Tuesday 30 May 2023

বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা হুমকি… নেপথ্যে কি?

৩০শে মে ২০২৩

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ অত্যাধুনিক মার্কিন প্রযুক্তির যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনতে পারবে; যার মাঝে শুরুতেই থাকবে ‘এফ-১৬’ ফাইটার বিমান। এই চুক্তি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির জন্যে নয়; উভয় পক্ষের। যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিকে সামরিক তথ্যের ক্যাটাগরিতে ফেলেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটা দেশের ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতাকে নিজের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ এই দেশগুলি বিশ্বব্যাপী তাদের ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে যা তথ্য সংগ্রহ করবে, সেটা তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করতে বাধ্য থাকবে। 

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে বাধা প্রদানকারী যেকোন ব্যক্তি এবং তার পরিবর্গকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না। খবরটা মুহুর্তের মাঝে পুরো বাংলাদেশে আলোচনার খোরাক হয়ে গিয়েছে। কারণ বাংলাদেশে অনেক মানুষই যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের স্বপ্নের দেশ হিসেবেই দেখে। বিশেষ করে তারা অনেকেই চায় যে তাদের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করুক, অথবা সেখানে বসবাস করুক, অথবা তারা নিজেরাই কোন একদিন তল্পিতল্পা বিক্রি করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পথে পাড়ি জমাবার স্বপ্ন দেখে থাকেন। ঠিক এই ব্যাপারটাকেই কাজে লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলাফলস্বরূপ, ঘোষণার পরের দিনই ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলীয় নেতারা একত্রে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে ভীড় করেছেন। অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে চাইছে। আবার অনেকেই বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে, যেখানে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের টিকিটাও নেই। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির দিকে তারা আঙ্গুল তাক করছেন। তারা অনেকেই মত দিচ্ছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে বাংলাদেশের নির্বাচনের সুযোগটাকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে গণতন্ত্র রক্ষার কথাগুলি ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই নয়।

একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে যে, মূলতঃ ভিসা না দেয়ার হুমকি প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে; যাতে করে তারা বিভিন্ন খাতে বিশেষ সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। এই সুবিধাগুলির মাঝে রয়েছে বহুদিন থেকে ঝুলে থাকা দু’টা সামরিক চুক্তি; যা কিনা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ স্বাক্ষর করতে রাজি হচ্ছিলো না। এই দু’টা চুক্তি হলো ‘আকসা’ এবং ‘জিসোমিয়া’। যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলি পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করতে হলে এই চুক্তি দু’টার বৈশিষ্ট্যগুলি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।

‘আকসা’ … বাংলাদেশের আকাশসীমা, সমুদ্রসীমা, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের ব্যবহার

‘একুইজিশন ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’ বা ‘আকসা’ চুক্তির মাঝে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য যে দেশ এই চুক্তি করবে, তারা একে অপরের সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন প্রকারের লজিস্টিক সহায়তা দেবে। এসব সহায়তার মাঝে রয়েছে খাবার, পানি, কাপড়চোপড়, পরিবহণ, ট্রেনিং, পেট্রোলিয়াম, গোলাবারুদ, মেইনটেন্যান্স, মেডিক্যাল সার্ভিস, ইত্যাদি। মার্কিন কর্মকর্তারা উদাহরণ দিয়ে বলছেন যে, এই চুক্তি মোতাবেক একটা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে জ্বালানি নিতে পারে; যার বিনিময়ে বাংলাদেশ পেমেন্ট পাবে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে তো অনেক দেশের যুদ্ধজাহাজই আসে। এখানে চুক্তির প্রয়োজন কেন? এখানেই আসল ফাঁকিটা রয়ে যাচ্ছে। এই চুক্তি মোতাবেক কোন মার্কিন যুদ্ধজাহাজ বা যুদ্ধবিমান বাংলাদেশে আসলে তাকে বাংলাদেশ মানা করতে পারবে না। অর্থাৎ এতদিন বাংলাদেশে যেসকল মার্কিন সামরিক বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ এসেছে, সেগুলি এসেছে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে। ‘আকসা’ চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশের আমন্ত্রণ ছাড়াও তারা যেকোন সময়ে আসতে পারবে। এবং যদি তারা আসে, তাহলে বাংলাদেশ তাদেরকে এই দেশের বিমানবন্দর এবং সমদ্রবন্দরে ঢুকতে দিতে বাধ্য। চুক্তি মোতাবেক এই যুদ্ধবিমান বা জাহাজগুলি তেল নেয়া বা অন্য যেকোন সার্ভিস নেবার অজুহাতে বাংলাদেশে আসতে পারবে।

পুরো ব্যাপারটা অনেক জটিল হয়ে যাবে যদি এখানে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিকে যোগ করা হয়। যেমন, ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়ে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে তার বিমান ঘাঁটি এবং আকাশসীমা ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছিল। কারণ ইরাক যুদ্ধের জন্যে তুরস্কে জনসমর্থন ছিলো না। যুক্তরাষ্ট্র তখন অভিনব উপায়ে তুরস্ককে সহযোগিতা করতে বাধ্য করেছিল। একটা মার্কিন সামরিক বিমান উত্তর ইরাকে উড়তে গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তুরস্কের বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করে। এরপর থেকে তুরস্কের পুরো আকাশসীমাই মার্কিনীদের সামরিক মিশনের জন্যে খুলে যায়।

বাংলাদেশ যদি তার আকাশসীমা চীনের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে ব্যবহার করতে দিতে ইচ্ছুক না হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তিকে কাজে লাগাবে এবং যেকোন অজুহাতে তাদের বিমান বাংলাদেশে অবতরণ করাবে বা অবতরণ না করিয়েই বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে কোন মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে ওড়া ‘ইএ-১৮জি গ্রাওলার’ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান বা ‘ই-২ডি হকআই’ এয়ারবোর্ন রাডার বিমান বা ট্যাংকার বিমান জ্বালনি খরচ কমাতে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে।

ঠিক এরকম একটা ব্যাপার যদি ভারত-চীনের অরুণাচল প্রদেশ সীমানায় ঘটে, তাহলে কি হতে পারে? ভারত-চীন সম্ভাব্য সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতকে সামরিক সহায়তা দেবে, তা নিশ্চিত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু সহায়তা ভারতকে দেবে, যা ভারতের নেই; যার মাঝে থাকতে পারে গোয়েন্দা বিমান এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমানের সহায়তা। এই বিমানগুলি সহজে অরুণাচল পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করতে চাইবে। এখন বাংলাদেশ যদি তার আকাশসীমা চীনের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে ব্যবহার করতে দিতে ইচ্ছুক না হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তিকে কাজে লাগাবে এবং যেকোন অজুহাতে তাদের বিমান বাংলাদেশে অবতরণ করাবে বা অবতরণ না করিয়েই বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে কোন মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে ওড়া ‘ইএ-১৮জি গ্রাওলার’ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান বা ‘ই-২ডি হকআই’ এয়ারবোর্ন রাডার বিমান বা ট্যাংকার বিমান জ্বালনি খরচ কমাতে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে। ভারত মহাসগরে মার্কিন বিমান ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়া থেকে উড়ে আসা ‘বি-৫২’, ‘বি-১বি’ অথবা ‘বি-২’ বোমারু বিমানও বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করতে চাইবে। একইসাথে তাদের যুদ্ধজাহাজগুলিও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করবে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা সামরিক মহড়ায় কোলকাতার কাছাকাছি কালাইকুন্ড বিমান ঘাঁটিতে ‘এফ-১৫ই’ ফাইটার বিমান ও ‘বি-১বি’ বোমারু বিমান মোতায়েন তাদের এই পরিকল্পনাটাকেই তুলে ধরে। মোটকথা, যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই বাংলাদেশের বিমান ঘাঁটি, সমুদ্রবন্দর, আকাশসীমা এবং সমুদ্রসীমা চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। এখানে বাংলাদেশের বলার কিছুই থাকবে না।

এখন যে কোন দেশই বলতে পারে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এসকল লজিস্টিক্যাল সুবিধা দিতে ইচ্ছুক নয়। এরকম একটা দেশকে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে রাজি করাবে চুক্তি করতে? এই কাজটা তারা বাস্তবায়িত করছে সামরিক ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা তৈরির মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন যে, বাংলাদেশ খুব সহজেই এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত ‘মেটাল শার্ক’ বোটগুলির স্পেয়ার পার্টস পাবে এবং বাংলাদেশের সামরিক সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিং পাবে। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে স্পেশাল ফোর্সকে ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়েছে। এখন সেই ট্রেনিং এবং অস্ত্র অব্যাহত রাখতে তারা বলছে যে, ‘আকসা’ চুক্তি করতে হবে। বাংলাদেশে কেউ কেউ এই ‘সুযোগ’ হাতছাড়া করতে চাইছে না। তারা হয়তো মনে করতে পারেন যে, এই চুক্তি না করলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী এসকল আধুনিক প্রযুক্তি ও ট্রেনিং থেকে বঞ্চিত হবে। ঠিক এই নির্ভরশীলতাটাই যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যে ব্যবহার করে। স্পেয়ার পার্টস এবং ট্রেনিং পেতে হলে বাংলাদেশের বিমান ঘাঁটি, সমুদ্রবন্দর এবং আকাশসীমাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এটাই হলো ‘আকসা’ চুক্তি।

