Saturday 17 July 2021

চলমান সহিংসতা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, গণতন্ত্র দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণকে মুক্তি দিতে পারেনি

১৭ই জুলাই ২০২১

দক্ষিণ আফ্রিকায় লুটতরাজ ঠেকাতে গুলি ছুঁড়ছেন এক পুলিশ সদস্য। এবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেকারত্বের হার রেকর্ড ৩২ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে; ২০০৮ সাল থেকে যা সর্বোচ্চ। রামাফোসার আইনের শাসন বনাম জুমার অর্থনৈতিক মুক্তির ‘জাতিগত’ কৌশল একে অপরের মুখোমুখি। ১৯৯০এর দশকে সফল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পরেও প্রায় তিন দশকেও দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের শিকার। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার এহেন অবস্থা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।


মিডিয়াতে দক্ষিণ আফ্রিকায় সহিংসতা এবং লুটতরাজের ছবি দেখে বিশ্ববাসী যখন স্তম্ভিত, তখন অনেকেই এর মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আটককৃত প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার সমর্থকদের বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২’শ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার রাজনৈতিক দল ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ বা ‘এএনসি’তে তার বিরোধী গ্রুপের চাপের মুখে মেয়াদ শেষ হবার এক বছর আগেই তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। জুমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করা হলেও তিনি আদালতের সামনে স্বাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে আদালত অবমাননার জন্যে গত ২৯শে জুন তাকে ১৫ মাসের কারান্ডাদেশ দেয়া হয়। জুমার আটকের খবরের পরপরই দেশটার জনবহুল এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গুয়াতেং এবং কোয়াজুলু নাটাল প্রদেশে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়। একইসাথে সেখানে চলে ভয়াবহ লুটতরাজ। প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসার সরকার সহিংসতা বন্ধে তিন মাসের জন্যে ২৫ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে; যা কিনা দেশটার বর্ণবাদী সরকারের সময়ের পর থেকে সবচাইতে বড় সামরিক মিশন।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেকেই মনে করছেন যে, বর্তমান বিক্ষোভ এবং লুটতরাজ দেশটার গণতন্ত্রের জন্যে সবচাইতে কালো অধ্যায়। সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে এই সমস্যাকে ‘অর্থনৈতিক নাশকতা’; ‘অভ্যত্থান’ বা ‘বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট রামাফোসা বলছেন যে, এই সহিংসতা আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল। প্রথমে এই সমস্যাকে ‘জাতিগত একত্রিকরণ’ বলে আখ্যা দিলেও পরে তিনি সেই বক্তব্য থেকে সড়ে আসেন। তবে দেশটার রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ রাস্তায় সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারে বা জরুরি অবস্থা ঘোষণার ব্যাপারে একেবারেই রাজি ছিল না। নিরাপত্তা সংস্থার এক বৈঠকে সামরিক কর্মকর্তারা সরাসরিই জানিয়ে দেন যে, আইন প্রয়োগ করার জন্যে সৈন্যরা রাস্তায় নামেনি; আইন প্রয়োগের দায়িত্ব হলো পুলিশের।

‘এএনসি’র উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ এবং ইন্টেলিজেন্সের সদস্যদের বরাত দিয়ে ‘ডেইলি ম্যাভেরিক’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, এই সকল সহিংসতাই ছিল একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা; যার পিছনে রয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ডজনখানেক সমর্থক। সহিংসতা শুরুর প্রথম দিকে কোয়াজুলু নাটাল প্রদেশে গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এরপর গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর ডারবানের সাথে অর্থনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ গুয়াতেং প্রদেশের যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল যে, বর্তমানে ধুঁকে ধুঁকে চলা অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলে রামাফোসা সরকারকে সমস্যায় ফেলা। রাস্তায় সামরিক বাহিনী নামানোর উদ্দেশ্য সহিংসতা বন্ধ করা নয়; বরং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলি, যেমন ডারবান সমুদ্রবন্দর, তেলের রিফাইনারি, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খাবার এবং জালানির সাপ্লাই লাইন, ইত্যাদিকে রক্ষা করা।

ক্ষমতাসীন ‘এএনসি’র মাঝে এখন দু’টা গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এক গ্রুপ বলছে যে, জুমার অধীনে এক দশকের দুর্নীতির রাজত্ব থেকে দেশের কাঠামো এবং জবাবদিহিতাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন রামাফোসা। আরেক গ্রুপ জুমার সময়ে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছিল; এখন রামাফোসার অধীনে তাদের অবস্থান আবারও হুমকির মাঝে পড়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, একসময় ‘এএনসি’র ইন্টেলিজেন্সের দেখাশুনা করা জুমার সাথে দেশটার ইন্টেলিজেন্সে যোগাযোগ ভালো। জুমার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে যে, তিনি একটা সমান্তরাল ইন্টেলিজেন্স সংস্থা তৈরি করেছিলেন। ২০১৮ সালে এক প্রতিবেদনে জুমার এই ইন্টেলিজেন্স সংস্থার উল্লেখ করা হয়। তবে এব্যাপারে রামাফোসার সরকার তেমন কিছু করতে পেরেছে কিনা, সেব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। অপরপক্ষে জুমার সমর্থকরা বলছেন যে, সরকার দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন করতে না পেরে রাজনৈতিক বিভেদ বা সমান্তরাল ইন্টেলিজেন্সের কথাগুলি বলছে এবং একইসাথে সহিংসতার ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী করছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে জাতিগত বিভেদের ব্যাপারটা খুব বেশি আলোচিত নয়। দেশটার কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার রক্ষার আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সময়েও এই বিভেদ ছিল। দেশটার সবচাইতে বড় জাতিগোষ্ঠি হলো জুলু; যাদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ। মোঙ্গোসুটু বুথেলেজি ১৯৭০এর দশকে ‘ইনকাথা ফ্রিডম পার্টি’ নামে প্রধানতঃ জুলুদের একটা দল গঠন করেন। ‘ইনকাথা’র সাথে ‘এএনসি’র দ্বন্দ্ব সেই সময় থেকেই। ‘এএনসি’র আন্দোলনে ‘ইনকাথা’ জড়িত ছিল না। ১৯৯০এর দশকে দেশটার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় ‘ইনকাথা’ নির্বাচনে অংশ নেবার শর্ত হিসেবে জুলুদের রাজাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চেয়েছিল। তবে তাদের এই দাবির বাস্তবায়ন ছাড়াই তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে ‘ইনকাথা’ তাদের মূল ঘাঁটি কোয়াজুলু নাটাল প্রদেশে ৫০ শতাংশ ভোট পায়। অথচ আর কোন প্রদেশে তারা ৪ শতাংশ ভোটও পায়নি। কোয়াজুলু নাটালে ‘এএনসি’ পেয়েছিল ৩২ শতাংশ ভোট। তবে পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে কোয়াজুলু নাটালে ‘এএনসি’র ভোট বাড়তে থাকে। ২০০৪ সালে ‘এএনসি’ সেখানে ৪৭ শতাংশ ভোট পায়। আর ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম জুলু প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার নির্বাচনের সময় ‘এএনসি’ সেখানে ৬৩ শতাংশ ভোট পায়। জুমা ক্ষমতা হারাবার পর ২০১৯ সালের নির্বাচনে কোয়াজুলু নাটালে ‘এএনসি’র ভোট ৫৪ শতাংশে নেমে আসে। শিল্পভিত্তিক দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু অঞ্চলগুলি মূলতঃ কৃষিভিত্তিক। ‘স্ট্যাটস সাউথ আফ্রিকা’র হিসেবে কোয়াজুলু নাটালের মাথাপিছু আয় দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টা প্রদেশের মাঝে ৭ম। অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় ২০ শতাংশ জনগণ নিয়ে কোয়াজুলু নাটাল দ্বিতীয়। ২৫ শতাংশ নিয়ে সর্বোচ্চ হলো গুয়াতেং; যেখানে রয়েছে জোহান্সবার্গ এবং প্রিটোরিয়া। বর্তমানে সহিংসতা হচ্ছে এই দুই প্রদেশেই; যেখানে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে।

‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সহিংসতা যেসব অঞ্চলে হচ্ছে, সেসব অঞ্চলই করোভাইরাস এবং লকডাউনে অর্থনৈতিকভাবে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লুটতরাজ চালানো অনেকেই বলছেন যে, তারা তাদের পরিবারকে বাঁচাতে লুটতরাজ চালাচ্ছেন। দেশটার সরকারের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, এবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেকারত্বের হার রেকর্ড ৩২ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে; ২০০৮ সাল থেকে যা সর্বোচ্চ। রামাফোসার আইনের শাসন বনাম জুমার অর্থনৈতিক মুক্তির ‘জাতিগত’ কৌশল একে অপরের মুখোমুখি। ১৯৯০এর দশকে সফল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পরেও প্রায় তিন দশকেও দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের শিকার। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার এহেন অবস্থা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।

Tuesday 13 July 2021

হাইতির প্রেসিডেন্টের হত্যাকান্ড … যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার দ্বন্দ্বের ফলাফল?

১৩ই জুলাই ২০২১

২০১৮ সাল। প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোইজের ছবি নষ্ট করছেন একদল প্রতিবাদকারী। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদেরা সরাসরিই নির্বাচন পাশ কাটিয়ে হাইতির প্রেসিডেন্ট মোইজকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা বলছিলেন। আবার অনেকেই হাইতির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর বিপক্ষে কথা বলছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সকলের সামনে ক্যারিবিয়ানে মার্কিন স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারটাই সামনে আসছে; যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িত থাকুক আর না থাকুক।

 

হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোইজকে তার বাড়িতে ঢুকে হত্যার ঘটনার পিছনে কারা জড়িত ছিল, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনা কল্পনা। ৭ই জুলাই দিবাগত রাতে মোইজের প্রাইভেট বাড়িতে ঢুকে তাকে নৃশংশভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রীও ভীষণভাবে আহত হন। এই হত্যাকান্ড এমন সময়ে এলো, যখন হাইতির নেতৃত্ব নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব চলছে। দেশটাতে এখন কোন কার্যকর পার্লামেন্ট নেই। মোইজের পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভ চলছে প্রায় তিন বছর ধরে। ২০১৭ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট মোইজ ছয়জনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন। ক্লদ জোসেফ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হলেও তাকে মোইজ নিয়োগ দিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। হত্যাকান্ডের শিকার হবার মাত্র কয়েকদিন আগে মোইজ আরিয়েল হেনরিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট ছাড়া হেনরির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর কঠিন হবে। অপরদিকে হাইতির সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে ক্ষমতা পাবার কথা প্রধান বিচারপতির। কিন্তু কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি করনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট মোইজের হত্যাকান্ডের ঘটনার সময়টা ছিল খুবই সংবেদনশীল। ১ কোটি ১২ লক্ষ মানুষের হাইতি আমেরিকা মহাদেশের দরিদ্রতম দেশ। ১৯৯০এর দশক থেকে দেশটা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে খুঁড়িয়ে চলছে। তবে এই দরিদ্র দেশটাকে কেন্দ্র করেই চলছে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা।

যুক্তরাষ্ট্র এবং কলম্বিয়ার নাগরিকেরা জড়িত

‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, হাইতির পুলিশ কর্মকর্তারা যেখানে বলছেন যে, হত্যাকারীরা ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক সদস্য এবং তারা কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করেছে, সেখানে তারা যে হাইতির পুলিশের আক্রমণের শিকার হবে, তা তারা একেবারেই চিন্তায় রাখেনি! শুধু তাই নয়, আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, মোইজের শরীরে অনেকগুলি বুলেটের আঘাতের কথা বলা হলেও প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তারক্ষীদের মাঝে কারুরই হতাহত হবার খবর আসেনি! বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সেই রাতে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে ছুটে আসা নিরাপত্তা সদস্যরা কোন কারণে পাঁচটা গাড়িতে করে আসা হত্যাকারীদেরকে বিনা বাধায় চলে যেতে দেয়। এরপর গাড়িগুলি কিছুদূর যাবার পর কয়েক’শ নিরাপত্তারক্ষীর বাধার সন্মুখীন হয় এবং গাড়ি থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায়। একটা বাড়িতে লুকিয়ে থাকা গ্রুপকে হাইতির নিরাপত্তা বাহিনী ঘিরে ফেলে। সকালের দিকে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ার পর তারা নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে ফোনে আলাপ করতে থাকে এবং একে একে বের হয়ে আসতে থাকে। এদের মাঝে দু’জন ছিল হাইতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। তারা নিজেদেরকে অনুবাদক বলে পরিচয় দেয়। কমপক্ষে তিনজন ভাড়াটে সেনা গোলাগুলিতে নিহত হয় বলে নিরাপত্তা বাহিনী জানায়। প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, কয়েকজন সদস্য কাছেই তাইওয়ান দূতাবাস থাকার ব্যাপারে জানতো বা অন্য কারো কাছ থেকে জানতে পারে। যদিও স্প্যানিশ ভাষাভাষী কলম্বিয়ার নাগরিকেরা ফরাসি ভাষাভাষী হাইতিতে কি করে তাইওয়ানের দূতাবাস খুঁজে পেলো, তা বোধগম্য নয়। হয়তো তারা মনে করেছিল যে, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাইওয়ানের দূতাবাসের কর্মকর্তারা হাইতির পুলিশের কাছে তাদের ধরিয়ে দেবে না বা পুলিশকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এই ব্যক্তিরা পাহাড় এবং দূতাবাসের উঁচু দেয়াল বেয়ে দূতাবাসে ঢুকে পড়ে। তাইওয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন যে, প্রেসিডেন্টের হত্যার খবর জানার পর নিরাপত্তার কারণে তাইওয়ানের দূতাবাসে কেউ অবস্থান করছিল না। তবে হাইতির নিরাপত্তা বাহিনীর অনুরোধে তাইওয়ান দূতাবাসের কর্মকর্তারা পুলিশকে সেখানে ঢোকার অনুমতি দেয়। সেখান থেকে ১১ জন ভাড়াটে সেনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিজস্ব সূত্রের বরাত দিয়ে ‘সিএনএন’ বলছে যে, গ্রেপ্তারকৃত কিছু ব্যক্তি মার্কিন ‘ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন’ বা ‘ডিইএ’ এবং ‘ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ বা ‘এফবিআই’এর ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করতো।

