Monday 31 August 2020

কাশ্মির থেকে উইঘুর... মুসলিমরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির শিকার

৩১শে অগাস্ট ২০২০

 

চীনা সরকারি মিডিয়ায় প্রকাশিত উইঘুরের ডিটেনশন ক্যাম্প।জাতিসংঘের হিসেবে উইঘুরে ১০ লক্ষ মুসলিমকে চীন সরকার আটকে রেখে ‘নতুন করে শিক্ষা’ দিচ্ছে। শুধু কাশ্মির, আসাম বা উইঘুরই নয়; এর সাথে রয়েছে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, লিবিয়া, আরাকান এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমদের উপর নির্যাতনের অগুণিত প্রতিবেদন। প্রতিটা ক্ষেত্রেই জাতিরাষ্ট্রগুলি তার নিজস্ব জাতিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। করোনাভাইরাসের মহামারি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ ‘মানবাধিকার’ এখন হাস্যকর এক শব্দে পরিণত হয়েছে। অন্ততঃ মুসলিম বিশ্বের মাঝে জাতীয়তাবাদ প্রসূত স্বার্থের রাজনীতি যে বিভাজন ও অন্যায়ের জন্ম দিচ্ছে, তা মুসলিমদেরকে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা খুঁজতে বেশি অনুপ্রাণিত করবে।

গত ৩১শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ চীনা কোম্পানি ‘শিনজিয়াং প্রোডাকশন এন্ড কন্সট্রাকশন কর্পোরেশন’ এবং এর দুইজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা প্রাক্তন পার্টি সেক্রেটারি সুন জিলং এবং ডেপুটি সেক্রেটারি পেং জিয়ারুইএর উপর চীনের পশ্চিমের উইঘুর অঞ্চলে মুসলিমদের উপর নির্যাতনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অবরোধ আরোপ করে। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র এই কোম্পানি এবং ব্যাক্তিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও ব্যাক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেবে এবং মার্কিনীদের এদের সাথে ব্যবসা করার উপর নিষেধাজ্ঞা দেবে। এর আগে গত ১৭ই জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উইঘুর মুসলিমদের উপর নির্যাতনের কারণ দেখিয়ে তৈরি করা নতুন মার্কিন আইনে স্বাক্ষর করেন। গত ডিসেম্বরে এই আইন মার্কিন কংগ্রেসে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়; যেখানে বিপক্ষে পড়েছিল মাত্র এক ভোট। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল চীনকে মানবাধিকার বিষয়ে একটা বার্তা দেয়া। এই আইনের অধীনে চীনের উইঘুর বা শিনজিয়াং রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি চেন কুয়াংগুয়োর উপর অবরোধের কথা বলা হয়েছে এবং মার্কিন কোম্পানিগুলিকে উইঘুরের জোরপূর্বক শ্রমে তৈরি যে কোন পণ্য বর্জন করতে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে উইঘুরে ১০ লক্ষ মুসলিমকে চীন সরকার আটকে রেখে ‘নতুন করে শিক্ষা’ দিচ্ছে। মার্কিন নেতৃবৃন্দ বলছেন যে, চীনারা উইঘুরের মুসলিমদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসকে মুছে ফেলতে চাইছে। অপরদিকে চীনারা বলছে যে, এই ক্যাম্পগুলিতে বিভিন্ন বিষয়ে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এবং এটা উগ্রবাদী চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে দরকার রয়েছে। চীনারা মার্কিন কংগ্রেসে পাস করা আইনের কড়া সমালোচনা করে বলে যে, এর মাধ্যমে চীনকে খারাপ প্রমাণ করার ষড়যন্ত্র চলছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে তার ভুল শুধরে নিতে বলা হয়। চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারেও হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। এতে আরও বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এর থেকে বিরত না হলে চীন এর বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বন্দ্বের জন্যে পুরোপুরি দায়ী থাকবে। উইঘুর মুসলিমদের সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস’ ট্রাম্পকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে যে, এটা উইঘুরের জনগণকে আশা দেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, উইঘুরের মুসলিমদের রক্ষায় তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে? এতে কার স্বার্থই বা কি?

‘বিজনেস ইনসাইডার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, শুধু উইঘুরই সমস্যা নয়। ভারত তার অধিকৃত কাশ্মির অঞ্চলের বিশেষ অধিকার বাতিল করেছে এবং তার পূর্বের আসাম রাজ্যে বাঙ্গালী মুসলিমদের আটক করার ব্যবস্থা করছে। চীন এবং ভারত উভয়েই বলছে যে, এই ব্যবস্থাগুলি তারা নিচ্ছে সহিংসতা বন্ধ করতে; এবং একইসাথে অন্যান্য দেশগুলিকে তারা এব্যাপারে নাক না গলাতে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে বলা হচ্ছে যে, উভয় দেশই মূলতঃ মুসলিমদেরকে টার্গেট করেছে ‘সহিংসতা বন্ধের’ কথা বলে। আর বাকি বিশ্ব এই দুই দেশের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। হয় চীনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ধরে রাখতে বা চীনের হুমকির ভয়ে একটা মুসলিম দেশও চীনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও চীনকে শুধরে নিতে বলেছে, কিন্তু চীনকে বাধ্য করতে কোন পদক্ষেপই নেয়নি। উইনিভার্সিটি অব কলোরাডোর গবেষক ড্যারেন বায়লার বলছেন যে, অনেককেই চীনের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলতে শোনা যাচ্ছে; কিন্তু যখন এর ফলশ্রুতিতে মানবসম্পদ বা অর্থসম্পদহানির কোন সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই তারা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। তারা একইসাথে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির নেতৃবৃন্দের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলছে যে, মুসলিম দেশগুলিই তো কিছু করছে না, তাহলে তাদের উপর কেন দায় থাকবে? তারা নিজেদের অবস্থানের সমর্থনে বলছেন যে, অন্ততঃপক্ষে এর বিরুদ্ধে কিছু কথা তো তারা বলছেন।
    

ভারতীয় বাহিনীর পেলেট গানের শিকার কাশ্মিরের জনগণ। মুসলিম হওয়াটাই যেন ছিল তাদের অপরাধ। উইঘুরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নিলেও কাশ্মির এবং আসামের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি চুপ থেকেছে। অন্যদিকে কাশ্মির ইস্যুতে সবচাইতে সরব রয়েছে পাকিস্তান; আর ঠিক একইভাবে উইঘুর ইস্যুতে একইরূপ নিস্তব্ধ রয়েছে তারা। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় স্বার্থ এক্ষেত্রে কাশ্মির, উইঘুর এবং আসামের মুসলিমদের উপর নির্যাতন চলমান থাকার পিছনে বড় রকমের ইন্ধন যুগিয়েছে।
 

উইঘুরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নিলেও কাশ্মির এবং আসামের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি চুপ থেকেছে। গত অক্টোবরের মার্কিন কংগ্রেসের ‘হাউজ এশিয়া’ সাবকমিটির মানবাধিকার বিষয়ক শুনানিতে এবং এর পরবর্তীতে ‘ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ রিপোর্টে ভারতের মুসলিমদের উপর নাগরিকত্বের শর্ত দিয়ে মানবাধিকার ভূলুন্ঠিত করার কথা এসেছিল। কাশ্মির ইস্যুতে সবচাইতে সরব রয়েছে পাকিস্তান; আর ঠিক একইভাবে উইঘুর ইস্যুতে একইরূপ নিস্তব্ধ রয়েছে তারা। এবছরের জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর এক আলোচনায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রথমে বলেন যে, তিনি উইঘুরে চীনা সরকারের কর্মকান্ডের ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত নন। পরে সাংবাদিকদের চাপের মুখে সরাসরিই বলেন যে, পাকিস্তানের সবচাইতে খারাপ সময়ে চীন পাকিস্তানকে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে; তাই তারা চীনা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানী মিডিয়া যতটা সরব, ততটাই সরব দেখা যাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়াকে উইঘুর ইস্যুতে। বিশেষ করে লাদাখ সীমান্তে চীনের সাথে সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই ভারতীয় মিডিয়া উইঘুর ইস্যুতে পাকিস্তানের সমালোচনায় মুখর রয়েছে। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় স্বার্থ এক্ষেত্রে কাশ্মির, উইঘুর এবং আসামের মুসলিমদের উপর নির্যাতন চলমান থাকার পিছনে বড় রকমের ইন্ধন যুগিয়েছে।

ব্রিটেনের ‘ইন্ডেপেন্ডেন্ট’ পত্রিকার প্রবীন কলামিস্ট প্যাট্রিক ককবার্ন বলছেন যে, দুনিয়াব্যাপী জাতীয়তাবাদের এক উত্থান দেখা যাচ্ছে। তিনি বলছেন যে, তুরস্ক তার তুর্কি জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামকে ব্যবহার করে তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে; অন্যদিকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি হিন্দুত্ববাদী চিন্তার উপর ভর করে ভারতের পরিচয় পূননির্ধারণ করতে চাইছে। চীনারাও তাদের হান ভিত্তিক চৈনিক জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় শক্তির ভিত্তি হিসেবে দেখতে চাইছে। এই জাতীয়তাবাদী চিন্তার ফলে একেকটা দেশের অভ্যন্তরে জাতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বয়ে আসছে অমানুষিক অত্যাচার। অধিকৃত কাশ্মির ছাড়াও ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপর যেমন অত্যাচার হচ্ছে, তেমনি চীনের পশ্চিমাঞ্চলের উইঘুর রাজ্যেও কয়েক বছর ধরেই মুসলিমদের উপর চলছে ‘শুদ্ধাভিযান’। তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দিদেরকে আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে তুরস্কের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে। ককবার্নের কথাগুলিকে সাম্প্রতিক বিশ্ব মিডিয়ার খবরের সাথে সমন্বয় করলে দেখা যায় যে, প্রতি ক্ষেত্রেই বাইরের দেশগুলি সেই দেশের অভ্যন্তরের সংখ্যালঘুদেরকে সমর্থন দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চাইছে। কারণ ককবার্ন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এই সংখ্যালঘুরা কতটুকু শক্তিশালী, তা নির্ভর করছে বিশ্বব্যাপী তারা কতটা রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করতে পারে সেটার উপর। সেই হিসেবেই কাশ্মিরের মুসলিমদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান; কুর্দিদের আলাদা রাষ্ট্র গড়ার পিছনে মদদ যোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; আর গত এক বছরের মাঝে উইঘুর মুসলিমদের পক্ষে কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে চীনকে চাপের মুখে রাখতে চাইছে।
    

উইঘুরের সন্দেহভাজন ক্যাম্পগুলির মানচিত্র। অনেককেই চীনের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলতে শোনা যাচ্ছে; কিন্তু যখন এর ফলশ্রুতিতে মানবসম্পদ বা অর্থসম্পদহানির কোন সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই তারা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। তারা একইসাথে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির নেতৃবৃন্দের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলছে যে, মুসলিম দেশগুলিই তো কিছু করছে না, তাহলে তাদের উপর কেন দায় থাকবে? তারা নিজেদের অবস্থানের সমর্থনে বলছেন যে, অন্ততঃপক্ষে এর বিরুদ্ধে কিছু কথা তো তারা বলছেন।

 

