Tuesday 6 September 2022

মার্কিন নৌবাহিনী কেন ঠিক করতে পারছে না যে তাদের কতগুলি জাহাজ দরকার?

০৬ই সেপ্টেম্বর ২০২২
 
মার্কিন নৌবাহিনীর 'স্যান এন্টোনিও-ক্লাস'এর দৈত্যাকৃতির উভচর জাহাজ 'নিউ ইয়র্ক'। বিশ্বের সবচাইতে বড় নৌবাহিনী থাকা সত্ত্বেও মার্কিনীরা তাদের সক্ষমতার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। তারা একদিকে যেমন তাদের দৈত্যাকৃতির জাহাজগুলির নিরাপত্তার ব্যাপারে শংকিত, তেমনি জাহাজের সংখ্যার ব্যাপারেও আত্মবিশ্বাসী নয়। একারণেই ম্যারিন কোর, নৌবাহিনী এবং পেন্টাগন কর্মকর্তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক দ্বন্দ্ব, যা কিনা সমস্যায় ফেলেছে কংগ্রেসকে। যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, আদর্শিক শক্তি হবার পরেও অনিশ্চিত বিশ্ব পরিস্থতিতে নিজেদের আদর্শ নয়, বরং বাস্তবতাই মার্কিন নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।


মার্কিন নৌবাহিনীর কতগুলি জাহাজ প্রয়োজন, তা তারা ঠিক করতে পারছে না। ‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই সংখ্যাটা সর্বনিম্ন এসেছে ৩’শ ১৬; একসময় ৩’শ ২৭; এরপর ৩’শ ৬৭; এবং সর্বোচ্চ ৫’শ পর্যন্ত। মোট জাহাজের সংখ্যার মাঝে কতগুলি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, কতগুলি ডেস্ট্রয়ার বা কতগুলি সাবমেরিন থাকবে, সেখানে দ্বন্দ্ব তেমন একটা নেই। দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে উভচর মিশনের জন্যে কতগুলি জাহাজ থাকা উচিৎ সেখানে। উভচর জাহাজগুলি ম্যারিন কোরের সদস্যদেরকে বহণ করে শত্রুর উপকূলে মোতায়েন করে। এই ইস্যু নিয়ে নৌবাহিনী, ম্যারিন কোর এবং পেন্টাগনের কর্মকর্তারা ব্যাপক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন; যার ফলশ্রুতিতে কংগ্রেস ঠিক করতে পারছে না যে আগামী অক্টোবর মাসে বাজেট নিয়ে কথা বলার সময় নৌবাহিনীর জন্যে কত অর্থ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, একপক্ষে রয়েছেন উপপ্রতিরক্ষা সচিব ক্যাথলিন হিকস; যিনি চাইছেন বড় আকৃতির উভচর জাহাজগুলির সংখ্যা কমিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ এবং মনুষ্যবিহীন ড্রোন জাহাজ তৈরিতে মনোনিবেশ করতে। অপরদিকে নৌবাহিনী এবং ম্যারিন কোর চাইছে বড় জাহাজগুলিকে ধরে রাখতে; যেগুলি ছাড়া ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনকে মোকাবিলা করা যাবে না বলে বলছেন তারা।

বড় জাহাজ বনাম ছোট জাহাজ

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো জন ফেরারি ‘পলিটিকো’কে বলছেন যে, নৌবাহিনী এবং এর জাহাজ নির্মাণ কর্মকান্ডে ধ্বস নেমেছে। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর নৌবাহিনী বাধ্য হচ্ছে একটা ৩০-বছরব্যাপী পরিকল্পনা নিয়ে আসতে। এই পরিকল্পনাগুলি করতে প্রকৃতপক্ষে দুই দশক লাগার কথা। নৌবাহিনীর জন্যে কত জাহাজ দরকার, সেটার ব্যাপারে কোন সমঝোতা ছাড়াই ৩০টা বছর পার করে দেয়া হয়েছে! জন ফেরারির কথাগুলি বুঝতে পারা যাবে, যখন দেখা যাবে যে, সমস্যাটা কোথা থেকে শুরু হয়েছে। মার্কিন সামরিক চিন্তাবিদদের অনেকেই মনে করছেন যে, বড় জাহাজগুলি চীনা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যে সহজ টার্গেটে পরিণত হতে পারে। আর এই জাহাজগুলি এতটাই বড় যে, প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপগুলিতে স্বল্প সংখ্যক ম্যারিন কোর সদস্যদের নামানো এবং সরবরাহ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এগুলি তেমন জুতসই হচ্ছে না। এর বিকল্প হিসেবে ছোট জাহাজ তৈরির কথা বলা হচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা ইয়র্কটাউন ইন্সটিটিউট’এর প্রধান সেথ কর্পসি ‘দ্যা হিল’ পত্রিকার এক লেখায় জাহাজের সংখ্যার জটিলতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মার্কিন নৌবাহিনী মনে করছে যে, শুধুমাত্র বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিন দিয়ে চীনকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না; কারণ চীনারা এত বৃহৎ সংখ্যায় তাদের কাছাকাছি সমুদ্রগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে, যা কিনা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, বন্দর এবং ঘাঁটিগুলিকে টার্গেট করে এক ধাক্কায় বড় রকমের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। চীনাদেরকে প্রত্যুত্তর দেয়ার সক্ষমতা রাখতে হলে মার্কিন বাহিনীকে তাদের সম্পদগুলিকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দিতে হবে। তাতে করে এক ধাক্কায় সকল সম্পদ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে নৌবাহিনী চাইছে ছোট আকারের উভচর জাহাজ ‘লাইট এম্ফিবিয়াস ওয়ারশিপ’ বা ‘এলএডব্লিউ’ তৈরি করতে; যা কিনা ৭৫ জন ম্যারিন সেনাকে ছোট কোন দ্বীপে নামিয়ে দিতে পারবে। এই সেনাদের সাথে থাকবে চীনা জাহাজ টার্গেট করার জন্যে জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এভাবে চীনা জাহাজগুলিকে একটা দ্বীপ বেষ্টনির মাঝে বেঁধে ফেলা যাবে। মিশন শেষ হবার আগ পর্যন্ত এই জাহাজগুলি সেনাদেরকে সহায়তা দেবে এবং মিশন শেষে তাদেরকে আবারও ফেরত নিয়ে আসবে। এই জাহাজগুলি তেমন শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে তৈরি করা হবে না। মাত্র ১’শ মিলিয়ন ডলারের বাজেটের মাঝে একেকটা জাহাজকে একটা ৩০ মিঃমিঃ কামান দেয়া হবে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইঞ্জিন দেয়া হবে, যা কিনা জাহাজটাকে ঘন্টায় ১৪ থেকে ১৫ নটিক্যাল মাইলের বেশি গতি দিতে পারবে না। নৌবাহিনী ২০৩০ সালের পর থেকে শুরু করে ২৮ থেকে ৩০টা ‘এলএডব্লিউ’ ডেলিভারি পাবার পরিকল্পনা করছে।
 
'লাইট এম্ফিবিয়াস ওয়ারশিপ' বা 'এলএডব্লিউ'এর একটা ধারণা। চীনারা এত বৃহৎ সংখ্যায় তাদের কাছাকাছি সমুদ্রগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে, যা কিনা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, বন্দর এবং ঘাঁটিগুলিকে টার্গেট করে এক ধাক্কায় বড় রকমের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। চীনাদেরকে প্রত্যুত্তর দেয়ার সক্ষমতা রাখতে হলে মার্কিন বাহিনীকে তাদের সম্পদগুলিকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দিতে হবে। তাতে করে এক ধাক্কায় সকল সম্পদ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে নৌবাহিনী চাইছে ছোট আকারের উভচর জাহাজ ‘লাইট এম্ফিবিয়াস ওয়ারশিপ’ বা ‘এলএডব্লিউ’ তৈরি করতে; যা কিনা ৭৫ জন ম্যারিন সেনাকে ছোট কোন দ্বীপে নামিয়ে দিতে পারবে।

তবে সেথ কর্পসি আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, এই ছোট জাহাজগুলি অর্ডার করার অর্থ এই হওয়া উচিৎ নয় যে, বড় জাহাজগুলিকে বাদ দিতে হবে। এই ছোট জাহাজগুলি ৭টা থেকে ৯টা একত্রে একটা স্কোয়াড্রন হিসেবে কাজ করবে; আর তাদের কমান্ড আসবে একটা বড় উভচর জাহাজ থেকে। কিন্তু সমস্যা হলো, ২০২০এর দশকের শেষের দিকে বড় আকারের ‘স্যান এন্টোনিও-ক্লাস’এর ‘ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম ডক’ বা ‘এলপিডি’ জাহাজগুলি তৈরি বন্ধ করে দেয়া হবে; যার ফলশ্রুতিতে নৌবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বড় আকারের উভচর অপারেশনে যাবার সক্ষমতা হারাবে। এটা মার্কিন নৌবাহিনীর ইন্দোপ্যাসিফিকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার জন্যে যথেষ্ট।

