Tuesday 29 November 2016

রাষ্ট্রের জন্যে কাজ করা বলতে আমরা কি বুঝি?

২৯শে নভেম্বর ২০১৬

 
Motorola-কে আমরা মোবাইল হ্যান্ডসেট কোম্পানি বলে চিনি। কিন্তু তারা যে ডিফেন্স সাপ্লাইয়ার, সেটা আমরা কতজন জানি?


ডিফেন্স কনট্রাকটর কারা?

ইস্রাইলের মেরকাভা (Merkava) ট্যাঙ্কের বিভিন্ন কম্পোনেন্ট-এর সাপ্লাইয়ারের নাম আমরা কতটুকু জানি? অথবা জিজ্ঞেস করার মতো চিন্তা কতজন করি? আমরা যতটুকু জানি সেটা হলো ইস্রাইল মেরকাভা ট্যাঙ্ক তৈরি করে। কিন্তু একটা ট্যাঙ্ক তো আর এমনি এমনি কেউ তৈরি করে ফেলতে পারবে না। এর বিভিন্ন কম্পোনেন্ট তৈরিতে বিভিন্ন ব্যাপারে এক্সপার্ট হতে হবে। যেমন যে ট্যাঙ্কের কামান তৈরি করবে, সে ইলেকট্রনিক্স বা ইঞ্জিন বা ট্র্যাক তৈরি করবে না। এই ট্যাঙ্কের কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতির encryption-এর সাপ্লাইয়ার হলো Motorola, যাকে আমরা মোবাইল হ্যান্ডসেট কোম্পানি বলে চিনি। এর ব্যালিস্টিক প্রোটেকশনের জন্যে যেসব জিনিস লাগছে, সেগুলি আসছে কেমিক্যাল কোম্পানি DuPont-এর কাছ থেকে। Caterpillar-কে আমরা চিনি কন্সট্রাকশন যন্ত্রপাতি তৈরি করার কোম্পানি হিসেবে; এরা সাহায্য করেছে ট্যাঙ্কটির ট্র্যাক ডিজাইন করতে। কাজেই এখন Motorola, DuPont আর Caterpillar-কে আপনি কি ধরনের কোম্পানি হিসেবে দেখবেন? এরা যে সকলেই ডিফেন্স কনট্রাকটর হিসেবে কাজ করছে এটা কি আমরা এখন বুঝতে পারছি?
  
মাহিন্দ্রা আমাদের কাছে গাড়ির কোম্পানি।মাহিন্দ্রা সেনাবাহিনীর জন্যে গাড়ি তৈরি করে। মাহিন্দ্রার সাথে Airbus Helicopters-এর চুক্তি হয়েছে সামরিক হেলিকপ্টার তৈরি করার জন্যে।

ভারতীয় কর্পোরেট হাউস, নাকি ডিফেন্স কনট্রাকটর?

এবার দেশের কাছাকাছি কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মেরকাভা ট্যাঙ্কের ব্যালিস্টিক কম্পিউটার এবং ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম তৈরি করেছে ইস্রাইলের Elbit Systems Ltd, যারা কিনা মূলত ডিফেন্স-এর কনট্রাকটর। এই একই কোম্পানি ভারতের অর্জুন ট্যাঙ্কের Laser Warning Control System (LWCS) তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এই একই ট্যাঙ্কের ইঞ্জিনটি এখন ডেভেলপ করছে ভারতের কয়েকটি কোম্পানি মিলে। এর মাঝে রয়েছে মহারাষ্ট্রের পুনের Kirloskar Group, যারা পাম্প, ইঞ্জিন, মোটর, ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, কমপ্রেসার, CNC Lathe, মোটরগাড়ি, ইত্যাদি তৈরি করে। ১৯৮৮ সালে এই গ্রুপের ১০০তম জন্মদিনে ভারতের রাষ্ট্রীয় ডাকটিকেট উন্মোচন করা হয়। এতে বোঝা যাচ্ছে যে সেই রাষ্ট্রের কাছে এই কোম্পানিটি শুধু একটি প্রাইভেট কোম্পানি নয়; অন্য কিছু। কোম্পানিটির ইঞ্জিন তৈরি করার সাবসিডিয়ারি ৩ হর্সপাওয়ারের পানির পাম্পের ইঞ্জিন থেকে শুধু করে ১১ হাজার হর্সপাওয়ারের ইলেকট্রিক পাওয়ার জেনারেশন ইঞ্জিন তৈরি করে। এরা ভারতে Toyota গাড়ি তৈরি করে। বর্তমানে কোম্পানিটি আমেরিকার Cummins-এর সাথে একত্রে অর্জুন ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন ডেভেলপ করছে; সাথে অন্যান্যদের সহায়তাও রয়েছে। এখন Kirloskar Group-কে আমরা কি কোম্পানি বলবো? পানির পাম্প বা ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার তৈরি করা কোম্পানি, নাকি ডিফেন্স কনট্রাকটর?
  
