Friday 26 August 2016

একটা রাষ্ট্রকে যেভাবে দুর্বল করা হয়……

২৬ অগাস্ট ২০১৬

  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফাইটার বিমানের মাঝে একটি ছিল Republic P-47 Thunderbolt. বিমানটি তৈরি করেছিল Republic নামের একটি বিমান নির্মাতা কোম্পানি। আমাদের দেশের প্রথম যুদ্ধবিমানের নাম কি হবে – Akij P-88, নাকি Bashundhara X-3, নাকি PHP N-52, নাকি অন্য কোন নাম?
ঘটনা ১-

১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত সুরক্ষিত মার্কিন নৌ এবং বিমান ঘাঁটি পার্ল হারবারের মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা লক্ষ্য করলো যে সকালের আকাশে ঝাঁক বেঁধে গগন-বিদারী শব্দে আবির্ভূত হয়েছে জাপানি নৌবাহিনীর ‘রাইজিং সান’ মার্কিং-এর শতশত যুদ্ধবিমান। আক্রমণকারী বাহিনীর প্রথম বহরে ছিল ১৮৩টি বিমান – ৮৯টি Nakajima B5N বোমারু এবং টর্পেডোবাহী বিমান, ৫১টি Aichi D3A ডাইভ বম্বার এবং ৪৩টি Mitsubishi A6M “Zero” ফাইটার বিমান।

ঘটনা ২-

১৯৪৩ সাল। মার্কিন বিমান বাহিনীর ৮ম, ৯ম এবং ১২তম এয়ার ফোর্স ব্যাপক বোমাহামলা চালাচ্ছে জার্মান অধিকৃত ইউরোপের উপর। এই হামলায় অংশ নিচ্ছে মার্কিন বিমান বাহিনীর শতশত Boeing B-17 Flying Fortress এবং Consolidated B-24 Liberator বোমারু বিমান, এবং এগুলিকে এসকর্ট দিচ্ছে Republic P-47 Thunderbolt, North American P-51 Mustang, Lockheed P-38 Lightning ফাইটার বিমান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দু’টা আলাদা ঘটনাকে বর্ণনা করলাম এখানে। আসলে ঘটনা বর্ণনার চাইতে এখানে তুলে ধরলাম ওই দুই যুদ্ধের ঘটনায় ব্যবহৃত বিমানগুলির নাম। খেয়াল করলেই দেখবেন যে এই বিমানগুলির নামের শুরুতে রয়েছে – Nakajima, Aichi, Mitsubishi, Boeing, Consolidated, Republic, North American এবং Lockheed, যা কিনা আসলে কতগুলি বিমান ডিজাইন এবং ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির নাম। এর আগের লেখায় লিখেছিলেম যে বাংলাদেশের শিল্পপতিদের নিজেদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি নামে পরিচিতি পেতে চান – মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় আন্ডারওয়্যার সাপ্লাই দিয়ে, নাকি দেশের জন্যে প্রথম যুদ্ধবিমান ডিজাইন করে। আমাদের দেশের প্রথম যুদ্ধবিমানের নাম কি হবে – Akij P-88, নাকি Bashundhara X-3, নাকি PHP N-52, নাকি অন্য কোন নাম? আজকে এই চিন্তাটাকেই আরেকটু প্রসারিত করবো।
   
আলেক্সান্ডার ডে-সিভিয়ার্সস্কি একজন অসফল বিমান নির্মাতা। কিন্তু তার সামরিক চিন্তাগুলি ১৯৪২ সালে Victory Through Air Power নামের একটি বইতে প্রকাশ করে তিনি বিখ্যাত হয়ে যান। হলিউডের ওয়াল্ট ডিজনি তার সেই বইকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একটি ডকুমেন্টারি মুভি তৈরি করেন যুদ্ধের পক্ষে জনগণের মতামত আনার লক্ষ্যে। ছবিতে সিভিয়ার্সস্কিকে সেই মুভিতেই দেখা যাচ্ছে। সিভিয়ার্সস্কি এবং ডিজনি দুজনেই এখানে রাষ্ট্রের কাজ করেছেন।

বই থেকে মুভি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়েই আরও কিছু কথা বলবো। অনেক বড় ছিল ওই যুদ্ধখানা। বহু বিষয়ে কথা বলার জন্যে বহু উদাহরণ রয়েছে সেই যুদ্ধে; তাই তর্কের খাতিরেই হোক, আর নিছক উদাহরণ হিসেবেই হোক, সেই যুদ্ধের কথা বারংবার আসবেই। যাই হোক, আসল কথায় আসি। আলেক্সান্ডার ডে-সিভিয়ার্সস্কি (Alexander P. de Seversky, 1894-1974) ছিলেন রাশিয়ায় জন্ম নেয়া একজন মার্কিন বিমান নির্মাতা এবং সামরিক চিন্তাবিদ। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ান বিমান বাহিনীতে পাইলট ছিলেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন বলবত হবার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হন। সেখানে ১৯২৩ সালে নিউ ইয়র্কে তিনি সিভিয়ার্সস্কি এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানি চালানো ক্ষেত্রে সিভিয়ার্সস্কি মোটেই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। আর জাপানিদের কাছে ২০টি ফাইটার বিক্রি করার পরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিরাগভাজন হন তিনি (তথাকথিত মুক্ত বাণিজ্য!)। মার্কিন সরকারের কারসাজিতে তার কোম্পানি অন্য শিল্পপতিদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়, যেখানে সিভিয়ার্সস্কি তার নিজের তৈরি কোম্পানিতেই সকল ক্ষমতা হারান। ১৯৩৯ সালে নতুন কোম্পানির নাম হয় Republic Aviation Corporation, যা কিনা পরবর্তীতে উপরে উল্লিখিত P-47 Thunderbolt বিমান তৈরি করে বিখ্যাত হয়ে যায়। সিভিয়ার্সস্কি এসব ক্রেডিট থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হন। সকলেই মনে করছিল যে এই লোকটির ক্যারিয়ার শেষ।

নিজের কোম্পানি হারাবার পরে মাথা কুটে মরেননি সিভিয়ার্সস্কি। তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন তার সমর-চিন্তাতে। পার্ল হারবারে জাপানি হামলার পরপরই তিনি তার চিন্তাগুলি বই আকারে প্রকাশ করলেন, যার নাম Victory Through Air Power. এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালের এপ্রিলে। বইটি ৫০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে রেকর্ড তৈরি করে ফেলে। কৌশলগতভাবে বিমান শক্তিকে ব্যবহার করে কি করে জার্মানি-জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জেতা সম্ভব, সেই তত্ত্ব তিনি দেন সেই লেখায়। হাজার হাজার বোমারু বিমান তৈরি করে জার্মানি এবং জাপানের সামরিক উতপাদন শক্তিকে ধ্বংসের মাধ্যমে যুদ্ধ জয়ের কথা বলেন তিনি। বইটির নাম যখন সকলের মুখে মুখে, তখন এই ঘটনার মাঝে মার্কিন মুভি জগতের বিখ্যাত নাম ওয়াল্ট ডিজনির (Walt Disney) আবির্ভাব হয়।

ডিজনি সিভিয়ার্সস্কির বই পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হন এবং তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে এই বার্তা তিনি হলিউডে তার নিজের শক্তিশালী অবস্থানকে ব্যবহার করে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ লোকজন এবং সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছে দেবেন। ডিজনি নিজ পয়সায় সিভিয়ার্সস্কির বইয়ের উপরে ভিত্তি করে ১৯৪৩ সালে Victory Through Air Power নামে একটি এনিমেশন ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। ডিজনিকে সবাই চিনতোই এনিমেশন কার্টুনের জন্যে; তিনি তার সেই শক্তিশালী অবস্থানের মাঝে থেকেই যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করেন। ডিজনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বই পড়ে সেই মেসেজ বুঝতে পারা আর motion picture-এর মাধ্যমে সেই একই মেসেজ বুঝতে পারার মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। ডিজনি এই মুভিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলকে কানাডার কুইবেকে ১৯৪৩ সালের অগাস্টে দুই নেতার বৈঠকের সময়ে তাদের সামনে দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ১৯৪২ সালে সিভিয়ার্সস্কির বইখানা বের হবার পর থেকে মার্কিনীরা তাদের সামরিক চিন্তাতে সিভিয়ার্সস্কির তত্ত্ব খাটাতে থাকেন। আর মুভিখানা মুভি থিয়েটারে দেখানোর মাধ্যমে রুজভেল্ট সরকার তাদের সামরিক সিদ্ধান্তগুলি সামরিক অফিসার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। যুদ্ধের সময়ে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে জনমত গড়ার পেছনে এই মুভি বেশ কাজে দিয়েছিল। এই মুভির মাধ্যমে কৌশলগত বোমাহামলায় যে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, সেটাকে সামরিক লক্ষ্যের আলোকে যুক্তিযুক্ত করে তোলা হয়। মোটকথা, মুভিটি যুদ্ধের সময়ে মার্কিন সরকারের propaganda tool হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

রাষ্ট্র = জনগণ + সরকারী কর্মকর্তা + সামরিক সদস্য + শিল্পপতি + মুভি ইন্ডাস্ট্রি + ……

আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম কতগুলি বিমান-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে। এরপর সেখান থেকে গিয়েছি একজন অসফল বিমান নির্মাতার কাছে, যার সামরিক চিন্তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপরে বিরাট প্রভাব ফেলে এবং সেই চিন্তার উপরে ভিত্তি করে হলিউডের এক বিখ্যাত মুভি নির্মাতা মুভি তৈরি করেন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন সরকারের যুদ্ধ-সিদ্ধান্তের পক্ষে propaganda tool হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই সকল কিছু যখন আমরা মিলিয়ে দেখবো, তখন দেখবো যে এখানে অনেকগুলি প্রাইভেট কোম্পানি এবং ব্যক্তির নাম এসে গিয়েছে, যারা কিনা বিশাল যুদ্ধের মাঝে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেউ তার দ্বায়িত্ব পালন করেন বিমান ডিজাইন করে, কেউবা সামরিক চিন্তার উপরে বই লিখে, কেউবা যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে মুভি তৈরি করে। এই ব্যাপারগুলি সম্ভব হয়েছিল কারণ মার্কিন সমাজে সামরিক এবং বেসামরিক সমাজ বলে আলাদা সমাজ ছিল না। এক হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন আলাদা করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে মার্কিন জনগণ, সরকারী আমলা, সামরিক বাহিনীর সদস্য, শিল্পপতি, সামরিক শিল্প, মুভি ইন্ডাস্ট্রি, মুভি সেলেব্রিটি – সকল কিছুই ছিল একই সূত্রে গাঁথা। এর পুরোটাই কাজ করেছে একত্রে – আলাদা করার কোন পদ্ধতিই ছিল না। যখন একটি রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যে কাজ করে, তখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ এবং ব্যক্তিকে আলাদা করে দেখানো সম্ভব নয়। এটাই হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের শক্তির মূল উতস। কিন্তু এই উতস কিভাবে তারা পেল? রাষ্ট্রের সকল শক্তিকে একত্র করতে পারলো তারা কি করে? আমাদের দেশে তো জনগণ, সরকারী আমলা, সামরিক বাহিনীর সদস্য, শিল্পপতি, মুভি ইন্ডাস্ট্রি, মুভি সেলেব্রিটি – এগুলিকে একত্র করা আর তেলের সাথে পানি, মধু আর ঘি একত্রে মিশানো একই কথা! আমরা কেনো পারি না? সেই উত্তর খোঁজার কাজটা আমরা কখনোই করি না; বরং দায়সাড়া কিছু উত্তর খুঁজে অন্যের উপরে দোষ চাপিয়ে দিয়ে হাল্কা হতে চাই।

রাষ্ট্র একটা শরীরের মতো…

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তথা পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তার সাথে খাপ খাওয়ানোর দরকার নেই, বরং উপরের আলোচনায় যেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে তা হলো – একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র চলে একটা একটা চিন্তার উপরে ভর করে। এই চিন্তাই রাষ্ট্রকে একটি লক্ষ্যে ধাবিত করে। সেই চিন্তা পুরো রাষ্ট্রের শরীরে ধমনীর ন্যায় প্রবাহিত হয়; কোন অঙ্গকেই অন্য অঙ্গ থেকে আলাদা করা যায় না। পায়ে চিমটি কাটলে হাত টের পায়; জেগে ওঠে। এক অঙ্গে আঘাত করলে অন্য অঙ্গ বাধা দেয়। আর সকল অঙ্গ কাজ করে একটি শরীরের মাঝে – যা হচ্ছে রাষ্ট্র। সকল অঙ্গই এই শরীরের অংশ। একটি অঙ্গ আলাদা করে ফেললে শরীর রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে পড়বে। এই চিন্তার মাঝে আমরা যদি আমাদের অবস্থাটা ‘ফিট’ করি, তাহলে কি দেখি?

আমরা আসলে রক্তশূণ্য! আমাদের ধমনী দিয়ে কিছুই প্রবাহিত হয় না। এক অঙ্গ অন্য অঙ্গকে টের পায় না; তাই একটা অঙ্গকে কেটে ফেললে অন্য অঙ্গ ঘুমিয়ে থাকে; বাধা দেয় না। একটা শরীরকে দুর্বল করে ফেলতে হলে তাকে রক্তশূণ্য করে ফেলতে হয়; তাহলে তার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আলাদা করে ফেলা যায়; কেটে ফেলতে হয় না। এই পদ্ধতির নামই হচ্ছে Subversion, যাকে আভিধানিক অর্থে বলে দুর্বল করে ফেলা। একে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ বা নাশকতাও বলা হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে নাশকতা শব্দটাকে এতটাই হাল্কাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে আমরা নাশকতা বলতে এখন শুধুই বুঝি বোমাবাজি। তাই আমার লেখাতে আমি নাশকতা শব্দটা একেবারেই ব্যবহার করি না; করি Subversion শব্দটির ব্যবহার। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি Subversion-এর মাধ্যমে অন্য দেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে রাখে; রক্তশূণ্য করে ফেলে। এই কর্মকান্ড তারা বেশি করে সেইসকল দেশের ক্ষেত্রে, যেগুলি শক্তিশালী দেশের জন্যে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। অদরকারি দেশের মাঝে Subversion-এর মাধ্যমে কেউ অর্থ অপচয় করে না। শক্তিশালী দেশের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলির একটা বড় বাজেট থাকে Subversion-এর জন্যে। Subversion-এর কাজটা রাষ্ট্রযন্ত্রের মাঝে একটা ভাইরাসের ন্যায় কাজ করে।

রাষ্ট্রের শরীরে ভাইরাস…

Subversion প্রসেসের মূল ব্যাপারটা Divide and Rule চিন্তার উপরে ভিত্তি করে হয়। প্রথমে সমাজের দুর্বল দিকগুলিকে কাজে লাগিয়ে কিছু এজেন্ট তৈরি করা হয়, যাদের মূল শর্ত থাকে ‘দেশদ্রোহিতা’। কাজটা কঠিন হলেও কিছু লোক এটা করতে রাজি হয় নিজেদের স্বার্থের জন্যে। এই লোকগুলি সমাজের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে সমস্যা সৃষ্টি করে, যাতে রাষ্ট্রযন্ত্র উপরে যেরকম বলেছি, সেরকম ‘একটি শরীর’ হিসেবে কাজ না করতে পারে না। এই প্রসেসখানা যেসব সেক্টরে কাজ করে, তার একটা ছোট্ট বর্ণনা নিচে দেয়া হলো। উল্লেখ্য যে এই বাইরেও আরও অনেক সেক্টর রয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করিনি। তবে পাঠকের বোঝার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট মনে করছি।

১. ন্যায়ের উৎসে কুঠার মারাঃ সমাজে ন্যায়পরায়ণতার মূল উৎস হলো ধর্ম। আর Subversion সফল হতে হলে সমাজের ন্যায়-নীতিকে আক্রমণ করতে হয়। কাজেই ধর্মকে উপরে আক্রমণ দিয়েই Subversion-এর শুরু। ধর্মের মাঝে বিভাজন তৈরি করা হয়, যাতে নানা ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়। এতে মানুষ ধর্মের উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং ন্যায়নীতি তার কাছে relative হয় যায়, অর্থাৎ কারো কাছে একটা কাজ অন্যায়ের হলেও অন্যের কাছে সেটা ন্যায় হিসেবে ঠেকে। ধর্মের নামে খারাপ কাজ করানো হয়, যাতে ধর্মকে আক্রমণ করা সহজ হয় (এর আগে লিখেছি এ নিয়ে)। কাজেই সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং ন্যায়-নীতি থাকে না বলে মানুষ শুধুমাত্র ব্যাক্তিস্বার্থ দ্বারা ধাবিত হয়।

২. শিক্ষার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে ফেলাঃ ন্যায়ের উৎসে কুঠারের পরে শিক্ষার মূল উপড়ে ফেলা হয়। যেহেতু ধর্মের অবর্তমানে ন্যায়-নীতিতে ধ্বস নামে, কাজেই সকলে ব্যক্তিস্বার্থের জন্যে শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়। নিজেকে তুলে ধরার ব্যাপারটা শিক্ষাক্ষেত্রে আসে একটি বিকৃত চিন্তার মাধ্যমে – “শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হলো অর্থ উপার্জন”। একজন ইঞ্জিনিয়ার দেশের সম্পদ না হয়ে দেশের উপরে একজন বেকার বোঝায় রূপান্তরিত হয়। একজন শিক্ষক শিক্ষা দেয় জ্ঞান বিতরণের জন্যে নয়, শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্যে। অর্থ হয়ে ওঠে মূল চিন্তা এবং এতে চিন্তাশক্তি পুরোপুরি লোপ পায়। দীর্ঘমেয়াদে জাতির ঘুরে দাঁড়াবার পদ্ধতিও এতে বন্ধ হয়ে যায়। বই পড়া এবং জ্ঞান-চর্চা অদরকারি হয়ে পড়ে (এর আগে এ নিয়ে লিখেছি)।

৩. নিরাপত্তাকে ভূলুন্ঠিত করাঃ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে মানুষের কাছে বিকৃতরূপে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে মানুষ সামরিক বা নিরাপত্তার ক্যারিয়ার থেকে দূরে থাকে। যে বিকৃত চিন্তাটি তুলে ধরা হয় তা হলো – “যাদের বুদ্ধি নেই, বা যাদের নীতির অভাব রয়েছে বা যাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, তারাই নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগদান করে”। এভাবে সামরিক এবং বেসামরিক – দু’টি আলাদা সমাজের জন্ম হয় (যা নিয়ে এর আগে লিখেছি) এবং এদের মাঝে লেগে থাকে রেষারেষি। সামরিক বাহিনীর যেকোন কর্মকান্ডকে বেসামরিক লোকজন সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। দেশ সামরিকভাবে আক্রান্ত হলে এই বিভাজনের ফলে দেশের উপরে মহাবিপদ নেমে আসে। এই কাজটাকে বাস্তবে রূপ দিতে এবং সর্বদা এই বিভেদ জারি রাখতে মিডিয়া এবং এনজিও ব্যাপক সহযোগিতা করে।

৪. মিডিয়ার মাধ্যমে ভেড়ার পাল নিয়ন্ত্রণঃ মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো দেশের মানুষকে বিভিন্ন বিকৃত চিন্তা দেয়া হয়। অথর্ব লোকগুলিকে মিডিয়াতে বারংবার সামনে এনে দেশের মানুষের সামনে সেলেব্রিটি করে তোলা হয়, যারা নতুন কোন কথা বলতে তো পারেই না, বরং বছরের পর বছর মানুষকে একই গতবাধা কথা বলে ভুল পথে প্রবাহিত করে। এই লোকগুলি ভেড়ার পালের পাহাড়াদার কুকুর হিসেবে কাজ করে। গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানে এজেন্টদের দৌড়াত্ম থাকায় মিডিয়ার এই Subversion-এর বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকে না। এরা সমাজের অন্যান্য স্থানে কর্মরত এজেন্টদের বড়সড় ব্যাকআপ দেয়। দরকারবিশেষে কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নে একনাগারে শুধুমাত্র এজেন্টদেরকেই এরা হাইলাইট করতে থাকে।

৫. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ নেয়াঃ যে কাজগুলি সরকার সমাজের মানুষের জন্যে করার কথা ছিল, সে কাজগুলি বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিক্ষেত্রে তুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ সরকারের কাজ ব্যক্তি করতে থাকে। ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রাইভেট সংস্থা (এনজিও) বাইরের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়। এভাবে সমাজে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছুটে যায় এবং বাইরের অর্থদাতারা দেশের তৃণমূলে কাজকর্মের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এদের তৈরি করা নেটওয়ার্ক তারা যেকোন সময় দেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে, কারণ বহু মানুষ তাদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং নিজেদের কোন চিন্তা না থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কোন সন্দেহ প্রকাশ করে না।

৬. রাষ্ট্রের উপরে চাপ সৃষ্টি করাঃ বিভিন্ন এনজিও, সাহায্য সংস্থা, এবং ব্যক্তিকে ব্যবহার করা হয় প্রেসার গ্রুপ হিসেবে। এরা বিভিন্ন উছিলা দেখিয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বন্ধ করার জন্যে মামলা করে, রাস্তায় বিক্ষোভ করে, আন্তর্জাতিকভাবে চাল সৃষ্টির চেষ্টা চালায়, ইত্যাদি। সামরিক বাহিনীর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টগুলির বিরুদ্ধে এরা জনমত গড়ার চেষ্টা চালায়। বিমান বাহিনীর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে মনে করে এরা যেকোন এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত হয়। দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল প্রমাণ করে বিদেশের কাছে হাত পাতার প্রেসক্রিপশনও দেয় তারা। মিডিয়াতে বসে থাকা এজন্টরা এদেরকে সরাসরি সাহায্য করে।

৭. ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়াঃ অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করে ফেলার জন্যে শিল্প এবং বিভিন্ন ব্যবসাক্ষেত্রে মালিক এবং শ্রমিকের মাঝে আরও একটি পক্ষকে আনা হয়, যাকে আমরা শ্রমিক নেতা বলে জানি। মালিকপক্ষ তার স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়; যার ফলে সে শ্রমিক নেতার সাথে স্বার্থের সমন্বয় করে ফেলে। যেহেতু মালিকপক্ষ নীতি থেকে আগেই সরে এসেছে, তাই স্বার্থান্বেষী এই কাজ করতে তার কোন কষ্টই হয় না। এতে সাধারণ শ্রমিক বঞ্চিত হয় এবং এই বঞ্চনা কোনদিনই যায় না। এভাবে শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক অসন্তোষ কখনোই যায় না এবং যখন ইচ্ছে এজেন্টদের ব্যবহার করে শ্রমিকদের উস্কে দেয়া যায়। যানবাহন ধর্মঘট উস্কে দিয়ে পুরো দেশকে অচল করে ফেলা যায়। শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলা যায়। আবার শ্রমিকদের মাঝে এজেন্টদের ব্যবহার করে কারখানায় আগুন, যন্ত্রপাতিতে বিস্ফোরণ, লিফট ছিড়ে পড়া, অবাস্তব দুর্ঘটনা, ইত্যাদি মানব-সৃষ্ট দুর্যোগের সৃষ্টি করা হয়।

৮. শিল্পের লাগাম টেনে ধরাঃ দেশের material power-কে দুর্বল করার লক্ষ্যে কৌশলগত শিল্পের ব্যাঘাত ঘটানো। বিভিন্ন শিল্পে খবরদারি করা হয়, যাতে – স্টিল ইন্ডাস্ট্রিতে যেন মিলিটারি গ্রেড স্টিল তৈরি না করা হয়, অথবা সিমেন্ট মিলে যেন সুপার স্ট্রেংথ কোন মিক্সচার ডেভেলপ করা না হয়, অথবা পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কয়েকটি বিশেষ কেমিক্যাল যেন তৈরির ব্যবস্থা করা না হয়, অথবা মেশিন ফ্যাক্টরিগুলিতে বিশেষ কিছু প্রসেসিং ক্যাপাসিটি না বসানো হয়, অথবা গ্লাস ফ্যাক্টরিতে এক্সট্রা-স্ট্রং গ্লাস উইন্ডশিল্ড তৈরি করার ক্ষমতা না থাকে, অথবা মিডিয়াম সাইজের ইঞ্জিন তৈরির কাস্টিং সক্ষমতা না হয়, অথবা হাই-টেক সার্কিট-বোর্ড তৈরির চেষ্টা না করা হয়, ইত্যাদি। এসব শিল্প দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়, তাই এগুলির উপরে নজরদারির জন্যে এজেন্টদের লেলিয়ে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীদের মাঝেও কিছু এজেন্ট তৈরি করা হয়, যাতে তারা বিদেশী ব্যবসার স্বার্থ দেখে সর্বদা। এরা দেশে শিল্প গড়ার চাইতে দেশকে আমদানি-নির্ভর করতে বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্য শিল্পপতিদেরকেও এরা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।

এবং যেভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে চলে যায়…

উপরের এই সকল সেক্টরের কাজগুলি সফল হয় কারণ প্রথম সেক্টরে ন্যায়-নীতি থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে ফেলা হয় এবং দ্বিতীয় সেক্টরে চিন্তার ভিত্তি ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই প্রসেস পেকে লাল হতে মোটামুটি ১৫-২০ বছর লেগেই যায় – যা কিনা এজেন্টদের এক জেনারেশনকে ট্রেনিং দেবার সমান। এজেন্টরা পরিপক্ক হলেই কাজগুলি পাকতে শুরু করে। একসময় প্রতিটি সেক্টরের সমস্যা এতটাই ঘনীভূত হয়ে যায় যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ভারে শেষঅবধি পুরো রাষ্ট্রই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। এমতাবস্থায় বাইরে থেকে রাষ্ট্রের জন্যে একটি সমাধান দেয়া হয়, যা কিনা দেশের জনগণ মেনে নেয়া ছাড়া কোন গতি দেখে না। তার বিনা বাক্যে মেনে নেয়, কারণ ১) তাদের ন্যায়-নীতির মাপকাঠি ধ্বংস করা হয়েছে এবং ২) তাদের চিন্তাশক্তির বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে যায় বাইরের শক্তির হাতে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি এসময় নিজেদের মধ্যে কুকুরের মতো কামড়া-কামড়ি করতে থাকে দেশটির দখল নেবার জন্যে। মাঝেমধ্যে হিংস্র কুকুরের খাদ্যরূপে দেশটির বিভাজনও ঘটে যায়!

