Friday 29 January 2021

‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার বাস্তবতার দিকেই ইঙ্গিত দেয়

২৯শে জানুয়ারি ২০২১

 
‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’এর পরিস্থিতি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় আদর্শ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থই সকল সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। একইসাথে মানুষের জীবন নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির উপর প্রভাবই জাতীয় সিদ্ধান্তের পিছনে মূল প্রেরণা।


করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে ব্রিটেন এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব এখন বেশ পরিষ্কার। ব্রিটিশ সুইডিশ কোম্পানি ‘এসট্রাজেনেকা’ বলছে যে, তারা ইইউএর কাছে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে না। ২৬শে জানুয়ারি ইতালিয় পত্রিকা ‘লা রিপাবলিকা’র সাথে এক সাক্ষাতে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পাসকাল সোরিঅট বলেন যে, চুক্তি অনুযায়ী ‘সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা’ দেয়ার জন্যে কোম্পানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে; তবে নির্দিষ্ট তারিখের মাঝে সকল ভ্যাকসিন সরবরাহ করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ইইউ ‘এসট্রাজেনেকা’র এই বক্তব্য মানতে নারাজ। ইইউএর স্বাস্থ্য কমিশনার স্টেলা কিরিয়াকিদেস ২৭শে জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন যে, কোম্পানির ব্রিটিশ কারখানাগুলি ইইউএর সাথে করা চুক্তির অংশ। যেহেতু ব্রিটিশ কারখানাগুলির সরবরাহ ভালোমতো চলছে, তাই কোম্পানি তার প্রতিশ্রুতি রাখতে বাধ্য। পরদিন এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন যে, ইইউ ‘এসট্রাজেনেকা’র চলমান অস্বচ্ছ সরবরাহ শিডিউলে ব্যাথিত। কিরিয়াকিদেস সাংবাদিকদের বলেন যে, কোম্পানি চুক্তিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করছে, তা ভুল এবং অগ্রহণযোগ্য। এর সপ্তাখানেক আগে কোম্পানি বলে যে, মার্চের মাঝে তারা তাদের প্রতিশ্রুত ৮ কোটি ভ্যাকসিনের মাঝে মাত্র ৩ কোটি ১০ লক্ষ সরবরাহ করতে পারবে। কারণ হিসেবে কোম্পানিটা বলছে যে, তাদের ইইউএর ভূমিতে বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের কারখানাগুলি সরবরাহ দিতে হিমসিম খাচ্ছে। এছাড়াও কোম্পানির দু’টা কারখানা রয়েছে ব্রিটেনে। ইইউএর সাথে ‘এসট্রাজেনেকা’র দ্বন্দ্বের মাঝে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট অফিসের মন্ত্রী মাইকেল গোভ বলেন যে, ইইউএর সাথে ‘এসট্রাজেনেকা’র যে দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন, ব্রিটিশ জনগণের ভ্যাকসিন পেতে কোন সমস্যাই হবে না। তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, ব্রিটেনের কাছে ‘পূর্ণ নিশ্চয়তা’ রয়েছে যে, ব্রিটেন তার ভ্যাকসিন ঠিকমতোই পাবে। আর ব্রিটেনের ভ্যাকসিন প্রকল্প সম্পূর্ণ সফলতা পাবার পরই ইইউএর দেশগুলিকে সহায়তা দেবার কথা আসবে। তিনি আরও বলেন যে, ইউরোপিয়ান কমিশনের চাপ সত্ত্বেও ‘এসট্রাজেনেকা’ ব্রিটেনকে নিশ্চিত করেছে যে, তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখবে। ভ্যাকসিন নিয়ে ইইউ এবং ব্রিটিশ সরকারের পরস্পরবিরোধী কথাগুলি ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’এর আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসছে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট।

ইইউ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবং ভ্যাকসিন প্রকল্প বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইইউ তার প্রায় ৪৫ কোটি জনসংখ্যার জন্যে এখন পর্যন্ত মোট ২’শ ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন অর্ডার করেছে। এর মাঝে ‘এসট্রাজেনেকা’র কাছ থেকে অর্ডার করেছে ৪০ কোটি। ইইউ কর্মকর্তারা বলছেন যে, ইইউএর কাছ থেকে কোম্পানি যে অর্থ পেয়েছে, তা দিয়েই কোম্পানির ব্রিটিশ কারখানার উন্নয়ন করা হয়েছে। ইইউএর সাথে চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, কোম্পানির মূল কারখানা ব্রিটেনে; বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডসের কারখানাগুলি দ্বিতীয় সারির। ‘এসট্রাজেনেকা’ ছাড়াও মার্কিন কোম্পানি ‘ফাইজার’ ও জার্মান কোম্পানি ‘বায়োএনটেক’এর জয়েন্ট ভেঞ্চার থেকে ইইউ অর্ডার করেছে ৬০ কোটি ডোজ; আর মার্কিন কোম্পানি ‘মডার্না’র কাছ থেকে অর্ডার করেছে ১৬ কোটি ডোজ। ‘ফাইজার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ২০২০এর ডিসেম্বরের মাঝে তারা ১ কোটি ২৫ লক্ষ ডোজ সরবরাহ করবে। কোম্পানির বেলজিয়ান কারখানা সম্প্রসারণের কাজ চলায় তারা সিডিউলে কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে রয়েছে বলে বলছে। এর ফলাফলস্বরূপ স্পেন সরকার ২৭শে জানুয়ারি ঘোষণা দেয় যে, ভ্যাকসিনের অভাবে মাদ্রিদ এলাকায় ভ্যাকসিন দেয়ার কর্মকান্ড দুই সপ্তাহের জন্যে স্থগিত করা হয়েছে। কাতালোনিয়াতেও ভ্যাকসিন কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতালি সরকার ইতোমধ্যেই ‘এসট্রাজেনেকা’র বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছে। অপরদিকে জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেন্স স্পাহন ইউরোপিয়ান কমিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন যাতে ভ্যাকসিন কারখানাগুলি ইইউএর যে সদস্য রাষ্ট্রের সীমানার মাঝে অবস্থিত, তাদের সরকারের অনুমতি ব্যাতীত যেন ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে না পারে।

‘এসট্রাজেনেকা’ এবং ইইউএর দ্বন্দ্ব বলে দিচ্ছে যে, ভ্যাকসিনের কারখানা কোন দেশের জাতীয় সীমানার মাঝে রয়েছে, তা এখন যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সব দেশের মাটিতে তো কারখানা নেই; বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। ২৬শে জানুয়ারি ‘প্যান আফ্রিকানিস্ট’ সাংবাদিক সন্মেলনে ধনকুবের বিল গেটস বলেন যে, মহামারি থেকে উদ্ধার পেতে আরও অনেক ভ্যাকসিন কারখানা চালু করতে হবে এবং সব দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। গেটস বলেন যে, তিনি বিশ্বের ভ্যাকসিন কারখানাগুলিকে অর্থায়ন করছেন, যাতে করে ভ্যাকসিন ডেভেলপ করা বায়োটেকনলজি কোম্পানিগুলির ভ্যাকসিন অনেকগুলি কারখানায় তৈরি করা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনের ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র ডেভেলপ করা ভ্যাকসিন তৈরি করছে ‘এসট্রাজেনেকা’; আর ‘এসট্রাজেনেকা’র সহায়তা নিয়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে ভারতের ‘সিরাম ইন্সটিটিউট’। তবে গেটস বিশ্বের সকল স্থানে কারখানা তৈরিকেও আবার সমর্থন করছেন না। এক প্রশ্নের জবাবে গেটস বলেন যে, আফ্রিকায় একটা ভ্যাকসিন কারখানা করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে; কাজেই এটা বরং ভবিষ্যতের কোন মহামারির প্রস্তুতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশেগুলির বড় কারখানাগুলির উপর নির্ভর করা ছাড়া গতি নেই। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ভ্যাকসিন কারখানার জন্যে ধনী দেশগুলির বিনিয়োগ প্রত্যাশা করেন।

‘ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স’এর গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী সব দেশে ভ্যাকসিন প্রকল্প চালু করা না গেলে বিশ্ব অর্থনীতি ৯ হাজার ২’শ বিলিয়ন বা ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার হারাবে। বিল গেটস বলছেন যে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব যেখানে ২৮ হাজার বিলিয়ন বা ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছে, সেই তুলনায় ভ্যাকসিনের জন্যে নতুন কারখানার পিছনে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ কিছুই নয়। কিন্তু গেটসএর কথায় এটা পরিষ্কার যে, কেউই আসলে এই মুহুর্তে আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলে ভ্যাকসিন কারখানার কথা চিন্তা করছেন না। আর ‘এসট্রাজেনেকা’র কোন কারখানা কোন দেশের সীমানার মাঝে অবস্থিত, তা যখন ব্রিটেন এবং ইইউএর মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে, তখন আফ্রিকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ভ্যাকসিন কারখানা তৈরি করাটা অবাস্তবই শোনাবে। ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’এর এই পরিস্থিতি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় আদর্শ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থই সকল সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। একইসাথে মানুষের জীবন নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির উপর প্রভাবই জাতীয় সিদ্ধান্তের পিছনে মূল প্রেরণা।

Saturday 23 January 2021

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বন্দ্বের সমাধান বাইডেন প্রশাসনের হাতে নেই

২৩শে জানুয়ারি ২০২১

১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানি ঔপনিবেশিক সময়ে কোরিয়দেরকে জোরপূর্বক কারখানায় কাজ করাবার ব্যাপারে আদালতের রায়ের পর জাপানি দূতাবাসের বাইরে কোরিয়দের বিক্ষোভ। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপান এবং কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। কিন্তু দুই দেশের দ্বন্দ্ব এতটাই গভীর যে, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে এর সমাধান দেয়া সম্ভব নয়।


গত ৮ই জানুয়ারি জাপান সরকারের মন্ত্রীসভা দক্ষিণ কোরিয়াতে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কোয়িচি আইবোশিকে নিয়োগ দেয়। ‘নিকেই এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তিনি ২০১৮ সাল থেকে ইস্রাইলে জাপানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আইবোশি এর আগে দু’বার কোরিয়াতে কূটনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি কোরিয়াতে জাপানি দূতাবাসের সেক্রেটারি ছিলেন। এরপর ২০০৬ সাল থেকে তিনি সেখানে আবারও নিয়োগ পান রাজনীতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে। সেসময় কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রোহ মুন হিউন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন তখনকার প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। জাপানি সরকার আইবোশির সেই অভিজ্ঞতাগুলিকেই কাজে লাগাতে চাইছে। তবে অনেকেই বলছেন যে, কোয়িচি আইবোশির কাজ খুব একটা সহজ হবে না। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জাপানের সাথে কোরিয়ার সম্পর্ক বেশ খারাপই যাচ্ছে। যেদিন আইবোশির নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেদিনই দক্ষিণ কোরিয়াতে জাপান বিরোধী আবেগ নতুন করে জেগে ওঠে। সিউলের জেলা আদালতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাদের যৌন সম্ভোগের জন্যে ব্যবহৃত ১২ জন মহিলার পক্ষে এক রায় দেয়া হয়। রায়ে জাপানি সরকারকে বেঁচে থাকা একেকজন মহিলাকে এবং মৃত মহিলাদের পরিবারকে ৯১ হাজার ডলার সমমূল্যের ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। ২০১৩ সালে ‘কমফোর্ট উইমেন’ বলে পরিচিত এই মহিলারা জাপান সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করে। আদালত বলে যে, জাপান রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দায় এড়াতে পারে না; এবং এটা মানবাধিকার বিরোধী। জাপানি প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে শুগা এই মামলা বাতিল করে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন কোরিয়দের কাছে। শুগা বলেছিলেন যে, একটা স্বার্বভৌম রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের আদালতের রায় মানতে বাধ্য থাকতে পারে না। শুগা বলেন যে, জাপান এই রায় কোনভাবেই মানবে না; কারণ এটা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, কোরিয় সরকার আদালতের রায়কে শ্রদ্ধা করে এবং অত্যাচারিত মহিলাদের সন্মান রক্ষার্থে সরকার সকলকিছু করবে। দুই দেশের পক্ষ হতে এই ইস্যুতে ভিন্নমত আসার কারণে এবং কোরিয়ার জনগণের কাছে এটা আবেগের ইস্যু হবার কারণে সামনের দিনগুলিতে দুই দেশের সম্পর্কে উষ্ণতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। আর একারণেই এ দ্বন্দ্বের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।

বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৫ সালে উভয় দেশ কোরিয়ার ‘কমফোর্ট উইমেন’দের ব্যাপারটা চিরতরে সমাধান করে বলে ঘোষণা দেয়। সেসময় তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ব্যক্তিগতভাবে এই মহিলাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাদের জন্যে জাপান সরকারের ৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবার ঘোষণা দেন। সেসময় কিছু মহিলার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করে বলা হয় যে, এই সিদ্ধান্ত তাদের সাথে কথা না বলেই নেয়া হয়েছে; এবং এতে তাদের সাংবিধানিক অধিকার ব্যাহত হয়েছে। ২০১৭ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন এব্যাপারে নতুন নীতিতে এগুলে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের অবণতি হয়। জাপান সরকার বলছে যে, ১৯৬৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী এই ইস্যু সমাধান হয়ে যায়। সেসময় কোরিয়াকে জাপান প্রায় ৩’শ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়; যার বর্তমান মূল্য প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার। সেই অর্থ কোরিয়ার অর্থনীতি গড়ে তোলায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু মুন জে ইনএর সরকার বলে যে, সেই চুক্তিতে ব্যক্তিগত কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে কোরিয়ার ক্ষমতাসীন দলের আইনপ্রণেতা ইউন মী হিয়াংএর বিরুদ্ধে ‘কমফোর্ট উইমেন’দের জন্যে জাপান থেকে আসা ফান্ড অন্য খাতে সরনোর অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও ২০১৮ সালে কোরিয়ার আদালতে কয়েকটা রায়ে ১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়াতে জাপানি ঔপনিবেশিক সময়ে কোরিয়ার জনগণকে জোরপূর্বক কারখানা এবং খনিতে কাজ করানোর জন্যে জাপানি কোম্পানিগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। ২০১৯ সালে জাপান সরকার কোরিয়ার সাথে প্রযুক্তি সরবরাহে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেবার হুমকি দিলে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, দুই দেশ তাদের মাঝে স্বাক্ষরিত ইন্টেলিজেন্স আদানপ্রদানের চুক্তি থেকে বের হয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মার্কিন হস্তক্ষেপে শেষ মুহুর্তে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একটা দেশের আদালত আরেকটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না। কিন্তু কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন বলছেন যে, আদালতের উপর তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র বিশ্লেষক লরেন রিচার্ডসন বলছেন যে, দুই দেশ এতটাই ভিন্নপথে চিন্তা করছে যে, এদেরকে কাছাকাছি আনাটা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকারের জন্যে বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, যুদ্ধকালীন সময়ে জাপানি কোম্পানিতে কোরিয়দের জোরপূর্বক কাজ করানোর ইস্যুটা দুই দেশের সম্পর্ককে বেশি পরীক্ষার মাঝে ফেলবে। কারণ কোরিয়ার আদালত জাপানি কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে রায় বাস্তবায়ন করতে পারবে। জাপান সরকার জাপানি কোম্পানির বিরুদ্ধে কোরিয়ার ব্যবস্থা নেয়াকে ভালো চোখে দেখবে না। ‘কোবে ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর কান কিমুরা ‘জাপান টাইমস’কে বলছেন যে, বাইডেন প্রশাসনের চোখে ভালো থাকার জন্যেই কোরিয়রা জাপানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রসর হবে, যাতে উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখা যায়। অপরদিকে ‘ইউনিভার্সিটি অব শিজুওকা’র প্রফেসর সুসুমু কোহারি বলছেন যে, জাপানি প্রধানমন্ত্রী শুগা কোরিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ বাড়িয়ে কিছু করবেনা না। ২০১৫ সালের চুক্তি মান্য না করার কারণে শুগা কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুনকে বিশ্বাস করেন না। তাছাড়া উভয় দেশের নেতারাই ছাড় দিয়ে নিজ দেশে ভোট ব্যাংক হারাতে চান না। ২০১৬ সালে ওবামা প্রশাসনের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন জো বাইডেন ‘দ্যা আটলান্টিক’এর সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন যে, দুই দেশের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাটা হলো ‘তালাকের আইনজীবী’র মতো। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপান এবং কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। কিন্তু দুই দেশের দ্বন্দ্ব এতটাই গভীর যে, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে এর সমাধান দেয়া সম্ভব নয়।

Sunday 17 January 2021

ভূরাজনীতিতে করোনা মহামারির প্রভাব কতটুকু?

১৭ই জানুয়ারি ২০২১


করোনা মহামারির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ৯ কোটি ৫০ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে; যার মাঝে ২০ লক্ষ ৩২ হাজার ৭’শ ৫০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র ১৫ই জানুয়ারি এক দিনেই মৃত্যুবরণ করেছে ১৪ হাজার ৯’শ ১৩ জন। এর তুলনায় গত এপ্রিলের ১৭ তারিখে মৃতের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৫’শ ২৭ জন। অর্থাৎ প্রথম ঢেউএর তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউএ মৃতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত জুলাই মাসে এই সংখ্যা বেশ বাড়লেও তা ২২শে জুলাইএর ৭ হাজার ৩’শ ২৬ জনের বেশি ছিল না। সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; ৪ লক্ষ ৫ হাজার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্রাজিলে; ২ লক্ষ ৯ হাজার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ভারতে; ১ লক্ষ ৫২ হাজার। চতুর্থ সর্বোচ্চ মেক্সিকোতে; ১ লক্ষ ৪০ হাজার। এরপর রয়েছে ব্রিটেন ৮৮ হাজার; ইতালি ৮২ হাজার; ফ্রান্স ৭০ হাজার; রাশিয়া ৬৫ হাজার; ইরান ৫৭ হাজার; স্পেন ৫৩ হাজার; কলম্বিয়া ৪৮ হাজার; জার্মানি ৪৭ হাজার; আর্জেন্টিনা ৪৫ হাজার; পেরু ৩৯ হাজার; দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৭ হাজার; পোল্যান্ড ৩৩ হাজার। প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যার মাঝে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে বেলজিয়ামে; ১’শ ৭৫ জন মানুষের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্লোভেনিয়া ১’শ ৫৩ জন; ইতালি ১’শ ৩৫ জন। জনসংখ্যার বিচারে মৃত্যুর সংখ্যা ইউরোপে সবচাইতে বেশি। প্রথম ১০টা দেশের সবগুলিই ইউরোপের। ১১তম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও ১৫তম স্থানে পেরু, ১৮তম স্থানে পানামা এবং ১৯তম স্থানে মেক্সিকো ছাড়া প্রথম ২০টা দেশের ১৬টাই ইউরোপের। বলাই বাহুল্য যে, ইউরোপ এবং আমেরিকা করোনা মহামারিতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

করোনা মহামারির প্রভাব সারা বিশ্বের উপর পরলেও সকল ক্ষেত্রে এর প্রভাব এক নয়। ভূরাজনীতিতে মহামারির প্রভাব হিসেব করতে গেলে ইউরোপ এবং আমেরিকার কথাই আসবে শুরুতে। একইসাথে সেই অঞ্চলগুলিতে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের কথাগুলি আসবে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। তবে করোনার সরাসরি প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধ্বস নামায় বিশ্বের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলির কথাও চলে আসবে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনকে নিয়ে থাকবে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। এছাড়াও আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে সবচাইতে বড় সরবরাহকারী মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়েও কথা হবে। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার নিম্নগামিতাকে করোনাভাইরাস আরও দ্রুতগামী করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুর্বলতার সময়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলি ভূরাজনৈতিক শূণ্যস্থানগুলি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে। এতে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও প্রবল হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার অনেকটাই মহামারির আগে থেকেই চললেও এর উপর মহামারির প্রভাব উল্লেখ করার মতো।

মহামারির মাঝেও চলেছে লিবিয়ার যুদ্ধ; যেখানে তুরস্ক হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছে। নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে চলেছে যুদ্ধ; সেখানেও তুরস্ক হস্তক্ষেপ করেছে। হিমালয়ের পাদদেশে ভারত এবং চীনের মাঝে হয়েছে সংঘর্ষ; যদিও তা পুরোদস্তর সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়নি। ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন অব আফ্রিকা’র ইথিওপিয়াতে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সৌদি গ্রুপের দেশগুলিও তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে। এই ঘটনাগুলির উপর মহামারির সরাসরি প্রভাব না থাকলেও পরোক্ষ প্রভাব কিছুটা হলেও ছিল।

পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ

মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স এন্ড সাসটেইনেবাল ডেভেলপমেন্ট’এর এক লেখায় বলছেন যে, মহামারির সমাধান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাছে চাওয়া হলেও তারা সেই মুহুর্তে কোন প্রতিষেধক বা ঔষধ দিতে সক্ষম হয়নি। তদুপরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যখন ভেন্টিলেটর, মাস্ক এবং টেস্টিং কিটের মতো জিনিসগুলি চাওয়া শুরু করলো, তখন তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সামাজিক ব্যবস্থাকেও চাপের মাঝে ফেলে দিলো। আর পুরো ব্যাপারটার দায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও চাপের মাঝে পড়ে গেলো। মহামারি মারাত্মক আকার ধারণ করায় তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে আসা সামাজিক সমাধানকেই বেছে নেয়া হলো; যেটাকে বলা হলো লকডাউন। কিন্তু এর ফলে অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো। অর্থাৎ এই মুহুর্তে সহজলভ্য মেডিক্যাল সমাধান অর্থনৈতিক ধ্বস ডেকে আনছে। তবে জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, অর্থনীতি স্থবির করে ফেলার ফলাফল হলো দীর্ঘমেয়াদে পুরো অর্থনীতিকেই ধ্বংস করে ফেলা। কাজেই মেডিক্যাল সমাধানের চাপ সহ্য করার জন্যে স্বল্প মেয়াদে রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে দেয়া হলো অর্থনৈতিক প্রণোদনা। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, অর্থনীতি স্থবির করে দিয়ে লকডাউনের সমাধান কোন টেকসই সমাধান নয়। জনগণকে ঘরের মাঝে আটকে থাকতে বাধ্য করলে অর্থনৈতিক, পারিবারিক, মনস্তাত্বিক এবং সামাজিক চাপে পড়ে একসময় তারা নিয়ম ভেঙ্গে বের হয়ে আসবেই। জোরপূর্বক লকডাউন বাস্তবায়নের ফলাফল হবে ভয়াবহ সামাজিক অসন্তোষ। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি ছাড়াও সামাজিক সংস্থাগুলির উপর মানুষের আস্থা বিলুপ্ত হবে। মানুষের কাছে মনে হতে থাকবে যে, এর কোন সমাধান কেউ দিতে পারেনি।

‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব শুধু ব্যাপকই ছিল না, এটা হবে সুদূরপ্রসারী। আর চীনে যখন রোগের প্রদুর্ভাব শুরু হয়, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন যে, ‘লকডাউন’এর মতো একটা সমাধানের পথে এগুলে রোগের সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো যে, লকডাউন পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে মোটামুটি কাজ করলেও ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়াতে তেমন সফল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং ব্রাজিল মিলেই গোটা বিশ্বের মোট সংক্রমণের এক তৃতীয়াংশ হয়ে গিয়েছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক বিশ্লেষণে করোনা পরবর্তী বিশ্বের একটা মলিন ছবি আঁকা হয়। সেখানে লেখা হয় যে, মার্কিন নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি করা বিশ্বব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে। এই বিশ্বব্যবস্থার মাঝে রয়েছে লিবারাল গণতান্ত্রিক ভাবধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইনের শাসন, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলির মদদে গড়ে ওঠা কতগুলি আন্তর্জাতিক সংস্থা। পশ্চিমা দেশগুলির অর্থনীতি সমস্যায় পতিত হবার সাথেসাথে চীনের উত্থান হচ্ছে। এবং একইসাথে বৈশ্বিক মহামন্দার মাঝে একেকটা দেশ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিতে তৈরি করা সংস্থাগুলি নিজেদের ব্যর্থতাকে লুকাতে সক্ষম হয়নি। আটলান্টিকের দুই পাড়ের দেশগুলি নিজেকে বাঁচাতে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। বিশ্বে আইনের শাসন, চিন্তার স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই সেরকম পদক্ষেপ নেবার সক্ষমতা রাখে? অন্ততঃ ২০২০এর নভেম্বরে চরম বিরোধপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এক বিভক্ত রাষ্ট্রকে মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র সেই সক্ষমতা কতটুকু দেখাতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

 

অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং সামাজিক অসন্তোষ

অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগেই বিশ্ব অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলছিল। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, জিডিপির নিম্নগামিতা, ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের ব্যাপক বৃদ্ধি, এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপক পার্থক্য, ইত্যাদি সমস্যা বিশ্বে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি করার ক্ষেত্র তৈরি করেই রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর পর যে ব্যাপক বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল, তার ভিতও ছিল মূলতঃ অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং মহামারির মাঝে ব্যাপক বেকারত্বের করাল গ্রাসের বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই বিক্ষোভ এবং সহিংসতার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যেগুলির ফলাফল অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে; আর একনায়কোচিত দেশগুলিতে সরকারগুলি হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রতিবাদী জনগণের উপর আরও বেশি করে চড়াও হবে।

তুরস্কের আনতালিয়া বিলিম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর তারিক ওগুজলু ‘ডেইলি সাবাহ’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বহুগুণে বেড়ে যাবার কারণেই মূলতঃ করোনাভাইরাস সারা দুনিয়াতে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণে চীনের অর্থনীতি স্থবির হবার সাথে সাথেই চীনের সাপ্লাই চেইনের উপর নির্ভরশীল দেশগুলিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা

‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বিশ্বায়নের বিরুদ্ধাচরণ করে জাতীয়তাবাদের উত্থান মহামারির আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের একে অপরকে দোষারোপ করে দ্বন্দ্বে জড়ানোটা করোনার কারণে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। তবে প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মন্দার পরপর যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজের অর্থনীতিকে পুনরায় দাঁড় করাতে এবং বিশ্বব্যাপী তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ জড়িয়ে ব্যস্ত ছিল, সেই সুযোগে চীন শূণ্যস্থান পূরণে মনোযোগী হয়েছিল। ঠিক একইভাবে করোনা মহামারির মাঝে পশ্চিমা শক্তিরা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সেসময় চীনারা দক্ষিণ চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে নিতে চাইছে। এর সমান্তরালে হংকংএর আন্দোলনকারীদের যখন চীনা সরকার জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, তখন পশ্চিমা দেশগুলি আন্দোলনকারীদের পক্ষাবলম্বণ করে চীনের সাথে দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করছে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কিন কোম্পানিগুলি চীন ছাড়তে শুরু করেছে এবং ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমছে। তবে হংকংএর আন্দোলন চীনের উইঘুর এবং তিব্বতের মতো অঞ্চলগুলিতে যেনো ছড়িয়ে না পড়ে, সেব্যাপারে চীনা সরকার যথেষ্ট সাবধান থাকতে চাইবে।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, করোনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের প্রযুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। চীনারা করোনা নিয়ন্ত্রণে ‘বিগ ডাটা’, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’, ‘ফেশিয়াল রেকগনিশন’ এবং ড্রোনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে চীনকে প্রযুক্তিতেই শুধু এগিয়ে নেবে না, নিজ জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও বৃদ্ধি করবে। চীনারা ‘মেইড ইন চায়না ২০২৫’ প্রকল্পের অধীনে অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকার উদ্দেশ্যে আরও বিনিয়োগ করবে। আর উল্টোদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলি চীনের উপর প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা কমাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের সাথে দূরত্ব তৈরি করতে থাকবে। তবে মার্কিনীরা চীন থেকে তাদের শিল্পগুলিকে সরিয়ে নেবার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করছে, তা বাস্তবায়ন করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুব সহজ হবে না। আর চীনের বড় বাজার হারিয়ে কোন কোম্পানিই নিজেদের আয় কমাতে চাইবে না।

তারিক ওগুজলু বলছেন যে, মহামারির কারণে ‘গ্লোবালাইজেশন’ বা বিশ্বায়ন হয়তো কিছুটা স্থবির হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার কারণে চীন আঞ্চলিকভাবে নিজস্ব একটা ‘বিশ্বায়ন’এর দিকে এগুবে। সাপ্লাই চেইনের মাঝে নিজেদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ না হলে কঠিন সময়ে তা কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দেখেছে। সেই হিসেবেই তারা চাইবে পারস্পরিক একটা নির্ভরশীলতা তৈরি করতে, যাতে ভবিষ্যতে আবারও বিপদে পড়তে না হয়। চীনের আশেপাশের দেশগুলি চীনের আগ্রাসী তৎপরতাতে ভীত হলেও এটা তারা বুঝতে পারছে যে, মহামারির পর অর্থনৈতিকে পুনরায় জাগাতে চীনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউএর উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করাটা মোটেই সমীচিন নয়। বৈশ্বিকভাবে চীনা এবং মার্কিনী মডেলের প্রতিযোগিতা হবে। স্বাস্থ্য, টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন, ইত্যাদি বিষয়ে এই প্রতিযোগিতা হবে। উভয় দেশই নিজেদের উন্নয়নের মডেল অন্যান্য দেশের কাছে বিক্রি করতে চাইবে। চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ আলোচনায় আসতেই থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ‘মার্শাল প্ল্যান’এর মতো কোন পরিকল্পনা নিয়ে আসতে না পারে, তাহলে চীনকে সরিয়ে দিয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কষ্টকরই হবে।

এশিয়ায় ব্রিটেনের প্রত্যাবর্তন

করোনা মহামারির মাঝে ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাবার প্রক্রিয়া বন্ধ থাকেনি। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার সুযোগ নিতে এবং একইসাথে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ব্রিটেন ইইউএর গন্ডি থেকে বের হয়ে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাইছে। ব্রিটেনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেন ইন্দোপ্যাসিফিককে আরও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ইন্দোপ্যাসিফিকের জন্যে নতুন একজন ডিরেক্টর জেনারেল নিয়োগ দিচ্ছে। একইসাথে ব্রিটেন তার ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলকে একটা ‘ফ্রেমওয়ার্ক’এর মাঝে সাজাচ্ছে। এশিয়াতে সামরিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার জন্যে ব্রিটিশ সরকার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে। এই সামরিক অবস্থানের মূল কেন্দ্রবিন্দু ভারত মহাসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য হলেও তা দক্ষিণ চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

 

মধ্যপ্রাচ্যে দ্বন্দ্ব এবং তেলের বাজারে অস্থিরতা

‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি ঘোষণা করার ঠিক আগে আগেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কুদস ফোর্সের জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করে। এছাড়াও লেবানন এবং ইরাকের রাস্তায় হাজারো মানুষের বিক্ষোভ গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে রেখেছিলো আরও আগ থেকেই। শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং নিম্নগামী অর্থনীতি মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিলো। এছাড়াও সিরিয়া, ইয়েমেন এবং লিবিয়ার যুদ্ধও চলমান ছিলো। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় ইরানের সাথে সৌদি আরব এবং তুরস্কের সাথে আমিরাতের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছিল। ইরান এবং তুরস্ক উভয়েই আঞ্চলিকভাবে তাদের প্রভাব বিস্তারে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবে একইসাথে তেলের বাজারে দরপতনের কারণে তেল রপ্তানির উপর নির্ভরশীল ধনী দেশগুলির অর্থনীতি যেমন ধাক্কা খেয়েছে, তেমনি এই দেশগুলিতে মানবসম্পদ রপ্তানির উপর নির্ভরশীল দেশগুলিও সমস্যায় পতিত হয়েছে। আর অর্থনৈতিক দৈন্যতা ও অব্যাবস্থাপনার ফলশ্রুতিতে শাসকশ্রেণীর উপর জনগণের আক্রোশ বেড়েই চলেছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব পুরো অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, করোনা মহামারি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ এবং ভাইরাসের চাপে পড়ে ইরান হয়তো আঞ্চলিকভাবে আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এতে সৌদি গ্রুপের দেশগুলির সাথে যেমন ইরানের সংঘাত বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে, একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রাইলও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে।

‘ইউনিভার্সিটি অব ডেনভার’এর এর প্রফেসর হায়দার খান ‘আল জাজিরা’তে এক লেখায় বলছেন যে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের ব্যাপক দরপতনের সময় রাশিয়া নিজেকে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে রাশিয়া নিজের অর্থনীতিকে বেশ কিছুটা বহুমুখীকরণ করে নিয়েছে। তেলের মূল্য কমে যাবার কারণে আমদানিকারক হিসেবে চীন বেশ লাভবান হয়েছে। অপরদিকে করোনার কারণে স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণে তেলের বাজার নিয়ে প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামিতা গতিশীল হতে পারে এবং চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা ঢুকে পড়তে পারে। চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্তগুলি সংঘাতের সম্ভাবনাকে বাড়িতে দিতে পারে।

 

উদ্দেশ্যবিহীন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান

‘হাডসন ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, করোনাভাইরাস ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অস্তিত্বকেই হুমকির মাঝে ফেলে দিচ্ছে। ইইউ তৈরি হয়েছিল এমন একটা সমঝোতার মাঝ দিয়ে, যার মাধ্যমে ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে কোন ঝামেলা থাকবে না। সদস্য দেশগুলি এটা মেনে নেবে কারণ এর বিনিময়ে তারা ইইউএর অন্য দেশগুলির বাজারে কোন বাধা ছাড়াই ঢুকতে পারবে। কিন্তু বর্তমান ইইউএর মূল সমস্যা হলো জনগণের আনুগত্য ইইউএর প্রতি নয়, বরং তাদের নিজ দেশের প্রতি। যতদিন ইইউ তার সদস্য দেশগুলিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখাতে পেরেছে, ততদিন তারা ইইউএর সদস্য থাকার পিছনে শক্তিশালী কারণ পেয়েছে। তবে সিরিয়া, লিবিয়া ও মালির যুদ্ধের ফলে ইউরোপে শরণার্থীর ঢল এবং অর্থনৈতিক মহামন্দায় ইইউএর অস্তিত্ব প্রশ্নের মাঝে পড়েছে। উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলির মাঝে বৈষম্য সকলের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপ জুড়ে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের উত্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে, যারা বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলছে। ইউরোপের দেশগুলিতে রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের ভোট পেতে জাতীয়তাবাদকেই ব্যবহার করবে। তারা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ইউরোপিয় সমাধান নয়; জাতীয় সমাধানের পথ খুঁজবে। মহামারি ব্যবস্থাপনায় ইইউএর দুর্বল পদক্ষেপগুলি জনগণের কাছে ইইউএর চিন্তাটাকে অবান্তর করে তুলবে। আর করোনাভাইরাসের কারণে মার্কিন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির উপর নির্ভরশীল ইউরোপের অর্থনীতি, বিশেষ করে জার্মানির অর্থনীতি, চাপের মুখে পড়বে।

জর্জ ফ্রীডম্যান আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, মহামারির সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ইউরোপের জনগণ তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দিকেই তাকাবে; কারণ সেই নেতৃবৃন্দের তাদের জনগণের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। ব্রাসেলসের ইইউ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে জনগণ এই সমস্যার সমাধান আশা করে না। জাতীয় দুর্যোগের সময় জনগণের কাছে জাতীয় পরিচয় এবং স্বশাসনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেকারণেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি জাতীয় নেতৃবৃন্দই নিচ্ছে; ইইউ নিচ্ছে না। যদিও ইইউএর সব দেশেই মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে, তথাপি তারা নিজেদের জান মালের নিরাপত্তা দিতে অন্য দেশের সাথে সীমানা আটকে রাখার পথেই এগিয়েছে। এক্ষেত্রে ইইউএর সীমানাবিহীন চিন্তা কাজ করেনি। একটা জোট কতটা ভালোভাবে কাজ করছে, তা বুঝতে হলে দেখতে হবে তারা খারাপ সময়ে কিভাবে কাজ করে। কঠিন সময়ে ইউরোপের দেশগুলি নিজেদের স্বার্থকেই প্রথমে দেখেছে; তারপর অন্যের স্বার্থ দেখেছে। নিজ ভাষা, ইতিহাস এবং বিশ্বাসের মাঝেই ইউরোপিয় দেশগুলি নিজেদের গন্ডিকে সীমাবদ্ধ করেছে। বাকিরা সবসময়ই কম প্রাধান্য পেয়েছে। ইইউ তৈরি হয়েছিল এই দেয়ালগুলি ভেঙ্গে ফেলার জন্যে; তা সফল হয়নি। ইউরোপিয়ান পরিচয় তৈরি করার চেষ্টাটা যতটা সফল হবে বলে ভাবা হয়েছিল, তা হয়নি।

ফ্রীডম্যান শুধু ইইউএর মাঝেই দেয়াল তোলার কথা বলেননি। তিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের একটা রাজ্য আরেকটা রাজ্যের সাথে প্রায় একই ধরণের ব্যবহার করেছে। যেমন টেক্সাসের গভর্নর পার্শ্ববর্তী লুইজিয়ানা রাজ্যের সাথে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিল, কারণ টেক্সাসের চাইতে লুইজিয়ানায় সংক্রমণ বেশি ছিল তখন। কিন্তু লুইজিয়ানার সাথে সীমানা বন্ধ করেও টেক্সাস তার সংক্রমণ থামাতে পারেনি। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, দেয়াল তুলে দেয়ার ব্যাপারটা ইউরোপের একার নয়। তবে ইউরোপের ক্ষেত্রে এর পিছনে একটা লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এক দেশ আরেক দেশের সাথে যুদ্ধ করেছে; সর্বদা সংঘাতের ভয় তাদের গ্রাস করেছে। টেক্সাস এবং লুইজিয়ানার মাঝে মনোমালিন্য খুব বেশিদূর হয়তো যাবে না; তবে ইইউএর সদস্য দেশগুলির জন্যে এই বিভেদ মারাত্মক। একইসাথে মার্কিনীদের চোখে বাকি বিশ্বের প্রতি অবিশ্বাসও হবে মারাত্মক। বৈশ্বিক সংস্থাগুলির উপর মানুষের আস্থাটাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Wednesday 13 January 2021

রাশিয়া কেন মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছে?

