Saturday 25 June 2022

ভারতের নতুন সামরিক রিক্রুটমেন্ট প্রকল্পের উদ্দেশ্য কি?

২৫শে জুন ২০২২

নতুন দিল্লীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারেড। সামরিক ট্রেনিং পাওয়া এহেন জনগণ একটা দেশের জন্যে মারাত্মক হতে পারে, যেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মারাত্মক আকার নিচ্ছে। ১৯৪৭ সালেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ট্রেনিংপ্রাপ্তরা জাতিগত সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল। বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে, যখন একটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয় এবং সংখ্যালঘুরা নেতৃত্বশূণ্য থাকে, তখনই গণহত্যা সবচাইতে প্রকট আকার নেয়। প্রকৃতপক্ষে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে; পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।


গত ১৪ই জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘অগ্নিপথ’ নামে দেশের সামরিক বাহিনীর জন্যে নতুন রিক্রুটিং প্রকল্পের ঘোষণা দেন। এই প্রকল্পের অধীনে সাড়ে ১৭ বছর থেকে ২১ বছর বয়সের ব্যক্তিরা ৪ বছরের জন্যে বাহিনীতে যোগদান করবে। এর মাঝে এক চতুর্থাংশকে সামরিক বাহিনীকে স্থায়ীভাবে রেখে দেয়া হবে; বাকিদেরকে এককালীন ১১ লক্ষ ৭০ হাজার রুপির বিনিময়ে সামরিক বাহিনী থেকে বিদায় দেয়া হবে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বহু স্থায়ী সদস্যপদকে অস্থায়ী সদস্যপদের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করে এবছরের মাঝেই ৪০ হাজার সেনা রিক্রুট করা হবে; যা সামনের বছরগুলিকে ৫০ হাজারে ওঠানো হবে। সরকারের এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করা ছাড়াও সরকারি অফিসে হামলা এবং মোটরগাড়ি ও রেলগাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কমপক্ষে একজনের মৃত্যু ছাড়াও হাজারো মানুষকে আটক হয়েছে। এই বিক্ষোভের মাধ্যমে ভারতের চরম বেকারত্ব পরিস্থিতি আবারও সামনে এলো। ‘নিকেই এশিয়া’র এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ভারতের একটা বড় সংখ্যক মানুষের কাছে সামরিক বাহিনীর স্থায়ী চাকুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার আশা; যেখানে অবসরের পর পেনশনের ব্যবস্থাও রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, তাদেরকে চার বছর পর আবারও নতুন করে চাকুরি খুঁজতে হবে। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘এনডিটিভি’কে একজন সম্ভাব্য রিক্রুট বলেন যে, তাদের জীবনের পুরো আশাটাকেই সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে। আরেকজন বলছেন যে, চার বছর পর তারা আর ‘অগ্নিসেনা’ থাকবে না; তাদেরকে তখন বলা হবে ‘বাতিল সেনা’!

ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বলছে যে, তারা নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের গড় বয়স কমাবে; যার মাধ্যমে দেশ শারীরিক দিক থেকে আরও সবল সেনাদের পাবে। ২১শে জুন ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ‘এএনআই’কে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেন যে, একটা নবীন রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রবীন হতে পারে না। আগামী দিনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে গেলে পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন।

তবে অনেকেই মনে করছেন যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার সেনাদের বেতন ও পেনশনের পিছনে খরচ কমিয়ে তা সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের পিছনে ব্যয় করতে চাইছে। ভারতীয় থিংকট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’এর সিনিয়র ফেলো সুশান্ত সিং গত ২১শে জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে বলেন যে, ভারতের ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক বাজেটের দিকে সকলের দৃষ্টি থাকলেও এর ৫২ শতাংশ খরচই যে বেতনাদির পিছনে যায়, সেখানকার সমস্যাগুলি সরকার সমাধান করতে পারছে না; বরং সাম্প্রতিক সময়ে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। দেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝ থেকেই সামরিক রিক্রুট বেশি আসে। এদের মাঝেই এখন অর্থনীতি নিয়ে হতাশা সবচাইতে বেশি। অপরদিকে সামরিক সদস্যরা অভিযোগ করছে যে, তাদের দুই তৃতীয়াংশের বেশি অস্ত্রসস্ত্রই খুবই পুরোনো এবং ব্যবহারের অনুপযোগী। এর আগের কিছু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, যেকোন সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মাত্র ১০ দিন যুদ্ধ চালিয়ে নেবার মতো রসদ রয়েছে।

অর্থনৈতিক সমস্যা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকটের মাঝে সরকার সামরিক বাহিনীর দাবিগুলি কিভাবে মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভারতের গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রতিমাসে ভারতের অর্থনীতিতে ১০ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ যোগ হচ্ছে। কিছুদিন আগেও বেকারত্বের হার ইতিহসাসের সর্বোচ্চ হলেও এই জুন মাসে তা ৭ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে প্রায় ৯০ কোটি ভারতীয় এখন চাকুরি খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছে! অর্থনৈতিক দৈন্যতার সাথে সাথে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের অপ্রতুলতাও দেশটাকে পেয়ে বসেছে। ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি বছরে ২ কোটি চাকুরি তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০২০ সালে ‘ম্যাককিনসি গ্লোবাল ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০৩০ সাল নাগাদ ভারতে কৃষিকাজের বাইরে নতুন ৯ কোটি চাকুরি তৈরি করতে হবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে মোদির সরকারের সামনে এটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।

ভারতের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল দীপেন্দ্র সিং হুদা ‘নিকেই এশিয়া’কে বলছেন যে, নতুন প্রকল্পের সেনাদের সাথে পুরোনো সেনাদের সম্পর্ক যেমন নিশ্চিত নয়, তেমনি নতুনদেরকে কতটা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, সেটাও কিন্তু নিশ্চিত নয়। কারণ সামরিক বাহিনীতে একজন সেনাকে পরিপূর্ণভাবে প্রশিক্ষণ দিতে ৩ বছর লেগে যায়। আর যদি এই নতুন প্রকল্প সামরিক ক্যারিয়ারের আকর্ষণ কমিয়ে ফেলে, তাহলে সবচাইতে ভালো রিক্রুটগুলি থেকে সামরিক বাহিনী বঞ্চিত হতে পারে।

