Saturday 24 August 2019

ভেনিজুয়েলার সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে কিউবার ইন্টেলিজেন্স?


২৪শে অগাস্ট ২০১৯
অর্থনৈতিক সমস্যায় পতিত হবার পর ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি এখন মধ্য আমেরিকার ছোট দেশগুলির আকারে এসে পৌঁছেছে, যদিও দেশটা বিশ্বে বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির একটা; এবং পৃথিবীর সবচাইতে বড় তেলের রিজার্ভ (প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেল) রয়েছে সেখানে। মার্কিন অবরোধ এবং ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতি মাসে ভেনিজুয়েলার তেল বিক্রির আয় ১৫ শতাংশ করে কমছে। ভেনিজুয়েলা সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার পিছনে সবচাইতে বড় স্তম্ভ হলো এর সেনাবাহিনী, যা এখনও প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে সমর্থন করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, মাদুরোকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে কিউবা।



যুক্তরাষ্ট্র বনাম ভেনিজুয়েলা-কিউবা

গত ২৪শে জুলাই ভেনিজুয়েলায় মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি এলিয়ট এব্রামস এক অনুষ্ঠানে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে টিকিয়ে রাখতে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে কথা বলেন। তিনি বলেন যে, ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মাঝে মাদুরো সরকার ৩৮ মিলিয়ন ডলার খরচ করে সামরিক ইউনিফর্ম কিনেছে। মে মাসে ২’শ ৯ মিলিয়ন ডলার খরচে ভেনিজুয়েলা সরকার রাশিয়ার সহায়তায় তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঠিকঠাক করেছে। একইসাথে ৯টা রুশ ‘সুখোই-৩০’ যুদ্ধবিমান আর ৮টা পরিবহণ হেলিকপ্টার ক্রয়ের কথাও হয়েছে রুশদের সাথে। তবে রাশিয়ার ব্যাপারে এব্রামসের কথাগুলিতে নতুন কিছু না থাকলেও তিনি কিউবা নিয়ে যে কথাগুলি বলেছেন, তা অনেককেই অবাক করেছে। তিনি বলেন যে, ভেনিজুয়েলাতে আড়াই হাজার কিউবান ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট কাজ করছে। আর এই সুযোগে কিউবা ভেনিজুয়েলা থেকে বিনা খরচে তেলের সরবরাহ পাচ্ছে। এব্রামসের কথার একদিন পরই আরেকজন উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সাথে টেলিকনফারেন্সের সময় একই ধরনের কথা বলেন। তিনি বলেন যে, কিউবার আর্থিক নেটওয়ার্ক, আয়ের উৎস, তেলের বাণিজ্য – এসকল কিছুর বিরুদ্ধেই মার্কিন সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। এই ব্যবস্থা আরও কঠোর হবে যদি কিউবানরা ভেনিজুয়েলার সরকারকে সমর্থন দেয়া বন্ধ না করে। আসলেই কি ভেনিজুয়েলায় কিউবার ততটা প্রভাব রয়েছে? মার্কিন চেষ্টার বিরুদ্ধে ভেনিজুয়েলার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে কিউবার ভূমিকাই বা কতটুকু?

মার্কিন কর্মকর্তাদের হুমকির পরদিনই কিউবার ‘হাভানা টাইমস’ পত্রিকার এক খবরে বলা হয় যে, কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ-কানেল কিউবা ভেনিজুয়েলাকে তার সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখবে। কিউবান বিপ্লবের ৬৬তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দিয়াজ-কানেল বলেন যে, ওয়াশিংটন কিউবার বিদ্যুৎ, পানি, এমনকি বাতাস আটকে দিতে চাইছে যাতে কিউবা ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে সহায়তা দিতে না পারে। মার্কিনীরা কিউবার বন্দরে তেলের জাহাজ ভিড়তে বাধা দিচ্ছে, জাহাজ কোম্পানিগুলিকে ভীতি প্রদর্শন করছে। ভেনিজুয়েলা থেকে কিউবায় তেল নিয়ে যাওয়া কয়েকটা কোম্পানির উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। মার্কিন অবরোধের কারণে জুলাই মাসে কিউবায় পর্যটকের আগমন প্রায় ২৪ শতাংশ কমে গেছে। তবে একইসাথে কিউবার প্রেসিডেন্ট এ-ও বলেন যে, কিউবা ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়; পারস্পরিক সন্মান প্রদর্শনের ভিত্তিতে নিজেদের বিরোধগুলিকে দেখতে চাচ্ছে কিউবা। তবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে মার্কিনীরা যখন কিউবার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে দেশটাকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিল, ঠিক তখনই ট্রাম্প প্রশাসন সেখান থেকে পুরোপুরি উল্টো পথে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিউবার সাথে মার্কিনীদের বহু বছরের বিরোধের সূত্রে কিউবা তাদের নিরাপত্তাকে সর্বদাই গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে; বিশেষতঃ তাদের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সক্ষমতাকে গড়ে তুলেছে।

‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর ফেলো মইজেস নাইম ১৯৯০-এর দশকে ভেনিজুয়েলার সরকারে ছিলেন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জি’-জিরো মিডিয়া’র সাথে এক সাক্ষাতে তিনি বলেন যে, অর্থনৈতিক সমস্যায় পতিত হবার পর ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি এখন মধ্য আমেরিকার ছোট দেশগুলির আকারে এসে পৌঁছেছে, যদিও দেশটা বিশ্বে বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির একটা; এবং পৃথিবীর সবচাইতে বড় তেলের রিজার্ভ (প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেল) রয়েছে সেখানে। মার্কিন অবরোধ এবং ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতি মাসে ভেনিজুয়েলার তেল বিক্রির আয় ১৫ শতাংশ করে কমছে। ভেনিজুয়েলা সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার পিছনে সবচাইতে বড় স্তম্ভ হলো এর সেনাবাহিনী, যা এখনও প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে মইজেস নাইম বলছেন যে, সেনাবাহিনীর হাতে আর কোন অপশন নেই। এবং একইসাথে মাদুরোকে সমর্থন দিয়ে চলছে কিউবার ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি – বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিউবার ইন্টেলিজেন্সের প্রভাব এখন ব্যাপক।

গত মে মাসে ‘অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস’এ এক ভাষণে কিউবা গবেষক মারিয়া সি ওয়েরলাউ বলেন যে, দুর্বল অর্থনীতি এবং ছোট জনসংখ্যা সত্ত্বেও কিউবা বস্তুতঃ ভেনিজুয়েলার দখল নিয়ে নিয়েছে। কোন গুলি খরচ না করেই কিউবা তার চাইতে অনেক বড় এবং অনেক বেশি বিত্তশালী একটা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ওয়েরলাউ-এর কথাগুলি যে ভিত্তিহীন নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভেনিজুয়েলার ব্যাপারে কানাডার কূটনৈতিক চেষ্টা দেখে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ২২শে অগাস্ট ঘোষণা দেন যে, তিনি কিউবা যাচ্ছেন সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রদরিগেজের সাথে ভেনিজুয়েলা বিষয়ে কথা বলতে। মে মাস থেকে এটা হবে রদরিগেজের সাথে তার তৃতীয় বৈঠক।

 
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে ভালো বন্ধুত্ব থাকার কারণে ১৯৯৯ সালে হুগো শাভেজ ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হবার পর ‘জি-২’এর জন্যে নতুন করে দুয়ার খুলে যায়। কিউবা থেকে আসা ডাক্তার, ক্রীড়া প্রশিক্ষক, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ারদের মাঝ দিয়েই ‘জি-২’ ভেনিজুয়েলায় তাদের উপস্থিতি গড়ে তোলে। ২০০৭ সালে হুগো শাভেজ বলেন যে, ভেনিজুয়েলাতে ২০ হাজারের বেশি কিউবান ডাক্তার, নার্স এবং টেকনিশিয়ান কাজ করছে। ২০০২ সালে হুগো শাভেজকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টাটাই ছিল দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্ট।



হুগো শাভেজ এবং ফিদেল ক্যাস্ট্রো

‘জিওপলিটিক্যাল মনিটর’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ‘কিউবান ইন্টেলিজেন্স ডিরেকটরেট’ বা ‘জি-২’-এর শক্তির উৎস হচ্ছে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ১৯৬০-৭০-এর দশকে সোভিয়েত এবং পূর্ব-জার্মানির ইন্টেলিজেন্সের দ্বারা প্রশিক্ষণের ভিত। টানা ছয় দশক যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি অবস্থিত হয়েও সমাজতান্ত্রিক সরকারকে রক্ষা করতে পারার সাথে সাথে ‘জি-২’-এর ভিত আরও শক্ত হয়েছে। ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করার বেশ কয়েকটা চেষ্টাকেও তারা প্রতিহত করেছে বলে শোনা যায়। মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার বেশকিছু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী গ্রুপকে ‘জি-২’ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভিয়েতনামেও তাদের জড়িত থাকার কথা জানা যায়। ১৯৫৯ সালে কিউবায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকেই ‘জি-২’ ভেনিজুয়েলায় প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিল। কিউবা ভেনিজুয়েলার বামপন্থী বিপ্লবীদের সহায়তা করছিল। অন্যদিকে ভেনিজুয়েলার সরকার ছিল বামপন্থা-বিরোধী। তাই এসময়ে দুই দেশের সম্পর্ক সহজ ছিল না। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষের পর থেকে কিউবার জ্বালানি নিরাপত্তা শঙ্কার মাঝে পড়ে গেলে ভেনিজুয়েলা কিউবার কাছে আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে ভালো বন্ধুত্ব থাকার কারণে ১৯৯৯ সালে হুগো শাভেজ ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হবার পর ‘জি-২’এর জন্যে নতুন করে দুয়ার খুলে যায়। কিউবা থেকে আসা ডাক্তার, ক্রীড়া প্রশিক্ষক, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ারদের মাঝ দিয়েই ‘জি-২’ ভেনিজুয়েলায় তাদের উপস্থিতি গড়ে তোলে। ২০০৭ সালে হুগো শাভেজ বলেন যে, ভেনিজুয়েলাতে ২০ হাজারের বেশি কিউবান ডাক্তার, নার্স এবং টেকনিশিয়ান কাজ করছে। বেসরকারি হিসেবে অনেকে এই সংখ্যাকে ৪০ হাজার বলছেন।

