Saturday 26 September 2020

সৌদি নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ কি?

২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২০
করোনাভাইরাসের মহামারি এবং তেলের বাজারে ধ্বসের কারণে বিন সালমানের ২০৩০ পরিকল্পনা আকাশ কুসুমই মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। দীর্ঘমেয়াদে কেউ কেউ স্বপ্ন দেখলেও তা বর্তমানের কঠিন বাস্তবতাকে ভুলিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতির তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাবার পরিকল্পনা কাগজে কলমে ভালো ঠেকলেও বাস্তবায়ন কঠিন। আরব দেশগুলির ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে এগুবার ফলে জনগণের কাছে সৌদি নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে ঠেকবে। আর এমতাবস্থায় সৌদিরা পশ্চিমাদের সমর্থনের উপরই নির্ভর করতে বাধ্য হবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামন্দার বাস্তবতার মাঝে কোনকিছুই এখন প্রশ্নাতীত নয়। 


করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশ্ব যখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তখন সৌদি আরবের, বিশেষ করে সৌদি নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো দেশটা যে খনিজ তেল বিক্রির উপর নিজেদের অর্থনীতিকে তৈরি করেছে, সেই তেলের বাজারই মহামারির মাঝে ধ্বসে পড়েছে। এর উপর দেশের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক অসন্তোষ সৌদি নেতৃত্বের ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর আঞ্চলিকভাবেও বিভিন্ন ইস্যুতে চাপের মাঝে রয়েছে সৌদিরা, যার মাঝে ইস্রাইলের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের অতি সংবেদনশীল ব্যাপারটাও রয়েছে। সৌদি আরবে প্রাক্তন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম প্যাটি ‘বিবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, সৌদি আরবের নিজস্ব কিছু শক্তিশালী স্তম্ভ রয়েছে, যার উপরে দেশটা টিকে রয়েছে। এর মাঝে একটা হলো তার তেল বিক্রির উপর তৈরি করা রাষ্ট্রীয় ফান্ড, যা কেউ কেউ ধারণা করেন ৩’শ ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে। আর সৌদি তেল কোম্পানি ‘আরামকো’ দেশটার আয়ের স্তম্ভ, যার মূল্যায়ন করা হয়েছে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৭’শ বিলিয়ন ডলারে। এর মাঝে দেড় শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে তারা ২৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তবে উইলিয়াম প্যাটির কথাগুলি সৌদি নেতৃত্বের সমস্যাগুলির সমাধান দেয় না।

সৌদি আরবের অর্থনীতি এখনও তেলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। অর্থনীতিকে তেল থেকে সরাতে যে পরিকল্পনাগুলি সৌদি সরকার করেছে, তা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে করোনাভাইরাস এবং এর ফলশ্রুতিতে তেলের বাজারে মূল্য ধ্বসের কারণে। খরচ কমাবার মাধ্যমে সৌদি সরকার ২৬ বিলিয়ন ডলার বাঁচাতে চাইলেও শুধু মার্চ মাসেই এই পরিমাণ অর্থ তারা হারিয়েছে। সৌদি অর্থমন্ত্রী নিজেই খরচ কমাবার প্রচেষ্টাগুলিকে দেশের মানুষের জন্যে কষ্টকর হবে বলে মন্তব্য করেন। মূল্য সংযোজন কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকারি খরচ কমানো হয়েছে ২২ শতাংশ। সৌদি তেল কোম্পানি ‘আরামকো’র তেল বিক্রির আয় জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝে ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। একই সময়ে সৌদি সরকারের বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাস এবং তেলের মূল্যধ্বস ২০১৬ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘোষিত ২০৩০ প্রকল্পকে ডুবিয়ে দেবার অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সৌদিরা যেসব প্রকল্প নিয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে পঞ্চম জেনারেশনের টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তির উপর নির্ভর ‘নিওম’ নামের হাইটেক শহর, যেখানে ৫’শ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে সৌদিদের। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর এসোসিয়েট ফেলো মাইকেল স্টিফেন্স বলছেন যে, সৌদি আরবের অর্থনীতি এমন এক সমস্যায় পতিত হয়েছে, যা থেকে উঠে দাঁড়াতে যথেষ্ট সময় লাগবে। কঠিন নীতি নেবার কারণে সৌদি আরবের কর্মসংস্থান তৈরিকারীরা সমস্যায় পড়ছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে আরও সমস্যা তৈরি করবে।

তবে কেউ কেউ মনে করছেন যে, সৌদি সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলি রয়েছে, তা তারা উতড়াতে পারবে। বৈরুতের ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি’র দানিয়া কোলাইতাত খতিব সৌদি আরবের ‘আরব নিউজ’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, সামনের দিনগুলিতে প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাঝেই সৌদিদের ভবিষ্যৎ রয়েছে। তবে এই মিশন বেশ শক্ত। কারণ চীনের মতো দেশ যেখানে তিন জেনারেশনে তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে, সৌদিদের সেটা করতে হবে এক জেনারেশনের মাঝেই। এই মুহুর্তে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে জার্মানি বা জাপানের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো মানবসম্পদ সৌদিদের নেই। প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের সৌদি আরবের জনসংখ্যা আরব দেশগুলির মাঝে অপেক্ষাকৃত বেশি হলেও সরকার তাদের খরচের ভার নেবার কারণে তারা রাষ্ট্রের জন্যে একটা বোঝা। ‘নিওম’ হাইটেক শহরে বিদেশীদেরই চাকুরি হবে বেশি। তবে সৌদি আরবের তরুণ জনসংখ্যাকে এক জেনারেশনের মাধ্যমে পরিবর্তন করে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, এক জেনারেশন পরেই ‘এপল’এর মতো হাইটেক কোম্পানিগুলি সৌদি আরবকে উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে মনে করবে।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জের মাঝে রয়েছে সৌদি নেতৃত্ব। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ৩৪ বছর বয়সী বিন সালমান ধীরে ধীরে তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সকলকেই ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছেন; যা কিনা তাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতার অবস্থানে বসিয়েছে। তথাপি তার ক্ষমতা খুব সহজেই হুমকির মাঝে পড়ে যেতে পারে। বিন সালমান তার দেশের জন্যে যেসকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা যদি আগামী পাঁচ বছরের মাঝে দেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতিতে তেমন একটা পরিবর্তন না আনতে পারে, তাহলে সৌদিদের শক্তিশালী নেতৃত্ব রাতারাতিই নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়ে যাবে। সৌদি সরকার ইয়েমেনের যুদ্ধ এবং সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার কারণে পশ্চিমা দেশগুলিতে বেশ ধিকৃত হয়েছে। সৌদি আরবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো নেই বললেই চলে; নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলাও একেবারেই সম্ভব নয়। কিন্তু ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সরবরাহকৃত যুদ্ধাস্ত্রই ব্যবহার করেছে মানবতাবিরোধী অপরাধের পিছনে। সৌদি আরব বৈশ্বিক তেলের বাজারে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী যে, তাকে হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দেয়া একেবারেই সম্ভব নয়। ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মস্কোতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিন সালমানের বড় সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হলেও করোনাভাইরাসের মহামারির শুরুতে তেলের বাজারে ব্যাপক সরবরাহের মাধ্যমে বিন সালমান উভয় দেশের তেল কোম্পানিগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন; যা কিনা ওয়াশিংটন এবং মস্কো কেউই ভালো চোখে দেখেনি। পছন্দ হোক আর না হোক, সৌদি আরব পশ্চিমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুই থাকছে।

করোনাভাইরাসের মহামারি এবং তেলের বাজারে ধ্বসের কারণে বিন সালমানের ২০৩০ পরিকল্পনা আকাশ কুসুমই মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। দীর্ঘমেয়াদে কেউ কেউ স্বপ্ন দেখলেও তা বর্তমানের কঠিন বাস্তবতাকে ভুলিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতির তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাবার পরিকল্পনা কাগজে কলমে ভালো ঠেকলেও বাস্তবায়ন কঠিন। আরব দেশগুলির ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে এগুবার ফলে জনগণের কাছে সৌদি নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে ঠেকবে। আর এমতাবস্থায় সৌদিরা পশ্চিমাদের সমর্থনের উপরই নির্ভর করতে বাধ্য হবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামন্দার বাস্তবতার মাঝে কোনকিছুই এখন প্রশ্নাতীত নয়। 

ইরানের সাথে চীনের কৌশলগত চুক্তির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতখানি?

২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২০
মধ্যপ্রাচ্যে চীনের স্বার্থ অর্থনৈতিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও চীনের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়; কারণ চীনে একটা বড় বাজার এবং চীন বিভিন্ন পণ্যের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য উৎস। কেউই চীনকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছুক নয়। অপরপক্ষে চীনও এই অঞ্চলে ইরান এবং সৌদি গ্রুপের মাঝে দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক সংঘাতে চীনের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাই চীন এখানে সকলকে ব্যালান্স করেই চলতে চাইবে।



সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে বিষয়টা সবচাইতে বেশি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো ইস্রাইলের সাথে আরব দেশগুলির সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। তবে এর মাঝে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পিছনে পড়ে যাচ্ছে, যা হলো ইরানের সাথে চীনের কৌশলগত চুক্তি। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর তেহরান সফরের সময় দুই দেশের মাঝে কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জুলাই মাসে ‘ফাঁস হওয়া’ নথির উপর ভিত্তি করে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলে যে, ২৫ বছর মেয়াদী এই বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে ৪’শ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ইরানের জন্যে নতুন একটা জীবন দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। আর যদিও সেই চুক্তিতে সামরিক ব্যাপারে আলাদাভাবে কিছু বলা ছিল না, ইরানের বিরোধী নেতা ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ এবং তার সমর্থকেরা বলতে থাকেন যে, চুক্তি মোতাবেক ইরান খুব সম্ভবতঃ পারস্য উপসাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বীপ চীনকে লিজ দিতে যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও ‘ফক্স নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ইরানে চীনের বিনিয়োগের কারণে ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের হাতে প্রচুর অর্থ যাবে এবং তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। একসাথে তা ইস্রাইল, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিরাপত্তাকে ব্যাহত করবে। অর্থাৎ ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থীরা উভয়েই ইরানে চীনের বিনিয়োগের বিরোধিতা করছেন।

এই চুক্তির ব্যাপারে বিভিন্ন মিডিয়াতে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা প্রিন্ট’ বলছে যে, সেপ্টেম্বরের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইরানে ছুটে গিয়েছেন এটা নিশ্চিত করতে যে, ইরানে ভারতের চাবাহার সমুদ্রবন্দর প্রকল্প যেন চীনারা ব্যবহার করতে না পারে। ভারত এই প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শেষ করেছে, যার মাঝে ছিল চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন করা। তবে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের মাঝে ছিল চাবাহার থেকে তুর্কমেনিস্তানের সীমানা পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা; যা বাস্তবায়িত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের হুমকির মুখে ভারত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে পারছে না; তাই ইরান চাইছে প্রকল্পটা নিজেরাই এগিয়ে নিতে। ভারতের ভয় হলো, চীনারা এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। ব্যাপারটাকে আরও একধাপ এগিয়ে বৃহত্তর দ্বন্দ্বের অংশ হিসবে বলছেন কেউ কেউ। ‘আয়েল প্রাইস’ পত্রিকার এক লেখায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে, চাবাহার বন্দরে চীন এবং রাশিয়ার সহায়তায় ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। আসলেই কি ইরান এবং চীনের এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে?

‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক ক্যারেন ইয়াং ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের কাছে চীন দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হয়ে উঠছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের উত্থান সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিচ্ছে, এই কথাগুলি প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃবৃন্দের উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তাদেরকে হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকতে হবে, নতুবা চীনের সাথে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনেকে পুরোপুরি বাদ দেয়াটা একেবারেই অবাস্তব। তিনি বলছেন যে, চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর বিনিয়োগ প্রতিটা দেশই পেতে চাইছে; এবং ‘বিআরআই’এ যুক্ত হতে গিয়ে অঞ্চলিক একটা প্রতিযোগিতাও দেখা যেতে পারে। চীন এই প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থানে নেই; কিন্তু এটাকে বাইপাস করার পদ্ধতিও সে জানে না।

ভারতীয় মিডিয়া ‘স্ট্রাটেজিক নিউজ গ্লোবাল’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি’র ডিরেক্টর কামরান বোখারি বলেন যে, ইরানের সাথে চীনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের একটা দরকষাকষির সুযোগ করে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, মার্কিন পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় সৌদি আরবে চীনা পারমাণবিক বিনিয়োগের ব্যাপারে রিপোর্ট করে মার্কিন জনমতকে চীনের বিপক্ষে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছে। একই সুরে ইরানে চীনের বিনিয়োগ বা লাদাখে ভারতের সাথে সীমান্ত দ্বন্দ্ব যে মার্কিন স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে, তা কেউ কেউ মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। তবে কামরান বোখারি বলছেন যে, চীনের এই বিনিয়োগগুলিকে তাদের ‘বিআরআই’এর অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। চীনারা পাকিস্তানে বড় বিনিয়োগ করছে, এবং একইসাথে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতেও বিনিয়োগ করছে। চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে অত্র অঞ্চল যদি স্থিতিশীল থাকে, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়। অর্থাৎ চীনা অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের অখুশি থাকার কথা নয়। তবে একইসাথে তিনি এও বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে দীর্ঘ মেয়াদে অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাব অনেক বেড়ে যাক।

মধ্যপ্রাচ্যে চীনের স্বার্থ অর্থনৈতিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও চীনের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়; কারণ চীনে একটা বড় বাজার এবং চীন বিভিন্ন পণ্যের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য উৎস। কেউই চীনকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছুক নয়। অপরপক্ষে চীনও এই অঞ্চলে ইরান এবং সৌদি গ্রুপের মাঝে দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক সংঘাতে চীনের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাই চীন এখানে সকলকে ব্যালান্স করেই চলতে চাইবে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন উপস্থিতি কমে যাবার কারণে বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ইরানে চীনের বিনিয়োগকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিস্থাপন বা আঞ্চলিক হুমকি বলে দেখাতে চাইছে। একদিকে ওয়াশিংটনের কট্টরপন্থীরা যেমন চাইছে ব্যাপারটাকে আলোচনায় এনে চীনের বিরুদ্ধে শক্তি জড়ো করতে, অন্যদিকে ইরানের কট্টরপন্থীরা চাইছে এই চুক্তিকে জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়ে তেহরানের বর্তমান সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে স্বল্প মেয়াদে চিন্তিত নয়; কারণ অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে চীনা প্রভাব বৃদ্ধিকেও সে দেখতে চায় না।



Friday 25 September 2020

ফ্রান্সের পশ্চিম আফ্রিকায় রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াচ্ছে তুরস্ক

