Saturday 30 September 2017

বাংলাদেশের হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার কোথায়?


৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১৭

ব্রিটিশ রয়াল নেভির হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার HMS Ocean-এর উপরে ওয়াইল্ডক্যাট, এপাচি এবং চিনুক হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে। ২০১৮ সালে জাহাজটা ব্রিটিশরা রিটায়ার করিয়ে দিচ্ছে অর্থ সংকুলান না হওয়ায়। ৮০ মিলিয়ন পাউন্ডে ব্রাজিলের কাছে অফার করা হলেও ব্রাজিল সরকার তার বর্তমান অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে তা কিনতে সক্ষম হবে কিনা, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ।


নিয়ম ভঙ্গের ইতিহাস

জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার দেখলে কেউ এখন আশ্চর্যান্বিত হন না। কিন্তু কয়জন চিন্তা করে দেখেছেন যে প্রথমবার জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার নামানোটা কতটা সহজ বা কঠিন কাজ ছিল? জার্মানরা প্রথম জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার অপারেশন চালিয়েছিল – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেসময় আটলান্টিকের ওপাড়েও আমেরিকাতেও হেলিকপ্টার নিয়ে অনেক কর্মযজ্ঞ চলছিল। জার্মান নৌবাহিনীতে হেলিকপ্টারের ব্যবহার খুব গুরুত্ববহ কিছু বয়ে আনেনি, কারণ জার্মান নৌবাহিনীর সার্ফেস ফ্লিট তেমন বড় ছিল না। অন্যদিকে মার্কিন আর ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বিশাল সার্ফেস ফ্লিটের জন্যে হেলিকপ্টার নিয়ে গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। জাহাজের উপরে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার নামানোর ব্যাপারটা ছিল নিয়ম ভঙ্গ করা এবং নতুন নিয়মের জন্ম দেয়ার একটা উদাহরণ। নতুন কিছুর জন্ম দিতে হলে নিয়ম ভঙ্গ করাটা জরুরি। আর একারণেই নিয়ম ভঙ্গ করার ইতিহাস জানাটা জরুরি।
  

 
১৯৪৩ সালের মে মাসে ‘বাংকার হিল’ নামের একটা মার্কিন তেলবাহী জাহাজের উপরে কাঠের প্ল্যাটফর্মের উপরে হেলিকপ্টার অবতরণ করে দেখানো হয় যে জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার নামতে পারে।

নৌবাহিনী নয়, মার্কিন কোস্ট গার্ডই ছিল হেলিকপ্টারের প্রবর্তক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক ব্যবহারের জন্যে হেলিকপ্টার তৈরি করার চিন্তাখানা এসেছিলো মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে। মার্কিন বিমানবাহিনী তখনও ছিল সেবাবাহিনীর একটা অংশ। অন্যদিকে মার্কিন নৌবাহিনী সমুদ্রে ব্যবহারের জন্যে হেলিকপ্টার নিয়ে একেবারেই আগ্রহী ছিল না। বরং আগ্রহী ছিল মার্কিন কোস্ট গার্ড! নৌবাহিনীর নীতিনির্ধারকেরা মনে করতেন যে তখনকার হেলিকপ্টারের ধারণক্ষমতা ছিল যথেষ্টই কম; যা কিনা ব্যবহারিক দিক থেকে তেমন একটা কার্যকারী না হবার সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়াও তারা মনে করতেন যে ঐমুহুর্তে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার জন্যে হেলিকপ্টারের চাইতে আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ছিল; তাই হেলিকপ্টারের পিছনে সময় এবং অর্থ ব্যয় করাটা যুক্তিযুক্ত হবে না। ঠিক এসময়েই – ১৯৪২ সালে মার্কিন কোস্ট গার্ডের কয়েকজন অফিসার মার্কিন বিমান ডিজাইনার ইগর সিকোর্স্কির একখানা হেলিকপ্টারের উড্ডয়ন দেখতে যান। তারা শূণ্যের মাঝে হেলিকপ্টারটাকে ঝুলে থাকতে দেখে যারপরনাই পুলকিত হন। ঐ মুহুর্তেই তারা তাদের উর্ধ্বতনদের কাছে লিখে পাঠান হেলিকপ্টার নিয়ে গবেষণায় যাতে কোস্ট গার্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন সেই অফিসারদের চিন্তা ছিল যে হেলিকপ্টারকে তারা ব্যবহার করতে পারবেন উদ্ধ্বারকারী যান হিসেবে। কিন্তু তাদেরকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয় যে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে মূল লক্ষ্য শত্রুকে হত্যা করা, মানুষ বাঁচানো নয়! এরকম অবস্থায় আরেক মার্কিন কোস্ট গার্ড অফিসারের আবির্ভাব হয়, যিনি হেলিকপ্টারের উড্ডয়ন দেখার পরে লিখে পাঠান যে এটা সাবমেরিন ধ্বংসে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই লেখাই সব হিসেব পাল্টে দিল। ওই মুহুর্তে মার্কিন সরকারের কাছে আটলান্টিকে জার্মান সাবমেরিনের হাত থেকে বাণিজ্য জাহাজের কনভয় রক্ষাটা ছিল বিরাট এক ইস্যু। তাই ওই মুহুর্তেই মার্কিন নৌবাহিনীর চীফের কাছ থেকে অনুমতিপত্র মিলে যায়। তবে নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসারের কাছ থেকে অনুমতি এলেও এই গবেষণাকে এগিয়ে নেন কোস্ট গার্ডের অফিসারেরাই। কারণ মার্কিন নৌবাহিনী তখনও হেলিকপ্টারে আগ্রহী ছিল না। তবে এক্ষেত্রে একটা ভালো সাপোর্ট তারা পায় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কাছ থেকে, যারা হেলিকপ্টারে আগ্রহী ছিল এবং বেশ কয়েক’শ হেলিকপ্টার তারা অর্ডার করেছিল।
  

   
প্রথম হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার মার্কিন কোস্ট গার্ডের যুদ্ধজাহাজ 'কব'। মার্কিন কোস্ট গার্ড ৩৭ বছরের পুরোনো ‘এসএস গভর্নর কব’ নামের একটা প্যাসেঞ্জার জাহাজ কিনে সেটাকে পরিবর্তন করে। ২৮৯ফুট (৮৮মিটার) লম্বা জাহাজটার উপরের সুপারস্ট্রাকচার প্রায় পুরোটাই ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে গড়া হয়। কিছু অস্ত্রসস্ত্রও বসানো হয় উপরে। তবে সবচাইতে বড় পরিবর্তনটা ছিল ৩৮ফুট x ৬৩ফুট আকারের কাঠের তৈরি একটা ফ্লাইট ডেক। ১৯৪৩-এর জুলাইতে জাহাজটা কমিশনিং করা হয়।



পরিবহণ জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার

১৯৪৩ সালের মে মাসে ‘বাংকার হিল’ নামের একটা মার্কিন এবং ‘এমপায়ার মার্সি’ নামের একটা ব্রিটিশ তেলবাহী জাহাজের উপরে ৪০ফুট x ৮০ফুট প্ল্যাটফর্মের উপরে হেলিকপ্টার অবতরণ করে দেখানো হয় যে জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার নামতে পারে। তবে সেটা ছিল বন্দরে ভেড়ানো জাহাজ; সমুদ্রে জাহাজের উপরে অবতরণ ছিল অন্য কথা। ‘জেমস পার্কার’ নামের একটা পরিবহণ জাহাজকে হেলিকপ্টার বহণের উপযোগী করে (৬০ফুট x ৫০ফুট প্ল্যাটফর্ম ) তার উপরে দু’টা হেলিকপ্টার দিয়ে দেয়া হয়। মার্কিন উপকূলের কাছাকাছি জাহাজটায় দুই দিন ধরে ৯৮ বার হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করে ও নেমে দেখায়। মার্কিন কোস্ট গার্ড ৩৭ বছরের পুরোনো ‘এসএস গভর্নর কব’ নামের একটা প্যাসেঞ্জার জাহাজ কিনে সেটাকে পরিবর্তন করে। ২৮৯ফুট (৮৮মিটার) লম্বা জাহাজটার উপরের সুপারস্ট্রাকচার প্রায় পুরোটাই ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে গড়া হয়। কিছু অস্ত্রসস্ত্রও বসানো হয় উপরে। তবে সবচাইতে বড় পরিবর্তনটা ছিল ৩৮ফুট x ৬৩ফুট আকারের কাঠের তৈরি একটা ফ্লাইট ডেক। ১৯৪৩-এর জুলাইতে জাহাজটা কমিশনিং করা হয়। ব্রিটিশরাও ‘এসএস দাগেস্তান’ নামের একটা জাহাজ লিজ নিয়ে সেটাকে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার বানিয়ে নেয়। ব্রিটশ নৌবাহিনী ‘দাগেস্তান’ জাহাজে হেলিকপ্টার নিয়ে প্রথম আটলান্টিক পাড়ি দেয় ১৯৪৪ সালের জানুয়ারীতে। নিউ ইয়র্ক থেকে লিভারপুল পর্যন্ত যেতে সেই জাহাজের উপর থেকে হেলিকপ্টারগুলি ৫০ফুট x ৯৬ফুট ফ্লাইট ডেকের উপরে উড্ডয়ন-অবতরণের ট্রায়াল দিতে থাকে। জাহাজটা একইসাথে ৮ হাজার টন খাদ্যশস্যও বহণ করছিল! জাহাজটা ঠিকমতো লোডিং না করায় সমুদ্রে ভীষণভাবে দুলছিল এবং কার্গো একপাশে চলে যাওয়ায় স্থায়ীভাবে ৫ ডিগ্রি বেঁকে চলছিল! ১৬ দিনের এই জার্নিতে খারাপ আবহাওয়ার দরুন (মাঝে মাঝে ১৪৮ কিঃমিঃ/ঘন্টা পর্যন্ত বাতাস ছিল!) মাত্র তিন দিন হেলিকপ্টার অপারেশন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও ৩২৮ বার হেলিকপ্টারগুলি ওঠা-নামা করে জাহাজের উপরে। তারা বুঝতে পারেন যে ৭৪কিঃমিঃ/ঘন্টা বাতাসের গতিতেও হেলিকপ্টার অপারেশন সম্ভব!

জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার নামার ইতিহাস থেকে কিছু ব্যাপার বেরিয়ে আসে –

১। পরিবহণ এবং যাত্রীবাহী জাহাজকেও যুদ্ধজাহাজ বানানো সম্ভব

২। পরিবহণ এবং যাত্রীবাহী জাহাজকেও হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার বানানো সম্ভব

৩। স্পেশালাইজড যুদ্ধজাহাজ না হলেও সেটাকে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার বানানো সম্ভব

৪। কোস্ট গার্ড এন্টি-সাবমেরিন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে

৫। কোস্ট গার্ডের যুদ্ধজাহাজ থাকতে পারে

৬। কোস্ট গার্ডের এন্টি-সাবমেরিন কর্মকান্ডের জন্যে যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা যেতে পারে


মার্কিন নৌবাহিনীও তাদের নতুন তৈরি করা USS Lewis B. Puller জাহাজটাকে পারস্য উপসাগরে পাঠিয়ে কমিশনিং করেছে ২০১৭-এর অগাস্টে। এই জাহাজটা এখন CH-53-এর মতো বিশাল হেলিকপ্টার যেমন অপারেট করতে পারবে, আবার এপাচি এটাক হেলিকপ্টারও অপারেট করতে পারবে। Expeditionary Mobile Base(ESB)নামের একটা নতুন ক্যাটাগরিই তারা তৈরি করে ফেলেছে কম খরচে (৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার) হেলিকপ্টার অপারেশনের জন্যে। যেখানে একটা এম্ফিবিয়াস হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার তৈরি করতে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, সেখানে পাঁচ ভাগের এক ভাগ খরচেই কমার্শিয়াল তেলবাহী জাহাজের ডিজাইনের উপরে কিছু পরিবর্তন করে স্পেশালাইজড জাহাজের বেশ কিছু কাজ করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে।


কম খরচে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার


বাংলাদেশে এখনো অনেকেই নিয়ম ভাঙতে পারছেন না বলে অনেক কিছুই তাদের জন্যে কঠিন ঠেকছে। তাদের জন্যেই নিয়ম ভাঙ্গার এই ইতিহাসটুকু দেয়া। যেটা মনে রাখতে হবে তা হলো, নতুন যেকোন কিছুই তৈরি হয়েছে বর্তমান নিয়ম ভাঙ্গার মাধ্যমে। পৃথিবীর যে সময়টাতে কোন হেলিকপ্টার ছিল না, সে সময়টা নিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার আসলে তেমন বিশাল কোনকিছু নয়। একটা জাহাজের উপরে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার মাধ্যমেই হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার তৈরি করা যায়। ব্রিটিশরা কয়েকটা কনটেইনার জাহাজকে ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিল হেলিকপ্টার এবং হ্যারিয়ার বিমান বহণ করে নিয়ে যাবার জন্যে। তার মাঝ থেকে একটা জাহাজকে পরবর্তীতে স্পেশালাইজড হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার বানিয়ে ফেলে তারা। RFA Argus নামের ঐ জাহাজটা World War Z নামের একটা হলিউড মুভিতেও ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্রিটিশ রয়াল নেভি HMS Ocean নামে আরেকটা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার তৈরি করে, যার ১৯৯৮ সালে খরচ পড়েছিল ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড; যা আজকের হিসেবে ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের (৪০০ মিলিয়ন ডলার) মতো। কমার্শিয়াল ডিজাইনকে পরিবর্তন করে ঐ জাহাজটা তৈরি করা হয়েছিল বলেই এতো কম খরচে তৈরি করা গিয়েছিল। ২০১৮ সালে জাহাজটা ব্রিটিশরা রিটায়ার করিয়ে দিচ্ছে অর্থ সংকুলান না হওয়ায়। ৮০ মিলিয়ন পাউন্ডে ব্রাজিলের কাছে অফার করা হলেও ব্রাজিল সরকার তার বর্তমান অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে তা কিনতে সক্ষম হবে কিনা, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ।

মার্কিনীরাও খরচ বাঁচানোর দিকেই যাচ্ছে। Expeditionary Mobile Base(ESB)নামের একটা নতুন ক্যাটাগরিই তারা তৈরি করে ফেলেছে কম খরচে (৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার) হেলিকপ্টার অপারেশনের জন্যে। এই ক্যাটাগরিকেও তারা বেশ কয়েক দফা নামকরণ করেছে; এখনকার নামটাই যে স্থায়ী, সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। যাই হোক, যেখানে একটা এম্ফিবিয়াস হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার তৈরি করতে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, সেখানে পাঁচ ভাগের এক ভাগ খরচেই কমার্শিয়াল তেলবাহী জাহাজের ডিজাইনের উপরে কিছু পরিবর্তন করে স্পেশালাইজড জাহাজের বেশ কিছু কাজ করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। মার্কিনরী দুনিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছে বলেই বাকি দুনিয়ার মানুষ কষ্ট করে তাদের তৈরি করা LHA, LHD, LPH, LSD, LPD, ইত্যাদি সংজ্ঞা মুখস্ত করছে মিলিটারি একাডেমিগুলিতে। অথচ তারা নিজেরাই প্রতি নিয়ত এরকম সংজ্ঞার জন্ম দিচ্ছে। বাকিরা সেই সুরের তালেই নেচে যাচ্ছে। নিজেদের কোন কনসেপ্ট জন্ম দেবার ক্ষমতা নেই!
    
 
ব্রিটিশরা কয়েকটা কনটেইনার জাহাজকে ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিল হেলিকপ্টার এবং হ্যারিয়ার বিমান বহণ করে নিয়ে যাবার জন্যে। তার মাঝ থেকে একটা জাহাজকে পরবর্তীতে স্পেশালাইজড হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার বানিয়ে ফেলে তারা। RFA Argus নামের ঐ জাহাজটা World War Z নামের একটা হলিউড মুভিতেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

কমার্শিয়াল জাহাজের উপরে তৈরি করা এহেন জাহাজগুলি দেখতে খুব মারাত্মক কিছু না হলেও যে কাজের জন্যে তৈরি, সেটা কিন্তু করে ফেলতে পারছে। ব্রিটিশ রয়াল নেভির RFA Argus এবং HMS Ocean জাহাজগুলি সারা দুনিয়াতে ব্রিটেনের প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করেছে। মার্কিন নৌবাহিনীও তাদের নতুন তৈরি করা USS Lewis B. Puller জাহাজটাকে পারস্য উপসাগরে পাঠিয়ে কমিশনিং করেছে ২০১৭-এর অগাস্টে। যেটা সকলের জন্যেই একটা মেসেজ হিসেবে গিয়েছে। এই জাহাজটা এখন CH-53-এর মতো বিশাল হেলিকপ্টার যেমন অপারেট করতে পারবে, আবার এপাচি এটাক হেলিকপ্টারও অপারেট করতে পারবে। মিশনের উপরে নির্ভর করবে জাহাজটা কোন হেলিকপ্টার বহন করবে। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে জাহাজের উপরে যা বহণ করা হবে, সেটা নির্ধারণ করবে জাহাজের শক্তি-সামর্থ্য। জাহাজটা তার নিজের আত্মরক্ষার জন্যে যেকোন মডিউলার অস্ত্রও বহন করতে পারবে, যা কিনা জাহাজটার পুরো সক্ষমতাকেই পাল্টে দেবে মুহুর্মুহু।

বাংলাদেশের হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার কোথায়?

শক্তিশালী রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের তৈরি করা নিয়ম মেনে চলবে না; নিজেই নিয়ম তৈরি করতে জানবে। যুদ্ধজাহাজের অপারেটিং কনসেপ্টগুলিও সেরকমই। অন্যের কনসেপ্ট মেনে চললে অন্যের নেতৃত্বই মেনে চলতে হবে চিরকাল। আর অন্যের নেতৃত্ব মেনে চলতে গেলে অন্যের উদ্দেশ্যই বাস্তবায়িত হতে থাকবে; নিজের উদ্দেশ্যই হবে অন্যের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন! এভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি হয় না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি দেখিয়ে দেয় যে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। আর এর জন্যে শক্ত অবস্থান নিতে হবে, নতুবা অন্যের দাস হয়ে থাকতে হবে। বাংলাদেশের উদ্দেশ্য ভারতের মতো নয়। ভারত যেভাবে পরাশক্তির দাস হয়ে চিরকাল বাংলাদেশের সাথে সমস্যা করতে থাকবে, সেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নয়। তাই বঙ্গোপসাগর পাহাড়া দেবার জন্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তা দরকার – এমন শিয়ালের কাছে মুরগি দেবার মতো চিন্তা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশের হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার থাকাটা “অন্যায়” নয়, “অবাস্তব”ও নয়, বরং নেকড়ের পালের মাঝে বসবাস করার জন্যে অতি জরুরি।

Tuesday 26 September 2017

ভারতের আধিপত্যবাদকে যেভাবে মোকাবিলা করবে বাংলাদেশ

মালদ্বীপের রাজধানী মালের অদূরে ২০১২ সালে ভারত-শ্রীলংকা-মালদ্বীপ অংশ নিচ্ছে যৌথ সামরিক মহড়া 'দোস্তি-১১'-তে। ভারত যৌথ সামরিক মহড়াগুলিকে ব্যবহার করে এই এলাকার ছোট দেশগুলির উপরে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে। ভারতের প্রভাবকে কমাতে হলে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের ছোট দেশগুলির সাথে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে।    
২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৭

দুর্বল রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদ


ভারত একটা দুর্বল রাষ্ট্র। দুর্বল ভারতকে সর্বদাই সুপারপাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করেছে, এবং উপমহাদেশকে ‘সঠিকভাবে’ বিভাজিত রেখে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে কোন শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাবকে থামিয়ে রেখেছে, যা কিনা সুপারপাওয়ারের বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা ফর্মূলা। একসময় সোভিয়েত রাশিয়া ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করেছে; এখন করছে যুক্তরাষ্ট্র। এতবড় একটা রাষ্ট্রের বিশাল সম্পদকে সুপারপাওয়ার ব্যবহার করতে চাইবে – এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এধরনের ভূরাজনৈতিক খেলার কারণে ভারতের প্রতিবেশীদের বারোটা বাজছে সর্বদাই। ঠিক একারণেই ভারত তার প্রতিবেশীদের জন্যে হুমকিস্বরূপ। চীনকে ব্যালান্স করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ব্যবহার করছে। ভারতকে তারা নিয়ে গেছে দক্ষিণ চীন সাগর, এবং ফিলিপাইন সাগরে। আর চীন অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে তার নৌবাহিনী নিয়ে। বাব-এল মান্ডেব প্রণালীর পাশে জিবুতিতে করেছে সামরিক ঘাঁটি [১]; পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং মিয়ানমারে করছে স্ট্র্যাটেজিক প্রজেক্ট [২] । আর এতে এই অঞ্চলে ভারত-চীন দ্বন্দ্বও উঠেছে চরমে। মজার ব্যাপার হলো, এই পুরো গেমটারই নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতকে চীনের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক ইউনিটগুলিকে ভারত মহাসাগরের অন্যত্র মোতায়েন করতে সক্ষম হচ্ছে। এভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে ভারত। [৩]



মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে অং সান সু কি-র মাধ্যমে। আর সেই সুযোগখানা নিতে পেছনে পেছনে ঢুকেছে ভারত। এর আগে মিয়ানমারে যেমন চীনের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল, এখন সেটা বিভক্ত হয়ে গেছে চীন আর ভারতের মাঝে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করেছে। মিয়ানমারে প্রভাব ধরে রাখতে ভারত আর চীন উভয়েই মিয়ানমারের উগ্রপন্থী জঙ্গি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে না তাকানোর নীতি নিয়েছে। রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়াতে এই নীতি নেয়া উভয়ের জন্যেই হয়েছে সহজ, কারণ উভয় দেশেই মুসলিমরা নিপীড়িত। রাখাইনে মুসলিমদের উপরে নিপীড়নের কারণে সরাসরি সমস্যায় পতিত হয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রেও ভারত ও চীন উভয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে গিয়ে তারা মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবে না। অর্থাৎ মিয়ানমার তাদের জন্যে বাংলাদেশের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের কেউই আসলে বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী একটা রাষ্ট্রকে দেখতে চাইছে না। এই সিদ্ধান্ত তাদের জন্যে কতটা বিপদ বয়ে আনছে, সেটা তারা এখনো অনুধাবন করতে সক্ষম হননি।



ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়ায় ভারত এবং চীন তাদের প্রতিযোগিতাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, যা কিনা তার প্রতিবেশীদের নাভিশ্বাস উঠিয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা ‘ইনজেক্ট’ করার আগেই বেশ ক’বছর ধরে ভারত-চীন ঠেলাঠেলি চলছে। চীনের অর্থায়নে বিভিন্ন বড় প্রজেক্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গ্রুপগুলি বিভিন্নভাবে সেই প্রজেক্টগুলিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন বসাতে জেটি বানাতে গিয়ে আদালতে মামলা করে প্রজেক্ট আটকে দিয়েছে; দেরি করিয়েছে ছয় মাস। চার-লেইন প্রজেক্টে শুধু চাইনিজ সেকশনে গাদা-গাদা মামলা করে দেরি করিয়েছে কয়েক বছর। বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্যে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে মারামারি করিয়ে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। পত্রিকায় রিপোর্ট করে বিভিন্ন প্রজেক্টের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করেছে। বিমানবন্দর উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর – এসব প্রজেক্ট আটকে দিয়েছে একাধিকবার। এলএনজি প্রজেক্ট পিছিয়ে দিয়েছে কমপক্ষে পাঁচ বছর। আর পদ্মা সেতুর কথা সবাই জানেন। যারা এই কাজগুলি করেছে, তাদের দু’টা উদ্দেশ্য একত্রে হাসিল হয়েছে – ১। চীনের প্রভাবকে ব্যালান্স করা এবং ২। বঙ্গোপসগরে শক্তিশালী একটা রাষ্ট্র তৈরিতে বাধা দেয়া। ভারত-মার্কিন-চীনা এই ভূরাজনৈতিক খেলায় নাভিশ্বাস উঠেছে বাংলাদেশের জনগণের। শুধু কি বাংলাদেশের জনগণের? না; আশেপাশের দেশগুলিতেও এই খেলা চলছে।