‘আল জাজিরা’র এক লেখায় সুশান্ত সিং বিজেপি সরকারের নতুন প্রকল্পের সম্ভাব্য ফলাফল আলোচনা করেছেন। বিজেপির গত ৮ বছরের শাসনামলে সামরিক বাহিনীর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাজেট চাহিদা অপূর্ণ রাখা হয়েছে। এই অপূর্ণ বাজেটের প্রায় ৫৩ শতাংশই হলো ‘ক্যাপিটাল বাজেট’; যা ব্যবহার করার কথা বাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পিছনে। এই সময়ের মাঝে সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা তুলে ধরার চাইতে বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা করাতেই মগ্ন ছিল মোদি সরকার। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী দুই বছরের মাঝে ১ লক্ষ নতুন চাকুরি তৈরি করতে চাইছে সরকার। মোদি সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পার্লামেন্টে কারুর সাথে কোন আলোচনাই করেনি; যা সকলকেই অবাক করেছে।

মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার ভারতকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে; যেখানে জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংতার সম্ভাবনা আরও প্রবল হচ্ছে। সুশান্ত সিংএর সবচাইতে বড় দুশ্চিন্তা হলো ৪ বছর পর এই রিক্রুটরা কি করবে? তিনি চিন্তিত যে, সামরিক ট্রেনিং পাওয়া এহেন জনগণ একটা দেশের জন্যে মারাত্মক হতে পারে, যেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মারাত্মক আকার নিচ্ছে। ১৯৪৭ সালেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ট্রেনিংপ্রাপ্তরা জাতিগত সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল। বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে, যখন একটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয় এবং সংখ্যালঘুরা নেতৃত্বশূণ্য থাকে, তখনই গণহত্যা সবচাইতে প্রকট আকার নেয়। প্রকৃতপক্ষে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে; ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বব্যবস্থায় যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।

Saturday 18 June 2022

পাকিস্তানের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা উঠছে কেন?

১৮ই জুন ২০২২

 
মে ২০২২। ইস্রাইলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পাকিস্তানিদের ইস্রাইল সফররত গ্রুপ।  পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবিরা ইসলাম নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে চিন্তার কেন্দ্রে রাখছেন। পাকিস্তান ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে কিনা, সেটা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার। যখন ইস্রাইল কোন আলোচনাতেই ছিল না, তখন ইমরান খানই হঠাত করে পাকিস্তান ইস্রাইলের সম্পর্কের ব্যাপারটা তুলে এনেছেন; যা কিনা এই বিষয়টাকে খোলা আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

গত মে মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পাকিস্তানিদের একটা দল ইস্রাইল সফর করে। এই সফরের মূল আয়োজক ছিল ‘শারাকা’ নামের একটা গ্রুপ, যারা ২০২০ সাল থেকে আরব দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের স্বাক্ষরিত ‘আব্রাহাম একর্ড’এর উপর ভিত্তি করে মুসলিম দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পিছনে কাজ করছে। পাকিস্তানি পত্রিকা ‘দ্যা নিউজ’ বলছে যে, পাকিস্তানিদের ঐ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান লবির সদস্য আনীলা আলী। আর এই গ্রুপের মাঝে ছিলেন সাংবাদিক আহমেদ কুরাইশি, যিনি সরকারি পাকিস্তান টেলিভিশনের একজন টক-শো সঞ্চালক। ‘জিও টিভি’র সাথে এক সাক্ষাতে আনীলা আলী বলেন যে, তাদের সফরের সাথে পাকিস্তানের কোন সম্পর্ক নেই; বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের সাথে ইহুদীদের সম্পর্কোন্নয়ন।

‘এনপিআর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের পাসপোর্টে এখনও ইস্রাইল ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। যারা ইস্রাইল গিয়েছেন, তারা মার্কিন পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এটার আয়োজক ছিল মার্কিন মুসলিম মহিলাদের একটা সংস্থা। এই সফর ইস্রাইলে খুব একটা আলোচিত না হলেও পাকিস্তানে এ নিয়ে তুমুল ঝড় বয়ে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগে অনেকেই ধারণা করছেন যে, সৌদিদের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে চলেছে। যদিও পাকিস্তান সৌদি আরব দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত, তথাপি পাকিস্তান হয়তো সৌদিদের পথে হাঁটতে পারবে না।

পাকিস্তানি সাংবাদিক কুনওয়ার খুলদুনে শহীদ ইস্রাইলের ‘হারেতস’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, সৌদি আরবের কারণেই ইস্রাইলের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ হয়তো অবশ্যম্ভাবী। তিনি মনে করছেন যে, সৌদি আরবের পর সুন্নী মুসলিম দেশগুলির মাঝে পাকিস্তান ইস্রাইলের বিরুদ্ধে শেষ বাধা হিসেবে থাকতে পারে না। পাকিস্তানের সবচাইতে শক্ত জাতীয়তাবাদীরাও এখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষপাতী। ইস্রাইল সফরকারী আহমেদ কুরাইশিকে এখন পাকিস্তানের সাংবাদিকদের মাঝেই অনেকে সমর্থন দিচ্ছেন। পাকিস্তানের পরিবেশবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িতরা এবং কৃষিবিদদের কেউ কেউ এখন বলছেন যে, ইস্রাইলের কাছ থেকে পাকিস্তান প্রযুক্তি নিয়ে নিজেদের পরিবেশ এবং কৃষির উন্নয়ন করতে পারে। মাত্র এক দশক আগেও ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা পাকিস্তানে করা যেতো না। সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিই পাকিস্তানকে এই পথে হাঁটাচ্ছে। তবে তার ধারণা যে, ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গেলে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সামাল দেয়ার চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেব্যাপারে পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা মনে করছেন যে, ইস্রাইলকে স্বীকৃতি দিতে গেলে তারা জনগণের যে আক্রোশের শিকার হবে, সেটাকে সেনাবাহিনী যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবেই কাজটা করা সম্ভব। রাজনীতিবিদেরা নিরাপত্তা চাইছেন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে; আর সেনাবাহিনী নিরাপত্তা চাইছে ওয়াশিংটন এবং রিয়াদের কাছ থেকে। খুলদুনে শহীদ বলছেন যে, খুব শিগগিরই হয়তো পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘আইএমএফ’এর ঋণের মতো সুন্দর কিছু প্রস্তাব দেয়া হবে; যেগুলির সাথে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তাবও থাকবে। এছাড়াও সামনের দিনগুলিতে নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবে সৌদি আর্থিক সহায়তায় আমদানি করা গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের উপর ভর্তুকির ঘোষণা এবং পবিত্র আল আকসা মসজিদে যেতে দেয়ার দাবি হয়তো আসতে থাকবে।
 