২৫শে সেপ্টেম্বর ২০২০

তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির অভ্যুত্থানকারীদের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। মালির অভ্যুত্থানের পিছনে তুরস্কের হাত রয়েছে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করাটা সুদূরপ্রসারী। তবে যেহেতু মালির ক্ষমতাসীন অভ্যুত্থানকারীরা ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার কোন বার্তা দেয়নি; বরং ফরাসী বিরোধী কথাবার্তাই তারা বলেছে। তুরস্ক খুব সম্ভবতঃ এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছে না। বিশেষ করে মালিসহ পশ্চিম আফ্রিকায় যুদ্ধাবস্থার পিছনে অনেকেই যখন ফ্রান্সকে দায়ী করছে, তখন অত্র অঞ্চলে একটা শক্তির শূণ্যতা তৈরি হয়েছে।

গত ৯ই সেপ্টেম্বর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি সফর করেন। সফরকালে তিনি বলেন যে, মালি সর্বদাই তুরস্কের বন্ধু এবং ভাইয়ের মতো। তুরস্ক মালির কঠিন সময়েও মালির জনগণের পাশে থেকেছে। তিনি বলেন যে, তিনি মালির বর্তমান ‘কঠিন সময়েই’ দেশটাতে সফর করতে চেয়েছিলেন। মালির স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা তুরস্কের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি। গত ১৮ই অগাস্ট মালিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটাতে তুরস্কের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিবিদের সফর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কাভুসোগলু মালির অভ্যুত্থানকারীদের তৈরি করা ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর দ্যা স্যালভ্যাশন অব দ্যা পিপল’এর নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। মালিতে শান্তিরক্ষা করার জন্যে তুরস্কের সমর্থন ছাড়াও এই মিশনে অর্থায়নের কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। এছাড়াও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর তুরস্ক মালিতে ‘এন৯৫’ মাস্ক এবং ভেন্টিলেটর সরবরাহ করেছে। মালির পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে তুরস্ক সকল সহায়তা দেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক ‘আল মনিটর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মালির এমন পরিস্থিতিতে কাভুসোগলুর সফরের কারণে কেউ কেউ মনে করছেন যে, বর্তমানে ফ্রান্স এবং তুরস্কের মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব মালির অভ্যুত্থানে কোন ভূমিকা রেখেছিল কিনা।

‘আল মনিটর’ বলছে যে, মালির অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে মালির রাস্তায় বিক্ষোভকেই সামনে আনতে হবে। এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মালির ইসলামিক নেতা মাহমুদ ডিকো। মালির ইসলামিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শহর তিমবুকতু থেকে আসা ডিকো সৌদি আরবের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মদিনা থেকে পড়াশোনা করেছেন। সৌদি আরবে পড়াশোনার কারণে ডিকোকে ফরাসীরা ওয়াহাবি চিন্তার লোক বলেই মনে করে এবং জিহাদিদের সাথে যোগসাজস আছে বলে সন্দেহের চোখে দেখেছে। ডিকো ২০১২ সালে মালিতে ফরাসী হস্তক্ষেপের বিরোধিতা না করলেও পরবর্তীতে তার অবস্থান পাল্টে ফেলে মালির সমস্যার জন্যে ফ্রান্সকে দায়ী করতে শুরু করেন। কিন্তু ডিকোর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক কোথায়? প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুরস্কের ‘ন্যাশনাল আউটলুক মুভমেন্ট’এর সাথে ডিকোর সম্পর্ক রয়েছে। ‘ন্যাশনাল আউটলুক মুভমেন্ট’ বা ‘মিল্লি গাইয়ুশ’ ১৯৬৯ সালে তুর্কি রাজনীতিবিক এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেকমেত্তিন এরবাকান তৈরি করেছিলেন। প্রথমে এই সংস্থার কর্মকান্ডে ইসলাম খুব কম আসলেও পরবর্তীতে তুর্কি সরকার বিভিন্ন দেশে তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধি করতে ইসলামিক আবেদনকে ব্যবহার করা শুরু করে। মালির রাজধানী বামাকোতে তুরস্কের ‘ডিরেক্টোরেট অব রিলিজিয়াস এফেয়ার্স’ বা ‘দিয়ানেট’এর উদ্যোগে ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ইউরো খরচে ‘আইয়ুব সুলতান মসজিদ’ তৈরি করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মসজিদটা উদ্বোধন করেন দিয়ানেটের প্রেসিডেন্ট মেহমেত গোরমেজ। উদ্বোধনের সময় ‘সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিল অব মালি’র চেয়ারম্যান মাহমুদ ডিকো উপস্থিত ছিলেন। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, মসজিদের জন্যে জমি জোগান দেয়ার পিছনে ডিকোর ভূমিকা ছিল। তবে মালির অভ্যুত্থানের পিছনে তুরস্কের হাত রয়েছে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করাটা সুদূরপ্রসারী। অভ্যত্থানকারীদের নেতা কর্নেল আসিমি গোইতা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ফ্রান্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। আরও দু’জন নেতা সাদিও কামারা এবং মালিক দিয়াও রাশিয়াতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অভুত্থানকারীদের সহায়তা দেয়া অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ফান্তা মাদি দেমবেলের সাথে জার্মানির গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

মালিতে তুরস্কের দূতাবাস স্থাপিত হয় ২০১০ সালে। ২০১৮ সালে মালির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুবাকার কেইতা তুরস্ক ভ্রমণ করেন। তবে মালিতে এখনও তুরস্কের চাইতে ফ্রান্সের প্রভাবই বেশি বলে বলছে ‘আল মনিটর’। দেশটার নিরাপত্তার পিছনে তুরস্কের বিনিয়োগ একেবারেই তুচ্ছ। মালিতে ১৩ হাজার জাতিসংঘ সেনা রয়েছে; রয়েছে ৫ হাজার ১’শ ফরাসী সেনা। তুরস্কের সেখানে রয়েছে মাত্র দু’জন পুলিশ অফিসার! জাতিংঘের ‘কমট্রেড’এর হিসেবে ২০১৭ সালে মালি যেখানে তুরস্ক থেকে আমদানি করছে ৪৫ লিমিয়ন ডলারের পণ্য, সেখানে ফ্রান্সের কাছ থেকে আমদানি করছে ৩’শ ৪২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। তবে মালির ক্ষমতাসীন অভ্যত্থানকারীরা ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার কোন বার্তা দেয়নি; বরং ফরাসী বিরোধী কথাবার্তাই তারা বলেছে। তুরস্ক খুব সম্ভবতঃ এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছে না। বিশেষ করে মালিসহ পশ্চিম আফ্রিকায় যুদ্ধাবস্থার পিছনে অনেকেই যখন ফ্রান্সকে দায়ী করছে, তখন অত্র অঞ্চলে একটা শক্তির শূণ্যতা তৈরি হয়েছে। 

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মালির রাজধানী বামাকোতে ‘আইয়ুব সুলতান মসজিদ’ মসজিদ উদ্বোধন করেন তুরস্কের দিয়ানেটের প্রেসিডেন্ট মেহমেত গোরমেজ। উদ্বোধনের সময় ‘সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিল অব মালি’র চেয়ারম্যান মাহমুদ ডিকো উপস্থিত ছিলেন। মালির অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে মালির রাস্তায় বিক্ষোভকেই সামনে আনতে হবে। এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মালির ইসলামিক নেতা মাহমুদ ডিকো।


দিয়ানেট, টিকা এবং অন্যান্য তুর্কি সংস্থার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার

তদুপরি এটা নিশ্চিত যে, তুর্কিরা দিয়ানেটের মাধ্যমে আফ্রিকাসহ বিশ্বব্যাপী তুরস্কের প্রভাবকে প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। গত বছরের অক্টোবরে দিয়ানেটের উপপ্রধান সেলিম আরগুন ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে দেয়া এক সাক্ষাতে বলেন যে, আফ্রিকার দেশগুলিতে দিয়ানেটের কর্মকান্ডকে স্বাগত জানানো হচ্ছে; কারণ এই কর্মকান্ড পুরোপুরিভাবে মানবতা এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত। আফ্রিকাতে তুরস্কের কোন সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস বা গোপন উদ্দেশ্য নেই। দিয়ানেটের কর্মকান্ডকে তিনি মিশনারি কর্মকান্ড থেকে আলাদা করে বলেন, ইউরোপিয় বিভিন্ন সংস্থা এবং এনজিও যখন মুসলিম দেশগুলিতে কাজ করতে যায়, তখন জনগণ সন্দেহের চোখে দেখে। তুরস্কের কর্মকান্ডকে মানুষ সেভাবে দেখে না।

অক্টোবরে আফ্রিকার ধর্মীয় নেতৃবৃন্দদের নিয়ে ইস্তাম্বুলে তৃতীয়বারের মতো হয়ে যায় ‘আফ্রিকান মুসলিম রিলিজিয়াস লিডার্স’ শীর্ষ বৈঠক। এতে আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন সরকারের ধর্ম মন্ত্রীরা সহ একশ’রও বেশি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি অংশ নেয়। এর মাধ্যমে তুর্কিরা ইসলামকে নিয়ে তাদের নিজেদের চিন্তাধারাগুলিকেই আফ্রিকার সামনে উপস্থাপন করে; যেকারণে এই অনুষ্ঠানটা প্রতিবছর ইস্তাম্বুলে করার পরিকল্পনা রয়েছে; আফ্রিকার মাটিতে নয়। দিয়ানেটের ওয়েবসাইটে এই বৈঠকের এজেন্ডাসমূহের একটা তালিকা দেয়া হয়; যার মাঝে ছিল আফ্রিকার ছাত্রদেরকে তুরস্কের ইসলামিক কারিকুলামের স্কুলগুলিতে এবং সাতটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্যে স্কলারশিপের সুযোগ বৃদ্ধি। ‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দিয়ানেট বিশ্বের ১’শ ১১টা দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের তুরস্কে পড়াশোনার সুযোগ করে দিচ্ছে এবং ১৩টা দেশে মোট ২৫টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। তুরস্কের কারাবুকে ৮ হাজারের বেশি আফ্রিকার শিক্ষার্থী শিক্ষা নিচ্ছে বলে বলছেন দিয়ানেটের সেলিম আরগুন।

দিয়ানেট ছাড়াও আফ্রিকায় কাজ করছে তুরস্কের অন্যান্য সংস্থা। ‘তুর্কস এব্রড এন্ড রিলেটেড কমিউনিটিজ’ বা ‘ওয়াইটিবি’ আরেকটা সংস্থা, যা কিনা ২০১৮ সালে ১১ হাজারেরও বেশি আফ্রিকানের জন্যে তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। গতবছরের জুলাই মাসে তুরস্কের কৃষি ও বন মন্ত্রী বলেন যে, আফ্রিকায় দিয়ানেট, ‘টারকিশ কোঅপারেশন এন্ড কোঅরডিনেশ এজেন্সি’ বা ‘টিকা’ এবং আরও অন্যান্য সংস্থা এবং এনজিও ৫’শ ৫টা পানির কূপ খনন করেছে। এর মাঝে সবচাইতে বেশি ২’শ ৫৮টা কূপ খনন হয়েছে নিজেরএ; মৌরিতানিয়াতে ১’শ ২টা; বুরকিনা ফাসোতে ৮৪টা; মালিতে ৩৬টা; সোমালিয়াতে ২০টা; সোমালিল্যান্ডে ৫টা। এর মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের ১৮ লক্ষ মানুষের পানির সংকুলান হবে বলে বলছেন তারা। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ‘টিকা’ আফ্রিকায় ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। টিকার ওয়েবসাইটে আফ্রিকায় টিকার ২১টা অফিস দেখানো হয়েছে; যার মাঝে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় গিনি, গাম্বিয়া, সেনেগাল, নিজের, ক্যামেরুন এবং শাদএ অফিস রয়েছে। এসব এলাকায় হাসপাতাল এবং স্কুল নির্মাণ ছাড়াও বিভিন্ন কৃষি প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছে টিকা। বিভিন্ন দেশে শরণার্থীদের সহায়তার কাজটাও তুর্কি সরকারের পক্ষে টিকাই করে। বর্তমানে করোনা মহামারি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশে মেডিক্যাল সহায়তা দিচ্ছে টিকা।

তুর্কিরা তুর্কি ভাষা এবং সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে তৈরি করে ‘ইউনুস এমরে ইন্সটিটিউট’; আফ্রিকাতে যার অফিস রয়েছে সেনেগাল, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, তিউনিসিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া এবং মিশরে। এছাড়াও রয়েছে ‘টারকিশ মারিফ ফাউন্ডেশন’। ২০১৬ সালে স্থাপিত এই সংস্থা বিশ্বব্যাপী ৪৩ দেশে ৩’শ ৩৩টা স্কুল চালায়; যার মাঝে ২৩টা দেশই আফ্রিকার। এর মাধ্যমে তুরস্কের সহায়তায় পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষাও পায়। টারকিশ এয়ারলাইন্স তুরস্কের পতাকা নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। মোট ১’শ ২৪টা দেশের ৩’শ ১১টা গন্তব্যে বিমান পরিচালনা করছে তারা। ২০১৮ সালে তুরস্কে ৪ কোটি মানুষ ভ্রমণ করে; যার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো টারকিশ এয়ারলাইন্স। আফ্রিকার ৫৬টা গন্তব্যে যাচ্ছে এই এয়ারলাইন্স; এর মাঝে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় রয়েছে ২১টা। আফ্রিকাতে শুধুমাত্র ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সই টারকিশ এয়ারলাইন্সএর চাইতে বেশি গন্তব্যে যায় বলে বলেন সংস্থাটার কর্মকর্তা টুনচায় এমিনোগলু। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সালের মাঝে আফ্রিকাতে তাদের যাত্রীসংখ্যা প্রায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সাংবাদিকদের বলেন তিনি।

‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, তুরস্কের আফ্রিকা নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে ১৯৯৮ সাল থেকে। ২০০৫ সালকে তুরস্ক ‘ইয়ার অব আফ্রিকা’ বলে আখ্যা দেয়। ২০০৮ সাল থেকে তুরস্ক আফ্রিকান ইউনিয়নের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। একই বছরে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ‘তুর্কি আফ্রিকা কোঅপারেশন সামিট’; যেখানে আফ্রিকার ৫০টা দেশ থেকে প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিল। ২০০৯ সালে যেখানে আফ্রিকার ১২টা দেশে তুরস্কের দূতাবাস ছিল, সেখানে এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২এ। দিয়ানেটের উদ্যোগে প্রথম ‘আফ্রিকান মুসলিম রিলিজিয়াস লিডার্স’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। দ্বিতীয় বৈঠক হয় ২০১১ সালে। মালি ছাড়াও দিয়ানেট আফ্রিকার দেশ জিবুতি, ঘানা, বুরকিনা ফাসো এবং শাদে মসজিদ নির্মাণ করেছে। দিয়ানেট বিভিন্ন ভাষায় ইসলামিক নিয়মকানুনের প্রকাশনা চালায়, যেখানে বিভিন্ন ভাষায় ইসলামিক গ্রন্থ অনুবাদও করা হয়। 


ফ্রান্সের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে তুরস্কের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে

সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকাকে তুরস্ক তার পরিবর্তিত নীতিতে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে, তা তুর্কি নেতৃবৃন্দের সফরসূচি দেখলেই বোঝা যাবে। শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীই নয়, প্রেসিডেন্ট এরদোগানও বেশ কয়েকবার আফ্রিকা সফর করেছেন। ২০১৪ সালে উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা; ২০১৫ সালে পূর্ব আফ্রিকা; ২০১৬ সালে আলাদাভাবে পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকা; ২০১৭ সালে আবারও পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকা দু’বার; ২০১৮ সালে উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা এবং আলাদাভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০২০ সালে উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ করেন তিনি। যে দেশগুলিতে তিনি ভ্রমণ করেছেন, তার মাঝে অনেকগুলি দেশই প্রাক্তন ফরাসী উপনিবেশ এবং সেখানে ফরাসীদের প্রভাব যথেষ্ট। এরদোগানের ভ্রমণ করা ১১টা প্রাক্তন ফরাসী উপনিবেশের মাঝে রয়েছে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, জিবুতি, সেনেগাল, আইভোরি কোস্ট, গিনি, মাদাগাস্কার, শাদ, মৌরিতানিয়া, মালি। এর মাঝে তিনি আলজেরিয়া এবং সেনেগালে ভ্রমণ করেন তিনবার করে। প্রতিটা দেশের সাথে তুরস্ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দাতব্য কর্মকান্ড নিয়ে চুক্তি করেছে। তবে এর মাঝে রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালীকরণ এবং নিরাপত্তা ইস্যুকেন্দ্রিক চুক্তি স্বাক্ষর খুব বেশি দেশের সাথে হয়নি। তবে এই অংশটাই প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

সেনেগাল

কাভুসোগলু সেনেগালে তুরস্কের নতুন দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শিক্ষা এবং সংস্কৃতি বিষয়ে দুই দেশের মাঝে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে সেনেগাল থেকে তুরস্কে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়। সেনাগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদু বা বলেন যে, এখন দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য প্রায় আড়াই’শ মিলিয়ন ডলার; যা তিনি ৪’শ মিলিয়নে নিয়ে যাবার আশা করেন। তুর্কিরা সেনেগালে তাদের অবস্থানকে আরও আগে থেকেই শক্তিশালী করতে শুরু করেছে। এবছরের জানুয়ারিতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান সেনেগাল সফর করে আসেন। এর আগে ২০১৬ এবং ২০১৮ সালেও তিনি সেনেগাল সফর করেন। সেখানে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন কাজে তুর্কিরা অংশ নিচ্ছে; সেখানে তারা বিভিন্ন স্কুলও চালাচ্ছে। ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, ২০২২ সালের ইয়ুথ অলিম্পিক গেমসকে টার্গেট করে তুর্কি কন্সট্রাকশন কোম্পনিগুলি সেখানে একটা অলিম্পিক পুল, ৫০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার একটা স্টেডিয়াম এবং একটা হোটেল নির্মাণ করছে। তুর্কি কোম্পানিগুলি সেখানে সাড়ে ৭’শ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ২৯টা প্রকল্প পেয়েছে। তুর্কি কোম্পানি ‘সুম্মা’ রাজধানী দাকারে ‘দাকার এরেনা’, ‘দাকার এক্সপো সেন্টার’ এবং ‘দাকার ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার’ নামে তিনটা বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই কোম্পানিটা ‘লিমাক’ নামে আরেক তুর্কি কোম্পানিকে সাথে নিয়ে ‘ব্লেইজ দিয়েইন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ২০১৬ সালে তুর্কি কোম্পানি ‘ইয়াপি মারকেজি গ্রুপ’ ফরাসী এবং সেনেগালের কোম্পানির সাথে যৌথভাবে দাকার থেকে নতুন বিমানবন্দর পর্যন্ত রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ পায়। ২০১৮ সালে তুর্কি কোম্পানি ‘তোসইয়ালি’ সেনেগালে ২ বিলিয়ন ডলারের একটা স্টিল মিলে বিনিয়োগ করে। এরদোগান দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার ব্যাপারে আশাবাদী। এরদোগানের সফরের সময়ে দুই দেশের মাঝে মোট ৭টা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; যার মাঝে প্রতিরক্ষা চুক্তিও ছিল। সেনেগাল ইতোমধ্যেই তুরস্ক থেকে ২৫টা ‘এজদার ইয়ালসিন’ আর্মার্ড ভেহিকল এবং ৪টা ‘এজদার তোমা’ রায়ট কন্ট্রোল ভেহিকল কিনেছে। ‘ডেইলি সাবাহ’ সেনাগালে তুরস্কের বড় বিনিয়োগের ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, সেনেগাল এবং আইভোরি কোস্ট পশ্চিম আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত দেশগুলির সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছাবার পথ। এছাড়াও সেনেগালের সমুদ্র উপকূলে হাইড্রোকার্বন রিজার্ভের খোঁজ পাওয়ায় দেশটার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। তুর্কি মারিফ ফাউন্ডেশনের ১৩টা স্কুল রয়েছে সেনেগালে। ৫০ জন সেনেগালি ছাত্র তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ছে বলে বলেন এরদোগান। টারকিশ এয়ারলাইন্স দাকারে ৮টা প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট এবং ৪টা কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করে। টিকা এবং ইউনুস এমরে ইন্সটিটিউটএর অফিসও রয়েছে সেনেগালে।

গাম্বিয়া

এরদোগান জানুয়ারির একই সফরে সেনেগালের প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ গাম্বিয়াও সফর করেন। ২০১১ সালে সেখানে তুরস্কের দূতাবাস স্থাপন করা হয়। দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ২০১৯ সালে ৫৫ মিলিয়ন ডলার পৌঁছে। গাম্বিয়াতে তুরস্কের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ হলো একটা ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তুর্কি কোম্পানি ‘কারপাওয়ারশিপ’ ২০১৮ সাল থেকে গাম্বিয়াতে ৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটা ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করছে; যা কিনা গাম্বিয়ার ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

নিজের

কাভুসোগলু নিজের সফরে গিয়ে বলেন যে, তার দেশ নিজেরএর পরিবহণ, কন্সট্রাকশন, জ্বালানি, খনিজ এবং কৃষিক্ষেত্রে অবদান রাখতে চায়। কাভুসোগলু নিজেরএর প্রেসিডেন্ট ইসুফু মোহামাদুর সাথে সাক্ষাতে লিবিয়া এবং মালিতে সংঘাত, এবং সেকারণে নিজেরএর নিরাপত্তা ব্যাহত হবার ব্যাপারটা আলোচনা করেন। দুই দেশের মাঝে নিরাপত্তা এবং সামরিক ইস্যুতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা নিয়ে ‘দ্যা নিউ খালিজ’ বলছে যে, এর মাধ্যমে লিবিয়ার দক্ষিণের প্রতিবেশী নিজেরএ তুরস্কের একটা খুঁটি স্থাপিত হলো। ২০১৩ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজের সফর করে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের সূচনা করেন।

আইভোরি কোস্ট

পশ্চিম আফ্রিকার দ্বার হিসেবে খ্যাত আইভোরি কোস্ট সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় পার করছে। দেশটা সবসময়েই ফ্রান্সের গুরুত্বপূর্ণ একটা বন্ধু রাষ্ট্র। ২০০৯ সালে সেদেশে তুরস্কের দূতাবাস খোলা হয়। ২০১৫ সালের মার্চে আইভোরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট আলাসানে উয়াত্তারা তুরস্ক সফর করেন; আর পরের বছর তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান আইভোরি কোস্ট সফর করেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন যে, তুরস্ক আইভোরি কোস্টকে চারটা সেক্টরে সহায়তা করতে চায়; যার মাঝে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার এবং নিরাপত্তা। সফরকালে এরদোগান দুই দেশের মাঝে বাণিজ্যকে ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, যা তখন ছিল ৪’শ মিলিয়নের নিচে। বিনিয়োগ, ঔষধ, তথ্য প্রযুক্তি, টেলিকমিউনিকেশন ছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্পের ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। প্রতিরক্ষা শিল্পের চুক্তি তুরস্কের পার্লামেন্টে ২০২০এর ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদিত হয়; যার মাঝে ছিল শিল্প উৎপাদন, ক্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট, তথ্য আদানপ্রদান এবং গবেষণা।

মৌরিতানিয়া

সেনেগালের পার্শ্ববর্তী দেশ মৌরিতানিয়া সেনেগালে তুর্কি বিনিয়োগ দেখে তার সাথে নিজেরাও যোগ হতে চাইছে। এবছরের জানুয়ারি মাসে মৌরিতানিয়ার পরিবহণ মন্ত্রী মোহামেদু মোহাইমিদ সেদেশে তুর্কি রাষ্ট্রদূত চেম কায়াওগলুর সাথে কথা বলতে গিয়ে মৌরিতানিয়ার পরিবহণ সেক্টরে তুর্কিদের বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ২০১৮ সালে মৌরিতানিয়া সফর করেছিলেন। মৌরিতানিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হচ্ছে সেদেশের উপকূল থেকে সার্দিনেলা মাছ আহরণ করে কারখানায় প্রসেস করে তা থেকে মাছের খাদ্য তৈরি করা, যা কিনা বিশ্বব্যাপী মাছ চাষের জন্যে ব্যবহৃত হয়। সেনেগাল এবং গাম্বিয়াতেও এই শিল্প রয়েছে। তুরস্ক মৌরিতানিয়াতে এই শিল্পে বিনিয়োগ করেছে এবং উপকূলে মাছ ধরার ট্রলার অপারেট করছে।

গিনি বিসাউ

তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলু তার এবারের পশ্চিম আফ্রিকা সফরে মালি থেকে গিনি বিসাউ ভ্রমণ করেন। গিনি বিসাউতে তুর্কি মারিফ ফাউন্ডেশনের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় স্কুল পরিচালনার বিষয়ে। গিনি বিসাউএর কূটনীতিবিদদেরকে তুর্কিরা অনলাইন ট্রেনিং দেবে বলে বলা হয়। পরিবহণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে টারকিশ এয়ারলাইন্স গিনি বিসাউকে তাদের গন্তব্যের মাঝে নেবার চেষ্টা করবে। গিনি বিসাউএর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজি কারলা বারবোসা বলেন যে, তার দেশ অবকাঠামো উন্নয়নে তুরস্কের বিনিয়োগ আশা করে। সফরের সময় কাভুসোগলুকে গিনি বিসাউএর ‘ন্যাশনাল অর্ডার’ পুরষ্কার দেয়া হয়।

টোগো

গত জুলাই মাসে কাভুসোগলু টোগোতে যান এবং সেখানে তুরস্কের একটা দূতাবাস খোলার পরিকল্পনার ঘোষণা দেন।টোগোতে তুর্কিরা স্কুল পরিচালনা করছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দেশটাকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তুর্কি এজেন্সি টিকা। টোগোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট দুসে আশা করেন যে, টারকিশ এয়ারলাইন্স টোগোর রাজধানী লোমেকে তাদের নেটওয়ার্কে যুক্ত করবে।

ইকুয়েটোরিয়াল গিনি

কাভুসোগলু গিনি উপসাগরের ছোট্ট দ্বীপ দেশ ইকুয়েটোরিয়াল গিনিও সফর করেন। প্রাক্তন স্প্যানিশ উপনিবেশ এই দেশ তেল খনির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে এরদোগানও এখানে আসেন। কাভুসোগলু রাজধানী মালাবোতে নতুন তুর্কি দূতাবাস উদ্বোধন করেন। কাভুসোগলু বলেন যে, তুর্কি কোম্পানি ‘সুম্মা’ এখানকার ‘কনগ্রেশনাল সেন্টার’ ভবন তৈরি করেছে এবং ভবিষ্যতেও তুর্কি কোম্পানিগুলিকে কাজ পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে অনুরোধ করেন তিনি। তিনি বলেন যে, দুই দেশের মাঝে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পশ্চিম আফ্রিকার সাথে তুরস্কের সম্পর্কোন্নয়ের ব্যাপারটা শুধু অর্থনৈতিক লাভের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং ভবিষ্যতে তা নিরাপত্তার দিকেও ধাবিত হবে। সোমালিয়াতেও তুরস্ক প্রথমে অর্থনৈতিক কারণেই গিয়েছিল। ধীরেধীরে সেখানে বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে যায় তারা। এরপর একসময় সোমালিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্যে একটা সামরিক ঘাঁটিও তৈরি করে তারা। তবে তুরস্ক এখনও অর্থনৈতিক কারণেই আফ্রিকায় যেতে চায়; কারণ তুরস্ক খনিজ সম্পদে একেবারেই সমৃদ্ধ নয়।

রাজনীতি এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে পশ্চিম আফ্রিকায় তুরস্ক

মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম গত জুনে তুর্কি মার্কিন বিজনেস কাউন্সিলের এক আলোচনায় বলেন যে, তিনি সবচাইতে বেশি খুশি হবেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক একত্রে আফ্রিকায় কাজ করে। করোনাভাইরাসের মহামারির মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে একটা দাবি উঠেছে, যাতে চীনা পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চললেও চীনের বিকল্প খুঁজতে এক্ষেত্রে তুরস্ককে আফ্রিকাতে পার্টনার হিসেবে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি’র ফেলো মেহমেত ওজকান লন্ডনভিত্তিক ‘মিডলইস্ট আই’এর এক লেখায় বলেন যে, লিবিয়ার যুদ্ধে জড়াবার পর থেকে আফ্রিকায় তুরস্কের অবস্থানে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এর আগে দিয়ানেট বা টিকা বা টারকিশ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে আফ্রিকায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তার হলেও এখন এর মাঝে রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা যুক্ত হয়েছে। যেমন সোমালিয়ার সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সাথেসাথে সেখানে তুরস্ক তার রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার স্বার্থকে এগিয়ে নিয়েছে। একই কৌশল পশ্চিম আফ্রিকায় মালি এবং নিজেরএর ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে। তবে তুরস্কের পশ্চিম আফ্রিকা কৌশল এখনও আকার নিচ্ছে মাত্র। এর মাধ্যমে তুরস্কের সাথে ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব আরও গভীর হবে। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাঝে অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ইতালি এবং স্পেনের সাথে নিরাপত্তা এবং অভিবাসী ইস্যুতে তুরস্কের ঐক্য হতে পারে। মোটকথা, সামনের দিনগুলিতে অত্র এলাকায় তুরস্কের নীতি নিয়ে আরও অনেক কথা হবে। তবে যে ব্যাপারটা সিনেটর গ্রাহাম বা মেহমেত ওজকান এড়িয়ে গেছেন তা হলো, ফরাসী প্রভাবের পশ্চিম আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক ঐকমত্য হলে সেটা ফ্রান্সের স্বার্থের সাথে যাবে কিনা। অন্যকথায়, যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা নীতি কি ফ্রান্সের স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক? একই সূত্রে প্রশ্ন করা যায় যে, পশ্চিম আফ্রিকায় তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের ফসল কি তুরস্কের ঘরে উঠবে, নাকি অন্য কারও ঘরে?