বাংলাদেশে ভেড়ামারার ৩৬০ মেগাওয়াট গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র এবং শিকলবাহার ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ করছে Larsen & Toubro. তারা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জন্যে রাডার, মিসাইল, রকেট, নেভাল টর্পেডো, সাবমেরিন হাল, সোনার, ইত্যাদি তৈরি করে। Prithvi-II-সহ ভারতের অনেক স্ট্র্যাটেজিক মিসাইলের মোবাইল প্ল্যাটফর্ম Larsen & Toubro-এর হাতে তৈরি। এই কোম্পানিকে আমরা কি বলে চিনি?

এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে ভারতে এবং বাকি বিশ্বে। ভারতের প্রাইভেট ডিফেন্স কনট্রাকটরদের মাঝে রয়েছে Tata, Mahindra, Reliance, Hinduja, Larsen & Toubro, Godrej ইত্যাদি। Tata Advanced Systems Limited নামে কোম্পানিটি আমেরিকার Sikorsky Aircraft Corporation-এর সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে Sikorsky S-92 হেলিকপ্টার তৈরি করছে। Israel Aircraft Industries-এর সাথে একত্রে তারা ড্রোন তৈরি করছে। হিন্দুজা গ্রুপের Ashok Leyland Defence Systems ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ ট্রাক তৈরি করেছে। মাহিন্দ্রা সেনাবাহিনীর জন্যে গাড়ি তৈরি করে। মাহিন্দ্রার সাথে Airbus Helicopters-এর চুক্তি হয়েছে সামরিক হেলিকপ্টার তৈরি করার জন্যে। Reliance Defence and Engineering Limited ভারতের নৌবাহিনীর জন্যে যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে। Godrej Aerospace ভারতের স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেভিকেলের জন্যে ইঞ্জিন তৈরি করছে, BrahMos মিসাইল তৈরি করছে; যুক্তরাষ্ট্রের GE, Honeywell, যুক্তরাজ্যের Rolls-Royce এবং ইস্রাইলের Rafael-এর জন্যে বিভিন্ন কম্পোনেন্ট তৈরি করছে। Larsen & Toubro ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জন্যে রাডার, মিসাইল, রকেট, নেভাল টর্পেডো, সাবমেরিন হাল, সোনার, ইত্যাদি তৈরি করে। Prithvi-II-সহ ভারতের অনেক স্ট্র্যাটেজিক মিসাইলের মোবাইল প্ল্যাটফর্ম Larsen & Toubro-এর হাতে তৈরি। এই কোম্পানিগুলিকে আমরা কি বলে চিনি? বাংলাদেশে ভেড়ামারার ৩৬০ মেগাওয়াট গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র এবং শিকলবাহার ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ করছে Larsen & Toubro. গোদরেজ-কে আমরা চিনি চুলের কালার এবং গুডনাইট মশার ওষুধের জন্যে। টাটা, মাহিন্দ্রা, অশোক লেল্যান্ড আমাদের কাছে গাড়ির কোম্পানি; রিলায়েন্স হলো মোবাইল ফোন কোম্পানি। মোটকথা, আমাদের কাছে এই কোম্পানিগুলি বেসামরিক কোম্পানি, মিসাইল-রাডার-ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন তৈরির কোম্পানি নয়। আমরা এমন অদ্ভূত শিশুসুলভ আচরণ কতোদিন করে যাবো সেটাই কি প্রশ্ন নয়?
 
Caterpillar-কে আমরা চিনি কন্সট্রাকশন যন্ত্রপাতি তৈরি করার কোম্পানি হিসেবে; এরা সাহায্য করেছে ইস্রাইলের মেরকাভা ট্যাঙ্কের ট্র্যাক ডিজাইন করতে। তাদের তৈরি ইঞ্জিন বহু সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

আমরা রাষ্ট্রের জন্যে কাজ করা শুরু করবো কবে থেকে?

এর আগেই লিখেছিলাম যে আমাদের শিল্পপতিরা কিভাবে ব্লু ইকনমি গড়বেনসামরিক-বেসামরিক বিভেদ চিন্তা এখানে আসতে দিলে রাষ্ট্র হবে ক্ষতিগ্রস্ত। রাষ্ট্রের জন্যে কাজ করাই হচ্ছে উচ্চতর কাজ; বাকি সব গৌণ। ১০০ টাকার কাজের মাঝে ১ টাকার কাজ যদি রাষ্ট্রের জন্যে করা হয়, তার মানে হলো সেই কোম্পানিকে রাষ্ট্র বিশ্বাস করে। ওই ১% কাজই সেই কোম্পানিকে রাষ্ট্রের অংশ বানিয়ে ফেলে। আর সেটাই হয়ে যায় তার মার্কেটিং-এর সবচাইতে বড় অস্ত্র – “আমরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকি”। তার আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। ডিফেন্স কনট্রাকটর হওয়াটা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশ। চিপস-এর প্যাকেট, আন্ডারওয়্যার, বিউটি সাবান অনেক তৈরি হয়েছে; এবার রাষ্ট্রের জন্যে কাজ করার পালা। বাংলাদেশ এখন আর বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞায় পড়ছে না; যেকারণে শুধু দিল্লীতে নয়, আটলান্টিকের ওপাড়েও ক্রাইসিস চলছে। এই রাষ্ট্র এখন বিশ্বকে আগের মতো দেখছে না – আমাদের কর্পোরেটদের এই ব্যাপারটাকে শুধু অনুধাবন করা নয়, কাজে প্রমাণ করার সময় এসেছে। যারা এসময় গালে হাত দিয়ে বসে থাকবেন, তাদের একসময় বিরাট আফসোসের মাঝে পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে – সময় ফেরত আসে না।

Tuesday 22 November 2016

সামরিক বাজেট ব্যাপারটা আসলে কি?

২২শে নভেম্বর ২০১৬

সামরিক-বেসামরিক বিভেদ তৈরি করে সেটাকে জিইয়ে রাখার একটা উতকৃষ্ট পদ্ধতি হলো আলাদা করে সামরিক বাজেট ঘোষণা করে সেটিকে ইস্যু হিসেবে সামনে নিয়ে আসা। বেসামরিক জনগণের মাঝে একটা চিন্তার সূত্রপাত ঘটানো যে সামরিক বাজেট সব টাকা খেয়ে ফেলছে। এভাবে দেশের মানুষকে দিয়েই দেশের নিজ নিরাপত্তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয় যাতে দেশের জনগণ নিজেরাই নিজেদের প্রতিরক্ষা দুর্বল করে ফেলতে থাকে। আর দেশের প্রতিরক্ষা দুর্বল হলে তাদেরই লাভ হয়, যারা এই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী।


বাংলাদেশের সামরিক বাজেট নিয়ে কম বিতর্ক দেখিনি আমরা। সবসময়েই বিতর্কের নেতৃত্ব দিয়েছে বিদেশী অর্থে লালিত এনজিও-গুলি এবং তাদের মুখপাত্র কিছু আদর্শিক পত্রিকা। কিন্তু এই সামরিক বাজেট আসলে কি? বেসামরিক বাজেটই বা কি? সামরিক বাজেটকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে যে বেসামরিক বাজেটটা আসলে কি। এর আগে সামরিক-বেসামরিক আলাদা করার লাইনের কৃত্রিমতা নিয়ে লিখেছিলাম। আবার এরও আগে লিখেছিলাম যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা শুধু সামরিক কোন বিষয় নয়। আসলে সামরিক-বেসামরিক বিভেদ তৈরি করে সেটাকে জিইয়ে রাখার একটা উতকৃষ্ট পদ্ধতি হলো আলাদা করে সামরিক বাজেট ঘোষণা করে সেটিকে ইস্যু হিসেবে সামনে নিয়ে আসা। বেসামরিক জনগণের মাঝে একটা চিন্তার সূত্রপাত ঘটানো যে সামরিক বাজেট সব টাকা খেয়ে ফেলছে। দেশের সকল মানুষের হক খেয়ে ফেলছে সামরিক বাজেট। এভাবে দেশের মানুষকে দিয়েই দেশের নিজ নিরাপত্তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ দেশের জনগণ নিজেরাই নিজেদের প্রতিরক্ষা দুর্বল করে ফেলতে থাকে। আর দেশের প্রতিরক্ষা দুর্বল হলে তাদেরই লাভ হয়, যারা এই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী।

