Saturday 24 September 2022

‘এসসিও’ কি পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হতে পারবে?

২৪শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এতগুলি দেশ ‘এসসিও’র সাথে যুক্ত হতে চাইছে। তবে রাশিয়া ও চীনের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের মাঝেও এতগুলি দেশ যে ‘এসসিও’তে যোগদানের চেষ্টা করছে, তা পশ্চিমা লিবারাল আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার আকর্ষণীয়তার উপর মরিচা পড়ার দিকেই ইঙ্গিত দেয়।


সেপ্টেম্বরের ১৫-১৬ তারিখে মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের সমরখন্দে অনিষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’র ২২তম শীর্ষ বৈঠক। তিন বছরের মাঝে প্রথমবারের মতো সংস্থার সদস্য দেশগুলির শীর্ষ নেতারা সামনাসামনি বৈঠকে বসেছেন। এবারের বৈঠকে সংস্থার ৬টা সদস্য দেশ ছাড়াও ৪টা অবজার্ভার দেশ এবং ৯টা ডায়ালগ পার্টনার দেশ যোগ দেয়। বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ৩০ শতাংশ জিডিপি এই সংস্থার মাঝে একত্রিত হয়েছে। এই বৈঠক এমন সময়ে আয়োজিত হলো, যখন রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার জের ধরে পশ্চিমারা রাশিয়ার উপরে অত্যন্ত কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়েছে এবং চীনের সাথে পশ্চিমাদের ব্যাপক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এই বৈঠকের মাধ্যমে রাশিয়া অন্যান্য সদস্য দেশগুলিকে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, ‘এসসিও’র মাঝ দিয়ে পশ্চিমাদের নেতৃত্বের বিশ্বব্যবস্থার একটা বিকল্প তৈরি হতে পারে।

সংস্থার লক্ষ্য দোদুল্যমান?

২০০১ সালে গঠিত এই সংস্থার শুরুতে চীন এবং রাশিয়ার সাথে এর সদস্য ছিল মধ্য এশিয়ার চারটা দেশ কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তান। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে রাশিয়ার উদ্যোগে ভারত এবং পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে সংস্থার অবজার্ভার দেশ হিসেবে রয়েছে ইরান, বেলারুশ, মঙ্গোলিয়া এবং আফগানিস্তান। তবে আগামীতে ইরানও সংস্থার পূর্ণ সদস্য হতে যাচ্ছে। এছাড়াও মিশর, তুরস্ক এবং সৌদি আরবসহ নয়টা দেশ সংস্থার ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে রয়েছে। সংস্থার জন্মের সময় এর প্রধান লক্ষ্য নির্ধারিত হয় সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে। প্রধানতঃ ইউরেশিয়ার এই দেশগুলি নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় যাতে অন্য কোন দেশ হস্তক্ষেপ না করে, তা নিশ্চিতে এই সংস্থা গঠন করে। এর অধীনে অনেকগুলি বড় আকারের যৌথ সামরিক মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার কাছে নিরাপত্তা ইস্যুগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরবর্তীতে সংস্থার এজেন্ডাতে নিরাপত্তার ইস্যু অনেক ইস্যুর মাঝে একটা হয়ে দাঁড়ায়। মধ্য এশিয়াতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগের কারণে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির কাছে সামরিক উদ্দেশ্যের চাইতে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে থাকে।

সংস্থার সদস্য দেশগুলির মাঝে কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের মাঝে সীমান্ত সংঘর্ষ চলছে এবং আঞ্চলিকভাবে দুই ডায়ালগ পার্টনার দেশ আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝেও চলছে উত্তেজনা। এই দ্বন্দ্বগুলি দেখিয়ে দেয় যে, ‘এসসিও’ প্রতিষ্ঠিত হবার সময়ে এর যে লক্ষ্যগুলি নির্ধারণ করা হয়েছিল, এখন পরিস্থিতি এর চাইতেও অনেক বেশি জটিল হয়ে গেছে।

‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘এসসিও’র সদস্যদের ন্যাটোর মতো কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ন্যাটোর ‘আর্টিকেল ৫’এ বলা হয়েছে যে, একজন সদস্য আক্রান্ত হলে বাকিরাও সেটাকে নিজেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবেই দেখবে। ‘ইস্তাম্বুল কুলতুর ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর মেনসুর আকগুন বলছেন যে, ‘এসসিও’ হলো একটা ‘হাইব্রিড জোট’, যা মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে রাজনৈতিক শূণ্যস্থান পূরণে বিভিন্ন সহযোগিতার পথ বেছে নিয়েছে। তারা আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সদস্য দেশগুলির সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে। এবং একইসাথে অত্র অঞ্চলের বাইরের আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে একটা সমন্বিত কন্ঠ তুলে ধরছে। যে সংস্থার মাঝে ভারত এবং পাকিস্তান একত্রে রয়েছে, তা কখনোই ন্যাটোর মতো সামরিক দিকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পারবে না।

অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইস্ট এশিয়া ফোরাম’এর এক লেখায় জাপানের ‘ইউনিভার্সিটি অব শুকুবা’র প্রফেসর তিমুর দাদাবায়েভ তার বিশ্লেষণে বলছেন যে, এবারের বৈঠকে রুশ এজেন্ডার সাথে সকলে কতটা একমত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ তুরস্ক, চীন এবং ইরান রুশদের সাথে কিছুটা একমত পোষণ করলেও বাকিরা ততটা আগ্রহ দেখায়নি। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার বক্তব্যে মূলতঃ পশ্চিমাদের সাথে সহাবস্থানের পক্ষেই কথা বলেছেন। কারণ চীনা অর্থনীতি পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

 
রুশদের ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনারা মৌন সম্মতিই দিয়েছে। তবে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন করে চীনারা তাদের অর্থনীতিকে পশ্চিমা অবরোধের শিকার হিসেবে দেখতে চায় না; বিশেষ করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের আগে শি জিনপিং এহেন কোন পদক্ষেপ নিতে চাইবেন না। আপাততঃ রাশিয়ার কাছ থেকে বাজারের চাইতে কম মূল্যে তেল-গ্যাস আমদানি করেই চীনারা খুশি। চীন জানে যে রাশিয়া ধ্বংস হলে মধ্য এশিয়াতে চীনের সকল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য হুমকির মাঝে পড়ে যাবে এবং চীনাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ও অবাস্তব হয়ে দাঁড়াবে। অপরদিকে রাশিয়া দুর্বল হয়ে গেলে মধ্য এশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে প্রভাব বিস্তার করা তুরস্ক অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়া এবং চীনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে।

রাশিয়া এবং চীন – প্রতিদ্বন্দ্বী না সহযোগী?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইয়র্কটাউন ফাউন্ডেশন’এর প্রধান সেথ ক্রপসি হংকং ভিত্তিক পত্রিকা ‘এশিয়া টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, রুশদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, শি জিনপিং ইউক্রেনের নাম একবার উচ্চারণ না করলেও তিনি যুদ্ধের ব্যাপারে তার উদ্বেগ জানিয়েছেন। অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকই বলা শুরু করেছেন যে, পুতিনের সাথে শি জিনপিংএর বন্ধুত্ব বুঝি টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে গেছে। সেথ ক্রপসি বলছেন যে, প্রকৃতপক্ষে রুশদের ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনারা মৌন সম্মতিই দিয়েছে। তবে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন করে চীনারা তাদের অর্থনীতিকে পশ্চিমা অবরোধের শিকার হিসেবে দেখতে চায় না; বিশেষ করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের আগে শি জিনপিং এহেন কোন পদক্ষেপ নিতে চাইবেন না। আপাততঃ রাশিয়ার কাছ থেকে বাজারের চাইতে কম মূল্যে তেল-গ্যাস আমদানি করেই চীনারা খুশি। পুতিন তার বক্তব্যে তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের নীতিকে সমর্থন করলেও শি জিনপিং ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন দেননি। এ থেকে যারা মনে করছেন যে, চীনারা রাশিয়ার ধ্বংস চাইছে, তারা বড় ভুল করছেন। চীন রাশিয়াকে প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স এবং সামরিক সহায়তা দেয়া থেকে বিরত থেকেছে ঠিকই, কিন্তু বাকি সকল ক্ষেত্রে দুই দেশের বাণিজ্য আগের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। চীনাদের ভাষ্য অনুযায়ী শি জিনপিং রাশিয়ার প্রধান স্বার্থকে সমর্থন করে কথা বলেছেন। চীনারা বারংবার বলেছে যে, ন্যাটোর পূর্বদিকের সীমানা বিস্তারের কারণেই ‘পূর্ব ইউরোপের সমস্যা’ তৈরি হয়েছে। শি জিনপিং বারংবার বলেছেন যে, চীনারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে। পশ্চিমা লিবারাল আদর্শের পুঁজিবাদ এবং দ্বিমুখী মানবাধিকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকার পক্ষপাতি নয় তারা।

