Friday 25 November 2022

ইরানের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের নতুন মোড়?

২৬শে নভেম্বর ২০২২

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসমূহ। ইরান নতুন করে ইউরেনিয়াম প্রসেসিং শুরু করার পরিকল্পনা করছে। ইরান তার এই কর্মকান্ড চালাচ্ছে ফোরদাউ-এর ভূগর্ভস্থ স্থাপনায়, যে জায়গাটা বোমা মেরে ধ্বংস করাটা বেশ কঠিন হতে পারে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিনীদের সামরিক সক্ষমতাকে বিভক্ত করেছে। এমতাবস্থায় ওয়াশিংটনে অনেকেই চাইছে না মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দায়িত্ব বেড়ে যাক। কিন্তু ইরানের বাস্তবতা ওয়াশিংটনকে তার নীতির পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে; যা কিনা মার্কিন সামরিক বাহিনীর বৈশ্বিক অবস্থানকে চাপের মাঝে ফেলছে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পরমাণু প্রকল্পের বিষয়ে ইরানের সহযোগিতা যথেষ্ট নয় বলে বিবৃতি দেয়ার পর গত ২২শে নভেম্বর ইরান বলে দিয়েছে যে, দেশটা নতুন করে ইউরেনিয়াম প্রসেসিং শুরু করার পরিকল্পনা করছে। ‘এরাব নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৫ সালে ইরানের সাথে পশ্চিমাদের চুক্তির আগ পর্যন্ত ইরান ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম প্রসেস করছিল; চুক্তি মোতাবেক যা ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। এখন ইরান সেটাকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে চাইছে। তবে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে এটাকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে; যা থেকে ইরান এখনও বেশ কিছুটা দূরেই রয়েছে। চুক্তি মোতাবেক ইরান ইউরেনিয়াম প্রসেসিংএর জন্যে প্রথম জেনারেশনের ‘আইআর-১’ সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করতে পারার কথা। তবে এখন ইরান নতুন জেনারেশনের ‘আইআর-২এন’, ‘আইআর-৪’ এবং ‘আইআর-৬’ সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করছে; যা কিনা ইরানের ইউরেনিয়াম প্রসেসিং সক্ষমতাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই সিদ্ধান্ত ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে নিয়ে যাবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো হেনরি রোম ‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, ইরান তার এই কর্মকান্ড চালাচ্ছে ফোরদাউ-এর ভূগর্ভস্থ স্থাপনায়, যে জায়গাটা বোমা মেরে ধ্বংস করাটা বেশ কঠিন হতে পারে। পেন্টাগনের কর্মকর্তারা এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যথেষ্টই নিম্নমুখী। পারমাণবিক ইস্যু ছাড়াও ইরান অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়েছে, যেখানে পশ্চিমারা ইরানের সরকারবিরোধীদের সমর্থন দিচ্ছে। অপরদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়াকে সুইসাইড ড্রোন সরবরাহ করে চলেছে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা বলছেন যে, ইরান হয়তো খুব শিগগিরই রাশিয়ার জন্যে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন শুরু করতে পারে। এছাড়াও ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানের হস্তক্ষেপ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্ব রয়েছে।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, প্রায় ১৮ মাস ধরে পারমাণবিক ইস্যুতে যখন ইরানের সাথে পশ্চিমাদের আলোচনা চলমান ছিল, তখন পশ্চিমাদের দৃষ্টি ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের সাথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার দিকে। কিন্তু এখন হয়তো মার্কিনীদের সাথে ইরানের সম্পর্কে নতুন মোড় আসতে যাচ্ছে; যেখানে সংঘাতই প্রাধান্য পাবে। ইরান ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির সাথে পারমাণবিক চুক্তি করে; যা থেকে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের নীতিকে পরিবর্তন করার কথা বললেও এটা এখন পরিষ্কার যে, ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি এখন একটা মৃত বিষয়।

বাইডেন প্রশাসন কিছুদিন আগেই ইরানের উপরে নতুন করে অবরোধ আরোপ করেছে এবং ইরানের সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদেরকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন দেয়া শুরু করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কারবি ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ইরানের সাথে এখন কোন কূটনীতি নেই। পারমাণবিক আলোচনা থমকে রয়েছে এবং এব্যাপারে এখন হোয়াইট হাউজের কোন আগ্রহই নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা ‘দ্যা নিউ নিয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা বৈঠকগুলিতে এখন ইরানের সাথে আলোচনা চালিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোন কথা হয় না; বরং কথা হয় কিভাবে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পকে পিছিয়ে দেয়া যায়; কিভাবে ইরানের সরকারবিরোধীদেরকে যোগাযোগ সুবিধা দেয়া যায়; কিভাবে ইরান থেকে রাশিয়ায় অস্ত্রের সরবরাহকে ব্যাহত করা যায়। তবে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে রাশিয়ার এই সরবরাহ রুটকে ব্যাহত করতে উদ্যত হয়, তাহলে রাশিয়াও ইউক্রেনের সাথে পশ্চিমাদের সামরিক সরবরাহ রুটের উপর হামলা করতে পারে। হেনরি রোম বলছেন যে, হোয়াইট হাউজ একসময় বলতো যে, তারা ইরান ইস্যুকে একটা বাক্সের ভেতরে ভরে রাখতে চায়। কিন্তু এখন মার্কিন সরকারের এই নীতি চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে।

অপরপক্ষে ইরান জানে যে, পশ্চিমাদের সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে চুক্তি করার সাথেসাথেই ইরানকে বোমা তৈরির উপযোগী সকল ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করতে হবে। এই ব্যাপারটা ইরানের কট্টরপন্থীদের কাছে মোটেই পছন্দের ছিল না বিধায় তারা পারমাণবিক আলোচনার ঘোর বিরোধী ছিল। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও কট্টরপন্থীরা ইরানের সাথে যেকোন আলোচনার বিরোধী। ইরানের সাথে আলোচনায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিনিধিত্ব করা রবার্ট ম্যালি গত সপ্তাহে বলেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইরান কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যার ফলে ইরানের সরকার শুধু তার জনগণ থেকেই দূরে সরে যায়নি; তারা ইউরোপের সাথেও দূরত্ব তৈরি করেছে। অথচ ইউরোপিয় দেশগুলিই ইরান ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে নেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।

তবে প্রশ্ন হলো, ইস্রাইলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে নতুন ডানপন্থী সরকার ক্ষমতা নেবার পর ইরানের ব্যাপারে ইস্রাইলের নীতির পরিবর্তন হবে কিনা। নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলার লক্ষ্যে ইরানের উপরে সামরিক হামলার পক্ষপাতি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষমও হয়, তদুপরি ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে এই বোমাকে ব্যবহার করার সক্ষমতা তৈরি করতে ইরানের আরও দুই বছর লাগবে।

তবে মার্কিনীরা যে ইস্রাইলকে আস্বস্ত করতে ব্যস্ত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক কর্মকান্ডে। মার্কিন ডানপন্থী মিডিয়া ‘ফক্স নিউজ’ বলছে যে, গত ২১শে নভেম্বর ইস্রাইলি বাহিনীর চিফ অব স্টাফ আভিভ কোচাভি ওয়াশিংটনে মার্কিন সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভানের সাথে কয়েক দফা আলোচনার পর সামনের সপ্তাহগুলিতে উভয় দেশ বিমান বাহিনীর যৌথ মহড়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা করছে। এই মহড়ার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হবে ইরানের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করা। মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ইস্রাইল যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু ছিল এবং আছে; আর ইস্রাইলের সাথে সহযোগিতা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

ভূরাজনৈতিক দিক থেকে চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিনীদের সামরিক সক্ষমতাকে বিভক্ত করেছে। এমতাবস্থায় ওয়াশিংটনে অনেকেই চাইছে না মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দায়িত্ব বেড়ে যাক। কিন্তু ইরানের বাস্তবতা ওয়াশিংটনকে তার নীতির পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে; যা কিনা মার্কিন সামরিক বাহিনীর বৈশ্বিক অবস্থানকে চাপের মাঝে ফেলছে।

Saturday 19 November 2022

যুক্তরাষ্ট্র কি ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে তার নীতির পরিবর্তন করতে যাচ্ছে?