দেশের বেসামরিক বাজেটের মাঝে যা থাকে, সেটার কি আসলে কোন সামরিক গুরুত্ব নেই? তাহলে কেন জরুরী মুহুর্তে বেসামরিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়? সেটা করা হয়, কারণ সেটা “বেসামরিক” হবার কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সেটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটা “কৌশলগত” দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই “কৌশলগত” ব্যাপারটাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। এভাবে অনেক ব্যাপারই রয়েছে যেগুলি কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেগুলিকে বলা হয় “বেসামরিক” বাজেট। যেমন –

দুর্বল স্বাস্থ্যের একটা লোক তো একটা রাইফেলই তুলতে পারবে না। দেশের খাদ্য এবং স্বাস্থ্যনীতি তাই দেশের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত।
    
 ১. যদি দেশের মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে, তাহলে আপনি দরকারের সময়ে সামরিক বাহিনীর জন্যে রিক্রুট পাবেন কোথা থেকে? দুর্বল স্বাস্থ্যের একটা লোক তো একটা রাইফেলই তুলতে পারবে না। ১৯৭১ সালে সালে যত মানুষ যুদ্ধ করেছিল, তার বেশিরভাগই তো ছিল বেসামরিক লোক। তাহলে সেই সময়ের “সামরিক সামরিক” এবং “বেসামরিক সামরিক” লোকগুলিকে আপনি কি করে আলাদা করবেন? এরা সবাই তো অস্ত্রধারী যোদ্ধা ছিল এবং রক্ত ঝড়িয়েছে। দেশের খাদ্য এবং স্বাস্থ্যনীতি তাই দেশের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত।
     
ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, এরোনটিক্যাল, ম্যারিন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার না থাকলে সামরিক কোন স্থাপনা বা যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব নয়। শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা বাজেট তাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
২. দেশের মানুষ অশিক্ষিত হলে উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক যন্ত্র চালানোর জন্যে লোক কি আপনি বাইরে থেকে নিয়ে আসবেন? অশিক্ষিত লোক তো আর্টলারি টার্গেটিং-এর হিসেব বুঝবে না। যুদ্ধবিমান চালাতে বা বিমান তৈরি ও মেরামতে হবে অক্ষম। ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, এরোনটিক্যাল, ম্যারিন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার না থাকলে সামরিক কোন স্থাপনা বা যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব নয়। শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা বাজেট তাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনীতির চাকাকে সর্বদা সচল রাখতে না পারলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং সামরিক সক্ষমতাও হ্রাস পাবে।

    ৩. ষোল কোটি মানুষকে খাইয়ে-পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখতে যে অর্থনীতির চাকা চালিত রাখতে হবে, সেটা কাউকে বোঝাতে হবে না। এই চাকাকে সর্বদা সচল রাখতে না পারলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং সামরিক সক্ষমতাও হ্রাস পাবে। বাণিজ্যনীতি, জ্বালানিনীতি, পরিবহণনীতি, সমুদ্রনীতি, ইত্যাদি আরও অনেক কিছুই এর মাঝে পড়ে যাবে।

ইলেকট্রনিক্স শিল্প, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক্স শিল্প, পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প, অটোমোবাইল শিল্প, জাহাজ-নির্মাণ শিল্প, এরোনটিক্যাল শিল্প, মহাকাশ শিল্প, অবকাঠামোগত শিল্প, ইত্যাদি গড়ে না উঠলে সামরিক সক্ষমতা তৈরি হবে না কখনোই।



