Monday 31 January 2022

পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোতে অভ্যুত্থান … ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলাফল

৩১শে জানুয়ারি ২০২২

বুরকিনা ফাসোর রাস্তায় অভ্যুত্থান সমর্থনকারীদের হাতে লেঃ কর্নেল দামিবার পাশে মালির অভ্যুত্থানকারী নেতার ছবি। পশ্চিম আফ্রিকার প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলিতে তিন অভ্যুত্থানের তিন নেতা বেশ ভালোই জনসমর্থন পাচ্ছেন। সেখানকার সেনা অফিসাররা একসময় শুধুমাত্র ফ্রান্সে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হলেও তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও ট্রেনিং পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে সামরিক বাহিনীগুলি শুধুমাত্র ফ্রান্সের প্রভাবের মাঝে আর নেই। এর মাঝে সেখানে জড়িয়েছে রাশিয়া। রুশরা পশ্চিম আফ্রিকায় রাজনৈতিক প্রভাব না বাড়ালেও সামরিক অভ্যুত্থানের মতোই তারাও ফ্রান্সকে সরিয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে।

 
গত ২৪শে জানুয়ারি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোতে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। বুরকিনা ফাসো এক বছরের মাঝে পশ্চিম আফ্রিকার তৃতীয় দেশ যেখানে অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো। অভ্যুত্থানের নেতা লেঃ কর্নেল পল হেনরি দামিবা তার প্রথম ভাষণে বলেন যে, দেশের প্রেসিডেন্ট রোশ কাবোরে জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা ক্ষমতা নিয়েছেন। সহিংসতায় সেখানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনকে শীর্ষ লক্ষ্য আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন যে, তার সরকার গ্রামাঞ্চল পুনরুদ্ধার করবে এবং ১৫ লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে। ‘সঠিক সময়ে’ তারা দেশকে সাংবিধানিক শাসনে ফেরত নিয়ে আসবেন। সংস্কারে সম্মতি আদায়ের জন্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করবেন বলে জানান তিনি। একইসাথে তার দেশের আগের চাইতে আরও বেশি আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার উল্লেখ করে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুরকিনা ফাসোর সংকট কাটাতে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানান। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, কর্নেল দামিবা তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে কোন কোন দেশ বুঝিয়েছেন, তা বলেননি। এই ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কেননা জঙ্গিবাদ দমনে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিকে সহায়তা দানে প্রাক্তন উপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সাথে রাশিয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি, নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে ফ্রান্সের কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। অত্র অঞ্চলে ফরাসি সামরিক উপস্থিতি জনগণের অপছন্দ। ইতোমধ্যেই ফরাসিরা মালি থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নিচ্ছে; যাদের শূণ্যস্থান পূরণ করছে রাশিয়া। রুশ ভাড়াটে সেনাদের একটা অংশ বুরকিনা ফাসোর অভ্যুত্থান নেতাদের নিরাপত্তা দেয়ার অফার দিয়েছে। ‘বিবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, প্রতিবেশী মালিতে যেমন সামরিক অভ্যুত্থানের পর আঞ্চলিক জোটের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, বুরকিনা ফাসোর ক্ষেত্রেও সেটারই সম্ভাবনা রয়েছে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, অভ্যুত্থান নেতা কর্নেল দামিবা ফ্রান্সের সামরিক একাডেমি থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং ফ্রান্স থেকে অপরাধ বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। এছাড়াও মার্কিন সামরিক বাহিনীর আফ্রিকা কমান্ডের বরাত দিয়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, তিনি ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মাঝে বিভিন্ন মার্কিন সামরিক কোর্স এবং মহড়ায় অংশ নিয়েছেন। তিনি এতদিন জঙ্গিবাদ দমনে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন; এবং সেটার উপর তিনি গতবছর একটা বইও লিখেছেন। অভ্যুত্থানের দু’মাসেরও কম সময় আগে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট কাবোরে দামিবাকে রাজধানী উয়াগাডুগুসহ উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিবাদ দমনে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। গত নভেম্বরে নিরাপত্তা বাহিনীর ৫০ জন সদস্য নিহত হবার পর প্রেসিডেন্টের সেই সিদ্ধান্তকে অনেকেই সামরিক সদস্যদেরকে ঠান্ডা রাখার একটা প্রয়াস হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর এক সূত্র বলছে যে, কর্নেল দামিবা মনে করেন না যে, জঙ্গিবাদের সমস্যা শুধুমাত্র সামরিক অপারেশনের মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।

পশ্চিম আফ্রিকার প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলিতে তিন অভ্যুত্থানের তিন নেতা বেশ ভালোই জনসমর্থন পাচ্ছেন। বুরকিনা ফাসোর রাজধানীতেও শতশত মানুষ অভ্যুত্থানের পক্ষে আনন্দ করেছে। ‘এএফপি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বুরকিনা ফাসোর রাজধানী উয়াগাডুগুর এক শিক্ষক জুলিয়েন ত্রাওরে বলেন যে, এটা তাদের চোখে কোন অভ্যুত্থান নয়। এটা হলো অক্ষম রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত থেকে দেশের স্বাধীন হওয়া। উয়াগাডুগুর রাস্তায় কেউ কেউ রুশ পতাকা নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে উল্লাস করেছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, পার্শ্ববর্তী মালিতে রুশ ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর ভাড়াটে সেনারা নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং সেখানেও অনেকেই রাস্তায় রাশিয়ার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। ১৫টা ইউরোপিয় দেশ এবং কানাডা ডিসেম্বরে এক যৌথ বিবৃতিতে এব্যাপারে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে।

 


২৮শে জানুয়ারি পশ্চিম আফ্রিকার জোট ‘ইকনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ বা ‘একোওয়াস’ তৃতীয় দেশ হিসেবে বুরকিনা ফাসোর সদস্যপদ স্থগিত করে। জোটের জরুরি ভার্চুয়াল বৈঠকে গৃহবন্দী ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টকে অবিলম্বে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও জোটের পক্ষ থেকে বুরকিনা ফাসোর অভ্যুত্থান নেতাদের সাথে আলোচনা করতে একটা প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জোটের বর্তমান চেয়ারম্যান ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আফুকো আদ্দো বলেন যে, এই অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক চিন্তার সাথে যায় না; এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের দিকে চেয়ে আছে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে। বার্তাসংস্থা ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, বুরকিনা ফাসোর উপর আরও কোন অবরোধ দেয়া হবে কিনা, সেব্যাপারে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মালির উপর ইতোমধ্যেই বিমানের ফ্লাইট বন্ধ এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও বিভিন্ন অবরোধ দিয়েছে ‘একোওয়াস’। তবে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, মালি এবং গিনির উপর অবরোধ সেখানকার বাস্তবতা পরিবর্তন করতে পারেনি। ‘একোওয়াস’ মালির অভ্যুত্থানকারীদের সাথে ১৮ মাসের মাঝে নির্বাচন দেয়ার চুক্তি করেছিল; যা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অনেকেই ‘একোওয়াস’এর সমালোচনা করেছেন। মালির সামরিক নেতৃত্ব নিরাপত্তা পরিস্থিতির বরাত দিয়ে চার বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। বুরকিনা ফাসোর ব্যাপারেও ভিন্ন কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম দেখা যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

সামরিক অভ্যুত্থানের পরেও ফুটবল খেলার জন্যেই আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বুরকিনা ফাসোর নাম আসছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, মিডিয়ার কাছে আফ্রিকার অভ্যুত্থানগুলি অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল তো ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, নতুন বছরে সামরিক অভ্যুত্থান ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়াতে পারে! ১৭ মাসের মাঝে পশ্চিম আফ্রিকায় চতুর্থ অভ্যুত্থানের পটভূমি মূলতঃ ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশের এলাকাগুলিতে ফ্রান্সের প্রভাব প্রতিদিনই কমছে। জঙ্গিবাদ দমনে ফরাসিরা প্রথমে মালিতে সেনা মোতায়েন করলেও সহিংসতা এখন পুরো পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েছে; এবং যুদ্ধ বন্ধের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল থেকে ফরাসি সেনা সরিয়ে নেয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি হওয়ায় সেই শূণ্যস্থান পূরণের প্রতিযোগিতা চলছে। সেখানকার সেনা অফিসাররা একসময় শুধুমাত্র ফ্রান্সে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হলেও তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও ট্রেনিং পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে সামরিক বাহিনীগুলি শুধুমাত্র ফ্রান্সের প্রভাবের মাঝে আর নেই। এর মাঝে সেখানে জড়িয়েছে রাশিয়া। রুশরা পশ্চিম আফ্রিকায় রাজনৈতিক প্রভাব না বাড়ালেও সামরিক অভ্যুত্থানের মতোই তারাও ফ্রান্সকে সরিয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে।

Sunday 30 January 2022

ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলি বিভক্ত কেন?

৩১শে জানুয়ারি ২০২২

কানাডিয় সেনাসদস্য ইউক্রেনিয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন পশ্চিমা আদর্শকে কাবুল বিমান বন্দরে রেখে এসেছে, তখন ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেবে না, সেটাই স্বাভাবিক। ব্রিটেনও বলছে যে, তারাও ইউক্রেনে সরাসরি যুদ্ধ করবে না। তথাপি ইউক্রেন সীমান্তে পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষার দায়িত্ব কেবল ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার ব্রিটেন এবং কানাডাকেই যেন নিতে হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনকে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে মানা করছেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে সামরিক সহায়তা দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ ইউক্রেনকে রক্ষা নয়, বরং ইউক্রেনের ধ্বংসস্তূপের মাঝেই পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষার ‘পবিত্র’ দায়িত্ব পালন করবে।

পূর্ব ইউরোপে সামরিক শক্তি মোতায়েনের ঘোষণা দেয়ার পরদিন ৩০শে জানুয়ারি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস ‘বিবিসি’কে বলেন যে, তার দেশ ইউক্রেনে হামলা হলে রাশিয়ার উপর অবরোধের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে; যার অধীনে বিভিন্ন রুশ আর্থিক ও জ্বালানি কোম্পানিও থাকবে। রাশিয়ার আগ্রাসনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি মত দেন। তিনি বলেন যে, একারণেই রুশ হামলা মোকাবিলায় কূটনীতির পাশাপাশি ডিটারেন্স তৈরি করার জন্যে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। ‘স্কাই নিউজ’এর সাথে আরেক সাক্ষাতে তিনি ব্রিটেনে রুশ বিলিয়নায়ারদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন রুশ হামলার ব্যাপারে যতটা নিশ্চিত, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি ততটা নন। জেলেন্সকির কথায়, রাশিয়া ‘মনস্তাত্বিক চাপ’ প্রয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি পশ্চিমা দেশগুলিকে আতঙ্ক ছড়াতে মানা করেন; কারণ তা ইউক্রেনের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অপরদিকে ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র ফ্রান্স, জার্মানি এবং নরওয়ে মনে করছে যে, কূটনীতির মাধ্যমে একটা ছাড় দেয়ার পদ্ধতি বের হবেই। একইদিনে রুশ নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান নিকোলাই পাত্রুশেভ ইউক্রেনে রুশ হামলার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়ে বলেন যে, রাশিয়া যুদ্ধ চায় না। রুশ হামলার সম্ভাবনার মুখে পশ্চিমা দেশগুলির মাঝে মতবিরোধ এখন পরিষ্কার। পশ্চিমাদের মাঝে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনই ইউক্রেনে তাদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পরিবারকে সরিয়ে নেবার নির্দেশনা দিয়েছে।

ন্যাটোর মাঝে ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্রিটেনের অবস্থান বাকি ইউরোপ থেকে পুরোপুরি আলাদা। এক সপ্তাহের মাঝেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে কথা বলবেন বলে আশা করা হচ্ছে; এবং তিনি অত্র অঞ্চলের দেশগুলিতে ভ্রমণ করবেন বলেও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ট্রাসও রাশিয়া এবং ইউক্রেন সফর করবেন। ব্রিটিশ সরকার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’কে স্বল্প সময়ের নোটিশে মোতায়েন করার জন্যে প্রস্তুত রেখেছে। তবে পররাষ্ট্র সচিব ট্রাস বলেছেন যে, ব্রিটিশ সেনাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তারা হামলা মোকাবিলায় ইউক্রেনের ২০ হাজার সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে, এবং দেশটার নৌবাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে। এই মুহুর্তে পূর্ব ইউরোপের এস্তোনিয়াতে ৯’শ ব্রিটিশ সেনা, পোল্যান্ডে দেড়’শ এবং ইউক্রেনে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে ১’শ সেনা মোতায়েন রয়েছে। বল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়াতে আর্টিলারি রকেট মোতায়েন ছাড়াও কৃষ্ণ সাগরে দু’টা যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে ব্রিটেন। রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়ার আকাশসীমার নিরাপত্তা দিতে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জনসন বলছেন যে, পূর্ব ইউরোপে অতিরিক্ত সামরিক শক্তি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নরডিক এবং বল্টিকে বন্ধু রাষ্ট্রগুলির প্রতি ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতি রাখার লক্ষ্যে।

ব্রিটেনের মতো একই ধারায় রয়েছে কানাডা। উভয় দেশই আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছে। অর্থাৎ ব্রিটেনের মতোই, জাতীয় স্বার্থ নয়, বরং পশ্চিমা আদর্শকে সমুন্নত রাখাকেই কানাডা প্রাধান্য দিচ্ছে। ইউরোপ বিভাজিত হলেও কানাডায় ইউক্রেনের পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অন্তর্গত কানাডার জাস্টিন ট্রুডোর লিবারাল সরকার ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা না করলেও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিচ্ছে। ২৬শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ঘোষণা দেন যে, ইউক্রেনে ‘অপারেশন ইউনিফাইয়ার’এর অধীনে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ২’শ কানাডিয় সেনার সাথে আরও ৬০ জন অতি শীঘ্রই যোগ দিচ্ছে। তিনি তার মন্ত্রীসভার সাথে বৈঠকের পর বলেন যে, সৈন্যসংখ্যা ৪’শ পর্যন্ত যেতে পারে। কানাডার সরকার ইউক্রেনকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মেটাল ডিটেক্টর, থার্মাল বাইনোকুলার, লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার, সার্ভেইল্যান্স প্রযুক্তি এবং মেডিক্যাল সরঞ্জাম দিচ্ছে। এছাড়াও কানাডার ইলেকট্রনিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘কমিউনিকেশন্স সিকিউরিটি এস্টাবলিশমেন্ট’ ইউক্রেনের ইলেকট্রনিক এবং সাইবার নিরাপত্তায় সহায়তা দিচ্ছে। এই সহায়তাগুলির মূল্যমান প্রায় ২’শ ৬৬ মিলিয়ন ডলার। এছাড়াও কানাডা ইউক্রেনকে ৩৯ মিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা এবং ৯৪ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়া ছাড়াও কূটনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করেছে। কানাডার ‘সিবিসি নিউজ’ বলছে যে, এ পর্যন্ত ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ছাড়াও ছোট্ট বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়া অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে। বিরোধী কনজারভেটিভ দল ইউক্রেনকে অস্ত্র দেয়ার জন্যে সরকারের উপর চাপ দিচ্ছে। তারা আরও চাইছেন যে, ২০১৪ সাল থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের সরকার ইউক্রেনকে স্যাটেলাইট ইমেজ দিয়ে যে সহায়তা দিচ্ছিলো, তা আবারও চালু করা হোক। কানাডায় বসবাসরত ১৩ লক্ষ ইউক্রেনিয়ানের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ‘ইউক্রেনিয়ান ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস’ও ইউক্রেনকে অস্ত্র দেয়ার জন্যে লবিং করছে।