উপরে যা যা লিখেছি, এদেশের মাঝে এগুলির উতস খুঁজে পেতে কোন কষ্টই করতে হবে না। আমাদের দেশে প্রায় সকল সেক্টরেই Subversion চলেছে; চলছে। এদেশকে রক্তশূণ্য করে রাখা হয়েছে; এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের জন্যে চিন্তা করে না – মনে করে ওর সমস্যা; আমার কি? এই প্রসেস কতদিন চলবে, তা ঠিক করবে দু’টো জিনিস – ১) ভূরাজনীতিতে বাইরের শক্তিদের নিজেদের শক্তির অবস্থা এবং ২) আমাদের মৌলিক চিন্তার অবস্থা। প্রথম ক্ষেত্রটিকে মেনে নেয়া মানে আমরা নিজেদের প্রিয়জনকে চোখের সামনে বিরামহীনভাবে ধর্ষন হতে দেখেই যাবো। একজন ধর্ষণকারীর পরে আরেকজনের আবির্ভাব হবে; আমরা তাকেও মেনে নিতে বাধ্য হবো! আর দ্বিতীয়টির অর্থ হলো, এই অসহ্য যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করে নিজেদের চোখের চশমা খুলে ফেলা এবং রাষ্ট্রের ধমনীতে রক্তের মতো নিজেদেরকে প্রবাহিত করা। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের শরীরের যেকোন অঙ্গের আঘাত আমাদের নিজেদের গায়ে ক্ষতের সৃষ্টি না করবে, বুঝতে হবে যে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের চিন্তা মুক্তি পায়নি। এই মৌলিক চিন্তা কাজ করবে এন্টি-ভাইরাসের মতো। যখন আমরা রাষ্ট্রের সকল অঙ্গে ভাইরাস ধরতে শিখতে শুরু করবো, শুধুমাত্র তারপরেই কথা উঠতে পারে রাষ্ট্রকে পুরোপুরি ভাইরাস-মুক্ত করার। Subversion-এর প্রসেসেই বলে দেয় যে এই চিন্তার মূল শক্তি কোথায়।

Saturday 20 August 2016

আমাদের শিল্পপতিরা যেভাবে ‘ব্লু ইকোনমি’ গড়বেন

'ব্লু ইকোনমি' বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে কিভাবে আমরা এটা পাবো, আর কে কিভাবে বাধা দেবে সেই পথে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে কঠোরতাই পারবে বাধা অতিক্রম করতে।
২০শে অগাস্ট ২০১৬


ঘটনা না গল্প?

মাঝ সমুদ্র। সূর্য উঠি উঠি করছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহিদুল ইসলাম চোখ রেখেছেন তার গন্তব্যের দিকে। আর মাত্র ঘন্টা কয়েকের পথ; তারপরেই জাহাজ পৌঁছে যাবে আফ্রিকার সেই বন্দরে। অনেকে অপেক্ষা করে আছে সেখানে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের জন্যে। সকাল হলে তো তারা সেই পণ্য পেয়েই যাচ্ছে। কিন্তু জীবনে পণ্য বিক্রি করাই তো সব নয়। ক্যাপ্টেন জাহিদ তাঁর ব্রিজ থেকে সামনে এগিয়ে থাকা জাহাজটির দূরত্বের একটু খোঁজ করে নিলেন। তিনি বুঝে ফেললেন যে তাঁর জাহাজের সাধ্যি হবে না ওই জাহাজের আগে জেটিতে পৌঁছানো। জাহাজের সেকেন্ড অফিসার আশিকুল ইসলামের মুখটা মলিন হয়ে গেল এটা ভেবে। ক্যাপ্টেন জাহিদ তাঁর বহু বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাঁর ব্রাইট জুনিয়র অফিসারকে বললেন, “মন খারাপ করছো কেন আশিক? ওই জাহাজের ফ্ল্যাগটা মনে রেখো – ওই ফ্ল্যাগটাও আমাদেরই! আমাদেরই ভাই ওই জাহাজ চালাচ্ছেন”। আশিকের চেহারায় তেমন একটা পরিবর্তন না দেখে ক্যাপ্টেন তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কিছু বের করলেন, “বছর দশেক আগের কথা। তখনও আমার রক্ত তোমার মতোই গরম ছিল। আফ্রিকার এমনই একটা বন্দরে ঢোকার জন্যে আমাদের জাহাজের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গিয়েছিল আরেকটি জাহাজ। কিন্তু সেবার ওই জাহাজটি ছিল আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী দেশের। তীরে নেমে আমাদের কারুরই মন স্থির ছিল না, যদিও আমাদের মিশনের সবটাই সাফল্যের ছিল। আজ নাহয় আমরা আমাদের ভাইদের কাছেই হারলাম”।

উপরের পুরো কাহিনিটাই কাল্পনিক। কিন্তু কল্পনা না থাকলে তার বাস্তবায়নের প্রশ্নও ওঠেনা। আজকের ‘ব্লু ইকোনমি’র কল্পনাটা আগামীকালের বাস্তব ঘটনা। ক্যাপ্টেন জাহিদ যে মিশনের কথা বলছিলেন – সময়মত পণ্য পৌঁছে দেয়া – এটাই কি আসল মিশন? যদি তা-ই হবে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাথে ছোট্ট একটা প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে তার মন খারাপ হবে কেন? আসলে মিশন হচ্ছে সেটাই, যা তার পেট ঠান্ডা রাখার সাথে সাথে তার আত্মাকেও তৃপ্তি দেয়। ক্যাপ্টেন জাহিদের দশ বছর আগের মিশনে তার আত্মা পরিতৃপ্ত হয়নি, কিন্তু আজকের এই মিশনে হেরে যাবার পরেও আত্মা বিচলিত হয়নি, কারণ সেই হেরে যাওয়াটা তার “আসল মিশন”এর সাথে সাংঘর্ষিক ছিল না। আফ্রিকার একটি বন্দরে নিজ ভাইয়ের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ঢোকাতেও তার সমস্যা নেই, কিন্তু তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাহাজের চেহাড়াও দেখতে চান না। কারণ তাঁর মনে আছে যে, যে জাহাজটিতে তিনি প্রথম তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছেলিন, সেই জাহাজখানা তৈরিতে সেই পার্শ্ববর্তী দেশ subversion-এর মাধ্যমে বাধা দিয়েছিল। তিনি জানতেন যে আফ্রিকার বৈচিত্র্যময় উপকূলের মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার তাঁর যে সাধ ছিল, নতুন দেশ, নতুন এলাকা দেখার তাঁর যে স্বপ্ন ছিল, সেটা বাস্তবায়নের পেছনে সবচাইতে বড় বাধা ছিল সেই ‘শক্তিশালী’ দেশের subversive activity. তাঁর রাষ্ট্রকে উন্নত একটা অবস্থানে দেখার তাঁর যে খায়েস ছিল, সেখানে বাগড়া বাধিয়েছিল ওরা – এটা ভুলে যাবার মতো কোন ব্যাপার নয়।

এভাবে আমরা গল্পটির বাকি অংশটুকু এগিয়ে নিতে পারি…… তাই ক্যাপ্টেন জাহিদ তীরে নেমেই দেশে তাঁর অফিসে ফোন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন ওই ভদ্রলোকের ফোন নম্বর দেয়া যাবে কিনা, যাঁর শিপইয়ার্ডে তাঁর দশ বছর আগের জাহাজটি তৈরি হয়েছিল! নম্বর পেলেন এবং ফোন করলেন ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল আলমকে, যিনি তখন অসুস্থ্য এবং প্রায় মৃত্যুশয্যায়। এরপরেও সাইফুল আলম সাহেব ফোনটা ধরলেন। ক্যাপ্টেন জাহিদ বললেন, “সেদিন আপনি যদি আমাদের শত্রুর subversion-এ ভয় পেয়ে যেতেন, তাহলে আজ আফ্রিকার এই বন্দর আমাদের সন্মানে অপেক্ষা করতো না”। সাইফুল আলম সাহেব কিছু বলতে পারলেন না, কিন্তু তাঁর অজান্তেই তাঁর চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি বেরিয়ে এলো। দশ বছর আগের সেই দুর্বল রাষ্ট্র আজ আর নেই। তাঁর চিন্তা এবং অধ্যবসায়ের ফসল আজ বাস্তব সত্য। তিনি এই দিনটিরই স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেদিন পুরো ভারত মহাসাগর দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের জাহাজ! এটাই সেই ‘ব্লু ইকোনমি’র স্বপ্ন।
'ব্লু ইকোনমি'র মূলে রয়েছে জাহাজ নির্মাণ। আমাদের শিল্পপতিরা এখানেই তাদের নাম প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। ভারত মহাসাগরের বিশাল জলরাশির হাতছানিতে সাড়া দিতে আমাদের অনেক জাহাজ লাগবে। শিল্পপতিরা জাহাজ তৈরিতে এগিয়ে এসে বঙ্গোপসাগরে দাঁড়াবার জন্যে স্তম্ভ তৈরি করে দিতে পারেন।
 
 স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নের লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প

ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল আলম জাহাজ তৈরির সময়ে কি ভেবেছিলেন? কি স্বপ্ন ছিল তাঁর? সেই স্বপ্ন কি আমাদের শিল্পপতিদের রয়েছে? ‘ব্লু ইকোনমি’ কি জিনিস সেটা কি তারা বোঝেন? অনেকে বলতে চাইবেন যে এই দূর্নীতিগ্রস্ত মানুষগুলিকে আমি কি বলছি? কিন্তু যারা এটা বলছেন, তারা বলতে চাইছেন না যে এই দূর্নীতিগ্রস্ত সমাজই যে তাদের দূর্নীতিগ্রস্ত করেছে; তারা জন্মের সময় দূর্নীতিগ্রস্ত ছিল না। তাই এই যুক্তি খাটে না। বরং যেটা চিন্তা করতে হবে তা হলো, এই মানুষগুলি সমাজ পরিবর্তন করতে কতটুকু কাজ করেছে। আজ একজন শিল্পপতি ঝালমুড়ির প্যাকেট বানিয়েই খুশি থাকতে পারেন, আবার এটাও মনে করতে পারেন যে দেশের প্রাইভেট সেক্টরের তৈরি প্রথম যুদ্ধজাহাজখানা তিনিই তৈরি করবেন। গার্মেন্টস ব্যবসায়ে থাকা কেউ কি ভেবেছেন যে কোন জামা তৈরিতে তারা বেশি গর্ববোধ করবেন – মিস ইউনিভার্সে অংশ নেয়া প্রতিযোগীদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বল্পবাস তৈরিতে, নাকি দেশের সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম তৈরিতে (দ্বিতীয়টি সবচাইতে খারাপ কাপড় দিয়ে তৈরি হলেও)? বিল গেটস-এর সন্তানের জন্যে ল্যাপটপ তৈরিতে তিনি বেশি সন্মানিত বোধ করবেন, নাকি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক তৈরিতে? পশ্চিমা দেশের ধনীর ঘরের ফার্নিচার তৈরিতে তাঁর শান্তি হবে বেশি, নাকি আফ্রিকার একটি দেশের সাথে শক্ত বন্ধন রচনা করে দেশের স্বার্থকে তুলে ধরতে বেশি শান্তি হবে তাঁর? আর এই ধরনের অধিক গর্বের লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাঁরা যে শত্রুদের বাধায় পড়বেন, সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ এসবের মাঝেই সাম্রাজ্যবাদীরা বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তির আবির্ভাব দেখে। তারা এই দেশে গত কয়েক যুগ ধরে তৈরি করা তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে subversive activity-তে মনোনিবেশ করবে। মামলা করবে, মিডিয়াতে বাজে রিপোর্ট করবে, মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলবে তাদের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে তাদের সমস্যা তৈরি করে রাখার চেষ্টা করবে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ থেকে কোম্পানি নিয়ে আসবে দেশের ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস করতে। তবে যাঁরা বুঝতে পারবেন যে – দুনিয়াতে তাঁরা আসেন খুব অল্প সময়ের জন্যে; আর এর মাঝেই গর্বের কিছু করে যেতে হবে – তাঁরাই শত্রুর বাধাকে identify করতে পারবেন এবং লক্ষ্যে সুস্থির থাকতে পারবেন। সেখানেই সাফল্য। সেটা না করতে পারলে সারাজীবন পরিশ্রম করার পরে দেখতে পাবেন যে তার পরিশ্রমের ফসল টাটা, আদানি, আম্বানি, বা রিলায়েন্সের মতো কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের কোম্পানির ঘরে চলে গেছে!  

মিতসুবিশি "জেরো" ফাইটারের সাথে অমর হয়ে রয়েছে মিতসুবিশির নাম। বাংলাদেশের শিল্পপতিদেরও আজ সিদ্ধান্ত নেবার সময় চলে এসেছে - তারা যখন দুনিয়াতে থাকবেন না, তখন মানুষ তাদের কোন নামে চিনবে - মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় আন্ডারওয়্যার সাপ্লাই দেয়াব্র জন্যে, নাকি দেশের প্রথম যুদ্ধবিমান তৈরি করার জন্যে?
     
কারো নাম প্রতিষ্ঠা পায় কিভাবে?

