Monday 27 April 2020

করোনাভাইরাসের সুযোগে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বাড়াচ্ছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

২৮শে এপ্রিল ২০২০

এপ্রিল মাসে দক্ষিণ আমেরিকার কাছে সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজ ‘ফোর্দ’। ব্রিটেনের সামরিক সক্ষমতা সর্বদাই প্রশ্নের মুখে। কিন্তু এই ছোট্ট সক্ষমতাকে ব্যবহার করেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ বিশ্বব্যাপী তার প্রভাবকে বৃদ্ধি করতে চাইছে; যখন করোনা দুর্যোগে সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত; যখন সকলেই যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের সংঘাত নিয়ে চিন্তিত।

ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’ এক প্রতিবেদনে বলছে যে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মাঝে ১’শর কম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও প্রায় ১৩ হাজার সেনা এই মুহুর্তে কোয়ার‍্যান্টিনে রয়েছেন, অথবা বাড়িতে থেকে কাজ করছেন, যা কিনা ব্রিটেনের পুরো সামরিক বাহিনীর ৯ শতাংশ। এদের মাঝে কারুর হয়তো উপসর্গ দেখা দিয়েছে; কারুর হয়তো পরিবারের সদস্য আক্রান্ত; অথবা পরিবারের দুর্বল কোন সদস্যকে সহায়তা দেয়ার জন্যে বাড়িতে রয়েছেন। দক্ষিণ আটলান্টিকে ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জে কমপক্ষে ১১ জন সামরিক সদস্য করোনা আক্রান্ত বলে জানা গিয়েছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সাইপ্রাস দ্বীপে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিতেও কমপক্ষে দুইজন সেনার মাঝে করোনার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। তবে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, তারা ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর কতজন আক্রান্ত হলো, তার হিসেব তারা নিয়মিতভাবে দেবেন না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে নিজ দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও এটা নিশ্চিত যে বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাগুলি থেমে থাকেনি। করোনাভাইরাসের মাঝে বহু দেশ যখন শুধুমাত্র নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, তখন সারাবিশ্বে সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে।

মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত মহাসাগর

২৬শে এপ্রিল ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন যে, গত ১০ই এপ্রিল প্রায় সাত মাসে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান উত্তর ইরাকের তুক খুর্মা এলাকায় আইসিস টার্গেটের উপর বোমাবর্ষণ করে। রয়াল এয়ার ফোর্সের দু’টা ‘টাইফুন’ বিমান বোমাবর্ষণে কয়েকটা বিল্ডিং ধ্বংস করে। এতে সহায়তা দেয় রয়াল এয়ার ফোর্সেরই আরেকটা মনুষ্যবিহীন ‘রিপার’ ড্রোন। এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে শেষবার আইসিসের বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা বিমান হামলা করেছিল। ব্রিটেনের ‘মর্নিং স্টার’ পত্রিকা জানাচ্ছে যে, ব্রিটিশদের এই হামলার এক সপ্তাহ আগেই গত ৩রা এপ্রিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব জাতিসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতিতে সমর্থন দেন। শান্তিবাদী এনজিও ‘পিস প্লেজ ইউনিয়ন’ অভিযোগ করে বলছে যে, ব্রিটিশ সরকার করোনাভাইরাসের আড়ালে চুপিসারে বোমাবর্ষণের কথা ঘোষণা করছে, যখন সকল মিডিয়ার দৃষ্টি মহামারির দিকে। ব্রিটিশ এই হামলার মাত্র চার দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিলেন। হামলার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস বলছেন যে, ব্রিটিশদের প্রতিরক্ষা কখনও ঘুমায় না। এবং তারা নিজেদের মানুষকে রক্ষা করতে যা করা দরকার তা-ই করবে।

ইরাকে হামলার দিনই ব্রিটিশ রয়াল নেভির ফ্রিগেট ‘আরগিল’ প্লাইমাউথের নৌঘাঁটি ছেড়ে যায়; উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত মহাসাগর। জাহাজটার নেতৃত্বে থাকা কমান্ডার এন্ড্রু আইন্সলি ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা নিউজ’কে বলেন যে, এক বছরের কম সময় আগেই ‘আরগিল’ নয় মাসের মিশন শেষ করে দেশে ফিরেছিল। এবারে সাত মাসের মিশনে জাহাজটা মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে জাহাজটা পঞ্চম বারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে; আর গত এক বছরের মাঝে এটা দ্বিতীয়বার। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে ব্রিটেনের ফ্রিগেট ‘মনট্রোজ’ ছাড়াও চারটা মাইনহান্টার এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ মোতায়েন রয়েছে। মার্চ মাসেই ডেস্ট্রয়ার ‘ডিফেন্ডার’ মধ্যপ্রাচ্যে মিশন শেষে দেশে ফিরে আসে। ‘আরগিল’ এই ‘ডিফেন্ডার’এর স্থান নিতে যাচ্ছে। ২৩শে এপ্রিল রয়াল নেভির এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, সারাবিশ্ব লকডাউনে থাকলেও পারস্য উপসাগরে ব্রিটিশ মাইনহান্টারগুলি সমুদ্রপথ নিরাপদ রাখতে সর্বদা সমুদ্রে টহল দিয়ে যাচ্ছে। উপসাগরে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করতে দু’টা মাইনহান্টার কুয়েতের নৌবাহিনীর সাথে একটা মহড়ায় অংশ নেয়। এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ওমানের সাথে যৌথ মহাড়ায় অংশ নেয় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজগুলি।

২৪শে এপ্রিল ‘নেভাল টেকনলজি’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, রয়াল নেভি তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’কে সমুদ্রে ট্রেনিংএর জন্যে পাঠাতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যে সকল ক্রুকেই করোনাভাইরাস টেস্টিং এবং ১৪ দিনের কোয়ার‍্যান্টিনের মাঝ দিয়ে যেতে হবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যে, মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ এবং ফরাসী বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘শার্ল দ্য গল’এ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর এমন একটা সময়ে ব্রিটেনের জন্যে তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের ট্রেনিং কতটা জরুরি। রয়াল নেভির কর্মকর্তারা বলছেন যে, সকল ধরনের প্রস্তুতিই তাদের থাকবে, যাতে সেই ধরনের কোন সমস্যা না হয়। মূলতঃ রয়াল নেভি ডিসেম্বর ২০২০এ নতুন এই জাহাজটার অপারেশনাল হবার সময় নির্ধারণ করেছে। সেই টাইমলাইন নিশ্চিত করতে গেলে মে মাসের শুরু থেকে প্রথম দফা ট্রেনিং শুরু করতে হবে। এরপর এবছরেই শেষবারের মতো ট্রেনিং সম্পন্ন করে মার্কিন ম্যারিন কোরের সাথে ‘এক্সারসাইজ জয়েন্ট ওয়ারিয়র’এ অংশ নেয়ার মাধ্যমে জাহাজটা অপারেশনাল হবার সার্টিফিকেট পাবে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এই টাইমলাইন পিছিয়ে ২০২১ সালে চলে যেতে পারে। গত বছরের নভেম্বরে দিল্লীতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ডমিনিক এসকুইথ ঘোষণা দেন যে, ৭০টা বিমান বহণে সক্ষম যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর প্রথম অপারেশনাল এলাকা হবে ভারত মহাসাগর। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটেন তার প্রভাব বাড়াবার কথা ভেবেই করোনাভাইরাসের লকডাউনের মাঝেই এই যুদ্ধজাহাজকে কর্মক্ষম করতে ট্রেনিং মিশনের আয়োজন করছে।
  
ফেব্রুয়ারি মাসে ভিয়েতনাম সফরে ব্রিটিশ রয়াল নেভির সার্ভে জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’। ‘এন্টারপ্রাইজ’ জাহাজটাকে যুদ্ধজাহাজের পর্যায়ে রাখবেন না অনেকেই। কিন্তু এই জাহাজটার মাধ্যমে ব্রিটেন পূর্ব এশিয়াতে তার প্রভাব ধরে রাখার কাজ করছে; বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়।

ইন্দো-প্যাসিফিক

গত জানুয়ারিতে ব্রিটেন ‘আসিয়ান’এর (এসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস) সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জাকার্তায় একটা অফিস খুলেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, বর্তমান সম্পর্ককে পুঁজি করে আসিয়ান এবং এর সদস্য রাষ্ট্রগুলির সাথে সহযোগিতার নতুন পথ বের করাই এই মিশনের কাজ। ব্রিটেনের সাথে আসিয়ানের বাৎসরিক বাণিজ্যের পরিমাণ এখন প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আসিয়ান দেশগুলি থেকে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ব্রিটেনে পড়াশুনা করছে। আর এখানকার ব্রিটিশ কাউন্সিল ৩৬ হাজার ইংরেজি শিক্ষক তৈরি করেছে। ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ের মাধ্যমে আসিয়ান কৌশলগতভাবে লাভবান হতে পারে। ‘এশিয়া টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে ‘আসিয়ান’ সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে হিমসিম খাবে। তাদেরকে বাধ্য করা হবে যেকোন একদিকে হেলে যেতে। এমতাবস্থায় অত্র অঞ্চলে ব্রিটেনের উপস্থিতিকে অনেকেই স্বাগত জানাতে পারেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব এশিয়া সফর শুরু করার সময় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব বলেন যে, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে কর্মে পরিণত করার এটাই সময়। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রচুর সুযোগ রয়েছে; আর ব্রিটেনের বার্তা হলো, ব্রিটেন বাণিজ্যের জন্যে উন্মুক্ত। এই সফরে রাব অস্ট্রেলিয়া থেকে জাপানে যান; আর এরপর সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া হয়ে সফর শেষ করেন। এই অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অংশ; আর সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং ব্রুনাইএর সাথে ব্রিটেনের নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট’এর সূত্র ধরে সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ সামরিক অবস্থান রয়েছে, যেটাকে ব্যবহার করে এই অঞ্চলে ব্রিটেন তার কৌশলগত স্বার্থ দেখাশুনা করে।

রয়াল নেভির সার্ভে জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ অনেকদিন ধরেই পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রে টহল দিচ্ছে; কিন্তু তা মিডিয়াতে খুব বেশি একটা আসেনি। গত নভেম্বরে জাহাজটা সিঙ্গাপুরে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সেরে সেখান থেকে ডিসেম্বরে জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া সফর করে। তবে পথে ৭ই ডিসেম্বর জাহাজটা চীন এবং তাইওয়ানের মাঝের তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিকে হাইলাইট করে; যা মিডিয়াতে প্রচারিত হয়। এই জাহাজটা ডিজাইন করা হয়েছে সারা বিশ্বের সমুদ্রে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে। এই তথ্য ব্রিটেনের সামরিক এবং বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। জাহাজটা প্রায় সারা বছরই ব্রিটেন থেকে দূরে থাকতে পারে। জাহাজের কনসেপ্টের সাথেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে যুক্ত করা হয়েছে। জানুয়ারিতে আবারও সিঙ্গাপুরে ভ্রমণ শেষ করে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ‘এন্টারপ্রাইজ’ ভিয়েতনামের হাই ফং বন্দরে এক সপ্তাহের শুভেচ্ছা সফর করে। চীনা সার্ভে জাহাজের সাথে যখন ভিয়েতনামের নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ নিয়মিত সেখানে ব্রিটিশ সার্ভে জাহাজের জন্যে ভিয়েতনামের বন্দর উন্মুক্ত। ৯ই মার্চ জাহাজটা পুনরায় সিঙ্গাপুরে আসে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষে প্রায় দেড় মাস পর ২১শে এপ্রিল জাহাজটা সিঙ্গাপুর ছেড়ে যায়। ‘এন্টারপ্রাইজ’ জাহাজটাকে যুদ্ধজাহাজের পর্যায়ে রাখবেন না অনেকেই। কিন্তু এই জাহাজটার মাধ্যমে ব্রিটেন পূর্ব এশিয়াতে তার প্রভাব ধরে রাখার কাজ করছে; বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়।
  
ইংলিশ চ্যানেলে ব্রিটিশ অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ‘টাইন’ রুশ ‘স্টেরাগুশি-ক্লাস’ ফ্রিগেটের উপর নজর রাখছে। মার্চের শেষে রাশিয়ার ৭টা যুদ্ধজাহাজ ইংলিশ চ্যানেলের মাঝ দিয়ে যাওয়া শুরু করে। ইউরোপের নরওয়েতে ‘কোল্ড রেসপন্স’ মহড়া দেয়ার মাধ্যমে ব্রিটেন করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও রাশিয়াকে জবাব দিতে বাধ্য করেছে।

ইউরোপ


মার্চ মাসে নরওয়ের অতিশীতল উত্তরাঞ্চলে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী ‘কোল্ড রেসপন্স ২০২০’ নামের মহড়ায় অংশ নেয়। অনেকগুলি দেশের প্রায় ১৫ হাজার সেনা এই মহড়ায় অংশ নেয়। তবে করোনাভাইরাসের লকডাউনের কারণে মহড়াটা সংক্ষিপ্ত করে ১১ই মার্চে শেষ করে দেয়া হয়। ব্রিটেনের সামরিক মিডিয়া ‘ফোর্সেস নেটওয়ার্ক’ জানাচ্ছে যে, প্রায় ২ হাজার ব্রিটিশ সেনা এই মহড়ায় অংশ নেয়। সরাসরি রাশিয়ার কথা বলা না হলেও নরওয়েকে নিরাপত্তা দেয়ার এই মহড়া যে রাশিয়াকে কেন্দ্র করেই তা বুঝতে বাকি থাকে না।

মার্চের শেষে রাশিয়ার ৭টা যুদ্ধজাহাজ ইংলিশ চ্যানেলের মাঝ দিয়ে যাওয়া শুরু করে। রুশ জাহাজগুলির মাঝে ছিল ৫টা ফ্রিগেট, ২টা ল্যান্ডিং শিপ; এবং এগুলির সহায়ক অক্সিলারি জাহাজ। ব্রিটিশ নৌবাহিনী জরুরি ভিত্তিতে তাদের ৯টা জাহাজকে সমুদ্রে প্রেরণ করে রুশ জাহাজগুলির উপর নজরদারি করার জন্যে। ব্রিটিশ জাহাজগুলির মাঝে ছিল ৪টা ফ্রিগেট, ২টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল, একটা সার্ভে জাহাজ এবং দু’টা সাপ্লাই জাহাজ। অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ‘টাইন’এর এক্সিকিউটিভ অফিসার লেফটেন্যান্ট নিক ওয়ার্ড বলেন যে, বাকি সামরিক বাহিনী যেহেতু মহামারি ঠেকাতে ব্যস্ত, এখন এটা তাদের দায়িত্ব যে, ব্রিটেনের নিরাপত্তাকে তুলে ধরা। সামরিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, রাশিয়া খুব সম্ভবতঃ ‘কোল্ড রেসপন্স’ মহড়ার জবাব হিসেবেই এতগুলি জাহাজ ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে পার করিয়েছে।