১৯শে নভেম্বর ২০২২

ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে চীনের সাথে একটা সমঝোতায় পোঁছার চেষ্টায় রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বাইডেন বলেন যে, ইউক্রেনে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একমত হয়েছে; এবং দুই দেশ এব্যাপারে যোগাযোগ রেখে চলবে। তার কথাগুলি যুদ্ধের কারণে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপারে মার্কিন জনগণের মতামতকেই প্রতিফলিত করছে। তদুপরি মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর কংগ্রেসে বিরোধী রিপাবলিকান শিবিরের শক্তিশালী অবস্থান হোয়াইট হাউজকে চাপে রাখবে।

 গত ১৭ই নভেম্বর মার্কিন সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জয়েন্ট চীফ অব স্টাফএর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ইউক্রেন এই মুহুর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। আর এই অবস্থাতেই তারা যদি আলোচনার টেবিলে বসে, তাহলে রুশরা হয়তো কোন একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগুতেও পারে। জেনারেল মিলির কথাগুলি ওয়াশিংটনের ইউক্রেন নীতিতে নতুন সুর যোগ করেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

জেনারেল মিলি বলেন যে, রুশরা প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশি সেনা নিয়ে ইউক্রেন হামলা করে বহু হতাহতের শিকার হয়েছে। কিন্তু তারপরেও যে বাহিনী তারা ইউক্রেনে রেখেছে, তা বেশ শক্তিশালী। আর এর সাথে নতুন করে মোবিলাইজ করা সেনারা যুক্ত হচ্ছে। ইউক্রেনিয়রা রুশদের আক্রমণ সফলভাবে ঠেকাতে পেরেছে; এবং এরপর তারা আক্রমণে গিয়ে খারকিভ এবং খেরসনের বেশকিছু এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে। তবে এই পুনরুদ্ধার করা ভূমি রুশদের দখলীকৃত ভূমির খুব বড় কোন অংশ নয়। রুশদেরকে সামরিকভাবে ইউক্রেনের দখলীকৃত ভূমি থেকে উৎখাত করাটা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। কাজেই ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ক্রিমিয়া সহ ইউক্রেনের পুরো ভূমি থেকে রুশদেরকে বিতাড়িত করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার ইউক্রেন ছেড়ে যাবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখন পর্যন্ত রুশ সামরিক বাহিনী যতটা ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছে, তাতে তারা আলোচনার মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগুলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।

‘সিএনএন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এক সপ্তাহ আগেও জেনারেল মিলি বলেছেন যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেলে ইউক্রেনিয়দের তা হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না। অপদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান বলছেন যে, ওয়াশিংটন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখবে। শান্তিচুক্তির জন্যে টেবিলে বসা হবে কিনা, সেটা ইউক্রেনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোন প্রভাব রাখবে না। জেনারেল মিলি এবং জেইক সুলিভানের এহেন ধোঁয়াশা বক্তব্যে ইউক্রেনে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে, তারা কার কথা শুনবে?

প্রায় একই সময়ে ঘটে যাওয়া আরেকটা ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, ওয়াশিংটন প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনের যুদ্ধকে আরও বড় কোন যুদ্ধের দিকে নিতে ইচ্ছুক নয়। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলে যে, ইউক্রেনের আকাশ থেকে একটা ক্ষেপণাস্ত্র এসে ইউক্রেনের প্রতিবেশী ন্যাটো দেশ পোল্যান্ডে আছড়ে পড়েছে এবং সেখানে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ‘সিএনএন’ বলছে যে, এই খবরটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পৌঁছায় যখন তিনি ‘জি-২০’ শীর্ষ বৈঠকের জন্যে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অবস্থান করছিলেন। খবরটা দিতে ভোর রাতে প্রেসিডেন্টকে ডেকে তোলা হয় এবং তিনি তার কর্মকর্তাদের ছাড়াও পোলিশ প্রেসিডেন্ট এবং ইউক্রেনের নেতৃত্বের সাথে কথা বলে তাদেরকে শান্ত থাকার জন্যে উপদেশ দেন।

‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ন্যাটো সদস্য দেশ হিসেবে পোল্যান্ডের উপরে ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ার এই ঘটনা যদি রুশদের হামলা হিসেবে প্রমাণ হয়, তাহলে প্রশ্ন আসবে যে, জোটের ‘আর্টিকেল-৫’ অনুসারে ন্যাটোভুক্ত বাকি দেশগুলি পোল্যান্ডকে সামরিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসবে কিনা। এই আর্টিকেল অনুসারে জোটের একটা দেশের উপরে হামলা হলে বাকিরাও তাদের উপরে হামলা হয়েছে বলে ধরে নেবে। তবে ঘটনার ২৪ ঘন্টার মাঝেই ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান্স স্টলটেনবার্গ সাংবাদিকদের বলেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রটা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, যা রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে ঘায়েল করতে গিয়ে টার্গেট মিস করে পোল্যান্ডে আছড়ে পড়ে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের পক্ষ থেকেও বলা হয় যে, পোল্যান্ডের উপরে রুশ সামরিক হামলার কোন প্রমাণ মেলেনি।

ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া ‘ফোর্সেস নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘বেলিংক্যাট’এর লেখক ব্রিটিশ সাংবাদিক এলিয়ট হিগিন্স বলছেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া গেছে তা হলো, এটা ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, যা এই মুহুর্তে ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়েই ব্যবহার করছে। তবে প্রমাণাদি দেখে মনে হচ্ছে যে, মিডিয়াতে প্রচারিত খবরটা সত্য নয়। অর্থাৎ এই ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়া ছোঁড়েনি। লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর প্রফেসর মাইকেল ক্লার্ক বলেন যে, পোল্যান্ডের ঘটনাটা ঘটার সাথেসাথেই ইউক্রেন ঘোষণা দেয় যে, ক্ষেপণাস্ত্রটা রুশরা ছুঁড়েছে। কিন্তু বাকি সকলেই বলে যে, তদন্ত সম্পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। ইউক্রেনের চারিদিকে ন্যাটোর গোয়েন্দা বিমানগুলি দিনরাত উড়ছে। কাজেই ইউক্রেনের আকাশে কতগুলি ক্ষেপণাস্ত্র উড়ছে, তা ন্যাটোর অজানা থাকার কথা নয়।