ইউক্রেন উত্তেজনার মাঝে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে কথা বলবেন। উদ্দেশ্য হলো, রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র গ্যাসের জন্যে রাশিয়ার উপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। জার্মানি রুশ গ্যাসের উপর সবচাইতে বেশি নির্ভরশীল থাকায় তারা ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধের কথা বললেও ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেবার পক্ষপাতি নয়। যেখানে ব্রিটেন এবং কানাডা পশ্চিমা আদর্শিক লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে, সেখানে জার্মানি তার জাতীয় স্বার্থকে জ্বলাঞ্জলি দিয়ে এগুতে চাইছে না। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সাথে এক সাক্ষাতে ন্যাটোর প্রত্যুত্তরকে ‘আদর্শ দ্বারা প্ররোচিত’ বলে আখ্যা দেন। ল্যাভরভ মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং কানাডার আদর্শিক অবস্থানকে লক্ষ্য করেই কথাগুলি বলেছেন। শুধুমাত্র পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার সীমান্তে ছোট্ট দেশগুলিই এদের সাথে রয়েছে। ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো বড় ইউরোপিয় শক্তিরা সরাসরি নিজেদেরকে জড়াতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন পশ্চিমা আদর্শকে কাবুল বিমান বন্দরে রেখে এসেছে, তখন ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেবে না, সেটাই স্বাভাবিক। ব্রিটেনও বলছে যে, তারাও ইউক্রেনে সরাসরি যুদ্ধ করবে না। তথাপি ইউক্রেন সীমান্তে পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষার দায়িত্ব কেবল ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার ব্রিটেন এবং কানাডাকেই যেন নিতে হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনকে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে মানা করছেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে সামরিক সহায়তা দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ ইউক্রেনকে রক্ষা নয়, বরং ইউক্রেনের ধ্বংসস্তূপের মাঝেই পশ্চিমা আদর্শকে রক্ষার ‘পবিত্র’ দায়িত্ব পালন করবে।

Wednesday 26 January 2022

ইউক্রেন নিয়ে যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী?

২৬শে জানুয়ারি ২০২২

জানুয়ারি ২০২২। ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়ায় রুশ সৈন্য। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলি থেকে দূরে রাখতেই হুমকি দিচ্ছেন, ইউক্রেনকে দখল করতে নয়; কারণ পশ্চিমা ঘেঁষা ইউক্রেনই রাশিয়ার জন্যে হুমকি।

 
ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর প্রতিমন্ত্রী জেইমস হিপ্পে ২৫শে জানুয়ারি ‘দ্যা সান’ পত্রিকার এক লেখায় বলেন যে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে ইন্টেলিজেন্স রয়েছে যে, রুশ সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত বহু ব্যক্তি এই মুহুর্তে ইউক্রেনের ভেতরে অবস্থান করছে। এর আগে ২২শে জানুয়ারি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেন যে, ক্রেমলিন ইউক্রেনে একটা রুশ সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের উপর রুশ হামলার আশংকায় পশ্চিমা দেশগুলি ইউক্রেনকে প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করছে। এই অস্ত্রের মাঝে রয়েছে ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, গ্রেনেড লঞ্চার, মেশিন গান, গোলাবারুদ, ইত্যাদি। এগুলি রুশ সামরিক আগ্রাসন থামাতে না পারলেও রাশিয়ার জন্যে সামরিক অপারেশনকে আরও কঠিন করে ফেলবে। রুশ হুমকির প্রত্যুত্তরে ন্যাটো সদস্যদেশগুলি বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়াতে যুদ্ধবিমান মোতায়েন ছাড়াও রোমানিয়াতে সৈন্য বৃদ্ধি এবং কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করছে। তবে রাশিয়াও তার সামরিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করে চলেছে। ইউক্রেনের পূর্ব সীমানায় ১ লক্ষ সেনা মোতায়েন ছাড়াও উত্তরের সীমানায় বেলারুশের সাথে যৌথ মহড়ার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনে সাইবার হামলার জন্যেও রুশদেরকে দায়ী করা হচ্ছে। যুদ্ধের শংকায় ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গকে সরিয়ে নেবার আদেশ দেয়া হয়েছে।

ইউক্রেন ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া কে কিভাবে দেখছে?

মার্কিন মিডিয়া ‘সিবিএস’এর সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই বলে আসছে যে, যদি রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসান চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ একত্রে দ্রুত এবং মারাত্মক প্রত্যুত্তর দেবে। তিনি আরও বলেন যে, ইউক্রেন বা অন্য কোন দেশে সেনা না পাঠিয়ে রাশিয়া যদি ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’, সাইবার হামলা বা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করে, তাহলেও তিনি আত্মবিশ্বাসী যে ইউরোপিয় মিত্রদেরকে একত্রিত করে দ্রুত প্রত্ত্যুত্তর দেবেন তারা। তবে এই প্রত্যুত্তরের মাঝে মার্কিন সেনা মোতায়েন থাকবে কিনা, সেব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ব্লিংকেন অর্থনৈতিক অবরোধ ছাড়াও ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়া এবং ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার কথা বলেন। তিনি ‘সিএনএন’কে বলেন যে, ন্যাটো বাস্তবসম্মত এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে; যার মাঝে সামরিক অপশনও থাকবে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার কি স্বার্থ রয়েছে? রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের গুরুত্বই বা কতটুকু? যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ভার্চুয়াল টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘ম্যাককুইস্টিয়ন টিভি’র সাথে এক সাক্ষাতে ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, সপ্তদশ শতাব্দীর পর থেকে পশ্চিম থেকে রাশিয়া চারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে; দক্ষিণ থেকে আক্রমণ হয়েছে দু’বার। রাশিয়ার অস্তিত্ব নির্ভর করছে এই সীমানাগুলির উপর। এই সীমানাগুলিকে শক্তিশালী করতে রাশিয়া পশ্চিমে পোল্যান্ড ও বেলারুশের সমতলভূমি, আর দক্ষিণে ককেশাস এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে মূলতঃ ইউক্রেন। ইউক্রেন যদি পশ্চিমা ঘেঁষা না হতো, তাহলে রাশিয়ার কোন সমস্যা ছিল না। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া এব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলোনা বলেই তারা ইউক্রেনে জড়িয়েছে।

 
সপ্তদশ শতাব্দীর পর থেকে পশ্চিম থেকে রাশিয়া চারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে; দক্ষিণ থেকে আক্রমণ হয়েছে দু’বার। রাশিয়ার অস্তিত্ব নির্ভর করছে এই সীমানাগুলির উপর। এই সীমানাগুলিকে শক্তিশালী করতে রাশিয়া পশ্চিমে পোল্যান্ড ও বেলারুশের সমতলভূমি, আর দক্ষিণে ককেশাস এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে মূলতঃ ইউক্রেন। ইউক্রেন যদি পশ্চিমা ঘেঁষা না হতো, তাহলে রাশিয়ার কোন সমস্যা ছিল না। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া এব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলোনা বলেই তারা ইউক্রেনে জড়িয়েছে।

কে কি করতে পারে?

মার্কিন থিংকট্যাংক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রেসিডেন্ট ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খুব সম্ভবতঃ তার কমান্ডারদের কাছ থেকে ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে এর মানে এই নয় যে, তিনি হামলা করবেন। তিনি তার অপশনগুলি খোলা রাখতে চাইছেন। তবে কূটনৈতিক দিক থেকে সফলতা না আসলে হয়তো উত্তেজনা আরও বাড়বে। তিনি বলছেন যে, তিনি মনে করতে পারেন না যে, সাম্প্রতিক সময়ে কবে কোন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মার্কিন রাজনীতিবিদেরা এতটা একমত হতে পেরেছিল। রুশ দাবিগুলি মার্কিন রাজনৈতিক মতামতকে একত্রিত করেছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, মার্কিন নীতি সফল হবে। কারণ ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়া যতটা চিন্তিত, মার্কিনীরা ততটা চিন্তিত নয়। ইউরোপের উপর রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রভাব যতটা রয়েছে, তার কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নেই। এর ফলশ্রুতিতে ইউক্রেনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে খুব কম বাধাই রয়েছে। তবে সারা বিশ্বের ‘পুলিশম্যান’ থাকার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে অনীহা দেখিয়েছে, তাতে মার্কিনীদের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা কোয়ালিশন তৈরি করা কঠিন হবে। তিনি পরিষ্কার করে দেন যে, যদিও অনেকেই সোশাল মিডিয়াতে ‘স্ট্যান্ড উইথ ইউক্রেন’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে, তথাপি এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলি ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিতে পারে, কিন্তু সরাসরি ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার যুদ্ধ, বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার কোন সম্ভাবনা নেই বলে তিনি বলেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’এর এক লেখায় জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনের উপর সামরিক হামলার প্রস্তুতি নিয়েও হামলা না করে বরং আলোচনা করতে চাইছে। রাশিয়া দাবি করছে যে, ন্যাটো ইউক্রেনকে যেন কখনোই সদস্য হিসেবে গ্রহণ না করে; এবং ন্যাটো যেন রাশিয়ার সীমানায় অস্ত্র মোতায়েন নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়া এমন একটা দাবি করেছে, যা তারা খুব ভালো করেই জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র সেব্যাপারে কিছুতেই রাজি হবে না। কারণ এতে করে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। চাপের মুখে রাশিয়ার কাছে নতি স্বীকার করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একেবারেই সমীচিন নয়। ফলাফল হিসেবে এর প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী। অভ্যন্তরীণভাবেও তা যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে, যা কিনা মার্কিন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সামরিক মিশনের প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকার মানে হয় না। কারণ প্রতি মুহুর্তে ন্যাটো ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে; এবং রাশিয়ার জন্যে মিশনটা প্রতি মুহুর্তে কঠিনতর হচ্ছে। তাহলে রাশিয়া কি পুরো কাজটাই করছে তথ্যযুদ্ধ হিসেবে? কিন্তু সমস্যা হলো, আরেকটা দেশে সামরিক হামলা করলে জনমত নিজের পক্ষে নিয়ে আসাটা বেশ কঠিন। হামলা করার সবচাইতে ভালো সময়টাতে হামলা না করে বসে থেকে হামলার হুমকি দেয়ার অর্থ হলো, রাশিয়া আসলে ইউক্রেনে হামলা করতে চায় না। যুদ্ধ করার নিয়ম হলো, সর্বোচ্চ সুবিধাজনক পর্যায়ে হামলা করা; এবং শত্রুকে কোন সুবিধা না দেয়া। আর কূটনীতির নিয়ম হলো, সমঝোতায় পৌঁছাবার আগে যথেষ্ট হুমকি দেয়া।

 
নভেম্বর ২০২১। ইউক্রেনের বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদ। যদিও অনেকেই সোশাল মিডিয়াতে ‘স্ট্যান্ড উইথ ইউক্রেন’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে, তথাপি এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলি ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিতে পারে, কিন্তু সরাসরি ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার যুদ্ধ, বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার কোন সম্ভাবনা নেই। 

ইউক্রেনের ব্যাপারে ইউরোপের অনৈক্য

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথে কথা বলার পর ২৫শে জানুয়ারি পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে বলেন যে, ইউরোপের কিছু দেশ রাশিয়ার গ্যাসের উপর প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল হবার কারণে রাশিয়ার উপর মারাত্মক কোন অর্থনৈতিক অবরোধের ব্যাপারে চিন্তিত। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জনসন মূলতঃ জার্মানিকেই বোঝাচ্ছিলেন। তিনি আরও বলেন যে, তাদের এখন কাজ হলো চিন্তিত রাষ্ট্রগুলিকে বুঝিয়ে যতদূর সম্ভব নিয়ে যাওয়া; যাতে করে রাশিয়ার উপর একটা শক্ত অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়া যায়। জনসন বলেন যে, রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আন্ত ব্যাংকিংএর মানি ট্রান্সফার ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে বের করে দেয়া যায় কিনা, সেব্যাপারে মিত্র দেশগুলির মাঝে কথা হলেও সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়। আর এব্যাপারে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ইতোমধ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। জনসন বলেন যে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ রুশ ব্যক্তিত্ব এবং কোম্পানির উপরেই মূলতঃ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে। একইসাথে তিনি বলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে ব্রিটেন পূর্ব ইউরোপে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। ‘নিউজউইক’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে চাইছে না। তাদের কথা বলা হলো, এটা ইউক্রেনের জন্যে সহায়ক হবে না। বার্লিন এর বদলে ইউক্রেনকে মেডিক্যাল সহায়তা দিতে চাইছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, জার্মানির অবস্থান ঐক্যের বিরুদ্ধে এবং এতে পুতিন ইউক্রেনে নতুন করে হামলা করতে আগ্রহী হবেন। কিন্তু ব্লিংকেন ‘এনবিসি’কে বলেন যে, জার্মান চ্যান্সেলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার সাথে একমত এবং দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারেও যে তারা একমত, সেব্যাপারেও তার কোন সন্দেহ নেই।

তবে ফ্রীডম্যান বলছেন যে, ইউরোপ রাশিয়ার ব্যাপারে একমত নয়। ইউরোপিয়রা শত শত বছর ধরে শুধু যুদ্ধই করেছে। এখনও সেই প্রতিদ্বন্দ্বিত বিদ্যমান। জার্মানি চাইছে রাশিয়ার অর্থনৈতিক পশ্চাতগামীতাকে নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে। অপরদিকে পোল্যান্ড মনে করছে যে, তারা ১৯৩৯ সালে দেখেছে যে কিভাবে জার্মানি এবং রাশিয়া পোল্যান্ডকে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ফ্রান্স আবার মনে করছে এই সুযোগে জার্মানিকে সরিয়ে দিয়ে ইউরোপকে নিজেদের প্রভাবে নিয়ে আসা যায় কিনা। ইউরোপ এবং ন্যাটোর দেশগুলির মাঝে দ্বন্দ্বের সুযোগটাই রাশিয়া নিতে চাইছে। তবে এই মুহুর্তে দুনিয়ার অপর প্রান্তে চীন নিজের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাশিয়ার দিকে সকলের চোখ যাচ্ছে।

ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের অবস্থানের একটা গুরুত্ব রয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ডিরেক্টর ক্রিস মিলার এক লেখায় বলছেন যে, বিভিন্ন সময়ে উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ মান্য করা নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চলেছে। চীন অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে অবরোধ মান্য করতে বাধ্য হয়েছে; যা কিনা চীনের দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ইস্যুতে পশ্চিমারা রাশিয়ার উপর যে অবরোধ দিয়েছিল, তা খুব একটা কঠোর ছিল না। চীন এবং রাশিয়ার বাণিজ্য সম্পর্কের উপর এই অবরোধের প্রভাব ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এবারে যে সেটার ব্যতিক্রম হবে, তা নিশ্চিত। এবারে চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ মেনে নেয়, তাহলে সকলের চোখেই চীনের অর্থনৈতিক শক্তি যথেষ্ট দুর্বল মনে হবে; আর যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক শক্তিও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার চাইতে রাশিয়ার অর্থনীতি অনেক বড়। তাই ঐ দুই দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কর্তনের জন্যে ক্ষতি খুব কম হলেও রাশিয়ার বেলায় সেটা হবে না। রাশিয়ার উপর অবরোধ চীনের অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একারণেই এবারে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক কর্তনে রাজি নাও হতে পারে। যদি চীন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে রাশিয়া তার দুর্যোগের মাঝে অনেক বড় একটা বন্ধু পাবে; আর পশ্চিমাদেরকেও একত্রে দুই ফ্রন্টে আর্থিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।

ধোঁকা না সত্যিকারের হুমকি?