জুন ২০২২। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ 'জেরুজালেম আমাদের' লেখা স্কার্ফ পড়ে পার্লামেন্টে ঢুকছেন। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছেন বলেই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের পক্ষে পাকিস্তানের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলছেন যে, তার উত্তরসুরীদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারতের সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে। খুলদুনে শহীদ বলছেন যে, প্রকৃতপক্ষে ইমরান খানকেও এই একই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল; যিনি তা করতে পারেননি। ইমরানের কথাগুলিকে মোকাবিলা করতে ২রা জুন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ‘জেরুজালেম আমাদের’ এই স্লোগান লেখা স্কার্ফ গলায় জড়িয়ে পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা মারইয়াম নাওয়াজ বলছেন যে, জেমাইমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করে পাকিস্তানে শুধুমাত্র ইমরান খানই ইহুদীদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক করেছেন। আর ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট’ দলের নেতা ফজলুর রহমান, যিনি এতকাল ইস্রাইলের বিরুদ্ধে খুবই সরব ছিলেন, তিনি এখন বলছেন যে, ইমরান খানই ইস্রাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছিলেন। ২০২১ সালের জুনে ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী রাজনীতিবিদ বিলাওয়াল ভুট্টো অভিযোগ করেন যে, ইমরান সরকারের দু’জন উপদেষ্টা গোপনে ইস্রাইল সফর করে এসেছেন।

এক টুইটার বার্তায় আহমেদ কুরাইশি বলছেন যে, ইমরানের দলের শিরীন মাজারি, যিনি এখন ইস্রাইলের বিপক্ষে কথা বলছেন, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থিংকট্যাংক ‘আইএসএসআই’এর প্রধান থাকার সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি তুরস্কে গিয়ে পাকিস্তানের পণ্যের ইস্রাইলের সহজে ঢোকা নিশ্চিত করতে ইস্রাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলভান শালমএর সাথে আলোচনায় বসেছিলেন; অথচ তখন শিরীন মাজারি কোন প্রতিবাদই করেননি। ‘দ্যা ডন’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাতে আহমেদ কুরাইশি বলেন যে, শেহবাজ শরীফের সরকার যখন বলছে যে, সরকার তাকে পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে বরখাস্ত করেছে, তখন বোঝা যায় যে, তারা ইমরানের অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে একই নীতিতে হাঁটছেন।

পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবিরা ইসলাম নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে চিন্তার কেন্দ্রে রাখছেন। আহমেদ কুরাইশি বলছেন যে, পাকিস্তান ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে কিনা, সেটা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার। তিনি বলছেন যে, যখন ইস্রাইল কোন আলোচনাতেই ছিল না, তখন ইমরান খানই হঠাত করে পাকিস্তান ইস্রাইলের সম্পর্কের ব্যাপারটা তুলে এনেছেন; যা কিনা এই বিষয়টাকে খোলা আলোচনায় নিয়ে এসেছে। পুরো ব্যাপারটার একটা ধারণা পাওয়া যায় ‘এনপিআর’এর প্রশ্নে ইমরানের সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীর উত্তরে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানিদের ইস্রাইল সফরে পাকিস্তান সরকার অনুমতি দিয়েছিল কিনা, এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তাদের নীতি হলো ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক না রাখা। খুলদুনে শহীদ বলছেন যে, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছেন বলেই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের পক্ষে পাকিস্তানের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

Sunday 12 June 2022

ভারতে নবী (সাঃ)কে অবমাননার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

১২ই জুন ২০২২
মালদ্বীপের সৈকতে ময়লার ঝুড়িতে মোদির ছবি। যদিও বিজেপি সরকার তার মুসলিম বিদ্বেষী নীতি বাস্তবায়নে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্বের ‘রেড লাইন’ কোথায়, তা বুঝতে পেরেছে; তথাপি মুসলিম বিশ্বের জনগণের ‘রেড লাইন’ তাদের কাছে পরিষ্কার না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই যে, উগ্র হিন্দুবাদী ভারত তৈরির আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সুস্থ্য মস্তিষ্কের চিন্তা বেশিরভাগক্ষেত্রেই অবহেলিত হবে; যার ফলশ্রুতিতে আবারও হয়তো মুসলিম বিশ্বের সেকুলার নেতৃত্ব তাদের জনগণের কাছ থেকে চাপ অনুভব করবে। প্রতি ক্ষেত্রেই মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে নেতৃত্বের হাহাকার জেঁকে বসবে; যা কিনা ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

 
ভারতের বিজেপি সরকারের দুই মুখপাত্র ও রাজনীতিবিদ নুপুর শর্মা এবং নাভীন জিনদালের নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে করা অবমাননাকর মন্তব্যের উপর ভর করে পুরো মুসলিম বিশ্বে যখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তখন এই ঘটনার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র। গত ২৬শে মে নুপুর শর্মা এক ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে রাসূল (সাঃ) এবং তার স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। এই মন্তব্যের মারাত্মক সমালোচনা শুরুর পর বিজেপির আরেক মুখপাত্র নাভীন জিনদাল টুইটারে তার সহকর্মীকে সমর্থন দেন। ‘সিএনএন’এর খবরে বলা হচ্ছে যে, ঘটনার স্পর্শকাতরতা অনুধাবন করে বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া শর্মার কথাগুলি কি ছিল, তা পরিষ্কার করে বলা থেকেও বিরত থেকেছে। শর্মা পরবর্তীতে এক টুইটার বার্তায় তার এই মন্তব্য তুলে নেন। পুরো মুসলিম বিশ্ব থেকে চাপ আসার পর ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ৫ই জুন নুপুর শর্মার সদস্যপদ স্থগিত করে এবং নাভীন জিনদালকে দল থেকে বহিষ্কার করে। প্রশ্ন উঠেছে যে, বিজেপির অধীনে ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদের উপর চরম অত্যাচারের খবরের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব থেকে এতকাল কোন চাপ না আসলেও এখন কেন চাপ আসা শুরু হয়েছে?

