Saturday 29 February 2020

করোনাভাইরাস – ইরানের নেতৃত্বের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ

২৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২০

  
সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে ফ্লাইট চালানো এবং চীনে ভ্রমণ করাটা ইরানের সাধারণ জনগণের কাজ নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও রোগের প্রাদুর্ভাবকে ছোট করে উপস্থাপন এবং রোগ ছড়াবার খবরকে ইরানের নির্বাচন আটকাতে বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ বলে আখ্যা দেয়াটা ইরানের নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা কমার পিছনে কাজ করবে। একইসাথে ‘কোয়ার‍্যানটিন’কে প্রস্তরযুগের পদ্ধতি আখ্যা দেবার মাঝ দিয়ে ইরানের নেতৃত্ব নিজের জনগণ তথা বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে এটাই ইরানের নেতৃত্বের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।



ইরানের কর্মকর্তারা ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন যে, সেদেশে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩’শ ৮৮তে পৌঁছেছে। আর এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪এ। তবে ‘বিবিসি’র পার্সি সার্ভিস হাসপাতাল থেকে নিজস্ব প্রচেষ্টায় উপাত্ত সংগ্রহ করে খবর দেয় যে, কমপক্ষে ২’শ ১০ জন এই রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। ইরানি কর্মকর্তারা এই সংখ্যাকে অস্বীকার করেন। কিন্তু ইরানি কর্মকর্তাদের বিবৃতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইরানের উপ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইরাজ হারিরচি সাংবাদিক সন্মেলনে বলেন যে, ইরান এই ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। তিনি ইরানের ক্বোম শহরের আইনপ্রণেতা আহমেদ আমিরিয়াবাদি ফারাহানির দাবিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, আসল সংখ্যা যদি ফারাহানির সংখ্যার অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশও হয়, তবে তিনি তার পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। তিনি তখন বলেন যে, ইরানে মাত্র ৬১ জনের মাঝে ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে; মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। তিনি আরও বলেন যে, ইরান ‘কুয়ার‍্যানটিন’ বা পৃথকীকরণের বিরোধী; কারণ এধরণের চিন্তা প্রস্তরযুগের। ‘নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিন বলছে যে, তিনি এই কথাগুলি যখন বলছিলেন, তখন প্রচন্ড ঘামছিলেন এবং ঘনঘন টিস্যু দিয়ে তার কপাল মুছছিলেন। পরদিন টুইটারে এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন যে, তিনিও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং নিজেকে ‘কুয়ার‍্যানটিন’ বা পৃথক করেছেন।

ইরানি কর্মকর্তাদের কথা থেকে আক্রান্তদের মাঝ থেকে কতজন মৃত্যুবরণ করছে, তা নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা। চীন থেকে আসা সংখ্যাগুলিকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেখানে আক্রান্তদের মাঝ থেকে ৩ শতাংশ বা তারও কম মৃত্যুবরণ করেছে। ইরানের সরকারি হিসাবগুলিকে বিশ্বাস করলে দেখা যায় যে, সেই একই সংখ্যা ৮ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশের মাঝে ওঠানামা করছে। শুধু তা-ই নয়, ইরানের আক্রান্তদের একটা বড় অংশ হলো জেষ্ঠ্য সরকারি কর্মকর্তা। ২৭শে ফেব্রুয়ারি ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুমেহ এবতেকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর আসে। আক্রান্ত হবার খবর আসার আগের দিনই তিনি প্রেসিডেন্ট রুহানি এবং তার ক্যাবিনেটের সাথে এক বৈঠকে যোগ দেন। আক্রান্তদের মাঝে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান। এছাড়াও তেহরানের একজন ডিস্ট্রিক্ট মেয়র মোস্তফা রাহমানজাদেহ ২২শে ফেব্রুয়ারি ভাইরাসে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ‘রেডিও ফারদা’ বলছে যে, সনাক্ত হবার ক’দিন আগেই রাহমানজাদেহ তেহরানের সিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মোহসেন হাসেমির সাথে সভায় যোগ দিয়েছিলেন। ভ্যাটিকানে ইরানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হাদি খসরুশাহি ৮১ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করেছেন। আইনপ্রণেতা মাহমুদ সাদেগি ২৫শে ফেব্রুয়ারি টুইটারে বলেন যে, তাঁ বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ; তার বয়স ৫৭। তবে আক্রান্তদের সকলেই বৃদ্ধ নন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ইরানের মহিলা ফুটবল খেলোয়াড় এলহাম শেইখি মাত্র ২৩ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে মারা যান।

২৪শে ফেব্রুয়ারি কানাডার ‘টরন্টো ইউনিভার্সিটি’র গবেষকদের এক গবেষণার ফলাফলে বলা হয় যে, ইরানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৮ হাজারেরও বেশি হতে পারে। তারা ইরান থেকে বিভিন্ন দেশে যাওয়া মানুষের মাঝে করোনাভাইরাস ছড়াবার ঘটনাগুলিকে পরিসংখ্যান মডেলের মাঝে এনে হিসেব করেছেন। যেহেতু ইরানের সাথে আশেপাশের অনেক দেশেরই বিমানে যাতায়াত খুবই কম, তাই সেই কম সংখ্যক যাত্রীর মাঝেও ভাইরাসের উপস্থিতি পেতে হলে ইরানে বহু সংখ্যক মানুষের মাঝে এই রোগের সংক্রমণ হতে হবে। ইরানের সরকারি হিসেবে ১৯শে ফেব্রুয়ারি প্রথম মৃতের খবর আসে শিয়াদের পবিত্র শহর ক্বোম থেকে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ভাইরাসের প্রদুর্ভাব শুরু হয় তিন থেকে ছয় সপ্তাহ আগে; জানুয়ারি মাসে। এর অর্থ হচ্ছে মৃত ব্যক্তিরা কয়েক সপ্তাহ ধরে অন্যদেরকে আক্রান্ত করেছে। সরকারি হিসেবে প্রথম মৃত্যুর আট দিনের মাথায় এই রোগ ইরানের ৩১টার প্রদেশের মাঝে ২৪টায় ছড়িয়েছে বলে বলা হচ্ছে। প্রদুর্ভাব রোধে যাতায়াত কমাতে বলা দূরে থাকুক, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ক্বোমের প্রতিনিধি মোহাম্মাদ সাঈদি এক ভিডিও বার্তায় বলেন যে, ক্বোমের পবিত্র মাজারগুলি হলো আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পথ; তাই মানুষের উচিৎ এখানে আসা। ইরান থেকে ইতোমধ্যেই আজেরবাইজান, জর্জিয়া, আফগানিস্তান, কুয়েত, বাহরাইন, আমিরাত, ওমান, ইরাক, লেবানন, পাকিস্তান এবং কানাডায় এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। এর মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই রোগ বহণকারীরা ক্বোম শহর ঘুরে এসেছেন। ২৭শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মাইক রায়ান জেনেভাতে এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, ইরানে করোনাভাইরাস ঢোকার সময় কেউ খেয়াল করেনি। তাই রোগের প্রাদুর্ভাব যা দেখা যাচ্ছে, তার চাইতে হয়তো আরও অনেক বেশি হতে পারে।

মার্কিন অবরোধে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং এর ফলশ্রুতিতে রাস্তায় বিক্ষোভ ও সহিংসতা; ৩রা জানুয়ারি কাসেম সুলাইমানি হত্যার পর যুদ্ধের শংকা; ৮ই জানুয়ারি ভুলবশতঃ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে প্রথমে তা অস্বীকার করা; ইত্যাদি সঙ্কটের মাঝে ইরান বন্ধু খুঁজেছে। ২রা ফেব্রুয়ারি ইরান সরকার অফিশিয়ালি চীনে ফ্লাইট বন্ধ করে দিলেও দু’দিন পর চীনা রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের সময় ইরানের প্রভাবশালী ‘মাহান এয়ার’এর প্রধান হামিদ আরাবনেযাদ চীনে ফ্লাইট চালু রাখার ঘোষণা দেন। ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত ‘মাহান এয়ার’ চীনের সাথে ৫৫টা ফ্লাইট অপারেট করে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে ফ্লাইট চালানো এবং চীনে ভ্রমণ করাটা ইরানের সাধারণ জনগণের কাজ নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও রোগের প্রাদুর্ভাবকে ছোট করে উপস্থাপন এবং রোগ ছড়াবার খবরকে ইরানের নির্বাচন আটকাতে বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ বলে আখ্যা দেয়াটা ইরানের নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা কমার পিছনে কাজ করবে। একইসাথে ‘কোয়ার‍্যানটিন’কে প্রস্তরযুগের পদ্ধতি আখ্যা দেবার মাঝ দিয়ে ইরানের নেতৃত্ব নিজের জনগণ তথা বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে এটাই ইরানের নেতৃত্বের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।


Thursday 27 February 2020

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা কতটুকু?

২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০২০
 
পাকিস্তানের কাছে তুরস্কের ‘টি ১২৯ আতাক’ হেলিকপ্টার রপ্তানির কার্যাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে সমস্যায় পড়েছে; কারণ হেলিকপ্টারের টারবোফ্যান ইঞ্জিন তুরস্কে তৈরি নয়
 
তুরস্কের বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আজেরবাইজানের বার্তাসংস্থা ‘আজেরনিউজ’ বলছে যে, এবছরের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে আজেরবাইজান তুরস্ক থেকে প্রায় ৮৯ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসস্ত্র আমদানি করেছে; যা কিনা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। আগের বছরের ডিসেম্বরেও দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ১০৩ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার হয়েছিল। ডিসেম্বরে সারা বিশ্বে তুরস্ক প্রায় ২’শ ৮৯ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসস্ত্র রপ্তানি করে। আর ২০১৯ সালে পুরো বছরে তুরস্ক ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করে। সাম্প্রতিক সময়ে অস্ত্র রপ্তানি হয়ে গিয়েছে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০১৭ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সুদান সফরের সময় দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষাশিল্প সংক্রান্ত সহযোগিতার চুক্তি গত ৫ই ফেব্রুয়ারি তুর্কি পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়। গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি এরদোগান তার পাকিস্তান সফরের সময় ঘোষণা দেন যে, পাকিস্তানের সাথে তুর্কি প্রতিরক্ষা শিল্পগুলি ৬৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার মূল্যমান সাড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুর্কিদের সাথে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্পের সহযোগিতাকে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে নিয়মিত বৈঠক হয়ে আসছে। গত ২৪শে জানুয়ারি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৭ম বৈঠক। বৈঠকে যৌথভাবে অস্ত্র উৎপাদন এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে জোর দেয়া হয়। কিয়েভে তুর্কি রাষ্ট্রদূত আহমেত গুলদেরে প্রতিরক্ষা শিল্পকে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের উদীয়মান তারকা বলে উল্লেখ করেন। তুর্কি বার্তাসংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘এফএনএসএস’এর প্রধান নাইল কুর্ত বলেন যে, গত ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার ‘পিটি পিনদাদ’এর সাথে ‘কাপলান এমটি’ নামের একটা মিডিয়াম ট্যাঙ্ক তৈরি করার জন্যে তারা চুক্তি চুড়ান্ত করে। এর ফলে ২০২০ সালের মাঝে প্রথম প্রোটোটাইপ তৈরি করা ছাড়াও ২০২১এর মাঝে ১৮টা ট্যাঙ্ক তারা সরবরাহ করবে। অন্য দু’টি দেশের সাথে এই ট্যাঙ্ক রপ্তানির জন্যেও কথাবার্তা চলছে। এছাড়াও গত ডিসেম্বরে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম যোমার্ত তোকাইয়েভ একটা নতুন আইনে স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে তুরস্কের সাথে কাজাখস্তানের সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া, ট্রানজিট, মেডিক্যাল শান্তিরক্ষা ছাড়াও দুই দেশের মাঝে সামরিক শিল্পের ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথাও সেখানে বলা হয়।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প যেভাবে গড়ে উঠেছে

  
তুরস্কের নৌবাহিনীর জন্যে তৈরি করা ‘মিলজেম ক্লাস’ কর্ভেটের বেশিরভাগটা তুরস্কের নিজস্ব হলেও রাডার, টর্পেডো, ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ পশ্চিমা দেশ থেকে আমদানি করা
 
যুদ্ধজাহাজ তৈরি - সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ-র হাত ধরে যার যাত্রা শুরু

জাহাজ নির্মাণে তুর্কিদের দক্ষতা ৬’শ বছরের। প্রথম শিপইয়ার্ড স্থাপিত হয় ১৩৯০ সালে। ২০০৩ সালে যেখানে তুরস্কে ৩৭টা শিপইয়ার্ড ছিল, ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৮০তে। এর মাঝে ২টা সরকারি, ৩টা সামরিক বাহিনীর এবং বাকিগুলি বেসরকারি। এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নৌবাহিনীর শিপইয়ার্ড। ১৪৫৫ সালে ‘ইস্তাম্বুল নেভাল শিপইয়ার্ড’এর প্রতিষ্ঠা হয় কন্সটান্টিনোপল বিজয়ী সুলতান মেহমেত ‘দ্যা কঙ্কারার’এর হাতে, যিনি মুহাম্মদ আল-ফাতিহ নামেও পরিচিত। সাড়ে ৪’শ বছর ধরে এই শিপইয়ার্ড উসমানি খিলাফতের নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ করছে। ষোড়শ শতাব্দীতে একত্রে ২’শ যুদ্ধজাহাজ তৈরি করার সক্ষমতার এই শিপইয়ার্ড ছিল দুনিয়ার সবচাইতে বড় শিপইয়ার্ডগুলির একটা। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ১৮৩০ সালে প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিত জাহাজ তৈরি করে তারা। ব্রিটিশ সহায়তায় ১৮৮৬ সালে প্রথম সাবমেরিন তৈরি করা হয় এখানে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই শিপইয়ার্ডের যন্ত্রপাতি গোলচুক শিপইয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৪১ সালে ‘ইস্তাম্বুল শিপইয়ার্ড’এর জায়গায় ‘তাসকিজাক শিপয়ার্ড’ স্থাপিত হয়, যা ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ছোট যুদ্ধজাহাজ ডিজাইন, তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে। ১৯৯৯ সালে ভূমিকম্পের পর পেনদিকএ স্থানান্তরিত হয় এই শিপইয়ার্ড, যেখানে মূলত বড় আকারের বাণিজ্যিক জাহাজ তৈরি হতো। তুর্কি নৌবাহিনীর হাতে চলে যাবার পর এর নাম হয় ‘ইস্তাম্বুল নেভাল শিপইয়ার্ড’, যা বর্তমানে ৩’শ মিটার পর্যন্ত দৈঘ্যের এবং ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার সামরিক ও বেসামরিক জাহাজ নির্মাণে সক্ষম।

তবে বর্তমান সময়ে জটিল যুদ্ধজাহাজ তৈরির কর্মকান্ডের সূত্রপাত হয় ১৯৭০এর দশকের মাঝামাঝি, যখন জার্মান ‘টাইপ ২০৯’ ডিজাইনের সাবমেরিন তৈরি শুরু করে ‘ইস্তাম্বুল নেভাল শিপইয়ার্ডে’। জার্মান সহায়তায় প্রায় তিন দশকে ১১টা সাবমেরিন তৈরি করে তুরস্ক। এর প্রায় একইসাথে ১৯৮০এর দশকে জার্মান ‘মেকো ২০০’ ডিজাইনের ফ্রিগেট তৈরি শুরু হয়। জার্মান সহায়তায় ‘ইয়াভুজ-ক্লাস’এর এরকম দু’টা ফ্রিগেট তৈরি হয় ‘ইস্তাম্বুল নেভাল শিপইয়ার্ডে’। প্রায় একই ডিজাইনের আরও দু’টা ফ্রিগেট ১৯৯০এর দশকে তৈরি করে তারা। ২০০৫ সাল থেকে কাজ শুরু হয় তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের ‘মিলজেম-ক্লাস’ কর্ভেটএর। উদ্দেশ্য ছিল নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পে উৎপাদিত সর্বোচ্চ পরিমাণ যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা। ৪টা কর্ভেট তৈরির পর ২০১৮ সালে পাকিস্তান আরও ৪টা এরকম জাহাজ তৈরির অর্ডার দেয় তুরস্ককে। ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে প্রথম জাহাজের কাজ শুরু হয়। অন্যদিকে, ২০০৮ সালে তুরস্ক সাবমেরিন তৈরির নতুন প্রকল্প নেয়, যার মাধ্যমে ৬টা জার্মান ‘টাইপ ২১৪’ ডিজাইনের অত্যাধুনিক সাবমেরিন তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। এই প্রকল্পে সাবকন্ট্রাক্টর হিসেবে থাকছে তুরস্কের ‘আসেলসান’, ‘হাভেলসান’, ‘মিলসফট’, ‘এসটিএম’, ‘কচ’, ‘তুবিতাক’, ‘মেতেকসান’, ‘আয়েসাস’ এবং আরও কিছু। প্রথম সাবমেরিনটা ২০১৫ সালে কাজ শুরু হয়ে পানিতে ভাসানো হয় ২০১৯এর ডিসেম্বরে। এছাড়াও তুর্কি নৌবাহিনীর জন্যে ১৯টা মিসাইল বোট এবং ৬টা মাইন হান্টার তৈরি হয় এই শিপইয়ার্ডে। ‘ওসমান গাজী’ নামের ৩ হাজার ৭’শ টনের একটা উভচর ট্যাঙ্ক ল্যান্ডিং শিপ এবং ১৯ হাজার টনের ‘আকার-ক্লাস’এর সাপ্লাই জাহাজও এখানে তৈরি হয় ১৯৯০এর দিকে।