 
প্রেসিডেন্টকে হত্যার অভিযোগে হাইতির পুলিশ দু’জন মার্কিন নাগরিক এবং ১৫ জন কলম্বিয়ার নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে। হত্যাকারীদের হাইতি ছেড়ে পালাবার তেমন কোন পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। হয়তো তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর একটা অভ্যুত্থান সংগঠিত হবে এবং নতুন ক্ষমতা নেয়া ব্যক্তিরা তাদেরকে নিরাপদে দেশ ছাড়তে সহায়তা করবে।


১২ই জুলাই ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক খবরে বলা হয় যে, হাইতির প্রেসিডেন্টকে হত্যায় জড়িত থাকার সন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে বসবসকারী হাইতির নাগরিক ক্রিশ্চিয়ান ইমানুয়েল সানোনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও হাইতির কর্মকর্তারা বলছেন যে, ইউটিউবে প্রকাশ করা ভিডিওতে জাজক এবং ডাক্তার সানোন হাইতির নেতৃত্ব পাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন, অনেকেই বলছেন যে, সানোন প্রকৃতপক্ষে এব্যাপারে কিছুই জানেনা; বরং যারা সত্যিকারের অপরাধী, তারাই সানোনের নাম সামনে এনেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সানোনের বন্ধুর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিছু ব্যক্তি নিজেদেরকে মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি আখ্যা দিয়ে সানোনের সাথে দেখা করে এবং তাকে হাইতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসাতে চায়। এতে পরিকল্পনা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট মোইজকে আটক করা হবে; খুন করা হবে না। ফ্লোরিডাতে সানোনের বন্ধুরা বিশ্বাস করতে পারছেন না যে সে হত্যার মতো প্রকল্পের অংশ হতে পারে।

হাইতির পুলিশ প্রধান লিয়ন চার্লস বলছেন যে, হাইতিতে সানোনের বাড়িতে মার্কিন ‘ডিইএ’এর লোগো খচিত একটা টুপি তারা পেয়েছেন; সাথে ২০ বাক্স বুলেট, অস্ত্র, ডোমিনিকান রিপাবলিকের চারটা লাইসেন্স প্লেট, দু’টা গাড়ি, এবং কিছু চিঠি। তিনি বলেন যে, এখন পর্যন্ত ২৩ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; যাদের বেশিরভাগই কলম্বিয়ার নাগরিক। তিনজন হাইতির নাগরিককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও আরও তিনজন ইতোমধ্যেই গোলাগুলিতে মৃত্যুবরণ করেছে। অপরদিকে কলম্বিয়ার পুলিশ প্রধান জেনারেল লুইস ভারগাস বলেন যে, ফ্লোরিডাতে রেজিস্টার করা ‘সিটিইউ সিকিউরিটি’ নামের এক কোম্পানি কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা থেকে ডোমিনিকান রিপাবলিকের সান্টো ডোমিঙ্গো পর্যন্ত ১৯টা বিমানের টিকেট ক্রয় করেছিল। এই ব্যক্তিরা জুনে ডোমিনিকান রিপাবলিকে আসে, এবং কয়েক সপ্তাহের মাঝেই স্থলপথে সীমান্ত অতিক্রম করে হাইতিতে প্রবেশ করে। দ্বীপ দেশ হাইতির একমাত্র স্থলসীমানা রয়েছে ডোমিনিকান রিপাবলিকের সাথে। শুধু তাই নয়, হাইতির পুলিশ কর্মকর্তা দিমিত্রি হেরাল্ড হত্যাকান্ডের আগের মাসগুলিতে কলম্বিয়া, ইকুয়েডর এবং পানামাতে যাতায়াত করেছিল। তাই কলম্বিয়ার পুলিশ তার ব্যাপারেও তদন্ত করে দেখছে যে ভাড়াটে সেনাদের রিক্রুট করার ক্ষেত্রে তার কোন ভূমিকা ছিল কিনা। হাইতির পুলিশ বলছে যে, সানোনের সাথে ‘সিটিইউ সিকিউরিটি’র যোগাযোগ ছিল; এবং একটা প্রাইভেট বিমানে করে সানোন হাইতিতে আসেন; তার সাথে কিছু অস্ত্রধারী ব্যক্তিও ছিল। সানোনের এক বন্ধু বলছে যে, কিছুদিন আগে ‘সিটিইউ সিকিউরিটি’র মালিক ভেনিজুয়েলার নাগরিক ইমানুয়েল ইন্ত্রিয়াগো ভালেরার সাথে সানোনের বৈঠক হয়; যেখানে ভালেরা হাইতির উন্নয়নের জন্যে কিছু প্রকল্প তুলে ধরেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সানোন হাইতিতে একজন অপরিচিত ব্যক্তি। তাকে এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কেউই মানতে পারছেন না।