পোল্যান্ডের ঘটনাটা দেখিয়ে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র, তথা পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে মোটেই আগ্রহী নয়। পশ্চিমাদের সামরিক সক্ষমতাও প্রশ্নাতীত নয়। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা শিল্পের কাছ থেকে সময়মতো খুচরা যন্ত্রাংশ পাচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্ত্রের অর্ডার বেড়েছে। কিন্তু সরবরাহ ২০২৪এর মাঝেও সমস্যায় থাকবে। অপরদিকে জেইক সুলিভান ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখার কথা বললেও ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় যাবার ব্যাপারে জেনারেল মিলির বক্তব্যকে বাতিল করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি শান্তি আলোচনার ব্যাপারটা একপ্রকার এড়িয়েই গেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন এই মুহুর্তে পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন সামরিক সহায়তার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। অর্থাৎ ইউক্রেনের যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা পশ্চিমা সহায়তার উপরেই নির্ভর করবে। ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে চীনের সাথে একটা সমঝোতায় পোঁছার চেষ্টায় রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘জি-২০’ বৈঠক থেকে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর সাথে বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাংবাদিকদের বলেন যে, ইউক্রেনে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একমত হয়েছে; এবং দুই দেশ এব্যাপারে যোগাযোগ রেখে চলবে। একইসাথে তিনি বলেন যে, তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভানকে আলোচনা এগিয়ে নিতে বেইজিং যেতে বলেছেন। বাইডেনের কথাগুলি যুদ্ধের কারণে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপারে মার্কিন জনগণের মতামতকেই প্রতিফলিত করছে। তদুপরি মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর কংগ্রেসে বিরোধী রিপাবলিকান শিবিরের শক্তিশালী অবস্থান হোয়াইট হাউজকে চাপে রাখবে।

Friday 11 November 2022

রুশ সেনাদের খেরসন শহর ছেড়ে যাবার কৌশলগত গুরুত্ব

১২ই নভেম্বর ২০২২
 
১১ই নভেম্বর ২০২২। খেরসনের সিটি সেন্টারে ইউক্রেনিয়রা পতাকা উত্তোলন করছে। খেরসনে ইউক্রেনের বিজয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা কোয়ালিশনকে টিকিয়ে রাখবে এবং মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা নিয়ন্ত্রণ নেবার আগেই ইউক্রেনের জন্যে আরও অস্ত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

ইউক্রেন যুদ্ধে আরও একটা বড় ঘটনা ঘটলো রুশ সেনাদের খেরসন শহর ছেড়ে যাবার সাথেসাথে। বেলজিয়ামের আকৃতির ইউক্রেনের দক্ষিণের খেরসন প্রদেশ দখল করে নেবার পরে মস্কো গত সেপ্টেম্বরের শেষে ইউক্রেনের আরও তিনটা প্রদশসহ রাশিয়ার মূল ভূখন্ডের অংশ বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খেরসন শহরের উত্তর-পূর্ব থেকে ইউক্রেনিয় আক্রমণে দেশটার সবচাইতে বড় এবং চওড়া নীপার নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত খেরসন শহরে রুশ সেনাদের অবস্থান হুমকির মাঝে পড়ে যায়। একারণে গত ৯ই নভেম্বর রুশ কর্মকর্তারা খেরসন শহর ছেড়ে যাবার জন্যে রুশ ইউনিটিগুলিকে নির্দেশ দেয়। অনেকেই ধারণা করছিলেন যে, খেরসন শহর ছেড়ে না আসলে কয়েক হাজার রুশ সেনা নদীর ওপাড়ে আটকা পড়তে পারতো। এর মাধ্যমে রুশরা নীপার নদীর পশ্চিম তীরে তাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানটা হারালো। ১১ই নভেম্বর রুশ সেনারা শহর পুরোপুরি ছেড়ে যাবার আগেই ইউক্রেনের কর্মকর্তারা খেরসনে প্রবেশ করে সিটি হলের উপরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। তবে রুশদের মাঝে অনেকের জন্যেই খেরসন ছেড়ে আসাটা ছিল কষ্টকর এবং অপমানজনক। রুশ সাংবাদিক ইউরি কোতিওনোক এক টেলিগ্রাম পোস্টে প্রশ্ন করেন যে, রুশরা কেন সেখানে সকল কিছু ধ্বংস করে এবং জ্বালিয়ে দিয়ে আসলো না?

নীপার নদীর উপরে নোভা কাখভকা বাঁধও ইউক্রেনিয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই বাঁধ ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে সেচের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর সবচাইতে বড় গুরুত্ব হলো এখান থেকে খালের মাধ্যমে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পানি পৌঁছায়। ২০১৪ সালে রুশদের দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপে বড় কোন পানির উৎস নেই। ইউক্রেনিয়রা ক্রিমিয়াতে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। সেজন্যে যুদ্ধের শুরুতেই রুশদের একটা লক্ষ্য ছিল ক্রিমিয়াতে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। এখন ইউক্রেনিয়রা আবারও ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। ইউক্রেনিয় বিশ্লেষক আলেক্সেয় কুশ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, খেরসন শহর নীপার নদীর নদীপথ এবং এর উপরে শিপইয়ার্ডগুলির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও রুশরা এখনও নীপার নদী থেকে কৃষ্ণ সাগরের প্রবেশস্থলে ‘কিনবার্ন স্পিট’এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জেনারেল এবং মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর মিক রায়ান টুইটারে এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, রুশদের খেরসন ছেড়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, রুশরা আত্মসমর্পণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের ইউনিটগুলিকে পুনর্গঠন করছে। রুশরা দুর্বল হলেও তাদের দখলীকৃত অঞ্চলগুলিকে তারা ছেড়ে দেয়ার চিন্তায় নেই। খেরসন থেকে সরিয়ে নেয়া সেনাদেরকে কোথায় মোতায়েন করা হয়েছে, সেটা দেখে বোঝা যাবে যে, রুশ সেনাদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং রুশ জেনারেল সুরভকিন ২০২৩ সালের শুরুতে কিসের উপরে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত কম এলাকা রক্ষা করতে হবে বলে সুরভকিনের পক্ষে তারা সেনাদের সংগঠিত করা কিছুটা সহজ হবে। আর রুশদের অবস্থান শক্ত করার অর্থ হলো যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হওয়া।

 
রুশদের খেরসন ছেড়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, রুশরা আত্মসমর্পণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের ইউনিটগুলিকে পুনর্গঠন করছে। রুশরা দুর্বল হলেও তাদের দখলীকৃত অঞ্চলগুলিকে তারা ছেড়ে দেয়ার চিন্তায় নেই। অপেক্ষাকৃত কম এলাকা রক্ষা করতে হবে বলে সুরভকিনের পক্ষে তারা সেনাদের সংগঠিত করা কিছুটা সহজ হবে। আর রুশদের অবস্থান শক্ত করার অর্থ হলো যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হওয়া।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, খেরসন শহরে রুশরা বিলবোর্ড লাগিয়েছিল, যেখানে রুশ কর্মকর্তাদের বার্তা দিয়েছে যে, ‘রাশিয়া এখানে থাকবে চিরকালের জন্য’। কিন্তু ১০ই নভেম্বর যখন হাজার হাজার রুশ সেনা খেরসন ছেড়ে যাচ্ছিলো, তখন ইউক্রেনিয়রা রুশদের বার্তাগুলিকে কটাক্ষ করছে। যদিও ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলছেন যে, খেরসন রাশিয়ার অংশ ছিল এবং এতে কোন পরিবর্তন হবে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এর মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধে বড় রকমের পরিবর্তন আসলো এবং রুশ ভূরাজনৈতিক সন্মান আবারও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার’ বা ‘আইএসডব্লিউ’ এক বিশ্লেষণে বলছে যে, আসন্ন শীতকাল অপেক্ষাকৃত খারাপভাবে সজ্জিত রুশ সেনাদের জন্যে বেশি কঠিন হবে। অপরদিকে ইউক্রেনিয়রা হয়তো শীতকালেও তাদের আক্রমণ চালিয়ে যেতে পারে। শীতকালে মাটি শক্ত হয়ে যাবার ফলে শরৎকালের কর্দমাক্ত সময়ের তুলনায় ভূমির উপর দিয়ে চলাচল আরও সহজ হবে। ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো রব লী টুইটারে এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, রুশ সেনারা মনোবলের দিকে থেকে ইউক্রেনিয়দের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। একারণে শীতকালের খারাপ আবহাওয়াকেও ইউক্রেনিয়রা সুযোগ হিসেবে নিয়ে তাদের পুনর্দখল করা অঞ্চলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চাইতে পারে।