    
জুন ২০১৭ - ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ 'আইএনএস তেগ' টেনে নিয়ে চলেছে মরিশাসের জন্যে তৈরি প্যাট্রোল বোট 'ভ্যালিয়্যান্ট'-কে। ভারত বিভিন্ন দেশে তার প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। রপ্তানি এগিয়ে নিতে ঋণও দিচ্ছে ভারত সরকার।

ভারতের আধিপত্যবাদ এবং সামরিক হস্তক্ষেপ




মিয়ানমারের নৌবাহিনী ৩টা ফ্রিগেট নিজ দেশেই চীনের সহায়তায় তৈরি করলেও ভারতের সাথে মিয়ানমারের সখ্যতা বাড়ার পর থেকে চীন এক পা এগুচ্ছে তো তিন পা পেছাচ্ছে। বহুদিন ধরে জাহাজগুলির কাজ ঝুলে ছিল। এই সুযোগে ভারত এই ফ্রিগেটগুলির জন্যে রাডার এবং সোনার সরবরাহ করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিমান, জাহাজ এবং সাবমেরিন খুঁজতে বা টার্গেট করতে মিয়ানমার নৌবাহিনী ভারতীয় ইলেকট্রনিক্স (ইউরোপিয়ান জিনিস লাইসেন্স প্রডাকশন) ব্যবহার করবে! এখন মিয়ানমার নৌবাহিনীর জন্যে অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল (ওপিভি) দিতে চাচ্ছে ভারত, যেগুলিকে খুব শিগগিরই হয়তো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিপক্ষে দেখা যাবে সমুদ্রে। ভারত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আরও বেশি করে সামরিক প্রশিক্ষণ দেবার চেষ্টায় রয়েছে। উভয় দেশ খুব শিগগিরই যৌথ সামরিক মহড়া দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ভারতের স্পেশাল ফোর্স অপারেশনও চালিয়েছে, কিন্তু মিয়ানমার তাতে কিছুই মনে করেনি। মিয়ানমারের সাথে ভারতের সামরিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্যে নতুন হুমকি তৈরি করছে।



শ্রীলংকায়ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে ভারত আর চীনের মাঝে বেশ বড়সড় ধাক্কাধাক্কি হয়ে গেছে। ভারত কিছুতেই শ্রীলংকাতে চীনা সমুদ্রবন্দর সমর্থন করবে না, সেটা শ্রীলংকার অর্থনীতির জন্যে যতটা গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন। শ্রীলংকার সামরিক বাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারত। যাদিও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হিসেব করলে শ্রীলংকারই বরং প্রশিক্ষক হবার কথা! শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর জন্যে ভারত দিয়েছে দু’টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল (ওপিভি)। আরও দু’টা নতুন ওপিভি তৈরি করে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে তাদের কোস্ট গার্ডের একটা কাটার। অস্ট্রেলিয়াও দিয়েছে প্যাট্রোল বোট। এর আগের চীনা এবং ইস্রাইলী প্যাট্রোল বোটগুলিকে ভূরাজনৈতিকভাবে ব্যালান্স করছে এগুলি। শ্রীলংকাকে সামরিক রাডারও দিয়েছে ভারত। তামিল টাইগারদের কয়েক যুগ ধরে সহায়তা দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে এখন সামরিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টাকে কি ধরনের দু’মুখী নীতি বলা উচিৎ?

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল, যাকে ভারত "নিজস্ব হ্রদ" মনে করে
    

১৯৮৮ সালে মালদ্বীপেও সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল ভারত (অপারেশন ক্যাকটাস)। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টকে রক্ষার নামে এই সামরিক হস্তক্ষেপ ভারতের প্রভাব বিস্তারেরর অংশ ছিল। এখন সেখানে চীনের সাথে ভারতের চলছে ব্যাপক প্রতিযোগিতা। মালদ্বীপে বিমানবন্দরের উন্নয়ন ভারতীয় অর্থায়নে না করে চীনা অর্থায়ন করায় ভারত জোরেসোরে লেগেছে এর পেছনে। অথচ বর্তমানে পুরো মালদ্বীপ জুড়ে রাডার বসাচ্ছে ভারত, যাতে মালদ্বীপের আশেপাশের পুরো এলাকার সমুদ্রের উপরে নজরদাড়ি করা যায়। ২০০৭ সালে প্রথমটা, ২০১২ সালে দ্বিতীয়টা এবং ২০১৫ সালে তৃতীয় রাডারটা বসায় ভারত। মালদ্বীপকে দু’টা সামরিক হেলিকপ্টার, কিছু সামরিক গাড়ি, আর প্যাট্রোল বোট দিয়েছে ভারত। এর উপরে নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং যৌথ মহড়া তো আছেই। এগুলির মাধ্যমে মালদ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ভারত।



নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক নিম্নমুখী বেশ অনেকদিন ধরেই। চীন হিমালয়ের মাঝ দিয়ে কাঠমুন্ডু পর্যন্ত রাস্তা তৈরির পর থেকে নেপালকে নিয়ে ভারত-চীনের খেলা বেড়ে চলেছে। নেপাল সর্বদা ভারতের সাথেই যৌথ সামরিক মহড়া চালাতো। কিন্তু ২০১৭-এর মে মাসে সেখানে যুক্ত হয়েছে চীন। নেপালের উপরে চাপ সৃষ্টির যেকোন সুযোগই ভারত হাতছাড়া হতে দেয়নি। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড হওয়া নেপালে একই বছরের সেপ্টেম্বরেই ভারত মদেশী আন্দোলনের নাম করে ‘আনঅফিশিয়াল’ অবরোধ দেয়। ভূমিকম্পের পরপর রিলিফের কাজ করতে আসা ভারতীয়দের ভাবচক্করের বিরুদ্ধে যেমন নেপালিরা খেপে গিয়েছিল, সেই খেপা ভাবটাই মদেশী আন্দোলনের সময় আরও ব্যাপক বিস্তৃতি পেয়েছে।



ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশ মরিশাস এবং সেইশেল-এও ভারত প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। ১৯৮৬ সালে ‘অপারেশন ফ্লাওয়ারস আর ব্লুমিং’-এর নামে ভারত সরকার সেইশেল সরকারকে অভ্যুত্থান থেকে বাঁচাবার নামে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। ১৯৮৩ সালে ‘অপারেশন লা দোরা’র নামে ভারত সরকার মরিশাসে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছিল; শেষ মুহুর্তে তা বাতিল করা হয়। বর্তমানেও সেইশেল এবং মরিশাসে ভারতের প্রভাব রয়েছে। তাদের জন্যে ভারত দিচ্ছে প্যাট্রোল বোট। ২০১৪-এর ডিসেম্বরে মরিশাসের জন্যে ভারত একটা ওপিভি তৈরি করে দিয়েছে। সেটা কেনার জন্যে আবার মরিশাস সরকারকে ঋণও দিয়েছে ভারত। ২০১৭ সালেও মরিশাসের কাছে প্যাট্রোল বোট বিক্রি করেছে ভারত। এভাবে ঋণের মাধ্যমে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে ছোট দেশগুলির উপরে ভারত তার প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করে যাচ্ছে।

ডিসেম্বর ২০১৪ - বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাহাজ 'বিএনএস সমুদ্র জয়' পানি সহায়তা নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে। এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব কমাতে বাংলাদেশকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সামরিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।    
 

বাংলাদেশের সাথে আশেপাশের দেশগুলির সম্পর্ক



শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ উভয় দেশই বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের সমুদ্র-বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাব। একইসাথে শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে প্রাচীন এক বন্ধন। একসময় এই বদ্বীপের মানুষেরাই শ্রীলঙ্কাকে বসবাসের উপযোগী করেছিল। আর মালদ্বীপের মানুষের সাথে বাংলাদেশের মানুষের বন্ধনও যথেষ্ট গভীর। মালদ্বীপের অর্থনীতির মূলে রয়েছে তাদের ট্যুরিজম ব্যবসা, যেখানে বেশিরভাগ লোকই বাংলাদেশী। মাত্র চার লাখ মানুষের ঐ দেশে ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশীর বসবাস! উভয় দেশেই সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দুর্যোগে বাংলাদেশ সহায়তা দিয়েছে। ২০১৪-এর ডিসেম্বরে মালদ্বীপে পানি সমস্যা হলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ দিয়ে মালদ্বীপে পানি এবং পানি শোধনের যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়েছিল। ২০১৬-এর জানুয়ারীতে মালদ্বীপকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে তৈরি গাড়িও দিয়েছে। ২০১৭-এর মে-জুন মাসে শ্রীলংকায় বন্যার সময় বিমান বাহিনীর বিমান এবং নৌবাহিনীর জাহাজে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠায় বাংলাদেশ। [৪]



নেপালের দুর্যোগের সময়েও বাংলাদেশ সহায়তা দিয়েছে। সেখানে ভূমিকম্পের সময় ফায়ার সার্ভিসের দল গেছে। পরবর্তীতে ২০১৬-এর মাঝামাঝি বাংলাদেশ নেপালের খাদ্য সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করলে ১০ হাজার টন চাল পাঠায়। ভারত-সমর্থিত মদেশী আন্দোলনের সময়ও বাংলাদেশ নেপালকে সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নেপালের ব্যবহারের জন্যে সৈয়দপুর বিমানবন্দর এবং মংলা সমুদ্রবন্দরও অফার করেছে বাংলাদেশ। নেপালের সাংকোশি নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা বাংলাদেশে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে, যা কিনা ভারতের দয়াদাক্ষিন্যের উপরে নির্ভর করছে এখনও।



২০১৭-এর জুনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মরিশাস একটা ভোটের আয়োজন করে। যার মূল ছিল মরিশাসের আশেপাশের দ্বীপগুলি মরিশাসের অধীনেই থাকা উচিৎ ছিল কিনা। এই দ্বীপগুলি এখনও ব্রিটিশ উপনিবেশ। আর এর একটি দ্বীপ হলো দিয়েগো গার্সিয়া, যেখানে মার্কিন বিমান বাহিনীর বি-৫২ বোমারু বিমানের ঘাঁটি রয়েছে। ৯৪টি দেশ মরিশাসের পক্ষে এবং ১৯টি দেশ বিপক্ষে (যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সহ) ভোট দেয়। ৬৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে (চীন এবং রাশিয়া সহ)। বাংলাদেশ মরিশাসের পক্ষে ভোট দেয়। এই ভোটের ফলাফল খুব বেশি কিছু না হলেও এই ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশ মরিশাসের রাজনীতিতে প্রবেশ করলো। ২০১৪ সালের হিসেব অনুযায়ী মরিশাসে কর্মরত ৩৮ হাজার বিদেশী শ্রমিকের মাঝে সাড়ে ২১ হাজার এসেছে বাংলাদেশ থেকে, ২০১১ সালে যে সংখ্যাটা ছিল ১০ হাজারের মতো। মরিশাসের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতেই এরা কাজ করছে মূলতঃ। সাড়ে ১২ লাখ মানুষের ছোট্ট একটা দ্বীপ দেশের জন্যে সংখ্যাটা বেশ বড়। দ্বীপে ভারতের আধিপত্য থাকায় বাংলাদেশী শ্রমিকেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বোঝাই যায় যে বাংলাদেশ এখনো দায়িত্ব নেবার সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেনি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের মরিশাসের পক্ষে দাঁড়ানোটা বাংলাদেশের সামনে একটা নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের বুঝতে হবে যে মরিশাস এবং সেইশেল বাংলাদেশের সাথে আফ্রিকার যোগাযোগ পথের মাঝে অবস্থিত। আর যেহেতু সামনের দিনগুলিতে আফ্রিকা বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, তাই মরিশাস এবং সেইশেলের গুরুত্বও বাংলাদেশের কাছে বাড়তে বাধ্য।

বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের একটা গ্রুপ ফটো। বাংলাদেশ তার বিশ্বমানের সামরিক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটগুলিকে এই অঞ্চলের দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যবহার করতে পারে।  
 

বাংলাদেশের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে দায়িত্ব নিতে হবে



মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিয়েছে যে পিছনের সীটে বসে কূটনীতি হয় না। পিছনের সীটে বসলে কেউ পাত্তাও দেবে না; বরং যাচ্ছেতাই ব্যবহার করবে। অন্যদিকে দায়িত্ব নিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসার চেষ্টা বাংলাদেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ সামনের দিনগুলিতে কিছু কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করতে পারে, যা কিনা অদ্য অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে প্রভাবিত করবে। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সেইশেল এবং মরিশাসের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।



১। বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা আরও সম্প্রসারিত করা।



২। যোগাযোগ বৃদ্ধি। অদ্য এলাকার দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের বিমান, সড়ক এবং নৌযোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে দাপ্তরিক ঝামেলাগুলিকে কমাতে হবে।



৩। সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশের সামরিক প্রশিক্ষণ সংস্থাগুলিতে এসব দেশের প্রশিক্ষণার্থীদের প্রাধান্য দেয়া এবং তাদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সুসম্পর্ক তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল ইউসুফ বুরাতাই-এর কথা বলা যেতে পারে, যিনি বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। তাঁর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্পর্ক কতটা গভীর, তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলালের নাইজেরিয়া সফরের সময় বেশ বোঝা গিয়েছিল।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এসল্ট রিভার ক্রসিং মহড়া। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর শুধুমাত্র নিজেরা মহড়া দিলেই হবে না। এই অঞ্চলের ছোট দেশগুলির সামরিক বাহিনীর সাথেও যৌথ মহড়ার আয়োজন করতে হবে। নেকড়ের ঝাঁকের মাঝে বসবাস করতে গেলে বিড়াল হয়ে থাকা যাবে না। নিজে বিড়াল হলে ভেড়ার পালকে নেকড়ের কাছেই ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি বিড়াল হয়ে বেঁচে থাকার বাসনা পরিহার করতে হয়, তাহলে ভেড়ার পালের দায়িত্ব নিতে হবে।
  

৪। যৌথ মহড়ার আয়োজন। এসব দেশের সাথে নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করতে হবে। নিয়মিত নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমান বাহিনীর বিমান এবং স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের পাঠাতে হবে যৌথ প্রশিক্ষণের জন্যে। নেপালের সাথে মাউন্টেন ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং, শ্রীলংকার সাথে জাঙ্গল ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং, মালদ্বীপের সাথে এম্ফিবিয়াস ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং করতে হবে। ভারত এতে কি মনে করলো, সেটা চিন্তা করে উচিৎ কাজ বাদ দেয়া যাবে না।



৫। নিরাপত্তা চিন্তার আমূল পরিবর্তন সাধন করা। এখন থেকেই চিন্তা করতে হবে যে নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের জাহাজ মালদ্বীপ-সেইশেল-মরিশাসে যেতে পারবে কিনা; বিমান বাহিনীর বিমান রিফুয়েলিং ছাড়া (বা শ্রীলংকায় রিফুয়েলিং করে) ঐ দ্বীপ দেশগুলিতে ল্যান্ড করতে পারবে কিনা। ঐসব দেশের ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝা এবং শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। বিমান বাহিনীর কোন বিমান নেপালের দুর্গম এলাকায় ল্যান্ডিং করতে পারবে এবং সেই ল্যান্ডিং-এর জন্যে ট্রেনিং নেপালের কাছ থেকে পাওয়া যাবে কিনা; ইত্যাদি।



নেকড়ের ঝাঁকের মাঝে বসবাস করতে গেলে বিড়াল হয়ে থাকা যাবে না। নিজে বিড়াল হলে ভেড়ার পালকে নেকড়ের কাছেই ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি বিড়াল হয়ে বেঁচে থাকার বাসনা পরিহার করতে হয়, তাহলে ভেড়ার পালের দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব নেবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেই দায়িত্ব শুধু বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাঝে রেখে দিলেই হবে না। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্ববহ বিষয়গুলিতে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। ভেড়ার পালের নিরাপত্তা দিতে হবে; নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। রাখাইনের রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশকে দায়িত্ব নেবার এবং নিরাপত্তা দেবার শিক্ষাটাই দিয়েছে।


[১] 'পূর্ব আফ্রিকায় সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা', সাম্প্রতিক দেশকাল, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
[২] 'চীন-মিয়ানমার - পাইপলাইনের রাজনীতি', সাম্প্রতিক দেশকাল, ১২ নভেম্বর ২০১৫
[৩]  'চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র', সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৭ জুন ২০১৬
[৪] 'দক্ষিণ এশিয়ার রিলিফ ডিপ্লোম্যাসি', সাম্প্রতিক দেশকাল, ২৬ মে ২০১৬

Monday 11 September 2017

বাংলাদেশের সামরিক বাজেট নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে

মিয়ানমারের সামরিক প্যারেডে শোভা পাচ্ছে রাশিয়ায় তৈরি শক্তিশালী Kvadrat-M (Buk-M1) মিডিয়াম-রেঞ্জ এয়ার-ডিফেন্স মিসাইল। যুগের পর যুগ যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-সমর্থিত সুশীলদের কথা শুনে সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী পত্রিকা প্রতিদিনের খবরে তথাকথিত "সুশীল সমাজ"এর কিছু লোককে প্রতিদিন হাইলাইট করেছে। "খবর" বলে প্রকাশিত ঐসব বিবৃতি ঔপনিবেশিকদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছুই করেনি। এই ঔপনিবেশিক এজেন্টদের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের কারণে বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী দেশগুলির সামরিক দিক থেকে বিরাট অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হয়েছে।


১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭


  
ঔপনিবেশিক এজেন্টদের সামরিক বাহিনী-বিরোধী প্রপাগান্ডা 

যুগের পর যুগ যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-সমর্থিত সুশীলদের কথা শুনে সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী পত্রিকা প্রতিদিনের খবরে তথাকথিত "সুশীল সমাজ"এর কিছু লোককে প্রতিদিন হাইলাইট করেছে। "খবর" বলে প্রকাশিত ঐসব বিবৃতি ঔপনিবেশিকদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছুই করেনি। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়ে এই লোকগুলিকে দিয়ে মানুষের আবেগ যেদিকে যায় এমন সব কথাবার্তা বলিয়ে এদের পক্ষে বড় একটা সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করেছে। সময় সুযোগমত এরা সর্বদা বাংলাদেশের সামরিক শক্তি তৈরিতে বাধা দিয়েছে। যেকোন সামরিক উন্নয়ন পদক্ষেপকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় বলে উপস্থাপন করেছে, এবং সন্তর্পণে প্রতিবেশী দেশ ভারত বা মিয়ানমারের সামরিক শক্তির উন্নয়নের ব্যাপারগুলিকে এড়িয়ে গিয়েছে। এরা তৈরি করেছে সামরিক-বেসামরিক বিভেদ। সমাজের প্রভাবশালী মহলের মাঝ থেকে কেউ যেন সামরিক বাহিনী সদস্য হয়ে না যায়, তারা সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। এমন একটা চিন্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে যে 'ভালো ঘরের ছেলেপেলার মিলিটারিতে কেন যাবে'!!

বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্টগুলি জায়গা নষ্ট করছে বলে একজন তথাকথিত মানবাধিকারকর্মী সাংবাদিক সন্মেলন করে বলেন যে, "বাংলাদেশে জমির দাম সাংঘাতিক। জমি তো সোনার চেয়েও দামি বাংলাদেশে।... এতো বিশাল জমি তাদের আবাসনের জন্য কেন দরকার? হাজার হাজার একর জমি তারা নিয়ে নিয়েছে তাদের বাসস্থানের জন্য। - কেন?" তাদের কথায়, সেনানিবাস প্রতিষ্ঠার নামে একের পর এক বসত ভিটা, কৃষিজমি, বনভূমি, জলাধার বেআইনিভাবে বেহাত হচ্ছে। দেশের প্রতিরক্ষার উন্নয়নের চাইতে দেশের সেকুলার সাংস্কৃতিক উন্নয়ন (নাচ-গান-কবিতা আবৃত্তি) তাদের কাছে সর্বদাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছে। আরেক দল আবার পরিবেশ আন্দোলনের নাম করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রজেক্টের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে (বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্ট্র্যাটেজিক শিল্পকারখানা) বাধাগ্রস্ত করতে "পরিবেশ দূষণ"এর নামে আদালতে মামলা করে কাজের স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছে। আবার সামরিক ক্রয়ের কথা শুনলেই পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে বিবৃত দিয়েছে এরা। "স্বচ্ছতার অভাব"এর কথা বলে সামরিক ক্রয় বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে বারংবার। তথাকথিত দূর্নীতি-বিরোধী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে "সামরিক খাতে বাংলাদেশের দুর্নীতির ঝুঁকি রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত গোপন বিষয়গুলো সম্পর্কে সংসদে যেমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয় না, তেমনি নিরাপত্তা খাতের বার্ষিক হিসাবের নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়েও কোনো বিতর্কের প্রমাণ মেলে না।"

এজেন্টরা বাংলাদেশকে ঘোরের মাঝে রেখে দুর্বল করেছে

এই ঔপনিবেশিক এজেন্টদের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের কারণে বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী দেশগুলির সামরিক দিক থেকে বিরাট অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ধারও অনেক কমে গেছে। কূটনৈতিক ভাষার পেছনে সামরিক শক্তি যে প্রচ্ছন্ন হুমকি বহণ করে, সেটা অন্য কিছুতে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যে এক্ষেত্রে তার প্রতিবেশীদের থেকে পিছিয়ে আছে, তা সীমান্ত হত্যা, সীমান্ত প্রহরার বাহিনীর মাঝে গোলা বিনিময়, সমুদ্র ও আকাশাসীমা লংঘন, ইত্যাদি ঘটনায় মোটামুটি পরিষ্কার। মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনাকে মিয়ানমার গুরুত্ব দেয়নি একেবারেই। একে তো মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছে, অন্যদিকে চীন এবং রাশিয়াও যে কিছু বলবে না, সেটা মিয়ানমার জানে। একইসাথে তারা এটাও টের পেয়েছে যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী মিয়ানমারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করবে না। যেকারণে রাখাইনে সামরিক অভিযান তারা চালিয়েই গেছে।
  


নিজ দেশে তৈরি মিয়ানমার নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক ফ্রিগেট 'সিন-ফায়ু-সিন'। নৌবাহিনীর স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিক থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশের চাইতে বহু বছর এগিয়ে আছে। যতদিনে বাংলাদেশ ৫০মিটারের পদ্মা-ক্লাসের প্যাট্রোল বোট তৈরি শুরু করেছে, ততোদিনে মিয়ানমার ১০৬মিটার স্টেলথ ফ্রিগেট তৈরিতে বেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে তৈরি 'দুর্জয়'-ক্লাসের জাহাজগুলি এখনো অপারেশনাল হয়নি; অথচ মিয়ানমারের স্টেলথ ফ্রিগেটগুলি অলরেডি কমিশন্ড হয়ে গেছে।