ইউক্রেন রাশিয়ার জন্যে অস্তিত্বের প্রশ্ন; অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে এটা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। যদিও আফগানিস্তান থেকে পলায়নের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর দুনিয়ার ‘পুলিশম্যান’ থাকতে চাইছে না, তথাপি রাশিয়ার দাবির কাছে নতি স্বীকার করে বাকি বিশ্ব, বিশেষ করে চীনের কাছে একটা উদাহরণ তৈরি করতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের অনৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা কোয়ালিশন তৈরি করতে হিমসিম খাচ্ছে। তবে রাশিয়ার হামলা বাস্তবতায় রূপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ঐকমত্য তৈরি করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলি থেকে দূরে রাখতেই হুমকি দিচ্ছেন, ইউক্রেনকে দখল করতে নয়; কারণ পশ্চিমা ঘেঁষা ইউক্রেনই রাশিয়ার জন্যে হুমকি। পুতিন হয়তো তার হুমকিকে শক্ত ভিত দিতেই সামরিক পরিকল্পনার ব্যাপারে যত্নবান হয়েছেন; যাতে তার আগ্রাসী ইচ্ছাটাই পশ্চিমাদের চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু তার দাবিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন অবাস্তব মনে করছে, তখন পুতিন কি বাধ্য হবেন সামরিক মিশনে যেতে? তাতে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র কিছু না হারালেও রাশিয়া যথেষ্টই ক্ষতির মুখে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকেও রাশিয়ার কাছ থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করবে; যদিও এবারে চীন রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ নাও মানতে পারে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে সামরিক মিশনে যেতে বাধ্য করতে পারলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে অনেক বড় কৌশলগত বিজয়; যা কিনা তার আফগানিস্তানে দুই দশকের ব্যর্থতাকে ভুলতে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।

Sunday 23 January 2022

‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কি একটা দিবাস্বপ্ন?

২৩শে জানুয়ারি ২০২২

পশ্চিমা আদর্শের অধঃপতনের ফলস্বরূপ ব্রিটেনের নাগরিকেরা যখন নিজেদের স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে সামরিক বাহিনীতে যেতে ইচ্ছুক নয়, তখন সামরিক বাহিনী আকারে ছোট হতে থাকলেও প্রযুক্তির কারণে তার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এহেন বক্তব্য হয়তো সেই চিন্তাটার অবাস্তবতাকে ঢেকে রাখার জন্যেই। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের চিন্তাটাও সেই আঙ্গিকে দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

 
ব্রিটেনের বৈশ্বিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘এমএই ৬’এর নতুন প্রধান অনেকটা নিয়ম ভেঙ্গেই জনসন্মুখে এসে কথা বলছেন। ২০২১এর ডিসেম্বরে সংস্থার প্রধান রিচার্ড মুর ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক অনুষ্ঠানে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের ভূমিকা নিয়ে এক বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন যে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এখন ঠিকমতো কাজ করছে না এবং বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীরা আগের চাইতে বেশি আত্মবিশ্বাসী; তারা কম বাধার সন্মুখীন হচ্ছে; এবং তারা আগের চাইতে বেশি সম্পদ কাজে লাগাতে পারছে। একারণেই তারা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার দুর্বলতাগুলিকে কাজে লাগাচ্ছে। তিনি রাশিয়া, চীন, ইরান এবং সন্ত্রাসবাদকে তাদের বড় ফোকাস বলে উল্লেখ করেন। একইসাথে জলবায়ু পরিবর্তন এবং মহামারির মতো বৈশ্বিক সমস্যাও রয়েছে। তিনি চীনের প্রভাব বিস্তারকে ‘এমআই ৬’এর সবচাইতে বড় প্রাধান্য হিসেবে আখ্যা দিলেও চীনের সাথে বৈশ্বিক ইস্যু এবং বাণিজ্যের ব্যাপারে সহযোগিতার কথা বলেন। কারণ চীনের কর্মকান্ড এবং নীতি অনেক ক্ষেত্রেই ব্রিটেনের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। তিনি আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে, রাশিয়ার কর্মকান্ডকে, বিশেষ করে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্যে সকলকে আহ্বান জানান। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া, লেবানন এবং ইরাকে ইরানের প্রভাব বিস্তারের কথা উল্লেখ করেন; এবং এর ফলে ব্রিটেন এবং ব্রিটেনের বন্ধু রাষ্ট্রদের প্রতি হুমকিকে মোকাবিলায় সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। এছাড়াও আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ব্রিটেনের কাজ করার কথা বলেন তিনি। প্রতিটা বিষয়েই তিনি নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। মুরের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, একুশ শতকে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় ব্রিটেন একটা বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজের নামকে সামনে আনতে চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেনের এই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ে সমন্বিত নীতিপত্র প্রকাশের পর থেকে ব্রিটেনের লক্ষ্যকে অনেকেই অতি উচ্চাভিলাসী বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় ব্রিটেনের ‘ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ’এর সামরিক বিষয়ের শিক্ষক ক্রিস মরিস বলছেন যে, ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দ দেশের সম্পদের অপ্রতুলতাকে বিবেচ্য বিষয় না ধরে বরং বৈশ্বিক বাস্তবতাকে নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করছে। ফলশ্রুতিতে ব্রিটেন যা করতে চাইছে, তার জন্যে যথেষ্ট শক্তি সে যোগাড় করতে পারছে না। একারণে ব্রিটেন তার সামরিক শক্তির কিছু অংশকে শক্তিশালী করতে গিয়ে বাকিগুলিকে একেবারেই কমিয়ে ফেলছে। বিশেষ করে বলা হচ্ছে যে, কিছু সামরিক শক্তিকে কমিয়ে ফেলে অর্থ বাঁচিয়ে সেই অর্থ দিয়ে প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্রিটেন সকলের চাইতে এগিয়ে থাকবে। কিন্তু যেটা সকলেই ভুলে যাচ্ছে তা হলো, ব্রিটেনের বন্ধু এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে আরও অনেক বেশি সম্পদ রয়েছে; যেকারণে তারা কেন ব্রিটেনের থেকে প্রযুক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকবে? ব্রিটেনের ছোট করে ফেলা সামরিক বাহিনীকে সামনের দিনগুলিতে আরও ঘনঘন এবং আরও বেশি সময়ের জন্যে বিশ্বব্যাপী মোতায়েন করতে হবে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীরও কাগজে কলমে যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে, বাজে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিকল্পনার কারণে সেটাও পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করতে পারছে না।

 
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রিক্রুটিং বিজ্ঞাপণ, যেখানে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। তবে নাগরিকেরা বলছে যে, অনেক জায়গাতেই আত্মবিশ্বাস পাওয়া যেতে পারে; সেটা সেনাবাহিনীতে নাও হতে পারে। কেউ কেউ বলছেন যে, সেনাবাহিনীতে যোগদানের অর্থ হলো অনেক বড় একটা প্রতিশ্রুতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা; যা অনেকেই করতে ইচ্ছুক নয়। তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ধরে রাখতেই বেশি আগ্রহী।

কাগজে কলমে ব্রিটেনের সামরিক বাজেট বিশ্বের মাঝে চতুর্থ। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারত ব্রিটেনের চাইতে এগিয়ে আছে। করোনা মহামারির আগে ২০১৯ সালেও ৭৮ বিলিয়ন ডলার নিয়ে সৌদি আরব এবং ৬১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে রাশিয়া ব্রিটেনের থেকে এগিয়ে ছিল। তখন ব্রিটেনের বাজেট ছিল প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২০ সালে বাজেট বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ার পর ব্রিটেনের সামরিক বাজেট ৬১ বিলিয়ন ডলার পেরিয়ে গেলে এবং রাশিয়ার বাজেট কিছুটা কমানো হলে ব্রিটেন চতুর্থ অবস্থানে চলে আসে। আর সেবছর সৌদি আরব তেলের বাজারে মারাত্মক ধ্বসের কারণে সামরিক বাজেট কমিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে কমিয়ে আনে। ফ্রান্স তার বাজেট ৫২ থেকে ৫৫ বিলিয়নে উন্নীত করলেও তা রাশিয়ার পিছনে ষষ্ঠ অবস্থানে থাকে। ‘আইআইএসএস’এর সিনিয়ন ফেলো অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বেন ব্যারি বলছেন যে, সামরিক বাজেটের র‍্যাংকিংএর কারণে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্রিটেনের সামরিক শক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। তবে এর মাধ্যমে ব্রিটেনের সামরিক শক্তি খুব বেড়ে যাচ্ছে না। এর মাধ্যমে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সে নতুন কোন স্কোয়াড্রনও যুক্ত হচ্ছে না। রয়াল নেভির যে আকার পরিকল্পনা করা হতো, সেদিকে নিয়ে যাবার একটা চেষ্টা চলছে। বরিস জনসন যখন বলেছেন যে, ব্রিটিশ রয়াল নেভি হবে ইউরোপের মাঝে সবচাইতে বড়, তখন কথাটা ঠিক। তবে এর মানে এই নয় যে, নৌবাহিনী অনেক বড় হয়ে যাবে। একইসাথে এই বাজেট বৃদ্ধির মানে এই নয় যে, বিশ্বব্যাপী মোতায়েন করার জন্যে ব্রিটেনের সেনা ইউনিটের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

ব্রিটিশ সামরিক শক্তির সমস্যা বহু প্রকারের। এর মাঝে সবচাইতে বড় সমস্যাগুলির একটা হলো রিক্রুটিং। ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বশেষ রিক্রুটিং বিজ্ঞাপণে জনগণকে বিজ্ঞাপণ এবং সোশাল মিডিয়াতে হাল্কা লাইফস্টাইল বক্তব্য থেকে সরে আসতে আহ্বান জানানো হচ্ছে; যখন টানা নয় বছর ধরে সেনাবাহিনী ছোট হচ্ছে। রিক্রুটিং সমস্যা বহুদিন ধরেই চলছে। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটা গ্রুপ মাউন্ট এভারেস্ট আরোহন করতে গিয়েছিল জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে। সেই মিশন সফল হয়নি। যারা সেনাবাহিনীর জন্যে নাম লেখায়, তাদের মাঝে মাত্র ১০ শতাংশ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পর্যন্ত যেতে পারে। এই সমস্যার সমাধান করতে সেনাবাহিনী আগ্রহীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শারীরিক সক্ষমতাকে সামরিক মাপকাঠিতে নিয়ে আনার জন্যে কাজ করছে। তবে এর চাইতে বড় সমস্যা হলো, গবেষণা বলছে যে, ব্রিটিশ ছেলেমেয়েরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছে। এটাকে মাথায় রেখেই সর্বশেষ রিক্রুটিং ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই ভিডিও দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়নি। নাগরিকেরা বলছে যে, অনেক জায়গাতেই আত্মবিশ্বাস পাওয়া যেতে পারে; সেটা সেনাবাহিনীতে নাও হতে পারে। কেউ কেউ বলছেন যে, সেনাবাহিনীতে যোগদানের অর্থ হলো অনেক বড় একটা প্রতিশ্রুতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা; যা অনেকেই করতে ইচ্ছুক নয়। তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ধরে রাখতেই বেশি আগ্রহী।

 
বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের প্রধান প্রধান সামরিক অবস্থান। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটাকে বাস্তবায়ন করতেই বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনকে সামরিক উপস্থিতি রাখতে হচ্ছে। এই সামরিক অবস্থানগুলিকে ধরে রাখতে বৈশ্বিকভাবে ব্রিটেন অনেক দেশের সরকারকেই নিজেদের প্রভাবের অধীনে রাখতে চাইছে। এটা পরিষ্কার যে, সামরিক শক্তির অপ্রতুলতাকে কাটাতে রাজনৈতিক এবং ইন্টেলিজেন্স প্রভাবকেই ব্রিটেন প্রাধান্য দিতে চাইছে।

ইউরোপে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান লেঃ জেনারেল বেঞ্জামিন হজেস ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া ‘ফোর্সেস নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতোই বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দোপ্যাসিফিক, ইউরোপ সকল ক্ষেত্রেই ব্রিটেনের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব রয়েছে। ২০১০ সালে যখন আফগানিস্তানে সেনাসংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল, তখন ব্রিটেন মাত্র তিনটা দেশের মাঝে একটা হিসেবে সেটাকে সমর্থন করেছিল। সেই তুলনায় ব্রিটেনের সেনাবাহিনীর আকার মারাত্মক ছোট হয়ে গেছে। পৃথিবীর সকল মানুষই স্থলে বাস করে; কাজেই স্থলভাগে মানুষ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা দিতে স্থলবাহিনীর প্রয়োজন। তিনি বলেন যে, বাইরের একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি খুবই চিন্তিত হবেন জেনে যে, ব্রিটেনের সেনাবাহিনীর আকার মেঝের নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে।

ক্যারিবিয়ান সাগর, দক্ষিণ আটলান্টিকের ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ, ভূমধ্যসাগরের জিবরালটার ও সাইপ্রাস, মধ্যপ্রাচ্যে বাহরাইন এবং ওমান ছাড়াও পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর ও ব্রুনাই; এবং আফ্রিকার কেনিয়া ও উত্তর আমেরিকার কানাডাতে ব্রিটেনের সামরিক অবস্থান রয়েছে। এর বাইরেও ইউরোপের নরওয়ে, তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এবং পশ্চিম আফ্রিকার মালিতে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিশন রয়েছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটাকে বাস্তবায়ন করতেই বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনকে সামরিক উপস্থিতি রাখতে হচ্ছে। এই সামরিক অবস্থানগুলিকে ধরে রাখতে বৈশ্বিকভাবে ব্রিটেন অনেক দেশের সরকারকেই নিজেদের প্রভাবের অধীনে রাখতে চাইছে। ‘এমআই ৬’এর প্রধানের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, সামরিক শক্তির অপ্রতুলতাকে কাটাতে রাজনৈতিক এবং ইন্টেলিজেন্স প্রভাবকেই ব্রিটেন প্রাধান্য দিতে চাইছে। একটা আদর্শিক শক্তি হিসেবে দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশের রাজনৈতিক সীমানা এবং সংবিধানকে ব্রিটেন তৈরি করেছে, অথবা প্রভাবিত করেছে। পশ্চিমা আদর্শিক চিন্তাগুলি ব্রিটেনই একসময় উপনিবেশের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ আইনকানুনই ব্রিটেনের হাতে তৈরি অথবা সেখানে ব্রিটেনের প্রভাব ছিল। এমনকি বিশ্বের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষাও ব্রিটেনের মানুষের মাতৃভাষা। ব্রিটেন নিজে সুপারপাওয়ার থাকার সময়েই এই কাজগুলির বেশিরভাগ সম্পাদন করেছিল। সেই ঐতিহাসিক প্রভাবটাকে ব্যবহার করেই ব্রিটেন আবারও শক্তিশালী হতে চাইছে। বৈশ্বিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করে নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী আকৃতি দিতে; অথবা অন্যের সক্ষমতাকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক উদ্দেশ্যগুলিকে বাস্তবায়ন করতে চাইছে তারা। তবে সকলেই বুঝতে পারছেন যে, অতি ক্ষুদ্র একটা সামরিক বাহিনী দিয়ে একটা পরিবর্তনশীল লাগামহীন বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করাটা অবাস্তব চিন্তা। পশ্চিমা আদর্শের অধঃপতনের ফলস্বরূপ ব্রিটেনের নাগরিকেরা যখন নিজেদের স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে সামরিক বাহিনীতে যেতে ইচ্ছুক নয়, তখন সামরিক বাহিনী আকারে ছোট হতে থাকলেও প্রযুক্তির কারণে তার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এহেন বক্তব্য হয়তো সেই চিন্তাটার অবাস্তবতাকে ঢেকে রাখার জন্যেই। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের চিন্তাটাও সেই আঙ্গিকে দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

Saturday 22 January 2022

বাইডেন কি ইয়েমেন যুদ্ধের ব্যাপারে তার নীতি পাল্টেছেন?