অভিজ্ঞতার দিক থেকে ‘জি-২’ ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্স থেকে অনেক এগিয়ে থাকার কারণেই কিউবা তার নেতৃত্ব ধরে রাখতে পেরেছে। তবে ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্সের মাঝে অনেকেই বামপন্থী-বিরোধী থাকায় তারা ‘জি-২’এর প্রভাবকে পছন্দ করেনি। ২০০২ সালে হুগো শাভেজকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টায় মার্কিনীদের জড়িত থাকার খবর দেয় ব্রিটেনের ‘দ্যা অবজার্ভার’ পত্রিকা। জার্মান মিডিয়া ‘ডিডব্লিউ’ বলছে যে, শাভেজের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টাটাই ছিল দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্ট। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ক্যাস্ট্রো এবং শাভেজ ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতে চুক্তি করেন। চুক্তি মোতাবেক কিউবা ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনী এবং ইন্টেলিজেন্সকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে। প্রথম উদ্দেশ্যই থাকে ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরে শত্রু দেশের ইন্টেলিজেন্সের কর্মকান্ডকে খুঁজে বের করে দমন করা। এই কাজে ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্স ব্যাপক ধরপাকরড় চালায়।

নিরাপত্তা-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সিএনএ’-এর সিনিয়র এনালিস্ট উইলিয়াম রোজনাউ এবং রালফ এসপাচ ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, ছোট দেশ হয়েও কিউবা তার ইন্টেলিজেন্সের বদৌলতে নিজের ওজন বাড়িয়ে নিয়েছে। প্রাক্তন মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সদস্য এডওয়ার্ড স্নোডেন-কে ল্যাটিন আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে কিউবার ইন্টেলিজেন্স মধ্যস্ততা করে। সোভিয়েতদের সাথে কিউবানরাও মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর এবং ইন্টেলিজেন্সের ভেতরে ঢুকে পড়ে। স্পেন এবং ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলিতেও কিউবানরা কাজ চালিয়ে যায়। ১৯৮০-এর দশকে মধ্য আমেরিকার এল-সালভাদর এবং গুয়াতেমালাতে মার্কিন সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলাদের সহায়তা দেয় ‘জি-২’। ঠান্ডা যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রে ‘জি-২’এর কর্মকান্ড বৃদ্ধি পায়; বিশেষ করে ফ্লোরিডায় ক্যাস্ট্রো-বিরোধী গ্রুপগুলির ব্যাপারে ‘জি-২’ বেশি সক্রিয় ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফবিআই’ ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মার্কিন নিরাপত্তা স্থাপনায় বহুদিন ধরে কাজ করা বেশকিছু কিউবার ইন্টেলিজেন্স সদস্যকে গ্রেপ্তার করে এবং আদালতে বিচারও করে। ২০১০ সালে ‘উইকিলিকস’এর ফাঁস করা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তারবার্তার বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ কিউবান ইন্টেলিজেন্সের উপদেশেই চলছেন। মার্কিন তারবার্তায় বলা হয় যে, ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্স কিউবার ইন্টেলিজেন্সের মতো সক্ষম নয়; তাই কিউবানরা ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্সকে প্রশিক্ষণও দেয়। স্পেনের পত্রিকা ‘এবিসি’ এক প্রতিবেদনে বলে যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যোগ দেবার জন্যে মাদুরো যখন নিউ ইয়র্ক যাচ্ছিলেন, তখন তার বিমানে থাকা কিউবানদেরকে মার্কিন সরকার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ায় মাদুরোর বিমান ভেনিজুয়েলায় ফিরে যায়। ভেনিজুয়েলাকে ব্যবহার করে ‘জি-২’ ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশ, যেমন ব্রাজিল এবং কলম্বিয়াতে ইন্টেলিজেন্স অপারেশন চালাচ্ছে কিউবা।

তেলের বিনিময়ে নিরাপত্তা

কিউবা ভেনিজুয়েলার কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা পাচ্ছে; আর ভেনিজুয়েলা কিউবা থেকে পাচ্ছে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং ইন্টেলিজেন্স সহায়তা। ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১২ সাল নাগাদ দুই দেশের বাণিজ্য কিউবার জিডিপির ২১ শতাংশে দাঁড়ায়। অথচ সেই তুলনায় এই বাণিজ্য ভেনিজুয়েলার অর্থনীতির মাত্র ৪ শতাংশ ছিল। ভেনিজুয়েলা থেকে কিউবা ১ লক্ষ ৪ হাজার ব্যারেল তেল আমদানি করে ঐ বছরে, যা ছিল ভেনিজুয়েলার মোট জ্বালানি তেলের চাহিদার ৬১ শতাংশ। অথচ কিউবায় রপ্তানি করা তেল ছিল ভেনিজুয়েলার মোট তেল রপ্তানির ৫ শতাংশ। এই তেল ভেনিজুয়েলা কিউবাকে দেয় অতি সুলভ মূল্যে। মাত্র ৬০ শতাংশ মূল্য ৯০ দিনের মাঝে পরিশোধ করতে হয়; বাকিটা ২৫ বছরে ১ শতাংশ সুদে পরিশোধযোগ্য। অন্যদিকে কিউবা থেকে আসা ডাক্তার-প্রশিক্ষক-টেকনিশিয়ানরা ভেনিজুয়েলার সামাজিক উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছে। ভেনিজুয়েলার মানুষ উচ্চতর চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে কিউবাতে। আবার হাজার হাজার ভেনিজুয়েলান ছাত্র মেডিক্যাল বিষয়ে পড়াশোনা করছে কিউবাতে।

