Saturday 24 June 2017

জার্মানি এবং বাংলায় বিভাজনের ভূরাজনীতি

২৪শে জুন ২০১৭



ভারত জন্মের পর থেকেই একটি দুর্বল রাষ্ট্র, কারণ ব্রিটিশরা সেভাবেই ভারতকে তৈরি করেছে। আর ভারত টিকে আছে যে “মিরাক্কেল”-এর জন্যে, সেটিই হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে অনেকের মাঝেই প্রচলিত আছে যে আসলে ভারত একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র। এই কথাটাকে ভিত্তি দেয়া হয়েছে একটা মিথ্যা কথাকে বারংবার প্রচার করার মাধ্যমে। যারা এই মিথ্যাটিকে প্রচার করেছে, তারা কিন্তু ঠিকই জানেন যে ভারত কতটা দুর্বল একটা রাষ্ট্র। আর তারা এই দুর্বলতার ভিত্তি সম্পর্কেও যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। তবে একটা রাষ্ট্রকে দুর্বল করে তখনই তৈরি করা হবে যখন দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর জন্যে একটা গভীর ভীতিকে ব্যবহার করা যাবে; নাহলে এই দুর্বলতাটা যারা তৈরি করেছে (পরাশক্তিরা), তাদের কোন কাজে আসবে না। তথাপি এখানে পরাশক্তিদের দুশ্চিন্তার একটা কারণ রয়ে যায় – যদি সেই দুর্বলতাকে সত্যিকার অর্থেই কেউ কাজে লাগিয়ে ফেলে? সেটা কিন্তু হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্বলের দুর্বলতার “গোপন” কাহিনী কেউ না জানে। এই কাহিনী গোপন করার নিমিত্তেই ভারতকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এই “গোপন” কাহিনীর গোড়ার কিছু কথা আলোচনায় আসলে অবশ্য “শক্তিশালী” বলার ভিত্তিটাই থাকবে না। এই আলোচনাতে কয়েক হাজার মাইল দূরে ইউরোপের এক উদাহরণ টেনে আনাটা প্রসঙ্গতঃ – জার্মানির বিভাজনের কাহিনী। এর আগের একটি পোস্টে ঊনিশ শতকে জার্মানির একত্রীকরণের কাহিনী পাওয়া যাবে। আর আজকের আলোচনাটি হলো এর পরের বিভাজনের কাহিনী নিয়ে। এই কাহিনীর মাধ্যমে দুর্বল করার ফর্মূলাটা পাঠক পেয়ে যাবেন বলে আশা করা যায়।

জার্মান রাষ্ট্র একত্রীকরণে নেতৃত্ব দিয়েছিল জার্মানদের মাঝে সবচাইতে বড় রাজ্য প্রুশিয়া। বাকি ইউরোপ এই প্রুশিয়াকেই ‘জার্মান প্রবলেম’-এর মূল বলে ধরে নিয়েছিল। তাই প্রুশিয়ার বিরুদ্ধেই পরাশক্তিদের ছিল যতো ক্ষোভ।


জার্মানি আর পোল্যান্ড…



একটা জাতিকে রাজনৈতিকভাবে কি করে ভাঙ্গা যায়, তার সবচাইতে বড় উদাহরণ হচ্ছে জার্মানির বিভক্তি। এই বিভক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই মূল বিভক্তি হয়েছিল। আজকের যে পোল্যান্ডকে সকলে চেনে, সেটা কতটুকু আসলে পোল্যান্ড আর কতটুকু জার্মানি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কিছুটা ইতিহাসচর্চা করতে হবে। জার্মান রাষ্ট্র একত্রীকরণে নেতৃত্ব দিয়েছিল জার্মানদের মাঝে সবচাইতে বড় রাজ্য প্রুশিয়া। বাকি ইউরোপ এই প্রুশিয়াকেই ‘জার্মান প্রবলেম’-এর মূল বলে ধরে নিয়েছিল। তাই প্রুশিয়ার বিরুদ্ধেই পরাশক্তিদের ছিল যতো ক্ষোভ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পরে জার্মানি থেকে কিছু অংশ কেটে নিয়ে পোল্যান্ডকে দিয়ে দেয়া হয়। এই অংশটুকু ছিল প্রুশিয়ার কিছু অংশ। এভাবে পূর্ব প্রুশিয়া নামে একটা ছিটমহলের জন্ম দেয়া হয়, যা মূল জার্মানি থেকে আলাদা করে রাখা হয় ‘ডানজিগ করিডোর’ নামে একটা ভূখন্ড দ্বারা। এই ভূখন্ড দেয়া হয় পোল্যান্ডের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে হিটলার পোল্যান্ডের কাছ থেকে ওই করিডোরখানা দাবি করে বসেন। তার দাবি না মানায় তিনি পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রায় পুরো পোল্যান্ডই দখল করে নেন। যখন জার্মানরা পোল্যান্ড দখল করছিল, তখন সোভিয়েতরা ওই সুযোগে পোল্যান্ডের পুর্বের কিছু অংশ দখল করে নেয়। এই দখলীকৃত অংশের বিনিময়ে দ্বিতীয় বিশযুদ্ধ শেষের পরে জার্মানি থেকে ভূখন্ড কেটে পোল্যান্ডকে দেয়া হয়। এতে একে জার্মান জাতিকে কয়েক টুকরা করা হয়, আবার পোল্যান্ডের পূর্বংশ পাওয়ার কারণে রাশিয়ার strategic depth বৃদ্ধি পায়।

১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডন প্রোটোকলের আওতায় ঠিক করা হয় যে জার্মানিকে ভেঙ্গে কোন কোন অংশে ভাগ করা হবে। তাই ১৯৪৫ সালে জার্মানির আত্মসমর্পনের সময়ে যদিও দেখা যায় যে আমেরিকানরা পূর্ব-সম্মতিক্রমে আঁকা বাউন্ডারি অতিক্রম করে ফেলেছে, তবু সমস্যা হয়নি। মার্কিনীরা চুক্তি মোতাবেক তাদের কিছু জায়গা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ছেড়ে দেয়। উপরের মানচিত্রের নীল অংশটুকু মার্কিনীরা সোভিয়েতদের কাছে ছেড়ে দিয়েছিল।


প্রুশিয়ার ব্যাপারে পরাশক্তিরা একমত…..



১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডন প্রোটোকলের আওতায় ঠিক করা হয় যে জার্মানিকে ভেঙ্গে কোন কোন অংশে ভাগ করা হবে। তাই ১৯৪৫ সালে জার্মানির আত্মসমর্পনের সময়ে যদিও দেখা যায় যে আমেরিকানরা পূর্ব-সম্মতিক্রমে আঁকা বাউন্ডারি অতিক্রম করে ফেলেছে, তবু সমস্যা হয়নি। মার্কিনীরা চুক্তি মোতাবেক তাদের কিছু জায়গা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ছেড়ে দেয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কোন ভিত্তির উপরে লন্ডন প্রোটোকলের মানচিত্র তৈরি করা হয়েছিল? জার্মানির বর্তমান মানচিত্রের উপরে প্রুশিয়ার মানচিত্র superimpose করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রুশিয়ার মূল অংশের পশ্চিম বাউন্ডারিকেই পূর্ব জার্মানির পশ্চিম বাউন্ডারি করে বাকি জার্মানি থেকে আলাদা করা হয়। এই বাউন্ডারিটা মানতেই মার্কিনীরা ১৯৪৫ সালে বেশ কিছু অঞ্চল থেকে তাদের সৈন্য সরিয়ে নেয়। সাবেক প্রুশিয়ার মূল অংশ আলাদা করার ফলে এর পশ্চিমাংশ পড়লো পশ্চিম জার্মানিতে। আর বাকি অংশ? সেটা আরও জটিলভাবে ভাগ করা হলো।



জার্মানির পূর্বাংশ, যা একসময় প্রুশিয়ার অন্তর্গত ছিল, তার বেশিভাগই পোল্যান্ডকে দিয়ে দেয়া হয়। এর মাঝে ছিল সাইলেসিয়া, পমেরানিয়া, পোজেন, পশ্চিম প্রুশিয়া, পূর্ব প্রুশিয়া এবং ব্র্যান্ডেনবার্গের বেশ কিছুটা। শুধু অল্প কিছু অংশ (পূর্ব প্রুশিয়ার উত্তর অংশ) রাশিয়া কেটে নেয়, যা এখনও Kaliningrad exclave নামে রাশিয়ার অন্তর্গত রয়েছে। এসবকিছুর বিনিময়ে পোল্যান্ডের পূর্ব থেকে কিছু অংশ কেটে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও পোল্যান্ডের সীমানা ওটাই আছে; অর্থাৎ status quo বজায় রাখা হয়েছে। পোল্যান্ড হচ্ছে রাশিয়ার সাথে বাকি ইউরোপের বাফার জোন; তাই পোল্যান্ডকে সবসময়েই কাটাছেঁড়ার মাঝে পড়তে হয়েছে। প্রুশিয়ার জন্মের পর (আঠারো শতকের শুরুতে) থেকে পোল্যান্ডের সমুদ্রের সাথে সরাসরি কোন যোগাযোগ ছিল না। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পরে ডানজিগ করিডোর জার্মানি থেকে কেটে পোল্যান্ডকে দিয়ে দেয়া হলে পোল্যান্ডের সাথে সমুদ্রের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিকে কমপক্ষে তিন ভাগে ভাগ করা হয়; আসলে প্রাক্তন প্রুশিয়াকে ভাগ করা হয় তিন ভাগে। এর পশ্চিমাংশ পড়ে পশ্চিম জার্মানিতে; মধ্যাঞ্চল পড়ে পূর্ব জার্মানিতে; আর পূর্বাংশ পরে পোল্যান্ডে। এভাবে জার্মানির একত্রীকরণে মূল ভূমিকা রাখা প্রুশিয়ানদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় যাতে ভবিষ্যতে প্রুশিয়ানরা একত্রিত হয়ে আবার নতুন করে শক্তিশালী জার্মান জাতি গঠন করতে না পারে। ১৯৮৯ সালে জার্মান পূণ-একত্রীকরণের পরে যদিও অনেকেই মনে করতে পারেন যে জার্মানরা আবারও একত্রিত হয়ে গিয়েছে, আসলে ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়। কারণ বর্তমান পোল্যান্ডের প্রায় অর্ধেকই আসলে একসময় জার্মানি তথা প্রুশিয়ার অধীনে ছিল।

১৯৮৯ সাল। ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে বার্লিন ওয়াল। জার্মান জাতীয়তায় ঠিকমতো উস্কানি যে-ই দিতে পেরেছে, সে-ই জার্মানদের একত্রিত করে ফেলতে পেরেছে। তবে এটা হয়েছে জার্মানির আশেপাশে আগ্রাসী শক্তিগুলির কারণেই। প্রুশিয়াকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সত্ত্বেও জার্মানরা আবারও একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হতে পারে কিনা, সেটা দেখার বিষয়।


গোঁয়াড় জাতির উত্থান ঠেকানো….



এখানে নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে প্রুশিয়ার কথা বার বার এলেও সবচাইতে অদ্ভূত ব্যাপার হলো, হিটলারের জন্ম ছিল অস্ট্রিয়াতে। একজন অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত জার্মানও পেরেছিল জার্মানদের একত্রিত করে ফেলতে। অর্থাৎ জার্মান জাতীয়তায় ঠিকমতো উস্কানি যে-ই দিতে পেরেছে, সে-ই জার্মানদের একত্রিত করে ফেলতে পেরেছে। তবে এটা হয়েছে জার্মানির আশেপাশে আগ্রাসী শক্তিগুলির কারণেই। তারা যদি নিজেদের দ্বন্দ্বে জার্মানদেরকে বলির পাঠা হিসেবে ব্যবহার না করতো, তাহলে হয়তো কেউ জার্মান জাতীয়তাকে উস্কে দিতে পারতো না অতো সহজে। ইউরোপীয় শক্তিরা বহু বছর জার্মানদের বিভক্ত করে রেখে তাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছিল। তাই দাসত্বের কুফল তাদেরকে বোঝাতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। তবে যা-ই হোক, কোন একটা উদ্ভট কারণে জার্মানরা একত্রিত অবস্থায় অন্য যেকোন জাতির থেকে বেশি মনযোগ দিয়ে কাজ করে। প্রুশিয়াকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সত্ত্বেও জার্মানরা আবারও একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হতে পারে কিনা, সেটা দেখার বিষয়।



ঊনিশ শতকে উত্থান এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করার কারণে জার্মানিকে তথা প্রুশিয়াকে ভেঙ্গে ফেলা হয়। ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলি মধ্য ইউরোপে শক্তিশালী কোন জাতির উত্থান পছন্দ করেনি। এই জার্মানরাই ইউরোপের শক্তির সমতা পুরোপুরি পালটে দেয়। এখন জার্মানদেরকে হিসেবের বাইরে রেখে কিছুই করা যায় না। বাকি ইউরোপ একভাবে চিন্তা করলে জার্মানরা আবার সেটা নিজেরদের ‘জার্মান পাল্লা’য় মেপে দেখে। যদি সেটা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাহলে সেটা তারা মেনে নেয়না একেবারেই। এসব কারণে একুশ শতকে এসেও জার্মানি পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা সমস্যা। মার্কিনীরা পুরো ইউরোপকে তাদের দিকে নিয়ে আসতে পারলেও জার্মানিকে পারে না অনেকক্ষেত্রেই, যদিও আজও জার্মানিতে মার্কিন সামরিক ঘঁটি রয়েছে। মার্কিনীরা পশ্চিমের আদর্শিক শক্তি সেটা মেনে নিয়েই পশ্চিমারা আমেরিকার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু জার্মানরা ঠিকই ‘জার্মান পাল্লা’য় মেপে নেয় সেটা। অর্থাৎ আদর্শিক কারণও তাদের জাতীয় স্বার্থের নিচে স্থান নেয়। অবশ্য সেটা জার্মানির জন্যেই তো শুধু প্রযোজ্য নয়; যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র কেন মিশরের হোসনী মোবারক, ইয়েমেনের আলী আব্দুল্লাহ সালেহ, সৌদি বাদশাহ, জর্দানের বাদশা আবদুল্লাহ, ওমানের সুলতান কাবুস, এবং আরও অনেক অগণতান্ত্রিক নেতাদের সমর্থন করে যাচ্ছে, তা বেশ সুন্দরভাবেই প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন ব্যাখ্যা করেছেন তার “Hard Choices” বইতে। কিন্তু নিজেদের জন্যে আলাদা নিয়ম তৈরি করে নেয়া তো পরাশক্তির চিন্তা। জার্মানি কেন এমন আচরণ করবে? তারা কেন মার্কিন স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থের নিচে স্থান দেবে? সেখানেই অন্তর্নিহিত সেই গোঁয়াড়, যাকে দুইটা বিশ্বযুদ্ধের পরে তিন ভাগে ভাগ করেও পুরোপুরি ঠিক করা যায়নি। গোঁয়াড় জাতিকে বশে আনাটা কঠিন, কিন্তু জরুরী। এদের সমস্যা হলো ঠিক নেতৃত্ব দেখতে পেলে এদের গোঁয়াড়তমি কমে না, বরং বাড়ে। এই গোঁয়াড়ের উদাহরণ বাকি বিশ্বেও রয়েছে।

১৮৫৭ সালের ভারতের মানচিত্রে দেখা যায় যে বোম্বে এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে শুধু অল্প কিছু ভূখন্ড তারা নিয়ন্ত্রণ করেছিল, কারণ সেখানে উপকূলীয় সমুদ্রবন্দরগুলির নিয়ন্ত্রণই তাদের কাছে মূল বিষয় ছিল। অন্যদিকে বাংলা প্রেসিডেন্সিতেই ছিল তাদের পুরো ভূখন্ড। এই এলাকাটাই ছিল সবচাইতে সম্পদশালী, আর সেকারণেই ব্রিটিশরা সকল শক্তি নিয়োজিত করেছিল বাংলাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে। বাকি ভারত নিয়ন্ত্রণে নেয়াটা তাদের কাছে ছিল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ, আর সেকারণেই পশ্চিম ভারত এবং বর্তমাদের পাকিস্তানের ভূখন্ডের অধীন ভারতের অংশগুলি ব্রিটিশরা বহু পরে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল।


ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ - বাংলাতেই কেন হতে হবে?




ভারতীয় উপমহাদেশে এসে ব্রিটিশরা এখানে কি দেখেছিল? ব্রিটিশরা ভারতে যে স্থানগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিল, সেখানেই বড় ভূখন্ড নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল। এই নীতির ফলাফল দেখা যায় ১৮৫৭ সালের ভারতের মানচিত্রে। বোম্বে এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে শুধু অল্প কিছু ভূখন্ড তারা নিয়ন্ত্রণ করেছিল, কারণ সেখানে উপকূলীয় সমুদ্রবন্দরগুলির নিয়ন্ত্রণই তাদের কাছে মূল বিষয় ছিল। অন্যদিকে বাংলা প্রেসিডেন্সিতেই ছিল তাদের পুরো ভূখন্ড। এই এলাকাটাই ছিল সবচাইতে সম্পদশালী, আর সেকারণেই ব্রিটিশরা সকল শক্তি নিয়োজিত করেছিল বাংলাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে। বাকি ভারত নিয়ন্ত্রণে নেয়াটা তাদের কাছে ছিল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ, আর সেকারণেই পশ্চিম ভারত এবং বর্তমাদের পাকিস্তানের ভূখন্ডের অধীন ভারতের অংশগুলি ব্রিটিশরা বহু পরে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। কিছু জায়গা তারা আবার পুরোপুরি দখলে নেয়ার দরকারই মনে করেনি; যেমন – হায়দ্রাবাদ, যা কিনা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা আলাদা রাজ্য হিসেবেই রেখে গিয়েছিল। অর্থাৎ ভারত নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই এলাকাগুলির নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাহলে বাংলা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল?



ব্রিটিশরা বাংলায় অবতরণ করেই এখানকার তিনটি বিশাল নদীর অববাহিকায় অবস্থিত বাংলার শক্তি অনুধাবন করতে পেরেছিল। আদর্শিক চিন্তার মাঝে থাকার কারণে তারা এক স্থানে সকল বৃষ্টি এবং এক স্থানে সকল নদনদীর জমাট পাকানোটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল; বাংলাকে তারা ধরে নিয়েছিল শক্তির কেন্দ্র। তারা ভারতের ইতিহাস থেকেও শিক্ষা নিয়েছিল এবং বুঝেছিল যে বাংলাতে একবার কেউ জেঁকে বসলে তাকে এখান থেকে উতখাত করা খুবই কঠিন হয়ে যায়। এই এলাকার কৃষিজ সম্পদের প্রাচুর্য্য, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাত, তিনটি বিশাল নদীর সঙ্গমস্থল, সমুদ্রবন্দরের আধিক্য, পানি-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ছাড়াও এখানকার ভূ-কৌশলগত অবস্থান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ব্রিটিশরা বুঝেছিল যে যারা বাংলার নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই ভারতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলবে। তাদের প্রথম কাজটাই পরবর্তীতে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল – কোলকাতায় একটি বন্দর প্রতিষ্ঠা। এর মাধ্যমে পরবর্তীতে তারা বাংলার শক্তিকে দুই ভাগ করে ফেলতে পেরেছিল। তারা নিজেরা হতে চেয়েছিল এই ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণকারী; অন্য কাউকে সেটা দেবার ইচ্ছে তাদের ছিল না। তারা হিসেব কষে বুঝেছিল যে, যেহেতু এই এলাকার মুসলিমদের হাতে ব্রিটিশরা আগমণের আগ পর্যন্ত একনাগারে ৫৫১ বছর ক্ষমতা ছিল, তাই তারাই ছিল তাদের মূল ভীতি। আর ভূ-কৌশলগতভাবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বাংলাতেই মুসলিমদের সবচাইতে বড় অংশটুকু বাস করতো। এই অঞ্চলের মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্রিটিশরা হিমসিম খেয়েছিল। প্রায় নিয়মিতভাবেই ব্রিটিশদের এই অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করতে হয়েছিল, যার সবচাইতে বড়টি ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব, যখন ৫৭ হাজার সৈন্যের পুরো বেঙ্গল আর্মি বিদ্রোহ করে বসেছিল। বাকি ভারত থেকে সৈন্য এনে এই বিদ্রোহ দমন করতে হয়েছিল তাদের। তবে তারা যে ভয় পেয়েছিল এই বিদ্রোহের মাধ্যমে, সেই ভয় থেকে তারা বের হতে পারেনি কখনোই। তারা বুঝে গেছিল যে আজ হোক, কাল হোক, এই উপমহাদেশ তাদের ছাড়তেই হবে; আর সেটা হবে এই বাংলার সমস্যার কারণেই। বাংলার মানুষ বহু আগ থেকেই রাজনৈতিকভাবে বাকি ভারত থেকে বেশি সচেতন ছিল; তাই এরা যেমন নেতৃত্ব দিয়েছিল, তেমনি দখলের সময়ে এরাই ছিল সকলের দুশ্চিন্তা।

বাংলার অবশিষ্টাংশকে দুই ভাগ করে দুইটি দেশের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। এমন এক পদ্ধতি করা হয়, যাতে ভারত-পাকিস্তানের মাঝে শত বৈরিতা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে যেন একাত্বতা থাকে – বাংলাকে কখনোই এক হতে দেয়া যাবে না। এখানকার মানুষ বাংলায় কথা বলতো সেকারণে নয় (আসলে বাংলা ছাড়াও এখানে আরও ভাষা ছিল), বরং ভূ-কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকায় আদর্শিকভাবে শক্তি ধরে রাখার এবং সেই শক্তিকে ব্যবহার করার উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে – সেই কারণে।


বাংলার বিষয়ে ভারত-পাকিস্তানের ঐক্য



বাংলাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ডিভাইড-এন্ড-রুল পদ্ধতির অনুসরণ করেছিল ব্রিটিশরা। অমুসলিমদেরকে শক্তিশালী করে মুসলিমদেরকে দুর্বল করার চেষ্টায় ছিল তারা। যার ফলশ্রুতিতে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মতো ঘটনার জন্মও তারা দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই দাঙ্গার জন্ম তারা দিতে পেরেছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ চেষ্টার মাধ্যমে। (এর আগেই বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছিল। আসামকে পুরোপুরি আলাদা করা হয় ১৯৪৭ সালে) যদিও বঙ্গভঙ্গ এরপরে রদ করা হয়েছিল, আসল ব্যাপারে ব্রিটিশরা হয়েছিল সফল। তারা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার এমন একটা বীজ বপন করে দিয়েছিল, যা কিনা শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের মানচিন্ত্র তৈরিতে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। ভূ-কৌশলগত দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিকভাবে সবচাইতে শক্তিশালী বাংলার অবশিষ্টাংশকে (বিহার ও উড়িষ্যাকে আগেই আলাদা করা হয়েছিল) তারা দুই ভাগ করে দুইটি দেশের কাছে দিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, এমন এক পদ্ধতি তারা করে দিয়ে যায়, যাতে দু’টি দেশের মাঝে শত বৈরিতা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে যেন একাত্বতা থাকে – বাংলাকে কখনোই এক হতে দেয়া যাবে না। পরাশক্তিদের নীতি অনুসরণ করে ১৯৪৭ পরবর্তী উভয় দেশই বাংলার মানুষের শক্তিকে খর্ব করেছিল, যদিও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রায় পুরো রাজনৈতিক কর্মকান্ডই ছিল বাংলা-কেন্দ্রিক। ১৯০৯ সাল পর্যন্ত কোলকাতাই ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনীতিকদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছিল কোলকাতায়। কোলকাতা ভারতকে দিয়ে দেয়া দেবার কারণে বঙ্গবন্ধুর কতটা কষ্ট হয়েছিল, সেটা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বই থেকে জানা যায়। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত পাকিস্তানের কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাঙ্গালী – এগুলি কোন দুর্ঘটনা নয়; সেটাই স্বাভাবিক ছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলার থাকার কথা উপরে; কিন্তু বিভাজনের মাধ্যমে সেটাকে করা হয়েছে দুর্বল। কারখানা করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, অথচ কারখানার কাঁচামাল আসতো পূর্ববাংলা থেকে। এদেরকে আলাদা করে ফেললে কেউই তো শক্তিশালী থাকে না। (এক্ষেত্রে তিন প্রধান নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহের উল্টোদিকে কোলকাতাকে পশ্চিমবঙ্গে মূল শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কারণে বিভাগ অনেক সহজ হয়েছে।) জার্মানির বিভাগের কাহিনীর সাথে প্রচুর মিল রয়েছে বাংলার কাহিনীর। যেভাবে প্রুশিয়াকে কয়েক টুকরো করে বিলিয়ে দেয়া হয়েছিল কয়েকটি দেশের মাঝে, ঠিক সেভাবেই বাংলাকে কয়েক টুকরো করে ভাগ-বাটোয়ারা করে ফেলা হয়েছিল। এরা বাংলায় কথা বলতো সেকারণে নয় (আসলে বাংলা ছাড়াও এখানে আরও ভাষা ছিল), বরং ভূ-কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকায় আদর্শিকভাবে শক্তি ধরে রাখার এবং সেই শক্তিকে ব্যবহার করার উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে – সেই কারণে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনীতিকদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছিল কোলকাতায়। যেহেতু বরাবরই বাংলা রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে ছিল, তাই এখানকার মানুষের মাঝেও রাজনৈতিক চিন্তা বেশি দেখা যেত। এই রাজনৈতিক সচেতনতাকে আদর্শিক শক্তিরা কাজে লাগাতে পারে। যেখানে কোন ধরনের রাজনৈতিক সচেতনতা নেই, সেখানে আদর্শিক রাজনীতিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাটা কঠিন, কারণ এই রাজনীতির ধরণটা বেশ কিছুটা sophisticated, যেখানে চিন্তা করার ক্ষমতার অগ্রাধিকার থাকে। বাংলার মানুষ চিন্তার দিক থেকে এগিয়ে ছিল; তাই বাংলার বিভাজনটা পরাশক্তিদের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


শরীর থেকে মাথা আলাদা করা হলে আত্মা পালিয়ে যায়…




প্রুশিয়ার তথা জার্মান বিভাগ ইউরোপে একটা শক্তিশালী জাতির উত্থান প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। বাংলার বিভাগও বঙ্গোপসাগরে ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এই দুই বিভাজনে ব্যাপক মিল থাকলেও একটি জায়গায় দু’টি বিভাগের মাঝে অমিল রয়েছে। জার্মানি পশ্চিমা আদর্শকে তাদের জাতীয়তার নিচে স্থান দেয়ায় ইউরোপের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে; যে কারণে জার্মান জাতীয়তাবাদকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলায় পশ্চিমা আদর্শের বিপরীত কোন আদর্শ যাতে গেঁড়ে বসতে না পারে, সেজন্য সেখানে জাতীয়তাবাদের প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে এমনভাবে, যাতে তা শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিতে না পারে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৭১ সালে ভারত পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) থেকে কোটিখানেক শরণার্থী নিয়ে মহাবিপদে পড়ে। হ্যাঁ, সেটা অর্থনৈতিক দিক থেকে বিরাট সমস্যা তৈরি করেছিল; ভারতের অভ্যন্তরীণ হিন্দু-মুসলিম সমস্যাকে জাগিয়ে দেবার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল; ভারতের বাঙ্গালীদের ‘বাঙ্গালীত্ব’কে জাগিয়ে দিয়েছিল ‘ভারতীয় জাতীয়তাবোধ’ উপেক্ষা করে; ভারতের পূর্বাংশের আদর্শিক আন্দোলনকে (তখনকার আদর্শিক আন্দোলন ছিল কমিউনিজম) পূর্ব বাংলার আদর্শিক আন্দোলনের সাথে মিলিয়ে ফেলার উপক্রম করেছিল। [1] কিন্তু আসল সমস্যা কি ছিল? আসল সমস্যা ছিল এই যে শরণার্থী প্রবাহের সাথে সৃষ্ট উপরোল্লিখিত সমস্যাগুলি এখানকার রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলে থাকা মানচিত্রকেই ভূলুন্ঠিত করেছিল! এটা ছিল পরাশক্তিদের বেঁধে দেয়া নিয়মের প্রচন্ড বরখেলাপ! ব্রিটিশরা যে নিয়ম ১৯৪৭ সালে রেখে গিয়েছিল, মার্কিনীরা সেটা বজায় রেখেছিল ১৯৭১ সালে। বাংলায় একটা আদর্শিক উত্থানই কেবল এই নিয়মকে ভেঙ্গে ফেলার পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলতে পারতো। আর বাংলার শক্তিশালী ভূ-কৌশলগত অবস্থান তাদের হস্তগত হতো ঐ মুহুর্তেই; তখন এই প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শিক শক্তিকে মোকাবিলা করা পরাশক্তিদের জন্যে অত্যন্ত কঠিন হয়ে যেত। তাই পরাশক্তিরা এই এলাকায় আবারও একটি আদর্শিক শক্তির উত্থান চায় না।



যেহেতু বরাবরই এই এলাকা রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে ছিল, তাই এখানকার মানুষের মাঝেও রাজনৈতিক চিন্তা বেশি দেখা যেত। এই রাজনৈতিক সচেতনতাকে আদর্শিক শক্তিরা কাজে লাগাতে পারে। যেখানে কোন ধরনের রাজনৈতিক সচেতনতা নেই, সেখানে আদর্শিক রাজনীতিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাটা কঠিন, কারণ এই রাজনীতির ধরণটা বেশ কিছুটা sophisticated, যেখানে চিন্তা করার ক্ষমতার অগ্রাধিকার থাকে। বাংলার মানুষ চিন্তার দিক থেকে এগিয়ে ছিল; তাই বিভাজনটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা মানুষের দেহ থেকে হাত-পা এমনকি যৌনঙ্গ আলাদা করে ফেললেও তার বেঁচে থাকার ক্ষমতা রয়ে যায়। কিন্তু মাথা যদি দেহ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, তাহলে তার দেহ থেকে আত্মা চলে যায়। বাংলা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মাথা। এটা ছাড়া অন্য যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকবে, সেগুলিকে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে খুব সহজেই – কারণ চিন্তা করার মাথাখানা তো কয়েক ভাগ করে ফেলা হয়েছে।



দুই পরমাণু হাইড্রোজেনকে ধরে রাখে এক পরমাণু অক্সিজেন



বাংলার ব্যাপারটাকে রসায়নে পানির অণুকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। পানির এক অণুতে অক্সিজেনের একটি পরমাণুর সাথে দু’টি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। অক্সিজেন পরমাণুটি ছাড়া হাইড্রোজেন পরমাণুদু’টি কিছুই করতে পারে না। অক্সিজেন পরমাণুটিই হলো হাইড্রোজেনগুলির যোগসূত্র। এই হাইড্রোজেনের একটি পরমাণু হলো বাংলার ভূ-কৌশলগত অবস্থান আর আরেকটি হলো এর বিশাল জনগোষ্ঠী – এদেরকে আগলে রেখে একত্রিত করে অক্সিজেনের পরমাণু, অর্থাৎ আদর্শিক শক্তি। এরা আলাদা থাকলে পানি কখনোই তৈরি হয় না; আর পানি তৈরি হবার আগে হাইড্রোজেন পরমাণুদু’টি কখনোই বোঝে না যে এরা একত্রিত হলে পানি তৈরি হয়। বরং অক্সিজেনের অভাবে হাইড্রোজেনের পরমাণুগুলিকে অন্য যৌগরা তাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করে; তারা শুধু ব্যবহৃতই হয়ে যেতে থাকে।



বাংলায় পশ্চিমাদের (ব্রিটিশদের পরে মার্কিনীরা এই দায়িত্ব নিয়েছে) এই ব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ। ব্রিটিশরা আসলে এখানে কি করেছিল? তারা শুধু বাংলার মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে “সমাজব্যবস্থা” মূল আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়; মূল আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত “আমার গোষ্ঠী”র স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি-না। এভাবে ব্রিটিশরা বাংলার মানুষের জন্যে খেলার মাঠ তৈরি করে দিয়ে গেছে। এখানকার মানুষ সেই মাঠের নিয়মের ভেতরে চলে; আর মাঠে নেমে নিজেদের জাতি-গোত্র নিয়ে মারামারি করে। জার্মানির জন্যে প্রুশিয়া আর ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যে বাংলা – উভয়টিই ডিভাইড এন্ড রুল-এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। তবে যেটা একেবারে শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে – এই খেলাটা চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্বলের দুর্বলতা প্রকাশ না পায়, আর শক্তিশালী তার শক্তির উতসকে খুঁজে না পায়।



[1] পড়ুন – ‘Myths and Facts: Bangladesh Liberation War’ by B.Z. Khasru (2010)

এবং ‘Blood Telegram: India’s Secret War in East Pakistan’ by Gary J Bass (2013)

Friday 23 June 2017

হলিউডের ভবিষ্যৎ কোন দিকে?

২৪শে জুন ২০১৭



হলিউড হলো মার্কিন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মার্কিন জনগণকে পথ দেখিয়ে যাবার কাজটা অনেক ক্ষেত্রেই হলিউড করেছে। ১৯৮০-এর দশকে ঠান্ডা যুদ্ধের শেষাংশের চাইতে অন্য কোন সময় সম্ভবত এই কাজ অতটা গুরুত্ব বহন করেনি। ১৯৯০-এও সেব্যাপারটা কিছুটা চলেছিল। সেসময়ের মার্কিন মুভি এবং টিভি সিরিয়ালগুলির দিকে তাকালে দেখা যায় যে হলিউড তখন সকলের কথাই চিন্তা করেছে। টম ক্রুজ এগিয়ে থাকা মার্কিন তরুণদের রক্তে আগুন দিয়েছিলেন তার Top Gun মুভির মধ্য দিয়ে। আরনল্ড শোয়ার্জনেগার ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিরো; সিলভেস্টার স্ট্যালোন, কার্ট রাসেল এবং ভ্যান ড্যামরাও ছিলেন ঐ ধাঁচেরই। ব্রুস উইলিস, মেল গিবসন আকর্ষণ করেছিলেন সমাজের ঐ লোকগুলিকে, যারা কিনা নিজেকে সমাজের জন্যে সপে দিচ্ছেন নিজে কিছু না পেয়েও, যেমন পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, সিকিউরিটি গার্ড – এধরনের লোকজন। এডি মার্ফি আকর্ষণ করেছিলেন কালোদের ঐ অংশটাকে, যারা কিনা কালোদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ নিয়ে ছিলেন সন্দিহান। আবার ডেনজেল ওয়াশিংটন এবং ওয়েসলি স্নাইপস কালো-সাদা দন্দ্ব কমাতে চেষ্টা করেছেন; তবে এরা আকর্ষণ করেছিলেন শহুরে sophisticated মানুষগুলিকে। পুলিশ নিয়ে অনেকগুলি মুভি তৈরি হয়েছিল; সামরিক বাহিনী নিয়ে মুভিগুলি ছিল কিছুটা নেগেটিভ – ভিয়েতনাম যুদ্ধের কালো ছায়াটা সমাজকে ঘিরে রেখেছিল তখন। সামরিক সার্ভিস নিয়ে ঐ নেগেটিভ মাইন্ডসেট থেকে উতড়ানোর চেষ্টা তারা করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তৈরি মুভিগুলি দিয়ে; এর মাঝে Saving Private Ryan-এর নাম হয়তো সর্বপ্রথমে আসবে। Forrest Gump-এর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল এবং ছোট শহরের পিছিয়ে থাকা মানুষদেরকে রাষ্ট্রের সাথে একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়; আশা দেয়া হয় তাদেরকে। কেভিন কস্টনারের মুভিগুলিও ছিল সেরকমই। Hawaii Five-O তৈরি করা হয়েছিল হাওয়াই-এর জন্যে; Miami Vice তৈরি করা হয়েছিল মায়ামির জন্যে। ডেট্রয়েট এবং শিকাগোর জন্যেও তৈরি হয়েছিল মুভি এবং টিভি সিরিজ। মোট কথা, রাষ্ট্র সকলের কথাই চিন্তা করতো তখন। সেসময় মার্কিন চিন্তাচেতনা দুনিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছে একাই। রাষ্ট্রের চিন্তার সাথে জনগণের চিন্তা যাতে সাংঘর্ষিক না হয়, তার চেষ্টা তারা করতেন মোটামুটিভাবে। কারণ এক্ষেত্রে অমিল রাষ্ট্রকে দুর্বল করবে।