২২শে জানুয়ারি ২০২২

এক বছর ধরে ইয়েমেনে মানবাধিকার রক্ষার আদর্শিক লক্ষ্য এবং আরব দেশগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মার্কিন জাতীয় স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যের মাঝামাঝি যে একটা অস্পষ্ট নীতিকে তিনি লালন করছিলেন, তার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। আফগানিস্তানের পর এখন ইয়েমেনে পশ্চিমা আদর্শকে জ্বলাঞ্জলি দেয়ার এই নীতিকে বাইডেনের বামপন্থী লিবারাল ও প্রগ্রেসিভ মিত্ররা পছন্দ করছে না; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাইডেনের দুর্বল অবস্থানকে দুর্বলতর করবে।

 
২১শে জানুয়ারি ইয়েমেনের উত্তরে হুথি বিদ্রোহী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা সাদা শহরের এক অস্থায়ী কারাগারের উপর বিমান হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক এনজিও ‘মেডিসিনস সাঁস ফ্রন্টিয়ের’ বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’কে বলছে যে, হামলায় মহিলা ও শিশুসহ কমপক্ষে ৭০ জন নিহত এবং ১’শ ৩৮ জন আহত হয়েছে। এই অস্থায়ী কারাগারটা শরণার্থী শিবির হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো। হুথিরা এই বিমান হামলার জন্যে সৌদি আরবকে দায়ী করলেও সৌদি নেতৃত্বের কোয়ালিশন এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে। কোয়ালিশনের একজন মুখপাত্র বলেন যে, জায়গাটা জেনেভা কনভেনশনের অধীনে আক্রমণ থেকে দূরে রাখার স্থানের মাঝে পড়ে না। তারা শীঘ্রই ঘটনার ব্যাপারে সত্যটা ছাড়াও হুথিদের মিডিয়াতে বানোয়াট খবরের ব্যাপারে তথ্য দেবেন। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, গত ১৭ই জানুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবু ধাবি বিমানবন্দর এবং তেলের স্টোরেজ ট্যাঙ্কে ড্রোন হামলার পর থেকে কোয়ালিশনের বোমা হামলা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮ই জানুয়ায়রি ইয়েমেনের রাজধানী সানাতে এক বিমান হামলায় কমপক্ষে ১৪ জন নিহত হয়। ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’ বলছে যে, দক্ষিণের হোদেইদা শহরে একটা টেলিকম স্থাপনায় সৌদি বিমান হামলার সময় কাছেই খেলতে থাকা ৩ জন শিশু নিহত হয়। বোমা হামলার ঘটনায় মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন এক বার্তায় যুদ্ধের তীব্রতার ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে উভয় পক্ষকে সহিংসতা কমাতে আহ্বান জানান। তবে এর আগে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সউদএর সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলির নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যহত রাখার কথা বলেন। অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইয়েমেনের ব্যাপারে তার নীতি পরিবর্তন করেছেন কিনা।

উত্তর ইয়েমেনের সাদা শহরে বিমান হামলার পরপরই বাইডেনের ডেমোক্র্যাট শিবিরের মিত্র মার্কিন কংগ্রেসের বামপন্থীদের সর্ববামের সংগঠন ‘কংগ্রেশনাল প্রগ্রেসিভ ককাস’এর এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, বাইডেন প্রশাসনকে অবশ্যই অবৈধভাবে সৌদিদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়া বন্ধ করতে হবে; এবং বোমাবর্ষণ ও অবরোধ শেষ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী মার্কিন শক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কথা বলা থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কুইন্সি ইন্সটিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফট’এর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ক্ষমতা নেবার পর থেকে বাইডেন প্রশাসন ১৩ বার হুথিদের কর্মকান্ডের সমালোচনা করলেও ইয়েমেনে সৌদিদের বোমা হামলার একবারও সমালোচনা করেনি।

২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে বাইডেন হোয়াইট হাউজের এক প্রেস ব্রিফিংএ বলেছিলেন যে, ইয়েমেনের যুদ্ধ শেষ হতেই হবে। তিনি বলেছিলেন যে, যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণকারী দেশগুলিকে ‘আক্রমণাত্মক অস্ত্র’ বিক্রি করা বন্ধ করবে। কিন্তু এক বছর পর ২০২১এর ডিসেম্বরে বাইডেন প্রশাসন সাড়ে ৬’শ মিলিয়ন ডলারে সৌদি আরবের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার জন্যে কংগ্রেসের অনুমতি নিলে অনেকেই বাইডেনের নীতির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেন। বাইডেন প্রশাসন বলছে যে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য; যার অর্থ হলো, সেগুলি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা ঠেকাতে ব্যবহৃত হবে; ইয়েমেনের ভূমিতে বোমা হামলার জন্যে নয়। ১৯শে জানুয়ারি এক সংবাদ সন্মেলনে জো বাইডেন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ইয়েমেনের যুদ্ধ বন্ধে দুই পক্ষের মাঝে সমঝোতা হতে হবে; যা কিনা যথেষ্টই কঠিন একটা কাজ। একইসাথে তিনি বলেন যে, তিনি হুথিদেরকে পুনরায় ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্যে চিন্তা করছেন। ২০২১ সালের শুরুতে বাইডেন হুথিদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন ঘোষণার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিলেন।

 
সৌদি বিমান বাহিনীর মার্কিন নির্মিত 'এফ-১৫' যুদ্ধবিমান।  যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সৌদিদেরকে ইন্টেলিজেন্স, খুচরা যন্ত্রাংশ, রক্ষনাবেক্ষণ, এবং অস্ত্র সরবাহ করছে, সেটা ‘আক্রমণাত্মক’ বা ‘প্রতিরক্ষামূলক’ই হোক, যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বাড়বে। এটা এখন পরিষ্কার যে, বাইডেন ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্পের নীতিতে যেতে চাইছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজে আসার এক বছরেও যখন তিনি সৌদি আরব এবং আমিরাতের যুদ্ধ সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কোন চেষ্টাই করেননি, তখন তার নীতির কতটুকু পরিবর্তন হলো, তা বলা কঠিন।

২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার পর থেকে মার্কিন কংগ্রেসের অনেক সদস্য সৌদিদের সাথে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করার জন্যে এবং ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদিদের সহায়তা না দেয়ার জন্যে সরকারের উপর চাপ দিতে থাকে। তবে এখনও পর্যন্ত সৌদি কোয়ালিশন মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করেই ইয়েমেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন লিবারাল রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষক ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান রোহিত ‘রো’ খান্না বাইডেনের বক্তব্যের সমালোচনা করে এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ট্রাম্পের পুরোনো নীতিতে ফিরে গিয়ে যুদ্ধকে আরও উস্কে দেয়া নয়, বরং ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা করতে হবে। হুথিদের ‘সন্ত্রাসী’ ঘোষণা দিয়ে তাদের কর্মকান্ডকে থামানো যাবে না; বরং এতে লাখো মানুষের খাবার ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাবে। মার্কিন সাংবাদিক এবং লেখক স্পেনসার একারম্যান এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, বাইডেন এবং তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা যে যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই যুদ্ধে সৌদি আর আমিরাতের যেকোন বিমান হামলায় মার্কিন হাত রয়েছে। তিনি আশা করেন যে, ইয়েমেনে নিহত শিশুদেরকে মার্কিন কর্মকর্তারা যেন রাতে স্বপ্নের মাঝে দেখতে পান।

‘ভোক্স’ ম্যাগাজিন বলছে যে, মার্কিনীরা সৌদি বিমান বাহিনীর বিমানগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করছে; যেগুলি ইয়েমেনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে ৪১ জন কংগ্রেসম্যান সৌদি আরবের জন্যে মার্কিন সামরিক সহায়তার ব্যাপারে জানতে চাইলে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা দুই মাস পর ধোঁয়াশা উত্তর দেন। কংগ্রেসম্যান পিটার ডেফাজিও ‘মিডলিস্ট আই’কে বলছেন যে, বাইডেন এক বছরেও তার ইয়েমেন নীতিকে পরিষ্কার করেননি। মার্কিন এনজিও ‘ফ্রেন্ডস কমিটি অন ন্যাশনাল লেজিসলেশন’এর ডিরেক্টর হাসান এল তাইয়াব বলছেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সৌদিদেরকে ইন্টেলিজেন্স, খুচরা যন্ত্রাংশ, রক্ষনাবেক্ষণ, এবং অস্ত্র সরবাহ করছে, সেটা ‘আক্রমণাত্মক’ বা ‘প্রতিরক্ষামূলক’ই হোক, যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বাড়বে। এটা এখন পরিষ্কার যে, বাইডেন ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্পের নীতিতে যেতে চাইছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজে আসার এক বছরেও যখন তিনি সৌদি আরব এবং আমিরাতের যুদ্ধ সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কোন চেষ্টাই করেননি, তখন তার নীতির কতটুকু পরিবর্তন হলো, তা বলা কঠিন। বরং এক বছর ধরে ইয়েমেনে মানবাধিকার রক্ষার আদর্শিক লক্ষ্য এবং আরব দেশগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মার্কিন জাতীয় স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যের মাঝামাঝি যে একটা অস্পষ্ট নীতিকে তিনি লালন করছিলেন, তার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। আফগানিস্তানের পর এখন ইয়েমেনে পশ্চিমা আদর্শকে জ্বলাঞ্জলি দেয়ার এই নীতিকে বাইডেনের বামপন্থী লিবারাল ও প্রগ্রেসিভ মিত্ররা পছন্দ করছে না; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাইডেনের দুর্বল অবস্থানকে দুর্বলতর করবে।

Thursday 20 January 2022

ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের অর্থ কি?

২০শে জানুয়ারি ২০২২

ইথিওপিয়ার হারার মেদা বিমান ঘাঁটিতে চীনে নির্মিত 'উইং লুং ১' ড্রোন। এটা মনে করার কারণ নেই যে, এই যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ করার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র আমিরাত বা তুরস্কের উপর অবরোধ দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন ইথিওপিয়ার সরকারের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার চেষ্টাকে সমর্থন দিলেও বাইডেন প্রশাসন সেখানে ইথিওপিয়া সরকারের মানবাধিকার লংঘনকে হাইলাইট করতে চাইছে। অর্থাৎ ইথিওপিয়ার অখন্ডতা রক্ষা এখন মার্কিন সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।


২০২১এর ২০শে ডিসেম্বর ইথিওপিয়ার তিগ্রে বিদ্রোহীরা ঘোষণা দেয় যে, তারা সরকারি আক্রমণের মুখে কিছু এলাকা ছেড়ে দিচ্ছে। একইসাথে তারা জাতিসংঘের কাছে তিগ্রে অঞ্চলের উপর যুদ্ধবিমান এবং ড্রোনের জন্যে একটা ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করার জন্যে আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ তিগ্রে অঞ্চলে মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে তদন্ত করতে একটা কমিশন গঠন করলেও ইথিওপিয়ার সরকার এর বিরোধিতা করেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন সরকার ঘোষণা দেয় যে, যারা ইথিওপিয়ার যুদ্ধে সামরিক সহায়তা দেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসছে যে, ইথিওপিয়াকে বিভিন্ন দেশ অস্ত্র সরবরাহ করছে; যাদের মাঝে সর্বাগ্রে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর এক বিশ্লেষণে উইলিয়াম ডেভিডসন বলছেন যে, তিগ্রে সেনাদের পিছু হটার কারণ হয়তো আবি আহমেদের ইথিওপিয় সরকারের জন্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিদেশী সামরিক সহায়তা; বিশেষ করে অস্ত্রবাহী ড্রোন।

ডাচ প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’এর এক বিশ্লেষণে স্টাইন মিতজার এবং জুউস্ট ওলিমান্স বলছেন যে, ইথিওপিয়ার অস্ত্র বহণকারী ড্রোন ফ্লিটের মাঝে রয়েছে ৯টা চীনে নির্মিত ‘উইং লুং ১’, ২টা ইরানে নির্মিত ‘মোহাজের ৬’; এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে তৈরি কয়েকটা ‘ভার্টিক্যাল টেইক অফ এন্ড ল্যান্ডিং’ বা ‘ভিটিওএল’ ড্রোন। এছাড়াও ইস্রাইলে নির্মিত দুই প্রকারের গোয়েন্দা ড্রোনও রয়েছে এগুলিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যে। ইথিওপিয়া তার প্রথম ৩টা ‘উইং লুং ১’ ড্রোন চীন থেকে পায় ২০২১এর সেপ্টেম্বরে। এরপর নভেম্বর মাসে আমিরাত থেকে একই ধরনের আরও ৬টা ড্রোন আসে। এছাড়াও কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, যুদ্ধের শুরু থেকেই এরিত্রিয়ার আসাব বন্দরে অবস্থিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক ঘাঁটি থেকে ড্রোন হামলা হয়েছে তিগ্রেদের উপর। এব্যাপারে কেউ সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তবে ‘ওরিক্স’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, এর মানে এই নয় যে, আমিরাতের ঘাঁটি থেকে কোন হামলা হয়নি। বরং যেসময় ইথিওপিয়ার কাছে কোন ড্রোন ছিল না, সেসময় তিগ্রেদের হাতে থাকা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং বড় ক্যালিবারের রকেটের উপর নিখুঁতভাবে হামলা সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।

তিগ্রে অঞ্চলের মাইচিউ এলাকায় ইথিওপিয়দের হাতে আমিরাতে তৈরি প্রথম ‘ভিটিওএল’ ড্রোনগুলিকে দেখা যায় ২০২১এর মাঝামাঝি। তবে তিগ্রেদের দ্রুত স্থানান্তরযোগ্য বাহিনীর বিরুদ্ধে এহেন ড্রোনের কর্মক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। ইথিওপিয়ার পক্ষে আমিরাতের সবচাইতে বড় সহায়তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২১এর নভেম্বরে যখন ইথিওপিয়ার হারার মেদা বিমান ঘাঁটিতে ‘উইং লুং ১’ ড্রোনগুলিকে দেখা যেতে থাকে। ইথিওপিয়ার রাজধানী অভিমুখে বিদ্রোহী বাহিনীর রওয়ানা হবার খবরেই হয়তো আমিরাত জরুরি ভিত্তিতে তাদের নিজেদের বিমান বাহিনী থেকে ড্রোনগুলি ইথিওপিয়াতে পাঠিয়েছে। ড্রোনগুলির অপারেটরও নিঃসন্দেহে আমিরাতেরই ছিল। চীন থেকে আনা ‘উইং লুং ১’ ড্রোনগুলি প্রথম থেকেই ‘টিএল ২’ আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করেনি। কিন্তু আমিরাতি ড্রোনগুলি প্রথম থেকেই প্রচুর ক্ষেপণাস্ত্রসহ মোতায়েন হয়েছে।

জানুয়ারির শুরুতে অরোমিয়া অঞ্চলের গিদামি শহরে ইরানে নির্মিত ‘ঘানেম ৫’ আকাশ থেকে নিক্ষেপিত অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবার পর ধারণা করা হচ্ছে যে, ইথিওপিয়া সরকার ইরানে নির্মিত ‘মোহাজের ৬’ ড্রোনগুলিকে অরোমিয়া অঞ্চলের কাছাকাছি মোতায়েন করেছে। স্যাটেলাইট ছবি বলছে যে, খুব সম্ভবতঃ আসোসা বিমানবন্দরেই এগুলিকে মোতায়েন করা হয়েছে। সেখান থেকে অরোমিয়া অঞ্চলের বেশিরভাগটাই ড্রোনগুলির ২’শ কিঃমিঃ পাল্লার মাঝে চলে আসবে। ২০২১এর অগাস্টে অরোমো অঞ্চলের বাহিনী ‘অরোমো লিবারেশন আর্মি’ বা ‘ওএলএ’ ‘তিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘টিপিএলএফ’এর সাথে জোট বেঁধে আবি আহমেদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এর আগ পর্যন্ত সেমেরা এবং হারার মেদা বিমান ঘাঁটি থেকে তিগ্রে অঞ্চলে ড্রোন হামলা করা গেলেও অরোমিয়া ছিল ড্রোনের পাল্লার বাইরে। ডাচ এনজিও ‘প্যাক্স’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তুরস্কে তৈরি ড্রোনও ইথিওপিয়া ব্যবহার করছে। তুর্কি সরকার অবশ্য তা অস্বীকার করেছে। 



 
‘ওরিক্স’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ইথিওপিয়া বিমান বাহিনীর ড্রোন হামলার ফলস্বরূপ এখন তিগ্রেদের হাতে তেমন কোন বড় অস্ত্র নেই। ড্রোন হামলার ব্যাপারটা তিগ্রে সেনাদের মনোবলের উপরেও হয়তো আঘাত হেনেছে। অন্ততঃ ট্যাংক বা আর্টিলারির মতো বড় ক্যালিবারে অস্ত্র না থাকায় তিগ্রেদের সামনে অগ্রসর হবার সক্ষমতা কমে যেতে পারে। একারণেই হয়তো তিগ্রেরা আক্রমণে না গিয়ে নিজেদের অঞ্চলকে রক্ষা করতে বেশি যত্নবান হচ্ছে। তবে ‘উইং লুং ১’ ড্রোনগুলি একইসাথে বেসামরিক টার্গেটে হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে বলে তথ্য মিলছে। কিছুদিন আগেই তিগ্রে অঞ্চলের আলামাতা শহরে ড্রোন হামলায় ৪২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং দেড়শতাধিক আহত হয়। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে চীনে নির্মিত ‘ব্লু এরো ৭’ ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষের দেখা মেলে; যা কিনা ‘উইং লুং ১’ ড্রোন ব্যবহার করে।

যুদ্ধের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসনের শেষ দিনগুলিতে যুক্তরাষ্ট্র আবি আহমেদের সরকারকে সমর্থন দিলেও জো বাইডেন প্রশাসনের নীতিতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সেই নীতির উপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্র ইথিওপিয়া সরকারের কাছে তুর্কি ড্রোন বিক্রির রিপোর্টের ব্যাপারে চিন্তিত। গত ডিসেম্বরে হর্ন অব আফ্রিকার জন্যে মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি জেফরি ফেল্টম্যান তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময়ে ইথিওপিয়াতে সশস্ত্র ড্রোন ব্যবহারের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন বলে বলছে ‘রয়টার্স’ এবং ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’। ‘এক্সপোর্টার্স এসেম্বলি’র হিসেবে ২০২১ সালের ১১ মাসে ইথিওপিয়াতে তুরস্ক ৯৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক পণ্য রপ্তানি করেছে। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, ইথিওপিয়া সরকারের ইরানি ড্রোন ব্যবহারের ব্যাপারেও মার্কিন কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন।

বাইডেন প্রশাসন ইথিওপিয়ার যুদ্ধ বন্ধে তেমন কোন পদক্ষেপ না নিলেও ইথিওপিয়ার সরকার যাতে সহজে যুদ্ধজয়ের পথে এগুতে না পারে, সেজন্য ইথিওপিয়ার উপর বিভিন্ন অবরোধের হুমকি দিচ্ছে। তবে এটা মনে করার কারণ নেই যে, এই যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ করার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র আমিরাত বা তুরস্কের উপর অবরোধ দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন ইথিওপিয়ার সরকারের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার চেষ্টাকে সমর্থন দিলেও বাইডেন প্রশাসন সেখানে ইথিওপিয়া সরকারের মানবাধিকার লংঘনকে হাইলাইট করতে চাইছে। অর্থাৎ ইথিওপিয়ার অখন্ডতা রক্ষা এখন মার্কিন সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

Sunday 16 January 2022

‘এরদোগানোমিকস’…… ২০২২ সালে তুরস্কের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি

১৬ই জানুয়ারি ২০২২

 
এরদোগান একটা নরম ‘প্রকৃতির ইসলামিস্ট তুরস্ক’ তৈরি করে নতুন তুরস্কের জনক হতে চাইছেন। আর এরদোগানের সমালোচকেরা তার তথাকথিত ‘ইসলামিস্ট’ নীতির সমালোচনা করে বলছেন যে, একুশ শতকের জটিল অর্থনীতি সপ্তম শতাব্দীর নীতি দ্বারা চালনা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ তারা সার্টিফিকেট দিচ্ছেন যে, এরদোগানের সুদের হার কমাবার নীতি ইসলাম সমর্থিত।


তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান সর্বদাই তার অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে সমালোচিত। কারণ তিনি বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাধারণ চিন্তাগুলির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এরদোগান বলছেন যে, উচ্চ সুদের হারের কারণেই মুদ্রাস্ফীতি হয়; যদিও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সাধারণভাবে উল্টোটা মনে করা হয়। তিনি বলছেন যে, ইসলাম সুদ কমাতে বলেছে। যারা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন, তাদেরকে তিনি ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়ে বলছেন যে, এই ‘ইন্টারেস্ট রেট লবি’গুলি উচ্চ সুদের উপর ভিত্তি করে মুনাফা বাড়াতে চাইছে। এরদোগানের সমালোচকেরা অনেকেই এহেন নীতিকে ‘এরদোগানোমিকস’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। এরদোগানের এই নীতিগুলির প্রভাব বুঝতে হলে তুরস্কের অর্থনীতির সূচকগুলি দেখা ছাড়াও অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

এরদোগানের ‘একে পার্টি’র নীতি … ঋণ নিয়ে খরচ করো

‘দ্যা ইকনমিস্ট’ তুরস্কের অর্থনীতির প্রধান কিছু ইস্যুকে তুলে এনেছে। তুরস্ক হলো ইউরোপের সবচাইতে বড় টেলিভিশন এবং হাল্কা বাণিজ্যিক গাড়ি নির্মাতা। বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম খাদ্য প্রস্তুতকারক এবং ৬ষ্ঠ বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র। বিশ্বের সবচাইতে বড় আড়াই’শ কন্সট্রাকশন কোম্পানির মাঝে ৪৩টাই তুরস্কের। ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তুরস্কের জিডিপি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। তবে এর সাথে তুরস্কের অর্থনীতির বড় কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। দেশটার অর্থনীতি খুব বেশি ইউরোপকেন্দ্রিক। তুরস্কের মোট বহিঃবাণিজ্যের ৬০ শতাংশই হয় ইউরোপের সাথে; দেশে মোট বাইরের বিনিয়োগের তিন চতুর্থাংশও আসে ইউরোপ থেকে। একারণেই ইউরোপ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়লে তা তুরস্ককেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। তুরস্ক হয়তো গাড়ি এবং ওয়াশিং মেশিন তৈরি করতে পারে; কিন্তু নিজস্ব গবেষণা, ডিজাইন, ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিংএ তুর্কিরা তেমন আগাতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০০২ সালের পর থেকে তুরস্কের মোট তৈরি করা রপ্তানিদ্রব্যের মাঝে মাত্র ২ শতাংশ আসে হাইটেক দ্রব্য থেকে।

এরদোগান তুরস্ককে ২০২৩ সালের মাঝে, অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কের জন্মের শততম বার্ষিকীতে, বিশ্বের শীর্ষ ১০ অর্থনীতির একটা হিসেবে তৈরি করতে চান বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় এসে কিছু মেগা কন্সট্রাকশন প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। তুর্কি সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি’ এই মেগা প্রকল্পগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রথমেই রয়েছে ইস্তাম্বুলের নতুন বিমানবন্দর। এর প্রথম স্টেজের কাজ ২০১৫এর মে মাসে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে শেষ হয়; খরচ হয় প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। তবে এর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্টেজের কাজ ২০২৫ পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। এরপর রয়েছে বসফরাস প্রণালির সমান্তরালে ৪৫ কিঃমিঃ লম্বা ইস্তাম্বুল ক্যানাল। ২০২১ সালের জুনে এরদোগান এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ছয় বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে বলছেন তিনি। তার নিজের কথায়, এটা একটা ‘উন্মাদীয় প্রকল্প’। এছাড়াও রয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলার বাজেটের হাই স্পিড রেলওয়ে প্রকল্প। এর অংশ হিসেবে ইস্তাম্বুলে বসফরাস প্রণালির তলদেশ দিয়ে ‘মারমারায়’ পাতাল রেলের খরচ পড়বে ৫ বিলিয়ন ডলার। তারপর রয়েছে ইস্তাম্বুল ফাইনান্স সেন্টার; যা তৈরির মাধ্যমে এরদোগান ইস্তাম্বুলকে বিশ্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বাজারে পরিণত করতে চান। এর বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও ১০ বিলিয়ন ডলার খরচে তুরস্কের মাঝ দিয়ে মধ্য এশিয়ার গ্যাস ইউরোপে রপ্তানির পাইপলাইন প্রকল্প চলমান। এই সবগুলি প্রকল্পই তুরস্কের অর্থনীতিতে বিশাল ঋণ যুক্ত করেছে এবং আরও করছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপিতে করার কারণে প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ঋণই হলো বেসরকারি খাতে।

 
তুরস্কের মেগা প্রকল্প ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর। মেগা প্রকল্পগুলি তুরস্কের অর্থনীতিতে বিশাল ঋণ যুক্ত করেছে এবং আরও করছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপিতে করার কারণে প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ঋণই হলো বেসরকারি খাতে।

২০০২ সালে যখন ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় আসে, তখন কনজিউমার ঋণ ছিল তুরস্কের প্রতি পরিবারের গড় আয়ের প্রায় ৫ শতাংশ। ২০১৩ সাল নাগাদ এটা হয়ে যায় প্রায় ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনীতির আকার বড় করার উদ্দেশ্যে ‘একে পার্টি’ সাধারণ জনগণকে খরচ বাড়াতে উৎসাহ দিতে ব্যাপকহারে ঋণ দিতে থাকে। এই খরচার কারণে তুর্কি পরিবারগুলি নিজেদেরকে ধনী মনে করতে থাকে; কারণ এক দশকের মাঝে তাদের পারিবারিক সম্পদ বেড়ে তিনগুণ হয়ে যায়। তবে সমস্যা হলো এই সম্পদ তৈরি হয়েছে ঋণের উপর ভর করে। ঋণ ফেরত দিতে গিয়ে সীমিত আয়ের খুব স্বল্প অংশই সঞ্চয় হিসেবে রাখতে পেরেছে তারা। ২০১৪ সালে তুরস্কের জাতীয় সঞ্চয় হার ছিল মাত্র ১২ দশমিক ৬ শতাংশ; যা কিনা বড় উঠতি অর্থনীতিগুলির মাঝে সর্বনিম্ন। ব্যবসায়ীরাও লাভের আশায় কনজিউমার দ্রব্যের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে; বড় শিল্প গড়ার উপর নয়। একারণে বাইরে থেকে আমদানি করা কনজিউমার দ্রব্যের চাহিদাও ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। আইএমএফএর হিসেবে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মাঝে তুরস্কের ব্যংকগুলির দেয়া মোট ঋণের মাঝে কন্সট্রাকশন সেক্টরে দেয়া ঋণের অংশ ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে গিয়ে ৭০ শতাংশে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ব্যাংকগুলি কারখানা নয়, বরং এপার্টমেন্ট বিল্ডিং, অফিস বিল্ডিং এবং শপিং কমপ্লেক্সের জন্যে ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহী ছিল। একইসাথে ২০১২ সালে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে বিদেশী মালিকানার অনুমোদন দেয়ায় রিয়েল এস্টেটের মূল্য দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এক বছর আগের তুলনায় তুরস্কের বড় শহর ইস্তাম্বুলে বাড়ির মূল্য ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।