Saturday 19 September 2020

গ্রীস ও তুরস্কের দ্বন্দ্ব ইউরোপিয়দের শক্তি প্রদর্শনেরই ফলাফল

১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২০
গ্রীকরা তাদের স্বাধীনতা পেতে ইউরোপিয়দের উপর নির্ভর করেছিল; তুরস্কের সাথে যেকোন সম্ভাব্য যুদ্ধে গ্রীস তাদের সহায়তাই চাইবে। ইউরোপিয় মধ্যস্ততায় তুর্কিদের সাথে গ্রীসের আলোচনা শক্তি ব্যবহারের পথে বাধাগুলিকেই দেখিয়ে দেয়। গ্রীস তৈরি হবার পর সীমানা নির্ধারণের যে আইনগুলিকে তুরস্ক মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই আইন অমান্য করাটাই এখন জাতিরাষ্ট্র তুরস্কের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। 



১৮ই সেপ্টেম্বর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ঘোষণা দেন যে, তুরস্ক প্রস্তুত রয়েছে গ্রীসের নেতৃত্বের সাথে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল গ্যাস আহরণকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা প্রসমণে আলোচনা করতে। গত কয়েক মাস ধরেই ন্যাটোর দুই সদস্য প্রতিবেশী এই দেশগুলি দ্বন্দ্বের উপর ভরত করে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ঘনঘন সামরিক মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে এরদোগান বলেন যে, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দুই পক্ষ কি নিয়ে আলোচনা করবে এবং কোন কাঠামোর মাঝে এই আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন যে, তিনি মধ্যস্ততাকারী দেশগুলিকে জানিয়েছেন যে, দুই দেশের মাঝে সুসম্পর্ক থাকলে আলোচনা হতে পারে। ভিডিওকনফারেন্সিংএর মাধ্যমে বা তৃতীয় কোন দেশে এই আলোচনা হতে পারে। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, দুই দেশের মাঝে গত মাস থেকে উত্তেজনা শুরু হয়, যখন তুরস্ক তার সার্ভে জাহাজ ‘ওরুচ রাইস’কে গ্রীক দ্বীপ কাস্তেলোরিতসোর কাছাকাছি সমুদ্রের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে নৌবাহিনীর প্রহরায় পাঠায়। এক মাস সমুদ্রে কাজ করার পর গত ১৩ই সেপ্টেম্বর জাহাজটা বন্দরে ফিরে যায় মেইনটেন্যান্স এবং জ্বালানির জন্যে। এরদোগান বলেন যে, যদি ‘ওরুচ রাইস’কে তুরস্ক বন্দরে ফেরত নিয়ে আসে, তাহলে নিশ্চয়ই এর একটা অর্থ রয়েছে। তুরস্ক চাইছে আলোচনাকে একটা সুযোগ দিতে। তবে জাহাজটার মিশন শেষ হয়ে গিয়েছে, এটা বলা যাবে না। এরদোগানের কথাগুলি এমন সময়ে এলো, যখন তুর্কি এবং গ্রীক সামরিক নেতৃবৃন্দ ন্যাটোর মধ্যস্ততায় ব্রাসেলসে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। চেক রাজধানী প্রাগে গ্রীসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস দেনদিয়াস বলেন যে, তুরস্ক তার উস্কানিমূলক কর্মকান্ড থামালে গ্রীস অবশ্যই তুরস্কের সাথে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। তবে তুরস্কের ড্রিলিং জাহাজ ‘ইয়াভুজ’ অক্টোবরের ১২ তারিখ পর্যন্ত সাইপ্রাসের অদূরে ড্রিলিংএর কাজ চালিয়ে যাবে, যদিও ইউরোপিয়রা এই কাজের ঘোর বিরোধী। তুরস্ক কেনই বা শক্তি প্রদর্শনের পথে এগুলো এবং কেনইবা আবার আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হলো?

তুরস্কের সাথে গ্রীসের এই দ্বন্দ্বে ফ্রান্স ইতোমধ্যেই গ্রীসের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমান প্রেরণ করেছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলিও তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধের হুমকি দিচ্ছে। গ্রীসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেনদিয়াস বলছেন যে, গ্রীস চাইছে তাদের ইইউএর বন্ধুরা তুরস্কের বিরুদ্ধে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হবে, সেটার একটা খসরা তৈরি করুক, যা কিনা তুরস্কের জন্যে একটা উদাহরণ হিসেবে থাকবে যে, বেআইনী কাজ করলে কি ধরনের অবরোধ আসতে পারে। তবে অপরদিকে এরদোগান বলছেন যে, তুরস্ককে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করতে ব্যর্থ হবার পরই গ্রীস আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। তুরস্কের উপর সকল হুমকি বিফল হয়েছে।

গ্রীস বলছে যে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গ্রীসের প্রতিটা দ্বীপের চারিদিকে আঞ্চলিক সাগর এবং ‘এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন’ গ্রীসের পাওনা। অপরদিকে তুরস্ক বলছে যে, গ্রীস ইউরোপিয় দেশগুলির চাপে তুরস্কের উপর চাপ সৃষ্টি করতেই তুরস্কের পাওনা সমুদ্রাঞ্চলকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করতে চাইছে। গ্রীসের অনেকগুলি দ্বীপ তুরস্কের উপকূলের একেবারে কাছে থাকায় গ্রীসের দাবি অনুসারে তুরস্কের উপকূলের বেশিরভাগ অঞ্চলই তুরস্কের অধীনে থাকছে না। এতে তুরস্ক ইজিয়ান সাগর এবং ভূমধ্যসাগরে খনিজ আহরণ থেকেই শুধু বঞ্চিত হবে না, তুরস্কের নৌবাহিনী ইজিয়ান সাগরে অপারেট করার নূন্যতম অধিকারও হারাবে, যা কিনা কৌশলগত দিক থেকে তুরস্কের সক্ষমতাকে একবারেই সংকীর্ণ করে ফেলবে। এই পরিস্থিতি কি করে তৈরি হলো, তা বুঝতে হলে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বর্তমান গ্রীসের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।

১৮৩২ সালে ইউরোপিয়দের সামরিক সহায়তায় গ্রীস উসমানি খিলাফত থেকে আলাদা হয়ে নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেই সীমানায় উত্তর গ্রীসের থেসালি, এপিরাস, মেসিডোনিয়া এবং থ্রেস অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ইজিয়ান সাগরের পূর্ব দিকের বেশিরভাগ দ্বীপও সেই সীমানার মাঝে পড়েনি। ক্রীট এবং সাইপ্রাসও ছিল না; দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জও ছিল না। বর্তমান তুরস্কের উপকূলে অবস্থিত থাসস, লিমনস, সামোথরাকি, লেসবস, চিয়স, সারা, সামোস, আর্মেনিসটিস দ্বীপগুলিও গ্রীসের ছিল না। এই সবগুলি দ্বীপই বর্তমান গ্রীস-তুরস্কের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৯৭ সালে স্থলযুদ্ধে গ্রীসের পরাজয় হলেও ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে ক্রীট দ্বীপ উসমানি খিলাফত থেকে আলাদা হয়ে গ্রীসের সাথে যুক্ত হয়। ১৯১১-১২ সালে ইতালি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। এই দ্বীপগুলির মাঝে রয়েছে রোডস, কস, পাতমোস, এবং আরও ১২টা প্রধান দ্বীপ। ১৯২৩ সালে এই দ্বীপগুলিকে গ্রীসের হাতে তুলে দেয়া হয়। ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে ‘এলি’র যুদ্ধে ইউরোপিয় সমর্থনপুষ্ট গ্রীক নৌবাহিনী উসমানি নৌবাহিনীকে পরাজিত করে ইজিয়ান সাগরে লেসবস, চিয়স, লেমনস এবং সামোস দ্বীপ দখল করে ফেলে। ১৯১৫-১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-ফরাসী নৌবাহিনী কাস্তেলোরিতসো দ্বীপ দখল করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পুরো দোদেকানিজ ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ১৯৪৭ সালে ইতালির সাথে সাক্ষরিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শান্তি চুক্তি মোতাবেক দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ গ্রীসকে দিয়ে দেয়া হয়। এর মাঝে কাস্তেলোরিতসো দ্বীপও ছিল। ১৮৭৮ সালের রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের পর উসমানিরা ইস্তাম্বুলকে মুক্ত রাখতে ব্রিটেনকে সাইপ্রাসে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়। তবে দ্বীপের মালিকানা তখনও উথমানিদের হাতেই থাকে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানিরা জার্মানির পক্ষে যোগ দিলে ব্রিটেন অফিশিয়ালি সাইপ্রাস নিজের দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৬০ সালে ব্রিটেন সাইপ্রাসকে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দেয়। তবে সেখানে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলি থেকেই যায়।

বর্তমান গ্রীস তৈরিই হয়েছে ইউরোপিয়দের শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুর্কিরা সেই পথেই এগুবার চেষ্টা করছে। কিন্তু নিজেদের কাছ থেকে দখল করা দ্বীপগুলিকে তুর্কিরা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফেরত পাবার সাহস দেখাতে পারবে কি? গ্রীকরা তাদের স্বাধীনতা পেতে ইউরোপিয়দের উপর নির্ভর করেছিল; তুরস্কের সাথে যেকোন সম্ভাব্য যুদ্ধে গ্রীস তাদের সহায়তাই চাইবে। ইউরোপিয় মধ্যস্ততায় তুর্কিদের সাথে গ্রীসের আলোচনা শক্তি ব্যবহারের পথে বাধাগুলিকেই দেখিয়ে দেয়। গ্রীস তৈরি হবার পর সীমানা নির্ধারণের যে আইনগুলিকে তুরস্ক মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই আইন অমান্য করাটাই এখন জাতিরাষ্ট্র তুরস্কের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। 

Thursday 17 September 2020

তুরস্কের বঙ্গোপসাগরে অবতরণ?

১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২০

হিমালয়ের উত্তেজনার মাঝে প্রতিবেশীদের সমর্থন না পাওয়ায় ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে এতদিন ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল চীন; এখন তুরস্কের আবির্ভাবে তা আরও অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে। ভারত মহাসাগরে চীন এবং তুরস্ক উভয়ের পক্ষেই একা সামরিকভাবে ভারতকে ব্যালান্স করা দুষ্কর। একারণেই উভয়েই চাইছে ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী বন্ধু তৈরি করতে; পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ভূমিকা একারণেই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে।

১৬ই সেপ্টেম্বর তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়, যা গত ৪ঠা অগাস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিশাল বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা এখন পুরোপুরি সচল। তুরস্কের আকসাজ নৌঘাঁটিতে জাহাজটার মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এর মাত্র দু’দিন আগেই ১৪ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ককে নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামতের জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। শেখ হাসিনা আঙ্কারাতে ভিডিও কনফারেন্সিংএর মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন চান্সেরি কমপ্লেক্স উদ্ভোধন করার সময় মিয়ানমারের মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে তুরস্কের সমর্থন দেবার জন্যেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। একইসাথে দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক হিসেবনিকেশের মাঝে বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্কোন্নয়ের প্রচেষ্টার গুরুত্ব কতটুকু, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হতে শুরু করবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিহাসকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে তুরস্কের স্বীকৃতির বহু আগে নিয়ে যান। তিনি বলেন যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি জেনারেল ইখতিয়ার উদ্দিন মূহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী যখন বাংলা জয় করেন, তখনই তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শেখ হাসিনা এমন এক ইতিহাসের উদাহরণ টেনে এনেছেন, যা কিনা বর্তমান তুরস্ক এবং বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসের চাইতে অনেক পুরোনো এবং গভীর। তিনি দুই দেশের সম্পর্ককে আস্থা, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যের ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে আখ্যা দেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যমেই বাংলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এরপর থেকে আষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিকেরা নিয়ন্ত্রণ নেবার আগ পর্যন্ত বাংলার বেশিরভাগ শাসকই ছিলেন তুর্কি। অপরদিকে বর্তমান তুরস্ক উসমানি খিলাফতের ধ্বংসের পর প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। উসমানিরা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বশীল স্থানে আসার আগেই তুর্কি নেতৃত্ব ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। বখতিয়ার খিলজীর ইতিহাসও সেসময়েরই। বাংলা বিজয়ের আরও প্রায় আড়াই’শ বছর পর উসমানিরা ১৪৫৩ সালে কন্সটানটিনোপল বিজয় করে; যা এখন ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত। পরবর্তী সাড়ে ৪’শ বছর ইস্তাম্বুল ছিল উসমানি খলিফার রাজধানী। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে থাকা খলিফার সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের বিশ্বাসগত বন্ধন ছিল নিবিড়। ১৫১৯ সালে উসমানি খলিফা প্রথম সেলিম মধ্য এশিয়ার তুর্কি নেতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুরকে সমর্থন দেন। উসমানি আর্টিলারি জেনারেল উস্তাদ আলী কুলি এবং আগ্নেয়াস্ত্র ম্যাচলক বিশেষজ্ঞ মুস্তাফা রুমিকে বাবুরের সহায়তায় প্রেরণ করা হয়। এই আর্টিলারি প্রযুক্তি এবং বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়েই ১৫২৬ সালে বাবুর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে জয়লাভ করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৪ সালে ইউরোপিয়রা উসমানি খিলাফত ভেঙ্গে ফেললে বর্তমান তুরস্কের জন্ম হয়; যা কিনা উসমানিদের অধীনে থাকা আনাতোলিয়া অঞ্চল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। সেসময় ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই ইতিহাসগুলিই বলে দেয় যে, জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং তুরস্কের চাইতেও অনেক গভীর সম্পর্ক রয়েছে দুই দেশের মানুষের; যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বৈশ্বিক; আঞ্চলিক নয়।

  

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়এর মেরামত কাজ সম্পন্ন করা হয় তুরস্কের আকসাজ নৌঘাঁটিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ককে নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামতের জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি জেনারেল ইখতিয়ার উদ্দিন মূহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী যখন বাংলা জয় করেন, তখনই তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শেখ হাসিনা এমন এক ইতিহাসের উদাহরণ টেনে এনেছেন, যা কিনা বর্তমান তুরস্ক এবং বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসের চাইতে অনেক পুরোনো এবং গভীর।

 

২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঙ্কারা সফর করেন। তবে গত এক দশকে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক ওঠানামা করেছে। বিশেষ করে ১৯৭১এর স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’। ২০১৭ সালেও তুরস্কের সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘অবাধ্য রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। সেই অবস্থান থেকে ২০২০ সালের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই প্রয়াস বিরাট এক পরিবর্তন। দুই সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের মাঝে পার্থক্য থাকলেও দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সর্বদাই ভালো ছিল। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে সম্পর্ক বেশ গভীর। ১৯৮১ সালে দুই দেশের মাঝে সামরিক প্রশিক্ষণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তুরস্কে তৈরি ‘অতোকার কোবরা’ আর্মার্ড ভেহিকল ব্যবহার করে। বাংলাদেশি দূতাবাসের ভবন উদ্ভোধনের পর সংবাদ সন্মেলনে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন যে, দুই দেশের বাণিজ্য এখন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের মতো; তবে তিনি তা ২ বিলিয়ন ডলারে উঠিয়ে নেবার পক্ষপাতি। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর হিসেবে বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ তুরস্কে ৪’শ ৫৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন দূতাবাস উদ্ভোধন উপলক্ষে আঙ্কারা ভ্রমণ করেন। কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ ইনিশিয়েটিভ’ চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বাংলাদেশ। এই চিন্তার অংশ হিসেবে তুরস্ক এশিয়ার দেশগুলির সাথে শিক্ষা, প্রতিরক্ষা শিল্প, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি বিষয়ে সম্পর্ক গভীর করতে চায়। তিনি আরও বলেন যে, খুব শিগগিরই ঢাকায় নতুন তুর্কি দূতাবাস উদ্ভোধন করা হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার পত্নীকে দূতাবাস উদ্ভোধনের জন্যে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কে শৈত্য প্রবাহ?

তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের ঘটনা এমন সময়ে ঘটলো, যখন বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। অগাস্ট মাসেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ সফর করে যান। করোনাভাইরাসের লকডাউন শুরুর পর থেকে এটা ছিল শ্রিংলার প্রথম বিদেশ সফর। ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই সফরের মাধ্যমে ভারত চাইছিল বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক করতে। সেখানে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের নেয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের অবকাঠামোতে চীনের বড় আকারের বিনিয়োগের ব্যাপারে ভারতের অস্বস্তির কথাও সেখানে বলা হয়। ভারতের ‘দ্যা উইক’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, শ্রিংলার সফর ছিল দুই দেশের সম্পর্কের ‘শীতলতা’ কাটাবার চেষ্টা। সেখানে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারত কেন নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করেছিল, তা তিনি বুঝতে পারেননি; যদিও শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এরপর অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ শুরুর সময়েও বাংলাদেশে উদ্বেগ দেখা দেয় বলে উল্লেখ করে পত্রিকাটা। যদিও সেসময়ও বাংলাদেশ সরকার বলেছিল যে, সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু।

তবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের সবচাইতে বড় ইস্যু ছিল চীনের ব্যাপারে নীতি। ভারতের ‘দ্যা প্রিন্ট’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, লাদাখে যখন ভারত এবং চীনের মাঝে উত্তেজনা চলছে, তখন বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছিল। ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনারা ঢাকায় তাদের প্রভাব খাটিয়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের পিছনে কাজ করছে। লাদাখের উত্তেজনার মাঝেই চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়। বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার বীনা সিক্রি বলেন যে, চীন সর্বদাই এধরনের কৌশল অবলম্বন করে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে; এবং এতে তারা বেশ সফলও হচ্ছে। তিনি ভারত সরকারকে এব্যাপারে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নেবার উপদেশ দেন। চীন থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির ব্যাপারেও ভারতের পত্রিকাগুলিতে ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর ফেলো কনস্টানটিনো জেভিয়ার বলেন যে, দিল্লী এখন ঢাকার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে যেন বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে কিছুটা পিছিয়ে আসে।
   

২০১৯এর নভেম্বর। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ’ পরিদর্শনে। সোমালিয়া, কাতার এবং পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক দেখিয়ে দেয় যে, ভারত মহাসাগরে তুরস্কের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে তুরস্ক বঙ্গোপসাগরেও তার অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।
 

ভারত মহাসাগরে তুরস্ক

গত নভেম্বরে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতার সফর করেন। কাতারে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি তৈরি শেষে বলা হয় যে, মুসলিম বীর খালিদ বিন ওয়ালিদের (রাঃ) নামানুসারে এই ঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে। এখানে ৫ হাজার তুর্কি সেনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দু’বছর আগে কাতারের উপর সৌদি অবরোধের সময় কাতারে সেনা পাঠায় তুরস্ক। কাতারের জয়েন্ট স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল হামাদ বিন আব্দুল্লাহ আল ফুত্তাইস ২০১৮ সালে ঘোষণা দেন যে, কাতারে তুরস্কের জন্যে একটা নৌঘাঁটি তৈরির জন্যে দুই দেশের মাঝে সমঝোতা হয়েছে। কাতার ছাড়াও সোমালিয়াতে একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে তুরস্ক। ‘ক্যাম্প তুর্কসোম’ নামের এই ঘাঁটিতে সোমালিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে তুর্কি রাষ্ট্রদূত মেহমেত ইলমাজ বলেন যে, সোমালিয়ার সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ সেনার প্রশিক্ষণ দিয়েছে তুরস্ক; যা সংখ্যায় প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজারের মতো। এছাড়াও জানুয়ারি মাসে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঘোষণা দেন যে, তিনি সোমালিয়ার সরকারের কাছ থেকে সোমালিয়ার উপকূলে সমুদ্রে তেল গ্যাস আহরণের একটা আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তুরস্ক তেল গ্যাস আহরণের জন্যে ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণ সাগরে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে এবং তা করতে গিয়ে প্রতিবেশী গ্রীসের সাথে তুরস্কের উত্তেজনাও চলছে। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের এই আহরণের প্রচেষ্টাতে সরাসরি নিরাপত্তা দিচ্ছে তুর্কি নৌবাহিনী। তুরস্ক যদি সোমালিয়ার উপকূলে আহরণের কাজ শুরু করতে যায়, তাহলে সেখানেও তুরস্ক নিরাপত্তার কথা শুরুতেই চিন্তা করবে।

আদেন উপসাগর এবং আরব সাগরে জলদস্যু দমনের লক্ষ্যে তুরস্ক তার একটা নৌবাহিনী জাহাজকে টহলে রেখেছে। পাকিস্তানের সাথেও তুরস্কের রয়েছে গভীর সামরিক সম্পর্ক। ২০১৮ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্যে ৪টা ‘মিলজেম ক্লাস’এর ফ্রিগেট তৈরি করছে। ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, গত জুনে পাকিস্তানের করাচিতে দ্বিতীয় ফ্রিগেটের কাজ শুরু হয়। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে তুর্কি শিপইয়ার্ডে প্রথম ফ্রিগেটের কাজ শুরু হয়, তুর্কি প্রেসিডেন্ট নিজে যেটার উদ্ভোধন করেন। সোমালিয়া, কাতার এবং পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক দেখিয়ে দেয় যে, ভারত মহাসাগরে তুরস্কের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে তুরস্ক বঙ্গোপসাগরেও তার অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে। দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। অক্টোবরের ২৬ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত তুর্কিরা ‘ডিফেন্স পোর্ট টার্কি, সাউথ এশিয়া’ নামে একটা মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে। সেখানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ৮০ জন সামরিক প্রতিনিধি যোগ দেবেন বলে তারা আশা করছেন। ‘ক্যাপিটাল এক্সিবিশন’এর প্রধান নির্বাহী হাকান কুর্ত বলছেন যে, আগামী এক দশকের মাঝে এই তিন দেশে তুরস্কের ৫ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রির টার্গেট রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের ভিত বিশ্বাসগত; জাতি রাষ্ট্রের স্বার্থের উপর নয়। রাজনৈতিক দলের স্বার্থ যখন রাষ্ট্রের স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে না পারে, তখন তার ভূরাজনৈতিক ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী। দক্ষিণ এশিয়াতে শুধুমাত্র পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক রাখাটা তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির একটা দুর্বল দিক ছিল। কাশ্মির ইস্যুতে তুরস্কের অবস্থান ছিল মূলতঃ পাকিস্তানের কারণেই। এখন মিয়ানমার ইস্যুতেও তুরস্ক তাদের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে পারে। সেকুলার জাতি রাষ্ট্র তুরস্ক তার আদর্শিক ইতিহাসকে মুছে ফেলতে পারছে না; যদিও জাতীয় স্বার্থের কারণে তুরস্ক মুসলিমদের বিভিন্ন ইস্যুতে আদর্শত শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। হিমালয়ের উত্তেজনার মাঝে প্রতিবেশীদের সমর্থন না পাওয়ায় ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে এতদিন ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল চীন; এখন তুরস্কের আবির্ভাবে তা আরও অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের নতুন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আনাদোলু’কে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ভারত মহাসাগরেও দেখা যেতে পারে বলে বলছে তুর্কি পত্রিকা ‘ডেইলি সাবাহ’। তবে ভারত মহাসাগরে চীন এবং তুরস্ক উভয়ের পক্ষেই একা সামরিকভাবে ভারতকে ব্যালান্স করা দুষ্কর। একারণেই উভয়েই চাইছে ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী বন্ধু তৈরি করতে; পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ভূমিকা একারণেই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পাবে নিশ্চিত; তবে তুরস্কের বেলায় ভারতকে নতুন কোন কৌশলগত পার্টনার খুঁজতে হবে। পাকিস্তানের সাথে সৌদিদের সাম্প্রতিক মনোমালিন্যের পর তুর্কিদের মোকাবিলায় সৌদিদের ভারত নিজ পক্ষে আনার চেষ্টা চালাতে পারে। ভূমধ্যসাগরে তুর্কিদের প্রতিপক্ষ ফ্রান্সও ভারত মহাসাগরে ভারতের পাশে থাকতে পারে। ২০২১ সাল থেকে ব্রিটেনও ভারত মহাসাগরে তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে যাচ্ছে। মোট কথা দিনে দিনে ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি আরও জটিল হচ্ছে।

Saturday 12 September 2020

পশ্চিম আফ্রিকার মালির অভ্যুত্থান... ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় প্রভাব হারাচ্ছে ফ্রান্স

১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২০

‘ফ্রাঙ্কোফোন’ প্রাক্তন ফরাসী উপনিবেশ মালির রাজনৈতিক সমস্যায় ‘এংলোফোন’ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার ভূমিকা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করছে। মালির অভ্যুত্থান নেতারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নির্ধারণে ‘এংলোফোন’ নাইজেরিয়ার অবস্থানই যখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব হবার ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।

১৮ই অগাস্ট পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে। ১১ই সেপ্টেম্বর মালির সামরিক সরকারের নিযুক্ত ২০ সদস্যের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি নতুন এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করে, যার মেয়াদ হবে দুই বছর; প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করবে সেনাবাহিনী। আর প্রেসিডেন্ট নিজে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব করা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। এই প্রস্তাবে প্রেসিডেন্টকে সামরিক বা বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মালির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বেসামরিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং গ্রুপের কয়েক’শ সদস্যকে সেনাবাহিনী রাজধানী বামাকোতে তিনদিনের এক আলোচনায় ডাকে। এই আলোচনার দ্বিতীয় দিনের মাথায় এক চার্টারে বলা হয় যে, মালির সমস্যার গভীরতার কথা চিন্তা করেই দুই বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ‘ইকনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ বা ‘একোওয়াস’ মালির সেনাবাহিনীকে ১৭ই সেপ্টেম্বরের মাঝে একজন প্রেসিডেন্ট এবং একজন প্রধানমন্ত্রীর নাম প্রকাশ করার জন্যে সময় বেঁধে দেয়। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, বামাকোর আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছেন, তারা দু’টা ব্যাপারে বেশ বিভক্ত। প্রথমতঃ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে; আর দ্বিতীয়তঃ সেনাবাহিনীর ভূমিকাই বা এক্ষেত্রে কি হবে। সেনাবাহিনী প্রথমে প্রস্তাব করেছিল যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হবে তিন বছর। অর্থাৎ সেনাবাহিনী হয়তো তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। তবে সরকারের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তারা কোন ছাড় যে দেয়নি তা মোটামুটিভাবে পরিষ্কার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পুরো পশ্চিম আফ্রিকার উপর মালির রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব কতটুকু হবে, সেটাই হবে ভূরাজনৈতিকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

মালির সেনাবাহিনীর একাংশ এমন একটা সময়ে ক্ষমতা দখল করে, যখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বুবাকার কেইতার বিরুদ্ধে এক মাস ধরে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ চলছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা অভিযোগ আনা হয়েছিল। মালির উত্তরাংশে ২০১২ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে; এবং এই সংঘাত ইতোমধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ নিজের, বুরকিনা ফাসো এবং আইভোরি কোস্টে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে পুরো অঞ্চল অস্থির হওয়া ছাড়াও মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। মালির এই রাজনৈতিক সমস্যা অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করবে, এই যুক্তিতেই অঞ্চলিক জোট মালির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে।

মালিতে মাসব্যাপী সহিংস বিক্ষোভের মাঝেই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটা আলোচনায় আসতে থাকে। বিরোধী ‘জুন ফাইভ মুভমেন্ট’ এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়। সমস্যা সমাধানে ‘একোওয়াস’এর একটা প্রতিনিধিদল জুলাইএর মাঝামাঝি মালি রওয়ানা দেয়। নাইজেরিয়ার পত্রিকা ‘প্রিমিয়াম টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে ‘একোওয়াস’এর কমিশন প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ কাসি ব্রুএর স্বাক্ষরিত এক চিঠির বরাত দিয়ে বলা হয় যে, নাইজেরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথনকে এই মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে। জনাথন তার মিশনের মাধ্যমে একটা জাতীয় ঐক্যের সরকার প্রস্তাব করেন, যেখানে বিরোধী দল এবং বেসামরিক ব্যক্তিত্বরাও থাকবেন। তবে জনাথনের প্রস্তাবে ‘জুন ফাইভ মুভমেন্ট’ রাজি হয়নি। জনাথনের ব্যর্থতার পর ‘একোওয়াস’এর পাঁচটা দেশ নাইজেরিয়া, ঘানা, আইভোরি কোস্ট, নিজের এবং সেনেগালের প্রেসিডেন্টরা মালিতে গিয়ে উপস্থিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কেইতা যেমন ক্ষমতা ছাড়তে ছিলেন নারাজ, তেমনি বিরোধী গ্রুপের নেতা ইব্রাহিম ডিকোও ছিলেন নিজের অবস্থানে অটল। ‘একোওয়াস’এর এই প্রচেষ্টাও হয় ব্যর্থ।