‘জিসোমিয়া’ … বাংলাদেশের ইন্টেলিজেন্সকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজে লাগানো

‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফর্মেশন এগ্রিমেন্ট’ বা ‘জিএসওএমআইএ’ বা ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি হলো গোপন সামরিক তথ্য আদানপ্রদানের চুক্তি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ অত্যাধুনিক মার্কিন প্রযুক্তির যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনতে পারবে; যার মাঝে শুরুতেই থাকবে ‘এফ-১৬’ ফাইটার বিমান এবং ‘এএইচ-৬৪ এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার। তারা বলছেন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে সংবেদনশীল মার্কিন প্রযুক্তিকে সুরক্ষা দেয়া হবে। মার্কিনীরা তাদের প্রযুক্তিকে সুরক্ষা দিতে চাইতেই পারে। তারা বলতে পারে যে, বাংলাদেশ যেন তাদের প্রযুক্তি মার্কিনীদের প্রতিদ্বন্দ্বী, যেমন চীন বা রাশিয়াকে সরবরাহ না করে। কিন্তু এখানে সুকৌশলে কিছু ব্যাপার আলোচনায় আনা হচ্ছে না।

এই চুক্তি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির জন্যে নয়; উভয় পক্ষের। তাহলে বাংলাদেশ কি যুক্তরাষ্ট্রকে কোন প্রযুক্তি সরবহার করবে? না। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে, চুক্তির নামের মাঝেই রয়েছে ‘মিলিটারি ইনফর্মেশন এগ্রিমেন্ট’ অথবা সামরিক তথ্যের ব্যাপারে সমঝোতা; এখানে প্রযুক্তির কথা বলাই হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিকে সামরিক তথ্যের ক্যাটাগরিতে ফেলেছে। এই চুক্তির মাঝে ইন্টেলিজেন্স তথ্যও থাকবে; যেমন স্যাটেলাইট ছবি বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতা, যা কিনা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই রয়েছে। এখন এই সামরিক তথ্য যখন দুই পক্ষের ক্ষেত্রে বলা হবে, তখনই বোঝা যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশকেই তথ্য দিচ্ছে না; বাংলাদেশ থেকে তথ্য নেবেও। কি তথ্য চাইছে যুক্তরাষ্ট্র?

পৃথিবীর বহু দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটা দেশের ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতাকে নিজের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ এই দেশগুলি বিশ্বব্যাপী তাদের ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে যা তথ্য সংগ্রহ করবে, সেটা তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করতে বাধ্য থাকবে। কারণ এই চুক্তিতে তথ্য সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার সামরিক প্রযুক্তি বিক্রয়ের মাধ্যমে বহু দেশের ইন্টেলিজেন্সকে নিজের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করেছে। এটা সত্যিই অভিনব চতুর একটা পদ্ধতি!

গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ ঘোষণা করার পর থেকে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হেলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপ-সহকারি সচিব আফরিন আখতার বলেন যে, ওয়াশিংটন আশা করছে যে, আগামী কয়েক মাসের মাঝেই তারা ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। একইসাথে তিনি বাংলাদেশের সদ্য ঘোষিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’এর প্রশংসা করে বলেন যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘আইপিএস’এর সাথে যথেষ্টই সামঞ্জস্যপূর্ণ।


বাংলাদেশ কি যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই হেলে যাচ্ছে?

ইতোমধ্যেই অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হেলে যাচ্ছে। বিশেষ করে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ ঘোষণা করার পর থেকে এই ধারণাই করছেন অনেকে। নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশের উপরে চাপ প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থগুলিকে বাস্তবায়ন করে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছে। বিশেষ করে যে সামরিক চুক্তিগুলি বহুদিন থেকে ঝুলে ছিল, সেগুলি এক ঝটকায় স্বাক্ষর করিয়ে ফেলতে চাইছে ওয়াশিংটন। নির্বাচনের বছরের এই সুযোগখানা যুক্তরাষ্ট্র হাতছাড়া করতে চাইছে না। আর বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের সদস্যরাই যে যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া যায় না বলে মনে করেন, সেটা সকল দলের রাজনীতিকের একত্রে মার্কিন দূতাবাসে ধর্না দেয়ার মাঝেই ফুটে ওঠে। কিছুদিন আগেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘৬ষ্ঠ ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স’এ যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপ-সহকারি সচিব আফরিন আখতার। তিনি এক সাক্ষাতে বলেন যে, ওয়াশিংটন আশা করছে যে, আগামী কয়েক মাসের মাঝেই তারা ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। একইসাথে তিনি বাংলাদেশের সদ্য ঘোষিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’এর প্রশংসা করে বলেন যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘আইপিএস’এর সাথে যথেষ্টই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, ‘আকসা’ এবং ‘জিসোমিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের যতটুকুইবা ছিলো, তার প্রায় পুরোটাই কেড়ে নিতে চাইছে। এই চুক্তিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এবং ইন্টেলিজেন্সকে এমন কিছু সুযোগ বাংলাদেশের মাটিতে করে দেবে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার বেশিরভাগ কাজটাই বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়াই এদেশের আকাশসীমা, সমুদ্রসীমা, বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারার মতো একটা মারাত্মক চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারলে ওয়াশিংটন বঙ্গোপসাগরে, তথা ভারত মহাসাগরে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে যাবে। একইসাথে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতাকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজে লাগাবার মতো সুযোগও পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা থেকে বাঁচার কোন পদ্ধতিই থাকবে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব তখন পুরোপুরিভাবে ওয়াশিংটনের হাতে চলে যাবে।





সূত্র -
‘Announcement of Visa Policy to Promote Democratic Elections in Bangladesh’ STATEMENT BY SECRETARY ANTONY J. BLINKEN, US Embassy in Bangladesh, 24 May 2023
‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বৈঠক’ in Prothom Alo, 25 May 2023
‘Cope India 2023: India-US Joint Air Exercise Ends With Spectacular Aerial Manoeuvres At Bengal's Kalaikunda’ in Outlook India, 25 April 2023
‘US wants 2 defence deals with Bangladesh’, The Daily Star, 18 October 2019
‘The Acquisition and Cross Servicing Agreement: An Old Tool for the Modern Military’ by William M. Stephens in National Defense University Press, 14 May 2019
‘Dhaka’s relations with Beijing, Moscow don’t influence US-BD ties: State Dept official’, The Business Standard, 17 May 2023
‘Bangladesh in no hurry to sign proposed defence agreements with US’ in The Financial Express, 02 April 2022
‘Drawing South Asia into the US defence perimeter’ by P K Balachandran, in BDNews24, 21 July 2022
‘Bangladesh Tilts Toward the U.S. in the Indo-Pacific’ by Michael Kugelman in Foreign Policy, 30 March 2023
‘Bangladesh tilts toward US Indo-Pacific Strategy: media report’, The New Age, 01 April 2023
‘Above or Beyond: Overflight Considerations for U.S. Military Aircraft’ by Graham William Jenkins in National Defense University Press, 29 December 2021
‘এডিটরস গিল্ড আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক’ Editors Guild, Ekattor TV, 27 May 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=6js21Tn58t4)
‘যুক্তরাষ্ট্র নাকি চীন, কার দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ?’ in BBC Bangla, 04 May 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=kIIZRTwpNJo&t=96s)
‘বাংলাদেশের ইন্দোপ্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা’ in Channel 24, 24 April 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Ex8enRnpmeM)
‘ইন্দো-প্যাসিফিক ‘রূপরেখা’ জানাল বাংলাদেশ, যা আছে এতে’ in BDNews24, 24 April 2023

Sunday 28 May 2023

তুরস্কের নির্বাচন… জাতীয়তাবাদই জয়ী

২৯শে মে ২০২৩

আঙ্কারা। ৩০শে এপ্রিল ২০২৩। একদিকে এরদোগান যেমন জনগণের ইসলামিক আবেগকে বুঝতে পেরে তার পররাষ্ট্র ও আঞ্চলিক নীতিতে উসমানি খিলাফতের সময়ের ‘প্যান-ইসলামিক’ ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তুর্কি জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামকে সংমিশ্রিত করেছেন। ফলাফল হিসেবে তুর্কি নির্বাচনে অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য এরদোগানের রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতাকেই তুলে ধরে। তথাপি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়ার মুসলিম দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সাবেক উসমানি এলাকাগুলিতে প্রভাব বিস্তার তুরস্কের জনগণের আকাংক্ষারই অংশ।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে গড়ায়, তখনই অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানই জয়লাভ করবেন; কারণ নেতৃত্বের দিক দিয়ে তিনি অধিকতর বলিষ্ঠ এবং নির্বাচন জেতার ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতাও বেশি। এরদোগানের জয়লাভ তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জন্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গুরুত্ববহ। কারণ এরদোগানের জন্যে সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং এই নির্বাচনে সর্বাধিক ব্যবহৃত চিন্তাটা ছিল তুর্কি জাতীয়তাবাদ।