পশ্চিম আফ্রিকা
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম আফ্রিকায় সংঘাত ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মালি থেকে এই সংঘাত এখন পার্শ্ববর্তী নিজের এবং বুরকিনা ফাসোকে ধরে বসেছে। আর সাত বছর আগে মালিতে ফরাসীরা সামরিক হস্তক্ষেপের পর থেকে সেখান থেকে বের হতে পারছে না তারা। মালিতে ফ্রান্সের রয়েছে ৫ হাজার সৈন্য। আর ইতোমধ্যেই সেখানে প্রায় ২’শ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের এই যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান যুদ্ধের মতো চিরতরে আটকে যাবার মতো দশা হয়েছে। এই অবস্থাটাই ব্রিটেনকে সুযোগ করে দিয়েছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক এলাকায় হস্তক্ষেপ করার। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পশ্চিম আফ্রিকায় ব্রিটেন তার সামরিক উপস্থিতিকে অনেকটা বৃদ্ধি করতে চাইছে। মালিতে এবছরেই আড়াই’শ ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন করার কথা রয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার ‘সাহেল’ অঞ্চলে ব্রিটিশ সেনারা পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে আফ্রিকান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। সেনেগালে ৩০ জন ব্রিটিশ সেনা ক্যামেরুন, মরক্কো, নাইজেরিয়াসহ কয়েকটা পশ্চিম আফ্রিকার দেশের স্পেশাল ফোর্সের সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সেনাগালে ব্রিটিশ সেনা অফিসার মেজর জন হাউজ বলছেন যে, ব্রিটেনের নিজস্ব স্বার্থেই তারা এই অঞ্চলে বেশি করে জড়িত হচ্ছেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘স্পেশালাইজড ইনফ্যান্ট্রি গ্রুপ’এর ব্রিগেডিয়ার গাস ফেয়ার মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, সেটা ব্রিটেনের ক্ষেত্রে হবে না। কারণ ব্রিটেন তার সার্বভৌম শক্তিকে সরাসরি এখানে জড়াতে চাইছে না। ব্রিটেন চাইছে অত্র এলাকার দেশগুলিই তাদের সমস্যার সমাধান করুক।

ব্রিগেডিয়ার ফেয়ারের কথায় এটা পরিষ্কার যে, ব্রিটেন সাহেলে তার অবস্থানকে দৃঢ়তর করলেও সেই দেশগুলির দায়িত্ব সে নিতে চাইছে না। তবে তার প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টাটাও সে অব্যহত রাখতে চাইছে। ৭ই এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মালির পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় জাতিসংঘে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত জেমস রসকো মালিতে গত তিন মাসের ঘটনাবলির ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, মালিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সকল পক্ষ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে না। তবে পশ্চিম আফ্রিকার খারাপ পরিস্থিতির মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সেখানে এক কোটি ৩৮ লক্ষ মানুষ খাদ্যাভাবে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই লক্ষ্যে ব্রিটেন তার পার্টনারদের মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকাতে তার সহায়তা বৃদ্ধি করছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের কথাতেও বোঝা যাচ্ছে যে, সাহেলে ব্রিটেন সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইলেও ব্যর্থতার দায় অন্যের উপরে চাপাতে চাইছে। অর্থাৎ পশ্চিম আফ্রিকার, বিশেষ করে ফরাসী ভাষাভাষী প্রাক্তন ফরাসী ঔপনবেশিক এলাকার দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে নিতে ইচ্ছুক নয়।
  
রয়াল নেভির একমাত্র হসপিটাল জাহাজ ‘আরগাস’। ২রা এপ্রিল জাহাজটা ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির উদ্দেশ্যে প্লাইমাউথ ছেড়ে যায়। মধ্য আমেরিকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখতেই ব্রিটেন করোনা দুর্যোগের মাঝেও জাহাজটাকে ক্যারিবিয়ানে পাঠিয়েছে।

মধ্য আমেরিকা

২রা এপ্রিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অক্সিলারি জাহাজ ‘আরগাস’ ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির উদ্দেশ্যে প্লাইমাউথ ছেড়ে যায়। ক্যারিবিয়ানে হারিকেন সিজন মোকাবিলা এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সহায়তা দেবার জন্যে জাহাজটা সেখানে যাচ্ছে বলে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলছেন। ব্রিটিশ মিডিয়া ‘কর্নওয়াল লাইভ’ বলছে যে, এই জাহাজটা ব্রিটেনের একমাত্র হসপিটাল জাহাজ। প্লাইমাউথের লেবার এমপি লিউক পলার্ড বলছেন যে, যদিও এই জাহাজটাকে ক্যারিবিয়ানে পাঠানোটা সঠিক সিদ্ধান্ত, তদুপরি জনগণ জিজ্ঞেস করবে যে, দেশের একমাত্র হসপিটাল জাহাজটা লন্ডনের পাশে না থেকে কেন দূর দেশে যাচ্ছে। পলার্ড বলছেন যে, এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ব্রিটেনের কাছে যথেষ্ট সংখ্যক জাহাজ নেই। তবে তার মতে, ব্রিটেনের পক্ষে জিব্রালটার, ফকল্যান্ডস এবং ক্যারিবিয়ানের মতো উপনিবেশগুলিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ‘দ্যা ম্যারিটাইম এক্সিকিউটিভ’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, এই জাহাজটায় ৭০ বেডের একটা হাসপাতাল থাকা সত্তেও এটা সশস্ত্র জাহাজ হবার কারণে এটাকে অফিশিয়ালি হসপিটাল জাহাজ বলা হয় না। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণের সময় এই জাহাজটাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। মধ্য আমেরিকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখতেই ব্রিটেন করোনা দুর্যোগের মাঝেও জাহাজটাকে ক্যারিবিয়ানে পাঠিয়েছে।

দক্ষিণ আমেরিকা

ব্রিটেনের ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এবছরের শুরুতেই ব্রিটিশ রয়াল নেভির প্যাট্রোল জাহাজ ‘ফোর্দ’ দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জে তার স্থায়ী মিশন শুরু করে। এপ্রিলের শুরুতেই জাহাজটা ফকল্যান্ডসের ১৩’শ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে টহল দিয়ে আসে। ২০শে এপ্রিল আর্জেন্টিনার সর্বদক্ষিণাঞ্চলের সচিব আন্দ্রেস দাখারি এক বিবৃতিতে ফকল্যান্ডসকে আলোচনায় নিয়ে আসেন। তিনি বলেন যে, সারা বিশ্ব যখন স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থায় রয়েছে, তখন ব্রিটেন দক্ষিণ আটলান্টিকে তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। দক্ষিণ আটলান্টিকের সামরিকীকরণের দিকেই ঝুঁকছে ব্রিটেন। রয়াল নেভির এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকে ব্রিটিশ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার নিক সইয়ারকে সহ দুই ডজন সৈন্য, বিমান বাহিনীর সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বহণ করে সাউথ জর্জিয়াতে নিয়ে যায়। আর্জেন্টিনার সচিবের কথার জবাব দিতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ এডমিরাল এলান ওয়েস্ট বলেন যে, ঐ সচিবের উচিৎ ‘মুখ ঘুরিয়ে লুকানো’ এবং ‘চুপ থাকা’। ‘দ্যা নিউজ’এর সাথে সাক্ষাতে ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ডস যুদ্ধে অংশ নেয়া এই এডমিরাল বলেন যে, আর্জেন্টিনার সচিব অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছেন। আর যদি আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আটলান্টিকে শান্তিই চায়, তাহলে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলার কথা নয়।

করোনা দুর্যোগের মাঝেও ব্যস্ত রয়েছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

ইউরোপের নরওয়েতে ‘কোল্ড রেসপন্স’ মহড়া দেয়ার মাধ্যমে ব্রিটেন করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও রাশিয়াকে জবাব দিতে বাধ্য করেছে। দক্ষিণ আমেরিকাতে আর্জেন্টিনাকেও কথা বলাচ্ছে ব্রিটেন। সেনাবাহিনীর ১৩ হাজার সেনা কর্মক্ষেত্রে যোগ না দিতে পারলেও পশ্চিম আফ্রিকার প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশে সেনা মোতায়েনে অটল ব্রিটেন। লন্ডনে যখন করোনাভাইরাসে হাজারো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তখন রয়াল নেভির একমাত্র হসপিটাল জাহাজ যাচ্ছে ক্যারিবিয়ানে। মহামারির কারণে জাতিসংঘের ডাকা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতিতে সমর্থন দিয়েও ইরাকে বিমান হামলা করেছে ব্রিটেন। ভারত মহাসাগরে নতুন করে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করাটাও থেমে থাকেনি। করোনা সংক্রমণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ করেই ব্রিটেন তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে প্রস্তুত করছে ট্রেনিংএর জন্যে, যাতে সময়তো সেটাকে ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করা যায়। পূর্ব এশিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে রয়াল নেভির সার্ভে জাহাজ; আর ব্রিটেনের কূটনীতিকে জাগিয়ে রাখছে সেখানে, যখন সকলেই লকডাউনে ঘরের ভেতর। ব্রিটেনের সামরিক সক্ষমতা সর্বদাই প্রশ্নের মুখে। কিন্তু এই ছোট্ট সক্ষমতাকে ব্যবহার করেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ বিশ্বব্যাপী তার প্রভাবকে বৃদ্ধি করতে চাইছে; যখন করোনা দুর্যোগে সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত; যখন সকলেই যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের সংঘাত নিয়ে চিন্তিত। গত ফেব্রুয়ারি মাসে করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী মহামারি দেখা দেয়ার ঠিক আগে আগেই ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব পূর্ব এশিয়া সফর করে এই বার্তাই দিয়ে গেছেন।


Saturday 25 April 2020

করোনা দুর্যোগের মাঝে চীনের সামনে এখন উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক

২৫শে এপ্রিল ২০২০   

ভারত মহাসাগরে রয়েছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আইজেনহাওয়ার’। এই জাহাজগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভাসমান সার্বভৌমত্ব। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির অবক্ষয় অত্র অঞ্চলের ব্যালান্সকে সমস্যায় ফেলবে। এতে মার্কিন ‘বিশ্ব ব্যবস্থা’ যেমন হুমকির মাঝে পড়বে, তেমনি ভারত মহাসাগরে ব্যালান্সিং শক্তি হিসেবে অন্য দেশের আসার পথ উন্মুক্ত হবে।

উন্মুক্ত মহাসাগরে চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ

১৪ই এপ্রিল ভারতীয় নৌবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমনের মাঝেও তাদের ‘ইস্টার্ন নেভাল কমান্ড’এর অধীনে থাকা অন্ধ্র প্রদেশের ভিশাখাপত্নমে অবস্থিত ‘আইএনএস দেগা’ বিমান ঘাঁটি দিন রাত ২৪ ঘন্টা চালু রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, তাদের ‘৩১১ নেভাল এয়ার স্কোয়াড্রন’এর ‘ডরনিয়ার ২২৮’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমানগুলি সর্বদা সমুদ্রের উপর দিয়ে টহল দিচ্ছে। আর একইসাথে নৌবাহিনীর অন্যান্য বিমানগুলিকেও যেকোন মিশনের জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এই বিবৃতি এমন সময়ে এলো, যখন ৮ই এপ্রিল থেকে চীনা নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘লিয়াওনিং’ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অজানা মিশনে বের হয়েছে। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর মাঝে যেখানে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আর কোন দেশের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজই অপারেট করছে না, তখন চীনা নৌবাহিনীর এই মিশন অনেককেই চিন্তিত করেছে। মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’এ ৮’শর বেশি নাবিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর জাহাজখানা এখন মার্কিন ঘাঁটি গুয়ামে বসে রয়েছে। আরেকটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রোনাল্ড রেগ্যান’ও করোনা সংক্রমণের কারণে জাপানের ইয়োকোসুকা নৌঘাঁটিতে বসে রয়েছে। এপ্রিলের শুরুতে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যে অবস্থিত ব্রেমারটন নৌঘাঁটিতে বসে থাকা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিতজ’এও করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে বলে মিডিয়াতে রিপোর্ট এসেছে।

১৩ই এপ্রিল ‘লিয়াওনিং’ জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপ এবং তাইওয়ানের মাঝে অবস্থিত ‘মিয়াকো প্রণালী’ অতিক্রম করে তাইওয়ানের পূর্ব উপকূল ঘেঁষে দক্ষিণ চীন সাগরের দিকে যাত্রা করে। কিন্তু ২২শে এপ্রিল জাহাজখানা দিক পরিবর্তন করে তাইওয়ান এবং ফিলিপাইনের মাঝে অবস্থিত বাশি চ্যানেল পার হয়ে পূর্বদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে যাত্রা করে বলে বলছে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। জাহাজটার মিশন সম্পর্কে কেউই কিছু বলতে পারছেন না। জাহাজটা প্রশান্ত মহাসাগরেই থাকবে, নাকি ইন্দোনেশিয়ার প্রণালীগুলি পার হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আসবে তা পরিষ্কার নয়। জাহাজটার সাথে রয়েছে দু’টা ডেস্ট্রয়ার, দু’টা ফ্রিগেট এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ। ক’দিন আগেই দক্ষিণ চীন সাগরে মালয়েশিয়ার সাথে চীনের উত্তেজনার ঘটনা ঘটেছে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলির অবর্তমানে অত্র এলাকায় মার্কিন শক্তিশালী ইউনিট হলো এম্ফিবিয়াস এসল্ট জাহাজ ‘আমেরিকা’, যা কিনা অত্যাধুনিক ‘এফ-৩৫বি লাইটনিং’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান বহণ করছে। মালয়েশিয়ার সাথে উত্তেজনার সময় ‘আমেরিকা’ এবং এর সাথে মার্কিন ও অস্ট্রেলিয় মোট তিনটা যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরে ছুটে যায়। এরপর ২৪শে এপ্রিল এই গ্রুপে থাকা ডেস্ট্রয়ার ‘ব্যারি’ একমাসে দ্বিতীয়বারের মতো চীন এবং তাইওয়ানের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে যাতায়াত করে। চীনকে উত্তক্ত্য করার এই পদ্ধতি এর আগে বহুবার অনুসরণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এবারে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলির অনুপস্থিতিতে চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সমুদ্রে মিশন শুরু করাটা অন্য ধরনের উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে, যা এর আগে কখনোই ঘটেনি।
 
ড্রাইডকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিতজ’। মার্কিন নৌবাহিনীর ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থাকলেও এই মুহুর্তে মাত্র ২টা পুরোপুরি কর্মক্ষম রয়েছে। ভারত মহাসাগরে রয়েছে ‘আইজেনহাওয়ার’ এবং পাঁচ মাসের মিশন থেকে ফিরে বন্দরে না ভিড়ে আটলান্টিকে ঘুরছে ‘হ্যারি ট্রুম্যান’।

