Friday 30 September 2022

ইতালির ডানে মোড়… ইউরোপের জন্যে এটা কেমন বার্তা?

৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
ইতালির নির্বাচনে জেতার পর কট্টর ডানপন্থী কোয়ালিশনের তিন নেতা মাত্তেও সালভিনি, সিলভিও বারলুসকোনি এবং জর্জিয়া মেলোনি। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি কোন না কোন ফর্ম্যাটে চলেছে। নব্য-ফ্যাসিস্টরা তাদের কথাগুলি পরিবর্তন করেছে। কিন্তু তাদের কথার কেন্দ্রে ছিল অভিবাসী নীতি; যেটাকে তারা ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যতার মাঝে সকল সমস্যার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মেলোনির সরকার কতদিন টিকবে সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের উপর এর বিরূপ প্রভাব যে বাড়বে, তা নিশ্চিত।

সেপ্টেম্বরের ইতালির নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীরা বিশাল বিজয় পেয়েছে। নির্বাচনের সর্বশেষ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, জর্জিয়া মেলোনির ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’, মাত্তেও সালভিনির ‘লেগা নর্ড’ এবং সিলভিও বারলুসকোনির ‘ফোর্তসা ইতালিয়া’ দলের ডানপন্থী কোয়ালিশন প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এর মাঝে মেলোনির দল পেয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ ভোট। ইতালির সকল পত্রিকাই মেলোনির দলের বিজয়ের ব্যবধান নিয়ে হেডলাইন করে। কেউ কেউ বলে যে, মেলোনি ইতালির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। তবে মাত্র ৬৪ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়ার কারণে অনেকেই এই ভোটের গুরুত্বকে কিছুটা হলেও কম হিসেবে দেখছেন বলে বলছে ‘ডয়েচে ভেলে’। যারা ডানপন্থী দলের পক্ষে ভোট দেয়নি, তারা আশা করছেন দেশের বাকি জনগণকে সাথে নিয়েই যেন সরকার কাজ করে। তবে এই মুহুর্তে জীবনযাত্রার খরচ মারাত্মক বেড়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ চলমান থাকায় প্রথম দিন থেকেই মেলোনির সরকার চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়বে। নির্বাচিত হবার পর জর্জিয়া মেলোনি তার প্রথম ভাষণে বলেন যে, তিনি ইতালিকে একত্রিত করার চেষ্টা করবেন।

ইতালিতে ডানপন্থী রাজনীতির ইতিহাস

৪৫ বছর বয়স্ক মেলোনির দল ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা পেলেও আগের কিছু ইতিহাসের সাথে দলটার সম্পর্ক রয়েছে বলে বলছেন অনেকে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ১৯২২ সালে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ‘ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি’ ক্ষমতা দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি প্রথমে নাজি জার্মানির পক্ষে থাকলেও মুসোলিনির পতনের পর তারা মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের চিফ অব স্টাফ গিওরগিও আলমিরান্তের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় নব্য-ফ্যাসিস্ট দল ‘ইতালিয়ান সোশাল মুভমেন্ট’ বা ‘এমএসআই’। বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ফ্যাসিস্ট সমর্থকরা এই দলে যোগদান করতে থাকে। প্রায় তিন দশক ধরে চলা এর রাজনীতিতে তারা ১০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। তবে ইতিহাসবিদ পল জিনসবর্গ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এই দল যে এতকাল টিকে থেকেছিল, সেটাই বড় বিষয়। ইতালির দক্ষিণের জনগণ, শহরাঞ্চলের গরীব মানুষেরা এবং নিম্ন মধ্যবিত্তরা অনেকেই এদের পক্ষে ভোট দিয়েছে। জিয়ানফ্রাঙ্কো ফিনির অধীনে ১৯৯০এর দশকে এই দলে পরিবর্তন আসে। তিনি দলের বক্তব্যগুলিকে পরিবর্তন করেন এবং ১৯৯৩ সালে রোমের মেয়র নির্বাচনে ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সকলকে অবাক করে দেন। পরের বছরেই তিনি তার দলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’। এই সময়টাতেই রোমের খেটে খাওয়া একজন মহিলার সন্তান জর্জিয়া মেলোনি ‘এমএসআই’তে যোগদান করেন এবং পরে ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’এর যুব দলের নেতা হয়ে যান।

একসময় মুসোলিনিকে বিংশ শতকের সেরা রাজনীতিবিদ বলে আখ্যা দিলেও জিয়ানফ্রাঙ্কো ফিনি তার মতামতকে পরিবর্তন করেন এবং ২০০৩ সালে ইস্রাইল সফর করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যার শিকার ইহুদিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইতালির ইহুদী বিদ্বেষী আইনের সমালোচনা করেন। জর্জিয়া মেলোনিও ২০০৯ সালে সিলভিও বারলুসকোনির সরকারের মন্ত্রী থাকার সময় ইস্রাইল সফর করে একই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ২০১১ সালে ইইউএর প্রভাবে ইতালিতে গঠিত সরকারে মেলোনি যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। এবং ২০১২ সালে ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার দলকে ‘পুরোনো ঐতিহ্যের জন্যে নতুন দল’ হিসেবে পরিচিত করান। তবে ২০২২ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তার দল ১০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি।

মেলোনির ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’র লোগো হলো ইতালির জাতীয় পতাকার তিন রঙের আগুন। এর আগের ‘এমএসআই’ এবং ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’এর লোগোও সেটাই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ‘রুটগার্স ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর কোরি ব্রেনান ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, রাজনীতিতে লোগোটা ব্র্যান্ডিংএর মতো গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এটাকে খোঁজে এবং অনুসরণ করে। ইতালিতে মুসোলিনির তৈরি করা অনেক কিছুই এখনও টিকে আছে। বড় বড় স্থাপত্য ছাড়াও রোমের ম্যানহোলের ডাকনার এক-চতুর্থাংশের উপরে লেখা রয়েছে ‘এসপিকিউআর’। যার অর্থ হলো, ‘রোমের সিনেট এবং জনগণ’। মুসোলিনি তার সাম্রাজ্যকে প্রাচীন রোমের সাথে তুলনা দিতে এটা ব্যবহার করতেন। অনেক ম্যানহোলে ফ্যাসিট লোগোটাও রয়েছে। যদিও ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্যাসিস্ট দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তথাপি ডানপন্থীরা এখনও ফ্যাসিস্ট স্যালুট ব্যবহার করে।

বড় বড় স্থাপত্য ছাড়াও রোমের ম্যানহোলের ডাকনার এক-চতুর্থাংশের উপরে লেখা রয়েছে ‘এসপিকিউআর’। যার অর্থ হলো, ‘রোমের সিনেট এবং জনগণ’। মুসোলিনি তার সাম্রাজ্যকে প্রাচীন রোমের সাথে তুলনা দিতে এটা ব্যবহার করতেন। অনেক ম্যানহোলে ফ্যাসিট লোগোটাও রয়েছে। ইউরোপে ডানপন্থী রাজনীতি কখনোই বন্ধ করা হয়নি। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা লিবারাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাঝেই তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে অভিবাসী সংকটের পর থেকে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থীদের উত্থান হয়েছে। যেকারণে ইতালির এই নির্বাচন পুরো ইউরোপের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ।

 ডানপন্থীরা কিভাবে ইতালির নির্বাচনে জিততে পারলো?