তবে ককবার্ন এক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন উইঘুর এবং কাশ্মির ইস্যুতে। কাশ্মিরের জনগণের উপর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লকডাউন এবং বিচারবহির্ভূত অত্যাচার ভাইরাসের লকডাউনের চাইতেও বহুগুণে বেশি ক্ষতি করেছে। তবে কাশ্মির ছাড়াও ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিমের প্রতি বিজেপি সরকারের শত্রুভাবাপন্ন আচরণ এড়ানো যাবে না। রাম মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেধরণের মনোভাবই দেখিয়েছেন। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার পর ফলাফলস্বরূপ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। মোদি সরকার মনে করছে যে, তারা কাশ্মির সমস্যার ‘সমাধান’ করে ফেলবেন। তারা ভারতের বাকি মুসলিমদের ‘সমস্যা’ও সমাধান করে ফেলবেন বলে বলছেন। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লীর দাঙ্গাই দেখিয়ে দেয় যে, ২০ কোটি মানুষের সংখ্যালঘু জনসংখ্যাকে এতো হাল্কাভাবে নিলে মারাত্মক ভুল হবে। ভারতের চিন্তাবিদদের চিন্তার দৈন্যতা বোঝাতে ককবার্ন এক্ষেত্রে বৈরুতের কর্মকর্তাদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যারা বছরের পর বছর নিশ্চিন্তে বিশাল বোমার উপর বসে ছিলেন। ভারতের সরকারকে পশ্চিমারা নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছে; কারণ তারা মনে করছে যে, ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় ভারত চীনকে নিয়ন্ত্রণের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একই সুত্রে তারা উইঘুর ইস্যুতে মুসলিমদের পক্ষাবলম্বন করছে নিজেদের স্বার্থে।

ঊইঘুর ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান মুসলিমদের ব্যাপারে ট্রাম্পের দীর্ঘমেয়াদী চিন্তার পুরোপুরি বিরুদ্ধে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসলাম এবং মুসলিমবিদ্বেষী মন্তব্যের একটা তালিকা দেয়া হয়। এতে ২০১১ সাল থেকে ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বষী মনোভাবের প্রকাশ পায়। ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে বলেন যে, মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করে না। আবার বিভিন্ন সময়ে এ-ও বলেন যে, মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্রে টাইম বোমার মতো; এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মসজিদগুলিকে বন্ধ করে দেবার পক্ষেও যুক্তি দেন।

শুধু কাশ্মির, আসাম বা উইঘুরই নয়; এর সাথে রয়েছে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, লিবিয়া, আরাকান এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমদের উপর নির্যাতনের অগুণিত প্রতিবেদন। প্রতিটা ক্ষেত্রেই জাতিরাষ্ট্রগুলি তার নিজস্ব জাতিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ফায়দা লুঠতে একে অপরের দুর্বলতা ব্যবহার করতে চেয়েছে; মুসলিমদের বাঁচাবার উদ্দেশ্যে নয়। নিজের ভৌগোলিক অখন্ডতা অটুট রাখতে প্রতিটা জাতিরাষ্ট্র আবার চেয়েছে জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করতে। আর সেক্ষেত্রে জাতিগত এবং বিশ্বাসগত দিক থেকে সংখ্যালঘুরা হয়েছে অমানবিক নির্যাতনের শিকার। জাতীয়তাবাদের নামে চলেছে ‘শুদ্ধিকরণ’, যা উইঘুরই হোক, বা আসামই হোক। অভিভাবকহীন সন্তানের মতো কাশ্মির, আসাম, উইঘুর, আরাকান, ফিলিস্তিনের মুসলিমরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্যে। প্রত্যেকেই তাদের এই অসহায়ত্বকে ব্যবহার করেছে নিজেদের জাতীয় স্বার্থে। করোনাভাইরাসের মহামারি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ ‘মানবাধিকার’ এখন হাস্যকর এক শব্দে পরিণত হয়েছে। অন্ততঃ মুসলিম বিশ্বের মাঝে জাতীয়তাবাদ প্রসূত স্বার্থের রাজনীতি যে বিভাজন ও অন্যায়ের জন্ম দিচ্ছে, তা মুসলিমদেরকে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা খুঁজতে বেশি অনুপ্রাণিত করবে।

Thursday 27 August 2020

যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মাঝে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা কেন?

২৮শে অগাস্ট ২০২০ 

রাশিয়া সোভিয়েত আমলের ৫০ মেগাটনের বোমা পরীক্ষার ডকুমেন্টারি প্রকাশ করলো এমন সময়ে, যখন কথা উঠছে যে, রাশিয়া এমন এক ধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করছে, যা কিনা সাবমেরিন থেকে ছোঁড়া যাবে এবং যা প্রায় ১’শ মেগাটনের পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করবে। এরকম বোমা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের কাছে সমুদ্রের নিচে বিস্ফোরণ ঘটালে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় সুনামিতে নিউ ইয়র্কসহ উপকূলের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহরই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তা মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরিভাবে বাইপাস করবে। রাশিয়াকে চাপে রাখার যুক্তরাষ্ট্রের নীতিই রাশিয়াকে দুনিয়া বিধ্বংসী অস্ত্র ডেভেলপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাশিয়ার ভৌগোলিক অখন্ডতার চ্যালেঞ্জ রাশিয়াকে প্রতিযোগিতামূলক অস্ত্র তৈরিতে আরও বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে।



গত ২০শে অগাস্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় আণবিক শক্তি কোম্পানি ‘রসাটম’ একটা ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। এতে ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করার কার্যক্রম দেখানো হয়। ২৭ টন ওজনের এবং ২৬ ফুট লম্বা এই বিশাল বোমাটা রাশিয়ার উত্তরের অতিশীতল আর্কটিক সাগরের নোভায়া জেম্বলিয়া দ্বীপের উপর একটা ‘তুপোলেভ ৯৫’ বোমারু বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়। বিস্ফোরণের ‘মাশরুম ক্লাউড’ ৬৫ কিঃমিঃ উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ৫০ মেগাটন বা ৫০ হাজার কিলোটন শক্তির এই হাইড্রোজেন বোমার অফিশিয়াল নাম ‘আরডিএস ২২০’ হলেও একে এখন ‘জার বম্বা’ বলেই ডাকা হচ্ছে। বোমাটা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বোমারু বিমানের পাইলটরা কয়েক ঘন্টা পর ল্যান্ডিং করার সময় ৮’শ কিঃমিঃ দূর থেকেও এই বিস্ফোরণের ‘মাশরুম ক্লাউড’ দেখেছিলেন। বোমার প্রচণ্ডতায় কয়েক’শ কিঃমি দূরের বাড়িঘর ধ্বসে পড়েছিল অথবা জানালা ভেঙ্গে গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর যে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল, তার শক্তি ছিল ১৫ কিলোটন। ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে শক্তিশালী ‘ক্যাসল ব্রাভো’ পারমাণবিক পরীক্ষার শক্তি ছিল ১৫ মেগাটন। ‘পপুলার মেকানিকস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৯৬৩ সালে বাতাসে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করা বন্ধের পর থেকে এরকম বোমা পরীক্ষা বিশ্ব আর দেখেনি। এরপর কয়েক দশকে ছোট আকারের পারমাণবিক বোমা ডিজাইন করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়; উদ্দেশ্য ছিল বোমার সংখ্যা বাড়িয়ে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে অনেকগুলি শহরের উপর একসাথে পুংখানুপুখভাবে হামলা করা। আণবিক বিষয়ের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা গবেষক রবার্ট নরিস ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, রুশরাই বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছে যে, হাইড্রোজেন বোমা ব্যবহার করারটা কেন চিন্তাও করা উচিৎ নয়। তারা তাদের বিরাট আকারের বোমা পরীক্ষার মাধ্যমে বোমা ব্যবহারের ব্যাপারে ভীতির সঞ্চার করতে চেয়েছে। তবে নরিসের এই বক্তব্য থেকে যে প্রশ্নটা সামনে এসে যায় তা হলো, প্রায় ছয় দশক পর রাশিয়া এই বিশাল বোমা পরীক্ষার ডকুমেন্টারি কেন প্রকাশ করলো?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সরকারের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রধান ফিলিপ কোইল ‘বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ১৯৬০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক প্রযুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহু এগিয়ে ছিল। সোভিয়েতরা চাইছিল মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হিসেবে চিন্তা করুক। একারণেই তারা ‘জার বম্বা’র মতো এতো বড় বোমা পরীক্ষা করেছিল। এমনকি এই বোমা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, সোভিয়েতরাও চাইছিল না যে, পূর্ণ শক্তি নিয়ে এটা পরীক্ষা করা হোক; যেকারণে তারা বোমার ডিজাইন করার সময়েই সীসা ব্যবহার করে এর শক্তিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করেছিল। পারমাণবিক অস্ত্রের মতো ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ক্ষেত্রেও আকার নিয়ে কথা বলাটা অদ্ভূত শোনাতে পারে, যেখানে ছোট বোমাগুলিই এককেকটা শহর ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। এত বড় বোমার ব্যবহারিক দিকের চাইতে মনস্তাত্বিক দিকটাই বেশি গুরত্বপূর্ণ ছিল।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পাবলিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্সএর প্রফেসর ফ্রাঙ্ক ভন হিপেল বলছেন যে, সোভিয়েত আণবিক গবেষক আন্দ্রেই সাখারভ ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে এক গোপন চিঠিতে তিনি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের কাছে লিখেন যে, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দেবে। সাখারভের কথায় বেশ যুক্তি ছিল। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র ছোঁড়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি অকার্যকর হয়ে গেলে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়াতে সক্ষম নতুন ধরনের অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র চিন্তা করা শুরু করে যে, কোন ‘অবাধ্য’ রাষ্ট্র যদি পারমাণবিক বোমা এবং দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করে ফেলে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করবে। কারণ সেরকম ‘আবাধ্য’ রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন কৌশলগত চুক্তি ছিল, তেমন কোন চুক্তি দ্বারা আবদ্ধ থাকবে না। তবে এতে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসুরী রাশিয়ার। কারণ এতে রাশিয়ার পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলিও তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে; এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।

২০১৯এর অগাস্টে যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস’ ‘আইএনএফ’ বা মধ্যম পাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তি থেকে নিজেকে বের করে নেবার ঘোষণা দেবার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবধান করে দিয়ে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করার ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য পেলে রাশিয়াও তেমন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে বাধ্য হবে। পুতিনের কথাগুলিতে সেই পিছিয়ে পড়ার ভয়ই চলে আসে, যা কিনা সোভিয়েতদের ১৯৬০এর পারমাণবিক কর্মকান্ডে প্রকাশ পেয়েছিল।

ইউক্রেনকে নিজ নিয়ন্ত্রণ থেকে হারাবার পরই রাশিয়া নিজের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার ব্যাপারে সাবধান হতে শুরু করে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেবার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এমতাবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ই রাশিয়াকে নতুন অস্ত্র প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করছে, যার মাধ্যমে স্বল্প সামরিক বাজেটে রাশিয়া নিজের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করতে পারবে। রাশিয়া সোভিয়েত আমলের ৫০ মেগাটনের বোমা পরীক্ষার ডকুমেন্টারি প্রকাশ করলো এমন সময়ে, যখন কথা উঠছে যে, রাশিয়া এমন এক ধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করছে, যা কিনা সাবমেরিন থেকে ছোঁড়া যাবে এবং যা প্রায় ১’শ মেগাটনের পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করবে। মার্কিন বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এরকম বোমা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের কাছে সমুদ্রের নিচে বিস্ফোরণ ঘটালে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় সুনামিতে নিউ ইয়র্কসহ উপকূলের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহরই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তা মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরিভাবে বাইপাস করবে। রাশিয়াকে চাপে রাখার যুক্তরাষ্ট্রের নীতিই রাশিয়াকে দুনিয়া বিধ্বংসী অস্ত্র ডেভেলপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাশিয়ার ভৌগোলিক অখন্ডতার চ্যালেঞ্জ রাশিয়াকে প্রতিযোগিতামূলক অস্ত্র তৈরিতে আরও বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। 