চাপের মুখে মার্কিন নৌশক্তি


মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরে প্রায় পাঁচ মাসের মিশন শেষ করে দেশে ফেরত গেলেও বন্দরে না ভিড়ে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘হ্যারি ট্রুম্যান’কে আপাততঃ আটলান্টিক মহাসাগরে থাকতে বলা হয়েছে। মার্কিন নৌবাহিনীর দ্বিতীয় নৌবহরের প্রধান ভাইস এডমিরাল উডি লুইস বলেন যে, তারা এখনও জানেন না যে এই জাহাজের মিশন কি হতে পারে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিন বলছে যে, এই জাহাজটাকে প্রশান্ত মহাসাগরে পাঠানো হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের এশিয়া-কেন্দ্রিক চিন্তার অংশ হিসেবে চীনা অধিপত্যবাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার কারণে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দু’টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। ‘হ্যারি ট্রুম্যান’ জাহাজটাকে সেখান থেকেই সরিয়ে আনা হয়েছে। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলির গুরুত্ব তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেন যে, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের রয়েছে বিশাল আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতা; এটাকে যেকোন স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। তিনি বলেন যে, এই জাহাজগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভাসমান সার্বভৌমত্ব।

মার্কিন নৌবাহিনীর ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। এর মাঝে ৩টা জাহাজ দীর্ঘ সময়ের জন্যে ড্রাইডকে থাকবে। ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ এবং ‘জন সি স্টেনিস’ বর্তমানে ‘রিফুয়েলিং এন্ড কমপ্লেক্স ওভারহল’এর মাঝে রয়েছে, যা শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যাবে। ‘জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ’ গত ফেব্রুয়ারিতে ২৮ মাসের জন্যে ‘ড্রাইডকিং প্ল্যান্ড ইনক্রিমেন্টাল এভেইল্যাবিলিটি’ নামের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ঢুকেছে। সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের ‘জেরাল্ড আর ফোর্ড’ এখনও টেস্টিং পর্যায়ে রয়েছে; এর অপারেশনে আসতে আরও কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। পশ্চিম উপকূলে ‘কার্ল ভিনসন’ ১৪ মাসের রক্ষণাবেক্ষণের পর মাত্র পানিতে নেমেছে; পুরোপুরিভাবে সার্ভিসে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন। ‘আব্রাহাম লিংকন’ গত জানুয়ারিতেই সান ডিয়েগোতে ফেরত এসেছে। অন্য বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের অভাব থাকায় ‘লিংকন’ জাহাজের ক্রুদের ১০ মাস মিশনে থাকতে হয়েছিল। করোনা ইস্যুতে জাপানে বসে রয়েছে ‘রোনাল্ড রেগ্যান’ এবং গুয়ামে বসে আছে ‘থিওডোর রুজভেল্ট’। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে মিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকা ‘নিমিতজ’এও করোনা সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে বলে মিডিয়ায় খবর আসে। তাই এখন ‘নিমিতজ’ এবং এর নিরাপত্তায় থাকা জাহাজগুলির মোট ৮ হাজার নাবিককে করোনাভাইরাসের টেস্ট এবং কোয়ার‍্যান্টিনের মাঝ দিয়ে যেতে হচ্ছে। সুতরাং এই মুহুর্তে ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে মাত্র ২টা পুরোপুরি কর্মক্ষম রয়েছে। ভারত মহাসাগরে রয়েছে ‘আইজেনহাওয়ার’ এবং পাঁচ মাসের মিশন থেকে ফিরে বন্দরে না ভিড়ে আটলান্টিকে ঘুরছে ‘হ্যারি ট্রুম্যান’।
 
চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'লিয়াওনিং'। ভারত এটা বুঝতে পারছে যে, চীন তার সমুদ্রপথের নিরাপত্তা দিতে ভারত মহাসাগরে পদার্পণ করবেই। আর একারণেই চীনা বিমানবাহী জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে খবর পাওয়া মাত্রই ভারতীয় বিমান বঙ্গোপসাগরের উপর মহড়া দেয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে চীনও মেনে নিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব থাকবেই; তাই ভারতের সাথে তার প্রতিযোগিতা অনিবার্য।

চিন্তিত ভারত

জানুয়ারি মাসে ভারতের নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল কারামবির সিং বলেছিলেন যে, ভারত মহাসাগরে যেকোন সময়ে সাত থেকে আটটা চীনা যুদ্ধজাহাজ অপারেট করে। ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত ভূরাজনীতি বিষয়ক কনফারেন্স ‘রাইসিনা ডায়ালগ’এ কথা বলতে গিয়ে এডমিরাল সিং আরও বলেন যে, কেউ যদি ভারতের এলাকায় অপারেট করতে চায়, তাহলে তাকে আগে ভারতকে জানাতে হবে। এডমিরাং সিংএর চিন্তার কারণ শুধু চীনা নৌবাহিনীর আনাগোণা নয়। ভারত মহাসাগরে চীনারা সবচাইতে বেশি সহায়তা পাচ্ছে পাকিস্তানের কাছ থেকে। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে যে, গত জানুয়ারিতে পাকিস্তানের উপকূলে চীনাদের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া ‘সী গার্ডিয়ান ২০২০’এর সময় চীনা যুদ্ধজাহাজগুলি পাকিস্তানের করাচি বন্দরেই অবস্থান নিয়েছিল। একটা ডেস্ট্রয়ার, একটা ফ্রিগেট, একটা সাপ্লাই জাহাজ এবং একটা সাবমেরিন রেসকিউ জাহাজসহ ৫টা চীনা জাহাজ এই মহড়ায় অংশ নেয়। আর এই মহড়াকে কাছে থেকে উপলব্ধি করার জন্যে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘বিক্রমাদিত্য’কে আরব সাগরে মোতায়েন করে। চীনা নৌবাহিনীর এই জাহাজগুলি হলো ৩৪তম এসকর্ট টাস্ক ফোর্সের অংশ। জানুয়ারির ২০ তারিখের দিকে জাহাজগুলি কৌশলগত বাব-এল মান্ডেব প্রণালীর পাশে জিবুতিতে তাদের নৌঘাঁটিতে পৌঁছায়।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে চীনারা মেডিক্যাল সহায়তা দেবার কারণে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে ব্যাপক চাপের মাঝে পড়েছে ভারত। এপ্রিলের ১৫ তারিখ থেকে ভারতের দক্ষিণের তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর বিমান ঘাঁটি থেকে বঙ্গোপসাগরে মাসব্যাপী মহড়া শুরু করেছে ভারতীয় বিমান বাহিনী। বিমান থেকে বিমানে রিফুয়েলিং বা জ্বালানি সরবরাহে সক্ষম ‘ইলিউশিন ৭৮এমকেআই’ বিমান এই ঘাঁটিতে মোতায়েন করা হয়েছে বলে বলছে অনলাইন প্লেন স্পটাররা। নিরাপত্তা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, ২০শে জানুয়ারি ভারতীয় বিমান বাহিনী এই ‘থাঞ্জাভুর’ ঘাঁটিতে ‘সুখোই-৩০এমকেআই’ বিমানের ‘২২২তম স্কোয়াড্রন’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ভোধন করে। দক্ষিণ ভারতে সুখোই বিমানের একমাত্র এই স্কোয়াড্রন সুপারসনিক জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ‘ব্রাহমোস’ বহণে সক্ষম। রুশ নির্মিত ২৮ফুট লম্বা এবং আড়াই টন ওজনের প্রায় ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রকে যেকোন জাহাজের জন্যেই ধ্বংস করাটা কঠিন। আর এর ২’শ কেজি ওয়ারহেডের পক্ষে বিশাল জাহাজও ঘায়েল করা সম্ভব। ২০২১ সালের মাঝে এই স্কোয়াড্রনে ১৮টা সুখোই মোতায়েন করার কথা রয়েছে; যার মাঝে ৮টা বিমান ব্রাহমোস বহণ করতে পারবে। করোনা পরিস্থিতিতে চীনা নৌবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিই খুব সম্ভবতঃ থাঞ্জাভুরে মহড়ার কারণ। বিমান থেকে বিমানে রিফুয়েলিং করতে পারলে থাঞ্জাভুরের সুখোই বিমানগুলি ভারত মহাসাগরের একটা বড় এলাকা টহল দিতে পারবে। ভারতীয় নৌবাহিনীর মার্কিন নির্মিত ম্যারিটাইম দূরপাল্লার প্যাট্রোল বিমান ‘পি-৮আই নেপচুন’ বিমানও নিয়মিত টহল দিচ্ছে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে। ১৪ই এপ্রিল ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুততার সাথে এই বিমানগুলিতে ব্যবহারের জন্যে ভারতের কাছে ১০টা ‘হারপুন’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১৬টা সাবমেরিন-ধ্বংসী ‘মার্ক ৫৪’ লাইটওয়েট টর্পেডো বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। ২৪শে এপ্রিল ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতের সামরিক নেতৃবৃন্দের সাথে জরুরি বৈঠক করেন। তিনি হুঁশিয়ারি দেন যে, করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যস্ততার মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরা যেন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি না করতে পারে। বৈঠকে জম্মু-কাশ্মিরের বর্তমান অবস্থা আলোচনা করা ছাড়াও চীনের সাথে ভারতের সীমানা এবং ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের আনাগোণা বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় বলে বলছে ভারতের গণমাধ্যম ‘পিটিআই’। বৈঠকে অভিযোগ করে বলা হয় যে, পাকিস্তান গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বরাবর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে এবং ভারতী অধিকৃত কাশ্মিরে জঙ্গীদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এর ক’দিন আগেই জম্মু-কাশ্মিরের পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল দিলবাগ সিং অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তান করোনা আক্রান্ত জঙ্গীদের ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে যাতে এখানকার মানুষও করোনা আক্রান্ত হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দিলবাগ সিংকে সমর্থন করে একটা বিবৃতিও দেয়া হয়।
 
ভারতীয় নৌবাহিনীর মার্কিন নির্মিত ‘পি-৮আই’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুততার সাথে এই বিমানগুলিতে ব্যবহারের জন্যে ভারতের কাছে ‘হারপুন’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং সাবমেরিন-ধ্বংসী ‘মার্ক ৫৪’ লাইটওয়েট টর্পেডো বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে।

গত বছরের মে মাসেই ভারতীয় নৌবাহিনী ফ্রান্সের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘শার্ল দ্য গল’এর সাথে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। প্রায় একইসাথে ভারতীয়রা জাপানের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ইজুমো’ এবং অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের সাথে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। কিন্তু সেই সময়গুলি ছিল ভারতের জন্যে অপেক্ষাকৃত ভালো সময়; শক্তিশালী বন্ধুরা ছিল ভারতকে সহায়তা দেবার জন্যে। এখন করোনা দুর্যোগের কারণে ১১টা মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে মাত্র ২টা সমুদ্রে অপারেশনে রয়েছে; আর তন্মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে ভারত মহাসাগরে রয়েছে একটা। আরব সাগরের কাছাকাছি রয়েছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আইজেনহাওয়ার’। এছাড়াও জানুয়ারি থেকে এই অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছে এম্ফিবিয়াস এসল্ট জাহাজ ‘বাটান’। চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরে ঢুকুক বা না ঢুকুক, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ইতোমধ্যেই তা রাজত্ব করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বিশাল মার্কিন নৌবহরের এই অসহায়ত্ব ভারতকেও বিচলিত করেছে। একারণেই ভারত চাইছে চীনের পথ অনুসরণ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নিজের আঞ্চলিক প্রভাবকে দ্রুত ঝালাই করে নিতে।

চীনের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর ঝাও ইয়ি বেইজিংএ ভারতীয় সাংবাদিকদেরকে সরাসরিই বলেন যে, চীন ভারত মহাসাগরকে নিরাপদ রাখতে ভারতের বিশেষ ভূমিকাকে মেনে নেয়। তবে ভারত মহাসাগরের মতো উন্মুক্ত এক মহাসাগরকে ভারতের ‘উঠান’ বলাটা একেবারেই সমীচিন নয়। সুইডিশ সাংবাদিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক বার্টিল লিন্টনার ‘এশিয়া টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, চীন চাইছে না যে কোন একটা শক্তি ভারত মহাসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করুক। চীনের জ্বালানি, খনিজ এবং রপ্তানি পণ্যের মূল সমুদ্রপথ এখন ভারত মহাসাগর। আর তাই এই সমুদ্রপথের নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা না করাটাই বরং বেইজিংএর জন্যে হ্রস্বদৃষ্টির পরিচায়ক হবে। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির মাঝে চীনের এই প্রচেষ্টা শুধু চলছেই না, বাড়তেও পারে। লিন্টনারের কথা ধরেই বলা যায় যে, ভারত এটা বুঝতে পারছে যে, চীন তার সমুদ্রপথের নিরাপত্তা দিতে ভারত মহাসাগরে পদার্পণ করবেই। আর একারণেই চীনা বিমানবাহী জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে খবর পাওয়া মাত্রই ভারতীয় বিমান বঙ্গোপসাগরের উপর মহড়া দেয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে চীনও মেনে নিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব থাকবেই; তাই ভারতের সাথে তার প্রতিযোগিতা অনিবার্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক অবস্থান মানেই হলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ‘ব্যবস্থা’ বজায় থাকা। ভারত-চীনের প্রতিযোগিতার মাঝে অত্র অঞ্চলের ছোট দেশগুলি ব্যালান্সিং পাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই চেয়ে থাকবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির অবক্ষয় এই ব্যালান্সকে সমস্যায় ফেলবে। এতে মার্কিন ‘বিশ্ব ব্যবস্থা’ যেমন হুমকির মাঝে পড়বে, তেমনি ভারত মহাসাগরে ব্যালান্সিং শক্তি হিসেবে অন্য দেশের আসার পথ উন্মুক্ত হবে। তবে এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতেই অত্র অঞ্চলের দেশগুলি নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে পারে। এতে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির সাথেসাথে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে।

Thursday 23 April 2020

করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে দক্ষিণ চীন সাগরে আগ্রাসী চীন

২৩শে এপ্রিল ২০২০
   
চীনের জরিপ জাহাজ ‘হাই ইয়াং ডি ঝি ৮’। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চীনের সাথে সম্পর্কের বর্তমান বাস্তবতাকে মেনেই নিয়েছে। একদিকে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ চলছে; অন্যদিকে বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও চলছে। এমতাবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগরের আশেপাশের দেশগুলি তাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন রাস্তা খোলা দেখছে না।
 আগ্রাসী চীন

