Thursday 27 April 2017

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ওভারসীজ ট্রেনিং কমান্ড গড়ার সময় এসেছে

২৭শে এপ্রিল ২০১৭

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সৈন্যদের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণের মাঝে দিয়ে বেশকিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে বটে, তবে সেই অপারেশনগুলি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সীমিত অবদানই রাখবে। কারণ শান্তিরক্ষী মিশনের লক্ষ্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রভাব বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রাখবে না। সত্যিকার অর্থে, এধরনের প্রভাব বৃদ্ধি যাতে না হয়, জাতিসংঘ সেটা লক্ষ্য রাখে। কাজেই বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শান্তিরক্ষী মিশনের বাইরেও অপশন খুঁজতে হবে।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সক্ষমতার বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্বের কাছে বাড়ছে বাংলাদেশের সন্মান, প্রতিপত্তি, প্রভাব। এর মাঝে যে ব্যাপারটি বড় একটি ভূমিকা রাখে তা হলো সামরিক সক্ষমতা। এই সক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রের বর্তমান প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের সাথে সাথে সক্ষমতা তৈরির নীতির জানান দেয়া হয়েছে মাত্র। তবে সাবমেরিনের এই উপাখ্যান দরকার ছিল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের নামকে জাহির করার। যদিও এই জাহির করার মাঝে একটি কালো দাগ পড়েছে ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করার মাঝ দিয়ে। তথাপি সক্ষমতা বৃদ্ধির এই প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের চিন্তাশীল মহল অব্যাহতই রাখতে চান, এবং একইসাথে ভারতের প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় দেখার ইচ্ছাই এক্ষেত্রে প্রবল। ভারতের প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান চিন্তা হবে বাংলাদেশের প্রভাবকে বৃদ্ধি করা। এই প্রভাব বৃদ্ধি ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে জাকার্তায় আইওআরএ শীর্ষ বৈঠকে, ঢাকায় আইপিইউ সন্মেলনে, কসোভোকে স্বীকৃতির মাঝ দিয়ে, এবং এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকায় কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কর্মকান্ডকে ভিন্ন উচ্চতায় নেবার মাধ্যমে। এখান এই প্রভাবের মাঝে সামরিক সক্ষমতাকে ‘ফিট’ করার পালা।

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সৈন্যদের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণের মাঝে দিয়ে বেশকিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে বটে, তবে সেই অপারেশনগুলি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সীমিত অবদানই রাখবে। কারণ শান্তিরক্ষী মিশনের লক্ষ্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রভাব বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রাখবে না। সত্যিকার অর্থে, এধরনের প্রভাব বৃদ্ধি যাতে না হয়, জাতিসংঘ সেটা লক্ষ্য রাখে। কাজেই বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শান্তিরক্ষী মিশনের বাইরেও অপশন খুঁজতে হবে।
   
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল নাইজেরিয়া সফরের ছবি। বাংলাদেশ পৃথিবীতে বন্ধু খোঁজে। আর সেকারণেই আফ্রিকার বহু দেশে বাংলাদেশের বন্ধু তৈরি হয়েছে, যেখানে অনান্য অনেক দেশ নির্যাতকের তকমা নিয়ে আফ্রিকা ছাড়ছে। বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এবং সামরিক সক্ষমতা গড়াটা রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা গড়ার সাথে সম্পর্কিত। আর এখানেই আবারও আসছে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার কথা। বাংলাদেশের বন্ধুত্বের নীতির সাথে এর সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বন্ধুর সাথে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার বিনিময় – এটাই হতে পারে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মূলমন্ত্র।


বন্ধুর সাথে প্রশিক্ষণ – নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতার উত্তম ক্ষেত্র


বাংলাদেশ পৃথিবীতে বন্ধু খোঁজে। আর সেকারণেই আফ্রিকার বহু দেশে বাংলাদেশের বন্ধু তৈরি হয়েছে, যেখানে অনান্য অনেক দেশ নির্যাতকের তকমা নিয়ে আফ্রিকা ছাড়ছে। বন্ধু বন্ধুর বাড়িতে ঢোকে দরজা দিয়ে; কারণ বন্ধু বন্ধুর জন্যেই দরজা খুলে দেয়। চোর বা ডাকাত বাড়িতে ঢোকে সিঁদ কেটে। চোরের তাই দরকার হয় সিঁদ কাটা যন্ত্রপাতির। বাংলাদেশের সেধরণের যন্ত্রপাতির দরকার নেই। বরং বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়, এমন জিনিসই বাংলাদেশ সাথে নেবে। বন্ধুর কাছ থেকে বন্ধু কিছু পায়; চোরের কাছ থেকে নয়। বরং চোর মানুষের কাছ থেকে জিনিস কেড়ে নেয়। বাংলাদেশের বন্ধুরাও বাংলাদেশের কাছ থেকে কিছু পাবে; তাই তারাও বাংলাদেশের বন্ধু হতে চাইবে। বাংলাদেশ সামরিক দিক থেকে প্রশিক্ষণকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা সারা বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রফেশনালিজম বাকি দুনিয়ার মানুষ দেখেছে বিভিন্ন সময়ে। আর সেকারণেই পৃথিবীর বহু দেশের সামরিক অফিসাররা এখানে আসে প্রশিক্ষণের জন্যে। এই একই ইমেজটা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ধরে রেখেছে বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষী মিশনে। তবে এখন এই শান্তিরক্ষী মিশনের মাঝে আটকে না থেকে অভিজ্ঞতা এবং প্রফেশনালিজমকে পুঁজি করে বাকি বিশ্বের কাছে বন্ধুত্বের বাণী পৌঁছে দিতে হবে। আর এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ হবে উত্তম একটি সহযোগিতার ক্ষেত্র। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতার প্রভাবকে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে যে বিষয়গুলি বেশি গুরুত্ব পাবে, তার মাঝে থাকবে প্রশিক্ষণ।

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী নিজ দেশে অন্য দেশের সেনাদের প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় দেশের মাটিতে নিজেকে আটকে রাখাটা দূরদর্শিতার পরিচায়ক নয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা এখন শুধু ১৯৪৭-এ ব্রিটিশদের নির্ধারণ করে দেয়া ১ লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মাঝে নয়। যখন প্রায় কোটিখানেক বাংলাদেশী দুনিয়ার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে, তখন এদেশের সশস্ত্র বাহিনীর দেশে বসে বসে ভাববার সময় নেই। বাংলাদেশের হাজারো সৈন্য এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে; বিশেষ করে আফ্রিকায়। সুতরাং নিরাপত্তার সংজ্ঞা নিয়ে ভাববার সময় এখন এসেছে; নিরাপত্তা-সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা নিয়েও ভাববার সময় এসেছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের নিরাপত্তা দেবার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর থাকতে হবে। নাহলে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বুলি ফাঁপা ঠেকবে। ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরুর পর সেই দেশ থেকে বাংলাদেশীদের সরিয়ে আনার জন্যে ভারতের (যাকে কিনা শত্রু রাষ্ট্র জ্ঞান করে দেশের বেশিরভাগ জনগণ) দ্বারে ধর্ণা দিতে হয়েছে, যা কিনা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উন্নত করেনি, বরং আরেকটি রাষ্ট্রের কাছে ঋণগ্রস্ত করে কূটনৈতিকভাবে দেশকে দুর্বল করেছে। কাজেই বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এবং সামরিক সক্ষমতা গড়াটা রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা গড়ার সাথে সম্পর্কিত। আর এখানেই আবারও আসছে প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার কথা। বাংলাদেশের বন্ধুত্বের নীতির সাথে এর সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বন্ধুর সাথে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার বিনিময় – এটাই হতে পারে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মূলমন্ত্র।

বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বাইরে প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পদ্ধতি নিয়ে সক্ষমতা-বিষয়ক কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। যেমন বাংলাদেশের বাইরে এই প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা কি বাংলাদেশের আছে? উত্তরে বলতে হবে যে অবশ্যই আছে। তবে একইসাথে এটাও বলতে হবে যে এই সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। এই সক্ষমতাকে পরবর্তী উচ্চতায় নিতে কিছু সাংগঠনিক পরিবর্তন দরকার। যেমন, বাংলাদেশের বাইরে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে কিছু ইউনিট গঠন করে সেগুলিতে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পোস্টিং দেয়া যেতে পারে। এধরণের একটি ইউনিট সব বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। একটি ‘ওভারসীজ ট্রেনিং কমান্ড’এর অধীনে নিম্নোক্ত কিছু ইউনিট গঠন করা যেতে পারে –
  
সেনাবাহিনীর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট থাকা উচিত, যা কিনা একত্রে বাংলাদেশের বাইরে মোতায়েন করা যাবে। আর বেশ কিছুদিনের জন্যে মোতায়েনও থাকতে পারবে। এর মূল ইউনিটটি একটি ব্যাটালিয়ন হলেও এর সাথে বেশকিছু অনান্য ইউনিট থাকা উচিত, যা কিনা একে কমপক্ষে ব্রিগেড পর্যায়ের মর্যাদা দেবে। আর ইউনিটটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে এর মোবিলিটি। এর সকল কিছুই হবে হাইলি মোবাইল। তবে মোতায়েনের এলাকার উপর ভিত্তি করে এর কম্পোজিশন পরিবর্তিত করা যেতে পারে।

সেনা ইউনিটঃ

সেনাবাহিনীর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট থাকা উচিত, যা কিনা একত্রে বাংলাদেশের বাইরে মোতায়েন করা যাবে। আর বেশ কিছুদিনের জন্যে মোতায়েনও থাকতে পারবে। এর মূল ইউনিটটি একটি ব্যাটালিয়ন হলেও এর সাথে বেশকিছু অনান্য ইউনিট থাকা উচিত, যা কিনা একে কমপক্ষে ব্রিগেড পর্যায়ের মর্যাদা দেবে। আর ইউনিটটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে এর মোবিলিটি। এর সকল কিছুই হবে হাইলি মোবাইল। তবে মোতায়েনের এলাকার উপর ভিত্তি করে এর কম্পোজিশন পরিবর্তিত করা যেতে পারে। এখানে ইউনিটের সংখ্যা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই ইউনিটে থাকতে পারে -

১। একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন

২। মেকানাইজড ইউনিট (বিটিআর-৮০ এপিসি – ২০টি এবং অতোকার কোবরা এপিসি – ১২টি)

৩। আর্টিলারি ইউনিট (ডব্লিউএস-২২ রকেট লঞ্চার – ৪টি, নোরা বি-৫২ হাউইটজার – ৬টি এবং এসএলসি-২ রাডার – ১টি)

৪। এয়ার ডিফেন্স ইউনিট (একটি এফএম-৯০ ইউনিট)

৫। ট্রান্সপোর্ট ইউনিট (২০টি ট্রাক, ২০টি টেকনিক্যাল। সাথে এটিজিম থাকা উচিত।)

৬। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট (সাথে মাইন ক্লিয়ারেন্স এবং রিভার ক্রসিং ইকুইপমেন্ট থাকতে পারে)

৭। সিগনালস ইউনিট (স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সহ)

৮। মেডিক্যাল ইউনিট

৯। মেইনটেন্যান্স ইউনিট

১০। প্যারাকমান্ডোদের একটি ডিটাচমেন্ট

১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়ের ছবিতে ব্রিটিশ রয়েল নেভির কনটেইনার জাহাজ 'এটলান্টিক কনভেয়র'এর ডেকের উপরে বিমানের সারি দেখা যাচ্ছে। এরকম জাহাজ ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম অনেক দূরে পরিবহণ করা সম্ভব।

  নৌ ইউনিটঃ

এর প্রধান কাজ হবে সেনা এবং বিমান ইউনিটসমূহকে পরিবহণ করা এবং পরিবহণ করার ও বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানের সময় সমুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একইসাথে বন্ধুদেশের নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সাথে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া। এখানে সাতটি জাহাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই ইউনিট এর চাইতে ছোট বা বড় হতে পারে। যে জাহাজগুলি এখনও বাংলাদেশের নেই, সেগুলি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া হয়েছে কিছু উদাহরণের মাধ্যমে। এখানে এই নৌ ইউনিটটি বন্ধু দেশের বন্দরের উপরে নির্ভর করবে; অর্থাৎ বন্ধুর বাড়িতে ঢোকার পথ হলো বন্ধুই দরজা খুলবে। এখানে এমন কোন ইউনিট থাকবে না, যা কিনা বন্ধুর বাড়ির জানালার সিঁদ কেটে ঢোকার মতো মনে হয়।