২৫ হাজার টনের দৈত্যাকৃতির এই জাহাজগুলির একেকটা প্রায় ৭’শ সেনা, ১৪টা উভচর যান, ১ ইউটিলিটি ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং ২টা বড় আকৃতির হোভারক্রাফট বহণ করতে পারে। এছাড়াও জাহাজের উপরে বড় আকৃতির ৫টা ‘এমভি-২২’ বিমান বহণ করা যায়, এবং জাহাজটা ১৬টা স্বল্প পাল্লার বিমান ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণেও সক্ষম। তবে সমস্যা হলো, এই জাহাজগুলির একেকটা তৈরি করতে দেড় থেকে ২ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। এই জাহাজগুলির সাথে তুলনা করলে ‘এলএডব্লিউ’ জাহাজ হবে ৪ হাজার টনের কম। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, ম্যারিন কোরের সদস্যরা সাম্প্রতিক মহড়াগুলিতে বিভিন্ন আকারের জাহাজে চড়ে ছোট জাহাজের এই চিন্তাটা বাস্তবে কেমন হতে পারে, তার উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে।

জাহাজের সংখ্যা বনাম বাজেট বাস্তবতা

একটা বড় সমস্যা হলো বাজেট। নতুন জাহাজ তৈরি করতে গেলে পুরোনো জাহাজ সার্ভিস থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি করা ‘লিটোরাল কম্ব্যাট শিপ’ বা ‘এলসিএস’ জাহাজগুলিকে নৌবাহিনী সার্ভিস থেকে বাদ দিতে চাইছে। কারণ এই জাহাজগুলি একদিকে যেমন চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না; তেমনি জাহাজগুলিকে সার্ভিসে রাখতে গিয়ে যে খরচ হচ্ছে, সেটার কারণে নতুন জাহাজের জন্যে বাজেটের সংকুলান হচ্ছে না। অনেকেই বলছেন যে, এই জাহাজগুলি তৈরি করা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল; যেখানে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় হয়েছে। একারণেই সবগুলি জাহাজ তৈরি শেষ হবার আগেই এগুলিকে অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। জো বাইডেনের সরকার ২০২৩ সালের বাজেটে সব প্রকারের মোট ২৪টা জাহাজ সার্ভিস থেকে বাদ দিতে চাইছে; যার মাঝে ১৬টা জাহাজ যথেষ্ট ভালো অবস্থায় অবসরে পাঠানো হচ্ছে। এর মাঝে ‘এলসিএস’ থাকছে ২টা।

সামরিক পত্রিকা ‘নেভি টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন কংগ্রেসে অনেকেই জাহাজের সংখ্যা কমাবার বিরুদ্ধে। রিপাবলিকান সিনেটর রজার উইকার বলছেন যে, বহু বছর ধরেই নৌবাহিনী অর্থাভাবে রয়েছে। ৩’শ ৫৫টা জাহাজের টার্গেট কখনোই পূরণ হয়নি। বাইডেন প্রশাসনের জাহাজ কমাবার নীতি এই সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করবে। যদি প্রেসিডেন্ট এক্ষেত্রে সহায়তা না করেন, তাহলে কংগ্রেস ব্যাপারটা নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবে। রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য রব উইটম্যান এবং মাইক রজার্স প্রায় একই সুরে এক যৌথ বিবৃতিতে বলছেন যে, স্বল্প পরিমাণ অর্থ বাঁচাতে গিয়ে চীনাদের অগ্রাসনের মুখে মার্কিন সেনাদেরকে বিপদের মাঝে ফেলে দেয়া হচ্ছে। একটা জাহাজ তৈরি করতে অনেক বছর সময় লেগে যায়। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ নির্মাণের সেই সক্ষমতা নেই; যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল; যখন প্রায় হঠাত করেই হাজার হাজার জাহাজ তৈরি করে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসন ৩০ বছরের জাহাজ নির্মাণের যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলিকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ সক্ষমতা থাকবে না; শত্রুর তৈরি করা মাইনফিল্ড সরাতেও সক্ষমতা থাকবে না; ম্যারিন কোরও জোর করে শত্রু এলাকায় অবতরণ করতে পারবে না। আর পুরো নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার সক্ষমতা ১০ শতাংশ কমে যাবে। ‘পলিটিকো’ বলছে যে, এখানে সকলেরই আলাদা স্বার্থ রয়েছে। সিনেটর রজার উইকার মিসিসিপি রাজ্যের প্রতিনিধি; যেখানে মার্কিন বৃহৎ জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘হানটিংটন ইনগালস ইন্ডাস্ট্রিজ’এর শিপইয়ার্ড রয়েছে। অপরদিকে ছোট জাহাজ তৈরি করতে গেলে বর্তমানে নৌবাহিনীর কাজ না পাওয়া ছোট শিপইয়ার্ডগুলিও ব্যবসা পাওয়া শুরু করবে; যা কিনা পুরো জাহাজ নির্মাণ শিল্পকেই প্রভাবিত করবে।
 