বেসরকারি খাতে কালকাভান পরিবারের মালিকানায় লজিস্টিকস কোম্পানি ‘তুরকন হোল্ডিং’এর অধীনে রয়েছে ‘সেদেফ শিপইয়ার্ড’, যা ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা পায়। এখানেই তৈরি হচ্ছে তুরস্কের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আনাদোলু’, যা ২০২১ সালে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর হবার কথা রয়েছে। তুর্কি নৌবাহিনীর ‘আকার-ক্লাস’এর একটা সাপ্লাই জাহাজ ‘ইউজবাশি কুদরেত গুঙ্গর’ এখানে তৈরি হয়েছিল ১৯৯০এর দশকের প্রথম অর্ধ্বে। এটা ছিল তুর্কি নৌবাহিনীর জন্যে তুরস্কের কোন বেসরকারি শিপইয়ার্ডের তৈরি প্রথম জাহাজ। ১৯৫০এর দশকে প্রতিষ্ঠিত ‘আনাদোলু শিপইয়ার্ড’ মূলতঃ বাণিজ্যিক জাহাজ তৈরি করলেও ২০০৯ সালে নৌবাহিনীর জন্যে ৮টা ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং ২০১১ সালে ৭ হাজার ২’শ টনের ‘বায়রাকতার-ক্লাস’এর দু’টা ল্যান্ডিং শিপ তৈরির কাজ পায়। ১৯৮২ সালে অটো মেশিনারি সেক্টরের কোম্পানি ‘সেলাহ ইন্ডাস্ট্রিজ’এর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় ‘সেলাহ শিপইয়ার্ড’। এই শিপইয়ার্ড ২০১৫ সালে নৌবাহিনীর জন্যে ৬ হাজার টন ধারণক্ষমতার দু’টা সাপ্লাই জাহাজ তৈরির কাজ পায়। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মাঝে ‘এসএনআর হোল্ডিং’এর মালিকানায় থাকা ‘ইস্তাম্বুল শিপইয়ার্ড’ তুর্কি নৌবাহিনীর জন্যে জটিল এবং অত্যাধুনিক ৩টা সাবমেরিন রেসকিউ জাহাজ তৈরি করেছে। এই শিপইয়ার্ড ১৯৮০এর দশকে তৈরি হলেও ২০০৩ সালে ‘এসএনআর’এর অধীনে আসার পরেই এর কাজে গতি আসে। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘এসটিএম’ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করলেও তারা সবচাইতে নাম করেছে নৌবাহিনীর প্রকল্পগুলিতে। তারা তুরস্কের ‘মিলজেম-ক্লাস’ কর্ভেটের ডিজাইন এবং ইন্টিগ্রেশনের কাজ করেছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্যে ১৫ হাজার টনের একটা বড় সাপ্লাই জাহাজের কাজও তারা পায় ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালে জাহাজটা পাকিস্তান নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তুর্কি নৌবাহিনীর সাবমেরিনগুলিকে মডার্নাইজ করার কাজটা তারা পেয়েছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর ফরাসী নির্মিত ‘আগোস্তা ৯০বি’ সাবমেরিনের মডার্নাইজ করার কাজটাও তারা পেয়েছে। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘দিয়ারসান শিপইয়ার্ড’ তুরস্ক নৌবাহিনীর জন্যে ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মাঝে ৫৬ মিটার লম্বা ‘তুজলা-ক্লাস’এর ১৬টা এন্টি সাবমেরিন প্যাট্রোল বোট তৈরি করে। ১৯৯০এর দশকের শেষের দিকে ‘কচ হোল্ডিং’এর বিনিয়োগে তৈরি করা ‘আরএমকে ম্যারিন’ শিপইয়ার্ডে ৩ হাজার ২’শ টনের দু’টা ছোট আকারের সাপ্লাই জাহাজ তৈরি করা হয়। ২০০৭ সালে তারা তুর্কি কোস্ট গার্ডের জন্যে ‘দোস্ত-ক্লাস’এর ১৭’শ টনের ৪টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল তৈরির কাজ পায়।

জাহাজের ইঞ্জিনের ক্ষেত্রেও স্বাধীন হতে পারেনি তুরস্ক; তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ২০১৮এর এপ্রিলে ঘোষণা আসে যে, তুরস্কের পাঁচটা শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘সেদেফ’, ‘আনাদোলু’, ‘সেফিনে’ ‘সেলাহ’ এবং ‘ইস্তাম্বুল’ মিলে একত্রে ম্যারিন ইঞ্জিন ডেভেলপ করবে। ‘টারকিশ এসোসিয়েটেড ইন্টারন্যাশনাল শিপইয়ার্ডস’ বা ‘টিএআইএস’ নামে একটা কনসোর্শিয়ামের জন্ম দেয় তারা। ‘আনাদোলু শিপইয়ার্ড’এর প্রধান নির্বাহী সুয়াল্প উর্কমেজ বলেন যে, আড়াই বছরের মাঝে এই কনসোর্শিয়াম একটা ইঞ্জিনের প্রোটোটাইপ ডেভেলপ করবে এবং সাড়ে চার বছরের মাঝে সেটাকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে নেবে তারা। তার হিসেবে এই কনসোর্শিয়ামের প্রথম ১০ বছরের অপারেশনের মাঝে ১’শ ম্যারিন ইঞ্জিনের চাহিদা তৈরি হবে। এবং একইসাথে আরও ৪’শ জাহাজের ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে হবে। তুর্কি ম্যারিটাইম চেম্বারের চেয়ারম্যান মেতিন কালকাভান বলেন যে, তুরস্ক হলো পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে কিনা সকল ধরনের যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে পারে, কিন্তু নিজেদের ইঞ্জিন তৈরির কারখানা নেই। তিনি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, ‘যে কোন মূল্যে’ দেশীয় শিপইয়ার্ডগুলিকে ইঞ্জিনসহ সকল যন্ত্রাংশ নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন করতে হবে।

তবে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের উত্থান শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই। গ্রীকদের বিরুদ্ধে সাইপ্রাসের যুদ্ধে জড়াবার কারণে ১৯৭৪ সালে মার্কিনীরা তুরস্কের উপর অস্ত্র অবরোধ আরোপ করে; যদিও তুরস্ক ছিল ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র। ন্যাটো সদস্য দেশগুলির উপর অস্ত্রের জন্যে পুরোপুরি নির্ভর থাকার কারণে তুরস্ক বিরাট সমস্যায় পড়ে যায়। সেই সময় থেকেই তুরস্ক নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে। ১৯৮৫ সাল নাগাদ প্রতিরক্ষা সেক্টরের কোম্পানিগুলিকে সঠিকভাবে দেখভাল করার লক্ষ্যে সরকার ‘আন্ডারসেক্রেটারিয়াট অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘এসএসএম’ প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠানটাই পরবর্তী তিন দশকের বেশি সময় ধরে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের ভিত গড়তে সহায়তা করে।
  
‘রকেটসান’এর ডেভেলপ করা ৮ কিঃমিঃ পাল্লার ট্যাঙ্কধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ‘উমটাস’
 
ইলেকট্রনিক্স, সিস্টেম ও অর্ডন্যান্স শিল্প - ট্যাঙ্ক রেডিও থেকে যার শুরু

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তুরস্কের সামরিক শিল্পের একটা ইতিহাস পাওয়া যাবে ‘আসেলসান’এর ইতিহাস থেকে। তুর্কি সামরিক বাহিনীর যোগাযোগের যন্ত্রপাতি তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আসেলসান’। ১৯৮০ সাল নাগাদ কোম্পানিটি সৈন্যদের বহণ করা এবং ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত রেডিও তৈরি শুরু করে। ১৯৮৬ সাল থেকে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারএ প্রবেশ করে কোম্পানিটি। ১৯৮৭ সাল নাগাদ তারা যৌথভাবে বিমান বিধ্বংসী ‘স্টিংগার’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে পদার্পণ করে। ১৯৮৮ সালে তারা ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানের ‘ইনারশিয়াল ন্যাভিগেশন সিস্টেম’ তৈরি শুরু করে। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে প্রথম প্রযুক্তি সরবরাহ করে তারা। ১৯৯০ সালে তারা আর্টিলারির জন্যে ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম ছাড়াও টেলিভিশন ট্রান্সমিটার তৈরি শুরু করে। ১৯৯২ সালে রাডার সিস্টেমের উপর কাজ শুরু করে তারা; আর ১৯৯৫ সালে প্রথম মোবাইল ফোন তৈরি করে। ১৯৯৮ সাল থেকে থার্মাল এবং লেজার যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করে ‘আসেলসান’। ১৯৯৯ সালে বিমান প্রতিরক্ষা কমান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম এবং এক্স-ব্যন্ড স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স সিস্টেমের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয় তারা। উত্তর সিরিয়াতে তুর্কি সেনাবাহিনীর চালানো ‘অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ড’এর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ২০১৭ সাল থেকে ‘আসেলসান’ তুর্কি সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলির নিরাপত্তার জন্যে ‘আক্কর পুলাত’ নামের একটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম সরবরাহ করার শুরু করে। এই সিস্টেম ট্যাঙ্কের গায়ে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করার আগেই রাডারের মাধ্যমে বুঝে ফেলে এবং ট্যাঙ্ককে রক্ষার জন্যে ব্যবস্থা করে। মডার্নাইজ করা ১’শ ৬৯টা ‘এম ৬০টি’ ট্যাঙ্কের মাঝে ৪০টাতে এই সিস্টেম বসানো হয়।

তুরস্কের বিমান বাহিনীর রাডারগুলির মেইনটেন্যান্সের জন্য ১৯৮২ সালে ‘হাভেলসান’ প্রতিষ্ঠা পায় টারকিশ এয়ার ফোর্স ফাউন্ডেশনের হাত ধরে। ১৯৯৭ সালে কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম, ট্রেনিং সিমুলেশন, এবং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে কাজ শুরু করে কোম্পানিটা। সামরিক সফটওয়্যারের সাথে সাথে ই-গভর্ন্যান্স সফটওয়্যারও তারা ডেভেলপ করে।

ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কোম্পানি ‘রকেটসান’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে। এই কোম্পানির এগুনোর ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প। সলিড কম্পোজিট ফুয়েল রকেট ইঞ্জিন তৈরির প্রযুক্তি তুরস্কের হাতে আসে এই প্রকল্পের মাধ্যমেই। ১৯৯২ সালে শুরু হয়ে ১৯৯৯ সালে শেষ হবার আগেই এই প্রকল্পের বদৌলতে তুরস্ক ১১ কিঃমিঃ পাল্লার ‘টিআর ১০৭’ রকেট, ৪০ কিঃমিঃ পাল্লার ‘টিআর ১২২’ রকেট এবং ১২২ মিঃমিঃ মাল্টি ব্যারেল রকেট ডেভেলপ করে। তুরস্কের সেনাবাহিনীর জন্যে ‘কাসিরগা’ এবং ‘ইলদিরিম’ রকেট ডেভেলপ করে ‘রকেটসান’। ২০০৪ সাল থেকে তুর্কি সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের জন্যে ‘সিরিট’ ৭০ মিঃমিঃ লেজার গাইডেড রকেট ডেভেলপ করার সময় তারা লেজার গাইড্যান্স, ইন্টারমিডিয়েট স্টেজ গাইড্যান্স, ইনসেনসিটিভ রকেট মোটর এবং ইনসেনসিটিভ ওয়ারহেডের মতো জটিল প্রযুক্তি পেয়ে যায়। ২০০৫ সাল থেকে আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ৮ কিঃমিঃ পাল্লার ‘উমটাস’ ট্যাঙ্কধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তারা ডেভেলপ করা শুরু করে এবং ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে উৎপাদন। ভূমি থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ৪ কিঃমিঃ পাল্লার ‘ওমটাস’ ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও তারা ডেভেলপ করে। আরেকটা প্রকল্প হচ্ছে বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ‘হিসার’; ১৫ কিঃমিঃ পাল্লার ‘হিসার এ’ এবং ২৫ কিঃমিঃ পাল্লার ‘হিসার ও’। এর ডেভেলপমেন্ট শুরু হয় ২০০৭ সালে। এর জন্যে ‘কালকান’ এক্স ব্যান্ড থ্রিডি রাডার তৈরি করে ‘আসেলসান’, ওয়ারহেড ও ব্যাটারি ডেভেলপ করে তুর্কি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘তুবিতাক’ এবং ডাটালিঙ্ক তৈরি করে ‘মেতেকসান সাভুনমা’। ২০০৯ সাল থেকে ‘রকেটসান’ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের জন্যে বর্ম ডেভেলপ করার শুরু করে। ২০১৬ সাল থেকে ‘স্মার্ট মাইক্রো মিউনিশন’ ডেভেলপ করা শুরু করে তারা; যার উদ্দেশ্য হলো ড্রোনের মতো ছোট প্ল্যাটফর্মের জন্যে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা। ২০১৭ সাল থেকে ‘তেবার’ গাইড্যান্স কিট তৈরি করার শুরু করে তারা, যার সহায়তায় একটা সাধারণ বোমা অতিসূক্ষ্ম টার্গেটিংএর মাধ্যমে ২৮ কিঃমিঃ দূরের টার্গেটে নিশ্চিতভাবে আঘাত করতে পারে। ২০১৯এর মে মাসে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ‘আইডিইএফ ২০১৯’ প্রতিরক্ষা মেলায় ‘রকেটসান’ নিজেদের ডেভেলপ করা ‘আতমাকা’ জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ‘সিডা’ লেজার গাইডেড এন্টিট্যাঙ্ক ওয়েপন, ‘আলকা’ ড্রোনধ্বংসী লেজার ওয়েপন, ‘তানোক’ ১২০ মিঃমিঃ লেজার গাইডেড এন্টিট্যাঙ্ক আর্টিলারি, ‘ইয়াতাগান’ ৪০ মিঃমিঃ লেজার গাইডেড মিনিয়েচার মিসাইল এবং ‘কে প্লাস’ মিসাইল ডিসপ্লে করে।

২০০৬ সালে ‘বিলকেত হোল্ডিং’ এবং ‘বিলকেত ইউনিভার্সিটি’র প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা পায় ‘মেতেকসান সাভুনমা’; যার কাজ হলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ নিয়ে কাজ করা। বিভিন্ন অস্ত্রের জন্যে মাইক্রোওয়েভ, মিলিমিটার ওয়েভ, লেজার, ডাটা লিঙ্ক, সোনার, এবং সিমুলেটর তারা ডেভেলপ করা শুরু করে।