Saturday 22 August 2020

ভ্যাকসিন যুদ্ধ ... ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থার উপর আরেক আঘাত

২২শে অগাস্ট ২০২০

কোন দেশ কার কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনবে, সেটা নিয়েও শুরু হয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলির মাঝে চলছে মুনাফার প্রতিযোগিতা। শীঘ্রই গরীব দেশগুলিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে শুরু হবে স্থূল প্রতিযোগিতা। বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা এবং পশ্চিমা দেশে ভ্রমণের শর্ত হিসেবে ভ্যাকসিনের উৎসকে যাচাই করা হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। সামনের মাসগুলিতে ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং মুনাফাবৃত্তির এই প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা করোনা আক্রান্ত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করবে।



করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ফাইনাল হবার আগেই কয়েকটা দেশ কোটি কোটি ডোজের ভ্যাকসিনের অর্ডার করে ফেলেছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং আরও কিছু পশ্চিমা দেশ আগেভাগেই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যাকসিনের অর্ডার করে ফেলেছে, যাতে করে এবছর শেষের আগেই তাদের হাতে একটা কার্যকর ভ্যাকসিন থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ১০ বিলিয়ন ডলার খরচে প্রায় ৭০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের অর্ডার করেছে। রাশিয়া এবং চীনও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে পশ্চিমা বিশ্বের বিকল্প নিয়ে হাজির হবার যারপরনাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন এই ‘ভ্যাকসিন যুদ্ধে’র মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই।

‘জাপান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৫৭ সালে প্রথম রুশ মহাকাশ স্যাটেলাইট ‘স্পুতনিক’ যেমন মহাকাশ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল, এখন ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাকসিন বাজারে আনার পিছনেও তেমনই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রাশিয়ার ভ্যাকসিনের নাম ‘স্পুতনিক ৫’ রাখার নামকরণের স্বার্থকতা হয়তো সেখানেই। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, ফলাও করে ভ্যাকসিনের ঘোষণা দেবার পিছনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বার্থ রয়েছে যথেষ্টই। দেশটার অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলছে, আর ভাইরাসের আগমণের পর দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী জনসমর্থনের লাগাম টানতে এই ভ্যাকসিন পুতিনকে সহায়তা করতে পারে। আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এটা রাশিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। রাশিয়ার মতো চীনও প্রথম ভ্যাকসিন বাজারে আনতে ব্যাপক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। একটা চীনা সরকারি কোম্পানি জুলাই মাসেই তার শীর্ষ কর্মকর্তাদেরকে ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক ডোজ দিয়েছে। ভ্যাকসিনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পুতিন নিজেও তার কন্যাকে ভ্যাকসিন দিয়েছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নভেম্বরের নির্বাচনের আগে আগেই ভ্যাকসিন যোগার করাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন।

রাশিয়া এবং চীনের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে পশ্চিমা গবেষকেরা সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন যে, ভ্যাকসিন যদি এখন কাজও করে, সেটা কতদিন কার্যক্ষম থাকবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সময় লাগবে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডক্টর মাইকেল হেড বলছেন যে, ভ্যাকসিন কাজ করবে কি করবে না, এই মুহুর্তে এটা নিশ্চিত করে বলাটা বেশ কঠিন। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী ইতিহাস থাকায় অনেকেই রাশিয়ার ভ্যাকসিনের দাবিকে এড়িয়ে যেতেও পারছেন না। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ডিসটিনগুইশড ফেলো ড্যানিয়েল ফ্রীড বলছেন যে, প্রথম ভ্যাকসিন যে দেশ বাজারে আনতে পারবে, সে বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট সন্মানজনক একটা অবস্থান পাবে।

শক্তিশালী দেশগুলি ভ্যাকসিনের পিছনে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ সরকার তার ৬ কোটি ৬০ লক্ষ জনগণের জন্যে মোট ৬ প্রকারের ৩৪ কোটি ডোজের ভ্যাকসিনের অর্ডার করেছে। ব্রিটিশ ভ্যাকসিন টাস্কফোর্সের প্রধান কেইট বিংহ্যাম বলছেন যে, ব্রিটেন বিভিন্ন উৎস থেকে তার ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে। ভ্যাকসিনের প্রথম দিককার পরীক্ষামূলক ফলাফলগুলির দিকে ব্রিটেন দৃষ্টি রাখবে, যাতে বোঝা যায় যে, কোন ভ্যাকসিনটা ঠিকমতো কাজ করছে। ‘জনসন এন্ড জনসন’ কোম্পানি ব্রিটেনকে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে; সফল হলে এর সাথে আরও ২ কোটি ২০ লক্ষ ডোজ যোগ হবে। এর সাথে রয়েছে ‘নোভাভ্যাক্স’ থেকে ৬ কোটি ডোজ। ইউরোপিয়ান কমিশন ঘোষণা দিয়েছে তারা ‘এসট্রা জেনেকা’ কোম্পানির কাছ থেকে ৩০ কোটি ভ্যাকসিন অর্ডার করেছে। একই কোম্পানি ব্রিটেনকে দেবে ১০ কোটি ভ্যাকসিন; আর যুক্তরাষ্ট্রকে দেবে ৩০ কোটি। জুলাই মাসে ‘বায়ো এনটেক’ এবং ‘ফাইজার’এর যৌথ উদ্যোগের কাছ থেকে ব্রিটেন ৯ কোটি ভ্যাকসিনের অর্ডার করে; একই কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১০ কোটি ডোজ বিক্রি করছে। ‘মার্কেট ওয়াচ’ বলছে, এই প্রতিটা কোম্পানিই অর্থনৈতিক ধ্বসের মাঝেও শেয়ার বাজারে ব্যাপক ভালো করছে। ‘নোভাভ্যাক্স’এর শেয়ার মূল্য মে মাস থেকে প্রায় ৭ গুণ হয়েছে! মার্চ থেকে ‘বায়ো এনটেক’এর শেয়ারমূল্য ১৩৬ শতাংশ বেড়েছে! এছাড়াও এপ্রিল থেকে ‘ফাইজার’এর মূল্য বেড়েছে ৩৯ শতাংশ; মার্চ থেকে ‘এসট্রা জেনেকা’র মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। বহুজাতিক কর্পোরেটগুলি বিলিয়ন ডলারের মুনাফা করে নিচ্ছে; কিন্তু ধনী দেশগুলির জনসংখ্যার কয়েক গুণ ভ্যাকসিন অর্ডার করার উদ্দশ্য আসলে কি?

‘ওয়েলকাম ট্রাস্ট’ হেলথ চ্যারিটির গ্লোবাল পলিসির প্রধান এলেক্স হ্যারিস বলছেন যে, এভাবে ধনী দেশগুলি ভ্যাকসিনের অর্ডার করতে থাকলে গরীব দেশগুলি নিজেদের জন্যে কোন ভ্যাকসিনই পাবে না। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, গরীব দেশগুলির জন্যে বিনিয়োগ করতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি সর্বদাই কার্পণ্য করেছে। ধনী দেশগুলির কাছে বেশি মূল্যে ভ্যাকসিন বা ঔষধ বিক্রি করতে পারে বলেই তারা কখনো গরীব দেশগুলির দিকে তাকাবার প্রয়োজন মনে করে না।

নভেম্বরের নির্বাচনকে মাথায় রেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন যে, নভেম্বরের মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ভ্যাকসিন চলে আসবে। ব্রিটেনে জনমত তৈরি করা হচ্ছে, যাতে গরীব দেশগুলিতে ব্রিটেন ভ্যাকসিন দেবার মাধ্যমে তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে। জনসংখ্যার ৫ গুণ ভ্যাকসিন কিনছে ব্রিটেন! রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন চাইছেন ‘স্পুতনিক ৫’ ভ্যাকসিনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধের ‘স্পুতনিক’ স্যাটেলাইটের মতোই রাশিয়ার হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনতে; একারণে নিজের মেয়েকেও পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন দিতে ছাড়েননি তিনি। বিশ্বব্যাপী নিজেদের ডেভেলপ করা ভ্যাকসিন বিক্রির উদ্যোগ হিসেবে ২১শে অগাস্ট চীনারা ইন্দোনেশিয়ার কাছে ৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রির চুক্তি করেছে। কোন দেশ কার কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনবে, সেটা নিয়েও শুরু হয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলির মাঝে চলছে মুনাফার প্রতিযোগিতা। শীঘ্রই গরীব দেশগুলিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে শুরু হবে স্থূল প্রতিযোগিতা। বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা এবং পশ্চিমা দেশে ভ্রমণের শর্ত হিসেবে ভ্যাকসিনের উৎসকে যাচাই করা হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। সামনের মাসগুলিতে ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং মুনাফাবৃত্তির এই প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা করোনা আক্রান্ত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করবে।

Tuesday 18 August 2020

বেলারুশ ... ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি

১৯শে অগাস্ট ২০২০ 

২৬ বছর ধরে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো। বিশ্বব্যাপী মিডিয়াতে যখন বেলারুশের রাস্তায় লুকাশেঙ্কোর বিরোধী বিশাল সমাবেশের ছবি আসছে, তখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন বেলারুশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এটা শুধু এক ব্যক্তির ভবিষ্যৎ নয়; বেলারুশ রাষ্ট্র এবং তার প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ।

৬৫ বছর বয়সী লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি রাশিয়ার সাথে রাজনৈতিক একত্রীকরণের একটা চেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও দুই দেশের মাঝে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখনও যথেষ্ট গভীর। ২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী প্রায় ৯৫ লক্ষ মানুষের দেশ বেলারুশের ৪৮ শতাংশ মানুষ ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান। একারণেই রুশ অর্থোডক্স চার্চের সাথে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। দেশটার দু’টা অফিশিয়াল ভাষার একটা বেলারুশিয়ান; আরেকটা রুশ। ‘ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল কমিটি অব দ্যা রিপাবলিক অব বেলারুশ’এর হিসেবে দেশটার ৫৩ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বেলারুশিয়ান; আর সাড়ে ৪১ শতাংশের মাতৃভাষা রুশ। তথাপি দেশটার ৭০ শতাংশ মানুষ নিজেদের বাড়িতে সাধারণতঃ রুশ ভাষাতেই কথা বলে।

২০০১ সালের নির্বাচনে লুকাশেঙ্কো প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। ২০০৬ সালের নির্বাচনে তিনি ৮৪ শতাংশ ভোটে জয়ী হন। ২০১০ সালের নির্বাচনে পান ৮০ শতাংশ ভোট। ২০১৫ সালে তিনি আবারও ৮৪ শতাংশ ভোটে জয়ী হন। এবার ২০২০ সালে তিনি পেয়েছেন ৮০ শতাংশ ভোট। প্রতিবারই লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে; প্রতিবাদও হয়েছে। তবে ২০২০ সালের প্রতিবাদ ছিল পুরোপুরি আলাদা। ‘কিয়েভ পোস্ট’ বলছে যে, ২০১০ সালের নির্বাচনের পর প্রতিবাদের অপরাধে প্রায় ৭’শ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০০৬ সালের নির্বাচনের পরেও সাড়ে ৪’শর বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল; পুলিশের সাথে প্রতিবাদকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষও হয়। তবে ২০১৫ সালের নির্বাচনে তেমন কোন প্রতিবাদই হয়নি।