এই ইউনিটে থাকতে পারে -

১। একটি ফ্রিগেট (সাথে একটি হেলিকপ্টার থাকলে সবচাইতে ভালো; না থাকলে অন্য কোন ইউনিটে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে হবে)

২। একটি এলপিসি (দুর্জয়-ক্লাস)

৩। একটি ওপিভি (কোস্ট গার্ডের সাদা রঙের একটি জাহাজ এখানে বেশি মূল্যবান হবে)

৪। একটি ট্রুপ শিপ (১,০০০ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটি জাহাজ, যা বাণিজ্যিকভাবে কিনে নিজেদের প্রয়োজনে পরিবর্তন করে নেয়া যেতে পারে। এতে অবশ্যই ১,০০০ মানুষের কমপক্ষে তিন সপ্তাহ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। হেলিপ্যাড এবং স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন অতি দরকারী ব্যাপার হবে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রাক্তন জাহাজ বিএনএস শহীদ সালাহউদ্দিন-এর নাম বলা যেতে পারে, যদিও এখন এর চাইতে আরও আপডেটেড জাহাজ দরকার হবে।)

৫। একটি কনটেইনার শিপ (১৬০ থেকে ১৮০ মিটারের মাঝে, যা কিনা চট্টগ্রাম বন্দরে ঢুকতে পারে এবং আফ্রিকার বেশিরভাগ বন্দরে ঢুকতে পারবে। এটিকে বিমান এবং অনান্য সরঞ্জামাদি পরিবহণে ব্যবহার করা হবে। বাণিজ্যিকভাবে কিনে এটাকে এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যাতে ডেকের উপরে বিমান বহণ করা যায়। মোটামুটি ১৪-১৫টা বিমান বহণ করার মতো সক্ষমতা থাকলে এটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। কিছু অংশ হেলিপ্যাডের জন্যে খোলা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হবে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ রয়াল নেভির ব্যবহৃত ২১২ মিটার লম্বা এবং ১৫,০০০ টনের ‘আটলান্টিক কনভেয়র’ এবং ‘আটলান্টিক কজওয়ে’, যেগুলির ডেকের উপরে করে ২৪ থেকে ২৮টি বিমান নেয়া হয়েছিল ফকল্যান্ডে।)

ব্রিটিশ রয়েল নেভির 'পয়েন্ট-ক্লাস'-এর রো-রো ফেরি, যা কিনা বেশ কয়েক'শ গাড়ি বহনে সক্ষম। এরকম জাহাজে একটি সামরিক ইউনিটের প্রায় সকল গাড়িই বহুদূর পর্যন্ত বহন করা সম্ভব।

 ৬। একটি রো-রো ফেরি (বাণিজ্যিকভাবে কিনে এটাকে নিজেদের প্রয়োজনে পরিবর্তন করে নেয়া যাবে। সামরিক গাড়ি এবং সরঞ্জাম এই ফেরি বহণ করবে। এটার আকারও ১৬০ থেকে ১৮০ মিটারের মতো হওয়া উচিত বন্দর সুবিধা নেবার জন্যে। উদাহরণস্বরূপ রয়াল নেভির ‘পয়েন্ট-ক্লাস’এর কথা বলা যেতে পারে। ১৯৩ মিটার এবং ২৩,০০০ টনের এই জাহাজগুলি ১৩০টি সাঁজোয়া যান এবং ৬০টি ট্রাক বহণ করতে পারে।)

৭। একটি সাপ্লাই জাহাজ (পথে জ্বালানি বা অন্য কোনকিছুর সরবরাহের ঘাটতি পূরণ করতে পারার মতো। তবে পুরো পথের সরবরাহ নিশ্চিতের দরকার নেই। বাংলাদেশের জাহাজ পৃথিবীর বেশিরভাগ বন্দরেই “ওয়েলকাম”)

৮। স্পেশাল ফোর্স সোয়াডস-এর একটি ডিটাচমেন্ট (সাথে হাই-স্পিড বোট থাকা উচিত।)


আফ্রিকার কঙ্গোতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সি-১৩০ পরিবহণ বিমান। বাংলাদেশের বাইরে প্রশিক্ষণ মিশনে বিমান থাকাটা অবশ্য দরকারি।


বিমান ইউনিটঃ

বিমান ইউনিটের মাঝে সব ধরনের বিমানই রাখা হয়েছে। প্রশিক্ষণ সকল ক্ষেত্রেই দরকার; তাই বিমানের ধরনের ক্ষেত্রেও তা-ই হওয়া উচিৎ। সংখ্যার দিক থেকে একটা ধারণা এখানে দেয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে এখানে যে সংখ্যা বলা হবে, তা কিন্তু পরিবহণও করতে হবে।

এই ইউনিটে থাকতে পারে -

১। একটি ফাইটার ইউনিট (এফ-৭বিজি – ৪টি এবং এফ-৭বিজিআই ৪টি)

২। একটি ট্রান্সপোর্ট ইউনিট (এলইটি-৪১০ – একটি। এটি নিজ শক্তিতে উড়ে গন্তব্যে যাবে, যদিও বাকিরা যাবে জাহাজে।)

৩। হেলিকপ্টার ইউনিট (এমআই-১৭১ – ৪টি এবং আগুস্টা এ-১০৯ – ২টি)

৪। ড্রোন ইউনিট (অবজারভেশন মিশনের জন্যে একটি ড্রোন ইউনিট অবশ্যই থাকা উচিত)

৫। রাডার ইউনিট (একটি এয়ার সার্চ রাডার গ্রাউন্ডে বসানোর জন্যে এই কমান্ডে থাকা উচিত)

৬। মেইনটেন্যান্স ইউনিট

৭। এয়ারবেইস ইউনিট (এরকম ইউনিট বাংলাদেশ আফ্রিকার একাধিক দেশে মোতায়েন করেছে। এরকমই আরেকটি ইউনিট এই কমান্ডে থাকতে পারে।)


কোস্ট গার্ডের সাদা রঙের একটি জাহাজ ওভারসীজ ট্রেনিং-এ খুবই মূল্যবান হবে। ‘ওভারসীজ ট্রেনিং কমান্ড’এর মাধ্যমে এরকম মিশনে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা এবং প্রফেশনালিজম যেমন আরও উন্নত হবে, তেমনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের বন্ধুর সংখ্যা বাড়বে। একইসাথে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির উন্নয়ন হবে এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাবও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। শক্তিশালী বাংলাদেশ শুধু কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না, বাস্তব জীবনে দেখাতে হবে। আর সেক্ষেত্রে সামরিক সক্ষমতা একটি অপরিহার্য প্রয়োজন।


উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি রাষ্ট্রের কথা বলা যেতে পারে, যাদের সাথে বন্ধুপ্রতীম প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান হতে পারে; যেমন – শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, ইত্যাদি। দূরত্ব হিসেবে এধরনের প্রশিক্ষণ মিশনের দৈর্ঘ্য নির্ধারিত হতে পারে। ‘ওভারসীজ ট্রেনিং কমান্ড’এর মাধ্যমে এরকম মিশনে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা এবং প্রফেশনালিজম যেমন আরও উন্নত হবে, তেমনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের বন্ধুর সংখ্যা বাড়বে। একইসাথে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির উন্নয়ন হবে এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাবও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। শক্তিশালী বাংলাদেশ শুধু কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না, বাস্তব জীবনে দেখাতে হবে। আর সেক্ষেত্রে সামরিক সক্ষমতা একটি অপরিহার্য প্রয়োজন।


Tuesday 25 April 2017

তুলা ও গমের মনোপলি বাংলাদেশ যেভাবে ভাঙতে পারে

পৃথিবীর মানুষকে কাপড় পড়তেই হবে। জন্তু-জানোয়ারের সাথে মানুষের একটি প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ চিন্তা করতে পারে এবং একারণে তার লজ্জাবোধ রয়েছে – সেখানেই কাপড়ের প্রয়োজন। কিন্তু এই কাপড়ের বাজারকে দুনিয়ার অল্প কিছু রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে দেয়াটা অনুচিত (যা অবশ্য অনেককাল ধরেই চলে আসছে)। ২০০৯-১০ সাল থেকেই তুলার বাজার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের খেলার ক্রীড়নক হওয়া থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ তুলার বিকল্প উৎস খুঁজতে থাকে। এর একটি পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ায়। মোট ৪ লক্ষ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেখানে তুলা চাষ হয়, যা এলাকার আকৃতির তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ! ৮ লক্ষ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি সারা দুনিয়ার তুলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে বোঝাই যায় যে মধ্য এশিয়ার ৫-৬ লক্ষ হেক্টর এলাকা তুলা চাষের অধীনে আনা গেলে তুলার বাজারের মনোপলি থাকবে না। কাপড় পড়ার অধিকার সকলেরই আছে; শুধু যাদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে, তাদের নয়।
২৫শে এপ্রিল ২০১৭



তুলার বাজারের নিয়ন্ত্রণ তিনজনের হাতে!

‘ইউএস ডিপার্টমেন্ত অব এগ্রিকালচার’ (ইউএসডিএ) তুলার বাজার নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০১৭-এর এপ্রিলের রিপোর্টে তারা দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচাইতে বড় তুলা আমদানিকারক রাষ্ট্র। সারা বিশ্বের সব রাষ্ট্র মিলে যে পরিমাণ তুলা ২০১৬-১৭তে আমদানি করেছে, তার মাঝে বাংলাদেশ আমদানি করেছে প্রায় ১৮% বা প্রায় প্রায় ১৪ লক্ষ টন। বাংলাদেশের পরে ভিয়েতনাম প্রায় ১২ লক্ষ টন, চীন ১০ লক্ষ টন, তুরস্ক ৭ লক্ষ টন, ইন্দোনেশিয়াও প্রায় ৭ লক্ষ টন, পাকিস্তান প্রায় ৬ লক্ষ টন এবং ভারত প্রায় ৫ লক্ষ টন তুলা আমদানি করে। ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আমদানিকারক রাষ্ট্র ছিল চীন। তবে তারা ক্রমান্বয়ে আমদানি কমিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশ সবচাইতে বড় আমদানিকারক হয়ে উঠেছে। সবচাইতে বেশি রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২৯ লক্ষ টন, ভারত প্রায় ১০ লক্ষ টন, অস্ট্রেলিয়া প্রায় ৯ লক্ষ টন, ব্রাজিল ৬ লক্ষ টন, উজবেকিস্তান প্রায় ৪ লক্ষ টন, বুরকিনা ফাসো প্রায় আড়াই লক্ষ টন এবং মালি দুই লক্ষ টনের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র একাই আন্তর্জাতিক বাজারের প্রায় ৩৭% তুলা সরবরাহ করে। অর্থাৎ পৃথিবীর তুলার বাজার যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তুলার বাজারে উত্থান পতনের কারণও যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রপ্তানির পরিমাণ দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা – প্রায় ২৯ লক্ষ টন (২০১৬-১৭), প্রায় ২০ লক্ষ টন (২০১৫-১৬), সাড়ে ২৪ লক্ষ টন (২০১৪-১৫), প্রায় ২৩ লক্ষ টন (২০১৩-১৪) এবং ২৮ লক্ষ টনেরও বেশি (২০১২-১৩)। ভারতের অবস্থান হচ্ছে সবচাইতে অবাক করা। ভারত একইসাথে রপ্তানি করে এবং আমদানি করে। ভারত ২০১৬-১৭ সালে প্রায় ৫ লক্ষ টন তুলা আমদানি করলেও রপ্তানি করেছে প্রায় ১০ লক্ষ টন! এর আগের বছর ভারতের রপ্তানি ছিল সাড়ে ১২ লক্ষ টন, আর রপ্তানি দুই লক্ষ টনের উপরে। ২০১৪-১৫ সালে রপ্তানি করেছে ৯ লক্ষ টনের বেশি; ২০১৩-১৪ সালে ২০ লক্ষ টন; ২০১২-১৩ সালে প্রায় ১৭ লক্ষ টন! এক বছরের সাথে আরেক বছরের কোন মিলই নেই! তুলা উৎপাদনে আবহাওয়া যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ঠিক। তবে তুলা যে দুনিয়ার বেশিরভাগ স্থানে যথেষ্ট পরিমাণে হয় না, এটাও ঠিক। এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া এই বাজারের কর্তৃত্ব নিয়ে খেলা খেলছে, এবং সেটা আবার রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার করছে।