মালির সমস্যার পিছনে শক্তিশালী দেশগুলির বড় ভূমিকা রয়েছে। মালির গৃহযুদ্ধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে দেশটার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্স। মালিতে ফ্রান্সের ৫ হাজারের বেশি সেনা রয়েছে। অপরদিকে দেশটার রাজনৈতিক সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে আঞ্চলিক সংগঠন ‘একোওয়াস’। এই সংস্থার ১৫টা সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে ৮টা দেশই ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ; যেগুলির রাষ্ট্রীয় ভাষা ফরাসী; এগুলিকে বলা হয় ‘ফ্রাঙ্কোফোন’ দেশ। চারটা ব্রিটেনের উপনিবেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা একটা রাষ্ট্রের অফিশিয়াল ভাষা ইংরেজি; এগুলিকে বলা হয় ‘এংলোফোন’ দেশ। বাকি দু’টা দেশ পর্তুগালের উপনিবেশ হওয়ায় তাদের অফিশিয়াল ভাষা পুর্তুগীজ। তবে জনসংখ্যার দিক থেকে ‘একোওয়াস’এর প্রায় ৩৫ কোটি জনগণের মাঝে ইংরেজি ভাষাভাষি দেশগুলির জনসংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি। এর মাঝে আবার এক নাইজেরিয়ার জনসংখ্যাই প্রায় ২০ কোটি। অর্থনীতির আকারের দিক থেকেও পুরো অঞ্চলে নাইজেরিয়ার ধারেকাছেও কোন দেশ নেই। ‘একোওয়াস’এর মোট প্রায় ৬’শ ৭৫ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির মাঝে নাইজেরিয়ার একার জিডিপিই প্রায় ৫’শ বিলিয়ন ডলার। ‘একোওয়াস’এর মাঝে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার অবস্থান অতি শক্তিশালী হওয়ার কারণে সংস্থার উপর ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম এবং ফ্রান্স ‘একোওয়াস’এর ব্যাপারে সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ‘একোওয়াস’এর মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে নাইজেরিয়ার নেতৃত্ব নেয়াকে ফ্রান্স তার প্রাক্তন উপনিবেশগুলির উপর ‘এংলোফোন’ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হিসেবেই দেখেছে।

‘মিডল ইস্ট মনিটর’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, পশ্চিম আফ্রিকার মূল সমস্যা হলো ফ্রান্স। যতদিন ফ্রান্স আফ্রিকার দেশগুলির উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ না সরিয়ে নেবে, ততদিন আফ্রিকার সমস্যাগুলির সমাধান হবে না। এই মন্তব্যের সাথে মিল পাওয়া যাবে আফ্রিকার দেশগুলির মুদ্রার দিকে তাকালেই। পশ্চিম আফ্রিকার ৮টা এবং মধ্য আফ্রিকার ৬টা দেশের মুদ্রা ‘সিএফএ ফ্রাঙ্ক’, যা ফরাসী মুদ্রা ফ্রাঙ্কের সাথে যুক্ত; যেকারণে এই দেশগুলির অর্থনীতি বহুলাংশেই ফ্রান্সের উপর নির্ভরশীল। নাইজেরিয়ার নেতৃত্বে ‘একোওয়াস’এর চাপের মুখে ২০১৯এর শেষের দিকে পশ্চিম আফ্রিকার ৮টা ফরাসী ভাষাভাষী দেশ ২০২০ সাল থেকে ‘সিএফএ ফ্রাঙ্ক’ থেকে বের হয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। তবে ফ্রান্স এর মাধ্যমে তার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবার পরিস্থিতিই দেখছে। ফরাসী নেতৃত্বে দীর্ঘ আট বছর ধরে মালির যুদ্ধ চলতে থাকার ফলে অত্র অঞ্চলে ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ‘ফ্রাঙ্কোফোন’ প্রাক্তন ফরাসী উপনিবেশ মালির রাজনৈতিক সমস্যায় ‘এংলোফোন’ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার ভূমিকা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করছে। মালির অভ্যুত্থান নেতারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নির্ধারণে ‘এংলোফোন’ নাইজেরিয়ার অবস্থানই যখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব হবার ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।


Monday 7 September 2020

ইউরোপে উগ্রপন্থীদের উত্থান প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা আদর্শের সংকট

৭ই সেপ্টেম্বর ২০২০
বার্লিনে করোনা বিরোধী প্রতিবাদের বিশেষত্ব ছিল উগ্র ডানপন্থীদের অংশগ্রহণ এবং জার্মান পার্লামেন্টে হামলার চেষ্টা। যে উগ্রপন্থী চিন্তাকে পুঁজি করে ডানপন্থীরা ইউরোপজুড়ে ক্ষমতায় যাচ্ছে, তার পিছনে জনগণের সমর্থন গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ধারাতেই উগ্রপন্থীরা ইউরোপে আরও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। সেই হিসেবে জার্মান পুলিশের উগ্রপন্থীদের টার্গেট করে চাপের মাঝে ফেলার চেষ্টাখানা যথেষ্টই অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রকে পুঁজি করে পরস্পরবিরোধী এই কার্যকলাপ ইউরোপের আদর্শিক সংকটেরই চিত্র, যা থেকে বের হবার কোন পথ কেউ দেখাতে পারছেন না। 




অগাস্টের শেষে জার্মান রাজধানী বার্লিনে ৩৮ হাজার মানুষের এক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। করোনাভাইরাস বিষয়ে জার্মান সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছিল। পুলিশ এদের মাঝ থেকে প্রায় ৩’শ প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তারও করে। পরবর্তীতে কয়েক’শ ডানপন্থী প্রতিবাদকারী জার্মান পার্লামেন্ট ‘রাইখস্টাগ’এ হামলা করার চেষ্টা করে। জার্মান রাজনীতিবিদেরা অনেকেই এই হামলাকে ‘লজ্জাজনক’ এবং ‘অগ্রহনীয়’ বলে আখ্যা দেন। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, প্রতিবাদকারীদের মাঝে অনেকেই উগ্রপন্থী কথা লেখা টি শার্ট বা পতাকা বহন করছিল। ‘ল্যাটেরাল থিংকিং ৭১১’ নামের একতা সংগঠন বলে যে, সরকারের করোনাভাইরাসের নিয়মকানুন জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর আঘাতের স্বরূপ। অংশগ্রহণকারীদের মাঝে অনেকেই করোনাভাইরাস বলে কিছু আছে, সেটাই বিশ্বাস করে না। তারা মনে করছে যে, করোনাভাইরাস একটা ষড়যন্ত্র; এবং সরকার করোনাভাইরাসের নামে মানুষের উপর গোয়েন্দাগিরি করছে। একই রকমের চিন্তার মানুষের লন্ডন, প্যারিস, ভিয়েনা এবং জুরিখ শহরেও বিক্ষোভ করে।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানিতে মোট ২ লক্ষ ৪২ হাজার মানুষের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে, যা কিনা অন্যান্য ইউরোপিয় দেশ থেকে কম। ৯ হাজার ৩’শ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটাও ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি বা রাশিয়ার চাইতে কম বলে বলছে ‘জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’র গবেষণা। ‘ইসিডিসি’র হিসেবে অগাস্ট মাসে পুরো ইউরোপেই সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। জার্মানিতেও তাই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার। ২৭শে অগাস্ট চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের সরকার জনসমক্ষে মাস্ক না পড়ার জন্যে ৫০ ইউরো জরিমানা ধার্য্য করে। আগামী বছর পর্যন্ত জনসমাগমের উপরে নিষেধাজ্ঞা বলবত করা হয়েছে। বার্লিনের করোনা বিরোধী প্রতিবাদের বিশেষত্ব ছিল উগ্র ডানপন্থীদের অংশগ্রহণ এবং জার্মান পার্লামেন্টে হামলার চেষ্টা। করোনা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ডানপন্থীরা নিজেদের অবস্থান সংহত করতে চাইছে কিনা, তা নিয়েও কথা শুরু হয়েছে। কারণ জার্মানিতে উগ্রবাদী, বিশেষ করে নিও নাজিদের কর্মকান্ড নিয়ে উদার ও মধ্যপন্থীরা যারপরনাই চিন্তিত।

গত মার্চে জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘বিএফভি’এর প্রধান থমাস হালডেনওয়াং এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, ডানপন্থী উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ জার্মানির গণতন্ত্রের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি। তিনি বলেন যে, উগ্র ডানপন্থীদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজারের মতো; এর মাঝে ১৩ হাজারের সম্ভাব্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়াবার সম্ভাবনা বেশি। তিনি আরও বলেন যে, জার্মানির ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘অলটারনেটিভ ফুর ডয়েচল্যান্ড’ ‘এএফডি’ বা ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’র সবচাইতে উগ্রবাদী অংশের নেতৃবৃন্দকে গোয়েন্দা নজরে রাখা হয়েছে। এই অংশটার নাম ‘ডের ফ্লুগেল’ বা ‘দ্যা উইং’; যার সদস্যসংখ্যা আনুমানিক ৭ হাজারের মতো। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, এই গ্রুপের গুরুত্ব তাদের সংখ্যার চাইতেও আরও বেশি; কারণ এরা পুরো দলের নীতি নির্ধারণেও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। জার্মান পুলিশ এবং তাদের কথাবার্তা শুনতে এবং রেকর্ড করতে পারবে। হালডেনওয়াং বলেন যে, জার্মানিতে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন হামলার ঘটনাই বলে দিচ্ছে যে, উগ্রবাদী গ্রুপগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। গত ফেব্রুয়ারিতে হানাউ শহরে একতা শিশা বারে এক উগ্রপন্থী বন্দুকধারী ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে অক্টোবরে হাল শহরে ইহুদিদের উপাসনালয় সিনাগগে হামলায় দুই জন নিহত হয়। তারও আগে জুন মাসে হেস রাজ্যে ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থানে থাকা এক রাজনীতিবিদ ওয়াল্টার লুবেককে এক উগ্রপন্থী ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করে।

  
জার্মানির ‘এএফডি’ দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আলেক্সান্ডার গল্যান্ড ছিলেন একজন সরকারি আমলা এবং পরবর্তীতে পটসড্যামের একটা পত্রিকার সম্পাদক। জার্মানির উগ্রপন্থী রাজনীতিবিদেরা জার্মানির স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাঝ থেকেই উঠে এসেছে। এদের অনেকেই সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল এঙ্গেলা মার্কেলের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’এর সদস্য ছিল; কেউ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর; সরকারি কর্মকর্তা; বা গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার সাংবাদিক বা কলামিস্ট। জার্মান গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়েই এই উগ্রপন্থী চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে। 



‘এএফডি’ তৈরি হয় ২০১২ সালে। দল গঠনের পিছনে মূল যুক্তি ছিল জার্মানিকে ইউরো থেকে নিজস্ব মুদ্রা ডয়েচ মার্কে ফিরিয়ে নেয়া। তাদের বক্তব্য ছিল যে, ইউরোর চাপে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলি দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং তারা ক্রমান্বয়ে জার্মানির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। ২০১০ সালে গ্রীসের দেউলিয়া হবার ঘটনায় জার্মানির অর্থনৈতিক সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দল গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। দলের উদ্যোক্তা হিসেবে তিনজনের নাম বলা হয়েছিল। এর মাঝে আলেক্সান্ডার গল্যান্ড ছিলেন একজন সরকারি আমলা এবং পরবর্তীতে পটসড্যামের একটা পত্রিকার সম্পাদক। গল্যান্ড একইসাথে এঙ্গেলা মার্কেলের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’ বা ‘সিডিইউ’এর সদস্য ছিলেন। ‘সিডিইউ’ হলো জার্মানির সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল। জার্মান পার্লামেন্ট ‘বুন্দেস্টাগ’এর ৭’শ ৯টা আসনের মাঝে ‘সিডিইউ’এর আসন রয়েছে ২’শ। আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা বার্ন্ড লাক ইউনিভার্সিটি অব হামবুর্গের অর্থনীতির প্রফেসর। তিনি বিশ্ব ব্যাঙ্কের একজন উপদেষ্টার পদে থাকা ছাড়াও কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভিজিটিং স্কলার ছিলেন। আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা কোনরাড এডাম মূলতঃ সাংবাদিক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ‘ফ্রাঙ্কফুটার আলেমাইন জাইটুং’ এবং ‘ডাই ওয়েল্ট’এর সাথে কাজ করেছে। ২০০৭ সাল থেকে তিনি পত্রিকাতে কলামিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। ‘এএফডি’ গঠনের পূর্বে তিনিও ‘সিডিইউ’এর সদস্য ছিলেন। গত সাত বছরে দলটা রও বেশি উগ্রবাদী ধারণা পোষণ শুরু করে এবং নিজেদের নেতৃত্বে বেশ কয়েক দফা পরিবর্তন হয়। ২০১৫ সালে ইউরোপে শরণার্থী আগমণ শুরু হলে ‘এএফডি’ চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের সীমান্ত খুলে রাখার নীতির ব্যাপক সমালোচনা করে। বর্তমানে ‘এএফডি’ই হলো ক্ষমতাসীন ‘সিডিইউ’এর সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। পার্লামেন্টে এখন তাদের ৮৮টা আসন রয়েছে; ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টেও এদের ১১টা আসন রয়েছে। কাজেই এই দলকে এড়িয়ে যাওয়া কারুর পক্ষেই সভব নয়। গোয়েন্দা সংস্থার বিবৃতির পর ‘এএফডি’র মুখপাত্র জোর্গ মিউথেন বলেন যে, দলের বিরুদ্ধে এই কর্মকান্ড দলটার কন্ঠরোধ করার একটা চেষ্টা। এই প্রচেষ্টা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

‘ডের ফ্লুগেল’ শাখার নেতা বিয়র্ন হোক হলেন জার্মানির পূর্বাংশের থুরিঞ্জিয়া রাজ্যের ‘এএফডি’র রাজনীতিবিদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদি নিধনের স্মৃতি স্তম্ভকে তিনি ‘লজ্জার স্মৃতি’ বলে আখ্যা দিয়ে এই স্মৃতি রোমন্থনের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানান। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, গত অক্টোবরে থুরিঞ্জিয়ার প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ ‘এএফডি’কে ভোট দিয়েছে। সিরিয়া এবং আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদেরকে জার্মানিতে ডুকতে দেবার নীতির সমালোচনা থেকেই ‘এএফডি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের কথা হলো, চ্যান্সেলর মার্কেল একনায়কের মতো দেশ চালান এবং তাদের মতামতকে কোন মূল্যই দেন না। বিয়র্ন হোক অভিযোগ করেন যে, আফ্রিকা থেকে আগত মানুষেরা জার্মানির সমাজকে কলুষিত করে ফেলছে। তার কথার ধরণ অনেকেই পছন্দ না করলেও তিনি যা বলছেন, সেগুলিকে যুক্তিযুক্ত বলছেন তারা। অনেকেরই ধারণা রয়েছে যে, জার্মানিতে যথেষ্ট গরীব মানুষ রয়েছে; সরকারের উচিৎ বাইরে থেকে আসা মানুষের পিছনে অর্থ ব্যয় না করা। তবে জার্মান গোয়েন্দারা শুধুমাত্র বিয়র্ন হোককে টার্গেট করার কথা বললেও ‘এএফডি’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দও উগ্রপন্থী বক্তব্যে পিছিয়ে নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা রাজনীতিবিদ আলেক্সান্ডার গল্যান্ড মন্তব্য করেন যে, জার্মান ফুটবল দলের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় বোয়াটেং খেলার মাঠে জার্মানির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হলেও জার্মানির অনেক মানুষই তাকে নিজেদের প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে চাইবে না। তিনি আরও বলেছিলেন যে, শিশুদের চেহাড়া দেখে শরণার্থীকে জার্মানিতে ঢুকতে দেয়াটা ব্ল্যাকমেইলের শামিল। ২০১৭ সালে তিনি বলেন যে, তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান রাজনীতিবিদ আইদান উজুগুজকে তুরস্কে ফেরত পাঠানো উচিৎ। ২০১৬ সালে ‘এএফডি’র রাজনীতিবিদ ফ্রাউকা পেট্রি এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, শরণার্থীদের থামাতে সীমান্ত পুলিশের দরকার হলে গুলি করা উচিৎ। বিয়াট্রিক্স ভন স্টর্ক আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে শরণার্থীদেরকে আক্রমণকারী হিসেবে আখ্যা দেন। ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্যের ‘এএফডি’র প্রধান আন্দ্রেয়াস কালবিতজ ২০০৭ সালে গ্রীসে এক নিও নাজি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে স্বস্তিকা সংবলিত পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।

