Sunday 29 December 2019

সেকুলার ভারতের ভবিষ্যৎ কি?


বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত করতে চাইছে, যার মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে স্থাপিত সেকুলার ভারতই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে।


২৯শে ডিসেম্বর ২০১৯

২০১৯ সালে ভারতের অগুণিত সমস্যা দেশটার সাংগঠনিক মূলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, ১৯৪৭ সালে যে সেকুলার ভারতের জন্ম হয়েছিল, তা আসলে টিকবে কিনা। তবে এই প্রশ্নের সাথে ভারতের ১৯৪৭ সালের রাষ্ট্র গঠনের মূলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। মুম্বাইএর ‘গুরু নানক কলেজ অব আর্টস, সাইন্স এন্ড কমার্স’এ অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা ভারতের একত্রিত থাকার গুরুত্বকে তুলে ধরেন। তারা বলেন যে, ভারতের রাজনীতি ধর্মের উপর নির্ভর করে হতে পারে না। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেকুলার ভারতে মুসলিম হিসেবে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট ভারতের পার্লামেন্টে দেয়া বক্তৃতায় জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন যে, সকল ধর্মের মানুষ ভারতে একই অধিকার পাবে। কিন্তু ৭০ বছর পর নেহেরুর চিন্তাগুলি সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক হলো জাতিগত, ভাষাগত এবং বিশ্বাসগত দিক থেকে বিশাল বিভক্তি থাকার পরেও ভারত রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে। টিকে থাকার সেই ভিতটাই হলো সেকুলারিজম, যা বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।ভারতের সেকুলার সমাজব্যবস্থার মাঝ দিয়েই জন্ম নিয়েছে আরএসএস; ক্ষমতা পেয়েছে বিজেপি; ধ্বংস হয়েছে বাবরী মসজিদ; আইনী বৈধতা পেয়েছে রাম মন্দির; পার্লামেন্টে পাস হয়েছে এনআরসি।বর্তমান এই সমস্যাগুলি এমন কিছু ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে, যেগুলি ভারত রাষ্ট্রের স্থায়িত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

‘অক্সফাম’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারতের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ জাতীয় সম্পদের ৭৭ শতাংশের মালিক। আর ২০১৭ সালে ভারতে উৎপাদিত হওয়া মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ গিয়েছে সবচাইতে উপরের ১ শতাংশের কাছে। মাত্র ১ শতাংশ গিয়েছে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে। আর ভারতের জনসংখ্যার নিচের ৬৭ কোটি মানুষের সম্পদ বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। ভারতে এখন ১’শ ১৯ জন বিলিয়নায়ার রয়েছে, যা ২০০০ সালে ছিল ৯ জন এবং ২০১৭ সালে ছিল ১শ ১ জন। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মাঝে ভারতে প্রতিদিন ৭০ জন করে নতুন মিলিয়নায়ার তৈরি হবে বলে আশা করছে ‘অক্সফাম’। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে না পেরে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যের মাঝে পতিত হয়েছে; সময়ের হিসেবে তা প্রায় প্রতি সেকেন্ডে দু’জন। ভারতের গ্রামাঞ্চলে নিম্ন পর্যায়ে কাজ করা এক ব্যক্তিকে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করা উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার এক বছরের আয়ের সমান আয় করতে হলে ৯’শ ৪১ বছর কাজ করতে হবে! যদিও অন্য দেশ থেকে ভারতে মানুষ চিকিৎসা করাতে আসে, ভারতের গরীব রাজ্যগুলিতে শিশুমৃত্যুর হার আফ্রিকার দরিদ্র এলাকাগুলির চাইতেও খারাপ! সারা বিশ্বে সকল মাতৃমৃত্যুর মাঝে ১৭ শতাংশ ঘটে ভারতে; আর পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর মাঝে ২১ শতাংশ ঘটে ভারতে।
ভারতে এখন ১’শ ১৯ জন বিলিয়নায়ার রয়েছে, যা ২০০০ সালে ছিল ৯ জন এবং ২০১৭ সালে ছিল ১শ ১ জন। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মাঝে ভারতে প্রতিদিন ৭০ জন করে নতুন মিলিয়নায়ার তৈরি হবে বলে আশা করছে ‘অক্সফাম’।


ভারতের ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ বা ‘সিএমআইই’এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। ২০১৭ সালের জুলাইএ এই হার ছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশের নিচে। সেই সময় থেকে বেকারত্বের হার সর্বদাই বাড়ছে। একইসাথে কর্মক্ষেত্রে অংশ নেবার হার (কতজন কাজ করতে ইচ্ছুক) দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশের কিছু বেশি, যা কিনা ২০১৬ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। বেকারত্বের হার শহর এলাকায় আরও বেশি – পার ৯ শতাংশের কাছাকাছি; আর গ্রামাঞ্চলে তা ৭ শতাংশের কাছাকাছি। আবার ভারতের সকল রাজ্যে বেকারত্বের হার এক নয়। গোয়াতে ৩৪ শতাংশের বেশি বেকার; ত্রিপুরায় প্রায় ২৬ শতাংশ; হিমাচলে ২৩ শতাংশ; হরিয়ানায় ২১ শতাংশ; দিল্লীতে ১৬ শতাংশ; বিহারে ১৩ শতাংশ; আর উত্তর প্রদেশে ৮ শতাংশ। অপরদিকে পন্ডিচেরিতে ১ শতাংশের নিচে বেকারত্ব; মেঘালয়ে ২ শতাংশের নিচে; কর্ণাটকে ২ শতাংশ; তামিল নাড়ুতে আড়াই শতাংশ; আর মধ্য প্রদেশে সাড়ে ৩ শতাংশের কাছাকাছি বেকার। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের সকল স্থানে কর্মসংস্থানের সুযোগ একরকম নয়। বিশেষ করে ভারতের রাজ্যগুলি অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিসিল’ বলছে যে, ভারতের মোট সরকারি খরচার প্রায় ৬৫ শতাংশ এখন রাজ্য সরকারের হাতে, যা কিনা রাজ্যগুলিকে আলাদা নীতিতে চলতে প্রেরণা যুগিয়েছে।

রাজ্যকেন্দ্রিক চিন্তার কারণে বেশিরভাগ মানুষই নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে বসবাস করতে পারে না। ভারতের অর্থনীতি যে অবস্থানে রয়েছে, তাতে মনে করা হয় যে, দেশের ভিতরে মানুষের যাতায়াত আরও বেশি হবার কথা ছিলো। ২০১৬ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ভারতের অনেক রাজ্যে বাইরের রাজ্য থেকে মানুষ আসাকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইকনমিক এন্ড সোশাল এফেয়ার্স’এর এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ৮০টা দেশের মাঝে মানুষের অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ছিল ৮০তম। অথচ ভারতের সংবিধানের ‘আর্টিকেল ১৯(১)’এ রয়েছে যে, ভারতের নাগরিক হলে তার অধিকার রয়েছে যে কোন রাজ্যে যেতে পারার, এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার। ভারতের প্রতিটা রাজ্যে নিজ রাজ্যের মানুষের সরকারি চাকুরি, উচ্চশিক্ষা, এবং সামাজিক সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে কোটা রয়েছে।

‘ইন্ডিয়া মাইগ্রেশন নাউ’ নামের একটা এনজিও ‘ইন্টারস্টেট মাইগ্র্যান্ট পলিসি ইন্ডেক্স ২০১৯’ নামে একটা গবেষণা চালিয়েছে। তারা বের করতে চাইছে যে, ভারতের কোন রাজ্য অন্য রাজ্য থেকে আসা মানুষের জন্যে কতটা সুবিধা দিচ্ছে। যে ৭টা রাজ্যে প্রচুর মানুষ যাচ্ছে, সেগুলির মাঝে সবচাইতে ভালো ফলাফল দেখিয়েছে কেরালা, মহারাষ্ট্র আর পাঞ্জাব। কেরালার জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে, যা এই রাজ্যের মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে। তদুপরি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ এবং সহজে বাসস্থান পাবার ক্ষেত্রে কেরালা অভিবাসীদের আলাদা চোখে দেখেছে। অন্যান্য রাজ্যে অভিবাসীরা জীবনধারণের জন্য নিজেদের নেটওয়ার্ক এবং কর্মক্ষেত্রের উপর পুরোপুরি নির্ভর করেছে। তাদের বেতন কম দেয়া হয়; সুযোগসুবিধাও নেই বললেই চলে। খারাপ জীবনযাত্রার কারণে সুযোগমতো নিজ রাজ্যে ফিরে যাবার আকাংক্ষাও তাদের মাঝে থাকে প্রবল। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাতায়াত করাটা বেশিরভাগ মানুষের জন্যে যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি অনিশ্চয়তার; ব্যাপারটা অনেকটা অন্য কোন রাষ্ট্রে যাতায়াতের মতোই। স্বল্প আয়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা বেশিদূরে যায় না; তাই তারা বেশিরভাগ সময়ই নিজ রাজ্যের মাঝেই থেকে যায়। অন্যদিকে যারা অর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে, তারাই ভারতের অন্য রাজ্যে বা বাইরের কোন দেশে কাজের জন্যে যায়।

১৯৪৭ সাল থেকে সেকুলারিজম ভারতকে একত্রে রেখেছে, কিন্তু দেশটার অভ্যন্তরীণ বৈষম্যকে দূর করতে পারেনি; বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথেসাথে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের রাজ্যগুলি আলাদা দেশের মতো চলছে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধকে আরও উস্কে দিচ্ছে রাজ্যগুলির মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য।


ভারতের ফিনানশিয়াল পত্রিকা ‘লাইভমিন্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারত হলো একটা মহাদেশের মতো; যার একেকটা রাজ্য একেক ধরনের উন্নয়ন পেয়েছে। গত দুই দশকে ভারতের রাজ্যগুলির মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০ সালের দিকে ভারতের সবচাইতে বিত্তশালী পাঁচটা রাজ্যের মাথাপিছু আয় সবচাইতে নিচের রাজ্যগুলির মাথাপিছু আয়ের প্রায় দেড় গুণ ছিল। ২০১০ সালের দিকে এটা বেড়ে ২ দশমিক ৯ গুণে পৌঁছায়। আর ২০১৮ সালে সেটা ৩ দশমিক ৪ গুণ হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত গরীব রাজ্যগুলির আয় কম; তাই তারা শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের পিছনে কম খরচ করতে পারে। কেন্দ্র সরকারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও রাজ্যগুলির এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যখাতে সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে ধনী রাজ্যগুলিই বেশি লাভবান হচ্ছে। অথচ ভারতের বেশিরভাগ শিশুই রয়েছে গরীব রাজ্যগুলিতে।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারতের বৈষম্য মহাকাশ থেকেই দেখা যায়। অর্থনীতিবিদ প্রবীন চক্রবর্তী এবং ভিভেক দেহাজিয়া মার্কিন সামরিক স্যাটেলাইটের তোলা ছবি বিশ্লেষণে এই উপসংহারই টেনেছেন। এই স্যাটেলাইটগুলি রাতের বেলায় ভূমি থেকে আসা আলোর ছবি তুলতে পারে। এই ছবির বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মুম্বাই এবং ব্যাঙ্গালুরুর মত শহরগুলি অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি উজ্জ্বল। এই দুই গবেষকের কথায়, ভারতের গরীব রাজ্যগুলি ধনী রাজ্যগুলির সাথে পেরে উঠছে না। তাই আয় বৈষম্যও বেড়েই চলেছে। বড় ফেডারেল রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে এত বড় বৈষম্য ইতিহাসেই নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এতে ভারতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে এবং গরীব অঞ্চলগুলি ধনী অঞ্চলের মতো সুবিধা পেতে চাইবে।

১৯৪৭ সাল থেকে সেকুলারিজম ভারতকে একত্রে রেখেছে, কিন্তু দেশটার অভ্যন্তরীণ বৈষম্যকে দূর করতে পারেনি; বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথেসাথে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের রাজ্যগুলি আলাদা দেশের মতো চলছে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধকে আরও উস্কে দিচ্ছে রাজ্যগুলির মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য। একইসাথে গণতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি, যা কিনা সেকুলারিজমের গোড়ায় আঘাত করেছে। বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত করতে চাইছে, যার মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে স্থাপিত সেকুলার ভারতই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালে ভারতের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মাঝে ভারতের আর্থসামাজিক সঙ্কট আরও প্রবল আকার ধারণ করেছে। ২০২০ সালে সেকুলার ভারতের স্থায়িত্ব নিয়েই আলোচনা হবে। 

Thursday 5 December 2019

বঙ্গোপসাগর আসলে কার?

০৫ ডিসেম্বর ২০১৯ 
বঙ্গোপসাগর আসলে কার?




আলহামদুলিল্লাহ!
আমার দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হলো।
 
'বঙ্গোপসাগর আসলে কার? বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান'










 বই-এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এই বর্ণনা থেকে পাওয়া যাবে -


-----------------------------------------------------------------------------------------------



"স্রষ্টার ইচ্ছাই ফাইনাল! জায়গাটা এমন এক ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে, যেখানে সারা ভারত মহাসাগরের বৃষ্টির মেঘগুলি রিমোট কন্ট্রোল ড্রোনের মতো বাকি সকল স্থান বাদ দিয়ে এখানেই ঢুকছে; তৈরি করছে বৃষ্টির সাম্রাজ্য! এই বৃষ্টি তৈরি করেছে তিনটা বিশাল নদী, যেগুলির সঙ্গমস্থলে রয়েছে একাধিক সমুদ্রবন্দর। বন্দরগুলি নদীর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার উর্বরতম এলাকাগুলির সাথে যুক্ত। নদীগুলি ভারত মহাসাগরের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এই ভূমির মানুষের সমুদ্র দাপিয়ে বেড়ানোটা শুধু ইচ্ছের ব্যাপার। এই জায়গাটার নামই বাংলা বা বেঙ্গল। আর এর নামেই এর দক্ষিণের সাগরের নামকরণ – বঙ্গোপসাগর বা বে অব বেঙ্গল। ভারতীয় উপমহাদেশ বা হিন্দুস্তানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে এই বাংলা। কিন্তু বাংলার অস্তিত্ব এখন টিকে রয়েছে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত এক ভূমির মাঝে। এই ভূমির নাম কাঁধে নিয়েছে বাংলাদেশ নামে এক রাষ্ট্র। ভারত মহাসাগরের উপকূলে শক্তিশালী এক রাষ্ট্রের উত্থানের হাতছানি এদেশের মানুষ শুনতে পাচ্ছে কি?

১৯৪৭ সালের আদর্শিক বাউন্ডারির চিন্তাগুলি দেশটাকে এখনও বেঁধে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাউন্ডারি আঁকিয়েদের আদর্শের ক্রাইসিসের সাথে সাথে ইতোমধ্যেই এই বাউন্ডারি পড়েছে চ্যালেঞ্জের মাঝে। তবে এই চ্যালেঞ্জকে ব্যবহার করতে পারাটা পুরোটাই নির্ভর করছে এদেশের মানুষের চিন্তাগত উতকর্ষতার উপর। বাস্তবতার পর্দা উঠে যাবার পরিবর্তিত বাস্তবতা মানুষের চিন্তাকে উস্কে দিচ্ছে; প্রশ্ন করাচ্ছে। অস্বস্তিকর এই প্রশ্নগুলির মাঝেই রয়েছে চিন্তার উত্থান; আর সেই চিন্তার মাঝেই রয়েছে শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত।" 


-----------------------------------------------------------------------------------------------


  
আশা রাখি বইখানা খুব শিগগিরই বেশ কয়টি বুকস্টোরে (অনলাইনসহ) পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। 

----------------------------------------------------------------------------------------------- 

আপডেট ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯

রকমারি ডট কমে পাওয়া যাচ্ছে বইখানা।

https://www.rokomari.com/book/193534/bongoposagor-asole-kar-



----------------------------------------------------------------------------------------------- 


বইটি কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা অর্ডার করতে ইচ্ছুক, তারা নিচের ফেসবুক পেইজে পুরো ঠিকানা এবং ফোন নম্বরসহ 'ইনবক্স' করুন। পেমেন্ট করতে হবে বিকাশে। ডেলিভারি চার্জ ফ্রি। অর্থাৎ বইএর মূল্যের বাইরে কোন চার্জ দিতে হবে না।  

https://www.facebook.com/k360bd/

--------------------------------------------------------------------------------------------------

বইটি ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান এবং যমুনা ফিউচার পার্কের Bookends-এর তিনটি স্টোরে পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। Bookends-এর ধানমন্ডি এবং গুলশানের স্টোরগুলি Unimart সুপারস্টোরের ভিতরে। আর যমুনা ফিউচার পার্কের Wholesale Club-এ। 
 
https://web.facebook.com/Bookendsbd/


-------------------------------------------------------------------------------------

লেখক - আহমেদ শরীফ

প্রকাশক - মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, ড্রিমস পাবলিকেশনস, টাঙ্গাইল

প্রথম প্রকাশ - নভেম্বর ২০১৯

প্রচ্ছদ - তৌহিদুল ইসলাম

মুদ্রণ - ওমাসিস প্রেস, কাঁটাবন, ঢাকা

পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৩৭১; হার্ড কভার 

মূল্য - ৯০০/- (নয়শত টাকা মাত্র) 

ISBN : 978-984-34-7564-0
 -------------------------------------------------------------------------------
লেখকের প্রথম বইটা না পেয়ে থাকলে এই লিঙ্ক থেকে ঘুরে আসুন - 
 

Thursday 31 October 2019

পুতিনের আফ্রিকায় অবতরণ!

৩১শে অক্টোবর ২০১৯
 


২৩শে অক্টোবর রুশ বিমান বাহিনীর দু’টা ‘তুপোলেভ টিইউ-১৬০’ পারমানবিক বোমারু বিমান দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে অবতরণ করে। এটা ছিল আফ্রিকার মাটিতে রুশ পারমানবিক বোমারু বিমানের প্রথম অবতরণ। রাশিয়া থেকে ১১ হাজার কিঃমিঃ উড়ে আসা এই বিমানগুলির মিশনকে প্রশিক্ষণ মিশন হিসেবে বলা হলেও এর রয়েছে বিশেষ কৌশলগত তাতপর্য। বিমানগুলি যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় অবতরণ করছিল, তখনই রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরের উপকূলের শহর সোচিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল প্রথম রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ বৈঠক। বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে সেখানে যান আফ্রিকার ৪৩ জন রাষ্ট্রপ্রধান এবং ৩ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী। পুরো অনুষ্ঠানটির কান্ডারী হিসেবে পুতিনের সাথে ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি।

‘দ্যা মস্কো টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই অনুষ্ঠানটি সোচির অলিম্পিক ভিলেজে আয়োজন করাটা একটা প্রতীকি ব্যাপার ছিল। এই অলিম্পিক ভিলেজেই ২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের সময় পুতিন তার নতুন বহিঃর্মুখী পররাষ্ট্রনীতির আভাস দেন। সেই গেমসের প্রায় সাথে সাথেই রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পরে। সেবছরের এপ্রিলে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়; এবং সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের পূর্বে ডনবাস এলাকায় রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হয়। এর পরের বছর সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সিরিয়ার যুদ্ধে বাশার আল-আসাদের সরকারের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষপের অভিযোগ, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সদস্য এডওয়ার্ড স্নোডেনকে আশ্রয় প্রদান, ভেনিজুয়েলার সরকারকে সামরিক সমর্থন প্রদান এবং তুরস্কের কাছে অত্যাধুনিক ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রয়সহ আরও অনেক আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অংশ হয় রাশিয়া। ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের যে অবরোধের চাপ নেমে এসেছে, সেটাই রাশিয়ার পৃথিবীব্যাপী বন্ধু খোঁজার কাজকে ত্বরান্বিত করেছে। রাশিয়ার আফ্রিকায় গমনের কারণও সেটাই। সোচির রাশিয়া-আফ্রিকা বৈঠকের অনেক অগেই রাশিয়া আফ্রিকাতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই বৈঠকের মাধ্যমে সেই চেষ্টাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলো রাশিয়া।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে বৈঠক শেষ করেই পুতিন আফ্রিকার বৈঠকে যোগ দেন। মধ্যপ্রাচ্যে একটা সাফল্যমন্ডিত সফর শেষ করেই পুতিন সোচিতে আসেন। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে একটা শক্তিশালী অবস্থান পাকাপোক্ত করেই তবে তিনি সোচিতে আফ্রিকা নিয়ে বসেছিলেন। সাম্প্রতিককালে আফ্রিকাতে রাশিয়ার অবস্থান নিয়ে খুব কমই কথা হয়েছে। আফ্রিকার সাথে চীন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি, জাপান, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যতটা গভীর সেক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থান তেমন কিছুই নয়। আফ্রিকার সাথে রাশিয়ার বাৎসরিক বাণিজ্য ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো; যেখানে এই মহাদেশের সাথে ইইউ-এর বাণিজ্য ৩’শ বিলিয়ন ডলার; চীনের বাণিজ্য ২’শ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এমনকি ফ্রান্সের বাণিজ্যও ৫০ বিলিয়ন ডলারের উপর। ‘ইউরোস্ট্যাট’এর হিসেবে আফ্রিকার বৃহত্তম পাঁচ বাণিজ্য সহযোগী দেশের মাঝে রাশিয়ার নাম নেই; ইইউ, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর আসে রাশিয়ার নাম। ভ্লাদিমির পুতিন এক্ষেত্রে আর্থিক সম্পর্ককে সামনে না টেনে আফ্রিকার দেশগুলির স্বাধীনভাবে চলতে পারার প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন। সন্মেলনের আগে রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’এর সাথে এক সাক্ষাতে তিনি বলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি আফ্রিকার দেশগুলির উপর চাপ প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং ব্ল্যাকমেইলের পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলিকে কোন শর্ত ছাড়াই সহায়তা করতে প্রস্তুত। তিন বলেন যে, রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলিকে ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হতে সহায়তা দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফ্রিকার সাথে রাশিয়ার দূরত্ব তৈরি হলেও ইতিহাস মুছে যায়নি। যেমন, মোজাম্বিক পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশের পতাকায় একটা কালাশনিকভ রাইফেল রয়েছে। সন্মেলনে অংশ নেয়া অনেকেই পুতিনের কথাগুলির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাহায্যের বদলে সহযোগিতা এবং বশ্যতার পরিবর্তে সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলেন। আফ্রিকার দেশগুলির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে রাশিয়া সরব থাকলেও নিজের সীমানাতেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং অন্যান্য দেশের ব্যাপারে রাশিয়া চুপ থেকেছে।
 