সেথ ক্রপসি বলছেন যে, চীন জানে যে রাশিয়া ধ্বংস হলে মধ্য এশিয়াতে চীনের সকল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য হুমকির মাঝে পড়ে যাবে এবং চীনাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ও অবাস্তব হয়ে দাঁড়াবে। অপরদিকে রাশিয়া দুর্বল হয়ে গেলে মধ্য এশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে প্রভাব বিস্তার করা তুরস্ক অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়া এবং চীনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। চীন বরং শক্তিশালী রাশিয়ার কাছ থেকে সুবিধাই পাবে। রাশিয়া ইউক্রেনে পশ্চিমাদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকার অর্থ হলো, পশ্চিমারা সামরিক শক্তি রাশিয়া এবং চীনের মাঝে ভাগ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমাদের সাথে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য চীনের অর্থনীতিকে বড় একটা সহায়তা প্রদান করবে। ‘এসসিও’র বৈঠকে পুতিন এবং শি জিনপিং যা বলেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে সারা বিশ্বকে দেখাবার জন্যে। তাদের মাঝে আসল কথাগুলি তারা গত ছয় মাসের মাঝে ফোনালাপেই সেড়ে ফেলেছেন।

মধ্য এশিয়ার দেশগুলির ভিন্ন এজেন্ডা


কাজাখস্তানের পত্রিকা ‘আস্তানা টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ত তোকাইয়েভ ‘এসসিও’র বৈঠকে তার দেশের কিছু এজেন্ডা তুলে ধরেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ট্রানজিট সুবিধা আদানপ্রদান, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং খাদ্যের মতো বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দেয়ার জন্যে তিনি সদস্য দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানান। সংস্থার সদস্যদেশগুলির ২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সামষ্টিক অর্থনীতির উল্লেখ করে তোকাইয়েভ বলেন যে, সংস্থার উচিৎ হবে একে একটা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলা। এই দেশগুলির কাছে রয়েছে জ্বালানি, কয়লা, রেয়ার আর্থ মেটাল এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিশাল উৎস। ট্রানজিটের উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন যে, চীন এবং ইউরোপের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হলো মধ্য এশিয়া। এছাড়াও কাস্পিয়ান সাগরের মাঝ দিয়ে ট্রানজিট এবং মধ্য এশিয়ার সাথে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগের গুরুত্বও তিনি তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন যে, কাজাখস্তান থেকে তুর্কমেনিস্তান এবং ইরান হয়ে যে পরিবহণ করিডোর রয়েছে, তার মাধ্যমে পূর্ব এশিয়ার সাথে সবচাইতে কম সময়ে মধ্য এশিয়ার যোগাযোগের উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। তিনি উজবেকিস্তানের সীমানা থেকে আফগানিস্তানের মাঝ দিয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের গুরুত্বের কথাও তুলে ধরেন। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘এসসিও’র সদস্য দেশগুলি বিশ্বের সবচাইতে বড় খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশ। তোকাইয়েভ তার আরেকটা এজেন্ডা হিসেবে মধ্য এশিয়ার পানির বন্টনের ইস্যুকে তুলে আনেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের পানিসম্পদের উৎস অন্য আরেক দেশে; তাই সদস্য দেশগুলির মাঝে সুষ্ঠু পানি বন্টনের উপরে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।