প্রেসিডেন্ট মোইজ বনাম হাইতির জনগণ

এবছরের এপ্রিলে ‘হারভার্ড ল’ স্কুল’এর ‘ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ক্লিনিক’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৮ থেকে ২০২০এর মাঝে হাইতির রাজধানী পোর্ট আউ প্রিন্সএর গরীব এলাকাগুলিতে সরকারি সহায়তায় তিনটা গণহত্যা চালানো হয়। এতে কমপক্ষে ২’শ ৪০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে হাইতির সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং পুলিশ সদস্যরা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যে এলাকাগুলিতে এই হত্যাকান্ড চালানো হয়, সেই এলাকাগুলি থেকেই সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু এবং পরিচালনা করা হয়েছিল। নিহত প্রেসিডেন্ট মোইজ ক্ষমতা নেবার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের মূল বিষয় ছিল দেশটার রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতি। মোইজএর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এই হত্যাকান্ডগুলি সশস্ত্র গ্যাংএর সহিংসতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, এই হত্যাকান্ডগুলি পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং তথ্যপ্রমাণ গোপন করার পিছনে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন। মোইজের সরকার গ্যাংগুলিকে অর্থ, অস্ত্র এবং গাড়ি দিয়ে সহায়তা দেয়। দায়িত্বরত না থাকা পুলিশ কর্মকর্তারাও এসব কর্মকান্ডে অংশ নেন। পুলিশ স্টেশনগুলির কাছেই এই ঘটনাগুলি ঘটে; কিন্তু পুলিশ মানুষকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে আসেনি। অপরাধীদের বেশিরভাগই ছিল ‘জি৯’ গ্যাংএর সদস্য। এই গ্যাংএর নেতা জিমি শেরিজিয়ের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকেন।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে মোইজের সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিবাদস্বরূপ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো দেশজুড়ে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয় এবং স্কুল, ব্যাংক এবং আদালতসহ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় শূণ্যের কোঠায় পৌঁছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ব্যাপক দারিদ্র্য পেয়ে বসে জনগণকে। এখন পর্যন্ত সহিংসতায় দু’শর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে বলে বিভিন্ন খবরে প্রকাশ। এই আন্দোলনের সময় হাইতিতে অতি প্রভাবশালী বিদেশী গ্রুপগুলির ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 
২০১০ সাল। হাইতিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। হাইতির রাজনীতি এবং নীতিনির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখেছে। একদিকে যেমন মার্কিন সরকার মোইজকে সমর্থন দিয়ে গিয়েছে, অন্যদিকে মার্কিন রাজনীতিবিদেরা হাইতি প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে সরাসরি বক্তব্য দিয়েছেন।


হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব

মার্কিন সরকারের একটা প্রতিনিধিদল হাইতি ঘুরে এসেছেন। সফরকালে তারা হাইতির বর্তমান নেতৃত্বের এবং নেতৃত্ব দাবি করা ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছেন। হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব জেন পিসাকি সাংবাদিকদের বলেন যে, হাইতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ সামরিক হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। তবে সেব্যাপারে মার্কিন সরকার এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তিনি আরও বলেন যে, প্রতিনিধিদল সফরে বুঝেছেন যে, নেতৃত্বের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না।

হাইতির নীতিনির্ধারণে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ‘কোর গ্রুপ’; যা হলো শক্তিশালী কয়েকটা রাষ্ট্র এবং সংস্থার প্রতিনিধিদের গ্রুপ। এর সদস্যদের মাঝে সবচাইতে শক্তিশালী হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা; যারা ক্যারিবিয়ানে সবচাইতে প্রভাবশালী। হাইতির প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সও এতে রয়েছে; ক্যারিবিয়ানে ফ্রান্সের এখনও উপনিবেশ রয়েছে। এছাড়াও এই গ্রুপে রয়েছে জাতিসংঘ, ইইউ, জার্মানি, স্পেন এবং ল্যাটিন আমেরিকার একমাত্র প্রতিনিধি দেশ ব্রাজিল। ‘অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস’ বা ‘ওএএস’এর একজন প্রতিনিধিও রয়েছে এই গ্রুপে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইতির রাস্তায় ব্যাপক সহিংসতার পর ‘কোর গ্রুপ’ একটা বিবৃতি দেয়। হাইতিতে মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘কোর গ্রুপ’এর এই বিবৃতিতে বলা হয় যে, তারা হাইতিতে ভোট ব্যতীত আর কোন পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন সমর্থন করে না। বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের সময় পুলিশের ভূমিকারও ব্যাপক প্রশংসা করা হয় সেই বিবৃতিতে। আর সহিংসতা থামাতে হাইতির নেতৃত্বকে আলোচনায় মনোনিবেশ করার উপদেশ দেয়া হয়। একইসাথে মোইজের সরকারকে সংস্কার কাজ চালিয়ে যেতে আহ্বান জানানো হয়।

কয়েক দশক ধরে হাইতির রাজনীতি এবং নীতিনির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখেছে। একদিকে যেমন মার্কিন সরকার মোইজকে সমর্থন দিয়ে গিয়েছে, অন্যদিকে মার্কিন রাজনীতিবিদেরা হাইতির প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে সরাসরি বক্তব্য দিয়েছেন। হাইতির সহিংসতার মাঝে ২০১৯এর অক্টোবরে ফ্লোরিডার ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য ফ্রেডারিকা উইলসন হাইতির উপর একটা গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত হাইতির নাগরিকরা হাইতির রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানান এবং প্রেসিডেন্ট মোইজের ক্ষমতা ছাড়ার পক্ষে মত দেন। ডিসেম্বরে হাইতির পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির শুনানি হয়। ‘মায়ামি হেরাল্ড’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই শুনানি ছিল ছয় বছরের মাঝে হাইতি নিয়ে প্রথম শুনানি। সেসময়ে ডেমোক্র্যাট সদস্যরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরাবার চেষ্টা করছিলেন। ফ্লোরিডার ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য ফ্রেডারিকা উইলসন হাইতির প্রতিনিধিদের জিজ্ঞেস করেন যে, হাইতির প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজ কতটা এগুলো। হাইতির রাজনৈতিক কর্মী ইমানুয়েলা দুইয়োন বলেন যে, হাইতির পার্লামেন্টের সদস্যারা সকলেই প্রেসিডেন্ট মোইজের সমর্থনপুষ্ট এবং অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে তারা বিভিন্ন আইন পাস করার জন্যে অর্থ পেয়ে থাকে। সেবছরের মার্চে প্রেসিডেন্টের সমর্থনপুষ্ট হয়েই পার্লামেন্টের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দেয়। এর পর থেকে হাইতিতে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক কোন সরকার নেই। শুনানিতে ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য ম্যাক্সিন ওয়াটার্স অভিযোগ করেন যে, মোইজের সরকার ভেনিজুয়েলার পেট্রোক্যারিব তেল আমদানি প্রকল্প থেকে বেঁচে যাওয়া ২ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে। অথচ ২০১০ সালের মারাত্মক ভূমিকম্পের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হাইতির পুনর্বাসনের জন্যে এই অর্থ ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি মার্কিন সরকার মোইজের সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। হাইতির ‘ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক’এর ডিরেক্টর পিয়েরে এসপেরেন্স বলেন যে, হাইতিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা মূলতঃ দেয়া হচ্ছে দেশটার নির্বাচন পদ্ধতিকে সঠিক করতে; হাইতির পুলিশ এবং আদালতকে শক্তিশালী করতে সহায়তা আসছে না। হাইতির আরেক নাগরিক লিওনি হেরমানটিন বলেন যে, আন্তর্জাতিক শক্তিরা নির্বাচন কেন্দ্রিক সহায়তার মাঝেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করার কারণে হাতে গোণা কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছে। হাইতিতে নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র সঠিকভাবে বজায় থাকবে, এব্যাপারে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। ওবামা প্রশাসনের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ উপদেষ্টা ড্যানিয়েল এরিকসন বলেন যে, হাইতির সমস্যার সমাধান করতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত কানাডা, ইইউ এবং ‘অর্গানাইজেন অব আমেরিকান স্টেটস’ বা ‘ওএএস’এর সাথে যৌথভাবে কাজ করা। তিনিও হাইতির পুলিশ এবং আদালতের জন্যে মার্কিন সাহায্য দেয়ার আহ্বান জানান। ফ্রেডারিকা উইলসন বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে মাত্র দু’শ মাইল দূরের একটা দেশে কি হচ্ছে, সেব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকার সময় নয় এটা।

 
২০১৮ সাল। হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোইজের সাথে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। হাইতিতে কানাডার প্রভাব খুব একটা দৃশ্যমান নয়। কয়েক দশক ধরেই ক্যারিবিয়ানে ব্রিটেনের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিকে উপজীব্য করে নিজের প্রভাব ধরে রেখেছে কানাডা। ১৯৯০এর দশক থেকে হাইতির রাজনৈতিক সমস্যা শুরু হলে কানাডা এই সুযোগে সেখানে নিজেদের রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব বৃদ্ধি করার সুযোগ পায়। কিন্তু বরাবরের মতোই সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নামটাই প্রচারিত হয়; কানাডার নয়। তাই যেকোন রাজনৈতিক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সকলেই যুক্তরাষ্ট্রের নামটাই উচ্চারণ করতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র বনাম কানাডা

‘দ্যা ডেইলি বিস্ট’এর নিকো হাইনসএর মতে, হত্যাকারীদের হাইতি ছেড়ে পালাবার তেমন কোন পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। হয়তো তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর একটা অভ্যুত্থান সংগঠিত হবে এবং নতুন ক্ষমতা নেয়া ব্যক্তিরা তাদেরকে নিরাপদে দেশ ছাড়তে সহায়তা করবে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর ওয়াশিংটন প্রতিবেদক কেথেভানি গোরজেস্তানি বলছেন যে, হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারা যেভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে একই কথা বারবার বলছিলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র কাউকেই তড়িঘড়ি করে দোষী বলে বিপদে পড়তে চাইছে না। অর্থাৎ মার্কিন প্রশাসন আসলে নিশ্চিত নয় যে, এই হত্যাকান্ড কারা চালিয়েছে। হাইতির রাস্তার মানুষ বলছে যে, মোইজ একজন দুর্নীতিগ্রস্ত লোক ছিলেন; যাকে আরও কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিই খুন করেছে। কেউ কেউ বলছেন যে, এই হত্যাকান্ডের পিছনে কাজ করছে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিরা; যাদের মাঝে রয়েছে কানাডা এবং ফ্রান্স। ফ্রান্স ছিল হাইতির প্রাক্তন ঔপনিবেশি শক্তি; যুক্তরাষ্ট্র দু’শ মাইল দূরে বর্তমান বিশ্বের সুপারপাওয়ার। সেই হিসেবে হাইতির রাজনীতিতে ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের নামটা আসতেই পারে। কিন্তু কানাডার নামটাও হাইতির রাস্তার মানুষের কাছে এতটা পরিচিত কেন?

হাইতিতে কানাডার প্রভাব খুব একটা দৃশ্যমান নয়। তবে একটা উদাহরণই বলে দিতে পারে যে, পুরো ক্যারিবিয়ানে কানাডা আসলে কতটা প্রভাব রাখে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৪ সালে কিউবার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠার পিছনে এক বছরের বেশি সময়ে ধরে কাজ করেছিলেন ওবামা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বেন রোডস। রোডস গোপনে কিউবার ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছিলেন কানাডাতে। কয়েক দশক ধরেই ক্যারিবিয়ানে ব্রিটেনের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিকে উপজীব্য করে নিজের প্রভাব ধরে রেখেছে কানাডা। ১৯৯০এর দশক থেকে হাইতির রাজনৈতিক সমস্যা শুরু হলে কানাডা এই সুযোগে সেখানে নিজেদের রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব বৃদ্ধি করার সুযোগ পায়। কিন্তু বরাবরের মতোই সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নামটাই প্রচারিত হয়; কানাডার নয়। তাই যেকোন রাজনৈতিক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সকলেই যুক্তরাষ্ট্রের নামটাই উচ্চারণ করতে থাকে।

২০২০ সালের মে মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে বিদেশী ভাড়াটে সেনাদের ব্যবহার করে অপহরণ করার অবাস্তব পরিকল্পনা মিডিয়াতে আসার পর ক্যারিবিয়ানে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, তেমনি জো বাইডেন প্রশাসনের সময় হাইতির প্রেসিডেন্ট মোইজের হত্যাকান্ড একইভাবে মার্কিন অবস্থানকে দুর্বল করবে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদেরা যখন সরাসরিই নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে হাইতির প্রেসিডেন্ট মোইজকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা বলছিলেন। অপরপক্ষে অনেকেই হাইতির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর বিপক্ষে কথা বলছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সকলের সামনে ক্যারিবিয়ানে মার্কিন স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারটাই সামনে আসছে; যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িত থাকুক আর না থাকুক। গত কয়েক দশক ধরে ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে মূল বাধা হলো কানাডা। সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে বহুদূরে থাকা কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের স্থলসীমানায় অবস্থান করে কিভাবে সুপারপাওয়ারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে, তা বুঝতে হলে কানাডাকে আলাদা একটা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে দেখলে হবে না। ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কানাডা চিন্তাগত দিক থেকে প্রাক্তন সুপারপাওয়ার ব্রিটেনের মতোই। তাই নিজের ভৌগোলিক আকার হিসেব করে তারা তাদের নীতিনির্ধারণ করেনি। হাইতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দু’শ মাইল দূরে হলেও কানাডা থেকে কিন্তু অনেক দূরে। তথাপি সেখানে কানাডার সম্মতি ছাড়া যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কোন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না, তা নিশ্চিত। কয়েক দশক চেষ্টার পরেও হাইতির রাজনীতিকে নিজ পক্ষে নিয়ে আসতে না পারাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা বড় ব্যর্থতা। সেখানে অন্য কারুর বাধা থাকুক আর না থাকুক; সকলেই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতাটাই মনে রাখবে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় দুর্বল হতে থাকা সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রকে নিজ উঠানে হেনস্তা করাটা আসলে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কৌশলের মাঝে পড়ে; কানাডা যেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ক্যারিবিয়ানে প্রতি পদে যুক্তরাষ্ট্রের হারানো প্রভাবকে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে কানাডা।

Saturday 10 July 2021

কৃষ্ণ সাগরে ব্রিটেনের স্বার্থ কি?

১০ই জুলাই ২০২১

ক্রিমিয়ার উপকূলে রুশ যুদ্ধজাহাজ থেকে দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ রয়াল নেভির ডেস্ট্রয়ার 'ডিফেন্ডার'কে। ‘ডিফেন্ডার’ এবং ডাচ ফ্রিগেট ‘এভারস্টেন’ ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর সাথে দূরপ্রাচ্যের মিশনে বের হয়েছে। জাহাজগুলির দক্ষিণ চীন সাগরে পৌঁছানো এখনও অনেক দেরি; কিন্তু ইতোমধ্যেই তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আসার মতো একটা খবর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। কৃষ্ণ সাগরে ন্যাটোর মিশনের সাথে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ নিয়মিতই মোতায়েন হচ্ছে; তবে মিডিয়ায় এসেছে মার্কিন কর্মকান্ড। এই ঘটনার মাধ্যমে ব্রিটেনের কৃষ্ণ সাগরের ব্রিটিশ মিশনকে হাইলাইট করা হলো।


গত ২৩শে জুন ব্রিটিশ রয়াল নেভির একটা যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণ সাগরে রুশ সামরিক বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবার পর থেকে ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মাঝে কাদাছোঁড়াছুড়ি চলছে। রুশ বার্তাসংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার ‘ডিফেন্ডার’ রাশিয়ার সমুদ্রসীমায় ঢুকে পড়লে রাশিয়ার সীমান্তরক্ষী যুদ্ধজাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করে সতর্ক করা হয় এবং একটা ‘সুখোই ২৪’ যুদ্ধবিমান থেকে কয়েকটা বোমা জাহাজটার কাছাকাছি ফেলা হয়। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলে যে, ব্রিটিশ জাহাজটা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অমান্য করেছে। রুশ বার্তাসংস্থা ‘তাস’ জানাচ্ছে যে, ঘটনার পর ব্রিটিশ সামরিক এটাশেকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। অপরদিকে টুইটারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ‘ডিফেন্ডার’কে লক্ষ্য করে কোন সতর্কতামূলক গোলাবর্ষণ করা হয়নি। বরং জাহাজটা আন্তর্জাতিক আইন মেনে ইউক্রেনের সমুদ্রসীমানা ‘নিরপরাধভাবে অতিক্রম’ করছিল। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস পার্লামেন্টের আইনপ্রণেতাদেরকে বলেন যে, রাশিয়ার এই দাবির ব্যাপারে তিনি অবাক হননি; কারণ রাশিয়ার সাথে এরকম ঘটনা নিয়মিত।

২৪শে জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন যে, ক্রিমিয়ার উপকূলে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের চলাচল পুরোপুরি সঠিক ছিল। সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে ব্রিটেন মস্কোকে চ্যালেঞ্জ করে যেতে থাকবে। তিনি বলেন যে, আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা ব্যবহার করাটা পুরোপুরি সঠিক ছিল; এবং এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ব্রিটেন রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ার স্বীকৃতি দেয়নি। মূলতঃ বরিস জনসনের কথাগুলি এই দ্বন্দ্বকে সংজ্ঞায়িত করে। ব্রিটেন ক্রিমিয়াকে এখনও ইউক্রেনের অংশ হিসেবে দেখছে এবং ক্রিমিয়ার সমুদ্রসীমানাকেও ব্রিটেন দেখছে ইউক্রেনের এলাকা হিসেবে; রাশিয়ার এলাকা হিসেবে নয়। অপরদিকে ব্রিটেন এবং রাশিয়া উভয়েই ক্রিমিয়ার মালিকানার সংজ্ঞার উপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখার কথা বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিজের সমুদ্রসীমা থেকে হাজার মাইল দূরে ব্রিটেন কৃষ্ণ সাগরে কি করছে?

‘ডিফেন্ডার’ ব্রিটিশ রয়াল নেভির দৈত্যাকৃতির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর সাথে ভূমধ্যসাগরে এসেছিল। সেই গ্রুপ থেকে আলাদা হয়ে ‘ডিফেন্ডার’ এবং ডাচ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘এভারস্টেন’ কৃষ্ণ সাগরে ঢোকে। ঘটনার দুই দিন আগে ২১শে জুন ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে ‘ডিফেন্ডার’এর ডেকের উপর ইউক্রেনের সাথে একটা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, গত অক্টোবরে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ি এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক ব্রিটেন ইউক্রেনের জন্যে ৮টা ছোট দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করবে এবং ব্রিটিশ রয়াল নেভির পুরোনো দু’টা মাইন সুইপার জাহাজ ইউক্রেনকে দেবে। ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জন্যে দু’টা নৌঘাঁটি তৈরিতেও সহায়তা দেবে ব্রিটেন। একইসাথে এই প্রকল্পের জন্যে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নও ব্রিটিশ সরকারই করছে। এছাড়াও ইউক্রেনের বর্তমান কিছু যুদ্ধবিমানকেও পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করার জন্যে উপযোগী করার কথা উল্লেখ করা হয়। তদুপরি ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জন্যে ফ্রিগেট তৈরির প্রকল্পেও সহায়তা দেবে ব্রিটেন।

 
কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ছাড়াও পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নিতে চাইছে ব্রিটেন; প্রতিটা সুযোগই কাজে লাগাতে চাইছে তারা।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়ন ফেলো ব্রায়ান হুইটমোর বলছেন যে, ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পর থেকে এই এলাকায় উত্তেজনা চলছে; ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের সাথে রুশদের এই দ্বন্দ্ব সেই উত্তেজনারই অংশ। ক্রিমিয়ার আশেপাশে কৃষ্ণ সাগরে আন্তর্জাতিক আকাশসীমানায় মার্কিন এবং ব্রিটিশ সামরিক বিমান নিয়মিত টহল দিচ্ছে এবং রুশ যুদ্ধবিমান সেগুলিকে আকাশে বাধা দিচ্ছে। ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর সিনিয়র ফেলো স্টিভেন পাইফার এই ঘটনাকে ‘চায়ের কাপে ঝড়’এর সাথে তুলনা দেন। তিনি বলছেন যে, রাশিয়া বলতে চাইছে যে, পশ্চিমারা রাশিয়ার সীমানায় আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে; আর রাশিয়া নিজ সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করছে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়া যেমন বলতে চাইছে যে, পশ্চিমা চাপের মুখে রাশিয়া নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে; অপরপক্ষে রুশ সরকার নিজ জনগণের কাছ থেকেও সমর্থন চাইছে। তবে তিনি বলছেন যে, রাশিয়া কৃষ্ণ সাগরের শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করে যেতে থাকবে এবং পশ্চিমারাও রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে যেতে থাকবে।

কৃষ্ণ সাগরে ব্রিটেনের স্বার্থ নতুন নয়। ১৮৭৮ সালে ইস্তাম্বুলের উপকন্ঠে রুশ সেনাবাহিনী হাজির হলে ব্রিটেনের বাধায় রাশিয়া পিছু হঠতে বাধ্য হয়। কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বসফরাস প্রণালির নিয়ন্ত্রণ ব্রিটেন রাশিয়ার হাতে ছাড়তে রাজি নয়; তাই বসফরাসের নিরাপত্তা কথা বলে ব্রিটেন সাইপ্রাসে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে; যা আজও রয়েছে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে উসমানি খিলাফতের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলি ভাগবাটোয়ারা করার সময়েও বসফরাস প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ যেন রাশিয়ার কাছে চলে না যায়, সেব্যাপারটা নিশ্চিত করে ব্রিটেন। ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত লাউস্যান চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন বসফরাসের নিয়ন্ত্রণ দেয় লীগ অব নেশনসএর হাতে। তবে ১৯৩০এর দশকে ফ্যাসিস্ট ইতালি এবং নাজি জার্মানির আবির্ভাবের পর ১৯৩৬ সালে ‘মনট্রিউ কনভেনশন’এর মাধ্যমে নতুন করে বসফরাসের নিয়মগুলি ঠিক করা হয়; যেগুলি আজও বলবত রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাইলে কৃষ্ণ সাগরে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের আগমণ ঘটে এবং চার দশক তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল থাকে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষে ২০০৪ সালে কৃষ্ণ সাগরের দেশ রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হলে কৃষ্ণ সাগরে পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার উত্তেজনা শুরু হয়। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে। এরপর ২০১৪ সালে ইউক্রেনে বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ সমর্থিত সরকারের পতনের পর পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয় এবং রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়।

ব্রিটিশ রয়াল নেভির ডেস্ট্রয়ার ‘ডিফেন্ডার’ এবং ডাচ ফ্রিগেট ‘এভারস্টেন’ ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর সাথে দূরপ্রাচ্যের মিশনে বের হয়েছে। জাহাজগুলির দক্ষিণ চীন সাগরে পৌঁছানো এখনও অনেক দেরি; কিন্তু ইতোমধ্যেই তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আসার মতো একটা খবর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। কৃষ্ণ সাগরে ন্যাটোর মিশনের সাথে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ নিয়মিতই মোতায়েন হচ্ছে; তবে মিডিয়ায় এসেছে মার্কিন কর্মকান্ড। এই ঘটনার মাধ্যমে ব্রিটেনের কৃষ্ণ সাগরের ব্রিটিশ মিশনকে হাইলাইট করা হলো। কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ছাড়াও পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নিতে চাইছে ব্রিটেন; প্রতিটা সুযোগই কাজে লাগাতে চাইছে তারা।

Sunday 4 July 2021

আদিবাসী শিশুদের গণকবর … কানাডার বর্ণবাদী ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ করছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে

৪ঠা জুলাই ২০২১

 
কানাডার একটা আবাসিক স্কুলের ১৮৯০ সালের ছবি। ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কানাডার ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’র ইতিহাস আবারও উঠে এলো এমন এক সময়ে, যখন পরিবর্তিত বিশ্বে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ পুনরায় নেতৃত্ব পাবার চেষ্টায় রয়েছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে সাথে নিয়ে ব্রিটেনের এই চেষ্টা কানাডায় প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের গণহত্যার ইতিহাসকেও সামনে টেনে নিয়ে আসছে। বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিনিয়ত ব্রিটিশ নেতৃত্বের বর্ণবাদী ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়াটা ব্রিটিশ সরকার আটকাতে পারছে না কিছুতেই।

কানাডায় গত মে মাস থেকে কমপক্ষে তিনটা গণকবরের সন্ধান মিলেছে, যেগুলি সেখানকার আদিবাসী মানুষদের সন্তানদের কবর বলে সনাক্ত হয়েছে। এই ঘটনায় পুরো কানাডা জুড়ে আবেগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই কবরগুলি ছিল আবাসিক স্কুলে পড়া আদিবাসী ছাত্রদের। এখন পর্যন্ত কানাডার সরকারি অর্থায়নের বোর্ডিং স্কুলগুলির আশেপাশে কমপক্ষে ১১’শ কবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ‘বিবিসি’ জানাচ্ছে যে, এই বোর্ডিং স্কুলগুলির উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদেরকে কানাডার ইউরোপিয় সংস্কৃতিকে মেনে নিতে বাধ্য করা এবং আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ভাষাকে ধ্বংস করা। তবে এই গণকবর আবিষ্কার কানাডায় নতুন কিছু নয়। দেশটার পুরো ইতিহাস জুড়েই রয়েছে এই কলঙ্কময় কর্মকান্ড; যা এখন বিশ্ব মিডিয়াতে নতুন করে আসছে।