বৈদেশিক ঋণের উপর ভর করে প্রবৃদ্ধি

২০০২ সালে যখন ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় আসে, তখন তুরস্কের জিডিপি ছিল আড়াই’শ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সাল নাগাদ তা পৌঁছে যায় সাড়ে ৯’শ বিলিয়নে। অর্থাৎ মাত্র এক দশকে তুরস্কের অর্থনীতির আকার ৩ দশমিক ৮ গুণ বেড়ে যায়! তবে এই প্রবৃদ্ধির পিছনে ছিল ঋণের বোঝা। জাতীয় সঞ্চয় কমে যাবার কারণে দেশের কন্সট্রাকশন প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ করার মত অর্থেরও ঘাটতি পড়ে যায়। এই ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়া শুরু হয়। বৈদেশিক ঋণ তুরস্কের জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ হয়ে যায়; যার বেশিরভাগই ছিল বেসরকারি ঋণ। তুরস্কের ‘আহভাল নিউজ’ বলছে যে, তুরস্কের বৈদেশিক ঋণ ২০২০ সাল নাগাদ সাড়ে ৪’শ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়; যার মাঝে বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টরের ঋণই ছিল ৩’শ বিলিয়ন ডলার। এসকল ঋণ তুরস্ককে পরিশোধ করতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়; যা কিনা তুর্কি লিরার উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে। তবে দুর্বল মুদ্রাব্যবস্থা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং ঘনঘন সরকারি নীতির পরিবর্তনের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দেশটাতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি। সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল স্বল্প সময়ের মাঝে মুনাফা করে নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া।

‘আহভাল নিউজ’ বলছে যে, তুর্কি লিরার দরপতনের পর থেকে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক লিরাকে শক্তিশালী করতে ব্যাপক হারে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করতে থাকে। এতে লিরার মূল্য স্থিতিশীল না হলেও তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মারাত্মকভাবে কমে যায়। অপরদিকে এরদোগানের ঋণ গ্রহণ সহজ করে বেসরকারি খরচ বাড়াবার নীতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকহারে বাড়তে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৮ সালের মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝে সুদের হার ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৪ শতাংশে নিয়ে যায়; অর্থাৎ তিনগুণ করে ফেলে! কিন্তু তারপরেও ২০১৯ সালের মাঝামাঝি মুদ্রাস্ফীতি ১৪ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়ে যায়। কিন্তু ঋণের অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই আমদানি করা পণ্যের পিছনে খরচ হতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে রপ্তানির চাইতে আমদানি অনেক বেশি বেড়ে যায়। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং পর্যটনের মাধ্যমে তুরস্ক তার বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণ করতো। ২০১৯ সালে এক পর্যটন শিল্প থেকেই এসেছিল সাড়ে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। করোনার কারণে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ পড়তে শুরু করে। আর ২০২০এর জুলাইএ বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তুরস্কের বন্ড মার্কেট থেকে ব্যাপকহারে পালাতে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সংকট শুরু হয়।

 
সরকারি হিসেবে তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতি ২১ শতাংশ। বেসরকারি হিসেবে তা ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত। ২০২২ সালে মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশ হতে পারে। বাজারে ঘনঘন মূল্য তালিকা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এরদোগান তার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তুরস্কের জনগণের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়েছেন; দ্রব্যমূল্যের চাপে জনগণের জীবন হয়েছে দুর্বিসহ। তার দেশের সবচাইতে বড় হুমকি এখন তার নীতি ‘এরদোগানোমিকস’।

আকশচুম্বি মুদ্রাস্ফীতি এবং তুর্কি লিরার দরপতনের রেকর্ড

২০২১এর ডিসেম্বরে এরদোগান ২০২২ সালে ৬০ লাখের বেশি মানুষের জন্যে সর্বনিম্ন বেতন ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ হাজার ২’শ ৫৩ লিরা বা প্রায় ২’শ ৭০ ডলারে উন্নীত করেন। এটা ছিল ৫০ বছরে সর্বোচ্চ বেতন বৃদ্ধি। ফলস্বরূপ একদিনে তুর্কি লিরার মূল্য ৫ শতাংশ কমে গিয়ে এক ডলারে সাড়ে ১৫ ছাড়িয়ে যায়; যা সর্বনিম্নের রেকর্ড। অথচ এর আগে ২০২০ সালের অগাস্টে ২০ শতাংশ মূল্য হারাবার পরেও ডলারে পাওয়া যেতো ৭ দশমিক ৪ লিরা। ২০২১ সালের মাঝে লিরার মূল্য আরও ৫০ শতাংশ পড়ে যায়। সরকারি হিসেবে গত নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ২১ শতাংশে ঠেকে। কিন্তু তুরস্কের অর্থনীতিবিদদের সংগঠন ‘ইএনএজি’র হিসেবে এই মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৫৯ শতাংশ! মুদ্রাস্ফীতি কমাতে এবং মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক দেশেই সুদের হার যখন বাড়ানো হচ্ছে, তখন তুরস্কে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝে সুদের হার ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৪ শতাংশ করা হয়। কারণ এরদোগান মনে করছেন যে, সুদের হারের কারণেই মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। ‘নিকেই এশিয়া’র সাথে সাক্ষাতে ‘ক্যাপিটাল ইকনমিকস’এর জেসন টুভে বলছেন যে, ২০২২ সালের প্রথমার্ধের মাঝে লিরার মূল্য যেমন স্থির হবার সম্ভাবনা কম, তেমনি মুদ্রাস্ফীতিও কমবে না। কাজেই এরদোগান সম্ভবতঃ তার সুদের হার কমাবার নীতি অব্যাহত রাখবেন। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদেরাই বলছেন যে, তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতি ২০২২ সালে সরকারি হিসেবে ৩০ শতাংশ হতে পারে; তবে ‘ইএনএজি’র হিসেবে তা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হতে পারে! কারণ সরকারের বেতন বৃদ্ধির প্রভাবগুলি তখন অর্থনীতিতে পড়তে থাকবে।

এদিকে তুর্কি লিরার দরপতনের কারণে তুরস্কের আমদানি ব্যয় ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘নিকেই এশিয়া’ বলছে যে, দেশীয় মুদ্রার মূল্য নিম্নগামী হওয়ায় তুর্কিরা তাদের সঞ্চয় লিরা থেকে পরিবর্তন করে বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ, স্টক, ক্রিপ্টোকারেন্সি এমনকি বাড়িঘরে নিয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের ব্যাংকে সঞ্চিত সকল সম্পদের মাঝে ৬২ শতাংশই এখন বৈদেশিক মুদ্রায়। তুরস্কের ব্যাংকিং সেক্টর বিশ্লেষক উগুর গারসেস ‘নিকেই এশিয়া’কে বলছেন যে, লিরার দরপতন ঠেকানো না গেলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা আসতে পারে; আবার ব্যাংকগুলি থেকে গ্রাহকরা তাদের গচ্ছিত অর্থ ব্যাপকহারে সরিয়ে নিতে পারে। ‘ডয়েচে ব্যাংক’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যেভাবে মানুষ লিরা থেকে ডলারের দিকে যাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে লিরার দরপতন হচ্ছে, এবং একইসাথে মুদ্রাস্ফীতি যেভাবে বাড়ছে, তাতে জরুরি ভিত্তিতে সুদের হার বাড়ানোটাও বেশ কঠিন হয়ে যাবে।

এরদোগান নতুন তুরস্কের জনক হতে চাইছেন?

এরদোগান তার নীতিকে ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক নীতির সাফল্য দেখাতে এরদোগানের সরকার পরিসংখ্যানও পরিবর্তন করেছে। ‘ব্লুমবার্গ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৬ সালে এরদোগান তুরস্কের জিডিপির হিসাবে বিরাট পরিবর্তন আনেন; যার ফলশ্রুতিতে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের চাইতে বেশি বলে প্রতীয়মান হতে থাকে। নতুন হিসাবে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত ‘একে পার্টি’র সময়ে তুরস্কের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ; ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সালের মাঝে তা ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ হিসাব পরিবর্তনের আগে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ; আর ২০০৯ সালের পর ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিসংখ্যানও ভালো কোন প্রতিচ্ছবি দেখাতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০১৩ সালে তুরস্কের জিডিপি ছিল ৯’শ ৫৮ বিলিয়ন ডলার; ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৭’শ ২০ বিলিয়নে। অর্থাৎ ২০১৩ থেকে ২০২০এর মাঝে তুরস্ক তার জিডিপির এক চতুর্থাংশ হারিয়েছে।

 
এরদোগান তার সুদ কমাবার নীতিকে ইসলামের সাথে যুক্ত করতে চাইছেন; যদিও ইসলামে যে সুদ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ, তা তার অজানা থাকার কথা নয়। তথাপি তিনি তুর্কি জনগণের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ইসলামিক দেখাতে চাইছেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনে জেতার জন্যে এরদোগান সকল কিছুই করবেন। যার অংশ হিসেবে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির মাঝে যখন প্রতিনিয়ত দোকানে পণ্যের মূল্য পরিবর্তন করতে হচ্ছে, তখন তিনি ব্যাপকহারে বেতন বৃদ্ধি করেছেন। দেশের মানুষের জাতীয়বাদ জাগিয়ে তুলতে নতুন কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতেও তিনি হয়তো পিছপা হবেন না।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মার্ক চ্যাম্পিয়ন ‘ব্লুমবার্গ’এর এক লেখায় বলছেন যে, এরদোগান চাইছেন নতুন করে একটা ‘নরম প্রকৃতির ইসলামিস্ট তুরস্ক’ তৈরি করতে; যার ভিত্তি হিসেবে তিনি কম সুদের হার এবং দ্রুত বর্ধমান কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিকে রাখতে চাইছেন। ২০২৩ সালের মাঝে এরদোগান কিছু মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্কের আকৃতিই পরিবর্তন করে ফেলতে চাইছেন। অপরদিকে এরদোগান এবং তার ‘একে পার্টি’র সাথে সমমনা ‘ইসলামিস্ট’ ব্যবসায়ীরাই এর মাঝে সরকারি নীতির সুবিধা ভোগ করবে; আর তার বিরোধী কট্টর সেকুলাররা বঞ্চিত হবে। তুরস্কের কর কাঠামোগুলিকে এমনভাবে সাজানো হচ্ছে, যাতে করে সমাজের পুরোনো এলিটদের হাত থেকে সম্পদ নতুন এলিটদের হাতে চলে আসে। মার্ক চ্যাম্পিয়ন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তুরস্কে এহেন নীতি নতুন নয়। এরদোগানের আগে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা সামরিক বাহিনী এবং কট্টর সেকুলারদেরকে সুবিধা দিতো; মুদ্রানীতিও সেই আঙ্গিকেই হতো। প্রকৃতপক্ষে এরদোগান নতুন একজন ‘আতাতুর্ক’ বা নতুন এক তুরস্কের জনক হতে চাইছেন।

‘নিকেই এশিয়া’ বলছে যে, এরদোগান যেভাবে তুরস্কের অর্থনীতির কর্তৃত্ব নিয়েছেন, তাতে নিজের সিদ্ধান্ত উল্টে ফেলে নির্বাচনের আগে সুদের হার বৃদ্ধি করা রাজনৈতিকভাবে খুবই কঠিন হবে। এরদোগান তার সুদ কমাবার নীতিকে ইসলামের সাথে যুক্ত করতে চাইছেন; যদিও ইসলামে যে সুদ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ, তা তার অজানা থাকার কথা নয়। তথাপি তিনি তুর্কি জনগণের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ইসলামিক দেখাতে চাইছেন। মার্ক চ্যাম্পিয়ন বলছেন যে, এরদোগান একটা নরম ‘প্রকৃতির ইসলামিস্ট তুরস্ক’ তৈরি করে নতুন তুরস্কের জনক হতে চাইছেন। আর এরদোগানের সমালোচকেরাই তার নীতিকে ইসলামিক বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক লেখায় ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর সিনিয়র ফেলো আসলি আয়দিনতাসবাস এরদোগানের তথাকথিত ‘ইসলামিস্ট’ নীতির সমালোচনা করে বলছেন যে, একুশ শতকের জটিল অর্থনীতি সপ্তম শতাব্দীর নীতি দ্বারা চালনা করা সম্ভব নয়। তার কথায় অর্থনীতি চালাবার জন্যে বিজ্ঞজনদের নিয়ে এসে তাদের কথা শুনতে হবে। অর্থাৎ তিনি সার্টিফিকেট দিচ্ছেন যে, এরদোগানের সুদের হার কমাবার নীতি ইসলাম সমর্থিত।

২০২৩ সালের নির্বাচনে জেতার জন্যে এরদোগান সকল কিছুই করবেন। যার অংশ হিসেবে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির মাঝে যখন প্রতিনিয়ত দোকানে পণ্যের মূল্য পরিবর্তন করতে হচ্ছে, তখন তিনি ব্যাপকহারে বেতন বৃদ্ধি করেছেন। দেশের মানুষের জাতীয়বাদ জাগিয়ে তুলতে নতুন কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতেও তিনি হয়তো পিছপা হবেন না। কিন্তু তার ২০২৩ সালের মাঝে তুরস্ককে বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হওয়া থেকে বহুদূরে। আইএমএফএর হিসেবে তুরস্কের অর্থনীতি ২০২১ সালে ছিল বিশ্বের ২০তম। বরং সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি তুরস্কের জনগণের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়েছেন; দ্রব্যমূল্যের চাপে জনগণের জীবন হয়েছে দুর্বিসহ। তার দেশের সবচাইতে বড় হুমকি এখন তার নীতি ‘এরদোগানোমিকস’। তুর্কি জনগণ তাদের উসমানি খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর; যেই স্বপ্নকে দেখিয়েই এরদোগান তার জনমতের ভিত তৈরি করেছেন। কিন্তু ২০২২ সালে ‘এরদোগানোমিকস’এর অব্যবস্থাপনার কারণে সেই স্বপ্নে ভাটা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

Thursday 13 January 2022

তুরস্কে ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন?