  
২০১৬ সালে জার্মান ডানপন্থীদের একটা সমাবেশ। উগ্র ডানপন্থী দল ‘এএফডি’ এখন জার্মান পার্লামেন্টে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল; তাদের রয়েছে লাখো সমর্থক। পুলিশি কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই উগ্রপন্থী চিন্তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে। স্বাধীনচেতা ইউরোপের কাছে কিছু রাজনীতিবিদদের উপর ধরপাকড়ের বিষয়টা মানুষের বাকস্বাধীনতার উপর হামলা বলে বিবেচিত হবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে তা সমাজকে যে বিভক্ত করবে, তা নিশ্চিত।



যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, জার্মানির উগ্রপন্থী রাজনীতিবিদেরা জার্মানির স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাঝ থেকেই উঠে এসেছে। এদের অনেকেই সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল এঙ্গেলা মার্কেলের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’এর সদস্য ছিল; কেউ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর; সরকারি কর্মকর্তা; বা গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার সাংবাদিক বা কলামিস্ট। জার্মান গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়েই এই উগ্রপন্থী চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে। ‘ডের ফ্লুগেল’এর নেতাদের নজরদারির মাঝে আনার কথা বলা হলেও পুরো ‘এএফডি’র নেতারাই তো প্রকাশ্যে স্বাধীনভাবে উগ্রপন্থী কথা বলছেন। শুধু তাই নয়, ‘এএফডি’ এখন জার্মান পার্লামেন্টে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল; তাদের রয়েছে লাখো সমর্থক। পুলিশি কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই উগ্রপন্থী চিন্তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে। স্বাধীনচেতা ইউরোপের কাছে কিছু রাজনীতিবিদদের উপর ধরপাকড়ের বিষয়টা মানুষের বাকস্বাধীনতার উপর হামলা বলে বিবেচিত হবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে তা সমাজকে যে বিভক্ত করবে, তা নিশ্চিত।

আর জার্মানি কেন, বাকি ইউরোপেও ডানপন্থী চিন্তার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সে সহিংসতার সংখ্যা বেড়ে গেছে। উদাহরণসরূপ, মাস্ক পড়তে বলার কারণে কিছু বাসযাত্রীর হাতে এক বাস ড্রাইভারের প্রাণ গিয়েছে। ফরাসী ফুটবল দল প্যারিস সাঁ জার্মেই জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে যাবার পর রাস্তায় কিছু লোক ভাংচুর করে। বিভিন্ন শহরের মেয়ররাও জনগণকে মাস্ক পড়তে বলার কারণে হামলার শিকার হয়েছে। ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী নেতা ম্যারিন লা পেন ৬ই সেপ্টেম্বর জনসমক্ষে এক ভাষণে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সরকার অপরাধের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর হতে পারছে না। আর ফ্রান্স ধীরে ধীরে আরও ‘হিংস্র’ হয়ে যাচ্ছে। লা পেন ২০১৭ সালের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে ম্যাক্রঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ২০২২ সালের নির্বাচনেও তিনি ম্যাক্রঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইছেন। তিনি মনে করছেন যে, ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো আর কেউই এখন ফ্রান্সে নেই। ২০১৭এর নির্বানের দ্বিতীয় ধাপে তিনি ৩৪ শতাংশ মানুষের ভোট পেয়েছিলেন। লা পেনের অভিবাসন নীতি জার্মান ডানপন্থীদের মতোই। তিনি ঘোরতরভাবে মুসলিম বিদ্বেষী এবং শরণার্থীদের ফ্রান্সে ঢোকার যারপরনাই বিরোধী। ফ্রান্সে মুসলিম অভিবাসী আসা থামাতে তিনি ফ্রান্সের সীমানা বন্ধ করে দেবার কথা বলেন। একজন উগ্র ডানপন্থী নেতার জন্যে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ ভোট অর্জন বলে দেয় যে, পুরো জাতির মাঝেই ডানপন্থী চিন্তা কতটা বাসা বেঁধেছে। জার্মানি এবং ফ্রান্সের চাইতেও ডানপন্থীরা বেশি শক্তিশালী ইতালিতে। সেখানে ডানপন্থী কোয়ালিশন ক্ষমতায়ও গিয়েছে। হাঙ্গেরিতেও ডানপন্থী ভিক্টর অরবান বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী। গতবছর পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন ডানপন্থীরা তাদের ভোট ৩৮ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশে বাড়িয়ে নিয়েছে।

জার্মানি ও ফ্রান্সসহ ইউরোপে ডানপন্থীদের উত্থান শুধু ইউরোপিয় ইউনিয়নের ঐক্যের জন্যেই যে হুমকি তা নয়; ব্যক্তিস্বাধীনতায় কঠোরভাবে বিশ্বাসী ইউরোপিয়দের আদর্শিক অবস্থানকেও তা আঘাত করেছে। ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে পুলিশি গোয়েন্দাগিরি চালনা করাটা সেই আঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে যে চিন্তার স্বাধীনতা থেকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাঝে উগ্রপন্থী ধারণা বাসা বাঁধছে, সেই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিজেদের আদর্শকেই খাঁচায় পুরতে হচ্ছে ইউরোপিয়দের। একইসাথে যে উগ্রপন্থী চিন্তাকে পুঁজি করে ডানপন্থীরা ইউরোপজুড়ে ক্ষমতায় যাচ্ছে, তার পিছনে জনগণের সমর্থন গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ধারাতেই উগ্রপন্থীরা ইউরোপে আরও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। সেই হিসেবে জার্মান পুলিশের উগ্রপন্থীদের টার্গেট করে চাপের মাঝে ফেলার চেষ্টাখানা যথেষ্টই অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রকে পুঁজি করে পরস্পরবিরোধী এই কার্যকলাপ ইউরোপের আদর্শিক সংকটেরই চিত্র, যা থেকে বের হবার কোন পথ কেউ দেখাতে পারছেন না।


Saturday 5 September 2020

সৌদি পাকিস্তান টানাপোড়েন মুসলিম নেতৃত্বের বিভাজনকেই দেখিয়ে দেয়

০৫ই সেপ্টেম্বর ২০২০
   

কাশ্মির ইস্যুতে অনৈক্য মুসলিম দেশগুলির পারস্পরিক সাংঘর্ষিক জাতীয় স্বার্থের বেড়াজালে আটকে রয়েছে। সৌদি নেতৃত্বের দেশগুলির সাথে তুর্কি নেতৃত্বের দেশগুলির দ্বন্দ্ব এতটাই প্রাধান্য পেয়েছে যে, মুসলিম নেতৃত্বের কাছে কাশ্মির, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন বা উইঘুরের মতো সমস্যাগুলি ছোট হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে চীনের কাছ থেকে ব্যাপক সহায়তা পাওয়ায় পাকিস্তানের জন্যে সৌদি আরবের সাথে মনোমালিন্য কাটিয়ে ওঠা সহজতর হবে। তবে কাশ্মির ইস্যুতে চীন, তুরস্ক বা মালয়েশিয়ার সমর্থন পেলেও এখানেও যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবে না, তার নিশ্চয়তা পাকিস্তানের কাছে নেই। আদর্শগত অবস্থান নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই এগুচ্ছে পাকিস্তানসহ সকলে। অপরদিকে কোন পথে এগুলে কাশ্মির সমস্যার সত্যিকার সমাধান হবে, সেটার উত্তরও পাকিস্তানের কাছে নেই।

 

পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক বেশ গভীর বলেই সকলে জানে, কিন্তু তারপরেও হঠাত করেই সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন দেখা দেয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন পাকিস্তানের পরররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী গত ৪ঠা অগাস্ট পাকিস্তানের একটা টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তিনি আবারও ‘ওআইসি’কে আহ্বান করছেন যাতে তারা কাশ্মির ইস্যুতে কাউন্সিল অব ফরেন মিনিস্টার্সএর একটা আলোচনার ডাক দেয়। যদি ‘ওআইসি’ সেটা করতে ব্যর্থ হয়, তবে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে বলতে বাধ্য হবেন যে, তিনি যেন এমন একটা আলাদা আলোচনার ডাক দেন, যেখানে কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে দাঁড়াবে এমন মুসলিম দেশগুলি যোগ দেয়। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের নিজস্ব কিছু অবস্থান রয়েছে যেগুলি ‘ওআইসি’ এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলিকে বুঝতে হবে। কোরোশীর এই বক্তব্যের পরপরই ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলে যে, সৌদি আরব পাকিস্তানের জন্যে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা স্থগিত করেছে। একইসাথে তারা পাকিস্তানকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ ফেরত দিতে বলে। চীনাদের জরুরি সহায়তায় পাকিস্তান এই ঋণ ফেরত দেয়। এই ঋণ ২০১৮ সালের নভেম্বরে দেয়া হয়েছিল, তখন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভয়াবহ রকমের কমে গিয়েছিল। সৌদি আরব থেকে তেল কেনার মূল্য দেরিতে পরিশোধ করার ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে যে চুক্তি রয়েছে, সেই চুক্তিও সৌদি আরব নবায়ন করা বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানা যায়। ১৭ই অগাস্ট পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া সৌদি আরব সফরে গেলে পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা বলে যে, অনেকেই মনে করছেন যে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ওআইসি’র আরব নেতৃত্বের সমালোচনা এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের জন্যে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারটার সাথে সেনাপ্রধানের এই সফরের সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই সফরকে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবেই আখ্যা দেয়। এর কয়েকদিন পরেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে কাশ্মিরের ব্যাপারে ‘ওআইসি’র ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোরেশীও সাংবাদিকদের বলেন যে, কাশ্মির ইস্যুতে ‘ওআইসি’ বহু রেজোলিউশন পাস করেছে, যার ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। আর সেই ব্যাপারগুলি পাকিস্তানের অবস্থানের সাথে মিল রেখেই হয়েছিল। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেন যে, পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের কোন মতপার্থক্য নেই। এতো অল্প সময়ের মাঝে পরস্পরবিরোধী এই খবরগুলির গুরুত্ব আসলে কোথায়?

সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মাঝে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রয়েছে। গত বছর দুই দশের মাঝে বাণিজ্য ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার; যার মাঝে ৭৪ শতাংশই ছিল সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানের তেল আমদানি। পাকিস্তানের এক চতুর্থাংশ তেল আসে সৌদি আরব থেকে। এছাড়াও প্রায় ২৫ লক্ষ পাকিস্তানি সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছে; যাদের কাছ থেকে পাকিস্তানের মোট রেমিট্যান্স আয়ের ৩০ শতাংশ আসে। অপরদিকে সৌদি আরবের সামরিক বাহিনীর গঠন এবং প্রশিক্ষণের পিছনে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তথাপি কাশ্মির ইস্যুতে সৌদি আরবের পক্ষে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নেয়াটা অতটা সহজ নয়। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভারতের সাথে সৌদি আরবের বার্ষিক বাণিজ্য এখন প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরব এতবড় বাণিজ্যকে ছেড়ে দিয়ে কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নিতে চাইবে না। ভারতের সাথে সৌদিদের সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের অসন্তোষ থাকলেও সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের দরকষাকষির সুযোগ খুব কমই রয়েছে। অন্ততঃ পরবর্তীতে সৌদিদের ব্যাপারে পাকিস্তানের সুর পাল্টে ফেলার ব্যাপারটা সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছে।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর ফেলো মাদিহা আফজাল বলছেন যে, দুই দেশের নির্ভরশীলতার মাঝে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাগুলি বেশ অদ্ভূতই ঠেকেছে। তবে এতে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এটা এর আগেও একবার হয়েছে, যখন গতবছর কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং পাকিস্তান আলাদাভাবে ‘ওআইসি’কে বাইপাস করে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্ব নেবার একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরির দিকে এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেই বৈঠক থেকে শেষ মুহুর্তে নিজের নাম সড়িয়ে নিয়ে সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান বা ‘এমবিএস’এর অধীনে সৌদি আরব তুরস্ক, ইরান এবং কাতারকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হিসেবে দেখছে; পাকিস্তানের সাথে এই দেশগুলির সম্পর্কোন্নয়নও তাই সৌদি আরবের কাছে ভালো ঠেকছে না।

‘উড্রো উইলসন সেন্টার ফর স্কলার্স’এর দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলমান ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, পাকিস্তানের পক্ষে প্রমাণ করা কঠিন হচ্ছে যে, পাকিস্তানের কাশ্মির নীতি কাজ করছে। এই প্রচেষ্টা যদি ফলাফল না নিয়ে আসে, তাহলে তারা কি করবে? ইসলামাবাদের ‘কায়েদ এ আজম ইউনিভার্সিটি’র এসিসট্যান্ট প্রফেসর রাজা কায়সার আহমেদ বলছেন যে, এখন পর্যন্ত কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তান শুধুমাত্র চীন, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়াকে পাশে পেয়েছে। এর থেকে বের হতে পাকিস্তানের আরও আক্রমণাত্মক কূটনীতিতে যেতে হবে। কুগেলমান বলছেন যে, সৌদিদের সাথে সমস্যা খুব সহজেই মুছে যাবে না; তবে চীন এবং আরবের বাইরে অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান।

কাশ্মির ইস্যুতে অনৈক্য মুসলিম দেশগুলির পারস্পরিক সাংঘর্ষিক জাতীয় স্বার্থের বেড়াজালে আটকে রয়েছে। সৌদি নেতৃত্বের দেশগুলির সাথে তুর্কি নেতৃত্বের দেশগুলির দ্বন্দ্ব এতটাই প্রাধান্য পেয়েছে যে, মুসলিম নেতৃত্বের কাছে কাশ্মির, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন বা উইঘুরের মতো সমস্যাগুলি ছোট হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে চীনের কাছ থেকে ব্যাপক সহায়তা পাওয়ায় পাকিস্তানের জন্যে সৌদি আরবের সাথে মনোমালিন্য কাটিয়ে ওঠা সহজতর হবে। তবে কাশ্মির ইস্যুতে চীন, তুরস্ক বা মালয়েশিয়ার সমর্থন পেলেও এখানেও যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবে না, তার নিশ্চয়তা পাকিস্তানের কাছে নেই। আদর্শগত অবস্থান নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই এগুচ্ছে পাকিস্তানসহ সকলে। অপরদিকে কোন পথে এগুলে কাশ্মির সমস্যার সত্যিকার সমাধান হবে, সেটার উত্তরও পাকিস্তানের কাছে নেই।

Tuesday 1 September 2020

করোনা মন্দায় পুঁজিবাদের নিম্নগামীতাকে থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই!

