Saturday 24 April 2021

আফ্রিকার দেশ শাদে ‘ফরাসী’ অভ্যুত্থান?

২৪শে এপ্রিল ২০২১

রাজধানী নিজালমিনায় সাঁজোয়া যান মোতায়েনের ব্যাপারটা অনেকেকই চিন্তিত করেছে। ইদ্রিস দেবির মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতিকে পশ্চিমারা সর্বদাই এড়িয়ে গেছে; কারণ সাহেলে তিনিই ছিলেন পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষক। শাদের অভ্যুত্থান এমন সময়ে ঘটলো, যখন মালির যুদ্ধ প্রতিবেশী নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে ছড়িয়ে গেছে এবং শেষ হবার কোন লক্ষনই দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্স এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ক্রমেই তার পশ্চিমা বন্ধুদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে; যা বন্ধুদেরকে ফ্রান্সের নীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিচ্ছে। এমনই এক অবস্থায় সাহেলের প্রধান ঘাঁটি শাদকে নিয়ে চাপের মাঝে পড়েছে প্যারিস। ফ্রান্স যত বাধ্য হচ্ছে বন্ধুদের চাপ সহ্য করতে, ততটাই দুর্বল হচ্ছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ।


গত ১৯শে এপ্রিল মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদের প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস দেবির হঠাত করেই মৃত্যু হয়। ১৯৯০ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি দেশটার ক্ষমতা নেন। দেশটার সামরিক বাহিনী বলছে যে, শাদের উত্তরে বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে যুদ্ধে অংশ নেবার সময় তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিতর্কিত নির্বাচনে ষষ্ঠবারের মতো নির্বাচিত হবার সাথেসাথেই তার মৃত্যু হলো। বিদ্রোহী গ্রুপ ‘ফ্রন্ট ফর চেঞ্জ এন্ড কনকর্ড ইন শাদ’ বা ‘এফএসিটি’ গত ১১ই এপ্রিল লিবিয়া থেকে শাদের সীমানায় প্রবেশ করে। দেবির মৃত্যুর পর ২১শে এপ্রিল তার ছেলে জেনারেল মাহামাত ইদ্রিস দেবিকে সামরিক সরকারের প্রধান ঘোষণা করে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হয়। সংবিধান স্থগিত করে ১৮ মাসের মাঝে নির্বাচন দেয়ার কথা বলা হয়। অথচ সংবিধান অনুযায়ী দেশটার পার্লামেন্টের স্পিকার হারুন কাবাদির নেতৃত্ব নেবার কথা। ইদ্রিস দেবির রহস্যজনক মৃত্যু এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেবার ঘটনাকে বিশ্লেষকেরা অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখছেন। শাদে যা কিছুই হোক না কেন, সেখানে ফ্রান্সের ভূমিকা থাকে গুরুত্বপূর্ণ। শাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স কখনোই এই দেশ ছেড়ে যায়নি। তাই ইদ্রিস দেবির মৃত্যুতে ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া ছিল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

‘ফ্রান্স ২’ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ ইভস লে ড্রিয়ান শাদে ইদ্রিস দেবির ছেলের ক্ষমতা নেয়ার ব্যাপারটা সমর্থন করে বলেন যে, স্পিকার হারুন কাবাদি দেশের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষমতা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর কাবাদি এই ব্যাপারটা মেনেও নিয়েছেন। তিনি দেশটার স্থিতিশীলতাকেই সবচাইতে গুরুত্ব দিচ্ছেন; তবে লে ড্রিয়ান ১৮ মাস সময়ের মাঝে নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি। ফরাসী সরকারের বক্তব্য অনেককেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। শাদের বিরোধী ‘রিফরমিস্ট পার্টি’র প্রধান ইয়াসিন আব্দেরামানি সাকিনে বলছেন যে, এটা পরিষ্কার যে এর পিছনে সামরিক বাহিনী এবং ফ্রান্স জড়িত। এটা একটা অভ্যুত্থান; যার মাধ্যমে বাবার কাছ থেকে ছেলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। লিবিয়া থেকে হামলা করা সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ ‘এফএসিটি’এর নেতৃত্ব বলছে যে, শাদ কোন রাজতন্ত্র নয় যে, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব আসবে।

 

