Sunday 22 January 2017

বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন?

২২শে জানুয়ারী ২০১৭

একুশ শতকে বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে বহু জায়গায়। তবে একটি স্থানে সবগুলি আলোচনা পাওয়া যায়না সর্বদা। এখানে এমনই একটি চেষ্টার অবতারণা করা হয়েছে। 

ভারত মহাসাগরের মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাতের কারণে এটিই পৃথিবীর একমাত্র এলাকা যেখানে তিনটি বিশাল নদী (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক) একস্থানে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। সুপেয় পানির প্রাচুর্য্যের জন্যে এখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা এখানে এসে বুঝেছিল যে এই এলাকায় একটি নৌশক্তি আবির্ভাবের সকল নিয়ামক রয়েছে, যারা ভবিষ্যতে কোন এক সময় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তারা এই এলাকার শক্তি বুঝতে পেরে কোলকাতা নামের একটি বন্দর স্থাপন করে সেখানেই উপনিবেশের রাজধানী করে।

প্রথমতঃ বঙ্গোপসাগরের ঐতিহাসিক ভূকৌশলগত গুরুত্ব

ভূকৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশ সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আছে। ভারত মহাসাগরের মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাতের কারণে এটিই পৃথিবীর একমাত্র এলাকা যেখানে তিনটি বিশাল নদী (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক) একস্থানে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। সুপেয় পানির প্রাচুর্য্যের জন্যে এখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা এখানে এসে বুঝেছিল যে এই এলাকায় একটি নৌশক্তি আবির্ভাবের সকল নিয়ামক রয়েছে, যারা ভবিষ্যতে কোন এক সময় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তারা এই এলাকার শক্তি বুঝতে পেরে কোলকাতা নামের একটি বন্দর স্থাপন করে সেখানেই উপনিবেশের রাজধানী করে। প্রায় দু’শ বছর এই এলাকা শাসন করে যাবার আগে তারা এই এলাকাটাকেই দুই ভাগ করে দু’টি দেশের মাঝে বিতরণ করে দেয়, যাতে এখানে শক্তিশালী আরেকটি দেশের আবির্ভাব না হতে পারে। এর ফলে ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের রেখে যাওয়া এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া বাংলাদেশ স্বনির্ভর না হয়ে সমুদ্র বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে যায়। এভাবেই বঙ্গোপসাগরে নতুন একটি নৌশক্তি আবির্ভাবের ভিত তৈরি হয়ে যায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ বাণিজ্য হয় নৌপথে, তাই নৌশক্তি বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর একারণেই পৃথিবীর কোন অঞ্চলে শক্তিশালী কোন নৌশক্তির অবির্ভাব যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরুদ্ধ। একইসাথে ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় এই নৌশক্তির আবির্ভাব ভারতেরও স্বার্থবিরুদ্ধ। কাজেই একুশ শতকের বাস্তবতায় বঙ্গোপসাগরে যেকোন নৌশক্তির আবির্ভাবে ভারত বাধা দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সমর্থন যোগাবে।

 
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে মালাক্কা প্রণালীতে চীনকে আটকানোর পরিকল্পনা শুরু করে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের মোট জ্বালানির প্রায় ৮০ শতাংশ যাতায়াত করে। এমতাবস্থায় মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করাটা চীনের জাতীয় স্বার্থের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটির একটি হয়ে পড়ে। চীনারা মালাক্কাকে বাইপাস করে ভারত মহাসাগরে পৌঁছাবার চেষ্টা করতে থাকে। সেই লক্ষ্যে চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত স্থলভাগের উপর দিয়ে রুটগুলিকে চীনারা ডেভেলপ করা শুরু করে।


দ্বিতীয়তঃ দু’দশকের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন

দুই দশকের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনেও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে চীনের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকারণে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে মালাক্কা প্রণালীতে চীনকে আটকানোর পরিকল্পনা শুরু করে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের মোট জ্বালানির প্রায় ৮০ শতাংশ যাতায়াত করে। এমতাবস্থায় মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করাটা চীনের জাতীয় স্বার্থের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটির একটি হয়ে পড়ে। চীনারা মালাক্কাকে বাইপাস করে ভারত মহাসাগরে পৌঁছাবার চেষ্টা করতে থাকে। সেই লক্ষ্যে চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত স্থলভাগের উপর দিয়ে রুটগুলিকে চীনারা ডেভেলপ করা শুরু করে। মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে সেখান থেকে মিয়ানমারের মাঝ দিয়ে তেল এবং গ্যাসের পাইপলাইন চীনের কুনমিং পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানের গোয়াদরে আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে সেখান থেকে একটি ব্যয়বহুল ইকনমিক করিডোর তৈরি করে সেটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত নিয়ে যাবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে আসা জাহাজগুলি যেহেতু বেশিরভাগই শ্রীলংকা হয়ে যায়, তাই চীনারা শ্রীলংকাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। আর যেহেতু মালাক্কা আটকে দেয়ার হুমকিতে ভারত মহাসাগরে চীনাদের আবির্ভাব হয়েছে, তাই ভারত স্বভাবতই চীনকে হুমকিস্বরূপ নেবে। এই হিসেবে ভারত চীনকে ঠেকাতে স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে আসে

তাহলে এখানে বাংলাদেশের ভূমিকা কোথায়? বঙ্গোপসাগরে চীনারা যা-ই চেষ্টা করুক না কেন, সেখানে ভারতের অবস্থানের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী দেশ না থাকলে ভারত চীনের এই পরিকল্পনাকে চ্যালেঞ্জ করবে খুব সহজেই। আর চীনারা অতদূর থেকে ভারত মহাসাগরে এসে এই জ্বালানি রুটের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবে না। তাই চীনারা চায় বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে আরেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাব হোক। সেই রাষ্ট্র সরাসরি চীনের পক্ষে না থাকলেও যেহেতু ভারত (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে) তার প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হতে দেবে না, তাই অটোমেটিকভাবে সেই রাষ্ট্র ভারতের শত্রুতে পরিণত হবে। চীন যেহেতু শুধু অর্থনৈতিক শক্তি (আদর্শিক শক্তি নয়), তাই চীনারা ভারত মহাসাগরে নতুন শক্তির সাথে সংঘাত এড়িয়ে চলবে, কারণ সেই শক্তি চীনের অতি দরকারী জ্বালানি এবং খণিজের নিয়ন্ত্রক হবে।



  
গত ১৫-২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেটা কেউই খেয়াল করেনি। দেড় দশকে এই দেশের অর্থনীতি প্রায় চার গুণ হয়ে গিয়েছে! চীন এবং ভারতের উত্থানের তুলনায় ছোট বলে বেশিরভাগ বিশ্লেষকের চোখে পড়েনি বাংলাদেশ। আবার অনেকেই ভূরাজনৈতিক জ্ঞান না রাখায় এই এলাকায় কোন নতুন অর্থনৈতিক শক্তির আবির্ভাবকে খেয়াল করেনি।



তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক উত্থান

গত ১৫-২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেটা কেউই খেয়াল করেনি। দেড় দশকে এই দেশের অর্থনীতি প্রায় চার গুণ হয়ে গিয়েছে! চীন এবং ভারতের উত্থানের তুলনায় ছোট বলে বেশিরভাগ বিশ্লেষকের চোখে পড়েনি বাংলাদেশ। আবার অনেকেই ভূরাজনৈতিক জ্ঞান না রাখায় এই এলাকায় কোন নতুন অর্থনৈতিক শক্তির আবির্ভাবকে খেয়াল করেনি। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে গত বছর পাঁচেক ধরে। অনেকেই খেয়াল করা শুরু করেছে যে যখন বিশ্বের অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তিগুলি ডাবল ডিজিটে এগুচ্ছিল, তখন যেমন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ, আবার যখন বিশ্বজুড়ে মন্দা শুরু হলো, তখনও এই দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই দৃঢ়তা পশ্চিমাদের বিচলিত করে এবং এরপর থেকেই হিসেব-নিকেশ শুরু হয়ে যায় – কি করে দেশটিকে আটকানো যায়উপরোল্লিখিত কারণগুলির সাথে অর্থনৈতিক উত্থান যোগ হলে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বঙ্গোপসাগরে একটি আঞ্চলিক শক্তির আবির্ভাব হতে পারে। Subversion-এর মাধ্যমে এই দেশটিকে দুর্বল করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই চলছিল। তবে সেটা এখন নতুন মাত্রা নেয় যখন সেখানে “সন্ত্রাসবাদ” শব্দটি যুক্ত করা হয়