গত ১৬ই এপ্রিল চীনের একটা জরিপ জাহাজ মালয়েশিয়ার উপকূলের কাছাকাছি এসে জরিপের কাজ শুরু করলে মালয়েশিয়া এবং চীনের মাঝে উত্তেজনা দেখা দেয়। ভেসেল ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ‘ম্যারিন ট্রাফিক’এর মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, চীনের জরিপ জাহাজ ‘হাই ইয়াং ডি ঝি ৮’ ৯ই এপ্রিল চীনের হাইনান থেকে যাত্রা শুরু করে ১৪ই এপ্রিল ভিয়েতনামের কাছাকাছি আসে। এরপর ১৫ই এপ্রিল দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ পার হয়ে পরদিন মালয়েশিয়ার সারাওয়াক প্রদেশ থেকে ৩’শ ২৫ কিঃমিঃ দূরে অবস্থান নেয়। চীনা কোস্ট গার্ডের কমপক্ষে ৬টা জাহাজ এই জাহাজকে নিরাপত্তা দিচ্ছিলো। মালয়েশিয়ার নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, চীনা জাহাজটা মালয়েশিয়ার হাইড্রোকার্বন কোম্পানি ‘পেট্রোনাজ’এর জন্যে কাজ করা ৬০ হাজার টনের ড্রিলিং জাহাজ ‘ওয়েস্ট কাপেলা’র কাছাকাছি চলে আসে। ব্রিটিশ কোম্পানি ‘সীড্রিল’এর মালিকানায় থাকা এই জাহাজটা ঐ একই স্থানে কয়েক মাস ধরে ড্রিলিংএর কাজ করছে এবং চীনা কোস্ট গার্ডের জাহাজগুলি নিয়মিতই পেট্রোনাজের জাহাজের ক্রুদের ভীতি প্রদর্শন করে আসছে । দক্ষিণ চীন সাগরের এই স্থানটা মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং চীন সকলেই নিজের বলে মনে করে। মালয়েশিয়ার কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ১৭ই এপ্রিলে এক পর্যায়ে চীনা সার্ভে জাহাজটার নিরাপত্তায় চীনা কোস্ট গার্ড এবং চীনা ম্যারিটাইম মিলিশিয়ার ১০টারও বেশি জাহাজ মোতায়েন করা হয়। এগুলির কাছাকাছি ভিয়েতনামের একটা জাহাজও ছিল। এই ঘটনার ব্যাপারে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অফিস বা পেট্রোনাজ কেউই মুখ খুলতে রাজি হয়নি। মালয়েশিয়ার সমুদ্র নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান জুবিল মাত সম মালয়েশিয়ার পত্রিকা ‘হারিয়ান মেট্রো’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, জাহাজটা মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমানায় আসলেও তা কোন বেআইনী কাজ করছিলো না। তবে কেন জাহাজটা সেখানে অবস্থান করছিলো, তা সম্পর্কে তিনি জানেন না বলে জানান। চীনা সার্ভে জাহাজের এহেন কর্মকান্ড এমন সময়ে এলো, যখন নভেল করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে সহায়তা দিচ্ছে; যার মাঝে মালয়েশিয়াও রয়েছে।





দক্ষিণ চীন সাগরের ‘ফায়ারি ক্রস রীফ’এ চীনাদের নির্মিত কৃত্রিম দ্বীপ; এখানে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার ফুট রানওয়ে, আর্লি ওয়ার্নিং রাডার সিস্টেম, বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই দ্বীপগুলিকে ব্যবহার করে পুরো দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে চীন। এই সমুদ্র দিয়ে সারা দুনিয়ার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্য সম্পন্ন হয়।


চীনের জন্যে দক্ষিণ চীন সাগরে এহেন উত্তেজনা নতুন নয়। এই একই চীনা জাহাজ গত বছরের জুলাইএ ভিয়েতনামের উপকূলের কাছাকাছি বিরোধপূর্ণ ‘ভ্যানগার্ড ব্যাঙ্ক’এ জরিপের কাজ চালায়। এর ফলশ্রুতিতে ভিয়েতনামের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে কয়েক মাস জুড়ে উত্তেজনা চলে। এরপর ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনা কোস্ট গার্ডের প্রহরায় চীনের ৬৩টা মাছ ধরার ট্রলার ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে দুই সপ্তাহের বেশি সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। আর এপ্রিলের শুরুতেই ভিয়েতনাম অভিযোগ করে যে, চীনা জরিপ জাহাজের ধাক্কায় ভিয়েতনামের একটা মাছ ধরার ট্রলার ডুবে যায়। দক্ষিণ চীন সাগরের স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জে চীনারা কৃত্রিমভাবে দ্বীপ উন্নয়ন করে সেখানে বিমান ঘাঁটি, রাডার স্টেশন, বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, সৈন্য ব্যারাকসহ শক্তিশালী সামরিক স্থাপনা বসিয়েছে। চীনারা দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় পুরোটাই নিজেদের বলে দাবি করে। অন্যদিকে এই সাগরের বেশকিছু অংশ ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এবং ব্রুনাই নিজেদের বলে দাবি করে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর ‘এশিয়া ম্যারিটাইম ট্রান্সপারেন্সি ইনিশিয়েটিভ’এর ডিরেক্টর গ্রেগোরি বি পোলিংএর মতে, চীনারা মালয়েশিয়ার সাথে সংঘাতে যেতে চাইছে না; শুধুই ভয় দেখাতে চাইছে। করোনাভাইরাস চীনকে থামাতে পারেনি।

দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ‘আমেরিকা। সাথে অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিগেট ‘পারামাত্তা’, মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ‘ব্যারি’ এবং ক্রুজার ‘বাংকার হিল’। জাহাজগুলি মালয়েশিয়া-চীন বিরোধে কোন অংশ নিতে পারেনি। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র যখন করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত, তখন মার্কিন বন্ধুরা চীনাদের কর্মকান্ড পছন্দ না হলেও করোনা মোকাবিলায় চীনের সহায়তা গ্রহণ করছে।

যুক্তরাষ্ট্র কোথায়?

করোনাভাইরাসে যখন চীনের প্রতিবেশিরা ব্যাতিব্যস্ত, তখন মার্চের শেষে চীনারা দক্ষিণ চীন সাগরে বড় একটা সামরিক মহড়া দিয়েছে। চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ‘গ্লোবাল টাইমস’ বলছে যে, ‘লাইভ ফায়ারিং’ এই মহড়ায় যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন এবং ফাইটার জেট অংশ নেয়। চীনা সমর বিশ্লেষক ওয়েই ডংশু বলছেন যে, এই মহড়ার মাধ্যমে চীনারা মাল্টিডিমেনশনাল সক্ষমতা প্রদর্শন করলো, যেখানে সকল ধরনের যুদ্ধাস্ত্র একত্রে কাজ করবে। মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল অত্র অঞ্চলের সমুদ্র এবং দ্বীপগুলিকে রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ এবং এম্ফিবিয়াস এসল্ট শিপ ‘আমেরিকা’ ১৫ই মার্চেই দক্ষিণ চীন সাগরে মহড়া দিয়ে যায়। এরপর ‘রুজভেল্ট’ জাহাজে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পরার পর অত্র অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির ব্যাপক অভাব দেখা দেয়। শুধুমাত্র নৌবাহিনীর ‘পি-৩সি’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমানগুলি সাগরের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে মার্কিনীদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছিলো। তবে চীনারা বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। ২৬শে মার্চ চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রেন গুওচিয়াং বলেন যে, অত্র এলাকায় মার্কিন কর্মকান্ড দক্ষিণ চীন সাগরের আশেপাশে অবস্থিত দেশগুলির নিরাপত্তাকে হুমকির মাঝে ফেলছে। একারণেই চীনারা তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার খাতিরে সবকিছু করবে।

মালয়েশিয়ার সাথে চীনের বিরোধকে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে চাইছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযোগ করেন যে, একদিকে চীনারা বিভিন্ন দেশকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলির সমুদ্রসীমার দাবিকে উপেক্ষা করে দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করছে। মালয়েশিয়ার সাথে উত্তেজনা বাড়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর এম্ফিবিয়াস এসল্ট শিপ ‘আমেরিকা’, ক্রুজার ‘বাংকার হিল’ এবং ডেস্ট্রয়ার ‘ব্যারি’কে দক্ষিণ চীন সাগরে প্রেরণ করে। এগুলির সাথে যোগ দেয় অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিগেট ‘পারামাত্তা’। তবে ২১ তারিখে এই জাহাজগুলি ঐ এলাকায় পৌঁছার পর চীনাদের কোন জাহাজ সেখানে ছিল না। অর্থাৎ মালয়েশিয়া এবং চীনের এই বিরোধের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি।

গ্রেগোরি পোলিং বলছেন যে, ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র যখন করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত, তখন মার্কিন বন্ধুরা চীনাদের কর্মকান্ড পছন্দ না হলেও করোনা মোকাবিলায় চীনের সহায়তা গ্রহণ করছে। ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্চের ২০ তারিখে চীনারা ইতালি, ইথিওপিয়া এবং কোরিয়াসহ পৃথিবীর ডজনখানেক দেশে করোনা প্রতিরোধের সরঞ্জাম পাঠাবার খবর দেয়। আবার একই দিনে ‘নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি’ বলছে যে, সমুদ্র গবেষণার জন্যে দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের ‘ফায়ারি ক্রস রীফ’ এবং ‘সুবি রীফ’এ তৈরি করা কৃত্রিম দ্বীপে দু’টা গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের মাঝ দিয়ে পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাণিজ্য সম্পাদিত হয়। আর এই এলাকায় রয়েছে প্রচুর খণিজ সম্পদ।
 
করোনা পরিস্থিতি চীনকে নিজের অবস্থান সুসংহত করার নতুন সুযোগ করে দিয়েছে, যা কিনা দক্ষিণ চীন সাগরের প্রতিবেশী দেশগুলিকে আরও ব্যাপক চাপের মাঝে ফেলবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের অবর্তমানে অত্র অঞ্চলের দেশগুলিও চীনকে ব্যালান্স করতে অন্যান্য শক্তিশালী দেশের উপস্থিতি চাইবে।



দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি কি করবে?

বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন এবং মালয়েশিয়ার সম্পর্ক বেশ কাছের। কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে দুই দেশের মতবিরোধ রয়েছে। গত ১২ই ডিসেম্বর মালয়েশিয়া জাতিসংঘের ‘ইউএন কমিশন অন দ্যা লিমিটস অব দ্যা কন্টিনেন্টাল শেলফ’ বা ‘সিএলসিএস’এর কাছে নিজেদের দাবির ডকুমেন্ট পেশ করে। পরিকল্পনা মোতাবেক মালয়েশিয়া তার সমুদ্রতট থেকে ৩’শ ৭০ কিঃমিঃ দূরের সমুদ্র পর্যন্ত নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। টোকিওর ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর স্টিফেন নাগি বলছেন যে, দক্ষিণ চীন সাগরের আশেপাশের অন্যান্য দেশগুলিও যেহেতু চীনা আধিপত্যবাদকে রুখতে চাইছে, তাই সেই সুযোগে মালয়েশিয়াও অন্যদের সাথে সাথে নিজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে চাইছে। মালয়েশিয়া নিজেকে একা আলাদাভাবে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাইছে না। অন্যদিকে সমুদ্রে চীনাদের আগ্রাসী ভূমিকা ঠেকাতে এই সাগরের আশেপাশের দেশগুলিকে মার্কিন সরকার এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলি সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে মালয়েশিয়ার অধিকার আদায়ের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত চীনাদেরকে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করাবে এবং চীন থেকে সহায়তা পাওয়াটা মালয়েশিয়ার জন্যে ধীরে ধীরে আরও কঠিন হয়ে যাবে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়া নজিব রাজাকের সরকার চীন থেকে অনেক প্রকল্পের জন্যে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের আশ্বাস পেয়েছিল। মাহাথির মোহামেদ নির্বাচনে জেতার পর বিভিন্ন সময়ে চীনের সমালোচনা করলেও চীনের সাথে বন্ধুত্ব যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখেছিলেন। ‘সিঙ্গাপুর ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স’এর সিনিয়র ফেলো ওহ এই সুন বলছেন যে, মালয়েশিয়া খুব সম্ভবতঃ চীনের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিবাদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক আইনী পদক্ষেপের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সিঙ্গাপুরের ‘এস রাজারাতনাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর এসোসিয়েট প্রফেসর এলান চং মনে করছেন যে, আইনী পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে মালয়েশিয়রা চীনের কাছ থেকে উন্নয়ন সহায়তা পাবার ক্ষেত্রে আরও ভালো শর্ত পাবার আশা করছে।

তবে চীনের এহেন আগ্রাসী মনোভাব চীনের জন্যে ক্ষতিকরও হতে পারে। সিঙ্গাপুরের ‘নানইয়াং টেকনলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি’র ম্যারিটাইম সিকিউরিটি বিশ্লেষক কলিন কোহ মনে করছেন যে, চীনের আগ্রাসী কর্মকান্ড করোনা মোকাবিলায় অত্র অঞ্চলের দেশগুলিকে সহায়তা দিয়ে আয় করা বিশ্বাসটুকু নষ্ট করে দিতে পারে। মার্চ মাসে চীন থেকে মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাবার পর মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেইজিংকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন যে, দুর্যোগের সময়েই সত্যিকারের বন্ধু চেনা যায়। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইস্টিটিউট’ বলছে যে, করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির দিক থেকে ব্যাপক চাপের মাঝে পড়ায় অত্র অঞ্চলের দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতা নিয়ে চিন্তিত। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে যে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেউই বন্ধু হিসেবে নির্ভরযোগ্য নয়। ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট’এর রিসার্চ ফেলো জ্যাক কুপার বলছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চীনের এহেন বাস্তবতাকে মেনেই নিয়েছে। একদিকে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ চলছে; অন্যদিকে বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও চলছে। এমতাবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগরের আশেপাশের দেশগুলি তাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন রাস্তা খোলা দেখছে না। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবর্তমানে চীনের আগ্রাসী মনোভাবের কাছে কোন কিছুই যেন দাঁড়াতে পারছে না। করোনা পরিস্থিতি চীনকে নিজের অবস্থান সুসংহত করার নতুন সুযোগ করে দিয়েছে, যা কিনা দক্ষিণ চীন সাগরের প্রতিবেশী দেশগুলিকে আরও ব্যাপক চাপের মাঝে ফেলবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের অবর্তমানে অত্র অঞ্চলের দেশগুলিও চীনকে ব্যালান্স করতে অন্যান্য শক্তিশালী দেশের উপস্থিতি চাইবে।

Sunday 19 April 2020

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে নিয়ে মার্কিন-ব্রিটিশ দ্বন্দ্ব করোনা-পরবর্তী নতুন ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ইঙ্গিত

২০শে এপ্রিল ২০২০



যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় নিজের প্রতিপত্তি হারিয়েছে বলেই অর্থায়ন করতে চাইছে না। অন্যদিকে ব্রেক্সিট-পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় বিভোর ব্রিটেন তার অর্থায়ন বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানটাকে কেড়ে নিতে চাইছে। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব করোনা-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক সংঘাতের একটা শক্তিশালী ইঙ্গিত।
    


