদের মুক্ত করেছে। বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দরগুলি নদীর মুখে না হবার কারণে ভারত অভ্যন্তরীণ পরিবহণের আসল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অবশ্য এই ভৌগোলিক নিয়তি ভারতীয় উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা-সহ অন্যান্য নদীগুলির সঙ্গমস্থল বাংলাতে হবার কারণে বাংলা ছিল ভারতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। উর্বর ভূমি, খণিজ সম্পদ, বিশাল নদীর অববাহিকা, বৃষ্টির প্রাচুর্য্য এবং নদীগুলির সঙ্গমস্থলে সুমদ্রবন্দর থাকায় বাংলা ছিল বিদেশী শক্তির কাছে সবচাইতে লোভনীয় টার্গেট। মাহান নদী অববাহিকার মুখে বন্দরের গুরুত্ব আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন। মিসিসিপি নদী, হাডসন নদী, পটোম্যাক নদী এবং সেন্ট লরেন্স নদীর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বকে তিনি হাইলাইট করেছেন। ঠিক একইভাবে ব্রিটিশরা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার সঙ্গমস্থলে সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব ধরতে পেরেছিল। যেকারণেই তারা বাংলাতে এসে কলকাতা বন্দর তৈরি করেছিল, যা কিনা ওই নদীগুলির সঙ্গমস্থল থেকে অনেক পশ্চিমে, অর্থাৎ নদীগুলির প্রাকৃতিক প্রবাহের একেবারে উল্টোদিকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যখন বাংলার কর্তিত্ব নিয়ে নেয়, তখন এই কৃত্রিম স্থানেই ভারতের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং প্রধান শহর স্থাপন করে। কোলকাতায় প্রধান সমুদ্রবন্দর স্থাপনের কারণে বাংলার পূর্বাঞ্চল থেকে পণ্য উল্টাদিকে নদীপথে পাঠাতে হতো কলকাতায়। পূর্বাঞ্চলেই চাল, পাট, চা-সহ বেশিরভাগ পণ্য উতপাদিত হতো। ব্রিটিশরা কোলকাতায় প্রধান শহর করার কারণে কোলকাতায় সকল কারখানা গড়ে উঠলো, যেগুলি বাংলার পূর্বাংশের উপরে নির্ভরশীল ছিল। আবার বাংলার পূর্বাংশে সকল নদী থাকার কারণে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ-নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশরা এই শিল্পের বারোটা বাজিয়ে কোলকাতায় জাহাজ-নির্মাণ শিল্প করে, যেখানে মানুষের জীবনধারণের জন্যে জাহাজ নির্মাণ করাটা জরুরি নয়। এই ইতিহাসগুলির ফলশ্রুতিতে যা দাঁড়ালো তা হলো, যখন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা দেশ বিভাগ করলো, তখন ভারত কোলকাতার পশ্চাদভূমির বেশিভাগ হারালো পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ)-এর কাছে। আসামের বিশাল এক ভূমি (বর্তমানে সাতটি রাজ্য) কোলকাতা থেকে আলাদ হয়ে গেলো ব্রহ্মপুত্র নদ এবং গঙ্গা নদীকে কেটে ফেলার জন্যে। বিহার এবং উড়িষ্যাকেও বাংলা থেকে আলাদা করা হলেও সেগুলি অবশ্য ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকলো। ব্রিটিশদের এই বিভাজন ভারতকে জন্ম থেকে দুর্বল করেছে। পশ্চাদভূমি ছাড়া আধা-গুরুত্বের কোলকাতা বন্দর পায় ভারত এবং তিনটি প্রধান নদীর সঙ্গমস্থল সমুদ্রবন্দর-সহ হারায় ভারত। ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল যে ভারতীয় উপমহাদেশের মূল শক্তি হচ্ছে বাংলা। তাই বাংলাকেই তারা প্রায় দু’শ বছর তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্ত্রভূমি করেছিল। বাকি অঞ্চল ছিল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাকে একটা অঞ্চল হিসেবে না রাখার ক্ষেত্রে তারা ছিল বদ্ধ পরিকর। ভারত এবং পাকিস্তান গঠনের চাইতে বাংলাকে কয়েক ভাগ করে দুই দেশের মাঝে বিতরণ করাটা বৃটিশদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাই বিপ্লব সহ উপমহাদেশের বেশিরভাগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বাংলাতেই সংগঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা বঙ্গোপসাগরে একটা শক্তিশালী দেশ রেখে যাবার পক্ষপাতি ছিল না; বরং এমন একটা ভারতের পক্ষপাতি ছিল যার কিনা আকারে বিশাল হলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উঠতে অনেক কষ্ট করতে হতো। বহুজাতিক এক রাষ্ট্র ভারত নিজেকে সামাল দিতেই ব্যস্ত থাকবে চিরকাল। আর এরকম একটা উদ্ভট রাজনৈতিক ম্যাপ ভারতের নেতৃবৃন্দকে সারাজীবন ভারতের অখন্ডতা বজায় রাখার চিন্তায় (যেখানে বাংলা নিয়ে চিন্তা থাকবে সবার উপরে) মশগুল রাখবে এবং তাদেরকে পশ্চিমা শক্তির কথায় চলতে বাধ্য করবে। বহু বছর আগে থেকেই চীনারা ভারতের উপরে পশ্চিমা প্রভাবের এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ভারতকে বিশ্বাস করতে ছিল অনিচ্ছুক।

ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এই বিন্যাসের ষোল কলা পূর্ণ করেছে ভারত নিজেই। অজায়গায় ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কোলকাতা বন্দর চালু রাখতে ভারত গঙ্গা নদীতে বাঁধ দিয়ে স্রষ্টার দেওয়া সবচাইতে বড় উপহারগুলির একটিকে ধর্ষণ করেছে। প্রাকৃতিক এই নদীকে কেটে ফেলে ভারত ভাটির দেশ বাংলাদেশের যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি তারা ভারতের করেছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তাতে সঠিক নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ পানির সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেয়েও যেতে পারে, কিন্তু ভারত সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলবে। অন্যান্য নদীর উপরে বাঁধ এবং নদী-সংযোগ প্রকল্পের মতো আত্মহননের চেষ্টা ভারতকে ডোবাবে। এভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করে এবং ভাটির দেশের উপরে চরম চাপ সৃষ্টি করে ভারতের পক্ষে বঙ্গোপসাগরের কর্তিত্ব রাখা কতোটা সম্ভব হবে, সেটা প্রশ্নাতীত নয়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের বিশাল লম্বা সমুদ্রতট রক্ষা করা ভারতের জন্যে বেশ কঠিনই হবে। এই লম্বা সমুদ্রতট তাদের বঙ্গোপসাগরের সামরিক শক্তিকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ফেলবে, যেটা তাদের ভবিষ্যতের যে কোন সামরিক পদক্ষেপে তাদের বিপক্ষে কাজ করবে। আলফ্রেড মাহান ১৮০৫ সালের ব্রিটিশদের সাথে নৌ-যুদ্ধে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্সের এই দুর্বলতার কথা বলেছিলেন, যেখানে ফ্রান্সের আকৃতি ভারত থেকে আরও অনেক ছোট। ভারতের সমস্যা ফ্রান্সের কয়েক গুণ হবে –এটাই স্বাভাবিক। নদী কম থাকার কারণে এই লম্বা উপকূল বরাবর কোলকাতা, বিশাখাপত্তম, চেন্নাই-সহ অনেকগুলি বন্দর রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের সাথে যোগ হয়েছে মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা থাকার কারণে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিরাপত্তা দেওয়া, যা কিনা বঙ্গোপসাগরে ভারতকে আরও বেশি দুর্বল করবে। বঙ্গোপসাগরে ভারত চিরকাল অকর্মণ্য শক্তির মোকাবিলা করবে বলে চিন্তা করে থাকলে সামনের দিনগুলিতে তাদের সামনে চমক অপেক্ষা করছে।
আরব সাগরে পাকিস্তানের সাবমেরিন ভারতের বাণিজ্যপথের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই বিপদ ভারতের বিভক্ত নৌবহরকে বেশ ব্যস্ত রাখতে পারবে।


পাকিস্তান – অল্পেই সাফল্য?

পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) জন্ম হয়েছিল এমন একটা ভূমি নিয়ে, যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী একটা নদীর (সিন্ধু নদ) মুখে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর (করাচী) তারা পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান এই নদী এবং বন্দরের পুরো সদ্যবহার করতে পারেনি। এটার কারণ হিসেবে ভারতের সাথে পাকিস্তানের বিশাল ভূমি-সীমান্তের কথা বলা যায়। এতবড় ভূমিকে নিরাপত্তা দিতে পাকিস্তানের নেতৃত্বের দৃষ্টি চলে যায় ভূমির দিকে। মাত্র কিছুদিন আগে, ২০১১ সালে, পাকিস্তান সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ নদীপথ উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করে। পাকিস্তানের ৯৬% পণ্য পরিবহণ হয় স্থলপথে; বাকি ৪% রেলপথে। এর অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তান নিজেদেরকে ম্যারিটাইম শক্তি হিসেবে তৈরি করার চেষ্টাই করেনি কখনো। মাহান বলেছিলেন যে ইউরোপিয়ান ভূমির অংশ হবার কারণে ফ্রান্স নৌশক্তিতে ঠিকমতো উন্নতি করতে পারেনি; যেটা ব্রিটেন পেরেছিল দ্বীপ দেশ হবার কারণে। পাকিস্তানও ফ্রান্সের মতো তার জাতীয় শক্তির বেশিরভাগটা খরচ করবে স্থলশক্তি তৈরি করতে; অর্থাৎ পাকিস্তানের স্থলসীমানার আশেপাশের এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারার চাইতে খুব বেশি ক্ষমতা থাকছে না। এরপরেও পাকিস্তান তাদের নৌবাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা কিনা আরব সাগরে পাকিস্তানের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের যোগাযোগ অটুট রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। আর একইসাথে ভারতের নৌবহর দুই সাগরের মাঝে ভাগ হয়ে যাবার কারণে আরব সাগরে পাকিস্তান কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকবে। স্থলভাগে দৃষ্টি থাকার কারণে পাকিস্তান গভীর সমুদ্রে যাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ না করে আরব সাগরে নিজেদের বাণিজ্য রক্ষা করা এবং দরকারে আক্রমণাত্মক কাজের মাধ্যমে ভারতের আরব সাগরের বাণিজ্য ব্যাহত করবে। এক্ষেত্রে ভারত অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে থাকবে, কারণ মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতের ঠিক মাঝখানে পাকিস্তানের অবস্থান। ম্যারিটাইম শক্তি না হয়েই পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারতের যথেষ্ট ক্ষতি করা সম্ভব। আরব সাগরের বাণিজ্য রক্ষা করতে ভারতের নৌবহরের বেশিরভাগটাই লাগবে; অথচ তারা তাদের পূর্বের সমুদ্র উপকূলও খালি রাখতে পারছে না। চীন পুরো ভারত মহাসাগরে নৌশক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে ভারতকে যতটা না সমস্যায় ফেলতে পারবে, তার চাইতে পাকিস্তানী নৌবাহিনীর আক্রমণাত্মক শক্তি বৃদ্ধি করে এর চাইতে অনেক সমস্যায় জর্জ্জরিত করতে পারবে – এটা চীনারা ভালোই বুঝেছে।

মিয়ানমার যুদ্ধজাহাজ তৈরিতে বেশ এগুচ্ছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল নীতি তাদেরকে অন্ধকারে পতিত করবে।

মিয়ানমার – উদ্দেশ্যহীন?

বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) জন্ম হয়েছে ইরাবতী নদী এবং এর দক্ষিণ প্রান্তে রেঙ্গুন (বর্তমান ইয়াংগন) সমুদ্রবন্দর নিয়ে। একইসাথে মিয়ানমার বিশাল এক উপকূল পেয়েছে। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই দেশ প্রকৃতই নদীমাতৃক; নদীভিত্তিক পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই চমতকার। তবে মিয়ানমারের বিশাল উপকূলের নিরাপত্তা দেওয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন সামরিক জান্তার অধীনে থাকার কারণে মিয়ানমার বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়নি একেবারেই। কিন্তু একইসাথে শক্তিশালী একটা দেশ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ভৌগোলিক অখন্ডতা ঠিক রাখতে নিজেদের নাগরিকদের মেরে শেষ করেছে; দেশকে করেছে দুর্বল। মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়েছে তার প্রতিবেশী চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড। মিয়ানমার ১৯৯০ সাল থেকে তার নৌবাহিনী তৈরির কাজে হাত দিয়েছে; নিজেরাই যুদ্ধজাহাজ বানাচ্ছে তারা। আপাতঃদৃষ্টিতে এই নৌবহর তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, কারণ তাদের সাথে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিয়ে একটা দীর্ঘমেয়াদী সাম্প্রদায়িক সমস্যা রয়েছে। মিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়বাদীরা খুবই শক্তিশালী, যা কিনা মিয়ানমারকে ভেতর থেকে দুর্বল রাখবে। কিন্তু যেহেতু মিয়ানমার সরকার দেশকে ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে তৈরির কোন চেষ্টাই কখনো করেনি, তাই তাদের এই জাহাজ নির্মাণ অন্তসারশূণ্যই মনে হয় আপাতঃদৃষ্টিতে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে না পারার কারণেই মিয়ানমার হয়তো এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেহেতু এই নীতি প্রতিক্রিয়াশীল, তাই এটা বেশিদূর এগুবে বলে মনে করাটা সমীচীন হবে না। চীনের কাছ থেকে সাহায্য নিলেও এখন তারা ভারতের দিকে হাত বাড়িয়েছে, যা কিনা চীনের ভালো চোখে দেখার কথা নয়। মিয়ানমারে চীনের প্রচুর স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগ রয়েছে যেটা চীন রক্ষা করতে চাইবে যেকোন মূল্যে; বিশেষ করে যদি কোন কারণে চীন মালাক্কা প্রণালী ব্যবহারে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে মিয়ানমারে তৈরি ডীপ-সী পোর্ট হয়ে উঠবে চীনের রক্ষাকবচ। চীনের কাছে মিয়ানমারের এই ধরনের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণেই চীন মিয়ানমারকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রেও এই বাণিজ্যপথ রক্ষা করাটা কঠিন। কারণ এতে করে বঙ্গোপসাগরে চীনের একটা নৌবহর রাখতে হবে, যা কিনা বর্তমান বাস্তবতায় খাটে না। এমতাবস্থায় চীন বঙ্গোপসাগরে সবসময়ই যুদ্ধ এড়িয়ে চলবে।


নদীমাতৃক বাংলাদেশে জাহাজ তৈরি একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তারপরেও ম্যারিটাইম দেশ হতে এখনও কিছু পথ পেরুতে হবে


বাংলাদেশ – ফিনিক্স ফ্রম দ্যা এশেজ?

পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জন্ম বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে। উপরেই বলেছি যে ব্রিটিশরা গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র-কে ভাগ করতেই বেশি সচেষ্ট ছিল। বহুকাল রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জ্জরিত থাকলেও গত ১৫-২০ বছরে এদেশ অর্থনৈতিকভাবে যা অর্জন করেছে, সেটা অনেক জিওপলিটিশিয়ানকে অবাক করেছে। মাত্র এক দশক আগেও বাংলাদেশ কোন হিসাবেই ছিল না; অথচ আজ সব হিসাবেই বাংলাদেশ বিদ্যমান। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া অভাব অনটন এদেশের মানুষকে আর্থিক উন্নতির জন্যে ভুভুক্ষু করেছিল। দেশ বিভাগের সময় বেশিরভাগ কারখানা রয়ে যায় কোলকাতায়, অথচ কারখানার বেশিরভাগ কাঁচামাল আসতো বাংলাদেশ থেকে। এদেশের অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলে পাকিস্তান আমলে এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ হবার পরেও। শীতলযুদ্ধের প্রভাবে বৃহত শক্তিদের ততপরতায় বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল রক্তাক্ত; সামরিক শাসনও ছিল বহুকাল। এদেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অগ্রগতি শুরু হয় ১৯৮০-এর শেষের দিকে, যখন থেকে এদেশে তৈরি পোষাকের কারখানা স্থাপন শুরু হয়। কমদামী দর্জিগিরির কাজ হলেও এখানেই প্রকৃত বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্ভব হয় এদেশের। এই শিল্প জন্ম দেয় ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের এবং সেগুলি জন্ম দেয় আরও শিল্পের। বৈদেশিক বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে বহু পণ্যের রপ্তানি শুরু হয় পরবর্তী দশকগুলিতে। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব হয়, যারা বিভিন্ন বাণিজ্য এবং কলকারখানার হাল ধরে। ’৯০-এর দশকে কৃষিতে শুরু হয় বিপ্লব; এদেশের মাটি, আবহাওয়া এবং ব্যাপক বৃষ্টিপাত সাহায্য না করলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ হতো না, কারণ উজানে ভারত প্রায় সব নদীতে বাঁধ দিয়েছে; ব্রিটিশরা হয়তো এটা চিন্তা করেই সীমান্ত ঠিক করেছিল। ২৪,০০০ কিলোমিটার নদীপথ শুকিয়ে কমতে কমতে চার হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে আজ, কিন্তু তারপরেও এদেশের মানুষ এখনো পানির উপরে নির্ভরশীল। গুগল আর্থের ম্যাপে গেলে বোঝা যায় যে এদেশের বিরাট একটা অংশ আসলে পানিতে ভর্তি। শুধু মানুষের চিন্তা থেকে পানিকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে (কিভাবে করা হয়েছে সেটা নাহয় আরেকদিন লিখবো)। ম্যারিটাইম দেশ তৈরিতে এটা একটা বড় বাধা।

কিছুদিন আগে মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা মিটমাট করার পর থেকে ম্যারিটাইম সেক্টর বেশ গুরুত্ব পেতে শুরু করে। আলফ্রেড মাহান বলেছিলেন যে একটা দেশ ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে তার দরকার একটা বড় জনসংখ্যা (যেটা বাংলাদেশের আছে) এবং দেশের মানুষের পানির সাথে সম্পৃক্ততা (যেটা অনেকটাই কমে গেছে গত কয়েক দশকে)। একসময় দেশের জনস্ংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাওয়া গেলেও এখন এটা পরিষ্কার যে এই বিশাল জনগোষ্ঠীই এদেশের সবচাইতে বড় সম্পদ। বিশ্ব অর্থনীতি এখন দ্রুত জনবহুল দেশগুলির দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে। গত এক দশকে দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্রিটিশরা ১৭৭৮ সাল থেকে বাংলায় জাহাজ নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে; তারা জানতো যে এদেশের মানুষ জাহাজ তৈরিতে মনোনিবেশ করলে কি হতে পারে। এদেশে জাহাজ-নির্মাণ শিল্পের পিছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করেছে জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প, যেকারণে এই শিল্পের বিরূদ্ধে Subversive Activity ছিল সবচাইতে বেশি। এই শিল্প থেকে আসা স্ক্র্যাপ লোহা দিয়েই গড়ে উঠেছে দেশের কৃষি-যন্ত্র শিল্প, মেশিন শিল্প, রড তৈরি শিল্প (যা কিনা রিয়েল এস্টেটের বিকাশে বিশাল ভূমিকা রেখেছে)। রিয়েল এস্টেট জন্ম দিয়েছে সিমেন্ট শিল্পের, জন্ম দিয়েছে ইট তৈরি শিল্পের, কাঁচ শিল্পের, এলুমিনিয়াম শিল্পের, ইলেক্ট্রিক পণ্যের, পেইন্ট শিল্পের, স্যানিটারি ওয়্যার শিল্পের, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদির। এসব ইন্ডাস্ট্রির জন্যে লেগেছে জাহাজ – বালুবাহী জাহাজ, ড্রেজার, কার্গো জাহাজ, তেলবাহী জাহাজ, ইত্যাদি। কন্টেইনার জাহাজও তৈরি শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো। এই জাহাজগুলির অনেকগুলিই ব্যবহৃত হলো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে মালামাল দেশের অন্যান্য স্থানে পরিবহণে। দেশের ৯০% তেল নদীপথে পরিবাহিত হয়। কাজের জন্যে মানুষ বিভিন্ন শহরে বসবাসের কারণে নদীপথে বহু যাত্রী পরিবাহিত হয়; যাত্রীবাহী জাহাজ তৈরিও চলছে ব্যাপক হারে। এদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রায় ৩৫ হাজার নৌযান চলছে। এতকিছুর পরেও কেন ম্যারিটাইম দেশ নয়? কারণ এখন পর্যন্ত চিন্তায় সমুদ্র খুব অল্প স্থান জুড়ে রয়েছে; দেশের মানুষ পানিকে বন্ধু ভাবে না (সেটা অবশ্য তৈরি করা হয়েছে); ড্রেজিং-এর মাধ্যমে দেশের নদীপথ উন্নয়নে বাজেট থাকে না (যদিও সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে প্রচুর বিদেশী ডলার আসে); সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরিতে দেশীয় উদ্যোগতাদের তেমন আগ্রহ নেই (যদিও এদেশের জাহাজ ইউরোপে রপ্তানি হয়); সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে অথর্বের নীতি অনুসরণ (যদিও বন্দর বাণিজ্য বিরাট সাফল্য পেয়েছে); বঙ্গোপসাগরে খণিজ সম্পদ আহরণের কোন কিনারাই হলো না (যদিও ভারত ও মিয়ানমার এগিয়ে গেছে); গভীর সমুদ্রবন্দর প্রজেক্ট শম্ভুক গতিতে চলছে (জিওপলিটিক্সে আটকে গেছে); ইত্যাদি। উপরের লম্বা বর্ণনাতে ইন্ডাস্ট্রির সাথে সাথে জাহাজ-নির্মাণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের উল্লেখ করেছি, যা কিনা বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নদী এবং সমুদ্র বিষয়ে পড়াশোনা শুরু হয়েছে সবে; বঙ্গোপসাগরের জন্যে ফিশিং ট্রলার তৈরি শুরু হয়েছে দেশে; শিপিং লাইনারও চালু হতে চলেছে (যা কিনা মানুষকে সমুদ্রের ব্যাপারে আগ্রহী করবে); ইউরোপে মন্দার পরেও জাহাজ রপ্তানি শুরু হয়েছে আবার; যুদ্ধজাহাজ তৈরি শুরু হয়েছে; তিনটা নদীর পলিত উপরে নির্ভরশীল বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে দ্বীপ উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে; নৌবাহিনীর মূল্যায়ন শুরু হয়েছে অবশেষে – এগুলি সামনের দিন দেখায়। তবে দেশের সরকারের সঠিক নীতি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

বেঁচে থাকার তাগিদেই বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটবে। সমুদ্র বাণিজ্য এবং সমুদ্র সম্পদের নিরাপত্তার প্রশ্ন এই জাতিকে যতো বেশি ভাবাবে, তারা ততো বেশি বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে বের হতে চাইবে।

বঙ্গোপসাগর – বাংলাদেশের বেসিন?

