Monday 26 September 2022

ইউক্রেনকে ঘিরে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা কতটুকু?

২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
পুতিন হয়তো মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয় বন্ধুরা, বিশেষ করে জার্মানরা হয়তো পুতিনের হুমকিকে ভিন্ন চোখে দেখতে পারে; যদিও জার্মানরা আপাততঃ কোন দুর্বলতা দেখায়নি। তবে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, মার্কিনীরা পুতিনের পারমাণবিক হুমকিকে সত্যিকারের বুঝেও উপেক্ষা করতে প্রস্তুত; যা কিনা ইউরোপে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

গর ২১শে সেপ্টেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন ভাষণে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে আংশিক ‘মোবিলাইজেশন’এর ঘোষণা দেন; যার অর্থ হলো, কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের মাঝ থেকে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক রিক্রুটিংএর ব্যবস্থা করা। তার দ্বিতীয় ঘোষণাটা ছিল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশদের দখল করা এলাকায় গণভোটের আয়োজন করা। আর তৃতীয় ঘোষণাটা ছিল, রাশিয়া তার নিজস্ব ভূমি রক্ষায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। ভ্লাদিমির পুতিনের এই ঘোষণাগুলিকে সকলেই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সবচাইতে মারাত্মক অবস্থা বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যদিও পুতিন বলেছেন যে, ‘মোবিলাইজেশন’এর মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে পূর্বে সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রায় ৩ লক্ষ নাগরিককে ডাকা হবে, তথাপি সংখ্যাটা এর চাইতেও অনেক বাড়তে পারে। এই ঘোষণার পর রাশিয়ার ৩০টা শহরে বিক্ষোভ হয়েছে; যেখানে শতশত মানুষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। দ্বিতীয় ঘোষণায় দখলকৃত এলাকায় গণভোটের কথা বলা হলেও মূলতঃ সেই অঞ্চলগুলিকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত এটা। তৃতীয় ঘোষণায় পুতিন বলেছেন যে, দখলকৃত এলাকাগুলি যদি রাশিয়ার অংশ হয়ে যায়, তাহলে রাশিয়া সেই অঞ্চলগুলিকে রক্ষায় তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে প্রস্তুত থাকবে। রাশিয়ার কাছে বহু কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেও পশ্চিমাদের মূল ভয় হলো রাশিয়া ছোট আকারের ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেন এবং তাদের পশ্চিমা বন্ধুদেরকে মনস্তাত্বিকভাবে দুর্বল করে ফেলে তাদেরকে যুদ্ধ বন্ধের জন্যে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারে। পুতিনের এই হুমকি কোন ফাঁকা হুমকি নয়। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের আহ্বান করে যে, তারা যেন রাশিয়াকে বার্তা দেয় যে, পশ্চিমারা রাশিয়ার পারমাণবিক ‘ব্ল্যাকমেইল’এ পিছু হটবে না এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে পশ্চিমারা মারাত্মক জবাব দেবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পীস’এর সিনিয়র ফেলো আলেক্সান্ডার বাউনভ এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, রুশ কর্মকর্তারা সবসময়েই বলেছেন যে, তারা ইউক্রেনে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। এটা তারা বলতে পারেন, কারণ ইউক্রেনে তাদের লক্ষ্য কি, তা তারা কখনোই পরিষ্কার করে বলেননি। ফলে তারা প্রথমে পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর লক্ষ্যকে শুধুমাত্র ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মাঝে সীমাবদ্ধ করতে পারতেন। সেটাও না হলে ডোনেতস্ক ও লুহানস্ক এলাকার নিয়ন্ত্রণের মাঝে সীমাবদ্ধ করতে পারতেন। সেটাও না হলে যতটুকু পাওয়া গেছে, সেগুলিকে রুশ অঞ্চল ঘোষণা দিয়ে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে পারতেন। মূলতঃ কত ভূমি রাশিয়া নেবে সেটা গুরুত্বপূর্ন নয়; বরং রাশিয়া যা বলেছে, সেটা করবে, সেটা প্রমাণ করা। যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার অর্জনগুলি প্রায় শূণ্য হয়ে গিয়েছে, তাই পুতিন আবারও হিসেবটা পরিবর্তন করেছেন; যাতে করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেখানে রয়েছে, সেখানেই থেমে যায়। যদি সেই হুমকিতেও কাজ না হয়, তাহলে পুতিনকে আবারও প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি মিথ্যা বলছেন না। আর তখন তার হুমকিগুলিকে বিশ্বাস করাতে আরও মারাত্মক কাজ করতে হবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ১০ জন বিশ্লেষক আলাদাভাবে তাদের বিশ্লেষণে বলেছেন যে, ভ্লাদিমির পুতিন এখন ইউক্রেনে যথেষ্ট খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন বলেই তিনি আংশিক ‘মোবিলাইজেশন’এর ঘোষণা দিয়েছেন এবং একইসাথে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলকে রুশ এলাকা বলে ঘোষণা দিয়ে সেই এলাকাকে পারমাণবিক অস্ত্রের ছত্রছায়ায় আনার কথা বলেছেন। পুতিন যদি যুদ্ধে হেরে যাবার মতো অবস্থায় পড়ে যান, তাহলে তিনি ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। কাউন্সিলের বিশ্লেষকেরা সর্বসম্মতিক্রমে বলেছেন যে, রুশদের এই হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা যেন কোন অবস্থাতেই ছাড় না দেয়। পুতিন হয়তো মনে করছেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াবার জন্যে পশ্চিমারা নিশ্চয়ই রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাতে যাবে না। কিন্তু পশ্চিমাদেরকে বুঝতে হবে যে, রাশিয়ার দাবির সামনে মাথা নত করার অর্থ হলো অন্য রাষ্ট্রের জন্যে একটা উদাহরণ তৈরি করে দেয়া, যে জোর করে একটা রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তন করা যায়। কাজেই পশ্চিমাদের উচিৎ হবে পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিকে আমলে না নিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখা। তারা আরও বলছেন যে, যদি রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ পরিস্থিতি বিবেচনা করে রুশদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী বাহিনীর উপরে প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মারাত্মক হামলা করা অথবা রুশদের আক্রমণের একইরূপ জবাব প্রদান করা। মোটকথা, কাউন্সিলের সকলেই রুশদের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিকে এড়িয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা দানের কথা বলেছেন; এবং সেটা তারা বলেছেন এই কারণে নয় যে, পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন না; বরং তারা পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার সত্ত্বেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবার কথা বলেছেন!