পৃথিবীর মানুষকে কাপড় পড়তেই হবে। জন্তু-জানোয়ারের সাথে মানুষের একটি প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ চিন্তা করতে পারে এবং একারণে তার লজ্জাবোধ রয়েছে – সেখানেই কাপড়ের প্রয়োজন। কিন্তু এই কাপড়ের বাজারকে দুনিয়ার অল্প কিছু রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে দেয়াটা অনুচিত (যা অবশ্য অনেককাল ধরেই চলে আসছে)। ২০০৯-১০ সাল থেকেই তুলার বাজার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের খেলার ক্রীড়নক হওয়া থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ তুলার বিকল্প উৎস খুঁজতে থাকে। এর একটি পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানে। উজবেকিস্তান তাদের প্রায় ৮ লক্ষ টন উৎপাদনের অর্ধেকটা রপ্তানি করে। উজবেকিস্তানের পার্শ্ববর্তী তুর্কমেনিস্তানে তুলা উৎপাদন হয় প্রায় ৩ লক্ষ টন। তবে ঐ এলাকার বাদবাকি দেশগুলি তেমন একটা তুলা উৎপাদন করে না; যেমন বিশাল জমি থাকা সত্ত্বেও কাজাকস্তান উৎপাদন করে মাত্র ৬২ হাজার টন, তাজিকিস্তান ৮৫ হাজার টন এবং কিরগিজস্তান ৯ হাজার টন। মোট ৪ লক্ষ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেখানে তুলা চাষ হয়, যা এলাকার আকৃতির তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ! ৮ লক্ষ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি সারা দুনিয়ার তুলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে বোঝাই যায় যে মধ্য এশিয়ার ৫-৬ লক্ষ হেক্টর এলাকা তুলা চাষের অধীনে আনা গেলে তুলার বাজারের মনোপলি থাকবে না। কাপড় পড়ার অধিকার সকলেরই আছে; শুধু যাদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে, তাদের নয়।
    
বিশাল কাজাকস্তানের জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৮০ লক্ষ। আর তাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা প্রায় ৯০ লক্ষ। এর মাঝে ২৫ লক্ষেরও কম কৃষিতে নিযুক্ত। তাদের প্রধান ফসল গম। ১ কোটি ২৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে দেড় কোটি টন গম উৎপাদন করে প্রায় ৭৫ লক্ষ টন তারা রপ্তানি করেছে ২০১৬-১৭ সালে। আর বাংলাদেশ আমদানি করেছে মোট ৫৮ লক্ষ টন গম। মার্কিন-ভারতীয় খাদ্যশস্য-রাজনীতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাবের জানান দিয়েছে। বাংলাদেশের আহ্বানে অনেকেই এখন সাড়া দেবে। মধ্য এশিয়ার বিশাল চারণ-ভুমিতে গম এবং তুলার আবাদ ছাড়াও সেখানে পশুপালনের মাধ্যমে পৃথিবীর খাদ্য সমস্যা সমাধানের একটি পথ খোঁজা যেতে পারে। সেখানে কৃষিকাজে জনশক্তির যে অভাব রয়েছে, তা বাংলাদেশ পূরণ করতে সহায়তা করতে পারে।

গমের বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছয়জনের হাতে!


গম একটি খাদ্যশস্য এবং পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছেই গম প্রধান খাদ্যশস্য। অথচ পৃথিবীতে মাত্র ১১টি দেশ (ইইউ একত্রে ধরে) মোট ১৮ কোটি টন গমের বাণিজ্যের প্রায় ৯৪% নিয়ন্ত্রণ করে। আরও বিশেষভাবে বিবেচনা করলে মাত্র ৬টি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউক্রেন এবং আর্জেন্টিনা) সারা বিশ্বের মোট গমের বাণিজ্যের ৭০% নিয়ন্ত্রণ করে! । এখানে আর্জেন্টিনা অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে বড় রপ্তানিকারক হয়েছে। আর এই ছয় দেশের মাঝে রাশিয়া রয়েছে বলেই যুক্তরাষ্ট্রের মনোপলিকে ব্যালান্স করার কিছুটা চেষ্টা রয়েছে। সবচাইতে বড় গম আমদানিকারক রাষ্ট্র হলো মিশর (প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ টন)। এরপর রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (৯০ লক্ষ টন), আলজেরিয়া (৮২ লক্ষ টন), ব্রাজিল (৭৩ লক্ষ টন), বাংলাদেশ (৫৮ লক্ষ টন), জাপান (৫৮ লক্ষ টন), মরক্কো (৫৫ লক্ষ টন), ফিলিপাইন (৫৫ লক্ষ টন), ভিয়েতনাম (৫০ লক্ষ টন), মেক্সিকো (৪৯ লক্ষ টন), তুরস্ক (৪৮ লক্ষ টন), নাইজেরিয়া (৪৫ লক্ষ টন), দক্ষিণ কোরিয়া (৪৫ লক্ষ টন), চীন (৪০ লক্ষ টন) এবং ভারত (শুধু এক বছরের জন্যে ৫৫ লক্ষ টন)। বাংলাদেশ গত ৫-৬ বছরের মাঝে একটি প্রধান গম আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তবে প্রায় সবাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঐ ৬টি দেশের রাজনীতি দ্বারা। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হবার পর বাংলাদেশ যখন রাশিয়া থেকে গম কিনতে যাচ্ছিল, তখন একটি বিশেষ দেশের দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে রাশিয়ার বদলে ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করতে বাধ্য করতে চাইলো। অথচ মানব-সৃষ্ট কারণে এখন পৃথিবীর ৪টি দেশের ২ কোটিরও বেশি মানুষ খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষের শিকার! [১] এখন সেই রাজনীতি মানবতার পক্ষে অবস্থান নেয়নি, কারণ সেই রাজনীতি হচ্ছে মুনাফা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি; মানুষের কল্যাণের রাজনীতি নয়। এই অনিষ্টের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার একটি পথ রয়েছে – খাদ্যশস্য উৎপাদনকে ছড়িয়ে দিয়ে গুটিকয়েক মুনাফাখোরের হাত থেকে বের করে নিয়ে আসা। এই লক্ষ্যে গম চাষের জন্যে নতুন ভূমি খুঁজতে হবে।
  
মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ মানুষই মুসলিম। পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মুসলিমদের কাছে তাসখন্দ, বুখারা এবং সমরখন্দের নাম অতি পরিচিতই শুধু নয়, সেই শহরগুলি তাদেরকে টানে। উপমহাদেশে ইসলাম যাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদেরও অনেকেই এসেছিলেন মধ্য এশিয়া থেকেই। সেখানকার বিশাল ভূমি সারা বিশ্বের কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণের এবং লজ্জা ঢাকার সমাধান হতে পারে। সেই সমাধান খোঁজায় বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারে

মধ্য এশিয়ায় সমাধান...

কাজাকস্তানের রাষ্ট্রদূত (অনাবাসিক) কয়েকবার ঢাকায় আসেন এবং রাষ্ট্রপতি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলাদেশকে কাজাকস্তানে বিনিয়োগ এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির অনুরোধ করেন। বিশাল কাজাকস্তানের জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৮০ লক্ষ। আর তাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা প্রায় ৯০ লক্ষ। এর মাঝে ২৫ লক্ষেরও কম কৃষিতে নিযুক্ত। তাদের প্রধান ফসল গম। ১ কোটি ২৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে দেড় কোটি টন গম উৎপাদন করে প্রায় ৭৫ লক্ষ টন তারা রপ্তানি করেছে ২০১৬-১৭ সালে। উজবেকিস্তান ১৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৭২ লক্ষ টন গম উৎপাদন করলেও চাহিদা বেশি থাকায় ২৭ লক্ষ টন আমদানি করতে হয়েছে তাদের। কাজাকস্তানে জনশক্তি রপ্তানির অফারের মাঝেই লুকিয়ে আছে খাদ্যশস্য-ভিত্তিক এই ব্যাপক শোষণ থেকে মুক্তির পথ। আন্তর্জাতিক বাজারে জুয়ার মতো গম বিক্রি না করে সরাসরি ক্রয়ের মাঝে গেলে মূল্য নিয়ে মনোপলি খেলা কমতে পারে। এর জন্যে প্রয়োজন শক্ত আন্তর্জাতিক কৃষি-জোট। বিশ্বের প্রধান কৃষি-ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলির একটি হওয়ায় বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারে। মার্কিন-ভারতীয় খাদ্যশস্য-রাজনীতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাবের জানান দিয়েছে। বাংলাদেশের আহ্বানে অনেকেই এখন সাড়া দেবে। মধ্য এশিয়ার বিশাল চারণ-ভুমিতে গম এবং তুলার আবাদ ছাড়াও সেখানে পশুপালনের মাধ্যমে পৃথিবীর খাদ্য সমস্যা সমাধানের একটি পথ খোঁজা যেতে পারে। সেখানে কৃষিকাজে জনশক্তির যে অভাব রয়েছে, তা বাংলাদেশ পূরণ করতে সহায়তা করতে পারে। এ লক্ষ্যে কিছু বাস্তসম্মত কার্যকলাপকে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে –

১। মধ্য এশিয়ার কাজাকস্তান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের সাথে আলোচনা করে কৃষিতে ব্যাপক-ভিত্তিক বিনিয়োগের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছানো। জমির দীর্ঘমেয়াদি লীজ এক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে।

২। বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং ফুড-প্রসেসিং শিল্পে বিনিয়োগ করা কোম্পানিগুলিকে মধ্য এশিয়ায় কৃষিতে বিনিয়োগ করতে অনুপ্রেরণা যোগানো। এই বিনিয়োগ জমিতে, কৃষি যন্ত্রপাতিতে, সেচে, বীজ-সার-কীটনাশকে, শস্য প্রসেসিং-এ, শস্য স্টোরেজে, পরিবহণে এবং ডিস্ট্রিবিউশনে হতে পারে।

৩। বাংলাদেশ থেকে কৃষিতে অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন জনশক্তি মধ্য এশিয়ায় রপ্তানির ব্যবস্থা করা।

মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ মানুষই মুসলিম। পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মুসলিমদের কাছে তাসখন্দ, বুখারা এবং সমরখন্দের নাম অতি পরিচিতই শুধু নয়, সেই শহরগুলি তাদেরকে টানে। উপমহাদেশে ইসলাম যাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদেরও অনেকেই এসেছিলেন মধ্য এশিয়া থেকেই। সেখানকার বিশাল ভূমি সারা বিশ্বের কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণের এবং লজ্জা ঢাকার সমাধান হতে পারে। সেই সমাধান খোঁজায় বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারে।



[১] ‘অস্তিত্ব-সংকটে জাতিসংঘ’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৬ই মার্চ ২০১৭

Sunday 23 April 2017

ব্যর্থ সফর এবং নিম্নমানের কূটনীতি

২৪শে এপ্রিল ২০১৭

ভারত যেসব দেশের সাথে সামরিক সমঝোতা করতে পারে, যেমন নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভুটান – এরাও যখন ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করছে, তখন বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভারতের পক্ষ থেকে আসা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় সামরিক সমঝোতার প্রস্তাব এড়িয়ে যেতে না পারাটা রাজনৈতিক দুর্বলতার লক্ষণ। অন্তত তিস্তা চুক্তি না হবার কারণেও বাংলাদেশের পক্ষে সহজেই ভারতের উপরে চাপ সৃষ্টি করে সামরিক সমঝোতা এড়ানো যেত।


একটি সম্পূর্ণ অদরকারি সমঝোতা......