১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন যুদ্ধে যোগ দেয়, তখন মার্কিনীরা এবং তাদের সহযোগী পশ্চিমা শক্তিরা আবিষ্কার করলো দু’টি জাপানি বিমান, যা কিনা রীতিমতো কাঁপিয়ে দিল তাদের। প্রথমটি ছিল Mitsubishi A-6M “Zero” ফাইটার এবং Mitsubishi G-3M দূরপাল্লার বোমারু বিমান। Zero ফাইটার বেশ কিছুদিন প্রশান্ত মহাসাগর দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। আর G-3M সিঙ্গাপুরের অদূরে ডুবিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর গর্ব ব্যাটলশিপ ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ এবং ব্যাটলক্রুজার ‘রিপালস’। খেয়াল করে দেখবেন যে দু’টি বিমানই জাপানের মিতসুবিসি কোম্পানির তৈরি। এই কোম্পানি পেন্সিল থেকে শুরু করে জাহাজ অবধি বানায়। কিন্তু তাদের নাম হয় কিন্তু পেন্সিলের কারণে নয়।

একটা রাষ্ট্রের চিন্তাই আসল শক্তি। সেই চিন্তাই ঠিক করে তার material power-কে কিভাবে ব্যবহার করা হবে। উপরে যে কথাগুলি লিখেছি, এগুলি সবই এরকম material power-এর উদাহরণ। শিল্পপতিরা নিজেরাই ঠিক করুন যে মৃত্যুর আগে তাঁদের নামের আগে মানুষ কি টাইটেল যোগ করবে। তাঁদের নাম কি হওয়া উচিত ‘চিনি’ হাসেম? অথবা ‘জাঙ্গিয়া’ আনোয়ার? ‘ঝালমুড়ি’ সেলিম? নাকি এমন কিছু হলে ভালো হতো – ‘ডেস্ট্রয়ার’ হাসেম, আনোয়ার দ্যা ‘ট্যাঙ্ক’, বা ‘হাই টেক’ সেলিম? তারা নিজেদের নাম নিজেরা তৈরি করতে চান, নাকি আদানি-রিলায়েন্স-আম্বানি-টাটা-দের নামের ভারে নিজেদের কবর খুড়তে চান? আমাদের শিল্পপতিরা যখন এই লক্ষ্যগুলি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করবেন, তখন এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর বিরোধী কর্মকান্ডগুলিও তাঁদের অন্তরের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে – এর বিরুদ্ধে জয়ী হবার আগ পর্যন্ত তিনি শান্তি পাবেন না। কোন একটা দিন এই সমাজ পরিবর্তিত হবেই। বঙ্গোপসাগরে একটা নতুন শক্তির আবির্ভাব এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। ‘ব্লু ইকোনমি’র চিন্তাটা এজন্যেই বাস্তব। এই শক্তির material স্তম্ভগুলির কে কোনটা গড়ে দিয়েছেন, সেটা একসময় হিসেব কষবে মানুষ। আর অন্যদিকে যারা আজ বিদেশী শক্তির স্বার্থ বাস্তবায়নে এসব স্তম্ভ তৈরির বিপক্ষে দাঁড়াবে, তারাই আগামীতে তীব্র জনরোষের শিকার হবে।

'ব্লু ইকোনমি'তে অনেক শিল্পের প্রয়োজন হবে, যেমন স্টিল ইন্ডাস্ট্রি। শিল্পপতিদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা তাদের সারাজীবনের পরিশ্রমকে নামফলকে বাঁঢিয়ে রেখে যেতে চান, নাকি তাদের পরিশ্রমের ফসল টাটা-আম্বানি-আদানি-রিলায়েন্সের ঘরে উঠুক, সেটা চান?
 
 লক্ষ্য কোনটা?

প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত চিনি বা ভোজ্য তেলের ব্যবসা করে কে কতো বেশি টাকা কামাবে সেখানে নয়। বরং দেশের প্রথম হাই-টেক পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্ট কে তৈরি করলো, বা প্রথম ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট কে করলো, বা প্রথম সিনথেটিক রাবার প্ল্যান্ট কে করলো, বা দেশের প্রথম কমপ্লিট হাই-টেক ইলেকট্রনিক্স প্ল্যান্ট কে করলো – এগুলি হওয়া উচিত প্রতিযোগিতার বিষয়। এর আগের লেখায় লিখেছি যে বাংলাদেশের পুরো সমুদ্রতীরই একটা গভীর সমুদ্রবন্দর। তাই এই দেশের লাইটার জাহাজগুলি হলো এই দেশের বিশাল সম্পদ। এগুলি আমাদের ‘ব্লু ইকোনমি’র স্তম্ভগুলির একটি। আজকের হাজারখানেক লাইটার জাহাজ সামনের দিনগুলিতে প্রতিস্থাপিত (replace) করতে হবে। আর সামনে পাথর, কয়লা, কনটেইনার, জ্বালানি তেল এবং আরও অনেক নব্য পণ্য নদীপথে পরিবহণ করতে হবে – লাগবে আরও কয়েক হাজার জাহাজ। আশেপাশের দেশগুলির সাথে যোগাযোগ রক্ষায় তৈরি করতে হবে মার্চেন্ট ফ্লীট – ঠিক যেরকম একটি জাহাজের মিশনের বর্ণনা দিয়ে এই লেখার শুরু করেছি। বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের সম্পদের সফল আহরণের জন্যে লাগবে বহু ফিশিং ট্রলার। এই পুরো বাণিজ্যিক বহরের নিরাপত্তা দিতে লাগবে শক্তিশালী নৌবহর। আর এই জাহাজের বহরের জন্যে দরকার হবে স্টিল মিল, ইলেকট্রনিক্স কারখানা, ফার্নিচার কারখানা, পেইন্ট কারখানা, যন্ত্রাংশ কারখানা, মেশিন ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা, কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল কারখানা, ইত্যাদি। মিতিসুবিসির মতো আমাদের শিল্পপতিদেরও ‘ব্লু ইকোনমি’র একেকটি স্তম্ভ তৈরি করে অমর হবার সুযোগ রয়েছে, আবার মানুষের বিদ্রুপের বিষয় হবার সুযোগও রয়েছে। সঠিক স্বপ্ন আজ যারা দেখতে পারবেন, আর এসব কাজে বিদেশী শক্তি এবং তাদের এজেন্টদের বাধাকে যারা সামনে এগুবার শক্তিরূপে নেবেন, তারাই হবেন সফল; মানুষের কাছে তারাই হবেন অমর।

Thursday 18 August 2016

গভীর সমুদ্রবন্দর, নাকি “বাক্সের মোহ”?

১৮ অগাস্ট ২০১৬
গভীর সমুদ্রবন্দরের ভিত্তিতেই যে আছে কনটেইনার নামের বাক্সটি - সেটা আসলে কি জিনিস? আমরা কি সেই বাক্সের গুরুত্ব বুঝি?


কনটেইনারে কি সুবিধা?

গভীর সমুদ্র বন্দরকে বুঝতে গেলে আমাদের কনটেইনার জাহাজের সুবিধা বুঝতে হবে। আর কনটেইনার জাহাজের সুবিধা বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে কন্টেইনার কি জিনিস। কন্টেইনার একটা স্টিলের বাক্স, যা কিনা পণ্য পরিবহণে কিছু সুবিধা দেয়। যেসব সুবিধা দেয়, তার মাঝে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনৈতিক সুবিধা। একটি কনটেইনারের মাঝে, বাক্স-ভর্তি করে পাঠানো হয় – এরকম অনেক পণ্য একত্রে ঠেঁসে দেয়া যায়। এতে একটা কনটেইনার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরালে আলাদা আলাদা করে অনেকগুলি বাক্স সরাতে হয় না। এতে পণ্য ওঠাতে-নামাতে সময়, শ্রম ও খরচ কম লাগে। প্রথমবার যখন কনটেইনার ব্যবস্থার প্রচলন হয়, তখন স্ট্যান্ডার্ড ২০ফিট বা ৪০ফিট কনটেইনারের মাপে কোন অবকাঠামোই তৈরি ছিল না। এগুলি ১৯৬০-এর দশক থেকে কয়েক যুগ ধরে তৈরি করা হয়েছে। এখন জাহাজ, মোটরযান, রেল – সকল পরিবহণই স্ট্যান্ডার্ড কনটেইনার ডিজাইন মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। যেমন কনটেইনার বহণ করতে রেলের আলাদা ‘ফ্ল্যাট-কার’ লাগে; রাস্তা দিয়ে নিতে লাগে সেমি-ট্রেইলার; আর কনটেইনার পরিবহণের আলাদা জাহাজ তো আছেই। তবে প্রথমবার কনটেইনার পরিবহণের জন্যে এগুলি তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল। তবে এখানে মূল চিন্তাটা হচ্ছে খরচ বাঁচানো – ১০টা বাক্সকে আলাদা পরিবহণ না করে ১টি বাক্সে পরিবহণ করা।

এই খরচ বাঁচানোর ফলে এক ধরনের Economy of Scale তৈরি হয়, যার ফলে পূর্বের ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহণ নতুন ব্যবস্থার সাথে আর পেরে ওঠে না। এখন এই কনটেইনার নামের অপেক্ষাকৃত বড় বাক্সখানা যে যত বেশি পরিমাণে একত্রে পরিবহণ করতে পারবে, তার খরচ ততোই কম পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, ২,৫০০ স্ট্যান্ডার্ড সাইজের কনটেইনার যে সাইজের জাহাজে পরিবহণ করা যায়, ৪,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে তার তুলনায় প্রতি কনটেইনারে ২৯.৭% খরচ কম পরে; ৬,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে ৪৫.৫% খরচ কম পরে; ১০,০০০ কনটেইনার পরিবহণ করলে ৫০.২% খরচ কম পরে। ১৯৬৮ সালে Weser Express-এর ধারণক্ষমতা ছিল ৭৩৬ টিইউএস; ১৯৮১ সালে Frankfurt Express এটাকে নিয়ে গেল ৩,০৫০-এ; ১৯৯৭ সালে Susan Maersk ছিল ৮,৮৯০ টিইউএস; ২০০৩ সালে Gjertrud Maersk ছিল ১০,৫০০ টিইউএস; ২০০৬ সালে সবচাইতে বড় কনটেইনার জাহাজ ছিল Emma Maersk, ১৫,৫০০ টিইউএস; ২০১৫ সালে MSC Oscar-এর ধারণক্ষমতা ১৯,২২৪ টিইউএস। শেষ বারো বছরে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৮৩% এবং শেষ নয় বছরে ২৪% বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে! বর্তমানে ১৩,০০০ টিইউএস ধারণক্ষমতার বেশি কমপক্ষে ১১০টি জাহাজ সমুদ্রে রয়েছে। বর্তমানে বাল্ক বা খোলা পণ্য ছাড়া যত পণ্য রয়েছে, তার ৯০% পণ্যই কনটেইনারে পরিবহণ করা হয় – কারণ একটাই – খরচ কম। এখানে যে Economy of Scale তৈরি হচ্ছে, তার কারণে ছোট জাহাজ যারা অপারেট করে, তারা বড় জাহাজের সাথে প্রতিযোগিতায় পারবে না। একইভাবে যার বড় জাহাজের সংখ্যা বেশি থাকবে, সে কম সংখ্যক জাহাজ আছে এরকম কোম্পানিকে ব্যবসা থেকেই ছিটকে ফেলে দেবে। বড় কনটেইনার জাহাজগুলি নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করে; এই রুটগুলিকে লাইনার বলে। বড় কনটেইনার জাহাজের এই লাইনারগুলি এমন সব বন্দরে ভিড়ে, যেখানে পণ্যের যথেষ্ট আসা-যাওয়া রয়েছে। সেখানেই বড় জাহাজ ঢোকার ব্যবস্থা করতে হয়। এখন কনটেইনার কিভাবে ওঠা-নামা করানো হয়, সেটা বুঝতে হবে; তাহলে আমরা আমাদের বাস্তবতার সাথে কনটেইনারের বাস্তবতা মেলাতে পারবো।
  
যে লাইটার জাহাজগুলি বিশাল জাহাজগুলিকে আনলোড করে ফেলছে, সেগুলিকে আমরা কেন গুরুত্ব দিই না? পশ্চিমা দেশে এগুলি ব্যবহার করার সুযোগ নেই বলে? তাহলে আমরা এগুলি ব্যবহার করলে কার সমস্যা?