গত ১৪ই এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে না পারার অভিযোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্যে অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা দিতে পেরেছে কিনা, সেব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন আসার আগ পর্যন্ত দুই থেকে তিন মাসের জন্যে অর্থায়ন স্থগিত করা হয়েছে। সংস্থাটার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে তিনি ব্যাপক অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তথ্য গোপন করার অভিযোগ করেন। ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ বা ‘ডব্লিউএইচও’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মূলতঃ জাতিসংঘের একটা অঙ্গ সঙ্গঠন। জাতিসংঘের মহাসচিত এন্টোনিও গুতেরেজ বলেন যে, বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাবার সময় অর্থায়ন বন্ধ করা একেবারেই উচিৎ হয়নি। তবে এর আগে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের ব্যাপারেও অনিয়মের অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল। মোটকথা জাতিসংঘের সংস্থাগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে বেশ খারাপই যাচ্ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই এতকাল যাবত জাতিসংঘের বাজেটের সবচাইতে বড় অংশটা দিয়ে এসেছে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মহানুভবতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল কিনা, সেব্যাপারে তার যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। তিনি সংস্থাটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন যে, সংস্থাটার গাফলতির জন্যে এই ভাইরাসকে ঠেকাতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি সংস্থাটার ‘চীন-কেন্দ্রিকতা’র সমালোচনা করেন। গত ২৪শে জানুয়ারি তিনি নিজেই এক টুইটার বার্তায় করোনাভাইরাস নিয়ে চীনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। আবার ১০ই জানুয়ারিতেই ডব্লিউএইচও এই রোগের মানুষ থেকে মানুষে ছড়াবার সম্ভাবনার কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ডব্লিউএইচওএর সংস্কার চাইছে। তাহলে ট্রাম্প কেন এখন এই সংস্থার অর্থায়ন বন্ধ করতে চাইছেন? আর কেনই বা তিনি চীনকে এই অভিযোগের সাথে যুক্ত করতে চাইছেন? উত্তরটা করোনাভাইরাসের মাঝে নয়; ভূরাজনীতির মাঝে রয়েছে।

‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর এক লেখায় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন কিভাবে হয়। সংস্থার ৫১ শতাংশ অর্থ আসে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে; ১৬ শতাংশ আসে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা থেকে; ১৩ শতাংশ আসে দাতা ফাউন্ডেশনগুলি থেকে; ৯ শতাংশ করে আসে বিভিন্ন এনজিও এবং বিভিন্ন পার্টনারশিপ থেকে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলির কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে ডব্লিউএইচওকে অর্থায়ন করার। সেই হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে ১’শ ১৬ মিলিয়ন ডলার; চীনের বাধ্যবাধকতা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৭ মিলিয়ন ডলার; জাপানের ৪১ মিলিয়ন ডলার; জার্মানির ২৯ মিলিয়ন; ব্রিটেনের ২২ মিলিয়ন; ফ্রান্সের ২১ মিলিয়ন; ইতালির ১৬ মিলিয়ন; ব্রাজিলের ১৪ মিলিয়ন। কিন্তু প্রভাবশালী দেশগুলি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়াতে বাধ্যবাধকতার অনেক বেশি অর্থায়ন করে। একারণেই সর্বোচ্চ ৪’শ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের মাধ্যমে সংস্থার প্রায় ১৫ শতাংশই দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় ১০ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থায়নকারী হলো ধনকুবের বিল গেটসএর ‘বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রাক্তন সুপারপাওয়ার ব্রিটেন। সর্বোচ্চ ২০ জন অর্থায়নকারীর মাঝে ৬টা হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন; আর একটা হলো রাষ্ট্র গুচ্ছ (ইয়রোপিয়ান কমিশন); বাকি ১৩টা জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র। দেশগুলির মাঝে প্রথম স্থানে যুক্তরাষ্ট্র; ব্রিটেন দ্বিতীয়; জার্মানি ও জাপান তৃতীয় ও চতুর্থ; কুয়েত ও সুইডেন পঞ্চম ও ষষ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্র তার বাধ্যবাধকতার প্রায় ৪ গুণ অর্থায়ন করে; ব্রিটেন অর্থায়ন করে বাধ্যবাধকতার ১০ গুণ; জার্মানি ৬ গুণ; জাপান ৪ গুণ; অস্ট্রেলিয়া ৪ গুণ; কানাডা ৩ গুণ; কোরিয়া ৩ গুণ। আর কুয়েত, সুইডেন, নরওয়ে, সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের প্রায় পুরোটাই স্বেচ্ছায় দিয়ে থাকে; বাধ্যবাধকতা থেকে নয়। তবে এই স্বেচ্ছায় অর্থায়ন আবার দেশগুলি নির্দিষ্ট করে বলে দেয় যে কোথায় ব্যয় করতে হবে। অর্থাৎ অর্থায়নকারী দেশগুলি নিজেদের স্বার্থ বিচারেই ঠিক করে দেয় যে বিশ্ব স্বাস্থ্যের কোন সেক্টরে এবং বিশ্বের কোন অঞ্চলে বা দেশে এই অর্থ যাবে। চীন এবং ফ্রান্স বাধ্যবাধকতার চাইতে খুব কমই অতিরিক্ত অর্থায়ন করে। এটা ধরেই নেয়া যায় যে, ডব্লিইএইচওতে যারা বেশি অর্থায়ন করবে, এই সংস্থাতে তাদের প্রতিপত্তিই বেশি থাকবে; কারণ অর্থায়নকারী দেশগুলি নিজেদের স্বার্থ বিচারেই এই অর্থায়ন করে থাকে; মানবতা বিচারে নয়।

ব্রিটেন তার বৈদেশিক সাহায্যগুলিকে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির একটা অংশ হিসেবে দেখে; এবং এক্ষেত্রে নিজেদেরকে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় দেখতে চায় তারা। এপ্রিলের শুরুতে ব্রিটেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী প্রায় আড়াই’শ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করার কথা জানায়। ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক সহায়তা বিষয়ক মন্ত্রী এন-ম্যারি ট্রেভেলায়ান বলেন যে, বিশ্বের সবচাইতে গরীব দেশগুলিকে অর্থায়নের মাধ্যমে করোনাভাইরাস যাতে ব্রিটেনে ফেরত না আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে চাইছে তার সরকার। ব্রিটেন বিশ্বব্যাপী তার বিশেষজ্ঞদেরকে এবং অর্থায়নকে কাজে লাগিয়ে এই রোগের দ্বিতীয়বারের মতো ব্রিটেনে আগমণ বাধাগ্রস্ত করতে চায়। সেই হিসেবে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ব্রিটেন প্রায় ১’শ ৬২ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করার ঘোষণা দেয়। এর মাঝে ৮১ মিলিয়ন ডলার যাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়; যা কিনা এই সংস্থায় চীনের পুরো এক বছরের অর্থায়নের চাইতে বেশি। ৬২ মিলিয়ন ডলার যাবে রেডক্রসের কাছে; যারা তা যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শরনার্থীদের জন্যে ব্যয় করবে। এর মাঝে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী। এর বাইরে আরও ২৫ মিলিয়ন ডলার যাবে আরও কিছু সংস্থা এবং চ্যারিটির কাছে।
   

ঘেব্রেইসাসের নির্বাচিত হওয়াটা কিছুটা নোংড়া প্রতিযোগিতার অংশ ছিল। ঘেব্রেইসাস বলেন যে, ব্রিটেনের প্রার্থীর সমর্থকেরা ঔপনিবেশিক চিন্তা দিয়ে তাকে সমস্যায় ফেলতে চাইছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে একজন প্রার্থী আসুক এটা তারা চাইছে না। ‘উন্নত বনাম উন্নয়নশীল’ দেশের রাজনীতিকে পুঁজি করেই ঘেব্রেইসাস তার সাফল্য পেয়েছেন। পাকিস্তানের প্রার্থী বাদ পড়ে যাওয়ায় এবং তার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ প্রার্থী থাকায় ঘেব্রেইসাস এহেন কথাগুলি বলতে পেরেছেন।



কে এই ঘেব্রেইসাস?

একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও ব্রিটেনের সেটা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেলের ব্যাপারেও মার্কিন এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের রয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। ৫৫ বছর বয়সী তেদ্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস একজন ইথিওপিয়ান রাজনীতিবিদ। জাতিগতভাবে তিগ্রে হবার কারণে তিনি সমাজের এলিট শ্রেণীর অংশ। তাই তার জন্ম বর্তমান এরিত্রিয়াতে হলেও ইথিওপিয়ার শাসক গোষ্ঠীর অংশ হয়ে যান। জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ হলেও ঐতিহাসিকভাবে ইথিওপিয়ার শাসক শ্রেণী এসেছে তিগ্রেদের থেকে। প্রায় ২১ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা মেলেস জেনাউইএর সরকারে ২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ঘেব্রেইসাস। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইথিওপিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। ১৯৯০এর দশকে ব্রিটেন থেকে ঘেব্রেইসাস স্বাস্থ্য বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০১৬ সালের মে মাসে ঘেব্রেইসাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের পদের জন্যে নির্বাচনে অংশ নেবার কথা ঘোষণা করেন। তবে এটা বলাই বাহুল্য যে, এই নির্বাচনে অংশ নেয়াটা ঘেব্রেইসাসের ব্যক্তিগত কোন ইচ্ছা বাস্তবায়ন নয়। এতবড় সংস্থার প্রধানের পদটা সবসময়েই বিশ্বরাজনীতির অংশ। এখানে নিঃসন্দেহেই শক্তিশালী দেশগুলির স্বার্থ জড়িত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের পদের জন্যে নির্বাচন প্রতি ৫ বছরে অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। ‘গ্লোবাল হেলথ নাউ’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। প্রথমে ২০১৭এর জানুয়ারিতে সংস্থাটার ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’এর ১৪০তম সভায় মোট ৬ জন প্রার্থীর মাঝ থেকে তিনজনকে গোপন ভোটের মাধ্যমে ফাইনালিস্ট ঘোষণা করা হয়। ঘেব্রেইসাস ছাড়া বাকিরা হলেন ব্রিটেনের ডেভিড নাবারো এবং পাকিস্তানের সানিয়া নিশ্তার। বাদ পড়ে যান ইতালি, ফ্রান্স এবং হাঙ্গেরির প্রার্থীরা। এরপর একই বছরের মে মাসে ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলির ৭০তম সভায় জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলি গোপনে ভোট দেয় তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে। প্রথম ভোটে কেউ দুই তৃতীয়াংশ বা ৯৮টা ভোট না পেলে সর্বনিম্ন ভোট পাওয়া প্রার্থী বাদ হয়ে যান এবং বাকি দু’জনের মাঝে দ্বিতীয় দফায় প্রতিযোগিতা হয়। গোপনে ভোটাভুটি হওয়া এই সেসনের কোন রেকর্ড না রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সদস্যদেশগুলির। প্রথম দফা ভোটে ঘেব্রেইসাস ৯৫ ভোট পান এবং পাকিস্তানের প্রার্থী বাদ হয়ে যান। দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটিতে ঘেব্রেইসাস পান ১’শ ৩৩ ভোট, এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ প্রার্থী পান ৫০টা ভোট। ব্রিটেনের ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ঘেব্রেইসাসের নির্বাচিত হওয়াটা কিছুটা নোংড়া প্রতিযোগিতার অংশ ছিল। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথএর প্রফেসর ম্যাথিউ কাভানাউ বলছেন যে, স্বাস্থ্য বিষয়টা আসলে রাজনৈতিক। ঘেব্রেইসাস তার পদ পেয়েছেন তার রাজনৈতিক দক্ষতার কারণেই। ইথিওপিয়ার সরকারে থাকার সময় ঘেব্রেইসাস দেশটার স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনলেও মানবাধিকার ইস্যুতে তার সরকারের রেকর্ড মোটেই ভালো ছিল না। নির্বাচনের মাঝেই অভিযোগ উঠে যে, ঘেব্রেইসাস মন্ত্রী থাকার সময়ে ইথিওপিয়াতে কলেরার প্রাদুর্ভাবের তথ্য গোপণ করেছিলেন। ‘কোয়ার্টজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০০৬, ২০০৯ এবং ২০১১ সালে ইথিওপিয়াসহ পুরো পূর্ব আফ্রিকাতেই কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়; যার ফলশ্রুতিতে কয়েক’শ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সোমালিয়া, সাউথ সুদান এবং কেনিয়া কলেরা সংক্রমণের কথা ঘোষণা করলেও ইথিওপিয়া এটাকে ডায়রিয়া বলে চালিয়ে দেয়। ঘেব্রেইসাস এই অভিযোগের জবাব দেন রাজনৈতিকভাবে। তিনি বলেন যে, ব্রিটেনের প্রার্থীর সমর্থকেরা ঔপনিবেশিক চিন্তা দিয়ে তাকে সমস্যায় ফেলতে চাইছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে একজন প্রার্থী আসুক এটা তারা চাইছে না। ‘উন্নত বনাম উন্নয়নশীল’ দেশের রাজনীতিকে পুঁজি করেই ঘেব্রেইসাস তার সাফল্য পেয়েছেন। পাকিস্তানের প্রার্থী বাদ পড়ে যাওয়ায় এবং তার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ প্রার্থী থাকায় ঘেব্রেইসাস এহেন কথাগুলি বলতে পেরেছেন।
  
সংস্থাটা প্রথম থেকেই রাজনৈতিক সংস্থা ছিল; মানবাধিকার সংস্থা নয়। আর এর ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচনের পদ্ধতিও শক্তিশালী দেশগুলি মিলেই ঠিক করেছিল; যাদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রই নেতৃত্ব দিয়েছিল। মার্কিন সরকারের অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণাতে এটা এখন পরিষ্কার যে, এই সংস্থা এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করছে না। আর অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়ন বাড়াবার সিদ্ধান্ত বলে দিচ্ছে যে, ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়া শূণ্যস্থানে বসতে চাইছে।



বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা অস্বচ্ছ সংস্থা

নির্বাচন থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেশিরভাগ কাজকর্মের মাঝেই স্বচ্ছতা নেই। ২০১৯ সালের মে মাসে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক বছরে শুধুমাত্র ট্রাভেল খরচ বাবদ ১’শ ৯২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। যেখানে সংস্থাটা এক বছরে এইডস এবং হেপাটাইটিসএর পিছনে খরচ করেছে ৭১ মিলিয়ন ডলার; ম্যালেরিয়ার পিছনে ৬১ মিলিয়ন ডলার; যক্ষ্মার পিছনে ৫৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সংস্থার সবচাইতে বড় রোগ প্রতিরোধক প্রোগ্রামগুলির চাইতে স্টাফদের ট্রাভেলের পিছনেই বেশি খরচ হচ্ছে। সংস্থার তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল মার্গারেট চ্যান একাই ২০১৫ সালে ট্রাভেলের পিছনে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার ডলার খরচ করেন। ডব্লিউএইচওএর এসেম্বলিতে পাঁচ বছরের জন্যে ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচিত করা ছাড়াও ৩ বছরের জন্যে ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’এর ৩৪ জন সদস্য নির্বাচন করা হয়। এই বোর্ডই ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচনের জন্যে ফাইনালিস্টদের নির্বাচন করে। অর্থাৎ বোর্ড কাউকে বাদ দিয়ে দিলে সে মূল নির্বাচন থেকেই বাদ পড়ে যাবে। অন্যভাবে দেখলে, এই ৩৪ জনই ঠিক করে দিয়েছিলেন যে, ইথিওপিয়া, ব্রিটেন এবং পাকিস্তানের প্রার্থীরা আসেম্বলির কাছে ভোট চাইতে পারবেন। এই ৩৪ জনের ৭ জন আফ্রিকা থেকে, ৬ জন আমেরিকা থেকে, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া থেকে ৩ জন, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া থেকে ৮ জন, উত্তর পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৫ জন, এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে ৫ জন। এতগুলি অঞ্চলের মাঝে নিজের প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের লোক বসাবার ক্ষমতা খুব দেশেরই আছে।