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের অতি আকাংক্ষিত পানির সমস্যা সমাধান না করেই দেশে ফেরত আসলেন। কাজেই এই সফরকে আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ সফর বলা ছাড়া গতি থাকে না। ভারত তাঁকে ডেকে নিয়ে গেছে এমন সময়, যখন তিস্তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশের মানুষ শুধু পানির ব্যাপারেই একটি মিমাংসা চাইছিল। মূল আলোচ্য বিষয় পানিকে পাশে ঠেলে দিয়ে যখন নিরাপত্তা এবং সামরিক বিষয়ে একটি চুক্তির প্রস্তাব করা হলো, তখন সেই সফরের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। ভারত খুব ভালো করেই জানে যে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের সাথে যে কোন ধরণের সামরিক সমঝোতার বিরুদ্ধতা করবে; কারণ একে তো মুসলিম বিশ্বাসের বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতের বিজেপি সরকারের মাঝে হিন্দুত্ববাদিতা দেখে, তার উপরে ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক কারণেও ভারতকে একমাত্র শত্রুদেশ হিসেবে চিন্তা করে। এমন একটি রাষ্ট্রের সাথে সামরিক সমঝোতা বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে ছোট করা হবে জেনেই ভারত এই সমঝোতায় বাংলাদেশকে চাপ দেয়।

তবে শুধু ভারতকে দোষারোপ করলেই তো হবে না। বাংলাদেশের তরফ থেকেই বা এই সমঝোতায় সই করা হলো কেন? বাংলাদেশ যখন সাবমেরিন ক্রয় করেছিল, তখন দিল্লীর নীতিনির্ধারকদের ঘর্মাক্ত শরীর জানান দিয়েছিল এমন এক বাংলাদেশের আবির্ভাবের, যা কিনা কারও দাসত্ব স্বীকার করবে না। কিন্তু এর পরবর্তীতে কি এমন ঘটে গেল যে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চীন থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়কে ব্যালান্স করতে গিয়ে আবার ভারতের সাথেই সামরিক সমঝোতায় বসতে হবে? চীন থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়কে যদি ব্যালান্স করতেই হয়, তাহলে ভারতকে দিয়ে সেই ব্যালান্স নয়, করতে হবে অন্য কাউকে দিয়ে; যাতে ভারতও ব্যালান্সে থাকে। ভারত যেসব দেশের সাথে সামরিক সমঝোতা করতে পারে, যেমন নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভুটান – এরাও যখন ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করছে, তখন বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভারতের পক্ষ থেকে আসা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় সামরিক সমঝোতার প্রস্তাব এড়িয়ে যেতে না পারাটা রাজনৈতিক দুর্বলতার লক্ষণ। অন্তত তিস্তা চুক্তি না হবার কারণেও বাংলাদেশের পক্ষে সহজেই ভারতের উপরে চাপ সৃষ্টি করে সামরিক সমঝোতা এড়ানো যেত।


বঙ্গবন্ধু যে মুহুর্তে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে করমর্দন করলেন এবং অনান্য মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিলেন, তখন ভারতের পায়ের তলা থেকে মাটি সড়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক কূটনীতির এরূপ উদাহরণ থাকতে বাংলাদেশের চীনকে ব্যালান্স করার জন্যে ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করাটা অত্যন্ত নিম্নমানের কূটনীতির পর্যায়ে পড়ে।

ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে ইমব্যালান্স করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও পাকিস্তানের কাছ থেকে যুদ্ধাপরাধের জন্যে একটি ক্ষমা প্রার্থনাও আসেনি; বরং সম্পর্ক আগের মতোই ঠান্ডা রয়ে গেছে। এই বিরোধ মিটমাট করাটাই কি সবচাইতে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল না, যা করতে পারলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ব্যালান্সটাই পরিবর্তিত হয়ে যেত। এরকম সমস্যা মিটমাট না করাটি কি ভারতের স্বার্থকেই সমুন্নত করেনি? ভারত কি নিশ্চিন্ত থাকছে না, যে বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের সাথে সে আলাদাভাবে সামরিক সংঘাতে যেতে পারবে, কারণ একজনকে আক্রমণ করলে অন্যজন ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে? বাংলাদেশের ইতিহাসেই ভারত-পাকিস্তানকে ব্যালান্স করার চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে মুহুর্তে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে করমর্দন করলেন এবং অনান্য মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিলেন, তখন ভারতের পায়ের তলা থেকে মাটি সড়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক কূটনীতির এরূপ উদাহরণ থাকতে বাংলাদেশের চীনকে ব্যালান্স করার জন্যে ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করাটা অত্যন্ত নিম্নমানের কূটনীতির পর্যায়ে পড়ে।



   
হিন্দুত্ববাদী ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কি মুচলেকা নেবে, যে ভারত তার মার্কিন-নির্মিত এপাচি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না? কোন গ্যারান্টিতে বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে যে ভারত তার পি-৮ বিমানকে বাংলাদেশের সদ্য ক্রয় করা সাবমেরিনকে খুঁজে বের করতে ব্যবহার করবে না? ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করে বাংলাদেশ কি জানান দিলো না, যে ভারতের সাথে চীন বা পাকিস্তানের সংঘর্ষে বাংলাদেশ ভারতের সাথেই থাকবে? আর এরকম সমঝোতার ফলাফল যদি হয় যে বাংলাদেশ তেমন কোন সংঘাতে ভারতের পাশেই থাকবে, তাহলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি ভারতের দ্বারা ঠিক করা হলো না? বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তখন কোথায় গেলো?

ভারত একটি শত্রু রাষ্ট্র

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী থাকার একমাত্র কারণ ভারত। বাংলাদেশের নেতৃবর্গকেও ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতীয় সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হবার স্থান শুধু পাকিস্তান বা চীনের সীমানা নয়; এখানে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুত্ববাদী ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কি মুচলেকা নেবে, যে ভারত তার মার্কিন-নির্মিত এপাচি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না? কোন গ্যারান্টিতে বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে যে ভারত তার পি-৮ বিমানকে বাংলাদেশের সদ্য ক্রয় করা সাবমেরিনকে খুঁজে বের করতে ব্যবহার করবে না? তাহলে বাংলাদেশই বা কেন ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করবে, যখন এটি একটি জানা ব্যাপার যে অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের সাথে এবং কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সংঘর্ষ বাধার সম্ভাবনা সর্বদাই রয়েছে? ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করে বাংলাদেশ কি জানান দিলো না, যে এধরণের যেকোন আন্তর্জাতিক সংঘর্ষে বাংলাদেশ ভারতের সাথেই থাকবে? আর এরকম সমঝোতার ফলাফল যদি হয় যে বাংলাদেশ তেমন কোন সংঘাতে ভারতের পাশেই থাকবে, তাহলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি ভারতের দ্বারা ঠিক করা হলো না? বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তখন কোথায় গেলো?

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এর কার্যকলাপ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই যখন কথা বলেছেন, তখন কাউকে বলে দিতে হয় না যে ভারত বাংলাদেশের জন্যে একটি নিরাপত্তা সমস্যা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি করা একটি দেশের সাথে কোন ধরনের নিরাপত্তা সমঝোতা সম্ভব হতে পারে, সেটার বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা দেয়া কষ্টকর। সেই সমস্যা সৃষ্টিকারী দেশকেই আবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা দিতে হবে – সেটাই বা কোন ধরনের হীন চিন্তার ফসল? প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন যে, ‘আক্রান্ত হলে সমুচিত জবাব দেবার সক্ষমতা আমাদের আছে’, তখন তো তিনি নিশ্চয়ই ভারতকে বাদ দিয়ে বলেননি! তাহলে যার থেকে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে (সবচাইতে বেশিই রয়েছে), তার সাথেই আবার নিরাপত্তা সমঝোতায় যাওয়াটা কোন যুক্তিতে যুক্তিযুক্ত? যাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচা যায় – এই যুক্তিতে? এটা কি মাথা নোয়াবার পর্যায়ে পড়ে যায় না? মুসলিম হিসেবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথা নত করাটা এদেশের মানুষের বাস্তবতা হতে পারে না।
ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তির তোষণের মাঝেই ভারত তার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। কোন বুদ্ধিতে পানি চুক্তি না করে বরং একটি সম্পূর্ণ অদরকারি সামরিক সমঝোতায় স্বাক্ষর করার জন্যে বাংলাদেশের উপরে চাপ দিয়ে তারা যেভাবে পুরো বাংলাদেশকে নিজেদের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করলেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিত্বের প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ ছিল ভারতের এই কর্মকান্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ব্যর্থতার দায়ভার অনেকাংশেই ভারতের।

নিম্নমানের কূটনীতি এবং রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্ব

পৃথিবীর সবচাইতে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব আনতে ভারতের নেতৃবর্গের লজ্জাবোধ হওয়া উচিত ছিল। জাতিসংঘের মিশনে ভারতের সৈন্য প্রেরণের পরে জাতিসংঘ বাজে মানের অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে ভারতকে জরিমানা করে! আর সেই ভারত কোনরূপ লজ্জাবোধ তো দূরে থাকুক, বরং ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তির তোষণের মাঝেই তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। [১] কোন বুদ্ধিতে পানি চুক্তি না করে বরং একটি সম্পূর্ণ অদরকারি সামরিক সমঝোতায় স্বাক্ষর করার জন্যে বাংলাদেশের উপরে চাপ দিয়ে তারা যেভাবে পুরো বাংলাদেশকে নিজেদের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করলেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিত্বের প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ ছিল ভারতের এই কর্মকান্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ব্যর্থতার দায়ভার অনেকাংশেই ভারতের।

বাংলাদেশ শক্তিশালী হবেই। কিন্তু তাই বলে চীনকে ব্যালান্স করার নামে ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করার মতো নিম্নমানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা? এধরণের সমঝোতা শক্তিশালী বাংলাদেশের পরিপন্থী, তাই এর বাস্তবায়নও বর্জনীয়। বিশেষ করে যে সমঝোতা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে এবং বিভাজনের রাজনীতিকে উস্কে দেয়, তা কোনদিনও জনকল্যানকর হতে পারে না। এই রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে যাদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা দিতে তাদের সাথেই নিরাপত্তা চুক্তি করাটা রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্বের লক্ষণ। 



[১] 'যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বাড়ছে', সাম্প্রতিক দেশকাল, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬
'অতঃপর যুক্তরাষ্ট্রের ভারত জয়?', সাম্প্রতিক দেশকাল, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

Wednesday 12 April 2017

বাংলাদেশ- জাপান সম্পর্ক কোনদিকে যাবে?

১৩ই এপ্রিল ২০১৭

জাপানের কোস্ট গার্ড খুবই সমৃদ্ধ। ১২ হাজার সদস্যের এই বাহিনী আকারে আরেকটি নৌবাহিনীর মতো। পূর্ব চীন সাগরে চীনের সাথে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় কোস্ট গার্ডের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে আরও বেশি। কোস্ট গার্ড সেদেশের নেতৃত্বকে আরও একটি অপশন দেয়। যেখানে নৌবাহিনী পাঠানোটা কূটনৈতিক দিক থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে কোস্ট গার্ডের জাহাজ পাঠানোকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে হতে পারে। সাদা রঙের জাহাজের বিরুদ্ধে সাদাই মোতায়েন করতে হবে – এরমকম একটা অলিখিত নিয়মই যেন সবাই মেনে চলছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, নিজের শক্তিকে উপরে তুলে ধরতে কোস্ট গার্ডের জাহাজগুলি ক্রমেই বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে।