বাংলাদেশের বন্দরের বাস্তবতা…

আমাদের দেশে বেশিরভাগ পণ্যই (প্রায় তিন-চতুর্থাংশ) ওঠানামা করা হয় বহির্নোঙ্গরে; অর্থাৎ সমুদ্রের মাঝখানে। বড় জাহাজ (৫০,০০০টন বা তারও বেশি) সেখানে আসার পরে নোঙ্গর করে। এরপর ছোট জাহাজ (৫০০টন থেকে ২,০০০ টন পর্যন্ত হয়), যেগুলিকে লাইটার জাহাজ বলে, সেগুলি বড় জাহাজের পাশে এসে ভিড়ে। তখন কোন একটা পদ্ধতি করে (পণ্যের ধরণের উপরে নির্ভর করে) সেই পণ্য ছোট লাইটার জাহাজে খালাশ করা হয়। লাইটার জাহাজ তখন হয় চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে মাল খালাশ করে অথবা নদীপথ ব্যবহার করে পণ্যের ব্যবহারকারীর কাছে (ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, বাঘাবাড়ি, চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, গোপালগঞ্জ, আশুগঞ্জ, এবং অন্যান্য স্থানে) সরাসরি পোঁছে যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই লাইটার জাহাজের চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরের চেহারাও দেখা লাগে না। নদীপথে বড় জাহাজের মালামাল খালাশ করে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানো খুবই সহজ একটা পদ্ধতি। বাংলাদেশে এরকম হাজার খানেক লাইটার জাহাজ রয়েছে। তবে এই পদ্ধতি সেসব দেশেই কাজ করবে যেখানে সমুদ্র থেকে নদীর মাধ্যমে কারখানা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানো যাবে। এক্ষেত্রে নাব্য নদী থাকলেই শুধু হবে না, নদীগুলি এমনমুখী হতে হবে, যাতে নদী দেশের অভ্যন্তরে মূল শিল্পাঞ্চলগুলিকে সমুদ্রের সাথে সরাসরি জুড়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের নদীগুলি এই দিক থেকে বিশ্বসেরা; সমুদ্র থেকে একেবারে গাছের শাখা-প্রশাখার মতো করে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর সবচাইতে বেশি নাব্য নদীপথ রয়েছে রাশিয়াতে। কিন্তু রাশিয়ার নদীগুলির একটিও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলিকে সমুদ্রের সাথে যুক্ত করেনা। নদী তো মনুষ্য-সৃষ্ট জিনিস নয় – সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জিনিস; রাশিয়া সেটা পায়নি। তাই সবচাইতে বিশাল (১ লক্ষ কিলোমিটারের বেশি; যেখানে বাংলাদেশে ৩ থেকে ৬ হাজার কিলোমিটার) নৌপথ থাকা সত্ত্বেও সেটা তাদের কাজে লাগে না।

এখন এভাবে কিন্তু সকল পণ্য খালাশ করা সম্ভব নয়। আবার অনেক পণ্যই খালাশ করা সম্ভব। আমাদের আমদানি পণ্যের চার ভাগের তিন ভাগ পণ্যই বাল্ক পণ্য, যা কিনা সমুদ্রের মাঝখানে লাইটার জাহাজে খালাশ করা যায়। ২০১৫-১৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ৫ কোটি ৩৭ লক্ষ টন পণ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে এর মাঝে যেসব পণ্য পরে – সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল (প্রায় ২৮%), জ্বালানি তেল (১১%-এর উপরে), গম (৭%), কয়লা (৪%), ঢেউটিনের কাঁচামাল স্টিল কয়েল (৪%), ভোজ্যতেল (৩%) – এগুলি মিলে প্রায় ৫০%-এর মতো পণ্য। এর বাইরে রয়েছে চাল, ডাল, পাথর, কেমিক্যাল, লবণ, অপরিশোধিত চিনি, তুলা, রাসায়নিক সার, স্ক্র্যাপ লোহা – এগুলির সবগুলিই ৫ লক্ষ টন থেকে ১০ লক্ষ টনের কম না, যদিও আলাদাভাবে শতাংশের হিসেবে খুব বড় কিছু নয়। এর বাইরে স্ক্র্যাপ জাহাজ রয়েছে, যেগুলি চট্টগ্রাম বন্দরে না গিয়ে একবারে সীতাকুন্ডে সমুদ্রতটে উঠিয়ে ফেলা হয়; এরকম জাহাজ থেকে আসে প্রায় ৩০ লক্ষ টন লোহা, যা উপরের হিসেবের বাইরে। এই বাল্ক পণ্যগুলির কিছু আবার জাহাজ জেটিতে এনে ক্রেনের মাধ্যমে খালাশ করা হয় – যেমন স্ক্র্যাপ লোহা। তবে বেশিরভাগ বাল্কই খালাশ হয় সমুদ্রের মাঝে। আর ইউরোপের জাহাজের বাজারে মন্দার পর থেকে এই খালাশ করা লাইটার জাহাজই এখন আমাদের জাহাজ নির্মান শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আগামী কয়েক বছরের মাঝে এই হাজার খানেক লাইটার জাহাজ প্রতিস্থাপন ছাড়াও নতুন ধরনের অনেক জাহাজ আমাদের তৈরি করতে হচ্ছে, যা কিনা আমদের ‘ব্লু ইকনমি’ এবং ‘ম্যারিটাইম নেশন’-এর ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

জ্বালানি তেল খালাশের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নামে একটি প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে কুতুবদিয়ার কাছাকাছি, যার মাধ্যমে সমুদ্রের মাঝ পর্যন্ত একটি পাইপ নিয়ে ভাসমান জেটিতে যুক্ত করা হবে। সেই জেটির পাশেই তেলবাহী বড় জাহাজ ভিড়বে। পাইপের মাধ্যমে পাম্প করে তেল সরাসরি চট্টগ্রামের স্টোরেজে চলে যাবে। এলনজি টার্মিনালর প্রজেক্টও এভাবেই তৈরি হচ্ছে – ভাসমান জেটিতে তরল গ্যাস খালাশ করার পরে ভাসমান প্রসেসিং সেন্টারে সেটা গ্যাসে রূপান্তরিত করে পাইপের মাধ্যমে গ্যাস দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়ে যাবে। এগুলিতে লাইটার জাহাজের ব্যবহার থাকছে না।

চট্টগ্রাম বন্দর একটি প্রাকৃতিক বন্দর। এখানে কৃত্রিমভাবে কোন কিছুই তৈরি করতে হয়নি জেটিগুলি ছাড়া। এখানে ৯.৫ মিটার ড্রাফটের এবং ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজ ঢুকতে পারে। প্রায় ৩৫,০০০ টনের ক্ষমতার জাহাজ এই সাইজে ফিট করে; এর চাইতে বড় হলে পারে না। (কনটেইনার জাহাজ আসতে পারে ১,৫০০ টিইউএস সাইজের।) বাল্ক পণ্য নিয়ে যেসব জাহাজ আসে তার বেশিরভাগই এর চাইতে অনেক বড়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬-এর অগাস্টে পায়রা বন্দরে যে জাহাজের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর পাথর নিয়ে আসা হয়েছে, তা ৫৩,০০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এর চাইতে আরও অনেক বড় জাহাজ নিয়মিত খালাশ করা হয়। আবুল খায়ের গ্রুপের একটি জাহাজ রয়েছে ৫৭,০০০ টনের। এখানে মূল বিষয়টি হলো – এই বড় আকৃতির জাহাজগুলিও বাংলাদেশে খালাশ করা যাচ্ছে। ডীপ সী পোর্ট যদি আমাদের না-ই থাকবে, তাহলে এত্তোবড় জাহাজ আমরা কি করে খালাশ করলাম?? মালামাল খালাশ করতে আমাদের জেটি লাগেনা, এটা আমাদের নদী সম্পদের প্রাচুর্য্যের কারণে, বন্দরের অসুবিধার কারণে নয়। অন্য দেশের এই সুবিধা নেই বলে আমরা কি আমাদের এই সুবিধাকে unfair advantage মনে করবো?? সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই সুবিধা দিয়েছেন – এটা অন্যদের ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু আমরা সেটা না বুঝে অন্যের প্ররোচনাতে পথভ্রষ্ট হবো কেন? এভাবে মালামাল খালাশ দেখতে sexy নয়, কিন্তু এটা অনেক বেশি কার্যকর। এই পণ্যগুলি সব মিলে যদি বন্দরে নামানো হতো, তাহলে বন্দর যে হিমসিম খেয়ে উঠতো সেটাই শুধু নয়, সেই মালামাল ঢাকা এবং এর আশেপাশের শিল্পাঞ্চলে আনতে হতো রাস্তা এবং রেল ব্যবহার করে, যা কিনা নৌপথের চাইতে অনেক বেশি ব্যয়সাধ্য। বর্তমানে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোট কনটেইনার জাহাজের (১৪০ থেকে ১৮০ টিইউএস) মাধ্যমে ঢাকার আশেপাশে ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল তৈরি করে কনটেইনার নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি, যা খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গভীর সমুদ্র বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে শুরু করলে ছোট জাহাজের স্পেস কতটুকু থাকবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। মানে আবারও সেই রাস্তার উপরেই চাপ দেয়া। আর আমাদের নদীমাতৃক দেশে রাস্তা এবং রেলপথ তৈরি করতে প্রচুর সেতু তৈরি করতে হয়; আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তা তাড়াতাড়ি নষ্টও হয়ে যায়। রাস্তা তৈরির পুরো বিটুমিন আমদানি-নির্ভর।

এই বাল্ক পণ্যগুলি ছাড়া যে পণ্যগুলি রয়েছে, সেগুলি খালাশ করতে জাহাজকে জেটির পাশে আসতে হয়। যেমন মোটরগাড়ি; যা আনা হয় roll-on/roll-off জাহাজে, যেগুলিতে গাড়ি নিজের চাকায় চালিয়ে জাহাজে ঢোকানো এবং বের করা হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারি রয়েছে কিছু, যেগুলি জেটি ছাড়া খালাশ করা যায় না। আর রয়েছে কনটেইনার, যা খালাশ করতে জেটি লাগে; লাগে ক্রেন। তার মানে কনটেইনার খালাশ করতে বা কনটেইনার ভরতে জাহাজের সাইজের সাথে বন্দরকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আমাদের চট্টগ্রাম, মংলা এবং পায়রা বন্দরের ‘সমস্যা’ এখানেই। এটা আসলে কতোটা বড় ‘সমস্যা’, সেটা এখন আলোচনা করা যাক।
   
বড় বড় জাহাজ কোম্পানিগুলি তাদের জাহাজের আকৃতি বড় করছে প্রতি নিয়ত। আর সারা দুনিয়ার মানুষকে বলে দিচ্ছে বন্দরের সাইজ বড় করার জন্যে। তাহলে গভীর সমুদ্র বন্দর কার সুবিধার জন্যে?

ডিমের সাইজ অনুযায়ী মুরগি?

উপরে কনটেইনার জাহাজের যে লাইনারের কথা বলেছি, সেগুলি হলো শহরের বাস সার্ভিসের মতো। কয়েকটা বিশেষ স্টেপেজেই থামবে। আপনাকে বাসায় যেতে হলে বাস স্টপেজ থেকে পায়ে হাঁটতে হবে বা রিক্সা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমি যদি বলি যে বাসকে আমার বাড়ি পর্যন্ত আসতে হবে, তাহলে আমার বাড়ির দরজা পর্যন্ত রাস্তা বাস আসার মতো চওড়া করতে হবে। আর আমাকে শিওর করতে হবে যে আমার বাড়ি থেকে বাস ভর্তি করে মানুষ উঠবে, শুধু এক-দুইজন নয়। আমি যদি আজকে এই বাস আমার বাসা পর্যন্ত আনতে গিয়ে রাস্তা প্রশস্ত করি, তাহলে আমাকে শিওর হতে হবে যে ভবিষ্যতে সেই বাস আবার অন্য কোন যুক্তি দেখিয়ে আমার বাসা পর্যন্ত আসা বন্ধ করে দেবে না। কারণ সেই বাস কেনার সাধ্য আমার নেই; অন্যের বাসের উপরেই আমার নির্ভর করতে হবে। আমি নিজে কিনলে ছোট গাড়ি কিনবো, যে দিয়ে যাতায়াত করলে খরচ অনেক বেশি পড়ে যাবে। অর্থাৎ আমার বাসা পর্যন্ত বাসের রুট আনতে হলে ওই ব্যাটা বাস-অলাদের Economy of Scale-এর সাথে আমাকে খাপ খাওয়াতে হবে। মানে আমাকে জাহাজের সাথে মিলিয়ে বন্দর বানাতে হবে, যা কিনা ডিমের সাইজ মাথায় রেখে মুরগি ডিজাইন করার মতো হয়ে যাচ্ছে!!

বিশাল আকৃতির এই জাহাজগুলিকে বন্দরে ঢোকানোর জন্যে বিপুল পরিমাণ ড্রেজিং করতে হচ্ছে; বিশাল খরচ করে তৈরি করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। অতিরিক্ত ড্রেজিং-এর কারণে পরিবেশের বারোটা বাজছে। জার্মানির এলব নদীতে রয়েছে ইউরোপের অন্যতম বড় বন্দর হামবুর্গ। জোয়াড়ের সময়ে এখানে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারে, যা মোটেই কম নয়। আমাদের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্যেও এমনই কিছু পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু হামবুর্গ বন্দরের লোকজন চাইছিলেন এখানে আরও বড় জাহাজ আসুক, নাহলে বন্দর হিসেবে হামবুর্গের গুরুত্ব কমে যাবে। নতুন তৈরি করা বিশাল জাহাজগুলি অন্য বন্দরে চলে যাবে। আরও বড় জাহাজ আনতে গেলে বন্দরের গভীরতা বাড়ালেই শুধু হচ্ছে না, চ্যানেলের প্রশস্ততাও বাড়াতে হবে, নাহলে জাহাজ ঘোরানো সম্ভব হবে না। হামবুর্গে এই পরিকল্পনার প্রতিবাদে পরিবেশ আন্দোলন গ্রুপগুলি আদালত পর্যন্ত গিয়েছে; কারণ এই বিশাল ড্রেজিং-এর ফলে পরিবেশগত প্রভাব মোটেই অনুকূল হবে না। তবে যেহেতু পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ বন্দরই বেসরকারি মালিকানায় রয়েছে, তাই অর্থই যে সকল চিন্তার মূলে থাকবে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাতে পড়ার পর থেকে খরচ কমানোর চিন্তা নেতৃত্বে থাকা কোম্পানিগুলিকে আরও বেশি পেয়ে বসেছে। জাহাজের মাপ অনুযায়ী তারা সকলকে বন্দর তৈরি করে নিতে বলছে, যদি তারা চায় যে তাদের দেশে ঐসব বড় কনটেইনার জাহাজগুলি আসতে হবে। তবে বন্দর তৈরি করে ফেলার পরে নতুন কোন ফ্যাক্টর এখানে চলে আসবে না – এই প্রতিশ্রুতি জাহাজ কোম্পানিরা দেবে না। আর সেই গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে গিয়ে আবার ভূরাজনৈতিক রেষারেষিতে পড়েছে অনেক দেশ। পাকিস্তানে, শ্রীলংকায় আর মিয়ানমারে বন্দর বানিয়েছে চীন; ইরানে বন্দর বানাচ্ছে ভারত। জাহাজ কোম্পানিগুলির টাকার চিন্তাকে প্রাধান্য দেবার ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই উদ্ভট পরিস্থিতি। বাংলাদেশেও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে কম ঠেলাঠেলি হয়নি চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে; এখনও চলছে। কিন্তু কেউ একবারও বললো না যে এই বন্দর বানাতে তো ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে; জাহাজ কোম্পানিগুলি বরং কয়টাদিন কম লাভে ব্যবসা করে না কেন? অত বড় জাহাজ না বানিয়ে একটু ছোট জাহাজে কি একেবারেই হবে না? খরচ বাঁচাতে গিয়ে গত কয়েক বছরে শীর্ষ বিশ জাহাজ কোম্পানির মাঝে কয়েকটি merger বা একত্রীকরণ হয়েছে। পরিস্থিতি যেভাবে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে গুটি কয়েক কোম্পানির হাতেই দুনিয়ার সকল বাণিজ্য চলে যাবে। কারণ সেই Economy of Scale ছাড়া তো সে আর কোনকিছুকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। তার লাভ তো সে কমাবে না কিছুতেই!