এরদোগান প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে ৪৯ শতাংশের বেশি ভোট পাবার পর ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতি ৪৩ শতাংশ হবার পরেও কেউ কেউ বলেছেন যে, আলু এবং পিঁয়াজের মূল্য বাড়ুক বা কমুক, এরদোগান তাদের আশা হিসেবেই থাকবেন। নির্বাচনের আগে জনমত জরিপের ফলাফলে এরদোগান সর্বদাই পিছিয়ে থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হলো। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমস্যা এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী সরকারি উদাসীনতার অভিযোগের পরেও এরদোগানের পক্ষে এই ফলাফল অনেকেই আশা করেননি। এরদোগানের বিরোধীরা অর্থনীতিকেই ব্যবহার করেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ বলছে যে, তুরস্কের অনেক ভোটারই এরদোগানের সমর্থক না হলেও তারা তাকে পরিবর্তন করতে চাননি। কারণ তারা এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে তেমন কিছু জানেনই না। তবে যে ব্যাপারটাতে তারা একমত তা হলো, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে এরদোগান নিঃসন্দেহে অগ্রগামী। প্যারিস-ভিত্তিক এনজিও ‘আরএসএফ’ বলছে যে, গত এপ্রিল মাসে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘টিআরটি’তে এরদোগান তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চাইতে ৬০ গুণ বেশি কভারেজ পেয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে তুরস্কের মিডিয়া এবং আদালতের স্বাধীনতাকে উল্লেখ করে ‘ফ্রিডম হাউজ’ নামের পশ্চিমা আরেকটা এনজিও তুরস্কের গণন্ত্রকে ‘আংশিক স্বাধীন’ থেকে নামিয়ে ‘স্বাধীন নয়’ ক্যাটাগরিতে স্থান দিয়েছে।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যারা এরদোগানের সমর্থক না হয়েও তাকে ভোট দিয়েছেন, তারা বলেছেন যে, এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারোগলু যেসকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলি তিনি কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, সেব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন। অপরদিকে এরদোগানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তারা নিশ্চিত নন; কারণ তিনি সেতু এবং মসজিদ তৈরি করেছেন। এবং তিনি তুর্কি জাতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবার কথা বলেছেন; যা কিনা তুর্কিদের জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছে। অপরদিকে পশ্চিমা স্বাধীনচেতা ধ্যানধারণায় অধিকতর বিশ্বাসীরা অনেকেই এরদোগানের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন; যাদের মাঝে রয়েছেন নারীবাদী এবং সমকামিতার সমর্থকেরা। নির্বাচনের আগে আগে ‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে এক সাক্ষাতে এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারোগলু বলেন যে, তিনি নির্বাচনে জিতলে তুরস্ককে পশ্চিমাদের আরও কাছে নিয়ে যাবেন; কারণ তারা কথায়, সেটাই তুরস্কের ভবিষ্যৎ।

‘বিবিসি’ বলছে যে, তুরস্কের নির্বাচনে যে ব্যাপারটা সকলেই ব্যবহার করেছেন, তা হলো জাতীয়তাবাদ। কে কার চাইতে বেশি জাতীয়তাবাদী, সেটা প্রমাণ করেই সকলে ভোট চেয়েছেন। তুরস্কের এবারের পার্লামেন্ট ইতিহাসের সবচাইতে বেশি জাতীয়তাবাদী পার্লামেন্ট। এরদোগান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে নতুন ‘তুর্কি শতাব্দী’র সূচনা করবেন। তার সমর্থকেরা বলছেন যে, এরদোগান আরও উন্নয়ন এবং আরও শক্তিশালী তুরস্ক উপহার দেবেন। অপরদিকে কিলিচদারোগলু প্রথমদিকে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিলেও কিছুদিন আগেই নির্বাচনী জনসভায় ঘোষণা দেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে সকল সিরিয় শরণার্থীকে দেশে ফেরত পাঠাবেন। কিলিচদারোগলুর এরূপ জাতীয়তাবাদী বক্তব্য তুরস্কে অনেকেই পছন্দ করেছে। প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে জয়ী না হবার পর তিনি ডানপন্থীদের আকৃষ্ট করতে আরও বেশি সচেষ্ট হয়েছেন।

ইস্তাম্বুল। ২৯শে মে ২০১৬। কন্সটানটিনোপল বিজয়ের ৫৬৩তম বার্ষিকীতে এরদোগান। এরদোগানের প্রতিটা কর্মকান্ডের মাঝেই ছিল শক্তিশালী জাতি, ইসলামিক আবেগ এবং ঐতিহাসিক গৌরবের ইঙ্গিত। ১৪৫৩ সালের ২৮শে মে তৎকালীন বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপলের উপর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত চুড়ান্ত আক্রমণ শুরু করেছিলেন; যার ফলশ্রুতিতে এর পরদিন মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে শহরটার পতন হয় এবং সুলতান মেহমেত বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করেন। এই শহরটার নামই এখন ইস্তাম্বুল। এবারের নির্বাচনেও এরদোগান সেরকমই পরিকল্পনা করেছেন- বিজয়ী হলে ২৯শে মে কন্সটানটিনোপল বিজয়ের ৫’শ ৭০তম বার্ষিকীতে তিনি বিজয়ীর বেশে ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করবেন।

গত ২৩শে এপ্রিল তুরস্কের নৌবাহিনীর প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আনাদোলু’র উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন যে, তিনি আশা করছেন যে, এই যুদ্ধজাহাজ বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের নাম তুলে ধরতে সহায়তা করবে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এরদোগানের প্রতিটা কর্মকান্ডের মাঝেই ছিল শক্তিশালী জাতি, ইসলামিক আবেগ এবং ঐতিহাসিক গৌরবের ইঙ্গিত। আর এই ইঙ্গিতটাই এরদোগানকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে আলাদা করেছে বারংবার। ১৪৫৩ সালের ২৮শে মে তৎকালীন বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপলের উপর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত চুড়ান্ত আক্রমণ শুরু করেছিলেন; যার ফলশ্রুতিতে এর পরদিন মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে শহরটার পতন হয় এবং সুলতান মেহমেত বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করেন। এই শহরটার নামই এখন ইস্তাম্বুল। এবারের নির্বাচনেও এরদোগান সেরকমই পরিকল্পনা করেছেন- বিজয়ী হলে ২৯শে মে কন্সটানটিনোপল বিজয়ের ৫’শ ৭০তম বার্ষিকীতে তিনি বিজয়ীর বেশে ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করবেন।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এরদোগান ক্ষমতাসীন থাকার সময় তুরস্কের সংস্কৃতিতে অটোমান বা উসমানি খিলাফতের সময়ের ঐতিহ্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। উসমানি সময়ের বিভিন্ন স্থাপনা উন্মুক্ত করা এবং সেই সময়ের আদলে নতুন করে মসজিদ তৈরি করা ছাড়াও ঐতিহাসিক টেলিভিশন সিরিয়াল বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এরদোগান তার ইমেজকে যতটা না ইসলামিক দেখিয়েছেন, তার চাইতে বেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে সাজিয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও সেটাই করেছেন; ঠিক যে ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা গিয়েছে। তুরস্কে সাম্প্রতিক সময়ে আর্মেনিয় বা কুর্দি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চলেছে; অনেকের উপরে আক্রমণও হয়েছে; যা কিনা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থানকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। একসময়ের কেমালিস্টরাও জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরতে কেমাল আতাতুর্কের অর্জনগুলিকে তুলে ধরেছে। আর এরদোগানের সময়ের জাতীয়তাবাদীরা এর সাথে ইসলামকে সংমিশ্রিত করেছে। সেই আলোকেই ইস্তাম্বুলে ‘প্যানোরামা ১৪৫৩ হিস্টোরি মিউজিয়াম’ তৈরি করা হয়েছে; যেখানে সুলতান মেহমেতের কন্সটানটিনোপল বিজয়কে হাইলাইট করা হয়েছে।

একদিকে এরদোগান যেমন জনগণের ইসলামিক আবেগকে বুঝতে পেরে তার পররাষ্ট্র ও আঞ্চলিক নীতিতে উসমানি খিলাফতের সময়ের ‘প্যান-ইসলামিক’ ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তুর্কি জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামকে সংমিশ্রিত করেছেন। ফলাফল হিসেবে তুর্কি নির্বাচনে অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য এরদোগানের রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতাকেই তুলে ধরে। তথাপি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়ার মুসলিম দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সাবেক উসমানি এলাকাগুলিতে প্রভাব বিস্তার তুরস্কের জনগণের আকাংক্ষারই অংশ। তবে একইসাথে তা সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজেরবাইজানের মতো আঞ্চলিক সংঘাতে জড়ানো ছাড়াও গ্রিস, আর্মেনিয়া এবং ফ্রান্সের মতো দেশের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে; যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও বৃদ্ধি পেলো।

Wednesday 24 May 2023

বাখমুতের যুদ্ধ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

২৪শে মে ২০২৩

১৯শে মে ২০২৩। বাখমুত শহরের ধ্বংসাবশেষ। বাখমুত শহরের যুদ্ধক্ষেত্রের ছবিগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা-যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে আনে। শহরের তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর এখানে কত সেনার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও কেউই বলতে পারে না। বাখমুতের যুদ্ধটা যতটা সামরিক, তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক। রাশিয়ায় জনমতের জন্যে এই বিজয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে এই শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাবার খবরটা ইউক্রেনিয়দের মনোবলকে আঘাত করবে এবং একইসাথে ইউক্রেনের বন্ধু দেশগুলির মাঝে দুশ্চিন্তার জন্ম দেবে।