এর বিনিময়ে কিউবাকে ভেনিজুয়েলা কতটা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, তা সঠিক মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে তেলের বিনিময়ে ভেনিজুয়েলাকে নিরাপত্তা সহায়তা দিচ্ছে কিউবা। ভেনিজুয়েলার জনগণের বায়োমেট্রিক ডাটাবেস তৈরি করে দিচ্ছে কিউবান সরকারি কোম্পানি। হুগো শাভেজের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তার চিকিৎসাও হয়েছে কিউবাতে – ব্যাপক নিরাপত্তার মাঝে। ২০১৩ সালে শাভেজ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার মন্ত্রীসভার বৈঠকগুলি কিউবাতেই করতেন। ‘রয়টার্স’এর প্রতিবেদন বলছে যে, কিউবার ইন্টেলিজেন্সের সহায়তার কারণেই মাদুরো ক্ষমতায় টিকে গেছেন। ব্যাপক অর্থনৈতিক ধ্বস এবং ৪০ লক্ষ মানুষের দেশত্যাগের পরেও কিউবানদের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী মাদুরোর বিরুদ্ধে যায়নি। ভেনিজুয়েলার ইন্টেলিজেন্সের একসময় দায়িত্ব ছিল গণতন্ত্র রক্ষা। কিউবানদের প্রশিক্ষণের পর নতুন দায়িত্ব দাঁড়ায় সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। এবছরের শুরুতে ভেনিজুয়েলার বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদো নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনীকে মাদুরোর বিরুদ্ধে যাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যুক্তরাষ্ট্র গুয়াইদোর কথায় সমর্থন দিলেও ভেনিজুয়েলার সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে কোন সাড়াই মেলেনি।
মধ্য আমেরিকায় ভেনিজুয়েলার তেলের বিনিময়ে কিউবা প্রভাব বিস্তারের একটা সুযোগ পেয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থার মাঝেও কিউবা তার স্থান করে নিচ্ছে। মার্কিন প্রভাবে থাকা সংস্থাগুলিকে কিউবা অকার্যকর করে দিচ্ছে। ২০০১ সালে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ কারণে ল্যাটিন আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি সড়ে যাবার পরই যুক্তরাষ্ট্রকে বাইপাস করে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হতে থাকে। কিউবা-ভেনিজুয়েলার একত্রে কাজ করার কারণে পুরো আমেরিকাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে প্রতি নিয়ত। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথে এটা সাংঘর্ষিক নয়। 



আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াচ্ছে কিউবা

‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর প্রতিবেদন বলছে যে, কিউবা এবং ভেনিজুয়েলার মাঝে ‘বলিভারিয়ান’ সহযোগিতাকে পুরো ল্যাটিন আমেরিকা এবং মধ্য আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে চাইছে কিউবা। ২০০৫ সালের ‘পেট্রোক্যারিব’ প্রকল্পের মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার তেল শুধু কিউবা নয়, ক্যারিবিয়ানের দ্বীপ দেশগুলি এবং মধ্য আমেরিকার দেশগুলির বেশিরভাগের কাছেই যাওয়া শুরু করেছিল। মোট ১৫টা দেশ এই চুক্তির অধীনে সাশ্রয়ী মূল্যে ভেনিজুয়েলার তেল পাচ্ছিলো। এভাবে মধ্য আমেরিকায় ভেনিজুয়েলার তেলের বিনিময়ে কিউবা প্রভাব বিস্তারের একটা সুযোগ পেয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থার মাঝেও কিউবা তার স্থান করে নিচ্ছে। যেমন ‘অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস’এর মতো মার্কিন প্রভাবে থাকা সংস্থাগুলিকে কিউবা অকার্যকর করে দিচ্ছে। এধরনের সংস্থাগুলির প্রধান এজেন্ডা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার, যেগুলি ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশই এড়িয়ে যেতে চায়। ২০০১ সালে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ কারণে ল্যাটিন আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি সড়ে যাবার পরই যুক্তরাষ্ট্রকে বাইপাস করে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হতে থাকে। কিউবা সরাসরি জড়িত থেকে অথবা ভেনিজুয়েলার মাধ্যমে এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজের চেষ্টায় ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা বাদে পুরো আমেরিকার বাকি ৩৩টা দেশকে নিয়ে ‘কমিউনিটি অব ল্যাটিন আমেরিকান এন্ড ক্যারিবিয়ান স্টেটস’ গঠন করা হয়। ২০০৮ সালে গঠন করা হয় ‘ইউনিয়ন অব সাউথ আমেরিকান নেশনস’ (যদিও কিউব এর সদস্য নয়), যেটাকে আবার ‘বামপন্থী’ আখ্যা দিয়ে মার্কিন প্রভাবে থাকা বেশ কয়েকটা দেশ ২০১৮-১৯ সালে সেখান থেকে বের হয়ে যায়।

রোজনাউ এবং এসপাচ তাদের প্রতিবেদনে লিখছেন যে, কিউবা নিশ্চিতভাবেই তার ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ককে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ে ব্যবহার করছে। কোন রাষ্ট্রই বিনা কারণে ইন্টেলিজেন্স তথ্য যোগাড় করে না। আর গোপন তথ্য যোগাড় করার খরচও তো যোগাতে হবে। কিউবা মার্কিনীদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির সাথে ইন্টেলিজেন্সের তথ্য আদান-প্রদান করে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করতে পারে। কিউবানরা মার্কিন নিরাপত্তা, ইন্ডাস্ট্রি, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করে সেগুলি মার্কিনীদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ, যেমন - রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য করতে পারে।