যুক্তি আসবে যে আমাদের দেশে যেভাবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়ছে, তাতে আমরা ডীপ সী পোর্ট তৈরি না করে কি করে পারবো? কথা হচ্ছে কনটেইনার ওঠাতে-নামাতে কনটেইনার টার্মিনাল লাগে, ডীপ সী পোর্ট লাগে না। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার টার্মিনাল ছাড়াও আমরা মংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং-এর ব্যবস্থা করতে পারি অতি সহজেই (পশ্চিমা কোম্পানির হাতে বন্দর তুলে না দিয়ে); সেটা গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো এতো খরচ হবে না। সেখানে বর্তমানে যে সাইজের ফীডার ভেসেল (১,০০০ থেকে ১,৫০০ টিইউএস) দিয়ে কনটেইনার আনা-নেওয়া হচ্ছে, সেটাই চলবে। আর আমরা নিজেদের দেশে ওই সাইজের কিছু জাহাজ তৈরি করে সমুদ্রে চালাতে পারবো। সেখানে নাবিক থাকবে আমাদের নিজেদের লোক। জাহাজ তৈরির এই অর্ডারগুলিও পাবে দেশের শিপইয়ার্ড। এটাই হবে ম্যারিটাইম নেশনের বুনিয়াদ। বর্তমানে বিদেশী জাহাজ দিয়েই আমরা সকল বাণিজ্য করছি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসেবে পণ্য আমদানিতে খরচ হয়েছে মোট ৩৯.৭১ বিলিয়ন ডলার, আর রপ্তানি হয়েছে ৩৩.৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য (মোট রপ্তানি আয় যদিও ৩৪.২৪ বিলিয়ন)। দু’টা মিলিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য হয় ৭৩.১৫ বিলিয়ন, যার প্রায় পুরোটাই বিদেশী জাহাজের উপর ভর করে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসেবে বলা হয়েছে যে পণ্যের মূল্যের কমপক্ষে ১০% পর্যন্ত খরচ হয় শিপিং-এ। এই হিসেবে আমরা গত অর্থবছরে কমপক্ষে ৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা দিয়েছি বিদেশী শিপিং কোম্পানিগুলিকে!! আমরা নিজেরা নিজেদের মার্চেন্ট ফ্লিট তৈরি করতে চাইলে বিদেশী শিপিং কোম্পানিগুলি এর বিরুদ্ধে নামবে নিঃসন্দেহে। এই দুর্মূল্য বাজারে কেউ ৭ বিলিয়ন ডলারের লোভ সামলাতে পারবে না। অন্ততঃ যাদের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আরও টাকা উপার্জন, তার কাছে এটা জীবন-মরণের মতো ব্যাপার।
  
আমরা যখন গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্যে অন্ধ হয়ে যাই, তখন আমরা দেখতে পাই না যে এই বন্দর দিয়ে আসলে কি কি পণ্য আসবে; বরং আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ওই Big Shiny Object, যার অর্থ আমাদের কাছে কোনদিনই পরিষ্কার ছিল না। গভীর সমুদ্রবন্দর আসলে একটি "কনটেইনার পোর্ট"; অথচ "কনটেইনার" কি জিনিস সেটাই আমরা বুঝিনি!!

আদৌ কি আমাদের কোন লাভের আশা ছিল?

বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করলে কি আমরা একটা জাহাজ লাইনার কোম্পানি তৈরি করতে পারবো? ওই ২০ফিট ৪০ফিট বাক্সের উপরে আমাদের একটা নাম কি সেঁটে দিতে পারবো? কয়েক লক্ষ টনের গোটা পাঁচেক জাহাজ বানাতে পারবো? এই উত্তরগুলি যদি ‘সম্ভবত না’ হয়, তাহলে কোন হিসেবে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়ে আমরা গভীর সমুদ্র বন্দর করতে চাইছি? জাহাজ কোম্পানিগুলির Economy of Scale-এ সুবিধা দেবার জন্যে? কনটেইনারের ভেতরে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয় সেগুলির সুবিধার্থে তো, তাই না? তো কতো টাকার সুবিধা আমরা পাবো, যেটার জন্যে আমাদের সেই বন্দর বানিয়ে প্রতি বছর মেইনটেন্যান্স খরচ উসুল হবে? আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টস (যা কিনা নিজেই আমদানি-নির্ভর) থেকে আমরা কতটা value addition পাই (এবং ভবিষ্যতেও পেতে থাকবো) যেটা আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দরের খরচ উঠিয়ে দেবে? দর্জির মাইনে দিয়ে কি ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধ করা যাবে (সুদ সহ)?

এরপর এই গভীর সমুদ্রবন্দর প্রজেক্টের রয়েছে কিছু বাই-প্রডাক্ট। যেমন কোন জাহাজকেই আর কলম্বো বা সিঙ্গাপুর বা কেলাং যেতে-আসতে হবে না; বড় জাহাজ কোম্পানির দৈত্যাকৃতি জাহাজগুলিই আমাদের এখানে চলে আসবে। অর্থাৎ কোন জাহাজে আর বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ ওড়ানোর দরকার নেই! আমাদের নিজেদের কোন জাহাজ আর থাকবে না। এখনও খুব একটা আছে যে তা নয়, তবে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে আর থাকার প্রশ্নও থাকবে না। আমরা নাবিক তৈরি করবো বিদেশী জাহাজের জন্যে, যদি তারা কোন অভিজ্ঞতা ছাড়া বাংলাদেশী নাবিক নিতে ইচ্ছুক হয় (কারণ হাতেকলমে শেখানোর জন্যেও আমাদের কোন বাণিজ্য জাহাজ থাকবে না)। যারা বড় কোম্পানি তারাই বাংলাদেশের বন্দরে জাহাজ ঢোকাবে আর বের করবে। বাংলাদেশের কোন জাহাজ সমুদ্রে না থাকা মানে গুডবাই ‘ব্লু ইকনমি’ এবং ‘ম্যারিটাইম নেশন’। আমরা শুধু যেটা করতে পারবো তা হলো বড় কোম্পানিগুলির জন্যে গতর খেটে জাহাজ তৈরি করে দিতে পারবো। আমাদের জাহাজ তৈরি শিল্পের অবস্থাও হবে বাঙ্গালীর চিংড়ি চাষের মতো – এত্তো এত্তো চিংড়ি সে উতপাদন করে, কিন্তু সবটাই সে নিজে না খেয়ে অন্য জাতির কাছে বিক্রি করে দেয় – শুধুমাত্র ক’টা টাকা পাবে বলে। আহা রে!

আমরা এই খেলাটা ধরতে পারবো কবে?

কোম্পানির লোগো লাগানো ওই বাক্সগুলি কতো শক্তিশালী তাই না? আসলেই কি তাই? না, তা নয়। ওই বাক্সকে আবর্তে যে চিন্তাটা, সেটা হচ্ছে শক্তিশালী। বাক্সটা তৈরি করা কতো সহজ; কিন্তু ইচ্ছে করলেই সেটা তৈরি করা যায় না। কি অদ্ভূত! চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশগুলিও এই বাক্স ওঠা-নামার বন্দর তৈরি করতে গিয়ে মারামারি করছে! এই বাক্সের চিন্তা এসেছে ১৯৬০-এর দশক থেকে, যখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার দখল নিতে থাকে। কনটেইনার কোম্পানিগুলির বেশিরভাগই গত দুই-তিন দশকে তৈরি হয়েছে; পুরোনো কোম্পানি আছে খুব কমই – যেমন APM-Maersk, CMA CGM, Hapag-Lloyd, APL এবং জাপানি দুই-একটা। বাকি বেশিরভাগই, যেমন MSC, Evergreen, COSCO, CSCL, Hanjin ইত্যাদি – এ এসবই তৈরি হয়েছে গত কয়েক দশকে। পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সবচাইতে বেশি, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এখানে মাত্র একটি – APL, তা-ও আবার সেটা অত বড় নয়, তা-ও আবার সেটা সিঙ্গাপুরে বিক্রি হয়ে গেছে। তার মানে কি এই যে যেই সমুদ্র বাণিজের দখল নিতে ইউরোপিয়রা কয়েক’শ বছর যুদ্ধ করেছে সেই সমুদ্র বাণিজ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদাসীন? প্রশ্নই আসে না। পরাশক্তি তার শক্তির কিছু স্থানে ছাড় দেবে না; আর সেগুলির একটি হচ্ছে সমুদ্র বাণিজ্য। মার্কিনীরা সমুদ্রের নিয়মগুলি ঠিক করে দেয় শুধু। বাকিরা সবাই সেই নিয়ম মেনে চলে। এবং নিয়মের দাস হিসেবে থাকে। এবং সেই নিয়মকে ধর্মগ্রন্থরূপে ধরে নিয়ে নিজেদের মাঝে প্রভাবের লড়াই করে চলে – যেমনটি চীন এবং ভারত করছে।

আসলে বাংলাদেশের পুরো সমুদ্র উপকূলই গভীর সমুদ্র বন্দর – শুধুমাত্র ভৌগোলিক কারণে, যা কিনা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। বাংলাদেশে নদীগুলি না থাকলে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমরা পদ্মা সেতুর জন্যে ৫৩,০০০ টনের জাহাজে পাথর এনে খালাশ করতে পারতাম না – এটা আমরা কতটুকু বুঝি?? ব্রিটিশরা যে এই এলাকার maritime potential উপলব্ধি করেছিল, সেটা এর আগেই লিখেছি। আমরা যতদিন চিন্তাহীনভাবে অন্যের কথায় নাচতে থাকবো, ততোদিন আমরা অন্যের ক্রীড়নকই থেকে যাবো। কনটেইনার খারাপ জিনিস নয়, কিন্তু যে চিন্তাটা কনটেইনারের সাথে আসে, সেই চিন্তাখানা বুঝতে হবে। কনটেইনারকে না বুঝে কনটেইনার পোর্ট নিয়ে বেহুদা লম্ফ-ঝম্ফ বোকার স্বর্গে বসবাস। কনটেইনার কোম্পানিগুলি কি আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে বানাতে তাদের কোন নীতিতে পরিবর্তন আনবে না? কে গ্যারান্টি দিচ্ছে যে ১০ বিলিয়ন খরচ করে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে করতেই সেটা obsolete হয়ে যাবে না?? যে বাক্সের মোহ আমাদের দেখানো হচ্ছে, সেটার মাঝে আমাদের ব্লু ইকনমি নেই, ম্যারিটাইম দেশ নেই; রয়েছে ওই সমুদ্রের মধ্যিখানে। বাক্সের মোহে আমরা শুধু আমাদের সমুদ্রাভিযানকে পিছিয়েই দেব না, আমাদের দাসত্বের শৃংখলকে চিরস্থায়ী করে নেব!