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, শাদের প্রেসিডেন্টের প্রধান বন্ধু ছিল ফ্রান্স। সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্স ৫ হাজার ১’শ সেনা মোতায়েন রেখেছে; যার হেডকোয়ার্টার্স হলো শাদের রাজধানী নিজালমিনাতে। এছাড়াও ফরাসী সেনারা উত্তরে ফায়া লারগিউতে লিবিয়ার সীমানায় নজর রাখছে এবং পূর্বের আবেশেতে সুদানের সীমানার উপর নজর রাখছে। প্রতিবেদনে শাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কথাটাই তুলে ধরা হয়; যেকারণে ইদ্রিস দেবি এতকাল ফ্রান্সের বন্ধু ছিলেন; যদিও তার সরকারের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন ছিল ব্যাপক। স্থলবেষ্টিত শাদের উত্তরে রয়েছে লিবিয়া; যেখানে এখন চলছে গৃহযুদ্ধ। পশ্চিমে শাদ হ্রদকে ঘিরে রয়েছে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া এবং নিজের, যেখানে বোকো হারাম সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে ফরাসী নেতৃত্বে যুদ্ধ চলছে। দক্ষিণে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং পূর্বে সুদানের দারফুর অঞ্চলেও চলছে গৃহযুদ্ধ। জাতিসংঘের হিসেবে গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মোতায়েন রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার ৭’শ শান্তিরক্ষী সেনাসদস্য এবং দারফুরে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার শান্তিরক্ষী। অর্থাৎ শাদের চারিদিকের সবগুলি অঞ্চলেই চলছে যুদ্ধ। শাদ হ্রদ অঞ্চলে শাদের সামরিক বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে জড়িত। মালির গৃহযুদ্ধে ফরাসী নেতৃত্বে শাদের সেনারা যুদ্ধ করছে। এবছরের শুরুতেই শাদের ১২’শ সেনাকে নিজের, মালি এবং বুরকিনা ফাসো, এই তিন দেশের সীমানার সংযোগস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে, যা কিনা সাহেলে ফরাসী সামরিক কৌশলের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অপরদিকে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং দারফুরে শাদের বিদ্রোহী গ্রুপগুলি যুদ্ধ করছে। লিবিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়া শাদের যোদ্ধারাই এখন শাদে হামলা করেছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, এই সেনারা লিবিয়ার যুদ্ধ থেকে অর্থ, অস্ত্র এবং অভিজ্ঞতা পেয়েছে, যা ব্যবহার করে তারা শাদ আক্রমণ করেছে। এরা একসময় লিবিয়ার সামরিক নেতা খলিফা হাফতারের পক্ষে যুদ্ধ করেছে।

শাদের রাজধানী নিজালমিনা হলো অত্র অঞ্চলের সবচাইতে বড় সামরিক বিমান ঘাঁটি। আশেপাশের সবগুলি দেশে যুদ্ধ তদারিক করার ক্ষেত্রে শাদের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ আর নেই। ২০১৯এর ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়া থেকে আসা বিদ্রোহী সামরিক বাহিনীর উপর ফরাসী বিমান বাহিনী ব্যাপক বোমা হামলা করে। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, চলমান বিদ্রোহী হামলায় প্যারিস এখনও পর্যন্ত সরসরি সামরিক সহায়তা না দিলেও শাদের সামরিক বাহিনীকে ইন্টেলিজেন্স এবং লজিস্টিক্যাল সহায়তা দিচ্ছে ফ্রান্স। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দি আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় সিনিয়র ফেলো ক্যামেরন হাডসন বলছেন যে, ফ্রান্স তার ইউরোপিয় বন্ধুদের চাপের মুখে রয়েছে। সাহেলের সামরিক মিশনে সহায়তার দেবার অংশ হিসেবে তারা দাবি করছে যে, ফ্রান্স যেন শাদের অভ্যন্তরীণ কলহতে না জড়ায়।

সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আজিম বেরমানদোয়া আগুনা ১৭ই এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন যে, লিবিয়া থেকে আসা বিদ্রোহীদেরকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা হয়েছে। কিন্তু দেবির মৃত্যুর আগের দিন মার্কিন এবং ১৭ই এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার যখন নিজালমিনাতে তাদের দূতাবাস খালি করতে বলে, তখন দেশটার স্থিতিশীলতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। রাজধানী নিজালমিনায় সাঁজোয়া যান মোতায়েনের ব্যাপারটা অনেকেকই চিন্তিত করেছে। ১৬ই এপ্রিল ‘এফএসিটি’ দাবি করে যে, তারা গুরি নামের এলাকায় একটা সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। এবং ফরাসী লজিস্টিক্যাল সহায়তার পরেও শাদের সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়েছে। ইদ্রিস দেবির মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতিকে পশ্চিমারা সর্বদাই এড়িয়ে গেছে; কারণ সাহেলে তিনিই ছিলেন পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষক। শাদের অভ্যুত্থান এমন সময়ে ঘটলো, যখন মালির যুদ্ধ প্রতিবেশী নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে ছড়িয়ে গেছে এবং শেষ হবার কোন লক্ষনই দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্স এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ক্রমেই তার পশ্চিমা বন্ধুদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে; যা বন্ধুদেরকে ফ্রান্সের নীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিচ্ছে। এমনই এক অবস্থায় সাহেলের প্রধান ঘাঁটি শাদকে নিয়ে চাপের মাঝে পড়েছে প্যারিস। ফ্রান্স যত বাধ্য হচ্ছে বন্ধুদের চাপ সহ্য করতে, ততটাই দুর্বল হচ্ছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ।

Sunday 18 April 2021

পূর্ব ইউক্রেনে কি চাইছেন পুতিন?

১৮ই এপ্রিল ২০২১

সাত বছর আগে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে তার সামরিক শক্তি প্রেরণ করে তা অস্বীকার করেছিল; এখনও করছে। সেটা ছিল রাশিয়া গোপন অপারেশন। কিন্তু এবারে রুশরা বড়সর আয়োজন করে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করছে। রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সামনে ভালবাসার বস্তু হিসেবে আবির্ভূত হবার আশা ছেড়ে দিয়েছে; বরং তারা চাইছে যে, পশ্চিমারা রাশিয়াকে ভয় করুক। রাশিয়া এবারে সৈন্য পাঠায়নি; বার্তা পাঠিয়েছে।


এপ্রিলের শুরু থেকেই ইউক্রেনের সীমান্তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী মোতায়েনের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। অনেকেই একে নতুন করে সহিংসতা শুরুর আভাস হিসেবে দেখছেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইম’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কয়েক বছর ধরে এই সুপ্ত অবস্থায় থাকার পর গত মার্চ মাস থেকেই পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর সাথে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘাত হঠাত করেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে রুশ সৈন্য সমাবেশ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সৈন্য সমাবেশের উদ্দেশ্য কি? রাশিয়া বলছে যে, ইউক্রেনের সীমান্তে রুশ সামরিক বাহিনী মোতায়েনের পিছনে মূল কারণ হলো ইউক্রেনের মাটিতে ন্যাটোর সামরিক মহড়া এবং হুমকি। রুশ সরকারি টেলিভিশনে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বক্তারা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর শত্রুতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। এই উত্তেজনার মাঝেই ১৩ই এপ্রিল হোয়াইট হাউজ বলে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে কয়েক মাসের মাঝে তৃতীয় কোন দেশে দু’জনের এক শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন। অনেক ইস্যুর মাঝে বাইডেন ইউক্রেনের বিষয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন যে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধ পরিকর। একই দিনে ক্রেমলিন থেকেও এই ফোনালাপের কথা স্বীকার করা হয়। ‘ডয়েচে ভেলে’র সাংবাদিক এবং রাশিয়া বিশ্লেষক কনস্টানটিন এগার্ট ‘বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, বাইডেন ও পুতিনের এই খেলায় বাইডেনই প্রথম চোখের পলক ফেলেছেন। বাইডেন কিছুদিন আগেও পুতিনকে ‘খুনি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন যে, এখন ফোন করে তিনি কি দুর্যোগ আটকালেন, নাকি বড় কোন ছাড় দিলেন? তবে শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা রুশ সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। কারণ তা পুতিনের জন্যে রাষ্ট্রনায়কোচিত হবে না। তবে যেহেতু বাইডেন প্রথমে এই বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাই পুতিন সেক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন।