  
ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বব্যাপী রাজত্বের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইসলামকেই দেখতে শুরু করে। মার্কিন চিন্তাবিদেরা তাই খোলাখুলিই বলতে থাকেন যে মুসলিম দেশগুলির সামরিক শক্তি কর্তন করা হোক। ৯/১১-এর পর থেকে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবতারণা করে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের সকল দেশে সংঘাতের সূচনা করে। লক্ষ্য – কোন শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র তৈরিতে বাধা দেয়া, যা কিনা মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শকে প্রতিস্থাপন করে বর্তমান Global Order-কেই পরিবর্তন করতে পারে। সে হিসেবে মুসলিম বিশ্বের জনবহুল, অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ভূকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পরিণত হয়।



চতুর্থতঃ আদর্শিক সংঘাত

ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বব্যাপী রাজত্বের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইসলামকেই দেখতে শুরু করে। মার্কিন চিন্তাবিদেরা তাই খোলাখুলিই বলতে থাকেন যে মুসলিম দেশগুলির সামরিক শক্তি কর্তন করা হোক। ৯/১১-এর পর থেকে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবতারণা করে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের সকল দেশে সংঘাতের সূচনা করে। লক্ষ্য – কোন শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র তৈরিতে বাধা দেয়া, যা কিনা মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শকে প্রতিস্থাপন করে বর্তমান Global Order-কেই পরিবর্তন করতে পারে। সে হিসেবে মুসলিম বিশ্বের জনবহুল, অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ভূকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পরিণত হয়১৬ কোটি জনসংখ্যা, ২২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, বঙ্গোপসাগরে ভূকৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান, এবং ভূরাজনৈতিক কারণে চীনের কাছে গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া – এসব কারণে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির একটিতে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে আটকাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সমর্থন দেয়া, মিয়ানমারকে মুসলিম-বিদ্বেষী করা, সন্ত্রাসবাদের নাম করে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে হস্তক্ষেপ, ইত্যাদি নীতি নিতে থাকে।

উপরের সবগুলি কারণ একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রথম কারণটি সর্বদাই ছিল, যা ব্রিটিশরা বুঝেছিল এবং সে বুঝে দেশ ভাগ করেছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কারণগুলি গত দুই দশকের মাঝে সৃষ্ট, যা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত গড়তে সহায়তা করছে। আর চতুর্থটি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে যে মুহুর্ত থেকে এখানে ইসলাম এসেছে, অর্থাৎ ১২০৬ সাল থেকে। শেষ এই কারণটি বাকি সবগুলির মালিকানা নিয়ে নেয়, কেননা প্রথম তিনটি কারণ কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে শুধুমাত্র আঞ্চলিক একটি শক্তি তৈরি করতে সক্ষম; কিন্তু চতুর্থটি একটি পরাশক্তির জন্ম দিতে সক্ষম। একুশ শতকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যখন “ট্রাম্প কার্ড” ফুরিয়ে যাচ্ছে, তখন বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের উত্থান সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক উপাখ্যানের একটি।

Tuesday 17 January 2017

দ্বীপ নিয়ে বিতর্কে ইতিহাসের বাস মিস করছে মিশরীয়রা

১৭ই জানুয়ারী ২০১৭
দ্বীপের ‘সার্বভৌমত্ব’ নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়ে মিশরীয়রা যেভাবে ইতিহাসের বাস মিস করছে...
১৯৮২ সাল থেকে দ্বীপদু’টি মিশরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ইস্রাইলকে চটানোর ভয়ে মিশরের শাসকগোষ্ঠী দ্বীপদু’টি নিয়ে কোন পরিকল্পনা থেকে দূরে থাকে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে সৌদি বাদশা সালমান মিশরে গেলে এই সেতু তৈরি নিয়ে আবারও কথা শুধু হয়। তবে এবারে মিশরের সামরিক শাসক আল-সিসি অন্য কান্ড করে বসেন। তিনি দ্বীপদু’খানা সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। সাথে সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যায় সেতু নয়, বরং দ্বীপের ‘সার্বভৌমত্ব’। মিশরের জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি যে এই সেতু আসলে মিশরের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯৮৬ সালের নভেম্বরে সৌদি আরব এবং বাহরাইনের মাঝে পারস্য উপসাগরের মাঝ দিয়ে ২৫ কিঃমিঃ লম্বা ‘কিং ফাহদ কজওয়ে’ বা বাদশা ফাহদ সেতু জনসাধারণের জন্যে খুলে দেয়া হয়। মোটামুটি সব পত্রিকাতেই রিপোর্ট করা হয় যে এই সেতুর মাধ্যমে দু’দেশের মাঝে ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে এবং দু’দেশের অর্থনীতিতে এই সেতু বড় একটি ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন পঁচিশ হাজার গাড়ি এবং পঞ্চাশ হাজার মানুষ যাতায়াত করে, যা কিনা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেটা পত্রিকাগুলি বলতে অক্ষম ছিল তা হলো, এই সেতুটি তৈরি করা হয়েছিল যাতে জরুরি প্রয়োজনে বাহরাইনের রাজবংশকে সুরক্ষা দিতে সৌদি সরকার সৈন্য পাঠাতে পারে। সেতুটি ছিল এই অঞ্চলে সৌদি-সমর্থিত সরকারগুলিকে টিকিয়ে রাখার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। সেতু চালু করার পঁচিশ বছর পর ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সৌদি আরব সরকার বাহারাইনে সৈন্য পাঠায়। সেতু ব্যবহার করে দু’শ গাড়িসহ হাজার খানেক সৈন্য ঝড়ের গতিতে বাহরাইন পৌঁছে যায়। এই সেতুর কথাটি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, কারণ ঠিক এমনই আরেকটি প্রকল্প এখন সাধারণ জনগণের আলোচনার পিছনে অবস্থান করছে।

মিশর এবং সৌদি আরবের মাঝে দু’টি ছোট দ্বীপের হস্তান্তর নিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। ‘তিরান’ এবং ‘সানাফির’ নামের ছোট্ট দ্বীপ দু’টি সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তর করা হবে কি হবে না, সেটা হয়ে দাঁড়ায় পত্রিকার হেডলাইন। কিন্তু যে ব্যাপারে কেউ কথা বলছে না তা হলো এই দু’টি দ্বীপের উপর দিয়ে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ এবং সৌদি আরবের তাবুকের মাঝে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি করতে ২৩ কিঃমিঃ লম্বা একটি সেতু বানাবার কথা চলছে বহুদিন ধরে, যা কিনা এখন থমকে গেল। ১৯৮৮ সালে এই সেতু তৈরির চেষ্টা শুরু হয়। জানা যায় যে ২০০০ সালের পর কোন এক সময় ইস্রাইলের হস্তক্ষেপে এই সেতু বানাবার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যাবে যে এই সেতু আকাবা উপসাগরের মুখে তিরান প্রণালীর উপর তৈরি হবে। প্রকৃতপক্ষে ঐ দ্বীপদু’টি আকাবা উপসাগরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রক। আকাবা উপসাগরের গোড়ায় রয়েছে দু’টি দেশের দু’টি সমুদ্র বন্দর – ইস্রাইলের এইলাট এবং জর্ডানের আকাবা। ১৯৬৭ সালে ইস্রাইল যখন সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়, তখন এই দ্বীপদু’টিও ইস্রাইলের হাতে চলে যায়। টানা পনর বছর দখলে রেখে ১৯৮২ সালে দ্বীপদু’টি মিশরের কাছে ফেরত দেয় ইস্রাইল। এর পর থেকে দ্বীপ দু’টি মিশরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ইস্রাইলকে চটানোর ভয়ে মিশরের শাসকগোষ্ঠী দ্বীপদু’টি নিয়ে কোন পরিকল্পনা থেকে দূরে থাকে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে সৌদি বাদশা সালমান মিশরে গেলে এই সেতু তৈরি নিয়ে আবারও কথা শুধু হয়। তবে এবারে মিশরের সামরিক শাসক আল-সিসি অন্য কান্ড করে বসেন। তিনি দ্বীপদু’খানা সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। সাথে সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যায় সেতু নয়, বরং দ্বীপের ‘সার্বভৌমত্ব’। মিশরের জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি যে এই সেতু আসলে মিশরের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ইস্রাইল এবং জর্ডান উভয় দেশকেই লোহিত সাগরে একটি করে সমুদ্রবন্দর দেয়া হয় (এইলাট এবং আকাবা)। এই সমুদ্রবন্দরদু’টি হলো এই মানচিত্রের উদ্ভটতার মূল। এর মাধ্যমে মিশর এবং আরব উপদ্বীপের মাঝে দু’টি নতুন দেশের আবির্ভাব হয়। কাজেই মিশরের সরকার যদি পশ্চিমাদের তৈরি করা আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি মেনে চলে, তাহলে আরবের মাটিতে সৈন্য পাঠাতে মিশরের ইস্রাইল এবং জর্ডানের কাছ থেকে “অনুমতি” নিতে হবে। অর্থাৎ যদি ইসলামের পবিত্র ভূমি মক্কা এবং মদিনা কখনো শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মিশর স্থলপথে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হবে না, যদি না ইস্রাইল “অনুমতি” দেয়!

দ্বীপের রাজনীতি যেভাবে শুরু হলো...

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই দ্বীপগুলির আদৌ কোন গুরুত্ব ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ-ফরাসীদের হাতে উথমানিয়া খিলাফতের পতনের পর এখানে উদ্ভট পদ্ধতিতে কতগুলি দেশ তৈরি করা হয়, যার একটি ছিল জর্ডান, যা থেকে কেটে প্যালেস্টাইন তৈরি হয়া, যা কিনা আবার পরবর্তীতে ইহুদী রাষ্ট্র ইস্রাইল হিসেবে পশ্চিমাদের স্বীকৃতি পায়। এই ইস্রাইলের সীমানা তৈরি করতে গিয়েই যত সমস্যা তৈরি করা হয়। ইস্রাইলের পূর্বে থাকে দুর্বল রাষ্ট্র জর্ডান, যা কিনা ইস্রাইল এবং ইরাকের মাঝে ‘বাফার’ তৈরি করে। ইস্রাইল এবং জর্ডান উভয় দেশকেই লোহিত সাগরে একটি করে সমুদ্রবন্দর দেয়া হয় (এইলাট এবং আকাবা)। এই সমুদ্রবন্দরদু’টি হলো এই মানচিত্রের উদ্ভটতার মূল। এর মাধ্যমে মিশর এবং আরব উপদ্বীপের মাঝে দু’টি নতুন দেশের আবির্ভাব হয়। কাজেই মিশরের সরকার যদি পশ্চিমাদের তৈরি করা আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি মেনে চলে, তাহলে আরবের মাটিতে সৈন্য পাঠাতে মিশরের ইস্রাইল এবং জর্ডানের কাছ থেকে “অনুমতি” নিতে হবে। অর্থাৎ যদি ইসলামের পবিত্র ভূমি মক্কা এবং মদিনা কখনো শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মিশর স্থলপথে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হবে না, যদি না ইস্রাইল “অনুমতি” দেয়!

১৯৯১ সালে ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেন স্বেচ্ছায় ইরাকের বিশাল সামরিক বাহিনীকে পশ্চিমাদের হাতে ধ্বংস করান। ফলে উত্তর দিক থেকে আরব উপদ্বীপকে রক্ষা করার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার সামরিক শক্তি ধ্বংস হবার ফলে সিরিয়া থেকেও আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। সিরিয়া ও ইরাকের উত্তরে তুরস্ক আরব উপদ্বীপ থেকে বেশ দূরেই। পাকিস্তান এবং বাকি মুসলিম দেশগুলি তো আরও দূরে। বাকি থাকে শুধুমাত্র মিশর। আরব উপদ্বীপের সবচাইতে কাছের হলেও মিশর এবং সৌদি আরবের মাঝে রয়েছে লোহিত সাগর; আর স্থলপথে যাবার পথটি তো ব্রিটিশরা ইস্রাইলের হাতে তুলেই দিয়েছে। এমতাবস্থায় আকাবা উপসাগরের মুখে তিরান প্রণালীর উপর দিয়ে প্রস্তাবিত সেই সেতুটি মিশরের হাতে এমন একটি ক্ষমতা দিত, যার মাধ্যমে মিশর আরব উপদ্বীপের রক্ষাকর্তারূপে আবির্ভূত হতো। বর্তমানে আরব উপদ্বীপে মিশরের সামরিক হস্তক্ষেপের পদ্ধতিগুলি মোটামুটি কঠিন – সমুদ্রপথে এবং বিমান বন্দরের মাধ্যমে সৈন্য অবতরণ। আরব উপদ্বীপের পুরোটাই মরুভূমি হওয়ায় সেখানে ভারি আর্মার্ড ফর্মেশনের দরকার হবে, যেকারণে সমুদ্র এবং বিমানপথে সৈন্য পাঠাতে সময় অনেক বেশি লাগবে; লজিস্টিক্যাল সমস্যা অনেক বেশি হবে।
বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের (Intellectual Bankruptcy) মাঝে এই দেশগুলি যে নিজেদের তথাকথিত ‘আলাদা’ সত্ত্বাকেই বেশি তুলে ধরবে, সেটাই স্বাভাবিক। ইস্রাইলকে না ক্ষেপানোটাই তাদের কাছে যখন হয় মূল লক্ষ্য, তখন ইসলামের পবিত্রভূমির নিরাপত্তা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে – এটা চিন্তা করাটাই তো অর্থহীন। সিরিয়ার যুদ্ধে পাঁচ লক্ষাধিক মুসলিমের মৃত্যুও যেখানে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়নি, সেখানে আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তা দেবার চিন্তাটা তাদের মস্তিষ্কে আদৌ গুরুত্ব পাবে কেন? আরব উপদ্বীপ থেকে মিশরীয়দের দূরে রাখতে শুধুমাত্র মিশরীয়দের জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেয়াটাই যথেষ্ট ছিল। ছোট্ট দু’টি দ্বীপের জন্যে তারা পুরো আরব উপদ্বীপের রক্ষাকর্তা হবার সন্মানটি হারাচ্ছে। মিশরীয়রা জাতীয়তাবাদের উপরে ভর করে ১৯১৮ সালে ব্রিটিশদের তৈরি সীমানাকেই পবিত্রজ্ঞান করে ইতিহাসের বাস মিস করছে।

 
বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব ও দাসত্ববরণ

দ্বীপ নিয়ে মামলা করে মিশরের জাতীয়তাবাদীরা ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাতকে শক্তিশালী করেছে। দ্বীপ কার হবে সেটা আদৌ কোন বিষয় নয়, যখন দ্বীপের উপর দিয়ে প্রস্তাবিত সেতু তৈরিই হবে মিশরের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য প্রার্থনার জন্যে। মিশরের জাতীয়তাবাদীরা জাতীয়তার নামে আরব উপদ্বীপের রক্ষাকর্তা হবার আসনটি ইস্রাইলের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সৌদি রাজবংশ এখন এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। বাদশাহ সালমান তার ভাইদের মাঝে শেষজন। এর পর ক্রাউন প্রিন্স হলেন তার ভাতিজা, যেখানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সালমানের নিজের ছেলেই বর্তমান সরকারের সবচাইতে শক্তিশালী ব্যক্তিদের একজন। সালমানের বয়স আশি পার হয়েছে এবং তার পরবর্তীকালে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব হবে কিনা, সেটা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। সৌদি রাজবংশে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আশেপাশের শক্তিরা কে কি করবে সেটা দেখার বিষয় হবে। তিরান প্রণালীর উপর দিয়ে সেতু তৈরি হোক আর না হোক, সেরকম কোন সম্ভাব্য বিশৃংখলার মাঝে মিশরের ভূমিকা হয়ে দাঁড়াবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ফ্রান্স থেকে কেনা ‘মিস্ত্রাল’-ক্লাসের উভচর অপারেশনের জাহাজদু’টি (যা কিনা রাশিয়ার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল) এব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সম্ভাব্য বিশৃংখলার মাঝে আরব উপদ্বীপে শক্তি নিয়ে যারা অবতরণ করবে, আরবের ছোট সামরিক শক্তিগুলি (সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত-এর ছোট্ট সামরিক বাহিনীগুলি) তাদের দিকেই ভিড়তে থাকবে। বিশেষ করে মক্কা ও মদিনার নিরাপত্তা যাদের হাতে থাকবে, তারাই হবে নিয়ন্ত্রক।

বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের (Intellectual Bankruptcy) মাঝে এই দেশগুলি যে নিজেদের তথাকথিত ‘আলাদা’ সত্ত্বাকেই বেশি তুলে ধরবে, সেটাই স্বাভাবিক। ইস্রাইলকে না ক্ষেপানোটাই তাদের কাছে যখন হয় মূল লক্ষ্য, তখন ইসলামের পবিত্রভূমির নিরাপত্তা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে – এটা চিন্তা করাটাই তো অর্থহীন। সিরিয়ার যুদ্ধে পাঁচ লক্ষাধিক মুসলিমের মৃত্যুও যেখানে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়নি, সেখানে আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তা দেবার চিন্তাটা তাদের মস্তিষ্কে আদৌ গুরুত্ব পাবে কেন? আরব উপদ্বীপ থেকে মিশরীয়দের দূরে রাখতে শুধুমাত্র মিশরীয়দের জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেয়াটাই যথেষ্ট ছিল। ছোট্ট দু’টি দ্বীপের জন্যে তারা পুরো আরব উপদ্বীপের রক্ষাকর্তা হবার সন্মানটি হারাচ্ছে। এখনও সেটা পুরোপুরি হারায়নি, তবে সেতুটি না হলে কাজটা বেশ কঠিন হবে বৈকি। এই দেশগুলির লক্ষ্য কোন চিন্তার উপরে ভিত্তি করে নয়; যে চিন্তা তারা হয়তো প্রতিষ্ঠা, রক্ষা এবং প্রচার করতো। আদর্শের অনুসারী নয়, বরং নিজেদেরকে মার্কিনীদের ভৃত্য হিসেবে দেখতেই আজকের আরব নেতৃত্ব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তদুপরি এটা বলা যায় যে যেসময়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার নিয়ন্ত্রক হিসেবে মিশরের আবির্ভাব হবার কথা, সেসময় মিশরীয়রা জাতীয়তাবাদের উপরে ভর করে ১৯১৮ সালে ব্রিটিশদের তৈরি সীমানাকেই পবিত্রজ্ঞান করে ইতিহাসের বাস মিস করছে।

Sunday 8 January 2017

স্বর্ণদ্বীপ মহড়া কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নে কতটুকু সক্ষম?

০৯ জানুয়ারী ২০১৭

 
স্বর্ণদ্বীপে সেনাবাহিনীর যে মহড়া বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তবে স্বর্ণদ্বীপের মহড়া বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে সত্যিকার কোন মেসেজ দিতে সক্ষম হচ্ছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখাটা জরুরি। একটি বহিঃশত্রু কি করে এমন একটি দ্বীপ দখল করে নিল এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সেটা হতে দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। আবার শত্রুর হাতে থাকা একটি দ্বীপে কি করে নৌবাহিনী একটি উভচর অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীকে নামাতে সক্ষম হলো, সেটাও প্রশ্নাতীত নয়।


স্বর্ণদ্বীপে সেনাবাহিনীর যে মহড়া অনুষ্ঠিত হলো, তা নিয়ে প্রশংসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো আর কেউ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। তবে একটি প্রশংসাকে ভবিষ্যতে আরও প্রশংসায় রূপ দিতে গঠনমূলক সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। স্বর্ণদ্বীপ এক্সারসাইজের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি মিডিয়াতে তেমন একটা আসেনি। বগুড়ার ১১ ডিভিশনের ৯৩ আর্মার্ড ব্রিগেড এই এক্সারসাইজে নেতৃত্ব দেয়। এধরণের একটি ইউনিটকে বঙ্গোপসাগরের মাঝের একটি দ্বীপে মোতায়েন করাটা একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। তবে ঠিক যেভাবে এটি একটি অর্জন, ঠিক সেভাবেই এটি একটি চ্যালেঞ্জ, যা কিনা আলোচিত হয়নি। একটি বহিঃশত্রু কি করে এমন একটি দ্বীপ দখল করে নিল এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সেটা হতে দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। আবার শত্রুর হাতে থাকা একটি দ্বীপে কি করে নৌবাহিনী একটি উভচর অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীকে নামাতে সক্ষম হলো, সেটাও প্রশ্নাতীত নয়। যদি শত্রুপক্ষ এতটাই শক্তিশালী হয় যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীকে এড়িয়ে তারা দ্বীপ দখল করে নিতে সক্ষম, তাহলে সেই একই শক্তিশালী শত্রুকে এড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সেই দ্বীপে কি করে নামানো গেল? আসল কথাটি হলো, সক্ষমতা কতটুকু হয়েছে তা নির্ভর করছে সত্যিকার সংঘাতের সময় সামরিক বাহিনী কতটুকু সফল হবে। স্বর্ণদ্বীপের মহড়া বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে সত্যিকার কোন মেসেজ দিতে সক্ষম হচ্ছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
 
বঙ্গোপসাগরের মাঝে যদি বাংলাদেশের কোন কোম্পানি গ্যাস রিগ বসাতে যায়, তাহলে নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী কি সেটার নিরাপত্তা দিতে সক্ষম? বঙ্গোপসাগরের মাঝে মূল ভূখন্ড থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দূরে এরকম একটি রিগের নিরাপত্তা দেয়াটা সেজায়গায় আরেকটি স্বর্ণদ্বীপের নিরাপত্তা দেয়ার শামিল হবে।

মহড়ায় দখলকৃত দ্বীপের উপর বিমান এবং ড্রোন সার্ভেইল্যান্সের কথা বলা হয়। কিন্তু সেই সার্ভেইল্যান্স কি বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধনশীল দ্বীপমালার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম? যদি দ্বীপমালার নিরাপত্তা দেয়াটা কঠিন হয়ে থাকে, তবে গভীর সমুদ্রের সম্পদের নিরাপত্তা কি করে দেয়া সম্ভব? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অবঃ) খোরশেদ আলম চমৎকার একটি কথা বলেছেন গভীর সমুদ্রের সম্পদ সম্পর্কে। তিনি বলেছেন যে গভীর সমুদ্রের মূল্যবান এই সম্পদকে বিদেশীদের হাতে দেয়া যায় না, কারণ তারা এব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে তাঁর এই মূল্যবান মতামতকে সামনে এগিয়ে নিতে গেলে বলতে হবে যে বঙ্গোপসাগরের মাঝে যদি বাংলাদেশের কোন কোম্পানি গ্যাস রিগ বসাতে যায়, তাহলে নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী কি সেটার নিরাপত্তা দিতে সক্ষম? বঙ্গোপসাগরের মাঝে মূল ভূখন্ড থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দূরে এরকম একটি রিগের নিরাপত্তা দেয়াটা সেজায়গায় আরেকটি স্বর্ণদ্বীপের নিরাপত্তা দেয়ার শামিল হবে।
ভবিষ্যতের আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরেশন কর্মকান্ডে যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে, সেটার নিরাপত্তা নৌবাহিনী দিতে সক্ষম কিনা? আরও ভেঙ্গে বলতে গেলে, গভীর সমুদ্রে শত্রু সাবমেরিনের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর জাহাজগুলিকে গভীর সমুদ্রের এহেন কর্মকান্ডকে রক্ষা করতে যতটুকু Air Asset বহণ করতে হবে, সেটা নৌবাহিনীর বর্তমানে আছে কি?

এডমিরাল খোরশেদ আলম আরও বলেছিলেন যে বাংলাদেশের সাবমেরিনগুলি গভীর সমুদ্র এক্সপ্লোর করার জন্যে দেশকে প্রস্তুত করবে। খুব ভালো কথা বলেছেন তিনি। তাহলে প্রশ্ন থাকবে যে ভবিষ্যতের আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরেশন কর্মকান্ডে যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে, সেটার নিরাপত্তা নৌবাহিনী দিতে সক্ষম কিনা? আরও ভেঙ্গে বলতে গেলে, গভীর সমুদ্রে এন্টি সাবমেরিন নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতা নৌবাহিনীর কতটুকু আছে? এন্টি-সারফেস সক্ষমতাই বা কতটুকু আছে, যেখানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ শক্তি হলো ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান? নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ সার্ভেইল্যান্স ক্ষমতাই বা কতটুকু, যখন ডরনিয়ার বিমানগুলির পাল্লা বঙ্গোপসাগরের বিশালতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল?

আলোচনার সারসংক্ষেপে বলা যায় যে বাংলাদেশের নৌশক্তি এবং বিমানশক্তির উপরে নির্ভর করছে যে ভবিষ্যতে স্বর্ণদ্বীপের মতো একটি দ্বীপকে সত্যিকার অর্থেই দখলমুক্ত রাখা সম্ভব কিনা। এই সক্ষমতাকে কয়েকটি বিষয়ে ভাগ করে ব্যাখ্যা করা যায় -

১। বাংলাদেশের নতুন আনা সাবমেরিনগুলি শত্রু সাবমেরিনের বিরুদ্ধে গভীর সমুদ্রের এক্সপ্লোরেশন কর্মকান্ডের নিরাপত্তা দিতে যথেষ্ট সক্ষম কিনা। যদি সক্ষম না হয়, তাহলে কত সময় পর্যন্ত নিরাপত্তার অভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ডীপ সি এক্সপ্লোরেশন বসে থাকবে?

২। শত্রু সাবমেরিনের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর জাহাজগুলিকে গভীর সমুদ্রের এহেন কর্মকান্ডকে রক্ষা করতে যতটুকু Air Asset বহণ করতে হবে, সেটা নৌবাহিনীর বর্তমানে আছে কিনা। যদি না থাকে, তবে কি ধরনের জাহাজ এই দুর্বলতাকে দূর করতে পারে, সেটা খুঁজে দেখতে হবে।
 
বঙ্গোপসাগরের উপর বাংলাদেশের এন্টি-সারফেস সক্ষমতা কতটুকু আছে, যেখানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ শক্তি হলো ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান? নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ সার্ভেইল্যান্স ক্ষমতাই বা কতটুকু, যখন ডরনিয়ার বিমানগুলির পাল্লা বঙ্গোপসাগরের বিশালতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল? বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পুরো বঙ্গোপসাগরের উপরে কর্তৃত্ব করতে যদি সক্ষম না হয়, তাহলে পুরো বঙ্গোপসাগরের উপর Combat Air Patrol (CAP) টহল দেবার মতো রেঞ্জের বিমান কেনাটা প্রক্রিয়ার মাঝে আছে কি?

৩। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পুরো বঙ্গোপসাগরের উপরে কর্তৃত্ব করতে সক্ষম কিনা। যদি সক্ষম না হয়, তাহলে পুরো বঙ্গোপসাগরের উপর Combat Air Patrol (CAP) টহল দেবার মতো রেঞ্জের বিমান কেনাটা প্রক্রিয়ার মাঝে আছে কিনা।

৪। আর সবশেষে শত্রুর কোন ফ্লীট যাতে বাংলাদেশের উপকূলের কাছে বা দূরের কোন দ্বীপকে দখল করতে না আসে, সেরকম কোন Strategic Deterrent বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পেরেছে কিনা। যেটা পরিষ্কার তা হলো টাইপ-০৩৫জি সাবমেরিন সেটা করতে সক্ষম নয়। টাইপ-০৩৫জি-এর পরের সাবমেরিনগুলিতে টর্পেডো টিউব ছাড়া কোন মিসাইল ডেলিভারি সিস্টেম থাকবে কিনা, সেটা এধরনের একটি ডিটারেন্টের প্রশ্নের উত্তর হতে পারে।
 
শত্রুর কোন ফ্লীট যাতে বাংলাদেশের উপকূলের কাছে বা দূরের কোন দ্বীপকে দখল করতে না আসে, সেরকম কোন Strategic Deterrent বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পেরেছে কি? যেটা পরিষ্কার তা হলো টাইপ-০৩৫জি সাবমেরিন সেটা করতে সক্ষম নয়। টাইপ-০৩৫জি-এর পরের সাবমেরিনগুলিতে টর্পেডো টিউব ছাড়া কোন মিসাইল ডেলিভারি সিস্টেম থাকবে কিনা, সেটা ডিটারেন্ট তৈরির প্রশ্নের উত্তর হতে পারে।

উপসংহারে বলা যায় যে বাংলাদেশের নৌ এবং বিমান বাহিনীর গভীর সমুদ্রে নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতা এখনও অপ্রতুল। কিছু হার্ডওয়্যার ক্রয়ই এই সক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয়। এমতাবস্থায় উপকূলের কাছাকাছি মহড়া যতটাই দৃষ্টিনন্দন হোক না কেন, সেটা বহিঃশত্রুকে আক্রমণ করা থেকে দূরে রাখতে সক্ষম নয়। সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর গভীর সাগরে অপারেশনের অভিজ্ঞতা বাড়াতে হবে, যা কিনা শুধুমাত্র Exclusive Economic Zone (EEZ) নামক চিন্তার মাঝে থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। সমুদ্রে Combat Air Patrol (CAP), আন্ডার-সী অপারেশন ও ডীপ-সী এক্সপ্লোরেশনের নিরাপত্তা, ডীপ-সী এয়ার অপারেশন, ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে বিশ্বের অনান্য সাগরগুলিতে নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে যৌথ মহড়াতে অংশ নেয়াতে হবে। আরব সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলকে এক্ষেত্রে অপশন হিসেবে দেখা যেতে পারে।

Thursday 5 January 2017

জ্বালানি সম্পদ যেভাবে বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি করবে

০৫ জানুয়ারী ২০১৭
গ্যস ফুরিয়ে যাচ্ছে; গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে - - এভাবে মাতম জুড়ে দিয়েছে অনেকে। তাহলে প্রশ্ন হলো আফ্রিকার যে দেশগুলিতে প্রাকৃতিক সম্পদের শেষ নেই, তারা কেন অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছে? আর প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই ব্রিটেন কিভাবে দু'শ বছর পৃথিবী শাসন করেছে? উত্তর হলো - প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা-না-থাকা একটি দেশকে শক্তিশালী করে না। সম্পদ ঠিক করে না যে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে কিনা; বরং শক্তিশালী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ঠিক করে যে সম্পদ নিয়ে সে কি করবে।


প্রাকৃতিক সম্পদ কি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে?

যে ব্যাপারটি মোটামুটি নিয়মিতভাবেই ‘খবর’ হিসেবে সামনে আসছে তা হলো বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে রান্না করা যাচ্ছে না। যে প্রশ্নটি বেশিরভাগ মানুষই করছে না তা হলো, ষোল কোটি মানুষের মাঝে কত কোটি আসলে গ্যাসের রান্নায় পেট ভরে। যা নিয়ে কেউ কথা বলছে না তা হলো দেশের নব্বই ভাগ মানুষ তো কোনোদিনই গ্যাসের রান্না খায়নি। তাহলে গুটিকয়েক মানুষের কথাকেই সারা দেশের মানুষের কথা বলে মিডিয়াতে প্রতিদিন জাবর কাটা হচ্ছে কেন? এর ফলস্বরূপ যা হচ্ছে তা হলো, মানুষ প্রতিনিয়ত চিন্তা করছে যে এদেশের গ্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না যে দেশের প্রতিটি মানুষই বিভিন্ন দ্রব্য খাচ্ছেন; যেকারণে তারা হলেন ভোক্তা। কিন্তু ভোক্তা তো তাদের পরিচয় নয়। এই মানুষগুলি তাদের জীবনে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। আর যখন তাদের চিন্তায় থাকে যে এদেশের গ্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন সেই চিন্তাটা তাদের অনান্য কাজ-কর্মেও প্রকাশ পায়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, গ্যাস যে ফুরিয়ে আসছে, সেটা নিয়ে মানুষ কথা বললে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো, গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে – এই বিষয়টি মাথায় থাকা মানে হলো বাংলাদেশের “সীমিত সম্পদ” ফুরিয়ে যাচ্ছে। যখন একজন মানুষ এই সম্পদ ফুরানোর চিন্তাকে অন্তরে নেবেন, তখন তার জীবনযাত্রাতেও সেটা প্রতিফলিত হবে। তিনি এই দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিছপা হবেন; নিজের সন্তানদের এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে আগ্রহ যোগাবেন না; দেশের ভালো কোনকিছু তাকে অনুপ্রাণিত করবে না। এই ব্যাপারগুলি হবে সেই “গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে” চিন্তার বাই-প্রডাক্ট। তাহলে কি কেউ গ্যাস নিয়ে চিন্তা করবে না?