ভেনিজুয়েলা বন্ধু খুঁজছে

কিছুদিন আগেই মাদুরো সরকারকে উৎখাত করার জন্যে মার্কিনীরা ভেনিজুয়েলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে এই অভ্যুত্থান চেষ্টা ভেস্তে গেলেও মাদুরো অভ্যুত্থান চেষ্টার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কিছু করেননি অথবা করতে পারেননি। এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে যে, অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারীরা ভেনিজুয়েলার সমাজে এতটাই প্রভাশালী যে, মাদুরো তাদেরকে আটক করা বা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবার চেষ্টাই করতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন যে, মাদুরোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টা ভেস্তে যাবার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মোক্ষম সময়ে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ। রাশিয়ার পাঠানো সেনারা ভেনিজুয়েলার ক্ষমতার সমীকরণে অনিশ্চয়তা জুড়ে দিলে অভ্যুত্থান ভেস্তে যায়। রুশ সরকার দরকারমতো সহায়তা দিলেও কিউবানরা মাদুরোর সাথে আঠার মতোই লেগে আছে।

২১শে অগাস্ট ভেনিজুয়েলা উত্তর কোরিয়াতে তার দূতাবাস খুলেছে। উত্তর কোরিয়ার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সাথে ভেনিজুয়েলা সরকার নিজেদের অবস্থানের অভিন্নতা খুঁজছে; উদ্দেশ্য – বহিঃবিশ্বে সমর্থন খোঁজা। এর কয়েকদিন আগেই ১৫ই অগাস্ট ভেনিজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ মস্কো সফর করেন। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ভেনিজুয়েলার সরকারের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি এবং মার্কিন চাপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্যে রুশ সমর্থনের কথা মনে করিয়ে দেন। এই বছরেই রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা কমপক্ষে দু’বার ভেনিজুয়েলা সফর করেন। তবে ভেনিজুয়েলাকে সমর্থন দেবার ক্ষেত্রে পুরোনো বন্ধুরাও শক্ত অবস্থানে থাকতে পারছে না। ১৯শে অগাস্ট ‘রয়টার্স’ বলছে যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপে চীনা তেল কোম্পানি ‘চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন’ বা ‘সিএনপিসি’ অগাস্ট মাসে ভেনিজুয়েলার তেল আমদানি স্থগিত করেছে। ভেনিজুয়েলা তেল সরবরাহের বিনিময়ে চীনাদের কাছ থেকে বড় অংকের ঋণ পেয়েছে। ভেনিজুয়েলার বেশিরভাগ তেলের ক্রেতাই চীন। সাম্প্রতিক সময়ে বেইজিং-এ মার্কিন দূতাবাসের সাথে ‘সিএনপিসি’র আলোচনার পরই এই সিদ্ধান্ত এলো। অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিকোলাস মাদুরোর বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা এখন সর্বোচ্চ।

ভেনিজুয়েলায় প্রভাব বিস্তার কিউবার জন্যে সবচাইতে বড় ভূকৌশলগত সাফল্য। যুক্তরাষ্ট্রের উঠানে ছয় দশক ধরে সমাজতান্ত্রিক সরকারকে টিকিয়ে রাখার পর ভেনিজুয়েলার সরকারকেও টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে কিউবা। ছোট্ট কিউবার পক্ষে পশ্চিম গোলার্ধে শক্তিধর দেশগুলিকে ব্যালান্সে রাখাটা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হবার ইঙ্গিত। 


কিউবার সাফল্য যা ইঙ্গিত দিচ্ছে

ভেনিজুয়েলার জনস্যংখ্যা কিউবার প্রায় তিন গুণ; ৩ কোটি ২০ লাখ বনাম ১ কোটি ১৫ লাখ। অর্থনৈতিক দিক থেকেও একইরকম গল্প। ভেনিজুয়েলার জিডিপি ২০১৪ সালে ছিল ৪’শ ৮২ বিলিয়ন ডলার; আর কিউবার ছিল ৮১ বিলিয়ন ডলার; অর্থাৎ প্রায় ৬ গুণ। (এখন অবশ্য ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি পঙ্গু।) ‘জিওপলিটিক্যাল মনিটর’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভেনিজুয়েলায় প্রভাব বিস্তার কিউবার জন্যে সবচাইতে বড় ভূকৌশলগত সাফল্য। যুক্তরাষ্ট্রের উঠানে ছয় দশক ধরে সমাজতান্ত্রিক সরকারকে টিকিয়ে রাখার পর ভেনিজুয়েলার সরকারকেও টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে কিউবা। কিউবার ‘জি-২’এর সাফল্য বলছে যে, শুধু বড় রাষ্ট্রগুলিই নয়, ছোট রাষ্ট্রও শক্তিশালী ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস তৈরি করতে সক্ষম, যদি তার জনগোষ্ঠির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা চিন্তার দিক থেকে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকে। ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক ব্যালান্স অব পাওয়ার পরিবর্তন সম্ভব, তা কিউবার কর্মকান্ডই প্রমাণ দেয়। পশ্চিম গোলার্ধে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, এবং অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলিকে ব্যালান্সে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কিউবা।