রোমে ‘ইইউ’এর পররাষ্ট্র বিষয়ক কাউন্সিলের প্রকল্প ব্যবস্থাপক টেরেসা কোরাটেলা ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, মেলোনির এই অবস্থানে আসার সবচাইতে বড় কারণ হলো, ২০১৮ সাল থেকে ইতালিতে যতগুলি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে, তিনি সেগুলির কোনটারই অংশ ছিলেন না। আর দ্বিতীয়তঃ তার কোয়ালিশন সহযোগী মাত্তেও সালভিনি এবং সিলভিও বারলুসকোনি এই মুহুর্তে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবচাইতে খারাপ সময় পার করছেন। ইতালির আগের সরকার প্রধানদের অনেকেই প্যারিস এবং বার্লিনের নেতৃত্বের সাথে যেমন সমঝোতা করে চলতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি হয়তো সেই পথে নাও হাঁটতে পারেন। অন্ততঃ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তিনি হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডের ডানপন্থী নেতৃত্বের সাথে বেশি কাছের সম্পর্ক রেখেছিলেন।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে রোমের ‘ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স’এর ডিরেক্টর নাথালি টচ্চি ডানপন্থীদের জয়কে ইতালির রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সাথে যুক্ত করেন। ডানপন্থীরা জিতেছে, এর অর্থ এই নয় যে, ইতালিয়রা ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছে। এদের জয়ের মূল কারণ হলো, জনগণ ইতালির রাজনীতির ব্যাপারে যারপরনাই ক্ষুব্ধ; তারা পরিবর্তন চাইছে। তারা ভিন্ন একটা দলকে ভোট দিতে চাইছিল।

তবে ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ডানপন্থীরা ভোট পাবার জন্যে এমন কিছু ইস্যুকে বেছে নিয়েছে, তা চিন্তা করার মতো। মাত্তিও সালভিনির নির্বাচনী এলাকা ফেরারা কিভাবে বামপন্থী থেকে ডানপন্থী হয়ে গেলো তার উত্তর খুঁজতে ‘বিবিসি’ বলছে যে, সেখানকার জনগণ মনে করছে যে, অভিবাসীদের কারণে তাদের শহরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এবং সাধারণ ইতালিয়রা অর্থনৈতিক সমস্যা পড়েছে। অথচ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই অঞ্চলটা ইতালির অনেক অঞ্চলের চাইতে অধিকতর সমৃদ্বশালী। এখানকার সমস্যা হলো এখানকার স্থবির জনসংখ্যা; যেটার কারণে এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন আসছে না; তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি হচ্ছে না। ডানপন্থীরা বলছে যে, এখানকার অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে অভিবাসীদের কারণেই; আর সেটাই অনেক মানুষ সমর্থন করছে। অথচ একসময় এই শহরে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অপরাধে অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে; যাদের মাঝে কেউ কেউ এখনও বেঁচে আছেন। তাদের জীবদ্দশাতেই তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, ইতালি আবারও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

অনেকেই ডানপন্থীদের জয়ের পিছনে কিছু ষড়যন্ত্র থিউরির কথা বলছেন; যা মানুষ বিশ্বাস করছে। ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি’র প্রফেসর লরেন্স রোজেনথাল ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, মেলোনি বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন; যার মাঝে রয়েছে নারীবাদী ইস্যুগুলি। তিনি ইতালির পরিবারগুলির স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছেন; শরণার্থী থামাতে সীমানা পাহাড়া দেবার কথা বলেছেন। তিনি সেই থিউরির কথা বলে জনগণকে ক্ষেপিয়েছেন, যেখানে বলা হচ্ছে যে, ‘গ্লোবাল এলিট’রা পশ্চিমা দেশগুলির আদিবাসীদেরকে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসী দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাইছে। এই থিউরিটাই জনগণের ক্রোধের কেন্দ্রে রয়েছে; যা তিনি ব্যবহার করেছেন। সবগুলি পশ্চিমা দেশেই এই চিন্তাটা ঘনীভূত হচ্ছে এবং এরা সকলেই অশ্বেতাঙ্গদেরকে তাদের সমস্যার কারণ হিসেবে দেখছে।

মেলোনি কিছুদিন আগেই এক বক্তব্যে বলেছেন যে, বামপন্থীরা রক্ষণশীলদের সকল বিশ্বাসের উপরে হামলা করেছে। তিনি সিসিলির উপকূলে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ও মেক্সিকোর সীমানার তুলনা করেন। তিনি বলেন যে, হাজারো অভিবাসী শহরের বস্তিগুলি ভরে ফেলছে; এবং তাদের কারণে ইতালির জনগণের পারিশ্রমিক কমে গেছে; এই অভিবাসীরা অনেকেই বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। মেলোনি ইউরোপের অন্যান্য দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে যখন কথা বলছেন, তখন তার কথাগুলি বেশ স্পস্ট। স্পেনের কট্টর ডানপন্থী ‘ভোক্স’ পার্টির এক র‍্যালিতে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, তিনি স্বাভাবিক পরিবারের পক্ষে; সমকামি লবির পক্ষে নন। মানুষের লিঙ্গ পরিচয়ের ব্যাপারে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করলেও লিঙ্গ নিয়ে আদর্শের বিরোধী।

 
জর্জিয়া মেলোনির পিছনে 'ব্রাদার্স অব ইতালি'র লোগো; যেখানে রয়েছে ইতালির পতাকার তিন রঙের আগুন। এর আগের নব্য-ফ্যাসিস্ট দল ‘ইতালিয়ান সোশাল মুভমেন্ট’ বা ‘এমএসআই’ এবং ‘ন্যাশনাল এলায়েন্স’এর লোগোও ছিল এটাই। রাজনীতিতে লোগোটা ব্র্যান্ডিংএর মতো গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এটাকে খোঁজে এবং অনুসরণ করে।

ডানপন্থীদের নীতি কি ইইউএর সাথে সাংঘর্ষিক হবে?

ইইউ পার্লামেন্টে জার্মানির ক্ষমতাসীন সোশালিস্ট দলের প্রতিনিধি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাটারিনা বারলি ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, মেলোনি ক্ষমতায় যাবার পরে তার পূর্বের নীতির মতোই চলবেন, নাকি পরিবর্তিত হবেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, অর্থনৈতিক এবং আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি রক্ষণশীল ভূমিকা নেবেন; আর মানবাধিকার, নারীর অধিকার, এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের মতো আদর্শিক বিষয়ের ক্ষেত্রে খুবই কঠোরভাবে জনমতের উপরে চলবেন। ইউরোপের খারাপ সময়ে তার জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাগুলি ইউরোপকে একত্রিত করবে না। ক্যাটারিনা বারলি বলছেন যে, তাদের অভিজ্ঞতায় এধরনের সরকারগুলির ইইউএর মাঝে ছাড় দেয়ার প্রবণতা থাকে না। অথচ ইইউএর নীতি তখনই তৈরি করা সম্ভব, যখন সেখানে একেকটা দেশের ছাড় দেয়ার প্রবণতা থাকে। যদি একেকটা দেশ মাঝে মাঝে নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সেটা যদি চলতেই থাকে, তাহলে ইইউ আর ইইউ থাকবে না; তা হয়ে যাবে কিছু স্বার্থপর মানুষের ক্লাব। বারলি বলছেন যে, এখন পর্যন্ত মেলোনি ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে কথা বললেও তার কোয়ালিশন সহযোগী মাত্তেও সালভিনি এবং সিলভিও বারলুসকোনি ভ্লাদিমির পুতিনের সমর্থক বলে পরিচিত। কাজেই এখনই বলা যাচ্ছে না যে, ইউক্রেন যুদ্ধে ইতালির অবস্থান কি হবে। তবে ইইউএর জ্বালানি সংকটের মাঝে ইতালি খুব সম্ভবতঃ রুশ জ্বালানির উপরে নির্ভরশীল দেশগুলির জন্যে কোন ছাড় দিতে রাজি হবে না।

মেলোনির ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ দলের সংসদ সদস্য ইলেনিয়া লুকাসেলি ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইতালির জনগণ রক্ষণশীল; তাদের দলও সেইরকমই। অভিবাসী, সমকামিদের অধিকার, গর্ভপাতের অধিকার ইত্যাদি আদর্শিক বিষয় এই মুহুর্তে তাদের দলের কাছে অর্থনৈতিক সমস্যার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইতালির রক্ষণশীল জনগণ প্রকৃতপক্ষে শরণার্থীদের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত নয়। লুকাসেলি বলছেন যে, তাদের দলের সাথে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দলের কোন সম্পর্ক নেই। এই দলের সাথে সম্পর্কিত কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে সোশাল মিডিয়াতে কোন উগ্রপন্থী কথা বলে থাকে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন; কারণ এই দলটা অনেক বড়। প্রতিটা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে দলের কোন নীতির মাঝে উগ্রতা নেই।

ডানপন্থীদের বিজয়কে কে কিভাবে দেখছে?