মার্কিন নৌবাহিনীর 'লিটোরাল কম্ব্যাট শিপ' বা 'এলসিএস'। এই জাহাজগুলি একদিকে যেমন চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না; তেমনি জাহাজগুলিকে সার্ভিসে রাখতে গিয়ে যে খরচ হচ্ছে, সেটার কারণে নতুন জাহাজের জন্যে বাজেটের সংকুলান হচ্ছে না। অনেকেই বলছেন যে, এই জাহাজগুলি তৈরি করা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল; যেখানে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় হয়েছে। একারণেই সবগুলি জাহাজ তৈরি শেষ হবার আগেই এগুলিকে অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

মার্কিন নৌবাহিনীর অপারেশন্স’এর উপ-প্রধান ভাইস এডমিরাল স্কট কন এক সংবাদ সন্মেলনে নৌবাহিনীর অবস্থানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নৌবাহিনী কংগ্রেসের সামনে তিনটা সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছে; কারণ ২০৫২ সাল পর্যন্ত এমন অনেক কিছুই ঘটতে পারে, যা এখন কেউই চিন্তা করতে পারছে না; বিশেষ করে বাজেটের সংকুলানের ব্যাপারে অনেক বাধা আসতে পারে। তিনটা সম্ভাবনার মাঝে ২০৫২ সালের মাঝে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩’শ ১৬; ৩’শ ২৭ এবং ৩’শ ৬৭। প্রথম দুই ক্ষেত্রে বাজেটের সংকুলানের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে শেষেরটার ক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয়েছে যে, বাজেটে কোন সমস্যা থাকবে না। এডমিরাল কন সমালোচকদের টার্গেট করে বলেন যে, আর্থিক বাস্তবতা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; যা কেউ প্রকৃতপক্ষে এড়িয়ে যেতে পারবে না। একটা জাহাজ যদি অবসরে না পাঠিয়ে সার্ভিসে রেখে দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ হবে; যা কিনা অন্য ক্ষেত্রে পুষিয়ে নেয়া কঠিন।

ম্যারিন কোর বনাম নৌবাহিনী বনাম পেন্টাগন বনাম …

‘পলিটিকো’ বলছে যে, বাইডেন প্রশাসনের নৌবাহিনী সচিব কার্লোস ডেল তোরো চাইছেন যে, নৌবাহিনীর উভচর জাহাজের সংখ্যা ৩১শে রাখতে; যা কিনা ম্যারিন কোরের কমান্ডার জেনারেল ডেভিড বার্জারও চাইছেন। তবে পেন্টাগন চাইছে এই সংখ্যাকে কমিয়ে ২৫এ নিয়ে আসতে। আর জেনারেল বারজার চাইছেন নৌবাহিনী আরও ৩৫টা ছোট আকারের ‘এলএডব্লিউ’ তৈরি করুক; যার মাধ্যমে ম্যারিন কোর চীনের কাছাকাছি দ্বীপগুলিতে ম্যারিন কোরের ছোট ছোট গ্রুপের সহায়তায় জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে। ম্যারিন কোরের কাছে এই পরিকল্পনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেলেও নৌবাহিনীর কাছে তা অত গুরুত্বপূর্ন নয়। পরপর দুই বছর নৌবাহিনী ‘এলএডব্লিউ’ জাহাজ তৈরির জন্যে কোন বাজেট রাখেনি। ২০২৫ সালের আগে এই জাহাজগুলির জন্যে অর্থ সংকুলানে রাজি নয় নৌবাহিনী। ততদিনে ম্যারিন কোরের জেনারেল বারজার অবসরে চলে যাবেন। অর্থাৎ এখানে কয়েকটা আলাদা গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই আলোচনা কংগ্রেসে আসার অর্থ হলো এই বিভেদগুলিও জনসন্মুখে এসে যাবে।