জার্মানির ‘ব্রিমেন ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর নিকোলায় মিত্রোখিন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, খেরসন হারাবার পরে ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলে রুশদের আক্রমণ করার সক্ষমতা খুবই কমে গেলো। এখন রুশদের হাতে রয়েছে অর্ধ্বচন্দ্রাকৃতির একটা ভূখন্ড। ইউক্রেনিয় সেনারা পরবর্তীতে খেরসন প্রদেশের পূর্বদিকে আজভ সাগরের তীরবর্তী মেলিটোপোল, বেরদিয়ানস্ক এবং মারিউপোলের দিকে আক্রমণ চালালে রুশরা বর্তমানে তাদের হাতে থাকা খেরসন প্রদেশের অঞ্চলগুলিকেও ছেড়ে দিয়ে ক্রিমিয়াতে অবস্থান নিতে বাধ্য হবে। একইসাথে রুশরা যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনের দক্ষিণের ওডেসা বন্দর এবং মলদোভার বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্রান্সনিস্ত্রিয়া অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে নেবার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, তা এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্ট্রাল এশিয়া ডিউ ডিলিজেন্স’এর প্রধান আলিশার ইলখামমভ বলছেন যে, ইউক্রেনে রুশদের সামরিক বিপর্যয়ে রাশিয়ার সন্মান যেমন আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, তেমনি তা মধ্য এশিয়াতে ভূরাজনৈতিক শূণ্যতা তৈরি করেছে। এই শূণ্যতার জায়গাটা নিতে যাচ্ছে চীন এবং তুরস্ক।

জেনারেল মিক রায়ান বলছেন যে, খেরসন ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিতে রুশদেরকে ইউক্রেনের উপরে কৌশলগত হামলা করে যেতে হবে, যাতে করে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে থাকে। এক্ষেত্রে ইরানের কাছ থেকে আমদানি করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কাজে আসতে পারে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক লেখায় ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর ফেলো ম্যাক্স বুট বলছেন যে, খেরসনে ইউক্রেনের বিজয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা কোয়ালিশনকে টিকিয়ে রাখবে এবং মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা নিয়ন্ত্রণ নেবার আগেই ইউক্রেনের জন্যে আরও অস্ত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। রুশ বিশ্লেষক পাভেল লুজিন ‘দ্যা ইনসাইডার’এর এক লেখায় বলছেন যে, রাশিয়ার সামনে এখন কোন কষ্টহীন পথ নেই। যদি ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তাহলে হয়তো বাকি দুনিয়া থেকে আরও বেশি দূরে সরে যেতে হতে পারে। আর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলে বড় কোন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।

Thursday 3 November 2022

সেভাস্তোপোলের রুশ নৌঘাঁটিতে ইউক্রেনিয় হামলার কৌশলগত গুরুত্ব

০৩রা নভেম্বর ২০২২
 
ইউক্রেনের সুইসাইড ড্রোন বোটগুলি শেষ পর্যন্ত ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়েছে। এরকমই একটা ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, রুশ 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার থেকে বোটের দিকে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। একটা যুদ্ধজাহাজ কতগুলি সুইসাইড বোট ঠেকাতে পারবে, সেই সংখ্যাটা নির্দিষ্ট। আর সবগুলি বোটের মোট খরচও সর্বদাই যুদ্ধজাহাজের খরচের চাইতে অনেক কম হবে। সকলেই এখন ইউক্রেনের যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।

গত ২৯শে অক্টোবর ইউক্রেনিয়রা রুশ কৃষ্ণ সাগরীয় নৌবহরের হেডকোয়ার্টার্স সেভাস্তোপোলে বড়সড় হামলা করে।হামলার মূল টার্গেট ছিল রুশ নৌবহরের যুদ্ধজাহাজগুলি। আর হামলা করা হয় ইউক্রেনের নৌবাহিনীর নিজস্ব ‘ম্যারিন ড্রোন’ বা মনুষ্যবিহীন সুইসাইড বোটের মাধ্যমে। একইসাথে আকাশ থেকেও মনুষ্যবিহীন বিমান ড্রোনের মাধ্যমে হামলা করা হয়। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন যে, রুশ কৃষ্ণ সাগরীয় নৌবহরের ফ্ল্যাগশিপ ফ্রিগেট ‘এডমিরাল মাকারভ’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরদিকে রুশরা বলছে যে, শুধু একটা মাইনসুইপার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনিয়দের প্রকাশ করা একটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, রুশ ‘এমআই-৮’ হেলিকপ্টার থেকে ড্রোন বোটকে লক্ষ্য করে মেশিন গানের গুলি ছোঁড়া হচ্ছে; যা বোটের আশেপাশে পানিতে আছড়ে পড়ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই ড্রোনটা হয়তো তার টার্গেটে পৌঁছাবার আগেই ধ্বংস হয়েছিল। হামলার কিছু সময় পরেই রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলে যে, যে জাহাজগুলির উপর ইউক্রেনিয়রা হামলা করেছে, সেগুলি ইউক্রেনের শষ্য রপ্তানির জাহাজগুলিকে রক্ষা করছিল। সেই হিসেবে রাশিয়া ইউক্রেনের শষ্য রপ্তানির চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়।

হামলার বর্ণনা

আপাততঃ পাওয়া প্রমাণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রুশরা ইউক্রেনের ড্রোনগুলির মাঝে বেশ কতগুলির বিরুদ্ধে সফলতা পেয়েছিল। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, এই হামলা চালায় ইউক্রেনের ‘৭৩তম ম্যারিন স্পেশাল ফোর্সেস সেন্টার’; যাদেরকে সহায়তা দিয়েছে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেনিয়রা কমপক্ষে ৭টা ম্যারিন ড্রোন এবং ৯টা বিমান ড্রোন ব্যবহার করেছিল। একটা ড্রোন সম্ভবতঃ ইউক্রেনের শষ্য রপ্তানির করিডোর ব্যবহার করেছে। সেখানে ইউক্রেনিয় বা পশ্চিমা একটা বাণিজ্য জাহাজ থেকে এই ড্রোন পানিতে ভাসানো হয়েছে। তারা আরও বলছে যে, সবগুলি বিমান ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে; আর ম্যারিন ড্রোনগুলির মাঝে ৪টা সমুদ্রে, আর ৩টা ভূমিতে ধ্বংস করা হয়েছে। বিবৃতিতে মাইনসুইপার জাহাজ ‘আইভান গোলুবেতস’এর স্বল্প ক্ষতি হবার কথা স্বীকার করা হয়। ‘নেভাল নিউজ’এর এক লেখায় তুর্কি নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, প্রমাণাদি দেখে ব্যাপারটা ভিন্ন মনে হয়। কারণ রুশ ‘এডমিরাল গ্রিগোরোভিচ-ক্লাস’এর একটা ফ্রিগেটের খুবই কাছ থেকে ড্রোন ফুটেজ দেখা যায়; যেখানে ফ্রিগেটটা নিজেকে রক্ষা করতে কিছুই করছে না বলে আপাতদৃষ্টে মনে হয়।

ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য এবং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক এইচ আই সাটন মনে করছেন যে, এর আগে রুশ নৌবাহিনীর ক্রুজার ‘মস্কভা’ ডুবে যাবার মতো সেভাস্তোপোলে ইউক্রেনের হামলাও নৌ ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচিত হবে। অনেক নৌবাহিনীই হয়তো এধরণের ড্রোন বোটের কথা ভেবেছে। কিন্তু ইউক্রেনই প্রথম এটা করে দেখিয়েছে। এতকাল যাবত ড্রোনের ক্যামেরা থেকে পাওয়া ফুটেজে টার্গেটকে আকাশ থেকে নিচে দেখা গিয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো টার্গেটের পাশ থেকে ড্রোন ফুটেজ দেখা গেলো।

ড্রোন বোট হামলার ইতিহাস

তবে রিমোট কন্ট্রোল ড্রোন বোটের ব্যবহার এর আগে হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯১৭ সালে জার্মানরা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের উপরে রিমোট কন্ট্রোল বোট দিয়ে হামলা করেছিল; যদিও তা সফলতা পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ইতালি, জাপান, ব্রিটেন এবং জার্মানি মূলতঃ মনুষ্যচালিত বোটের মাধ্যমে শত্রু জাহাজের উপরে হামলা করে। জার্মানরা টার্গেটে আঘাত করার আগে শেষ দুই মাইল মনুষ্যচালিত কমান্ড বোট থেকে ড্রোন বোট নিয়ন্ত্রণ করতো। ড্রোন বোটগুলিতেও পাইলট থাকতো; যারা শেষ মুহুর্তে বোট থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তো। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭ এবং ২০২২ সালে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা বিস্ফোরক বহণ করা বোট দিয়ে সৌদি এবং আমিরাতি যুদ্ধজাহাজের উপরে হামলা করে।

তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, ২০০০ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘কোল’এর উপর ইয়েমেনের আদেন বন্দরে হামলা হবার পর পশ্চিমা নৌবাহিনীগুলি নিজেদের বন্দর ও জাহাজগুলির নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। কারণ এহেন হামলা এমন সময়ে করা হয়, যখন একটা যুদ্ধজাহাজ সবচাইতে দুর্বল অবস্থানে থাকে। বন্দরে থাকা অবস্থায় জাহাজগুলি নিজেদের অস্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে না। ২০০০ সালের এই ঘটনাকে পুঁজি করে নিজেদের নৌবাহিনী তৈরি করেছে ইরান। মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলি বড় জাহাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে তৈরি হলেও বহু সংখ্যক ছোট বোটের সমন্বিত হামলা মোকাবিলা করার জন্যে তৈরি করা হয়নি।

 
সেভাস্তোপোল বন্দরের স্যাটেলাইট ছবি। সেভাস্তোপোল সামরিক ঘাঁটির মুখটা বেশ সরু এবং সেখানে যেকোন জাহাজ ঢোকার মুখে চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়াও বন্দরের বাইরে রয়েছে নৌবাহিনীর প্যাট্রোল। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বন্দরের বাইরে এবং ভিতরে রুশ প্যাট্রোল ম্যারিন ড্রোনগুলিকে বাধা দিয়েছিল। তথাপি দু’টা ম্যারিন ড্রোন বন্দরের ভেতরে কোনভাবে ঢুকে পড়ে। রাশিয়া যেখানে ৯ মাস ধরে যুদ্ধরত, তখন সেভাস্তোপোল বন্দরে ঢোকার মুখে একটা ড্রোন বোটকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বা বোটগুলিকে রুশরা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হবে; এটা মেনে নেয়া যায় না।

কিভাবে এবং কি দিয়ে এই হামলা সম্ভব হলো?

সেভাস্তোপোল সামরিক ঘাঁটির মুখটা বেশ সরু এবং সেখানে যেকোন জাহাজ ঢোকার মুখে চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়াও বন্দরের বাইরে রয়েছে নৌবাহিনীর প্যাট্রোল। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বন্দরের বাইরে এবং ভিতরে রুশ প্যাট্রোল ম্যারিন ড্রোনগুলিকে বাধা দিয়েছিল। তথাপি দু’টা ম্যারিন ড্রোন বন্দরের ভেতরে কোনভাবে ঢুকে পড়ে। তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, রাশিয়া যেখানে ৯ মাস ধরে যুদ্ধরত, তখন সেভাস্তোপোল বন্দরে ঢোকার মুখে একটা ড্রোন বোটকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বা বোটগুলিকে রুশরা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হবে; এটা মেনে নেয়া যায় না। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে, রুশ হেলিকপ্টারগুলি বোটগুলির উপরে মেশিনগান দিয়ে গুলি করছে। কিন্তু এধরণের ছোট এবং দ্রুতগামী টার্গেট ধ্বংস করতে হয়তো নিখুঁত নিশানার ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।

ইউক্রেনিয়দের এহেন ম্যারিন ড্রোনের কথা জানা যায় গত সেপ্টেম্বরে; যখন একটা ড্রোন বোট ক্রিমিয়া উপদ্বীপের ওমেগা উপসাগর উপকূলে ভেসে আসে। এইচ আই সাটন এই বোটের একটা বিশ্লেষণ করেছেন। এর ইঞ্জিন খুব সম্ভবতঃ পানিতে খেলাধূলার জন্যে ব্যবহৃত জেটস্কির ওয়াটারজেট ইঞ্জিন। খুব সম্ভতঃ কানাডিয় কোম্পানি ‘সীডু’এর তৈরি জেটস্কির ইঞ্জিন এতে লাগানো হয়েছে। বোটের সামনে দু’টা সোভিয়েত ডিজাইনের ফিউজ (ইউপি-৫৮১) ব্যবহার করা হয়েছে। এই ফিউজগুলি দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে, এর ওয়ারহেড ছিল হয়তো ‘এফএবি-৫০০’ বোমা। একটা ঘুর্নায়মান ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ক্যামেরার মাধ্যমে টার্গেটের ছবি তুলতে পারে বোটটা। এই ক্যামেরা দিয়ে তোলা ভিডিওই ইউক্রেনিয়রা প্রকাশ করেছে। বোটের ন্যাভিগেশন আসছে এর উপরে বসানো স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট এন্টেনা থেকে।

‘দ্যা ড্রাইভ’ ম্যাগাজিনের প্রতিরক্ষা সেকশন ‘ওয়ারজোন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এই বোটগুলি ইউক্রেনের উপকূল থেকে ছাড়ার অর্থ হলো যথেষ্ট পরিমাণে জ্বালানি বহণ করতে হবে; যা কিনা বহণকৃত বিস্ফোরকের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। এগুলিকে ডিজাইন করা হয়েছে দূরপাল্লার টার্গেটে আঘাত হানার জন্যে; যা থাকবে সরাসরি দৃষ্টির পাল্লার বাইরে। তবে সেই দূরত্বেও সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এর অর্থ হলো, বিশ্বের যেকোন বন্দর এখন এধরণের হামলার আওতায় পড়তে পারে। এরকম দূরত্ব থেকে বোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারার অর্থ হলো, অস্থায়ী টার্গেটেও হামলা করা সম্ভব হবে; প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও এড়াতে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে; ঐ মুহুর্তে কোন সুযোগ হাজির হলে সেটাও কাজে লাগানো যাবে। কারণ বোটটাকে শেষ পর্যন্ত কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এবং দরকার হলে এর দিক পরিবর্তন করতে পারছে। এই ব্যাপারটা নৌযুদ্ধের ক্ষেত্রে অনেক বড় নতুনত্ব। এতকাল সুইসাইড ড্রোন বোট অপারেট করেছে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে যে, এই চিন্তাটা যখন আরও উন্নততর কোন শক্তি লুফে নেবে, তখন এগুলির সক্ষমতা কেমন হতে পারে।