প্রকৃতপক্ষে ২০১৭ সালের আগে কখনোই ডব্লিউএইচওএর ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচিত ব্যক্তি ছিলেন না! সংস্থার ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’ ডিরেক্টর জেনারেলের নাম দিয়ে দিতো। সদস্য দেশগুলির এসেম্বলি শুধু সেই ব্যক্তির নাম অনুমোদন দিতো মাত্র। ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত অনেকেই বহুদিন ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। দ্বিতীয় ডিরেক্টর জেনারেল ব্রাজিলের মার্কোলিনো গোমেজ চানডাউ এই পদে ছিলেন ২০ বছর; তৃতীয়জন ডেনমার্কের হাফদান মাহলার পদে ছিলেন ১৫ বছর; চতুর্থজন জাপানি হিরোশি নাকাজিমা ছিলেন ১০ বছরের জন্যে। ২০০৭ সাল থেকে ১০ বছরের জন্যে আসীন ছিলেন হংকংএর মার্গারেট চ্যান। এর মাঝে নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেম ব্রুন্টলান্ড ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন ১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত। সংস্থাটা প্রথম থেকেই রাজনৈতিক সংস্থা ছিল; মানবাধিকার সংস্থা নয়। আর এর ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচনের পদ্ধতিও শক্তিশালী দেশগুলি মিলেই ঠিক করেছিল; যাদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রই নেতৃত্ব দিয়েছিল। মার্কিন সরকারের অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণাতে এটা এখন পরিষ্কার যে, এই সংস্থা এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করছে না। আর অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়ন বাড়াবার সিদ্ধান্ত বলে দিচ্ছে যে, ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়া শূণ্যস্থানে বসতে চাইছে।

ডব্লিউএইচওএর ব্যর্থতার বহু হিসেব রয়েছে, যেগুলির কারণে কোন ডিরেক্টর জেনারেলকে পদচ্যুত হতে হয়নি। সংস্থার হিসেবে ২০১৭ সালে বিশ্বে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ছিল ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ১১ লক্ষ! এর মাঝে ৬৪ লক্ষ ছিল নতুন রোগী! আর এক বছরে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৪ লক্ষ! এছাড়াও সংস্থার ২০১৮ সালের হিসেবে এক বছরে এইচআইভি এইডসে মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ১১ লক্ষ! এরপর রয়েছে ম্যালেরিয়া। সংস্থার ২০১৭ সালের হিসেবে এক বছরে ম্যালেরিয়াতে বিশ্বব্যাপী ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়! ডেঙ্গুতে প্রতিবছর আক্রান্ত হচ্ছে ৩০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মানুষ! দুই দশকে ডেঙ্গুর সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে ১৫ গুণ! এক বছরেই মৃত্যুবরণ করছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ! ২০১৪ থেকে ২০১৬এর মাঝে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ! প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ লক্ষ লাশের পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়েই ডব্লিউএইচও তার ‘সফলতা’র কথা বর্ণনা করছে। ছোটখাটো সমালোচনা হয়েছে; কিন্তু কেউ অর্থায়ন বন্ধ করার হুমকি দেয়নি। করোনাভাইরাস পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। এই ভাইরাস পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিকে মহাবিপদে ফেলেছে; তাই এর গুরুত্ব এতো বেশি। যক্ষ্মা বা এইডস বা ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু বা ইবোলার কারণে পশ্চিমের কোন কারখানার চাকা বন্ধ হয়নি। তাই বছরে ২০ থেকে ২৫ লক্ষ মরদেহও কাউকে নিজের অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি। বরং এই রোগগুলিকে শক্তিশালী দেশগুলি প্রভাব বিস্তারের ছুতো হিসেবে দেখেছে। এখন সেই প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রের যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছে। চীনের নাম খুব বেশি প্রচারিত হলেও ডব্লিউএইচওএর নিয়ন্ত্রণ কিন্তু চীনের হাতে নয়। বিশ্বের ৩৪টা দেশের ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা আদর্শিক শক্তির কাজ। যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থায় নিজের প্রতিপত্তি হারিয়েছে বলেই অর্থায়ন করতে চাইছে না। অন্যদিকে ব্রেক্সিট-পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় বিভোর ব্রিটেন তার অর্থায়ন বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানটাকে কেড়ে নিতে চাইছে। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব করোনা-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক সংঘাতের একটা শক্তিশালী ইঙ্গিত।


Wednesday 15 April 2020

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাপানের সিদ্ধান্তহীনতা দেশটার চিন্তাগত পরাধীনতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে

১৬ই এপ্রিল ২০২০


জাপানে জরুরি অবস্থা জারি করা হলেও কর্তৃপক্ষ নাগরিকদেরকে বাড়িতে থাকতে এবং সামাজিক দূরত্ব রাখতে ‘অনুরোধ’ করতে পারবে মাত্র। কিন্তু কেউ যদি এই ‘অনুরোধ’ না মানে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীদের লিখে দেয়া এই সংবিধান করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও জাপানকে ভোগাচ্ছে। প্রতিনিয়তই জাপান সরকারকে চিন্তা করতে হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গেলে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর আঘাত আসবে কিনা। জাপানের সংবিধান এই ব্যাপারটাকেই পবিত্র করে রেখেছে।

নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৪ই এপ্রিল জাপানে একদিনে সর্বোচ্চ ১৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর একদিনে ৪’শ ৭৭ জনের মাঝে সংক্রমণ পাবার পরে সর্বমোট সংক্রমণের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। টোকিওতে একদিনে ১’শ ৬১ জন, ওসাকায় ৫৯ জন, ফুকুওকাতে ৩৩ জনের মাঝে ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত জাপানে মোট ৮ হাজার ১’শ ৬১ জন আক্রান্তের মাঝে টোকিওতেই পাওয়া গেছে ২ হাজার ৩’শ ১৯ জন। এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১’শ ৭৩ জনে। এই তিনটা ‘প্রিফেকচার’ বা অঞ্চলেই গত সপ্তাহে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন প্রিফেকচারে স্কুল, রেস্তোঁরা, সমাজসেবা সংস্থা, চাইল্ড কেয়ার হোম, ইত্যাদি সংস্থায় একজন বা একাধিক আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে আরও অনেকজনের আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে বলে জানাচ্ছে ‘জাপান টাইমস’। সাপ্পোরোতে একটা হাসপাতাল থেকে ২৫ জন মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। তবে অনেকেই বলছেন যে, জাপানে জরুরি অবস্থা এসেছে অনেক দেরিতে। এবং কেউ কেউ বলছেন যে, একারণে জাপানকে কড়া মূল্য দিতে হবে।

জাপানের ‘কিয়োদো নিউজ’এর এক জরিপ বলছে যে, ৮০ শতাংশ জনগণ মনে করছেন যে, সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণা অনেক দেরিতে এসেছে। সরকারের সমর্থনও ৫ শতাংশ কমে ৪০ শতাংশে এসেছে। কিয়োটোর দোশিশা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির প্রফেসর নোরিকো হামা সরকারের সমালোচনা করে বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে টুইটারে তার কুকুরের সাথে অন্তরঙ্গ ছবি এবং তার চা খাওয়ার ছবি প্রকাশ করছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তিনি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। সাধারণ মানুষের গভীর অর্থনৈতিক সমস্যাকে তিনি বুঝতেই পারছেন না। ১ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পরেও অনেকেই বলছেন যে, তা এই দুর্যোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। আক্রান্ত জনগণ খুঁজে তাদেরকে নগদে ২ হাজার ৮’শ ডলার করে দেবার সিদ্ধান্ত হলেও অনেকেই বলছেন যে, অন্য দেশের মতো সকল নাগরিককেই এই অর্থ দেবার ব্যবস্থা করা উচিৎ।

  

১৫ই এপ্রিল জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক টাস্ক ফোর্সের রিপোর্টের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, কোন সাবধানতা অবলম্বণ করা না হলে করোনাভাইরাসের কারণে জাপানে ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। টাস্ক ফোর্সের সদস্য হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিরোশি নিশিউরা বলছেন যে, বিপদ এড়াতে হলে বর্তমানে চলমান জরুরি অবস্থার মাঝে মানুষে মানুষে সরাসরি যোগাযোগ ৮০ শতাংশ কমাতে হবে। সরকারি গবেষকেরা বলছেন যে, প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ মানুষের ভেন্টিলেটর দরকার পড়ার মতো খারাপ অবস্থা হতে পারে। জাপানের বার্তা সংস্থা ‘এনএইচকে’ বলছে যে, ৯টা প্রিফেকচারে ইতোমধ্যেই ইমার্জেন্সি বেডের সংখ্যা অপ্রতুলতার দিকে ধাবমান। মেডিক্যাল কর্মীদের ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’ স্বল্পতার কারণে ওসাকা শহরের সরকার নাগরিকদের কাছে নিজেদের ওয়াটারপ্রুফ কোট দান করতে আহ্বান জানিয়েছে। ডাক্তাররা সেখানে ডাস্টবিনের উপরে ব্যবহার করা প্লাস্টিক গায়ে পরিধান করছেন। শহরের কাপড় তৈরি করার কারখানাগুলিকে পিপিই তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছে ওসাকা সরকার। টোকিওর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মিয়েকো নাকাবায়াশি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সরকারের সমালোচনা করে বলেন যে, সরকারের পদক্ষেপ নিতে দেরি হবার কারণে ডাক্তাররা ভীতি নিয়ে কাজ করছেন। আর সরকার যথেষ্ট সংখ্যায় টেস্ট করতে দিচ্ছে না এখনও।

জাপান সরকারের বরাত দিয়ে ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’ বলছে যে, জাপানের ৪৭টা প্রিফেকচারের মাঝে ৪৩টা প্রিফেকচারেই করোনাভাইরাসে বেশি অসুস্থ্য মানুষকে সেবা দেয়ার জন্যে আইসিইউ বেডের স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। মাত্র চারটা প্রিফেকচার - টোকিও, ওকাইয়ামা, ফুকুওকা এবং ওকিনাওয়াতে দরকারের চাইতে বেশি আইসিইউ আছে বলে বলে বলা হচ্ছে। জাপানে মাথাপিছু আইসিইউ বেডের সংখ্যা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কম। ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনলজি ইনফর্মেশন’র হিসেবে প্রতি লাখ জনগণের জন্যে জাপানে রয়েছে ৫টা করে আইসিইউ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে লাখে ৩৫টা; জার্মানিতে ৩০টা; ফ্রান্স ও ইতালিতে ১২টা; স্পেনে ১০টা। বেশি বয়সের মানুষের জন্যে আইসিইউতে থাকাটা খুব বেশি কষ্টকর। জাপানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই সেখানে আইসিইউএর সংখ্যা কম রাখা হয়েছে।



জাপানের মেইজি ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের প্রাক্তন প্রফেসর লরেন্স রেপেটা ‘জাপান টাইমস’এর এক লেখায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন জরুরি অবস্থা জারি করতে জাপানের এতো সময় কেন লেগে গেল। এপ্রিলের ৭ তারিখে টোকিওসহ ৬টা প্রিফেকচারে জরুরি অবস্থা জারি করার জন্যে মার্চ মাসে পরিবর্তন করা ‘নিউ ইনফ্লুয়েঞ্জা স্পেশাল মেজার্স এক্ট’ নামের আইন ব্যবহার করা হয়। জাপানের সর্বমোট ৪৭টা ‘প্রিফেকচার’এর মাঝে ৭টাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তবে এই আইনের অধীনে প্রিকেফচারের গভর্নররা নাগরিকদেরকে বাড়িতে থাকতে এবং সামাজিক দূরত্ব রাখতে ‘অনুরোধ’ করতে পারবে মাত্র। কিন্তু কেউ যদি এই ‘অনুরোধ’ না মানে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তাহলে কেন জাপানের কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের বাধ্য করতে পারলো না? প্রফেসর রেপেটা বলছেন যে, এক্ষেত্রে তিনটা কারণ থাকতে পারে। প্রথমতঃ জাপানের জনগণ অফিশিয়াল ‘অনুরোধ’কে বাধ্যবাধকতা হিসেবেই দেখে। দ্বিতীয়তঃ জাপানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মানদন্ড বেশ শক্ত। আর তৃতীয়তঃ জাপানের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিই ক্ষমতাসীন লিবারাল ডেমোক্র্যাট পার্টির অর্থায়ন করে। লকডাউন করলে এই ব্যবসাগুলিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচাইতে বেশি। তবে এর বাইরেও বড় একটা কারণ হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের লিখে দেয়া জাপানের শান্তিবাদী সংবিধানকে কেউ অবমূল্যায়ন করতে সাহস দেখায়নি, এবং পরিবর্তন করতেও এগিয়ে আসেনি। করোনাভাইরাসের সুযোগে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের কিছু রাজনৈতিক মিত্র চাইছিলো সংবিধানকে পরিবর্তন করে নিতে; কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।

১২ই এপ্রিল জাপানের সবচাইতে উত্তরের হোক্কাইডো প্রিফেকচারে পুনরায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয় বলে জানাচ্ছে ‘কিওদো নিউজ’। এক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকায় কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে তিন সপ্তাহের জরুরি অবস্থা জারি করে ১৯শে মার্চ তা তুলে ফেলা হয়; স্কুলগুলিকে খুলে দেয়া হয় এবং জনসমাগমের অনুমতিও দেয়া হয়। কিন্তু এবারে আবারও ৬ই মে পর্যন্ত স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং জরুরি দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে মানা করা হয়েছে। হোক্কাইডোর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন যেন জাপান সরকারের সিদ্ধান্তহীনতারই সারসংক্ষেপ। জাপান এখনও নিশ্চিত নয় যে, তার কি করা উচিৎ। নিজেদের সংবিধান নিয়েও একটা অনিশ্চয়তা জাপানকে প্রায় দুই দশক ধরে ঘিরে রেখেছে; যা কিনা জাপানের সকল চিন্তাকে প্রভাবিত করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীদের লিখে দেয়া এই সংবিধান করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও জাপানকে ভোগাচ্ছে। প্রতিনিয়তই জাপান সরকারকে চিন্তা করতে হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গেলে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর আঘাত আসবে কিনা। জাপানের সংবিধান এই ব্যাপারটাকেই পবিত্র করে রেখেছে। জনগণকে বাধ্য করার মতো কোন সিদ্ধান্তই সরকার সহজে নিতে পারছে না। অন্যদিকে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে জনগণের আস্থাও হারাতে হচ্ছে সরকারের। বিশ্বযুদ্ধের সাড়ে সাত দশক পেরুলেও রাষ্ট্রচিন্তার দিক থেকে জাপান এখনও অনেকটাই পরাধীন থেকে গিয়েছে।