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানির ক্ষমতাসীন বামপন্থী সোশালিস্ট সরকার ইতালির নির্বাচনের ব্যাপারে রয়েসয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। তবে উগ্র ডানপন্থী ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’ দল ইতালির নির্বাচনে খুশি। তারা বলছে যে, সুইডেন এবং ইতালিতে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির বিজয় প্রমাণ করছে যে, বামপন্থী রাজনীতি এখন অতীতের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্স এবং স্পেনের ডানপন্থী বিরোধী দলগুলিই মেলোনির বিজয়ে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছে। এছাড়াও ইইউএর মাঝে ‘ইউরোস্কেপটিক’ পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির সরকারও তাদের উৎফুল্লতা প্রকাশ করেছে। তবে ইইউএর বাকি দেশগুলি মেলোনির ব্যাপারে একেবারেই আশাবাদী নয়; কারণ তিনি এতদিন তার নীতিতে ইতালির স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবার কথা বলেছেন। যদিও ইইউএর পক্ষ থেকে নীতিগত কারণে ইতালির নির্বাচন নিয়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি, তথাপি ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন বলেছেন যে, যেসব দেশ ইইউএর আদর্শকে সন্মান করবে না, সেসব দেশকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পদ্ধতি ইইউএর জানা রয়েছে।

জার্মানির ‘গ্রিন পার্টি’র সংসদ সদস্য টোবিয়াস বাখেরলে ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়া এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ চালিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ইতালির ডানপন্থী দলের নীতি কি হবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউএর অন্যান্য দেশের ডানপন্থী সরকারগুলির সাথে ইতালির এই সরকার তাল মেলাবে। বাখেরলে পুরো ইউরোপ জুড়ে ডানপন্থী দলগুলির জয়জয়কারে যথেষ্ট চিন্তিত। তিনি মনে করছেন না যে, ডানপন্থীদের উত্থানের ব্যাপারে শুধুমাত্র তার দলের মতো বামপন্থী দলগুলিরই চিন্তা করতে হবে। তিনি বিশেষ করে উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়াটা সকলের কর্তব্য বলে মনে করেন; কারণ এই চিন্তাগুলি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, পশ্চিমা দেশগুলিতে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীরা কিছু ইস্যুতে একমত হচ্ছে; যার মাঝে রয়েছে অভিবাসী ইস্যু, গর্ভপাতের অধিকার, সমকামিদের অধিকার; এবং এর সাথে কিছু ইস্যু, যেগুলিকে ডানপন্থীরা ‘গ্লোবালিস্ট’ ইস্যু বলে আখ্যা দিচ্ছে; অর্থাৎ তারা বলছে যে, সেগুলি দুনিয়ার সমস্যা হলেও তাদের দেশের সেখানে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এই চিন্তগুলি যুক্তরাষ্ট্রেও অনেকেই সমর্থন করেন; যারা মূলতঃ রিপাবলিকান দলের সমর্থক। রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ এবং টম কটন; কংগ্রেস সদস্য মারজোরি টেইলর গ্রিন, এবং প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও সকলেই ইতালির ডানপন্থী নেতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কংগ্রেস সদস্য লরেন বুবার্ট এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, বামপন্থীরা শুধু ধ্বংসই করেছে; যা সারা দুনিয়ার মানুষ বুঝতে পারছে। রিপাবলিকানপন্থী মিডিয়া ‘ফক্স নিউজ’এর প্রভাবশালী সাংবাদিক টাকার কার্লসন ইতালিতে ডানপন্থীদের বিজয়কে একটা বিপ্লব হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

 
ফ্যাসিস্ট স্যালুট দিচ্ছে ইতালির ফুটবল ক্লাব 'লাতসিও'র সমর্থকেরা। ইতালিতে মেলোনির জয় বাকি ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে চরম ডানপন্থীদের শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে জার্মানির উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলি এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও অনুপ্রাণিত হবে। এমতাবস্থায় সবচাইতে বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে জার্মানির রাজনৈতিক লক্ষ্য; যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে মিত্রশক্তিই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

ইউরোপে উগ্রপন্থীদের পুনরুত্থান

ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত ইতালিয় সাংবাদিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অব মায়ামি’র প্রফেসর রুলা জেব্রীল ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, ইতালিতে মেলোনির জয় বাকি ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে চরম ডানপন্থীদের শক্তিশালী করবে। ডানপন্থী এই কর্মকান্ডগুলি যথেষ্ট সংগঠিত এবং এদের বিচরণ এখন বিশ্বব্যাপী। একসময় মেলোনিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার ফলে তিনি ডানপন্থীদের ক্রোধের শিকার হন। ইতালিতে নির্বাচনের পর থেকে তার এবং তার মতো ডানপন্থীদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে প্রাণনাশের হুমকি আসতে শুরু করেছে।

২০১৯এর এপ্রিলে ইতালির ফুটবল ক্লাব ‘লাতসিও’র কিছু সমর্থক মিলানে একটা খেলা শুরুর আগে রাস্তায় ‘বেনিতো মুসোলিনির প্রতি সন্মান’ লেখা একটা ব্যানার তুলে ধরে। প্রায় ৭০ জনের মতো সমর্থক ফ্যাসিস্ট সঙ্গীত গায় এবং ফ্যাসিস্ট স্যালুট দেখায়। ‘সিএনএন’ বলছে যে, ব্যানারটা যে যায়গায় দেখানো হয়, তার কাছেই ১৯৪৫ সালে মুসোলিনি, তার স্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ ফ্যাসিস্ট নেতাদের হত্যা করে তাদের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়া রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, দিনটাও ছিল ‘লিবারেশন ডে’র আগের দিন; যে দিনটা ইতালিতে ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে ইতালির মুক্ত হওয়ার দিন হিসেবে পালন করা হয়। অবশ্য ইতালিতে ফুটবল মাঠে ডানপন্থীদের স্যালুট এবং অন্যান্য প্রতীকের দৃশ্যমান হওয়াটা নতুন নয়। বহুবার এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলেও তা চলছে। তৎকালীন ডানপন্থী উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি ফুটবল মাঠে ফ্যাসিস্ট স্যালুটের সমালোচনা করলেও এর বাইরে তিনি তেমন কিছু করেননি।

ডানপন্থীরা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে?

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, ইতালিতে যখন ১৯৪৮ সালের পর থেকে একেকটা সরকারের গড় আয়ু মাত্র ১৪ মাস, সেখানে ডানপন্থী কোয়ালিশনের প্রতিশ্রুত ৫ বছর উচ্চাকাংক্ষাই বটে। আর দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে নীতি নিয়ে কোয়ালিশনের সদস্য দলগুলির মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমাতে আগের সরকার ৪০ বিলিয়ন ইউরোর প্রণোদনা দিয়েছে। এখন মেলোনির শরীক দলের প্রধান বারলুসকোনি চাইছেন আরও ৩১ বিলিয়ন ইউরো ঋণ করে প্রতি মাসে ১ হাজার ইউরো পেনসনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ইতালির বর্তমান রাষ্ট্রীয় ঋণ ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ইউরো, যা কিনা দেশটার জিডিপির দেড় গুণ! এমতাবস্থায় উচ্চ সুদে ইতালি কতটা অর্থ ঋণ করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অপরদিকে মেলোনির উপদেষ্টারা বলছেন যে, তারা হয়তো দারিদ্র্য বিমোচনে অর্থায়ন কমিয়ে দিয়ে কর কমাবার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু মেলোনির শরীক দলগুলি যদি তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বেশি আগ্রহী হয়, তাহলে তার নীতি বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে না পারলে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোম্পানি এবং ৩ লক্ষ ৭০ হাজার কর্মসংস্থান ঝুঁকির মাঝে পড়বে।

ইউরোপে ডানপন্থী রাজনীতি কখনোই বন্ধ করা হয়নি। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা লিবারাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাঝেই তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে অভিবাসী সংকটের পর থেকে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থীদের উত্থান হয়েছে। যেকারণে ইতালির এই নির্বাচন পুরো ইউরোপের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে নাজি পার্টির সকল স্তম্ভ দূরীকরণের যে প্রচেষ্টা চলেছে, তা ইতালিতে হয়নি। কিন্তু তারা বলছে না যে, জার্মানিতে এতকিছু করার পরেও নব্য-নাজিরা এখনও সক্রিয় এবং উগ্র ডানপন্থী দল ‘এএফডি’ আইনগতভাবেই রাজনীতিতে রয়েছে। অপরদিকে ইতালিতে নব্য-ফ্যাসিস্ট দলের রাজনীতি করার ব্যাপারটা অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি যতটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছে, ইতালিতে সেটা তেমন বড় কোন বিষয় ছিল না কখনোই। মোটকথা ইতালিতে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি কোন না কোন ফর্ম্যাটে চলেছে। নব্য-ফ্যাসিস্টরা তাদের কথাগুলি পরিবর্তন করেছে। কিন্তু তাদের কথার কেন্দ্রে ছিল অভিবাসী নীতি; যেটাকে তারা ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যতার মাঝে সকল সমস্যার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মেলোনির সরকার কতদিন টিকবে সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের উপর এর বিরূপ প্রভাব যে বাড়বে, তা নিশ্চিত। আর ইউরোপের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে জার্মানির উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলি এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও অনুপ্রাণিত হবে। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থীদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ইইউএর কর্মসম্পাদনকে আরও চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলে দেবে। একেকটা দেশ যখন জাতীয় স্বার্থকে ইউরোপের উপরে স্থান দিচ্ছে, তখন ইইউএর অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সবচাইতে বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে জার্মানির রাজনৈতিক লক্ষ্য; যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে মিত্রশক্তিই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।