মিয়ানমার নৌবাহিনী - বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে

মিয়ানমারের সামরিক উন্নয়ন তাদের নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যেই মিয়ানমার তার সামরিক ইন্ডাস্ট্রিকে বেশ ভালোই উন্নয়ন করেছে। নিজেদের সামরিক গাড়ি বানানো ছাড়াও নৌবাহিনীর জন্যে ফ্রিগেট, কর্ভেট, ওপিভি, মিসাইল বোট, টর্পেডো বোট এবং ল্যান্ডিং ক্রাফট তৈরি করছে তারা। '৯০-এর দশকের শুরুতে যখন দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হয়, তখনই তারা বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে ব্যালান্স করার নিমিত্তে যুদ্ধজাহাজ তৈরি শুরু করে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১২ সালের মাঝে তারা ৪৫ মিটার লম্বা ২০টি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছে যেগুলির ১১টি সজ্জিত হয়েছে চীনে তৈরি সি-৮০২ সারফেস-টু-সারফেস মিসাইল দিয়ে। শুধু তা-ই নয়, এগুলির অনেকগুলিরই নিজস্ব বিমান-প্রতিরক্ষা রয়েছে। 'ইগলা' সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল দেখা যায় এগুলির অনেকগুলির উপরেই।

মিয়ানমার ‘আনাওইয়াহতার’-ক্লাসের ৭৭ মিটার লম্বা দু'টা কর্ভেটও বেশ আগেই তৈরি করেছে। পরে সেগুলিকে আরও উন্নত করেছে; মিসাইল-সজ্জিত করেছে সেগুলি। তাদের বানানো ফ্রিগেট 'অং জে ইয়া', ‘কায়ান সিথথার’ এবং 'সিন-ফায়ু-সিন' আর ৪৯ মিটার লম্বা মিসাইল বোটের ডিজাইন দেখলে বিশ্বাস করা দুষ্কর যে সেগুলি মিয়ানমারের মত তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে তৈরি। ৮০মিটার লম্বা লেটেস্ট কর্ভেট 'তাবিনশয়েতি' এবং নতুন তৈরি অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলও লেটেস্ট ডিজাইন ফলো করেছে। এগুলির প্রায় সকল জাহাজেই জাহাজ-ধ্বংসী সারফেস-টু-সারফেস মিসাইল বসানো হয়েছে। শুধু ১৭টা মিসাইল বোটেই বসানো রয়েছে ৫৬টা সি-৮০২ মিসাইল। ৫টা ফ্রিগেটে ৪০টা, ৩টা কর্ভেটে ১২টা মিসাইল এবং ৪৯মিটারের মিসাইল বোটে আরও ৪টা; মোট কমপক্ষে ১১২টা মিসাইল। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ৪টা গাইডেড-মিসাইল ফ্রিগেট বহন করে ৩২টা মিসাইল; ৬টা কর্ভেট-এলপিসি বহন করে ২৪টা মিসাইল; আর পুরোনো ৯টা মিসাইল বোট বহন করে ২৬টা মিসাইল; মোট ৮২টা মিসাইল। বলা বাহুল্য যে নৌবাহিনীর স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিক থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশের চাইতে বহু বছর এগিয়ে আছে। যতদিনে বাংলাদেশ ৫০মিটারের পদ্মা-ক্লাসের প্যাট্রোল বোট তৈরি শুরু করেছে, ততোদিনে মিয়ানমার ১০৬মিটার স্টেলথ ফ্রিগেট তৈরিতে বেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে তৈরি 'দুর্জয়'-ক্লাসের জাহাজগুলি এখনো অপারেশনাল হয়নি; অথচ মিয়ানমারের স্টেলথ ফ্রিগেটগুলি অলরেডি কমিশন্ড হয়ে গেছে। মিয়ানমার চীনের কাছ থেকেও টাইপ ০৫৩-এর দু'টা ফ্রিগেট কিনেছে। মিসাইল বোট এবং অনান্য বোটও কিনেছে। এখন ভারত চাইছে মিয়ানমারের কাছে অফশোর প্যাট্রোল বোট বিক্রি করতে। মিয়ানমার সাবমেরিন কেনার চেষ্টাতেও আছে। আর সেটা কিনে ফেললে বাংলাদেশের আর কোন এডভান্টেজ থাকছে না মিয়ানমার নৌবাহিনীর সাথে।
   






মিয়ানমারের বিমান প্রতিরক্ষা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে দূরে রাখবে 

বিমান প্রতিরক্ষায় মিয়ানমার আরও বেশি এগিয়ে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের সবে-ধন নীলমণি ৮টা মিগ-২৯ বিমান মিয়ানমারের ৩১টা মিগের সাথে কতটা প্রতিযোগিতা দিতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে যে কেউ আলোচনা করবেন। মিয়ানমার আকাশ-প্রতিরক্ষার জন্যে মিডিয়াম রেঞ্জের (৩০ থেকে ৫০কিঃমিঃ) রুশ Pechora-2M (S-125/SA-3), রাশিয়ার Kvadrat-M (Buk-M1) এবং চীনের KS-1/HQ-12 বিমান-ধ্বংসী সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল মোতায়েন করেছে। শর্ট রেঞ্জের Igla-S (SA-24) মিসাইল দিয়েও ভরিয়ে ফেলেছে সেনাবাহিনী। ২০০০ সালের শুরুতেই মিয়ানমার Myanmar Integrated Air Defence System (MIADS) প্রতিষ্ঠা করে। ২০১০ সালে সারাদেশে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ের্কের সাথে যুক্ত হয় এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যার ফলে মিয়ানমারের সকল বিমানবন্দর, বিমান ইউনিট, রাডার ইউনিট, এয়ার ডিফেন্স মিসাইল এবং আর্টিলারি-সহ বিমান প্রতিরক্ষার সকল কিছু একটা সিস্টেমের অন্তর্গত হয়।

মিয়ানমার যদিও বহুকাল যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির মাঝে ছিল, তদুপরি সে কিন্তু তার বিমান প্রতিরক্ষাকে কেবল সাম্প্রতিক সময়েই উন্নত করেছে; এবং এখনও উন্নত করে যাচ্ছে। এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলি বেশ মডার্ন এবং মোবাইল। যেকোন সময়ে দরকারে যেকোন স্থানে মোতায়েন করা যায়।  মিয়ানমারের এই বিমান-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিপক্ষে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফাইটারগুলিকে পাঠালে কয়েকটা বিমান হারানোটা অসম্ভব কিছু ছিল না। তখন বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষার দুর্বলতার সর্বোচ্চ অবস্থা সকলের কাছে বেরিয়ে যেতো।  


২০১৫ সালের এই ছবিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চীনে তৈরি মিডিয়াম-রেঞ্জের KS-1/HQ-12 বিমান-ধ্বংসী সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমার যদিও বহুকাল যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির মাঝে ছিল, তদুপরি সে কিন্তু তার বিমান প্রতিরক্ষাকে কেবল সাম্প্রতিক সময়েই উন্নত করেছে; এবং এখনও উন্নত করে যাচ্ছে। এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলি বেশ মডার্ন এবং মোবাইল। যেকোন সময়ে দরকারে যেকোন স্থানে মোতায়েন করা যায়।  মিয়ানমারের এই বিমান-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিপক্ষে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফাইটারগুলিকে পাঠালে কয়েকটা বিমান হারানোটা অসম্ভব কিছু ছিল না। তখন বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষার দুর্বলতার সর্বোচ্চ অবস্থা সকলের কাছে বেরিয়ে যেতো। 


মিয়ানমার সেনাবাহিনী - পুরোপুরি ডিফেন্সিভ

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বেশ ভালো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বহু বছর মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে তাদের অভিজ্ঞতা কম হয়নি। তবে তাদের পুরো সেনাবাহিনীই মোটামুটিভাবে কাউন্টার ইনসার্জেন্সিতে এক্সপার্ট; এবং ওটাই তারা পারে। 

৩০০-এর বেশি লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন রয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে, যার একেকটার সদস্যসংখ্যা ৫০০-এর মতো। ১৪টা রিজিওনাল কমান্ড এবং ১০টা লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন (১০টা ব্যাটালিয়নে একটা ডিভিশন) অধীনে এই ব্যাটালিয়নগুলি সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেশকে বহু খন্ডে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোই এদের উদ্দেশ্য। আশেপাশের দেশে অপারেশন চালাবার মতো সক্ষমতা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নেই। তাদের বাহিনী পুরোপুরিই ডিফেন্সিভ। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সৈন্য পাঠানোটা নির্ভর করবে একেক অঞ্চলের বিচ্ছন্নতাবাদীদের সাথে যুদ্ধের অবস্থার প্রেক্ষিতে।

সাম্প্রতিক সময়ে এর বাইরে তারা যে সক্ষমতাগুলি অর্জন করেছে তার মধ্যে মূল হলো আর্টিলারি, সাঁজোয়া ইউনিট এবং এয়ার ডিফেন্স। এগুলি ইনসার্জেন্সিতে যতটা না বেশি ব্যবহৃত হবে, তার চাইতে বেশি ব্যবহৃত হবে আশেপাশের প্রতিবেশীদের ভয় দেখিয়ে দূরে রাখতে। একসময় শুধুমাত্র চীনের ছত্রছায়ায় থাকার সময়ে মিয়ানমার সবসময়েই ভয়ে থাকতো যে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কখনো তাদের উপরে সামরিক হামলা করে বসবে। তবে অং সান সু কি-র ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিয়ানমারের সেই ভয়টুকু নেই। তবে আশেপাশের দেশগুলির (চীন, থাইল্যান্ড, ভারত) ইন্ধনপ্রাপ্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীরা রয়েই গেছে। তাদের রয়েছে বিশাল সুগঠিত সামরিক বাহিনী। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী হয়েছে এক্সপার্ট। তবে বাইরের যেকোন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে।

প্রায় ৪৫০-এর মতো ট্যাঙ্ক মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে সক্ষম। এর মাঝে ৫০টা চীনের MBT-2000, ১২০টার মতো ইউক্রেনের T-72S, ৮০টার মতো চীনা Type 69-II, ১৬০এর মতো চীনা Type 59D, এবং ৫০টার মতো চীনা Type 63 লাইট ট্যাঙ্ক। এর সাথে রয়েছে হাজার খানেকের মতো আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, ১৮০-২০০-এর মতো সেলফ-প্রপেল্ড আর্টিলারি এবং একটা বড় সংখ্যক টানা আর্টিলারি। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সফলভাবে এই আর্টিলারির ব্যাপক ব্যবহার করেছে।
  

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর T-72S ট্যাঙ্ক। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বেশ ভালো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বহু বছর মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে তাদের অভিজ্ঞতা কম হয়নি। তবে তাদের পুরো সেনাবাহিনীই মোটামুটিভাবে কাউন্টার ইনসার্জেন্সিতে এক্সপার্ট; এবং ওটাই তারা পারে। তবে বাইরের যেকোন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে।


মিয়ানমারের দুর্বল ভূকৌশলগত অবস্থান - বাংলাদেশ কিছুই করতে পারলো না!