প্রতিবারের নির্বাচনের পরই রাশিয়া লুকাশেঙ্কোকে অভিনন্দনের মাধ্যমে সমর্থন দিয়েছে। ইউরোপিয় সরকারগুলি লুকাশেঙ্কোর সমালোচনা করলেও তার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। আদর্শগতভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করলেও লুকাশেঙ্কো ছিল ইউরোপের কাছে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ তাকে পশ্চিমারা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একজন প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে চেয়েছে। আর অন্যদিকে নিজস্ব নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থেই রাশিয়া বেলারুশের একনায়ককে সাথে রেখেছে, যদিও তার ২৬ বছরের শাসনামলে মস্কোর সাথে সম্পর্ক সকল সময়ে মধুর ছিল না। বেলারুশের ভূরাজনৈতিক এই অবস্থানকে আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেশটাকে ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হিসেবেই মনে হবে। দেশটার গুরুত্ব শুধু একজন ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়।
   

 


তেল ও গ্যাস ... ইউরোপ এবং রাশিয়ার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা

ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি রাশিয়ার তেল গ্যাসের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকনমিক এফেয়ার্স এন্ড এনার্জির হিসেবে জার্মানি প্রতি বছর প্রায় ৯ কোটি টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে থাকে। এর মাঝে এক তৃতীয়াংশের বেশি সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে, যা কিনা প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টন। রাশিয়া বাদে নরওয়ে এবং ব্রিটেন থেকে আসে প্রায় ১ কোটি টন করে। বাকিটা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলি থেকে আসে। গবেষণা সংস্থা ‘সিইআইসি ডাটা’ বলছে যে, জার্মানি দৈনিক ১৭ লক্ষ ব্যারেলের বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে থাকে। পশ্চিম ইউরোপে জার্মানি ছাড়াও নেদারল্যান্ডস আমদানি করে সাড়ে ১১ লক্ষ ব্যারেল তেল; ফ্রান্স প্রায় ১০ লক্ষ ব্যারেল; বেলজিয়াম ৭ লক্ষ ব্যারেল। আর পূর্ব ইউরোপে পোল্যান্ড আমদানি করে প্রায় ৫ লক্ষ ব্যারেল।

আরেক বড় আমদানিকারক নেদারল্যান্ডস ২০১৯ সালে প্রায় ৪৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত তেল আমদানি করে, যা কিনা বিশ্বে আমদানিকারকদের মাঝে ষষ্ঠ বৃহত্তম। জার্মানি সপ্তম স্থানে রয়েছে প্রায় ৪১ বিলিয়ন ডলারের তেল আমদানি করে।‘স্ট্যাটিসটিকস নেদারল্যান্ডস’ বলছে যে, নেদারল্যান্ডসের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বা প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। ‘স্ট্যাটিসটা’র হিসেবে নেদারল্যান্ডস ২০১৯ সালে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারের রুশ অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। জার্মানি আমদানি করে ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের তেল; বেলারুশ এবং ইতালি আমদানি করে প্রত্যেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের তেল; পোল্যান্ড প্রায় ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার; ফিনল্যান্ড ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার; স্লোভাকিয়া ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের তেল। একই বছরে রাশিয়া মোট ১’শ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে। আর এর মাঝে শুধু ইউরোপেই অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে রাশিয়া ৫৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করে। অর্থাৎ ইউরোপই শুধু রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের উপরে নির্ভরশীল নয়, রাশিয়ারও ইউরোপের উপরে নির্ভরশীলতা রয়েছে তার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির জন্যে।

‘ওইসিডি’র এক হিসেব বলছে যে, ১৯৬০এর দশক থেকে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ২০ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গ্যাসের মূল ব্যবহার শীতকালে বাড়িঘর উষ্ণ রাখার জন্যে। অন্য কথায় এই চাহিদাটা ইউরোপের সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানিতে গ্যাসের ব্যাবহার প্রায় ৮৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার বা বিসিএম। এর মাঝে প্রায় ৬০ বিসিএমই আসে রাশিয়া থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানিকারক ইতালির প্রায় ৭০ বিসিএম আমদানির মাঝে ২৫ বিসিএম আসে রাশিয়া থেকে। তুরস্ক তার প্রায় ৫০ বিসিএম চাহিদার মাঝে ২৫ বিসিএম পায় রাশিয়া থেকে। পোল্যান্ড তার প্রায় ২০ বিসিএম চাহিদার মাঝে ১০ বিসিএম রাশিয়া থেকে আমদানি করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হিসেবে রাশিয়া ইইউএর প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহকারী।

রাশিয়ার তেল গ্যাসের উপর ইউরোপের নির্ভরশীলতাকে যুক্তরাষ্ট্র মোটেই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ প্রকল্প নিয়ে জার্মানির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব সেটাই দেখিয়ে দেয়। ইউক্রেনের যুদ্ধের সময় পাইপলাইনের মাধ্যমে রুশ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবার পর ইউরোপই সবচাইতে বেশি চিন্তায় পড়েছিল। বেলারুশও ঠিক একই কারণে রাশিয়া এবং ইউরোপের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বেলারুশের রাজনৈতিক অবস্থান যেন ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে সমস্যা তৈরি করতে না পারে, সেকারণে বেলারুশকে বাইপাস করা গ্যাস পাইপলাইনগুলি রাশিয়া এবং ইউরোপের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

পাইপলাইন এবং বাইপাস পাইপলাইনের ভূরাজনীতি

ভূরাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার উপর তেল গ্যাসের জন্যে নির্ভরশীলতা ইউরোপে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। পোল্যান্ড রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে ‘বল্টিক পাইপ’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মাধ্যমে নরওয়ে থেকে পাইপলাইন ডেনমার্ক হয়ে পোল্যান্ডে আসবে। এর সক্ষমতা প্রায় ১০ বিসিএম। ২০২২ সালে পোল্যান্ডের সাথে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। তখন ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এই পাইপলাইন রাশিয়ার উপর পোল্যান্ডের নির্ভরশীলতা একেবারেই কমিয়ে ফেলবে। পোল্যান্ড রাশিয়ার সীমান্তে থাকায় ন্যাটোর সদস্য হিসেবে রাজনৈতিকভাবে পোল্যান্ডের অবস্থান বেশ সংবেদনশীল। রুশ হুমকি মোকাবিলা করতেই রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে পোল্যান্ড। অপরদিকে জার্মানি রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বৃদ্ধি করতে চাইছে। বর্তমানে জার্মানি যে কয়টা গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করে, তার মাঝে ২০০৭ সালে তৈরি করা ‘নর্ড স্ট্রিম’ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এর সক্ষমতা প্রায় ৫৫ বিসিএম। এই পাইপলাইনের সমান্তরালে একই সক্ষমতার আরেকটা ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন তৈরির প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জার্মানি এবং রাশিয়ার টানাপোড়েন চলছে। পাশাপাশি দেশ পোল্যান্ড এবং জার্মানি রাশিয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। পোল্যান্ড যেখানে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসতে চাইছে, সেখানে জার্মানি তার নির্ভরশীলতাকে দ্বিগুণ করতে চাইছে। এই ইস্যুতেই জার্মানির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে; আর অপরদিকে পোল্যান্ডের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন হচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক প্রতিবেদনে বেলারুশের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বেলারুশ এমন একটা দেশ, যা নিজে তেল গ্যাস উৎপাদন না করলেও এর রপ্তানি পণ্যের একটা বড় অংশই তেল গ্যাস। স্থলবেষ্টিত এই দেশটা ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে সেতুর মতো। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েতরা বেলারুশে দু’টা তেল রিফাইনারি তৈরি করেছিল। ১৯৫৮ সালে তৈরি করা নাফতান রিফাইনারির বাৎসরিক সক্ষমতা ১ কোটি ২০ লক্ষ টন। আর মজির রিফাইনারির সক্ষমতা ৮০ লক্ষ টন। এই রিফাইনারিগুলিতে দ্রুজবা পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আসে সাইবেরিয়ার তেলখনিগুলি থেকে; আর সেখান থেকে রিফাইন করা বিভিন্ন জ্বালানি পাইপলাইনের মাধ্যমে যায় ইউরোপের বাজারে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার তেল যায় জার্মানি, পোল্যান্ড, বেলারুশে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বেলারুশ প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ টন অপরিশোধিত তেল পায় রাশিয়া থেকে; আর একই পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে ইউরোপ যাচ্ছে ৪ কোটি টন তেল।

তেল ছাড়াও বেলারুশ পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে ২০ বিসিএম গ্যাস আমদানি করে; আর একইসাথে প্রায় ৩৯ বিসিএম গ্যাস বেলারুশ হয়ে ইউরোপ যায়। রাশিয়া থেকে ভূমির উপর দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে যতো গ্যাস যায়, তার পুরোটাই যায় বেলারুশ এবং ইউক্রেনের উপর দিয়ে। এর বাইরে গ্যাস যাচ্ছে কৃষ্ণ সাগর এবং বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে।

ঠান্ডা যুদ্ধের পর বেলারুশ স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর থেকেই দেশটার অর্থনীতি তেল গ্যাস বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল। বেলারুশ পাইপলাইনের ব্যবসা করা ছাড়াও স্বল্প মূল্যে রাশিয়া থেকে গ্যাসের সরবরাহ পায়। তেল গ্যাসের মূল্য নিয়ে রাশিয়ার সাথে বেলারুশের দ্বন্দ্ব হয়েছে বহুবার। দ্বন্দ্বের জের হিসেবে রাশিয়া ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেলারুশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপের জনগণকে গ্যাসের অভাবে প্রচন্ড ঠান্ডায় শীত পোহাতে হয়েছিল। প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বেলারুশ ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবয়াহ বন্ধ করে দিয়েছে কয়েকবার। আর ২০০৭ সাল থেকে বেলারুশ নতুন কৌশল হিসেবে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাঠানো গ্যাস থেকে নিজেদের জন্যে গ্যাস সরিয়ে রাখার হুমকি দিতে থাকে। আর তেলের বাজারে মূল্যপতনের পর থেকে বেলারুশের পাইপলাইনের আয়ও কমতে থাকে। ২০১৬ সালে রাশিয়া বেলারুশের কাছে বিক্রি করা তেলের মূল্য বৃদ্ধি করতে চাইলে বেলারুশ রাজি হয়নি। কিন্তু রাশিয়া তার দাবি আদায়ে ২০১৭ সালের শুরুতে বেলারুশে তেলের সরবরাহ ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে বেলারুশ বেশি মূল্য দিয়ে ইউক্রেন এবং পোল্যান্ডের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। ২০১৯এর অগাস্টে বেলারুশ নিজ দেশের উপর দিয়ে যাওয়া রুশ পাইপলাইনের ট্রানজিট ফি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেয়। আর ২০২০এর জানুয়ারিতে বেলারুশ পাইপলাইনের ট্রানজিটের উপর আরও ৬ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করে।

ইউক্রেনের সাথেও রাশিয়ার পাইপলাইনের বিরোধ বহুদিনের। থেকে থেকে চলা এই দ্বন্দ্ব সবচাইতে মারাত্মক আকার ধারণ করে ২০১৪ সালে, যখন ইউক্রেনে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে। সেবছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে গণুভ্যুত্থানে রুশ সমর্থিত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সরকারের পতনের পরপরই রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। এর জের হিসেবে পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। জুন মাসে ইউক্রেনের মাঝ দিয়ে যাওয়া পাইপলাইনগুলিতেও রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যস্ততায় গ্যাস সরবরাহ আবারও শুরু হলেও এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি একেবারেই কমে যায়। রাজনৈতিক সমস্যা এড়াতেই ইউক্রেন এবং বেলারুশকে বাইপাস করে বল্টিক সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে যথাক্রমে ‘নর্ড স্ট্রিম’ এবং ‘তুর্ক স্ট্রিম’ পাইপলাইন তৈরি করা হয়। বেলারুশও আগে যেভাবে ইউরোপে রাশিয়ার তেল গ্যাস রপ্তানি করার পাইপলাইন বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়ে আলোচনার টেবিলে রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখতো, এই বাইপাস পাইপলাইনগুলির কারণে বেলারুশের সেই ক্ষমতা অনেকাংশেই কমে গিয়েছে।