সারা মুসলিম বিশ্বে প্রতিক্রিয়া

বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’ জানাচ্ছে যে, ৫ই জুন ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কাইয়াহ নাইডু কাতার সফর করার সময় ভারতের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানানো হয়। একই দিনে ইরানের বার্তা সংস্থা ‘ইরনা’ জানায় যে, সেদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ইরানের ‘সরকার এবং জনগণের পক্ষ থেকে’ প্রতিবাদ জানানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টা দেশ নিয়ে গঠিত ‘গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল’ বা ‘জিসিসি’র সেক্রেটারি জেনারেল নায়েফ ফালাহ আল হাজরাফএর পক্ষ থেকেও বিবৃতি দেয়া হয়। ৫৭টা মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত ‘ওআইসি’র পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানানো হয় যাতে করে ভারতের মুসলিমদের রক্ষা করার জন্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ৬ই জুন ভারতের বার্তা সংস্থা ‘পিটিআই’ জানায় যে, সোদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্দান, বাহরাইন, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের সাথে ইন্দোনেশিয়াও যোগ দিয়েছে নিন্দা জানাতে। তবে একইসাথে সৌদি আরব এবং কুয়েত বিজেপির মুখপাত্রকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার মোদি সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়।

৬ই জুন ‘ইজিপ্ট টুডে’র এক খবরে বলা হচ্ছে যে, মিশরের সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংস্থা ‘আল আজহার’ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, বিজেপির নেতৃত্বের বক্তব্য সন্ত্রাসের শামিল। এধরনের মন্তব্য পুরো বিশ্বকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মাঝে ফেলা দেয়া ছাড়াও যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, ভারতের কিছু রাজনীতিবিদেরা নিজেদের ভোট বাড়াতে এধরনের কথা বলছে। সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সৌদি আরবের ‘জেনারেল প্রেসিডেন্সি অব দ্যা এফেয়ার্স অব দ্যা গ্র্যান্ড মস্ক’এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের বক্তব্যকে নিকৃষ্টতম কর্মকান্ড বলে আখ্যা দেয়া হয়। ‘সৌদি আরবের ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ’এর পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে। এর দু’দিন আগে ওমানের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আহমাদ বিন হামাদ আল খলিল এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, এধরনের মন্তব্য সকল মুসলিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শামিল। তিনি ভারতীয় পণ্য বয়কট করারও আহ্বান জানান। বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’র এক খবরে বলা হয় যে, কুয়েতের ‘আল আরাবিয়া কোঅপারেটিভ সোসাইটি’র এক সুপারস্টোরের কর্মচারীরা সেখানকার ভারতীয় পণ্য শেলফ থেকে সড়িয়ে ট্রলিতে করে জমিয়ে আলাদা করেছে। প্লাস্টিকে মুড়িয়ে রাখা চাল এবং মসলার প্যাকেটের উপর লিখে দেয়া হয় যে, ‘আমরা ভারতীয় পণ্য সড়িয়ে ফেলেছি’। কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন যে, তারা পুরো কোম্পানিজুড়ে ভারতীয় পণ্য বয়কট করার চিন্তা করছে। ‘দ্যা মালদিভস জার্নাল’ বলছে যে, মালদ্বীপে হুলহুমালে দ্বীপের সৈকতে এবং হাউজিং প্রকল্প এলাকায় ময়লার ঝুড়ির উপর নরেন্দ্র মোদির ছবি লাগানো হয়েছে। ছবিতে মোদির চেহারার উপর জুতার ছাপ দেয়া ছিল। কুয়েতেও ডাস্টবিনের উপর একই ছবি দেখা গেছে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র বলে খ্যাত প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ১০ই জুন শুক্রবার জুমআর নামাজের পর হাজারো মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে।

 
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি। ভারত সফরের সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে আলিঙ্গন করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নেতৃত্বও যথারীতি বাস্তববাদীই থেকেছে। তারা নুপুর শর্মার বিরুদ্ধে নেয়া বিজেপির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এই মুসলিম দেশগুলির কোনটাই ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের অত্যাচার নিয়ে কোন কথাই বলেনি। ভারতের মুসলিমদের উপর অত্যাচারের খবরাখবর যাতে দিল্লীর সাথে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত থাকার লক্ষ্যের উপর কোন বিরুপ প্রভাব না ফেলে, সেব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব সর্বদাই খেয়াল রেখেছে। ঠিক একারণেই এই দেশগুলির পক্ষ থেকে নবী (সাঃ)কে অবমাননার বিষয়ে ভারত সরকারের সমালোচনা অনেকের কাছেই অদ্ভূত ঠেকেছে।


সকলেই ঘটনার সুযোগ নিচ্ছে

সাংবাদিক এবং লেখক দেবাশিষ রায় চৌধুরী ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের প্রতিনিধিরা যখন নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে অবমাননা করেছে, তখন ভারতের সেকুলার রাজনীতিবিদেরাও চুপ থেকেছে। শুধুমাত্র এক সপ্তাহ পর মুসলিম বিশ্ব থেকে প্রতিবাদ আসার পরেই তারা মুখ খুলেছেন। মুসলিম বিশ্ব থেকে ভারত সরকারের উপর চাপ আসায় ভারতের মুসলিমরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও সেটা খুব বেশি হলে স্বল্প সময়ের জন্যে। এই উত্তেজনা যখন ঠান্ডা হয়ে আসবে, তখনই বোঝা যাবে যে, ভারতের মুসলিম জনগণের নিরাপত্তার চাইতে বাণিজ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোদি সরকার তখন হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা বলে কিছু ব্যক্তিকে কারাবন্দী করবে। আর উগ্রবাদী হিন্দু এবং সরকারি শক্তিকে আবারও মুসলিমদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, মোদি আবারও মুসলিম দেশগুলি সফর করে তাদের নেতৃত্বকে আলিঙ্গন করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে কথা না বলবে, ততক্ষণ সকলকিছু স্বাভাবিক থাকবে। বিজেপির ৮ বছরের শাসনের মাঝে ভারতের মুসলিমদের উপর চরম অত্যাচার হলেও মুসলিম বিশ্ব থেকে কোন প্রতিবাদই আসেনি। উল্টো সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব দিল্লীর সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করেছে।

ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা বিজেপির মুখপাত্রকে বরখাস্ত করার মোদির সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। এদের কেউ কেউ মোদিকে কাপুরুষ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ‘শেইম অন মোদি’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে। তারা অনেকেই টুইটারে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালনা শুরু করেছে। কেউ কেউ মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দিচ্ছে। কাতারের সমালোচনা করে কেউ কেউ ‘কাতার এয়ারলাইন্স’কে বয়কটের ডাকও দিয়েছে।

তবে নুপুর শর্মা এবং নাভীন জিনদালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীনরা দেখাতে চেয়েছে যে, তারা পুরো মুসলিম বিশ্বের সাথে সংঘাতে যাবার জন্যে প্রস্তুত নয়। এতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের দুর্বলতাটাও প্রকাশ পায়। সকলেই এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করতে চাইছে। জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার পক্ষ থেকেও ভারতকে হুমকি দেয়া হয়েছে। ‘সিএনএন’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ভারতের প্রভাবশালী থিংকট্যাংক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর ফেলো মোহাম্মদ সিনান সিয়েচ বলছেন যে, এটা আল কায়েদার রিক্রুটিং প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর ফেলো হাসান আল হাসান বলছেন যে, মোদি সর্বদাই চেষ্টা করেছেন যাতে করে তার অভ্যন্তরীণ হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার ফলাফল দেশের বাইরে চলে না যায়; এবং সেটা যেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে ভারতের সম্পর্ককে সমস্যায় না ফেলে।

 
১০ই জুন ২০২২। ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র বলে খ্যাত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় হাজারো মানুষের বিক্ষোভ। প্রতিবাদ শুধু সরকার নয়, বরং সকল প্রকারের ধর্মীয় সংস্থার পক্ষ থেকে এমনকি বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকেও এসেছে। এটা বলে দিচ্ছে যে, পুরো মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলেই এখানে কূটনীতিকদের জড়িত হতে হয়েছে; যা এর আগে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের জনগণের এই প্রতিক্রিয়া মুসলিম দেশগুলির সেকুলার নেতৃত্বের বাস্তবাদী থাকার নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলেই বিজেপিকে ছাড় দিতে হয়েছে।


ভারতের মুসলিমদের কি হবে?


‘সিএনএন’এর এক প্রতিদেবনে বলা হচ্ছে যে, নবী (সাঃ)কে অবমাননার ঘটনা ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিমদের কাছে নতুন কোন ব্যাপার হয়ে আসেনি। কারণ গত ৮ বছর ধরে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের অধীনে তারা মারাত্মক অত্যাচারের শিকার হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতে উগ্রবাদী হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কর্মকান্ড বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসেই ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতা পূজা শাকুন পান্ডে ভারতকে রক্ষা করতে মুসলিমদের নিধন করে ফেলার কথা বলেন। তিনি বলেন যে, তারা যদি ২০ লক্ষের মতো মুসলিম হত্যা করে ফেলতে পারে, তাহলে একটা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসেই দক্ষিণের কর্ণাটক রাজ্যে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পড়া নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৮ সালে বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন যে, বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমরা হলো ‘পিঁপড়া’র মতো এবং এদেরকে উৎপাটন করার জন্যে তারা ব্যবস্থা নেবেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মাঝে বহু মুসলিমকে হিন্দুত্ববাদীরা গরুর গোশত খাওয়ার ‘অপরাধে’ হত্যা করেছে বলে বলছে মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। ২০১৯ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব বিল পাস হয়; যার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ থেকে সংখ্যালঘুদেরকে ভারতে আশ্রয় দেয়ার কথা বলা হয়। অপরদিকে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিল ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উত্তর প্রদেশে নতুন আইন করা হয়, যার মাধ্যমে হিন্দুদের পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করার কঠিন করে ফেলা হয়।

মুসলিম দেশগুলি যদি ভারতকে এতটাই গুরুত্ব দেয় এবং মুসলিমদের উপর অত্যাচারের ব্যাপারে এতদিন চুপ থাকে, তাহলে এখন কেন তারা মুখ খুলছে? দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলছেন যে, হয়তো মুসলিম নেতৃত্ব নিজেদের দেশের জনগণকে ঠান্ডা রাখার জন্যেই ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। কুয়েতের মিডিয়া বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যসংকটে নিজেদের সুরক্ষা দিতে ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার পর কুয়েতের সরকার দিল্লীকে তাদের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে। ভারতের মোট বহির্বাণিজ্যের ১৫ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টা দেশের সাথে হয়ে থাকে। ভারতের মোট জ্বালানি তেলের এক তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বিশ্বব্যাপী ভারতের মোট ১ কোটি ৩৫ লক্ষ প্রবাসীর মাঝে প্রায় ৮৭ লক্ষই বাস করে ‘জিসিসি’ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে। এই প্রবাসীদের কাছ থেকে বছর প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে; যা কিনা ভারতের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৬৫ শতাংশ। বুঝতে বাকি থাকে না যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মধ্যপ্রাচ্যের উপর যেমন অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যও ভারতের সাথে বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি জনবলের সংকটের কারণে বিদেশী শ্রম, বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিকদের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।

নবী (সাঃ)কে অবমাননার ফলে মোদির বিজেপি সরকারের অবস্থান অভ্যন্তরীণভাবে পরিবর্তন হচ্ছে না ঠিকই; তবে ঘটনার বাস্তবতার চাপ মোকাবিলা করতে বিজেপি সরকার যে তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডায় কিছুটা ছাড় দিয়ে বাস্তববাদীও হতে পারে সেটার প্রমাণ মিলেছে আবারও। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নেতৃত্বও যথারীতি বাস্তববাদীই থেকেছে। তারা নুপুর শর্মার বিরুদ্ধে নেয়া বিজেপির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এই মুসলিম দেশগুলির কোনটাই ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের অত্যাচার নিয়ে কোন কথাই বলেনি। ভারতের মুসলিমদের উপর অত্যাচারের খবরাখবর যাতে দিল্লীর সাথে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত থাকার লক্ষ্যের উপর কোন বিরুপ প্রভাব না ফেলে, সেব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব সর্বদাই খেয়াল রেখেছে। ঠিক একারণেই এই দেশগুলির পক্ষ থেকে নবী (সাঃ)কে অবমাননার বিষয়ে ভারত সরকারের সমালোচনা অনেকের কাছেই অদ্ভূত ঠেকেছে। এই প্রতিবাদ শুধু সরকার নয়, বরং সকল প্রকারের ধর্মীয় সংস্থার পক্ষ থেকে এমনকি বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকেও এসেছে। এটা বলে দিচ্ছে যে, পুরো মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলেই এখানে কূটনীতিকদের জড়িত হতে হয়েছে; যা এর আগে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের জনগণের এই প্রতিক্রিয়া মুসলিম দেশগুলির সেকুলার নেতৃত্বের বাস্তবাদী থাকার নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলেই বিজেপিকে ছাড় দিতে হয়েছে। যদিও বিজেপি সরকার তার মুসলিম বিদ্বেষী নীতি বাস্তবায়নে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্বের ‘রেড লাইন’ কোথায়, তা বুঝতে পেরেছে; তথাপি মুসলিম বিশ্বের জনগণের ‘রেড লাইন’ তাদের কাছে পরিষ্কার না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই যে, উগ্র হিন্দুবাদী ভারত তৈরির আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সুস্থ্য মস্তিষ্কের চিন্তা বেশিরভাগক্ষেত্রেই অবহেলিত হবে; যার ফলশ্রুতিতে আবারও হয়তো মুসলিম বিশ্বের সেকুলার নেতৃত্ব তাদের জনগণের কাছ থেকে চাপ অনুভব করবে। প্রতি ক্ষেত্রেই মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে নেতৃত্বের হাহাকার জেঁকে বসবে; যা কিনা ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