তুরস্কের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির জন্ম উসমানি সময়ে; ১৫শ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। ‘তোপহানে ই আমিরে’ নামে শুরু হয়ে ১৮৩২ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ‘তোপহানে মুসাভিরলিগি’ এবং ১৯০৮ সাল থেকে ‘হারবিয়ে নাজেরাতি’ নামে কারখানাগুলির সমন্বয় করা হয়। ১৯১৯ থেকে ১৯২৩এর মাঝে এগুলিকে পুনরায় সংগঠিত করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা কারখানাগুলিকে একটা ছাতার অধীনে আনার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে ‘এমকেইকে’ নামে একটা সংস্থা গঠন করা হয়। বর্তমানে এর অধীনে ১০টা কারখানা রয়েছে, যেখান প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মী রয়েছে। এই কারখানাগুলিতে সামরিক বাহিনীর জন্যে গোলাবারুদ, আর্টিলারি, বোমা, মাইন, রকেটসহ বিভিন্ন ভারি অস্ত্র তৈরি ছাড়াও বেসামরিক ব্যবহারের জন্যে স্টিল, পিতল, ইলেকট্রিসিটি মিটার এবং আরও কিছু জিনিস তৈরি হয়। ‘এমকেইক’ সংস্থাটা এমুনিশন গ্রুপ, রকেট গ্রুপ, ওয়েপন গ্রুপ এবং একাপ্লোসিভ পাউডার ও পাইরোটেকনিক প্রডাক্টস গ্রুপএর মাঝে বিভক্ত। আর এর মালিকানা রয়েছে ‘মেকানিক্যাল এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন’এর হাতে। মধ্য আনাতোলিয়ার কিরিক্কালেতে অবস্থিত এমুনিশন ফ্যাক্টরিতে ২৫মিঃমিঃ থেকে শুরু করে ২০৩মিঃমিঃ পর্যন্ত কামানের গোলা, বিমান থেকে নিক্ষেপণযোগ্য সাড়ে ৪ পাউন্ড থেকে শুরু করে ২ হাজার পাউন্ডের ‘মার্ক ৮৪’ বোমা, পেনেট্রেশন বম্ব, প্রোপেলিং চার্জ, ডেমোলিশন ব্লক এবং হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি হয়। এই ফ্যাক্টরির বাৎসরিক ৭৫০ টন উৎপাদনক্ষমতার ‘বল পাউডার প্রোডাকশন প্ল্যান্ট’এ ২০০৬ সাল থেকে বিভিন্ন ক্যালিবারের রাইফেল এবং মেশিন গানের এমুনিশন তৈরি হয়। ‘রকেট এন্ড এক্সপ্লোসিভ ফ্যাক্টরি’র একাংশে তৈরি হয় ডাবল বেইজ সলিড ফুয়েল রকেট; অন্যদিকে তৈরি হয় ডিনামাইট, টিএনটি, ডিএনটি, বিভিন্ন এসিড, ব্ল্যাক পাউডার, প্রোপেলিং চার্জ, ইত্যাদি। আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ৭০মিঃমিঃ রকেট থেকে শুরু করে ১২২মিঃমিঃ আর্টিলারি রকেট এখানে তৈরি হয়। আঙ্কারার উত্তরের চানকিরিতে ‘হেভি ওয়েপন্স এন্ড স্টিল ফ্যাক্টরি’ তৈরি করা হয়েছিল ‘উরলিকন’এর ২০মিঃমিঃ এবং ৩৫মিঃমিঃ বিমানবিধ্বংসী কামান তৈরির জন্যে। এখন সেখানে ৬০মিঃমিঃ, ৮১মিঃমিঃ, ১০৫মিঃমিঃ ট্যাংক গান, ১২০মিঃমিঃ মর্টার, ১২ দশমিক ৭মিঃমিঃ মেশিন গান, ফরাসী ‘জিয়াট’এর ডিজাইনের ২৫মিঃমিঃ অটোমেটিক কামান, ১৫৫মিঃমিঃ আর্টিলারি গান ব্যারেল তৈরি হয়। এখানে তুর্কি সেনাবাহিনীর মার্কিন নির্মিত ‘এম ৪৮’ ট্যাঙ্ক এবং জার্মান নির্মিত ‘লেপার্ড এ১’ ট্যাঙ্ক মডার্নাইজ করা হয়। এখানে ৩ হাজার এবং ৬ হাজার টনের ওপেন ডাই ফোর্জিং প্রেস এবং ৯ হাজার টনের মোল্ড ডাই ফোর্জিং প্রেস বসানো হয়েছে। ‘স্মল আর্মস ওয়েপন ফ্যাক্টরি’তে তৈরি হয় ৭ দশমিক ৬২ মিঃমিঃ রাইফেল, ৫ দশমিক ৫৬ মিঃমিঃ রাইফেল এবং ৯ মিঃমিঃ রাইফেল। এছাড়াও এখানে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, হেলমেট, এন্টি রায়ট শটগান, টিয়ার গ্যাস, সিগনাল পিস্তল, ফ্লেয়ার, চ্যাফ, ডেটোনেটর, পিস্তল কার্ট্রিজ, স্মোক কার্ট্রিজ, ইত্যাদি তৈরি হয়।

    
   
সিরিয়ার বিদ্রোহীরা চালাচ্ছে ‘এফএনএসএস’এর নির্মিত ‘এসিভি ১৫’ এপিসি


স্থলবাহিনীর অস্ত্র - সাঁজোয়া যান রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু

‘মিলিটারি ফ্যাক্টরি এন্ড শিপইয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘আসফাত’ হলো তুর্কি সরকারের মালিকানায় থাকা একটা কোম্পানি। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২৭টা সামরিক কারখানা এবং ৩টা সামরিক শিপইয়ার্ডকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা হয়। এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ হাজার মানুষের। এই কোম্পানিটা তৈরি করার উদ্দেশ্য হলো গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট বা ‘জিটুজি’ ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি। ‘ফার্স্ট মেইন মেইনটেন্যান্স ফ্যাক্টরি’ স্থাপিত হয়েছিল উত্তরপশ্চিমের আদাপাজারির আরিফিয়ে শহরে। আর ‘সেকেন্ড মেইন মেইনটেন্যান্স ফ্যাক্টরি’ স্থাপিত হয়েছিল সেন্ট্রাল আনাতোলিয়ার কায়সেরি শহরে। ‘ফার্স্ট ফ্যাক্টরি’ হলো তুর্কি সেনাবাহিনীর মূল ট্যাঙ্ক ফ্যাক্টরি, যা সাম্প্রতিক সময়ে ‘আলতায়’ ট্যাঙ্ক তৈরির জন্যে ‘বিএমসি’র কাছে ২৫ বছরের জন্য লিজ দিয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে ‘ফিরতিনা’ ১৫৫মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড হাউইটজার এবং হাউইটজারের জন্যে ‘পয়রাজ’ এমুনিশন রিসাপ্লাই ভেহিকলও তৈরি করে তারা। ‘আসফাত’ বিমান টানার জন্যে ৬৩ টন টানা সক্ষমতার ‘রাহভান’ এয়ারক্রাফট টোয়িং ভেহিকলও তৈরি করে। ২০১৯ সালেই কোম্পানির অধীনে থাকা ইস্তাম্বুলের দক্ষিণে অবস্থিত ইয়ালোভাতে ‘হাত-সান শিপবিল্ডিং’এ ১৮০ মিটার লম্বা ১০ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটা ফ্লোটিং ড্রাইডক তৈরি করা হয়। ‘আসফাত’এর অধীনেই পাকিস্তানের কাছে ৪টা ‘মিলজেম ক্লাস’ কর্ভেট বিক্রি করা হচ্ছে।

তুর্কিদের সেনাবাহিনীর যন্ত্রপাতি তৈরির উল্লেখযোগ্য বেসরকারি কোম্পানিগুলি হলো, ‘অতোকার’, ‘এফএনএসএস’ ও ‘নুরল মাকিনা’, ‘বিএমসি’, ‘আনাদোলু ইসুজু’, ‘কাতমারচিলার’, এবং ‘তুমোসান’।

চারমিকলি পরিবারের হাতে গড়ে ওঠা কন্সট্রাকশন কোম্পানি ‘নুরল হোল্ডিং’ ১৯৮৮ সালে ‘ব্রিটিশ এরোস্পেস সিস্টেমস’এর সাথে যৌথভাবে ‘এফএনএসএস’ নামে একটা কোম্পানি তৈরি করে, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এম ১১৩’ আর্মার্ডা পার্সোনেল ক্যারিয়ার বা এপিসির ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে তুরস্কের নিজস্ব একটা এপিসি ডেভেলপ করা। ‘এসিভি ১৫’ নামের ১৫ টন ওজনের এপিসিগুলি অনেকগুলি ভার্সনে তৈরি করে তারা। শেষ পর্যন্ত তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্যে ২ হাজার ২’শ ৪৯টা এপিসি তৈরি করে ‘এফএনএসএস’। এর বাইরেও আমিরাত, জর্দান এবং মালয়েশিয়ার কাছে ৫’শ গাড়ি বিক্রি করে তারা। একই মালিকানায় থাকা ‘নুরল মাকিনা’ ১৯৭৬ সাল থেকে স্টিল কন্সট্রাকশনের কাজ করতো। মূলতঃ স্টিলের তৈরি বড় বড় শিল্প কাঠামো এবং মেশিনারি তৈরিই ছিল তাদের কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ২০১৩ সালে ডেভেলপ করা ‘এজদার ইয়ালসিন’ হুইল্ড আর্মার্ড কম্ব্যাট ভেহিকল তারা বিক্রি করেছে কাতার, তিউনিসিয়া, সেনেগাল, উজবেকিস্তান এবং আরও কিছু দেশের কাছে। আবার উজবেকিস্তানে যৌথভাবে ১ হাজার গাড়ি তৈরির চুক্তিও করেছে তারা। এছাড়াও তারা ‘এজদার তোমা’ রায়ট কন্ট্রোল ভেহিকল, ‘ইলগাজ’ ইন্টারনাল সিকিউরিটি ভেহিকল এবং ‘এনএমএস’ মাইন রেসিসট্যান্ট আর্মার্ড ভেহিকল ডেভেলপ করেছে।

২০১২ সালে ‘নুরল টেকনলজিস’ সৈন্যদের জন্যে নতুন ধরনের হাল্কা বর্ম তৈরি করে তুর্কি বাহিনীগুলি ছাড়াও দেশের বাইরেও বিক্রি করতে শুরু করে। ‘টি শিল্ড’ নামের এই বর্ম ডেভেলপ করতে তারা ৬’শ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বলে বলেন কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার তুঞ্চ বাতুম। এই একই বর্ম তুরস্কের ‘মিলজেম-ক্লাস’ যুদ্ধজাহাজ এবং ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত হবে। এতদিন বর্মের জন্যে চীন এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর নির্ভর করতে হতো তুরস্ককে; কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির মতো দেশগুলি নিজেদের বর্ম অন্যদের কাছে বিক্রি করে না। ২০০৫ সালে ‘এফএনএসএস’ একটা হুইল্ড আর্মার্ড ভেহিকল তৈরি করে, যার নাম তারা দেয় ‘পার্স’।

তুরস্কের সেনাবাহিনীর জন্যে সাঁজোয়া যান তৈরির ইতিহাস ‘অতোকার’ কোম্পানির ইতিহাসের সমান্তরাল। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ‘অতোকার’ কোম্পানি প্রথমে বাস তৈরি শুরু করে। তুরস্কের সবচাইতে বড় প্রাইভেট কোম্পানি ‘কচ হোল্ডিং’ কোম্পানিটা কিনে নেবার পর ১৯৮০এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তারা তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্যে আর্মার্ড ভেহিকল এবং ল্যান্ড রোভার ডিফেন্ডার গাড়ি তৈরি শুরু করে। ১৯৯০এর শুরুর দিকে তারা ‘আকরেপ’ এবং ‘কোবরা’ আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার তৈরি শুরু করে। ২০০৩ সালে তারা সিঙ্গাপুরের ‘এসটি ইঞ্জিনিয়ারিং’এর সাথে যৌথভাবে ‘ইয়াভুজ’ আর্মার্ড ভেহিকল তৈরি শুরু করে। আরেকটা কোম্পানি ‘বিএমসি’ সাঁজোয়া যান তৈরিতে বেশ নাম করেছে। ১৯৬৪ সালে ব্রিটেনের রানীর হাত দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ‘ব্রিটিশ মোটর কর্পোরেশন’ বা ‘বিএমসি’ লেল্যান্ড ব্র্যান্ডের ট্রাক তৈরি শুরু করে। ১৯৭৫ সালে তুরস্কে প্রথম ডিজেল ইঞ্জিন তৈরি শুরু করে ‘বিএমসি’। ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কামিন্স’এর ইঞ্জিন তৈরি শুরু করে তারা। ১৯৮৯ সালে তুরস্কের শুকরোভা গ্রুপ কোম্পানিটা কিনে নিলে এর কাজে গতি আসে। ১৯৯৯ সালে সেনাবাহিনীর জন্যে গাড়ি তৈরি শুরু করে তারা। ২০০৮ সালে কোম্পানিটা ‘কিরপি’ আর্মার্ড ভেহিকল ডেভেলপ করা শুরু করে। ২০১৩ সালে তুরস্ক সরকার একে রাষ্ট্রীয়করণ করে পরের বছর টেন্ডারে ৩’শ ৬০ মিলিয়ন ডলারে কাতার এবং তুরস্কের যৌথ বিনিয়োগের কাছে বিক্রি করে দেয়। এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি ‘কিরপি’ আর্মার্ড ভেহিকল তৈরি করেছে ‘বিএমসি’। ২০১৫ সালে ‘ভুরান’ এবং ‘আমাজন’ নামে আরও দু’টা আর্মার্ড ভেহিকল তৈরি করে তারা। ২০১৮ সালে তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্যে ৭২টা ‘তুগ্রা’ ট্যাঙ্ক ট্রান্সপোর্টার তৈরির অর্ডার পায় তারা। এখন তারা তুরস্কের নিজস্ব ‘আলতায়’ ট্যাঙ্ক ডেভেলপ করছে। ‘কাতমারচিলার’ ১৯৮৫ সাল থেকে আইনশৃংখলা বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস এবং সামরিক বাহিনীর জন্যে বিভিন্ন ধরনের বর্মাবৃত গাড়ি তৈরি করে আসছে। ২০১৬ সাল থেকে তারা ‘হিজির’ নামের একটা আর্মার্ড ভেহিকল বাজারে ছেড়েছে। ২০১৯এর জুলাই মাসে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ফুরকান কাতমারচি ঘোষণা দেন যে, তারা প্রথমবারের মতো ২০ মিলিয়ন ডলারের একটা রপ্তানি অর্ডার পেয়েছে, যা মোতাবেক তারা আফ্রিকার একটা দেশে ‘হিজির’ আর্মার্ড ভেহিকল রপ্তানি করবে।

১৯৬৫ সালে স্থাপিত ‘আনাদোলু ইসুজু’ কোম্পানির শুরুটা ছিল সুইডিশ ‘স্কোডা’ ব্র্যান্ডের ট্রাক তৈরির মাঝ দিয়ে। তবে এর মূল শেয়ারহোল্ডার তুর্কি কোম্পানি ‘আনাদোলু গ্রুপ’এর বেশিরভাগ বিনিয়োগই হলো কনজিউমার গুডস সেক্টরে। ১৯৮৩ সালে তারা পার্টনারশিপ করে জাপানি কোম্পানি ‘ইসুজু’র সাথে। তাদের মূল পণ্য ছিল ট্রাক এবং বাস। ১৯৯৫ সালে ৩৫ শতাংশ শেয়ার জাপানিদের দেবার পর থেকে কোম্পানির বর্তমান নামকরণ হয়। ২০১৮ সাল থেকে ‘আনাদোলু সাভুনমা’ নামে সামরিক ব্যবহারের জন্য ৮ চাকা থেকে শুরু করে ২০ চাকার হেভি ট্রাক এবং লজিস্টিকস ভেহিকল তৈরি শুরু করে তারা, যার মাঝে ‘কামিন্স’এর ৬’শ হর্সপাওয়ার ইঞ্জিনের ‘সেঈত’ আর্মার্ড ট্রাকও আছে। তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্যে আর্মার্ড রিকভারি ভেহিকল তৈরি করছে তারা, যেগুলি কিনা নষ্ট হয়ে যাওয়া ভারি যানবাহন টানতে পারবে।
 
        
‘তুমোসান’ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন শক্তির ডিজেল ইঞ্জিন ডেভেলপ করতে, যেগুলি তুরস্কের তৈরি ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ভেহিকল এবং হেভি ট্রান্সপোর্টগুলিতে ব্যবহৃত হবে


১৯৭৭ সাল থেকে ইতালির ‘ফিয়াট’ কোম্পানির ডিজেল ইঞ্জিন তৈরির মাধ্যমে কর্মকান্ড শুরুর পর থেকে জার্মানির ‘ডাইমলার’, জাপানের ‘মিতসুবিসি’ এবং সুইডেনের ‘ভলভো’ ইঞ্জিন লাইসেন্সের মাধ্যমে তৈরি করে ডিজেল ইঞ্জিন এবং ট্রাক্টর প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘তুমোসান’। ১৯৮৮ সালে ‘ফিয়াট’এর সাথে লাইসেন্স শেষ হবার পর ‘তুমোসান’ তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব ব্র্যান্ডের ইঞ্জিন তৈরি শুরু করে। ২০০৪ সালে সরকার কোম্পানিটাকে ‘আলবায়রাক গ্রুপ’ কিনে নেয়। ২০১৩ সালে তারা ১’শ হর্সপাওয়ারের বেশি শক্তির ইঞ্জিন তৈরি শুরু করে। ২০১৪ সালে তুরস্কের নিজস্ব ট্যাঙ্ক ‘আলতায়’এর জন্যে লাইসেন্সের মাধ্যমে ইঞ্জিন তৈরির কাজ শুরু করলেও ২০১৭ সালে ইউরোপিয় পার্টনার সরে গেলে ইঞ্জিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সাল থেকে ‘তুবিতাক’এর সহায়তায় তারা ১’শ ৫৫ হর্সপাওয়ার থেকে ১ হাজার হর্সপাওয়ারের মাঝে অত্যাধুনিক ‘হাই প্রেসার স্প্রে বার্নিং’ প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেকগুলি ইঞ্জিনের একটা ফ্যামিলি ডেভেলপ করা শুরু করে। ২০১৭ সালের মে মাসে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ‘আইডিইএফ’ মেলায় ‘তুমোসান’ নিজেদের ডেভেলপ করা হুইল্ড আর্মার্ড ভেহিকল ‘পুসাত’ উন্মোচন করে, যেখানে ব্যবহৃত হয়েছে নিজেদের ডেভেলপ করা ২’শ ৫০ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন এবং অটোম্যাটিক ট্রান্সমিশন। ২০১৮ সাল থেকে ৭০ জন বিদেশী সহ ২’শ জন ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছে সেখানে; যার উদ্দেশ্য হলো ৯’শ ১৭ হর্সপাওয়ারের একটা ইঞ্জিন ডেভেলপ করা, যা কিনা একটা ৪০টন ট্যাঙ্ককে চালাতে পারবে। ২০১৯এর অগাস্টে ‘তুমোসান’ ঘোষণা দেয় যে, তারা ‘এসিভি ১৫’ এপিসির জন্যে ৩’শ ৫০ হর্সপাওয়ারের একটা ইঞ্জিন ডেভেলপ করছে। ২০১৯এর ডিসেম্বরে ‘এফএনএসএস’এর ডেভেলপ করা ‘পার্স’ আর্মার্ড ভেহিকলের জন্যে ৫’শ ৬০ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন ডেভেলপ করা শুরু করে ‘তুমোসান’।