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থেকে দেশ বাঁচাতে ডিফেন্সিভ-ভাবে তৈরি করা হয়েছে। আর ভৌগোলিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকায় আরাকানে খুব একটা সহজে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সেনা মোতায়েন সম্ভব নয়। তবে আরাকানকে ধরে রাখার যথেষ্ট সক্ষমতা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আছে, যদি অন্য সার্ভিসগুলি তাদের ঠিকমতো সহায়তা করে।

অন্যদিকে মিয়ানমারের বিমান প্রতিরক্ষার বেশিরভাগটাই মিয়ানমারের পক্ষে আরাকান এবং এর আশেপাশে মোতায়েন করা সম্ভব; কারণ এগুলি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কমই ব্যবহৃত হয়। মিয়ানমার নৌবাহিনীর বেলাতেও একই কথা। এই অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে যদি মিয়ানমারের দক্ষিণে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে দাঁড়ায়। তাহলে মিয়ানমার তার বিমান এবং নৌবাহিনীর পুরোটা একত্রে মোতায়েন করতে সক্ষম হবে না।

তবে মূল কথা হলো, মিয়ানমার অত্যন্ত দুর্বল ভূকৌশলগত অবস্থানে থেকেও বাংলাদেশ মিয়ানমারকে কোন রকম ভীতি প্রদর্শন করতেই সক্ষম হলো না। মিয়ানমার জানে যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পক্ষে মিয়ানমারকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব নয়। আর একইসাথে কূটনৈতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-চীন-রাশিয়া সকলেই মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রায় সকলকেই সমূলে উৎপাটন করার দৃশ্য তথাকথিত বিশ্ব-নেতৃত্ব উপভোগ করেছে। বাংলাদেশের নাকের ডগা দিয়ে নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার গিয়ে স্ট্র্যাটেজিক চুক্তি করে আসলেন। আর তুরস্কের এরদোগান কৌশলগত দিক থেকে কোন সমর্থন না দিয়ে তার পত্নীর চোখের পানিতে তার কর্মসম্পাদন করলেন। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্টরা বাংলাদেশকে যুদ্ধবিমান না দিয়ে দিলেন মিয়ানমারকে! ইন্দোনেশিয়া যুদ্ধজাহাজ না পাঠিয়ে পাঠালো পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে, আর মালয়েশিয়া পাঠালো শুধুমাত্র ত্রাণ।
   

চোখের পানি, ত্রাণসামগ্রী, আর "মানবতার আহ্বান"এ মিয়ানমার চাপ বোধ করবে না। জাতিসংঘে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত আর চীন-রাশিয়ার মারামারি দেখার সময় নেই কারুর। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের কূটনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মালদ্বীপের মতো হতে পারে না। সুশীলদের "চাপে" প্রতি বছর দুই ফোঁটা করে সামরিক বাজেট বৃদ্ধির দিন শেষ! 'ব্লু ইকনমি', 'ম্যারিটাইম নেশন', ফোর্সেস গোল-২০৩০' - এগুলি বাকওয়াজ হয়ে থাকবে, যদি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যকে কাপড় খুলে লুঙ্গি পড়িয়ে অপমান করা হয় বা ১৭ বার কোন বাধা ছাড়াই আকাশসীমা লঙ্গন করা হয়। ভিক্ষাবৃত্তি আর অপমান হজম করা বাংলাদেশের মানুষের কাছে সমরশক্তির উন্নয়নের চাইতে বেশি আকর্ষণীয় হলো কবে থেকে?


সুশীলদের শান্তিপূর্ণ নীতি পরিহার করার সময়ে এসেছে 

চোখের পানি, ত্রাণসামগ্রী, আর "মানবতার আহ্বান"এ মিয়ানমার চাপ বোধ করবে না। জাতিসংঘে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত আর চীন-রাশিয়ার মারামারি দেখার সময় নেই কারুর। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের কূটনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মালদ্বীপের মতো হতে পারে না। বাংলাদেশ তার নিজের পররাষ্ট্রনীতির ফলকে ভারত-চীনের হাতেও তুলে দিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়ণক হয়ে সকলের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাবৃত্তিও করতে পারে না। তবে তার সামরিক শক্তিকে সত্যিকার অর্থে বলীয়ান করে সারা বিশ্বকে তার অবস্থান জানান দিতে পারে। সুশীলদের "চাপে" প্রতি বছর দুই ফোঁটা করে সামরিক বাজেট বৃদ্ধির দিন শেষ! এভাবে এগুলে ভারত খুব সহজেই মিয়ানমারকে দিয়েই বাংলাদেশকে ব্যালান্স করে রাখবে চিরকাল। 'ব্লু ইকনমি', 'ম্যারিটাইম নেশন', ফোর্সেস গোল-২০৩০' - এগুলি বাকওয়াজ হয়ে থাকবে, যদি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যকে কাপড় খুলে লুঙ্গি পড়িয়ে অপমান করা হয় বা ১৭ বার কোন বাধা ছাড়াই আকাশসীমা লঙ্গন করা হয়। ভিক্ষাবৃত্তি আর অপমান হজম করা বাংলাদেশের মানুষের কাছে সমরশক্তির উন্নয়নের চাইতে বেশি আকর্ষণীয় হলো কবে থেকে?

Tuesday 5 September 2017

অবাধ্য মিয়ানমার, আর নিম্নগামী বাংলাদেশ…

২৩শে জুলাই ২০১৭। আরব সাগরে নৌ-মহড়ায় তুর্কী জাহাজ 'গিরেসুন' এবং পাকিস্তানী জাহাজ 'সাইফ'। তুরস্কের এরদোগান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে ফোন করেছেন; কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগেই ২৯শে জুন ২০১৭-তে তুরস্ক আরব সাগরে Combined Task Force 151- নামের মাল্টিন্যাশনাল ম্যারিটাইম ফোর্সের কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছে চার মাসের জন্যে (পঞ্চম বারের মতো)। তুরস্কের এরদোগানের জন্যে আরব সাগর টহল দেয়াটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চাইতে মিয়ানমারের মুসলিমদের রক্ষা করাটা অবশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭


রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ আর এরদোগানের মায়াকান্না...

মিয়ানমারের মুসলিমদের আর্তনাদ যেমন মানুষ সহ্য করতে পারছে না, ঠিক তেমনি মিয়ানমারের ধৃষ্টতাও সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারকে একের পর এক সুযোগ দিয়ে এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে মিয়ানমার বেয়াড়া পশুর মতো আচরণ করছে। অবশ্য যেহেতু সেই সুযোগ মিয়ানমারকে বাংলাদেশ এবং মুসলিম বিশ্বের অনান্য দেশগুলির নেতৃত্বরাই দিয়েছেন, তাই কাকে দোষারোপ করা দরকার সে নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ দোষারোপের সংস্কৃতির মাঝেই কিছু লোক চাইছে “কিছু তো করেছি” বলে ভালো সাজতে এবং রাজনৈতিক সুবিধা নিতে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চলে আসবে। তুরস্কের এরদোগান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে ফোন করেছেন; কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগেই ২৯শে জুন ২০১৭-তে তুরস্ক আরব সাগরে Combined Task Force 151- নামের মাল্টিন্যাশনাল ম্যারিটাইম ফোর্সের কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছে চার মাসের জন্যে (পঞ্চম বারের মতো)। তুরস্কের এরদোগানের জন্যে আরব সাগর টহল দেয়াটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চাইতে মিয়ানমারের মুসলিমদের রক্ষা করাটা অবশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবশ্য সেটা খুব সহজেই বোঝা যাবে তুরস্কের সীমান্তে সিরিয়া-ইরাকের ধ্বংসের কাহিনী দেখে। এরদোগান চেয়ে চেয়ে লাখো মুসলিমের সমাধি দেয়া দেখেছেন। বিশাল সামরিক বাহিনী ঘরে পুষে রেখে এই হত্যাকান্ড দেখা মানে এতে অংশগ্রহণ করা। অবশ্য তিনি সিরিয়াতে সরাসরিও অংশগ্রহণ করেছেন। আলেপ্পোর যুদ্ধটা হঠাত শেষ হওয়ার পেছনে এরদোগানের অবদান যথেষ্ট। ‘অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ড’-এর নাম করে আলেপ্পো থেকে আসাদ-বিরোধীদের একটা বড় অংশকে এরদোগান বের করে নিয়ে আসেন; আর ঐ সময়েই আলেপ্পোর দখল নেয় আসাদ-বাহিনী। মুখে আসাদের বিরুদ্ধাচরণ করে তিনি আসাদের সাথেই হাতে-হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন; মুসলিম নিধনে সহায়তা দিয়েছেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে এরদোগানের কাছে একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের কয়েকটা যুদ্ধপরাধীকে বাঁচানোর জন্যে ফোন কল করাটা রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরাসরি দরকারি সহায়তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই এরদোগানের কাছ থেকে আশা করা যায় কতটুকু?

তুরস্ক বাংলাদেশকে বলছে যে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মুসলিমদের থাকার ব্যবস্থা করে দিক; তুরস্ক তাদের জন্যে অর্থ সরবরাহ করবে। অবশ্য এরদোগানের এমন ভালো সাজার ইতিহাস তো রয়েছেই। সিরিয়ার মানুষের পক্ষে যুদ্ধ না করে তিনি যুদ্ধ চলতে দিয়েছেন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্যে শরণার্থী শিবির তৈরি করে নিজে ভালো সাজার চেষ্টা করেছেন। আসলে ইরাক-সিরিয়ার মুসলিমদের মতো মিয়ানমারের মুসলিমদেরও দরকার নেই শরণার্থী শিবিরের; তাদের দরকার একজন অভিভাবকের, যিনি দায়িত্ব নেবেন মুসলিমদের এবং শত্রুর মুখের উপরে বলবেন – “আমার মুসলিম ভাইদের গায়ে আর একটা আচর লাগলে আমি তোমার হাত কেটে ফেলবো”। এরদোগান সেই নেতা হবার মতো ব্যক্তিত্ব দেখাতে পারেননি। তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারীদের পক্ষে তুরস্কের মার্কিন বিমান ঘাঁটি থেকে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান ওড়ার পরেও এরদোগান আমেরিকাকে সবচাইতে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১০ সালে গাজায় ইস্রাইলী অভিযানের সময়ে ইস্রাইলের আক্রমণে কয়েকজন তুর্কী সৈন্য নিহত হন। এরদোগান তাদের জন্যে শুধুমাত্র “হিরোস ফিউনেরাল” দিয়েছেন! ছয় বছর পরে ইস্রাইলের সাথে আবারও সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিয়েছেন। এই এরদোগানের কাছ থেকে আশা করা কঠিন যে তিনি ফোন দেবেন মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টকে এবং বলবেন যে, ‘তোমরা তোমাদের নৌবাহিনী থেকে দু’টা করে ফ্রিগেট এবং বিমান বাহিনী থেকে ৪টা করে ফাইটার জেট বাংলাদেশে পাঠাও। আমি আরব সাগর থেকে তুরস্কের নৌবাহিনীর জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পাঠাচ্ছি; সাথে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর দু’টা জাহাজ পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। আর আমি বাংলাদেশকে বলে দিচ্ছি আমাদের এই অভিযানে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার জন্যে’। সিরিয়ার মানুষের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়া এবং ইস্রাইলকে বন্ধু মনে করা এরদোগান এই ফোন কল করতে পারবেন?
  
ম্যানিলাতে অং সান সু কি-র সাথে মিলিত হয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট উইদোদো। ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্ক তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। মন্ত্রীদের এই সফর কি শুধু তাদের দেশের মানুষগুলিকে এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ঠান্ডা রাখার উদ্দেশ্যে, না সঠিক কোন পদক্ষেপ নেবার উদ্দেশ্যে? ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগের দফায়ও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে তার তখনকার সফর যে লোক দেখানোই ছিল, তা এই সমস্যার পূণরাবৃত্তি দেখলেই বোঝা যায়। এবারও কি সেই লোক দেখানো সফর? তুরস্কের ক্ষেত্রেও কি তা-ই? মুসলিম দেশগুলির মানুষের মাঝে যখন প্রচন্ড ক্রোধের সৃষ্টি হচ্ছে, তখন উনারা কি সেকুলার গণতন্ত্রের “পুরষ্কৃত” কন্যা অং সান সু কি-র সাথে চা-নাস্তা খেয়েই সময় পার করবেন?



সবাই আসছেন অং সান সু কি-র সাথে চা-নাস্তা খেতে...

তুরস্ক-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া-পাকিস্তানের মানুষ এবং সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় পদের লোকজন কিন্তু মিয়ানমারের মুসলিমদের এই অবস্থা সহ্য করতে পারছেন না। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এই অবস্থায় ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্ক তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। মন্ত্রীদের এই সফর কি শুধু তাদের দেশের মানুষগুলিকে এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ঠান্ডা রাখার উদ্দেশ্যে, না সঠিক কোন পদক্ষেপ নেবার উদ্দেশ্যে? ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগের দফায়ও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে তার তখনকার সফর যে লোক দেখানোই ছিল, তা এই সমস্যার পূণরাবৃত্তি দেখলেই বোঝা যায়। এবারও কি সেই লোক দেখানো সফর? তুরস্কের ক্ষেত্রেও কি তা-ই? মুসলিম দেশগুলির মানুষের মাঝে যখন প্রচন্ড ক্রোধের সৃষ্টি হচ্ছে, তখন উনারা কি সেকুলার গণতন্ত্রের “পুরষ্কৃত” কন্যা অং সান সু কি-র সাথে চা-নাস্তা খেয়েই সময় পার করবেন?