আফ্রিকার নিরাপত্তায় রাশিয়া

অর্থনীতিবিদ চার্লস রবার্টসন ‘দ্যা মস্কো টাইমস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, আফ্রিকাতে রাশিয়ার মোট রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ যায় মাত্র দু’টা দেশে – মিশর এবং আলজেরিয়াতে। তবে আফ্রিকার দেশগুলির সাথে নিরাপত্তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়া অনেকের থেকেই এগিয়ে। সোভিয়েত সময় থেকেই আফ্রিকার বহু দেশ রুশ অস্ত্রের উপরে নির্ভরশীল। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর হিসেবে গত পাঁচ বছরে রাশিয়া আফ্রিকার সবচাইতে বড় অস্ত্র রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা সরকারগুলি যখন আফ্রিকার দেশগুলিতে মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে অস্ত্র সরবরাহে লাগাম টেনেছে, তখন রাশিয়া সেই শূণ্যস্থান পূরণ করে নিয়েছে।

সোচির সন্মেলনের বাইরেই রুশ নির্মিত অস্ত্রের এক বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়; যা ছিল অস্ত্র কেনাবেচার আলোচনায় মুখর। রুশ সামরিক রপ্তানিকারক কোম্পানি ‘রসবরনএক্সপোর্ট’এর ডিরেক্টর জেনারেল আলেক্সান্ডার মিখিভ বলেন যে, আফ্রিকার ২০টি দেশে তাদের মোট অস্ত্র রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ যাচ্ছে; যার মূল্যমান ১৪ বিলিয়ন ডলার। সোচির বৈঠকের সাইডলাইনে ‘রসবরনএক্সপোর্ট’ ১৫টা দেশের সাথে আলোচনায় বসে। ‘আরআইএ’ সংবাদ সংস্থা বলছে যে, বৈঠকের ফাঁকে রাশিয়া নাইজেরিয়ার কাছে ১২টা ‘এমআই-৩৫পি’ এটাক হেলিকপ্টার বিক্রয়ের চুক্তি করে। নাইজেরিয়া বলছে যে, এই হেলিকপ্টারগুলি বোকো হারাম জঙ্গীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাল্লা আনকুরাও-এর বরাত দিয়ে রুশ মিডিয়া ‘আরটি’ বলছে যে, রুশ মিলিটারি একাডেমিগুলিতে এখন ১’শরও বেশি নাইজেরিয়ান সামরিক সদস্য ট্রেনিং নিচ্ছে। ‘রাশান হেলিকপ্টারস’ কোম্পানির ডিরেক্টর জেনারেল আন্দ্রেই বোগিনস্কি বলেন যে, বর্তমানে আফ্রিকায় উড়ছে ৯’শরও বেশি রুশ-নির্মিত হেলিকপ্টার, যা কিনা পুরো মহাদেশের মোট হেলিকপ্টারের এক-চতুর্থাংশ। আর সেখানে সামরিক হেলিকপ্টারের প্রায় ৪০ শতাংশই রুশ-নির্মিত। কাজেই এই হেলিকপ্টারগুলি সার্ভিসিং, আধুনিকায়ন এবং নবায়নের অনেক ব্যবসায়িক কনট্রাক্ট রুশরা পেতে পারে।

‘মস্কো স্টেট ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’এর আইভান লোশকারেভ বলছেন যে, রাশিয়া চাইছে পৃথিবীর শক্তির কেন্দ্রকে একটা দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) হাতে থাকতে না দিয়ে অনেকগুলি দেশের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া; যার মাঝে একটা দেশ হবে রাশিয়া। আর আফ্রিকাতে কয়েকটা দেশকে রাশিয়া শক্তির কেন্দ্র হিসেবে দেখতে চাইছে; যেমন, উত্তর আফ্রিকায় মিশর; পশ্চিম আফ্রিকায় নাইজেরিয়া; আর আফ্রিকার দক্ষিণে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই শক্তির কেন্দ্রগুলিতে রাশিয়া শক্ত অবস্থানে বসার লক্ষ্য নিয়েই এগুচ্ছে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফ্রিকাতে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধির একটা প্রমাণ ছিল ২০১৮ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে তিনজন রুশ সাংবাদিককে হত্যা। এই সাংবাদিকেরা সেই দেশে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ নামের গোপন রুশ ভাড়াটে সেনাদের অবস্থান নিয়ে রিপোর্ট করতে এসেছিলেন। সোচিতে পুতিন এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ফস্টিন-আরশাঞ্জ তুয়াদেরা এই হত্যাকান্ডের তদন্তের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন বলে ক্রেমলিন থেকে বলা হয়।

আফ্রিকাতে মস্কোর প্রভাব বৃদ্ধির সাথেসাথে এই অঞ্চলের পুরোনো শক্তিরা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে মনোযোগী হয়েছে বলে বলছেন ‘কন্ট্রোল রিস্কস’এর টিম স্ট্যানলি এবং বার্নাবি ফ্লেচার। ‘দ্যা মস্কো টাইমস’এ এক লেখায় তারা বলছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি তাদের রাজনৈতিকভাবে কর্মকান্ড বাড়াবার সাথে সাথে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থগুলিকেও বেশি করে সামনে নিয়ে আসছে। জুন মাসে ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রসপার আফ্রিকা’ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আফ্রিকাতে উন্নয়নের জন্যে সহায়তা দেবার সাথে সাথে সেই প্রকল্পগুলিতে মার্কিন কোম্পানিগুলিকে কাজ পাইয়ে দেবার চিন্তা আসছে। এর আগে মার্কিন নীতি ছিল মূলতঃ রাজনৈতিক সংস্কারকে ঘিরে। অন্যদিকে চীন আফ্রিকাতে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাবকে রাজনৈতিক প্রভাবে রূপান্তরিত করতে চাইছে।

‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের টানাপোড়েন চলছে। পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে রাশিয়া তার অর্থনীতিকে ইউরোপ থেকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফোকাস কমে যাবার ফলে রাশিয়ার জন্যে সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও আফ্রিকার দেশগুলির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শরণার্থী সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং আফ্রিকার সরকারগুলির উপর নানামুখী চাপের সৃষ্টি করেছে। এই সুযোগে রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলির সাথে সামরিক সম্পর্ক গভীর করেছে, বাণিজ্যিক সম্পর্কও বাড়িয়েছে, এবং সেসব দেশের স্বেচ্ছাচারী শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়েছে। প্রাক্তন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ব্রেগাদজে এখন পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে রুশ এলুমিনিয়াম কোম্পানি রুসালে রয়েছেন; যেখান থেকে তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডেকে সমর্থন যোগাচ্ছেন। প্রাক্তন রুশ ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা ভ্যালেরি জাখারভ এখন সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট ফস্টিন-আরশাঞ্জ তুয়াদেরার নিরাপত্তা উপদেষ্টা। সেন্ট্রাল আফ্রিকা এবং মোজাম্বিকে রুশ ভাড়াটে সেনারা সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলেও বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছে। গত জুনে রাশিয়ার প্রাক্তন ধনকুবের মিখাইল খদরকভস্কির মাধ্যমে পাওয়া কিছু নথি জনসম্মুখে আনে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’। সেখানে বেশ লম্বা বর্ণনা দেয়া হয় যে, কিভাবে নিরাপত্তা, রাজনীতি, ব্যবসা, মিডিয়া, এনজিও, ইত্যাদির উপর ভর করে রাশিয়া আফ্রিকায় তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। সেখানে ১৩টা দেশকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের হৃদ্যতার উপর ভিত্তি করে রেটিং করা হয়।






রাশিয়ার সক্ষমতা আসলে কতটুকু?
রাশিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। ‘দ্যা আফ্রিকা রিপোর্ট’এর এক লেখায় অলিভিয়ে মারবো মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকায় রাশিয়া বেশকিছু বন্ধু হারিয়েছে, যার মাঝে রয়েছে সুদান এবং আলজেরিয়া। এই দেশগুলিতে বহুকাল ক্ষমতায় থাকা নেতৃবৃন্দের পতন হয়েছে। একইসাথে কয়েক বছর ধরে আফ্রিকার মাটিতে একটা সামরিক ঘাঁটি বসাবার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করলেও রাশিয়া এখনও সেই প্রচেষ্টায় সফল হতে পারেনি। তদুপরি আফ্রিকার দেশগুলির সামরিক বাহিনীগুলির সাথে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক আফ্রিকার মাটিতে রাশিয়ার স্বার্থকে সমুন্নত রেখেছে।

রাশিয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে রয়েছে আরও বড় প্রশ্ন। ২০১৮ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন আফ্রিকাতে ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চ্যাটহ্যাম হাউজের আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান এলেক্স ভাইন্স বলছেন যে, এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে রাশিয়াকে অনেক চতুর হতে হবে। কম খরচে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করতে হবে তাদের, নতুবা সক্ষমতার বাইরে গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হতে পারে। ‘মেডুজা’ বার্তা সংস্থা বলছে যে, লিবিয়ার সামরিক নেতা খলিফা হাফতারের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে কয়েক ডজন রুশ ভাড়াটে সেনার মৃত্যু হয়েছে। ‘কারটা ডে মোজাম্বিক’ জানাচ্ছে যে, পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাঁচজন রুশ ভাড়াটে সেনার মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবর মাসের শুরুতে মোজাম্বিকে একজন রুশ নাগরিকের মৃত্যুর পর ক্রেমলিন থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, মোজাম্বিকে কোন রুশ সেনা নেই।

রাশিয়ার আফ্রিকাতে টিকে থাকার সক্ষমতা কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। ‘রাশান একাডেমি অব সাইন্সেস’এর ইন্সটিটিউট ফর আফ্রিকান স্টাডিজের ওলগা কুলকোভা রাশিয়ার আফ্রিকায় ফেরত আসাকে রেলগাড়ির শেষ কম্পার্টমেন্টে বসার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলছেন যে, আফ্রিকাতে রাশিয়াকে চেনে পুরোনো সোভিয়েত প্রজন্মের মানুষগুলি। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের সাথে রাশিয়ার সেই সম্পর্ক নেই। পুরোনো প্রজন্মের প্রস্থানের আগেই রাশিয়াকে সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তবে সেই সুযোগ রাশিয়ার জন্যে কখনও না-ও আসতে পারে। ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর আফ্রিকা প্রোগ্রামের ডিরেক্টর জাড ডেভারমন্ট বলছেন যে, পুরোনো সূত্রে রাশিয়া ‘গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতা’য় নেমেছে; কিন্তু এক্ষেত্রে তারা কতটুকু সক্ষমতা রাখে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। রুশরা জাতিসংঘেও আফ্রিকার দেশগুলিকে নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশেষতঃ ইউক্রেনের যুদ্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘে যে কোন আলোচনায় রাশিয়া আফ্রিকাতে বন্ধু খুঁজেছে। তবে এই চেষ্টার উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের রিচার্ড গোওয়ান বলছেন যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আফ্রিকার পক্ষে রাশিয়ার দাঁড়ানোর বিষয়টা রাশিয়ার নিজের ‘স্ট্যাটাস’ ঘোষণা করা এবং পশ্চিমা শক্তিদের ত্যাক্ত করার চাইতে বেশি কিছু বলে মনে হয় না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে পরিবর্তন করার কোন মাস্টার প্ল্যান রাশিয়ার নেই।


Monday 28 October 2019

বলিভিয়া – লিথিয়াম যুদ্ধের শুরু?


২৮শে অক্টোবর ২০১৯
বলিভিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতাকে মূল্যায়ন করতে হলে অত্র অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এক খনিজ সম্পদকে হিসেবের মাঝে আনতে হবে। এই খনিজের নাম হলো লিথিয়াম। সবচাইতে হাল্কা এই ধাতু এখন ইলেকট্রিক ব্যাটারি তৈরির অতি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত বিশ্বে ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে চাহিদা বাড়ছে লিথিয়ামের। গাড়ির জ্বালানি হিসেবে তেলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে লিথিয়াম ব্যাটারি। লিথিয়াম হয়ে যাচ্ছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক পদার্থ। আর এই কৌশলগত পদার্থের বেশিরভাগ রিজার্ভই রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়।


২০শে অক্টোবর বলিভিয়াতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর সুপ্রিম ইলেকটোরাল কোর্ট ঘোষণা দেয় যে, মোরায়েজ ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কার্লোস মেসা পেয়ছেন ৩৬ শতাংশ ভোট। দু’জনের মাঝে ১০ শতাংশের বেশি ভোটের ব্যবধান থাকায় দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনের আর দরকার হবে না। ভোট গননার প্রথম দিকে মোরায়েজ এগিয়ে থাকলেও ব্যবধান ছিল খুবই সামান্য। শেষের দিকের গণনায় হঠাত করেই মোরায়েজের পক্ষে ব্যবধান অনেক বেড়ে যায়। এতে বিরোধী দলগুলি ভোট গণনায় কারচুপির অভিযোগ তোলে এবং ব্যাপক বিক্ষোভের ডাক দেয়। ‘এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বলিভিয়ার নির্বাচনের ফলাফলে পশ্চিমা দেশগুলি খুশি হতে পারেনি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় রাউন্ড নির্বাচন করার জন্যে মোরায়েজের সরকারের উপর চাপ দিচ্ছে। অপরদিকে মোরায়েজ বলছেন যে, তার বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালাচ্ছে। বলিভিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতার এই আভাসকে মূল্যায়ন করতে হলে অত্র অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এক খনিজ সম্পদকে হিসেবের মাঝে আনতে হবে। এই খনিজের নাম হলো লিথিয়াম। সবচাইতে হাল্কা এই ধাতু এখন ইলেকট্রিক ব্যাটারি তৈরির অতি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত বিশ্বে ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে চাহিদা বাড়ছে লিথিয়ামের। গাড়ির জ্বালানি হিসেবে তেলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে লিথিয়াম ব্যাটারি। লিথিয়াম হয়ে যাচ্ছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক পদার্থ। আর এই কৌশলগত পদার্থের বেশিরভাগ রিজার্ভই রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। ‘ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে’র হিসেবে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচাইতে বড় লিথিয়াম রিজার্ভ পাওয়া গেছে বলিভিয়াতে; যা প্রায় ৯০ লক্ষ টনের মতো। পার্শ্ববর্তী দেশ চিলিতে রয়েছে ৭৫ লক্ষ টন এবং আর্জেন্টিনাতে ২০ লক্ষ টন। এর বাইরে চীনে ৩২ লক্ষ টনে এবং অস্ট্রেলিয়াতে ২৭ লক্ষ টন লিথিয়ামের রিজার্ভ পাওয়া গেছে।

  
‘ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে’র হিসেবে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচাইতে বড় লিথিয়াম রিজার্ভ পাওয়া গেছে বলিভিয়াতে; যা প্রায় ৯০ লক্ষ টনের মতো। পার্শ্ববর্তী দেশ চিলিতে রয়েছে ৭৫ লক্ষ টন এবং আর্জেন্টিনাতে ২০ লক্ষ টন। এর বাইরে চীনে ৩২ লক্ষ টনে এবং অস্ট্রেলিয়াতে ২৭ লক্ষ টন লিথিয়ামের রিজার্ভ পাওয়া গেছে।


সাদা সোনা?