Friday 10 June 2022

পশ্চিমারা একমত হতে পারছে না যে ইউক্রেন যুদ্ধ কিভাবে শেষ হওয়া উচিৎ

১০ই জুন ২০২২

 
ন্যাটোর সদস্যদেশগুলির পতাকা উড়ছে। পশ্চিমাদের মাঝে যুদ্ধ শেষ করার লক্ষ্যের ব্যাপারে অনৈক্য যখন আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন আবারও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের উপরেই সকলকে নির্ভর করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়াকে ‘দুর্বল’ করার কথা বলছে, তখন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের লক্ষ্যগুলি গৌন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে যুদ্ধ দীর্ঘ হচ্ছে; যা গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে হুমকির মাঝে ফেলে দিয়ে বিকল্পের রাস্তা প্রসারিত করছে।


ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সাড়ে তিন মাস পর পশ্চিমা দেশগুলি যুদ্ধ শেষ হবার ব্যাপারে একমত হতে পারছে না। যুদ্ধের শুরুতে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে যতটা ঐক্য প্রদর্শন করেছিল, যুদ্ধ লম্বা হবার সাথেসাথে তাদের চিন্তাগুলি ততটাই অনৈক্যে রূপ নিচ্ছে।

বার্লিনের ‘রবার্ট বশ একাডেমি’র ফেলো এবং ‘লে মন্ড’ পত্রিকার কলামিস্ট সিলভি কাউফম্যান ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক লেখায় বলেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ কিভাবে শেষ হওয়া উচিৎ, তা নিয়ে পশ্চিমাদের মাঝে দু’টা গ্রুপ তৈরি হয়েছে। প্রথম গ্রুপটা মনে করছে যে, রাশিয়াকে এমনভাবে শাস্তি দেয়া উচিৎ, যাতে করে সে আর এধরনের কাজ না করে। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করার সময়ে এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার সময়ে পশ্চিমারা যদি যথেষ্ট শক্তভাবে বাধা দিতো, তাহলে রাশিয়া হয়তো ২০২২ সালের কাজটা করতে সাহস পেতো না। ২৫শে এপ্রিল মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেছেন যে, রাশিয়াকে যথেষ্ট ‘দুর্বল’ করে ফেলা উচিৎ। তবে এই কথার সাথে ওয়াশিংটনের লক্ষ্যের সম্পর্ক কতটুকু, তা এখনও যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। অপরদিকে দ্বিতীয় গ্রুপটা মনে করছে যে, যুদ্ধ শেষ হওয়া উচিৎ ইউক্রেনের জয় দিয়ে। আর ইউক্রেনের সীমানা নিয়ে সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকেই নিতে দেয়া উচিৎ। ইউরোপের অনেকেই ভুলেনি কিভাবে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপকে ভাগাভাগি করেছিল; যা কিনা পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। আর এই দেশগুলিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও মধ্য ইউরোপকে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দেয়।

ব্রিটেনের ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক কন কাফলিন কিছু ন্যাটো সদস্যদেশের মারাত্মক সমালোচনা করছেন। তিনি বলছেন যে, জার্মানি এবং ফ্রান্স ইউক্রেনকে রক্ষা করার চাইতে রাশিয়াকে তুষ্ট করাতেই বেশি আগ্রহী। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো পশ্চিমা চিন্তাবিদও এখন যুদ্ধ শেষ করতে ইউক্রেনকে ছাড় দেয়ার কথা বলছেন। ১৯৯০এর দশকে সাদ্দাম হোসেনকে কুয়েত থেকে বের করতে পশ্চিমারা পাঁচ লক্ষ সেনার বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেছিল। কিন্তু এখন পশ্চিমারা একনায়কদেরকে মোকাবিলা করতে যথেষ্ট ইচ্ছুক নয়। রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনকে যথেষ্ট সহায়তা না দেয়ার অর্থ হলো অন্যান্য একনায়কেরাও মনে করতে পারে যে, তারাও পশ্চিমাদের তেমন কোন বাধা ছাড়াই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পারে। কন কাফলিনের কথায়, ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে যুদ্ধ জেতানোর মাধ্যমেই বিশ্বের অন্যান্য একনায়কদেরকে শিক্ষা দেয়া সম্ভব।