গত সেপ্টেম্বরে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে ভেসে আসা ড্রোন বোটটা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা উপকূল থেকে প্রায় ২’শ ৮০ কিঃমিঃ দূরে ছিল। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয় যে, ড্রোনগুলি এসেছে ইউক্রেনের ওচাকভ এলাকা থেকে; যা কিনা সেভাস্তোপোল থেকে প্রায় ২’শ ৪০ কিঃমিঃ দূরে। ‘ডিফেন্স আপডেট’এর এক লেখায় ইস্রাইলি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক তামির এশেল বলছেন যে, এর অর্থ হলো, এই লম্বা দূরত্ব এই বোটগুলি অতিক্রম করেছে রুশদের দৃষ্টি এড়িয়ে। আর সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেনিয় ড্রোন ক্রিমিয়ার উপকূলে আবিষ্কার হবার পরে রুশরা তাদের জাহাজগুলিকে খোলা সমুদ্রে প্যাট্রোল থেকে সরিয়ে সেভাস্তোপোল বন্দরের ভিতরে জমা করে; যে সুযোগ ইউক্রেনিয়রা কাজে লাগায় বন্দরের ভিতরে হামলা করে। একসাথে ম্যারিন এবং বিমান ড্রোন ব্যবহার করার ফলে ঐ মুহুর্তে ইউক্রেনিয়রা সর্বশেষ ইন্টেলিজেন্স পায় এবং সেগুলিকে সঠিকভাবে সমন্বয় করতে সক্ষম হয়। একইসাথে ইউক্রেনিয়রা ঘাঁটির মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে রুশদের হতভম্ব করে ফেলে।

সেপ্টেম্বর মাসে ক্রিমিয়ার উপকূলে ভেসে আসা ইউক্রেনিয় ড্রোন বোট। একটা ড্রোন বোট তৈরিতে হয়তো বেশ কয়েক হাজার ডলার খরচ হবে। তবে তা লক্ষ ডলারের কাতারে যাবে না। এর তুলনায় অনেক আধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য মিলিয়ন ডলারও হয়ে থাকে। একটা জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র খুব অল্প সংখ্যক রাষ্ট্রই তৈরি করতে পারে; কিন্তু এরকম একটা সুইসাইড বোট অনেকেই তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।

তেইফুন ওজবেরক রুশ কৃষ্ণ সাগরীয় নৌবহরের সমালোচনা করে বলছেন যে, তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে না। এর আগে তারা ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্রের হাতে ক্রুজার ‘মস্কভা’ এবং একটা গুরুত্বপূর্ণ টাগবোট হারিয়েছে। এছাড়াও তুর্কিদের নির্মিত ড্রোনের হামলায় তাদের বিভিন্ন প্যাট্রোল বোট ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধজাহাজ ‘মস্কভা’ আক্রান্ত হবার আগে রুশ ইন্টেলিজেন্স যদি সঠিক তথ্য দিতে পারতো যে, ইউক্রেনের জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলি উপকূলে অপারেশনাল রয়েছে, তাহলে জাহাজটাকে ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে রাখা যেতো। আর ইউক্রেনের হাতে মার্কিন ‘হারপুন’ জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে জেনেও রুশরা তাদের টাগবোট স্নেইক আইল্যান্ডের কাছে পাঠিয়েছিল। ‘মস্কভা’ হারাবার পর রুশরা উপকূলীয় অঞ্চলে আকাশের নিয়ন্ত্রণ হারায়। এরপরেও তারা হাল্কা বিমান প্রতিরক্ষা সজ্জিত প্যাট্রোল বোটগুলিকে উপকূলের কাছে পাঠায়; যেখানে সেগুলিকে ইউক্রেনের ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোনগুলি ধ্বংস করে। ‘মস্কভা’ হারাবার সময় বহু দেশের মতো রুশদেরও একই বাস্তবতা ছিল – তাদের নৌবাহিনী কয়েক দশক ধরে কোন যুদ্ধ করেনি। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রথম ঘটনার পরে তো তাদের শিক্ষা নেবার কথা; যা তারা নেয়নি। সেপ্টেম্বর মাসে সেভাস্তোপোলের কাছে যখন একটা ইউক্রেনিয় ড্রোন পাওয়া যায়, তখন রুশদের বোঝা উচিৎ ছিল যে, ইউক্রেনিয়রা সেভাস্তোপোলে রুশ নৌবহরের উপরে হামলার পরিকল্পনা করছে। পাঁচ সপ্তাহের আগাম সতর্কতা পাবার পরেও তারা সেভাস্তোপোলের নিরাপত্তা যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের উপর সেভাস্তোপোল হামলার সম্ভাব্য ফলফল


এইচ আই সাটন মনে করছেন যে, আক্রমণে রুশ নৌবাহিনীর কোন জাহাজ সম্ভবতঃ ডুবে যায়নি। তথাপি এর কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এতে রুশদের দৃষ্টি অন্য দিকে সড়ে যাবে এবং ঘাঁটি হিসেবে সেভাস্তোপোলকে হুমকির মাঝে রাখবে। রুশ নৌবাহিনীর ইউনিটগুলি ভবিষ্যতে কোথায় কিভাবে মোতায়েন করা হবে, তা এই ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবে।

তেইফুন ওজবেরকএর মতে, ইউক্রেনিয়রা এর আগে যেসব হামলা করেছে, সেগুলির কৌশলগত প্রভাব ছিল যথেষ্ট। সেই হামলাগুলি রুশ সামরিক বাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। বিশেষ করে রুশ নৌবাহিনীর ক্রুজার ‘মস্কভা’ ডুবে যাওয়া এবং ক্রিমিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কার্চ সেতুর উপরে হামলা রুশ সামরিক বাহিনীর সন্মানহানি করেছে। এখন ফ্রিগেট ‘এডমিরাল মাকারভ’এর উপরে হামলা সেই আঙ্গিকে ইউক্রেনের সাফল্য এবং রুশদের সন্মনহানি; যেখানে খুব ভালো ইন্টেলিজেন্স এবং নেটওয়ার্ক ভিত্তিক যুদ্ধক্ষমতার ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে রুশদের এই ব্যর্থতাগুলি দেখিয়ে দেয় যে, একেবারে সাধারণ সামরিক বিষয়গুলি, যেমন বন্দরের নিরাপত্তা দেয়া, নজর রাখতে পারা, এবং শত্রুর শক্তি বিচার করতে পারার মতো সক্ষমতার ক্ষেত্রে রুশরা যথেষ্ট পারঙ্গম নয়।
 
'এডমিরাল গ্রিগোরোভিচ-ক্লাস'এর ফ্রিগেট 'এডমিরাল মাকারভ', যা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনের ড্রোন বোটগুলি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এহেন হামলা এমন সময়ে করা হয়, যখন একটা যুদ্ধজাহাজ সবচাইতে দুর্বল অবস্থানে থাকে। বন্দরে থাকা অবস্থায় জাহাজগুলি নিজেদের অস্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে না।

নৌ-যুদ্ধকৌশলের উপরে দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কেমন হতে পারে?

‘দ্যা ওয়ারজোন’এর এক লেখায় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক টাইলার রোগোওয়ে বলছেন যে, এধরণের একটা ড্রোন বোট তৈরিতে হয়তো বেশ কয়েক হাজার ডলার খরচ হবে। তবে তা লক্ষ ডলারের কাতারে যাবে না। এর তুলনায় অনেক আধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য মিলিয়ন ডলারও হয়ে থাকে। খরচ কম রাখার একটা পদ্ধতি হলো বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায় এমন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা। একইসাথে স্যাটেলাইট যোগাযোগের মতো বিভিন্ন প্রযুক্তি এখন কম খরচে যে কেউই পেতে পারে; যা এরকম দূরপাল্লার হামলাকে সম্ভব করছে। একটা জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র খুব অল্প সংখ্যক রাষ্ট্রই তৈরি করতে পারে; কিন্তু এরকম একটা সুইসাইড বোট অনেকেই তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। আর কোন বন্দরের প্রতিরক্ষাই নিশ্ছিদ্র নয়। সকল নিরাপত্তাই নেয়া হয় অতীতে যা ঘটেছে সেটার উপর নির্ভর করে; ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে সেটা চিন্তা করে নয়।

রোগোওয়ে বলছেন যে, এরকম সুইসাইড ড্রোন যদি কোন বাণিজ্যিক জাহাজে করে দূরবর্তী এলাকায় নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে এরকম হামলা পৃথিবীর যেকোন অঞ্চলেই করা সম্ভব হতে পারে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে প্রচুর বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল রয়েছে, সেখানে বহু জাহাজের প্রপেলারের শব্দের মাঝে এরকম একটা ছোট ড্রোন বোটের শব্দ খুঁজেই পাওয়া যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্য রুটগুলির মাঝ দিয়ে যাবার সময় মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলিকে বেশ ধীরগতিতে যেতে হয়। এরকম সময়ে বহু দিক থেকে বিপুল সংখ্যক ম্যারিন ড্রোনের হামলা ঠেকানো বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে যেতে পারে। আর এর সাথে যদি বিমান ড্রোন যুক্ত হয় তাহলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সামরিক ঘাঁটিগুলি এরকম হামলার হুমকিতে থাকবে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা করার মাধ্যমেও সামরিক সাপ্লাই চেইনে বিশৃংখলা তৈরি করা সম্ভব।

এইচ আই সাটন বলছেন যে, যদিও অনেকেই এধরনের ড্রোনের ব্যাপারে চিন্তা করেছে, তথাপি অনেকগুলি ম্যারিন ড্রোন একত্রে একটা টার্গেটের উপরে হামলা করার ঘটনা এবারই প্রথম। আর ড্রোন বোটগুলি অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী হওয়ায় অনেকেই এগুলি তৈরির চেষ্টা চালাবে। এরকম একটা ড্রোন খুব বড় হুমকি না হলেও অনেকগুলি একত্রে প্রভাব তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে এই ড্রোনগুলিকে কিভাবে প্রতিহত করা হবে, সেটা চিন্তা করে অনেক সিদ্ধান্তই পরিবর্তিত হবে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ বা সামুদ্রিক মাইন অপসারণে বর্তমানে ব্যবহৃত ম্যারিন ড্রোনগুলি তাদের অবস্থান ধরে রাখবে অবশ্যই। তবে এর সাথে নতুন অস্ত্র হিসেবে এই সুইসাইড ম্যারিন ড্রোনও যুক্ত হবে। প্রকৃতপক্ষে, অনেক ধরণের ম্যারিন ড্রোনের মাঝে এরকম আক্রমণকারী ড্রোনকেই সকলে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।

অপরদিকে তেইফুন ওজবেরক বলছেন যে, একসাথে আকাশ এবং সমুদ্র থেকে অনেকগুলি ড্রোনের হামলা দেখিয়ে দেয় যে, স্বল্প খরচের এই অস্ত্রগুলি শতশত মিলিয়ন ডলারের যুদ্ধজাহাজগুলির জন্যে কতবড় হুমকি হতে পারে। ভবিষ্যতে বড় যুদ্ধজাহাজগুলিতে যদি এরকম হামলা ঠেকাবার জন্যে যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা না হয়, তাহলে সেগুলির নিরাপত্তা দেয়া কঠিন হবে। টাইলার রোগোওয়ে বলছেন যে, একটা যুদ্ধজাহাজ কতগুলি সুইসাইড বোট ঠেকাতে পারবে, সেই সংখ্যাটা নির্দিষ্ট। আর সবগুলি বোটের মোট খরচও সর্বদাই যুদ্ধজাহাজের খরচের চাইতে অনেক কম হবে। সকলেই এখন ইউক্রেনের যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, ইরান এবং উত্তর কোরিয়াও এখান থেকে শিখছে; যারা ভবিষ্যতে কোন সুযোগে এরকম সুইসাইড ড্রোন বোট দিয়ে সমুদ্র ছেয়ে ফেলতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু পশ্চিমা দেশগুলিরও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে অত্যন্ত দ্রুত এরকম ড্রোন তৈরি করার। কাজেই অতি শিগগিরই এরকম সুইসাইড ড্রোন বোট ডেভেলপ করার প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে; যেখানে বড় বা ছোট সকল দেশই অংশ নেবে।



সূত্রঃ
‘Ukraine's New Drone Boats That Will Change Naval Warfare, Explained’ by H.I. Sutton, 31 October 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=C_tvZufo4hE)
‘Analysis: Ukraine strikes with Kamikaze USVs – Russian bases are not safe anymore’ by Tayfun Ozberk in Naval News, 30 October 2022
‘Ukraine’s New Weapon To Strike Russian Navy In Sevastopol’ by H.I. Sutton in Naval News, 21 September 2022
‘Coordinated Drone Attack Targets the Russian Black Sea Fleet at Sevastopol’ by Tamir Eshel, in Defense Update, 30 October 2022 (https://defense-update.com/20221030_coordinated-drone-attack-targets-the-russian-black-sea-fleet-at-sevastopol.html)
‘Ukraine’s Unprecedented Mass Drone Boat Attack Was A Wakeup Call’ by Tyler Rogoway, in The Warzone, 01 November 2022 (https://www.thedrive.com/the-war-zone/ukraines-unprecedented-mass-drone-boat-attack-was-a-wakeup-call)
‘Ukraine Unleashes Mass Kamikaze Drone Boat Attack On Russia’s Black Sea Fleet Headquarters’ in The Warzone, 29 October 2022 (https://www.thedrive.com/the-war-zone/ukraine-unleashes-mass-kamikaze-drone-boat-attack-on-russias-black-sea-fleet-headquarters)
‘Russia says it has recovered, analyzed drones used to attack its fleet in Crimea’ by Reuters in Al-Arabiya News, 30 October 2022

Wednesday 2 November 2022

সুইসাইড ড্রোন … এটাই কি যুদ্ধের ভবিষ্যৎ?

০২রা নভেম্বর ২০২২
 
সুইসাইড ড্রোনগুলির অধিকাংশেরই টার্গেট ছিল ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনা। এই হামলার ফলে শীতকাল আসার ঠিক আগেআগেই ইউক্রেনের শহরগুলিতে জ্বালানি ও খাবার পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। বেসামরিক টার্গেটের উপর হামলা করে প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টাটা পশ্চিমা যুদ্ধচিন্তারই ফসল; যা নতুন নয়। এই লক্ষ্যের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ চিন্তার কারণেই এর আকর্ষণ এখনও দুর্নিবার।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের শহরগুলির উপরে রুশ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াগুলি ব্যাপক সরব রয়েছে। রাশিয়া এবং ইরান অস্বীকার করলেও রুশদের ব্যবহৃত ‘কামিকাজি’ বা ‘সুইসাইড’ ড্রোনগুলি যে মূলতঃ ইরানের সরবরাহ করা ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন, সেব্যাপারে অনেকেই একমত হয়েছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন যে, এই ড্রোনগুলি রাশিয়া ইরান থেকে কিনলেও সেগুলির গাইড্যান্স সিস্টেমকে তারা নিজেদের সুবিধামত পরিবর্তন করে নিয়েছে। এই ড্রোনগুলি ছেড়ে দেয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে টার্গেটের এলাকায় পৌঁছে টার্গেটের কাছাকাছি উড়তে থাকে এবং নিশ্চিত হবার পরে টার্গেটের উপর আত্মঘাতী হামলা করে। ‘বিজনেস ইনসাইডার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বেশ ছোট আকৃতির এই ড্রোনগুলি প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কেজি ওয়ারহেড বহণ করে প্রায় ২ হাজার কিঃমিঃ দূরত্বের টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম।