বঙ্গোপসাগরের ভবিষ্যত নির্ভর করছে বাংলাদেশের মানুষের নিজেদেরকে মূল্যায়নের উপরে। ভৌগোলিক অখন্ডতার কোন প্রশ্ন এদেশের নেই; এদেশের ভূ-প্রকৃতি এবং বিশাল জনসংখ্যা যেকোন আগ্রাসী শক্তির জন্যে দুঃস্বপ্ন; ভারতের মতো সামরিক শক্তির বিভক্ত হবার সম্ভাবনাও নেই একেবারেই – এসব ব্যাপার বাংলাদশের স্থলভাগকে করবে শক্তিশালী এবং বঙ্গোপসাগর নিয়ে চিন্তায় করবে আগ্রহী। অপরদিকে ভারত তার যে অবস্থানে রয়েছে (যা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে), সেখান থেকে খুব বেশি দূরে যাবার সম্ভাবনা কম। মিয়ানমার তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের দিকে। আরব সাগরে পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের অবস্থানকে প্রভাবিত করলেও সেটা হবে পরোক্ষভাবে। বিশাল সম্পদশালী বাংলাকে চিরে ব্রিটিশদের স্বজত্নে তৈরি করা বাংলাদেশের হাতে এখনও রয়েছে বিশাল তিনটা নদী (যা ১৯৪৭ সালে সীমানা দিয়ে কেটে ফেলার পরেও এবং পরে উজানে বাঁধ দিয়ে আটকালেও বৃষ্টির পানিতে ভরা সম্ভব) এবং এর সঙ্গমস্থলে রয়েছে একাধিক সমুদ্রবন্দর। এদেশ এখন বহিঃবানিজ্যের উপরে এতটাই নির্ভরশীল যে বহিঃবাণিজ্যকে রক্ষা করাটা দেশের বাঁচা-মরার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাহান ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে ব্রিটেন এবং হল্যান্ড কিভাবে তাদের দেশের অভাবের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয় এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। দু’টা দেশই পানির দেশ হবার কারণে এদের সাথে বাংলার সবচাইতে বেশি মিল ছিল। পার্থক্য ছিল একটাই – বাংলা ছিল সমৃদ্ধশালী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ; অপরদিকে ইউরোপিয়ানরা ছিল দরিদ্র এবং বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু এ-তো ১৭৬৪ সালের আগের কথা বলছি; আজকের বাস্তবতা তো ভিন্ন। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ভুভুক্ষু বাংলাদেশ গত ১৫-২০ বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল এক দেশে পরিণত হয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদেই সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট নিয়ে এই দেশের মানুষ বঙ্গোপসাগর আবিষ্কারে বের হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এদেশের বাণিজ্যিক স্বাধীনতা পূর্ণতা না পায়, ততদিন এদেশের মানুষ বঙ্গোপসাগরে পাড়ি জমাবে এবং এই সাগর থেকে ভারত মহাসাগরে পাড়ি জমাবে। মাহানের থিওরি এখানে পুরোপুরি সফলতা পেতে চলেছে। ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণমূলক সীমারেখা এদেশে প্রায় অর্ধশত বছর সাফল্য দেখিয়েছে; কিন্তু এখন এই নিয়ন্ত্রণই একটা এগ্রেসিভ ম্যারিটাইম দেশের জন্ম দিতে চলেছে। বিশাল এক জনগোষ্ঠী যখন ছোট্ট একটা দেশে বেঁচে থাকার চাপে থাকবে, তখন তার অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছে থাকবে প্রবল। একটা জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষিত করে Subversion-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এই শিক্ষাই একসময় মানুষকে তার ঘোর থেকে জাগিয়ে তুলে – এটা মানুষের সৃষ্টিতত্বেই নিহিত, যা কিনা অনেকেই বোঝেন না।

Thursday 13 August 2015

যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা আসলে কে?

১৩ অগাস্ট ২০১৫

এই নশ্বর পৃথিবীতে এটা চিন্তা করার উপায় নেই যে কোন একটা ধারণা সারাজীবন টিকে রইবে। ইউনিভার্সাল ট্রুথ ছাড়া এই কথাটা সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিশেষভাবে প্রযোজ্য ওইসব ক্ষেত্রে যেখানে পরিবর্তন আসে বেশ দ্রুততার সাথে। আর দ্রুত পরিবর্তন সেখানেই আসে, যেখানে ধারণাটা কোন জাতির অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চীনের প্রাচীরের কথা। হল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলের বাঁধের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলি তেমন একটা দ্রুত পরিবর্তনশীল নয়। হল্যান্ডের বাঁধ তৈরির পরে সমুদ্রের ঢেউ হঠাত দু’শ ফুট উপর দিয়ে আসতে শুরু করেনি। চীনের প্রাচীরের উপর দিয়েও মোঙ্গলরা উড়ে উড়ে আসেনি (যদিও তারা প্রাচীরের দরজা পার হয়েই চীন জয় করেছিল)। আসলে কথাটা যেখানে নিতে চাচ্ছি, তা হচ্ছে যুদ্ধ। যুগে যুগে মানুষ বহিঃশত্রুকে মোকাবিলায় নতুন নতুন ধারণার আবির্ভাব ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধ-প্রযুক্তি এবং কৌশলে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই এই পরিবর্তন হতে হয়েছে দ্রুত। যারাই এব্যাপারে শম্ভুক গতিতে এগিয়েছে, তারাই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, অথবা অস্তিত্ব পুরোপুরিই হারিয়েছে। এরই মাঝে কিছু ধারণা রয়েছে যেগুলি সময়ে সময়ে পুণরুজ্জীবিত হয়েছে; ইতিহাসের হয়েছে পূণর্লিখন। এমনই কিছু ধারণা নিয়ে আজ কথা বলতে চাইছি।
সুইডিশ আর্মি বাকি দুনিয়ার বাহিনীগুলি থেকে পুরোপুরি আলাদা, কারণ তারা বরফকে মাথায় রেখেই তাদের বাহিনী তৈরি করেছে
 
পরিবর্তন আসলে কি?

একটা সেনাবাহিনীর গঠনতান্ত্রিক চিন্তাধারার মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মাঝে একটা হচ্ছে কোন ধরনের বাহিনী বা অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনী সাজাবে। এক্ষেত্রে সেই দেশের ভৌগোলিক গঠন, রাজনীতি, অর্থনীতি, জনসংখ্যা ইত্যাদি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুতপূর্ণ সে দেশের সামরিক চিন্তাবিদেরা কোন ঐতিহাসিক চিন্তাকে প্রাধাণ্য দিচ্ছেন। যেমন বিংশ শতকের যুদ্ধগুলির কথা চিন্তা করে সামর্থ্য থাকা সেনাবাহিনীগুলি হেলিকপ্টারকে স্থলযুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে চিন্তা করতে শিখেছে। এক্ষেত্রে কেউ যদি এই হেলিকপ্টারের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে যায়, তাহলে সে হয়তো শুধু হেলিকপ্টারের টাইপ পরিবর্তন বা যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের অবস্থানগত পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হবে; অর্থাৎ এই পরিবর্তন যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যাকরণে আমূল পরিবর্তন আনবে না। অন্যভাবে বললে, আমূল পরিবর্তন আনার জন্যে যতটা সাহসী চিন্তার প্রয়োজন, সেটা সবাই প্রদর্শন করবে না। তবে এখানে আরেকটি ব্যপারও গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে – সেই পরিবর্তন কতটা প্রয়োজনীয়, সেটার সঠিক অনুধাবন করতে পারা। ব্যাপক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে মনে হতে পারে যে নিজেদের সেনাবাহিনী আশেপাশের দেশের সেনাবাহিনীর তুলনায় প্রায় অন্য গ্রহে অবস্থান করছে। কিন্তু নিজেদের ধারণা যদি শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এরকম চিন্তার আবির্ভাব নাও আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সুইডেনের সেনাবাহিনীর কথা বলা যেতে পারে। তাদের পুরো সেনাবাহিনীই বরফের উপরে চলাচলের উপযোগী। এটা করতে গিয়ে সুইডেনের সমরবিদদের কঠিন পক্ষেপ নিতে হয়েছে - অন্যান্য দেশের সেনাসদস্যরা শক্তিশালী অস্ত্র বলতে যা বোঝায়, সেগুলি পুরোপুরি উপেক্ষা করতে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সুইডেন এমন একটা বাহিনী তৈরি করেছে, যা কিনা বরফের উপরে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে দুনিয়ার সেরা। তবে বরফ ছাড়া অন্য কোথাও যুদ্ধ করার তেমন একটা চিন্তা তারা করেনি, কারণ দেশের বাইরে যুদ্ধ করাটা তাদের সরকারের রাষ্ট্রনীতির মাঝে পড়ে না। অবশ্য আজকের এই আলোচনায় সুইডেনের ভৌগোলিক-চিন্তার সেনাবাহিনীকে প্রাধান্য দেয়াটা উদ্দেশ্য নয়। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে ভৌগোলিকতাকে সাধারণ ধরে বিশ্বের স্থলযুদ্ধ-কৌশল নিয়ে কথা বলা, যেখানে ঐতিহাসিক পরিবর্তনগুলি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর এই ঐতিহাসিক চিন্তার কারণেই ভৌগোলিক চিন্তা বাদ দিয়েই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রেই স্থলযুদ্ধের ধারণাগুলি হয়েছে বৈশ্বিক ইতিহাস-নির্ভর, যেটার উদাহরণ হিসেবেই উপরের হেলিকপ্টারের কথা টেনেছি। 