রুশ সস্তা গ্যাসের কবল থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না বেলারুশ

বেলারুশের অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে গ্যাস নির্ভর। দেশটার ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় গ্যাস থেকে। শীতকালে বাড়ি উষ্ণ রাখার জন্যেও গ্যাসই ব্যবহার করা হয়। বেলারুশ নিজ দেশে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনার চেষ্টা করেও সফলতা পায়নি।‘ওয়ার্ল্ড ও মিটারস’এর হিসেবে বেলারুশে মাথাপিছু গ্যাস ব্যবহার প্রায় ১’শ ৮১ কিউবিক ফিট। অপরদিকে ব্রিটেনে মাথাপিছু গ্যাস ব্যবহার প্রায় ১’শ ১৫ কিউবিক ফিট; জার্মানিতে প্রায় ১’শ ৯ কিউবিক ফিট। ফ্রান্সে এটা মাত্র ৬২ কিউবিক ফিট; পোল্যান্ডে মাত্র ৫১ কিউবিক ফিট। সবচাইতে বেশি নেদারল্যান্ডসে ২’শ ৪৭ কিউবিক ফিট; বেলজিয়ামে ১’শ ৪৯ কিউবিক ফিট।

প্রতি হাজার কিউবিক মিটারে বেলারুশ রাশিয়াকে যা দিচ্ছে, তা বাকি দুনিয়ার চাইতে অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, ‘রয়টার্স’ বলছে যে, রাশিয়া ২০১৬ সালে কিরগিজস্তানে রপ্তানি করা গ্যাসের মূল্য প্রতি হাজার কিউবিক মিটারে ১’শ ৬৫ ডলার থেকে কমিয়ে ১’শ ৫০ ডলারে নামিয়ে নিয়ে আসে। রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’কে রুশ কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’এর ডিরেক্টর জেনারেল এলেনা বুরমিসত্রোভা বলেন যে, ২০১৯ সালে ইউরোপে রপ্তানির জন্যে রাশিয়ার গ্যাসের মূল্য ২’শ ৩০ ডলার থেকে ২’শ ৫০ ডলারের মাঝে ছিল। ২০১৮ সালে এই মূল্য প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ২’শ ৪৫ ডলার হয়। অপরদিকে ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, ২০১৯ সালে বেলারুশ রাশিয়াকে গ্যাসের জন্যে ১’শ ২৭ ডলার দিয়েছে, যা কিনা পুরো ইউরেশিয়ার মাঝে সর্বনিম্ন। তদুপরি এবছরের এপ্রিলে রুশ কোম্পানি ‘নেফতেগ্যাজ’ বলে যে, বেলারুশের জ্বালানি মন্ত্রী ভিক্টর কারানকেভিচ বিশ্ব বাজারের সাথে সমন্বয় করে রুশ গ্যাসের মূল্য কমাতে অনুরোধ করেছেন।

রুশ অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ থেকেই তাদের সোভিয়েত আমলের দু’টা রিফাইনারি দিয়ে বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য তৈরি করে তা ইউরোপে বিক্রি করে নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখছে বেলারুশ। আবার রাশিয়া থেকে তেল গ্যাসের পাইপলাইন ইউরোপ পর্যন্ত যাবার পথে তা বেলারুশের উপর দিয়ে যাবার কারণে বেলারুশ সেই পাইপলাইনের উপর ট্রানজিট ফি পায়। রুশ তেল গ্যাসের উপর বেলারুশের নির্ভরশীলতা শুধু অর্থনৈতিক কারণেই নয়; রাজনৈতিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া বেলারুশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বদাই অর্থনৈতিক চাপকে ব্যবহার করেছে। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের বিরোধের মাঝেই বেলারুশের সাথেও বিরোধ চলছিল। রাশিয়া বহুবার বেলারুশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে; কিন্তু ইউক্রেন যেভাবে ফুঁসে উঠেছে রুশ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে, বেলারুশ তা কখনোই করেনি। তাই বেলারুশকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে রাশিয়াকে অপেক্ষাকৃত কম বেগ পেতে হয়েছে। 


রাশিয়া এবং বেলারুশের ভৌগোলিক বাস্তবতা

ইউক্রেন এবং বেলারুশকে বাইপাস করে বিকল্প পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে রুশ তেল গ্যাস রপ্তানির ব্যবস্থা করা হলেও বেলারুশ এবং ইউক্রেনের গুরুত্ব কমে যায়নি। ভৌগোলিক কারণেই এই দুই দেশ রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ; সেখানে তেল গ্যাসের ইস্যু থাকুক আর না থাকুক। রাশিয়া এই দুই দেশকে নিজের এবং ইউরোপের মাঝে বাফার রাষ্ট্র হিসেবে দেখে। এই দেশগুলিতে ইউরোপিয় প্রভাব মানেই রাশিয়ার কাছে তা ভূরাজনৈতিক হুমকি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরপরই ইউক্রেনের সাথে ন্যাটো সম্পর্কোন্নয়ন করে। তবে ২০১০ সালে ইউক্রেনে রুশ সমর্থিত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেবার সম্ভাবনা উড়ে যায়। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে গণভ্যুত্থান এবং তার পরবর্তীতে সেখানে পশ্চিমা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র হবার জন্যে জোর প্রচেষ্টা শুরু করে। সেবছরই রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেবার পর থেকে ইউক্রেনের জনগণের মাঝে ন্যাটোর সদস্যপদ নেয়ার পক্ষে যুক্তি তৈরি হয়েছে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১২ সালে যেখানে মাত্র ২৮ শতাংশ ইউক্রেনিয়ান ন্যাটোর সদস্যপদের পক্ষে ছিল, ২০১৭ সালের জুনে তা বেড়ে গিয়ে ৬৯ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ইউক্রেন সরকারের যুদ্ধ শুরু হলে ন্যাটো ইউক্রেনের পক্ষ নেয়। রাশিয়া সরাসরিই জানিয়ে দেয় যে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়াটা রাশিয়ার জন্যে গ্রহণযোগ্য নয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে রাশিয়া তার ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ইউক্রেনের দিকেও তাক করবে।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান‘ বিজনেস ইনসাইডার’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে রাশিয়ার ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জের ব্যাখ্যা দেন। গত কয়েক শতাব্দী ধরেই রাশিয়া তার নিরাপত্তার জন্যে বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া এবং বেলারুস ও ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল। এই বাফার রাষ্ট্রগুলি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণেই ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে রাশিয়া। এই বাফার অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধ হতে হতেই আক্রমণকারীরা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই এই রাষ্ট্রগুলির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে রাশিয়া। বল্টিক রাষ্ট্রগুলি এবং ইউক্রেন ইতোমধ্যে পশ্চিমাদের নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে চলে গিয়েছে।বেলারুশের অবস্থানের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছেন যে, সোভিয়েত সময়ে রুশ শহর স্মোলেনস্ক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক অভ্যন্তরের একটা শহর। কিন্তু বর্তমানে তা হয়ে গিয়েছে বেলারুশের সাথে রাশিয়ার একটা সীমান্ত শহর।

বেলারুশের সীমান্ত থেকে মস্কোর দূরত্ব মাত্র সাড়ে ৪’শ কিঃমিঃ। আর ইউক্রেনের সীমানা থেকে মস্কোর দূরত্ব মাত্র ৫’শ ৩৩ কিঃমিঃ। অথচ বেলারুশ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তখন পোল্যান্ডের সীমানা থেকে মস্কোর দূরত্ব ছিল ১ হাজার কিঃমিঃ। আবার সোভিয়েত আমলে যখন পোল্যান্ড সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন পূর্ব জার্মানির সীমানা থেকে মস্কোর দূরত্ব ছিল ২ হাজার কিঃমিঃ। এর অর্থ হলো, সোভিয়েত আমলে যেখানে পশ্চিম ইউরোপের প্রভাবে থাকা অঞ্চল মস্কো থেকে ২ হাজার কিঃমিঃ দূরে ছিল, এখন পূর্ব জার্মানি এবং পোল্যান্ডের পর ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ পশ্চিম ইউরোপের কাছে চলে যাওয়ায় তা মাত্র ৪’শ থেকে ৫’শ কিঃমিঃ দূরে। এটা রাশিয়ার জন্যে বিরাট একটা ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবিলা করতে রাশিয়া এখন অনেক কিছুই করবে। বিশেষ করে ইউক্রেন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় রাশিয়া এখন বেলারুশ নিয়ে চিন্তিত।

বেলারুশ রাশিয়ারই থাকবে

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ইউরেশিয়া গ্রুপের প্রধান ইয়ান ব্রেমার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বেলারুশ হলো সেই দেশ যা কিনা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবার জন্যে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না। জাতিগত, ভাষাগত বা সংস্কৃতিগতভাবে বেলারুশের সাথে রাশিয়ার পার্থক্য খুব কম। তাই রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতাকে বেলারুশের জনগণ খুব বেশি সমস্যা বলে মনে করেনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা রাস্তায় নামেনি; বরং বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর কুশাসনের কারণেই বেলারুশিয়ানরা রাস্তায় নেমেছে। একারণেই মস্কো খুব সম্ভবতঃ লুকাশেঙ্কোর পক্ষে শক্তি খরচ না-ও করতে পারে। ব্রেমার আর্মেনিয়ার উদাহরণ টেনে বলেন যে, আর্মেনিয়াতেও সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাশিয়া কোন হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেনি। কারণ আর্মেনিয়ার জনগণ রাশিয়াকে বরাবরই আর্মেনিয়ার বন্ধু মনে করে।

পাইপলাইনকে কেন্দ্র করে বেলারুশের সাথে রাশিয়ার বিভিন্ন সময়ের বিরোধ ইউরোপকে আরও নিরাপদ তেল গ্যাসের উৎস খুঁজতে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে রাশিয়া চায়নি সেই সরবরাহ নেটওয়ার্ক থেকে বাদ পড়ে যেতে; কারণ রাশিয়ার অর্থনীতি ইউরোপের দেশগুলিতে তেল গ্যাস রপ্তানির উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। তাই রাশিয়াও উদ্যোগী হয়েছে ইউক্রেন এবং বেলারুশকে বাইপাস করে ইউরোপে তেল গ্যাস সরবরাহ করতে; ইউরোপও এতে সহায়তা দিয়েছে। ইউরোপ এবং রাশিয়ার এহেন পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বিপক্ষে গিয়েছে বলেই যুক্তরাষ্ট্র বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইনের বিরোধিতা করছে। ইউরোপে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়।

তেল গ্যাসের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতির কারণেই বেলারুশ রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিকভাবে আবদ্ধ থাকবে; রাশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে তেল গ্যাস রপ্তানির পাইপলাইনের কারণে নয়। বেলারুশের ভবিষ্যৎ কোন সরকার দেশটার অর্থনীতিকে রাশিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। কারণ বেলারুশের জনগণের মাঝে রাশিয়া বিরোধী ভাবধারা গত তিন দশকে তৈরি হয়নি; আর খুব তাড়াতাড়িই এটা পরিবর্তিত নাও হতে পারে। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বেলারুশের সাথে রাশিয়ার দূরত্ব বৃদ্ধি করতে। আপাততঃ বেলারুশে একটা পশ্চিমা ধাঁচের সরকার থাকাটা ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা আদর্শিক জয়।

Sunday 16 August 2020

ইস্রাইলের সাথে আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের গুরুত্ব কতটুকু?