সূত্রঃ
‘Why Republicans are elated by ‘triumph’ of Italy’s Giorgia Meloni’ in Al-Jazeera, 27 September 2022
‘Italy’s right-wing winners inherit poison chalice’ in Reuters, 26 September 2022
‘How a party of neo-fascist roots won big in Italy’ in Associated Press, 26 September 2022
‘Lazio fans hang pro-Mussolini banner, make fascist salutes ahead of Liberation day’ in CNN, 24 April 2019
‘Why is Italy swinging to the far right?’ in BBC News, (https://www.youtube.com/watch?v=BNRQTSfAR1o)
‘How extremist is Italy's designated far-right government?’ in DW News, 27 September 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=4S89Iuz1I7E)

Wednesday 28 September 2022

ইরানে সহিংসতার ঝড়… শুধুই হিজাব বিতর্ক, না অন্য কিছু?

২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনেকদিন ধরেই নাজুক। পশ্চিমা অবরোধের কারণে ইরানে অনেক পণ্যই দুর্লভ। স্থবির অর্থনীতির কারণে বেকারত্ব পরিস্থিতি চরমে উঠেছে; দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে অনেকগুলি বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সরকার শক্তহাতে বিক্ষোভ দমন করেছে। অর্থাৎ জনগণের সমস্যাগুলির সমাধান হয়নি। মাহসা আমিনিই ইরানের জনগণের রাস্তায় বিক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়; হিজাব তো নয়ই।

মাহসা আমিনি নামে ইরানের ২২ বছর বয়সী এক মহিলা ইরানের ‘নৈতিক পুলিশ’এর হাতে গ্রেপ্তার হবার পর তাদের জিম্মায় থাকার সময় নিহত হওয়ায় সারা ইরান জুড়ে বিক্ষোভ চলছে। কমপক্ষে ৪১ জনের মৃত্যুর খবর ইরানের মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। যদিও অনেকেই এই সংখ্যাকে অনেক বেশি বলে বলছেন। পশ্চিমা মিডিয়াগুলি বলছে যে, আমিনি ‘সঠিক পোষাক’ না পড়ায় ইরানের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। অনেক প্রতিবেদনেই এখানে হিজাব পড়ার ব্যাপারটাকে তুলে আনা হয়। অর্থাৎ আমিনি হিজাব পড়ার সময় তার মাথার চুল কিছুটা বের হয়ে ছিল বলে পশ্চিমা মিডিয়ার খবরে বলা হয়; যা কিনা তার অপরাধ ছিল। কিন্তু অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ইরানের মহিলারা অনেকেই হিজাব পড়ার সময় চুল বের করে রাখেন; যেসব ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয় না। একারণে ইরানের এই বিক্ষোভ কি আসলে হিজাব নিয়ে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখানে রাজনৈতিক ইস্যুগুলিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকেই।

২০১৮ সাল থেকে ইরানের মহিলারা স্টেডিয়ামে খেলা উপভোগ করতে পারছে বলে বলছে পশ্চিমা বার্তা সংস্থাগুলি। সেবছরের জুন মাসে স্পেনের সাথে ফুটবল খেলা উপভোগ করতে তেহরানের আজাদি স্টেডিয়ামে ৪ হাজার মহিলাকে ঢুকতে দেয়া হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে মহিলারা স্টেডিয়ামে খেলা উপভোগ করছেন; যেখানে নিজেদেরকে কঠোরভাবে ঢেকে চলার নিয়ম বেশ খানিকটাই উপেক্ষিত। মাত্র কিছুদিন আগেও ২৫শে অগাস্ট ‘সিএনএন’এর খবরে বলা হয় যে, তেহরানের স্টেডিয়ামে শ’পাঁচেক মহিলা তেহরানের ‘এস্তেঘলাল এফসি’র খেলা দেখার জন্যে স্টেডিয়ামে গিয়েছেন। স্টেডিয়ামে মহিলা দর্শকদের ছবিগুলিই বলে দেয় যে, ইরানে হিজাবের নিয়ম ততটা কঠোর নয়, যতটা কঠোর বলে পশ্চিমা মিডিয়া আমিনির হত্যাকান্ডের পর প্রচার করেছে।

২০২২এর ফেব্রুয়ারি মাসে তেহরানে ভারতীয় দূতাবাসের বাইরে স্বল্প কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্লাকার্ড হাতে ভারতের কর্ণাটকে মহিলাদের হিজাব পড়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। তারা বলে যে, হিজাব পড়তে না দেয়াটা মানুষের মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক এবং একইসাথে তা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপ্রসূত। এই প্রতিবাদের খবরটা ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘ফারস নিউজ’ এবং ‘প্রেস টিভি’তে প্রচার করা হয়। প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিবিদ ভিভেক কাটজু ‘ফার্স্টপোস্ট’ পত্রিকার এক লেখায় ইরানের সরকারের সমালোচনা করে বলছেন যে, খরবটা যখন ইরানের সরকারি মিডিয়াই প্রচার করেছে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, এই প্রতিবাদের পিছনে সরকারের সমর্থন ছিল। ইরান সরকার ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কথা বলছে এই বলে যে, হিজাব পড়াটা হলো একজন মহিলার পোষাক পড়ার স্বাধীনতার অংশ। অথচ নিজেদের দেশে হিজাব না পড়ার জন্যে অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে; প্রতিবাদ করলে মারাত্মক পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। ভিভেক কাটজু প্রকৃতপক্ষে বলছেন যে, ধর্মীয় কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক কারণে ইরান সরকার কর্ণাটকের হিজাব ইস্যুতে কথা বলেছে। ঠিক একই ব্যাপারটা ইরানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ হিজাব পড়তে বাধ্য করার ব্যাপারটা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার একটা অংশ।

ভারতীয় কলামিস্ট প্রাভীন স্বামী ‘দ্যা প্রিন্ট’ পত্রিকার এক লেখায় ইরানের গত এক’শ বছরের ইতিহাসে মহিলাদের অধিকার নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। পশ্চিমা ঘেঁষা রাজ পরিবারের সময় ইরানের মহিলাদের হিজাব পড়ার উপর বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়। এমনকি সরকার মহিলাদেরকে হিজাব ছেড়ে দিতে প্রণোদনা দেয়। রাজ পরিবারের মহিলারাও এক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়েছেন। সরকার বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো; যেখানে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে বলা হতো, তারা যেন তাদের স্ত্রীদেরকে সেখানে নিয়ে আসে। কিন্তু আমলাদের মাঝে অনেকেই নিজেদের স্ত্রীদেরকে নিয়ে আসতে চাইতেন না; বরং কিছু মহিলা স্বল্প সময়ের জন্যে এই আমলাদের জন্যে স্ত্রীর ভূমিকা নিতেন। অর্থাৎ আমলারা ভাড়া খাটানো স্ত্রী নিয়ে পার্টিতে আসতেন। অনেক মহিলাই হিজাব ছেড়ে দেননি। তারা হিজাব ছেড়ে দেয়াকে কাপড় খুলে উলঙ্গ হবার সাথে তুলনা করতেন। তবে সেই হিজাব পড়া মহিলাদের মাঝে অনেকেই রাজ পরিবারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বড়সড় প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রাভীন স্বামী বলছেন যে, এখন ইরানে ইসলামি গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে; অথচ সেই রাজ পরিবারের অত্যাচারের মতোই মহিলাদেরকে আবারও প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। হিজাব পড়তে বাধ্য করুক, আর না করুক, ইরানের মহিলারা সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