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ‘সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি এনালিসিস’এর ফেলো ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এডওয়ার্ড লুকাস ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, তিন বছর আগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ যখন বলছিলেন যে, ন্যাটোর ‘মস্তিষ্ক মৃত’, তখন তিনি সেসময়কার বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিলেন। কারণ তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত হতে পারছিলো না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এবার বুঝি ন্যাটো পুনরায় তার লক্ষ্য ফিরে পেয়েছে। তারা ইউক্রেনকে একযোগে অস্ত্র দিয়েছে, রাশিয়ার হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে, সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে, এবং পূর্বদিকের সীমানার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু ন্যাটোর এই ‘হানিমুন’ এখন শেষ! লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডসবার্গিস বলেছেন যে, ‘হানিমুন’এর সময়টা ছিল স্বল্প সময়ের। যুদ্ধ যখন দীর্ঘ হতে শুরু করেছে, তখনই এই ঐক্যে টানাপোড়েন পড়েছে এবং এই জোট এখনও দোদুল্যমান। লুকাস বলছেন যে, মাত্র ১৪ বছর আগেও ন্যাটোর গোপন গ্রুপ ‘এমসি ১৬১’এর হিসেবের মাঝে রাশিয়া কোন হুমকি হিসেবে ছিল না; যার মূল কারণ ছিল জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার পক্ষপাতি ছিল। রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে না দেখার কারণে ন্যাটোর পূর্ব দিকের সদস্য রাষ্ট্র পোল্যান্ড এবং তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকে দ্বিতীয় সাড়ির সদস্য দেশ হিসেবে দেখা হচ্ছিলো। পোল্যান্ডের প্রশ্নের উত্তরে ন্যাটো বলেছিল যে, ন্যাটোর পক্ষে এই দেশগুলিকে বেলারুশের আগ্রাসন থেকে বাঁচানো সম্ভব হলেও রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

 
১৪ বছর আগে রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে না দেখার কারণে ন্যাটোর পূর্ব দিকের সদস্য রাষ্ট্র পোল্যান্ড এবং তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকে দ্বিতীয় সাড়ির সদস্য দেশ হিসেবে দেখা হচ্ছিলো। পোল্যান্ডের প্রশ্নের উত্তরে ন্যাটো বলেছিল যে, ন্যাটোর পক্ষে এই দেশগুলিকে বেলারুশের আগ্রাসন থেকে বাঁচানো সম্ভব হলেও রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

কাউফম্যান বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের স্বার্থের দ্বন্দ্বগুলি সবার সামনে চলে এসেছে। একদিকে জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইতালি ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার সাথে তৈরি করা বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখে বিপদে পড়ে গেছে। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ মনে করছেন যে, ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইউরোপের যে নিরাপত্তা কাঠামো তিনি তৈরি করার স্বপ্ন দেখছিলেন, তা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভেস্তে যাচ্ছে। অপরদিকে, পোল্যান্ড এবং বল্টিক রাষ্ট্রগুলি মনে করছে যে, তারা এতদিন যাবত রাশিয়াকে যেভাবে অবিশ্বাস করতো, তা এখন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। আর ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করাতেও তারা নিজেদেরকে আরও বলীয়ান ভাবছে। পোল্যান্ড তো ভাবতে শুরু করেছে যে, ইউক্রেনের সাথে একযোগ হয়ে তারা ফ্রান্স ও জার্মানির পুরোনো জোটের বিপরীতে একটা নতুন জোট গঠন করতে পারবে, যা যথেষ্ট শক্তিশালী হবে এবং প্রভাব বহণ করবে। আর পশ্চিমাদের কাছ থেকে রাশিয়ার অপমানিত হবার কিছু নেই; কারণ পুতিন নিজেই নিজেকে যথেষ্ট অপমানিত করেছেন।

ইউক্রেনে হামলা করার আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে ব্যাপারগুলি ভেবেছিলেন তার মাঝে হয়তো বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ক্ষয়ের সাথেসাথে পশ্চিমাদের সিদ্ধান্তহীনতার ব্যাপারটাও ছিল। তবে এর অর্থ তা নয় যে, তিনি ইউক্রেনকে যেনতেনভাবে হারাতে পারতেন। কিয়েভ এবং খারকিভ থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর বুঝতে বাকি নেই যে, পুতিনও যুদ্ধ শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছেন। তবে পশ্চিমাদের মাঝে যুদ্ধ শেষ করার লক্ষ্যের ব্যাপারে অনৈক্য যখন আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন আবারও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের উপরেই সকলকে নির্ভর করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়াকে ‘দুর্বল’ করার কথা বলছে, তখন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের লক্ষ্যগুলি গৌন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে যুদ্ধ দীর্ঘ হচ্ছে; যা গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে হুমকির মাঝে ফেলে দিয়ে বিকল্পের রাস্তা প্রসারিত করছে।

Saturday 4 June 2022

বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে ইস্রাইল

০৪ঠা জুন ২০২২
 
ইরানের 'আইআরজিসি'র অন্তর্গত 'আল কুদস ফোর্স'এর কর্নেল হাসান সাইয়াদ খোদাইএর শেষকৃত্যানুষ্ঠান। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে; যা কিনা চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ইরানকে নিয়ন্ত্রণের কাজটা ইস্রাইলের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই রক্ষা করবে। ইরানের ‘আল কুদস ফোর্স’এর নেতা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যাকান্ড সেই পরিকল্পনারই অংশ।


১লা জুন ইস্রাইলের সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় যে, তারা একটা সামরিক মহড়া শুরু করেছে, যেখানে কয়েক ডজন ইস্রাইলি যুদ্ধবিমান দূরবর্তী টার্গেটে হামলা করার অনুশীলন করে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, এই মহড়ায় আকাশে থাকা অবস্থায় বিমান থেকে বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করার অনুশীলনও করা হয়। মহড়াটা হলো একমাসব্যাপী মহড়ার একটা অংশ, যেখানে সাইপ্রাসও যুক্ত রয়েছে। ‘দ্যা এরাব উইকলি’ বলছে যে, মহড়ার ধরণ এভাবে ঘোষণা দেয়ার অর্থ হলো ইস্রাইল নিঃসন্দেহে ইরানকে হুমকি দিচ্ছে। মহড়াটা এমন সময়ে এলো, যখন পশ্চিমা দেশগুলির সাথে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প কয়েক মাস ধরে আটকে রয়েছে। ইস্রাইল মনে করে যে ইরানের সাথে পশ্চিমাদের পারমাণবিক চুক্তির মাঝে ইস্রাইলের নিরাপত্তার জন্যে যথেষ্ট রক্ষাকবচ নেই। তাই তারা এই চুক্তির বিরোধী। ইস্রাইলের এই প্রচ্ছন্ন হুমকি ইরানের সাথে চলমান উত্তেজনা এবং সংঘাতকেই তুলে ধরে; যা মিডিয়াতে ‘ছায়াযুদ্ধ’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