  ৪. মূল শিল্পগুলিকে উন্নত না করলে সামরিক সক্ষমতা কখনোই তৈরি হবে না; অন্যের উপরে নির্ভরশীল থাকতে হবে। যেমন – স্টিল, এলুমিনিয়াম, কপার, ইত্যাদি মেটাল ইন্ডাস্ট্রি উন্নত করতে না পারলে সামরিক শিল্প গড়ে উঠবে না। ইলেকট্রনিক্স শিল্প, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক্স শিল্প, পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প, অটোমোবাইল শিল্প, জাহাজ-নির্মাণ শিল্প, এরোনটিক্যাল শিল্প, মহাকাশ শিল্প, অবকাঠামোগত শিল্প, ইত্যাদি গড়ে না উঠলে সামরিক সক্ষমতা তৈরি হবে না কখনোই। শিল্পনীতি তাই দেশের নিরাপত্তার জন্যে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।

উপরে যে কথাগুলি আলোচনা করেছি, সেগুলি সর্বদাই দেশের শত্রুর জন্যে টার্গেট থাকবে। এর আগে সবিস্তারে লিখেছি যে একটা দেশকে কিভাবে দুর্বল করা হয়। সেখানে বলেছিলাম যে আদর্শিক আক্রমণে কিভাবে একটি দেশকে দুর্বল করে ফেলা হয়। এখানে যেগুলি লিখেছিল সেগুলি একটা দেশের material power-এর সাথে সম্পর্কিত। এগুলি ঠিকমতো পরিচালনা করতে না পারলে রাষ্ট্র দুর্বল থাকবে।

একটা দেশের নিরাপত্তা দরকার হয় কেন? কারণ তার কিছু একটা রক্ষা করতে হয়। সেটা কি? সেটা হচ্ছে দেশের ভিত্তি; একটা চিন্তা। সেই চিন্তাকে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, নিরাপত্তা দেয় এবং বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। সেটাই হচ্ছে রাষ্ট্রের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে বাধা আসবেই। কারো পৌষ মাস; কারো সর্বনাশ! সেই বাধা অতিক্রম করার জন্যেই রাষ্ট্রের physical নিরাপত্তা দরকার হয়। এই নিরাপত্তার মাঝে সামরিক-বেসামরিক কোন ব্যাপার নেই। সেই ব্যাপারটা তৈরি করা মানেই রাষ্ট্রের লক্ষ্যকে আঘাত করা। নিরাপত্তা না থাকলে রাষ্ট্রের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না। আর চিন্তা না থাকলে রাষ্ট্র হবে লক্ষ্যহীন; অর্থহীন। 

Wednesday 9 November 2016

হুভার ড্যাম এবং পদ্মা সেতু - "Strategic Springboard'

১০ই নভেম্বর ২০১৬

  
হুভার ড্যাম তৈরি করেছিল সেই আমেরিকা, যা কিনা ড্যাম তৈরি করার পাঁচ বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, এবং আরও চার বছরের মাথায় পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী দেশরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। এই স্থাপনা মার্কিনীদের material power-এর সক্ষমতার জানান দিয়েছিল। আর মার্কিনীরাও তাদের ক্ষমতাকে নতুন করে টের পেয়েছিল।


যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর উপরে ১৯৩০-এর দশকে নির্মিত হয়েছিল হুভার ড্যাম বা হুভার বাঁধ। সেসময়ের চরম অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার পেছনে এই বাঁধের গুরুত্ব ছিল বিপুল। হাজার পাঁচেক মানুষ এখানে কাজ করেছিল, যাদের থাকার জায়গা দিতে সেখানে একটা শহর তৈরি করা হয়েছিল। ৩৩ লক্ষ কিউবিক মিটার কনক্রিট ব্যবহার করা হয়েছিল এতে; ব্যবহার করা হয়েছিল অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি, যা কিনা এর আগে কোনদিন ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৩৬ সালে বাঁধটি যখন চালু করা হয়, তখন এটি ছিল পৃথিবীর সবচাইতে বড় কনক্রিট স্থাপনা। বাঁধ ১,৩৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উতপাদন করে সেই বিদ্যুত বিক্রি করে বাঁধের ঋণ শোধ করা হয়েছিল। বাঁধের মূল সুফল পেয়েছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ। ১০ লক্ষ একর চাষের জমিতে সেচের ব্যবস্থা হয়েছিল। ছয়টি মার্কিন কোম্পানি একত্রিত হয়ে বাঁধটি তৈরি করে এমন সময়, যখন পুরো পশ্চিমা বিশ্বে কাজের হাহাকার চলচিল। হ্যাঁ, এগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক সুফল বয়ে এনেছিল। কিন্তু হুভার ড্যাম কি আসলেই শুধুমাত্র একটা অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল? আজ কিন্তু এই ড্যামের চাইতে অনেক বড় বড় ড্যাম তৈরি হয়ে গেছে? এটাকি তাহলে আজ গুরুত্বহীন? এই ব্যাপারটা বুঝতে হলে একটু ভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করে দেখতে হবে।
    