মিয়ানমারের সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের ভূরাজনীতি বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার চীনের বলয়েই ছিল বহুকাল। তবে অং সান সু কি-র মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মিয়ানমারে প্রবেশ। এর পর থেকেই চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের টানাপোড়েন শুরু। রাখাইনের উপকূলে Kyaukpyu বন্দরে চীন তৈরি করেছে গভীর সমুদ্রবন্দর, যেখানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাহাজে করে আসা তেল ডাউনলোড হচ্ছে। সেখান থেকে হাজার মাইলের পাইপলাইন দিয়ে সেই তেল পৌঁছে যাচ্ছে চীনের মূল ভুখন্ডে। একইসাথে গ্যাস পাইপলাইনও তৈরি করা হয়েছে। এই পাইলাইনের মাধ্যমে চীন স্ট্র্যাটেজিক মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করতে চাইছে। পাকিস্তানে গোয়াদর পোর্ট তৈরি করেও চীন একই সুবিধা চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই প্রচেষ্টাকে বাধা দিচ্ছে। আর এই কাজে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে ভারত। গোয়াদর পোর্ট পাকিস্তানের বালুচিস্তানে অবস্থিত, যেখানে ভারত বিচ্ছিন্নতাকামীদের সহায়তা দিচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাকামীরা চীনা ইঞ্জিনিয়ারদের মেরে ফেলছে। তবে মিয়ানমারে ভারত আরও একটা কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে- বাংলাদেশকে ব্যালান্স করে রাখা, বা ব্যস্ত রাখা। ভারত মিয়ানমারের নৌবাহিনীর ফ্রিগেটগুলির জন্যে অত্যাধুনিক রাডার, সোনার এবং টর্পেডো সরবরাহ করেছে। প্রশ্ন হলো, নৌবাহিনী কেন? কারণ মিয়ানমারের নৌবাহিনী বাংলাদেশের বাণিজ্য রুটের উপরে চলাচলের সুযোগ পাবে। এই কাজে মিয়ানমারকে আরও কার্যক্ষম করে তুলতে ভারত তাদের নিয়মিত ট্রেনিং দিচ্ছে।

তবে একটা ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না যে মিয়ানমারে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সকলেরই অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। তাই তারা কেউই মিয়ানমারকে ছেড়ে দিতে চায় না; প্রভাব রাখতে চায়। তাদের পূঁজিবাদী লক্ষ্যের আড়ালে পড়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের মুসলিমদের নিধনের গল্প। তারা কেউই মিয়ানমারের মুসলিমদের বাঁচাতে আসবে না; বরং তারা বাংলাদেশকে বলবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মাঝে থাকার জায়গা করে দিতে, যাতে তারা আরাম-আয়েশে মিয়ানমারে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারে। তাদের জন্যে অর্থই সবকিছু, তাই তারা বাংলাদেশকে শধু অর্থই সাধবেন। ঠিক এরদোগানের তুরস্কের মতোই।

সময় নষ্ট করার যতো পদ্ধতি...

অনেক ধরনের সমাধান দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। এই সমাধানগুলির সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে হলে এগুলির চিন্তার ভিত্তি নিয়ে কথা বলতে হবে।

১। রোহিঙ্গাদের স্বাধীন দেশ দেয়া হোকঃ

এই চিন্তাখানা এসেছে এই মনে করে যে এরকম একটা ছোট্ট দেশ তৈরি হলেও সেটা “স্বাধীন” হতে পারে। আর এখানে আরও ধরে নেয়া হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব-ব্যবস্থা থেকে অনুমতি না নিলে একটা দেশ “স্বাধীন” হবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের কাছ থেকে “স্বীকৃতি” পেতে হবে। বলাই বাহুল্য যে এই দেশগুলি রোহিঙ্গাদের উপরে অত্যাচার রোধে কিছুই করেনি। আর যে প্রশ্নটা করা হবে না তা হলো, এভাবে তৈরি হওয়া নতুন একটা দেশকে স্বীকৃতি দেয়া দেশের (যুক্তরাষ্ট্রের) দাসত্ব মেনে নিয়েই চলতে হবে। দেশটা যুক্তরাষ্ট্রের উপরে পুরোপুরি নির্ভর করবে, এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী হওয়ায় দেশটাকে প্রতিরক্ষার জন্যে সর্বদা যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে।

২। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের অস্ত্র সহায়তা দেয়া হোকঃ

এই চিন্তাখানা ধরে নিচ্ছে যে রোহিঙ্গা “মুক্তিযোদ্ধা”রা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই যুদ্ধ করে দেশ “স্বাধীন” করে ফেলবে। এক্ষেত্রে সেই উপরের প্রশ্নখানারই পূণরাবৃত্তি হচ্ছে – “স্বাধীন” বলতে কি বোঝাচ্ছি আমরা? যুক্তরাষ্ট্রের “স্বীকৃতি” নিয়ে “স্বাধীন”?

আর যদি যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত নয় এমন কোন বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ দেয়া হয়, তবে কিন্তু বাংলাদেশকে “সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” তকমা দেয়া হবে এবং “সন্ত্রাস তাড়ানো”র নাম করে ড্রোন হামলার শুরু হবে। বুঝতে বাকি থাকে না যে এই ড্রোন হামলা ভারতের মাটি থেকেই হবে।

আর একই সময়ে একই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত-সমর্থিত কিছু লোক স্বাধীনতা দাবি করতে থাকবে, যাদেরকে অস্ত্র দিতে ভারতের দুই মিনিটও অপেক্ষা করতে হবে না। তখন “ব্লু ইকনমি”, “ডিজিটাল বাংলাদেশ”, “ফোর্সেস গোল-২০৩০” এগুলি বাদ দিয়ে “বাংলাদেশের বিভাজন” ঠেকাতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে হবে।

৩। মিয়ানমারের উপরে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিঃ

এই চিন্তাখানার অসারতা প্রমাণ করার দরকার কতটুকু রয়েছে, সেটা নিয়ে বরং কথা হতে পারে। আলোচনার পর আলোচনা হয়েছে মিয়ানমার সরকারের সাথে। কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও কোন সমাধান আসেনি। যে পশ্চিমা আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলা হচ্ছে, তা কখনোই কাজ করেনি – একথা সবারই জানা। যে জাতিসংঘের কথা বলা হচ্ছে, সে জাতিসংঘের ব্যর্থতার তালিকা এতো বড় হয়েছে যে সেটা এখন নাম-সর্বস্ম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সর্বদা তার নিজের তৈরি করা এই প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে কাজ করছে। ২০০৩ সালে ব্যাপক-ধ্বংসী অস্ত্রের নাম করে ইরাক দখল করার চাইতে আর কোন ভালো উদাহরণ হয়তো দেয়া যাবে না। জাতিসঙ্ঘ কি করতে পেরেছিল ইরাকের লাখো মানুষের জন্যে, যারা পরবর্তীতে যুদ্ধে নিহত হয়? দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় মেনে চলতে বলছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই আন্তর্জাতিক আদালতের অংশ হতে স্বাক্ষর করেনি! অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আদালতের আইন তার নিজের উপরে প্রযোজ্য নয়। ‘মিয়ানমারের উপরে আন্তর্জাতিক চাপ’ – এটা একটা মরীচিকা মাত্র। সময় নষ্ট করার একটা পদ্ধতি।

৪। যা আলোচনা করা হবে নাঃ

যে চিন্তাখানা আলোচনায় আসবে না তা হলো মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের সামরিক অভিযান। এই অভিযানে পুরো আরাকান মুক্ত করার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে নিজেদের ভিটেমাটিতে পূনস্থাপন করা। এই চিন্তাখানা আসবে না শুধু এই কারণে নয় যে বাংলাদেশ এটা করতে পারে না, বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থায় বাংলাদেশ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অনুমতি চাইবে এই কাজটা করা জন্যে। অথচ এই সমাধানের চাইতে ভালো সমাধান নেই। মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন হলেই এটা সম্ভব।


সমাধান সামরিক……

বাংলাদেশ আহ্বান করলে তুরস্ক-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া-পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে সাড়া দেবেই; নেতৃত্ব যা-ই চাক না কেন। মিয়ানমারকে ভীতি প্রদর্শন করতে হলে দরকার মুসলিম দেশগুলির একত্রে সামরিক পদক্ষেপ। বঙ্গোপসাগরে জয়েন্ট মিলিটারি এক্সারসাইজ হতে পারে মিয়ানমার এবং তার পৃষ্ঠপোষকদের ভীতি প্রদর্শনের পথ। তবে যেহেতু এই এক্সারসাইজ সর্বদা চলবে না, তাই বাংলাদেশকে ডিটারেন্ট হিসেবে সামরিক বাহিনীকে ডেভেলপ করতে হবে। সাবমেরিন ফ্লীট গড়ে তোলা ছাড়াও বিমান বাহিনীকে উন্নত করাটা এখন ফরয কাজ হয়ে গেছে। আর কতো বছর বাংলাদেশের মানুষকে অপেক্ষে করতে হবে পরবর্তী ফাইটার বিমান অর্ডার করার জন্যে? কোন বিমান কেনা হবে, এটার উপরে বছরের পর বছর নষ্ট করে এক হাস্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব করা হয়েছে। এখন মিয়ানমার এক দিনে তিনবার বাংলাদেশের আকাশ-সীমা ভেদ করে গেলেও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কিছু শব্দ করে বিমান ওড়ানো ছাড়া কিছু করার সক্ষমতা থাকছে না। এই শব্দে মিয়ানমার ভয় তো পাবেই না, বরং আরও নতুন উদ্যমে মুসলিম খেদাও অন্দোলনে নামবে।
 
২০১৭ সালের বাংলাদেশ সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে JF-17 Thunder ফাইটারের রেপ্লিকা। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ভারতের জন্যে  হুমকি তৈরি করতে পারে JF-17 ফাইটার জেট। এই ফাইটার জেট দুনিয়ার সবচাইতে মারাত্মক ফাইটার জেট নয়। কিন্তু বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এই বিমানের অন্তর্ভুক্তি দিল্লীতে যে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করবে, তা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ক্রয়ের চাইতে বহুগুণে বেশি শক্তিশালী হবে।