Tuesday 14 April 2020

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট ভূরাজনৈতিক শূণ্যতা পূরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে তুরস্ক

১৪ই এপ্রিল ২০২০

১০ই এপ্রিল তুর্কিরা বিমানে করে মেডিক্যাল সামগ্রী পাঠায় ব্রিটেনে। তুরস্ক মানবিক সহায়তার রাজনীতিকে উস্কে দেবার পর আমিরাত, কাতার, মিশর, বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশগুলির অগ্রগামী ভূমিকা বিশ্বব্যাপী নতুন ভূরাজনীতির জন্ম দিচ্ছে।

গত পহেলা এপ্রিল তুরস্কের বিমান বাহিনীর ‘এ-৪০০এম’ পরিবহণ বিমান আঙ্কারা ছেড়ে যায়। এর গন্তব্য ছিল ইতালি এবং স্পেন; যারা নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তুর্কি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, বিমানে ছিল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অতি দরকারি মাস্ক, গাউন এবং জীবাণুনাশক, যা কিনা তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারখানাগুলিতে তৈরি হয়েছে। ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইজি ডি মাইও এবং স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাঞ্চা গঞ্জালেজ তুরস্ককে এই সহায়তার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ‘দ্যা ডিফেন্স পোস্ট’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, পহেলা এপ্রিল পর্যন্ত তুরস্কে করোনাভাইরাসে ২’শ ১৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে; আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজারেরও বেশি মানুষ। অর্থাৎ তুরস্ক তার নিজের দেশে মেডিক্যাল সরঞ্জামের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ইতালি এবং স্পেনকে সহায়তা দিয়েছে। ইতালির ১০ বছর বয়সী একটা ছেলে এক ভিডিও বার্তায় তুরস্কের এই সহায়তাকে ধন্যবাদ দেয়, যা কিনা দুর্যোগের মুহুর্তে তুর্কিদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার চিন্তাটাকেই হাইলাইট করেছে। মিলানের এই বাসিন্দা আর্নেস্ত গাব্রিয়েল স্ক্রোচ্চি তার বার্তায় বলে যে, প্রতি পাঁচ মিনিটে একটা করে এম্বুল্যান্সের শব্দ শুনতে শুনতে সে ব্যাথিত। এমন এক সময়েই তুরস্ক ইতালিকে সহায়তা দিয়েছে। তুর্কিদের প্রতি ইতালি কৃতজ্ঞ। তবে স্ক্রোচ্চির আবেগঘন বার্তাই তুরস্কের জন্যে একমাত্র পাওয়া নয়। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটা অংশ এই সহায়তা।

মার্চ মাস জুড়ে চীন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সহায়তা দিয়েছে। কম্বোডিয়াতে তারা পাঠিয়েছে টেস্টিং কিট, ইতালি এবং ফ্রান্সকে দিয়েছে ভেন্টিলেটর, মাস্ক এবং মেডিক্যাল কর্মী; ইরাক এবং ইরানেও পাঠিয়েছে মেডিক্যাল কর্মী। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পেনের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেন যে, ঝড়ের পরেই সূর্য দেখা যায়। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, করোনা দুর্যোগের মাঝে চীন নিজেকে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে বিশ্বের নেতৃত্বে বসাতে চাইছে। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে চীন বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বাড়িয়ে নিতে চাইছে। নিজ দেশে চীন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমিয়ে আনার সাথেসাথেই বিশ্বের প্রতি চীনের বাক্যগুলি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। নিজ দেশে চীন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রায় ‘জয়লাভ’ করার দাবি করছে এবং বাকি বিশ্বকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা দিতে চাইছে। অস্ট্রেলিয়ার ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর রিসার্চ ফেলো নাতাশা কাসাম বলছেন যে, চীনাদের প্রচারমাধ্যম করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘জয়লাভ’এর ইতিহাস লিখেছে, এবং তারা চাইছে যে বিশ্বব্যাপী সকলে তা বিশ্বাস করুক। শি জিনপিং ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টিকে ফোনে বলেন যে, তিনি একটা ‘হেলথ সিল্ক রোড’ তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন। ‘জার্মান মার্শাল ফান্ড’এর সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো নোয়াহ বারকিন বলছেন যে, চীন চাইছে ইউরোপিয়দের নিজেদের মাঝের দূরত্বকে বাড়াতে; আর যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে। একইসাথে শি জিনপিংএর সরকার নিজ জনগণকে বোঝাতে চাইছে যে, চীন নিজ দেশের দুর্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিকে চীনা সরকারের ব্যর্থতাগুলিকে এখন তারা আর আলোচনায় রাখতে চাইছে না। ‘চায়না ডেইলি’র এক প্রতিবেদনে গর্ব করেই লেখা হয় যে বাকি বিশ্বে সংক্রমণের সংখ্যা চীনের সংক্রমণের সংখ্যাকে অতিক্রম করেছে; যা কিনা “ভাগ্য উল্টে যাওয়া”র সাথে তুলনা করা হয়। এই প্রতিবেদনের জবাবে একজন পাঠক লিখেন যে, চীনাদের ঘরে পানির পাইপ ভেঙ্গে যাবার পর তারা প্রতিবেশীদের বাড়ি ডুবিয়ে দিয়েছে। এটাই কি সেই ‘স্বর্ণযুগ’, যার আশা চীনারা করেছিল?
 
বেলগ্রেডের রাস্তায় বিলবোর্ড ঘোষণা করছে কিভাবে “ব্রাদার শি” সার্বিয়ার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চীন এতকাল তার নিজের দেড়’শ কোটি মানুষকে উন্নততর জীবন দেবার জন্যেই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। বিশ্বের মানুষের সমস্যা নিরসনে তার কোন ভূমিকা ছিল না। এখন চীনা মাস্ক এবং ডাক্তাররা চীনের এই অবস্থানকে পরিবর্তন করতে চাইছে।


‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ইউরেশিয়া সেন্টারের সিনিয়র ফেলো দিমিতার বেচেভ বলছেন যে, রাজনীতিতে অনেক সময়ই হুমকি এবং সুযোগ একত্রে আসে। চীনের উদাহরণ দিয়ে বেচেভ বলছেন যে, মার্চের মাঝামাঝি ইতালি এবং স্পেনকে মেডিক্যাল সহায়তা দেবার মাধ্যমে চীন তার ক্ষয়ে যাওয়া প্রতিচ্ছবিটাকে কিছু ঘষামাজা করতে চাইছে। অনেকেই চীনে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব হবার ব্যাপারটাকে হাইলাইট করেছেন; আবার অনেকেই ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিকে চীনা সরকারের অস্বচ্চতা এবং অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করেছেন, যার ফলশ্রুতিতে ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়াতে পেরেছিল। চীন এতকাল তার নিজের দেড়’শ কোটি মানুষকে উন্নততর জীবন দেবার জন্যেই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। বিশ্বের মানুষের সমস্যা নিরসনে তার কোন ভূমিকা ছিল না। এখন চীনা মাস্ক এবং ডাক্তাররা চীনের এই অবস্থানকে পরিবর্তন করতে চাইছে। রাশিয়াও চীনকে অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রে মেডিক্যাল সহায়তা পাঠিয়েছে। অনেক মার্কিনীরাই রুশ এই সহায়তাকে প্রচারণার খাতিরে করা হয়েছে বলেই বলছেন। অন্যদিকে ইতালিতে রুশ সহায়তা পাঠাবার পর ইতালি থেকে কেউ কেউ অভিযোগ করা শুরু করে যে, রুশ মেডিক্যাল কর্মীদের মাঝে ইন্টেলিজেন্সের লোকও এসেছে। একইসাথে সার্বিয়াতে চীনা সহায়তা যাবার পর সার্বিয়ান প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিচ দুঃখ করে বলেন যে, ইউরোপের মাঝে কোন ঐক্য নেই। তিনি বলেন যে, ইউরোপিয়রাই সার্বিয়াকে বলেছিল তাদের টেন্ডারের নিয়ম পরিবর্তন করতে, যাতে ইউরোপিয় কোম্পানিগুলি চীনা কোম্পানির স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। আর এখন ইউরোপের কাছে সার্বিয়ার কোন গুরুত্ব নেই। বেলগ্রেডের রাস্তায় সরকারপন্থী পত্রিকার বিলবোর্ড বসানো হয়েছে, যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে কিভাবে “ব্রাদার শি” সার্বিয়ার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও সার্বয়াতে মেডিক্যাল সহায়তা পাঠিয়েছেন।

চীনারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের উপর মানবিক সহায়তার ভিত গড়ে তুলতে চাইলেও তুরস্ক এদিক থেকে পুরোনো খেলোয়াড়। বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা দেয়াটা সবসময়ই তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির অংশ। বসনিয়া থেকে শুরু করে সোমালিয়া বা আফগানিস্তান পর্যন্ত তুরস্ক মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে অনেক বছর ধরেই। গত নভেম্বরে আলবেনিয়াতে ভূমিকম্পের পর তুরস্ক সেখানে সহায়তা প্রেরণ করে। তুরস্ক ৮ই এপ্রিল বলকানের পাঁচটা দেশে মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাঠায়। তুর্কি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক টুইটার বার্তায় বলে যে, সার্বিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, নর্থ মেসিডোনিয়া এবং কসোভোতে মাস্ক, গাউন এবং টেস্ট সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে। ১০ই এপ্রিল তুর্কিরা আরেকটা বিমানে করে মেডিক্যাল সামগ্রী পাঠায় ব্রিটেনে। ১২ তারিখে দ্বিতীয় বিমানটা যায় ব্রিটেনে। ইউরোপের দেশগুলিতে তুর্কিদের পাঠানো মেডিক্যাল সামগ্রীর বাক্সগুলির উপর লেখা ছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুসলিম সাধক জালালুদ্দিন রুমির কবিতা - নৈরাশ্যতার পরেই রয়েছে অনেক আশা; এবং আঁধারের পরেই রয়েছে অনেক বেশি উজ্জ্বলতর সূর্য। ৯ই এপ্রিল তুর্কি সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ জানায় যে, ইস্রাইলও তুরস্কের কাছে মাস্ক, গাউন এবং গ্লাভস চেয়েছে। এর বিনিময়ে ইস্রাইলি সরকার প্যালেস্টাইনিদের কাছে তুর্কি ত্রাণ যাবার সুযোগ দেবে বলে সমঝোতা হয়েছে। তবে ইস্রাইলি কর্মকর্তারা ইস্রাইলের ‘ইনেত’ পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে প্যালেস্টাইনে ত্রাণ পাঠাবার সমঝোতার কথাটা অস্বীকার করেন।




তুরস্ক মানবিক সহায়তার রাজনীতিকে উস্কে দেবার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ৬ই এপ্রিল ইতালিতে ১০ টন এবং পাকিস্তানে ১১ টন মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাঠায়। এরপর ১০ই এপ্রিল ইউক্রেনে ১১ টন মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাঠায়। এছাড়াও আমিরাত ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, গ্রীক সাইপ্রাস এবং আরও কিছু দেশে সহায়তা পাঠাচ্ছে। ৮ই এপ্রিল ইতালিতে দু’টা ফিল্ড হাসপাতাল পাঠায় কাতার; যার মাধ্যমে মোট ২ হাজার করোনাভাইরাস রুগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে। অপরদিকে নিজেদের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও ইতালিকে সহায়তা দিয়েছে মিশর। মিশরের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হালা জায়েদ নিজে ইতালিতে দু’টা বিমান ভর্তি মেডিক্যাল সরঞ্জাম নিয়ে যান। ১৪ই এপ্রিল এক টুইটার বার্তায় ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রী গ্রেগ হ্যান্ডস বলেন যে, মিশর থেকে বিরাট সংখ্যক মেডিক্যাল গাউন আসছে; যার জন্যে তিনি মিশরকে ধন্যবাদ জানান। মিশরে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ১’শ ৬৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন; সংক্রমিত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি। আর কুয়েতে ১’শরও বেশি মেডিক্যাল কর্মী এবং মেডিক্যাল সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ। মালদ্বীপকেও ত্রাণ সহায়তা দিতে চাইছে বাংলাদেশ।

চীন করোনাভাইরাস থেকে কতটা ‘মুক্ত’ হতে পেরেছে, তা প্রশ্নাতীত না হলেও এই ভাইরাসকে পুঁজি করে শি জিনপিংএর চীন নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব গড়ে তুলতে চাইছে। ভাইরাসের আক্রমণে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের নাজেহাল হবার এই সুযোগে চীনারা এশিয়া, আফ্রিকা ছাড়াও ইউরোপের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা এবং সার্বিয়ার রাস্তায় বিলবোর্ডে শি জিনপিংএর ছবি একটা বড় ভূরাজনৈতিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এমনই সময় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তুরস্ক, এবং তার সাথেসাথে আমিরাত, কাতার, মিশর, বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশগুলির অগ্রগামী ভূমিকা বিশ্বব্যাপী নতুন ভূরাজনীতির জন্ম দিচ্ছে। নিজ দেশে করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যাপক সমস্যায় থাকা এবং মেডিক্যাল সরঞ্জামের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও দেশগুলি অন্যকে সহায়তা দিতে অগ্রসর হয়েছে, যা কিনা করোনাভাইরাসের কারণে ভূরাজনৈতিক শূণ্যতা পূরণের একটা চেষ্টা। সামনের দিনগুলিতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কেউ কিছু বলতে না পারলেও এর ফলশ্রুতিতে অবশ্যম্ভাবী ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনকে কেউ এখন আর অস্বীকার করছেন না।


Monday 13 April 2020

করোনা ঝুঁকির মাঝেও যুদ্ধ চলছে লিবিয়াতে

১৩ই এপ্রিল ২০২০

লিবিয়ার বেশিরভাগ এলাকাই এখন জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনীর হাতে। তবে রাজধানী ত্রিপোলিসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর এখনও ‘জিএনএ’এর নিয়ন্ত্রণে। প্রায় এক বছর চেষ্টার পরেও হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলির নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন আনতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝেও চলছে সামরিক অভিযান।

লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’এর বরাত দিয়ে ‘লিবিয়া হেরাল্ড’ জানাচ্ছে যে, ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত লিবিয়াতে মোট ২১ জন নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রুগী সনাক্ত হয়েছে। এর মাঝে একজন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দু’জন সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। ২৫শে মার্চ লিবিয়ার সরকার যুদ্ধবিদ্ধ্বস্ত দেশটাতে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ খুঁজে পায়, যখন ৭৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শরীরে রোগের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তখন বলা হয় যে, তিনি তিন সপ্তাহ আগে সৌদি আরব থেকে তিউনিসিয়া হয়ে লিবিয়া পৌঁছান। লিবিয়ার পুর্বের জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীন ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’এর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় বেনগাজি শহরেও প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তুরস্ক থেকে ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তিন সপ্তাহ আগে তিউনিসিয়া হয়ে বেনগাজি পৌঁছান। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগের মাঝেও লিবিয়াতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়নি। ৬ই এপ্রিল ত্রিপোলির ‘আল খাদরা জেনারেল হসপিটাল’এর উপর আর্টিলারি হামলা হয়, যার ফলশ্রুতিতে ৬ জন মেডিক্যাল কর্মী আহত হন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকান্ডের মুখপাত্র জ্যান্স লেরকা এক বার্তায় এই হামলার সমালোচনা করে বলেন যে, লিবিয়ার মানুষের যখন নিরাপদ বাড়ি এবং কার্যক্ষম মেডিক্যাল সার্ভিসের সবচাইতে বেশি দরকার, তখনই হাসপাতালে হামলার আরেকটা খবর এলো। লিবিয়ার মেডিক্যাল সার্ভিস এবং কর্মীরা এসময়ে বৈশ্বিক মহামারী মোকাবিলায় অতি গুরুত্বপূর্ণ।

লিবিয়াতে যুদ্ধরত উভয় পক্ষই তাদের সমর্থক দেশগুলি থেকে বেশি করে অস্ত্রের সরবরাহ পাচ্ছে। ডিসেম্বর মাসে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ জানায় যে, সুদান থেকে ৩ হাজার যোদ্ধা ‘এলএনএ’এর পক্ষে যোগ দিয়েছে। এছাড়াও রাশিয়া থেকেও এসেছে ৬’শ ভাড়াটে সেনা। ফেব্রুয়ারি মাসের এক প্রতিবেদনে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডাটার বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘এলএনএ’কে ৮৯টা ফ্লাইটের মাধ্যমে বড় আকারের কার্গো বিমানে করে ৪ হাজার ৬’শ ৮০ টন সাপ্লাই পাঠিয়েছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ এবং ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, ‘জিএনএ’ও তুরস্কের কাছ থেকে জাহাজে করে সাঁজোয়া যান, আর্টিলারি, বিমান বিধ্বংসী কামান এবং ড্রোন পেয়েছে। সিরিয় মিলিশিয়া যোদ্ধাদেরকে সিরিয়া থেকে লিবিয়ায় মোতায়েন করেছে তুরস্ক। অস্ত্রের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে, নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে উভয় পক্ষই। মার্চের শুরুতে হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলি এবং মিসরাতা শহরের উপর অবরোধ আরও কঠোর করলেও তুরস্কের সমর্থন পাবার পর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ‘জিএনএ’ই আক্রমণে যায়।

হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলির উপকন্ঠে পৌঁছে গেলেও আল আজিজিয়াহ এলাকা ‘জিএনএ’এর নিয়ন্ত্রণে থাকায় হাফতারের ত্রিপোলি অপারেশনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একইসাথে ভবিষ্যতে ত্রিপোলির উপকন্ঠে হাফতারের বাহিনীর আটকা পড়ে যাবার সম্ভাবনাও রয়েছে।



২০১৯এর এপ্রিল মাসে নতুন অভিযান শুরুর পর থেকে লিবিয়ার বেশিরভাগ এলাকাই হাফতারের অধীন ‘এলএনএ’ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে ‘এলএনএ’ রাজধানী ত্রিপোলি অধিকার করতে ব্যর্থ হয়। একইসাথে জুন মাসে পাল্টা আক্রমণে ত্রিপোলির ৯৩ কিঃমিঃ দক্ষিণে গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক্যাল শহর ‘ঘারিয়ান’ দখল করে নেয় ‘জিএনএ’। ঘারিয়ানের উত্তরে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার জংশন আল আজিজিয়াহ শহরও ‘জিএনএ’এর হাতে থাকে। ঘারিয়ানের পশ্চিমের জাবাল নাফুসাহ এলাকার ইয়াফরান, আল ঘাওয়ালেশ, কিকলাহ, জাদু, নালুতসহ বেশকিছু শহর ‘জিএনএ’এর নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে ত্রিপোলির পশ্চিমে তিউনিসিয়ার সীমানার কাছাকাছি কিছু এলাকা ‘এলএনএ’এর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর মাঝে রয়েছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘আল ওয়াতিয়াহ’ বিমান ঘাঁটি। এর ফলশ্রুতিতে উত্তরে জুয়ারাহ থেকে দক্ষিণে জাদু শহর পর্যন্ত এবং পূর্বে ঘারিয়ান শহর থেকে পশ্চিমে তিউনিসিয়ার সীমানা পর্যন্ত ‘এলএনএ’এর নিয়ন্ত্রণাধীন একটা ‘পকেট’এর আবির্ভাব হয়, যার দক্ষিণ এবং পূর্বে ‘জিএনএ’এর অধিকৃত অঞ্চল, পশ্চিমে তিউনিসিয়া এবং উত্তরে ভূমধ্যসাগর। ‘এলএনএ’ গত অগাস্টে আবারও ঘারিয়ান শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হলে এই ‘পকেট’টা রয়েই যায়। প্রায় এক বছর ধরে টিকে থাকা এই ‘পকেট’টাই এখন ‘জিএনএ’এর টার্গেট। ‘রাশান ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স কাউন্সিল’এর এক লেখায় কিরিল সেমেনভ এক বিশ্লেষণে বলেন যে, আজিজিয়াহ এবং ঘারিয়ান শহরের নিয়ন্ত্রণ ‘জিএনএ’এর হাতে থেকে যাওয়ায় তা হাফতারের ত্রিপোলি দখল করার চেষ্টাকেই শুধু বাধাগ্রস্ত করবে না, ত্রিপোলিকে অবরোধ করে রাখা হাফতারের বাহিনীকে ঘিরে ফেলার মতো অবস্থায়ও নিয়ে যেতে পারে।

গত ২৫শে মার্চ থেকে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে অবস্থিত ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড’ বা ‘জিএনএ’ সরকারের অধীন বাহিনী ত্রিপোলি অবরোধকারী ‘এলএনএ’এর বিরুদ্ধে নতুন অভিযান শুরু করে। ‘জিএনএ’কে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে তুরস্ক ও কাতার; আর ‘এলএনএ’কে সহায়তা দিচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, সৌদি আরব, জর্দান, রাশিয়া এবং ফ্রান্স। নতুন এই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন পিস স্টর্ম’। এই নামকে অনেকেই সিরিয়াতে তুরস্কের ‘অপারেশন পিস স্প্রিং’ এবং ‘অপারেশন ‘স্প্রিং শিল্ড’এর সাথে তুলনা করছেন। ‘আল মনিটর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ত্রিপোলির কাছের মিতিগা মিলিটারি একাডেমিতে স্থাপিত অপারেশন সেন্টারে এখন তুর্কি সামরিক এবং ইন্টেলিজেন্স অফিসারদের ব্যাপক প্রভাব। এই অপারেশনের লক্ষ্য হলো ত্রিপোলি থেকে ১’শ ৬০ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পশ্চিমে তিউনিসিয়ার সীমানার কাছাকাছি ‘আল ওয়াতিয়াহ’ বিমান ঘাঁটি। ২০১৪ সালের অগাস্ট থেকে এই ঘাঁটি হাফতারের বাহিনীর হাতে রয়েছে। অপারেশনের প্রথম দিনেই ঘাঁটিটা ‘জিএনএ’ হাত করে নেয়। তবে পরদিন হাফতারের সেনারা পাল্টা আক্রমণে এই ঘাঁটি পুনর্দখল করার দাবি করে। আর একইসাথে এর প্রায় ৫০ কিঃমিঃ উত্তরে সমুদ্রউপকূলের কাছে জুয়ারা শহরের বাইরে পৌঁছে যাবার দাবি করে। হাফতারের বাহিনী ৩০শে মার্চ ত্রিপোলির দক্ষিণে একটা তুর্কি নির্মিত ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোন বিমান ভূপাতিত করে এর ছবি প্রকাশ করে। আর পহেলা এপ্রিল ‘এলএনএ’ তুর্কি যুদ্ধজাহাজ থেকে ছোঁড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষের ছবি প্রকাশ করে। তারা বলে যে, উপকূলের কাছাকাছি ‘আল আযাইলাত’ এলাকায় হাফতারের বাহিনীর উপর তুর্কি নৌবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। ছবিতে মার্কিন নির্মিত ‘আরআইএম-৬৬ই’ বা ‘স্ট্যান্ডার্ড এসএম-১’ ক্ষেপণাস্ত্র দেখা যায়, যা কিনা তুরস্কের মার্কিন নির্মিত ৮টা ‘জি-ক্লাস’এর ফ্রিগেট ব্যবহার করে। এছাড়াও লিবিয়াতে তুর্কিরা সিরিয় মিলিশিয়াদের জড়িত করার পর থেকে এদের মাঝেও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি অব হিউম্যান রাইটস’এর হিসেবে লিবিয়াতে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত ১’শ ৮২ জন সিরিয় যোদ্ধা নিহত হয়েছে। সংস্থাটা আরও বলছে যে, ইতোমধ্যেই ৪ হাজার ৭’শ ৫০ জন সিরিয় যোদ্ধাকে লিবিয়াতে পাঠানো হয়েছে। আরও ১ হাজার ৯’শ জন তুরস্কে অবস্থান করছে প্রশিক্ষণের জন্যে।


ঘারিয়ান শহরের পশ্চিমে হাফতার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘পকেট’এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ‘আল ওয়াতিয়াহ’ বিমান ঘাঁটিই বর্তমানে ‘জিএনএ’এর অভিযানের মূল টার্গেট



লিবিয়ায় ‘অপারেশন পিস স্টর্ম’এর বিষদ বর্ণনা দেন তুর্কি নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেতিন গুরকান। লিবিয়ার ‘জিএনএ’ বাহিনী সাম্প্রতিককালে সিরিয়াতে তুরস্কের সামরিক অপারেশনের আঙ্গিকেই তাদের অপারেশনের পরিকল্পনা করে। এই অভিযানের মূলে থাকে কাতাদের অর্থায়নে তুর্কিদের সরবরাহ করা ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোন। এই ড্রোনগুলিকে রক্ষা করার জন্যে লিবিয়াতে মোতায়েন করা হয়েছে তুরস্কের অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক জ্যামার ‘কোরাল’। এই ‘কোরাল’এর কাজ হলো ড্রোনের কাছাকাছি এলাকায় হাফতারের বাহিনীর মোতায়েনকৃত বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের রাডারগুলিকে অকার্যকর করে দেয়া। ছোট এই ড্রোনগুলি ‘এমএএম-এল’ নামের ক্ষুদ্র ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করে এবং অব্যর্থভাবে শত্রুর টার্গেটে হামলা করে। তবে ক্ষুদ্র হওয়ায় এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। ইতোমধ্যেই ‘এলএনএ’এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার ড্রোন হামলায় নিহত হবার খবর আসছে। বেশ কিছুদিন আগে ইস্রাইলের কাছ থেকে কেনা ‘অরবিটার-৩’ ড্রোনও তুরস্ক সরবরাহ করেছে ‘জিএনএ’কে। হাফতারের বাহিনীও আরব আমিরাতের কেনা চীনা ‘উইং লুং-২’ ড্রোন ব্যবহার করছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ১লা এপ্রিল লিবিয়ার উপকূলে টহল দেয়া তুরস্কের নৌবাহিনীর ফ্রিগেট থেকে এমনই একটা ড্রোনকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছিল। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই তুর্কি ‘জি-ক্লাস’এর ফ্রিগেট ‘গোকসু’ এবং ‘গোকোভা’ ত্রিপোলি এবং সাব্রাথার মাঝামাঝি লিবিয়ার উপকূল পাহাড়া দিচ্ছে।


লিবিয়াতে ভূপাতিত তুরস্কের নির্মিত ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোন। সিরিয়ার যুদ্ধের কৌশল অনুসরণ করে এই ড্রোনগুলি লিবিয়ার যুদ্ধের চিত্র দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে।


মেতিন গুরকান বলছেন যে, এখন লিবিয়ার আকাশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার যুদ্ধ চলছে দুই পক্ষের মাঝে। এমতাবস্থায় সমুদ্র থেকে তুর্কি নৌবাহিনীর পক্ষে লিবিয়ার আকাশের নিরাপত্তা দেয়াটা কঠিন হবে। তাই খুব দ্রুতই লিবিয়াতে তুর্কিদের নিজস্ব ‘হিসার-ও’ বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হতে পারে। তুর্কি বিমান বাহিনীর একটা ‘বোয়িং ই-৭টি ওয়েজটেইল’ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান লিবিয়ার উপকূল বরাবর উড়ে আকাশ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা দিচ্ছে। সামরিক বিমানের ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ‘ইতামিল রাডার’ বলছে যে, তুরস্কের ‘কনইয়া’ বিমান ঘাঁটি থেকে ওড়া ‘ওয়েজটেইল’ বিমানগুলি গত বছরের জুন মাস থেকে বেশ নিয়মিতই লিবিয়ার উপকূলে টহল দিচ্ছে।

এটা এখন পরিষ্কার যে, করোনাভাইরাসের কারণে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্যবাধকতা আছে বলে লিবিয়ার যুদ্ধরত পক্ষগুলি মনে করছে না। তুরস্কের সরাসরি সমর্থন পাবার পর থেকে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে ‘জিএনএ’। তবে এতে ত্রিপোলি হারাবার সম্ভাবনা কিছুটা কমলেও যুদ্ধ জেতাটা এখনও বহু দূরে। এদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চাইছে লিবিয়ার উপকূল পাহাড়া দিয়ে লিবিয়ার উপর জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাকে নিশ্চিত করতে। তবে এতে সমুদ্রপথের উপর নির্ভরশীল ‘জিএনএ’ই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরূপ সম্ভাবনা তুরস্ককে ভূমধ্যসাগরে সরাসরি ইইউএর বিরুদ্ধে দাঁড় করাবে। যুক্তরাষ্ট্রও এখন চাইছে না যে, লিবিয়ার তেল বিক্রির অর্থ শুধুমাত্র তুর্কি সমর্থিত ‘জিএনএ’এর কাছে যাক। বর্তমানে তেলক্ষেত্রগুলি হাফতারের বাহিনী অবরোধ করে তেল রপ্তানি বন্ধ করে রেখেছে। ভূমধ্যসাগরে নিজের প্রভাব বাড়াতে তুরস্ক কোন ছাড় দিতে নারাজ। অপরদিকে সৌদি গ্রুপের মিশর ও আমিরাত এবং তার সাথে রাশিয়াও নিজেদের ভাগ ছাড়তে চাচ্ছে না। করোনাভাইরাস ইউরোপকে ভীষণভাবে আক্রান্ত করেছে, যা কিছুদিনের জন্যে হলেও লিবিয়াতে ইউরোপিয় শক্তিদের প্রভাব কমাবে। তবে ভূমধ্যসাগর হলো ইউরোপের দক্ষিণের সীমান্ত; ইউরোপিয়রা অত সহজে এর নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের কাছে ছেড়ে দিতে চাইবে না। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির মাঝেও কেউই চাইছে না লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে। অন্য কথায়, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাঝেও থেমে থাকেনি।