পরিবর্তনের ঐতিহাসিক চেইন

হেলিকপ্টারের কথাই যদি টেনে নিয়ে যাই, তাহলে দেখবো যে গত পঁচিশ বছরের ইতিহাসে স্থলযুদ্ধে ট্যাঙ্ক-ধ্বংসী হিসেবে হেলিকপ্টারের সুনাম তৈরি হয়েছে। অথচ এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই এই দায়িত্ব পালন করেছে রাশিয়ার ইল-২ এবং ইল-১০ বিমান, কারণ তখন হেলিকপ্টার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দেখলে দেখবো তেমন কোন শক্তিশালী বিমানই ছিল না; ট্যাঙ্কের আবির্ভাবই তো তেমন ভয়ঙ্করভাবে হয়নি। এসবের অর্থ হচ্ছে, মাত্র এক’শ বছরের মাঝেই যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগামীতেও যে এরকম দ্রুত পরিবর্তন অব্যহত থাকবে না, সেটা কি করে বলি? যাই হোক, যে কারণে ট্যাঙ্ক-ধ্বংসী হেলিকপ্টারের কথা আনা – ট্যাঙ্ক না থাকলে এমন হেলিকপ্টারের তো দরকারই হতো না, ঠিক কিনা? আর ট্যাঙ্ক-ধংসী হেলিকপ্টার না বানালে হেলিকপ্টার-ধ্বংসী হেলিকপ্টার বানানোর দরকারও যে হতো না! তাহলে শুরু কোথায়? ট্যাঙ্ক, ঠিক কিনা? কিন্তু ট্যাঙ্ক তৈরি হয়েছিল কেন? কারণ পরিখা থেকে কেউ বের হতে পারিছিলো না। সেটা কেন? কারণ পরিখা থেকে মেশিন গান চালালে কোন সৈন্যের পক্ষেই শত্রুর পরিখা দখল করা সম্ভব ছিল না। তাহলে তো সমস্যা মেশিন গান; ঠিক কিনা? কিন্তু মেশিন গানের আবির্ভাব হয়েছিল তো পদাতিক সৈন্যদের ফর্মেশন ভাঙ্গার জন্যে। তাহলে পদাতিকের এই ফর্মেশনই বা কেন দরকার হলো? ঘোড়সওয়ার-বাহিনী বা ক্যাভালরি – এদেরকে ঠেকানোর জন্যেই পদাতিকের ফর্মেশন দরকার হয়েছিল। ক্যাভালরি-কে ঠেকানোর জন্যে কামান বা আর্টিলারির আবির্ভাবও হয় গেল। তবে আর্টিলারি কিন্তু পদাতিকের ফর্মেশন ভাঙ্গার জন্যেও ব্যবহৃত হতো। একই কাজে হাতি, উট এবং ঘোড়াচালিত চ্যারিয়টও ব্যাবহৃতও হয়েছে। ক্যাভালরির আবির্ভাব হওয়ার আগে তীরন্দাজ এবং অন্যান্য ছুঁড়ে মারা অস্ত্র (মিসাইল) ব্যবহার করা হয়েছে পদাতিকের ফর্মেশন ভাঙ্গার জন্যে। আমরা তাহলে সেই একেবারে শুরুতে এমন একটা সময়ে পৌঁছে যাচ্ছি যখন একজন একক সৈন্যের অস্ত্র ধরার মাঝ দিয়েই পদাতিকের আবির্ভাব। আর ডিসিপ্লিনের মাধ্যমে পদাতিকের ফর্মেশন গঠন করে শত্রুর বিরূদ্ধে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। ঠিক এসময়েই পদাতিকের ফর্মেশন ভাঙ্গার জন্যে একে একে আবির্ভাব হতে থাকলো ঘোড়া, তীরন্দাজ, হাতি, উট, চ্যারিয়ট, আর্টিলারি, মেশিন গান এবং অবশেষে ট্যাঙ্ক। 

https://medium.com/war-is-boring/battle-of-the-dumbos-elephant-warfare-from-ancient-greece-to-the-vietnam-war-ca62af225917
জামা-র যুদ্ধ (খ্রীষ্টপূর্ব ২০২)। হস্তিবাহিনী পদাতিকের সামনে আবির্ভূত হতো ভয়ঙ্কর এক শক্তি-রূপে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পদাতিকের ডিসিপ্লিনের সামনে হস্তিবাহিনী টেকেনি।


যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা আসলে কে?

যুদ্ধক্ষত্রে এতকিছুর আবির্ভাব আসলে কি লক্ষ্যে? যুদ্ধ জয় অবশ্যই। কিন্তু সেটা কখন আসবে? যখন বিপক্ষের সৈন্যরা পালাবে বা হাত তুলে আত্মসমর্পণ করবে। সেটা কখন হবে? যখন শত্রুসৈন্যরা যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলবে বা মনে করবে যে এখন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর মানে হয় না। এই শত্রুসৈন্য বলতে আমরা কাদের বোঝাচ্ছি? অবশ্যই পদাতিক, কারণ পদাতিকেরাই যুদ্ধক্ষেত্রে ‘অবস্থান’ করে দখল অব্যহত রাখে। পালিয়ে যাওয়া মানেই যুদ্ধক্ষেত্রের দখল ছুটে যাওয়া। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রের দখল নেবার জন্যেই শত্রুপক্ষের পদাতিকের মনোবল ভাঙ্গাটা জরুরি। যখন হাজার হাজার তীর আকাশ কালো করে পদাতিকের উপরে আবির্ভূত হয়; যখন ভূমিকম্পের মতো শব্দ করে ক্যাভালরি, চ্যারিয়ট বা হস্তিবাহিনীর অবির্ভাব হয়; যখন বিকট শব্দে আর্টিলারি হামলা শুরু হয়; যখন ট্যাঙ্কের ইঞ্জিনের ধোঁয়া এবং শব্দে মাথা ভারি হয়ে ওঠে; যখন ডাইভ বোম্বার বিমানের সাইরেন-মার্কা শব্দ মৃত্যুর কথা মনে করায় – ঠিক তখনই, ঠিক তখনই – পদাতিকের মনোবলের উপরে আসে আঘাত। এতসকল অস্ত্রের মনস্তাত্বিক একটা চাপ প্রবলভাবে ঘিরে ধরে পদাতিক সৈন্যদের। হাজার হাজার বছর ধরে এই চাপ সহ্য করে আসছে পদাতিক। আর চাপ সহ্য করতে হবেই বা না কেন, তীরন্দাজ, ক্যাভালরি, হাতি, উট, চ্যারিয়ট, আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক, বিমান – এরা কেউই তো যুদ্ধক্ষেত্রে দখল কায়েম করে না, বরং নিজেদের পদাতিকের জন্যে দখল কায়েম সহজ করে দেয়। এসকল কারণেই পদাতিকের ডিসিপ্লিন শিক্ষা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ; পদাতিক বেঁকে বসলেই যুদ্ধ শেষ! এটা মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন যুগের যুদ্ধে রাজা বা জেনারেলের মৃত্যুর ব্যাপারটা। রাজা শেষ তো যুদ্ধ শেষ; অনেক যুদ্ধেই রাজাকে টার্গেট করা হয়েছে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করার জন্যে। পদাতিকের ব্যাপারটাও ঠিক তা-ই। অন্য যতো বাহিনীর পরাজয় হোক না কেন, পদাতিকেরা যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। অর্থাৎ গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখবো যে পদাতিকই যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা। এমনকি সাম্প্রতিক ইরাক যুদ্ধের দিকে তাকালেও আমরা দেখবো যে মার্কিন আর্মার্ড ফর্মেশনগুলি ইরাকের উপর দিয়ে প্রায় হেঁটেই পার হয়ে গেছে; কিন্তু এরপরে দেশের দখলের দায়িত্ব পড়েছে পদাতিকের হাতে। সেই পদাতিকদের শেষ পর্যন্ত রাস্তার পাশে রাখা বোমা আর চোরাগুপ্তা হামলায় নাভিস্বাস উঠেছিল। মার্কিন ট্যাঙ্ক, বিমান, আর্টিলারি – এগুলি কোনকিছুই ইরাক যুদ্ধের যবনিকা টানতে পারেনি। যতক্ষন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা, মানে পদাতিকের একটা গতি না হয়েছে, ততক্ষণ যুদ্ধ চলেছে। 