১৪ই জানুয়ারি ২০২১ 

রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ার জন্যে কিছু প্রযুক্তি যোগাড় করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যেগুলি মহাকাশে রাশিয়ার পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যক স্যাটেলাইট রাখাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এমতাবস্থায় রাশিয়া চাইছে মহাকাশে হুমকি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক দরকষাকষি করতে। যুক্তরাষ্ট্র বহুবছর ধরে চেষ্টা করেও তাদের স্যাটেলাইট ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। হয়তো এই সুযোগটাই রাশিয়া নিতে চাইছে। বিশেষ করে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট যখন চীন, তখন রাশিয়া তার দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরাতে সবকিছুই করবে। 


গত ১৬ই ডিসেম্বর মার্কিন সামরিক বাহিনীর স্পেস কমান্ডের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, রাশিয়া মহাকাশকে একটা যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করার দিকে এগুচ্ছে। রাশিয়া নতুন করে একটা স্যাটেলাইট ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়। এটা ২০২০ সালে রাশিয়ার এরকম তৃতীয় পরীক্ষা। স্পেস কমান্ড বলছে যে, এরকম ক্ষেপণাস্ত্র নিম্ন কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে সক্ষম। আর এরকম একটা স্যাটেলাইট ধ্বংস হলে এর ধ্বংসাবশেষ আশেপাশের স্যাটেলাইটের জন্যে হুমকি তৈরি করবে। মার্কিন স্পেস কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল জেমস ডিকিনসন এক বিবৃতিতে বলেন যে, রাশিয়া মুখে বলছে যে তারা মহাকাশে যুদ্ধ চায় না; কিন্তু তারপরেও তারা মহাকাশ এবং ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন সক্ষমতা তৈরি করছে, যা স্যাটেলাইটের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতাকে দুর্বলতা হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছে যে, রাশিয়া দুই ধরনের স্যাটেলাইট ধ্বংসী অস্ত্র ডেভেলপ করছে। এর একটা হলো ‘ডিরেক্ট এসেন্ট এন্টি স্যাটেলাইট’, যা মূলত ভূমি থেকে ছোঁড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র। আর দ্বিতীয়টা হলো ‘কো অরবিটাল এন্টি স্যাটেলাইট’, যার মাধ্যমে মহাকাশে একটা স্যটেলাইট আরেকটা স্যটেলাইটের উপর হামলা করে। রাশিয়ার মহাকাশ ভিত্তিক এই পরীক্ষাগুলির উদ্দেশ্য বুঝতে হলে এই প্রকল্পগুলির বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

গত জুলাই মাসে মার্কিন স্পেস কমান্ড জানায় যে, রাশিয়া আরও একটা স্যাটেলাইট ধ্বংসী ব্যবস্থার পরীক্ষা চালিয়েছে। ‘কসমস ২৫৪৩’ নামের এই স্যাটেলাইট মহাকাশে গিয়ে আরেকটা বস্তুকে মহাকাশে ছেড়েছে। এর মাধ্যমে কোনকিছু ধ্বংস করা ছাড়াই রুশরা একটা ‘কো অরবিটাল এন্টি স্যাটেলাইট’ ব্যবস্থার পরীক্ষা চালালো। এর আগে এপ্রিল মাসে রাশিয়া ডিসেম্বরের মতোই একটা এন্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছিল। ২০২০এর ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা বলে যে, দু’টা রুশ স্যটেলাইট মহাকাশে মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের উপর নজরদারি করছে। এর মাঝে একটা স্যাটেলাইট ছিল সেই ‘কসমস ২৫৪৩’, যা নিজের পেটের ভেতর থেকে আরেকটা স্যাটেলাইটের ‘জন্ম’ দেয়। রুশ স্যাটেলাইটগুলি মার্কিন স্যাটেলাইটের মাত্র ১’শ ৬০ কিঃমিঃএর মাঝে চলে আসে। মার্কিন জেনারেল জন রেইমন্ড ‘টাইম’ ম্যাগাজিনকে বলেন যে, রুশ স্যাটেলাইটের এহেন কর্মকান্ড খুবই অদ্ভুত এবং বিরক্তিকর। তিনি বলেন যে, মার্কিনীরা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে রুশদের কাছে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। রুশ কর্মকর্তারা রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’কে বলছেন যে, এই স্যাটেলাইট ছিল ইন্সপেক্টর স্যাটেলাইট, যার কাজ হলো অন্য রুশ স্যাটেলাইটের টেকনিক্যাল অবস্থা পরীক্ষা করা।

মহাকাশ গবেষক মাইকেল থম্পসন প্রথমবারের মতো রুশ স্যাটেলাইটের এই কর্মকান্ডকে অবলোকন করে টুইটারে পোস্ট দেন। তিনি বলেন যে, রুশ স্যটেলাইট মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ‘ইউএসএ ২৪৫’এর কাছাকাছি কক্ষপথে নিজের অবস্থান নিয়েছে। মার্কিন স্যাটেলাইটটা হলো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল রেকনাইস্যান্স অফিস’এর ‘কেএইচ ১১’ স্যাটেলাইট। ‘কীহোল’ প্রকল্পের অধীন এই স্যাটেলাইটের কাজ হলো মহাকাশ থেকে ভূমির হাই রেজোলিউশন অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড ছবি তোলা। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’র ওয়েবসাইট বলছে যে, ২০১৩ সালে মহাকাশে পাঠানো এই স্যাটেলাইটের কর্মকান্ড গোপনীয়। ক্রিস পীটের ব্যবস্থাপনায় চলা স্যাটেলাইট মনিটরিং ওয়েবসাইট ‘হেভেন্স এবাভ’এর এক বিশ্লেষণে দেখানো হচ্ছে যে, মার্কিন স্যাটেলাইট ‘ইউএসএ ২৪৫’এর কক্ষপথ রাশিয়ার পূর্বদিকের শ্বেত সাগর থেকে শুরু করে কৃষ্ণ সাগরের মাঝামাঝি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলির উপর দিয়ে যায়। দিনে ১৫ বার এটা পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।

‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক লেখায় রাশিয়া বিশ্লেষক পাভেল লুজিন বলছেন যে, রাশিয়া মহাকাশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ‘ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েনটিস্টস’এর হিসেবে মহাকাশে ২ হাজার ২’শর বেশি স্যাটেলাইট রয়েছে, যার মাঝে ১ হাজারের বেশি মার্কিন। তন্মধ্যে ১’শ ৮৯টা সামরিক স্যাটেলাইট। রাশিয়ার ১’শ ৬০টা স্যাটেলাইটের মাঝে সামরিক স্যাটেলাইট ১’শটার মতো। চীনের ৩’শ ২০টা স্যাটেলাইটের মাঝে ১’শ ৫টা সামরিক। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের অর্থনীতি স্যাটেলাইটের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল; তবে রাশিয়া ততটা নয়। রাশিয়ার সামরিক স্যাটেলাইটগুলির মাঝে ৫১টাই যোগাযোগ স্যাটেলাইট; আর মাত্র ১৬টা হলো ভূমির ছবি তোলার স্যাটেলাইট। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে রয়েছে ৫৬টা ছবি তোলা স্যাটেলাইট, যোগাযোগ স্যাটেলাইট রয়েছে মাত্র ৪৯টা। চীনের ক্ষেত্রেও ছবি তোলার স্যাটেলাইট ৫৭টা হলেও যোগাযোগের স্যাটেলাইট মাত্র ৩টা। অর্থাৎ ছবি তোলার স্যাটেলাইট, যেগুলি মূলত ইন্টেলিজেন্সের জন্যে ব্যবহৃত হয়, সেখানেই রাশিয়া প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছে। লুজিন বলছেন যে, রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ার জন্যে কিছু প্রযুক্তি যোগাড় করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যেগুলি মহাকাশে রাশিয়ার পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যক স্যাটেলাইট রাখাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এমতাবস্থায় রাশিয়া চাইছে মহাকাশে হুমকি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক দরকষাকষি করতে। রাশিয়া জ্যামিং এবং এন্টি স্যাটেলাইটের মতো প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে চাইছে, যেগুলির উদ্দেশ্য হবে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক ব্যবহারে বাধা প্রদান করা।

প্রতিপক্ষের শতশত স্যাটেলাইট টার্গেট করাটা একটা অর্থহীন কর্মকান্ড। ‘ইউনাইটেড নেশনস ইন্সটিটিউট ফর ডিজআর্মামেণ্ট রিসার্চ’এর সিরিয়র রিসার্চ ফেলো পাভেল পডভিগ এক সেমিনারে মত দিচ্ছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই এন্টি স্যাটেলাইট ব্যবস্থা ডেভেলপ করতে চেয়েছিল। কিন্তু উভয়েই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, এরূপ ব্যবস্থা ডেভেলপ করে ফলাফল পাওয়া কঠিন। কেননা প্রতিপক্ষ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে এন্টি স্যাটেলাইটের সফলতাকে কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে। এরপরও উভয়েই এন্টি স্যাটেলাইটের প্রযুক্তি একেবারে ফেলে দেয়নি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘এসএম ৩’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে একটা কক্ষপথচ্যুত স্যাটেলাইট ধ্বংস করেছিল। ২০২০ সালের এপ্রিলে রাশিয়ার পরীক্ষা করা ‘নুডল’ এন্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রও এধরণেরই একটা অস্ত্র। তবে মহাকাশ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘সিকিউর ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন’এর ডিরেক্টর ব্রায়ান উইডেন মনে করছেন যে, বিভিন্ন কারণে একটা দেশের পক্ষে নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবস্থাকে আঘাত সহ্য করার মতো করে তৈরি করাটা খুব সহজ হয় না। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহুবছর ধরে চেষ্টা করেও তাদের স্যাটেলাইট ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। হয়তো এই সুযোগটাই রাশিয়া নিতে চাইছে। বিশেষ করে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট যখন চীন, তখন রাশিয়া তার দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরাতে সবকিছুই করবে। 

Sunday 10 January 2021

ওয়াশিংটন ডিসির সহিংসতার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

১১ই জানুয়ারি ২০২১
সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র এখন অভ্যন্তরীণভাবে ভীষণভাবে বিভক্ত। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা সকলের কাছে দৃশ্যমান; অনেকেই এই বিভাজনে ইন্ধন যোগাতেও পিছপা হবে না। কেউ কেউ সেই বিভক্তিতে কোন একটা পক্ষকে সরাসরি সমর্থন করছে; আবার কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত। সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পিছনে যতটা জোরেসোরে চেষ্টা চালিয়েছে এতকাল, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও কমলো। চীন এবং রাশিয়া ছাড়াও ছোট দেশগুলি নিজেদের মতো করেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দাঁড় করাবে এবং পশ্চিমা আদর্শকে ভূলুন্ঠিত করতে থাকবে।