মার্কিন নৌবাহিনী ২০১৬ সালে ঘোষণা দেয় যে, তারা ৩’শ ৫৫টা জাহাজ চায়। তবে কিভাবে সেই টার্গেটে পৌঁছানো সম্ভব, তা নিয়ে কার্যকরী কোন সমাধান কেউই দিতে পারেনি। একেকটা মার্কিন সরকার সেই পরিকল্পনার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পায়নি অথবা এত বড় নৌবহরের জন্যে বাজেটের সংকুলান করতে সক্ষম হয়নি। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩’শ ৫৫টা জাহাজের পক্ষে অনেক কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তিনি জাহাজের সংখ্যা কমিয়েছেন। বর্তমানে ২’শ ৯৮টা জাহাজ থেকে ২০৪৫ সালের মাঝে ৫’শ জাহাজে পৌঁছানোর অবাস্তব টার্গেট নিয়েও অনেক কথা চলেছে। প্রতিবছরেই নতুন টার্গেট নিয়ে কথা হবার ফলে কংগ্রেস যেমন অর্থায়ন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে, তেমনি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলিও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে পারছে না। ‘ইউএস নেভাল ইন্সটিটিট’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত জুন মাসে নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে কংগ্রেসে এক গোপন প্রতিবেদন পাঠানো হয়; যেখানে ৩’শ ৭৩টা জাহাজের কথা বলা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন যে, এই সংখ্যার কোন গুরুত্বই নেয়; কারণ বাস্তবতা বিবর্জিত সেই প্রতিবেদনে বাজেট এবং জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতার ব্যাপারে কোন চিন্তাই করা হয়নি। অথচ এই দ্বন্দ্বের মাঝেই মার্কিন নৌবাহিনীর অপারেশন্স প্রধান এডমিরাল মাইক গিলডে বলে চলেছেন যে, চীনাদেরকে প্রতিরোধ করতে হলে ৫’শরও বেশি জাহাজ লাগবে!

এখানেই শেষ নয়। ‘পলিটিকো’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাইডেন প্রশাসনের নিযুক্ত ব্যক্তিদের মাঝেও বিরোধ রয়েছে। উপপ্রতিরক্ষা সচিব ক্যাথলিন হিকস এবং নৌবাহিনীর ক্রয় পরিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান টমি রস চাইছেন বড় জাহাজ কমিয়ে ছোট জাহাজ তৈরি করতে। অপরদিকে নৌবাহিনী সচিব কার্লোস ডেল তোরো চাইছেন বড় জাহাজের সংখ্যা স্থিতিতে রাখতে। এছাড়াও অস্থায়ী পদে আসীন থাকার কারণে টমি রস নতুন কোন ক্রয় সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। এই সিদ্ধান্ত বর্তমানে রয়েছে তার নিচের কর্মকর্তা জে স্টেফানির কাছে; যিনি ১’শ মিলিয়ন ডলার থেকে ৫’শ মিলিয়ন ডলারের ক্রয় সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে নৌবাহিনীর ক্রয় পরিদপ্তরের কোন স্থায়ী প্রধান না থাকায় জাহাজ নির্মাণ পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। এই মুহুর্তে কংগ্রেস মনে করছে যে, নৌবাহিনী নতুন জাহাজ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে সামনে এগুতে সক্ষম নয়। তারা মনে করছে না যে, নৌবাহিনী নির্দিষ্ট সময় এবং বাজেটের মাঝে কোন পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। কেউ কেউ তো মনে করছেন যে, নৌবাহিনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই পারবে না!

মার্কিন নৌবাহিনীতে কতগুলি জাহাজ থাকা উচিৎ, সেই দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে উভচর জাহাজের আকার এবং সংখ্যা। সকলেই আলোচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, কি রকমের কয়টা জাহাজ থাকলে তারা চীনাদের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠবে। চীনাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের চ্যালেঞ্জ মার্কিন নৌবাহিনীর ধরণ এবং আকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে বললেও অযৌক্তিক হবে না। আবার এর মাঝে যুক্ত হয়েছে বাজেট সংকুলানের রূঢ় বাস্তবতা। বিশ্বের সবচাইতে বড় নৌবাহিনী থাকা সত্ত্বেও মার্কিনীরা তাদের সক্ষমতার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। তারা একদিকে যেমন তাদের দৈত্যাকৃতির জাহাজগুলির নিরাপত্তার ব্যাপারে শংকিত, তেমনি জাহাজের সংখ্যার ব্যাপারেও আত্মবিশ্বাসী নয়। একারণেই ম্যারিন কোর, নৌবাহিনী এবং পেন্টাগন কর্মকর্তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক দ্বন্দ্ব, যা কিনা সমস্যায় ফেলেছে কংগ্রেসকে। যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, আদর্শিক শক্তি হবার পরেও অনিশ্চিত বিশ্ব পরিস্থতিতে নিজেদের আদর্শ নয়, বরং বাস্তবতাই মার্কিন নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

No comments:

Post a Comment