জাপানের নৌশক্তির নানাবিধ ব্যবহার

জাপানের নৌবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আগ্রাসী কোন কর্মকান্ড থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার পরেও পৃথিবীর সবচাইতে বড় নৌবাহিনীগুলির একটি। এর সদস্যসংখ্যা প্রায় ৫১ হাজার; রয়েছে ১৫০টির মতো জাহাজ এবং ৩৫০টির মতো বিমান। জাপানের কোস্ট গার্ডও খুবই সমৃদ্ধ। ১২ হাজার সদস্যের এই বাহিনী আকারে আরেকটি নৌবাহিনীর মতো। পূর্ব চীন সাগরে চীনের সাথে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় কোস্ট গার্ডের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে আরও বেশি। কোস্ট গার্ড সেদেশের নেতৃত্বকে আরও একটি অপশন দেয়। যেখানে নৌবাহিনী পাঠানোটা কূটনৈতিক দিক থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে কোস্ট গার্ডের জাহাজ পাঠানোকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে হতে পারে। সাদা রঙের জাহাজের বিরুদ্ধে সাদাই মোতায়েন করতে হবে – এরমকম একটা অলিখিত নিয়মই যেন সবাই মেনে চলছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, নিজের শক্তিকে উপরে তুলে ধরতে কোস্ট গার্ডের জাহাজগুলি ক্রমেই বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। জাপানের কোস্ট গার্ডের সবচাইতে বড় জাহাজ হলো শিকিশিমা-ক্লাসের দু’টি জাহাজ, যেগুলি একেকটি ৯,৩০০ টনের এবং ১৫০ মিটার পর্যন্ত লম্বা। এগুলির গতি ২৫ নটিক্যাল মাইল এবং রেঞ্জ ২০ হাজার নটিক্যাল মাইল। অস্ত্র হিসেবে আপাতত ৩৫মিঃমিঃ-এর দু’টি কামান এবং ২০মিঃমিঃ দু’টি কামান খুব বেশি কিছু নয়। তবে এটা বলাই যায় যে দরকারের সময়ে এই জাহাজে আরও অস্ত্র বহণ করা হবে, কারণ জাহাজগুলি বড় আকারের ডেস্ট্রয়ারের আকৃতির! দুই-দুইটি সুপার পুমা হেলিকপ্টার বহণ করে এই জাহাজগুলি। এই জাহাজ ছাড়াও জাপানের কোস্ট গার্ডে আরও অনেক জাহাজ রয়েছে। নৌবাহিনী থেকে ডিকমিশন করে হাটসুয়ুকি-ক্লাসের (৪,০০০ টন) চারটি ডেস্ট্রয়ার আনা হয়েছে কোস্ট গার্ডে। ঠিক যেমনটি করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। ইতালির নৌবাহিনী থেকে ডিকমিশন করে ৪টা মিনার্ভা-ক্লাসের কর্ভেট যেমন মিসাইল সরিয়ে ওপিভি-তে রূপান্তর করা হয়েছে বাংলাদেশের জন্যে। ১,০০০ টন থেকে ৩,৫০০ টনের বেশকিছু জাহাজ রয়েছে তাদের। ১৩০ টন থেকে ৫০০ টনের প্যাট্রোল ভেসেলও রয়েছে অনেকগুলি। এছাড়াও রয়েছে ১৫ মিটার থেকে ৩৫ মিটারের অনেক প্যাট্রোল বোট। ট্রেনিং, ফায়ার-ফাইটিং, সার্ভে, লাইট-হাউস টেন্ডার, ইত্যাদি জাহাজও রয়েছে বেশকিছু। মোটকথা এ আরেক নৌবাহিনী।
গত নভেম্বরে মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নজিব রাজাকের টোকিও ভ্রমণের সময় শিনজো আবে মালয়েশিয়াকে জাপানের কোস্ট গার্ড থেকে দু’টি প্যাট্রোল বোট দেবার ঘোষণা দেন। ‘ওযিকা-ক্লাস’এর একটি জাহাজ গত জানুয়ারীতে মালয়েশিয়াতে এসে পৌঁছেছে। গত অক্টোবরে মালয়েশিয়া প্রথমবারের মতো চীন থেকে ৪টি যুদ্ধজাহাজ কেনার ঘোষণা দেয়, যেখানে মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রায় সকল জিনিসই পশ্চিমা ডিজাইনের। এই ঘটনাতেও নজিব রাজাকের চীনের দিকে ঝোঁকার আভাস পাওয়া গেলেও তিনিও কিন্তু জাপান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেননি; ব্যালান্স করে চলেছেন। মোটকথা, চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা। চীনকে সকলেই বন্ধু হিসেবে পাশে চাইছে; বৈরিতা চাইছে না। আবার একইসাথে কোন একটি রাষ্ট্রের কোলের উপরেও কেউ বসে পড়তে চাইছেন না, যা কিনা রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির লক্ষণ। এক্ষেত্রে জাপানের নৌসক্ষমতা একটি বড় ভূমিকা রাখছে।



জাপানের সামরিক বাণিজ্যের শুরু

২০১৬-এর অগাস্টে ফিলিপাইনের জন্যে জাপানে তৈরি করা প্রথম কোস্ট গার্ড জাহাজটি ফিলিপাইনে এসে পৌঁছায়। ৪৪ মিটার লম্বা মোট ১০টি জাহাজ জাপান বিক্রি করছে ফিলিপাইনের কাছে। এর জন্যে সহজ শর্তে ১৫৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে জাপান। এর উপরে গত সেপ্টেম্বরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সাথে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তের সাক্ষাতে জাপান ফিলিপাইনকে ৯০ মিটার লম্বা দু’টি বড় জাহাজ দেবার অঙ্গীকার করে। দুতার্তে সাম্প্রতিক সময়ে বেইজিং-এর দিকে ঝুঁকলেও জাপানের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ রেখে চলেছেন। গত নভেম্বরে মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নজিব রাজাকের টোকিও ভ্রমণের সময় শিনজো আবে মালয়েশিয়াকে জাপানের কোস্ট গার্ড থেকে দু’টি প্যাট্রোল বোট দেবার ঘোষণা দেন। ‘ওযিকা-ক্লাস’এর একটি জাহাজ গত জানুয়ারীতে মালয়েশিয়াতে এসে পৌঁছেছে। গত অক্টোবরে মালয়েশিয়া প্রথমবারের মতো চীন থেকে ৪টি যুদ্ধজাহাজ কেনার ঘোষণা দেয়, যেখানে মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রায় সকল জিনিসই পশ্চিমা ডিজাইনের। এই ঘটনাতেও নজিব রাজাকের চীনের দিকে ঝোঁকার আভাস পাওয়া গেলেও তিনিও কিন্তু জাপান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেননি; ব্যালান্স করে চলেছেন। মোটকথা, চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা। চীনকে সকলেই বন্ধু হিসেবে পাশে চাইছে; বৈরিতা চাইছে না। আবার একইসাথে কোন একটি রাষ্ট্রের কোলের উপরেও কেউ বসে পড়তে চাইছেন না, যা কিনা রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির লক্ষণ। এক্ষেত্রে জাপানের নৌসক্ষমতা একটি বড় ভূমিকা রাখছে।

জাপানের রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিবর্তন


কিছুদিন আগ পর্যন্ত জাপানকে সবাই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবেই দেখতো; রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়। রাজনীতির কথা বলতে গেলেই সামরিক শক্তির বিষয়টি এসে যায়। শিনজো আবের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে জাপানের প্রভাবশালী মহল চাইছেন সামরিক দিক থেকে জাপানের যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভরশীলতা কমাতে। উত্তর কোরিয়ার ছুতো ধরে যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ান উপদ্বীপ এবং জাপানে তার সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখছে এবং তা দিয়ে চীনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এভাবে চীন-জাপান ব্যালান্সে থাকছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে। তবে ভারত মহাসাগরে জাপানি ম্যারিটাইম রুটগুলির নিরাপত্তায় জাপানি যুদ্ধজাহাজ নিয়মিতই যাতায়াত করছে; সেখানে ব্যালান্স করছে চীনকে। সোমালিয়ার উপকূলের কাছাকাছি জাপানের যুদ্ধজাহাজ জলদস্যুতা-বিরোধী টহল দিচ্ছে কয়েক বছর ধরে। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাব-এল-মান্ডেব প্রণালীতে অবস্থিত জিবুতিতে জাপান ছোটখাটো একটি সামরিক ঘাঁটিও তৈরি করেছে, যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রথম। দু’টি পি-৩ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান ভারত মহাসাগরে টহল দেয় সেখান থেকে। জাপানের সামরিক শক্তি অনেক সাগরেই দেখা যাচ্ছে, কারণ জাপান তার প্যাসিফিস্ট সংবিধান থেকে বের হবার বার্তা দিয়েছে। জাপান তার অর্থনৈতিক কার্ডের সাথে সামরিক কার্ডটিও খেলতে চাইছে ধীরে ধীরে। চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে শুধু অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে যে লাভ নেই, সেটা জাপানের ওয়াকিবহাল মহল বুঝতে পারছেন। মালয়েশিয়া-ফিলিপাইনকে সামরিক সহায়তা প্রদান এই নীতিরই অংশ।
ভারত মহাসাগর পাহাড়া দিতে ভারতের কাছে জাপান ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারে ১২টি ‘ইউএস-২’ উভচর ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান বিক্রি করছে। জাপান বুঝতে পারছে যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভূরাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হবে। তাই নিজেদের সামরিক সক্ষমতা তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে জাপান। এরই অংশ হিসেবে সামরিক বাণিজ্যের অবতারণা।


সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক শক্তিকে ব্যালান্স করাটা জাপানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে কাজ করেছে; কারণ এই সমুদ্রপথেই জাপানের বেশিরভাগ বাণিজ্য হয়ে থাকে। ২০১৫ সালে ভিয়েতনামকে দু’টি প্যাট্রোল বোট দেবার পরে এবছরের জানুয়ারী মাসে জাপান ৩৩৮ মিলিয়ন ডলারের সহজ শর্তের ঋণে আরও ৬টি প্যাট্রোল বোট সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গত বছর জাপান শ্রীলংকাকেও ১৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে দু’টি ৩০ মিটার লম্বা প্যাট্রোল বোট কেনার জন্যে। শুধু প্যাট্রোল বোট নয়, জাপান তার এয়ার ইন্ডেপেন্ডেন্ট প্রোপালশন (এআইপি) প্রযুক্তির সাবমেরিন অস্ট্রেলিয়ার কাছে অফার করেছিল (যদিও অস্ট্রেলিয়া ফ্রেঞ্চ সাবমেরিনের দিকে গিয়েছে)। ভারত মহাসাগর পাহাড়া দিতে ভারতের কাছে জাপান ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারে ১২টি ‘ইউএস-২’ উভচর ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান বিক্রি করছে।

বাংলাদেশে জাপান

জাপান বাংলাদেশের স্বীকৃত উন্নয়ন সহযোগী। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জাপানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মার্কিনীদের “বাস্কেট কেইস”-তকমা মুছে ফেলে বাংলাদেশ যখন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই হোলি আর্টিসানের ঘটনাটি ঘটলো – জাপানিদের টার্গেট করে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশ থেকে জাপানকে সরানো। কিছুদিনের জন্যে তারা সেক্ষেত্রে সফলও হয়েছিল, যখন জাপানি অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রজেক্ট থেমে গিয়েছিল। তবে জাপানিরা এই ষড়যন্ত্রের মর্ম বুঝতে পেরেছে বলেই তারা বাংলাদেশের সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাপানের জানার কথা যে ভারত মহাসাগরে জাপানি স্বার্থকে রক্ষা করতে একটি শক্তিশালী বাংলাদেশের বিকল্প নেই। একটি দুর্বল বাংলাদেশই কেবল নড়বড়ে হয়ে সকলকে বিচলিত করতে পারে। একুশ শতকে এসে বাংলাদেশ তার উন্নয়নের পথে জাপানকে সাথে চাইবে। জাপানের রাজনৈতিক নীতির পরিবর্তন এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে সহযোগিতার আরেকটি দুয়ার উন্মোচন করবে। এশিয়ার অনান্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশও জাপানের নৌশক্তি তৈরির অভিজ্ঞতা থেকে সুবিধা নিতে পারে। জাপান তার বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এশিয়ার দেশগুলির ম্যারিটাইম সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দিচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড জাপান থেকে ২৪টি ছোট বোট সংগ্রহের পথে রয়েছে। তবে এই সহযোগিতা আরও এগিয়ে নেয়া যায়। এয়ার-ডিফেন্স রাডার, মিসাইল-সহ জাপানের বেশকিছু সামরিক প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীল, যেগুলি হয়তো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তবে কোস্ট গার্ডের জন্যে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাটফর্ম জাপান সরবরাহ করলে সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির উপরে নির্ভরশীল হবার সম্ভাবনা অনেকটাই কম।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে জাকার্তায় আইওআরএ শীর্ষ বৈঠক, ঢাকায় ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের কনফারেন্স, কসোভোকে স্বীকৃতি, চীনা প্রেসিডেন্ট এবং জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, ইত্যাদি কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে যে বঙ্গোপসাগরে একটি নতুন শক্তির আবির্ভাব হতে চলেছে। আর দেশের অভ্যন্তরে সকল ধরনের Subversion নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলাদেশ জানান দিয়েছে যে এই রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে নতি স্বীকার করবে না। আর একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র বিশ্বে অনেক বন্ধু পাবে; সেটাই স্বাভাবিক। শক্তিশালীদের জন্যে অনেক বন্ধু থাকে; দুর্বলের জন্যে থাকে প্রভু। বাংলাদেশ এখন নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে দুনিয়ার যেকারুর সাথেই বন্ধুত্ব করতে সক্ষম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের মাধ্যমে এটাই পরিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগী চীনও এই বার্তাটাই পাবে। সাথেসাথে জাপানের কাছেও বার্তা যাবে যে বাংলাদেশের দুয়ার যে কারুর জন্যেই উন্মুক্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকে।

Friday 7 April 2017

বাংলাদেশের পূর্ব ইউরোপে প্রবেশ!