মিডিয়াতে সীমিত সম্পদ নিয়ে চিন্তা করতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে। তার অর্থ হচ্ছে, সম্পদ যাদের সীমিত নয় বা অনেক বেশি আছে, তারা অনেক উন্নতি সাধন করেছে; ঠিক কিনা? তাহলে আফ্রিকার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো-কে আমরা কি বলবো? দুনিয়ার খুব কম খণিজই আছে যা সেখানে পাওয়া যায় না। দেশটিতে বর্তমানে বাংলাদেশের কয়েক হাজার শান্তিরক্ষী অবস্থান করছে। খণিজ সম্পদে ভরপুর জিম্বাবুয়েকে আমরা কি বলবো, যেখানে কাগজের টাকার মূল্য নিচে নামার রেকর্ড হয়েছে? সোনা-হীরক-ইউরেনিয়াম-প্লাটিনাম দিয়ে ভরা পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতেও আমাদের কয়েক হাজার শান্তিরক্ষী রয়েছে। এই প্রতিটি দেশের মানুষই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদই একটা জাতিকে উপরে তুলতে সক্ষম নয়। তবে তাহলে ব্রিটেনের কথা কোথায় স্থান পাবে? বিংশ শতকে নাহয় নর্থ সী-তে তেল পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ব্রিটেন তো এসব খণিজ ছাড়াই সারা দুনিয়ার মাতবর ছিল দু’শ বছর! তারা কি করে পারলো সেটা? এই আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা-না-থাকা একটি দেশকে শক্তিশালী করে না।

বাংলাদেশের গ্যাস শেষ হচ্ছে – এটা কোন চিন্তার কারণ হতে পারে না। এদেশের মানুষ তো দিব্যি আমদানি করা সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, পিঁয়াজ, আদা, রসুন, মসলা, ইত্যাদি খাচ্ছে। একবারও তো তারা চিন্তা করেনি যে এগুলির জন্যে বাংলাদেশ বাইরের উপরে নির্ভরশীল! একবারও কারও চিন্তার কারণ হয়নি যে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ জ্বালানি তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়! এদেশের সকল বিল্ডিং তৈরি হয়েছে আমদানি করা লোহা (রডের কাঁচামাল) আর সিমেন্টের ক্লিংকার (সিমেন্টের কাঁচামাল) থেকে। এগুলি নিয়ে তো কারুরই ঘুম হারাম হয়নি। তাহলে গ্যাস নিয়ে কেন এতো চিন্তা? আসলে “গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে” চিন্তাটা একুশ শতকে শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ার বিরোধী এক চিন্তা, যা কিনা “বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঠেকাও” মহলের গোপন কুঠুরি থেকে বের হয়েছে। সেই কুঠুরির টেলিফোন লাইনটা আটলান্টিকের ওপাড়ে সংযুক্ত। এই ফুসলানো চিন্তা থেকে দেশের মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।

এখন পরবর্তী প্রশ্ন আসে যে গ্যাস না থাকলে দেশ শক্তিশালী হবে কি করে? খুব সহজ প্রশ্ন; যার উত্তরও সহজ। চিন্তার উপরে ভিত্তি করে, যে চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা করা, রক্ষা করা এবং দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেয়াই একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এভাবেই দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে; করছে। তাদের চিন্তা আলাদা হতে পারে; সঠিক না-ও হতে পারে; তবে মূল কথা হলো সেগুলি শক্তিশালী চিন্তা, যা কিনা তাদেরকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে; প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্য নয়। সম্পদ ঠিক করে না যে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে কিনা; বরং শক্তিশালী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ঠিক করে যে সম্পদ নিয়ে সে কি করবে।
 
অফশোর সার্ভে কোম্পানি পোলারকাস-এর হাই-টেক সার্ভে জাহাজ 'পোলারকাস সামুর'। জাহাজটি তুরস্কের একটি কোম্পানির কাছে প্রযুক্তি, ক্রু ট্রেনিং, মেইনটেন্যান্স-সহ বিক্রি করে দেয়া হয়। তেলের বাজারে মন্দায় এরকম প্রযুক্তির অনেক হাতবদল হচ্ছে, যা কিনা অনেকের জন্যেই অফশোর ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্যে বিরাট সুযোগ করে দিচ্ছে। এই সুযোগ যে সবসময় আসবে না, তা মোটামুটিভাবে বলাই যায়।

বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী রাষ্ট্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে যেভাবে...

শক্তিশালী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কাজের মাঝ দিয়ে। গ্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে! তাহলে বাংলাদেশের শিল্পপতিরা কি এখন মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকবেন? নাকি তেলের বাজারে যখন সবকিছু বিনে পয়সায় বেচা-বিক্রি হচ্ছে তখন সুযোগ বুঝে প্রভাব বিস্তার করবেন? পশ্চিম আফ্রিকার অয়েলফিল্ডগুলিতে বিনিয়োগের অভাব এখন। অয়েলফিল্ড সার্ভিসিং কোম্পানিগুলি জনবল ছাটাই করছে। বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকজন চাকুরি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছেন। দামী হাই-টেক হার্ডওয়্যারগুলি কমদামে বিক্রি করে দিয়ে সম্পদ কমিয়ে কোনমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে কোম্পানিগুলি। মোজাম্বিক হতে পারে বাংলাদেশের কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির সরবরাহকারী। এখন কয়লাতে কেউই বিনিয়োগে উতসাহী নয়; অথচ সামনের দিনগুলিতে বাংলাদেশের দরকার হতে চলেছে কোটি কোটি টন কয়লা। একটা সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের পুরো জ্বালানি চিত্রকে পালটে দিতে পারে। বিশ্বের জ্বালানি সেক্টর তেলের মুল্যের অবনমনের কারণে কোনমতে বেঁচে আছে। এই সেক্টরের বিদেশী কোম্পানির উপরে বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? তার উপরে তেল-গ্যাস হচ্ছে কৌশলগত খণিজ, যার নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। রাষ্ট্র কখনোই তার নিজের লোক ছাড়া অন্য কাউকে এই সম্পদ হস্তান্তর করতে পারে না।
 
ভারতের ওএনজিসি-এর কর্মীরা কাজ শুরু করছেন একটে অফশোর গ্যাস রিগে। বঙ্গোপসাগরে এধরনের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি ভারতীয় কোম্পানিগুলি নিজেদের দখলে নিচ্ছে। বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ কি পারে না গোঁ ধরতে যে – বঙ্গোপসাগরের মাঝে গ্যাস রিগে সামিটের নাম বড় করে লেখা থাকবে? নাকি সেখানে তারা রিলায়েন্সের নাম দেখলেও মনে করবেন যে তাদের জীবনে আর কোন সফলতা চাওয়ার নেই, তাই তারা চোখ-কান বন্ধ করে থাকবেন? ক্যারিয়ারের শেষে এসে আদানি-টাটা-রিলায়েন্সদের কাছে মাথা নিচু করে দুনিয়া প্রস্থান করাটা “সফলতা”, নাকি বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরের মাঝে এবং আফ্রিকার মাটিতে নাম খোদাই করে বাঘের গর্জন দিয়ে প্রস্থান; কোনটা?

বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরকে শক্তিশালী ভিত্তি দেয়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ বারংবার পাওয়া সম্ভব নয়। বসে থেকে সময় নষ্ট করলে পরে পস্তাতে হবেই। বাংলাদেশের শিল্পপতিরা যারা সামনের দিকে দেখতে সক্ষম, তারা কি উপরের দিকেও দেখতে সক্ষম? মানুষ সারাজীবন বাঁচে না। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফলতা পেতে পেতে চুলে পাক ধরেনি – এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। যারা এখনও মনে করেন যে তাদের দেশকে এখনও কিছু দেবার রয়েছে, তারা কি সত্যিই দেখতে পাচ্ছেন যে যতদিন তারা দুনিয়াতে আছেন ততদিন তারা উপরের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন; নিচের দিকে তাকিয়ে নয়? উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ কি পারে না গোঁ ধরতে যে – বঙ্গোপসাগরের মাঝে গ্যাস রিগে সামিটের নাম বড় করে লেখা থাকবে? নাকি সেখানে তারা রিলায়েন্সের নাম দেখলেও মনে করবেন যে তাদের জীবনে আর কোন সফলতা চাওয়ার নেই, তাই তারা চোখ-কান বন্ধ করে থাকবেন? ক্যারিয়ারের শেষে এসে আদানি-টাটা-রিলায়েন্সদের কাছে মাথা নিচু করে দুনিয়া প্রস্থান করাটা “সফলতা”, নাকি বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরের মাঝে এবং আফ্রিকার মাটিতে নাম খোদাই করে বাঘের গর্জন দিয়ে প্রস্থান; কোনটা?

Monday 2 January 2017

মিডিয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ কেন “সেন্সর” করে?

০২ জানুয়ারী ২০১৭
বছরের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "আপনারা কয়েকটি দেশ ঘুরে ঐ কোন দেশ জিএসপি দিল না, স্যারদের কাছে ধর্ণা দিয়ে না বেড়িয়ে আপনি খুঁজে বেড়ান অন্য জায়গায়। অন্য মার্কেট খোঁজেন"। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলিকে বাংলাদেশের সকল মিডিয়া একভাবে দেখেনি। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলি থেকে "জিএসপি" কথাটা কেটে "সেন্সর" করেছেন।

খৃষ্টীয় নতুন বছরের প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, যা কিনা ২০১৭ সালের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা উদ্ভোধন করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলা তার মূল কথাগুলির ট্রান্সক্রিপ্ট এরূপ - “বেসরকারি খাতেরও যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। শুধু নিজেরা ব্যবসাবাণিজ্য করে... নিজেরা, মানে অর্থশালী সম্পদশালী হবেন আর বড়লোক হবেন – এই চিন্তা যেন না থাকে। মনে রাখতে হবে আপনাদেরকে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দিচ্ছি অর্থাৎ আমরা সরকার হিসেবে ফ্যাসিলেটরের দায়িত্ব পালন করছি। আপনাদের সেই সুযোগ নিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণ করতে হবে, দেশের মানুষের উন্নতি করতে হবে।...... আজকে যারা শিল্প কল-কারখানা গড়ে তুলবেন তাদের খেয়াল রাখতে হবে আমরা রফতানিকে গুরুত্ব দেই। আবার এটাও ভাবতে হবে আমার নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। নিজের দেশের মানুষের ক্রমক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমার দেশের মানুষের যদি আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে, আমার দেশের মানুষের যদি ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, তা আপনার পণ্যও বাজার পাবে, তারাও মানুষ ভালো থাকবে, আপনার শিল্পের প্রসার ঘটবে।......... বাংলাদেশের মানুষ তারা এত যোগ্য, তাদের মেধা এত ভালো একটু সুযোগ সৃষ্টি করলে যেকোন কিছু তারা উতপাদন করতে পারবে – সেই সক্ষমতা বাংলাদেশের মানুষের আছে। তাদের শুধু পথ দেখাতে হবে, ট্রেনিং দিতে হবে। এটাই... মানে, আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে আপনারা কয়েকটি দেশ ঘুরে ঐ কোন দেশ জিএসপি দিল না, স্যারদের কাছে ধর্ণা দিয়ে না বেড়িয়ে আপনি খুঁজে বেড়ান অন্য জায়গায়। অন্য মার্কেট খোঁজেন। ওরা আপনার পিছনে দৌড়াবে। কারণ আমাদের মতন... বাংলাদেশ যত পণ্য যত দ্রুত... মানে... সরবরাহ করতে পারবে, পৃথিবীর কোন দেশ তা পারবে না। কাজেই আমাদের ব্যবসায়ীদেরকেও সে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার খুঁজে ফেরা আর আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা প্রসারিত করা। ............ কোন দেশে কোন ধরণের জিনিসের চাহিদা, কি ধরনের চাহিদা – সেটাও একটি দেখা দরকার।...... একটা সেল আপনাদের থাকা উচিত যাদের কাজ হবে গবেষণা করা, পৃথিবী বিভিন্ন দেশে... কোন দেশে কোন ধরণের পণ্যের চাহিদা... কোন ধরণের... সেই ধরনের পণ্য উতপাদন করবার মতো যোগ্যতা আমাদের দেশের আছে কিনা। আমরা মানুষকে যেমন স্বপ্ন দেখাতে পারি, আবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নও করতে পারি, যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারি – সেই ক্ষমতা বাংলাদেশের মানুষের আছে”।
 
বেশিরভাগ পত্রিকাই তাদের খবরে প্রধানমন্ত্রীর উল্লেখ করা মূল তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছে। শুধুমাত্র হাতে গোণা কয়টি পত্রিকা ভিন্নভাবে এই খবরটি তুলে ধরেছে। দেশের সবচাইতে প্রভাবশালী এবং বেশি বিক্রিত দৈনিকগুলির একটি যখন ঐ একই পদ্ধতি অনুসরণ করে, তখন খবরের ধরণটি নিয়েও কথা বলাটা জরুরি হয়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে কে কিভাবে প্রচার করলো

এখানে প্রধানমন্ত্রীর পুরো ভাষণ দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই কথাগুলিকে মিডিয়া কিভাবে উপস্থাপন করেছে। মোটামুটি বেশিরভাগ মিডিয়াই প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলি থেকে নিয়েছে মোটামুটিভাবে কয়েকটি বিষয় – “জিএসপির পিছনে না ছুটে নতুন বাজার খোঁজা”, দেশের “মানুষের সক্ষমতা কাজে লাগানো”, এবং বক্তৃতার শেষের দিকে “চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যকে প্রডাক্ট অব দ্যা ইয়ার ঘোষণা”। তবে একটি হেডলাইন করলেও মোটামুটি সবাই তাদের খবরে এই মূল তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছে। শুধুমাত্র হাতে গোণা কয়টি পত্রিকা ভিন্নভাবে এই খবরটি তুলে ধরেছে। একটি পত্রিকা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে গুরুত্ব দেয়নি, কারণ তারা সরকারী দলের বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত। এটা তেমন আলাদা কিছু নয়; কারণ তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টি মোটামুটি সবাই জানেন। তবে দেশের সবচাইতে প্রভাবশালী এবং বেশি বিক্রিত দৈনিকগুলির একটি যখন ঐ একই পদ্ধতি অনুসরণ করে, তখন খবরের ধরণটি নিয়েও কথা বলাটা জরুরি হয়ে যায়। প্রভাবশালী ঐ পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলিকে এভাবে ছাপানো হয় –

“শেখ হাসিনা বলেন, গত সাড়ে চার দশকে চামড়া খাতে রপ্তানি প্রায় ৭১ গুণ বেড়েছে। প্রথম সারির বৈশ্বিক চামড়াজাত পণ্য এখন বাংলাদেশেই প্রস্তুত হয়। এ পণ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য সংযোজন সম্ভব হয়েছে। সরকার শুধু পোশাকশিল্পের মধ্যে রপ্তানি আয়কে সীমাবদ্ধ না রেখে রপ্তানি পণ্যের বাজার বহুমুখী করার ওপর গুরুত্বারোপ করছে। তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য বেসরকারি খাতকে আমরা উন্মুক্ত করে দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে যাঁরা শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলবেন, তাঁদের ভাবতে হবে আমার নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। নিজের দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে।’ ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোন দেশের কোন এলাকায় কোন পণ্যের চাহিদা বেশি এবং কোন পণ্যের উৎপাদন আমাদের দেশে সম্ভব, তা আপনাদের খুঁজে বের করতে হবে। সেই সঙ্গে সেই সব পণ্য আপনাদের উৎপাদন করে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, শুধু দেশে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আপনারা যেন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন, সেই সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল) ও বিসিআইএম-ইসির (বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর) ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কারণে দেশের শিল্পায়ন ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার রপ্তানিতে উৎসাহদানের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে কয়েকটি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে ২ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে”।
 