২রা সেপ্টেম্বর ২০২০

দুনিয়ার সবচাইতে ধনী ব্যক্তি ‘আমাজন’এর প্রতিষ্ঠাতা বেফ বেজস করোনাভাইরাসের মন্দার মাঝে রেকর্ড পরিমাণ আয় করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার বেশিরভাগ অর্থ ব্যাংক এবং কর্পোরেটদের হাত ঘুরে গুটি কয়েক ধনীদের পকেটেই গিয়েছে। প্রণোদনার অর্থে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়েছে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্যেই। অপরদিকে প্রণোদনার অর্থে উঠে দাঁড়ানো ধনীদের অফশোর ব্যাংক একাউন্টও ফুলে ফেঁপে উঠছে। পুঁজিবাদের করুণ অবস্থা করোনাভাইরাসের আগে থেকেই দৃশ্যমান ছিল; বিশেষ করে ব্যাপক আয় বৈষম্যের প্রতিবেদনে পত্রিকার পাতা ভরেছে সাম্প্রতিক সময়ে। করোনাভাইরাসের মাঝে এই করুণ দৃশ্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় আয় বৈষম্যের চিত্রটা এখন আর সমাধানের পর্যায়ে নেই। পুঁজিবাদের নিম্নগামীতাকে থামাতে পারছেন না কেউই।

‘বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ’এর এক গবেষণা বলছে যে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় যেখানে মানুষের পকেট থেকে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গিয়েছিল, এবছর করোনাভাইরাসের কারণে সেটা ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে যেতে পারে। তবে এই সম্পদহানি সকলের জন্যে সমানভাবে আসেনি। ‘বিজনেস ইনসাইডার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের লকডাউনের কারণে যেখন প্রায় ৪ কোটি মানুষ তাদের চাকুরি হারাবার পর সরকারের কাছে বেকার ভাতা চেয়েছে, সেখানে সেদেশের বিলিয়নায়াররা আরও বেশি করে অর্থ কামিয়ে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নায়াররা একত্রে প্রায় ৬’শ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত সম্পদ আয় করে নিয়েছেন। মার্চ থেকে জুনের মাঝে ‘আমাজন’এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজস তার সম্পদকে ৪৮ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে নিয়েছেন। ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যার ‘জুম’এর মালিকের সম্পদ বেড়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলার। ‘মাইক্রোসফট’এর প্রধান নির্বাহী স্টিভ বলমারএর সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে এই মানুষগুলি ঠিক সময়ে ঠিক ব্যবসায়ে থাকার ফলেই লাভবান হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও কিছু ঘটনা রয়েছে, যা এই যুক্তির বিরুদ্ধে যাবে। ক্যাসিনো মালিক শেলডন এডেলসন তার সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন ৫ বিলিয়ন ডলার। এলন মাস্কও তার সম্পদ বাড়িয়েছে ১৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, এর আগে ২০০৭ সালে হাউজিং কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও এমনটাই ঘটেছিল। বাড়িঘরের মূল্য পড়ে গিয়েছিল ২১ শতাংশ; শেয়ার বাজারের মূল্য হয়ে গিয়েছিল অর্ধেক; ৮৮ লক্ষ আমেরিকান হয়েছিল বেকার। সেই মন্দার পরপর ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মাঝে নিচের ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছিল শূণ্য দশমিক ৪ শতাংশ; অপরদিকে উপরের ১ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছিল ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ।

‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্বে আয় বৈষম্য আরও বাড়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে, ধনীরা গত মার্চের পর থেকে অর্থ জমাতে সক্ষম হয়েছে; আর অন্যদিকে গরীব লোকেরা আয় না থাকার কারণে বাধ্য হয়েছে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিতে এবং নতুন করে ধারকর্য করতে। ব্রিটেনের ‘রেজোলিউশন ফাউন্ডেশন’এর এক গবেষণা বলছে যে, ব্রিটেনের নিম্ন আয়ের মানুষের বেশিরভাগই জুন মাসে ক্রেডিট কার্ডের উপর বেঁচে ছিল। লাক্সারি জিনিসপত্রের দোকান বন্ধ থাকায় এবং ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ধনী ব্যক্তিদের খরচ কমে গেছে। ‘নিউ পলিসি ইন্সটিটিউট’এর গবেষণা বলছে যে, ব্রিটেনের সমাজের উপরের ২০ শতাংশ মানুষের ব্যাংক একাউন্টে লকডাউনের মাঝে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার জমে গেছে। হারভার্ডের একদল গবেষক বলছে যে, মার্কিন সমাজের উপরের ২৫ শতাংশ মানুষের খরচ ২০ শতাংশ কমেছে; অথচ নিচের ২৫ শতাংশের খরচ কমেছে মাত্র ৫ শতাংশ। ধনীদেরকে টার্গেট করা লাক্সারি গাড়ি তৈরির কারখানা, দামী জামাকাপড় বিক্রেতা, রেস্টুরেন্ট, হোটেলগুলি বিপদে পড়েছে; আর ব্যবসা মালিকরা খরচ কমাতে গিয়ে কম মজুরির কর্মচারীদেরকে ছাঁটাই করেছে। ধনীদের সম্পদ যারা দেখাশোনা করছেন, তারা আবার উপদেশ দিচ্ছে যে, আপাততঃ বিনিয়োগ এবং খরচ কম করাই ভালো হবে। প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হচ্ছে যে, একজন ধনী ব্যবসায়ী যদি বাড়ি থেকেই কাজ করেন, তাহলে নতুন স্যুট কিনে তিনি কি করবেন? আর তার স্ত্রী যেহেতু কোন পার্টিতে যাচ্ছেন না, তাই নতুন লাক্সারি জিনিসপত্র কিনে তিনি কাকে দেখাবেন? সাধারণ সময়ে বোঝা না গেলেও মহামারি এবং অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেই বোঝা যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র কিছু ধনী ব্যক্তির ইচ্ছেমত খরচের উপর পুরো অর্থনীতিটা কিভাবে চলছে।

সমাজের উপরের স্তরের মানুষের সাথে নিচের স্তরের মানুষের এই ক্রমবর্ধমান বিভেদ, যা কিনা অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে বেড়েছে, এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ‘বিজনেস ইনসাইডার’ বলছে যে, এখানে দু’টা সমস্যার দিকে তাকাতে হবে। প্রথমতঃ সরকার বেশিরভাগ প্রণোদনা দেয় ব্যাংক এবং কর্পোরেটদেরকে। ২০০৮ সালের ‘ইমার্জেন্সি ইকনমিক স্ট্যাবিলাইজেশন এক্ট’এর অধীনে ৭’শ বিলিয়ন ডলার খরচে ব্যাংকগুলির কাছ থেকে মূল্য পড়ে যাওয়া সম্পদ কিনে নেয়া হয়। পরবর্তীতে বারাক ওবামা প্রশাসন ‘ট্রাবল্ড এসেট রিলিফ প্রোগ্রাম’ প্রকল্পের অধীনে বাড়ির মালিকদেরকে ৭৫ বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দিয়ে তাদের সুদ পরিশোধে সহায়তা দেয়। অর্থাৎ ৭’শ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা থেকে ৭৫ বিলিয়ন বা ১০ শতাংশ গিয়েছে বাড়ির মালিকদের কাছে; বাকিটা গিয়েছে ব্যাংক এবং কর্পোরেটদের কাছে। দ্বিতীয়তঃ কর্পোরেটদের হাতে প্রণোদনার অর্থ যাওয়ায় তারা শেয়ার বাজারে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে নিতে পেরেছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যারা প্রণোদনার অর্থ পায়নি, তারা ঝরে পড়েছে। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডেরাল রিজার্ভ ২০০৮ সালে স্বল্পমেয়াদী সুদের হার প্রায় শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসে। আর এই সুযোগে ব্যবসায়ীয়া পরবর্তী এক দশকে শেয়ার বাজার গরম করে রাখে। ‘স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর্স ৫০০’ ইন্ডেক্স মূল্যসূচক ৪’শ ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ হলো, মন্দার সবচাইতে খারাপ সময়ে যে ব্যবসায়ী শেয়ার বাজারে ১’শ ডলার বিনিয়োগ করেছে, সে ৪’শ ৬২ ডলার পর্যন্ত কামিয়ে নিতে পেরেছে। আর ১ মিলিয়ন ডলার যে বিনিয়োগ করেছে, সে তুলে নিয়েছে ৪ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিনিয়োগের সাড়ে চার গুণেরও বেশি সে তুলে নিতে পেরেছে। ২০০৯ সালের মাঝেই অতিধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদ ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৩৯ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যায়; মন্দার কারণে তারা যা হারিয়েছিল, তার পুরোটাই তারা এক বছরের মাঝেই পুষিয়ে নেয়। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মাঝে সকল মানুষের আয় মোট যত বৃদ্ধি পেয়েছে, তার ৯৫ ভাগই গিয়েছে ১ শতাংশ মানুষের হাতে; আর ৯৯ শতাংশ মানুষ পেয়েছে মাত্র ৫ ভাগ। আর যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের মাঝে বিলিয়নায়ারদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ শতাংশ।   
 

সারা দুনিয়ায় আয় বৈষম্য এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০০৮ সালের মতোই ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সময় যখন প্রণোদনা দেয়া হয়, তখনও বেশিরভাগ অর্থ চলে যায় কর্পোরেটদের হাতে। ধনীরা গত মার্চের পর থেকে অর্থ জমাতে সক্ষম হয়েছে; আর অন্যদিকে গরীব লোকেরা আয় না থাকার কারণে বাধ্য হয়েছে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিতে এবং নতুন করে ধারকর্য করতে।
 

২০০৮ সালের মতোই ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সময় যখন প্রণোদনা দেয়া হয়, তখনও বেশিরভাগ অর্থ চলে যায় কর্পোরেটদের হাতে। ‘স্মল বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন’এর মাধ্যমে ৩’শ ৪৯ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হয়, যার মাঝে ২’শ ৪৩ বিলিয়ন ডলার পায় বড় কর্পোরেটরা; যাদের কোন কোনটা ১’শ মিলিয়ন ডলারের চাইতে বড় কোম্পানি। ১৬ই মার্চ ‘ডাউ জোন্স’ ইন্ডেক্স ইতিহাসে একদিনের সবচাইতে মারাত্মক ধ্বসের মাঝে পড়ে। অথচ ৪ঠা জুনের মাঝেই বিশ্বের সবচাইতে ধনী সাত ব্যক্তির সম্পদ ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়! সরকারের প্রণোদনা ঘোষণার পরপরই শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং স্বাভাবিকভাবেই বড় শেয়ারহোল্ডার ব্যক্তিরা তাদের সম্পদ বাড়িয়ে ফেলে।

২০১০ সালে হাইতিতে ভূমিকম্পের পর ১’শ ৯৫ মিলিয়ন ডলারের যে সহায়তা দেয়া হয়, তার বেশিরভাগই চলে যায় মার্কিন কন্সট্রাকশন কোম্পানির কাছে; হাইতির কোম্পানিগুলি পায় মাত্র আড়াই শতাংশ ফান্ড। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়ান্সএ হারিকেন ‘ক্যাটরিনা’ আঘাত করার পর মার্কিন কন্সট্রাকশন কোম্পানি ‘কেবিআর’ ৩১ বিলিয়ন ডলারের কাজ পায়। এই কোম্পানির মালিক ‘হ্যালিবারটন’এর প্রধান নির্বাহী ছিলেন প্রাক্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। নিজেদের বিশাল সম্পদের উপরে সরকার থেকে আরও প্রণোদনা পাওয়ায় এই বিলিয়নায়াররা দুর্যোগের মুহুর্তগুলিকে কাজে লাগিয়ে আরও ধনী হয়েছে। আবার একইসাথে বিনিযোগের সুযোগ বাড়াবার নামে এই বিলিয়নায়ারদেরকে দেয়া হয়েছে কর সুবিধা এবং তাদের অতিরিক্ত মুনাফা করতে পারার জন্যে রেখে দেয়া হয়েছে নানা ফাঁকফোঁকড়। উদাহরণস্বরূপ, লিমিটেড কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রে কোম্পানি মালিকেরা নির্দিষ্ট আকারের ঋণের বেশি কোন ঋণ ফেরত দেবার জন্যে দায়বদ্ধ থাকে না। বিভিন্ন ছুতো ধরে ‘আমাজন’ কোম্পানি দুই বছরে এক ডলারও কর দেয়নি; আর ২০১৯ সালে তারা আয়ের উপর মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ কর দেয়! ১৯৮০এর দশক থেকে বিলিয়নায়ারদের কর ৭৯ শতাংশ কমে গেছে! শুধু তাই নয়, এই অতিধনীদের বেশিরভাগ অর্থই অফশোর ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়েছে। ২০১৭ সালে কিছু গবেষক বের করেন যে, পুরো দুনিয়ার জিডিপির ১০ শতাংশই এসব অফশোর ব্যাংক একাউন্টে চলে গেছে! ২০১২ সালে আরেক গবেষণায় উঠে আসে যে, প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৩২ হাজার বিলিয়ন ডলার অফশোর একাউন্টে জমা রয়েছে! এটা চীনের জিডিপির প্রায় তিন গুণ!

মন্দা থেকে উঠে দাঁড়াতে অনেকেই অনেক ফর্মূলা দিচ্ছেন। ট্রাম্প প্রশাসন জনগণকে নগদ অর্থ প্রদান করতে চাইলে অনেকেই বাধা দিয়েছেন। তবে এরপরেও প্রণোদনার বেশিরভাগ অর্থ ব্যাংক এবং কর্পোরেটদের হাত ঘুরে গুটি কয়েক ধনীদের পকেটেই গিয়েছে। প্রণোদনার অর্থে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়েছে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্যেই। আবার ধনীদের খরচের খাতা থমকে যাওয়াতেও চাকুরি হারাতে হয়েছে খেটে খাওয়া মানুষগুলিকেই। ধনীরা কবে আবার খরচ শুরু করবে, সেদিনের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে গরীব মানুষগুলিকে। ধনীদের মতো অর্থ জমানো দূরে থাক, শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিয়ে ক্রেডিট কার্ডের উপর বেঁচে থাকার পথ বেছে নিতে হয়েছে তাদের। অপরদিকে প্রণোদনার অর্থে উঠে দাঁড়ানো ধনীদের অফশোর ব্যাংক একাউন্টও ফুলে ফেঁপে উঠছে। পুঁজিবাদের করুণ অবস্থা করোনাভাইরাসের আগে থেকেই দৃশ্যমান ছিল; বিশেষ করে ব্যাপক আয় বৈষম্যের প্রতিবেদনে পত্রিকার পাতা ভরেছে সাম্প্রতিক সময়ে। করোনাভাইরাসের মাঝে এই করুণ দৃশ্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় আয় বৈষম্যের চিত্রটা এখন আর সমাধানের পর্যায়ে নেই। পুঁজিবাদের নিম্নগামীতাকে থামাতে পারছেন না কেউই।