 
২৫শে অগাস্ট ২০২২। তেহরানের স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা উপভোগ করছেন ইরানের মহিলারা। স্টেডিয়ামে মহিলা দর্শকদের ছবিগুলিই বলে দেয় যে, ইরানে হিজাবের নিয়ম ততটা কঠোর নয়, যতটা কঠোর বলে পশ্চিমা মিডিয়া আমিনির হত্যাকান্ডের পর প্রচার করেছে। জনগণকে ইসলামের সংস্কৃতিতে শিক্ষিত করতে ব্যর্থ সরকার যখন জোরপূর্বক হিজাব পড়তে বাধ্য করছে, তখনই মূল সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। যখন ইরানের বহু মহিলাই রস্তায়, এমনি স্টেডিয়ামে হিজাবের নিয়মনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তখন আমিনির বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সরকারের অনেকগুলি ব্যর্থতার মাঝে একটা হয়ে দেখা দিয়েছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি-জিরো মিডিয়া’র এক লেখায় ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্ববিরোধী দিকগুলিকে তুলে ধরা হয়। প্রথমতঃ ইরান একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; যার গণতান্ত্রিক কর্মকান্ড আবার ধর্মীয় নীতিনির্ধারকেরা নিয়ন্ত্রণ করেন। এই নীতিনির্ধারকেরা, যারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন, তারাই ঠিক করে দেন যে, কারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। এই ব্যবস্থার মাঝেই ইরানের নির্বাচনগুলি বেশ ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়; যা কিনা আশেপাশের আরব দেশগুলিতে কখনোই দেখা যায়না। দ্বিতীয়তঃ ইরানের সরকার বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভকে কঠোর হস্তে দমন করেছে। কিন্তু এরপরও দেশটাতে বড় আকারের বিক্ষোভ প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইরান সরকার মহিলাদের কাপড়ের ব্যাপারে বিভিন্ন আইনী নোটিশ দিচ্ছে। অথচ একইসাথে মহিলারা রাস্তায় এবং অনলাইনে এই আইনগুলির বিরুদ্ধে কথা বলছে। তৃতীয়তঃ ইরানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা বড় অংশ হলো পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে কথা বলা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার যখন ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন, তখন ইরান ইউরোপিয় দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে অগ্রগামী হয়; যারা কিনা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল।

সৌদি সাংবাদিক আমাল আব্দুলআজিজ আল-হাজ্জানি ‘আশরাক আল-আওসাত’ পত্রিকার এক লেখায় মানবাধিকারের ব্যাপারে শুধু ইরানের সরকার নয়, আরব এবং পশ্চিমা সরকারগুলিরও সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন করছেন যে, যদি ইরানের মতো এমন ঘটনা সৌদি আরবে ঘটতো, তাহলে পশ্চিমা মিডিয়া সেটা কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতো? পশ্চিমা মিডিয়া সর্বদাই একেকটা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে একেকভাবে কভারেজ দিয়েছে। আর পশ্চিমা দেশগুলি যখন ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করছে, তখন তারা একইসাথে ইরানের সাথে জেনেভাতে আলোচনায় বসছে, যাতে করে ইরান সরকারের উপর থেকে অবরোধ উঠে যেতে পারে। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হলেও ইরান জানে যে, সেই নিন্দার প্রকৃতপক্ষে কোন মূল্য নেই। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আদর্শ বলে কোনকিছু নেই; রয়েছে শুধুই স্বার্থ।

ইরান বলছে যে, ইরানের এই সহিংসতা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনেই হচ্ছে। এর পিছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে; কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরাসরিই বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দিয়েছে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, এই বিক্ষোভ জনগণ করছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে। ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনেকদিন ধরেই নাজুক। পশ্চিমা অবরোধের কারণে ইরানে অনেক পণ্যই দুর্লভ। স্থবির অর্থনীতির কারণে বেকারত্ব পরিস্থিতি চরমে উঠেছে; দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে অনেকগুলি বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সরকার শক্তহাতে বিক্ষোভ দমন করেছে। অর্থাৎ জনগণের সমস্যাগুলির সমাধান হয়নি। মাহসা আমিনিই ইরানের জনগণের রাস্তায় বিক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়; হিজাব তো নয়ই। জনগণকে ইসলামের সংস্কৃতিতে শিক্ষিত করতে ব্যর্থ সরকার যখন জোরপূর্বক হিজাব পড়তে বাধ্য করছে, তখনই মূল সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। যখন ইরানের বহু মহিলাই রাস্তায়, এমনকি স্টেডিয়ামে হিজাবের নিয়মনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তখন আমিনির বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সরকারের অনেকগুলি ব্যর্থতার মাঝে একটা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের জন্যে পশ্চিমাদের মৌখিক সমর্থন একদিকে যেমন ইরানের সরকারের কর্মকান্ডকে বৈধতা দেবে, অন্যদিকে আগেরগুলির মতোই এবারের বিক্ষোভকেও অমানবিকভাবে দমনে প্রণোদনা দেবে।

Tuesday 27 September 2022

মধ্য এশিয়ার দুই দেশ তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের সীমান্ত সংঘর্ষের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
সোভিয়েতদের তৈরি করা মধ্য এশিয়ার কৃত্রিম সীমানাগুলিকে এখন বাইরের শক্তিরা ব্যবহার করছে। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ পানি উৎস ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের হাতে থাকায় এবং মধ্য এশিয়ার সাথে চীনের পশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত উইঘুর প্রদেশের যোগাযোগের মূল পথ কিরগিজস্তানের মাঝ দিয়ে বা এর পাশ দিয়ে যাওয়ায় অত্র অঞ্চলে সকলেরই আগ্রহ বেশি।

মধ্য এশিয়ার সমরখন্দে যখন আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংস্থা ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’র শীর্ষ বৈঠক চলছিল, তখন দুই সদস্য রাষ্ট্র তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের সীমান্তে মারাত্মক সংঘর্ষে ১’শ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। অনেকেই বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল দুই দেশের মাঝে সংঘর্ষের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে চলা এই সংঘর্ষে উভয় দেশই শুরুর জন্যে একে অপরকে দায়ী করেছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, দুই দেশের ৯’শ ৭০ কিঃমিঃ সীমানার মাঝে প্রায় অর্ধেকই এখনও নির্দিষ্ট করা হয়নি। ২০২১এর এপ্রিল মাসেও এরকম সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জনের মৃত্যু হয়। ২৫শে সেপ্টেম্বর তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের মাঝে এক সমঝোতা হয়; যা মোতাবেক উভয় দেশ সংঘর্ষ এলাকা থেকে নিজেদের ৪টা করে সীমানা চৌকি খালি করে ফেলবে। কিরগিজ জাতীয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কমিটির প্রধান কামচিবেক তাশিইয়েভ সাংবাদিকদের বলেন যে, এর ফলে সংঘর্ষ এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া ১ লক্ষ ৪০ হাজার কিরগিজ তাদের নিজেদের ঘরবাড়িতে ফেরত আসতে পারবে।

‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সমঝোতার পর কিরগিজ জনগণের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের অনেকেই বলছেন যে, কিরগিজ সরকার তাজিকিস্তানের ভয় দেখানোর মুখে নতি স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের কথায়, কিরগিজ সেনারা যদি ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যায়, তাহলে কিরগিজ জনগণ সেখানে নিজেদের বসতভিটায় ফেরত যেতে ভয় পাবে। আর এই সুযোগে তাজিকরা সেই এলাকাগুলি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। সমঝোতার পরদিন ২৬শে সেপ্টেম্বর কিরগিজস্তানের দক্ষিণের বাতকেন শহরে সরকারি অফিসের কাছে অনেকে জড়ো হয়ে এব্যাপারে প্রতিবাদ করে। কিরগিজ সরকার এর জবাবে বলে যে, সীমান্তের ব্যাপারে সমঝোতা একটা অস্থায়ী সমাধান। আর কিরগিজ নিরাপত্তা বাহিনী ঐ এলাকায় টহল অব্যাহত রাখবে।

‘ইউরোশিয়ানেট’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, দুই দেশের সংঘর্ষ নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে চলা এই সংঘর্ষে ক্রমান্বয়ে বড় আকারের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আর্টিলারি, মেশিন গান, সাঁজোয়া যান, এমনকি এটাক ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, এভাবে সীমান্ত সংঘর্ষ বাড়তে থাকলে দুই দেশের মাঝে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। সংঘর্ষ শুরুর মাত্র একদিন আগেই কিরগিজ প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ তুরস্কের কাছ থেকে কেনা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন পরিচালনা করার জন্যে ঘাঁটি উদ্ভোধন করেন এবং সীমান্ত রক্ষায় এগুলির গুরুত্বকে তুলে ধরেন। তাজিক পক্ষ ইতোমধ্যেই কিরগিজদের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করার অভিযোগ করেছে। গত বছরের অক্টোবরে কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন যে, তার দেশ তুরস্ক থেকে ড্রোন কিনছে।