০৮ এপ্রিল ২০১৭
বাংলাদেশ কেন প্রায় ৯ বছর পর তার নীতিতে পরিবর্তন আনলো, যখন কসোভো অন্য দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী হস্তক্ষপের একটি উদাহরণ? যখন বাংলাদেশ জানে যে রাশিয়া, চীন এবং ভারত এই দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি, তখন কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ কি এই দেশগুলির সাথে সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলেনি?

২০১৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পূর্ব ইউরোপের রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশ করে। এই স্বীকৃতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে কসোভোর সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে দেখতে হবে।

কসোভোর স্বীকৃতির ইতিহাস
কসোভো স্বাধীনতা ঘোষণা করে ২০০৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী। পরের দিন ১৮ই ফেব্রুয়ারী যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, তুরস্ক, আলবেনিয়া-সহ ৮টি দেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সালের মাঝে মোট ৫৩টি দেশ স্বীকৃতি দেয়, যার মাঝে ৩১টি ইউরোপিয়ান দেশ ছাড়াও ছিল যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা ও তুরস্ক। এর বাইরে সকল দেশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারগুলির মাঝে থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের মাঝ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পূর্ব এশিয়া থেকে মালয়েশিয়া স্বীকৃতি দেয়। ২০০৯ সালে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয় আরও ১১টি দেশ, যার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে ছিল সৌদি আরব, বাহরাইন এবং জর্দান। ২০১০ সালে আরও ৮টি দেশ স্বীকৃতি দিলেও এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কোন দেশ ছিল না। ২০১১ সালে স্বীকৃতি দেয়া ১২টি দেশের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাতার, ওমান এবং কুয়েত। ততদিনে কসোভোর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রায় তিনটি বছর পেরিয়ে গেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই দেশগুলি এতো সময় নিয়ে স্বীকৃতি দিলেও এরা সকলেই কিন্তু মার্কিন সরকারের প্রভাব বলয়ে থাকা দেশ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রই চেয়েছিল যে স্বীকৃতিগুলি আস্তে আস্তে আসুক। তবে যতোই দিন যাচ্ছিল, মার্কিন প্রভাব বলয়ের একেবারে বাইরের দিকে থাকা দেশগুলি এগুচ্ছিল স্বীকৃতি নিয়ে। তারা এগুচ্ছিল কূটনৈতিক সুযোগের সদ্যবহার করার জন্যে। এর কেউ কেউ শুধু মার্কিন না, অন্য দেশ দ্বারাও প্রভাবিত ছিল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষে আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান। সেবছরে মোট ১১টি দেশ স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দেয়া মোট দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫। ২০১৩ সালে স্বীকৃতি দেয়া ৮টি দেশের মাঝে ছিল মিশর ও থাইল্যান্ড। ২০১৪ সালে স্বীকৃতি দেয়া ৪টি দেশের মাঝে একটিও গুরুত্বপূর্ণ দেশ ছিল না। ২০১৫ সালে একটি মাত্র দেশ এবং ২০১৬ সালে মাত্র দুইটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে, যার মাঝে সিঙ্গাপুর কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুর ছিল জাতিসংঘের ১১০তম সদস্য দেশ; বাংলাদেশ ১১১তম। এর বাইরে চারটি দেশ এমন কিছু নেতৃত্বের কাছ থেকে আসে, যাদের নিজেদের স্বীকৃতি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে, যেমন তাইওয়ান। এগুলি যোগ করলে বাংলাদেশ ১১৫তম দেশ হিসেবে কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ সময় নিয়েছে প্রায় ৯ বছর!


 
ফেব্রুয়ারী মাসে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়া এবং মার্চ-এপ্রিলে আইপিইউ সন্মেলনে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার মাধ্যমে সেটাকে ব্যালান্স করে বাংলাদেশ জানান দিলো যে রাশিয়া-চীন-ভারত কারুরই প্রভাব বলয়ে নেই এই রাষ্ট্র। বরং রাশিয়া-চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশগুলিকেও ব্যালান্সে ধরে রাখার সক্ষমতা এই রাষ্ট্রের রয়েছে। রাশিয়া-চীন-ভারতকে ব্যালান্সে রেখেই বাংলাদেশ পূর্ব ইউরোপের রাজনীতিতে প্রবেশ করলো। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বাংলাদেশের এই ‘কসোভো কার্ড’ একটি নতুন মাথাব্যাথার কারণ হবে।

বাংলাদেশ কেন ৯ বছর অপেক্ষা করে কসোভোকে স্বীকৃতি দিলো?
প্রায় চার বছর ধরে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ দেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ এব্যাপারে ‘নিয়ম’ ভঙ্গ করেছে। নতুন করে স্বীকৃতি দেয়ার ইস্যুটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখানে দেখতে হবে যে, কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে এরকম কচ্ছপের গতি কেন সকলের? উত্তর রয়েছে কসোভোর জন্মকে কে কিভাবে দেখছে, সেটার উপরে। রাশিয়া, চীন, ভারত,ইরান-সহ বেশকিছু দেশ কসোভোকে পশ্চিমা দেশগুলির অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের উদাহরণ হিসেবে দেখে। যেসব দেশে বিচ্ছন্নতাবাদী সমস্যা রয়েছে, সেসব দেশ কসোভোকে একটি বাজে উদাহরণ হিসেবে দেখে। একইসাথে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে থাকা বেশকিছু দেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রের উপরেই স্বীকৃতি দেবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করেছিল। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশ কেন প্রায় ৯ বছর পর তার নীতিতে পরিবর্তন আনলো, যখন কসোভো অন্য দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী হস্তক্ষপের একটি উদাহরণ? যখন বাংলাদেশ জানে যে রাশিয়া, চীন এবং ভারত এই দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি, তখন কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ কি এই দেশগুলির সাথে সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলেনি?

প্রথমতঃ মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকা দেশ/সরকারগুলি প্রথম চার-পাঁচ বছরের মাঝেই কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে। ৯ বছর অপেক্ষা করার ফলে বাংলাদেশের মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকার ব্যাপারটি একেবারেই নাকচ হয়ে গিয়েছে। বরং সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কঠিন অবস্থান দেখিয়ে দেয় যে মার্কিন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ কসোভোকে অন্য দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী হস্তক্ষপের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখে রাশিয়া-চীন-ভারত। স্বীকৃতি দেয়ার মাত্র এক মাসের মাঝেই ঢাকায় ১৩৬তম ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, এবং সেখানে এক দেশের অভ্যন্তরে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হয়। এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের সাথে ছিল রাশিয়া, চীন এবং ভারত। অর্থাৎ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়ার পরেও এই তিন দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অটুট রয়েছেই নয়, বরং আরও শক্ত হয়েছে।

তৃতীয়তঃ ফেব্রুয়ারী মাসে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়া এবং মার্চ-এপ্রিলে আইপিইউ সন্মেলনে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার মাধ্যমে সেটাকে ব্যালান্স করে বাংলাদেশ জানান দিলো যে রাশিয়া-চীন-ভারত কারুরই প্রভাব বলয়ে নেই এই রাষ্ট্র। বরং রাশিয়া-চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশগুলিকেও ব্যালান্সে ধরে রাখার সক্ষমতা এই রাষ্ট্রের রয়েছে। রাশিয়া-চীন-ভারতকে ব্যালান্সে রেখেই বাংলাদেশ পূর্ব ইউরোপের রাজনীতিতে প্রবেশ করলো। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বাংলাদেশের এই ‘কসোভো কার্ড’ একটি নতুন মাথাব্যাথার কারণ হবে।

এখন দেখতে হবে যে, ২০১৭ সালে ‘কসোভো কার্ড’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো কেন?

সিআইএ-এর হিসেবে কসোভোর জনসংখ্যা ১৮ লক্ষের মতো। তবে কেউ কেউ ১৯ থেকে ২২ লক্ষের মতো বলছেন। এর মাঝে বিভিন্ন মতভেদে ৮৮% থেকে ৯৫% মুসলিম; যাদের আবার বেশিরভাগই জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান। আর ৪% থেকে ৮% সার্ব। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধের মাঝেই ১৯৯৬ সাল নাগাদ কসোভোর প্রতিবেশী দেশ আলবেনিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলি কসোভোকে স্বাধীন করার চেষ্টা শুরু করে দেয়। এই প্রচেষ্টায় বাইরের ইন্ধন ছিল বলে সার্বিয়ানরা এবং রাশিয়ানরা অভিযোগ করে। এর মাঝে সার্বরা কসোভারদের উপরে নির্যাতন শুরু করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যায়। এই ঘোলাটে পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাকি বিশ্বের সমর্থন না পেয়ে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে ন্যাটোকে সাথে নিয়ে ১৯৯৯ সালে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। মার্কিন সরকার সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করে, যখন রাশিয়া-চীন এর বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়। রাশিয়া-চীন এক্ষেত্রে মানবাধিকারের নামে অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছিলো। যুদ্ধের ফলে প্রায় ১০ লক্ষ মুসলিম কসোভো ছেড়ে যায়; মৃত্যু হয় কমপক্ষে ১১ হাজার মানুষের, যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম। যুদ্ধ বন্ধের শর্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সার্বিয়ান সৈন্যদের কসোভো ছেড়ে যেতে বাধ্য করে এবং এর স্থলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করে। মার্কিন হস্তক্ষেপে প্রায় দুই লক্ষের মতো সার্ব কসোভো ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কসোভোকে ‘রক্ষা করা’র লক্ষ্যে পশ্চিমা বাহিনী কসোভোতে ৫০ হাজার সৈন্য পাঠায়। তবে পশ্চিমাদের ব্যালান্স করতে ‘কসোভো ফোর্স’ নামের এই বাহিনীতে রাশিয়াও ৪ হাজার সৈন্য পাঠায়। ভারত কসোভোকে স্বীকৃতি না দিলেও সেসময় ৮০০ সৈন্য পাঠায় কসোভোতে।

কসোভোর প্রেসিডেন্ট হাসিম থাচি ২০১৭ সালে এসে কসোভোর সেনাবাহিনী গড়ার পেছনে জোর দেয়া শুরু করেন। ১০ই মার্চ তিনি বলেন যে তিনি এমন দেশের রাষ্ট্রপতি থাকতে চাননা, যেদেশের পার্লামেন্ট নিজ দেশের কোন সামরিক বাহিনী থাকুক, সেটা চায় না। এখানেই হয়ে যায় বিপত্তি। ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র এর কঠোর বিরোধিতা করে; সার্বরাও বিরোধিতা করে। এদের কেউই চাচ্ছে না যে কসোভোর সেনাবাহিনী তৈরি হোক। অর্থাৎ মার্কিনীরা, ইউরোপিয়ানরা এবং সার্বরা সকলেই এক্ষেত্রে এক পক্ষে!

কসোভোর পার্লামেন্ট কসোভোর সেনাবাহিনী রাখার বিরোধী?