 
কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ত তোকাইয়েভ ‘এসসিও’র বৈঠকে তার দেশের কিছু এজেন্ডা তুলে ধরেন। উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান ‘এসসিও’কে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে দেখতে চাইছে। মধ্য এশিয়ার এই দেশগুলি রাশিয়া এবং চীনের ভূরাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের জন্যে ব্যবহৃত হোক, এটা তারা চাইছে না।

মধ্য এশিয়ার আরেক সদস্য দেশ উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিইয়োয়েভ চীন থেকে কিরগিজস্তান হয়ে উজবেকিস্তান পর্যন্ত রেললাইন তৈরির প্রকল্পকে ঐতিহাসিক বলে আখ্যা দেন। মিরজিইয়োয়েভ ‘এসসিও’র সদস্য দেশগুলির মাঝে শিল্প ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন একটা অর্থনৈতিক ডায়ালগ খোলার আবেদন করেন। এই ডায়ালগের মাধ্যমে তিনি সদস্য দেশগুলির মাঝে বাণিজ্য সহজীকরণ ছাড়াও নির্ভরযোগ্য সাপ্লাই চেইন তৈরি, যৌথভাবে আমদানি বিকল্প উৎপাদন প্রকল্প এবং বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার কথা বলেন। চীনা সরকারি থিংকট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকনমি এন্ড পলিটিক্স’এর কাজাখ বিশ্লেষক ঝুমাবেক সারাবেকভ ‘আস্তানা টাইমস’কে বলেন যে, ২০২১ সালে ‘এসসিও’র সদস্য দেশগুলির বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল প্রায় ৭’শ ট্রিলিয়ন ডলার; যার মাঝে মাত্র ৭ ট্রিলিয়ন বা মাত্র ১ শতাংশ সদস্য দেশগুলির মাঝে হয়। উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান ‘এসসিও’কে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে দেখতে চাইছে। মধ্য এশিয়ার এই দেশগুলি রাশিয়া এবং চীনের ভূরাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের জন্যে ব্যবহৃত হোক, এটা তারা চাইছে না।

ভারতের প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় হর্ষ পান্ত বলছেন যে, ‘এসসিও’র মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার সাথে ভারতের যুক্ত হবার চেষ্টাটা অবাস্তব নয়। আর যেহেতু ভারত এই সংযুক্তি চাইছে সদস্য দেশগুলির স্থলভাগের উপর দিয়ে, তাই সংস্থার মাঝেই ভারত তার স্বার্থ বাস্তবায়নকে দেখতে পাচ্ছে। তবে ভারত যে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির মতোই ‘এসসিও’কে পশ্চিমা বিরোধী সংস্থা হিসেবে গড়ার রাশিয়া এবং চীনের লক্ষ্যের সাথে একমত নয়, তা পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার। পান্ত বলছেন যে, এবারের শীর্ষ বৈঠকে সদস্য দেশগুলির ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা দেখে বোঝা যায় যে, সামনের দিনগুলিতে এর কর্মকান্ডগুলি বাস্তবায়ন করা আরও জটিল হবে।