বাক্সে বাক্সে বন্দী বাক্স
বাক্সে বাক্সে বন্দী বাসা
বাক্স দিয়ে বাক্স গড়া
বাক্সতে সব স্বপ্ন আশা।।

Friday 5 August 2016

তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও আমাদের জন্যে শিক্ষা

০৫ অগাস্ট ২০১৬

 
তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছে যে ভূরাজনীতিক্তে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ সেই দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে; সেই দেশের শাসকে জন্যে নয়, যাকে নিয়ে কিনা মিডিয়াতে সবচাইতে বেশি আলোচনা হচ্ছে।

তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে অনেক লেখা পড়া হয়ে গেছে সবার। তবে সেই ঘটনার মাঝে আমাদের জন্যে কি শেখার রয়েছে, সেটাই সবচাইতে বড় বিষয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানেই তথ্যের সবচাইতে বড় ঘাটতি লক্ষ্যনীয়। আজকে সেই দিকটা নিয়েই আলোচনা করবো। ২০১৬ সালের প্রায় পাঁচ মাস বাকি; এখনই এই বছর একটা ঘটনাবহুল বছর বলে সবার কাছে পারিচিতি পেতে যাচ্ছে। প্রতি মাসে নয়, এমনকি প্রতি সপ্তাহেও নয়; একেবারে প্রতিদিনই কিছু কিছু বড় ধরনের ঘটনা দেখতে হচ্ছে টিভির পর্দায় এবং খবরের কাগজে। প্রতিদিন এরকম ওজনদার খবরের ভারে মানুষের নুয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। যদিও নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে বিপদের আশংকার কথা বলছিলাম অনেকদিন থেকেই, এটা মোটামুটি জানা ছিল যে মাথার উপরে কিছু একটা ভেঙ্গে না পড়লে মানুষের সন্বিত ফেরে না। আর সেটা আমাদের ফিরেছে গুলশানের ঘটনার পরে। এখন আন্তর্জাতিক বড় ঘটনাগুলিকেও যেন খুব বেশি দূরের মনে হচ্ছে না।

তুরস্কের সমস্যা এর ইতিহাসের মাঝে নিহিত…

তুরস্কে কি কি ঘটেছে সেটা বর্ণনা না করে বরং ঘটনাগুলির অর্থ কি দাঁড়ায়, সেটা নিয়ে কথা বলবো; কারণ সেখানেই আমাদের জন্যে শেখার রয়েছে। প্রথমে বুঝতে হবে তুরস্কের রাজনীতির মূল বিষয়; যার মাঝ দিয়ে তুরস্কের ইতিহাস পর্যালোচনা জরুরি। ভূরাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত সাড়ে চার’শ বছরের বেশি সময় ধরে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ছিল ইস্তাম্বুলে। বিশ্বের মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব ছিল ইস্তাম্বুলে আসীন খলিফার নেতৃত্বের উপরে। বিশ্বের বাকি মুসলিম শাসকগণও ইস্তাম্বুলকেই ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে মেনে চলতেন এবং মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার্থে খলিফার সাহায্য চাইতেন। এরকমই একটা উদাহরণ এর আগের একটা লেখায় দিয়েছিলাম, যখন খলিফা আচেহ-এর (ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরে) সুলতানকে সহায়তা দান করেছিলেন পর্তুগীজদের থামাতে। সেটা ছিল খলিফার আদর্শিক হস্তক্ষেপ। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে উসমানিয়া খিলাফতের অধীনের পুরো এলাকা ব্রিটিশরা দখল করে নেয় এবং ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে এই এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির জন্ম দেয়। এর মাঝে একটি দেশ হচ্ছে তুরস্ক, যার ক্ষমতা চলে যায় মুস্তফা কেমাল (কেমাল আতাতুর্ক) নামের একজন সামরিক অফিসারের হাতে। ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চরা কেমালকে ক্ষমতায় যেতে সবধরণের সহায়তা দান করেছিল। কেমাল ১৯২৩ সালে ক্ষমতা নিয়ে খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং দেশ থেকে ইসলামের সকল চিহ্ন মুছে ফেলতে সক্রিয় হন। কেমালের অত্যন্ত কঠোর এই প্রক্রিয়াকে চালু রাখার দায়িত্ব নেয় কেমালের আদর্শে দীক্ষিত সেকুলার সেনাবাহিনী, যারা ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চদের দ্বারা সমর্থনপুষ্ট ছিল। এভাবে তুরস্কের জন্ম হয় ইউরোপিয়ানদের হাতে। তবে মার্কিনীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে তুরস্ককে ইউরোপিয় প্রভাব থেকে বের করে আনতে ব্যর্থ হয়। তবে মোটা দাগে কমিউনিজমের বিপক্ষে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে নিয়ে খুশিই ছিল, যদিও দেশটিতে গণতন্ত্রের প্রচলন ছিল না বললেই চলে।

১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তুরস্কের সেনাবাহিনী বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে রাজনীতিতে ইসলামের প্রবেশ রোধ করে, যদিও মানুষ বারংবার ইসলামের পক্ষেই রায় দিচ্ছিল। কেমালের তৈরি সেনাবাহিনীর এই স্বেচ্ছাচারিতা এবং পশ্চিমাদের তাতে পরোক্ষ সমর্থন তুরস্কের জনগণের মাঝে সেকুলার-বিরোধী এবং পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। এই সুযোগে রিসেপ তাইয়িপ এরদোগানের একেপি দলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে। একেপি নামমাত্র ইসলামিক দল হিসেবে জনগণের ভোট আদায়ে সক্ষম হয় এবং ২০০২ সাল থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপিয় সমর্থিত সেনাবাহিনীর সেকুলার অংশের ক্ষমতা কমতে থাকে। ইসলামের নামে রাজনীতি করার কারণে এরদোগানকে জনগণ ক্ষমতা প্রদান করতে থাকে এবং সেই ক্ষমতা এরদোগান তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকেন। তবে ইস্তাম্বুলের সুলতানরা যেভাবে মুসলিম বিশ্বকে সহায়তা দিয়েছিল, সেটা এরদোগান করেননি। বরং মার্কিনীদের স্বার্থই রক্ষা করে চলেছেন তিনি। তুরস্কের পাশেই সিরিয়াতে পাঁচ বছরে পাঁচ লক্ষ মুসলিমের জীবনাবসানও এরদোগানকে নড়াতে পারেনি, কারণ সেটা করতে গেলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হতেন। তবে তুরস্কের মানুষ এরপরেও এরদোগানের সাথেই থাকে, কারণ তাদের কাছে এরদোগানের শাসন কেমালের সেকুলার সামরিকতন্ত্রের কঠোরতার তুলনায় ভালো মনে হয়েছে। তুরস্কও আশেপাশের দেশগুলির যুদ্ধ থেকে দূরে থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের এই নীতি পছন্দ হয়নি। তারা তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত দেখতে চেয়েছে। এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে নামতে পারেননি তুরস্কের জনগণের সমর্থনের অভাবে। পরপর কয়েকটি জঙ্গী হামলাও তুরস্কের নীতি পরিবর্তন করতে পারেনি।
 
কেমাল আতাতুর্কের বিভীষিকাময় সেকুলার-তন্ত্রের ভয়েই তুরস্কের জনগণ রাস্তায় নেমে ট্যাঙ্কের সামনে জীবন দিয়েছে। ইসলামের উপরে আঘাত ঠেকাতেই তারা এটা করেছে; এরদোগানকে বাঁচাতে নয়!

সেকুলার বিদ্রোহ…

ঠিক এই সময়টাতেই সামরিক অভ্যত্থানের সূচনা হয়, যখন অভ্যত্থানকারীরা টিভি স্টেশন দখল করে এটাকে জোর গলাতেই ‘সেকুলার অভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দিতে থাকে। বিদ্রোহী সেনাদের এই শব্দগুলি শুনে তুরস্কের মানুষ চোখের সামনে আবারও কেমালের বিভীষিকাময় আধ্যায়কে দেখতে পায়। যদিও ইউরোপীয় সমর্থিত সেকুলার গোষ্ঠী এই অভ্যুত্থানে জড়িত থেকেছে, তথাপি তুরস্কের মাটিতে ইনচিরলিক বিমান ঘাঁটি (যা কিনা মার্কিনীরা নিয়ন্ত্রণ করে) এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ায় সন্দেহের তীর যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই তাক হয়। এরদোগান এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী ফেতুল্লা গুলেনকে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার কথা বলতে থাকেন, যদিও সবাই জানে যে গুলেনের দল নিতান্তই দন্তহীন। এরদোগান এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেবেন, যাদের একটা বড় অংশ থাকবে ইউরোপিয়-সমর্থিত সেকুলার সমাজের লোকজন।

তবে এরদোগান কর্তৃত্ব করতে চাচ্ছেন বলে ‘মানবাধিকার’এর দোহাই দিয়ে এখন আবার পশ্চিমা-সমর্থিত অভ্যুত্থানকারীদেরও বাঁচানোর চেষ্টা চলবে। দেশের বিরুদ্ধে, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে যে লোকগুলি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো, তাদেরকেই এখন ‘দয়া’ দেখানোর কথা বলা হবে। অথচ এদের হাতে বহু তুর্কী মৃত্যুবরণ করেছে। আবার তুরস্কের ভেতরে যুগ যুগ ধরে subversion চালানো এজেন্টরা ধরা পরে যাবার পরে এখন বিদেশের দিকে চেয়ে থাকবে। এরা বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান সফল করতে সেকুলার সেনাদের সরাসরি সমর্থন দিয়ে তুর্কী জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। বিদেশী এজেন্টদের এহেন জঘন্য কার্যকলাপের পরেও এদের বাঁচানোর চেষ্টাটা নিঃসন্দেহে অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি পশ্চিমাদের সরাসরি সমর্থনের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করবে। এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আঙ্গুল তাক করবেন দেশের মানুষের যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী চেতনাকে কাজে লাগানোর জন্য। গাজা অপারেশনের সময়ে ইস্রাইলীরা তুরস্কের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মেরে ফেললেও এরদোগান কিন্তু মুখেই বকর বকর করেছিলেন; কাজে কিছুই করেননি। এবারেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি শুধু মুখেই খই ফোটাবেন।

এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী সরানোর কার্যকলাপ ইউরোপিয়রা পছন্দ করছে না এবং তুরস্ককে ন্যাটো থেকে বের করে দেবার কথাও তারা তুলছেন। কিন্তু যেই তুরস্ক সাড়ে চার’শ বছরেরও বেশি সময় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে, যে তুরস্ককে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়েছে যাতে তাদের ইসলামের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা না থাকে, যে তুরস্কে ইসলামের পূনরাবির্ভাব ঠেকাতে সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করেছে পশ্চিমারা, যে তুরস্ককে তার ইতিহাস থেকে সরিয়ে রাখতেই তাকে ন্যাটোর মাঝে আটকে রাখা হয়েছে, সেই তুরস্ককে একুশ শতকে এসে ছেড়ে দেবার পাত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়। ন্যাটোর সদস্যপদই তুরস্ককে ভূরাজনৈতিকভাবে আটকে রাখার পদ্ধতি। আর এই আটকে রাখার চেষ্টা যে স্থায়ী হবে না, সেটা পশ্চিমারা জানেন অনেক আগ থেকেই। ভূরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব স্যামুয়েল হান্টিংটনের কথায়ঃ

“What, however, if Turkey redefined itself? At some point, Turkey could be ready to give up its frustrating and humiliating role as a beggar pleading for membership in the West and to resume its much more impressive and elevated historical role as the principal Islamic interlocutor and antagonist of the West…. Having experienced the bad and the good of the West in secularism and democracy, Turkey may be equally qualified to lead Islam. But to do so it would have to reject Ataturk’s legacy more thoroughly than Russia has rejected Lenin’s”.

হান্টিংটন এই কথাগুলি লিখেছিলেন তার “The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order” বইতে, যা দুই দশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। হান্টিংটন এখানে এরদোগান বা কোন রাজনৈতিক দলের কথা চিন্তা করে এই কথাগুলি বলেননি; বলেছিলেন তুরস্কের মানুষের কথা চিন্তা করে, কারণ ভূরাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব খুব কম, বরং জনগণের গুরুত্ব বেশি। রাজনৈতিক দল আসবে-যাবে, কিন্তু দেশ চলবে জনগণ যেদিকে যেতে যায়, সেদিকে। তাই তুরস্কের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে এবং অভ্যত্থান চেষ্টার বাস্তবসম্মত হিসেব কষতে গেলে তুরস্কের জনগণ কি চায়, সেটা বুঝতে হবে।

তুরস্কের ভূরাজনীতি তুরস্কের জনগণের হাতে, এরদোগানের হাতে নয়

অভ্যত্থান চেষ্টা প্রথমে দেখে মনে হচ্ছিল সফল হচ্ছে, কিন্তু সব পালটে গেল যখন ৩০-৪০ জনের একদল সাহসী বেসামরিক লোক “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিয়ে বিদ্রোহী সেনাদের ট্যাঙ্কের সামনে চলে আসে। সৈন্যরা ভয় পেয়ে গুলি চালিয়ে বসে; তারা চিন্তাও করেনি যে কতবড় ভুল তারা করেছে। বীর এই বেসমরিক নাগরিকদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তুরস্কের মানুষ আর নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকতে পারেনি। কেমালের দুস্বপ্ন তাদের পেয়ে বসে এবং দলে দলে তারা বিদ্রোহকারীদের উপরে চড়াও হয়। রাস্তায় মানুষ দেখে সেনাবাহিনীতেও একই ঘটনা ঘটে। ইনচিরলিক ঘাঁটিতে বিপদের বাঁশি বেজে ওঠে। মার্কিনীরা বুঝে ফেলে যে কিছুক্ষণ আগেও যা নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছিল, তা এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত। রাস্তায় মোতায়েন বিদ্রোহী সেনারা আত্মসমর্পণ করতে থাকে এবং জনগণ খালি হাতে এদের উপরে প্রতিশোধ নিতে থাকে। ট্যাঙ্কের সামনে আত্মাহুতি দেয়া মানুষগুলি এরদোগানের প্রতি ভালোবাসার কারণে জীবন উতসর্গ করেনি, করেছে ইসলামের উপরে আঘাতের আশংকায়। জনগণের এই চিন্তাটাই স্যামুয়েল হান্টিংটনসহ অন্যান্য পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা বুঝেছিলেন। যেকারণে তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছে সবসময়।

আইসিস-এর হামলা তুরস্ককে নড়াতে পারছিল না, তাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ছিল পশ্চিমারা। এখানে এরদোগান আসলে তেমন বড় কোন বিষয় নয়, যদিও মিডিয়া এরদোগানকেই বড় করে প্রচার করছে। এরদোগানকে ছোট্ট করে ফেলেছে সাধারণ মানুষের ছোট্ট একটি দল, যারা বিশাল হৃদয় নিয়ে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জনগণের শক্তির সামনে ‘সুলতান এরদোগান’ নামে খ্যাত পশ্চিমের বন্ধুটিকে দুর্বল মনে হয়েছে। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীও হতে যাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক সেসময় তুরস্কের জনগণ দেখিয়ে দিল যে ভূরাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করে, এরদোগান নয়।
  
পারভেজ মুশাররফ যুক্তরাষ্ট্রকে সেবা করার জন্যেই ক্ষমতা দকল করেছিলেন। আর যুক্তরাষ্ট্র তাকে বন্ধুরূপে নেয়াতে বোঝা হয়ে গেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গণতন্ত্রের মূল্য কতটুকু। পশ্চিমাদের কথায় চললে কি হয়, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান আমাদের জন্যে একটা বাজে উদাহরণ হয়ে আছে। আর যা-ই হোক পাকিস্তান হওয়া যাবে না!