 
সংঘর্ষ শুরুর মাত্র একদিন আগেই কিরগিজ প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ তুরস্কের কাছ থেকে কেনা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন পরিচালনা করার জন্যে ঘাঁটি উদ্ভোধন করেন। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কসহ অন্যান্য শক্তিদেরকে রুশ প্রভাব প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা দেবে। তাজিকিস্তানের সাথে সংঘর্ষে কিরগিজস্তানের তুর্কি ড্রোনের সাফল্য এই অঞ্চলের দ্বন্দ্বকে শান্তিপূর্ণ পথ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। একইসাথে কিরগিজস্তানের জন্যে তুর্কি সহায়তাকে ব্যালান্স করতে তাজিকিস্তান ইরানের মুখাপেক্ষি হতে পারে; যা কিনা মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের সাথে ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আরও বৃদ্ধি করবে।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক পত্রিকা ‘আল মনিটর’এর সাথে সাক্ষাতে মস্কো ভিত্তিক তুর্কি বিশ্লেষক কেরিম হাস বলছেন যে, ড্রোনের কারণে শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার চেষ্টাটা কমে যেতে পারে। তবে এর মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার রুশ ছায়ায় থাকা অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। কিরগিজস্তানের সাথে তাজিকিস্তান এতকাল সামরিক দিক থেকে এগিয়ে ছিল। কিন্তু এই ড্রোনের কারণে সেখানে ব্যালান্সে পরিবর্তন এসেছে। এছাড়াও অনেকেই এখন মনে করতে শুরু করেছে যে, কিরগিজস্তানকে তুরস্ক সহায়তা দিচ্ছে। তিনি বলছেন যে, এই সংঘর্ষের ফলে তাজিকিস্তান এখন তুরস্ক, ইরান বা রাশিয়ার কাছে ড্রোন চাইতে পারে। ইরান ড্রোন বিক্রি করলে ইরানের প্রভাব বাড়বে; তুরস্ক বিক্রি করলে কিরগিজস্তানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক খারাপ হবে।

দ্বন্দ্বের উৎস হিসেবে পানির ইস্যুকে উল্লেখ করা হচ্ছে। বৃষ্টিহীন মধ্য এশিয়ায় নদীর পানির বন্টন অতি সংবেদনশীল ইস্যু। অত্র অঞ্চলের বেশিরভাগ নদীর উৎপত্তিস্থল আলতায় এবং তিয়েনশান পর্বতে; যার বেশিরভাগটাই সোভিয়েত আমলের সীমানা নির্ধারণের ফলশ্রুতিতে কিরগিজস্তানে। একারণে ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও পানির দিক থেকে কিরগিজস্তান সবচাইতে ধনী। তাজিকিস্তানের দুই প্রধান নদী ভাখশ এবং শির দরিয়ার উৎপত্তি কিরগিজস্তানে। বিশেষ করে ভাখশ নদীর পানির উপর তাজিকিস্তানের বিদ্যুৎ, এলুমিনিয়াম এবং তূলার উৎপাদন নির্ভরশীল। সংঘর্ষে জড়ানো তাজিকিস্তানের সুঘদ রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ২৭ লক্ষ; অপরদিকে কিরগিজস্তানের বাতকেন অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ। সুঘদ রাজ্যের পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো কিরগিজস্তান থেকে আসা তিনটা নদী আকসু, রুসলো খোজা বকিরগন এবং ইসফারা। এই নদীর অববাহিকাগুলিতেই মূল সংঘর্ষ হয়েছে।

তুর্কি সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে উজবেক বিশ্লেষক ওতাবেক ওমোনকুলভ বলছেন যে, মধ্য এশিয়ার প্রধান সমস্যা এর সীমানাগুলি; যেগুলি সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল। পশ্চিমা ঔপনিবেশিকরা যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগাভাগি করেছিল, ঠিক সেভাবেই সোভিয়েতরা এই অঞ্চলকে ভাগ করেছিল যাতে এগুলিকে আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তারা এমনভাবে এই এলাকার সীমানাগুলি তৈরি করেছিল, যাতে করে এই রাষ্ট্রগুলি একদিন স্বাধীন হলে এরা একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়িত হবে। কিরগিজস্তানের জনগণ বেশিরভাগ তুর্কি জাতির; অপরদিকে তাজিকিস্তানের জনগণের বেশিরভাগ হলো পারসিক। তবে এই দেশগুলির সীমানায় বসবাস করা জনগণ তাজিক, কিরগিজ এবং উজবেক। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো কামাল আলম বলছেন যে, অনেকেরই ধারণা এই সংঘর্ষে পশ্চিমাদের স্বার্থ রয়েছে। রাশিয়ার প্রভাবে থাকা অঞ্চলে সমস্যা তৈরি হলে তা রাশিয়ার জন্যে চিন্তার। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এখানে না জড়ালেও মধ্য এশিয়াতে রাশিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নেয়াটা একটা কৌশল।

সোভিয়েতদের তৈরি করা মধ্য এশিয়ার কৃত্রিম সীমানাগুলিকে এখন বাইরের শক্তিরা ব্যবহার করছে। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ পানি উৎস ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের হাতে থাকায় এবং মধ্য এশিয়ার সাথে চীনের পশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত উইঘুর প্রদেশের যোগাযোগের মূল পথ কিরগিজস্তানের মাঝ দিয়ে বা এর পাশ দিয়ে যাওয়ায় অত্র অঞ্চলে সকলেরই আগ্রহ বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কসহ অন্যান্য শক্তিদেরকে রুশ প্রভাব প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা দেবে। তাজিকিস্তানের সাথে সংঘর্ষে কিরগিজস্তানের তুর্কি ড্রোনের সাফল্য এই অঞ্চলের দ্বন্দ্বকে শান্তিপূর্ণ পথ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। একইসাথে কিরগিজস্তানের জন্যে তুর্কি সহায়তাকে ব্যালান্স করতে তাজিকিস্তান ইরানের মুখাপেক্ষি হতে পারে; যা কিনা মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের সাথে ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আরও বৃদ্ধি করবে।

Monday 26 September 2022

ইউক্রেনকে ঘিরে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা কতটুকু?

২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
পুতিন হয়তো মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয় বন্ধুরা, বিশেষ করে জার্মানরা হয়তো পুতিনের হুমকিকে ভিন্ন চোখে দেখতে পারে; যদিও জার্মানরা আপাততঃ কোন দুর্বলতা দেখায়নি। তবে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, মার্কিনীরা পুতিনের পারমাণবিক হুমকিকে সত্যিকারের বুঝেও উপেক্ষা করতে প্রস্তুত; যা কিনা ইউরোপে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