https://en.wikipedia.org/wiki/Horses_in_World_War_II
রাশিয়ার কাদায় আটকে গেছে জার্মান পদাতিকের ট্রান্সপোর্ট। কিছু বাহিনী সামনে পৌঁছে গেলেই যুদ্ধ শেষ হয় না; সবাই যখন পৌঁছায় তখনই যুদ্ধ শেষ হয়। আর সবার সামনে পৌঁছাতে অনেক সমস্যা উতড়াতে হবেই।


যুদ্ধক্ষেত্রের গতি আসলে কি?

দখল মানেই অবস্থান; আর অবস্থান মানেই গতিবিহীন অবস্থা। তাহলে যুদ্ধক্ষেত্র দখল মাধ্যমে পদাতিকেরা কি গতির পথ রূদ্ধ করছে? সেটা নয়; কারণ পদাতিকেরা পয়েন্ট-এ থেকে পয়েন্ট-বি পর্যন্ত গিয়ে দখল কায়েম করছে – এটা কিন্তু গতি; স্ট্র্যাটেজিক গতি। যুদ্ধক্ষেত্রে তার গতি কম, মানে ট্যাকটিক্যাল গতি কম, কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক গতি যে একেবারেই কম, সেটা কিন্তু বলা যাবে না। পদাতিকেরা পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করলেও পায়ে হেঁটেই যে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছাবে, তা কিন্তু নয়। একসময় ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি, খচ্চর, উট ব্যাবহার করা হয়েছে পদাতিকদের পরিবহণের জন্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা ঘোড়ার গাড়ি, রেল এবং মোটর গাড়ি ব্যাবহার করতো পদাতিকদের পরিবহণ করার জন্যে। মার্কিন ম্যারিন সৈন্যরা নৌবাহিনীর জাহাজে করে লিফট নেয়। আজকাল মার্কিনরা সামরিক পরিবহণ বিমান ব্যবহার করে পদাতিক পরিবহণের জন্যে। বাংলাদেশের সৈন্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী মিশনে গিয়েছে সিভিলিয়ান যাত্রীবাহী বিমানে। ব্রাজিলের নৌবাহিনীতে বেশকিছু জাহাজ আছে আমাজন নদীর ভেতরে সৈন্য পরিবহণ করার জন্যে। ব্রিটিশ সৈন্যরা সর্বদাই ইউরোপের মেইনল্যান্ডে যুদ্ধ করতে গিয়েছে জাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেবার পরে। ব্রিটিশ মার্চেন্ট মেরিনের জাহাজগুলি রাজার নির্দেশে এই সৈন্যদের পরিবহণ করতো। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনী সিভিলিয়ান প্যাসেঞ্জার লাইনার জাহাজ রিজুইজিশন করেছিল সৈন্য পরিবহণের জন্যে। মালয়ের গৃহযুদ্ধে ব্রিটিশরা এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে জঙ্গলের ভেতরে পদাতিকদের নিয়ে যাবার জন্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আকাশ থেকে প্যারাশুটের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে পদাতিক সৈন্য ফেলে দেবার চলও শুরু হয়েছে। এই সবই হচ্ছে স্ট্র্যটেজিক গতি। 

যখন যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ক্যাভালরি-নির্ভর, তখন কিন্তু ক্যাভালরি একা একা যুদ্ধক্ষেত্রে যায়নি; অপেক্ষা করেছে নিজেদের পদাতিক সৈন্যদের আসার আগ পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অপারেশন বার্বারোসার (১৯৪১) সময় জার্মান আর্মার্ড ফর্মেশনগুলি বিশাল এক সোভিয়েত বাহিনীকে ইউক্রেনে ঘিরে ফেলেছিল গতির মাধ্যমে। কিন্তু এই এনভেলপ বা পকেট চারিদিক দিয়ে বন্ধ করে দিতে তাদেরকে পদাতিকের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই অপেক্ষাটা না করলে অগ্রগামী জার্মান আর্মার্ড ফর্মেশনকে পিছন থেকে সোভিয়েত বাহিনী কেটে ফেলতে পারতো। মোটকথা ট্যাঙ্কের গতি দিয়ে একটা বাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক গতি মাপা সম্ভব নয়। ট্যাঙ্ক কিছুদূর গিয়েই অপেক্ষা করবে নতুন করে তেল নেবার জন্যে। তেলের ট্রাক যুদ্ধক্ষেত্রের শেষমাথায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ট্যাঙ্কগুলি বসে থাকবে। তার মানে যে গতিতে তেলের ট্রাক এগুবে, যুদ্ধ তার চেয়ে বেশি গতিতে এগুবে না। রাস্তায় কোন কারণে তেলের ট্রাকের এগুতে সমস্যা হলে শত শত ট্যাঙ্ক থাকার পরেও যুদ্ধক্ষেত্রে গতি থাকবে না। সকল খাড়াই-উতড়াই পার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের শেষমাথা পর্যন্ত তেলের ট্রাকের গতিই হলো আর্মার্ড ফর্মেশনের জন্যে স্ট্র্যাটেজিক গতি। যাই হোক, এই গতি আসলে দরকার হচ্ছে কেন? গতির দরকার বিপক্ষের সৈন্যদের ঘিরে ফেলার জন্যে; আর ঘিরে ফেলার দরকার বিপক্ষের সৈন্যদের সাপ্লাই লাইন কেটে ফেলতে এবং পালানোর পথ বন্ধ করতে, যাতে তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। এই পুরো গতিটাকেই ব্যবহার করা হয়েছে শত্রুর মনোবল ভাংতে। যখনই পদাতিক সেই গতি দিতে পারেনি, তখনই আবির্ভাব হয়েছে নতুন নতুন বাহিনীর; এরা যুদ্ধক্ষেত্রে দিয়েছে গতি; ফলাফল নির্ধারনে রেখেছে বিরাট ভূমিকা। আর বিপক্ষের মনোবল ভাঙ্গার মাধ্যমে কম হতাহতের বিনিময়ে জয় তুলে নেবার চেষ্টা করেছে; হাতাহাতি পদাতিকের যুদ্ধে যেখানে হতাহতের সংখ্যা বেশি হতো বলে মনে হয়েছে। যদিও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে হাতাহাতির চাইতে অনেক কম সময়েই বেশি সৈন্যকে মেরে ফেলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

http://www.figuren.miniatures.de/dba-armee-154-mongolen-1206.html
ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গোল ক্যাভালরি সকলের কাছে ভীতির বস্তু ছিল। তাদের গতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু তাদের গতিকে কাজে লাগিয়েই মুসলিমরা তাদের এমবুশ করে হারিয়েছিল আইল জালুতের যুদ্ধে।