মিয়ানমারের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে হলে মিয়ানমারের পৃষ্ঠপোষকদের উপরেও চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এই চাপ তৈরি করতে ভূরাজনৈতিক হিসেব কষতে হবে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক সুপারপাওয়ারের জন্যে সর্বদাই বিপদের ডাক দেয়। তাই বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের কথা উঠলেই জামায়াত-ই-ইসলামী এবং ভারতপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর এভাবে তারা উভয়েই ভারতের (এবং যুক্তরাষ্ট্রের) বন্ধুরূপে কাজ করে। ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের সাজানো খেলায় পানি ঢেলে দেয়ার উপায় হলো পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ক্রয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পাকিস্তানে তৈরি K-8W ট্রেইনার বিমান ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে ‘বাখতার শিকান’ (রেড এরো-৮) এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল। বিমান বাহিনী পাকিস্তানে তৈরি কমান্ড সেন্টারও ব্যবহার করেছে। তবে এগুলি কোনটাই ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ভারতের জন্যে হুমকি-স্বরূপ হয়নি। এই হুমকি তৈরি করতে পারে JF-17 Thunder ফাইটার জেট। এই ফাইটার জেট দুনিয়ার সবচাইতে মারাত্মক ফাইটার জেট নয়। কিন্তু বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এই বিমানের অন্তর্ভুক্তি দিল্লীতে যে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করবে, তা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ক্রয়ের চাইতে বহুগুণে বেশি শক্তিশালী হবে। এই ফাইটারকে ব্যাপকভাবে উন্নত করতে সহায়তা করছে চীন, তুরস্ক, এবং সম্ভবতঃ দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ আরও কিছু দেশ। এই বিমান চালিত হচ্ছে রাশিয়ায় তৈরি বিখ্যাত RD-93 ইঞ্জিন দ্বারা, যা কিনা MiG-29 ফাইটারে ব্যবহৃত হয়। ভ্লাদিমির পুতিন পাকিস্তানকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে কত বড় সহায়তা দিয়েছে এই ইঞ্জিনই তার প্রমাণ। এই বিমানের কোন অংশের জন্যেই পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ হতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে এই ফাইটার জেট একটা ভূরাজনৈতিক বিভীষিকাময় অধ্যায়। বাংলাদেশের এই মুহুর্তে ২ থেকে ৩ স্কোয়াড্রন ফাইটার জেট দরকার; যাকে বলে “হট-ট্রান্সফার”! ফ্যাক্টরিতে তৈরি করে নয়, বরং অলরেডি তৈরি বিমানের লাইন থেকে এই সরবরাহ হতে হবে। যদি কেউ এর আগে কখনো ঢাকায় বসে দিল্লীতে বাজ পড়ার শব্দ না পেয়ে থাকেন, তবে এই ঘটনার সাথে সাথে সেটা শুনতে পাবেন। এই ঘটনাই পারবে মিয়ানমারকে থামাতে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ভূরাজনীতিতে অনেক স্টেশন মিস করেছে। দোকলাম ইস্যুতে বাংলাদেশের উচিত ছিল কথা বলা। একটা বিবৃতিই যথেষ্ট ছিল এক্ষেত্রে। বাংলাদেশ যদি বলতো যে বাংলাদেশের সীমানার এতো কাছে সামরিক কর্মকান্ডে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন, এবং ভারত-চীনকে বাংলাদেশ ঢাকায় বসে সমস্যার সমাধান খুঁজতে বলতো – বাংলাদেশের অবস্থান তখন বিশ্বে কোথায় থাকতো সেটা কল্পনাও করা সম্ভব নয়। কিন্তু ভারত কি মনে করবে – এধরনের নিম্নমানের চিন্তায় ডুবে গিয়ে এই সুযোগ হাতছাড়া করা হয়। এখন সেই একই নিম্নমানের কূটনীতির উপরে ভর করে মিয়ানমারকে আস্কারা দেয়া হচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আইওরা সামিটে যা দেখিয়েছে এবং কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়ে যে প্রভাব তৈরি করার সক্ষমতা দেখিয়েছে, সেখানে কোন যুক্তিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে ঠান্ডা করতে পারবে না, এটা বোধগম্য নয়। একুশ শতকে বাংলাদেশের অবস্থান মিয়ানমারের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। কিন্তু ভূরাজনীতি না বুঝে নিম্নমানের কূটনীতির উপরে ভর করে মিয়ানমার-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করে, আর বাকি দুনিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের জন্যে ভিক্ষাবৃত্তি করে বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নগামী হতে বাধ্য।

Friday 1 September 2017

মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ তার ডিটারেন্ট ব্যবহার করছে না কেন?

বাংলাদেশের সাবমেরিনগুলি মোটামুটি কর্মক্ষম হলেও একেবারে লেটেস্ট মডেলের কিন্তু নয়, যা কিনা তাদের ডিটারেন্ট ভ্যালুকে কমিয়ে দেয়। কাজেই বাংলাদেশকে খুব শীঘ্রই আরও সাবমেরিন যোগাড় করতে হবে। নতুন তৈরি করে সাবমেরিন যেমন আনতে হবে, তেমনি ‘অফ-দ্যা-শেলফ’ সাবমেরিনও খুঁজতে হবে, যা কিনা প্রযুক্তির দিক থেকে টাইপ-০৩৫জি থেকে আরও উন্নত।
০২রা সেপ্টেম্বর ২০১৭



সাবমেরিন হলো একটা ডিটারেন্ট প্ল্যাটফর্ম। অর্থাৎ শত্রু যাতে তার শত্রুতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, সেটা নিশ্চিত করে এই সাবমেরিন। শত্রু জানবে যে সে ঝামেলা করলে তাকেও ঝামেলাতে পড়তে হবে। এভাবে সাবমেরিন একটা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যাটফর্মই বটে। তবে সাবমেরিনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারার মাঝেই এই ডিটারেন্ট। বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে দু’টা টাইপ-০৩৫জি সাবমেরিন কেনার পরে বাংলাদেশের হাতেও ডিটারেন্টের একটা অপশন এসেছে। বাংলাদেশের প্রতি বৈরী আচরণকারী কোন দেশকে একটা মেসেজ দেয়ার জন্যে এই সাবমেরিনগুলির ব্যবহার হতে পারে।

বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের কিছু সমস্যা অনেক পুরোনো। এর প্রধানতম হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইনের মুসলিমদের নিয়ে। মিয়ানমারের এই মুসলিম নাগরিকদের প্রতি বৈরী আচরণ করার ফলে সেখান থেকে হাজারো মুসলিম নরনারীর বাংলাদেশমুখী যে ঢল সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রত্যুত্তর দিতে বাংলাদেশ তার ডিটারেন্টগুলিকে ব্যবহার করতে পারে, যার সর্বাগ্রে এখন রয়েছে সাবমেরিন-দু’টা। মিয়ানমারের সরকারকে মেসেজ পেতে হবে যে ভারত-মার্কিন ঔপনিবেশিকদের কথায় নেচে মিয়ানমার তার বিপদ ডেকে আনছে। মুখের কথায় যদি চিড়ে না ভেজে, তাহলে শক্ত হতেই হবে। এই শক্ত হবার কাজটা বাংলাদেশ আরও আগেই করতে পারতো। এর আগের বারে মিয়ানমার থেকে যখন দলে দলে মুসলিম আসা শুরু করলো, তখনই বাংলাদেশ মেসেজটা দিতে পারতো।

 


আগেই যা করা উচিত ছিল...

মালয়েশিয়ার একটা জাহাজ কিছু ত্রাণ নিয়ে বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছিল তখন। ইন্দোনেশিয়ার এক মন্ত্রীও এসেছিলেন শরণার্থীদের দেখতে। কিন্তু এই কাজগুলি তখন সেই সরকারগুলি করেছিল তাদের দেশের রাস্তায় মুসলিমদের প্রতিবাদ সমাবেশ সামলাতে। আসল কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, তা এখন খুবই পরিষ্কার। এধরনের কর্মকান্ডের অন্তসারশূণ্যতার একটা প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হয়ে রইলো সেটা। যা তখনই করা উচিত ছিল তা হলো –

১। মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সাথে ‘লাইভ-ফায়ারিং জয়েন্ট মিলিটারি এক্সারসাইজ’ করতো।

২। তারপর মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরে যৌথভাবে ত্রাণ পাঠাবার কথা বলতো।

৩। ত্রাণবাহী জাহাজটির সাথে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার চারটা যুদ্ধজাহাজ এবং ৮টা যুদ্ধবিমান আসতো এবং

৪। সেগুলিকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী এসকর্ট করে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে আসতো।

তাহলেই বোঝা যেতো কে কার কথা শোনে। মিয়ানমার যদি বুঝতে পারতো যে এই ভীতি প্রদর্শন শুধু ফাঁকা বুলি নয়; এরা দরকার হলে সামরিক অভিযানেও পিছপা হবে না, তাহলে মিয়ানমার সরকার সত্যিকারের ভয় পেতো।

আন্ডারওয়াটার জয়েন্ট এক্সারসাইজ

তবে যেহেতু সেবারে এটা করা হয়নি, তাই এবারে আরও কঠিন হবার সময় এসেছে। মিয়ানমারের সামরিক বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার ফলে কঠিন প্রত্যুত্তর দেবারই গ্রাউন্ড প্রস্তুত হয়েছে। এই প্রত্যুত্তর দিতে হবে বাংলাদেশের ডিটারেন্ট প্ল্যাটফর্ম সাবমেরিনকে ব্যবহার করে। বাংলাদেশ সাবমেরিন কিনেছে অল্প কিছুদিন। তাই সাবমেরিন অপারেশনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। আবার বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার কাছ থেকেও জয়েন্ট এক্সারসাইজের মাধ্যমে সহায়তা নিতে পারে। তাদের সাবমেরিন বহরকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে বঙ্গোপসাগরে মহড়া দেয়া যায়। এতে সবাই উপকৃত হবে। চীনও বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। চীনের সাবমেরিন ভারত মহাসাগরে নতুন নয়। তাই চীনের সাবমেরিনের সাথেও বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রুদের স্কিল ডেভেলপ করা যেতে পারে।
  
তুরস্কের সাবমেরিনগুলি জার্মান প্রযুক্তির; তাই সন্দেহাতীতভাবে আরও শক্ত ডিটারেন্ট তৈরি করতে সক্ষম। বঙ্গোপসাগর টহল দিতে এবং বাংলাদেশের সী-লেন-কে শত্রুর ভীতি প্রদর্শন থেকে দূরে রাখতে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৮ থেকে ১২টা সাবমেরিন লাগবে। আর প্রযুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলে সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হতে পারে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য যেহেতু সমুদ্রপথে হয়, তাই এর কোন বিকল্প বাংলাদেশের সামনে নেই।


আরও উন্নত প্ল্যাটফর্ম

তবে এক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় গুরুত পাবে। বাংলাদেশের সাবমেরিনগুলি মোটামুটি কর্মক্ষম হলেও একেবারে লেটেস্ট মডেলের কিন্তু নয়, যা কিনা তাদের ডিটারেন্ট ভ্যালুকে কমিয়ে দেয়। কাজেই বাংলাদেশকে খুব শীঘ্রই আরও সাবমেরিন যোগাড় করতে হবে। নতুন তৈরি করে সাবমেরিন যেমন আনতে হবে, তেমনি ‘অফ-দ্যা-শেলফ’ সাবমেরিনও খুঁজতে হবে, যা কিনা প্রযুক্তির দিক থেকে টাইপ-০৩৫জি থেকে আরও উন্নত। এক্ষেত্রে চীন যেমন ভালো অপশন দেবে, তেমনি তুরস্ক বা দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও উন্নত প্রযুক্তির সাবমেরিন আনা যেতে পারে। তুরস্কের সাবমেরিনগুলি জার্মান প্রযুক্তির; তাই সন্দেহাতীতভাবে আরও শক্ত ডিটারেন্ট তৈরি করতে সক্ষম। বঙ্গোপসাগর টহল দিতে এবং বাংলাদেশের সী-লেন-কে শত্রুর ভীতি প্রদর্শন থেকে দূরে রাখতে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৮ থেকে ১২টা সাবমেরিন লাগবে। আর প্রযুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলে সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হতে পারে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য যেহেতু সমুদ্রপথে হয়, তাই এর কোন বিকল্প বাংলাদেশের সামনে নেই।

আর অন্যদিকে মিয়ানমারের কৌশলগত অবস্থান খুব দুর্বল। বাংলাদেশ এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারে খুব সহজেই। সিতওয়ে বন্দর খুবই দুর্বল অবস্থানে, যে বন্দরের উপরে মিয়ানমারের রাখাইনের বেশিরভাগটাই নির্ভরশীল। এরকম দুর্বল অবস্থানে থেকেও মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে ঝামেলা করতে পারছে – এটা বাংলাদেশের দুর্বল কূটনীতির বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ তার ডিটারেন্ট তৈরিতে আরও মনোযোগী হলে, এবং বর্তমানের ডিটারেন্টগুলির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করলে মিয়ানমার এধরনের আচরণ করতে সাহস পেতো না কখনোই। মিয়ানমারকে শক্তভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তাদের ভারত-মার্কিন ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন বাংলাদেশ সহ্য করবে না।