কিউবার সাফল্য প্রথমতঃ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অবস্থান করেও ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের মাঝে থাকা দেশগুলিতে কিউবা প্রভাব বিস্তার করছে। ভেনিজুয়েলার মাদুরো সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোটা যুক্তরাষ্ট্রের অত্র অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখার জন্যে অতি জরুরি। কিউবা-ভেনিজুয়েলার একত্রে কাজ করার কারণে পুরো আমেরিকাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে প্রতি নিয়ত। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথে এটা সাংঘর্ষিক নয়। 
দ্বিতীয়তঃ চিন্তাগত দিক থেকে এগিয়ে থাকার কারণে শুধু ভেনিজুয়েলা নয়, পুরো এলাকায় কিউবা প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে। আকারে ছোট হলেও একটা আদর্শিক ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকার কারণে কিউবা এটা করতে পারছে। বাকি বিশ্বের জন্যে এটা একটা উদাহরণ বটে – চিন্তাগত উতকর্ষতা থাকলে ছোট দেশও সুপারপাওয়ারের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। 
তৃতীয়তঃ কিউবা পশ্চিম গোলার্ধে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতাকে আরও উস্কে দিচ্ছে। কিউবার ইন্টেলিজেন্স যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগী রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য দেশকে ইন্টেলিজেন্স সহায়তা দিয়ে এই প্রতিযোগিতাকে আরও ঘনীভূত করতে যাচ্ছে। 
চতুর্থতঃ ছোট্ট কিউবার পক্ষে পশ্চিম গোলার্ধে শক্তিধর দেশগুলিকে ব্যালান্সে রাখাটা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হবার ইঙ্গিত।

Tuesday 20 August 2019

কাশ্মির – আবার অগ্নুৎপাতের অপেক্ষায় ভূরাজনৈতিক অগ্নিগিরি


কাশ্মিরের পরিস্থিতির জন্যে মূলতঃ দায়ী অত্র অঞ্চলের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের চিন্তাগুলি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় অবিভক্ত ভারতের ৪০ শতাংশ এলাকা ছিল বিভিন্ন রাজন্যদের হাতে; কাশ্মির ছিল এরকমই একটা রাজ্য। এই রাজ্যগুলির শাসকরা বিভিন্ন চুক্তির বদৌলতে ব্রিটিশ অধীনতা মেনে চলতো। ব্রিটিশ-পরবর্তী জাতীয়তাবাদী ভারতে কাশ্মিরকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কিনা হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আমলে কঠোর আকার ধারণ করে। তবে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যে বলপ্রয়োগের পদ্ধতিগুলি ব্রিটিশ সময় থেকে বিজেপির সময় পর্যন্ত খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। 
২১শে অগাস্ট ২০১৯


ভারতের সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৩৭০’এর মাধ্যমে কাশ্মিরকে আলাদা কিছু সুবিধা দেয়া হতো; যেমন পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি ব্যাপারগুলিতে ভারত সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ভারতের ইতিহাস নিয়ে গবেষক করা লেখক জন উইলসনের মতে, এই আর্টিকেল কাশ্মিরকে ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে আলাদা কোন সুবিধা দিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা মোতাবেক এই আর্টিকেল বাতিল ঘোষণার পর থেকে কাশ্মিরে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে ইন্টারনেট এবং মিডিয়া। ‘বিবিসি’র ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায় যে শ্রীনগরে শুক্রবার জুমআর নামাজের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের উপর কাঁদানে গ্যাস এবং গুলি ব্যবহার করছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, হাসপাতালগুলিতে নেই কোন স্টাফ; আর প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে রাস্তায় বের হলেই জনগণের উপর চলছে নিরাপত্তা বাহিনীর মারধর। ‘এনডিটিভি’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১২ই অগাস্ট ঈদ-উল-আজহার দিন শ্রীনগরের মসজিদগুলি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল; ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতে দেয়া হয়নি।