পদাতিক থেকে ক্যাভালরি

যুদ্ধক্ষেত্রে দুই পক্ষই আক্রমণে থাকে না। একজন আক্রমণে গেলে আরেকজন রক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। আক্রমণে যেতে গেলেই দরকার হয় গতির – স্ট্র্যাটেজিক এবং ট্যাকটিক্যাল উভয়েরই। ডিফেন্সে যারা থাকবে তারা চাইবে সেই গতিকে রোধ করতে। ক্যাভালরিকে আটকাতে একসময় পদাতিক ফর্মেশন ব্যবহৃত হয়েছে। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেক্সান্ডার দি গ্রেটের বাবা মেসিডোনিয়ার ফিলিপ ‘ফ্যালাংস’ ফর্মেশনকে চমতকারভাবে তৈরি করেছিলেন, যেটা তার ছেলে পরবর্তীতে বিশাল এলাকা বিজয়ে ব্যবহার করেছিলেন। অস্ত্র এবং ডিসিপ্লিনের অভূতপূর্ব এক সমন্বয় ছিল এই ফ্যালাংস। শত্রুর ক্যাভালরি, চ্যারিয়ট এবং হাতির আক্রমণকে বহুবার হারিয়েছে এই ফর্মেশন। তবে এই ফর্মেশনের জন্যে খোলা জায়গা ছিল জরুরী। চিপা বা বন্ধুর পথে ফ্যালাংস সমস্যার পড়েছে। এই কারণে রোমানরা তৈরি করেছিল তাদের ‘লিজিয়ন’, যা কিনা ফ্যালাংস-এর চাইতে আরও বেশি স্থিতিস্থাপক (ফ্লেক্সিবল) ছিল। পাহাড়ি এলাকায় এবং বনে-বাঁদাড়ে লিজিয়ন রোমানদের জয় এনে দিয়েছে। কিন্তু লিজিয়নের আসল শক্তি ছিল এর ডিসিপ্লিন, যা কিনা রোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে একেবারেই নিচে নেমে যেতে থাকে; ঠিক সেসময়েই পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতকে রোমান সাম্রাজ্য গল, ভিসিগোথ, ভ্যান্ডাল এবং অস্ট্রোগোথ-দের দ্বারা আক্রান্ত হয়। অপেক্ষাকৃত কম ডিসিপ্লিনের সেনাবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয় রোমান লিজিয়ন। ডিসিপ্লিনের অধঃপতনের কারণে মধ্যযুগে অপেক্ষাকৃত এগ্রেসিভ জাতিগুলি যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যায়; আর সেখানে মূখ্য ভূমিকা নেয় ক্যাভালরি। সপ্তম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের নিয়ন্ত্রণে আরবরা এবং এর কিছু পরে দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পূর্ব-মধ্য এশিয়ার মোঙ্গলরা এসময়ে বিশাল এলাকা নিজেদের অধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এসব যুদ্ধে ক্যাভালরি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। 

http://www.moddb.com/groups/infantry-fans-group/images/french-napoleonic-infantry
ন্যাপোলিয়নের সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ বন্দুকধারী এবং কামানসজ্জিত পদাতিকের হাতে ফিরে আসে।


বন্দুক, কামান – আবারো পদাতিক

ক্যাভালরির জয়জয়কার এই সময়ে পদাতিকেরা যুদ্ধে জিতেছে অনেকবার; জিতেছে একটা অভিনব ডিফেন্সিভ পন্থায় – এমবুশ। ক্যাভালরির ট্যাকটিক্যাল গতিকে ব্যবহার করেই ক্যাভালরিকে ফাঁদে ফেলেছে পদাতিকেরা। ৬২৭ সালে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন করে মুসলিমরা কুরাইশ বাহিনীকে আটকে দেয়। ১২৬০ সালে আইন জালুতের যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দী বলে খ্যাত মোঙ্গোল ক্যাভালরিকে হারিয়েছিল কুতুয-এর অধীন মুসলিম সেনাবাহিনী। ১২৯৭ সালে উইলিয়াম ওয়ালেসের অধীন স্কটিশরা ইংলিশ হেভি ক্যাভালরিকে আগে থেকে তৈরি করে রাখা যুদ্ধক্ষেত্রে পরাভূত করেছিল। ক্রেসি-এর যুদ্ধে (১৩৪৬) এবং এজিনকোর্ট-এর যুদ্ধে (১৪১৫) ইংলিশরা তীরন্দাজ ব্যাবহার করে দেখিয়েছিল কিভাবে সঠিকভাবে এর ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুতগামী আক্রমণকারী বাহিনীকে পরাভূত করা যায়। ষোড়শ শতকের ইউরোপে ম্যাকিয়াভেলি তার লেখার মাধ্যমে ইউরোপিয়ান জেনারেলদের বোঝাতে সক্ষম হন যে পদাতিকের ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে না আনলে ক্যাভালরির বিরূদ্ধে নিয়মিত বিজয় পাওয়া কঠিন হবে। তিনি কামানের ব্যবহার বাড়ানোর জন্যেও বলেন, যদিও কামানকে যুদ্ধক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা অস্ত্র হিসেবে তৈরি হতে সময় লেগেছিল। প্রথম দিকের বন্দুকের মতো কামানের নিশানা ভালো ছিল না। তাই একত্রে ফর্মেশন আকারে ব্যবহার না করতে পারলে বন্দুক এবং কামানের কার্যকারিতা ছিল কম। তবে এখানে সবচাইতে বড় লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে বন্দুক এবং কামান ব্যবহার করা হয়েছে ডিফেন্সিভ অস্ত্র হিসেবে। যখন একত্রে অনেক বন্দুক ফায়ার করা হচ্ছে, তখন সেটা ক্যাভালরির বিরূদ্ধে একটা সীসার দেয়াল-রূপে দেখা দিল। এর সাথে কামান যোগ হওয়ায় ক্যাভালরির প্রতিপত্তি কমতেই থাকে। অষ্টাদশ শতকে প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডরিক দ্যা গ্রেট পদাতিকের ডিসিপ্লিনকে লৌহ-কঠিন অবস্থানে নিয়ে যান। এর পরে ন্যাপোলিয়ন কামানের ব্যবহারকে শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে যান উনিশ শতকের শুরুতে এবং পদাতিককে সেনাবাহিনীর প্রধান ফর্মেশন রূপে সামনে নিয়ে আসেন। ১৮৫৪ সালের বালাক্লাভার (রাশিয়ার ক্রিমিয়ায়) যুদ্ধে মোটামুটি বোঝা হয়ে যায় যে ক্যাভালরির দিন শেষ। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) সময় ক্যাভালরির যায়গা হয় সেনাবাহিনীর স্কাউট হিসেবে; মূল যুদ্ধক্ষেত্র পুরোপুরি চলে যায় বন্দুকধারী পদাতিক আর আর্টিলারির হাতে। যুদ্ধের গতি হয়ে আসে মন্থর। এখানে উল্লেখ্য যে বন্দুক এবং কামানের ব্যবহারে এমবুশ ছাড়াই পদাতিক বাহিনী হয়ে ওঠে প্রবল শক্তিশালী। সবাই তখন পদাতিকের ধারণা নিয়ে বসে আছে। দুপক্ষয়ই যখন ডিফেন্সিভ ট্যাকটিকস নিয়ে এগোয়, তখন যুদ্ধ যে স্থবির হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। পদাতিক আবার সেই গ্রীক ফ্যালাংস এবং রোমান লিজিয়নের মতো ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে।

http://fire2.net/military-history-of-italy-during-world-war-ii-wikipedia-
দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে ট্যাঙ্কের ব্যবহারে আসে বিরাট পরিবর্তন। গুডেরিয়ান, রমেল, মানস্টেইন প্রমুখ জার্মান জেনারেলরা ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে গতির সংজ্ঞাই পালটে দেন।