তবে ইউক্রেনিয় এবং রুশ উৎস থেকে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, এই সুইসাইড ড্রোনগুলির অধিকাংশেরই টার্গেট ছিল ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনা; বিশেষ করে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সেতু, রাস্তা ও রেল নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সেবা ও স্থাপনা। এই হামলার ফলে শীতকাল আসার ঠিক আগেআগেই ইউক্রেনের শহরগুলিতে জ্বালানি ও খাবার পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। আসন্ন শীতে ইউক্রেনের বেশিরভাগ মানুষকেই বাড়িতে হীটার ছাড়া বাস করতে হবে। সরকার মানুষকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে নির্দেশ দিয়েছে। আর জ্বালানি সরবরাহে সংকটের কারণে ইউক্রেন সরকার দেশের বাইরে থাকা ইউক্রেনিয়দেরকে দেশে ফিরতে নিষেধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একদিকে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার নিয়ে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট নির্ধারণ করা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে।

‘কার্নেগি কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো আর্থার হল্যান্ড মিশেল ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, খুবই কম খরচে তৈরি ছোট্ট এই ড্রোনগুলি ভূমির খুব কাছ দিয়ে ওড়ে বলে এগুলি সহজে রাডারে ধরা পড়ে না এবং একারণে এগুলির অনেকগুলিই টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। প্রচলিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত বিমান হামলা ঠেকাতে অনেক সময় ধরে প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে পেরেছে। সেই তুলনায় ড্রোনের হুমকিটা অনেক নতুন। বেশিরভাগ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাই এগুলিকে খুঁজে বের করতে বা ভূপাতিত করতে ডিজাইন করা হয়নি। ইউক্রেন এই ড্রোনগুলির বেশ কয়েক’শ ভূপাতিত করলেও সেগুলিকে ধ্বংস করার খরচ অত্যধিক বেশি ছিল। কয়েক হাজার ডলারের একটা ড্রোনকে ধ্বংস করতে মিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। আর ইউক্রেন রুশদের দখল করা ভূমি যতই পুনরুদ্ধার করুক না কেন, দূরপাল্লার হবার কারণে এই ড্রোনগুলি ইউক্রেনের যেকোন স্থানে হামলা করতে সক্ষম হবে। আর যতক্ষণ ইউক্রেনিয়রা এই ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করার সাশ্রয়ী কোন পদ্ধতি বের করতে না পারবে, ততক্ষণ এগুলি যুদ্ধের উপরে অনেক বড় প্রভাব রাখবে। এই অস্ত্রটার ধরণটাই এমন যে, এগুলি বিশ্বব্যাপী জনমতের উপরে একটা মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে।

 
রাশিয়া এবং ইরান অস্বীকার করলেও রুশদের ব্যবহৃত ‘কামিকাজি’ বা ‘সুইসাইড’ ড্রোনগুলি যে মূলতঃ ইরানের সরবরাহ করা ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন, সেব্যাপারে অনেকেই একমত হয়েছেন। আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের সুইসাইড ড্রোনের কার্যক্ষমতা ইতোমধ্যেই অনেকেই প্রভাবিত করছে তাদের সমরচিন্তাতে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ইউক্রেনে ব্যবহৃত সুইসাইড ড্রোনগুলি সিরিয়ার যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেই যুদ্ধের ফলেই এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির কাছ থেকে ড্রোন কিনতে না পেরে অনেক দেশই নিজস্ব ড্রোন ডেভেলপ করতে শুরু করেছে। এর মাঝে তুরস্ক সকলের চাইতে এগিয়ে রয়েছে। ‘আল জাজিরা’কে দেয়া এক সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটি’র ‘স্কার স্কুল অব পলিসি এন্ড গভর্ন্যান্স’এর ফেলো জাকারি কেলেনবর্ন বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ দিয়েছে যে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকা দেশগুলিও যুদ্ধে ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার করবে। এগুলির সামরিক ব্যবহার সকলের সামনে উন্মুক্ত হবার কারণে এই দেশগুলি চিন্তা করবে যে, এগুলিকে কিভাবে আরও উন্নত করা যায় এবং অন্যান্য কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করে এগুলিকে আরও কর্মক্ষম করা যায় বা টার্গেটিং কিভাবে আরও ভালো করা যায়।

বিংশ শতকের যুদ্ধের ইতিহাসে শত্রুপক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের উপরে ব্যাপক বোমাহামলার উদাহরণ রয়েছে অনেক। মূলতঃ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলি ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ফলগুলি ব্যবহার করে এধরণের যুদ্ধচিন্তার জন্ম দিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা উপনিবেশ থেকে সৃষ্ট নতুন জাতিরাষ্ট্রগুলিও এধরণের চিন্তাকে আলিঙ্গন করতে শুরু করে। ‘জেরুজালেম পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনার উপর রুশদের ড্রোন হামলাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘কারপেট বম্বিং’এর সাথে তুলনা করা হয়। ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনী সেই বোমা হামলাকে ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বিং’ বা কৌশলগত বোমাহামলা বলে আখ্যা দিলেও এর মাধ্যমে মূলতঃ বেসামরিক নাগরিকই হতাহত হয়েছে। এছাড়াও রুশদের ড্রোন হামলা অনেকটাই ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ে ‘শহরের যুদ্ধ’এর মতো; যখন উভয় দেশই একে অপরের শহরের উপরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় রুশদের এই হামলাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ‘ভি-১’ ‘ফ্লাইং বম্ব’ বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে তুলনা করা হয়। বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানরা ব্রিটিশ শহরগুলির উপরে নতুন ডেভেলপ করা এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে; যা কিনা পাইলটবিহীন জেট বিমানের মতো এবং যা টার্গেটের উপর আত্মঘাতী হামলা করে। লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর প্রফেসর মাইকেল ক্লার্ক ব্রিটেনের ‘দ্যা টাইমস’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার মাত্র আড়াই মাস আগে প্রায় হেরে যাওয়া জার্মানির ড্রেসডেন শহরের বেসামরিক মানুষের উপরে মিত্র বাহিনীর মারাত্মক বিমান হামলা থেকে শুরু করে ভিয়েতনামে মার্কিন বোমা হামলা পর্যন্ত ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বিং’ আখ্যা দেয়া হামলাগুলি ভালো কোনো ফলাফল বয়ে আনেনি।

আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের সুইসাইড ড্রোনের কার্যক্ষমতা ইতোমধ্যেই অনেকেই প্রভাবিত করছে তাদের সমরচিন্তাতে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্স’এর সিনিয়র ফেলো আলরিকা ফ্রাঙ্কা ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, রুশ সুইসাইড ড্রোনগুলি ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও দুর্বল করে ফেলছে। তবে বেসামরিক টার্গেটের উপর হামলা করে প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টাটা পশ্চিমা যুদ্ধচিন্তারই ফসল; যা নতুন নয়। এই লক্ষ্যের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ চিন্তার কারণেই এর আকর্ষণ এখনও দুর্নিবার।