আমরা কি করবো, তার আগে বরং ঠিক করি “কি করবো না”

তুরস্কের জনগণের ভাষা বুঝতে যদি আমরা ভুল করি, তাহলে জনগণের শক্তিকেও আমরা বুঝতে ভুল করবো। পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের সাথে যে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি নিয়েছে, সেটা থেকে উদ্ধার পেতে জনগণকে একত্রিত হতে হবে। ভূরাজনীতিতে আমাদের অবস্থান বোঝার সময় আমাদের হয়েছে। আদর্শিক যুদ্ধের পূণরাবির্ভাবের মাঝে আমাদের অবস্থান কোথায়, সেটা বুঝতে হবে আমাদের। পাকিস্তানের মতো ভুল পথে চললে দেশের এবং দেশের মানুষের উপরে ভয়াবহ বিপর্যয় চলে আসবে।

২০০১ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সকালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মুশাররফ বৈঠক করছিলেন আগের রাতে নিউ ইয়র্কে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে, যখন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কলিন পাওয়েলের ফোন এলো। মুশাররফ বললেন যে বৈঠক শেষে কল-ব্যাক করবেন। কিন্তু পাওয়েল চাইলেন যে মুশাররফ যেন বৈঠক ছেড়ে এসে ফোন ধরেন। আজ্ঞাবহ দাসের মতো মুশাররফ তা-ই করলেন। পাওয়েল বললেন, “You are either with us or against us”. পরদিন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রধান, যিনি তখন ওয়াশিংটনে ছিলেন, জানালেন যে ডেপুটি পররাষ্ট্র সচিব রিচার্ড আরমিটেজ তাকে বলেছেন পাকিস্তানকে ঠিক করতে হবে যে তারা কোন দলে থাকবে। যদি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে পাকিস্তান “should be prepared to be bombed back to the Stone Age.” মুশাররফ এসবকিছু বর্ণনা করেছে তারা বই “In the Line of Fire: A Memoir”-এ। তিনি পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার প্রসঙ্গে বলেছেনঃ

“My decision was based on the well-being of my people and the best interests of my country – Pakistan always comes first. I war-gamed the United States as an adversary. There would be a violent and angry reaction if we didn’t support the United States. Thus the question was: if we do not join them, can we confront them and withstand the onslaught? The answer was no, we could not”.

পারভেজ মুশাররফের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা আজ সকলের সামনে পরিষ্কার। এটা বলতে দ্বিধা করি না যে মুশাররফের মতো নেতৃত্ব আমাদের দেশে আসেনি বলেই আমরা এখনো পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাইনি। নাহলে এদেশে জঙ্গী তৈরির কারখানাকে ফুয়েল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করা থেকেও আমরা পিছপা হতাম না। সেই ড্রোন ঘাঁটি ব্যবহার করে ‘ভুল করে’ হামলা করা হতো কওমী মাদ্রাসাগুলিতে, আর তারপর থেকে জঙ্গী তৈরির প্রোডাকশন লাইন প্রস্তুত হয়ে যেত! সেই জঙ্গীদের দিয়ে হামলা করাতো সেনাবাহিনীর পরিবারদের উপরে, যাতে সেনাবাহিনী ক্ষেপে গিয়ে জঙ্গীদের পরিবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলে – ঠিক যা যা পাকিস্তানে করা হয়েছে। দেশকে টুকরা টুকরা করে ফেলার চমতকার এক ফর্মূলা, যা পাকিস্তানে বেশ সফলতা পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সমস্যা যে পাকিস্তানের সরকার নয়, বরং সেদেশের জনগণ, তার প্রমাণ আমরা পাই প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন-এর লেখা ‘Hard Choices’ বইতে। তিনি সেখানে লিখেছেন যে ২০০৯ সালে পাকিস্তানের জনগণের মুখোমুখি হতে তিনি কতটা শঙ্কিত ছিলেন। তিনে লিখেন যে, “পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্বেষও বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের মিডিয়াগুলো অসন্তোষের আগুনে বরাবরই ডিজেল ঢেলেছে। তারা পাকিস্তানে তালিবান দৌরাত্ম বাড়ার জন্যে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে। এছাড়াও আরও প্রচার হতে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র নাকি ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানের পেছনে লেগেছে। এসব ছাড়াও আরও অনেক কারণে, বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেয়ার পরেও, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব বাড়তেই থাকে। আর এজন্যেই পাকিস্তান সরকারের পক্ষেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে থাকে”। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো হিলারি ক্লিনটন পাকিস্তানের সরকারকে বন্ধু মনে করছেন; আর জনগণকে মনে করছেন সমস্যা! এ-ই হলো গণতন্ত্রের তথাকথিত ধারক ও বাহক। তিনি আরও বলেন, “উদ্দেশ্য … পাকিস্তানিদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব কমানো। …… সবাই বললো, ‘পাবলিক মনের ঝাল সব আপনার উপর ঝাড়বে’। আমি বললাম, ‘ঝাড়তে দাও’”। তিনি লাহোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সাথে এক বৈঠক করতে গিয়ে অত্যন্ত বাজে সব প্রশ্নের সন্মুখীন হন। তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে তিনি ছাত্রছাত্রীদের উত্তর দিয়ে খুশি করতে পারেননি।

এ প্রসঙ্গে তার বই থেকে এ-ও তুলে ধরতে পারি - “২০০৭ সালের এক জরিপে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তুর্কীদের সমর্থন ৯ শতাংশে নেমে এসেছে”। আবার, তিনি এরদোগান (তখন প্রধানমন্ত্রী) সম্পর্কে বলছেন যে, “যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক এই তুর্কী প্রধানমন্ত্রী”। এখানে আমরা তুর্কী জনগণ এবং পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একই রকম নীতি দেখতে পাই। আবার তুর্কী রাজনীতিবিদ এবং পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সাথে মার্কিনীদের সুসম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারি। এটা আমাদেরকে অবাক করার কথা নয়, কারণ মিশরের হোসনি মুবারক ও এল-সিসি, জর্ডানের বাদশা হুসেন ও বাদশা আবদুল্লাহ, সৌদি রাজপরিবার, ওমানের আমির, ইত্যাদি যত সব একনায়করা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সবসময় সমর্থন পেয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসিদ্ধি করার অপর নামই হচ্ছে গণতন্ত্র!

১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পারভেজ মুশাররফ পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বাস্তবায়ন করেন, যদিও ততকালীন নওয়াজ শরীফ সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। তুরস্কেও হয়তো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া-ইরাক-তুরস্কসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তার স্বার্থ বাস্তবায়ন করতো, যদিও এরদোগানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। ভূরাজনীতি এখানে আমাদের জন্যে কয়েকটি শিক্ষনীয় ব্যাপার রেখেছে।

আমরা যা শিখলাম

প্রথমতঃ তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছে যে ভূরাজনীতিতে তুরস্কের গুরুত্ব তুরস্কের জনগণের কারণে। তাদের মার্কিন সমর্থিত সরকার শুধুমাত্র তুর্কী জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখার পশ্চিমা চেষ্টায় ফুয়েল দিচ্ছে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে তুর্কী জনগণ মার্কিন পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণও পাকিস্তানের জনগণ, তাদের মার্কিন তাঁবেদার সরকার নয়। ঠিক একইভাবে, বাংলাদেশের মানুষকেও একত্রিত হতে হবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রুখতে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে, অন্য কোন কারণে নয়। দেশের স্বার্থ, দেশের জনগণের স্বার্থ, ইসলামের স্বার্থ বুঝতে হবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে। দেশের মানুষকে এই প্রসেসে সরাসরি যুক্ত করাটা জরুরি। চিন্তাহীন জাতির সামনে চিন্তার দুয়ার খুলে দিতে হবে, যাতে তারা বিদেশী ষড়যন্ত্র ধরতে পারে। জনগণের উপরে চাপ সৃষ্টি করাটা পশ্চিমা উদ্দেশ্য; জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করাটা হবে আমাদের উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমা চাপে নতি স্বীকার না করলে নয়, বরং করলেই একটা দেশের সর্বনাশ হবে। পাকিস্তান এর উতকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে। আমাদের সেই উদাহরণ এড়িয়ে চলা উচিত। আমরা পশ্চিমা পরিকল্পনার ঘোরের মাঝে পড়ে গেলে আর কোনদিন উঠতে হবে না সেখান থেকে। পশ্চিমা চাপের কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না; অন্যথায় পাকিস্তান হতে হবে!
  
বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত জীবনী'তে আমরা দেখতে পাই তিনি কিভাবে জেলের ভেতর সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজেছেন। তিনি নিঃসন্দেহে কেমাল আতাতুর্কের মতো ইসলাম-ত্যাগীদের অধীনে থাকতে পারতেন না। ইসলাম ত্যাগ নয়, বরং ইসলামকে জানার মাঝেই রয়েছে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র রোখার মূলমন্ত্র।

তৃতীয়তঃ ভূরাজনীতিতে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ এর ঐতিহ্যপূর্ণ ইসলামি ইতিহাসের জন্যে, কেমাল আতাতুর্কের ‘অন্ধ-সেকুলারিজম’-এর জন্যে নয়। ধর্মান্ধতা যেমন পরিবেশ দূষণ করে, ঠিক তেমনি ‘অন্ধ-সেকুলারিজম’-ও তা-ই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে তাঁর বহুবার জেল খাটার কাহিনীর মাঝে বারংবার লিখেছেন কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে ফিরেছেন। একবার তিনি লিখেন, “মওলানা সাহেবের [মওলানা ভাসানী] সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমদের জন্যে বাঁধা নিয়ম ছিল”। আরেকবার লিখেন, “আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খন্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি”। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সৃষ্টিকর্তাকে কোথায় রেখেছেন জানিনা, তবে এটা ভাবতেই অবাক লাগে যে তুরস্কের মানুষ কি করে কেমাল আতাতুর্কের শাসনের অধীনে দিনাতিপাত করেছে, যেখানে নামাজ-রোজা-কোরআন-ইসলামিক আলোচনা ছিল হারাম বস্তু!! দম আটকে মারা যাবার কথা তুর্কীদের। অবাক হইনা, যখন দেখি তুর্কীরা সেকুলারদের বিদ্রোহ দেখে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েকটি প্রাণ বাঁচিয়েছে কোটি মুসলিমের অধিকার। বঙ্গবন্ধু নিজে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেছেন, কিন্তু তিনিও যদি কেমালের তুরস্কে থাকতেন, তাহলে সেখানে টিকতে পারতেন কিনা সন্দেহ। অথচ তুরস্কের সেই গোড়ামিপূর্ণ সেকুলার লোকটির নামে আমাদের ঢাকা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণও করা হয়েছে! কত কম জানি এবং বুঝি আমরা! ইসলাম ত্যাগ নয়, বরং ইসলামকে সঠিকভাবে বোঝার মাঝেই পশ্চিমা ষড়যন্ত্র রোখার অস্ত্র নিহিত।

চতুর্থতঃ জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সামরিক-বেসামরিক বলে কোন কিছু যেমন নেই, ঠিক তেমনি সরকারি-বেসরকারি বলেও কিছু নেই। যে তুর্কী জনগণ ট্যাঙ্কের সামনে জীবন দিয়েছে, তারা না সামরিক বাহিনীর সদস্য, না সরকারের সদস্য। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগ দেশকে পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়েছে। এই লোকগুলির আত্মত্যাগ শুধু জনগণকে রাস্তায় নামায়নি, সামরিক বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদেরকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে। দেশের স্বার্থে সামরিক-বেসামরিক জনগণের মাঝে কোন বিভেদ থাকে না। এই দুই সমাজের মাঝে ব্যবধান পশ্চিমাদের তৈরি। পশ্চিমাদের এই দূরভিসন্ধিমূলক ‘ডিভাইড-এন্ড-রুল’ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যারা নিয়মিত সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্বে ইন্ধন দেয়, এরা দেশের মানুষকে ভাগ করে দেশকে দুর্বল করতে উদ্যত। পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র রুখতে হলে এদের রুখতে হবে।

পঞ্চমতঃ দেশের বিরুদ্ধে, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য কোন ক্ষমা দেখানোর প্রশ্নই ওঠে না। ‘মানবাধিকার’-এর কথা বলে যুদ্ধাপরাধীদের যেমন মাফ করে দেয়া যায় না, ঠিক তেমনি, পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের অংশ হবার কারণে দেশী-বিদেশী এজেন্টদেরও ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না।

শেষতঃ বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের, তথা গোটা বিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশকে দুনিয়া থেকে আলাদা করে ভাবে, এরকম কূপমুন্ডুকদের তালিকায় আমাদের নাম যদি এখনও থেকে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আমাদের নাম বাদ দিতে হবে।