পুতিনের সাথে বাইডেনের ফোনালাপের পরদিন তুর্কি কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানায় যে, যুক্তরাষ্ট্র বসফরাস প্রণালী অতিক্রমের জন্যে দু’টা মার্কিন যুদ্ধজাহাজের জন্যে যে অনুমতি চেয়েছিল, তা তারা বাতিল করেছে। এর পাঁচদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র এই অনুমতি চেয়েছিল। অর্থাৎ কৃষ্ণ সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন আপাততঃ বাতিল করা হয়েছে। তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, সামনের দিনে নতুন করে কোন যুদ্ধজাহাজের বসফরাস অতিক্রমের অনুমতিও চাওয়া হয়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, তুরস্কের কর্মকর্তারা হয়তো বুঝতে পারেননি যে, জাহাজগুলি মোতায়েন করার সিদ্ধান্তটা কখনোই নিশ্চিত করা হয়নি। অপরদিকে তুরস্ক বলছে যে, মার্কিনীরা ১৫ দিন আগেই ‘মনট্রিউ কনভেনশন’ অনুযায়ী তুর্কি সরকারকে জানিয়েছিল যে, জাহাজগুলি ১৪ বা ১৫ই এপ্রিল বসফরাস অতিক্রম করবে এবং ৪ঠা মে পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগরে থাকবে। ১৯৩৬ সালের এই কনভেনশন অনুযায়ী কৃষ্ণ সাগরের দেশ নয় এমন কোন দেশ কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করতে গেলে কমপক্ষে ৮ দিন আগে তুরস্ককে জানাতে হবে। আর একসাথে ৯টার বেশি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা যাবে না; যেগুলি সর্বমোট ১৫ হাজার টনও অতিক্রম করতে পারবে না। আর একটা জাহাজ ১০ হাজার টনের চাইতে বেশি বড় হতে পারবে না। বিদেশী যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণ সাগরে ২১ দিনের বেশি থাকতে পারবে না। তবে রাশিয়া নিজেই সাম্প্রতিককালে এই কনভেশনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।

‘মস্কো স্টেট ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’এর প্রফেসর মিখাইল ট্রইটস্কির মতে, রাশিয়া পশ্চিমাদের সাথে পুরো ভূরাজনৈতিক খেলাটাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে চাইছে। বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের জবাব দিতে চাইছে রাশিয়া। পশ্চিমারা যেমন বলছে যে, রাশিয়ার কর্মকান্ডের জন্যে তাদেরকে মূল্য দিতে হচ্ছে, তেমনি রাশিয়াও বলতে চাইছে যে, তারাও পশ্চিমাদের কর্মকান্ডের উপর মূল্য নির্ধারণ করতে পারে; যদিও এতে রাশিয়ার উপর অবরোধ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘রাশান ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স কাউন্সিল’এর প্রধান আন্দ্রেই করতুনোভের কথায় রাশিয়ার জনগণ এখন তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়েই জর্জরিত। করোনাভাইরাস, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন রাশিয়ার অর্থনীতিকে ব্যাপক ক্ষতির মাঝে ফেলেছে। এমতাবস্থায় একটা বড় সামরিক মিশন রাশিয়ার জন্যে বাহুল্যই বটে।

করতুনোভ বলছেন যে, ইউক্রেন সরকার পূর্বের সীমান্ত অঞ্চলে নিজেদের সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। রুশরা সীমান্তে সামরিক শক্তি মোতায়েন করে ডনবাসে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর নতুন করে যুদ্ধ শুরুর চিন্তাকে প্রতিহত করতে চাইছে। মার্কিন এবং ইউরোপিয়রা সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাটা রাশিয়ার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে করতুনোভ মনে করছেন যে, রাশিয়া খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেন আক্রমণ করবে না। কারণ রুশ কৌশল হলো পূর্ব ইউক্রেনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা এবং ইউক্রেনের অভ্যন্তরের ব্যাপক সমস্যার ফলশ্রুতিতে কিয়েভে রাজনৈতিক গোলযোগের অপেক্ষা করা। ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক হামলা রাশিয়াকে কিছুই দেবে না।

রুশ সিনেটর কনস্টানটিন কসাচেভ বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, সামরিক দিক থেকে রাশিয়াকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়; এবং দুই দেশের আলোচনায় ফেরত আসা ছাড়া গতি নেই। কসাচেভের কথায় বোঝা যাচ্ছে যে, রাশিয়া মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা চাইছে; যার প্রস্তাব বাইডেন ইতোমধ্যেই ফোনালাপের মাধ্যমে দিয়েছেন। মার্কিন থিকট্যাঙ্ক ‘সিএনএ কর্পোরেশন’এর ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান ‘দ্যা মস্কো টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, রাশিয়ার সমরশক্তি মোতায়েন মূলতঃ ভীতি প্রদর্শনের জন্যে; দেখানোর জন্যে। কারণ ইউক্রেনে সামরিক হামলা করে রাশিয়ার কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না। ‘বিবিসি’ এক বিশ্লেষণে বলছে যে, সাত বছর আগে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে তার সামরিক শক্তি প্রেরণ করে তা অস্বীকার করেছিল; এখনও করছে। সেটা ছিল রাশিয়া গোপন অপারেশন। কিন্তু এবারে রুশরা বড়সর আয়োজন করে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করছে। রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সামনে ভালবাসার বস্তু হিসেবে আবির্ভূত হবার আশা ছেড়ে দিয়েছে; বরং তারা চাইছে যে, পশ্চিমারা রাশিয়াকে ভয় করুক। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়া এবারে সৈন্য পাঠায়নি; বার্তা পাঠিয়েছে।