‘ওইয়াক’ হলো তুর্কি সেনাবাহিনীর একটা পেনশন ফান্ড। ‘ওইয়াক’ ২০১৯ সালের এপ্রিলে ফিনল্যান্ডের কোম্পানি ‘মাইলাক্স’এর ৭০ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়। এই কোম্পানিটা যুদ্ধজাহাজ এবং আর্মার্ড ভেহিকলের জন্যে রিইনফোর্সড স্টিল তৈরি করে। ফিনিশ মিডিয়া ‘ইলে’ জানাচ্ছে যে, ২০১৮ সালে ফিনল্যান্ডের অস্ত্র ব্যবসার সবচাইতে বড় ক্রেতা; তুরস্কে তার রপ্তানি করা ১৭ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্রের মাঝে সবচাইতে বড় অংশ হলো ‘মাইলাক্স’এর তৈরি এই স্টিল। ‘মাইলাক্স’এর ক্রেতা হলো তুর্কি কোম্পানি ‘বিএমসি’, ‘অতোকার’, ‘নুরল’, ‘কাতমারচিলার’ এবং ‘রকেটসান’। ২০১৯এর ডিসেম্বরে ‘দুনইয়া নিউজ’ এক প্রতিবেদনে বলে যে, সিরিয়াতে তুরস্কের মিশন শুরুর পর ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আন্তি রিনে তুরস্কে অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। রিইনফোর্সড স্টিলের জন্যে তুরস্ক বাইরের দেশের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ায় এই নিষেধাজ্ঞা তুরস্কের আর্মার্ড ভেহিকল শিল্পকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে বলে বলেন ‘বিএমসি’র প্রধান নির্বাহী এথেম সানচাক। তবে তুর্কিরা চাইছে ‘মাইলাক্স’ থেকে প্রযুক্তি আমদানির মাধ্যমে পশ্চিম তুরস্কের মানিসাতে ১৩ হাজার টন উৎপাদনক্ষমতা একটা কারখানা স্থাপন করতে, যেখানে তৈরি করা হবে রিইনফোর্সড স্টিল। পরবর্তীতে এর উৎপাদনক্ষমতা ২০ হাজার টনেও উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৭ সালের মে মাসে তুর্কি স্টিল কোম্পানি ‘তোসইয়ালি হোল্ডিং’ মার্কিন কোম্পানি ‘হার্সকো’র সাথে যৌথভাবে রিইনফোর্সড স্টিল তৈরি করার কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দেয়।

তুর্কি সামরিক বাহিনীর ক্রয় পরিকল্পনাগুলি তুর্কি প্রতিরক্ষা শিল্পের পাথেয়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তুর্কি সরকার ঘোষণা দেয় যে, তারা বিভিন্ন প্রকারের ৫ হাজার ৮’শ ৭২টা গাড়ি ক্রয় করার পরিকল্পনা করেছে। এর মাঝে রয়েছে ২ হাজার ৯’শ ৬২টা আর্মার্ড ট্র্যাকড ভেহিকল; ১ হাজার ১’শ ৬২টা হুইলড আর্মার্ড ভেহিকল। ৪’শ ৭৬টা হেভি ট্রাক এবং লজিস্টিকস ভেহিকলের মাঝে রয়েছে ১’শ ৩৪টা ট্যাঙ্ক ট্রান্সপোর্টার; ৬৫টা কনটেইনার ট্রান্সপোর্টার; ২’শ ৭৭টা রিকভারি ভেহিকল। ২’শ ৬০টা ওয়েপন ক্যারিয়ারের মাঝে রয়েছে ১’শ ৮৪টা ট্র্যাকড ভেহিকল এবং ৭৬টা হুইল্ড ভেহিকল।
   

‘বায়কার মাকিনা’র তৈরি করা ‘বায়রাকতার টিবি২’ আর্মড ড্রোন, যা কিনা ইতোমধ্যেই সাইপ্রাস, উত্তর সিরিয়া এবং লিবিয়াতে মোতায়েনের মাধ্যমে তুরস্কের কৌশলগত হাতিয়ারে তৈরি হয়েছে


বিমান তৈরি শিল্প – ‘এফ ১৬’ ফাইটার থেকে শুরু

‘টারকিশ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘টিএআই’ প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৭৩ সালে। তখন তার নাম ছিল ‘টারকিশ এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন’। ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান তৈরির জন্যে ২৫ বছরের চুক্তি করে কোম্পানিটা। ২০০৫ সালে বিদেশী শেয়ারগুলি কিনে নেয় তুরস্ক সরকার। ‘টিএআই’এর সবচাইতে বড় কাজ হলো ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান তৈরি, ওভারহল, মডার্নাইজেশন, কনভার্শন। মিশর, পাকিস্তান এবং জর্দানের বিমান বাহিনীর ‘এফ-১৬’ বিমানে তারা মডার্নাইজেশনের কাজ করেছে। তারা তুরস্কের নিজস্ব বেসিক ট্রেইনার বিমান ‘হুরকুস’ তৈরি করেছে। ‘টি-৩৮’ প্রশিক্ষণ বিমান, ‘সি-১৩০’ পরিবহণ বিমান মডার্নাইজেশন ছাড়াও কয়েক প্রকারের বিমানে কনভার্সনের মাধ্যমে ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান এবং এয়ারবোর্ন কন্ট্রোল বিমান তৈরি করছে তারা। ‘টিএআই’ তুরস্কের নিজস্ব হেলিকপ্টার ‘গোকবে’ ডেভেলপ করেছে; যৌথভাবে ডেভেলপ করেছে ‘টি-১২৯ আতাক’ এবং মার্কিন ‘ব্ল্যাক হক’ হেলিকপ্টারের তুর্কি ভার্সন ‘টি-৭০’। ড্রোন তৈরিতেও তারা এগিয়েছে; ডেভেলপ করেছে ‘আনকা’ মিডিয়াম ড্রোন এবং দুই ইঞ্জিনের ‘আকসুনগুর’ ড্রোন। এছাড়াও ‘টিএআই’এর কম্পোনেন্ট প্রোডাকশন সেকশন এয়ারবাস, বোয়িং, ফকার, বমবার্ডিয়ার যাত্রীবাহী বিমানের অংশ তৈরি করার ছাড়াও ‘এয়ারবাস এ৪০০এম’ সামরিক পরিবহণ বিমান, ‘লিওনার্ডো এডব্লিউ ১৩৯’ হেলিকপ্টারের বডি, ‘সিকোর্স্কি ইউএইচ ৬০’ হেলিকপ্টার, ‘এয়ারবাস কুগার’ হেলিকপ্টার, কোরিয়ার ‘কেইউএইচ সুরিয়ন’ হেলিকপ্টারের বডি তৈরি করছে। শুধু তাই নয়, ‘টিএআই’ তৈরি করছে স্যাটেলাইট সিস্টেম। ২০১২ সালে ‘গোকতুর্ক-২’ হাই রেজোলিউশন ইলেকট্রোঅপটিক্যাল স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করে তারা। ‘তুর্কস্যাট ৬এ’ টেলিকমিউনিকেশন স্যাটেলাইট তৈরি করছে তারা, যা ২০২২ সালে মহাকাশে প্রেরণের টার্গেট রয়েছে। ‘টিএআই’এর বর্তমান প্রকল্পগুলির মাঝে রয়েছে ‘হুরজেট’ জেট ট্রেইনার বিমান, ১০ টন পরিবহণ হেলিকপ্টার, ‘আতাক-২’ হেভি এটাক হেলিকপ্টার, নতুন ধরনের কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। আর সবার উপরে রয়েছে নিজস্ব প্রযুক্তির পঞ্চম জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার বিমান ‘টিএফএক্স’।

সাম্প্রতিক সময়ে মনুষ্যবিহীন ড্রোন তৈরিতে তুরস্ক বেশ অগ্রগামিতা দেখাচ্ছে। তবে এর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ভূমিকা রয়েছে। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬টা ‘ন্যাট’ সার্ভেইল্যান্স ড্রোন কেনে তুরস্ক, যেগুলি তারা ব্যবহার করে দেশের দক্ষিণপূর্বে কুর্দিদের বিদ্রোহী ‘পিকেকে’ গ্রুপের বিরুদ্ধে। এরপর ২০০৬ সালে ইস্রাইল থেকে ১০টা ‘হেরন’ সার্ভেইল্যান্স ড্রোন কেনে তুরস্ক, যেগুলি ডেলিভারি দিতে ৫ বছর লাগায় ইস্রাইল; শেষপর্যন্ত এগুলি ঠিকমতো কাজই করেনি; তদুপরি ড্রোনের মাধ্যমে ইস্রাইল গোপনে তথ্য পাচার করতো বলেও শোনা যায়। মার্কিনীরা কোন অবস্থাতেই তুরস্কের কাছে আর্মড ড্রোন বিক্রি করতে না চাওয়ায় নিজস্ব আর্মড ড্রোন ডেভেলপ করায় মনোযোগী হয় তুরস্ক। ২০০৬ সালে তরুণ এক ইঞ্জিনিয়ার সেলচুক বায়রাকতার ১৯টা ছোট ড্রোন বিক্রি করেন তুর্কি সেনাবাহিনীর কাছে। সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন থেকে ড্রোন ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ডেভেলপ করেন ৬’শ ৫০ কেজি ওজনের আর্মড ড্রোন ‘বায়রাকতার টিবি২’, যা সেনাবাহিনীর সামনে দেখানো হয় ২০১৫ সালে। ৪ হাজার মিটার উচ্চতা থেকে একটা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ৮কিঃমিঃ দূরের টার্গেট ধংস করে লাইমলাইটে চলে আসে এই ড্রোন। ২০১৬ থেকে তুর্কি সেনাবাহিনীকে এই ড্রোন সরবরাহ করছে বায়রাকতারের কোম্পানি ‘বায়কার মাকিনা’, যা তুরস্ক ব্যবহার করছে ‘পিকেকে’ গেরিলাদের বিরুদ্ধে। এই কোম্পানিকে বিনিয়োগ করেছে তুরস্কের বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল শিল্পের নেতৃস্থানীয় ‘কেইল গ্রুপ’। ৮৬টা ‘টিবি২’ আর্মড ড্রোন তুর্কি সেনাবাহিনী অপারেট করছে। উত্তর সিরিয়াতে তুরস্কের অভিযানগুলিতে ‘টিবি২’ ব্যবহৃত হবার খবর পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে তুর্কিরা ইউক্রেনের কাছে ৬৯ মিলিয়ন ডলারে ১২টা ‘টিবি২’ ড্রোন বিক্রি করার চুক্তি করে। তবে ২০১৯এর ডিসেম্বরে তুরস্কের নিয়ন্ত্রিত উত্তর সাইপ্রাসের গেচিটকালে বিমানবন্দরে অবতরণ করে ‘টিবি২’ ড্রোন একটা কৌশলগত অস্ত্রে পরিণত হয়। উত্তর সিরিয়া এবং লিবিয়াতেও এই ড্রোন ব্যবহৃত হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৯এর ডিসেম্বরে তারা ‘বায়কার আকিঞ্চি’ নামের ৪৫’শ কেজি ওজনের দুই ইঞ্জিনের দৈত্যাকৃতির একটা ড্রোন সফলভাবে আকাশে ওড়ায়। এছাড়াও ‘টিএআই’ও ডেভেলপ করছে ১৬’শ কেজি ওজনের ‘আঙ্কা’ মিডিয়াম ড্রোন। ২০১৩ সালে তুর্কি সামরিক বাহিনী ১০টা ‘আঙ্কা এস’ ড্রোন অর্ডার করে, যেগুলি স্যাটেলাইট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এর বাইরেও তুর্কি ইন্টেলিজেন্স ‘এমআইটি’এর জন্যে সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক্ ও কমিউনিকেন্স ইন্টেলিজেন্স ড্রোন ‘আঙ্কা আই’ ডেভেলপ করেছে তারা, যার মাধ্যমে শত্রুর ইলেকট্রনিক, রেডিও, ডাটালিঙ্ক এবং টেলিকমিউনিকেন্স সিগনালের উপর নজরদারি করতে পারবে তুর্কিরা। ২০১৯এর মার্চে ‘আকসুঙ্গুর’ নামে ‘টিএআই’ ৩৩’শ কেজি ওজনের দুই ইঞ্জিনের বিশাল এক ড্রোন আকাশে ওড়ায়।
      

‘অতোকার’এর তৈরি ‘কোবরা’ আর্মার্ড ভেহিকল আফ্রিকায় শান্তিরক্ষী মিশনে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
 
অস্ত্র রপ্তানির টার্গেট কতটা বাস্তব?

তুরস্ক সরকার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে যে, ২০৫৩ সালের মাঝে তুরস্ককে প্রতিরক্ষা খাতে পুরোপুরি স্বনির্ভর করবে। একইসাথে অস্ত্র রপ্তানির টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সবচাইতে বড় ১’শ অস্ত্র কোম্পানির মাঝে তুরস্কের কমপক্ষে ১০টা কোম্পানি থাকতে হবে। তুর্কি সরকার বলছে যে, তুরস্কের প্রতিরক্ষা সেক্টরের উৎপাদন ২০০৬ সালে ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম ছিল; যা ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৬ বিলিয়ন ডলার। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ বা ‘সিপরি’র হিসেবে ২০১৮ সালে তুরস্ক ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অস্ত্র রপ্তানি করে। তুরস্কের সকল শিল্পের মাঝে প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিল সবচাইতে বেশি। তবে ২০২৩ সালের মাঝে ২৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির টার্গেট এখন বেশ খানিকটাই অবাস্তব মনে হচ্ছে।

‘সিপরি’র হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাঝে তুরস্ক তার প্রতিরক্ষা ব্যয় ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১৯ বিলিয়ন ডলার করেছে। ২০১৮ সালে তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ছিল বিশ্বে ১৫তম। আবার অস্ত্র রপ্তানিতে তুরস্কের অবস্থান বিশ্বে ১৪তম, যা আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারের ১ শতাংশ। সর্বোচ্চ অবস্থানে ৩৬ শতাংশ নিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; ২১ শতাংশ নিয়ে রাশিয়া দ্বিতীয়; ৭ শতাংশ নিয়ে ফ্রান্স তৃতীয়; সাড়ে ৬ শতাংশ নিয়ে জার্মানি চতুর্থ; এবং ৫ শতাংশের কিছু বেশি নিয়ে চীন পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। এই পাঁচ দেশ মিলে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মাঝে তুরস্ক তার অস্ত্র রপ্তানি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের তুলনায় ১’শ ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পেরেছে; যা ছিল সকল দেশের মাঝে সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালে তুরস্কের ‘আসেলসান’ এবং ‘টারকিশ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘টিএআই’ বিশ্বের ১’শটা সবচাইতে বড় অস্ত্র উৎপাদন কোম্পানির মাঝে নাম লিখিয়েছে। ‘সিপরি’র জেষ্ঠ্য গবেষক পিয়েটার ওয়েজেমান বলছেন যে, তুরস্কের সামরিক শিল্পের বিকাশের পেছনে রয়েছে তার নিজস্ব অস্ত্রের চাহিদার বৃদ্ধি এবং অস্ত্রের জন্য পশ্চিমা দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা কমাবার প্রচেষ্টা। তুরস্কের ‘স্ট্র্যাটেজিক ভিশন ২০২৩’এর অধীনে সামরিক প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা তৈরি করা হচ্ছে।