গত ২০শে মে এক বিবৃতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বাখমুত শহর জয় করার জন্যে রুশ সেনা এবং ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনাদের অভিনন্দন জানান। পরদিন ইউক্রেনের সেনাপ্রধান কর্নেল জেনারেল আলেক্সান্দর সিরসকি বলেন যে, ইউক্রেনিয় সেনারা শহরটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। আর ইউক্রেনের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী হানা মালইয়ার বলেন যে, ইউক্রেনিয় সেনারা শহরের আশপাশ থেকে অগ্রসর হচ্ছে, এবং তারা শহরটার অনেকটাই ঘিরে ফেলেছে।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, ইউক্রেনিয়রা যখন বলছিল যে, বাখমুতের আশেপাশের অঞ্চলগুলির দখল নিয়ে রুশদের সাথে ইউক্রেনিয়দের যুদ্ধ চলছে, তখন এটা মোটামুটি বোঝা গিয়েছে যে, ১০ মাসের ভয়াবহ যুদ্ধের পর বাখমুত শহর অবশেষে রুশদের হাতে চলে গেছে। ইউক্রেনিয়দের হাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে খারকিভ এবং নভেম্বরে বন্দর শহর খেরসনের পতনের পর অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিল যে, ইউক্রেনিয়রা যুদ্ধে জিততে চলেছে। বাখমুতের জনগণের মাঝে কেউ কেউ আশা করতে শুরু করেছিল যে, এই শহরটাও ইউক্রেনিয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কিন্তু এই পুরো সময়ে রুশরা একবারের জন্যেও বাখমুতের দিক থেকে চোখ সরায়নি। ডিসেম্বর মাসে ইউক্রেনিয় প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি বাখমুত শহর পরিদর্শনে গিয়ে শহরটার নিয়ন্ত্রণকে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরেন। হয়তো তখনই শহরটার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, ইউক্রেনিয়রা শেষ পর্যন্ত এই শহরের জন্যে যুদ্ধ করবে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন সফরে জেলেন্সকি বাখমুতকে ইউক্রেনের ‘মনোবলের দুর্গ’ বলে আখ্যা দেন এবং বলেন যে, বাখমুতের ফলাফল পুরো যুদ্ধের দিক পরিবর্তন করে দেবে।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পুরো ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্যে বাখমুত শহরের দখল রাশিয়ার জন্যে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উভয় পক্ষ এই শহরটাকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, তা এর কৌশলগত গুরুত্বকে বহুগুণে ছাপিয়ে গেছে। এই শহরের নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনিয়দের মনোবল ধরে রাখার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনের বড় অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেও পরবর্তীতে ইউক্রেনিয় প্রতি-আক্রমণে দখলকৃত অঞ্চল হারাবার ফলে রুশদের জন্যে বাখমুতের দখল একটা সন্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একারণেই ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের ওয়াগনার গ্রুপকে সেখানে মোতায়েন করা হয় যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার জন্যে। বাখমুতের বিজয় হয়তো প্রিগোঝিনের বিজয় হিসেবেই পরিচিতি পাবে; এবং একইসাথে তা ক্রেমলিনে প্রিগোঝিনের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারে।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে কেন একটা অগুরুত্বপূর্ণ শহর, যার নাম বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি, সেটার দখল নেবার জন্যে উভয় পক্ষই এতটা মরিয়া হলে গেলো। গত মার্চ মাসে পশ্চিমা সাংবাদিকদের মিছিল দেখে বাখমুতে ইউক্রেনিয় এক সেনা মন্তব্য করেছিল যে, মনে হচ্ছে যেন সকল শকুন এক জায়গায় চলে এসেছে। বাখমুত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবার আগে এই সাংবাদিকেরা কোথায় ছিল? বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের সময় অনেক স্থানই হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়; যখন উভয় পক্ষের কেউই সেটা ছাড়তে চায় না; যখন উভয়েই নিজেদের সন্মান এবং মনোবল রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ঊনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ হবার আগে গেটিসবার্গ শহরের নাম কেউই জানতো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ আইওজিমা-র নামও কেউ শোনেনি; যার দখল নেবার জন্যে বহু জাপানি ও মার্কিন সেনা হতাহত হয়েছিল। একুশ শতকে ইরাক যুদ্ধের আগেও ফালুজা শহরের নাম বেশিরভাগ মানুষ শোনেনি; যেখানে মার্কিনীরা বেশ কষ্ট করে শহরটার দখল নিয়েছিল।


‘আল জাজিরা’ বলছে যে, জাপানে ‘জি৭’ বৈঠকে জেলেন্সকি যখন বলেন যে, বাখমুত শহরের কিছুই অবশিষ্ট নেই, তখন তিনি হয়তো বোঝাতে চাইছিলেন যে, ইউক্রেন যদি বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ হারায়, তাহলে রাশিয়া এই শহরের দখল নিয়ে তেমন কোন সুবিধা পাবে না। এই শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাবার খবরটা ইউক্রেনিয়দের মনোবলকে আঘাত করবে এবং একইসাথে ইউক্রেনের বন্ধু দেশগুলির মাঝে দুশ্চিন্তার জন্ম দেবে। গত মার্চে প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি বলেছিলেন যে, যদি বাখমুতের পতন হয়, তবে রুশরা হয়তো যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারে; যার মাধ্যমে ইউক্রেয়নিদেরকে হয়তো অগ্রহণীয় কোন প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করা হতে পারে। অপরদিকে এই বিজয় রুশদের মনোবল বৃদ্ধি করবে; যারা গত ১০ মাসে বড় কোন বিজয় পায়নি। এখন রুশরা হয়তো আরও পশ্চিমে, বিশেষ করে ৫০ কিঃমিঃ দূরে ক্রামাটোরস্ক শহরের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করতে পারে। গত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তর বলে যে, বাখমুতের দখল নিতে পারলে রুশরা ক্রামাটোরস্ক এবং স্লোভিয়ানস্কএর মতো বড় শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করতে পারে।

বাখমুত শহরের যুদ্ধক্ষেত্রের ছবিগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা-যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে আনে। শহরের তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর এখানে কত সেনার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও কেউই বলতে পারে না। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বাখমুতের যুদ্ধটা যতটা সামরিক, তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক। রাশিয়ায় জনমতের জন্যে এই বিজয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে ওয়াগনার গ্রুপের ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন এই যুদ্ধে তার পুরো সন্মানকে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, তার ভাড়াটে বাহিনী রুশ সেনাবাহিনীর চাইতে বেশি পারদর্শী। প্রিগোঝিন জনসন্মুখে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু-র সমালোচনা করেছেন। কাজেই বাখমুতে বিজয় অর্জন ছাড়া প্রিগোঝিনের সামনে কোন পথই খোলা ছিল না। এই দুই ব্যক্তির মাঝে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়েছে বাখমুত। অস্ট্রেলিয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জেনারেল মিক রায়ান ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, বাখমুত ছাড়ার পর ইউক্রেনিয়রা ক্রামাটোরস্ক রক্ষা করার চেষ্টা করবে। আর যেহেতু এই এলাকাটার প্রতিরক্ষা বৃদ্ধি করতে তারা অনেক সময় পেয়েছে এবং শহরটা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় অবস্থিত, তাই বাখমুতের চাইতে ক্রামাটোরস্ক রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে; যার অর্থ হলো ক্রামাটোরস্কের যুদ্ধ বাখমুতের যুদ্ধের মতো বা তার চাইতেও বেশি রক্তক্ষয়ী হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, বাখমুতের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে রুশরা দ্রুতই তাদের পরবর্তী আক্রমণে যেতে পারবে কিনা; অথবা ইউক্রেনিয়রা যত ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছে, তাতে ইউক্রেনিয়দের বসন্তের বহুল প্রতিক্ষীত প্রতি-আক্রমণের ধার কমে যাবে কিনা।

Saturday 20 May 2023

ব্রিটিশরা ইউক্রেনকে দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে কেন?

২০শে মে ২০২৩

ব্রিটিশ 'স্টর্ম শ্যাডো' ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ইউক্রেন যাতে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যবহার না করে, সেটার গ্যারান্টি কিন্তু ওয়াশিংটনকে লন্ডনের কাছ থেকেই নিতে হবে। অর্থাৎ ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ করলেও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের রজ্জু ব্রিটিশরা তাদের হাতে রাখতে চাইছে। রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের উত্তেজনা কতটা বৃদ্ধি পাবে, সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের মাঝে রয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা; যা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করার ব্রিটিশ প্রচেষ্টারই অংশ।

ব্রিটেন ইউক্রেনকে ‘স্টর্ম শ্যাডো’ নামের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার ঘোষণা দেয়ার পর তা মিডিয়াতে বেশ আলোচিত হচ্ছে। ‘সিএনএন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেটের পাল্লা প্রায় ৮০ কিঃমিঃ; যার তুলনায় ‘স্টর্ম শ্যাডো’র পাল্লা প্রায় আড়াই’শ কিঃমিঃ। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যুদ্ধবিমান থেকে ছোঁড়া হয়ে থাকে। মার্কিন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সেডরিক লেইটন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি দেড়’শ ফুটের কম উচ্চতা দিয়ে উড়ে গিয়ে টার্গেটে হামলা করে বলে এগুলি খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। ইউক্রেনিয়রা বলছে যে, তারা এগুলিকে রাশিয়ার ভূখন্ডের ভেতর হামলায় ব্যবহার করবে না। তবে যেহেতু ব্রিটেন ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে ইউক্রেনের অংশ বলে স্বীকৃতি দেয়, তাই এগুলি হয়তো ক্রিমিয়ায় রুশ সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। মার্কিনীর ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার ‘এটাকমস’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে রাজি হয়নি। ‘স্টর্ম শ্যাডো’র পাল্লা কিছুটা কম হলেও তা ‘এটাকমস’এর চাইতে আরও অনেক বেশি সক্ষমতার; কারণ এটাকে ধ্বংস করা বেশ কঠিন।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র সিনিয়র ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং এক লেখায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মার্কিনীরা ইউক্রেনিয়দেরকে ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেট এবং এর সাথে প্রয়োজনীয় ইন্টেলিজেন্স সরবরাহ করার পর থেকে রুশ লজিস্টিকস ব্যবস্থা এবং কমান্ড সেন্টারগুলি চাপের মাঝে পড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রুশরা তাদের কমান্ড সেন্টারগুলি এবং লজিস্টিকস হাবগুলিকে ফ্রন্টলাইন থেকে ১’শ ২০ কিঃমিঃ দূরে বা রকেটের পাল্লার বাইরে নিয়ে গিয়েছে।

রুশ কমান্ড সেন্টারগুলি এখন শক্তিশালী বাংকারের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে; যা রকেটের পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তবে ‘স্টর্ম শ্যাডো’র ওয়ারহেড এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে করে তা শক্তিশালী বাংকার ধ্বংস করতে পারে। রুশরা তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত করেছে; যার ফলে ইউক্রেনিয়রা আক্রমণে গেলেই রুশ আর্টিলারি তাদের মারাত্মক চাপের মাঝে ফেলছে। রুশরা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করেছে। তবে ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপাস্ত্রগুলি আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারের পক্ষে খুঁজে বের করা বা ধ্বংস করা কষ্টকর।

ওয়াটলিং বলছেন যে, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইউক্রেনের হাতে যাবার কারণে রাশিয়া তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে বাধ্য হবে। আর ক্রিমিয়া উপদ্বীপের রুশ বিমান ঘাঁটিগুলিতে এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করলে সেই ঘাঁটির বিমানগুলি ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময়ের জন্যে বাধা দিতে পারবে না। একইসাথে ইউক্রেনিয়রা এই ক্ষেপণাস্ত্রকে নিজেদের হাতে রেখে দিয়েই রুশদেরকে মানসিকভাবে চাপের মাঝে ফেলতে পারে।



ব্রিটেনের ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে ‘রুসি’র ডিরেক্টর নীল মেলভিন বলছেন যে, ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইউক্রেনের সক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রকে তারা যথেষ্টই প্রভাবিত করতে পারবে। তবে কোন একটা অস্ত্র পুরো যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিনীরা ইউক্রেনকে ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেট দেয়ার পর থেকে রুশরা সেই অনুযায়ী নিজেদের কর্মকান্ডকে পরিবর্তন করেছে; যা কিনা যুদ্ধক্ষেত্রে ‘হিমারস’এর প্রভাবকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। কাজেই যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হলে ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া সাঁজোয়া যান, ক্ষেপণাস্ত্র, মাইন অপসারণ প্রযুক্তি, যুদ্ধবিমান, ব্রিজ তৈরির সরঞ্জাম, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পদাতিক বাহিনীর ট্রেনিং, ইন্টেলিজেন্স এবং লজিস্টিকসের সমন্বয় ঘটাতে হবে; যোগাযোগের যথেষ্ট ব্যবহার করতে হবে এবং নিজেদের পক্ষে একটা ভরবেগ তৈরি করতে হবে। ইউক্রেনের হাতে এই ক্ষেপণাস্ত্রের অর্থ হলো, রুশরা কমান্ড সেন্টার, রসদের মজুত বা জ্বালানির ডিপোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিকে এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের সমন্বয় কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়বে।

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, যুদ্ধের মাঝে বিশেষ কিছু অস্ত্র নিয়ে এত বেশি আলোচনা হচ্ছে যে, যুদ্ধকৌশলের গুরুত্বটা সকলেই ভুলে যাচ্ছেন; যা কিনা যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার জন্যে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলির একেকটার মূল্য প্রায় ১০ লক্ষ ডলার। ব্রিটেন ইউক্রেনকে যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার মতো যথেষ্ট সংখ্যক ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না। কিন্তু যদি ইউক্রেন এগুলিকে চতুরতার সাথে ব্যবহার করে, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু ফাঁকা ক্ষেত্র তারা তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে; যা কিনা তাদেরকে যুদ্ধের মোড় ঘোরাবার মতো সুযোগ করে দিতে পারে।

মার্কিন কর্নেল সেডরিক লেইটন বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র রাশিয়ার ভূখন্ডের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হোক। কারণ ওয়াশিংটন মনে করছে যে, এতে রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই তারা হয়তো ইউক্রেনের উপর চাপ অব্যাহত রাখবে যাতে করে ইউক্রেন ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে রুশ ভূখন্ডের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। জ্যাক ওয়াটলিং ব্রিটিশ সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়ে বলছেন যে, ‘স্টর্ম শ্যাডো’র মাধ্যমে যুদ্ধের পরিধি বেড়ে গেছে চিন্তা না করে বরং বুঝতে হবে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের কিছু সক্ষমতার ঘাটতি পূরণে এগুলি ব্রিটিশরা তাদেরকে দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতামতগুলি দেখিয়ে দেয় যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে ব্রিটিশ এবং মার্কিন চিন্তার পার্থক্য দৃশ্যমান। মার্কিনীরা চিন্তিত যে, ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্ষেপাস্ত্রের কারণে রুশদের সাথে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাবে কিনা। ইউক্রেন যাতে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যবহার না করে, সেটার গ্যারান্টি কিন্তু ওয়াশিংটনকে লন্ডনের কাছ থেকেই নিতে হবে। অর্থাৎ ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ করলেও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের রজ্জু ব্রিটিশরা তাদের হাতে রাখতে চাইছে। এর আগে ইউক্রেনকে ট্যাংক দেবার ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা সবচাইতে অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছিল। ইউক্রেনকে পশ্চিমা যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার ব্যাপারেও ব্রিটিশরা সবচাইতে বেশি কথা বলছে। আবার রুশরাও ২০২২এর অক্টোবরে অভিযোগ করে যে, ব্রিটিশরা বল্টিক সাগরের ‘নর্ড স্ট্রিম’ পাইপলাইনে হামলায় জড়িত ছিল; এবং ব্রিটিশরা সেভাস্তোপোল বন্দরে রুশ নৌবাহিনীর উপর হামলায় ইউক্রেনিয়দেরকে সহায়তা দিয়েছে। মোটকথা, রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের উত্তেজনা কতটা বৃদ্ধি পাবে, সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের মাঝে রয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা; যা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করার ব্রিটিশ প্রচেষ্টারই অংশ।

Tuesday 9 May 2023

রাজা চার্লসের অভিষেকে সামরিক প্যারেড… অর্থহীন প্রথা, নাকি অন্য কিছু?

০৯ই মে ২০২৩

ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া কমনওয়েলথ সেনাদের একাংশ। ক্রমেই ক্ষুদ্র হওয়া ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী যখন ব্যাপক রিক্রুটমেন্ট সমস্যায় পতিত, তখন প্রথাগত সামরিক প্যারেড নতুন জেনারেশনের ব্রিটিশ যুবকদের মনে তেমন একটা দাগ না-ও কাটতে পারে। একারণেই হয়তো রাজার অভিষেকে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আসা সেনাদের উপস্থিতি বেশি গুরুত্ব বহণ করে। ব্রিটিশ রাজের অস্তিত্বের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সামরিক প্যারেডে বহুদূর থেকে আসা কমনওয়েলথের বহু বর্ণের সেনাদের অংশগ্রহণের মাঝেই।

ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অনেক আলোচনাই মিডিয়াতে এসেছে। একদিকে ব্রিটেনের রাজ প্রথাকে অনেকেই যেমন একুশ শতকে বাতিল বলে মনে করছে, তেমনি কেউ কেউ অভিষেক অনুষ্ঠানের সামরিক কুচকাওয়াজের অর্থ খুঁজছেন।

গত ৬ই মের অভিষেক অনুষ্ঠানের প্যারেড ছিল ৭০ বছরের মাঝে ব্রিটেনে সবচাইতে বড় সামরিক কুচকাওয়াজ। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘মিরর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির ৪ হাজারের বেশি সামরিক সদস্য এই কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। এছাড়াও আরও ১১’শ সেনা পুরো কুচকাওয়াজের পথে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। ১৯৫৩ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানের পর থেকে সর্ববৃহৎ এই সামরিক প্যারেডের প্রস্তুতি নিতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগেছিল। কুচকাওয়াজে পতাকা বহণকারী প্রথম কনটিনজেন্টের প্রধান লে কর্নেল জেমস শ-এর কথায়, সেনাবাহিনী রাজার অভিষেকে গত এক হাজার বছর ধরে প্যারেড করে আসছে। কাজেই এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। রাজা হলেন কর্নেল-ইন-চীফ; তার সাথে সেনাবাহিনীর একটা গভীর বন্ধন রয়েছে।