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বলিভিয়া সরকার জার্মান কোম্পানি ‘এসিআই সিস্টেমস’এর সাথে একটা জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রকল্পে লিথিয়াম হাইড্রক্সাইড প্ল্যান্ট এবং লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরিতে অগ্রসর হবার ঘোষণা দেয়। ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের এই প্রকল্প বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের উইউনিতে বাস্তবায়িত হবে। উইউনি হলো বৃহত্তম ‘সল্ট ফ্ল্যাট’ বা সমতল লবনের খনি। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লিথিয়ামের রিজার্ভ রয়েছে বলিভিয়াতে। আর বলিভিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ চিলি এবং আর্জেন্টিনাতে রয়েছে আরও বেশকিছু রিজার্ভ। এই তিন দেশের রিজার্ভ মিলে একে ‘লিথিয়াম ট্রাইএঙ্গেল’ বা ‘লিথিয়াম ত্রিভুজ’ বলা হয়ে থাকে। বলিভিয়া এতদিন নিজের অংশের খনিগুলিকে ব্যাবহার করতে সমর্থ হয়নি। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরায়েজ চাইছিলেন যে, বলিভিয়ার লিথিয়াম শুধুমাত্র কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি না হয়। তার লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয় এমন কিছু শিল্প স্থাপন করা। একইসাথে প্রেসিডেন্ট মোরায়েজের সরকার এই প্রকল্পের পরিবেশগত সমস্যা নিয়েও চিন্তিত ছিল। জার্মানরা বলিভিয়ানদের আস্বস্ত করে যে এই প্রকল্পে পরিবেশগত সমস্যা খুব একটা নেই। একইসাথে তারা বলিভিয়াতে ব্যাটারি তৈরির কারখানা করার প্রস্তাব দেয়ায় অন্য প্রস্তাবগুলি থেকে এগিয়ে যায়।

‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, দুই বছর ধরে জার্মান কর্মকর্তারা তদবিরের জন্যে বলিভিয়াতে যাতায়াত করেছেন। বলিভিয়ার কর্মকর্তারাও জার্মানিতে ব্যাটারি ফ্যাক্টরি ঘুরে আসেন। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিলেই খুব সম্ভবতঃ জার্মানি কাজটা নিশ্চিত করে ফেলে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর জার্মান অর্থমন্ত্রী পিটার অল্টমায়ার বলেন যে, জার্মানির উচিৎ বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ইলেকট্রিক ব্যাটারি প্রস্তুতকারক হয়ে যাওয়া। কারণ ব্যাটারি তৈরির খরচের একটা বড় অংশ আসে এর কাঁচামাল থেকে। তিনি আরও বলেন যে, জার্মান কোম্পানিগুলির উচিৎ আগেভাগেই নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী লিথিয়ামের সরবরাহ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া; এটা না করতে পারলে তারা অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এবং পিছিয়ে থাকবে। চুক্তিটাকে তিনি এই লক্ষ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে আখ্যা দেন। চুক্তি মোতাবেক ২০২২ সাল থেকে পরবর্তী ৭০ বছর পর্যন্ত জার্মান কোম্পানি ‘এসিআই সিস্টেমস’ প্রতি বছর ৪০ হাজার টন লিথিয়াম হাইড্রক্সাইড উৎপাদন করবে। ‘এসিআই’এর প্রধান নির্বাহী উলফগ্যাং শ্মাটজ বলেন যে, এখান থেকে ৮০ শতাংশ লিথিয়ামই জার্মানিতে রপ্তানি হবে। ‘এসিআই’ চাইছে যে, এই লিথিয়াম প্ল্যান্টের ব্যাটারি বড় কিছু জার্মান গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিকে সরবরাহ করতে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে জার্মানরা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ লিথিয়াম ত্রিভুজে নিজেদের স্থান করে নিল। ‘এসিআই’এর সামনে একটা ভীতি রয়েছে যে, এর আগে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট মোরায়েজ বিভিন্ন শিল্পকে সরকারীকরণ করেছিলেন। তবে এব্যাপারে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী শ্মাটজ বলছেন যে, বলিভিয়ানরা নিশ্চিত করেছে যে তারা বিদেশী বিনিয়োগের নিরাপত্তা দেবে। এব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হলেও জার্মানরা যে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে পারবে না তা হলো বলিভিয়া একটা স্থলবেষ্টিত দেশ। এখান থেকে লিথিয়াম জাহাজে ওঠাতে হলে পার্শ্ববর্তী দেশ চিলি বা পেরুর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে হবে। ‘এসিআই’ বেশ ছোট একটা কোম্পানি; আর লিথিয়াম প্রসেসিং-এ তাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাই নেই। আর ঠান্ডা পরিবেশে অবস্থিত হওয়ায় উইউনিতে লবন থেকে লিথিয়াম আলাদা করতে বেশ কষ্ট করতে হবে। পার্শ্ববর্তী চিলিতে উত্তপ্ত মরুভূমিতে অবস্থিত হবার কারণে সেখানে লিথিয়াম প্রসেসিংএ খরচ কম হয়।

‘রয়টার্স’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, যখন বলিভিয়ার সরকার জয়েন্ট ভেঞ্চারের জন্যে পার্টনার খোঁজার ডাক দেয়, তখন চীনাদের নাম স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসে। কারণ পৃথিবীর বেশিরভাগ লিথিয়াম ব্যাটারি চীনেই তৈরি হয়, এবং বলিভিয়ার সরকারের সাথে চীনাদের সম্পর্ক বেশ ভালো। জার্মানরা চীন, রাশিয়া এবং কানাডার সাতটা কোম্পানিকে ডিঙ্গিয়ে কাজটা পেয়ে যায়। জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের সরাসরি সম্পর্থন থাকার কারণে ‘এসিআই’ এই কাজের জন্যে কতটা উপযোগী, তা প্রমাণিত হয়। চীনারা বলিভিয়াতে ব্যাটারি তৈরির প্রস্তাব দেয়নি। তাদের যুক্তি ছিল যে, বলিভিয়াতে ব্যাটারি তৈরি করলে তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। বলিভিয়ানরা এই প্রকল্পের ৫১ শতাংশের মালিক থাকবে। এব্যাপারে বলিভিয়ানদের পূর্ব অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। কয়েক’শ বছর ধরে বলিভিয়াতে রূপার খনির কাজ চলছে। বলিভিয়ার রূপার খনির উপর ভিত্তি করে স্পেন বিশ্বব্যাপী তার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। কিন্তু এই খনিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিবেশে শ্রম দেয়া ছাড়া বলিভিয়ানরা কিছুই পায়নি। রূপার খনি শেষ হয়ে গেলে সকলেই বলিভিয়ানদের ভুলে যায়। ইভো মোরায়েজের সরকারও ইতিহাসকে মাথায় রেখেই বলিভিয়ার খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। সেই আঙ্গিকে ২০০৬ সালে মোরায়েজ বিদেশী কোম্পানি ‘পেট্রোব্রাজ’ এবং ‘রেপসল’এর তেলের খনিগুলি সরকারিকরণ করেন। বলিভিয়ার সরকারি কোম্পানি ‘ওয়াইএলবি’র প্রধান হুয়ান কার্লোস মন্টেনেগ্রো বলেন যে, কোন কোম্পানিকে কাজ দেয়া হবে, সেটা ঠিক করতে ভূরাজনৈতিকে প্রধান্য দিতে হয়েছে। তিনি বলেন যে, তারা চাননা যে, একটা দেশ এখানে সকলকিছু নিয়ন্ত্রণ করুক; বরং এখানে একটা ব্যালান্স থাকা উচিৎ। বলিভিয়ার জন্যে দরকার শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সহযোগী নয়, বরং দরকার ভূরাজনৈতিক কৌশলগত সহযোগী। তিনি আরও বলেন যে, চীনকে তারা এড়িয়ে যেতে চান না। কারণ চীনারা দুনিয়ার সকল দেশেই রয়েছে; তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