যারা ১৯৩০-এর দশকে হুভার ড্যাম বানিয়েছিলেন, তারাই ১৯৪০-এর দশকে হাজার হাজার জাহাজ তৈরি করেছিল বিশ্বযুদ্ধে জয়ের জন্যে। হুভার ড্যাম আমেরিকা এমন কিছু দিয়েছিল, যা তাদের ছিল না - বিশ্ব পরিচালনার আত্মবিশ্বাস।

হুভার ড্যাম থেকে গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার

হুভার ড্যাম তৈরি করেছিল সেই আমেরিকা, যা কিনা ড্যাম তৈরি করার পাঁচ বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, এবং আরও চার বছরের মাথায় পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী দেশরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। চীনের ইয়াংজি নদীর উপরে তৈরি Three Gorges Dam দেখে সারা বিশ্বের মানুষ যেমন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, হুভার ড্যাম তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এই স্থাপনা মার্কিনীদের material power-এর সক্ষমতার জানান দিয়েছিল। আর মার্কিনীরাও তাদের ক্ষমতাকে নতুন করে টের পেয়েছিল। এই ক্ষমতার আস্বাদন পুরোপুরি পেতে অবশ্য তাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেতা অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। হুভার ড্যাম ছিল একটা Springboard, যার উপরে পা দিয়ে তারা এক লাফে মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে আমেরিকানদের রাজি করানোটা খুবই কঠিন ছিল। তারা মনে করতো যে ওটা ইউরোপিয়ানদের যুদ্ধ, আমেরিকার যুদ্ধ নয়। দুনিয়াটাকে মার্কিনীরা তখনও তাদের করে নিতে শেখেনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। যখন হিটলার পুরো ইউরোপ দখল করে নিচ্ছিল, তখন মার্কিনীরা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। শুধুমাত্র জাপানের আক্রমণই মার্কিনীদের যুদ্ধে নামিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই জানতেন যে মার্কিনীদের যুদ্ধে জড়াতেই হবে। আর কেউ কেউ আবার মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন যে জাপানীর মার্কিনীদের আক্রমণ করে বসেছিল – কারণ তারা মনে করতেন যে জাপানীরা আক্রমণ না করলে তো এই অলস মার্কিনীদের দিয়ে মহাসাগর পাড়ি দেয়ানো যাবে না। কিন্তু মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করতে পারার মতো মানসিক সক্ষমতা তাদেরকে দিয়েছিল সেই হুভার ড্যাম। এই ড্যাম মার্কিনীদের সেই আত্মবিশ্বাস গড়ে দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাম হয়ে যায় গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার (Arsenal of Democracy)। হুভার ড্যাম তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখা মার্কিন ব্যবসায়ী হেনরি জে. কাইজার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিরাট সংখ্যক জাহাজ নির্মান করেন। তার শিপইয়ার্ডে ৮০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। হুভার ড্যাম কাইজারের মতো আরও অনেক লোক তৈরি করেছিল, যারা পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধ জয়ে বিরাট অবদান রেখেছিল।
  
হুভার ড্যাম এখন অনেক পুরোনো কথা। সেই ড্যাম এখন আর আমেরিকানদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় না। ফেসবুক সেলফি, কিম কার্দাশিয়ান, বা WWE Wrestling এখন তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প-হিলারির প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট-এ এন্টারটেইনমেন্ট না থাকলে মানুষ সেটা দেখে না।

অধঃপতনের পথে….