যদিও কর্নেল জেমস শ বলছেন যে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর জন্যে এই প্যারেড নতুন নয়, তথাপি এই প্যারেড যে খুব একটা নিয়মিত হয়, সেটা কিন্তু নয়। ব্রিটেনের ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অনেক ইউনিটই কিছুটা মানসিক চাপের মাঝে ছিল, কারণ তারা অল্প কিছুদিন আগেই বিদেশের মিশন থেকে দেশে ফিরেছে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেবার জন্যে। কিছু ইউনিট মাত্র দুই সপ্তাহের প্রস্তুতির সময় পেয়েছে; যা তারা খুবই অল্প মনে করছেন। এদের মাঝে কেউ কেউ এসেছে সাইপ্রাস বা কেনিয়া থেকে; আবার কেউ কেউ কিছুদিন আগ পর্যন্তও ইংল্যান্ডের মাটিতে ইউক্রেনিয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলো। কর্নেল জেমস শ ইউটিউবে ১৯৫৩ সালের অভিষেক প্যারেড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন কিছু শিক্ষা পাবার জন্যে। তিনি চাইছিলেন যাতে করে প্যারেডটা দৃষ্টিনন্দন হয়; বিশেষ করে সেনাদের লাল, হলুদ, কালো, সাদা এবং নীল রঙের পোষাকের মাঝে দর্শকেরা হারিয়ে যায়। প্যারেডে ৩৩টা কমনওয়েলথ দেশ এবং বর্তমানে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৬টা উপনিবেশকে প্রতিনিধিত্ব করে ৬’শরও বেশি সেনা। এদের মাঝে ক্যারিবিয়ানের বিভিন্ন দ্বীপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ফকল্যান্ড দ্বীপের সেনা প্রতিনিধিরা ছিল।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ৬০টা বিমানের ফ্লাইপাস্ট এই অনুষ্ঠানের অংশ থাকলেও শেষ পর্যন্ত আবহাওয়ার কারণে কয়েকটা হেলিকপ্টার এবং ‘রেড এরোজ’ এরোব্যাটিক্স বিমানের মাঝেই ফ্লাইপাস্টকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পুরো অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রায় ৯ হাজার সামরিক সদস্যের অংশগ্রহণ ছিল; যা কিনা পুরো ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর প্রায় ৫ শতাংশ। ‘অপারেশন গোল্ডেন অর্ব’ নামের এই রাজকীয় সামরিক কুচকাওয়াজে যত সেনা জড়িত ছিল, তা বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ ব্রিটিশ সামরিক মিশনের চাইতে বড় ছিল। সামরিক বিশ্লেষক ইয়াইন ওভারটন প্রশ্ন করছেন যে, একুশ শতকে এহেন অনুষ্ঠান ব্রিটিশ জনগণের সামনে গুরুত্ববহ কোন বার্তা দেয় কিনা। যখন ড্রোনের মতো হাইটেক অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তখন অতি পুরোনো প্যারেডের প্রথা ব্রিটিশ যুবকদের কতটা আগ্রহী করবে? ২০২২ সালে সামরিক বাহিনীতে রিক্রুটমেন্ট টার্গেটের চাইতে ২৩ শতাংশ কম ছিল। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধও রিক্রুটমেন্ট বাড়াতে ভূমিকা রাখেনি। যদিও সরকার রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে, তথাপি ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধে জড়াতে কেউই ইচ্ছুক নয়। একজন তরুণ প্রোগ্রামার হয়তো প্রথাগত এই প্যারেড দেখে সামরিক সার্ভিসের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী হবে না।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেন সাধারণতঃ সামরিক প্যারেডে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের মতো শক্তিগুলি প্রদর্শন করে না। কারণ ব্রিটিশরা মনে করে যে, এগুলি একনায়কদের কর্মকান্ড। তথাপি এবারের অভিষেক কুচকাওয়াজে ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’সহ সামরিক বিমানের বড়সড় ফ্লাইপাস্টের পরিকল্পনা ঠিকই করা হয়েছিল। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আইআইএসএস’এর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বেন ব্যারি মত দিচ্ছেন যে, ফ্লাইপাস্ট যোগ করা গেলে সেটা বেশ আধুনিকই ঠেকতো। তবে ফর্মেশনে ড্রোন ওড়ানো হয়তো কঠিন হতো।

পুরো প্যারেডের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা হয়তো ছিল ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির সামরিক কনটিনজেন্ট; যারা এসেছে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশের দেশগুলি থেকে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিতে রাজার অভিষেকের ব্যাপারে তেমন কেন আগ্রহই নেই। ‘আফ্রিকানিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে মানুষ এখনও ব্রিটিশ শাসনের তিক্ততা ভুলতে পারেনি। অভিষেক অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে ১২টা কমনওয়েলথভুক্ত দেশের প্রতিবাদকারীরা রাজার কাছে চিঠি লেখে; যেখানে ব্রিটেনকে ঔপনিবেশিক শাসনের জন্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর লিডিয়া থর্প বলছেন যে, রাজা চার্লসের উচিৎ ব্রিটিশদের শাসনের জন্যে ক্ষতিপূরণ দেয়া; যার মাঝে রয়েছে চুরি করা সম্পদ। ‘ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবি’র প্রফেসর হেরমান মানিওরা বলছেন যে, ১৯৫০এর দশকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ‘মাউ মাউ’ আন্দোলন ব্রিটিশরা কঠোর হস্তে দমন করেছিল। সেই সময়ের স্মৃতিগুলি এখনও কেনিয় জনগণ ভুলতে পারেনি। তবে উগান্ডার রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসুমান বিসিকা বলছেন যে, উগান্ডাসহ পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলিতে ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক প্রভাব এখনও যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার যুবকরা ইংলিশ ফুটবল দলগুলির খেলা দেখার জন্যে পাগল। ‘এনপিআর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, অভিষেক অনুষ্ঠানে কমনওয়েলথভুক্ত অনেকগুলি দেশ অংশ নিলেও ব্রিটিশ রাজকে নিজেদের রাষ্ট্রপ্রধান বলে স্বীকৃতি দেয়া কিছু দেশ তাদের অবস্থান থেকে সরে আসছে। ২০২১ সালে ক্যারিবিয়ানের দ্বীপ বার্বাডোস ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের স্থলে একজন প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেয়। জামাইকাও সেই পথেই এগুচ্ছে। তবে প্যারেডে অংশ নেয়া প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির বেশিরভাগই বর্তমানে প্রজাতন্ত্র।

ক্রমেই ক্ষুদ্র হওয়া ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী যখন ব্যাপক রিক্রুটমেন্ট সমস্যায় পতিত, তখন প্রথাগত সামরিক প্যারেড নতুন জেনারেশনের ব্রিটিশ যুবকদের মনে তেমন একটা দাগ না-ও কাটতে পারে। একারণেই হয়তো রাজার অভিষেকে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আসা সেনাদের উপস্থিতি বেশি গুরুত্ব বহণ করে। ব্রিটিশ রাজের অস্তিত্বের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সামরিক প্যারেডে বহুদূর থেকে আসা কমনওয়েলথের বহু বর্ণের সেনাদের অংশগ্রহণের মাঝেই।

Sunday 7 May 2023

ব্রিটিশ রাজের গুরুত্ব আসলে কতটুকু?

০৭ই মে ২০২৩

০৬ই মে ২০২৩। ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান। ব্রিটেনের রাজার কাজ নয় শাসন করা; বরং রাজার কাজ হলো রাষ্ট্রের পরিচয় বহণ করা; এবং একইসাথে ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিকে ব্রিটিশ পরিচয় দেয়া। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিকে ব্রিটেনের সাথে যুক্ত রাখার কৌশলটাই হলো ব্রিটিশ রাজ প্রথা। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ‘প্রজাতন্ত্রী ইংল্যান্ড’এর সাথে এই দেশগুলির সেই সম্পর্ক থাকবে না; যতটা না রয়েছে ব্রিটিশ রাজের সাথে।

ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু, অথবা রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেকের মতো ঘটনাগুলি ব্রিটিশ রাজের কাজ, উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। একুশ শতকে এসে অনেকেই ব্রিটেনের রাজ পরিবারের এই প্রথাগুলিকে বাতিল বলেই মনে করছেন। রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেকের সময় কিছু মানুষের রাজ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঘটনা সেই আলোচনাকেই আবারও সামনে নিয়ে আসছে। তবে প্রায় দু’শ বছর ধরে দুনিয়ার কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে ধরে রেখে পুরো বিশ্বের নিয়মগুলিকে নিজেদের মতো তৈরি করা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সুপারপাওয়ারের অবস্থান হারাবার পরেও বিশ্বব্যাপী প্রভাব ধরে রাখার পিছনে ব্রিটেনের রাজ প্রথার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা অনস্বীকার্য।

ব্রিটিশ রাজা আসলে কি করেন?