১৬ই অগাস্ট ২০২০ 


সকলেই আমিরাত এবং ইস্রাইলের চুক্তির ইস্যুটাকে ব্যবহার করবে; শুধু ফিলিস্তিনের জনগণ ছাড়া। আবারও প্রমাণিত হলো যে, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ফিলিস্তিনের জনগণের ব্যাপারে কতটা উদাসীন। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দকে জনগণের সামনে হেয় করবে এবং মুসলিমদেরকে যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজতে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলবে।




১৩ই অগাস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, ইস্রাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ইস্রাইল পশ্চিম তীরে নতুন করে ফিলিস্তিনি এলাকা দখল করার পরিকল্পনা আপাততঃ স্থগিত রাখবে। হোয়াইট হাউজের বরাত দিয়ে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, তিন দেশের প্রতিনিধিদের দীর্ঘ আলোচনার পরই এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে। ইস্রাইল এবং আমিরাতের একটা যৌথ বিবৃতি টুইটারে দেয়ার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটাকে একটা ‘বিরাট অর্জন’ বলে আখ্যা দেন। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয় যে, সামনের দিনগুলিতে দুই দেশের প্রতিনিধিরা বিনিয়োগ, পর্যটন, সরাসরি ফ্লাইট, নিরাপত্তা, টেলিকমিউনিকেশন্স, এবং অন্যান্য ইস্যু নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করবে। হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন যে, তিনি আশা করছেন যে, অত্র অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলিও আমিরাতের পথ অনুসরণ করবে। এই চুক্তির ফলে আমিরাত তৃতীয় মুসলিম দেশ হিসেবে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলো। এর আগে ১৯৭৭ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্দান সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল।

ফিলিস্তিন, ইরান, তুরস্ক চুক্তির বিপক্ষে

ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলি এই চুক্তির সরাসরি বিপক্ষে কথা বলেছে। হামাস বলেছে যে এই চুক্তি পিছন থেকে বিশাসঘাতকের ছুরিকাঘাতের মতো। ফাতাহ গ্রুপ বলছে যে, আমিরাত ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের জাতীয়, ধর্মীয় এবং মানবিক দ্বায়িত্বকে অস্বীকার করেছে। এক টুইটার বার্তায় প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য হানান আশরাউই বলেন যে, আমিরাত ইস্রাইলের সাথে তাদের গোপন বোঝাপরাকে এখন সামনে নিয়ে আসলো। ফিলিস্তিনের গ্রুপগুলির সাথে সরাসরি একাত্মতা জানিয়েছে তুরস্ক এবং ইরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই চুক্তিকে মুসলিম বিশ্বের জন্যে পিছন থেকে ছুরিকাঘাতের শামিল বলে বলা হয়। একইসাথে এটাকে ‘কৌশলগত নির্বুদ্ধিতা’ বলেও আখ্যা দেয়া হয়। লেবাননের টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাতে ইরান সমর্থিত হিযবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ প্রায় একই ধরনের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন যে, আরও কিছু আরব দেশ সম্ভবতঃ আমিরাতকে অনুসরণ করবে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকার কথা বলা হয়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, আমিরাতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে তুরস্ক।

আরব দেশগুলি চুক্তির পক্ষে 
 
১৪ই অগাস্ট বাহরাইনের সরকারি বার্তা সংস্থা ‘বিএনএ’ বলছে যে, আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদকে ফোন করে অভিনন্দন জানান বাহরাইনের বাদশাহ হামাদ বিন ঈসা আল খলিফা। চুক্তিটাকে ‘ঐতিহাসিক সফলতা’ আখ্যা দিয়ে বাদশাহ বলেন যে, এর ফলে আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট সুবিধা পাওয়া যাবে। এক টুইটার বার্তায় মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল সিসি চুক্তিকে স্বাগত জানান এবং বলেন যে, তিনি ব্যাপারটাকে আগ্রহের সাথে দেখছেন। ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটার সরকারি বার্তা সংস্থা ‘ওমান নিউজ এজেন্সি’ বলে যে, আমিরাত এবং ইস্রাইলের এই ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তিকে ওমান স্বাগত জানাচ্ছে। ইস্রাইলের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ইস্রাইলের সংবাদ সংস্থা ‘কেএএন’ বলছে যে, আমিরাতের পর বাহরাইনও সম্ভবতঃ ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে দুই দেশ এখনও অফিশিয়ালি কোন বিবৃতি দেয়নি। ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মিশর, ওমান এবং বাহরাইনকে সমর্থন দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এখন পর্যন্ত এই চুক্তির ব্যাপারে সৌদি আরব কোন কিছু বলা থেকে বিরত থেকেছে। তুর্কি মিডিয়া ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, আরব লীগও কোন বিবৃতি দেয়নি। কুয়েত এবং কাতার থেকেও এখনো কোন বিবৃতি পাওয়া যায়নি। 

এশিয়ার মুসলিম দেশগুলি সরাসরি কথা বলছে না

একই দিনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় বলা হয় যে, আমিরাত এবং ইস্রাইলের চুক্তিকে পাকিস্তান সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে বলে এতে বলা হয়। একইসাথে বলা হয় যে, ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার আদায়ে পাকিস্তানের দায়বদ্ধতা রয়েছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এবং স্থিতিশীলতাও পাকিস্তানের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে চুক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি কোন বক্তব্য এই বিবৃতিতে ছিল না।

‘দ্যা স্ট্রেইটস টাইমস’ বলছে যে, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি থেকে এখন পর্যন্ত চুক্তির ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। ১৪ই অগাস্ট ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তেউকু ফাইজাসিয়া বলেন যে, এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তাদের কোন বক্তব্য নেই। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ফাদিরোয়েল রাচমানও কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহামদ ‘দিস উইক ইন এশিয়া’র সাথে সাক্ষাতে আশংকা প্রকাশ করে বলেন যে, এর ফলে মুসলিম বিশ্বের মাঝে বিভাজনের সৃষ্টি হবে এবং ইস্রাইলিরা এতে জ্বালানি ঢালবে। ১৫ই অগাস্ট মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিশামুদ্দিন হুসেইন এক বিবৃতিতে বলেন যে, এই চুক্তি আমিরাতের সার্বভৌম অধিকারের ব্যাপার। তবে তিনি ফিলিস্তিনের আলাদা দেশের অধিকার আদায়ের পক্ষে মালয়েশিয়ার সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে বলেন।

অমুসলিম দেশগুলি খুশি

এক টুইটার বার্তায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন যে, এই চুক্তি অনেক বড় একটা সুখবর। তিনি বলেন যে, পশ্চিম তীরে আরও ভূমি দখলের ইস্রাইলি পরিকল্পনা এগিয়ে না নেয়ার কারণে তিনি আশা দেখছেন, কারণ এতে আরও শান্তিপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য দেখা যাবে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ ইভস লে ড্রিয়ান বলেন যে, চুক্তিকে ফ্রান্স স্বাগত জানিয়েছে এবং আরও বলেন যে, পশ্চিম তীরে ইস্রাইলের নতুন করে বসতি স্থাপন বন্ধ করাটা একটা ভালো কাজ হয়েছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের মুখপাত্র নাবিলা মাসরালি বার্তা সংস্থা ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলেন যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই চুক্তিকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং তারা মনে করছে যে, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ উভয় পক্ষের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত করবে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মাঝে উত্তেজনা প্রশমনে পদক্ষেপ নেয়ায় চীন খুশি হয়েছে, যা কিনা অত্র অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করবে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রিভাস্তাভা বলেন যে, ভারত এই চুক্তিকে স্বাগত জানায়। তিনি আরও বলেন যে, ভারত পশ্চিম এশিয়াতে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন দেখতে চায়; কারণ ভারত এই অঞ্চলকে তার নিজের প্রতিবেশী বলেই মনে করে।


১২ই অগাস্ট। হোয়াইট হাউজে বিজয়ীর বেশে ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র আবারও প্রমাণ করলো যে, মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান আগের মতো শক্তিশালী না হলেও অত্র অঞ্চলের নেতৃত্বের উপর তার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ট্রাম্প নির্বাচনের আগে আগেই একটা বড় জয় পেলেন, যা কিনা তার নির্বাচনে ভালো ফলাফলের পিছনে অনুপ্রেরণা দেবে।


কে কি চাইছে?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর ভিজিটিং ফেলো জেফরি ফেল্টম্যান বলছেন যে, আমিরাতের সাথে চুক্তির ফলে ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে এখন আপাততঃ পশ্চিম তীরের বসতির প্রকল্প নিয়ে এগুতে হবে না। মার্কিন নির্বাচনের আগে এধরনের প্রকল্প নিলে যদি জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে চলে আসেন, তাহলে নেতানিয়াহু বিপদে পড়ে যেতে পারতেন। ব্রুকিংসএর সিনিয়র ফেলো তামারা কফম্যান উইটস এর সাথে যুক্ত করে বলছেন যে, আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদও মার্কিন নির্বাচনকে মাথায় রেখেই হিসেব কষেছেন। ডেমোক্র্যাটরা যেহেতু সৌদিদের সমর্থক নয়, সেহেতু আমিরাতের অবস্থানকে তিনি সৌদিদের থেকে কিছুটা আলাদা করেই রাখতে চাচ্ছেন, যাতে করে হোয়াইট হাউজে ডেমোক্র্যাটরা চলে আসলে তিনি বিপদে পড়ে না যান। ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’ বলছে যে, এই চুক্তি থেকে দু’টা ব্যাপার সামনে আসবে। প্রথমতঃ নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনের আগে আগে এটা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে বিধায় ট্রাম্পের মধ্যস্ততায় এরকম একটা চুক্তি প্রশাসনের জন্যে বড় সাফল্য। আর দ্বিতীয়তঃ এটা প্রমাণ হলো যে, ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়াটা এখন থেকে আরব দেশের সরকারগুলির জন্যে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে থাকবে না। 

ব্রিটেনের ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা বলছে যে, আমিরাত এবং ইস্রাইলের চুক্তির পিছনে মূল কারণ হলো ইরান। ইস্রাইলের প্রাক্তন কূটনীতিবিদদের বরাত দিয়ে পত্রিকাটা বলছে যে, ইরানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী ফ্রন্ট গঠন করার লক্ষ্যেই এই চুক্তি করা হয়েছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা একই সুরে বলছে যে, মূলতঃ ইস্রাইল এবং আমিরাত অভিন্ন শত্রুর কারণে নিজেদের মাঝে শান্তি করেছে। ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, এই মুহুর্তে আরব দেশগুলির নেতৃত্বের কাছে অনেকগুলি ইস্যু রয়েছে যেগুলি ফিলিস্তিনের ইস্যুর চাইতে তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ; উদাহরণস্বরূপ তিনি ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া, ইত্যাদি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। মাত্র এক দশক আগেও যখন এই সমস্যাগুলি আরব নেতৃত্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের প্রশ্নই ওঠেনি। অভিন্ন শত্রু ইরান এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে; ফিলিস্তিনের শান্তিচুক্তি নয়। এটা এখন প্রমাণ হলো যে, কোনকিছু ছেড়ে না দিয়েই ইস্রাইল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থানকে সংহত করেছে। আর এটা অর্জন করতে ইস্রাইলিদের জন্যে ফিলিস্তিনিদের সাথে কথাও বলতে হয়নি। ফিলিস্তিনিদের জন্যে এটা যতটাই দুঃখজনক হোক না কেন, তা-ই ঘটেছে। প্যালেস্টিনিয়ান সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসএর হিসেবে ২০২০ সালের শুরুতে ফিলিস্তিনি যুবাদের মাঝে ৪২ শতাংশ মানুষ বেকার; অনেকেই অনাহারে অর্ধাহারে রয়েছে। আর এর থেকে পরিত্রাণ পাবার কোন সম্ভাবনাই তাদের নেই।