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীদের চিন্তাগুলিকে material রূপ দিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল হুভার ড্যাম এবং তার ঠিক পরবর্তী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন ছিল মার্কিন চেতনার উচ্ছ্বাসের সময়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে টানা ৪৫ বছর ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝ দিয়ে এই চেতনার উল্লম্ফন আমরা দেখেছি। প্রযুক্তিগত উত্তরণের পথে তারা বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে। তখন ছিল আদর্শিক যুদ্ধের চরম অবস্থা; জিততে না পারলে জীবনটাই বৃথা। সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। আফগানিস্তানে হঠাত যুদ্ধে হেরে যাবার ফলাফল যে এটা হতে পারে, তা ছিল সকলের কল্পনার বাইরে। রাতারাতি মার্কিনীরা সেই শত্রুকে হারালো, যার ভয় দেখিয়ে তারা শিশুদের ঘুম পাড়াতো, ব্যাংকার-স্টক ব্রোকারদের সামরিক ট্রেনিং দিতো, মাল্টিবিলিয়ন ডলার খরচ করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতো। শত্রু নাই তো অস্ত্রের উদ্দেশ্যও নাই। ২০০১ সাল থেকে অফিশিয়ালি এমন এক শত্রুকে মার্কিনীরা ধরে নিয়ে এলো, যার আসলে কোন শারীরিক অস্তিত্ব নেই। যার অস্তিত্ব নেই তাকে তারা মারবে কি করে? এখানেই হয়ে গেল সমস্যা। এই শত্রুকে মার্কিনীরা খুঁজে পাচ্ছে না; বুঝতে পারছে না। একুশ শতকের আমেরিকা এগুলি বুঝতে পারছে না। হুভার ড্যাম এখন অনেক পুরোনো কথা। সেই ড্যাম এখন আর আমেরিকানদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় না। ফেসবুক সেলফি, কিম কার্দাশিয়ান, বা WWE Wrestling এখন তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প-হিলারির প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট-এ এন্টারটেইনমেন্ট না থাকলে মানুষ সেটা দেখে না। অনুষ্ঠানের টিআরপি বেশি গুরুত্বপূর্ণ; ব্যবসা তো করতে হবে তাই না? অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়; কি আর করা? এই আমেরিকা এখন আর কিসিঞ্জার-ব্রেজিনস্কিদের মতো মারদাঙ্গা আদর্শিক চিন্তাবিদদের রাষ্ট্র নয়

চিন্তার অধঃপতনের সাথে সাথে material power-এরও অধঃপতন হয়েছে। এই মুহুর্তে পৃথিবীর কোথাও আরেকটা যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়ে সেখান থেকে সফলভাবে বের হয়ে আসার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তার অর্থনীতি এখন আমদানি-নির্ভর। তারা এখন তেমন কিছুই তৈরি করে না; সব আমদানি করে। এমনকি গণতন্ত্রের অস্ত্রাগারের অবস্থাও এখন খারাপের দিকে। একটা যুদ্ধবিমান (F-35) এবং একটা যুদ্ধজাহাজ (Littoral Combat Ship) ডিজাইন করতে গিয়ে তাদের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে এটা অস্ত্রাগার থেকে কোন একসময় ভাগাড়ে রূপ নিতে পারে। অবশ্য মার্কিন নেতৃত্বের ভাগাড়-সদৃশ প্রতিযোগিতাই দেখিয়ে দিয়েছে তারা কোন দিকে যাচ্ছে। একটা ক্ষয়িষ্ণু শক্তির করুণ চেহারা দিনে দিনে ফুটে উঠছে। ক’দিন আগেই ফিলিপাইনকে হারিয়েছে তারা। এর আগে হারিয়েছে থাইল্যান্ডকে। এই দুই দেশই ছিল তাদের বহুকালের স্যাটেলাইট দেশ। বিভিন্ন অঞ্চলে মার্কিনীরা “বন্ধু” দেশের উপরে নির্ভর করছে পুলিশম্যানের কাজ করার জন্যে। এই আমেরিকা হুভার ড্যামের আমেরিকা নয়। এই আমেরিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতি-ধর্ম বিদ্বেষযুক্ত কটূক্তিতে আসক্ত আমেরিকা। তবে হুভার ড্যামের একটা ব্যাপারের সাথে এখানে মিল পাওয়া যাবে – সেই ড্যাম তৈরিতে মাত্র ৩০ জন কালো চামড়ার মানুষকে নেয়া হয়েছিল। এটাই বলে দেয় যে মার্কিন সভ্যতা কিসের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প একুশ শতকে ওই ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতারই হাল ধরতে যাচ্ছেন।
   