ব্রিটিশ রাজের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, রাজা থাকার মূল উদ্দেশ্য হলো জাতীয় পরিচয়, ঐক্য এবং গর্বকে জিইয়ে রাখা। এছাড়াও ব্রিটিশ রাজ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকে তুলে ধরে; জনগণের সাফল্য এবং ভালো কাজকে স্বীকৃতি দেয়; স্বেচ্ছায় আত্মনিয়োগকে সমর্থন দেয়। এই কাজে রাজার সাথে থাকে রাজার কাছের পরিবারবর্গ। ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের রাজা ক্ষমতায় থাকলেও শাসন করেন না; কারণ শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। সরকার যা উপদেশ দেবে, সংবিধান অনুযায়ী রাজা তা মানতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ দেয়া, পার্লামেন্টের সভা শুরু করা, নতুন কোন আইনে সম্মতি দেয়ার মতো ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতাতেই তার বেশিরভাগ কাজ সীমাবদ্ধ। বিদেশী রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের নিয়োগ দেয়ার মতো কাজ রাজার হলেও এসকল ক্ষেত্রে সরকারের উপদেশ তিনি মানতে বাধ্য। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে থাকেন এবং বিভিন্ন পত্রে স্বাক্ষর করেন। তবে যে ব্যাপারটা ব্রিটিশ রাজকে পৃথিবীর অন্য সকল রাজা থেকে আলাদা করছে তা হলো, ব্রিটিশ রাজ বিশ্বের আরও ১৪টা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। এই দেশগুলির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং ক্যারিবিয়ানের বৃহৎ দ্বীপ জামাইকা। এছাড়াও রাজা হলেন কমনওয়েলথের প্রধান। কমনওয়েলথ হলো প্রধানতঃ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং ব্রিটেনের উপর নির্ভরশীল থাকা ৫৪টা দেশের একটা সংস্থা।

‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ রাজ প্রথার বিরুদ্ধে যখন বেশকিছু জনগণ বিক্ষোভ করছে, তখন এটা খতিয়ে দেখতেই হয় যে, রাজ প্রথা বাতিল করে দেয়া আসলেই কতটা সহজ হতে পারে। ব্রিটিশ রাজার প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা খুবই সীমিত। তিনি নিজে রাজা থাকবেন কি থাকবেন না, সেই ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে তার হাতেই নেই। মন্ত্রীদের নিয়োগ দিলেও কারা মন্ত্রী হচ্ছেন, সেব্যাপারে রাজার কোন কিছুই বলার নেই। পার্লামেন্টের তৈরি করা আইনে সম্মতি দিলেও আইন তৈরিতে রাজার কোন ভূমিকাই নেই। ব্রিটিশ সমাজে রাজার অবস্থান হলো নিরপেক্ষতা; যা কিনা দলীয় রাজনীতিতে ছাড় দেয়ার নীতির বাইরে। রাজা শুধুমাত্র রাষ্ট্রকেই তার সেবা দিয়ে থাকেন। ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’এর প্রফেসর রবার্ট হেজেল ‘টাইম’কে বলছেন, রাজার থাকার অর্থই হলো তিনি কি কাজ করেন সেটা; এখানে তার বাছবিচারের কোন সুযোগই নেই। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়েছে; যাদের মাঝে ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে এবং রোমানিয়ার একনায়ক নিকোলাই চসেস্কু। যদি রাজাকে বিলুপ্ত করতেই হয়, তাহলে সরকারকে প্রথমে গণভোটের আয়োজন করতে হবে; যা কিনা ব্রেক্সিটের সময় করা হয়েছিল। এরপর সেটা পার্লামেন্টে আইন আকারে পাস হতে হবে; সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এর আগে গণভোটের মাধ্যমে ইতালি এবং গ্রিসে রাজার অবস্থানকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে এবং স্পেনের মতো দেশগুলিতে রাজ প্রথাকে ধরে রাখা হয়েছে। এই মুহুর্তে ব্রিটেনে রাজ প্রথার পক্ষে জনসমর্থন বেশি থাকলেও ভবিষ্যতে তা না-ও থাকতে পারে। কারণ ২০২২ সালের এক জরিপে বলা হয় যে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মাঝে রাজ প্রথার পক্ষে সমর্থন ২০১১ সালে ৫৯ শতাংশ থেকে কমে মাত্র ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

রবার্ট হেজেল বলছেন যে, যদি রাজ প্রথা বিলুপ্ত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজার স্থানটা নেবেন প্রেসিডেন্ট। তবে রাজা যেখানে বংশানুক্রমিকভাবে রাজা হন, প্রেসিডেন্ট হবেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তথাপি প্রেসিডেন্টের মতো একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান একইসাথে সাংবিধানিক আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করবেন; যা কিনা একজন রাজার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।

 
কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির অনেকগুলিই এখনও ব্রিটিশ আইনে চলে; তাদের সংবিধানও ব্রিটিশদের অনুসরণে তৈরি করা। চিন্তাগত দিক থেকে সেসব দেশের অনেক প্রভাবশালী মানুষ এখনও ব্রিটেনের কাছাকাছি থাকতে চায়; যদিও পরিবর্তিত বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে তারা ঔপনিবেশিক সময় থেকে সরে আসার কথাই বলে থাকেন। ব্রিটিশ রাজের অবস্থান হয়তো এই ধোঁয়াশায় থাকা চিন্তার উপরেই - উপনিবেশও নয়; আবার পুরোপুরিভাবে প্রজাতন্ত্রও নয়; যা কিনা ব্রিটিশ চিন্তাটাকে ওয়াশিংটন-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে ভিন্নতা দিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ

খুব সম্ভবতঃ ব্রিটিশ রাজের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অবস্থান ধরে রাখা। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ক্যারিবিয়ানের বিভিন্ন দ্বীপ এবং সাবেক উপনিবেশ থাকা দেশগুলির উপরে ব্রিটিশ প্রভাব ধরে রাখার একটা পদ্ধতি হলো রাজ প্রথা। কিন্তু অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে যে, এই দেশগুলির ব্রিটিশ প্রভাবের অন্তর্ভুক্ত থাকার সময় ঘনিয়ে আসছে কিনা। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়দের মাঝে কোন আগ্রহই নেই। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এন্থনি এলবানেসি একসময় বলেছিলেন যে, অস্ট্রেলিয়ার প্রজাতন্ত্র হয়ে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিন্সও বলছেন যে, নিউজিল্যান্ডও একদিন প্রজাতন্ত্র হবে। ২৫ বছর আগে এক গণভোটে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ ব্রিটেনের সাথে রাষ্ট্রীয় এই সম্পর্ককে কর্তন করার বিপক্ষে রায় দিলেও আরও একবার গণভোট হয়তো বেশি দূরে নয়। তবে সাম্প্রতিক জনমত জরিপ বলছে যে, প্রজাতন্ত্রের পক্ষে মত এখনও গণভোটে পাস করার মতো যথেষ্ট নয়। এছাড়াও ব্রিটিশ রাজ থেকে আলাদা হতে হলে দেশের ছয়টা প্রদেশের মাঝে কমপক্ষে চারটার সম্মতি পেতে হবে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্যে অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডাতে যতটা জনসমর্থন ছিলো, তৃতীয় চার্লসের জন্যে ততটা নেই। সাম্প্রতিক জনমত জরিপ বলছে যে, কানাডাতেও অর্ধেকের বেশি জনগণ ব্রিটিশ রাজের সাথে দূরত্ব তৈরি করার পক্ষপাতি। প্রায় ৪০ শতাংশ কানাডিয় রাজার অভিষেকের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। বিশেষ করে কানাডার কুইবেক এবং ফরাসি ভাষাভাষি অন্যান্য অঞ্চলে ব্রিটিশ রাজের সাথে সম্পর্ককে একেবারেই ভালো চোখে দেখা হয় না। তবে ব্রিটিশ রাজ থেকে আলাদা হতে হলে কানাডার পার্লামেন্টের উচ্চ এবং নিম্নকক্ষের সম্মতি ছাড়াও দেশটার ১০টা রাজ্যের সবগুলির সর্বসম্মতি থাকতে হবে; যা অনেকেই মনে করেন প্রায় অসম্ভব।

‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা এবং ব্রিটিশ রাজ

নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা না থাকার পরেও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নামক চিন্তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ প্রভাবকে ধরে রাখার যে চিন্তার উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশরা ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ইইউ থেকে আলাদা হয়েছিল, সেই চিন্তার মূলে রয়েছে কমনওয়েলথভুক্ত অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডাকে ব্রিটেনের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসা। ব্যাপক সম্পদশালী এই দেশগুলি ভৌগোলিকভাবে ব্রিটেনের প্রভাবকে দুনিয়াব্যাপী ধরে রাখার হাতছানি দিচ্ছে। আর এই দেশগুলিকে ব্রিটেনের সাথে যুক্ত রাখার কৌশলটাই হলো ব্রিটিশ রাজ প্রথা। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ‘প্রজাতন্ত্রী ইংল্যান্ড’এর সাথে এই দেশগুলির সেই সম্পর্ক থাকবে না; যতটা না রয়েছে ব্রিটিশ রাজের সাথে। ব্রিটেনের রাজার কাজ নয় শাসন করা; বরং রাজার কাজ হলো রাষ্ট্রের পরিচয় বহণ করা; এবং একইসাথে ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিকে ব্রিটিশ পরিচয় দেয়া। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো দেশগুলি আলাদাভাবে দুনিয়াতে যতটা প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে, তা ব্রিটিশ পরিচয়ের ধারেকাছেও নয়। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির অনেকগুলিই এখনও ব্রিটিশ আইনে চলে; তাদের সংবিধানও ব্রিটিশদের অনুসরণে তৈরি করা। চিন্তাগত দিক থেকে সেসব দেশের অনেক প্রভাবশালী মানুষ এখনও ব্রিটেনের কাছাকাছি থাকতে চায়; যদিও পরিবর্তিত বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে তারা ঔপনিবেশিক সময় থেকে সরে আসার কথাই বলে থাকেন। ব্রিটিশ রাজের অবস্থান হয়তো এই ধোঁয়াশায় থাকা চিন্তার উপরেই - উপনিবেশও নয়; আবার পুরোপুরিভাবে প্রজাতন্ত্রও নয়; যা কিনা ব্রিটিশ চিন্তাটাকে ওয়াশিংটন-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে ভিন্নতা দিয়েছে।

Saturday 6 May 2023

ইউরোপজুড়ে মে দিবসের বিক্ষোভ শ্রমিকদের অপূর্ণ অধিকারকেই তুলে ধরে

০৬ মে ২০২৩

ফ্রান্সে মে দিবসে শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ। ‘আইএলও’ প্রধান তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন যে, এখনও নীতির ঘুরপাকেই পড়ে থাকতে হচ্ছে; যেখানে বৈষম্য এবং অস্থিরতাই স্বাভাবিক। ‘আইএলও’ প্রধানের হতাশার কথাগুলি ইউরোপের লিবারাল পুঁজিবাদী দেশগুলির রাস্তায় শ্রমিক বিক্ষোভের মাঝেই প্রতিফলিত হচ্ছে। ন্যায্য বেতন, জীবনযাত্রার মান, ছুটি, ইত্যাদি ইস্যুতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলি শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করতে মোটেই মনোযোগী হয়নি।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এবারের মে দিবসে পুরো ইউরোপজুড়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলি বহু বিক্ষোভের আয়োজন করেছে। বিশেষ করে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির কারণে যে মানুষগুলি অর্থনৈতিকভাবে বেশি চাপের মাঝে পড়েছে, তারাই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। ‘জার্মান ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন’ বা ‘ডিজিবি’ বলছে যে, তাদের আয়োজিত ৩’শ ৯৮টা মিছিলে ২ লক্ষ ৮৮ হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, বিমান পরিবহণ, সড়ক পরিবহণ, রেলওয়ে, ডাকবিভাগ, পরিচ্ছন্নকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকরা এবছরে জার্মানিতে ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছে। বার্লিনে এক মিছিলে জার্মান শিল্পভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন ‘আইজি মেটাল’এর নেতা জোর্গ হফমান ঘোষণা দেন যে, তারা ধর্মঘট করার অধিকারের উপর কোন প্রকারের নিয়ন্ত্রণ সহ্য করবেন না।

তবে ফ্রান্সের রাস্তাগুলি ছিল সবচাইতে উত্তপ্ত। পুরো ফ্রান্সজুড়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর নতুন পেনশন আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। অবসরের বয়স ৬২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফরাসি শ্রমিক ইউনিয়নগুলি ৩’শর বেশি মিছিলের ডাক দিয়েছিল। দিন যত গড়িয়েছে, বিক্ষোভগুলি ক্রমেই সহিংস হয়েছে এবং পুলিশের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়েছে। ফরাসি বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন বস্তু ছুঁড়ে মেরেছে এবং রাস্তার পাশের বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যাংকের জানালার গ্লাস ভাংচুর করেছে। লিয়ঁ শহরে পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমারিন এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, সহিংসতায় ১’শ ৮ জন পুলিশ আহত হয়েছে এবং দেশজুড়ে ২’শ ৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৮ লক্ষাধিক মানুষ এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, একদিকে শ্রমিকরা যেখানে বলছে যে, সরকারের নতুন আইনে তাদের অধিকার খর্ব হচ্ছে, সেখানে সরকার বলছে যে, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে এটা প্রয়োজন; কারণ ফ্রান্সের জনগণের গড় বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এবারে বামপন্থীদের সাথে যোগ দিয়েছিল সাধারণ জনগণ; যারা অর্থনৈতিক সুবিচার চায় এবং প্রেসিডেন্টের ব্যবসায়ী-বান্ধব নীতির বিরোধী।

এদিকে ইতালিতে ডানপন্থী সরকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি হবে এই লক্ষ্য নিয়ে দরিদ্রদের জন্যে সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এক বিবৃতিতে ঘোষণা দেন যে, চার বছর আগে চালু করা দরিদ্রদের সুরক্ষা আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে; যাতে করে কারা কাজ করতে পারে, আর কারা কাজ করতে পারে না, তাদের মাঝে আলাদা করা যায়। অর্থাৎ যাদেরকে এই সুবিধা দেয়া হবে, তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ইতালির বিরোধী দলগুলি ক্ষমতাসীনদের সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে ফেলার নীতির ব্যাপক সমালোচনা করছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, ইতালির উত্তরের তুরিন শহরে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির পাপেট নিয়ে মিছিল করে, যেখানে মেলোনি ফ্যাসিস্ট স্যালুট দিচ্ছেন বলে দেখানো হয়।

এদিকে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, স্পেনের শ্রমিক ইউনিয়নগুলি ৭০টার বেশি মিছিলের আয়োজন করে; যেখানে বলা হয় যে, মুদ্রাস্ফীতির সাথেসাথে শ্রমিকদের বেতন না বাড়লে সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। মাদ্রিদের ‘ইলাসট্রিয়াস কলেজ অব ল’ইয়ার্স’এর আইনজীবিরাও রাস্তায় মিছিল করে। তাদের দাবি ছিল ছুটির। স্পেনের আইন অনুযায়ী একজন আইনজীবিকে বছরে ৩৬৫ দিনই কাজের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হয়। এমনকি তাদের কাছের কোন ব্যক্তির যদি মৃত্যুও হয়, অথবা তারা নিজেরা যদি অসুস্থও হয়, তাহলেও তাদেরকে কাজের ডিউটি দিতে হয়। তারা বলছেন যে, করোনা মহামারির সময়ে আইনজীবিরা হাসপাতাল থেকে টুইটারে ছবি পোস্ট করেছিলেন, যেখানে তারা বলছিলেন যে, স্যালাইন দেওয়া অবস্থায় তারা কাজ করছিলেন।

‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে হাজারো শ্রমিক রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। মূলতঃ বামপন্থী সংগঠনগুলির আয়োজন করা এই বিক্ষোভে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির মাঝে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান রক্ষা করার কষ্টটাকেই তুলে ধরা হয়। একই দিনে গ্রিসে রেল শ্রমিক, জাহাজ ও বন্দর শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, মেসিডোনিয়ায় মন্ত্রীদের বেতন ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। সে দেশে শ্রমিকদের বেতন সাড়ে ৩’শ ডলার হলেও মন্ত্রীদের বর্তমান বেতন বাড়িয়ে ২ হাজার ৫’শ ৩০ ডলার করা হয়েছে।

ইউরোপের রাস্তায় বিক্ষোভগুলি যে বিশ্বব্যবস্থার সমস্যা, তা ‘আইএলও’ প্রধানের বক্তব্যতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’এর ডিরেক্টর জেনারেল গিলবার্ট হুংবো মে দিবস উপলক্ষে এক বার্তায় বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের জন্যে সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। একইসাথে তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জলবায়ুগত নীতিতে পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান; যাতে করে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা যায়। তিনি তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন যে, করোনা মহামারির সময়ে শ্রমিকদেরকে যেসকল প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সেগুলি বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের সত্যিকারের বেতন কমে গেছে, দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের চাইতেও আরও মারাত্মকভাবে যেঁকে বসেছে। শ্রমিকরা মনে করছে যে, করোনা মহামারির সময় তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে কাজগুলি করেছে, সেগুলির পুরষ্কার কেন, স্বীকৃতিই দেয়া হয়নি। এগুলির কারণে শ্রমিকদের মাঝে মারাত্মক আকারের অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে।

‘আইএলও’ প্রধান মনে করিয়ে দেন যে, ১৯৪৪ সালে ‘আইএলও’ প্রতিষ্ঠার সময়ে বলা হয়েছিল যে, বিশ্ব অর্থনীতি শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি এবং কিছু পরিসংখ্যান টার্গেটের পিছনেই ছুটবে না; বরং সেখানে মানুষের চাহিদা এবং ইচ্ছাকে প্রধান্য দেবে। অর্থাৎ বৈষম্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল; বিশেষ করে জনগণের জন্যে এমন ধরণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, যাতে করে মানুষ নিজেদের দায়িত্ব নিজেরাই নিতে পারে। কিন্তু তিনি তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেন যে, এখনও নীতির ঘুরপাকেই পড়ে থাকতে হচ্ছে; যেখানে বৈষম্য এবং অস্থিরতাই স্বাভাবিক। ‘আইএলও’ প্রধানের হতাশার কথাগুলি ইউরোপের লিবারাল পুঁজিবাদী দেশগুলির রাস্তায় শ্রমিক বিক্ষোভের মাঝেই প্রতিফলিত হচ্ছে। ন্যায্য বেতন, জীবনযাত্রার মান, ছুটি, ইত্যাদি ইস্যুতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলি শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করতে মোটেই মনোযোগী হয়নি।