আলেক্সান্ডার বাউনভ বলছেন যে, যুদ্ধের সাত মাসের মাথায় খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের পিছু হটার কারণে রাশিয়াতে ডানপন্থী গ্রুপগুলি, যারা ‘মোবিলাইজেশন’সহ আরও কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে ছিল, তাদের কথাই পুতিন শুনতে বাধ্য হয়েছেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, কোণঠাসা হয়ে যাবার কারণে পুতিন আগের চাইতে আরও মারাত্মক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে কঠিন পরিণতি হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির মুখে মার্কিনীরা কেউই পিছু হটার পক্ষপাতি না থাকলেও তাদের ইউরোপিয় বন্ধুরা কি একই কথাই বলবে? জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ পুতিনের ভাষণকে চাপের মুখে পড়ে বক্তব্য বলে আখ্যা দিলেও মার্কিন সেনাবাহিনীর ‘ওয়ার কলেজ’এর প্রফেসর জন ডেনি ‘পলিটিকো’র এক লেখায় ইউক্রেনকে যথেষ্ট সহায়তা না দেয়ার জন্যে জার্মানি ও ফ্রান্সের সমালোচনা করেন; এবং এই দেশগুলির নীতি সহজে পরিবর্তিত হবে না বলেও মন্তব্য করেন। পুতিন হয়তো মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয় বন্ধুরা, বিশেষ করে জার্মানরা হয়তো পুতিনের হুমকিকে ভিন্ন চোখে দেখতে পারে; যদিও জার্মানরা আপাততঃ কোন দুর্বলতা দেখায়নি। তবে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, মার্কিনীরা পুতিনের পারমাণবিক হুমকিকে সত্যিকারের বুঝেও উপেক্ষা করতে প্রস্তুত; যা কিনা ইউরোপে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment