Monday 18 March 2019

ক্রাইস্টচার্চ সন্ত্রাসী হামলা দেখিয়ে দিচ্ছে আদর্শিক রাষ্ট্রের গুরুত্ব

১৯শে মার্চ ২০১৯
ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলার সময় সেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা ছিলেন। এটা ঠিক যে নিতান্তই কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যাওয়ায় ক্রিকেট সদস্যদের সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার প্রবণতা বাড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে; কিন্তু তাতে রাষ্ট্র কি পেয়েছে? রাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, তার সেরা সন্তানদের নিরাপত্তার ব্যাপারটাই সে কখনোই চিন্তা করেনি। সেরা সন্তানেরাই যদি এতটা অনিরাপদ থাকে, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের কি অবস্থা হবে, সেটা বোঝাই যায়। চকবাজারের অগ্নিকান্ডের মতো ট্র্যাজেডি দেখিয়ে দেয় যে রাষ্ট্র তার সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটা উদাসীন ছিল। ক্রাইস্টচার্চ শুধু সেই ব্যাপারটাকেই নতুন করে দেখিয়ে দিল।


রাষ্ট্র তার জনগণের নিরাপত্তা না দিলে কে দেবে? অন্য রাষ্ট্র?

গত ১৫ই মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে মুসল্লীদের উপর বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের মানুষ বিদেশের মাটিতে এতকাল নিজেদের যতটা নিরাপদ মনে করতো ততটা নিরাপদ তারা নন। একইসাথে এটাও প্রমাণ হলো যে, বাংলাদেশ বিদেশে তার স্বার্থকে তৈরি করেছে কোন গভীর চিন্তা ছাড়াই। বর্তমান সময়টাকে বলা হচ্ছে গ্লোবালাইজেশনের যুগ; ডিজিটাল কমিউনিকেশনের যুগ। পৃথিবীব্যাপী নিজের কর্মকান্ডকে প্রসারিত করাটা এখন আর খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কর্মকান্ডকে প্রসারিত করলেই তো হবে না, সেগুলির নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য তো থাকতে হবে। উদ্দেশ্যই ঠিক করে দেবে যে, কি কি কাজ করতে হবে; কি কাজ করতে গিয়ে কি সমস্যা হলে কি করতে হবে। রাষ্ট্রের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মাঝে একটা হলো এর জনগণের নিরাপত্তা দেয়া। এটা না দিতে পারলে রাষ্ট্রের লক্ষ্য নিয়েই প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। মানুষের নিরাপত্তাই যদি রাষ্ট্র না দিতে পারে, তবে সেই রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল কেন? এর জনগণ তো রাষ্ট্র ছাড়াই ভালো ছিল; রাষ্ট্রের কি দরকার ছিল? এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে, সারা বিশ্বব্যাপী নিজের জনগণের নিরাপত্তা দেয়া খুব কঠিন ব্যাপার নয় কি? হ্যাঁ; অবশ্যই কঠিন ব্যাপার। তবে সেখানেও প্রশ্ন আছে – যদি কঠিন ব্যাপার জানাই থাকে, তাহলে বিদেশে মানুষ যাচ্ছে কেন? তাদের উদ্দেশ্য কি? আর রাষ্ট্র কি তাদেরকে সেই মুচলেকা দিয়েই বিদেশে পাঠাচ্ছে যে – বিপদে পড়লে রাষ্ট্রকে ডেকো না? অথবা গেলে নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজে করে নিও? রাষ্ট্র যদি তার জনগণের দায়িত্ব না নেয়, তাহলে জনগণ যে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিক হতে চাইবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

রাষ্ট্রের পক্ষে তার প্রত্যেক নাগরিকের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া কঠিন; তবে সেটা রাষ্ট্র চেষ্টা করে যাবে। যে রাষ্ট্র যত শক্তিশালী, তার জনগণের নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতাও তত বেশি। আসলে ব্যাপারটা উল্টো। নিরাপত্তা দিতে পারে বলেই সে শক্তিশালী। দুর্বল রাষ্ট্র মাত্রই সে তার জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবে – সেটা দেশের মাটিতেই হোক; বিদেশের মাটিতেই হোক। তবে পুরোটাই কিন্তু রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের সাথে ওঁতপ্রোঁতভাবে জড়িত। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই ঠিক করে দেবে যে, সে বিদেশে তার জনগণকে কেন পাঠাতে চায়। বিদেশে পাঠালে কোন দেশে পাঠাতে চায়? সেসব দেশে রাষ্ট্রের জনগণ কি কি কাজ সম্পাদন করবে? কিভাবে করবে? সেগুলি করতে গিয়ে কি কি সমস্যায় পতিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে? সমস্যায় পড়লে তার সেটা থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় কি? সে কার কাছে সাহায্য চাইতে পারে? কার কাছে সাহায্য চাওয়া তার জন্যে সমীচিন নয়? এই সবগুলি প্রশ্নেরই উত্তর রাষ্ট্রের কাছে থাকতে হবে।

   
বিদেশে বাংলাদেশের অনেকগুলি মিশন খোলা হয়েছে। তারা মূলতঃ ভিসা প্রসেসিং নিয়েই ব্যস্ত। ভিসা প্রসেসিং – অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতিতে মানুষের উপরে পুলিশী আচরণ করা ছাড়া বাংলাদেশের মিশনগুলি তেমন কিছুই করতে পারেনি। রাষ্ট্রের জনগণ বিদেশী পুলিশের হাতে যেমন লাঞ্ছিত হবে, তেমনি রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারাও হবে হয়রান, অপমানিত, প্রত্যাখ্যাত। 


কূটনৈতিক মিশনগুলি কি নিজেদের নাগরিকদের উপর পুলিশী কাজের জন্যে?

নিরাপত্তা মানেই এই নয় যে, প্রতিটা মানুষের সাথে একজন অস্ত্রধারী বডিগার্ড থাকবে। তবে সেটাও এক ধরনের নিরাপত্তা। ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলার সময় সেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা ছিলেন। এটা ঠিক যে নিতান্তই কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যাওয়ায় ক্রিকেট সদস্যদের সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার প্রবণতা বাড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে; কিন্তু তাতে রাষ্ট্র কি পেয়েছে? রাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, তার সেরা সন্তানদের নিরাপত্তার ব্যাপারটা সে কখনোই চিন্তা করেনি। সেরা সন্তানেরাই যদি এতটা অনিরাপদ থাকে, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের কি অবস্থা হবে, সেটা বোঝাই যায়। চকবাজারের অগ্নিকান্ডের মতো ট্র্যাজেডি দেখিয়ে দেয় যে রাষ্ট্র তার সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটা উদাসীন ছিল। ক্রাইস্টচার্চ শুধু সেই ব্যাপারটাকেই নতুন করে দেখিয়ে দিল।

বিদেশে বাংলাদেশের অনেকগুলি মিশন খোলা হয়েছে। তারা মূলতঃ ভিসা প্রসেসিং নিয়েই ব্যস্ত। সেখানে কেউ বিপদে পড়লে বাংলাদেশী মিশনগুলি কিছুই করতে পারে না। বাংলাদেশ তার জনগণকে বিশ্বব্যাপী কাজ করতে পাঠিয়েছে; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পাঠানো হয়েছে শ্রমিকের কাজ করার জন্যে। কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা অর্থ উপার্জন করবে এবং দেশে পাঠাবে। দেশে থাকার সময় রাষ্ট্র তাদেরকে অতিরিক্ত জনসংখ্যা বলে আখ্যা দিয়েছে। আর বিদেশে যাবার পরে তাদেরকে ‘ব্লাডি লেবার শেণি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। রাষ্ট্রের নাগরিক হবার সুবিধা দূরে থাক, নূন্যতম সন্মানটাও তাদের দেখানো হয়নি। নিরাপত্তা তো অন্য গ্রহের প্রশ্ন! ভিসা প্রসেসিং – অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতিতে মানুষের উপরে পুলিশী আচরণ করা ছাড়া বাংলাদেশের মিশনগুলি তেমন কিছুই করতে পারেনি। রাষ্ট্রের জনগণ বিদেশী পুলিশের হাতে যেমন লাঞ্ছিত হবে, তেমনি রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারাও হবে হয়রান, অপমানিত, প্রত্যাখ্যাত।

   
দেশের মানুষকে রাষ্ট্র বিদেশে পাঠিয়েছে নিজের “সমস্যা” থেকে পরিত্রাণ পেতে। নিজের জনগণকে আবর্জনার মতো মনে করার এই ভিতের উপরেই এখনও বসে আছে রাষ্ট্র। এই “আবর্জনা”র নিরাপত্তা দেবার প্রশ্ন আসবে কিভাবে? জনগণকে সম্পদ না ভেবে সমস্যা ভাবার এই ‘ম্যাটেরিয়ালিস্টিক’ চিন্তার ভিত নিয়ে কেউ ভেবেছে কি? এ-তো ভারতে জন্মানোর পরপরই মেয়ে শিশু মেরে ফেলার মতো চিন্তা! চীনে এক সন্তানের বেশি সন্তান না নিতে পারার আইনের মতো অবস্থা! জন্মের পরপরই অর্থের বিনিময়ে সন্তান বিক্রি করে দেবার মতো অবস্থা!


রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের সাথে বিদেশে মানুষ পাঠাবার সম্পর্ক কি?

বাংলাদেশের জনগণ এখনও বুঝতে পারছে না যে একুশ শতকে এই দেশের জন্যে কত বড় এক সুযোগ অপেক্ষা করছে – যে সুযোগ গত এক শতকে আসেনি। এই সুযোগ কাজে লাগাতে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকে বাড়াতে হবে। বুঝতে হবে যে, রাষ্ট্র কেন তৈরি হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে কি কি দরকার? কতদিনে তার কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে? সেগুলি কতটুকু বাস্তবসম্মত? রাষ্ট্রের নিরাপত্তার যে প্রশ্নগুলি উপরে এসেছে, সেই প্রশ্নগুলির উত্তর কি মিলবে? এই চিন্তাগুলির মাঝেই নিহিত রয়েছে সেই প্রশ্ন – রাষ্ট্র তার জনগণকে কেন বিদেশে পাঠিয়েছে? কেন রাষ্ট্র তার জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তরও সেখানেই রয়েছে। ১৯৭১ সালে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবার পর থেকে শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাই ছিল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়েছে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা কর্মকান্ডের মাঝ দিয়ে। কোনমতে বেঁচে থাকাটাই এই রাষ্ট্র তৈরির উদ্দেশ্য ছিল? এই কারণেই কি রাষ্ট্র তার সাধারণ নাগরিকদেরকে “জনসংখ্যা সমস্যা” বা ‘ব্লাডি লেবার শেণি’ বলে মনে করেছে? জনগণকে সম্পদ না ভেবে সমস্যা ভাবার এই ‘ম্যাটেরিয়ালিস্টিক’ চিন্তার ভিত নিয়ে কেউ ভেবেছে কি? এ-তো ভারতে জন্মানোর পরপরই মেয়ে শিশু মেরে ফেলার মতো চিন্তা! চীনে এক সন্তানের বেশি সন্তান না নিতে পারার আইনের মতো অবস্থা! জন্মের পরপরই অর্থের বিনিময়ে সন্তান বিক্রি করে দেবার মতো অবস্থা! দেশের মানুষকে রাষ্ট্র বিদেশে পাঠিয়েছে নিজের “সমস্যা” থেকে পরিত্রাণ পেতে। নিজের জনগণকে আবর্জনার মতো মনে করার এই ভিতের উপরেই এখনও বসে আছে রাষ্ট্র। এই “আবর্জনা”র নিরাপত্তা দেবার প্রশ্ন আসবে কিভাবে?

নিউজিল্যান্ডে তো “ব্লাডি লেবার শেণি” যায়নি! সেখানে ছিল শিক্ষিত মানুষেরা – ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, শিক্ষাবিদ। এদেরকেও রাষ্ট্র দেখেছে বাজে চোখেই। দু’পয়সা আয় করে তারা যেন দেশে ফেরত পাঠায় – এই উদ্দেশ্যেই তাদেরকে বিদেশে দেখতে চায় রাষ্ট্র; কিন্তু তাদের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব নিতে চায় না। প্রতিটা নাগরিককে রাষ্ট্র আগে দেখেছে “সমস্যা” হিসেবে; আর এখন দেখছে “কারখানা” হিসেবে! আশ্চর্য ব্যাপার হলো, যে কারখানার মালিক, তার তো কারখানার নিরাপত্তা দেবার কথা। তাহলে সেই কারখানার নিরাপত্তা সে কেন দেবার কথা চিন্তা করেনা? কারণ রাষ্ট্র তো সেই “কারখানা” থেকে আসা অর্থ নিয়েই সুখী; “কারখানা”র মালিকানা নিয়ে তার কোন দায়বদ্ধতাই নেই! অর্থাৎ বিদেশে থাকা এই জনগণকে রাষ্ট্র নিজের জনগণ হিসেবেই দেখছে না! উল্টো, নিজের নাগরিকেরা বিদেশের জন্যে কাজ করলে রাষ্ট্র তা নিয়ে গর্ববোধ করছে!

  
রবার্ট ক্লাইভ কত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছিল? কেন সে পুরো বাংলার কর্তৃত্ব নিতে চাইলো? ক্লাইভের রাষ্ট্র ব্রিটেন তাকে জন্মের পর থেকেই বেড়ে তুলেছে এমনভাবে যে এই কাজগুলি করে ফেলাটা ক্লাইভের জন্যে সহজাত ছিল। আসলে ক্লাইভ একা কাজগুলি করেনি। তার পরে যারা যারা এসেছিল, তারা সকলেই একই কাজ করেছে; কারণ তারা সকলেই একই ধরণের শিক্ষায় শিক্ষিত; ছোটবেলা থেকেই একই আদর্শকে আঁকড়ে ধরা শিখেছে তারা। একটা দরিদ্র (ফকির-প্রায়) রাষ্ট্র থেকে সুপারপাওয়ার হবার এই কাহিনী ক্লাইভদের জীবনের মাঝেই রয়েছে।


দায়িত্ব নিয়েই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আদর্শিক রাষ্ট্রগুলি

একটা দ্বায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। একটা আদর্শিক রাষ্ট্র তার চিন্তাকে বাস্তবায়িত করে, রক্ষা করে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। এই উদ্দেশ্যে সেই রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার জনগণকে পাঠায়। তাদের দেখভাল করার জন্যেও প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নেয়; সেটা যেকোন ধরণেরই হোক না কেন। জনগণও বোঝে তাদের কি করতে হবে। তারাও রাষ্ট্রের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করে। রবার্ট ক্লাইভকে এদেশের মানুষ দেখেছে একটা খারাপ মানুষ হিসেবে; যে কিনা ছলচাতুরির মাধ্যমে এদেশের নেতৃত্বকে হাত করে শেষ পর্যন্ত পুরো বাংলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ক্লাইভকে এখানে কেউ লন্ডনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেনি। ক্লাইভ কত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছিল? কেন সে পুরো বাংলার কর্তৃত্ব নিতে চাইলো? ক্লাইভের রাষ্ট্র ব্রিটেন তাকে জন্মের পর থেকেই বেড়ে তুলেছে এমনভাবে যে এই কাজগুলি করে ফেলাটা ক্লাইভের জন্যে সহজাত ছিল। আসলে ক্লাইভ একা কাজগুলি করেনি। তার পরে যারা যারা এসেছিল, তারা সকলেই একই কাজ করেছে; কারণ তারা সকলেই একই ধরণের শিক্ষায় শিক্ষিত; ছোটবেলা থেকেই একই আদর্শকে আঁকড়ে ধরা শিখেছে তারা। একটা দরিদ্র (ফকির-প্রায়) রাষ্ট্র থেকে সুপারপাওয়ার হবার এই কাহিনী ক্লাইভদের জীবনের মাঝেই রয়েছে।

এখানে উদ্দেশ্য এটা নয় যে রবার্ট ক্লাইভ বা তার আদর্শের গুণগান গাওয়া। উদ্দেশ্য হলো, একটা রাষ্ট্রের লক্ষ্যকে আলোচনায় নিয়ে আসা। লক্ষ্যহীণ এক রাষ্ট্র একুশ শতকের সুযোগ হাতছাড়া করবে – এটা নিশ্চিত। একটা রাষ্ট্রের ভিত ঔপনিবেশিক চিন্তা দ্বারা কলুষিত হলেই কেবল নিজের জনগণকে অন্যের জনগণ হিসেবে মেনে নেবার প্রবণতা তৈরি হবে। এবশ্যই ভারতের সকল জনগণ ব্রিটেনের সেবা করেছে; তাই ভারতের নাগরিকরা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনের নাগরিক হবার জন্যেই বেশি উৎসাহী ছিল সর্বদা। এখন মার্কিন, অস্ট্রেলিয় বা কানাডার নাগরিক হবার একই ধরণের প্রচেষ্টা দেখা যায় জনগণের মাঝে। কেনই বা এটা দেখা যাবে না – রাষ্ট্র তো জনগণকে “সমস্যা” মনে করে! অন্যদিকে সেই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের দুয়ার খুলে দেয় ব্রিলিয়্যান্ট মানুষগুলির জন্যে, যাতে মানুষগুলি সেই রাষ্ট্রের সেবা করতে পারে। আদর্শিক রাষ্ট্রগুলি দায়িত্ব নেয়।

বঙ্গোপসাগরে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখন অনেকেই দেখছেন। কিন্তু জনগণের দায়িত্ব না নেবার যে প্রবণতা রাষ্ট্রের মাঝে দেখা যাচ্ছে, তাতে শক্তিশালী হবার স্বপ্ন চিরকাল স্বপ্নই রয়ে যাবে। ক্রাইস্টচার্চে বাংলাদেশী জনগণের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব না পাবার কারণে আরও অনেক প্রশ্ন সামনে আসবে। নিজের জনগণই যদি রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব না পায়, তাহলে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকেরা কি আশা করতে পারে? সেখানেও কি রাষ্ট্র একইভাবে দেখে সবাইকে? বাংলাদেশে খেলতে আসা বিদেশী ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা আর মিয়ানমারের শরণার্থীদের নিরাপত্তা অবশ্যই এক হয় না। আবার দেশের মাটিতে বিদেশী ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা আর বিদেশের মাটিতে দেশী ক্রিকেটারদের নিরাপত্তাও তো এক হয় না, তাই না? কোন চিন্তার ভিত্তিতে এই মানুষগুলিকে আলাদা করে দেখা হচ্ছে? এই ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে রাষ্ট্রের মুক্তি দায়িত্ব নেবার মাঝে; দায়িত্ব এড়ানোর মাঝে নয়। আর দায়িত্ব নেবার সেই লক্ষ্য একমাত্র আদর্শিক রাষ্ট্রই ঠিক করতে পারে। একুশ শতকে বঙ্গোপসাগরে যে শক্তিশালী রাষ্ট্রটা দেখতে পাচ্ছে অনেকে – সেটা আসলে একটা আদর্শিক রাষ্ট্র; তবে তা রবার্ট ক্লাইভের ক্ষয়িষ্ণু আদর্শের নয়।