তবে চুক্তির পিছনে ইরানকে একমাত্র কারণ হিসেবে ভাবলে আমিরাতের সাথে ইরানের সাম্প্রতিক সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টাগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। গত বছরের অক্টোবরে ইরানের সাংসদ আকবর তোরকি বলেন যে, আমিরাত বাজেয়াপ্ত করা ৭’শ মিলিয়ন ডলারের ইরানি সম্পদ ইরানকে ফেরত দিয়েছে। দুই দেশের মাঝে আর্থিক লেনদেনও শুরু হয়েছে। গত জুন মাসে ‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ইরানের নেতৃত্বের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া রহিম সাফাভি বলেন যে, দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে এবং ইরান রাজি রয়েছে সৌদিদের সাথে আলোচনায় বসতে। তিনি মূলতঃ ইয়েমেনের যুদ্ধের জন্যে সৌদিদের দায়ী করেন; তবে আমিরাতের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন। ২০১৯ থেকে লিবিয়া ইস্যু নিয়ে তুরস্কের সাথে ব্যাপক দ্বন্দ্ব এবং একই বছরের মাঝে ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার পর থেকে আমিরাতের কাছে তার মূল হুমকি ইরান নয়; বরং তুরস্ক। আমিরাত বেশ কিছুদিন ধরেই সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে যাচ্ছে; আর এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ইরান। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গত ডিসেম্বরেই সিরিয়াতে আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আসাদকে ‘জ্ঞানী নেতৃত্ব’ হিসেবে উল্লেখ করে খবরে চলে আসেন। লিবিয়াতে তুরস্কের সরাসরি হস্তক্ষেপের পর থেকেই পালটা ব্যবস্থা হিসেবে সিরিয়াতে আমিরাত তার অবস্থানকে দৃঢ় করতে এগিয়েছে। আর সিরিয়াতে ইরানের শক্তিশালী অবস্থানের কারণেই ইরানের সাথেও আমিরাতের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে।

অপরদিকে ‘এরাব নিউজ’ মনে করিয়ে দিয়ে বলছে যে, চুক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার তুরস্ক নিজেই ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক অটুট রেখেছে। অধিকৃত গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইস্রাইলের আগ্রাসী ততপরতা নিয়ে তুরস্ক বেশ সরব থাকলেও তারা ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। ১৯৪৯ সালে ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে ২০১০ সালে গাজা অবরোধের সময় দুই দেশের মাঝে ব্যাপক দ্বন্দ্বও এই সম্পর্ককে পুরোপুরি স্তব্ধ করতে পারেনি। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষোণার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ খারাপ হয়েছে; রাষ্ট্রদূত ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রদূত না থাকলেও চার্জ ডে এফেয়ার্সএর মাধ্যমে এই সম্পর্ক চালু রয়েছে। তুর্কি চিন্তাবিদ গুভেন সাক তুর্কি মিডিয়া ‘হুরিয়েত ডেইলি নিউজ’এর এক লেখায় বলছেন যে, ইস্রাইলিরা তুরস্ককে খুব ভালো একটা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দেখে। বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষ ইস্রাইলি প্রতি বছর তুরস্ক সফর করে। ২০০৮ সালে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ছিল ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা বেড়ে এখন প্রায় ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, আমিরাতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে তুরস্ক। অধিকৃত গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইস্রাইলের আগ্রাসী ততপরতা নিয়ে তুরস্ক বেশ সরব থাকলেও তারা ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। ১৯৪৯ সালে ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে ২০১০ সালে গাজা অবরোধের সময় দুই দেশের মাঝে ব্যাপক দ্বন্দ্বও এই সম্পর্ককে পুরোপুরি স্তব্ধ করতে পারেনি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে কথা বলে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের জনগণের আবেগকে জয় করতে এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইবে।

কে কি পাচ্ছে?

যুক্তরাষ্ট্র আবারও প্রমাণ করলো যে, মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান আগের মতো শক্তিশালী না হলেও অত্র অঞ্চলের নেতৃত্বের উপর তার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ট্রাম্প নির্বাচনের আগে আগেই একটা বড় জয় পেলেন, যা কিনা তার নির্বাচনে ভালো ফলাফলের পিছনে অনুপ্রেরণা দেবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইস্রাইলের অবস্থান আরও শক্ত হলো; কারণ তার শত্রুর সংখ্যা কমলো। ইস্রাইল এতে আরও বেশি আগ্রাসী হবার সুযোগ পাবে। আমিরাত এখন তার শত্রু তুরস্ককে মোকাবিলা করতে ইস্রাইলকে পাশে পাবে। কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও ২০১৮ সাল থেকে ইস্রাইলের সাথে তুরস্কের রাজনৈতিক সম্পর্ক খুব একটা হৃদ্যতাপূর্ণ যাচ্ছে না। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল গ্যাস নিয়ে গ্রীস এবং মিশরের সাথে তুরস্কের দ্বন্দ্বে ইস্রাইল তুরস্কের বিপক্ষেই থাকছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিয়মিত কথা বলায় আঙ্কারার নেতৃত্ব তেল আভিভের বিরক্তির কারণ হয়েছে। আরবের অন্যান্য দেশগুলির এখন ইস্রাইলের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আর বাধা থাকছে না। সকলেই ইস্রাইলের সাথে গোপনে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে; এখন শুধু তা অফিশিয়ালি স্বীকার করার পালা। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলি অর্থনৈতিক কারণে আমিরাত বা সৌদিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না; তাই তারা আমিরাত ও ইস্রাইলের সম্পর্কের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকারই চেষ্টা করবে, যদিও তা তাদের জনগণের কাছে অপছন্দনীয় হবে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন এবং ভারতসহ অমুসলিম দেশগুলি এই চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত হবে বলে মনে করছে; তাই তারা খুশি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে কথা বলে তুরস্ক এবং ইরান মুসলিম বিশ্বের জনগণের আবেগকে জয় করতে এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইবে। তবে সেই চেষ্টায় হয়তো ইরানের চাইতে তুরস্কই এগিয়ে থাকবে। সকলেই এই ইস্যুটাকে ব্যবহার করবে; শুধু ফিলিস্তিনের জনগণ ছাড়া। আবারও প্রমাণিত হলো যে, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ফিলিস্তিনের জনগণের ব্যাপারে কতটা উদাসীন। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দকে জনগণের সামনে হেয় করবে এবং মুসলিমদেরকে যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজতে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলবে।

Saturday 15 August 2020

বৈরুত বিস্ফোরণের পর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে লেবানন

১৫ই অগাস্ট ২০২০

লেবাননের উপকূলে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ছত্রছায়ায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রীসের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করার ফরাসী কৌশলই বলে দিচ্ছে যে, ফ্রান্স তুরস্কের হুমকিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। লেবাননের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং বৈরুত বিস্ফোরণ দেশের মানুষের জন্যে যতটা কঠিন সময় এনে দিয়েছে, ততটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় শক্তিদের মাঝে।

গত ৯ই অগাস্ট ফরাসী নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনিয়েরে’ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী এবং জরুরি সহায়তা নিয়ে ফ্রান্স থেকে লেবাননের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে এমোনিয়াম নাইট্রেটের গুদামে বিস্ফোরণের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যাওয়া বৈরুতে বিভিন্ন দেশ থেকে সহায়তা আসছে। ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ প্রেরণও এই সহায়তার অংশ। ফরাসী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, এই জাহাজে খাদ্য সামগ্রী ও মেডিক্যাল সরঞ্জাম ছাড়াও রয়েছে সাড়ে তিন’শ জনের ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ, বৈরুত বন্দরের সার্ভে কাজের জন্যে হাইড্রোগ্রাফিক সরঞ্জাম ও নৌবাহিনীর ডুবুরি দল, ল্যান্ডিং ক্রাফট, হেলিকপ্টার, অগ্নি নির্বাপক দল, কন্সট্রাকশন সরঞ্জাম, ইত্যাদি। লেবাননের পথে মানবিক সহায়তা নিয়ে রওয়ানা হলেও ২১ হাজার টনের বিশাল এই যুদ্ধজাহাজের সক্ষমতা রয়েছে সাড়ে ৪’শ থেকে ৯’শ সৈন্য, ৪০টা ভারি ট্যাঙ্ক, ৪টা ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং ২০ থেকে ৩৫টা হেলিকপ্টার বহণ করার। ১২ই অগাস্ট ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এক টুইটার বার্তায় ঘোষণা দেন যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রীসকে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে ফ্রান্স তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। আর এর মাঝে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনিয়েরে’ও রয়েছে। এই ঘোষণার সাথেসাথে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোটকথা ফ্রান্স পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে লেবাননের ইস্যুটাকেই ব্যবহার করেছে, যা কিনা লেবাননে ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যগুলিকে আলোচনায় নিয়ে আসে।

গত ৪ঠা অগাস্ট বৈরুতের বন্দর এলাকায় মারাত্মক বিস্ফোরণে দেশটার প্রধান খাদ্য গুদাম ধ্বংস হয়ে যাবার পর ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে লেবাননের অর্থমন্ত্রী রাউল নেহমের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, দেশটাতে এক মাসেরও কম সময়ের খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে। তবে প্রতিবেদনে এও বলা হয় যে, এই গুদাম ধ্বংস হওয়াটাই প্রধান সমস্যা নয়। করোনা দুর্যোগের আগেই লেবাননের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছিল। আর একারণেই লেবাননের সরকারের পক্ষে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করার জন্যে বৈদেশিক মুদ্রা যোগাড় করাই কঠিন হয়ে গেছে। লেবাননের আমদানিকারক সিন্ডিকেটের প্রধান হানি বোহসালি বলছেন যে, অন্যান্য দেশ সহায়তা না করলে দেশটা খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে পড়বে। লেবাননের এই দুর্যোগকে আশেপাশের শক্তিশালী দেশগুলি লেবানন তথা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বৃদ্ধি করার সুযোগ হিসেবেই দেখেছে।

৬ই অগাস্ট ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ছুটে যান বৈরুতে। ‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফতের পতনের পর ফরাসীরা লেবাননের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৪৩ সালে লেবাননকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা দেবার পরেও ফ্রান্স তার সেই প্রভাবখানা ধরে রেখেছে। লেবাননের মারোনাইট খ্রিস্টানরা ফ্রান্সকে তাদের রক্ষাকারী হিসেবেই দেখে। লেবাননের ক্ষমতাবান লোকেরা ফ্রান্সে বাড়ি বানিয়েছে, ফরাসী ভাষা শিখেছে, নিজেদের স্কুলে ফরাসী ভাষাকে মূল ভাষা হিসেবে শিক্ষা দিয়েছে। বৈরুতে ম্যাক্রঁর সফরকে অনেকেই লেবাননে ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক এলি আবুআউন বলছেন যে, ফ্রান্স একা নয়, লেবাননে ইরান এবং সৌদি আরবের প্রভাব যথেষ্ট। লেবাননের বিশ্বাসগত বিভাজনের উপরই দেশটার রাজনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। খ্রিস্টানদের সমর্থনদাতা হলো ফ্রান্স; শিয়াদের পিছনে রয়েছে ইরান; সুন্নিদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্র এখানে ধীরে ধীরে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। অপরদিকে রাশিয়া এবং তুরস্ক মোটে চেষ্টা শুরু করেছে। লেবাননের দীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধের শেষে ১৯৮৯ সালে তায়েফের সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করা হয় যে, লেবাননের পার্লামেন্টে ১’শ ২৮টা আসনের মাঝে ৪৩টা পাবে মারোনাইট খ্রিস্টানরা, ২৭টা পাবে সুন্নি মুসলিমরা, ২৭টা পাবে শিয়ারা, ২০টা পাবে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খিস্টানরা, ৮টা পাবে দ্রুজরা, ২টা পাবে আলাওয়াতিরা এবং ১টা পাবে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানরা। ১৯৪৩ সালের নিয়ম অনুযায়ী দেশটার প্রেসিডেন্ট হবেন একজন মারোনাইট খ্রিস্টান এবং প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন সুন্নি মুসলিম। এই ব্যবস্থায় মারোনাইট খ্রিস্টানরা ফ্রান্সের অধীনে যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল, তার পরিবর্তন করে মুসলিমদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। তবে রাজনৈতিক বিভেদের এই ব্যবস্থায় লেবাননে কোনদিনই কোন শক্তিশালী সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। আর বিদেশী শক্তিরা বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ নিয়ে লেবাননের রাজনীতিতে কলকাঠি নেড়েছে।