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কাশ্মিরের এহেন পরিস্থিতির জন্যে মূলতঃ দায়ী অত্র অঞ্চলের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের চিন্তাগুলি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় অবিভক্ত ভারতের ৪০ শতাংশ এলাকা ছিল বিভিন্ন রাজন্যদের হাতে; কাশ্মির ছিল এরকমই একটা রাজ্য। এই রাজ্যগুলির শাসকরা বিভিন্ন চুক্তির বদৌলতে ব্রিটিশ অধীনতা মেনে চলতো। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ব্রিটিশদের আনুগত্য করেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার তাদের স্বায়ত্বশাসন মেনে নিয়েছে। ব্রিটিশ-পরবর্তী জাতীয়তাবাদী ভারতে কাশ্মিরকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কিনা হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আমলে কঠোর আকার ধারণ করে। তবে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যে বলপ্রয়োগের পদ্ধতিগুলি ব্রিটিশ সময় থেকে বিজেপির সময় পর্যন্ত খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভাগের সময় কাশ্মিরের হিন্দু রাজা হরি সিং কাশ্মিরকে ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেন, যদিও বর্তমান কাশ্মিরের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের মতো জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ শতাংশই মুসলিম। কাশ্মিরের হিন্দু রাজাদের শুরু ১৮৪৬ সালে; যখন প্রথম এংলো-শিখ যুদ্ধে শিখদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয়ের পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হেনরি লরেন্স-এর অনুগত দোগরা রাজপুত বংশীয় গুলাব সিং-কে ৭৫ লক্ষ রুপির বিনিময়ে সিন্ধু নদের পূর্ব এবং রাভি নদীর পশ্চিম পাড়ের মাঝের কাশ্মির উপত্যকা নামের পাহাড়ি এলাকাটার রাজত্ব দিয়ে দেয়া হয়। অমরিতসরের চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মির ব্রিটিশদের অধীনে আলাদা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় কাশ্মিরের দোগরা রাজারা বিপ্লব দমনে ব্রিটিশদেরকে যথাসাধ্য সহায়তা করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে ভারতের অংশ হবার সিদ্ধান্ত নেবার আগে রাজা হরি সিং কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেননি। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পাকিস্তান প্রান্তের পুশতুন গোত্রীয় মিলিশিয়ারা কাশ্মির আক্রমণ করলে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন রাজাকে ভারতের কাছে নতি স্বীকার করতে বলেন। সেই হিসেবে ১৯৪৭ সালের ২৬শে অক্টোবর রাজা হরি সিং কাশ্মিরকে ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে চুক্তি সই করেন। তখন কাশ্মিরের অংশ হিসেবে ছিল জম্মু, কাশ্মির, উত্তরের গিলগিট-বালতিস্তান, লাদাখ, ট্রান্স-কারাকোরাম এবং আকসাই চিন। ব্রিটিশ ভারতের সীমারেখার ভাগবাটোয়ারার উপরেই শুরু হয় ১৯৪৭-৪৮ সালের প্রথম পাক-ভারত যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালে ১৩ই অগাস্টের জাতিসংঘ ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়। কাশ্মিরের দুই-তৃতীয়াংশ দেয়া হয় ভারতকে; আর বাকি এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানকে দেয়া হয়। এই যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে পাকিস্তান কাশ্মির থেকে তাদের নিয়মিত এবং অনিয়মিত বাহিনী সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। অল্পসংখ্যক সেনা মোতায়েনের বদলে কাশ্মিরের বেশিরভাগটার নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয় ভারতকে। তবে এখনও পাকিস্তান পুরো কাশ্মিরকে নিজের বলে মনে করে; ভারতও একই নীতিতে রয়েছে। আর অন্যদিকে আকসাই চিন অংশটার দাবিদার হলো চীন।
কাশ্মিরের কিছু ভৌগোলিক বাস্তবতা পাকিস্তান-ভারতকে আটকে রেখেছে। পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মির থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের দূরত্ব মাত্র ৬৭ কিঃমিঃ। এর মাঝের অংশটা বেশ দুর্গম হলেও তা পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়ে পাকিস্তান তার ‘কৌশলগত গভীরতা’ বৃদ্ধি করতে চায়। অন্যদিকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে কাশ্মিরের শ্রীনগরের সড়কপথে দূরত্ব ৯শ’ ১৪ কিঃমিঃ। এই দূরত্ব বেশি মনে হলেও এর মাঝে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা নেই তেমন। অর্থাৎ কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে না থাকলে দিল্লীর নিরাপত্তা হুমকির মাঝে পড়বে। একারণেই দিল্লীর চিন্তাবিদেরা কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অংশ তো নয়ই, কোন প্রকারের স্বাধীনও দেখতে চান না। 



কাশ্মিরকে বলা যায় ভূরাজনৈতিক অগ্নিগিরি। এই অঞ্চলে ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে সংঘটিত হয়েছে চারটা পাক-ভারত যুদ্ধ। ১৯৮৯ সাল থেকে পাকিস্তানের সমর্থনে কাশ্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে; আর ভারত বলছে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের ইন্ধনদাতা। এবছরের ফেব্রুয়ারিতেও পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর আরেকটা ছোটখাটো পাক-ভারত সংঘর্ষ হয়ে গেছে। শুধু ভারত-পাকিস্তানই নয়, আকসাই চিন-এর দাবি করা চীনও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর বিশ্লেষক কেভিন এলিসন বলছেন যে, মোদি সরকারের এই ঘোষণায় কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। পাকিস্তান বলছে যে, ভারতের এই ঘোষণায় কাশ্মিরের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলছেন যে, এই ঘোষণা ভারত সরকারের একটা কৌশলগত ভুল। অন্ততঃ কাশ্মিরের নরমপন্থী রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তারি পরওয়ানা পর সেটাই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে ৬ই অগাস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ ঘাফুর বলেন যে, পাকিস্তান ভারতীয় সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৩৭০’কে কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি; কারণ এই আর্টিকেল কাশ্মিরকে ভারতের অংশ হিসেবে মনে করিয়ে দেয়। কেভিন এলিসন বলছেন যে, কাশ্মিরের জনগণ স্বভাবগতভাবেই নিজেদের মুক্ত দেখতে যায়, যা ভারত সরকার সহজে এড়িয়ে যেতে পাববে না। আর এই আর্টিকেল-ই এতকাল কাশ্মিরের জনগনের একটা বড় অংশকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়ানো থেকে দূরে রেখেছিল। এখন কাশ্মিরের বাইরের জনগণও কাশ্মিরে জমি কিনতে পারবে, যা কিনা কাশ্মিরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে চ্যালেঞ্জ করবে, এবং উত্তেজনা বাড়াবে।

কাশ্মিরের কিছু ভৌগোলিক বাস্তবতা পাকিস্তান-ভারতকে আটকে রেখেছে। পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মির থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের দূরত্ব মাত্র ৬৭ কিঃমিঃ। এর মাঝের অংশটা বেশ দুর্গম হলেও তা পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। ‘দ্যা ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়ে পাকিস্তান তার ‘কৌশলগত গভীরতা’ বৃদ্ধি করতে চায়। অন্যদিকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে কাশ্মিরের শ্রীনগরের সড়কপথে দূরত্ব ৯শ’ ১৪ কিঃমিঃ। এই দূরত্ব বেশি মনে হলেও এর মাঝে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা নেই তেমন। অর্থাৎ কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে না থাকলে দিল্লীর নিরাপত্তা হুমকির মাঝে পড়বে। একারণেই দিল্লীর চিন্তাবিদেরা কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অংশ তো নয়ই, কোন প্রকারের স্বাধীনও দেখতে চান না। বিজেপির বিরোধী দল কংগ্রেস ‘আর্টিকেল ৩৭০’ বাদ দেয়ার সমালোচনা করলেও ভারতের বেশিরভাগ মানুষই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তকমা পাবার ভয়ে তেমন কিছু বলতে নারাজ।