গর ২১শে সেপ্টেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন ভাষণে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে আংশিক ‘মোবিলাইজেশন’এর ঘোষণা দেন; যার অর্থ হলো, কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের মাঝ থেকে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক রিক্রুটিংএর ব্যবস্থা করা। তার দ্বিতীয় ঘোষণাটা ছিল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশদের দখল করা এলাকায় গণভোটের আয়োজন করা। আর তৃতীয় ঘোষণাটা ছিল, রাশিয়া তার নিজস্ব ভূমি রক্ষায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। ভ্লাদিমির পুতিনের এই ঘোষণাগুলিকে সকলেই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সবচাইতে মারাত্মক অবস্থা বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যদিও পুতিন বলেছেন যে, ‘মোবিলাইজেশন’এর মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে পূর্বে সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রায় ৩ লক্ষ নাগরিককে ডাকা হবে, তথাপি সংখ্যাটা এর চাইতেও অনেক বাড়তে পারে। এই ঘোষণার পর রাশিয়ার ৩০টা শহরে বিক্ষোভ হয়েছে; যেখানে শতশত মানুষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। দ্বিতীয় ঘোষণায় দখলকৃত এলাকায় গণভোটের কথা বলা হলেও মূলতঃ সেই অঞ্চলগুলিকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত এটা। তৃতীয় ঘোষণায় পুতিন বলেছেন যে, দখলকৃত এলাকাগুলি যদি রাশিয়ার অংশ হয়ে যায়, তাহলে রাশিয়া সেই অঞ্চলগুলিকে রক্ষায় তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে প্রস্তুত থাকবে। রাশিয়ার কাছে বহু কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেও পশ্চিমাদের মূল ভয় হলো রাশিয়া ছোট আকারের ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেন এবং তাদের পশ্চিমা বন্ধুদেরকে মনস্তাত্বিকভাবে দুর্বল করে ফেলে তাদেরকে যুদ্ধ বন্ধের জন্যে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারে। পুতিনের এই হুমকি কোন ফাঁকা হুমকি নয়। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের আহ্বান করে যে, তারা যেন রাশিয়াকে বার্তা দেয় যে, পশ্চিমারা রাশিয়ার পারমাণবিক ‘ব্ল্যাকমেইল’এ পিছু হটবে না এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে পশ্চিমারা মারাত্মক জবাব দেবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পীস’এর সিনিয়র ফেলো আলেক্সান্ডার বাউনভ এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, রুশ কর্মকর্তারা সবসময়েই বলেছেন যে, তারা ইউক্রেনে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। এটা তারা বলতে পারেন, কারণ ইউক্রেনে তাদের লক্ষ্য কি, তা তারা কখনোই পরিষ্কার করে বলেননি। ফলে তারা প্রথমে পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর লক্ষ্যকে শুধুমাত্র ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মাঝে সীমাবদ্ধ করতে পারতেন। সেটাও না হলে ডোনেতস্ক ও লুহানস্ক এলাকার নিয়ন্ত্রণের মাঝে সীমাবদ্ধ করতে পারতেন। সেটাও না হলে যতটুকু পাওয়া গেছে, সেগুলিকে রুশ অঞ্চল ঘোষণা দিয়ে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে পারতেন। মূলতঃ কত ভূমি রাশিয়া নেবে সেটা গুরুত্বপূর্ন নয়; বরং রাশিয়া যা বলেছে, সেটা করবে, সেটা প্রমাণ করা। যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার অর্জনগুলি প্রায় শূণ্য হয়ে গিয়েছে, তাই পুতিন আবারও হিসেবটা পরিবর্তন করেছেন; যাতে করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেখানে রয়েছে, সেখানেই থেমে যায়। যদি সেই হুমকিতেও কাজ না হয়, তাহলে পুতিনকে আবারও প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি মিথ্যা বলছেন না। আর তখন তার হুমকিগুলিকে বিশ্বাস করাতে আরও মারাত্মক কাজ করতে হবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ১০ জন বিশ্লেষক আলাদাভাবে তাদের বিশ্লেষণে বলেছেন যে, ভ্লাদিমির পুতিন এখন ইউক্রেনে যথেষ্ট খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন বলেই তিনি আংশিক ‘মোবিলাইজেশন’এর ঘোষণা দিয়েছেন এবং একইসাথে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলকে রুশ এলাকা বলে ঘোষণা দিয়ে সেই এলাকাকে পারমাণবিক অস্ত্রের ছত্রছায়ায় আনার কথা বলেছেন। পুতিন যদি যুদ্ধে হেরে যাবার মতো অবস্থায় পড়ে যান, তাহলে তিনি ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। কাউন্সিলের বিশ্লেষকেরা সর্বসম্মতিক্রমে বলেছেন যে, রুশদের এই হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা যেন কোন অবস্থাতেই ছাড় না দেয়। পুতিন হয়তো মনে করছেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াবার জন্যে পশ্চিমারা নিশ্চয়ই রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাতে যাবে না। কিন্তু পশ্চিমাদেরকে বুঝতে হবে যে, রাশিয়ার দাবির সামনে মাথা নত করার অর্থ হলো অন্য রাষ্ট্রের জন্যে একটা উদাহরণ তৈরি করে দেয়া, যে জোর করে একটা রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তন করা যায়। কাজেই পশ্চিমাদের উচিৎ হবে পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিকে আমলে না নিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখা। তারা আরও বলছেন যে, যদি রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ পরিস্থিতি বিবেচনা করে রুশদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী বাহিনীর উপরে প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মারাত্মক হামলা করা অথবা রুশদের আক্রমণের একইরূপ জবাব প্রদান করা। মোটকথা, কাউন্সিলের সকলেই রুশদের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিকে এড়িয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা দানের কথা বলেছেন; এবং সেটা তারা বলেছেন এই কারণে নয় যে, পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন না; বরং তারা পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার সত্ত্বেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবার কথা বলেছেন!

আলেক্সান্ডার বাউনভ বলছেন যে, যুদ্ধের সাত মাসের মাথায় খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের পিছু হটার কারণে রাশিয়াতে ডানপন্থী গ্রুপগুলি, যারা ‘মোবিলাইজেশন’সহ আরও কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে ছিল, তাদের কথাই পুতিন শুনতে বাধ্য হয়েছেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, কোণঠাসা হয়ে যাবার কারণে পুতিন আগের চাইতে আরও মারাত্মক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে কঠিন পরিণতি হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির মুখে মার্কিনীরা কেউই পিছু হটার পক্ষপাতি না থাকলেও তাদের ইউরোপিয় বন্ধুরা কি একই কথাই বলবে? জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ পুতিনের ভাষণকে চাপের মুখে পড়ে বক্তব্য বলে আখ্যা দিলেও মার্কিন সেনাবাহিনীর ‘ওয়ার কলেজ’এর প্রফেসর জন ডেনি ‘পলিটিকো’র এক লেখায় ইউক্রেনকে যথেষ্ট সহায়তা না দেয়ার জন্যে জার্মানি ও ফ্রান্সের সমালোচনা করেন; এবং এই দেশগুলির নীতি সহজে পরিবর্তিত হবে না বলেও মন্তব্য করেন। পুতিন হয়তো মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয় বন্ধুরা, বিশেষ করে জার্মানরা হয়তো পুতিনের হুমকিকে ভিন্ন চোখে দেখতে পারে; যদিও জার্মানরা আপাততঃ কোন দুর্বলতা দেখায়নি। তবে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, মার্কিনীরা পুতিনের পারমাণবিক হুমকিকে সত্যিকারের বুঝেও উপেক্ষা করতে প্রস্তুত; যা কিনা ইউরোপে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

Sunday 25 September 2022

বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্ত উত্তেজনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

২৫শে সেপ্টেম্বর ২০২২

সেপ্টেম্বর ২০২২। বাংলাদেশের আকাশসীমানায় মিয়ানমারের হেলিকপ্টার। বাংলাদেশে অনেকে বলছেন যে, মিয়ানমার তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার দিক থেকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি সড়িয়ে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে দিতে চাইছে। তারা চাইছে বাংলাদেশ সামরিক দিক দিয়ে প্রত্যুত্তর দিক। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মিয়ানমারের এই ফাঁদে পা দেয়নি। একইসাথে মিয়ানমার চাইছে যে, বাংলাদেশে যে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফেরত যাওয়াটা যেন আরও দেরি করানো যায়।


সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের আরকান বা রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশের উপর নিয়মিতভাবে গোলাবারুদ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এতে কমপক্ষে একজন নিহত সহ আরও অনেকে হতাহত হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষের মাঝে মিয়ানমারের সামরিক বিমান বারংবার বাংলাদেশের আকাশসীমানা লংঘন করেছে। এই ঘটনাগুলির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চার সপ্তাহে মোট চারবার ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিয়াও মোয়িকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় অনেকেই বিকল্প খোঁজার পরামর্শ দিচ্ছেন। এই পরামর্শগুলির মূল কারণ হলো এর আগে মিয়ানমার কখনোই তাদের কথা রাখেনি। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে পালিয়া আসা ১১ লক্ষাধিক মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার শুধু কালক্ষেপণই করেছে। যদিও রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীই সেখানকার মুসলিম জনগণের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল, তথাপি ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের ওয়াশিংটন-ঘেঁষা গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু কি প্রায় নির্লজ্জ্বভাবেই মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বণ করেছিলেন। অর্থাৎ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং গণতান্ত্রিক নেতারা কেউই মুসলিম শরণার্থীদের নিতে রাজি হয়নি। এসব কারণে বাংলাদেশ সরকারও মিয়ানমারের সামরিক সরকার এবং গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অভিন্ন অনুভূতি দেখিয়েছে; যা কিনা পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধ ছিল।

বাংলাদেশ সরকার বারংবার বলেছে যে, তারা মিয়ানমারের সাথে কোন সংঘর্ষ চায় না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন যে, মিয়ানমারের ভেতরে সংঘর্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার; সেখানে তারা কিভাবে তাদের সমস্যার সমাধান করবে, তা তারাই ঠিক করুক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, মিয়ানমার তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার দিক থেকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি সড়িয়ে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে দিতে চাইছে। তারা চাইছে বাংলাদেশ সামরিক দিক দিয়ে প্রত্যুত্তর দিক। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মিয়ানমারের এই ফাঁদে পা দেয়নি। তিনি বলেন যে, একইসাথে মিয়ানমার চাইছে যে, বাংলাদেশে যে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফেরত যাওয়াটা যেন আরও দেরি করানো যায়। বাংলাদেশি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পীস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ’এর সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। এই মুহুর্তে সামরিক সমাধান কাম্য নয়। ২১শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএ মোমেন বলেন যে, মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে যাবার কোন ইচ্ছাই বাংলাদেশের নেই; আর বাংলাদেশ চাইছে ব্যাপারটা কূটনৈতিকভাবেই সমাধান হয়ে যাক। তবে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান অবস্থানের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে অনেকেই ভিন্ন সমাধান আশা করছেন।

মিয়ানমারের সাথে নীতির কি পরিবর্তন দরকার?