দন্তহীন বাঘ

প্রফেসর তিমুর দাদাবায়েভ বলছেন যে, মধ্য এশিয়ার দেশগুলি ‘এসসিও’র ভৌগোলিক পরিধিকে বৃদ্ধি করতে চাইছে। বিশেষ করে ইরান এবং বেলারুশ একারণে সংস্থার অন্তর্গত হতে চলেছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালদ্বীপ ও মিয়ানমারকেও ডায়ালগ পার্টনার করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ‘এসসিও’র সাথে ‘ইকনমিক এন্ড সোশাল কমিশন ফর এশিয়া প্যাসিফিক’ বা ‘এসক্যাপ’ এবং জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কোর সাথে সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির এজেন্ডাই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং একইসাথে সংস্থার পশ্চিমা-বিরোধী প্রতিচ্ছবিকে প্রতিস্থাপন করে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটা প্রতিচ্ছবি স্থান করে নিয়েছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলির এজেন্ডাগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ‘এসসিও’কে তারা দখছে একটা আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে; রাজনৈতিক জোট হিসেবে নয়।

‘এসসিও’র এবারের বৈঠকে তুর্কি প্রসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান যোগদান করেন এবং তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, তুরস্ক ‘এসসিও’র পূর্ণ সদস্য দেশ হতে ইচ্ছুক। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এটা তুরস্কের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের একটা প্রতিফলন। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও ‘এসসিও’র ডায়ালগ পার্টনার হতে চাইছে; যাদের লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে। যদিও অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, ‘এসসিও’ পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হতে পারে কিনা, তথাপি সংস্থাটা যে পরিবর্তিত বাস্তবতা এড়াতে পারেনি, তা কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের মূলতঃ অর্থনৈতিক এজেন্ডার পিছনে ছোটা দেখেই বোঝা যায়। নিরাপত্তাকে কেন্দ্রে রেখে ‘এসসিও’র জন্ম হলেও এখন তা বহুবিধ লক্ষ্যে বিভক্ত। পশ্চিমা জোটের মতো ‘এসসিও’র নেই কোন আদর্শিক লক্ষ্য। একদিকে ন্যাটোর মতো পারস্পরিক কোন নির্ভরশীলতা না থাকার কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মতো বিপরীতমুখী দেশগুলিও বিভিন্ন সুবিধা পেতে এখানে যুক্ত হয়েছে, অপরদিকে চীন এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে মধ্য এশিয়ার দেশগুলি এই সংস্থার মাঝে ব্যালান্স খুঁজে পেয়েছে। ‘এসসিও’ মূলতঃ চীন এবং রাশিয়ার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরলেও তা এই দুই দেশের রাজনৈতিক সক্ষমতার সীমানাকেও নির্দেশ করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য, জ্বালানি সরবরাহ এবং ট্রানজিট সুবিধা পাবার জন্যে অনেক দেশই হয়তো সংস্থার সদস্য হতে চাইবে, কিন্তু ন্যাটো সদস্যদের মতো নিরাপত্তাগত বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে বহু লক্ষ্যের মাঝে বিভক্ত ‘এসসিও’ একটা দন্তহীন বাঘই থেকে যাবে। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এতগুলি দেশ ‘এসসিও’র সাথে যুক্ত হতে চাইছে। তবে রাশিয়া ও চীনের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের মাঝেও এতগুলি দেশ যে ‘এসসিও’তে যোগদানের চেষ্টা করছে, তা পশ্চিমা লিবারাল আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার আকর্ষণীয়তার উপর মরিচা পড়ার দিকেই ইঙ্গিত দেয়।



সূত্রঃ
‘SCO Summit: President Tokayev Focuses on Transit and Transport, Food and Energy Security’ in The Astana Times, 17 September 2022
‘In search of a new identity for SCO’ by Timur Dadabaev in East Asia Forum, 20 September 2022
‘SCO summit did not show what you think it showed’ by Seth Cropsey in Asia Times, 21 September 2022
‘Can the SCO be Turkey’s alternative to the West?’ in Al-Jazeera, 21 September 2022
‘India and the SCO: A Parade of Disconnect’ by Harsh V. Pant, in Observer Research Foundation, 22 September 2022

No comments:

Post a Comment