Friday 9 April 2021

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাপানের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য কি?

১০ই এপ্রিল ২০২১
৩০শে মার্চ। টোকিওতে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোভো সুবিয়ান্তো এবং জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোশিমিতসু মোতেগি। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণেই জাপানের সাথে হাত মেলাচ্ছে। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবেই চীন এবং জাপান উভয়েই তাদের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় সামরিক শক্তি ধরে রাখতে সহায়তা করছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়ার বন্ধু দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে; যা জাপানের সামরিকীকরণে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।  


গর ৩০শে মার্চ জাপান এবং ইন্দোনেশিয়া একটা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ‘ডিফেন্স ইকুইপমেন্ট এন্ড টেকনলজি ট্রান্সফার এগ্রিমেন্ট’ নামক চুক্তি অনুযায়ী জাপান ইন্দোনেশিয়াতে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করবে। টোকিয়োতে দুই দেশের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকের মাঝেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাপানের ‘কিয়োদো নিউজ’ বলছে যে, এই চুক্তির পিছনে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের প্রভাব বিস্তারকে নিয়ে জাপানের দুশ্চিন্তা প্রকাশ পাচ্ছে। এক যৌথ সাংবাদিক সন্মেলনে জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোশিমিতসু মোতেগি বলেন যে, দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন সাগরে চীনের জোরপূর্বক অবস্থান শক্তিশালীকরণের ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে আলোচনা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে চীন সরকারের জারি করা আইন অনুযায়ী চীনা কোস্ট গার্ড চীনের দাবি করা সমুদ্রসীমায় অন্য দেশের জাহাজকে গুলি করতে পারবে। জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও কিশি বলেন যে, এই আইনের মাধ্যমে চীনারা অন্য দেশের বৈধ অধিকার এবং স্বার্থের লঙ্ঘন করতে পারে না। ইন্দোনেশিয়ার সাথে এই চুক্তির আগে জাপান ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইতালি, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এরূপ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। মোতেগি বলেন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার সাথে জাপানের নিরাপত্তা সম্পর্ক এগিয়ে নেবার জন্যে শক্ত ভিত তৈরি হলো; এবং একইসাথে আঞ্চলিক হুমকি মোকাবিলায় তা দুই দেশের যৌথ উদ্যোগের প্রতীক হয়ে থাকবে। তিনি আরও বলেন যে, ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জাপান সরকার ৪’শ ৫৩ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। অপরদিকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোভো সুবিয়ান্তো বলেন যে, তার দেশ জাপানকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নে অংশীদার হতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার সাথে জাপানের প্রতিরক্ষা চুক্তি আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে এখন শুরু হয়েছে আলোচনা।

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, চুক্তিতে কি রয়েছে তার বিস্তারিত বলা না হলেও এর মাধ্যমে জাপান হয়তো ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর কাছে ‘মোগামি ক্লাস’এর ফ্রিগেট রপ্তানি করতে পারে, যা তারা নিজেদের নৌবাহিনীর জন্যে বর্তমানে তৈরি করছে। দুই দেশের মাঝে সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা চলছে কয়েক বছর ধরেই। ২০২০ সালের শেষের দিকে একটা সমঝোতার ফলশ্রুতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। সেসময় জাপানের জাহাজ নির্মাণ সংস্থা ‘মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ’এর সাথে ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী তাদের ফ্রিগেট ক্রয় প্রকল্পের জন্যে চারটা ডিজাইনকে শর্টলিস্ট করেছিল; যার মাঝে ছিল হল্যান্ডের ‘ডামেন’ ইতালির ‘ফিনকানতিয়েরি’, জাপানের ‘মিতসুই’ এবং ব্রিটেনের ‘ব্যাবকক’ কোম্পানির ডিজাইন।