“জিএসপি” শব্দটি বেশিরভাগ মিডিয়াতেই হাইলাইট করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো এই প্রভাবশালী পত্রিকাটি “জিএসপি” শব্দটি উচ্চারণ করলো না কেন? প্রধানমন্ত্রী যে এই “স্যারদের” বলতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের বোঝাচ্ছেন সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। অর্থাৎ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে বলেছেন। এই কথা সেই প্রভাবশালী পত্রিকার পছন্দ হয়নি বলেই তারা নিজেদের মতো করে খবরটি প্রচার করেছে। 

প্রভাবশালী পত্রিকাটিতে যা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে

এই “সংবাদ”এ সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা ছিল একটি – “জিএসপি”, যা কিনা বেশিরভাগ মিডিয়াতেই হাইলাইট করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো এই পত্রিকাটি “জিএসপি” শব্দটি উচ্চারণ করলো না কেন? আবার, এই শব্দটি তো কোন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ও নয় যে বিরোধী দল ঘেঁষা পত্রিকাটিও এই শব্দটি তাদের রিপোর্ট থেকে বাদ দেবে। এই পত্রিকাগুলির এরকম “এডিটিং”-এর কারণ খুঁজতে হলে বুঝতে হবে যে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে “জিএসপি”-এর অর্থ কি? তিনি বলেছেন, “আপনারা কয়েকটি দেশ ঘুরে ঐ কোন দেশ জিএসপি দিল না, স্যারদের কাছে ধর্ণা দিয়ে না বেড়িয়ে আপনি খুঁজে বেড়ান অন্য জায়গায়”। এখানে তিনি এই “স্যারদের” বলতে যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের বোঝাচ্ছেন সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে বলেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের উপরে ব্যবসায়ীদের নির্ভরশীলতাকে বাড়াবার কথাও বলেছেন। কথাগুলিতে খুব পরিষ্কার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নের পিছনে পশ্চিমাদের অবদান রাখার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, সেটা এখন সবাইকে বুঝতে হবে। যে চামড়া পণ্যকে “প্রডাক্ট অব দ্যা ইয়ার” ঘোষণা করা হয়েছে, সেই চামড়া শিল্প বিরাট সমস্যায় পড়েছে ইতালির কারণে। ইতালি বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের সবচাইতে বড় ক্রেতা। অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে ইতালি দেশটাই এখন দেউলিয়া হবার পথে। ইতালি দেউলিয়া হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশেরও তা-ই হতে হবে – এমন কথার কোন যৌক্তিকতা নেই। সেসব দেশের উপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে সামনের দিনগুলিতে যে বিপদে ফেলতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো চামড়া শিল্প। এই শিল্পের সাথে বাংলাদেশের যত মানুষ জড়িয়ে আছে, তাদের কর্মসংস্থানকে বাঁচাতে সরকারকে বড় কিছু করতে হবে ২০১৭ সালে।
ইতালি বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের সবচাইতে বড় ক্রেতা। অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে ইতালি দেশটাই এখন দেউলিয়া হবার পথে। ইতালি দেউলিয়া হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশেরও তা-ই হতে হবে – এমন কথার কোন যৌক্তিকতা নেই। সেসব দেশের উপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে সামনের দিনগুলিতে যে বিপদে ফেলতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো চামড়া শিল্প।

এখানে উল্লেখ্য যে এই পত্রিকার এহেন “এডিটিং” কিন্তু নতুন নয়, নিয়মিত। উদাহরণস্বরূপ, তুর্কমেনিস্তানে প্রধানমন্ত্রীর বিমানের জরুরী অবতরণের পরে এ নিয়ে এক সংবাদ সন্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বাক্যগুলি উচ্চারণ করেন, সেখান থেকে কৌশলে একটিমাত্র বাক্য বাদ দিয়ে সংবাদটি প্রচার করা হয়। তারা শুধু ছাপায় যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটা একটা যান্ত্রিক দুর্যোগ ছিল। দুর্ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখন বেঁচে আছি, এটাই গুরুত্বপূর্ণ”। মাঝের কথাটি থাকলে অর্থ দাঁড়াতো যে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতভাবে জানেন না যে এটি মানবসৃষ্ট ছিল নাকি দুর্ঘটনা ছিল। তারা প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথা দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টায় ছিল যে এটি ছিল একটি দুর্ঘটনা মাত্র। অথচ এখন আমরা জানি যে বিমানের বেশ কয়েকজনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এখন তারা খবর প্রচার করছে যে বিমানের “অনিয়ম” ঐ ঘটনার জন্যে দায়ী, যার পেছনে রয়েছে “রাষ্টের অদক্ষতা”। প্রধানমন্ত্রীর কথা তারা “সেন্সর” করে পার পেতে পারলে অনান্য অফিশিয়ালদের ক্ষেত্রে তো সমস্যা থাকে না। যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী “থার্টি-ফার্স্ট” উদযাপনের সময়ে নিষেধাজ্ঞা উচ্চারণ করতে গিয়ে একসময় তিন বাক্যে তিনটি ব্যাপারকে নাকচ করে দেন। ঐ পত্রিকাটি মাঝের বাক্যটিকে বাদ দিয়ে প্রথম এবং তৃতীয় বাক্যটিকে ছাপায়। মাঝের বাক্যটিতে সকল মদের বার বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ শুধুমাত্র ঐ পত্রিকা যিনি পড়বেন, তিনি ঐ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে হয়তো অজ্ঞ থাকবেন।
 
প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলিতে ২০১৭ সালের জন্যে “টার্গেট” দেয়া হয়েছে! এই “টার্গেট” রাষ্ট্রের “টার্গেট”। এখানে কোন সরকারী-বিরোধী দলের তো কথা নেই। তাহলে কেন এখানে এই বিভেদ টানা হয়েছে ঐ পত্রিকাগুলির মাধ্যমে? উত্তর সহজ – ঐ পত্রিকাগুলির “টার্গেট” ভিন্ন। এই রাষ্ট্রের “টার্গেট” তাদের “টার্গেট” নয়। এই পত্রিকাগুলির জন্যে “রাষ্ট্র” আসলে এই রাষ্ট্র নয়, অন্য কোন রাষ্ট্র।

এই রাষ্ট্র আর তাদের রাষ্ট্র

“জিএসপি” ইস্যুটাই যখন প্রধানমন্ত্রী তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে, তখন ঐ পত্রিকাগুলি কেন এটা বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর খবর প্রচার করলো? বছরের প্রথম দিনে এতবড় একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটিকে কেন “সেন্সর” করা হলো, যেখানে এই কথাগুলি পুরো ২০১৭ সালে রাষ্ট্রের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হবে? প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলিতে ২০১৭ সালের জন্যে “টার্গেট” দেয়া হয়েছে! এই “টার্গেট” রাষ্ট্রের “টার্গেট”। এখানে কোন সরকারী-বিরোধী দলের তো কথা নেই। তাহলে কেন এখানে এই বিভেদ টানা হয়েছে ঐ পত্রিকাগুলির মাধ্যমে? উত্তর সহজ – ঐ পত্রিকাগুলির “টার্গেট” ভিন্ন। এই রাষ্ট্রের “টার্গেট” তাদের “টার্গেট” নয়। রাষ্ট্র যখন সকল চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের অপততপরতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে, তখন এই পত্রিকাগুলি এই রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ে আছে। রাষ্ট্র যখন নিজ অর্থে পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন এরা নানা প্রচেষ্টায় মেতেছিল পুরো প্রজেক্ট বাতিল করতে। রাষ্ট্র যখন চেষ্টা করছে “হোলি আর্টিসান”এর মতো “স্টিং অপারেশন” থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে, তখন এরাই চেয়েছে “বাংলাদেশে আইসিস আছে” – এই কথা বলে এখানে এফবিআই-কে নিয়ে আসতে। রাষ্ট্র যখন সাবমেরিন কিনেছে, তখন এরাই সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ করাটা ঠিক হবে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের সাথে রয়েছে। এটা পরিষ্কার যে এই পত্রিকাগুলির জন্যে “রাষ্ট্র” আসলে এই রাষ্ট্র নয়, অন্য কোন রাষ্ট্র। “বিদেশী” এই পত্রিকাগুলি থেকে রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে যে সতর্ক থাকতে হবে, তা ২০১৭ সালের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তারা নিজেরাই বলে দিল।