Thursday 15 September 2022

তুরস্ক ও গ্রিসের মাঝে উত্তেজনা কোন দিকে যাচ্ছে?

১৫ই সেপ্টেম্বর ২০২২
 
ইজিয়ান সাগরের প্রায় সবগুলি দ্বীপই পশ্চিমারা গ্রিসকে বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। যেকারণে ইজিয়ান সাগরের প্রায় পুরোটাই গ্রিসের হাতে; যা নিয়ে তুরস্ক গ্রিসের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে তুরস্ক পশ্চিমাদের জন্যে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আজকে ততটা নয়। যেকারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপিয়রা তুরস্ককে সামরিক প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে পারছে এবং গ্রিসের পক্ষও নিতে পারছে।

‘রয়টার্স’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, গত ১৩ই সেপ্টেম্বর তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সমুদ্রে ৫ জন শিশু ও একজন মহিলাসহ মোট ৬ জন অভিবাসন প্রত্যাশী ডুবে মৃত্যুবরণ করে। তুর্কি কোস্ট গার্ড এক বিবৃতিতে বলে যে, এই মানুষগুলি লেবানন থেকে ইতালি যাবার চেষ্টা করছিল। মোট ৭৩ জনকে তুর্কিরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। লেবানন থেকে রওয়ানা হয়ে তুরস্কের উপকূলের কাছে গ্রিক মালিকানায় থাকা রোডস দ্বীপের কাছে এসে তারা জ্বালানি নেবার চেষ্টা করে। তুর্কিরা বলছে যে, অভিবাসীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গ্রিক কোস্ট গার্ড তাদের কাছে যায় ঠিকই; কিন্তু তাদেরকে চারটা লাইফ বোটে তুলে দিয়ে তুর্কি উপকূলের কাছে ছেড়ে দেয়। তবে গ্রিক কোস্ট গার্ড এক বিবৃতিতে এই ঘটনাটা পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করে। অভিবাসন প্রত্যাশীদের ব্যাপারে তুরস্ক ও গ্রিসের নীতি সাংঘর্ষিক অবস্থানে থাকায় তা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে চাপের মাঝে ফেলেছে।

এর মাত্র দুই দিন আগে গ্রিক কোস্ট গার্ড ইজিয়ান সাগরের তুর্কি দ্বীপ বজকাদাএর ২০ কিঃমিঃ দূরে আন্তর্জাতিক সমুদ্রে একটা তুর্কি পরিবহণ জাহাজকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গ্রিক কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, তারা তুর্কি দ্বীপ বজকাদাএর প্রায় ৬০ কিঃমিঃ দক্ষিণে গ্রিক দ্বীপ লেসবসএর কাছাকাছি জাহাজটাকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে সাবধান করার জন্যে গুলি ছোঁড়ে। যেহেতু ইজিয়ান সাগর দিয়ে যাওয়া অনেক জাহাজেই ইউরোপ অভিমুখে যাওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীরা থাকে, তাই তারা অনেক সময়েই সন্দেহজনক মনে হলে জাহাজগুলির উপর নজরদারি করে থাকে।

‘আল জাজিরা’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুরস্কের কথায়, গ্রিকরা ইজিয়ান সাগরের ক্রিট দ্বীপে রুশ নির্মিত ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করে তুর্কি যুদ্ধবিমানগুলিকে হুমকির মাঝে রাখছে; যা গ্রিকরা অস্বীকার করেছে। এছাড়াও গ্রিক যুদ্ধবিমানও ইজিয়ান সাগরে তুর্কি যুদ্ধবিমানকে হুমকি দিয়েছে। তুর্কিরা এও অভিযোগ করেছে যে, গ্রিকরা তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহী গ্রুপ ‘পিকেকে’র সদস্যদেরকে গোপনে সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে; যা তারা গ্রেপ্তার হওয়া ‘পিকেকে’ সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে। অপরদিকে গ্রিকরা বলছে যে, ইজিয়ান সাগরে গ্রিসের মালিকানায় থাকা রোডস এবং কস দ্বীপের মতো দ্বীপগুলি পর্যটন শিল্পের জন্যে গ্রীসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সেই দ্বীপগুলি যেখানে গ্রিক মূল ভূখন্ড থেকে অনেক দূরে, সেখানে সেগুলি তুরস্কের মূল ভূখন্ড থেকে মাত্র ৫ থেকে ১৫ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত। গ্রিকরা এই দ্বীপগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে।

গত ৩রা সেপ্টেম্বর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান গ্রিক বিমানের তুর্কি আকাশসীমানা লঙ্ঘনের অভিযোগ করে বলেন যে, যদি গ্রিকরা ইজিয়ান সাগরে তুর্কি বিমানকে হুমকি প্রদান করে যেতে থাকে, তাহলে গ্রিকদেরকে ক্ষতির সন্মুখীন হতে হবে। অপরদিকে গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস বলেন যে, তুর্কি প্রেসিডেন্টের কথাগুলি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে তিনি উত্তেজনা হ্রাসে তুর্কি নেতার সাথে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, অক্টোবরে ইইউএর বৈঠকে হয়তো এরকম একটা সুযোগ তৈরি হতে পারে।