সক্ষমতা বেড়েছে অনেক তবে ঘাটতিও রয়েছে

সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক বেশকিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির ক্রয়াদেশ পেয়েছে। পাকিস্তানের নৌবাহিনীর কাছে তুরস্ক বিক্রি করছে ৪টা ‘মিলজেম’-ক্লাস কর্ভেট এবং ৩০টা ‘আতাক’ এটাক হেলিকপ্টার। ইউক্রেনের কাছে ‘বায়কার মাকিনা’র তৈরি ১২টা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন বিমান বিক্রি করার চুক্তি করেছে তুরস্ক। তবে তুরস্কের এই অস্ত্রগুলির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ অন্য দেশে তৈরি। উদাহরণস্বরূপ, ‘মিলজেম’-ক্লাস কর্ভেটে ব্যবহৃত হচ্ছে জার্মানির ‘রেঙ্ক’এর তৈরি ইঞ্জিন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘রেথিয়ন’এর তৈরি বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ‘রোলিং এয়ারফ্রেম মিসাইল’, ইউরোপের ‘থালেস’এর তৈরি জাহাজের মূল রাডার ‘স্মার্ট এস২’, মার্কিন ‘মার্ক ৩২’ টর্পেডো লঞ্চার, ইতালির ‘অটো মেলারা’র তৈরি ৭৬মিঃমিঃ কামান। অর্থাৎ জাহাজের মূল প্রতিরক্ষার জন্যে রাডার এবং অস্ত্র অনেকটাই আমদানির উপর নির্ভরশীল। তবে বেশকিছু যন্ত্রাংশ আবার দেশেও তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন, মার্কিন ‘হারপুন’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের স্থলে ‘রকেটসান’এর তৈরি তুরস্কের নিজস্ব ‘আতমাকা’ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করার পরিকল্পনা চলছে। ব্রিটেনের ‘সী সেন্টর’ টর্পেডো ডিফেন্স সিস্টেমকে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে ‘আসেলসান’এর তৈরি ‘হিজির’ সিস্টেম দিয়ে। জাহাজের ‘জেনেসিস’ কম্ব্যাট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি করেছে ‘হাভেলসান’। সাবমেরিন খোঁজার জন্যে জাহাজের ‘টিবিটি ০১ ইয়াকামোজ’ সোনার তৈরি করেছে তুরস্কের ‘সায়েন্টিফিক এন্ড টেকনলজিক্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’। ‘আসেলসান’ তৈরি করেছে জাহাজের ইলেকট্রনিক ডিসেন্স সিস্টেম ‘এআরইএস ২এন’ যার মাধ্যমে শত্রুর রাডার সিগনাল ধরা যাবে, ‘এলপার’ স্টেলথ ন্যাভিগেশন রাডার, শত্রুর লেজার টার্গেটিং থেকে জাহাজকে বাঁচাতে ‘লেজার ওয়ার্নিং রিসিভার’, ‘আসেলফ্লির ৩০০টি’ নামের ‘এডভান্সড টার্গেটিং সিস্টেম’, জাহাজের কাছাকাছি নিরাপত্তা দিতে ১২ দশমিক ৭ মিঃমিঃএর ‘স্ট্যাম্প’ অটোম্যাটিক গান সিস্টেম। ‘মিলজেম’-ক্লাসএর ৪টা কর্ভেট তৈরি করা হয়েছে তুরস্কের জন্যে; যার শেষটা ‘কিনালিয়াদা’ গত বছরের সেপ্টেম্বরে কমিশনিং করেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তিনি বলেন যে, এই জাহাজের ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ তুরস্কে তৈরি এবং ৫০টা কোম্পানি এখানে সরবরাহকারী হয়েছিল।


‘রকেটসান’এর ডেভেলপ করা ‘হিসার’ এয়ার ডিফেন্স মিসাইল। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যে তুরস্ক এখনও আমদানি করা অস্ত্রের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল


তুরস্কের সামরিক শিল্পকে বিশ্লেষণ করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’। গত এক দশকে তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি মূলতঃ চাকাওয়ালা বা হুইল্ড আর্মার্ড ভেহিকলএর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। শতশত ‘বিএমসি’এর ‘কিরপি’ এবং ‘অতোকার’এর ‘কোবরা’ আর্মার্ড ভেহিকল তারা বিক্রি করেছে তিউনিসিয়া, তুর্কমেনিস্তান, বাহরাইন, বাংলাদেশ, মৌরিতানিয়া এবং রুয়ান্ডার কাছে। গাড়িগুলির বিক্রির সংখ্যা অনেক হলেও এগুলি তৈরি করাটা খুব একটা কঠিন নয়; বিশ্বের অনেক কোম্পানিই একইরকম গাড়ি তৈরি করছে। এই অবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে, তা ২০১৮ সালের রপ্তানির চুক্তিগুলি দেখলেই বোঝা যায়। নৌবাহিনীর ফ্রিগেট এবং বিমান বাহিনীর এটাক হেলিকপ্টার ছাড়াও মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিক্রি করছে তুরস্ক। ‘আসেলসান’, ‘হাভেলসান’ এবং ‘রকেটসান’এর মতো কোম্পানিগুলি কম্ব্যাট সিস্টেম এবং গাইডেড ওয়েপন তৈরি করছে। তবে মেরিন এবং বিমানের ইঞ্জিন এবং রাডার তৈরিতে তুরস্কের ঘাটতি রয়ে গেছে। বর্তমানে তুরস্কে তৈরি অস্ত্র এবং যন্ত্রাংশগুলির অনেকগুলিই হয় আমদানি করা অথবা বিদেশী ডিজাইনের জিনিস লাইসেন্স নিয়ে দেশে তৈরি করা। সক্ষমতা তৈরির সাথে সাথে সামনের দিনগুলিতে তৈরি করা এবং রপ্তানি করা অস্ত্রগুলির অনেকটাই নিজস্ব ডিজাইনের হবে।

তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত পশ্চিমা দেশগুলির সাথে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রাংশের প্রযুক্তির দিক থেকে আটকে যাচ্ছে। যেমন ২০১৬ সালের নভেম্বরে তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর অস্থির পরিস্থিতির কারণ দেখিয়ে অস্ট্রিয়া তুরস্কের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে তুরস্ক সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ‘আলতায়’ ট্যাঙ্ক প্রকল্প সমস্যায় পড়ে যায়। তুরস্কের কৃষি ট্রাক্টর তৈরির কোম্পানি ‘তুমোসান’এর সাথে অস্ট্রিয়ার কোম্পানি ‘এভিএল লিস্ত’এর চুক্তি হয়; যার মাধ্যমে ‘এভিএল লিস্ত’এর এই ট্যাঙ্কের জন্যে ইঞ্জিন দেবার কথা। এরপর ২০১৮ সালে ‘বিএমসি’ এই ট্যাঙ্ক প্রকল্পের কাজ পায়। তবে এই ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত ইঞ্জিন জার্মানির ‘এমটিইউ’এর তৈরি। এই ইঞ্জিন তুর্কি সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারলেও এই ইঞ্জিন ব্যবহারে তৈরি ‘আলতায়’ অন্য কোন দেশে রপ্তানি করতে হলে বার্লিনের অনুমতি নিতে হবে, যা তুরস্কের সাথে জার্মানির সম্পর্কের উপর নির্ভর করবে। ‘বিএমসি’ একইসাথে এই ট্যাঙ্কের জন্যে তুরস্কের নিজস্ব একটা ইঞ্জিন ডেভেলপ করার কাজও পায়। ২০১৯এর অক্টোবরে ‘বিএমসি’ ঘোষণা দেয় যে, ২০২৩ সাল নাগাদ তারা নিজস্ব ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশসহ এই ট্যাঙ্কের কাজ শেষ করবে।

নির্ভরশীলতা অত সহজে যাচ্ছে না

২০১৯এর অক্টোবরে উত্তর সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরুর পর ইউরোপিয় ইউনিয়ন তুরস্কে অস্ত্র বিক্রি থামানোর সিদ্ধান্ত নেবার পর তুরস্কের ‘ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ প্রেসিডেন্সি’ বা ‘এসএসবি’এর প্রধান ইসমাঈল দেমির তুর্কি সরকারি মিডিয়া ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে বলেন যে, এই অস্ত্র বিক্রির নিষেধাজ্ঞা তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের উপর প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলছেন যে, বিকল্প সরবরাহকারী এবং নিজস্ব উতপাদনের মাধ্যমে তুরস্ক এই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে পারবে। ‘ইউরোস্ট্যাট’এর বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০১৮ সালে তুরস্ক ইইউ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্রয় করেছিল। সবগুলি সামরিক না হলেও ইউরোপ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারের বিমানও কেনে তুরস্ক। ইইউ একইসাথে তুরস্কের সবচাইতে বড় বিনিয়োগকারী। উত্তর সিরিয়াতে অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্রও তুরস্কের পণ্যের উপর ট্যারিফ বৃদ্ধি করেছে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উপর অবরোধ দিয়েছে। তবে বাইরের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা অনেকটাই কমে আসলেও এখনও তা শূণ্যের কোঠায় পৌঁছেনি। ২০০২ সালে তুরস্কের ৮০ শতাংশ অস্ত্র ছিল আমদানি করা; বর্তমানে তা ৩৫ শতাংশ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ব্যাপারে তুরস্ক এখনও পশ্চিমা দেশগুলির রপ্তানি লাইসেন্সের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালে পাকিস্তানের কাছে ‘টারকিশ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি’র ‘আতাক’ এটাক হেলিকপ্টার বিক্রয়ের চুক্তি সই হবার পর তা এখন মার্কিন অবরোধের কারণে আটকে গেছে। এই হেলিকপ্টারের ‘টি-৮০০’ টারবোশ্যাফট ইঞ্জিন তৈরি করে ‘এলএইচটিইসি’ নামের এক কোম্পানি; যা ব্রিটিশ কোম্পানি ‘রোলস রয়েস’ এবং মার্কিন কোম্পানি ‘হানিওয়েল’এর জয়েন্ট ভেঞ্চার।

তুরস্ক সেই ইঞ্জিনের বিকল্প হিসেবে নিজস্ব টারবোশ্যাফট ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে তুরস্ক কিছুটা এগিয়েছে; যেমন, ২০১৯এর মে মাসে ‘তুসাস ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘টিইআই’এর তৈরি একটা ‘টি-৭০০ ৭০১ডি’ ইঞ্জিন তুরস্কের নিজস্ব একটা হেলিকপ্টার প্রোগ্রামের জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ করা হয়। এই ইঞ্জিন তৈরির পিছনে প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে মার্কিন কোম্পানি ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’। ২০ বছরে মোট ২’শ ৩৬টা টারবোশ্যাফট ইঞ্জিন এখানে তৈরি হবে। একই অনুষ্ঠানে ‘টিআর ইঞ্জিন’ নামের আরেকটা গবেষণা কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করা হয়; যার কাজ হবে নতুন টারবোশ্যাফট ইঞ্জিন ডেভেলপ করা। আনাতোলিয়ার এসকিসেহিরের গভর্নর ওজদেমি শাকাচাক বলেন যে, এই ইঞ্জিন তৈরির জ্ঞানকে তুর্কিরা আরও বড় প্রকল্পে কাজে লাগাবে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তুরস্কের ‘টিআর মোটর’এর সাথে আরেকটা চুক্তি সই হয়, যার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় যে, কোম্পানিটি তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের স্টেলথ ফাইটারের জন্যে ইঞ্জিন ডেভেলপ করবে। ‘টিআর মোটর’ হলো তুরস্কের তিন কোম্পানি ‘বিএমসি পাওয়ার মোটর’, ‘টারকিশ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ এবং ‘এসএসটিইকে’এর একটা জয়েন্ট ভেঞ্চার। ইসমাঈল দেমির বলেন যে, এই জেট ইঞ্জিনের ব্যবহার, রপ্তানি বা অন্য কোন কাজের জন্যে তুরস্ক বাইরের কারুর চাপের মাঝে পড়তে চায় না। তাই এই ইঞ্জিনের সকল অংশের উপর তুরস্কের কর্তৃত্ব থাকবে।

বর্তমানে তুরস্কতে প্রায় ১’শ ৭৯টা কোম্পানি প্রতিরক্ষা বিষয়ক উৎপাদনে জড়িত। ‘ডিফেন্স নিউজ’এর প্রকাশিত বিশ্বে সবচাইতে বড় ১’শটা প্রতিরক্ষা কোম্পানির ২০১৯ সালের তালিকায় তুরস্কের ৫টা কোম্পানি রয়েছে। এর মাঝে ৫২তম অবস্থানে রয়েছে ‘আসেলসান’; ৬৯তম অবস্থানে ‘টারকিশ এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘টিএআই’; ৮৫তম অবস্থানে ‘এসটিএম’ এবং ‘বিএমসি’; আর ৮৯তম অবস্থানে রয়েছে ‘রকেটসান’। এই পাঁচ কোম্পানির মোট ব্যবসা সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০১৯এর ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক সরকার ‘টিএআই’এর সাথে একটা চুক্তির মাধ্যমে ‘আতাক ২’ হেভি এটাক হেলিকপ্টার ডেভেলপ প্রক্রিয়া শুরু করে। সেখানেও তুরস্কের ১৪’শ হর্সপাওয়ারের নিজস্ব টারবোশ্যাফট ইঞ্জিন ডেভেলপমেন্ট শেষ করার উপর গুরাত্বরোপ করা হয়। অর্থাৎ তুরস্কের এরোস্পেস শিল্পের উন্নয়ন অনেকটাই আটকে আছে নিজস্ব ইঞ্জিন ডেভেলপ করার উপর। 
    

‘টিএআই’এর ডেভেলপ করা দুই ইঞ্জিনের ৩৩’শ কেজির বিশাল ড্রোন ‘আকসুঙ্গুর’ আকাশে ওড়ে ২০১৯এর মার্চে


সামনের দিনগুলিতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক

তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী বাকীর ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এ এক লেখায় বলছেন যে, তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পকে এগিয়ে নিতে দেশ থেকে মেধা পাচার বন্ধ করতে হবে; আর বেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে; এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে মোকাবিলা করতে হবে। ‘এসএসবি’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পদোন্নতিতে নিরাশা, ক্যারিয়ার এগুনোর ব্যাপারে শঙ্কা এবং কম বেতনের কারণ দেখিয়ে অনেক ইঞ্জিনিয়ার তুরস্ক ছেড়ে চলে যাচ্ছে, যা তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জগুলির একটা। ২০১৮ সালে ২’শ ৭২ জন ইঞ্জিনিয়ার তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প থেকে চাকুরি ছেড়ে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি ছাড়াও আরও ১২টা পশ্চিমা দেশ এবং জাপান, থাইল্যান্ড, কাতারে চলে যায়। আবার বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা শিল্পে বাইরের বিনিয়োগ কতটুকু আনা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এই শিল্পটা জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত। যদি তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া বা চীন থেকে বিনিয়োগ আনতে চায়, তাহলে অস্ত্র উৎপাদনের উপর তুরস্কের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যাবে। কাতার থেকে বিনিয়োগ পেয়েছে তুরস্ক; তবে সেটা হয়তো যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে বাজার ধরার ক্ষেত্রেও রয়েছে চ্যালেঞ্জ। ২০১৮ সালে তুরস্কের অস্ত্রের মূল ক্রেতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ওমান, কাতার এবং নেদারল্যান্ডস। এছাড়াও পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ইউক্রেনে এবং আরও বেশকিছু দেশে অস্ত্র রপ্তানি করেছে তুরস্ক। ২০১৯ সালে নতুন ক্রেতা হিসেবে যোগ হয় মধ্য আমেরিকার গুয়াতেমালা, গায়ানা ও ত্রিনিদাদ টোবাগো; আর আফ্রিকার তাঞ্জানিয়া। কিন্তু এর মাঝে নেই বিশ্বের সবচাইতে বড় অস্ত্রের ক্রেতা দেশগুলি; যেমন সৌদি আরব, ইরাক এবং মিশর। সৌদি গ্রুপের সাথে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা থেকে বের না হতে পারলে তুরস্কের এই বাজারগুলি ধরতে পারার সম্ভাবনা ক্ষীন বলেই মনে করছেন আলী বাকীর।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প চার দশকে নিঃসন্দেহে অনেক এগিয়েছে। কিন্তু সেই শিল্প একাধারে যেমন তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের পরিচায়ক, তেমনি আবার পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতারও পরিচায়ক। তুরস্ক ‘টি ১২৯ আতাক’ হেলিকপ্টার তৈরি করতে পারলেও হেলিকপ্টারের টারবোফ্যান ইঞ্জিন বিদেশ থেকে আমদানি করা। ‘মিলজেম-ক্লাস’এর কর্ভেট তৈরি করতে পারলেও জাহাজের ইঞ্জিন, রাডার, বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র এবং টর্পেডো আমদানি করা। জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ‘আতমাকা’ নিজেরা তৈরি করেছে তারা, কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্রের মাইক্রো টারবো ইঞ্জিন ‘টিআর ৪০’ আসছে ফ্রান্সের কোম্পানি ‘সাফরান’ থেকে। ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের প্রকল্প থমকে দাঁড়িয়েছে ইঞ্জিনের অভাবে। আর্মার্ড ভেহিকল তৈরিতে অনেক এগিয়েছে তুরস্ক; কিন্তু এগুলি তৈরিতে ব্যবহৃত রিইনফোর্সড স্টিল আর্মার আমদানি করতে হচ্ছে অন্য দেশ থেকে। নিজস্ব পঞ্চম জেনারেশনের স্টিলথ ফাইটার বিমান তৈরি করার আগে নিজেদের টারবোফ্যান ইঞ্জিন তৈরি করতে হবে। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরিতে পিছিয়ে রয়েছে তারা; শক্তিশালী বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং দূরপাল্লার রাডার এখনও তুরস্কের পোর্টফোলিওতে নেই। তবে আশার আলোও রয়েছে তাদের জন্যে। ‘তুমোসান’ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে ডিজেল ইঞ্জিন তৈরিতে, যা আর্মার্ড ভেহিকল এবং ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত হবে। জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলি একত্রিত হয়েছে ম্যারিন ইঞ্জিন তৈরি করার জন্যে। ‘টিইআই’ তুরস্কের নিজস্ব টারবোফ্যান ইঞ্জিন তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে। নিজস্ব রিইনফোর্সড স্টিল আর্মার তৈরির কারখানাতেও বিনিয়োগ করছে তুরস্ক। ড্রোন তৈরিতে নিঃসন্দেহে অনেক এগিয়েছে তুরস্ক।

তুরস্কের সামরিক শিল্পের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি, যেমন ইঞ্জিন বা আর্মার, এখনও বিদেশের উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে হোঁচট খাবে, তা বলাই বাহুল্য। সিরিয়া এবং লিবিয়াতে অপারেশন চালাবার সময় পশ্চিমা দেশগুলির বৈরী নীতির শিকার হচ্ছে তুরস্ক। তুরস্ক তার সেকুলার পরিচয়কে পরিবর্তন না করেই বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের নেতৃত্ব দেবার যে ‘আইডেনটিটি পলিটিক্স’এ জড়িয়েছে, তা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তার পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতার কারণে। শতবর্ষ আগের উসমানি খিলাফতের প্রভাবগুলিকে ব্যবহার করতে চাইলেও পশ্চিমা নেতৃত্বের বিশ্বব্যবস্থাকে এড়িয়ে চলতে পদে পদে হিমসিম খাচ্ছে তুরস্ক। পশ্চিমা বিশ্বের উপর তুরস্কের নির্ভরশীলতা পুরোপুরিভাবে মুছে যেতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তুরস্কের যতটা পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন, তা বর্তমান তুরস্কের সাথে ততটাই সাংঘর্ষিক।

Friday 21 February 2020

আফগানিস্তানের ‘ব্ল্যাক হোল’ থেকে বের হতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?

