Sunday 4 September 2022

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সামরিকীকরণে চীনের ভীতিকে ব্যবহার করছে পশ্চিমারা

০৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২২
 
নভেম্বর ২০২০। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ দেশ পালাউএ মার্কিন সর্বাধুনিক 'এফ-২২ র‍্যাপটর' যুদ্ধবিমান। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশগুলিকে ঘনঘন সামরিক মহড়ায় ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র যখন অত্র অঞ্চলকে সামরিকীকরণের দিকে এগুচ্ছে, তখন সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ভিড়তে না দেয়ার ধৃষ্টতা সত্যিকার অর্থেই অবাক করার মতো। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে চীনাদের প্রভাব এখনও প্রধানতঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে থাকলেও পশ্চিমারা তা ব্যবহার করছে অত্র অঞ্চলকে সামরিকীকরণের ছুতো হিসেবে।


গত ২৬শে অগাস্ট মার্কিন কোস্ট গার্ড বিবৃতি দেয় যে, তাদের একটা প্যাট্রোল বোট ‘অলিভার হেনরি’ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের বন্দরে ঢোকার অনুমতি পায়নি। জাহাজটা চলমান মহড়া ‘অপারেশন আইল্যান্ড চিফ’এর অংশ হিসেবে অত্র অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপ দেশগুলি সফর করছিলো। জাহাজটাকে বন্দরে ঢোকার কূটনৈতিক ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। এর ফলশ্রুতিতে জাহাজটা কাছাকাছি পপুয়া নিউ গিনির এক বন্দরে চলে যায়। মার্কিন মিডিয়া ‘ফক্স নিউজ’ বলছে যে, এই মহড়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আকাশ ও সমুদ্রে টহল দেয়ার জন্যে বিভিন্ন ধরণের সামরিক শক্তি মোতায়েন করে; যে অঞ্চলের মাঝে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জও ছিল। প্রতিবেদনে আরও মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রী মানাসেহ সোগাভারে চীনের সাথে একটা নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করে পশ্চিমা দেশগুলিকে দুশ্চিন্তার মাঝে ফেলেছেন। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে সলোমোনে চীনা সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হবে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখন্ডের ২ হাজার কিঃমিঃএর মাঝে চীনারা সামরিক উপস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হবে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ছাড়াও তা মার্কিন ঘাঁটি গুয়ামএর কাছাকাছি চীনা সামরিক উপস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে। মার্কিনীরা অনেকেই সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের উপর চীনাদের প্রভাব মেনে নিতে পারছেন না। মার্কিন লেখক গর্ডন চ্যাং এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, চীন এই মুহুর্তে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জকে চালাচ্ছে।

তবে আপাততঃ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে যে পশ্চিমা দেশগুলিই প্রভাব বিস্তার করছে, তা পরিষ্কার। ‘সী পাওয়ার ম্যাগাজিন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন কোস্ট গার্ডের জাহাজ ‘অলিভার হেনরি’ যে ‘অপারেশন আইল্যান্ড চিফ’এর অংশ হিসেবে টহল দিচ্ছিলো, সেই মহড়া প্রতিবছরের চারটা মহড়ার একটা। এই মহড়ায় প্রশান্ত মহাসাগরের ১১টা দ্বীপ দেশ অংশ নেয়; যারা হলো, ফিজি, ফেডারেটেড স্টেটস অব মাইক্রোনেশিয়া, কিরিবাতি, পালাউ, পপুয়া নিউ গিনি, নাউরু, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, সামোয়া, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ, তুভালু এবং ভানুয়াটু। এই দ্বীপ দেশগুলির বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং সমুদ্রসীমাকে এই মহড়ায় ব্যবহার করা হয়। ‘অলিভার হেনরি’র কমান্ডিং অফিসার ফ্রেডি হফস্নাইডার বলছেন যে, জাহাজের ক্রুদের কাজ হলো আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন এবং তথ্য আদানপ্রদান করা। ‘অলিভার হেনরি’, ‘মার্টল হ্যাজার্ড’ এবং ‘ফ্রেডারিক হ্যাচ’ নামের কোস্ট গার্ডের তিনটা জাহাজ ২০২১এর জুলাই মাসে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুয়ামএ কমিশনিং করা হয় এবং সেখান থেকেই অপারেট করার ব্যবস্থা করা হয়। গুয়ামএর মার্কিন কোস্ট গার্ডের কমান্ডার ক্যাপ্টেন নিক সিমন্সএর কথায়, গুয়ামে তিনটা জাহাজের একত্রে কমিশনিংএর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অত্র অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া দেখিয়ে দিচ্ছে।
 