গত ৬ই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা হামলা করে কিছু সময়ের জন্যে ক্যাপিটল হিলের পার্লামেন্ট ভবন দখলে নেয়। নজিরবিহীন এই সহিংসতায় কমপক্ষে ৪ জন নিহত হয় এবং অর্ধশতাধিক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সারা দুনিয়ার নেতৃবৃন্দ, চিন্তাবিদেরা এবং মিডিয়া তাদের অবস্থান ব্যক্ত করছেন। এহেন ঘটনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে কতটুকু, তা বুঝতে হলে এই বিবৃতিগুলির বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ৬ই জানুয়ারি এক টুইটার বার্তায় মার্কিন কংগ্রেসের ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক দৃশ্য’ বলে আখ্যা দেন। তিনি একইসাথে শান্তিপূর্ণ এবং নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, আইনগত ক্ষমতা হস্তান্তরকে বাধাগ্রস্ত করার পিছনে কোন যুক্তিই থাকতে পারে না। ব্রিটিশ বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা কেয়ার স্টার্মার এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, এটা ছিল গণতন্ত্র এবং জনগণের প্রতিনিধিদের উপর সরাসরি আঘাত, যারা জনগণের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করছেন।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ওয়াশিংটনের ঘটনাকে ‘ভীষণ দুঃখজনক’ ও ‘উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন যে, এটা পরিষ্কার যে, সময়টা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বেশ কঠিন যাচ্ছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ সরকার পরিবর্তন আশা করেন।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, উশৃংখল জনগণের কারণে গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। পরদিন এক টুইটার বার্তায় আরডার্ন বলেন যে, এই ঘটনায় যারা দুঃখ পেয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের এতাত্মতা থাকবে তাদের জন্যে। নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নানাইয়া মাহুতা এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, এত কঠিন সময়ের মাঝে জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হবার ব্যাপারে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত নেয়াটা ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালিয়ে নেবার পথে বড় একটা পদক্ষেপ।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ৬ই জানুয়ারি এক রেডিও ইন্টারভিউতে বলেন যে, তিনি ওয়াশিংটনের সহিংস ঘটনা দেখে ‘উদ্বিগ্ন’ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে ‘গণতন্ত্রের উপর এই হামলায় কানাডিয়রা ভীষণভাবে মর্মাহত’। দু’দিন পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ট্রুডো ঘটনার জন্যে ট্রাম্পকে সরাসরি দায়ী করেন। তিনি বলেন, এটা ছিল বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং কিছু রাজনীতিবিদের উস্কে দেয়া সহিংস দাঙ্গা। তবে তিনি মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র যথেষ্ট শক্তিশালী এবং উগ্রবাদীরা মানুষের ইচ্ছাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন

‘ডয়েচে ভেলে’র টুইটারে এক ভিডিও বার্তায় জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল বলেন যে, মার্কিন ক্যাপিটলএর ছবিগুলি তাকে একইসাথে ‘রাগান্বিত’ এবং ‘দুঃখিত’ করেছে। নির্বাচনের ব্যাপারে জনমনে যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই শেষ পর্যন্ত এই ঘটনাকে বাস্তবতা দিয়েছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ওয়াশিটনের এই বীভৎস ছবিগুলি দেখে গণতন্ত্রের শত্রুরা ভীষণ খুশি হবে। ট্রাম্প এবং তার সমর্থকদেরকে শেষ পর্যন্ত মার্কিন জনগণের রায়কে মেনে নিতে হবে এবং গণতন্ত্রের উপর আঘাত করা বন্ধ করতে হবে। জার্মান পত্রিকা ‘ডাই ওয়েল্ট’এর শিরোনামে বলা হয় যে, এটা ছিল মার্কিন গণতন্ত্রের জন্যে লজ্জার দিন। মিথ্যাবাদী প্রেসিডেন্ট এবং মেরুদন্ডহীন রিপাবলিকান পার্টিই এর জন্যে দায়ী।

৭ই জানুয়ারি টুইটারে এক ভিডিও বার্তায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ বলেন যে, অল্প কয়েকজন ব্যক্তির সহিংসতার কাছে তারা নতি স্বীকার করবেন না। তিনি ইংরেজিতে বলেন যে, ওয়াশিংটন ডিসিতে যা ঘটেছে তা নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র নয়। তিনি ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের শক্তির উপর আস্থা রয়েছে বলে বলেন।

তুরস্ক

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ক্যাপিটল হিলের ঘটনা তুরস্ক উদ্বিগ্নতার সাথে অবলোকন করছে। একইসাথে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সকল পক্ষকে সাবধানী হবার এবং প্রজ্ঞার মাধ্যমে কাজ করার উপদেশ দেয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, তুরস্ক আশা করছে যে, যুক্তরাষ্ট্র পরিপক্কতা দেখিয়ে এই অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলা করবে।

চীন

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’এর এক লেখায় বলা হয় যে, চীনারা এখনও ভুলতে পারেনি সেই দিনটার কথা, যেদিন হংকংএর দাঙ্গাকারীরা ব্যাপক সহিংসতা চালাচ্ছিল। সেই সময়ে দাঙ্গার বিরুদ্ধে কথা না বলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা দাঙ্গাবাজদের সাহসিকতার প্রশংসা করেছিলেন। চীনের সোশাল মিডিয়া ‘উইবো’র একজন ব্যাবহারকারীর বক্তব্য তুলে ধরে ‘দ্যা টাইম’ ম্যাগাজিন। সেখানে বলা হয় যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মফল। যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে সারা বিশ্বে আগুন লাগিয়েছে; এখন সেই ‘স্বাধীনতা’র আগুন তাদেরকেই পোড়াচ্ছে। আরেকজন বলেন যে, এখানে কোন আইন নেই; আইনের শাসন নেই। এটাই হলো সেই ‘গণতন্ত্র’, যা নিয়ে তারা গর্ব করে। চীনা সাংবাদিক সিমা নান ২০১৯ সালে মার্কিন পার্লামেন্টের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির এক কথাকে তুলে আনেন; যখন হংকংএর সরকার বিরোধী আন্দোলন দেখে তিনি বলেছিলেন ‘চমৎকার একটা দৃশ্য’। সিমা নান বলেন যে, ওয়াশিংটনের দৃশ্যটা ছিল আরও চমৎকার।

রাশিয়া

‘রাশান ফেডারেশন কাউন্সিল’এর পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান কন্সটান্টিন কসাচেভ এক ফেইসবুক পোস্টে বলেন যে, গণতন্ত্রের জয়জয়কার এখন শেষ। এটা প্রথমবারের মতোও হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্যে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করার পক্ষে এখন কোন যুক্তি নেই। আমেরিকা যেখানে নিজেই সেই পথে হাঁটছে না, সেখানে সেই পথের সংজ্ঞা দেয়ার অধিকারও সে হারিয়েছে; আর অন্যের উপর তার চাপিয়ে দেয়ার অধিকার থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের বিভাজন এতটাই গভীর যে, রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয় শিবিরই এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে খুশি হতে পারবে না। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা সাংবাদিকদের বলেন যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তবে রাশিয়া আবারও বলছে যে, মার্কিন নির্বাচনী পদ্ধতি একটা অতি পুরাতন পদ্ধতি এবং তা আধুনিক গণতান্ত্রিক মানদন্ডে পাস করে না। এতে নিয়ম বহির্ভূত কর্মকান্ডের সম্ভাবনা থাকে। একইসাথে তিনি বলেন যে, মার্কিন মিডিয়া রাজনৈতিক কোন্দলের হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে।

রুশ বিশ্লেষকেরা কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বেলারুশ এবং ইউক্রেনে মস্কোপন্থী সরকার উৎখাত করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র একসময় উস্কানি দিয়েছিল। রুশ রাজনীতিবিদ সের্গেই মারকভ ফেইসবুকে এক লেখায় বলেন যে, এটা আশ্চর্য ব্যাপার যে, যেসব মার্কিন রাজনীতিবিদ একসময় ইউক্রেন এবং বেলারুশের পার্লামেন্ট ভবন দখলের পক্ষে কথা বলেছিলেন, এবং ট্রাম্প সমর্থকদের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বিষয়ে রাস্তায় সহিংসতায় জড়াবার পক্ষে ছিলেন, তারাই এখন মার্কিন কংগ্রেসে হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন।

কারা কোন পক্ষে

বিবৃতিগুলি থেকে এটা পরিষ্কার যে, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অন্তর্গত ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা মোটামুটিভাবে সরাসরিই ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছে এবং জো বাইডেনের পক্ষ নিয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, ব্রিটেনের বৈশ্বিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কতটা জরুরি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জার্মানি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে। ২০২১ সালেই এঙ্গেলা মার্কেল জার্মান চ্যান্সেলর পদ ছেড়ে দিচ্ছেন, যা ইউরোপে একটা নেতৃত্বের শূণ্যতা তৈরি করতে পারে। ফ্রান্সও যত জোর গলায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছে, ততই তার দুর্বলতাটা প্রকাশ পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সের রাস্তা সহিংসতায় পরিপূর্ণ ছিল। ফ্রান্স এবং জার্মানি উভয় দেশেই ডানপন্থীদের উত্থান পশ্চিমা সেকুলার আদর্শকে দুর্বল করেছে। ক্যাপিটল হিলের ঘটনার মাঝে ইউরোপ নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে।

চীনা এবং রুশরা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনাতেই বেশি ব্যস্ত রয়েছে। হংকং, ইউক্রেন এবং বেলারুশের রাস্তায় সহিংসতার কথা মনে করে তারা ওয়াশিংটনের ঘটনা দেখে খুশিই হয়েছে। তারা হয়তো এই ভেবে খুশি হবে যে, তাদের দেশে গণতন্ত্রের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তারা একটা শক্ত যুক্তি পেয়েছে। রুশরা অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাম্পকেই সমর্থন দিয়েছে।

সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র এখন অভ্যন্তরীণভাবে ভীষণভাবে বিভক্ত। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা সকলের কাছে দৃশ্যমান; অনেকেই এই বিভাজনে ইন্ধন যোগাতেও পিছপা হবে না। কেউ কেউ সেই বিভক্তিতে কোন একটা পক্ষকে সরাসরি সমর্থন করছে; আবার কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত। সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পিছনে যতটা জোরেসোরে চেষ্টা চালিয়েছে এতকাল, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও কমলো। চীন এবং রাশিয়া ছাড়াও ছোট দেশগুলি নিজেদের মতো করেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দাঁড় করাবে এবং পশ্চিমা আদর্শকে ভূলুন্ঠিত করতে থাকবে।

Saturday 9 January 2021

সৌদি আরব এবং কাতারের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

০৯ই জানুয়ারি ২০২১

আল উলা, সৌদি আরব, জানুয়ারি ২০২১। বিমানবন্দরে কাতারের আমির আল থানিকে স্বাগত জানাচ্ছে সৌদি যুবরাজ বিন সালমান। বিশ্বব্যাপী প্রভাব হারালেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর মার্কিন প্রভাব যে এখনও যথেষ্ট, তা কাতারের ইস্যু থেকে পরিষ্কার হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থনপুষ্ট হয়েই সৌদিরা কাতারের উপর অবরোধ দিয়েছিল; আবার সেই একই প্রশাসন হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে আলোচনার পিছনে চাপ দিয়েছে।

গত ৭ই জানুয়ারি রাতে কাতারের রাজধানী দোহা থেকে ‘কাতার এয়ারওয়েজ’এর একটা ফ্লাইট সৌদি ভূখন্ডের উপর দিয়ে উড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ‘আল আরাবিয়া টিভি’ বলছে যে, সৌদি আরবের সাথে কাতারের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সাথে সাথে ২০১৭এর পর প্রথমবারের মতো কাতারের বিমান সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে। এর আগে ৫ই জানুয়ারি সৌদি আরবের আল উলা শহরে ‘গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল’ বা ‘জিসিসি’র ৪১তম শীর্ষ বৈঠকে আরব দেশগুলি সর্বসম্মতিক্রমে কাতারের উপর থেকে সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান সাংবাদিকদের বলেন যে, সকলে মিলে নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব ভুলে যাবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদে ইন্ধন দেবার অভিযোগে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং দেশটার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার জন্যে কাতারের কাছে সৌদি গ্রুপের মোট ১৩টা দাবি ছিল; যার মাঝে ছিল ‘আল জাজিরা’ টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া, কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা, ইরানের সাথে কাতারের সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা, এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে কাতারের সকল সম্পর্ক কর্তন। তবে সাড়ে তিন বছর পর দুই পক্ষের মাঝে মিলমিশ হয়ে যাবার কারণ কি? ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, উভয় পক্ষই এই দ্বন্দ্বকে চালিয়ে নেবার শক্তি হারিয়ে ফেলায় শান্তির পথ বেছে নিয়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে কুয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।

‘জিসিসি’ বৈঠকে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান বা ‘এমবিএস’এর কথাগুলি কাতারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কারণ সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত দেয়। বিন সালমান তার বক্তব্যে বলেন যে, এই অঞ্চলের দেশগুলির একত্রিত হবার জন্যে একটা বিরাট চাহিদা তৈরি হয়েছে; যার উদ্দেশ্য হবে বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করা, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রকল্পের হুমকি এবং স্যাবোটাজ ও ধ্বংসের পরিকল্পনা। ‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ২০১৭ সালে মার্কিন সরকার সৌদিদের পক্ষাবলম্বন করে এবং কাতারকে ‘সন্ত্রাসের অর্থায়নকারী’ হিসেবে আখ্যা দেয়; যদিও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় সামরিক ঘাঁটি হলো কাতারের আল উদাইদ। ২০১৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের প্রচেষ্টায় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কাতারের ভালো ভূমিকার কথা বলা হতে থাকে। ইরানকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত নীতির অংশ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন যখন উভয় পক্ষের উপর চাপ দিতে থাকে, তখনই আলোচনায় গতি আসে। ট্রাম্পের জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা ও জামাতা জ্যারেড কুশনার ডিসেম্বরে সৌদি আরব এবং কাতার সফর করেন। আল উলার বৈঠকেও তিনি ছিলেন বলে খবর পাওয়া যায়।

‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি তেলের খনিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর থেকে সৌদিরা কাতারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে মনোযোগী হয়। সৌদি এবং মার্কিনীরা হামলার জন্যে ইরানকে দায়ি করেছিল। সেবছরের অক্টোবরে সৌদি আরব সফরের পর ডিসেম্বরে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুররহিম আল থানি ‘সিএনএন’কে বলেন যে, সৌদিদের সাথে আলোচনার পর অন্ততঃ বন্ধ হয়ে যাওয়া কথাবার্তার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। তবে কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখার কথা অস্বীকার করে এবং কাতারে তুর্কি ঘাঁটি বন্ধ করার ব্যাপারে অপারগতা জানায়। কাতারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, কাতারের খারাপ সময়ে যেসব দেশ সহায়তা দিয়েছে, তাদেরকে কাতার পিঠ দেখাবে না। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, সেই আলোচনাতেই সৌদিরা ‘আল জাজিরা’ বন্ধ করা এবং তুরস্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে নমনীয়তা দেখিয়েছিল। আর এই আলোচনার পিছনে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল, তা জানা যায় হোয়াইট হাউজের বিবৃতি থেকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে ফোনে বলেন যে, দুই দেশের মাঝে আলোচনা চলমান থাকলে তা উপসাগরীয় অঞ্চলের সমস্যা নিরসণে ভূমিকা রাখবে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, কাতার হয়তো অত সহজে সৌদি গ্রুপের অবরোধের কথা ভুলে যাবে না। অপরদিকে আরব আমিরাত এখনও কাতারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না; বিশেষ করে ফিলিস্তিন এবং লিবিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে কাতারের সম্পর্ককে আমিরাত তার রাজতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখে। নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে ২৭ লক্ষ জনগণের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে তুরস্ক ও ইরানের সাথে কাতার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে। ‘জিসিসি’র দু’টা সদস্য দেশ কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, যারা হলো কুয়েত এবং ওমান। এর মাঝে কুয়েতই আলোচনার মধ্যস্ততাকারী ছিল।

বিশ্বব্যাপী প্রভাব হারালেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর মার্কিন প্রভাব যে এখনও যথেষ্ট, তা কাতারের ইস্যু থেকে পরিষ্কার হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থনপুষ্ট হয়েই সৌদিরা কাতারের উপর অবরোধ দিয়েছিল; আবার সেই একই প্রশাসন হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে আলোচনার পিছনে চাপ দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সৌদিদের ভালো সম্পর্ক থাকলেও আসন্ন ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের আদর্শিক নীতির সাথে সৌদি সরকারের সম্ভাব্য বিরোধ আলোচনায় আসছে নিয়মিত। বিশেষ করে ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নীতি কি হবে, তা নিয়ে সৌদিরা চিন্তিত। মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্ট্রাটফর’ বলছে যে, কাতারের সাথে সৌদি গ্রুপের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য হলো বাইডেন প্রশাসনের ভালো নজরে আসা। তবে সৌদিদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিষয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে, যেগুলি থেকে সৌদিদের পক্ষে বেরিয়া আসা কঠিন। কাতারের উপর সৌদি অবরোধ পারস্য উপসাগরে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির সুযোগ করে দেয়া ছাড়াও কাতারকে নতুন একটা সামরিক বাহিনী তৈরির অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে; যা গড়ে তুলতে তুরস্কের ভূমিকাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদিরা তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে; তুরস্কও সৌদি গ্রুপের পথ অনুসরণ করে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় নিজস্ব জাতীয় অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জোটের সৃষ্টি হচ্ছে, যেগুলির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও স্বল্প মেয়াদে এগুলি আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিকে প্রভাবিত করবে।

Tuesday 5 January 2021

বালুচিস্তানে ভারতের প্রক্সি যুদ্ধ পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নীতিরই ফলাফল

৫ই জানুয়ারি ২০২১
বালুচিস্তানের বিচ্ছন্নতাবাদী নেত্রী করিমা বালোচের মৃত্যুর পর করাচির রাস্তায় প্রতিবাদ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এনজিও ‘ইইউ ডিজইনফোল্যাব’ তাদের এক বিশ্লেষণে বলে যে, ভারতীয় ইন্ধনে চলা ‘আফ্রিকান রুরাল এন্ড এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট অর্গানাইজেশন’এর পক্ষে বালুচিস্তানের নেত্রী কারিমা বালোচ বক্তৃতা দিয়েছেন। 



গত ২২শে ডিসেম্বর কানাডার টরোন্টো শহরে করিমা মেহরাব নামে এক মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। করিমা বালোচ নামে পরিচিত এই মহিলা পাকিস্তানের দক্ষিণের বালুচিস্তান প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। ২০ তারিখ থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন বলে বলছে তার আত্মীয়রা। টরোন্টো পুলিশ এক বিবৃতিতে বলে যে, মৃতের সকলকিছু বিশ্লেষণের পর পুলিশ অফিসাররা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এই মৃত্যু কোন হত্যাকান্ড নয়। মৃতের পরিবারকে এব্যাপারে জানানো হয়েছে। এক টুইটার বার্তায় টরোন্টো পুলিশ জানায় যে, পুলিশ এই মৃত্যুর ব্যাপারে মিডিয়ার যথেষ্ট আগ্রহের কথা জানে। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ বলছে যে, করিমা বালোচ ২০১৫ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে টরোন্টোতে বসবাস করছিলেন। পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনেছিল। তার মৃত্যুর সাথেসাথেই মিডিয়াতে অনেকেই সন্দেহ করা শুরু করে যে, বালোচের মৃত্যু হয়তো পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভদের হাতেই হয়েছে। পাকিস্তান সরকার ইতোমধ্যেই পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সকে জড়িত করার চেষ্টাকে ‘অবাস্তব’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এবং বলেছে যে, এই কথাগুলি বলা হচ্ছে পাকিস্তানের ইমেজ নষ্ট করার লক্ষ্যে।

করিমা বালোচের স্বামী হাম্মাল হায়দার ব্যাপারটাকে একদমই মেনে নিতে পারছেন না। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, বালোচ ‘টরোন্টো সেন্টার আইল্যান্ড’এ গিয়েছিলেন; যেখান থেকে তিনি আর ফেরেননি। যাবার সময় তিনি যথেষ্ট শক্তসমর্থ মানুষ হিসেবেই গিয়েছিলেন। এখানে কোন সন্দেহভাজন কর্মকান্ডকে উড়িয়ে দেয়া যায় না; কারণ তিনি হুমকির মাঝেই ছিলেন। তার বাড়িতে দু’বার অভিযানের পর তিনি পাকিস্তান ছেড়েছিলেন। ‘বিবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে করিমা বালোচের সহকর্মী লতিফ জোহার বালোচ বলেন যে, কিছুদিন আগেই করিমা হুমকি পান যে, তাকে নাকি ‘ক্রিসমাস গিফট’ দেয়া হবে এবং ‘শিক্ষা দেয়া হবে’।

২০০৫ সাল থেকে করিমা বালোচ বালুচিস্তানে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে প্রতিবাদ শুরু করেন। প্রতিবাদকারীরা বলছেন যে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হাজারো মানুষের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। করিমা বালোচের পরিবারের দুইজন সদস্য নিখোঁজ হন এবং এর কিছুদিন পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২০০৬ সাল থেকে ‘বালোচ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন’এ নাম লেখান করিমা। ২০১৩ সালে সংস্থাটাকে পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে এর কার্যক্রম চলমান থাকে; এবং ২০১৫ সালে করিমা বালোচ সংস্থার চেয়ারপার্সন হন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এলে তিনি পাকিস্তান ছাড়েন। টরোন্টোতে তিনি তার সহকর্মী হাম্মাল হায়দারকে বিয়ে করেন। গত পাঁচ বছর ধরে সোশাল মিডিয়া ছাড়াও কানাডা এবং ইউরোপে তিনি বালুচিস্তানের ব্যাপারে যথেষ্ট সরব ছিলেন। ২০১৬ সালে ‘বিবিসি’ করিমা বালোচকে ১০০ জন প্রভাবশালী মহিলার তালিকায় রাখে। বালুচিস্তানের আন্দোলনকারীর এরকম রহস্যজনক মৃত্যু এবারই প্রথম নয়। ২০২০ সালের মে মাসে সুইডেনে বসবাসকারী বালুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্যে কাজ করা সাংবাদিক সাজিদ হুসাইনের মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ বলে যে, তিনি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছেন এবং তা হত্যাকান্ড ছিল বলে কোন প্রমাণ নেই। ২০১২ সালে সাজিদ পাকিস্তান ছেড়ে পালিয়ে সুইডেনে আশ্রয় পান।
বালুচিস্তানে ‘সিপেক’ প্রকল্পের অধীন গোয়াদর বন্দর। ‘সিপেক’ প্রকল্পকে টার্গেট করে ভারত শুধু পাকিস্তানকেই দুর্বল করতে চাইছে না, চীনের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পকে হুমকির মাঝে রাখছে। এতে রক্তপাত হচ্ছে পাকিস্তানিদের; ভারতের কেউ মরছে না। এহেন প্রক্সিযুদ্ধে ভারতের লজ্জিত হবার কোন কারণও থাকার কথা নয়। বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার পরেও পাকিস্তানকে কেন কষ্ট করে একত্রে রাখতে হচ্ছে, সেই প্রশ্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।



ভারতের ভূমিকা

পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ হলো, বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পিছনে রয়েছে ভারতের মদদ। ২০১৬ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রাক্তন অফিসার কুলভুষন যাদব পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তান সরকার একটা ভিডিও ছাড়ে, যেখানে দেখা যায় যে, কুলভুষন যাদব বালুচিস্তানে বিভিন্ন হামলার পিছনে সহায়তা দিয়েছেন বলে স্বীকার করছেন। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে একটা সামরিক আদালতে বিচারের পর কুলভুষনের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়। ভারত এব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতে গেলেও আদালত পাকিস্তানের সামরিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। তবে দোষী ভারতীয় নাগরিককে ভারতীয় কূটনীতিবিদদের সাথে দেখা করার আদেশ দেয়। ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় কর্মকর্তারা কুলভুষনের সাথে দেখা করেন।

গত ৯ই ডিসেম্বর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এনজিও ‘ইইউ ডিজইনফোল্যাব’ তাদের এক বিশ্লেষণে বলে যে, ২০০৫ সাল থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে ভারত সরকার গোপনে মিথ্যা তথ্য ছড়াবার অপারেশন চালিয়ে আসছে। সাড়ে ৭’শর বেশি মিডিয়া আউটলেট এবং ১০টার বেশি এনজিওর নাম ব্যবহার করে প্রায় ১’শ ১৯টা দেশে এই অপারেশন চালাচ্ছে ভারত। এর অধীনে সাড়ে ৫’শ ইন্টারনেট ডোমেইন রয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া মিডিয়া, এনজিও এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক আবারও জীবন্ত করে চালিয়ে নেয়া হয় এই অপারেশন। এমনকি মৃত ব্যক্তিদেরও এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আফ্রিকা বিষয়ক এনজিওর নাম ব্যবহার করে পাকিস্তানের মানবাধিকার বিষয়ক খবরাখবর প্রচার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ ‘আফ্রিকান রুরাল এন্ড এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট অর্গানাইজেশন’এর পক্ষে বালুচিস্তানের নেত্রী করিমা বালোচ বক্তৃতা দিয়েছেন। ব্রাসেলস এবং জেনেভাতে অপারেট করা এই নেটওয়ার্কের মূল টার্গেট হলো পাকিস্তান; যদিও চীনও এই টার্গেটিংএর অংশ। ‘শ্রীভাস্তাভা গ্রুপ’এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য হলো ভারতীয়দের মাঝে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলা ও পাকিস্তান বিরোধী আবেগ উস্কে দেয়া; এবং একইসাথে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের অবস্থানকে সুসংহত করা। ‘ইইউ ডিজইনফোল্যাব’ ভারতের এই অপারেশনের নাম দেয় ‘ইন্ডিয়ান ক্রনিকলস’। এই প্রতিবেদন পাকিস্তানের জন্যে বড় সুখবর হিসেবে আসে। এর মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার মিডিয়াতে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণে যেতে পারে। পাকিস্তান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে ‘পঞ্চম জেনারেশনের যুদ্ধ’ বা তথ্য যুদ্ধ চালনা করার অভিযোগ করে।