কসোভোর নিরাপত্তার ভার বেশ কিছুটা কসোভো পুলিশ এবং ‘কসোভো সিকিউরিটি ফোর্স’-এর (কেএসএফ) হাতে দিলেও ২০১৬ সালেও সেখানে ৪,৬০০ বিদেশী সৈন্য মোতায়েন ছিল। ৯ হাজার পুলিশের সাথে রয়েছে কেএসএফ-এর প্রায় সাড়ে চার হাজার সদস্য, যাদেরকে কসোভো সরকার চাইছে সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত করতে। তবে এখানে বাধা হলো পশ্চিমাদের তৈরি করে দেয়া সংবিধান। সংবিধান অনুযায়ী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে আলাদাভাবে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পেলে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। আর সংবিধান সংশোধন না করতে পারলে কসোভোর সেনাবাহিনীও তৈরি করা সম্ভব নয়। ১০০ জন এমপি রয়েছেন আলবেনিয়ান মুসলিম, যাদের বেশিরভাগই হয়তো সেনাবাহিনীর পক্ষে ভোট দেবেন। কিন্তু ২০ জন সংখ্যালঘু এমপির মাঝে ১০ জন রয়েছেন সার্ব, যারা কসোভোর যেকোন সামরিক বাহিনীর পুরোপুরি বিরোধী। সার্বরা চায় কসোভোর নিরাপত্তা সার্বিয়ার হাতে থাকুক, নাহলে কসোভোতে সার্বদের স্বার্থ রক্ষা হবে না। ২০ জনের মাঝে এই ১০ জন কখনোই কসোভোর সেনাবাহিনীর পক্ষে ভোট দেবেন না, অর্থাৎ কসোভোর সেনাবাহিনীর থাকার সম্ভাবনা কখনোই থাকছে না। আর এর অর্থ হলো, কসোভোররা সর্বদাই তাদের নিরাপত্তার জন্যে পশ্চিমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কসোভোর প্রেসিডেন্ট হাসিম থাচি ২০১৭ সালে এসে কসোভোর সেনাবাহিনী গড়ার পেছনে জোর দেয়া শুরু করেন। ১০ই মার্চ তিনি বলেন যে তিনি এমন দেশের রাষ্ট্রপতি থাকতে চাননা, যেদেশের পার্লামেন্ট নিজ দেশের কোন সামরিক বাহিনী থাকুক, সেটা চায় না। এখানেই হয়ে যায় বিপত্তি। ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র এর কঠোর বিরোধিতা করে; সার্বরাও বিরোধিতা করে। এদের কেউই চাচ্ছে না যে কসোভোর সেনাবাহিনী তৈরি হোক। অর্থাৎ মার্কিনীরা, ইউরোপিয়ানরা এবং সার্বরা সকলেই এক্ষেত্রে এক পক্ষে!

কসোভোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত অবস্থান

কসোভোর সেনাবাহিনীর রাজনীতিকে বুঝতে হলে কসোভোর ভূকৌশলগত অবস্থান বুঝতে হবে। কসোভোর ভূকৌশলগত অবস্থান পূর্ব ইউরোপে বলকানের নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে। ১০ হাজার ৯০০ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের ছোট্ট কসোভো (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের প্রায় সমান) পুরোপুরি স্থলবেষ্টিত। তবে আলবেনিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে আলবেনিয়ার মাধ্যমে কসোভো সমুদ্রের দেখা পায়। এই ছোট্ট দেশটি ইউরোপের সবচাইতে গরীব দেশ। দেশটির অর্থনীতির আকার মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার। সাড়ে তিন’শো মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করলেও আমদানি করে প্রায় ২,৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ দেশটি বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। সবচাইতে বেশি রপ্তানি হয় ইতালি, আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়াতে এবং আমদানি হয় জার্মানি, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, তুরস্ক, ইতালি, আলবেনিয়া থেকে। গরীব হলেও দেশটি খণিজ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। জাতিসংঘের মতে দেশটিতে মজুদ খণিজ সম্পদের মূল্য সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। খণিজের মাঝে রয়েছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন টন লিগনাইট কয়লা (পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মজুদ)। কসোভোর ৯৭% বিদ্যুৎ তৈরি হয় এই কয়লা থেকে। এছাড়াও রয়েছে সীসা-জিঙ্ক-সিলভারের খণি। রয়েছে নিকেল এবং ক্রোমিয়ামের খণি। বক্সাইট এবং ম্যাগনেসিয়ামের খণিও রয়েছে এখানে। এসব খণিজ পদার্থ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরির জন্য যথেষ্ট। এর বাইরেও রয়েছে গ্রানাইট, চুনাপাথর, মার্বেল, ইত্যাদি বিভিন্ন কন্সট্রাকশন মিনারেলের খণি। এসব খণির নিয়ন্ত্রণ কার কাছে থাকবে, সেই প্রশ্ন এখন সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।
 
সার্বরা পালন করছে ১৩৮৯ সালের কসোভোর যুদ্ধের ৬২০তম বার্ষিকী। ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের কাছে কসোভোর গুরুত্ব অনেক। ১৩৮৯ সালের যুদ্ধে সার্বরা হেরেছিল উসমানি সুলতান মুরাদের কাছে, তারপরেও সার্বরা মনে রাখতে চায় সেই যুদ্ধের ফলাফলের কথা। ঐ সময় থেকেই বলকানে ইসলামের আবির্ভাব হয় এবং সেখানকার ইতিহাস পালটে যায় সারাজীবনের জন্যে। বর্তমানে পূর্ব ইউরোপে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধির মাঝে ইউরোপিয়ানরা ইউরোপে ৫০০ বছরের উসমানিয়া খিলাফতের ছায়াকে দেখতে পাচ্ছে।

কসোভোর ঐতিহাসিক বাস্তবতা

এই অঞ্চলের ইতিহাস ভূরাজনৈতিক হিসেবের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলকান অঞ্চল পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতকের গোড়া অবধি ৫০০ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই তুর্কি উসমানিয়া খিলাফতের অধীনে ছিল। বলকানে ইসলামের আবির্ভাব হয় এসময়েই। বলকানের খ্রিস্টানরা হচ্ছে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান, যা পশ্চিম ইউরোপের ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের থেকে আলাদা। মুসলিমদের সাথে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সমস্যা হজরত মুহম্মদ (সঃ)-এর সময় থেকে, যখন ইস্তাম্বুল (তখনকার নাম কনস্টানটিনোপোল) ছিল ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের (বাইজ্যানটাইন এম্পায়ার) রাজধানী। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুল মুসলিমদের হাতে চলে গেলে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়া, তথা মস্কো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝ দিয়ে তুর্কি খিলাফতের পতনের সাথে সাথে বলকানের কর্তৃত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। জার্মান এবং ইটালিয়ানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত সেখানে প্রভাবশালী ছিল। ব্রিটিশ এবং ফরাসীদের প্রভাবও ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই পশ্চিমাদের ইন্ধনে এই এলাকায় সমস্যার শুরু। রাশিয়া বলকানে পশ্চিমাদের প্রভাবকে নিজের স্বার্থবিরুদ্ধ দেখতে শুরু করে বলেই বলকানের সমস্যার দুই প্রান্তে অবস্থান করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রস্থানের সাথে সাথে এখানকার ভূরাজনীতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা একমত যে বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের বলকানে তুরস্কের প্রভাব প্রতিদিনই বাড়ছে। ইউরোপিয়ানরা তুরস্কের মাঝে সেই তুর্কি খিলাফতের ছায়া দেখতে পাচ্ছে, যা তাদেরকে ভীতিতে ফেলছে।

ঠিক এই সময়েই কসোভোকে স্বীকৃতি দিল বাংলাদেশ। যখন যুক্তরাষ্ট্র কসোভোকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, তখন বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেয়নি। এখন সেই স্বীকৃতিই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এই স্বীকৃতিকে তার স্বার্থবিরুদ্ধ মনে করলেও তুরস্ক এই স্বীকৃতির বিরুদ্ধে না-ও থাকতে পারে। এই স্বীকৃতির মাঝ দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বরাজনীতিতে একটি নতুন উপাখ্যান খুললো, কিছুদিন আগেও যার অস্তিত্বই ছিল না। বাংলাদেশের হাতে এর মাধ্যমে ‘কসোভো কার্ড’ এলো, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের উল্টোদিকে পারফেক্ট ব্যালান্সে রয়েছে রাশিয়া-চীন-ভারত। এতো বিশাল ওজনের দুই পক্ষ দুই পাশে থাকলেও ব্যালান্সে এতটুকু চাপও অনুভূত হয়নি! এতো শক্তিশালী অবস্থানকে বুঝতে পারাটা অতটা সহজ নয়, কারণ বেশিরভাগ লোকই বাংলাদেশের দৃশ্যমান আকৃতি নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।

Wednesday 5 April 2017

১৩৬তম আইপিইউ সন্মেলনঃ বিকল্প বিশ্ব-ব্যবস্থার হাতছানি?

০৬ এপ্রিল ২০১৭

পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের একটি এসোসিয়েশন হিসেবে এই সংস্থাটির জন্ম ১৮৮৯ সালে। র সদস্যসংখ্যা এবার ১৭১ থেকে ১৭৩ হয়ে গেল; অর্থাৎ এর পরিধি বিশ্বব্যাপী এবং এর সদস্য নয়, এমন দেশ হাতে গোণা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার নাম বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি কেনো, অথবা এই সংস্থাটির নাম শোনানো হয়নি কেন? উত্তর সহজ – যুক্তরাষ্ট্র চায়নি বলে!

বাংলাদেশে মাত্র হয়ে গেল ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর ১৩৬তম সন্মেলন। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের একটি এসোসিয়েশন হিসেবে এই সংস্থাটির জন্ম ১৮৮৯ সালে; ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। এর জন্ম দিয়েছিল তখনকার বিশ্বের শক্তিধর দেশ ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এর সদস্যসংখ্যা এবার ১৭১ থেকে ১৭৩ হয়ে গেল; অর্থাৎ এর পরিধি বিশ্বব্যাপী এবং এর সদস্য নয়, এমন দেশ হাতে গোণা। এই সংস্থাটির মাধ্যমেই বেশকিছু ইন্টার-গভর্নমেন্ট সংস্থার জন্ম হয়েছিল, যেমন জাতিসংঘ। সংস্থাটিকে ভিত্তি করে জাতিসংঘের ইন্টার-পার্লামেন্টারি এসেম্বলি তৈরি করার চেষ্টাও করেছিল কিছু সংগঠন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার নাম বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি কেনো, অথবা এই সংস্থাটির নাম শোনানো হয়নি কেন? উত্তর সহজ – যুক্তরাষ্ট্র চায়নি বলে!

যুক্তরাষ্ট্র কেন আইপিইউ-তে নেই?

১৮৮৯ সালে সংস্থাটির জন্মের সময়েই যুক্তরাষ্ট্র এর সাথে জড়িত থাকলেও অফিশিয়ালি যুক্তরাষ্ট্র এতে যুক্ত হয় ১৯৩৫ সালে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর চার বছর আগে। মার্কিন কংগ্রেস এবং সিনেট থেকে অনুমতি আসার পরেই যুক্তরাষ্ট্র এতে যুক্ত হয়। এরপর শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা। জার্মানি-জাপান-ইতালি কিছুদিনের জন্যে ব্রিটেন-ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়নকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। তবে যুদ্ধ শেষ হবার পরে পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে যায়। পুরো ইউরোপে যখন একটিও বিল্ডিং দাঁড়িয়ে ছিল না, তখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বোমাও পড়েনি। দুনিয়ার সকলে ঐ মুহুর্তেই বুঝে গিয়েছিল যে বিশ্বযুদ্ধ কাকে উঠিয়েছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের গোড়াপত্তনে তাই মার্কিন প্রভাব ছিল সবচাইতে বেশি; আজও রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে মার্কিনীরা এমনভাবে তৈরি করে, যাতে চাবি থাকে তাদের হাতে। এই সংস্থা বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলি ছাড়া বাকি সকলকেই নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত ছিল সবসময়, যদিও কাগজে-কলমে তার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ প্রতিহত করা। যাইহোক, বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের কর্তৃত্ব কমতে থাকার সাথেসাথে তাদের তৈরি করা সংস্থাগুলিও চাপা পড়ে যেতে থাকে। এর স্থলাভিষিক্ত হয় নতুন তৈরি করা মার্কিন সংস্থাগুলি। যেসকল সংস্থার গুরুত্ব কমে যেতে থাকে, তার মাঝে একটি ছিল আইপিইউ। মার্কিন জনপ্রতিনিধিরা ধীরে ধীরে আইপিইউ-তে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। আর ১৯৯৭ সালে মার্কিন কংগ্রেস থেকে আইপিইউ-এর কাছে একটি চিঠি দিয়ে বলা হয় যে যেহেতু মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা সেখানে আর যাচ্ছেন না, তাহলে আইপিইউ-এ মার্কিনীদের বাৎসরিক চাঁদা এক মিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে আধা মিলিয়ন ডলার করা যায় কিনা। আইপিইউ-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি মার্কিন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। মাত্র এক মিলিয়ন ডলার দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কঠিন হয়ে যাওয়ায় ১৯৯৯ সালের পহেলা অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাস করে যুক্তরাষ্ট্র অফিশিয়ালি আইপিইউ থেকে বের হয়ে যায়। অর্থাৎ গত ১৭ বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্র এর সদস্য নয়, যদিও সংস্থাটির সদস্য পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্র – গণতান্ত্রিক হোক, আর না হোক। ১৯০৪, ১৯২৫ এবং ১৯৫৩ সালের তিনটি সন্মেলন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিতও হয়েছিল।