গত বছরের অগাস্টে জাপান ফিলিপাইনের কাছে ১’শ ৩ মিলিয়ন ডলারে ৪টা অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা রাডার বিক্রয়ের চুক্তি করে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে জাপানি পার্লামেন্ট প্রতিরক্ষা আইনের আর্টিকেল ‘১১৬এর ৩’ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিদেশে অস্ত্র রপ্তানিকে বৈধতা দিয়েছিল। সেই মোতাবেক জাপান সরকার দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের নজরদারিতে সহায়তা দিতে ৫টা ‘টিসি ৯০’ সার্ভেইল্যান্স বিমান অনুদান হিসেবে দেয়। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ফিলিপাইনের কাছে বিক্রি করা রাডারগুলি মূলতঃ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা সামরিক কর্মকান্ডের উপর নজর রাখতে ব্যবহৃত হবে, যেখানে চীনারা বেশকিছু কৃত্রিম দ্বীপ ডেভেলপ করে সেখানে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। জাপান চাইছে তাইওয়ান এবং ফিলিপাইনের মাঝ দিয়ে যাওয়া বাশি চ্যানেলে চীনা জাহাজের গতিবিধির উপর নজরদারি করতে। আর সেক্ষেত্রে তারা ফিলিপাইনের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে চাইছে। এর আগে ফিলিপাইনের কোস্ট গার্ডের জন্যে ১’শ ৯১ মিলিয়ন ডলারে ১০টা ৪৪ মিটার লম্বা প্যাট্রোল বোট বিক্রি করে জাপান। আর বর্তমানে ১’শ ৩২ মিলিয়ন ডলারে ২টা ৯০ মিটার অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলও তৈরি করছে জাপান। এছাড়াও গত জুলাই মাসে জাপান ভিয়েতনামের কাছে ৪’শ মিলিয়ন ডলারে ৬টা ৭৯ মিটার লম্বা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল রপ্তানি করার চুক্তি করে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি’ বা ‘জাইকা’ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। আর সবগুলি জাহাজের মূল কাজ হবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা। ‘ফোর্বস’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এতকাল বিদেশে রপ্তানি করতে না পারার কারণে জাপানের সামরিক সরঞ্জাম ছিল দুর্মূল্য। এখন বিভিন্ন প্রকার বিমান, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্যাট্রোল বোট, ইত্যাদি সরঞ্জাম রপ্তানি করে সেগুলির খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে জাপান; যাতে তারা তাদের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে আরও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে অস্ত্র বিক্রি করতে পারে।

জাপানের পররাষ্ট্রনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের রচিত যুদ্ধবিরোধী সংবিধানের উপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রক্ষণশীলদের শক্ত অবস্থানের ফলে আইনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জাপান বিশ্বব্যাপী সামরিক বাহিনী মোতায়েন এবং বিদেশে অস্ত্র রপ্তানি করছে। চীন এবং উত্তর কোরিয়ার আক্রমণাত্মক অবস্থান জাপানকে সামরিক শক্তি বাড়াতে একপ্রকার বৈধতা দিয়েছে। তবে জাপানের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় তা এখনও ওয়াশিংটনের আশীর্বাদপুষ্ট হচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আগ্রাসনের ইতিহাস ভুলে না গেলেও জাপানের নতুন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শুধু চীনারাই কথা বলছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণেই জাপানের সাথে হাত মেলাচ্ছে। জাপানের সামরিক শিল্প যথেষ্ট উন্নত হলেও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তা এখনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীন নয়। দক্ষিণ চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরের সমুদ্রপথগুলি শুধু চীনের জন্যে নয়, জাপান এবং কোরিয়ার জন্যেও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেগুলি নিয়ন্ত্রণে জাপানের এমন কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই, যা কিনা মার্কিন নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। প্রতিরক্ষা রপ্তানির ক্ষেত্রে জাপানের আর্থিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশটা তাদের বিরাট অর্থনীতিকে পুঁজি করে প্রভাব বিস্তারে অগ্রগামী হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাব বিস্তারে তারা এখনও শিশুমাত্র। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবেই চীন এবং জাপান উভয়েই তাদের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় সামরিক শক্তি ধরে রাখতে সহায়তা করছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়ার বন্ধু দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে; যা জাপানের সামরিকীকরণে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।


Friday 2 April 2021

সুয়েজ খাল আটকে যাওয়া কি দেখিয়ে দিচ্ছে?