স্থবিরতা থেকে গতি

এরই মাঝে উনিশ শতকের শেষের দিকে আবিষ্কার হয় মেশিন গান, যা কিনা দুই পক্ষকেই পরিখা খুড়তে বাধ্য করে। ফর্মেশনে থাকা মানেই মৃত্যু! কাজেই প্রথমে ছড়িয়ে পড়া এবং পরবর্তীতে পরিখা খুড়ে লুকানো। বুর (বোয়ার) যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) এই মেশিন গান এবং পরিখার স্থবির যুদ্ধের অগ্রবার্তা দেয়, যা কিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সময়ে সবাইকে হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। আর এই হতাশা থেকেই গতি আনতে আবির্ভাব হয় ট্যাঙ্কের। যদিও টেকনিক্যাল কিছু সমস্যার কারণে ট্যাঙ্ক যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে ব্যর্থ হয়, পরিখা থেকে পদাতিক সৈন্যদের বের করে নিয়ে আসার একটা পদ্ধতি কিন্তু আবিষ্কার হয়ে গেল। বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশরা ট্যাঙ্কের ব্যবহার করতে থাকে পদাতিকের সহযোগী হিসেবে। তবে ব্যাসিল লিডেল হার্ট, হেইঞ্জ গুডেরিয়ানের মতো অল্প কিছু স্ট্র্যাটেজিস্টের চিন্তার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাঙ্ক আবির্ভাব হয় যুদ্ধক্ষেত্রের মূল পরিচালক হিসেবে। ফর্মেশন হিসেবে ট্যাঙ্কের আবির্ভাব হবার পরে এই ফর্মেশনকে ঠেকাতে তৈরি হতে থাকে বহু প্রকারের অস্ত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিমান ততটা শক্তিশালী না হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমান হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। আর বিমান আক্রমণের একটা অংশ কেন্দীভূত হয় শত্রুর ট্যাঙ্ক বা আর্মার্ড ফর্মেশনের উপর। এই সময় থেকে আকাশে বিমান ছত্রছায়া ছাড়া ট্যাঙ্ক খোলা জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি। মেশিনগানের আবির্ভাবের পরে পদাতিকেরা ছড়িয়ে পড়েছিল জীবন বাঁচাতে; তখন থেকেই বিমান থেকে একেকটি পদাতিক সৈন্যকে টার্গেট করা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ট্যাঙ্কের অপেক্ষাকৃত বৃহত আকার এবং কম সংখ্যার কারণে ট্যাঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় বিমানের প্রধান টার্গেট। আর মিসাইলের ব্যাপক প্রচলনের পর থেকে একজন পদাতিক সৈন্যও একটা ট্যাঙ্ককে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখছে অনায়াসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্যাঙ্ক যতটা না সহজ টার্গেট ছিল, আজ সেটা আরও অনেক সহজ টার্গেট। ট্যাঙ্ককে নিরাপত্তা দেবার জন্যে আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) দিয়ে পদাতিক সৈন্য সাথে নিতে হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে এপিসি-গুলি বিপক্ষের পদাতিকের হাতে থাকা মিসাইলের সহজ শিকার হচ্ছে। এর উপরে রয়েছে বিমান এবং হেলিকপ্টার। ফলশ্রুতিতে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো – যুদ্ধক্ষেত্রে ডিফেন্সিভ পদাতিকের বিরূদ্ধে গতি আনতে যে যন্ত্রগুলি তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলি আজ পদাতিকের সহায়তা ছাড়া এগুতে পারেনা এবং এগুলিকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পদাতিকের শুধু কষ্টই করতে হচ্ছে না, নিজেরাও একটা লোভনীয় টার্গেটে পরিণত হয়েছে। 

আধুনিক মিসাইল বর্তমানের পদাতিক সৈন্যের হাতে এনে দিয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা। সামনে দিনে এই সৈন্যরাই পরিবর্তন করবে যুদ্ধক্ষেতে গতির সংজ্ঞা।


নতুন ভবিষ্যত?

গতি থেকে আবারও স্থিতির দিকেই হয়তো এগুচ্ছি আমরা। ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন বিমান শক্তি দানবীয় এবং ভারী গাড়িগুলিতে (যেগুলিকে বলা হয়েছে এমআরএপি) চলা তাদের নিজস্ব পদাতিক বাহিনীকে আকাশ থেকে পুরো নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধ সবসময় খোলা মাঠে লক্ষ লক্ষ সৈন্যের মধ্যে সংগঠিত হবে – এটা কেউ বলতে পারে না। শহরে-শহরে এবং গ্রামে গ্রামে যুদ্ধ এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। গত এক’শ বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমান মানুষ শহরে চলে এসেছে; ভবিষ্যতে আরও আসবে। সামনের দিনগুলিতে শহুরে যুদ্ধই আমরা বেশি দেখবো। স্ট্যালিনগ্রাদের মতো শহুরে যুদ্ধ (১৯৪২-৪৩) এখন দেখা যাবে দেশে দেশে। বিশাল ফর্মেশনের চাইতে ছোট ছোট ফর্মেশন হয়ে উঠবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এরই মাঝে দশজন সৈন্যকে আলাদাভাবে আক্রমণ করার চাইতে তাদের পরিবহণকারী দামী এপিসি-টাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট হয়ে উঠবে। শহরের ভিতরে শত্রুর পদাতিক সৈন্যদের চোরাগুপ্তা হামলা ঠেকাতে নিজেদের পদাতিক সৈন্যদের গড়তে হবে অত্যাধুনিক সৈন্য হিসেবে। এর ফলশ্রুতিতে শহরের ভিতরে যুদ্ধ করার জন্যে পঞ্চাশ পদের যন্ত্রে সজ্জিত অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত পদাতিক সৈন্যও টার্গেটে পরিণত হবে। এরকম একজন সৈন্য তার যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যতটা না দীক্ষিত হবে, তার চাইতে বেশি সময় তাকে দিতে হবে যন্ত্র এবং অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষায়। অত্যন্ত ‘দামী’ এই সৈন্য যাতে সহজে জীবন না হারায়, সেজন্য তাকে দিতে হবে বহুল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অর্থ দিয়ে যে সৈন্যকে মূল্যায়ন করা হবে, যুদ্ধ সম্পর্কে তার মতামত অন্য দিকে ঘুরে যেতে বাধ্য; যুদ্ধে উদ্দেশ্যগত দিক থেকে তার থাকবে বিভ্রান্তিকর চিন্তা। 

ত্রিশ লক্ষ ভিয়েতনামীদের বিপক্ষে মার্কিনী নিহত হয়েছিল আটান্ন হাজার; যুদ্ধে কিন্তু জিতেছিল ভিয়েতনাম। উইলিয়াম ওয়ালেসের অধীনে স্কটিশরা ইংলিশদের গর্ব হেভি ক্যাভালরির উপরে আরোহিত নাইটদেরকে পরাজিত করেছিল স্বাধীনতার স্বাদ নিতে। একইভাবে আরবের মরুভূমির প্রথম দিকের মুসলিমরা খুব অল্প সময়ের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর এক বিরাট অংশ নিজদের অধীনে নিয়ে নিয়েছিল ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে। সামনের দিনগুলিতে অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশে যুদ্ধ করার জন্যে সৈন্যের অভাব হবে; তাই অল্প সৈন্যে বেশি কাজ করিয়ে নেবার একটা প্রবণতা থাকবে, যার ফলশ্রুতিতে তাদের পদাতিকেরা উপরে উল্লিখিত দামী হাই-টেক টার্গেটে পরিণত হবে। এসময়ে শক্তভাবে দীক্ষিত কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম খরচে সজ্জিত পদাতিক সৈন্য যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে বেশি সক্ষম হবে। পদাতিক সৈন্যের বহন করা অস্ত্র শত্রুর  ট্যাঙ্ক, বিমান, হেলিকপ্টার ধ্বংস করার সক্ষমতা রাখবে। অন্যদিকে এই একেকজন সৈন্যকে শহুরে যুদ্ধে খুঁজে ফিরে হতাশ হবে বিমান বাহিনী। বরং ছোট ছোট পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন পদাতিকের সাপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শহরের বিল্ডিংগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখার মতো (বা এর চাইতে ভালো) কাজ করবে। যেসব বাহিনী এরকম যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা ধরতে না পেরে ট্যাঙ্ক এবং অনান্য হেভি অস্ত্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে অক্ষম হবে, তারা খুব দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হবে; কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা তাদের বিশাল এলাকা হারিয়ে বসবে। যুদ্ধক্ষেত্রের ধারনার দিক থেকে স্বল্প পরিবর্তন যে কোন পরিবর্তনই নয়, সেটা তারা বুঝতে পারবে; কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে যাবে। পদাতিকের গতি তখনই সবাই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, যতক্ষন না সে তারই মতো আরেকটি পদাতিকের সন্মুখে না পরে। তখন শুরু হবে নতুন পরিবর্তনের খেলা।