মার্কিন ‘ইন্দপ্যাসিফিক কমান্ড’এর এক খবরে বলা হয় যে, গত ১০ই জুন মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩টা ‘এফ-৩৫এ’ স্টেলথ যুদ্ধবিমানকে প্রথমবারের মতো ‘ভ্যালিয়্যান্ট শিল্ড ২০২২’ নামের এক মহড়ার অংশ হিসেবে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ পালাউএ মোতায়েন করা হয়। খবরে বলা হয় যে, ইন্দোপ্যাসিফিকে সামরিক শক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দেশকে রক্ষা করা ছাড়াও বিশ্বব্যাপী শক্তি প্রদর্শনেও যে সক্ষম, সেটা প্রমাণ করছে। এর আগে ২০২০এর নভেম্বরে ২টা ‘এফ-২২’ যুদ্ধবিমানও পালাউএ মোতায়েন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রগুলিও অত্র অঞ্চলে শক্তি প্রদর্শন করছে। পালাউ দ্বীপে জাপানের দূতাবাসের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে যে, গত ১৯শে জুলাই তৃতীয়বারের মতো জাপানি নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘কিরিসামে’ পালাউ সফর করে; যার সাথে ছিল মার্কিন কোস্ট গার্ডের প্যাট্রোল বোট ‘মার্টল হ্যাজার্ড’ এবং ব্রিটিশ রয়াল নেভির প্যাট্রোল জাহাজ ‘তামার’। রয়াল নেভির আরেক জাহাজ ‘স্পে’ গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে টোঙ্গা, পিটকেয়ার্ন দ্বীপ, ফিজি ও পপুয়া নিউ গিনি সফর করে বলে বলছে ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইট। এর আগে ২০২১এর সেপ্টেম্বরে জাপানি নৌবাহিনীর ২০ হাজার টনের বিশাল হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘কাগা’ ডেস্ট্রয়ার ‘মুরাসামে’ ও ‘শিরানুই’এর সাথে পালাউ সফর করে। এই জাহাজগুলি পালাউএর ক্ষুদ্র দু’টা প্যাট্রোল বোটের সাথে যৌথ মহড়া সম্পন্ন করে।

এছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স গত ১০ থেকে ১২ই অগাস্টের মাঝে ফ্রান্সের মূল ভূখন্ড থেকে ৭২ ঘন্টার মাঝে প্রশান্ত মহাসাগরে ফরাসি উপনিবেশ নিউ ক্যালিডোনিয়াতে ৭টা যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে। ফরাসি সামরিক বাহিনী বলছে যে, এই বিমানগুলির মাঝে ছিল ৩টা ‘রাফাল’ ফাইটার বিমান, দু’টা ‘এ৩৩০’ রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার বিমান এবং দু’টা ‘এ৪০০এম’ পরিবহণ বিমান। এই বিমানগুলির অস্ট্রেলিয়াতে ‘পিচ ব্ল্যাক ২০২২’ নামের সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়ার কথা বলা হলেও অঞ্চলিকভাবে শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যটা দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। এর আগেও ফ্রান্স প্রশান্ত মহাসাগরে এভাবে যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। ব্রিটিশরাও আগে এভাবেই তাদের বিমান বাহিনীর বিমান ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করেছে। ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে অনুসরণ করেছে জার্মানি। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, জার্মান বিমান বাহিনীর ৬টা ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ যুদ্ধবিমান ৩টা ‘এ৩৩০’ রিফুয়েলিং বিমান এবং ৪টা ‘এ৪০০এম’ পরিবহণ বিমানের সাথে করে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াতে অবতরণ করে। জার্মান বিমান বাহিনীর প্রধান লেঃ জেনারেল ইনগো গেরহার্টজ বলছেন যে, জার্মানি দেখাতে চায় যে এক দিনের মাঝে তারা এশিয়াতে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করতে সক্ষম।

তবে পশ্চিমা দেশগুলি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সকলেই যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করছে। ২০২১এর জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র গুয়াম দ্বীপে ২৫টা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ‘এফ-২২ র‍্যাপটর’ স্টেলথ ফাইটার বিমান মোতায়েন করে। ‘অপারেশন প্যাসিফিক আয়রন ২০২১’ নামের এক মহড়ার অংশ হিসেবে এই বিমানগুলিকে সাময়িকভাবে মোতায়েন করা হলেও জাপানের ভূমিতে ‘এফ-২২’ বিমান স্থায়ীভাবে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হবার পথে। ‘সিএনএন’ বলছে যে, বিমান মোতায়েন করা হয়েছিল মূলতঃ চীনকে টার্গেট করেই। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশগুলিকে ঘনঘন সামরিক মহড়ায় ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র যখন অত্র অঞ্চলকে সামরিকীকরণের দিকে এগুচ্ছে, তখন সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ভিড়তে না দেয়ার ধৃষ্টতা সত্যিকার অর্থেই অবাক করার মতো। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে চীনাদের প্রভাব এখনও প্রধানতঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে থাকলেও পশ্চিমারা তা ব্যবহার করছে অত্র অঞ্চলকে সামরিকীকরণের ছুতো হিসেবে।

No comments:

Post a Comment