পদ্মা সেতুর মাঝে তারা বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় একটা Springboard দেখতে পাচ্ছিল; তারা দেখতে পাচ্ছিল হুভার ড্যামের প্রতিচ্ছবি। পদ্মা সেতু ভারত মহাসাগরে একটা ভূমিকম্পের জন্ম দেবে, যার থেকে সৃষ্ট সুনামি পুরো মহাসাগরের উপকূল ছাপিয়ে যাবে। রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের আত্মবিশ্বাসকে উঠিয়ে ধরতে এই সেতু যে কাজটি করবে, তা পরিমাপ করা দুষ্কর। এই Springboard জন্ম দেবে এমন আরও অনেক Springboard-এর।

হুভার ড্যাম এবং পদ্মা সেতু

এখন আসি আমাদের কথায়। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির কেলেংকারির কথা যখন তুঙ্গে, তখন না বুঝলেও এখন মানুষ বুঝতে পারছে যে আলোচনার বিষবস্তু আসলে ছিল এই সেতু তৈরিতে দুর্নীতি হয়ছিল কিনা সেটা নয়, বরং এই সেতু আদৌ তৈরি হবে কি হবে না, সেটা। তারা এই প্রশ্নটি তুলেছিল, কারণ তারা বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় একটা Springboard দেখতে পাচ্ছিল; তারা দেখতে পাচ্ছিল হুভার ড্যামের প্রতিচ্ছবি। পদ্মা সেতু ভারত মহাসাগরে একটা ভূমিকম্পের জন্ম দেবে, যার থেকে সৃষ্ট সুনামি পুরো মহাসাগরের উপকূল ছাপিয়ে যাবে। রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের আত্মবিশ্বাসকে উঠিয়ে ধরতে এই সেতু যে কাজটি করবে, তা পরিমাপ করা দুষ্কর। এই Springboard জন্ম দেবে এমন আরও অনেক Springboard-এর। এর আগের লেখায় একটা Springboard নিয়ে আলোচনা করেছি, যা কিনা বহুদূর নিয়ে যেতে পারে খুব অল্প সময়ের মাঝেই।

চিন্তার উত্তরণ নিয়ে অনেক লিখেছি। এখন চিন্তাকে material রূপ দেয়ার সময়। Material Progress-এর পথে যতো বাধা আসবে সব সাফ করতে হবে কঠোরভাবে। যারা গুলশানের রক্তাক্ত ঘটনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের পরেও বুঝে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে আসল টার্গেট কারা, তারা হয়তো কখনোই বুঝবেন না। বুঝতে বাকি থাকা উচিত নয় যে এই জঘন্য ব্যাপারগুলি ঘটানো হচ্ছে ভারত মহাসাগরে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান ঠেকাতে। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলি যখন মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে চোখের পানি ফেলছে, তখন প্রশ্ন করতেই হয় যে “তাদের নেতা” কি আসলেই “আমাদের নেতা” কিনা? তারা এমন চিন্তা করে কারণ স্ট্যাচু অব লিবার্টি তাদের তীর্থ। প্রভূর সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে তাধিং তাধিং করে নাচতে নাচতে সাত-সমুদ্র তারা পাড়ি দিয়ে দেয়; বাংলাদেশের জন্যে তারা একটা নদী বা খালও পাড়ি দেবে না। তাদের জন্যে পদ্মা সেতু Springboard নয়, বরং হুভার ড্যামের প্রতিযোগী। পদ্মা সেতুতে তারা ভারত মহাসাগরে মার্কিন কর্তৃত্বের ধ্বংসের ছায়া দেখতে পায়। আর ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্ব হারানোর চিন্তায় মার্কিনীদের সারা দুনিয়ার উপরে কর্তৃত্ব ছুটে যায়; ঘুম হারাম হয়। আটলান্টিকের ওপারের ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রের নেতৃত্ব আমাদের জন্যে কাঁসার পাতে কয় দানা বাশি ভাত রেখেছে, সেটা আজ আমাদের চিন্তা নয়। বরং চিন্তা হচ্ছে আর কি কি Springboard আমরা নিয়ে আসবো, যা কিনা আমাদের material শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য গতি দেবে।