সপ্তাহখানেক আগে গ্রিক সরকার ন্যাটো, ইইউ এবং জাতিসংঘের কাছে চিঠি দিয়ে তুর্কি আগ্রাসী মনোভাবের নিন্দা জানাতে অনুরোধ করে। চিঠিতে আশংকা প্রকাশ করা হয় যে, এহেন পরিস্থিতি সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। গ্রিকরা তাদের সমর্থন পাচ্ছে ফ্রান্সের কাছ থেকে। ‘গ্রিক সিটি টাইমস’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, গ্রিক প্রধানমন্ত্রী মিতসোতাকিস প্যারিস সফর করার সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর কাছ থেকে সমর্থন পান। ১২ই সেপ্টেম্বর এক যৌথ সংবাদ সন্মেলনে ম্যাক্রঁ বলেন যে, তুরস্কের বিবৃতি এবং কর্মকান্ড একবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং তিনি একইসাথে গ্রিসের সাথে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্স গ্রিকদেরকে ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে এবং নৌবাহিনীর জন্যে ফ্রিগেট দিচ্ছে; সাথে ঋণ সুবিধাও দেয়া হচ্ছে।

দুই ন্যাটো সদস্য দেশের মাঝে উত্তেজনা ন্যাটোর ঐক্যের মাঝেও প্রশ্ন তুলেছে। ন্যাটোর অফিশিয়াল টুইটার বার্তায় ১৯২২ সালে দখলদারি গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের শততম বার্ষিকীতে তুরস্ককে অভিনন্দন জানাবার পর গ্রিকরা প্রতিবাদ করে। ফলস্বরূপ ন্যাটো সেই বার্তা মুছে ফেললে তুর্কিরা নাখোশ হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, দুই ন্যাটো সদস্যের দ্বন্দ্ব মোটেই সুবিধা বয়ে আনবে না। আর ইজিয়ানের দ্বীপগুলির উপর গ্রিসের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কোন প্রশ্নই নেই।

প্রাক্তন মার্কিন সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব জিম টাউনসেন্ড ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, যদিও এই মুহুর্তে দুই দেশের উত্তেজনা নিরসনে কারুর মধ্যস্ততা প্রয়োজন, তথাপি তিনি কাছাকাছি সময়ে তা দেখছেন না। দুই দেশের কেউ যদি নিজেদের পক্ষ সমর্থনে ন্যাটোকে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, তাহলে ন্যাটোর ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আর এই অনৈক্যকে মস্কো ব্যবহার করতে চাইবে। প্রাক্তন ন্যাটো সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা মার্কিন জেনারেল ফিলিপ ব্রীডলাভ বলছেন যে, যদিও দুই দেশের উত্তেজনা নতুন নয়, তথাপি তুরস্কের নেতৃত্ব দেশটাকে এমন একটা দিকে নিয়ে যেতে চাইছে, যা কিনা বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ককে আবারও টানাপোড়েনের মাঝে ফেলেছে। তবে যেহেতু দুই দেশেরই সামনে নির্বাচন, তাই উত্তেজক কথাগুলি হয়তো কিছুটা হলেও অভ্যন্তরীণ জনগণকে টার্গেট করে বলা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলকে যেভাবে দেখতে চাইছে, সেক্ষেত্রে তুরস্কের চাইতে গ্রিস অপেক্ষাকৃতভাবে এগিয়ে আছে।

দুই দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন এই দ্বন্দ্বে ইন্ধন যোগালেও তুরস্ক ও গ্রিসের দ্বন্দ্ব তাদের জন্মকাল থেকেই। ইজিয়ান সাগরের প্রায় সবগুলি দ্বীপই পশ্চিমারা গ্রিসকে বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। যেকারণে ইজিয়ান সাগরের প্রায় পুরোটাই গ্রিসের হাতে; যা নিয়ে তুরস্ক গ্রিসের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে তুরস্ক পশ্চিমাদের জন্যে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আজকে ততটা নয়। যেকারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপিয়রা তুরস্ককে সামরিক প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে পারছে এবং গ্রিসের পক্ষও নিতে পারছে। ফ্রান্স ইতোমধ্যেই তুরস্ককে ব্যালান্স করতে গ্রিসকে সামরিক সহায়তাও দিচ্ছে। অপরদিকে রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের মাঝেও তুরস্ক রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও ন্যাটোর সদস্যদেশগুলির সাংঘর্ষিক লক্ষ্য সংস্থার ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

No comments:

Post a Comment