১৩ই জানুয়ারি ২০২২

তুর্কি উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী ‘উলকুচু’ বা ‘গ্রে উল্ভস’ গ্রুপের ‘উলফ স্যালুট’। তুরস্কে সিরিয় শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলি ঘটনাগুলি একটা ধারাবাহিকতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। আঙ্কারায় সিরিয় শরণার্থীদের সাথে তুর্কিদের দাঙ্গার পর ‘আমরা সিরিয়দেরকে চাই না’, ‘আমরা কোন আফগান চাইনা’ এবং ‘তুরস্ক হলো শুধুমাত্র তুর্কিদের জন্যে’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সোশাল মিডিয়া ভরে যায়।

 
গত ১১ই জানুয়ারি তুরস্কের দক্ষিণের দিয়ারবাকির শহরে ১৮ বছর বয়সী একজন সিরিয় শরণার্থীকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ছুরিকাঘাত করা হয়। এর আগের দিন তুরস্কের বড় শহর ইস্তাম্বুলের বায়রামপাশা এলাকায় নাঈল আল নাঈফ নামের ১৯ বছর বয়সী আরেকজন সিরিয় শরণার্থীকে গভীর রাতে তার ঘরে ঢুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এর আগে ৯ই জানুয়ারি একজন তুর্কি নাগরিককে একজন সিরিয় শরণার্থী সিগারেট দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় ইস্তাম্বুলের এসেনইয়ুর্ত এলাকায় সিরিয়দের ব্যবহৃত একটা শপিং মলে অনেকজন দুর্বৃত্ত একত্রে হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, কয়েক’শ মানুষ মিছিল করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এবং স্লোগান দিচ্ছে ‘এটা তুরস্ক; সিরিয়া নয়’। তারা একসময় রাস্তার পার্শ্ববর্তী শপিং মলে হামলা চালিয়ে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং মলের ভেতরে থাকা সিরিয়দের উপর হামলা করে। তবে সবচাইতে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটে তুরস্কের পশ্চিমের শহর ইজমিরে। ১৬ই নভেম্বর কনস্ট্রাকশন সেক্টরে কাজ করা তিনজন সিরিয় কর্মীকে ঘুমের মাঝে পুড়িয়ে মারা হয়। প্রথমে ঘটনাটা দুর্ঘটনা বলে বলা হলেও পরে এর পিছনে হত্যার লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। পুলিশ প্রায় একমাস পর ২১শে ডিসেম্বর কেমাল কোরুকমাজ নামের ৪০ বছর বয়সী একজন তুর্কি নাগরিকের স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে হত্যাকান্ডের তদন্ত শুরু করে। ২৩ বছর বয়সী মামুন আল নাবহান, ২১ বছর বয়সী আহমেদ আল আলী, এবং ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ আল বিশ রাতের বেলায় তাদের ঘরে আগুন লাগলে আর বের হতে পারেননি। গ্রেপ্তারকৃত কেমাল কোরুকমাজ নিজেই ঘটনার দিন আরেক ব্যক্তিকে বলেছিল যে, সে সিরিয়দেরকে খুন করতে চায়। এই সূত্রে পুলিশ তার উপর নজরে রাখার পরেও ঘটনা ঘটে এবং ঘটনার দশ দিন পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, এই ঘটনাগুলি তুরস্কে শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মারাত্মক ধারাবাহিকতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। তবে এই সহিংসতা যে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে।

রাজনীতিবিদেরাই যখন উগ্র জাতীয়তাবাদী

তুরস্কে বর্তমানে ৬০ লাখের মতো অভিবাসী এবং শরণার্থী রয়েছে; যাদের মাঝে প্রায় ৩৬ লাখ হলো সিরিয়। তুরস্কের রাজনৈতিক মহলে অনেকেই বলতে শুরু করেছে যে, তুরস্কের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্যে সিরিয় শরণার্থীরাই দায়ী। ২০২১ সালে তুরস্কের একটা আদালত ইস্তাম্বুলের পূর্বের শহর বোলুর মেয়রের শরণার্থী বিরোধী কিছু সিদ্ধান্তকে খোলাখুলিভাবে বর্ণবাদী আখ্যা দিয়ে বাতিল ঘোষণা করে। তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল ‘রিপাবলিকান পিপলস পার্টি’ বা ‘সিএইচপি’র সদস্য মেয়র তানজু ওজকান সিরিয় শরণার্থীদের জন্যে ১১ গুণ বেশি মূল্যে পানি সরবরাহ করার পরিকল্পনা করেন; একইসাথে সিরিয়দের বিয়ের লাইসেন্স ১ লক্ষ লিরা ধার্য করেন। তিনি বলেন যে, এই সিদ্ধান্তের পিছনে তার উদ্দেশ্য হলো সিরিয় শরণার্থীদেরকে তার শহর থেকে তাড়ানো। ‘সিএইচপি’র নেতৃত্ব ওজকানের এহেন বর্ণবাদী সিদ্ধান্তের সমর্থন না করলেও তুর্কি রাজনীতিবিদেরা অনেকেই তাদের শরণার্থী বিরোধী কথা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানুয়ারির শুরুতেই তুরস্কের পুলিশ ডানপন্থী দল ‘জাফের পার্টি’র প্রধান উমিত ওজদাগএর বিরুদ্ধে ‘মানুষের মাঝে ঘৃণা ছড়ানো’র অভিযোগ আনে। অথচ অভিযোগ দায়ের কথার তিন বছরেরও বেশি সময় আগে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওজদাগ দাবি করেছিলেন যে, সিরিয় শরণার্থীরা স্থূলকায় হয়ে যাচ্ছে; যেখানে তুর্কিরা দারিদ্র্যের মাঝে পতিত হচ্ছে। ওজদাগ একদিন একটা সিরিয় মালিকানার দোকানে ঢুকে ট্যাক্সের কাগজ এবং পরিচয়পত্র দেখতে চান এবং পুরো ব্যাপারটাকে ভিডিও করে অনলাইনে প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি দোকান মালিককে তুর্কি ভাষা না বলতে পারার জন্যে তিরস্কার করেন। তিনি টুইটারে লেখেন যে, এই দোকান মালিকের মতো আরও ৯ লক্ষ লোক তুরস্কে রয়েছে; যারা তুরস্কের জন্যে হুমকি। আরেকটা ঘটনায় গত নভেম্বরে তুরস্কের বিরোধী দল ‘আইওয়াইআই পার্টি’র সদস্য ইলায় আসকোয় ৪৫ জন সিরিয়কে তুরস্কের অর্থনীতিকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ভিডিও তৈরির অভিযোগে দেশ থেকে বের করে দেয়ার ব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন। তুর্কি মিডিয়া ‘আহভাল’ বলে যে, গত অক্টোবরে তুরস্কের রাস্তায় এক ব্যক্তি মিডিয়াকে বলে যে, তুর্কিরা অর্থনৈতিকভাবে খুব খারাপ রয়েছে; অথচ তুরস্কে থাকা সিরিয়রা বেশ রয়েছে। তিনি বলেন যে, তিনি কলা কিনতে পারছেন না; অথচ সিরিয়রা কেজি কেজি কলা কিনতে পারছে। এই সাক্ষাতের পর তুরস্কে বসবাসরত কয়েকজন সিরিয় অনলাইনে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে কলা খাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২১এর অগাস্টে আঙ্কারার আলতিনদাগ এলাকায় সিরিয় শরণার্থী এবং তুর্কিদের মাঝে দ্বন্দ্ব হানাহানিতে পরিণত হয়। এর মাঝে দু’জন তুর্কি ছুরিকাহত হয়; যাদের একজন পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করে। ঘটনার পর শতশত তুর্কি শহরের সিরিয় বাড়িঘর, দোকানপাট এবং গাড়ি ভাংচুর করে। এই ভাংচুরের দৃশ্য অনেকেই টুইটারে লাইভ প্রকাশ করে। ভিডিওগুলিতে অনেককেই দেখা যায় উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান ব্যবহার করতে। কেউ কেউ তাদের হাত দিয়ে ‘উলফ স্যালুট’ দিচ্ছিলো; যা হলো তুর্কি উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী ‘উলকুচু’ বা ‘গ্রে উল্ভস’ গ্রুপের চিহ্ন। দাঙ্গার পর ‘আমরা সিরিয়দেরকে চাই না’, ‘আমরা কোন আফগান চাইনা’ এবং ‘তুরস্ক হলো শুধুমাত্র তুর্কিদের জন্যে’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সোশাল মিডিয়া ভরে যায়।

তুরস্কের শরণার্থী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘হেপিমিজ গোচমেনিজ’এর একজন সদস্য য়িলদিজ ওনেন ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, ‘আইওয়াইআই পার্টি’ বা ‘সিএইচপি’র সদস্য বোলুর মেয়র বা উমিত ওজদাগএর মতো লোকেরা যখন বারংবার বলতে থাকে যে শরণার্থীরা তুরস্কের প্রধান সমস্যা, তখন কিছু উগ্রপন্থী লোক শরণার্থীদের উপর হামলা করার কারণ পেয়ে যায়। এটা শুধু কয়েক ব্যক্তির কর্মকান্ড নয়, বরং পুরো দেশে কয়েক মাস ধরে চলা রাজনৈতিক পরিবেশই এসকল ঘটনার জন্যে দায়ী। ওনেন বলছেন যে, সবচাইতে মারাত্মক ব্যাপার হলো, এই ঘটনাগুলি তুরস্কের সরকার বা মিডিয়ার কাছে তেমন কোন গুরুত্বই পায়নি; অথচ লক্ষ লক্ষ তুর্কি, যারা জার্মানিতে বসবাস করে জাতিগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তাদের ব্যাপারগুলি পুরোপুরি আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে। যখন জার্মানিতে তুর্কিদের উপর হামলা হয়, তখন রাজনীতিবিদেরা এবং সরকার কঠোর বিবৃতি দেয়; অনেকেই রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। অথচ ইস্তাম্বুলের এসেনইয়ুর্ত এলাকার ভিডিওতে যখন শতশত মানুষকে সিরিয় দোকানে হামলা করতে দেখা গেলো, তখন মাত্র সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলো!

 
আঙ্কারার রাস্তায় 'উলফ স্যালুট' দিচ্ছে তুর্কি যুবারা। সিরিয় শরণার্থীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলি তুরস্কের সরকার বা মিডিয়ার কাছে তেমন কোন গুরুত্বই পায়নি; অথচ লক্ষ লক্ষ তুর্কি, যারা জার্মানিতে বসবাস করে জাতিগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তাদের ব্যাপারগুলি পুরোপুরি আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে। যখন জার্মানিতে তুর্কিদের উপর হামলা হয়, তখন রাজনীতিবিদেরা এবং সরকার কঠোর বিবৃতি দেয়; অনেকেই রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। অথচ ইস্তাম্বুলের এসেনইয়ুর্ত এলাকার ভিডিওতে যখন শতশত মানুষকে সিরিয় দোকানে হামলা করতে দেখা গেলো, তখন মাত্র সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলো!

ইজমিরের নৃশংসতা

তুর্কি পত্রিকা ‘ইয়েনি সাফাক’ বলছে যে, ইজমিরের হত্যাকান্ডের স্বীকারোক্তি দেয়া কেমাল কোরুকমাজ ঘটনার ১০ দিন পর গত ২৬শে নভেম্বর দু’জন ব্যক্তিকে আলাদাভাবে ছুরিকাঘাত করে। পুলিশের সামনে সে গর্ব করে স্বীকার করে যে, এর আগে তিনজন সিরিয় নাগরিককে সে নিজেই আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তুর্কি মিডিয়া ‘এভরেনসেল’ বলছে যে, কোরুকমাজ পুলিশকে বলে যে, সে দুই দশক আগে তুরস্কের সামরিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘জেআইটিইএম’এর অধীনে গোপন মিশনে কাজ করতো। সে বলে যে, সে তার গাড়ির উইন্ডশিল্ডের উপর সিরিয়দেরকে হত্যা করার ব্যাপারে পরপর তিনটা নির্দেশনা পাবার পরেই কাজটার পরিকল্পনা শুরু করে। সে অভিযোগ করে যে, সিরিয়রা আসার পর থেকে সে চাকুরি পাচ্ছিলো না। সে মৃত ব্যক্তিদের সাথে একই বাড়িতে থাকা শুরু করে, যা কংক্রিট কোম্পানি ‘বিরলিক বেটন’এর মালিকানায় ছিলো। ঘটনার রাতে সে বের হয়ে গিয়ে পাঁচ লিটার পেট্রোল কিনে এনে বাড়িতে আগুন লাগায়।

ইজমিরে পুড়ে মারা যাওয়া সিরিয়দের একজনের ভাই আহমেদ আল বিশ তুরস্কের কুর্দি মিডিয়া ‘রুদাউ’কে বলেন যে, ভবিষ্যতে যাতে এধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য তিনি ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’, তুরস্কের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছেন। এধরনের হামলা জাতীয়তাবাদীরা করছে বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। মৃত আরেকজনের ভাই আহমেদ আল নাবহান তুর্কি মিডিয়া ‘দুভার’কে বলেন যে, পুলিশ তাকে বলেছিল যাতে সে ঘটনার ব্যাপারে চুপ থাকে। পুলিশ এক ব্যক্তিকে সন্দেহ করছে; এবং সেই ব্যক্তি গ্রেপ্তার হবার আগ পর্যন্ত যেন সে কাউকে কিছু না বলে। আল নাবহান আরও বলেন যে, তিনি চান সরকার যাতে সুষ্ঠু বিচার করে এবং বর্ণবাদ রোধে দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সাজা দেয়। তিনি বলেন যে, তুর্কি, সিরিয়, ইরাকি, জর্ডানিয়ানরা সকলেই মুসলিম। তুরস্কের ১৩টা মানবাধিকার সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে বলে যে, ইজমিরের ঘটনাটা ছিল পুরোপুরিভাবে বর্ণবাদী চিন্তা প্রসূত। তারা ঘটনা তুরস্কের জনগণ এবং মৃতদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্যে তুর্কি সরকারকে দায়ী করেন। তুরস্কের মানবাধিকার এসোসিয়েশন ‘আইএইচডি’র প্রধান জাফের ইনসে বলেন যে, তারা জানেন যে, আইন শৃংখলা বাহিনী এবং অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তবে দায়ী ব্যক্তি নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে এক মারাত্মক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই কাজটা করেছে। যদিও এখনও তদন্ত শুরুর দিকে রয়েছে, তথাপি এটা বোঝা যাচ্ছে যে, অনেক লোক এই ঘটনায় জড়িত।

 
তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা সিরিয় শরণার্থীদেরকে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্যে দায়ী করছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন তা হলো, শরণার্থী সমস্যার মাঝেই তুরস্কের জিডিপি ২০০৯ সালে সাড়ে ৬’শ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৩ সাল নাগাদ সাড়ে ৯’শ বিলিয়নে পৌঁছায়। তুরস্কের অর্থনীতি যখন ভালো ছিল, তখন কেউ শরণার্থী নিয়ে কথা বলেনি; অর্থনীতি খারাপ হবার সাথেসাথেই অনেকেই এর জন্যে শরণার্থীদের দায়ী করতে থাকে।

তুরস্কের শরণার্থী রাজনীতি

২০২১এর জুলাইএ তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল ‘সিএইচপি’র প্রধান কেমাল কিলিশদারোগলু বলেন যে, তার দলের পাঁচটা মূল লক্ষ্যের একটা হলো সিরিয় শরণার্থীদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো। তারা ক্ষমতায় যাবার দুই বছরের মাঝেই সকল শরণার্থীকে ফেরত পাঠাবেন; এবং এব্যাপারে তাদের সকল পরিকল্পনা করাই আছে। এর জবাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, তিনি তুরস্কে আশ্রয় খোঁজা ‘আল্লাহতে বিশ্বাসী’ মানুষদেরকে খুনিদের হাতে তুলে দেবেন না। তবে এরদোগানের এই কথাগুলির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করেন অনেকেই। ‘মাইগ্রেশন পলিসি ইন্সটিটিউট’এর লেখায় বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালে তুরস্ক ইইউএর সাথে সিরিয় শরণার্থীদের ব্যাপারে একটা চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক তুরস্ক ইইউএর সীমানা থেকে শরণার্থীদেরকে দূরে রাখবে। ইইউ শরণার্থীদের জন্যে ডেবিট কার্ড ইস্যু করে তাদেরকে অর্থ সহায়তা দিতে থাকে; যা ব্যবহার করে শরণার্থীরা বাজার থেকে কেনাকাটা করতে থাকে। চুক্তির ফলে ইইউতে শরণার্থী আসা অনেক কমে যায়। চুক্তিতে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে ইইউএর উপর চাপ সৃষ্টি করতে তুরস্ক ২০২০এর প্রথমাংশে কয়েক লক্ষ শরণার্থীকে গ্রিসে পাঠানোর হুমকি দেয়। এই ঘটনা বলে দিচ্ছে যে, ইইউ এবং তুরস্কের মাঝে শরণার্থী চুক্তি একটা অস্বস্তিকর চুক্তি, যা রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত।