মে মাসে কানাডার পশ্চিমের ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যের কামলুপস শহরের কাছে প্রথম গণকবরটা পাওয়া যায়। রাডার ব্যবহার করে ২’শ ১৫টা কবর আবিষ্কার করা হয়। কামলুপসএর স্কুলটাতে একসাথে প্রায় ৫’শ আদিবাসী ছাত্র পড়াশুনা করতো। ১৮৯০ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চালু ছিল এই স্কুল। এরপর জুন মাসে সাসকাচুয়ান প্রদেশে আরও একটা গণকবরে এখন পর্যন্ত ৭’শ ৫১ মরদেহ পাওয়া গিয়েছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় আরেকটা স্কুলে গণকবরে পাওয়া গিয়েছে ১’শ ৮২টা মরদেহ। এই স্কুলটা ১৯১২ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত চালু ছিল। দেশটার আদিবাসীদের নেতা চিফ রোজ্যান কাসিমির বলেন যে, আবিষ্কার করা কবরগুলির মাঝে কারো কারো বয়স হয়তো তিন বছরেরও কম ছিল। এই বোর্ডিং স্কুলগুলিতে মৃতুবরণ করা হাজারো শিশুর মৃতদেহ তাদের স্বজনদের কাছে পাঠানো হয়নি। কমপক্ষে ১’শ ৩০টা আবাসিক স্কুলে ১৮৭৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরকারি অর্থায়নে চালিত কর্মকান্ডে প্রায় দেড় লক্ষ আদিবাসী ‘মেটিস’ এবং ‘ইনুইট’ শিশুদেরকে তাদের পরিবার থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১৯২০এর দশকে আদিবাসী শিশুদের জন্যে বোর্ডিং স্কুলে পড়া বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়। এই আদেশ অমান্য করলে কারাদন্ডাদেশের ব্যবস্থা ছিল। শিশুদেরকে নিজস্ব ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি অথবা ফরাসি ভাষা শিখতে হয়েছিল এবং খিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে হয়েছিল।

২০০৯ সালে তৈরি হওয়া কানাডার ‘ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’এর ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে সরকারের এই কর্মকান্ডকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। সরকার, চার্চ এবং স্কুলের ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞার কারণেই কমপক্ষে ৬ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় বলে সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। শিশুদেরকে অত্যন্ত খারাপ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হতো, অত্যন্ত কঠিন শাস্তি দেয়া হতো, এবং তাদের কোন মেডিক্যাল সুবিধাও দেয়া হতো না। শিশুদের উপর এই পরিবেশের অতি খারাপ প্রভাব সরকারের সকল নেতৃত্বের কাছে জানা ছিল। প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয় যে, শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে কিছু শিশু বোর্ডিং স্কুল থেকে পালিয়েছিল। বাকিরা বিভিন্ন রোগ বা দুর্ঘটনা বা অবহেলায় মৃত্যুবরণ করে। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত আদিবাসী বোর্ডিং স্কুলে শিশুমৃত্যুর হার অন্যান্য বোর্ডিং স্কুলের চাইতে পাঁচগুণ বেশি ছিল। বোর্ডিং স্কুল থেকে বেঁচে যাওয়ারা বলে যে, তারা বিভিন্ন সময়ে হঠাত করেই লক্ষ্য করতো যে, তাদের একজন বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে চার্চের পাদ্রীদের অবৈধ সম্পর্কের জেরে জন্ম নেয়া সন্তানদেরকে তাদের মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চুল্লির মাঝে ফেলে দেয়া হতো বলে অভিযোগ রয়েছে।

জাস্টিন ট্রুডোর সরকার নতুন করে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার কথা ঘোষণা করলেও আদিবাসী নেতারা তাতে খুশি হতে পারেননি। তারা চাইছেন প্রথমে সত্যটা পুরোপুরিভাবে জানানো দরকার। সেকারণে আদিবাসী নেতা মারে সিনক্লেয়ার এবং চিফ বেলেগার্ড বলছেন যে, পুরো ১’শ ৩০টা স্কুলেই গণকবর খোঁজা দরকার। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ১৯৮০এর এবং ১৯৯০এর দশকে ‘ইউনাইটেড’, ‘এংলিকান’ এবং ‘প্রেবিসটেরিয়ান’ চার্চের প্রতিনিধিরা এসব কর্মকান্ডের ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে হাত ঝেড়ে ফেললেও ক্যাথোলিক চার্চের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পোপএর কাছ থেকে কোন বিবৃতি আসেনি। ট্রুডো ২০১৭ সালে পোপ ফ্রান্সিসকে ক্ষমা চাইবার আহ্বান করলেও ভ্যাটিকান তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।

তবে কানাডার এই গণকবরের ঘটনা কি শুধুই চার্চের ব্যাপার? ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা জানাচ্ছে যে, গণকবরের ঘটনার জের ধরে কানাডায় ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথ এবং রানী ভিক্টোরিয়ার মুর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। পহেলা জুলাই ‘কানাডা দিবস’এ ম্যানিটোবা রাজ্যে রানী ভিক্টোরিয়ার মুর্তির উপর কাপড় দিয়ে ঢেকে লাল রঙ মেখে সেটাকে টেনে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়। এই মুর্তিগুলি আদিবাসীদের কাছে কানাডার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের উদাহরণ। অটোয়া শহরে ‘পার্লামেন্ট হিল’ এলাকায় ‘কানাডা দিবস বাতিল কর’ শীর্ষক জনসমাবেশে হাজারো মানুষ ‘কানাডার জন্যে লজ্জা’ এবং ‘তাদেরকে ফিরিয়া আনো’ বলে স্লোগান দেয়। কিছুদিন আগে কানাডার বোর্ডিং স্কুল ব্যবস্থার স্থপতি বলে পরিচিত এগারটন রায়ারসনএর মুর্তিও ভেঙ্গে ফেলা হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে এক বার্তায় বলা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ রানীর মুর্তি ধ্বংস করার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তবে বিবৃতিতে এও বলা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার কানাডার আদিবাসীদের আবেগের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে।

কানাডার জাস্টিন ট্রুডোর সরকার এবং ব্রিটেনের ডাউনিং স্ট্রিট আদিবাসী শিশুদের গণকবরের ঘটনাগুলিকে কোনমতে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও তা ব্রিটিশদের লিবারাল সেকুলার আদর্শের প্রতি একটা আঘাত হিসেবেই এসেছে। ট্রুডো ব্যাপারটাকে ক্যাথোলিক চার্চের দায় বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও কানাডার লিবারাল সংস্কৃতির মাঝে ক্যাথোলিক চার্চের ক্ষমতা কতটুকু, তা সামনে চলে আসে। অন্ততঃ আদিবাসীদের কিছু অংশ বুঝতে পেরেছে যে, দোষটা শুধু ক্যাথোলিক চার্চের ঘাড়ে দিলেই হবে না; যেকারণে তারা ব্রিটিশ রানীর মুর্তিও ভাংচুর করেছে। ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কানাডার এই ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’র ইতিহাস আবারও উঠে এলো এমন এক সময়ে, যখন পরিবর্তিত বিশ্বে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ পুনরায় নেতৃত্ব পাবার চেষ্টায় রয়েছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে সাথে নিয়ে ব্রিটেনের এই চেষ্টা কানাডায় প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের গণহত্যার ইতিহাসকেও সামনে টেনে নিয়ে আসছে। বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিনিয়ত ব্রিটিশ নেতৃত্বের বর্ণবাদী ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়াটা ব্রিটিশ সরকার আটকাতে পারছে না কিছুতেই।