গত মার্চে লেবাননের সরকার ঘোষণা দেয় যে, দেশটা প্রথমবারের মতো ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে পারছে না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেন যে, এই ঋণের উপর সুদ পরিশোধ করাটা লেবাননের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, লেবাননের ব্যাঙ্কগুলি দেশটার নিজস্ব মুদ্রা থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরে বাধা দেয়ার ফলে দেশটার মুদ্রার মান মারাত্মক কমে যায়; যার ফলশ্রুতিতে লেবানিজ পাউন্ড প্রায় মূল্যহীন হয় পড়ে। একইসাথে দেশটাতে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা দুষ্কর হয়ে যায়। ঋণদাতাদের নেতৃত্ব দেয়া ফ্রান্স চাইছে দেশটাতে রাজনৈতিক সংস্কার হোক। ‘রয়টার্স’ বলছে, ম্যাক্রঁ চাইছেন যে, লেবাননের রাজনৈতিক দলগুলিকে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে রাজি করানো। এর মাধ্যমে অতি ঋণগ্রস্ত এই দেশটাকে একটা টেকনোক্র্যাট সরকারের অধীনে নিয়ে আসলে দাতা দেশগুলি লেবাননের জন্যে আবারও কয়েক বিলিয়ন ডলারের ঋণের ব্যবস্থা করবে।

লেবাননের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে সিরিয়া বা আল-শামএর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে হওয়ায় দেশটার আকারের তুলনায় এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ফ্রান্স তার হারানো প্রভাব ফিরে পেতে যেমন লেবাননে তার অবস্থানকে শক্ত করতে চাইছে, তেমনি ইরান এবং সৌদি আরবও চাইছে তাদের অবস্থান যাতে কিছুতেই দুর্বল না হয়। সৌদি আরব, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক দেশ লেবাননে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। ব্রিটেন নৌবাহিনীর সার্ভে জাহাজ পাঠিয়েছে বৈরুত বন্দরকে চালু করায় সহায়তা দিতে। এর উপরে আবার তুরস্ক চাইছে বৈরুতের সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন করতে। অত্র অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের খেলায় সর্বশেষ খেলোয়াড় তুরস্ক। তবে লেবাননের উপকূলে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ছত্রছায়ায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রীসের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করার ফরাসী কৌশলই বলে দিচ্ছে যে, ফ্রান্স তুরস্কের হুমকিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। লেবাননের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং বৈরুত বিস্ফোরণ দেশের মানুষের জন্যে যতটা কঠিন সময় এনে দিয়েছে, ততটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় শক্তিদের মাঝে।

Saturday 8 August 2020

জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ইউরোপের অনৈক্যকে দেখিয়ে দিচ্ছে

০৯ই অগাস্ট ২০২০
রুশ হুমকি মোকাবিলায় জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে যখন পোল্যান্ডে মোতায়েন করা হচ্ছে, তখন জার্মানরা তাতে খুশি; আর অপরদিকে পোল্যান্ড মার্কিন সেনাদের খরচ পুরোটাই বহণ করতে চাইছে। অর্থাৎ ইউরোপের দেশগুলির কাছে জাতীয় নিরাপত্তার সংজ্ঞা এক নয়। ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে যেমন সামনে নিয়ে আসছে, তেমনি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ অনৈক্যকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়েই ব্যবহার করতে চাইবে।

 

গত ২৯শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, তারা জার্মানি থেকে তাদের প্রায় ১২ হাজার সেনা সরিয়ে নিচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে, যাতে রাশিয়া এবং চীনের মতো শক্তিগুলিকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়। তিনি আরও বলেন যে, এর মাধ্যমে ন্যাটো আরও শক্তিশালী হবে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডিটারেন্স তৈরি হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করাটা আরও সহজ করবে। কিন্তু প্রায় একইসাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কোন রাখঢাক না রেখেই বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ জার্মানি তাদের নিজেদের রক্ষার জন্যে কোন খরচ করছে না। ব্যাপারটা খুবই সহজ; তারা ‘অপরাধী’। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর বোকা বনতে চায় না। আন্যান্য ন্যাটো দেশগুলির জন্যে এটা একটা উদাহরণ হিসেবে থাকবে। ট্রাম্প মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০১৯ সালে জার্মানি তার জিডিপির ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে, যা ন্যাটোর বেঁধে দেয়া টার্গেট ২ শতাংশ থেকে অনেক নিচে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে সমালোচনা আসছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। মার্কিন সিনেটর মিট রমনি এই টুইটার বার্তায় বলেন যে, এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের একটা বন্ধু রাষ্ট্রের মুখে চপেটাঘাত। ডেমোক্র্যাট সিনেটর বব মেনেনডেজ বলছেন যে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইউরোপে ক্রেমলিনের আগ্রাসী কর্মকান্ডকে রুখে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আরও কঠিন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে জার্মানি থেকে সেনা সরিয়ে নিয়ে তাদেরকে বেলজিয়াম এবং ইতালিতে মোতায়েন করতে। কিন্তু ইতালিও ২০১৯ সালে তার জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ২২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে; বেলজিয়াম করেছে শূণ্য দশমিক ৯৩ শতাংশ! অর্থাৎ ব্যাপারটা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বাজেটের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। জার্মানির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অন্য দিকগুলিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

৭ই অগাস্ট জার্মান পত্রিকা ‘ডাই ওয়েল্ট’এর এক খবরে বলা হয়ে যে, রাশিয়ার সাথে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার ‘অপরাধে’ জার্মানির সাসনিতজ বন্দরের উপর ভীষণ রকমের আইনগত এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার হুমকি দিয়েছেন তিনজন মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ, টম কটন এবং রন জনসন। বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে বসানো এই পাইপলাইনের কাজের অল্প কিছু অংশ বাকি রয়েছে; যা সমাপ্তির পিছনে সাসনিতজ বন্দরের অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সিনেটররা এই চিঠিতে বলছেন যে, এই প্রকল্পে সাসনিতজ বন্দর সহায়তা দিলে বন্দরের মালিক এবং ম্যানেজমেন্টের কর্তাব্যক্তিদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে দেয়া হবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা তাদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। তারা বলছেন যে, এই পাইপলাইন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে মারাত্মক হুমকি। তাদের কথায় মার্কিন কংগ্রেসের উভয় দলই রাশিয়ার সাথে জার্মানির এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে।

জার্মানরাও প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। জার্মান পত্রিকা ‘তাগেস স্পাইজেল’কে জার্মান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিয়েলস আনেন বলেন যে, মার্কিন সিনেটরদের চিঠিটাকে জার্মান সরকার মোটেই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি; এর ভাষা এবং শব্দচয়ন ছিল একেবারেই অনভিপ্রেত। তিনি বলেন যে, ইউরোপিয়রা যদি মার্কিনীদের এধরনের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধাচরণ না করে, তবে তারা ‘ব্ল্যাকমেইল’এর শিকার হবে। জার্মান ম্যাগাজিন ‘উইয়ো’র সাথে এক সাক্ষাতে জার্মান ইস্টার্ন বিজনেস এসোসিয়েশনের প্রধান মাইকেল হার্মস বলেন যে, জার্মানরা মার্কিনীদের বিরুদ্ধে পাল্টা কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না, এটা যেন কেউ না বলে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের কোম্পানিগুলির জন্যে একটা সুরক্ষা ব্যুহ থাকা উচিৎ, যেগুলি এধরনের অবরোধে কোম্পানিগুলিকে বাঁচাবে। তিনি বলেন যে, জার্মান সরকারের উচিৎ ইইউকে পাল্টা অবরোধ দিতে অনুপ্রাণিত করা।

৩১শে জুলাই থেকে ৩রা অগাস্টের মাঝে ‘ইউগভ’এর মাধ্যমে জার্মান প্রেস এজেন্সির করা এক মতামত জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, ৪৭ শতাংশ জার্মান মনে করছে যে, জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা কমানো উচিৎ। আর ২৫ শতাংশের মতো মানুষ বলছে যে, মার্কিন সেনা জার্মানি থেকে একেবারেই সরিয়ে নেয়া উচিৎ। ৩২ শতাংশ মনে করছে যে, মার্কিন সেনা থাকা উচিৎ। আরেক প্রশ্নের উত্তরে ৬৬ শতাংশ জার্মান মতামত দেয় যে, জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ২০টা পারমাণবিক বোমাই সরিয়ে ফেলা উচিৎ। মাত্র ১৯ শতাংশ চাইছে যে, বোমাগুলি জার্মানিতে থাকুক। ন্যাটোর প্রতিশ্রুতিকে আমলে না নিয়ে জার্মান প্রতিরক্ষা বাজেটের ব্যাপারে ৫৮ শতাংশ মানুষ বলছে যে, জার্মানি প্রতিরক্ষার পিছনে যথেষ্ট ব্যয় করে।

ন্যাটোর যে সদস্য রাষ্ট্রগুলি প্রতিশ্রুত ২ শতাংশের বেশি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করছে, তার বেশিরভাগই রাশিয়ার সীমানায় অবস্থিত; যেমন লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া। এই দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ভাটা পড়েনি। ইতোমধ্যেই ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দেয় যে, তারা পোল্যান্ডকে রক্ষা করতে সেখানে মার্কিন সেনার সংখ্যা আরও ১ হাজার বাড়িয়ে সাড়ে ৫ হাজার করবে। ‘মিলিটারি টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অতিরিক্ত মার্কিন সেনাদের রাখার জন্যে অবকাঠামো তৈরি করা শুরু হয়েছে; আর এই খরচের প্রায় পুরোটাই বহণ করবে পোলিশ সরকার।

ইউরোপ আজ বেসুরে অর্কেস্ট্রার মতো কথা বলছে। রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করতে জার্মানি ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইইউএর সমর্থন চাইছে। ইউরোপের সাথে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ককে জার্মানরা স্বাভাবিকভাবে নিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির ব্যাপারে জার্মানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক মতভেদ দৃশ্যমান। রুশ হুমকি মোকাবিলায় জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে যখন পোল্যান্ডে মোতায়েন করা হচ্ছে, তখন জার্মানরা তাতে খুশি; আর অপরদিকে পোল্যান্ড মার্কিন সেনাদের খরচ পুরোটাই বহণ করতে চাইছে। অর্থাৎ ইউরোপের দেশগুলির কাছে জাতীয় নিরাপত্তার সংজ্ঞা এক নয়। ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে যেমন সামনে নিয়ে আসছে, তেমনি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ অনৈক্যকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়েই ব্যবহার করতে চাইবে।