অন্যদিকে কাশ্মিরে রয়েছে চীনের স্বার্থ। পাকিস্তানের মাঝ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিপিইসি’, যা আরব সাগরে গোয়াদর সমুদ্রবন্দর থেকে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের উইঘুর বা শিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ‘সিপিইসি’র মাধ্যমে চীন পূর্ব এশিয়ার মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করে এবং মার্কিন নৌবাহিনীকে এড়িয়ে তার জ্বালানি তেলের সরবরাহ পাওয়া নিশ্চিত করতে চাইছে। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতাতে এই ‘সিপিইসি’ চীনের জন্যে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। অন্যদিকে পাকিস্তান এই প্রকল্প চাইছে তার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে। ‘সিপিইসি’-কে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখে বলেই বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে ভারত সরকার সমর্থন দিয়েছে। ‘সিপিইসি’ চীনে পৌঁছাবার আগে পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মিরের উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভারত-অধিকৃত কাশ্মির থেকে এই ‘সিপিইসি’র এর দূরত্ব ইসলামাবাদের কাছাকাছি ১’শ কিঃমিঃ-এর মতো। চীন শুধু এ-ই দেখতে চায় যে ‘সিপিইসি’র নিরাপত্তা যেন হুমকির মাঝে না পড়ে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির আহ্বানে ১৬ই অগাস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বদ্ধদুয়ার বৈঠকে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুন বলেন যে, ভারতের সংবিধানে পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হতে যাচ্ছে। চীন এক্ষেত্রে সকল পক্ষকে রয়েসয়ে চলার উপদেশ দিচ্ছে। কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে ঐকমত্যে পৌঁছে এই উপদেশ দেয়া সম্ভব হয়নি।

কাশ্মির ইস্যু বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাত্মতা প্রকাশের একটা মাধ্যম। তবে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্ব এই ইস্যুতে ততটা সক্রিয় কিনা, তা প্রশ্ন করাই যায়। ৮ই অগাস্ট সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘গালফ নিউজ’ জানায় যে, সৌদি সরকার কাশ্মিরের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, এবং সেখানে কোন সহিংসতা হোক, তারা তা চাচ্ছেন না। আর এব্যাপারে জাতিসংঘের চুক্তিগুলিকে মেনে চলতেই তারা উপদেশ দিচ্ছেন। ২০১৮ সালে ভারতের সাথে সৌদি আরবের বাণিজ্য ছিল সাড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার; যা হয়তো ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাওয়া থেকে সৌদি সরকারকে বাধা দিতে পারে। অন্যদিকে ১৭ই অগাস্ট তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, তারা চাইছেন যে জাতিসংঘ কাশ্মির ইস্যুতে আরও অগ্রগামী ভূমিকা নিক। আগের দিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এব্যাপারে আলোচনা হওয়াকেই তুরস্ক সরকার ভালো দিক বলে দেখছে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দুই দেশের জাতিসংঘের উপর নির্ভরশীলতাই জানিয়ে দিচ্ছে যে, ১৬ই অগাস্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক থেকে তেমন কিছু না আসাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যদিকে ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরে যেকোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতকে সাবধান করেন। তিনি বলেন যে, ভারত যদি আজাদ কাশ্মিরে সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তাহলে পাকিস্তান তার উচিৎ জবাব দেবে। ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মিরের ব্যাপারে পাকিস্তান অবশ্য জাতিসংঘের দিকেই তাকিয়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, পাকিস্তান সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না জড়াতে চাইলেও কাশ্মিরের উত্তেজনা পাক-ভারত প্রক্সি যুদ্ধকে আবারও উস্কে দিতে পারে। আর সেটার উপর ভর করে বিশ্বব্যাপী মুসলিম আবেগকে নেতৃত্বস্থানীয়রা জনমত আদায়ে ব্যবহার করতে পারেন।

‘আর্টিকেল ৩৭০’ বাতিল করার পর আপাততঃ নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা বাড়বে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দীর্ঘ মেয়াদে কাশ্মিরের উপর ভারত সরকারের আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে এই ঘোষণা। তবে স্বল্প মেয়াদে কাশ্মিরে ভারত-বিরোধী চিন্তা দানা বাধার সম্ভাবনাই বেশি, যা কিনা দীর্ঘ মেয়াদে মোদির সফলতাকে চ্যালেঞ্জ করবে। আর কাশ্মিরে সহিংসতা বৃদ্ধি মানেই পাক-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। মুসলিম বিশ্বে কাশ্মির ইস্যুতে আবেগ থাকলেও মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্ব ভারতের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু করা থেকে বিরত থাকবে। এই আর্টিকেল বাতিলের ঘটনা চীনের ‘সিপিইসি’ বা আকসাই চিন-কে আপাততঃ চ্যালেঞ্জ করবে না; তাই চীনও এব্যাপারে বিশেষ কিছু করা থেকে বিরত থাকবে। পশ্চিমারাও ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত ‘স্থিতাবস্থা’কে পরিবর্তন করতে চায় না বলেই এব্যাপারে খুব বেশি কিছু করবে না। কাশ্মিরের জনগণের কষ্টকে নয়, বরং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে সবাই।