   
লিথিয়াম ত্রিভুজের মাঝে চিলিরই সবচাইতে বেশি সফল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চিলির সমুদ্রবন্দর থেকে লিথিয়াম খুব সহজেই প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে চীন পৌঁছে যাবে। বলিভিয়াকে চিলির বন্দরগুলিই ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার খনি থেকে লিথিয়াম বের করে সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত পৌঁছানো বেশ কঠিন। আর্জেন্টিনার সমুদ্রবন্দরগুলি আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে।


চীনের পাল্টা আক্রমণ

জার্মানরা বলিভিয়াতে উইউনি খনিতে বিনিয়োগ নিশ্চিতের পর অনেকেই বলেছিলেন যে জার্মানরা চীনাদের হারিয়ে সেই স্থান দখল করে নিয়েছে। সেটার জবাব এসেছে চীনাদের কাছ থেকে এবছরের ফেব্রুয়ারিতে। বলিভিয়ার সরকার ঘোষণা দেয় যে, বলিভিয়ার কইপাসা এবং পাসতোস গ্রান্দেস খনির উন্নয়নের জন্যে সেদেশের সরকার চীনের ‘শিনজিয়াং টিবিইএ গ্রুপ’ নামের এক কনসোর্টিয়ামের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারের চুক্তি করেছে। ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে প্রথমে শুধু চীনারাই বিনিয়োগ করবে। তবে জার্মান কোম্পানির সাথে চুক্তির মতোই এই জয়েন্ট ভেঞ্চারেও ৫১ শতাংশ থাকবে বলিভিয়া সরকারের কাছে। চীনা কোম্পানি জার্মানি, রাশিয়া এবং আয়ারল্যান্ডের মোট ছয়টি কোম্পানিকে হারিয়ে এই চুক্তি করে। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট মোরায়েজ বলেন যে, তারা চীনকে নির্বাচন করেছেন কারণ চীনে রয়েছে লিথিয়াম ব্যাটারির একটা নিশ্চিত বাজার। বলিভিয়ান সরকার উইউনি খনিতে প্রায় ২ কোটি ১০ লক্ষ টন লিথিয়াম আছে ঘোষণা দিলেও কইপাসা এবং পাসতোস গ্রান্দেস খনিতে কতটা লিথিয়াম রয়েছে, তা জানায়নি। বলিভিয়ার সরকার বলছে যে, তারা হয়তো চীনে একটা ব্যাটারি ফ্যাক্টরি তৈরিতে সহযোগিতা করতে পারে। অর্থাৎ চীনারা বলিভিয়াতে ব্যাটারি ফ্যাক্টরি করছে না।

বলিভিয়ার সাথে চীনের সম্পর্ক বেশ ভালো। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট মোরায়েজ চীন সফর করেন। সফরকালে দুই দেশ তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত করার ঘোষণা দেয়। এর আগে ব্রাজিলের সাথে চীন তার সম্পর্ককে এই পর্যায়ে উন্নীত করে ২০০৯ সালে; চিলির সাথে ২০১৬ সালে; এবং উরুগুয়ের সাথে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। অর্থাৎ বলিভিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন দক্ষিণ আমেরিকায় চীনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনারই অংশ। ‘নর্থ আমেরিকান কংগ্রেস অন ল্যাটিন আমেরিকা’র এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বলিভিয়াতে ১’শর মতো চীনা কোম্পানি কাজ করছিল। এরা অনেকেই সরকারি কাজকর্মের একটা বড় অংশ নিয়ে নিয়েছে। ইলেকট্রনিক্স, নিরাপত্তা, পরিবহণ, টেলিকমিউনিকেশন, অবকাঠামো উন্নয়ন, ইত্যাদি খাতে চীনারা কাজ করছে সেখানে। এছাড়াও কাগজ কারখানা, চিনি পরিশোধনাগার, দস্তা ও টিন প্রসেসিং কারখানা, স্টিল মিল, ইত্যাদি খানে চীনারা বিনিয়োগ করেছে। এমনকি বর্তমানে বলিভিয়ার সরকার স্বল্প পরিসরে যে লিথিয়াম উৎপাদন করছে, তা-ও চীনা প্রযুক্তির কারণেই সম্ভব হচ্ছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বলিভিয়া প্রথমবারের মতো ১৫ টন লিথিয়াম চীনে রপ্তানি করে। বলিভিয়ার তামা খনির উন্নয়নেও চীনারা এগিয়ে এসেছে। বলিভিয়ার বিভিন্ন স্থানে তেল খনি উন্নয়নেও চীনা কোম্পানিগুলি কাজ পেয়েছে। মোট কথা, বলিভিয়ার লিথিয়াম খনিতে চীনারা কাজ করবে, এটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। বরং জার্মানদের কাজ পাওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক।

ভূরাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘স্ট্রাটফর’ বলছে যে, দক্ষিণ আমেরিকার লিথিয়াম খনির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ সামনের দিনগুলিতে ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার আরও বাড়তে চলেছে; আর এই গাড়িগুলি চলবে লিথিয়াম ব্যাটারিতেই। লিথিয়ামকে এখন বলা হচ্ছে ‘নতুন তেল’। ‘স্ট্রাটফর’ বলছে যে, লিথিয়াম ত্রিভুজের মাঝে চিলিরই সবচাইতে বেশি সফল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চিলির সমুদ্রবন্দর থেকে লিথিয়াম খুব সহজেই প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে চীন পৌঁছে যাবে। বলিভিয়াকে চিলির বন্দরগুলিই ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার খনি থেকে লিথিয়াম বের করে সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত পৌঁছানো বেশ কঠিন। আর্জেন্টিনার সমুদ্রবন্দরগুলি আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে। তবে আর্জেন্টিনার খনিতে চিলির কোম্পানি ‘এসকিউএম’ এবং কানাডার ‘লিথিয়াম আমেরিকাস কর্পোরেশন’ ও ‘এক্সার’ বিনিয়োগ করছে। অন্যদিকে নিজেদের খনিকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তিগত যোগ্যতা বলিভিয়ানদের নেই বলেই তারা বিদেশী সহযোগী খুঁজছে। নিজেদের চেষ্টায় তারা এখন মাসে ১০ টনের বেশি লিথিয়াম কার্বনেট উৎপাদন করতে পারছে না। তবে চিলি কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকলেও তাদের ক্ষেত্রেও নতুন করে সমস্যা তৈরি হতে যাচ্ছে। চিলিতে চলছে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। ২৫শে অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে হাজারো মানুষের বিক্ষোভের মাঝে ৭’শ মাইল উত্তরের আতাকামা লবনের খনির কাছে সাধারণ জনতা রাস্তা আটকে ফেলে। এই রাস্তা দিয়েই চিলির লিথিয়াম সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভে ইতোমধ্যেই ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

