Sunday 4 November 2018

যেকারণে মিয়ানমারের উচিৎ বাংলাদেশের প্রভাব বলয়ে থাকা



০৫ নভেম্বর ২০১৮

মিয়ানমার বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা। মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তার অবস্থান সেখানে। রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার থাকুক আর না থাকুক, এই ভূখন্ডের অবস্থান এখানে থাকবেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না সৃষ্টিকর্তা কিছু করবেন। বাংলাদেশের যেকোন জাহাজ ভারত মহাসাগরে যেতে চাইলে তাকে মিয়ানমারের হাজার মাইলের উপকূলের পাশ ঘেঁসে যেতে হবে। এতবড় উপকূলে অবস্থিত রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের নীতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ না করে, তবে তা বাংলাদেশের জন্যে হুমকিস্বরূপ হবে। এই রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। আর সেই সামরিক শক্তি যদি তেমন কিছু না-ও হয়ে থাকে, তবুও সেই রাষ্ট্র হুমকিস্বরূপ হতে পারে। কারণ ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী কোন রাষ্ট্র যখনই জানবে যে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের উত্তেজনা রয়েছে, তখনই তারা মিয়ানমারকে ব্যবহার করতে চাইবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

ভারতের অবস্থান

মিয়ানমারের উত্তর-দক্ষিণ বরাবর উপকূল বঙ্গোপসাগরের পূর্ব দিকের নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিরাপত্তাও এই উপকূলের উপরে নির্ভরশীল। ভারতের উপকূল থেকে আন্দামান এবং নিকোবর অনেক দূরে। দ্বীপ হবার কারণে আন্দামান এবং নিকোবর সর্বদাই বঙ্গোপসাগরের উপকূলের উপরে নির্ভরশীল থাকবে। তবে অবস্থানের কারণে এই দ্বীপগুলি মিয়ানমার এবং সুমাত্রার উপরেই বেশি নির্ভর করবে সর্বদা। বর্তমানে এই দ্বীপগুলি ভারতের অধীনে থাকায় তা ভারতের জন্যে একটা লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জ। মিয়ানমারের সহায়তা না পেলে কোন জরুরি সময়ে ভারত এই দ্বীপগুলির নিরাপত্তা দিতে সমস্যায় পড়তে পারে। একারণে ভারতের সর্বদাই লক্ষ্য থাকবে মিয়ানমারকে নিজের পক্ষে রাখতে। কাজেই মিয়ানমারে বাংলাদেশ এবং ভারতের স্বার্থ সাংঘর্ষিক।

চীনের অবস্থান

মিয়ানমারের পূর্বে রয়েছে চীন। চীন তার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানাকে নিরাপদ রাখতে মিয়ানমারে প্রভাব রাখতে চায়। কিন্তু এটা সবারই জানা যে মিয়ানমারে চীনের অবস্থান ভারতকে বিচলিত করে। মিয়ানমারের উপকূলে চীনের অবস্থান যেমন ভারতের কাছে চীনের একটা সামরিক নৌঘাঁটির মতো ঠেকে, ঠিক তেমনি চীনের কাছেও মিয়ানমারে ভারত এবং পশ্চিমা দেশগুলির বিনিয়োগকে চীনের জন্যে হুমকিস্বরূপ দেখা হয়। মিয়ানমারের সাথে ভারতের স্থলসীমানা থাকায় ভারত সেই সীমানার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ভোগে। এমতাবস্থায় মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির জন্যে হুমকি।

মিয়ানমার যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। মিয়ানমার যেহেতু বাংলাদেশের সীমানায়, কাজেই সেই ভূখন্ডকে ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি Subversion এর মতো কর্মকান্ড চালাতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০ লক্ষ মুসলিম শরণার্থীকে ঠেলে পাঠাবার মতো ঘৃণ্য কার্মকান্ড মিয়ানমার থেকে আসা কৌশলগত হুমকিকেই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একইসাথে সেদেশের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ব্যবহার করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি।

যা হতে হবে...

মিয়ানমারকে বুঝতে হবে যে, তারা চীনকে সেদেশে প্রভাব খাটাতে দিলে ভারত বিচলিত হয়ে মিয়ানমারের উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে মিয়ানমার যদি ভারতকে সেদেশে প্রভাব খাটাতে দেয়, তাহলে চীন তার উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। আর চীনের জন্যে মিয়ানমারের উপরে চাপ সৃষ্টি করা বেশ সহজ; কারণ দু’দেশের মাঝে রয়েছে লম্বা স্থলসীমানা এবং সেই সীমানা অঞ্চলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরের জনগোষ্ঠির বিচ্ছিন্নতাবাদী চেষ্টায় চীন সহায়তা দেবে। এতে দুই পক্ষের চাপের মাঝে মিয়ানমারের রাষ্ট্রচালনা বাধাগ্রস্ত হবে।

মিয়ানমারকে বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশই এক্ষেত্রে মিয়ানমারকে নিরাপত্তা দিতে পারে। মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রভাব বলয়ে থাকলে ভারত এবং চীন মিয়ানমারে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না।

চীনকে বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তার করলে চীনের সীমানায় সমস্যা হবে না। কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারকে ভারতের কাছে বিক্রি করবে না। আর মিয়ানমারের উপকূলে চীনের অর্থনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা চীনের নৌবাহিনীর পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ চীনের সবচাইতে কাছের নৌঘাঁটি দক্ষিণ চীন সাগরে, যা কিনা বঙ্গোপসাগর থেকে ইন্দোচীন, মালয় উপদ্বীপ, থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমার দ্বারা বিভাজিত। তবে বাংলাদেশের পক্ষে মিয়ানমারের উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বেশ সহজ। মিয়ানমারের স্থলসীমানায় চীনের জন্যে প্রভাব রাখা সহজ হলেও মিয়ানমারের উপকূলে প্রভাব ধরে রাখাটা চীনের জন্যে বেশ চ্যালেঞ্জিং; যেটা বাংলাদেশের জন্যে আবার সহজ।

ভারতকে বুঝতে হবে যে, মিয়ানমার বাংলাদেশের হেফাজতে থাকলে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নিরাপদ থাকবে। কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারকে চীনের কাছে বিক্রি করবে না। আর সেক্ষেত্রে মিয়ানমারে চীনের সাথে রেষারেষি নিয়ে ভারতকে মাথা ঘামাতে হবে না।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে যে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব একমাত্র বাংলাদেশের প্রভাব বলয়ে থেকে। দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পরেই যে শুধু নিরাপত্তার ব্যাপারটি তারা ধরতে পারবেন, এমনটা হওয়া কারুর জন্যেই মঙ্গলকর হবে না। মিয়ানমারের ভৌগোলিক বাস্তবতা হলো দেশটা বাংলাদেশ ভারত এবং চীনের মাঝে রয়েছে। এই ভৌগোলিক বাস্তবতা থেকে মিয়ানমারের রেহাই পাওয়া সম্ভব না হলেও সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃবর্গের শাসনক্ষমতার বাস্তবতা পরিবর্তিত হতেই পারে। সেই বাস্তবতা পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত বাস্তবতাও যাতে অনিশ্চিত না হয়ে যায়, সেজন্যেই তাদেরকে ঢাকার সাথে সখ্যতা বজায় রেখে চলা উচিৎ।

বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে নিজ ভূখন্ড এবং জনগণকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে দেবার মতো বাস্তবতা মিয়ানমারের থাকা উচিৎ নয়। এই বাস্তবতা মিয়ানমারের জনগণ এবং সেদেশের নেতৃবৃন্দ কারুর জন্যেই মঙ্গলকর নয়। কাজেই সেই বাস্তবতা একইসাথে বর্জনীয় এবং পরিবর্তনীয়। রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের অস্তিত্ব, সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কদের শাসনক্ষমতা এবং তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা শুধুমাত্র বাংলাদেশের ছায়াতলেই রয়েছে।