সংস্থার বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ক্যামেরুনের নাগরিক মার্টিন চুংগং বলেন যে কিছু দেশ নিরাপত্তার ঘাটতির কথা বলে বাংলাদেশের স্বাগতিক দেশ হবার বিরুদ্ধে   কঠোর আপত্তি জানায়। তবে বাকি বেশিরভাগ দেশ সমর্থন দেয়ায় প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। ২০১৪ সালের মার্চে প্রথম আফ্রিকান সেক্রেটারি জেনারেল হন চুংগং, এবং একইসাথে ২০১৪ সালেরই অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে তিন বছরের জন্যে সংস্থার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। এই সময়টি থেকেই নতুন ইতিহাস রচিত হতে থাকে।

২০১৪ থেকে ২০১৭

সংস্থাটির হেডকোয়ার্টার্স হলো সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। এর আগের ১৩৫টি সন্মেলনের মাঝে ২০টি সন্মেলনই হয়েছে সুইজারল্যান্ডে; এর মাঝে ২০০৩ থেকে ২০১৬-এর মাঝে ১৪টি সন্মেলন সুইজারল্যান্ডে হয়। ২০০১ সালের পর থেকে জাম্বিয়া, ইকুয়েডর, পানামা, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, বুরকিনা ফাসোর মতো দেশেও এই সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়; কিন্তু বাংলাদেশে একবারও হয়নি। এই দেশগুলির নাম দেখলেই বোধ করা যায় যে আয়োজকের যোগ্যতা কোন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল না কখনোই। কিন্তু সেটাকেই ইস্যু করা হয় যখন বাংলাদেশ ১৩৬তম সন্মেলন ঢাকায় করার প্রস্তাব দেয়। এই সংস্থার বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ক্যামেরুনের নাগরিক মার্টিন চুংগং বলেন যে কিছু দেশ বাংলাদেশে নিরাপত্তার ঘাটতি আছে বলে কঠোর আপত্তি জানায়। তবে বাকি বেশিরভাগ দেশ সমর্থন দেয়ায় প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। ২০১৪ সালের মার্চে প্রথম আফ্রিকান সেক্রেটারি জেনারেল হন চুংগং, এবং একইসাথে ২০১৪ সালেরই অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে তিন বছরের জন্যে সংস্থার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। এই সময়টি থেকেই নতুন ইতিহাস রচিত হতে থাকে।


ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৩৬তম আইপিইউ সন্মেলনে ১৩২টি দেশের জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেয়। সেখানে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনা হয়। বলা হয় যে জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্র রক্ষা, মানবাধিকার, ইত্যাদি ছুতো ব্যবহার করে অন্য দেশের ভেতরে নাক গলানো যাবে না। উদাহরণস্বরূপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপগুলিকেই হাইলাইট করা হয়। এই প্রস্তাবটি নিয়েই কয়েকদিন ধরে নাটকীয় বাকবিতন্ডা হয় এবং অবশেষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘে এই প্রস্তাব আনা কখনোই সম্ভব ছিল না; যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাব তুলতেই দিতো না। তুলতে পারলেও হয়তো ভেটো দিয়ে দিতো। যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের মতো আইপিইউ-তে কারো ভেটো প্রদানের ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশ এই সন্মেলনের আয়োজক হবার প্রস্তাব দেয়ার সাথেসাথেই একটি সাম্রাজ্যবাদী চক্র বাধা দিতে চেয়েছিল। তারা বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসীদের আখড়া বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। তাদের সেই চেষ্টা তো ব্যর্থ হলোই, একইসাথে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্রও বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি নস্যাৎ করে দেয়। তারা এই সন্মেলনের গুরুত্ব অনুধাবন করেই তাদের পরিকল্পনাগুলি আঁটতে থাকে। যেটার উপরে পুঁজি করে তারা বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রমাণ করতে চেয়েছিল; চেয়েছিল সামরিক-বেসামরিক চুক্তি করে নিয়ন্ত্রণের বলয় শক্ত করতে; চেয়েছিল এদেশের সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করতে, সেটাই এখন পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদেশী গোয়ান্দা সংস্থার অন্তর্ধানমূলক কর্মকান্ড, বিশেষ করে মার্কিন সিআইএ এবং ভারতের ‘র’-এর একত্রে কাজ করার প্রয়াস, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। আইপিইউ-এর অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত এই সাম্রাজ্যবাদী চক্রের গালে চপেটাঘাত।


অন্যায্য বিশ্ব-ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের পথ খুঁজছে সবাই। বাংলাদেশে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সকল ষড়যন্ত্রকেই নস্যাৎ করা হচ্ছে এবং একইসাথে এই সন্মেলনগুলির মাঝ দিয়ে মার্কিন বিশ্ব-ব্যবস্থার বিকল্প একটি ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে, যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী ।

বিকল্প বিশ্ব-ব্যবস্থার খোঁজে

আইপিইউ সন্মেলন এবং কিছুদিন আগে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া আইওআরএ-এর শীর্ষ বৈঠক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ার বার্তা বহন করছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জানান দিচ্ছে যে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রের অবস্থান বেশ শক্ত। ১৯৯০ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে মার্কিন আদর্শকে দুনিয়াব্যাপী রক্ষা করার একটি পদ্ধতি হলো মুসলিম দেশগুলির সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বাধা দেয়া। মুসলিম দেশগুলিকে বিভিন্নভাবে ব্যতিব্যস্ত রেখে বা সেসব দেশে সামরিক-বেসামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দুর্বল করে দিয়ে দুনিয়াব্যাপী তার আদর্শকে জারি রাখাই সেই পদ্ধতির অংশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরির মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে, যাতে যেকোন সময়ে সেসব দেশে সামরিক-বেসামরিক হস্তক্ষেপ করা যায়। নিজেদের হাতে হাজারো পারমাণবিক অস্ত্র রেখে দিয়ে ‘ওয়েপনস অব ম্যাস ডেসট্রাকশন’এর মিথ্যা কথা বলে ইরাককে ধ্বংস করেছে। ইরাকের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে নিঃসন্দেহে ২০০৩ সালের সেই যুদ্ধ এড়ানো যেত; বাঁচতো লাখো মুসলিমের জীবন। দুনিয়াতে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী দেশটিই বাকি সকল দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র রাখা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে। একই কাহিনী কেমিক্যাল এবং জীবানু অস্ত্রের ক্ষেত্রেও। সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার মুসলিম জনগণের উপরে কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহার করেছে বলেই মার্কিনীরা চুপ করে থেকেই ক্ষান্ত হয়নি, দিয়েছে পরোক্ষ সমর্থন। এই অন্যায্য বিশ্ব-ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের পথ খুঁজছে সবাই। বাংলাদেশে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সকল ষড়যন্ত্রকেই নস্যাৎ করা হচ্ছে এবং একইসাথে এই সন্মেলনগুলির মাঝ দিয়ে মার্কিন বিশ্ব-ব্যবস্থার বিকল্প একটি ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে, যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী ।

ভারত-বাংলাদেশ-চীনঃ ব্যালান্স অব পাওয়ার

০৬ এপ্রিল ২০১৭

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে ভারতে যাচ্ছেন বলেই আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে দিল্লীর নিরন্তর চেষ্টার ফসল হতে যাচ্ছে এই সফর – অন্তত দিল্লীর কূটনীতিকেরা এটা ভেবেই খুশি হতে চাইবেন। যদিও মনোহর পারিকরের ব্যর্থতা এবং তার ফলাফল সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল থাকবেন। আর এতোদিনে দিল্লীর বুঝে যাবার কথা যে এখন বাংলাদেশের সাথে কথা বলতে গেলে আগের ভাষায় কথা বললে চলবে না। চীন এবং ভারতের মতো দু’টি বিরাট রাষ্ট্রকে ব্যালান্স করে চলার মতো সক্ষমতা যে রাষ্ট্রের রয়েছে, তার শক্তি যাচাই করতে ভারতের হিসেব ভুল হওয়াটা একেবারেই সমীচিন নয়। দিল্লীর চিন্তাশীল মহল বোঝেন যে বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাব ভারতের সকল চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারে। শক্তিশালী বাংলাদেশ মানেই ভারতের দুর্বল দিকগুলি তার জানা রয়েছে, এবং সেব্যাপারে সিদ্ধান্তও বাংলাদেশেরই। কাজেই বাংলাদেশের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যখন বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশের মাটিকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দেয়া হবে না, তখন দিল্লীর বোঝা উচিত যে বাংলাদেশের সক্ষমতা কতটুকু।

সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা সমঝোতা নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে, তা ভারতের কাছে বার্তা হিসেবে যাওয়া উচিত যে বাংলাদেশের জনগণের মতামতের ভরবেগের বিরুদ্ধে কিছু আশা করাটা ভারতের পক্ষে সমীচিন হবে না। তবে পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ কোন কার্ডটি কোথায় খেলবে, সেটা নিতান্তই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। একটি ব্যালান্সের মাঝখানের অবস্থানটি যেমন শক্তিশালী, তেমনি দায়িত্বপূর্ণ। ব্যালান্সের দুই প্রান্তে অবস্থিত দুই পক্ষেরই বোঝা উচিত যে ব্যালান্সের মাঝের অবস্থানটিই সিদ্ধান্ত নেয় যে কোনদিকে দূরত্ব কমাতে বা বাড়াতে হবে। এই দূরত্বের হিসেব-নিকেশের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ চাইবে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সমঝোতা করতে, যদিও সেটা বাংলাদেশের কতটুকু দরকার, তাতে প্রশ্ন থেকেই যাবে সাধারণ জনগণের মাঝে। বিশেষতঃ তিস্তার নায্য পানিবন্টনের মতো ইস্যুকে জিইয়ে রেখে প্রতিরক্ষা স্মারক স্বাক্ষর করাটা কতটা জরুরি, সেই আলোচনাটি অবান্তর নয় মোটেই। তিস্তার পানির বন্টন না করেও একগাদা হাল্কা ইস্যু নিয়ে আলোচনার কথা বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লীতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভূরাজনৈতিকভাবে অপমান করার ভারতীয় পরিকল্পনা কতটা ভুল, তা ওয়াকিবহাল মহলের কাছে পরিষ্কার। ভারতকে বুঝতে হবে যে ভারত এবং চীনের মাঝে ‘পারফেক্ট ব্যালান্স’ কোথায় হবে, সেটি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ; ভারত নয়। এখানে ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব খুব কমই রয়েছে।

বাংলাদেশকে শক্তিশালী হতেই হবে। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীলতা। এই স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে অনেক ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়েছে – তথাকথিত জঙ্গীবাদ, শ্রমিক অসন্তোষ, সাম্প্রদায়িক হামলা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি, ইত্যাদি। কিন্তু সবই ভেস্তে গেছে একে একে। ভারতকে বুঝতে হবে যে সাম্রাজ্যবাদী এই চক্র চাইছে ভারত-চীনের ব্যালান্সের মাঝে অবস্থান নেয়া দায়িত্বশীল রাষ্ট্রটিকে অস্থির করে তোলা, যাতে পুরো ব্যালান্সটাই ধ্বসে যায়; উদ্দেশ্য – বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঠেকানো। ভারতকে বুঝতে হবে যে শক্তিশালী বাংলাদেশ ভারতের স্থিতিশীলতার জন্যেই জরুরি। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রই পারে ভারত এবং চীনকে ব্যালান্সে ধরে রাখতে; বঙ্গোপসাগরকে ব্যালান্সে রাখতে; ভারত মহাসাগরকে ব্যালান্সে রাখতে। নিজের স্বার্থ না বুঝে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বাস্তবায়ন ভারতের জন্যে দুঃখ ছাড়া কিছুই বয়ে আনবে না। ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সভা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া এবং সেই সভায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের বিভিন্ন ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের কর্মকান্ড বন্ধের আহ্বান ভারতের কাছে একটি বার্তা হিসেবে যাওয়া উচিত। এর আগে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ওশান রিম এসোসিয়েশন (আইওআরএ)-এর প্রথম শীর্ষ বৈঠকও একইরকম বার্তা দিয়েছিল। ভারত তার নিজের স্বার্থেই কোন অবস্থাতেই এই বার্তাগুলি ভুল বুঝতে পারে না। এই বার্তাগুলির সঠিক অনুধাবনের মাঝেই ভারতের অস্তিত্ব নিহিত।