   
ক্ষমতায় টিকে থাকতে গিয়ে মোরায়েজ তার জনসমর্থন যতো বেশি হারাবেন, ততই তাকে নির্ভরশীল হতে হবে পশ্চিমাদের সমর্থনের উপর। আবার বিদেশী কোম্পানিগুলিকে বেশি ছাড় দিতে থাকলে মোরায়েজ তার জনসমর্থন আরও হারাবেন। একইসাথে বলিভিয়ার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ লিথিয়ামের খনিগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পশ্চিমাদের সাথে চীনের উত্তেজনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।


বলিভিয়ায় খনিজ সম্পদের রাজনীতি

৭ই অক্টোবর পোতোসি প্রদেশে জার্মান কোম্পানি ‘এসিআই’এর চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এই প্রদেশেই বলিভিয়ার বেশিরভাগ খনিজ সম্পদ রয়েছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন যে, অত্র অঞ্চলের মানুষ এই প্রকল্প থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সুবিধা ভোগ করতে পারবে না। ‘পোতোসি সিভিক কমিটি’ বিক্ষোভ মিছিল করে এবং এবং ঘোষণা দেয় যে, প্রেসিডেন্ট মোরায়েজ তাদের কথা না শুনলে তারা তাদের কর্মকান্ডকে আরও প্রসারিত করবেন। প্রেসিডেন্ট মোরায়েজ বিরোধী দলের সমালোচনা করে বলেন যে, তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আগে এই আন্দোলন করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চাইছে। এই আন্দোলন শুরুর দুই সপ্তাহের মাঝে ২০শে অক্টোবর বলিভিয়াতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

৬০ বছর বয়সী ইভো মোরায়েজ জাতিগতভাবে ল্যাটিন আমেরিকার আদিবাদী। আর তিনিই বলিভিয়ার প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট। বলিভিয়ার সংবিধানে একজন প্রেসিডেন্টের পক্ষে দু’বারের বেশি ক্ষমতাসীন হবার নিয়ম না থাকলেও তিনি এবার চতুর্থবারের মতো নির্বাচন করেছেন। ২০১৬ সালে এক গণভোটে হেরে গিয়ে তিনি চতুর্থবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দাঁড়াবার পক্ষে জনমত যোগাড়ে ব্যর্থ হন। এর এক বছর পর সাংবিধানিক আদালত থেকে তিনি চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে দাঁড়াবার অনুমতি নিয়ে নেন। অপরদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কার্লোস মেসা ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গনথালো সানচেজ ডে লোজাদা ব্রিটিশ এবং স্প্যানিশ কোম্পানির সাথে দেশের গ্যাস রপ্তানির চুক্তি করতে গিয়ে ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে পদত্যাগ করেন। এরপর কার্লোস মেস ক্ষমতা নিলেও বিক্ষোভ থামাতে ব্যর্থ হন; এবং ২০০৫ সালে তিনিও পদত্যাগ করেন। ঐ একই বছরের ডিসেম্বরে বলিভিয়ার ‘গ্যাস যুদ্ধ’র নেতৃত্ব দেয়া বামপন্থী এবং আদবাসী নেতা ইভো মোরায়েজ প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন।

২০০৫ সালে বলিভিয়ার গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করার শপথ নিয়েই মোরায়েজ ‘গ্যাস যুদ্ধে’ নেতৃত্ব দেন এবং পরিশেষে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। আর এখন লিথিয়াম রপ্তানির জন্যে মোরায়েজ চুক্তি করেছেন জার্মান এবং চীনা কোম্পানির সাথে। বলিভিয়ার খনিজ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলি মোরায়েজকে বাধা হিসেবে দেখেছে। পশ্চিমা কোম্পানিগুলিকে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করায় মোরায়েজকে পশ্চিমারা লিথিয়ামের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে। বলিভিয়াতে জার্মান কোম্পানির সাথে চুক্তির বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু হলেও বিনিয়োগের ধরন এবং কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে জার্মানরা চীনাদের থেকে এগিয়ে আছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে জার্মানদের চাইতে চীনাদের বিনিয়োগই বেশি সমস্যায় পড়বে।

প্রেসিডেন্ট মোরায়েজ নির্বাচনের ফলাফল পরীক্ষা করার জন্যে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর বলিভিয়ার অর্থনীতিকে গতিশীল করেন। ২০০৫ সালে বলিভিয়ার জিডিপি ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ৪০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তার ১৪ বছরের শাসনামলে বলিভিয়ার অর্থনীতির আকার চারগুণ হয়েছে। তবে বলিভিয়ার অর্থনীতি খনিজ রপ্তানির উপরে যথেষ্টই নির্ভরশীল। জিডিপির প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগই রপ্তানি। আর রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশই খনিজ পদার্থ, যার মাঝে রয়েছে গ্যাস, স্বর্ণ, রূপা, দস্তা, এন্টিমনি, টাংস্টেন, ইত্যাদি। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেকই আসে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনাতে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানি করে। মোরায়েজের সরকার ক্ষমতায় এসে গ্যাস রপ্তানিতে মনোযোগী হন। তবে তিনি গ্যাসের খনিগুলিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে রাজস্ব বৃদ্ধি করেন। মোরায়েজের শাসনামলে আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজের মূল্য ভালো থাকায় বলিভিয়ার রপ্তানি আয় বাড়তে থাকে। মোরায়েজের অর্থনৈতিক সাফল্য তার তিনবার নির্বাচনে জেতার পিছনে বড় কারণ ছিল।

স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার কারণে ইভো মোরায়েজের জনসমর্থন আগের চেয়ে অনেক কমলেও এখনও তার বেশ জনসমর্থন রয়েছে। আর যেহেতু বলিভিয়াতে খনিজ সম্পদ রক্ষার একটা রক্ষণশীল আন্দোলন আগে থেকেই রয়েছে, তা সর্বদা মোরায়েজের বামপন্থী সরকারকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে খনিজ রপ্তানির দিকেই ঝুঁকতে হয়েছে মোরায়েজকে। একইসাথে লিথিয়াম খনির উন্নয়নে পশ্চিমা কোম্পানির সাথে চুক্তিও করতে হয়েছে তার সরকারের, যা কিনা মোরায়েজের একসময়কার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মোরায়েজের দুর্বল অবস্থান পশ্চিমারা ব্যবহার করবে বলিভিয়ার কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নেবার লক্ষ্যে। অপরদিকে সাংবিধানিকভাবে বেআইনী পদ্ধতিতে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবার পরেও পশ্চিমা দেশগুলি বলিভিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক চুক্তিগুলিকে পশ্চিমারা মোরায়েজকে ক্ষমতাচ্যুত করার উপরে প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু এখন ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ লিথিয়ামের খনিগুলি উন্নয়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গিয়ে মোরায়েজ তার জনসমর্থন যতো বেশি হারাবেন, ততই তাকে নির্ভরশীল হতে হবে পশ্চিমাদের সমর্থনের উপর। আবার বিদেশী কোম্পানিগুলিকে বেশি ছাড় দিতে থাকলে মোরায়েজ তার জনসমর্থন আরও হারাবেন। একইসাথে বলিভিয়ার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ লিথিয়ামের খনিগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পশ্চিমাদের সাথে চীনের উত্তেজনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।