৩রা এপ্রিল ২০২১
সুয়েজ বা পানামা খালের মতো মানবসৃষ্ট খালগুলি সর্বদা সরুই হয়। তবে মালাক্কা প্রণালী, হরমুজ, বাব এল মান্ডেব বা জিবরালটারের মতো স্রষ্টার তৈরি পথগুলি সেতুলনায় অনেক চওড়া। আর দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বা আর্কটিকের ‘এনএসআর’ হয়ে বা মধ্য এশিয়ার রেলপথ হয়ে পণ্য পরিবহণ কিছু ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের বিকল্প হলেও খরচ, সময় বা অন্য কারণে সেগুলি সুয়েজের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারছে না। মানবসৃষ্ট সুয়েজ খালের উপর নির্ভরশীলতা যেমন কমে যাচ্ছে না, তেমনি ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। একারণেই সরু এই পথগুলি সামনের দিনগুলিতে ভূরাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই থাকবে।


অতি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ সুয়েজ খালে আটকে পড়া দৈত্যাকৃতির কনটেইনারবাহী জাহাজ ছাড়ানো সম্ভব হওয়ায় সারা বিশ্বের মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে বিশ্লেষকেরা একমত যে, এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ‘এনপিআর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ৪’শ মিটার লম্বা জাহাজ ‘এভার গিভেন’ যখন খালের সরু জায়গায় আটকে যায়, তখন অনেকেই এর অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসেব করতে শুরু করে। এই পথে প্রতিদিন গড়ে ৫০টা জাহাজ যাতায়াত করে। দৈনিক ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ এই পথের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সাপ্লাই চেইন কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘ইনটেরোস’এর প্রধান নির্বাহী জেনিফার বিসেইলি বলছেন যে, ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে হঠাত করেই অনেকে বুঝতে শুরু করলো যে, সাপ্লাই চেইনের বেশিরভাগটাই চীনে পুঞ্জীভূত হয়ে গেছে। তাই অনেকেই চীনের বিকল্প সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখন সমুদ্রপথে এহেন ঘটনার ফলে একটা বড় জাহাজে সকল পণ্য তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে দু’বার চিন্তা করার সময় এসেছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, খুব বেশি সময়ের জন্যে খাল না আটকানোর ফলে বিশ্ব বাজারে পণ্য মূল্যের উপর এর প্রভাব খুব একটা হবে না। আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে বিকল্প পথগুলিকে নিয়ে।

সুয়েজ খাল আটকানো আবস্থায় বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে পথটাকে কেউ কেউ ব্যবহার করেছে। তবে এতে দুই থেকে চার সপ্তাহ দেরি হবে এবং কয়েক মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াতে হবে। তেলের মূল্য কমে যাবার সময় কেউ কেউ এই পথ ব্যবহার করলেও সময় কিন্তু বেশি লাগছেই। আরেকটা বিকল্প হলো প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করা পানামা খাল। তবে এই খাল দিয়ে ‘এভার গিভেন’এর মত বেশি বড় জাহাজগুলি যেতে পারবে না। নতুন একটা বিকল্প পথ হিসেবে সামনে আসছে রাশিয়ার উত্তরে উত্তর মেরু ঘেঁষে ‘নর্দার্ন সী রুট’ বা ‘এনএসআর’। এই পথকে বড় কনটেইনারবাহী কোম্পানিগুলি এখনও উপযুক্ত মনে করছে না। তবে রুশরা এব্যাপারে এখন বেশ সরব। রাশিয়ার পারমাণবিক সংস্থা ‘রোসাটম’এর বিশেষ প্রতিনিধি ভ্লাদিমির পানোভ রুশ বার্তা সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, সুয়েজ খালের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে বাণিজ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিকল্প পথ হিসেবে ‘এনএসআর’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ‘এনএসআর’ বেশ প্রতিযোগিতামূলক খরচে পণ্য পরিবহণ করার সুবিধা দিচ্ছে। নরওয়ের সংস্থা ‘সেন্টার ফর হাই নর্থ লজিসটিক্স’এর হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাঝে ‘এনএসআর’ দিয়ে জাহাজের যাতায়াত বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। পরিবাহিত পণ্যের পরিমাণ ৭৫ লক্ষ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ১০ লক্ষ টন। সুয়েজ খালের ১’শ কোটি টনের তুলনায় এটা কিছুই নয়। তবে ‘এনএসআর’এর সবচাইতে বড় সুবিধা হলো চীন থেকে ইউরোপে যাতায়াত ৩৪ থেকে ৪০ দিনের বদলে মাত্র ২৩ দিনে সম্ভব।