ভারত অবশ্য পাকিস্তানের সকল অভিযোগ অস্বীকার করে এবং ‘ইইউ ডিজইনফোল্যাব’কেই মিথ্যা খবরের উৎস বলে আখ্যা দেয়। ১১ই ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীভাস্তাভা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ভারত নয়, বরং পাকিস্তানই মিথ্যা এবং বানোয়াট খবর প্রচার করে। ‘ইইউ ডিজইনফোল্যাব’ এর প্রতিবাদ করে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার হুমকি দেয়।
করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার পর কড়া নিরাপত্তা। ১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানকে ভেঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি হয় এবং পাকিস্তান তার অর্ধেক জনসংখ্যা হারায়। পাকিস্তান সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতিকে ভারত ব্যবহার করেছিল মাত্র। পাকিস্তানের সেই জাতীয়তাবাদ মূলতঃ পাঞ্জাবিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পাকিস্তানকে জন্মের পর থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে; যদিও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মই হয়েছিল মুসলিম সংখ্যাধিক্য এলাকাগুলি নিয়ে। জাতিগত চিন্তাকে প্রাধান্য দেয়ায় পাকিস্তান তার বাঙ্গালী, পুশতুন, বালুচ এবং সিন্ধি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ভারত পাকিস্তানের সেই ঐতিহাসিক ভীতিকেই কাজে লাগিয়েছে। 



পাকিস্তান যেকারণে শান্তিতে নেই

করিমা বালোচ, সাজিদ হুসাইন, ‘ইন্ডিয়ান ক্রনিকলস’, কুলভুষনের ঘটনা পাকিস্তানকে স্বস্তি দেয়না। কারণ এতে পাকিস্তানের বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়নি। বালুচিস্তানের গুরুত্ব আরও বেড়ে গিয়েছে গোয়াদরে চীনা বিনিয়োগে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প শুরুর পর থেকে। গোয়াদর হলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিপেক’এর দক্ষিণ প্রান্ত। ‘সিপেক’এর মাধ্যমে বালুচিস্তানের গোয়াদর চীনের মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে। বালুচিস্তানে চীনা কর্মীদের উপর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলা বেশ নিয়মিত। গত জুলাই মাসে বালুচ এবং সিন্ধি বিচ্ছন্নতাবাদীরা একত্রিত হয়ে একটা জোট করে। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলে যে, চীনের আগ্রাসী কর্মকান্ডে সিন্ধি এবং বালুচ উভয়েই সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ২০২০এর জুনে করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে হামলার জন্যে বালুচরা দায় স্বীকার করলেও তারা সিন্ধিদের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছে বলে বলা হয়। ওয়াশিংটন ভিত্তিক বিশ্লেষক মালিক সিরাজ আকবর ‘নিকেই এশিয়া’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ একত্রিত হয়ে ‘সিপেক’এর জন্যে বড় সমস্যা তৈরি করতে পারলেও চীন এবং পাকিস্তানকে এই প্রকল্প বন্ধ করাতে সক্ষম হবে না। তবে তারা পাকিস্তান সরকারকে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে বাধ্য করবে; যার ফলে বিচ্ছন্নতাবাদীরা সাধারণ মানুষকে চীনাদের বিরুদ্ধে আরও খেপিয়ে তুলতে পারবে। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার হয়তো বালুচিস্তানের জনগণকে এই প্রকল্পের সাথে আরও বেশি যুক্ত করতে চাইবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’এর প্রফেসর মোহন মালিকের মতে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চীনের জন্যে ‘সিপেক’ প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দিতে চাইবে। তিনি আরও মনে করছেন যে, এর ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ এশিয়াতে প্রক্সি যুদ্ধ আরও বাড়বে। অত্র এলাকার রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রবিরোধী গ্রুপগুলিকে ভারত বা চীনের পক্ষে টানার একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাবে। লন্ডনের ‘ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিন্সটার’এর ‘স্কুল অব সোশাল সাইয়েন্সেস’এর প্রধান দিবিয়েশ আনন্দ বলছেন যে, পাকিস্তান সরকারের জন্যে বালুচিস্তানের জনগণকে ‘সিপেক’ প্রকল্পে জড়িত করার মাধ্যমে এর উন্নয়নকে পুরো অঞ্চলের জন্যে উন্নয়নের ইঞ্জিন বানানো যায়; আর উল্টোটা হলে তা হতে পারে চীনাদের গর্ব করার মতো একটা নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রকল্প, যেটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ঔপনিবেশিক কর্মকান্ড বলে আখ্যা দিতে পারবে।

১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানকে ভেঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি হয় এবং পাকিস্তান তার অর্ধেক জনসংখ্যা হারায়। পাকিস্তান সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতিকে ভারত ব্যবহার করেছিল মাত্র। পাকিস্তানের সেই জাতীয়তাবাদ মূলতঃ পাঞ্জাবিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পাকিস্তানকে জন্মের পর থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে; যদিও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মই হয়েছিল মুসলিম সংখ্যাধিক্য এলাকাগুলি নিয়ে। মুসলিম পরিচয়ের চাইতে জাতিগত পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়ায় পাকিস্তান তার বাঙ্গালী, পুশতুন, বালুচ এবং সিন্ধি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ভারত পাকিস্তানের সেই ঐতিহাসিক ভীতিকেই কাজে লাগিয়েছে। বালুচিস্তানে ‘সিপেক’ প্রকল্পকে টার্গেট করে ভারত শুধু পাকিস্তানকেই দুর্বল করতে চাইছে না, চীনের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পকে হুমকির মাঝে রাখছে। এতে রক্তপাত হচ্ছে পাকিস্তানিদের; ভারতের কেউ মরছে না। এহেন প্রক্সিযুদ্ধে ভারতের লজ্জিত হবার কোন কারণও থাকার কথা নয়। বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার পরেও পাকিস্তানকে কেন কষ্ট করে একত্রে রাখতে হচ্ছে, সেই প্রশ্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই যখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন ভারতও বালুচিস্তানে প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে চীনা কৌশলগত প্রকল্পে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সমান্তরালেই থাকবে। পারমাণবিক যুদ্ধ নয়, বরং প্রক্সিযুদ্ধই হতে চলেছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নতুন চেহারা। 

Monday 4 January 2021

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার নিয়ে ভোটাভুটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

৪ঠা জানুয়ারি ২০২১

ডিসেম্বর ২০১৯। আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মিয়ানমারের মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। তিনি সরাসরিই রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের বর্ণনা থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী’ বলে আখ্যা দেয়। শরণার্থী প্রত্যাবাসন যে একটা সময়ক্ষেপণ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না।


৩রা জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ একে আব্দুল মোমেন নিজ অফিসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে জাতিসংঘে পাস হওয়া রেজোলিউশনের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ এই ব্যাপারটাকে একটা কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখছে। তিনি বলেন যে, যেসব দেশ রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন অসন্তোষ নেই। তিনি তাদের ভোট না দেবার সিদ্ধান্তগুলিকে ‘কৌশলগত সিদ্ধান্ত’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন যে, দেশগুলি তাদের এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে বাংলাদেশকে জানিয়েছিল। এই দেশগুলি অন্য পদ্ধতিতে মিয়ানমারের উপর প্রভাবকে ব্যবহার করতে চাইছে বলে বলেন তিনি। তবে তিনি এও বলেন যে, এই দেশগুলি জাতিসংঘে আরও ভালো ভূমিকা রাখতে পারতো। জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনে গত ৩১শে ডিসেম্বর ‘দ্যা সিচুয়েশন অব হিউম্যান রাইটস অব দ্যা রোহিঙ্গা মুসলিমস এন্ড আদার মাইনরিটিজ ইন মিয়ানমার’ নামে এই প্রস্তাব পেশ করা হয়। মোট ১’শ ৩০টা দেশ এই রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়; ৯টা দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়; ২৬টা দেশ ভোট দানে বিরত থাকে। আরও ২৮টা দেশ ভোটাভুটির সময় উপস্থিত ছিল না।

কারা কোন পক্ষে ভোট দিয়েছে

ভোটাভুটির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ অমুসলিম দেশই রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়নি; এরা হয় বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, অথবা ভোটদানে বিরত থেকেছে। একমাত্র আলাদা দেশ ছিল দক্ষিণ কোরিয়া, যারা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। রাশিয়া এবং তার প্রভাবের মাঝে থাকা ইউরেশিয়ার দেশগুলিও ভোট দেয়নি; যেমন বেলারুশ, কাজাখস্থান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান। সাহারান আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ ভোট দেয়নি; যাদের মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ছিল নাইজেরিয়া এবং ইথিওপিয়া। ইউরোপে শুধুমাত্র হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়া পক্ষে ভোট দেয়নি। এমনকি গ্রিস এবং আর্মেনিয়াও পক্ষে ভোট দিয়েছে!

 
৩১শে ডিসেম্বর ২০২০। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমার বিষয়ে ভোটাভুটির ফলাফল। বিশ্বের সবচাইতে বড় দেশগুলির চারটা মিয়ানমারের পক্ষে থাকার চেষ্টা করেছে।




পক্ষে ভোট না দেয়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির বেশিরভাগই ‘আসিয়ান’ অর্থনৈতিক জোটের অংশীদার। আসিয়ানের তিন মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রুনাই পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই দেশগুলিতে মুসলিম জনগণের পক্ষ থেকে ব্যাপক চাপ রয়েছে সরকারের উপর, যা বিগত বছরগুলিতে রাস্তায় মিয়ানমার বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল দেখলেই বোঝা যায়। মধ্য এশিয়াতে হয়েছে পুরো উল্টাটা। এই দেশগুলির কট্টর রুশপন্থী সরকারগুলি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশের বন্ধু দেশগুলিও রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়নি, যেমন শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান। পশ্চিমা দেশগুলি পক্ষে ভোট দেবে এটা প্রায় জানাই ছিল; কারণ তাদের আদর্শিক কারণে তারা এটা করবে।

এই ভোটাভুটিতে সবচাইতে বড় ভূমিকা ছিল রাশিয়া, চীন, ভারত এবং জাপানের। এরকম চারটা দেশ এবং আসিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ার সকল অমুসলিম দেশ যদি মিয়ানমারের পক্ষে থাকে, তাহলে এই রেজোলিউশন যে মিয়ানমারকে ভয় দেখাতে পারবে না, তা নিশ্চিত। কয়েক দশক বিশ্ব থেকে আলাদা থাকা মিয়ানমারের জন্যে এরকম ভোটাভুটি এমনিতেই মূল্যহীন। তার উপর সেখানে যদি পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলির চারটা মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে মিয়ানমার এতে আশহত হওয়া তো দূরে থাকুক, যথেষ্ট উল্লসিতই হবে।