২২শে ফেব্রুয়ারি ২০২০

  
গত ১৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে আফগানিস্তানে। অথচ বিপুল অংখ্যক আফগান জনগণের মৌলিক চাহিদাই পূরণ করা হয়নি। আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা ‘ব্ল্যাক হোল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া ট্রাম্প সরকার তালিবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি এবং সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের মতো পাথুরে অঞ্চলকে ১৮ বছর চেষ্টার পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। 


আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান মিলিশিয়াদের সাথে আংশিক যুদ্ধবিরতির একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে। সমঝোতা অনুযায়ী ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে এক সপ্তাহ যুদ্ধবিরতির উপর লক্ষ্য রাখা হবে। যদি তা সফল হয়, তাহলে ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হবে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, সহিংসতা কমতে থাকলে এটাই হবে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ। আফগান সরকারের সাথে তালিবানদের সংঘাতও এতে কমার আশা করছেন কেউ কেউ। তবে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই পরিস্থিতিতে গত সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের নির্বাচন পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এবং বিরোধী নেতা আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ - উভয়েই জয় পাবার দাবি করেছেন। পাঁচ মাস ধরে ব্যাপারটা ঝুলে থাকার ফলে কে বা কারা আফগান সরকারের পক্ষে তালিবানদের সাথে আলোচনায় বসবে সেটাই নিশ্চিত নয়। ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে আরেক দফা যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার কারণে এবারের যুদ্ধবিরতির সফলতা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন করছেন। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইছেন যেকোন মূল্যে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক অবস্থান কমাতে; অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে তালিবানরা ক্ষমতা ভাগাভাগিতে কতটা রাজি থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে এও বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের বেশিরভাগ সরিয়ে ফেলা হলেও স্পেশাল ফোর্সের ছোট একটা অংশ সেখানে রয়ে যাবে।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, আফগানিস্তানের প্রতিটা নির্বাচন এতটাই সমস্যাসঙ্কুল ছিল যে, প্রতিবারই মার্কিন সরকার চেষ্টা করেছে যে, নির্বাচনের ফলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবার আগেই যেন তালিবানদের সাথে একটা শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিবারই নির্বাচনের কারচুপি এবং সহিংসতা তালিবানদের সাথে আলোচনায় বাধা দিয়েছে। আফগানিস্তানের মার্কিন সমর্থিত সরকার এখন কে চালাবে সেব্যাপারে দুই গ্রুপের মাঝে ব্যাপক বিরোধ দেখা দিয়েছে। ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তান’এর সহকারি অধ্যাপক ওমর সাদর বলছেন যে, মার্কিনীদের সাথে তাদের আফগান মিত্ররাও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের মাঝে এতটাই দূরত্ব তৈরি হয়েছে যে, তা দ্রুত কমানো না গেলে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে।

সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে তালিবানরা রাজি হয়েছে যে তারা শহর, হাইওয়ে এবং প্রধান নিরাপত্তা চৌকিগুলির উপর হামলা করা থেকে বিরত থাকবে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমর্থিত আফগান সরকারি বাহিনী তালিবানদের বিরুদ্ধে তাদের অপারেশন বন্ধ রাখবে। আফগান প্রেসিডেন্ট গনি বলছেন যে, তালিবানরা যদি বর্তমানে দিনে ৮০টা হামলা থেকে ১০টা হামলায় নামিয়ে আনে, তাহলে যুদ্ধবিরতি সফল হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। তবে তালিবানরা যদি পূর্ণ যুদ্ধবিরতি পালন করতে যায়, তাহলে তাদের যোদ্ধাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হতে পারে।

তবে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ শুধু যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা নয়। দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তানে শান্তি আনাতে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন। ‘ভোক্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের বড় শহরগুলিকে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড চললেও দেশটার বেশিরভাগ অঞ্চলই আসলে ঠিকমতো চলছে না। কাবুলের উচ্চবিত্তদের মাঝে পশ্চিমা লাইফস্টাইলে ১ ডলারের কফি জনপ্রিয় হলেও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের একদিনের আয় ১ ডলারের নিচে। উঁচু দালান এবং বিয়েশাদীর জন্যে তৈরি করা হলগুলি শহুরে উচ্চবিত্তদের নিজেদের জাহির করার পদ্ধতি হলেও তা দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। দেশটার প্রায় অর্ধেকটাই হয় তালিবানদের দখলে অথবা নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতার মাঝে রয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রহরায় নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে প্রার্থীরা; যেখানে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয়নি, সেখানে তারা যাননি। নির্বাচনের দিন সহিংসতার ভয়ে বেশিরভাগ পোলিং স্টেশন বন্ধ ছিল। অর্থাৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুধুমাত্র কিছু শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। আফগানদের কেউ কেউ মনে করছেন যে, আফগান সরকার যেকোন কিছুই করতে অক্ষম; অন্যদিকে তালিবানরা আর যা-ই হোক, কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং কাজ করতে পারে। কাবুল থেকে মাত্র ৩০ কিঃমিঃ দূরেও যেকোন ধরনের নাগরিক সুযোগসুবিধা অবর্তমান। জনগণ মনে করছে যে, এতে সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। কাবুল সরকারের অনেক কর্মকর্তাই পশ্চিমা ধারায় চিন্তা করেন; তাদের অনেকরই দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে; অনেকেই আফগানিস্তানের ভাষাও বলতে পারেন না। আফগান সরকার মার্কিন অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তার জন্যে ওয়াশিংটনের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল।

২০১৯এর অগাস্টে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বেশ ঘটা করে আফগানিস্তানের স্বাধীনতার ১’শ তম বার্ষিকী উদযাপন করেন। কিন্তু এই উতসব চলাকালীন রাতের বেলায় মার্কিন বিমান হামলায় আফগানদের মাঝে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। জাতিসংঘের গত ডিসেম্বর মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী যুদ্ধে ১ লক্ষের বেশি বেসামরিক জনগণ এবং ২ হাজার ৩’শ মার্কিন সেনাসহ দেড় লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অনেক আফগানের কাছেই এই ‘তথাকথিত স্বাধীনতা’র বার্ষিকী মূল্যহীন। আফগানিস্তানের কিছু গোপন দলিল ফাঁস হবার পর ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আফগানিস্তানের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার একটা প্রবণতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমর্থিত আফগান সরকারের মাঝে। তারা মিথ্যা এবং বানোয়াট তথ্য দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের ধারণাগুলিকে ভিত্তি দিতে চাইছেন। গত ১৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে আফগানিস্তানে। অথচ বিপুল অংখ্যক আফগান জনগণের মৌলিক চাহিদাই পূরণ করা হয়নি। গোপন দলিলে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক কমান্ডারদের স্বীকারোক্তি রয়েছে যে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই তারা নিশ্চিত নন; এবং তারা আফগানিস্তানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে মার্কিন জনগণকে অন্ধকারে রেখেছেন। আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা ‘ব্ল্যাক হোল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া ট্রাম্প সরকার তালিবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ যেমন মার্কিনীরা ছেড়ে দিতে নারাজ, আবার দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তানে শান্তি আনার মত কোন কাজই এত বছরে মার্কিনীরা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি এবং সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের মতো পাথুরে অঞ্চলকে ১৮ বছর চেষ্টার পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।


Sunday 16 February 2020

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ফিলিপাইন?

১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২০

   
ফিলিপাইন এখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রদের উপরে ফিলিপাইনের নির্ভরশীলতা যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপাইনের চুক্তি বাতিল হোক আর না হোক, ফিলিপাইন যে আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিরাপত্তার চাদরের মাঝে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না, তা নিশ্চিত। 


গত ১১ই ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইন ঘোষণা দেয় যে, দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপাইনের স্বাক্ষরিত একটা নিরাপত্তা চুক্তি তারা বাতিল করতে যাচ্ছে। ‘ভিজিটিং ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ভিএফএ’ নামের এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে তাদের সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে পারতো। ফিলিপাইন যে এই চুক্তি বাতিল করবে, তার আভাস আগেই পাওয়া যাচ্ছিলো, যখন ২৩শে জানুয়ারি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতার্তে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সিনেটর রোনাল্ড ডেলা রসার ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে, তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘ভিএফএ’ চুক্তি বাতিল করবেন। ফিলিপাইনের অনলাইন মিডিয়া ‘র‍্যাপলার’ বলছে যে, সাংবাদিকদের সাথে এক টেলিকনফারেন্সে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ক্লার্ক কুপার বলেন যে, এই চুক্তি বাতিল করা হলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে প্রতি বছর যে ৩’শ যৌথ কর্মকান্ড চালিত হয়, তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে তিনি আশা করেন যে, ফিলিপাইনের নীতিনির্ধারকদের মাঝে অনেকেই এসব যৌথ কর্মকান্ড বন্ধ করার বিপক্ষে থাকবেন। এই চুক্তি বাতিল করা হলে ২০১৪ সালে স্বাক্ষরিত ‘এনহান্সড ডিফেন্স কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ইডিসিএ’ চুক্তিও হুমকির মুখে পড়বে। ‘ইডিসিএ’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে সৈন্য রাখা ছাড়াও কিছু সামরিক ঘাঁটিতে আগে থেকেই স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদ মজুত করে রাখে। তবে কুপার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, ‘ভিএফএ’ চুক্তি বাতিল করা মানেই ‘ইডিসিএ’ বাতিল করা নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিলিপাইন এখনও যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র ক্রয় করছে। এমতাবস্থায় ১৯৫১ সালে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত ‘মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি’ হুমকির মাঝে পড়বে কিনা, এই প্রশ্নের জবাব কুপার এড়িয়ে যান।

দুতার্তে সিনেটর ডেলা রসার ভিসা নিয়ে যে হুমকি দিয়েছিলেন, তা ছিল ফিলিপাইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েনের একটা অংশ। মার্কিন সিনেটে অনুমোদিত ‘গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি এক্ট’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দুতার্তের মাদকবিরোধী যুদ্ধের উপরে লাগাম টানতে চাইছিল। তবে মার্কিনীরা একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সামরিক চুক্তিগুলিকে সমস্যায় ফেলতে চাইছিল না। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, দুতার্তের সরকার চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে তাদের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব তৈরি করছিল। ‘ভিএফএ’ চুক্তি বাতিল করে এই পথে আরও দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হচ্ছে ফিলিপাইন। এই ঘোষণা এমন সময়ে এলো, যখন দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা আরও গভীর হচ্ছে। ফিলিপাইন এক্ষেত্রে চীনের সাথে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলতে চাইছে।

    
ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর দূরের সাগরে পাড়ি জমাবার আকাংক্ষা দেখিয়ে দেয় যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে সংঘাত তাদের উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ফিলিপাইন তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিকভাবে বন্ধু খুঁজছে; যেকারণে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে তারা সাহস করছে। চীনকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ফিলিপাইনকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ফিলিপিনোদের আরও সুযোগসুবিধা এবং ছাড় দিতে চাপের মাঝে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।


সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়াও ফিলিপাইন তার পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। নীতির পরিবর্তনের অংশ হিসেবে গত এক দশকে ফিলিপাইন তার নৌশক্তিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। ২০১১ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড থেকে ‘হ্যামিল্টন-ক্লাস’এর একটা পুরোনো জাহাজ পায় ফিলিপাইনের নৌবাহিনী। ৩ হাজার ২’শ টনের এই জাহাজখানা চার দশকের বেশি পুরোনো হলেও এটা ছিল ফিলিপাইনের প্রথম বড় আকারের যুদ্ধজাহাজ, যা ফিলিপাইনের নিজস্ব সমুদ্রসীমা পার হয়ে দূরের সমুদ্রে যেতে সক্ষম। এরকম মোট ৩টা জাহাজ তারা পায় যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড থেকে। ২০১৪ সালে এমন একটা জাহাজ অস্ট্রেলিয়া যায় একটা নৌমহড়ায় অংশ নিতে। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে ‘ম্যাকাসার-ক্লাস’এর ২টা বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজের ক্রয়াদেশ দেয় ফিলিপাইন। ২০১৭ সালের মাঝে ডেলিভারি পাওয়া সাড়ে ১১ হাজার টনের এই জাহাজগুলির একেকটা ৫’শ সৈন্য, তাদের অনেক যানবাহন এবং ২টি হেলিকপ্টার ১৩ হাজার কিঃমিঃ দূরের সমুদ্র উপকূলে নামিয়ে দিতে সক্ষম। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এরকম একটা জাহাজ ’টারল্যাক’ রাশিয়ার ভ্লাডিভস্টক বন্দর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু আইল্যান্ড সফর করে; যা ছিল ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর জন্যে দূরের সাগরে পাড়ি জমাবার নতুন এক অধ্যায়। ২০১৯এর জুলাই মাসে এরকম আরেকটা জাহাজ ‘দাভাও দেল সুর’ ৩’শ সেনা ও ক্রু এবং একটা হেলিকপ্টার নিয়ে রাশিয়ার ভ্লাডিভস্টক বন্দরে যায়। ২০১৮ সালের অগাস্টে ফিলিপাইন দু’টা জাহাজ হাওয়াই দ্বীপে পাঠায় একটা মহড়ায় অংশ নিতে। ২০১৩ সালে ডাকা টেন্ডার জেতার পর দক্ষিণ কোরিয়া ২ জাহাজ ৬’শ টনের ‘হোজে রিজাল-ক্লাস’এর ২টা অত্যাধুনিক ফ্রিগেট বানিয়ে দিচ্ছে; যার প্রথমটা এবছরের মার্চে ফিলিপাইনে পৌঁছাবার কথা রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর ‘পোহাং-ক্লাস’এর একটা এন্টিসাবমেরিন কর্ভেটও ফিলিপাইনের কাছে হস্তান্তর করেছে কোরিয় সরকার। ফিলিপাইনের কোস্ট গার্ডও ৪টা বড় অফশোর প্যাট্রোল জাহাজ কিনছে ফ্রান্স এবং জাপান থেকে। আরও ৬টা জাহাজ কেনার জন্যে অস্ট্রেলিয়া এবং থাইল্যান্ডের সাথে কথা চলছে।

এই জাহাজগুলির দূরের সাগরে যাবার অভিজ্ঞতা নতুন মোড় নেয় যখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মাঝে উত্তেজনার ফলশ্রুতিতে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ফিলিপিনোদের সরিয়ে নেবার লক্ষ্যে উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘দাভাও দেল সুর’ এবং ‘হ্যামিল্টন-ক্লাস’ জাহাজ ‘রেমন এলকারাজ’ জানুয়ারির ১৪ তারিখে ফিলিপাইন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে ১৫ দিন পর শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে পৌঁছে। এটা ছিল ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর ইতিহাসে কোন জাহাজের প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ। ৬ই ফেব্রুয়ারি জাহাজগুলি ওমান পৌঁছে।

তবে ফিলিপাইন এখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে না; যা কিনা ক্লার্ক কুপারের কথায় বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রদের উপরে ফিলিপাইনের নির্ভরশীলতা যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপাইনের চুক্তি বাতিল হোক আর না হোক, ফিলিপাইন যে আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিরাপত্তার চাদরের মাঝে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না, তা নিশ্চিত। চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নও সেকারণেই। ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর দূরের সাগরে পাড়ি জমাবার আকাংক্ষা দেখিয়ে দেয় যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে সংঘাত তাদের উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ফিলিপাইন তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিকভাবে বন্ধু খুঁজছে; যেকারণে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে তারা সাহস করছে। চীনকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ফিলিপাইনকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ফিলিপিনোদের আরও সুযোগসুবিধা এবং ছাড় দিতে চাপের মাঝে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।

Saturday 8 February 2020

তুরস্ক কোনটা বেছে নেবে - ইদলিব, নাকি রাশিয়া?

০৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২০

 
তুরস্কের সামনে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত তারা ইদলিবকে রক্ষা করবে, নাকি রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে রাখবে? ইদলিব ধরে রাখতে হলে তুরস্ককে সিরিয় সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে হতে পারে। আর রুশ সামরিক সহায়তা ছাড়া সিরিয় বাহিনীর পক্ষে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন। একদিকে তুর্কিরা যেমন চাইবে না রুশদের সাথে কৌশলগত চুক্তিগুলি সমস্যায় পড়ুক, তেমনি রাশিয়াও চাইবে না তুরস্কের মাধ্যমে রুশ অর্থনীতি লাভবান হবার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাক।


‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ৭ই ফেব্রুয়ারি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমের শহর ইদলিবে বাশার আল আসাদের সরকারি বাহিনী এবং রুশ বিমান বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে তুরস্ক আরও সেনা এবং ট্যাঙ্ক পাঠাচ্ছে। ইদলিব হলো সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সর্বশেষ প্রতিরোধের এলাকা। সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন দেয়া তুরস্ক ইদলিবে বাশার বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়াবার কাছাকাছি রয়েছে। ‘ইসলাস নিউজ এজেন্সি’ বলছে যে, তুর্কি সেনাবাহিনীর কমপক্ষে ৩’শ ৩০টা গাড়ি কাফর লুসিন গিরিপথের মাঝ দিয়ে ইদলিব পৌঁছেছে। এর আগে ইদলিবের কাছাকাছি সারাকিবে তুরস্কের ৮ জন সেনা সিরিয় হামলায় নিহত হয়। এর জবাবে তুর্কিরাও সিরিয় বাহিনীর উপর গোলাবর্ষণ করেছে। ইদলিবের হাসপাতাল এবং স্কুলগুলির উপর রুশ এবং সিরিয় বিমান বাহিনীর নির্বিচার হামলা থেকে বাঁচতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝেই ইদলিব ছাড়ছে হাজারো মানুষ। গত কয়েক মাসে এখান থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ পালিয়েছে। এর মাঝে অনেকে ইতোমধ্যেই সিরিয়ার অন্যান্য এলাকা থেকে কয়েকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তুরস্ক বলছে যে, সিরিয়ার সরকার ২০১৮ সালে তুরস্ক এবং রাশিয়ার সম্মতিতে করা যুদ্ধবিরতি লংঘন করেছে। ইদলিবে তুরস্কের ১২টা অবজার্ভেশন পোস্ট রয়েছে, যার মাধ্যমে তুরস্ক যুদ্ধবিরতি দেখাশুনা করে। তুর্কিরা বলছে যে, তারা এই পোস্টগুলি থেকে তাদের সৈন্য সড়াবে না; এবং তুর্কি অবস্থানে সিরিয়রা হামলা করলে তুরস্কও এর বদলা নেবে।

তুর্কি মিডিয়া ‘আহভাল নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে লেবাননে কাজ করা জাতিসংঘের এক প্রাক্তন কর্মকর্তা তিমুর গোকসেল বলেন যে, ৬ই ফেব্রুয়ারি সারাকিব নামক স্থান সিরিয় বাহিনীর হাতে চলে যাবার পর তুর্কিরা এবং তাদের সমর্থিত মিলিশিয়ারা পুরো ইদলিব হারাতে বসেছে। আলেপ্পো থেকে আসা ‘এম৫’ এবং লাটাকিয়া থেকে আসা ‘এম৪’ হাইওয়ের সংযোগস্থলে সারাকিব হলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা শহর, যার নিয়ন্ত্রণের উপরে আলেপ্পো থেকে ইদলিব পর্যন্ত সাপ্লাই লাইনের নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করছে। এই হাইওয়ে ধরে রাখতে তুরস্ক সারাকিব এবং ইদলিবের মাঝে তিনটা শক্তিশালী অবজার্ভেশন পোস্ট তৈরি করছিল। সারাকিবের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তুর্কিদের ইদলিব পৌঁছানো কঠিন হবে। আর তখন ইদলিবের ৩০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে তুর্কি সীমানার দিকে রওয়ানা হবে। বর্তমানে তুরস্কের অভ্যন্তরে ৩৭ লাখেরও বেশি সিরিয় শরণার্থী রয়েছে। একারণেই হয়তো তুরস্ক সারাকিবের দিকে সেনা পাঠাবার ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গোকসেল বলছেন যে, এখন তুরস্ককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা রুশদের বিরুদ্ধে সংঘাতে যাবে কিনা; কারণ সিরিয় সরকার রুশ সহায়তা ছাড়া ইদলিবের অপারেশন শুরুই করতে পারতো না। উত্তর সিরিয়াতে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে তুরস্ক তার প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী এই প্রক্সিগুলিকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করেছে। ‘মিডলইস্ট মনিটর’ বলছে যে, ৬ই ফেব্রুয়ারি তুর্কি সেনারা ইদলিবের পূর্বে তাফতানাজ বিমান ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে নেবার পরপরই সিরিয়রা সেখানে গোলাবর্ষণ করেছে। তবে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলছেন যে, রুশ প্রতিনিধিদল তুরস্কে আসছে সিরিয়া বিষয়ে আলোচনা করতে। ইদলিবে উত্তেজনা প্রশমণে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন। ইদলিবের সংঘর্ষ এমন সময়ে এলো, যখন রাশিয়া এবং তুরস্কের সম্পর্কের মধুরতা চলছে বেশ কিছু সময় ধরে।
 
৬ই ফেব্রুয়ারি সারাকিব নামক স্থান সিরিয় বাহিনীর হাতে চলে যাবার পর তুর্কিরা এবং তাদের সমর্থিত মিলিশিয়ারা পুরো ইদলিব হারাতে বসেছে। আলেপ্পো থেকে আসা ‘এম৫’ এবং লাটাকিয়া থেকে আসা ‘এম৪’ হাইওয়ের সংযোগস্থলে সারাকিব হলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা শহর, যার নিয়ন্ত্রণের উপরে আলেপ্পো থেকে ইদলিব পর্যন্ত সাপ্লাই লাইনের নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করছে।
 

গত ৮ই জানুয়ারি তুরস্ক এবং রাশিয়ার নেতারা কৃষ্ণ সাগরের একটা গ্যাস পাইপলাইন উদ্ভোধন করেন। কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে যাওয়া ৯’শ ৩০ কিঃমিঃ লম্বা এই পাইপলাইন রাশিয়ার উপকূলের আনাপা থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের পশ্চিমের কিয়িকয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই পাইপলাইনের একাংশের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস তুরস্ক যাবে। আর বাকি আরেক অংশের মাধ্যমে গ্যাস তুরস্কের মাঝ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বুলগেরিয়া, সার্বিয়া এবং হাঙ্গেরিতে যাবে। ‘আল-জাজিরা’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, ‘তুর্কস্ট্রিম’ নামে পরিচিত এই পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউক্রেনকে বাইপাস করে ইউরোপ পৌঁছাবে। আর একইসাথে তা তুরস্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জ্বালানি ট্রানজিট করিডোরে পরিণত করবে। আবার ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির পর ‘তুর্কস্ট্রিম’ রাশিয়া এবং তুরস্কের মাঝে সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে। প্রকল্প অনুযায়ী তুরস্ক বছরে ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস আমদানি করবে রাশিয়া থেকে। আর এর দ্বিতীয় অংশের কাজ শেষ হলে একই পরিমাণ গ্যাস যাবে ইউরোপে। মস্কোর সাথে ইউক্রেনের সংঘাত শুরু পর থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনকে বাইপাস করে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করতে চাইছে। ‘তুর্ক্সট্রিম’ ছাড়াও রাশিয়া বল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ নামের আরেকটা পাইপলাইনের মাধ্যেম জার্মানিতে গ্যাস রপ্তানি করতে চাইছে। ২০১৯এর ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটা নতুন আইনে সই করেন, যার মাধ্যমে এই দুই পাইপলাইন তৈরির উপর অবরোধ আরোপ করা হয়। তবে ‘তুর্ক্সট্রিম’ তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় অবরোধ মূলতঃ পড়েছে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’এর উপর।
   
‘তুর্কস্ট্রিম’ নামে পরিচিত এই পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউক্রেনকে বাইপাস করে ইউরোপ পৌঁছাবে। আর একইসাথে তা তুরস্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জ্বালানি ট্রানজিট করিডোরে পরিণত করবে। একদিকে তুর্কিরা যেমন চাইবে না রুশদের সাথে কৌশলগত চুক্তিগুলি সমস্যায় পড়ুক, তেমনি রাশিয়াও চাইবে না তুরস্কের মাধ্যমে রুশ অর্থনীতি লাভবান হবার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাক।

 
তবে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্টতা তুরস্কের জন্যে কূটনৈতিক দুর্বলতা তৈরি করবে বলে মনে করেন কেউ কেউ। ‘টারকিশ চ্যাম্বার অব পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার্স’এর জ্বালানি নীতির প্রধান নেচদেত পামির বলছেন যে, এই পাইপলাইনের মাধ্যমে তুরস্ক গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা পেলেও তা তুরস্ককে রাশিয়ার সাথে বেঁধে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে রাশিয়ার উপরেও তুরস্কের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কিনা গ্যাস সরবরাহের ব্যাপারে তুরস্কের দরকষাকষির সুযোগকে কমিয়ে দিচ্ছে। এতে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশি সুবিধা ভোগ করবে। তবে পামির যে ব্যাপারটাকে উল্লেখ করেননি তা হলো ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক। রুশ গ্যাস যতদিন পর্যন্ত ইউক্রেনের মাঝ দিয়ে নির্বিঘ্নে না যেতে পারবে, ততদিন ‘তুর্ক্সট্রিম’ থাকবে রাশিয়ার কাছে মহামূল্যবান। মার্কিন অবরোধের মাঝে তুরস্ক এবং ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির এই সুযোগ দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যতা থেকে উত্তোরণের একটা পথ।

তুরস্কের সামনে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত তারা ইদলিবকে রক্ষা করবে, নাকি রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে রাখবে? ইদলিব ধরে রাখতে হলে তুরস্ককে সিরিয় সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে হতে পারে। আর রুশ সামরিক সহায়তা ছাড়া সিরিয় বাহিনীর পক্ষে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন। একদিকে তুর্কিরা যেমন চাইবে না রুশদের সাথে কৌশলগত চুক্তিগুলি সমস্যায় পড়ুক, তেমনি রাশিয়াও চাইবে না তুরস্কের মাধ্যমে রুশ অর্থনীতি লাভবান হবার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাক। সিরিয়ার মতো লিবিয়াতেও তুরস্ক এবং রাশিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে। আবার ক’দিন আগেই তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইউক্রেন ঘুরে এসেছেন, যা রাশিয়াকে উত্তক্ত করেছে বলেই বলছেন বিশ্লেষকেরা। ইদলিব, লিবিয়া এবং ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি দেখিয়ে দেয় যে, তুরস্কের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক খুব শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে নয়। কিন্তু আপাততঃ যেহেতু উভয়েই সেই কৌশলগত সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল, তাই ইদলিব বা লিবিয়ার মত স্থানে দুই দেশ সংঘাতের পরিস্থিতিতে গেলেও দ্রুত পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে চাইবে।

Thursday 6 February 2020

তুরস্কের এশিয়া গমন?

০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ 

  
প্রস্তাবিত ‘ইস্তাম্বুল ফিনানশিয়াল সেন্টার’এর পরিকল্পনা, যেটাকে বিশ্বের সবচাইতে বড় পুঁজিবাজার হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করছে তুরস্ক। তুরস্ক এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতুস্বরূপ, যা দেশটাকে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাকিদের থেকে আলাদা করেছে। ন্যাটো সদস্য এবং ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্থনীতি হিসেবে তুরস্ক চাইছে এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করতে। 

৪ঠা ফেব্রুয়ারি তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এশিয়া বিষয়ক এক কনফারেন্স। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু কনফারেন্সে বলেন যে, গত বছরের অগাস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের অংশ হিসেবে তুরস্ক চাইছে এশিয়ার দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদ এবং প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেন। কাভুসোগলু বলেন যে, আগামী ১০ বছরে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুই তৃতীয়াংশ আসবে এশিয়া থেকে। আর সম্ভবতঃ ১৫ বছরের মাঝে বিশ্বের সবচাইতে বড় পাঁচটা অর্থনীতির চারটাই থাকবে এশিয়াতে। এমতাবস্থায় ন্যাটো সদস্য এবং ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্থনীতি হিসেবে তুরস্ক এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে। এশিয়ার সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মিডিয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে চাইছে তুরস্ক। কাভুসোগলুর কথাগুলিকে শক্তিশালী ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত করতে ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, আসিয়ানের ১০টা দেশ সহ এশিয়ার মোট ৩২টা দেশে তুরস্কের কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। গত ২৬শে ডিসেম্বর ‘এশিয়া এনিউ’ বিষয়ক এক কর্মশালায় ২০২০ সালে এশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। সেই কর্মশালায় তুরস্কের প্রভাবশালী শিক্ষাবিদ এবং থিঙ্কট্যাঙ্করা অংশ নেয়। চীন, ভারত, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার সাথে অস্ট্রেলিয়াকেও ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের অংশ হিসেবে ধরা হয়। কাভুসোগলু বলেন যে, এশিয়ার বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলায় তুরস্ক মানবিক এবং মধ্যস্ততার কাজে তার অভিজ্ঞতাকে সামনে তুলে ধরতে চায়। তিনি আরও বলেন যে, অষ্টাদশ শতক ছিল এশিয়ার হাতে; ঊনিশ শতক চলে যায় ইউরোপের হাতে; এরপর বিংশ শতকে আমেরিকা হয়ে যায় বিশ্বসেরা; একুশ শতকের পথ দেখাবে ‘এশিয়া এনিউ’।

‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের অংশ হিসেবে তুরস্ক তার বিনিয়োগের উৎসকে আরও কিছুটা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। তারা চাইছে যে, তুরস্কের বিনিয়োগ শুধু ইউরোপ থেকে না এসে এশিয়া থেকেও আসুক। ১৪ই জানুয়ারি ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ফিনান্স অফিস’ বলে যে, ২০২০ সালে তুরস্ক এশিয়া থেকে অর্থায়নের চেষ্টাকে অধিক গুরুত্ব দেবে। এই অফিসের প্রধান গোকসেল আশান তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে বলেন যে, তারা মনে করছেন যে, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং কাতার তুরস্কে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগকারী হতে পারে। ২০১৫ সালে ‘আইসিবিসি’ তুরস্কে প্রথম চীনা ঋণদাতা হিসেবে ঢোকে। এরপর ২০১৭ সালে ‘ব্যাঙ্ক অব চায়না’ও তুরস্কে অপারেশন শুরু করে। আশান বলেন যে, তুরস্ক তার দৃষ্টি পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরিয়ে ফেলেনি; বরং বিশ্বের অর্থনীতিই পশ্চিম থেকে এশিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলু বলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি এশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করলে তো কেউ বলেন না যে, তারা নিজেদেরকে পূর্বমুখী করছেন; তাহলে তুরস্ক এশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইলে তুরস্ক তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেলেছে, এমন আলোচনা আসবে কেন? তুরস্কের শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে যে, ২০০২ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তুরস্ক এশিয়া থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। ২০১৮ সালে তুরস্কে আসা মোট বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগের ২৮ শতাংশ ছিল এশিয়; যা ২০১৯ সালে বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এর বিপরীতে ইউরোপিয় বিনিয়োগ ছিল ৫৫ শতাংশ এবং মার্কিন বিনিয়োগ ছিল ৯ শতাংশের কিছু কম। ২০১৯এর প্রথম দশ মাসে তুরস্কে সবচাইতে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্রিটেন থেকে; যার পরে রয়েছে কাতার এবং আজেরবাইজান।