৩রা জুন ইরান ঘোষণা দেয় যে, ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড কোর বা ‘আইআরজিসি’র অন্তর্গত ‘কুদস ফোর্স’এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মৃত্যুবরণ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইরানের সরকারি বার্তাসংস্থা ‘ইরনা’ জানায় যে, কর্নেল আলী এসমাইলজাদেহ কারাজ শহরে তার নিজ বাড়িতে কোন ‘একটা ঘটনায়’ মৃত্যুবরণ করেন। এর চাইতে বেশি কিছু বলা না হলেও সেখানে অস্বীকার করা হয় যে, কর্নেলকে হত্যা করা হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক ইরানের রাজনৈতিক বিরোধীদের ওয়েবসাইট ‘ইরান ইন্টারন্যাশনাল’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে বলছে যে, কর্নেলকে ‘আইআরজিসি’ই বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে। কারণ এসমাইলজাদেহ মাত্র কিছুদিন আগেই হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া ‘আল কুদস ফোর্স’এর আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ব্যাপারে তথ্য পাচার করেছিলেন। ওয়েবসাইটটা সৌদি আরবের অর্থায়ন পায় বলে অনেকে ধারণা করেন। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই কর্নেল হাসান সাইয়াদ খোদাইকে অজ্ঞাত দু’জন বন্দুকধারী মোটরসাইকেল থামিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তেহরানের মোজাহেদিন এ-ইসলাম স্ট্রীটের নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা এলাকায় তাকে হত্যা করা হয়; যেখানে ‘আইআরজিসি’র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বসবাস করেন। ইরান এখনও হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও ঘটনার জন্যে তারা ইস্রাইলকে দায়ী করেছে। এর আগে গত কয়েক বছরে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে কর্মরত বেশ ক’জন বিজ্ঞানী হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতেও কয়েকবার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে; যেগুলির জন্যেও ইরান ইস্রাইলকে দায়ী করেছে। ইস্রাইল বলছে যে, খোদাই ইরানের বাইরে বিভিন্ন অপহরণ এবং হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন; বিশেষ করে ইস্রাইলি টার্গেটের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন তিনি। ২০২০ সালের নভেম্বরে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যার পর থেকে এটাই ইরানের অভ্যন্তরে সবচাইতে বড় হত্যাকান্ড। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ জানাচ্ছে যে, ইস্রাইল মার্কিন কর্মকর্তাদের বলেছে যে, খোদাইএর হত্যাকান্ড ইস্রাইলই ঘটিয়েছে। এই ঘটনার জের ধরেই ইস্রাইল তুরস্কে ইস্রাইলি নাগরিকদের জন্যে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে; এবং বলেছে যে, ইরান তুরস্কে ইস্রাইলের স্বার্থে আঘাত করতে পারে।

 
লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে আকাবা উপসাগরের মুখে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দু’টা দ্বীপ তিরান এবং সানাফিরের মালিকানা নিয়ে মিশর এবং সৌদি আরবের মাঝে যে সমঝোতা হতে চলেছে, তা ইস্রাইল মেনে নেবে। দ্বীপ নিয়ে এই আলোচনাগুলির মূলে রয়েছে ইস্রাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ইস্রাইলও যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না থেকে বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে চাইছে।

এদিকে ২রা জুন ‘জেরুজালেম পোস্ট’ বলে যে, লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে আকাবা উপসাগরের মুখে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দু’টা দ্বীপ তিরান এবং সানাফিরের মালিকানা নিয়ে মিশর এবং সৌদি আরবের মাঝে যে সমঝোতা হতে চলেছে, তা ইস্রাইল মেনে নেবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জুন মাসে তার আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফরে এই দ্বীপগুলির মালিকানা মিশরের হাত থেকে সৌদি আরবের হাতে যাবার ঘোষণা দিতে পারেন। দ্বীপদু’টা ইস্রাইলের দক্ষিণের এইলাত সমুদ্রবন্দরের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে অবস্থিত। ১৯৬৭ সালে ইস্রাইল এই দ্বীপদু’টা দখল করে নেয় এবং ‘ক্যাম্প ডেভিড’ শান্তিচুক্তির পর ১৯৮২ সালে ইস্রাইল মিশরের কাছে দ্বীপদু’টা হস্তান্তর করে। ইস্রাইলের এই স্বীকৃতির বিনিময়ে সৌদি আরব তার আকাশসীমাকে ইস্রাইলের যেকোন বেসামরিক বিমানকে ব্যবহার করতে দেবে। বর্তমানে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সাথে ইস্রাইলের বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রে সৌদি আরব আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিচ্ছে। এছাড়াও ভারতের ‘এয়ার ইন্ডিয়া’র ফ্লাইটগুলিও ইস্রাইলে যাতায়াত করতে পারে। ‘মিডলইস্ট আই’ বলছে যে, দ্বীপ নিয়ে এই আলোচনাগুলির মূলে রয়েছে ইস্রাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা। ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের প্রচেষ্টায় ‘আব্রাহাম একর্ডস’এর মাধ্যমে আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করে।

১লা জুন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ‘ফরেন এফেয়ার্স’ ম্যাগাজিন আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সৌদি আরব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সহযোগী। তিনি আরও বলেন যে, ‘আব্রাহাম একর্ডস’এর মাধ্যমে ইস্রাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্যে মার্কিন সরকার কাজ করে যাবে। কিছুদিন আগেই সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর এক আলোচনায় সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সউদ বলেন যে, তিনি মনে করেন যে, ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কের পুরোপুরি স্বাভাবিকীকরণ পুরো অঞ্চলের জন্যে বিশাল সুবিধা বয়ে আনবে। তবে ফিলিস্তিনের ইস্যুটা সমাধান না করা গেলে এই সুবিধাটা পাওয়া যাবে না।

বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ইস্রাইলও যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না থেকে বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে চাইছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে; যা কিনা চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ইরানকে নিয়ন্ত্রণের কাজটা ইস্রাইলের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই রক্ষা করবে। ইরানের ‘আল কুদস ফোর্স’এর নেতা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যাকান্ড সেই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে দেখছেন অনেকেই। ইস্রাইল চাইছে না যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ইরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিক। অন্ততঃ গত কয়েক মাস ধরে ইরানের সাথে আলোচনায় কোন অগ্রগতি না হওয়ায় বাইডেন প্রশাসন ইস্রাইলের দাবিগুলিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে এবং ইস্রাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মাঝে ইস্রাইল এবং ইরানের মাঝে ‘ছায়াযুদ্ধ’ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।