মিয়ানমারের অস্ত্র ক্রয়ের জোয়ার

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার রাশিয়া, ভারত এবং চীন থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ক্রম করেছে। এই সরঞ্জামের অনেকটাই মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে নয়; যেমন বিমান বাহিনীর ৪র্থ জেনারেশনের যুদ্ধবিমান এবং নৌবাহিনীর জন্যে সাবমেরিন ও ফ্রিগেট। জাতিসংঘের ভোটাভুটির এক সপ্তাহ আগে ২৪শে ডিসেম্বর মিয়ানমার নৌবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত থেকে পাওয়া সাবমেরিন কমিশনিং করে। মিয়ানমারে ভারতের রাষ্ট্রদূত সৌরভ কুমার বলেন যে, সাবমেরিনের কমিশনিং দুই দেশের সম্পর্কে একটা মাইলফলক। এর মাধ্যমে দুই দেশের ম্যারিটাইম বন্ধুত্ব বহু এগিয়ে গেলো। একই অনুষ্ঠানে মিয়ানমার নৌবাহিনীর জন্যে নিজস্ব ডকইয়ার্ডে নির্মিত একটা স্টেলথ ডিজাইনের মিসাইল ফাস্ট এটাক ক্রাফট, দু’টা ৬৩ মিটার এন্টি সাবমেরিন ভেসেল, একটা ৫৬ মিটার লম্বা ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং দু’টা সমুদ্রগামী টাগবোট কমিশনিং করা হয়। চীনা সহায়তায় মিয়ানমারের ইয়াঙ্গনে তৈরি করা হয় ‘থিলাওয়া ডকইয়ার্ড’; যেখানে গত তিন দশক ধরে চলছে এক বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। এখানে ২০টা ৪৭ মিটার প্যাট্রোল ক্রাফট ও মিসাইল বোট, ২টা ৪৯ মিটার স্টেলথ ফাস্ট এটাক ক্রাফট, ৬টা ৫৬ মিটার লম্বা ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি, ২০টা ২৯ মিটার ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাঙ্ক, ৮টা ২৬ মিটার লম্বা সমুদ্রগামী টাগবোট তৈরি করা হয়েছে। ২০০১ সালে এর উন্নয়ন কাজ শেষ হবার পর থেকে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জন্যে ১’শ ৮মিটার লম্বা তিনটা ফ্রিগেট, ৭৭ মিটার লম্বা তিনটা কর্ভেট যুদ্ধজাহাজ এবং একটা ৮১ মিটার অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল তৈরি করা হয়েছে। এই যুদ্ধজাহাজগুলির ইলেকট্রনিক্স সরবরাহ করে ভারত; যার মাঝে রয়েছে জাহাজের মূল এয়ার ডিফেন্স রাডার এবং সাবমেরিন খোঁজার সোনার, যেগুলির প্রযুক্তি মূলতঃ পশ্চিমা। জাহাজগুলিতে সাবমেরিন ধ্বংসের জন্যে টর্পেডোও সরবরাহ করে ভারত। জাহাজের উপর থেকে অপারেট করার জন্যে ড্রোন কেনা হয়েছে অস্ট্রিয়া থেকে। অস্ট্রিয়া জাতিংসঘের রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ২০১৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর এক ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা যায় যে, মিয়ানমার গোপনে অস্ট্রিয়া থেকে অত্যাধুনিক ‘শাইবেল ক্যামকপ্টার এস১০০’ ড্রোন কিনেছে। এক হিসেবে বলা হয় যে, এই ক্রয়ের মূল্য ছিল প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার। এরকম একটা ড্রোনের মূল্য প্রায় ৪ লাখ ডলার; আর এর কন্ট্রোল স্টেশন ও ট্রেনিংসহ পুরো সিস্টেমের খরচ প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার। কাজেই মিয়ানমার আসলে কতগুলি ড্রোন কিনেছে, তা বলা কঠিন।

 

মিয়ানমার নৌবাহিনীর জন্যে অস্ট্রিয়া থেকে কেনা অত্যাধুনিক ‘শাইবেল ক্যামকপ্টার এস১০০’ ড্রোন। দন্তহীন সংস্থা জাতিসংঘের ভোটাভুটি পশ্চিমাদের লোক দেখানো কর্মকান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। গোপনে মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করে বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বলাটা কপটতার শামিলই বটে। মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দও আদর্শিক দিক থেকে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করাকে নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করছে না। বরং বাস্তবতাকে চিন্তার ভিত ধরে মিয়ানমারকে আরও কাছে টানার নীতিতে এগুচ্ছে।


এই অস্ত্রগুলি অন্ততঃ সংখ্যার দিক থেকে হলেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে। মিয়ানমার নৌবাহিনীর সবচাইতে বড় যুদ্ধজাহাজ উভচর ডক ল্যান্ডিং শিপ তৈরি করে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, যারা কিনা পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। গত ডিসেম্বরেই খবর বেরোয় যে, মিয়ানমার মুসলিম দেশ জর্দানের বিমান বাহিনীর কাছ থেকে প্রায় ৩৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দু’টা ‘এয়ারবাস সি২৯৫’ সামরিক পরিবহণ বিমান ক্রয় করছে। বিমানগুলি ইউরোপে তৈরি এবং এর ইঞ্জিনগুলিও কানাডার কোম্পানি ‘প্র্যাট এন্ড হুইটনি’র তৈরি। মিয়ানমারের মিডিয়া ‘ইরাবতী’ বলছে যে, ২০১১ সালে ইউ থেইন সেইন প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার বিমান বাহিনীতে ৯৬টা নতুন বিমান যোগ করা হয়েছে; যার মাঝে দশ প্রকারের ৭৯টা বিমান এবং পাঁচ প্রকারের ১৭টা হেলিকপ্টার রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের মাঝে ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে রাশিয়া মিয়ানমারের সবচাইতে বড় সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একই সময়ে চীনের কাছ থেকে মিয়ানমার পেয়েছে ১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। মিয়ানমারের কয়েক’শ সেনা যেকোন মুহুর্তে রাশিয়াতে সামরিক শিক্ষা নিচ্ছে।

অবাক ব্যাপার হলো, ১৯৮৮ সাল থেকে মিয়ানমারের উপর পশ্চিমা অস্ত্র অবরোধ রয়েছে। ‘ইরাবতী’ বলছে যে, ২০১৯এর ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল মিং অং হাইং বিমান বাহিনীর ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ১০টা বিমান কমিশনিং করেন; যার মাঝে ছিল পাকিস্তানে তৈরি ২টা ‘জেএফ১৭বি’ মাল্টিরোল ফাইটার, রাশিয়ায় তৈরি ৬টা ‘ইয়াক১৩০’ এডভান্সড ট্রেইনার বিমান এবং ২টা ‘এমআই৩৫’ এটাক হেলিকপ্টার। ৭০তন প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতেও মিয়ানমার বিমান বাহিনীর জন্যে ১০টা বিমান কমিশনিং করা হয়; যার মাঝে ছিল ৬টা ‘ইয়াক১৩০’, হল্যান্ডে তৈরি দু’টা ‘ফকার ৭০’ বিমান এবং ফ্রান্সে তৈরি দু’টা ‘এটিআর ৪২’ বিমান। এভাবে প্রতি বছরই মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর জন্যে যুদ্ধবিমান কমিশনিং করা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন টুন বলছেন যে, মিয়ানমার ভারত বা চীনের সাথে হয়তো প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, কিন্তু অন্য তিন প্রতিবেশী থাইল্যান্ড, লাওস এবং বাংলাদেশের সাথে তারা প্রতিযোগিতা করতে পারে। অস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্য হিসেবে তারা বলছে যে, এগুলি মূলতঃ বিদেশী হুমকিকে বাধা দেয়ার জন্যে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীরা এসে যাতে মিয়ানমারে বসতি স্থাপন না করতে পারে সেজন্য, আর দেশের সম্পদ রক্ষা করার লক্ষ্যে আকাশ পাহাড়া দেবার জন্যে। ২০০১ সালে থাইল্যান্ডের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত যুদ্ধে মিয়ানমারের ব্যাপক পরাজয়ের পর মিয়ানমার রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয়ে মনোযোগী হয় বলে বলা হয়। বহুবছর সামরিক শাসনের সময় পশ্চিমা অবরোধের মাঝে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার একটা চিন্তা ছিল যে, পশ্চিমারা হয়তো যেকোন সময় মিয়ানমারের উপর সামরিক হামলা করতে পারে। এছাড়াও বহু দশক ধরে নিজ জনগণের বিদ্রোহ দমন করতে ব্যস্ত মিয়ানমার। একারণেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি যথেষ্ট এডভান্সড। উদাহরণস্বরূপ, স্যাটেলাইট ছবিতে মিয়ানমারের কোন বিমান ঘাঁটির রানওয়েতেই সামরিক বিমান পার্কিং করা দেখা যায় না।

মিয়ানমারের সামরক বাহিনীর বরাত দিয়ে ‘ইরাবতী’ বলছে যে, চীনাদের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কমাবার লক্ষ্যেই মিয়ানমার রাশিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, ভারত, ইস্রাইল এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে থাকে। মিয়ানমারের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলতঃ রাশিয়া থেকে আসে। একটা বড় সংখ্যক যুদ্ধবিমান ছিল চীনা নির্মিত ‘এফ৭’ যুদ্ধবিমান। মিয়ানমারের সামরিক মুখপাত্র বলছেন যে, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডের হুমকি মোকাবিলা করতে মিয়ানমার একটা সাবমেরিন ফ্লিট গড়ে তুলতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে ভারতের কাছ থেকে কেনা রুশ নির্মিত ‘কিলো ক্লাস’এর সাবমেরিনটা মূলতঃ ব্যবহৃত হবে ট্রেনিংএর উদ্দেশ্যে। ২০১৮ সালে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ঘোষণা দেন যে, রাশিয়া ২’শ ৪ মিলিয়ন ডলারে মিয়ানমারের কাছে ৬টা ‘সুখোই ৩০’ ফাইটার বিমান বিক্রি করছে। একই বছর জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা কেনতারো সোনোউরা বলেন যে, জাপান মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে সহায়তা দেবে। সেই হিসেবেই জাপানের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমি’তে এখন মিয়ানমারের ক্যাডেট নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা খাতে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন টুন বলছেন যে, ভারত এবং চীনের মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বঙ্গোপসাগর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের বিমান এবং নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা ছাড়া সামনের দিনে কোন পথই খোলা নেই।

 
সেপ্টেম্বর ২০১৭। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরের সময় ঘোষণা দেন যে ভারত মিয়ানমারের সাথেই রয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্বে গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাই যখন মূল লক্ষ্য, তখন রোহিঙ্গাদের মতো মুসলিম শরণার্থীরা ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হিসেবেই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরে সকলেই শক্তিশালী অবস্থান চাইছে; আর তাদের ঢোকার রাস্তা হলো রোহিঙ্গা সমস্যা।

নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

মিয়ানমারে সামরিক যজ্ঞের ফিরিস্তি দেখলে বোঝা দুষ্কর যে দেশটা আসলে মানবাধিকারের ব্যাপারে চাপের মাঝে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সকল দেশ যেভাবে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছে, তাতে মিয়ানমারই শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে; তারা যা চাইছে, তাই পাচ্ছে। দন্তহীন সংস্থা জাতিসংঘের ভোটাভুটি এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের লোক দেখানো কর্মকান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। গোপনে মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করে বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বলাটা কপটতার শামিলই বটে। মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দও আদর্শিক দিক থেকে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করাকে নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করছে না। বরং বাস্তবতাকে চিন্তার ভিত ধরে মিয়ানমারকে আরও কাছে টানার নীতিতে এগুচ্ছে। কেউ হয়তো সরাসরি মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে; যার মাঝে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি রয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলি অস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে ভীষণ কঠোর হলেও মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ততটা নয়। জাতিসংঘের অধিবেশনে তারা কিন্তু ন্যায়ের পক্ষেই নিজেদের নাম লেখাচ্ছে।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার পর ২০১৯এর ডিসেম্বরে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি সরাসরিই রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। মিয়ানমার খুব ভালো করেই জানে যে, তারা বাংলাদেশের জন্যে কতটা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের বর্ণনা থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী’ বলে আখ্যা দেয়। একইসাথে যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেবার তাদের কোনরকম সদিচ্ছাই দৃশ্যমান নয়, কাজেই শরণার্থী প্রত্যাবাসন যে একটা সময়ক্ষেপণ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না। মিয়ানমার বাংলাদেশকে মূলতঃ বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মিয়ানমার বাংলাদেশের কথা শুনতে বাধ্য নয়। উল্টো বিশাল অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলে তারা বাংলাদেশকে একপ্রকার হুমকিই দিচ্ছে এবং শান্তির পথকে করছে সংকীর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা নতুন বছরের বার্তায় বলেন যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলে অশান্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আর অশান্তি হলে সবার জন্যে অসুবিধা। ডঃ মোমেনের এই বার্তায় যে অশান্তির আভাস দেয়া হয়েছে, তা কিন্তু মিয়ানমার এখনও টের পাচ্ছে না ভূরাজনৈতিক কারণেই। পরিবর্তিত বিশ্বে গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাই যখন মূল লক্ষ্য, তখন রোহিঙ্গাদের মতো মুসলিম শরণার্থীরা ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হিসেবেই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরে সকলেই শক্তিশালী অবস্থান চাইছে; আর তাদের ঢোকার রাস্তা হলো রোহিঙ্গা সমস্যা। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় এই সমস্যার সমাধান হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকলেও বঙ্গোপসাগরে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যে আরও তীব্র হবে, তা সন্দেহাতীত। সকলেই প্রস্তুতি নিচ্ছে আসন্ন দ্বন্দ্বের জন্যে।