Wednesday 7 September 2022

নতুন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ব্রিটেনের নীতি কেমন হবে?

০৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২
 
নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ১০ ডাউনিং স্ট্রীটের বাড়ির সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন। গত ৭ বছরে ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের রাজনৈতিক কলহকেই দেখিয়ে দেয়। ব্যাপক মূল্যস্ফীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও ট্রাসের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো কনজারভেটিভ পার্টিকে একত্রে রাখা। তবে ট্রাসের সামরিক বাজেট বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি এবং চীনকে হুমকি হিসেবে দেখাটা জনসনের চাইতে অপেক্ষাকৃত কট্টর পররাষ্ট্রনীতির দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।


লিজ ট্রাসকে ব্রিটেন নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেল। বরিস জনসন তার প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়ার সাথেসাথেই ট্রাস তার দায়িত্ব নেন। গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা আদর্শিক রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসেবে ট্রাসের নীতি কেমন হবে তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। ট্রাস দায়িত্ব নেবার পরপরই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটের বাড়িতে এক সংবাদ সন্মেলনে তার সরকারের প্রাথমিক তিনটা লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমতঃ তিনি ব্রিটিশ সরকারকে আবারও কার্যকর করবেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি জ্বালানি সংকটকে মোকাবিলা করবেন। এবং তৃতীয়তঃ তিনি তিনি নিশ্চিত করবেন যাতে জনগণ সরকারের স্বাস্থ্য সেবা সুষ্ঠুভাবে পায়।

লিজ ট্রাস ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি ব্রিটেনের সামরিক বাজেট বর্তমানে জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০৩০ সালের মাঝে ৩ শতাংশে উন্নীত করতে চান। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এর অর্থ হলো সামরিক বাজেটে প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি। অর্থাৎ সামরিক খাতে ব্যয়ের জন্যে ব্রিটিশ সরকারকে আগামী ৮ বছরে অতিরিক্ত প্রায় ১’শ ৮০ বিলিয়ন ডলার যোগাড় করতে হবে। এই বাজেট বৃদ্ধির অর্থ হতে পারে সামরিক সদস্যদের সংখ্যা বর্তমান ১ লক্ষ ৪৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মাঝে ১ লক্ষ ৯০ হাজারে উন্নীত করা। এই বাজেটের সংকুলান করতে গিয়ে আয়কর ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে অথবা মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বর্তমান ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আর সেটা সম্ভব না হলে সরকারি বাজেটের অন্যান্য খাতে খরচ কমাতে হবে; যার মাঝে বিভিন্ন সরকারি সেবা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন খরচ থাকতে পারে। সামরিক বাজেট বৃদ্ধিতে লিজ ট্রাসকে নিঃসন্দেহেই জনগণকে মোকাবিলা করতে হবে; যা খুব একটা সহজ হবে না। সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করতে হলে আগামী ৮ বছরের মাঝে অন্যান্য বড় সরকারি খাতগুলিতে খরচ কমাতে হবে; যেমন – স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, শিক্ষা, আইন শৃংখলা, ব্যবসা, জ্বালানি এবং পরিবহণ।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর এসোসিয়েট ফেলো কুয়েন্টিন পীল ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ট্রাস তার নির্বাচনের আগে বলেছেন যে, তিনি কর কমাবেন এবং ভর্তুকি বাদ দেবেন। অথচ জ্বালানি মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তাকে বিশাল ভর্তুকি দিতেই হবে। একইসাথে, সামরিক বাজেট বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যখাতে সেবা নিশ্চিত করতে ট্রাসকে সরকারের খরচ যথেষ্টই বাড়াতে হবে। তবে ট্রাসের সামনে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো কনজারভেটিভ পার্টিকে একত্রে রাখা। কারণ ঋষি সুনাকের সাথে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রেই দলকে বিভক্ত করেছে। দু’জন পদপ্রার্থী সর্বসন্মুখে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন। আর নির্বাচনেও ট্রাস কনজারভেটিভ পার্টির অর্ধেক সদস্যের ভোটই যোগাড় করতে পারেননি; এবং যারা পার্লামেন্টের সদস্য, তাদের সমর্থনও তিনি খুব একটা পাননি। এমনকি এটাও অবাস্তব নয় যে, তিনি হয়তোবা বেশিদিন প্রধানমন্ত্রী নাও থাকতে পারেন; যদি তিনি তার দলকে একত্রিত না রাখতে পারেন। তবে গত নির্বাচনে বরিস জনসন পার্লামেন্টে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, সেটার উপরে ভর করেই তাকে এগুতে হবে। অপরদিকে জনসনের তুলনায় আশেপাশের মানুষকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা ট্রাসের অপেক্ষাকৃতভাবে কম।

বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ট্রাস সামরিক বাজেট যতটা বাড়াতে চাইছেন, শান্তিকালীন সময়ে তেমন উদাহরণ খুব কমই রয়েছে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ সালের মাঝে জার্মানির চাপে সামরিক বাজেট জিডিপির আড়াই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। আর ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে সামরিক বাজেট জিডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়েছিল। তবে ১৯৫০এর দশকের পর থেকে ব্রিটেন সামরিক বাজেট কমিয়ে স্বাস্থ্য এবং পেনশন খাতে খরচ বৃদ্ধি করতে পেরেছিল।

‘রুসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, গত ৭ দশকে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা না থাকায় ব্রিটেন তার সামরিক বাজেট কমিয়ে রাখতে পেরেছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ন্যাটো দেশগুলি, এমনকি চীন এবং রাশিয়াও সামরিক বাজেট কর্তন করে। কিন্তু ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় এখন হয়তো বাজেটের প্রধান খাতগুলির বন্টন নিয়েই চিন্তা করতে হবে। তবে যদি ব্রিটিশ নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বাড়তে থাকে এবং সামরিক বাজেট বৃদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন যোগাড় করা সম্ভব হয়, তাহলে ২০৩০এর পর জিডিপির ৩ শতাংশের বেশিও প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করা সম্ভব হতে পারে।

‘ভয়েস অব আমেরিকা’ বলছে যে, গত ৭ বছরে ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের রাজনৈতিক কলহকেই দেখিয়ে দেয়। আর মাত্র ৮১ হাজার পার্টি সদস্যের ভোট পেয়ে তিনি নির্বাচিত হওয়া ট্রাসের ভিত শক্ত নয়। নিজ দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও ট্রাস ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন; যা এখন পর্যন্ত ঠেকেছে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে। এছাড়াও ট্রাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় চীনের ব্যাপারে জনসনের চাইতে কট্টর নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কাজেই তার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় চীনকে হুমকি হিসেবেই দেখা হবে। ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর বিশ্লেষক জন কাম্ফনার বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ থাকবে; কারণ ওয়াশিংটনকে সর্বদাই ভাবতে হচ্ছে যে তারা ইউরোপের সাথে থাকবে, নাকি ব্রিটেনের সাথে থাকবে। আমেরিকানরা এটা নিয়ে বিরক্ত।

কুয়েন্টিন পীল বলছেন যে, ট্রাস হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার আগের সরকারের নীতিই অনুসরণ করবেন। তবে যে জায়গাটায় দ্বন্দ্ব হতে পারে তা হলো ইইউএর সাথে সম্পর্ক। জনসনের সরকারে থাকার সময় তিনি ইইউএর সাথে কঠোর নীতিতে যাবার পক্ষে ছিলেন। সেই নীতি এখন বাস্তবায়ন করতে গেলে ইইউএর সাথে সম্পর্ক নিঃসন্দেহে খারাপ হবে। ট্রাসের কথাতে আদর্শের উপস্থিতি থাকলেও তিনি এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন ইস্যুতে তার মত পরিবর্তন করেছিলেন। অপরদিকে ‘রুসি’ বলছে যে, সামনের দিনগুলিতে ব্রিটেন হয়তো তার কৌশলগত নৌ এবং দূরপাল্লার আকাশ শক্তিকে শুধুমাত্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাক না করে চীনের দিকেও নিয়ে আসতে পারে; বিশেষ করে চীন যদি তাইওয়ানে আগ্রাসন চালায় তাহলে চীন ব্রিটেনের প্রতি প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

No comments:

Post a Comment