এছাড়াও রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে যাওয়া রেল সংযোগকে কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে চিন্তা করছেন; বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স এবং জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের ক্ষেত্রে। অনলাইন লজিসটিক্স প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়াইকিউএন লিঙ্ক’এর প্রধান নির্বাহী ঝৌ শিহাও চীনা সরকারি মিডিয়া ‘গ্লোবাল টাইমস’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, রেলপথে চীন থেকে একটা কনটেইনারের ইউরোপ যেতে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৫ দিন লাগে। আর বড় পরিসরে হিসেব করলে সমুদ্রপথ এবং রেলপথে কনটেইনার পরিবহণ খরচের মাঝে পার্থক্য খুবই কম। তবে একটা জাহাজের সাথে একটা রেলগাড়ির তুলনা দেয়া সম্ভব নয়। ‘এভার গিভেন’এর মত একটা দৈত্যাকৃতির কনটেইনার জাহাজ বহণ করতে পারে ২০ হাজার কনটেইনার; যা পরিবহণে লাগবে প্রায় ৫০টা রেলগাড়ি।

সুয়েজ খাল বন্ধ হওয়া নতুন কিছু নয়। ১৯৫৬ সালে এবং ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের কারণে খাল বন্ধ হয়েছিল। এর মাঝে ১৯৬৭ সালে বন্ধ হবার পর তা ৮ বছর পর ১৯৭৫ সালে খুলেছিল। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘প্লাইমাউথ হেরাল্ড’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সুয়েজ খালে এর আগেও জাহাজ আটকে গিয়েছিল। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ থেকে ফেরত আসা ব্রিটিশ রয়াল নেভির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ইউনিকর্ন’ খালে আটকে যায়। প্রায় চার ঘন্টা আটকে থাকার পর দু’টা টাগবোট দিয়ে প্রায় ২’শ মিটার লম্বা জাহাজটাকে টেনে বের করা হয়। তবে কেউ কেউ দুর্ঘটনা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ আটকে যাবার কথা বলছেন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার স্কট সাভিতজ প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক লেখায় মার্কিন সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের কারণে সরু সমুদ্রপথ বন্ধ হওয়া প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেবার কথা বলছেন। তিনি বলছেন যে, একটা পুরোনো জাহাজকে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরের মুখে আড়াআড়ি রেখে দিয়ে বন্দর আটকে দেবার কৌশল অনেক পুরোনো। ২০১৪ সালেই রাশিয়া ক্রিমিয়ার দখল নেবার সময় বন্দরের মুখে দু’টা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জাহাজগুলির পালানোর পথ রুখে দিয়েছিল। তিনি বলছেন যে, এই কাজটা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেও সম্ভব; আবার সাইবার হ্যাকিংএর মাধ্যমে কোন জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও করা সম্ভব।

মার্কিন থিঙ্কট্যাক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’এর এক লেখায় ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রিডম্যান বলছেন যে, সুয়েজ খালের ঘটনা একটা দুর্ঘটনা হলেও তা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, যেকোন যুদ্ধে কত সহজে এরকম একটা সরু নৌপথ আটকে দেয়া যেতে পারে; কারণ এর আগেও যুদ্ধের কারণে নৌপথ আটকানো হয়েছে। সুয়েজ বা পানামা খালের মতো মানবসৃষ্ট খালগুলি সর্বদা সরুই হয়। তবে মালাক্কা প্রণালী, হরমুজ, বাব এল মান্ডেব বা জিবরালটারের মতো স্রষ্টার তৈরি পথগুলি সেতুলনায় অনেক চওড়া। আর দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বা আর্কটিকের ‘এনএসআর’ হয়ে বা মধ্য এশিয়ার রেলপথ হয়ে পণ্য পরিবহণ কিছু ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের বিকল্প হলেও খরচ, সময় বা অন্য কারণে সেগুলি সুয়েজের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারছে না। মানবসৃষ্ট সুয়েজ খালের উপর নির্ভরশীলতা যেমন কমে যাচ্ছে না, তেমনি ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। একারণেই সরু এই পথগুলি সামনের দিনগুলিতে ভূরাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই থাকবে।