   

যেটা দেখার ব্যাপার হবে তা হলো, ২১ শতকে এসে হলিউড কি তৈরি করছে? হলিউডের মুভিগুলি এখন যতটা না আমেরিকান, তাই চাইতে বেশি গ্লোবাল। ব্রুস উইলিসের মুভি দেখলে বোঝা যায় যে মার্কিন রাষ্ট্রের জন্যে নিজেকে সঁপে দেবার মানুষদেরও বয়স বেড়ে গেছে। টম ক্রুজ এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন শহুরে এগিয়ে থাকা মানুষগুলিকে সাথে রাখতে; তবে তাদেরও বয়স বাড়ছে। এখন এডভেঞ্চার-সুপার হিরো-টেকনো ফ্লিকগুলি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে নিয়ে ভাবে না। একসময় মার্কিন জীবনযাত্রাকে দুনিয়ার কাছে নিয়ে গিয়েছিল হলিউড। তখন তাদের চিন্তাধারার ধার ছিল বলেই দুনিয়ার মানুষের অন্তরে মার্কিন মুল্লুকের জন্যে একটা আকর্ষণ তৈরি করতে পেরেছিল তারা। কিন্তু এখন মার্কিন যুদ্ধবাজিকে দুনিয়ার সামনে নিয়ে যায় হলিউড, যখন মার্কিন বোমার আঘাতে সারা দুনিয়া ক্ষতবিক্ষত। বাকি দুনিয়ার কাছেও হলিউডের এই অফারগুলি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নিজ দেশে, অর্থাৎ খোদ যুক্তরাষ্ট্রে Forrest Gump-এর মতো মানুষগুলি এখন কি করবে? সে কি সুপার হিরো হতে পারবে কখনো? নাকি টম ক্রুজের মুভির মতো sophisticated চিন্তার অধিকারী?



মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে বারংবার চেষ্টা করেও হলিউড বোঝাতে পারছে না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন যুদ্ধের মাঝে রয়েছে, যার জন্যে মার্কিন জনগণকে রাষ্ট্রের সাথে থাকতে হবে। যখন জনগণের বিরাট অংশের মাঝে চিন্তা ঢুকে গেছে যে তারা রাষ্ট্র দ্বারা অবহেলিত, তখন সেখানে কোন বার্তাই যে কানে যাবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। উইল স্মিথ তার The Pursuit of Happiness মুভির মাধ্যমে দেশের পিছিয়ে থাকা জনগণকে আশা দেবার যে চেষ্টাটা করেছেন, তা এখন প্রতারণা হিসেবেই দেখবে বেশিরভাগ মানুষ। Rush Hour মুভিতে ক্রিস টাকারকে জ্যাকি চ্যানের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নকে মাথায় রেখে; কালোদের জন্যে আলাদাভাবে কিছু করার জন্যে নয়। বরং এই মুভিতে কালোদেরকে মাথামোটা দেখিয়ে ছোটই করা হয়েছে।


মার্কিন চিন্তার চাকা এখন আর নিজে নিজে ঘুরছে না; ঠেলে নিতে হচ্ছে। হলিউডের অবস্থাও তা-ই। হলিউডে এখন টেকনলজি আছে; চিন্তা নেই। হলিউডে গ্লোব আছে; আমেরিকা নেই। বাকি বিশ্বের মানুষ এখন হলিউডের মাঝে যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছে; মার্কিন জনগণ কোথাও যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছে না। “We are 99”-এর কোন প্রত্যুত্তর হলিউডের কাছে নেই। বাকি বিশ্বকে জোর করে সন্ত্রাসী বানিয়ে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরার চেষ্টাটা এখন হাস্যকরই বটে। নিজেদের দ্বন্দ্বকে [১] ধামাচাপা দেয়াটাই যে এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হলিউড এখন কি দেখাবে সেটা এখন প্রশ্নবোধক চিহ্ন। কারণ মার্কিনীরা এখন আর জানে না যে আগামীকাল কি হবে। বোঝা যাচ্ছে যে চাবির গোছার মালিক পরিবর্তন হতে চলেছে। 



[১] ‘প্রশ্নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৬

‘ওবামার যুদ্ধগুলো লড়বে কে?’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৯ জানুয়ারী ২০১৭

‘যুক্তরাষ্ট্র কি নিজের যঙ্গেই যুদ্ধরত?’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