গোকসেল আশান আরও বলছেন যে, তুরস্ক চাইছে ২০২২ সালের মাঝে ‘ইস্তাম্বুল ফিনানশিয়াল সেন্টার’ নামের একটা পুঁজিবাজার তৈরি করতে, যা হবে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ১০টা বাজারের একটা। লন্ডন বা সিঙ্গাপুরের পুঁজিবাজারকে সরাসরি অনুকরণ না করে এই বাজারকে কিছুটা ভিন্নভাবে তৈরি করা হবে; কারণ তুরস্ক জানে যে, প্রচলিত পদ্ধতিতে লন্ডন বা সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেয়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামি মোড়কে পুঁজিবাজারটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে তারা। ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো নিউ ইয়র্ক, লন্ডন এবং দুবাইএর পুঁজিবাজারের চাইতে বড় একটা বাজার তৈরি করা, যা ইস্তাম্বুলকে আন্তর্জাতিক পুঁজির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করবে। ২৫ লক্ষ বর্গমিটার এলাকার মাঝে ৩০ হাজার মানুষের চাকুরির সুযোগ হবে বলে বলা হচ্ছে। সাড়ে ৫ লক্ষ বর্গমিটার আফিসস্পেস ছাড়াও এখানে থাকবে শপিং সেন্টার, হোটেল, বাসস্থান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং ২ হাজার মানুষ ধারণক্ষমতার কনফারেন্স সেন্টার।


  
আগামী ১০ বছরে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুই তৃতীয়াংশ আসবে এশিয়া থেকে। আর সম্ভবতঃ ১৫ বছরের মাঝে বিশ্বের সবচাইতে বড় পাঁচটা অর্থনীতির চারটাই থাকবে এশিয়াতে। এমতাবস্থায় ন্যাটো সদস্য এবং ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্থনীতি হিসেবে এশিয়ার সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মিডিয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে চাইছে তুরস্ক। 


২০১৯এর অগাস্টে এশিয়ায় অবস্থিত তুরস্কের কূটনৈতিক মিশনগুলির সাথে ১১তম সভায় নেয়া ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশল সম্পর্কে চীনা মিডিয়া ‘শিনহুয়া’ বলছে যে, তুরস্কের এই প্রচেষ্টা এশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে সবদিক থেকেই এগিয়ে নেবার একটা চেষ্টা। জুলাই মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের চীন সফরের সময় চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর মাধ্যমে দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। একজন জেষ্ট্য তুর্কি কূটনীতিক ‘শিনহুয়া’কে বলেন যে, ‘এশিয়া এনিউ’এর ফোকাস থাকবে বাণিজ্য বৃদ্ধি, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির মাঝে সম্পর্কোন্নয়ন এবং সামাজিক যোগাযোগের উন্নয়ন। তিনি বলেন যে, তুরস্ক এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতুস্বরূপ, যা দেশটাকে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাকিদের থেকে আলাদা করেছে। এই চেষ্টাটাকেই এখন তুরস্ক একটা কৌশলগত দিকনির্দেশনায় পরিণত করতে চাইছে। ইস্তাম্বুলের কচ ইউনিভার্সির প্রফেসর আলতায় আতলি বলছেন যে, এতদিন এশিয়ার বেশকিছু দেশের সাথে তুরস্কের বেশ ভালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিল; কিন্তু তা তুরস্কের এশিয়া নিয়ে বৃহৎ কোন কৌশলের অংশ ছিল না। পৃথিবীর ৬০ শতাংশ মানুষ এশিয়াতে থাকে, এবং এখানেই দুনিয়ার সবচাইতে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলি রয়েছে। তাই শুধুমাত্র পশ্চিমা দেশগুলির সাথে সম্পর্ক রাখাটা তুরস্কের জন্যে যথেষ্ট নয়।

তুরস্ক তার ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলকে নিয়মিত আলোচনার মাঝে দেখতে চাইছে। ২১শে জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর সাইডলাইনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলু আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ, জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রী গিওর্গি গাহারিয়া, চীনের রিটেইল ব্যবসা ‘আলীবাবা’র প্রতিনিধি, ভারতের গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘মাহিন্দ্রা’র প্রতিনিধি এবং আজেরবাইজানের তেল কোম্পানি ‘সোকার’এর প্রতিনিধির সাথে ‘নিউ ভিশন ফর এশিয়া’ আলোচনায় ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন যে, ২১ শতকে এশিয়া পৃথিবীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে। তুরস্কের ‘ইহলাস নিউজ এজেন্সি’র সাথে এক স্বাক্ষাতে কাজাখস্তানের রাষ্ট্রদূত আবজাল সাপারবেকুলি বলেন যে, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন এশিয়ার দিকে ধাবিত হওয়ায় তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশল এশিয়ার দেশগুলির সাথে সম্পর্কে গতি আনবে। তিনি আরও বলেন যে, যেভাবে কাজাখস্তান তুরস্কের জন্যে রাশিয়া, চীন ও মধ্য এশিয়ার জন্যে দরজা, তেমনি তুরস্কও এশিয়া থেকে ইউরোপে যাবার দরজা।

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। একইসাথে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে ইউরোপের সাথেও তুরস্কের সম্পর্ক শীতল যাচ্ছে। লিবিয়ার যুদ্ধে জড়াবার পর থেকে এই শীতল সম্পর্ক শীতলতর হবার আশংকা দেখা যাচ্ছে। একুশ শতকে নিজের প্রভাবকে নতুনতর উচ্চতায় নিয়ে যেতে তুরস্ক ইউরোপ এবং এশিয়া উভয় অঞ্চলেই অবস্থান নিতে চাইছে। বিশেষ করে ঐতিহাসিকভাবে এশিয়ার অর্থনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরে তুরস্ক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন একটা অধ্যায়কে প্রাধান্য দিতে চাইছে, যা মাত্র কয়েক দশক আগেও দৃশ্যমান ছিল না। এশিয়ার অর্থনীতিতে তুরস্কের উপস্থিতি এমন সময়ে আসছে, যখন ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ ও প্রযুক্তিযুদ্ধ প্রতিনিয়ত নতুন রূপ নিচ্ছে। তুরস্ক চাইছে চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটভ’কে যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রতিরোধ না করে বরং নিজের কাজে ব্যবহার করতে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে তুরস্ককে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর হলেই চলবে না, রাজনৈতিকভাবে এশিয়ায় তার অবস্থানকে দৃঢ় করতে হবে। রাজনৈতিক অবস্থান করতে এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির সাথে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোযোগী হবে তুরস্ক। ‘মুসলিম আইডেন্টিটি’কে ব্যবহার করে এগুতে চাইলেও আদর্শিক দিক থেকে তুরস্ককে নির্দিষ্ট একটা অবস্থানে আসতে হবে, যা কাশ্মির এবং উইঘুর ইস্যুতে তুরস্কের শক্ত অবস্থান নেবার অক্ষমতা থেকে আপাততঃ দৃশ্যমান নয়।

Saturday 1 February 2020

ব্রেক্সিট-পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর ভবিষ্যৎ কি?

১লা ফেব্রুয়ারি ২০২০
ইইউএর মাঝে থেকেও ব্রিটেন সর্বদাই আলাদা থাকতে চেয়েছে। ইইউএর সাধারণ মুদ্রা ইউরোকেও ব্রিটেন নিজের মুদ্রা হিসেবে মেনে নেয়নি। ইইউ থেকে ব্রিটেন সুবিধা চেয়েছে; কিন্তু বিনিময়ে কিছু দিতে কার্পণ্য করেছে। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় ইউরোপের সাথে ব্রিটেনের এই প্রতিযোগিতা শেষ হচ্ছে না; বরং নতুন রূপ নিচ্ছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্কও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে; বিশেষ করে ব্রিটেন যখন পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক নেতৃত্ব নিতে চাইছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ সম্পর্কে আলোচনা করছে। কিন্তু এর বাস্তবতা নিয়ে কৌতুহলের চাইতে প্রশ্নই বেশি আসছে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্বের সকলকে বিশ্বাস করানো যে ব্রিটেন বিশ্বকে আবারও নেতৃত্ব দেবার সক্ষমতা রাখে।


ইইউ পার্লামেন্ট এবং রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্মতির পর ৩১শে জানুয়ারি ব্রিটেন অফিশিয়ালি ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেল। তবে এতে সামনের দিনগুলিতে নতুন কিছু বিষয় আলোচনায় আসছে। এর একটা হলো ইইউএর সাথে নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি করা। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ব্রেক্সিটের পর আরও কঠিন সময় শুরু হচ্ছে। ইইউএর সাথে বাণিজ্য আলোচনা খুব একটা সহজ হবে না। ইউরোপের দেশগুলি এখন ব্রিটেনের সাথে তেমন সহজ শর্তে ব্যবসা করবে না। ব্রিটেনের অর্থনীতি ইউরোপের সাথে ব্যবসার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তাহলে ব্রিটেন কেন এই ঝামেলার মাঝে জড়াতে গেলো? ব্রিটেন চাইছে তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটাকে এগিয়ে নিতে; যার মাধ্যমে ব্রিটেন ইইউএর নিয়মকানুনের মাঝে আটকে না থেকে বিশ্বব্যাপী আদর্শিক নেতৃত্ব দিতে চাইছে।

প্রাক্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম হেগ ‘দ্যা ডিইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক লেখায় বলেন যে, ব্রিটেনের ইইউ থেকে বের হবার সাথেসাথে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর যুগ শুরু হলো। তিনি মনে করছেন যে, পশ্চিমা গণতন্ত্রই হচ্ছে বিশ্বের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং বিশ্বব্যাপী আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন যেহেতু তেমন কিছুই করছে না, তাই ব্রিটেনের উচিৎ এক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়া। তবে ইইউ ছেড়ে গেলেও ইউরোপকে সাথে নিয়েই কাজ করার কথা বলছেন উইলিয়াম হেগ।

ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর ইউরোপ প্রোগ্রামের ডিরেক্টর থমাস রেইনস ‘কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় বলছেন যে, ব্রিটেনের সামনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে ব্যালান্স করে চলার এবং এর মাঝেই বিশ্বব্যাপী প্রভাব বৃদ্ধি করার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের নিরাপত্তা সম্পর্ক গভীরই থাকবে; আর ইউরোপ যথারীতি ব্রিটেনের সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী থাকবে। এর মাঝেই ব্রিটেন চাইবে কানাডা এবং জাপানের মতো কিছু মধ্যম সারির শক্তির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে। জলবায়ু পরিবর্তন, মুক্ত বাণিজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক অবরোধের মতো ইস্যুগুলিতেও ব্রিটেন ইউরোপকে পাশে চাইবে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক সক্ষমতার দৈন্যের মাঝেই ব্রিটেন মানবাধিকারের মতো লিবারাল আদর্শগুলির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিতে চাইবে।

অপরদিকে ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক বিশ্লেষণে হচ্ছে যে, ইইউ থেকে বের হয়ে গেলেই যে ব্রিটেন স্বাধীনভাবে চলতে পারবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। চীনা কোম্পানি হুয়াইকে ব্রিটেনের ‘ফাইভ-জি’ মোবাইল নেটওয়ার্ক তৈরির অনুমতি দেবার পর যুক্তরাষ্ট্রের নাখোশ হবার ব্যাপারটাকে তুলে ধরে তারা বলছে যে, ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ব্রিটেনকে কোন একটা পক্ষে থাকতেই হবে।উইন্সটন চার্চিলের সময় থেকে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রক্ষা করে চলছে; আর এই সম্পর্ককে ব্রিটেন ইউরোপের উপরেই স্থান দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সর্বদাই এই ‘বিশেষ সম্পর্ক’কে বিশেষভাবে নয়, বরং নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তার আলোকে দেখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রিটিশ স্বার্থকে পদদলিত করে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থকেই সমুন্নত রেখেছে। তদুপরি, ইন্টেলিজেন্স, সামরিক এবং পারমাণবিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতে শত ঝড়ঝাপ্টার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই ব্রিটেনকে পাশে পেয়েছে। দুই দেশের এই ‘বিশেষ সম্পর্ক’কে ব্রিটেনের জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ব্রিটেনের আনুগত্যের সম্পর্ক হিসেবে দেখেছে। বিশেষ করে ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণের পর এই কথাগুলিই প্রচলিত হয়েছে। তবে ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্রিটেনের গুরুত্ব কমে যেতে পারে বলে মনে করছে ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা যুতসই বাণিজ্য চুক্তি করতে না পারলে এই সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে।

চীনারাও ব্রেক্সিটের পর ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর দিকে খেয়াল রাখছে। লন্ডনে চীনা রাষ্ট্রদূত লিউ শিয়াওমিংএর একটা লেখা ছাপা হয় ব্রিটেনের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকাতে। তিনি বলছেন যে, ব্রেক্সিটের পর ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে চীনের দিকেই তাকাতে হবে। গত পাঁচ বছরে চীনারা ব্রিটেনে যা বিনিয়োগ করেছে, তা এর আগের তিন দশকেও করেনি; এর মূল্যমান ১৯ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে ব্রিটিশরা চীনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগের যোগানদাতা। চীনা কোম্পানি হুয়াই গত পাঁচ বছরে ব্রিটেনে ২ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে, সাড়ে ৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এবং প্রতি বছর ৬০ মিলিয়ন পাউন্ড কর দিয়েছে। এর পরের পাঁচ বছরে হুয়াই ‘ফাইভ-জি’ প্রকল্পে আরও ৩ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করবে। শিয়াওমিং ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর কাছ থেকে মুক্ত বাণিজ্যের নিশ্চয়তা চাইছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের চলছে ব্যাপক বাণিজ্য যুদ্ধ। ব্রিটেন মনে করছে যে, ‘অকারণে’ চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়ালে ব্রিটেনের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুক্ত বাণিজ্যের প্রসার চাইলেও ব্রিটিশরা পূর্ব এশিয়ায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যেমে চীনের আগ্রাসী আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতি; যা কিনা ব্রিটেনের আদর্শিক চিন্তারই ফসল।

সিঙ্গাপুরের ‘এস রাজারাতনাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর ফেলো ফ্রেডারিক ক্লিয়েম ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’এর এক লেখায় ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেনের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধির কথা বলছেন। ২০১৮ সালে ‘আসিয়ান’এর সাথে ব্রিটেনের বাণিজ্য ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের; অত্র এলাকায় ব্রিটেনের বিনিয়োগ রয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলছেন যে, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্রিটেনকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যেই ১৯৭১ সালে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সাথে স্বাক্ষরিত ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স এরেঞ্জমেন্টস’এর অধীনে ব্রিটেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতে স্থায়ী খেলোয়াড় হতে চাইছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়মিত আসাযাওয়া করছে এবং এখানে একটা স্থায়ী নৌঘাঁটি করার পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে।

‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’এর ‘আইডিয়াস ইন্সটিটিউট’এর এসোসিয়েট স্টিফেন পাদুয়ানো ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার অবাস্তব আকাংক্ষাকে আজ হোক কাল হোক মেনে নিতে বাধ্য। আফ্রিকাতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং চীনকে টক্কর দিয়ে আফ্রিকায় সবচাইতে বড় বিনিয়োগকারী হবার আশা ব্রিটেন করতে পারে না। আফ্রিকাতে ব্রিটেন যদি তার পশ্চিমা সহযোগীদেরকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে থাকে, তাহলে ব্রিটেনের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন কঠিন। একইসাথে ব্রিটেন আফ্রিকার দেশগুলিকে বলতে পারে না যে তারা যেন ব্রিটেনকেই তাদের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে মেনে নেয়।

ইইউএর মাঝে থেকেও ব্রিটেন সর্বদাই আলাদা থাকতে চেয়েছে। ইইউএর সাধারণ মুদ্রা ইউরোকেও ব্রিটেন নিজের মুদ্রা হিসেবে মেনে নেয়নি। ইইউ থেকে ব্রিটেন সুবিধা চেয়েছে; কিন্তু বিনিময়ে কিছু দিতে কার্পণ্য করেছে। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় ইউরোপের সাথে ব্রিটেনের এই প্রতিযোগিতা শেষ হচ্ছে না; বরং নতুন রূপ নিচ্ছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্কও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে; বিশেষ করে ব্রিটেন যখন পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক নেতৃত্ব নিতে চাইছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ সম্পর্কে আলোচনা করছে। কিন্তু এর বাস্তবতা নিয়ে কৌতুহলের চাইতে প্রশ্নই বেশি আসছে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্বের সকলকে বিশ্বাস করানো যে ব্রিটেন বিশ্বকে আবারও নেতৃত্ব দেবার সক্ষমতা রাখে।