তুরস্কের চাপের মুখে ২০২১এর জুনে ইইউ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, তারা শরণার্থীদের জন্যে তুরস্ককে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আরও ৩ বিলিয়ন ইউরো সহায়তা দেবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইইউ গত ডিসেম্বরে ঘোষণা দেয় যে, ১৫ লক্ষ শরণার্থীর ডেবিট কার্ডে ৩’শ ২৫ মিলিয়ন ইউরো দেয়া হবে; যা ব্যবহার করে তারা তাদের দরকারি খাদ্য, বাড়িভাড়া, পরিবহণ এবং ঔষধ কেনাকাটা করতে পারবে। ইইউএর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার জানেজ লেনারসিচ বলেন যে, এই অর্থ সহায়তার ফলে শরণার্থীরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে, তাদের কোন জিনিসটা সবচাইতে বেশি দরকার; এবং একইসাথে তারা তুরস্কের অর্থনীতিকে সহায়তা দিতে পারবে।

‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, ইইউএর শরণার্থী দূরে রাখার প্রবণতা এবং তুরস্কে শরণার্থীদের অর্থায়নে ইইউএর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ব্যাপারে তুর্কি রাজনীতিবিদেরা সর্বদাই সমালোচনার ঝড় তুলেন। এরদোগানের তুর্কি সরকারের অভিযোগ যে, ইইউ তুরস্ককে যে পরিমাণ অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা না দিয়ে গ্রিসকে অর্থায়ন করে যাচ্ছে। চুক্তির পাঁচ বছর পর শরণার্থী নীতির ব্যাপারে ইইউ আগের চাইতে অনেক বেশি বিভাজিত; এবং চুক্তির শর্তগুলি এখন ভেঙ্গে পড়ছে।

 
তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল উগ্র জাতীয়তাবাদী 'সিএইচপি'র প্রধান কেমাল কিলিশদারোগলু। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার ‘একে পার্টি’ শরণার্থীদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করেনি। অপরদিকে তুরস্কের বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলিও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না পেয়ে দায়ভার চাপিয়েছে শরণার্থীদের উপর; যা কিনা তাদেরকে ডানপন্থীদের ভোট পেতে সহায়তা করবে। মোটকথা সিরিয় শরণার্থীরা এবং ডানপন্থী উগ্রবাদীরা এখন তুরস্কের রাজনৈতিক ময়দানে খেলার গুটি ছাড়া আর কিছুই নয়।

তুরস্কের উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার নেপথ্যে

‘ডেইলি সাবাহ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১১ সালে সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত তুরস্কে ৬০ হাজার অভিবাসী প্রত্যাশী ছিল। এখন তুরস্কে প্রায় ৬০ লক্ষ অভিবাসী বসবাস করছে; যার মাঝে প্রায় ৪০ লক্ষই এসেছে সিরিয়া থেকে। আর ২০১৬ সালে ইইউএর সাথে শরণার্থী চুক্তি করার পর তুরস্কে আরও ২০ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নেয়। রেড ক্রিসেন্ট বলছে যে, তুরস্কে শরণার্থীদের অর্ধেকই প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগাড় করতে পারছে না। আর করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে শরণার্থীদের উপর ঋণের বোঝা আগের চাইতে দ্বিগুণ হয়েছে। আর গত অগাস্টে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়নের পর তুরস্কে আবারও নতুন করে শরণার্থী আসার শংকা শুরু হয়। এই শংকাকে কেন্দ্র করে তুরস্কে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আরেক দফা শরণার্থী বিরোধী কর্মকান্ড দানা বাঁধে। তুরস্কের ‘রিসার্চ সেন্টার ফর এসাইলাম এন্ড ইমিগ্রেশন’ বা ‘আইজিএএম’এর প্রধান মেতিন কোরাবাতির ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, তুরস্কের উগ্র জাতীয়তাবাদের পিছনে রাজনীতিবিদদের একটা বড় অবদান রয়েছে। তারা অনেকেই ২০২৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখেই শরণার্থীদেরকে দেশে ফেরত পাঠাবার কথা বলছেন। সমাজ গবেষক উলাস সুনাতাও বলছেন যে, রাজনীতিবিদেরা যখন বারংবার বলছেন যে, শরণার্থীরা দেশে ফেরত পাঠানো হবে, তখন সামনের দিনগুলিতে আরও মারাত্মক সহিংসতা অপেক্ষা করবে।

তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা সিরিয় শরণার্থীদেরকে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্যে দায়ী করছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন তা হলো, শরণার্থী সমস্যার মাঝেই তুরস্কের জিডিপি ২০০৯ সালে সাড়ে ৬’শ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৩ সাল নাগাদ সাড়ে ৯’শ বিলিয়নে পৌঁছায়। তবে অর্থনৈতিক অবব্যস্থাপনার কারণে তুরস্কের জিডিপি কমে এখন ৭’শ বিলিয়নে নেমে এসেছে। বিশেষ করে ২০১৮ সাল থেকে তুর্কি লিরার ব্যাপক দরপতন ঠেকাতে না পারার ফলশ্রুতিতে মারাত্মক মূল্যস্ফীতি গ্রাস করেছে তুরস্কের অর্থনীতিকে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, তুরস্কের অর্থনীতি যখন ভালো ছিল, তখন কেউ শরণার্থী নিয়ে কথা বলেনি; অর্থনীতি খারাপ হবার সাথেসাথেই অনেকেই এর জন্যে শরণার্থীদের দায়ী করতে থাকে।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার ‘একে পার্টি’ শরণার্থীদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করেনি। এরদোগান একদিকে যেমন সিরিয় শরণার্থীদেরকে সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপে যাবার ট্রানজিট দিয়ে ইইউকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করেছেন, তেমনি সিরিয় শরণার্থীদেরকে তিনি ‘আল্লাহতে বিশ্বাসী’ শরণার্থী বলেই থাকতে দিয়েছেন বলে তুর্কি জনগণের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়েছেন। একইসাথে বিরোধী জাতীয়তাবাদী দলগুলিকে তিনি আক্রমণ করেছেন ‘বিশ্বাসী জনগণ’কে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করার জন্যে। এগুলি তিনি করেছেন তার ভোট ব্যাংক বাড়াবার উদ্দেশ্যেই। এরদোগানের সরকার শরণার্থীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটা আন্তরিক, তা ইজমিরে তিনজন সিরিয় কর্মীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে তার সরকারের প্রায় একমাস গোপন রাখার মাঝেই বোঝা যায়। অপরদিকে তুরস্কের বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলিও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না পেয়ে দায়ভার চাপিয়েছে শরণার্থীদের উপর; যা কিনা তাদেরকে ডানপন্থীদের ভোট পেতে সহায়তা করবে। মোটকথা সিরিয় শরণার্থীরা এবং ডানপন্থী উগ্রবাদীরা এখন তুরস্কের রাজনৈতিক ময়দানে খেলার গুটি ছাড়া আর কিছুই নয়।

Tuesday 11 January 2022

ইউরোপজুড়ে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থাকেই তুলে ধরে

১২ই জানুয়ারি ২০২২

প্যারিসের রাস্তায় ভ্যাকসিন বিরোধী অন্দোলন। ডোজের পর ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া সত্ত্বেও যখন ‘ওমিক্রণ’এর সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি; লিবারাল আদর্শ নয়। ফ্রান্স এবং চেক রিপাবলিকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বলে দিচ্ছে যে, রাজনীতিবিদেরা মূলতঃ জনগণের মতামতের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, জনগণ পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

 
নতুন বছরের শুরুতেই পুরো ইউরোপ উত্তপ্ত হয়েছে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনে। ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিকসহ ইউরোপের দেশগুলিতে করোনার ভ্যাকসিনের বিষয়ে সরকারি বাধ্যবাধতার বিরুদ্ধে চলছে এই বিক্ষোভ। বেশিরভাগ স্থানেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও কিছু শহরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। বিক্ষোভকারীরা ভ্যাকসিন নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপারটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর আগে গত ১৮ই ডিসেম্বর ফ্রান্সে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, এবারের বিক্ষোভ তার চাইতে চার গুণ বড় ছিল।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ৮ই জানুয়ারি ভ্যাকসিনের বাধ্যবাধকতার বিরোধিতা করে ফ্রান্সে ১ লক্ষ ৫ হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে। পুলিশ বলছে যে, রাজধানী প্যারিসে প্রচন্ড ঠান্ডা এবং বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১৮ হাজার মানুষ ‘সত্য’, ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘ভ্যাকসিন পাস মানি না’ লেখা প্লাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করে। অনেকেই তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রে রেখেছিল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁকে। এক সপ্তাহ আগেই ম্যাক্রঁ ‘লে প্যারিসিয়ান’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে ভ্যাকসিন বিরোধীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত খারাপ শব্দ ব্যবহার করে হুমকি দেন যে, যারা ভ্যাকসিন নেবে না তিনি তাদের জীবন এতটাই দুর্বিসহ করে ফেলবেন যে, তারা বাধ্য হবে ভ্যাকসিন নিতে। আন্দোলনকারীরা ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধেও একই ধরনের খারাপ শব্দ ব্যবহার করে প্রতিবাদ করে। একজন বিক্ষোভকারী ‘রয়টার্স’কে বলেন যে, এটা ছিল ম্যাক্রঁর ‘শেষ চেষ্টা’। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, সরকার তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা ছাড়াও নাগরিকদের মাঝে পার্থক্য করছে।

এই বিক্ষোভ এমন সময়ে এলো, যখন এক সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রান্সে ‘ওমিক্রন’ ভ্যারিয়্যান্টের কারণে একদিনে ৩ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। অথচ ইউরোপের দেশগুলির মাঝে ফ্রান্স সবচাইতে বেশি ভ্যাকসিন দেয়া দেশগুলির একটা। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ১২ বছরের বেশি বয়সের জনগণের ৯০ শতাংশকেই পুরোপুরি ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। আইসিইউগুলি ভর্তি হয়ে যাচ্ছে; হাসপাতালগুলি চাপের মাঝে রয়েছে। আর এর আগের দিন ৬ই জানুয়ারি ফ্রান্সের পার্লামেন্টে আইন পাস করে বলা হয় যে, জনগণকে রেস্টুরেন্টে খেতে, আন্তশহর বাসে চড়তে বা কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হলে পুরোপুরিভাবে ভ্যাকসিন নিতে হবে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ফরাসি সিনেটে বিরোধী দলের শক্তি বেশি থাকায় সেখানে বিল পাস হতে কিছু সময় লাগতে পারে। এই আইন ১৫ই জানুয়ারি থেকেই বাস্তবায়িত হবার কথা রয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে পুলিশ ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। ১০ জন পুলিশ অফিসারও কিছুটা আহত হয়। মঁপেলিয়ে শহরে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে।

অস্ট্রিয়ার পুলিশ বলছে যে, রাজধানী ভিয়েনাতে ৪০ হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে। সেখানে আগামী মাস থেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জার্মানিতেও অনেকগুলি শহরে বিক্ষোভ চলে। এর মাঝে সবচাইতে বড় বিক্ষোভ হয় হামবুর্গ শহরে; যেখানে ১৩ হাজার মানুষ রাস্তায় ছিল। সেখানে প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘যথেষ্ট হয়েছে; আমাদের সন্তানদেরকে রেহাই দাও’। একজন বিক্ষোভকারী তার গায়ে ইহুদিদের ‘স্টার অব ডেভিড’ বহন করছিলেন; যেখানে লেখা ছিল ‘ভ্যাকসিন নেয়া হয়নি’। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদিদের গায়ে বাধ্যতামূলকভাবে ‘স্টার অব ডেভিড’ এঁকে রাখার নির্দেশনার সাথে তুলনা দেয়া হয়। জার্মানিতে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা চলছে। সেখানে এক মাস আগে থেকে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদেরকে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, ৯ই জানুয়ারি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। পুলিশ ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করে। বিক্ষোভকারীদের প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘ভ্যাকসিন একনায়কতন্ত্র’। বেলজিয়ামে রেস্টুরেন্ট, বার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কোভিড পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে এক সপ্তাহে নতুন সংক্রমণ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। চেক রিপাবলিকে ৬০ বছরের উপরে জনগণ, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ এবং জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দেশটার নতুন কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা নেবার আগে এই পরিকল্পনাগুলির বিরোধিতা করেছিল। এখন ক্ষমতায় গিয়ে নীতি পরিবর্তন করে তারা বিভিন্ন প্রফেশনালদের বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চাইছে।

 
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন। ইউরোপের সরকারগুলি করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগের নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের দুই শতকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ভিত্তিক চিন্তাকে জ্বলাঞ্জলি দিচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তুলে ধরতে চাইলেও সরকার তাদের সংখ্যাকে ছোট বলে এড়িয়ে যেতে চাইছে।

ইতালির তুরিন শহরেও শতশত মানুষ বিক্ষোভ করে। সেখানে ৫০ বছরের বেশি বয়সী সকল ব্যক্তির ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যমূলক করা হয়েছে। আর ১১ই জানুয়ারি থেকে ইতালিতে ভ্যাকসিন না নিলে কেউ রেস্টুরেন্টে ঢুকতে পারবে না, অথবা গণপরিবহণে চড়তে পারবে না। জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্ল লাউটারবাক ‘ডাই আম সনটাগ’ পত্রিকাকে বলেন যে, স্বল্প সংখ্যক মানুষ সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে উপেক্ষা করে সেচ্ছায় মিথ্যা তথ্যের মাঝে ডুবে থাকতে চাইছে। তিনি বলেন যে, ভ্যাকসিন বিরোধীরা এবং করোনাভাইরাসকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দেয়া মানুষেরা সকল মাপকাঠি এবং লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে।

‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, জার্মানির মিনডেন শহরে আড়াই হাজার এবং ড্রেসডেন শহরে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে মানব বন্ধন করে। তাদের বক্তব্য ছিল, তারা ভ্যাকসিন বিরোধীদের আক্রমণের শিকার। এর মাঝে ৭ই জানুয়ারি অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার পুরোপুরি ভ্যাকসিন নেবার পর বুস্টার ডোজ নিয়েও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকা নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে ফ্রান্সের বিক্ষোভগুলি এমন সময়ে এসেছে, যখন কিছুদিন পরেই সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ভ্যাকসিন বিরোধীদের বিরুদ্ধে খারাপ শব্দ ব্যবহার করে বেশ বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছেন।

ইউরোপের সরকারগুলি করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগের নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের দুই শতকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ভিত্তিক চিন্তাকে জ্বলাঞ্জলি দিচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তুলে ধরতে চাইলেও সরকার তাদের সংখ্যাকে ছোট বলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ডোজের পর ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া সত্ত্বেও যখন ‘ওমিক্রণ’এর সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি; লিবারাল আদর্শ নয়। ফ্রান্স এবং চেক রিপাবলিকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বলে দিচ্ছে যে, রাজনীতিবিদেরা মূলতঃ জনগণের মতামতের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, জনগণ পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।