সিঙ্গাপুরের ‘দ্যা স্ট্রেইটস টাইমস’ পত্রিকার এক লেখায় ‘দ্যা ডেইলি স্টার’এর কলামিস্ট তাসনিম তাইয়েব বলছেন যে, মিয়ানমারের সাথে বর্তমান কূটনীতি যেহেতু সফল হচ্ছে না, তাই নীতির পরিবর্তন জরুরি। তিনি বলেন যে, মিয়ানমার বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগ পাচ্ছে এবং মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কোন নির্ভরশীলতা নেই, যা বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় ব্যবহার করতে পারে। কাজেই এখন সময় এসেছে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের নীতিকে নতুন করে দেখার। তিনি এই নীতি কেমন হতে পারে তার ব্যাপারে কিছু ধারণা দিয়েছেন। যেমন, ভারত এবং চীনের সাথে একটা ব্যালান্সিং নীতি রক্ষা করে চলার পক্ষপাতি তিনি। একইসাথে তিনি মিয়ানমার থেকে আসা মুসলিম শরণার্থীদেরকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলির উপর নির্ভর করার নীতিতে বিশ্বাসী; যদিও তিনি বলছেন যে, মিয়ানমারে কোন গণতান্ত্রিক সরকার না থাকার ফলে তারা নিজেদের জনগণের কাছে যেমন জবাবদিহিতা করতে বাধ্য নয়, পশ্চিমা দেশগুলির কাছেও জবাবদিহিতা করতে বাধ্য নয়। এছাড়াও তিনি বলছেন যে, মিয়ানমারে জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর ব্যাপক বিনিয়োগ করছে; যেই দেশগুলি প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কাছের বন্ধু। তিনি শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে জাতিসংঘের ব্যর্থতা নিয়েও কথা বলেন। এবং একইসাথে সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতার ব্যাপারেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে নিজেদের কূটনীতি, জাতিসংঘের ব্যর্থতা এবং পশ্চিমা বন্ধুদের মিয়ানমারে ব্যাপক বিনিয়োগের মাঝে বাংলাদেশ নতুন করে আর কি করতে পারে, তা তিনি তেমন একটা খোলামেলাভাবে বলেননি।

মিয়ানমার সীমান্তে সতর্ক বিজিবি। একদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তাভাবনার অংশ হিসেবে অনেকে চাইছেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সরাসরি যোগ দেয়া; বিশেষ করে আকাশসীমানা লংঘনের জের ধরে মিয়ানমারের বিমান ভূপাতিত করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘাতে যুক্ত হওয়া। এতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদী ফাটল দেখা দেবে, তেমনি যুদ্ধ চালিয়ে নিতে বাংলাদেশ পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন অস্ত্রের উপরে নির্ভরশীল হবে।

তাসনিম তাইয়েব যা বলেননি, তা সরাসরিই বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘হারভার্ড ইউনিভার্সিটি’র ‘জনস হপকিন্স স্কুল অব এডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর আনু আনোয়ার। ‘ঢাকা ট্রিবিউন’এর এক লেখায় তিনি অভিযোগ করে বলছেন যে, বাংলাদেশ এতদিন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে বলেনি যে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষানীতি কি হবে। তিনি বাংলাদেশের সকলের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রাখার নীতির সমালোচনা করেন। ভারত যেহেতু পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, তাই ভারতকে ব্যালান্স করার জন্যে বাংলাদেশের কাছে ডিটারেন্ট তৈরি করা ছাড়া আর কোন পদ্ধতি আছে কিনা, তা তিনি প্রশ্ন করেন। তবে তিনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ডিটারেন্ট গড়ার ব্যাপারে মত দেন। তিনি ২০১৫ সালে সিরিয়ার সাথে সীমানায় তুর্কি ফাইটার বিমানের রুশ বোমারু বিমান আকাশ থেকে গুলি করে ভূপাতিত করার উদাহরণ টেনে বলেন যে, বাংলাদেশেরও এধরণের নীতিতে যাওয়া উচিৎ। মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশের সামরিক শক্তির ঘাটতি উল্লেখ করে তিনি প্রতিরক্ষানীতি পরিবর্তনের আহ্বান জানান।

তাসনিম তাইয়েব এবং আনু আনোয়ারের কথায় যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, অনেকেই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতির পরিবর্তন চাইছেন; বিশেষ করে সকলের সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারটা তারা প্রশ্ন করছেন। একইসাথে তারা কেউ কেউ মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতির আহ্বানও জানাচ্ছেন। তবে এই ঘরানার মতামতের বিপরীতেও মতামত রয়েছে।

মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধের ফাঁদ?

অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা ‘ইন্ডেপেনডেন্ট অস্ট্রেলিয়া’র এক বিশ্লেষণে কামাল উদ্দিন মজুমদার বলছেন যে, বাংলাদেশের উচিৎ কোন সামরিক দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করা। মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রতিনিধি লুইজ নগুয়েনএর বরাত দিয়ে তিনি বলছেন যে, মিয়ানমারের সীমানায় যেহেতু কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না, তাই সেখানকার পরিস্থিতি পুরোপুরিভাবে বোঝা বেশ কঠিন। একারণে তিনি দুই দেশকে শান্তি বজায় রাখার পরামর্শ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ বলছেন যে, বাংলাদেশের উচিৎ আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের এই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক কর্মকান্ড চালানো। তিনি বিশেষ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এই ব্যাপারটা তোলার আহ্বান জানান। একইসাথে তিনি সামরিক-কূটনৈতিক কর্মকান্ড চালাবার পরামর্শ দেন।

প্রফেসর ইমতিয়াজের কথাগুলিই প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাদেশের সামরিক-কূটনৈতিক কর্মকান্ডে। ২১শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা সেনানিবাসের এক অনুষ্ঠানে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন যে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলাবর্ষণ বন্ধ না করে, তাহলে তার বাহিনীর সদস্যরা উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে তিনি মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলাবর্ষণ এবং বাংলাদেশের আকাশসীমানা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

কামাল মজুমদার বলছেন যে, মিয়ানমার হয়তো এমন একটা পরিস্থিতির তৈরি করতে চাইছে, যাতে করে আরাকানে থাকা বাকি মুসলিমরাও বাংলাদেশে চলে আসে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত শরণার্থীরাদের আরকানে প্রত্যাবাসনও যেন পুরোপুরিভাবে আটকে যায়। এরকম একটা উদ্দেশ্য নিয়েই মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধ শুরু করতে চাইছে। তিনি বলছেন যে, যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্যে একটা ফাঁদ হয়ে দেখা দেবে। বর্তমানে মিয়ানমার নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করতে পারছে, কারণ এতকাল মিয়ানমারকে কেউ শাস্তি দেয়নি।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কক্সবাজারে বিশাল শরণার্থী শিবির। ব্রিটিশ কমনওয়েলথপন্থী চিন্তাভাবনার অংশ হিসেবে অনেকেই যেকোন পদ্ধতিতে কৌশলগত জোট এড়িয়ে চলতে চাইছেন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করাটা সমীচিন হবে না বলে তারা বলছেন যে, মিয়ানমারে নিজস্ব যেকোন সংঘাতে জড়ানো হবে একটা ভূরাজনৈতিক ফাঁদ। তবে তাদের সমাধানের মাঝে উদ্বাস্তু সমাধানের কোন সুরাহা নেই। তারা শরণার্থীদের ব্যাপারে পশ্চিমাদের সহায়তা চাওয়া এবং দন্তহীন জাতিসংঘের কাছে ধর্না দেয়ার পক্ষপাতি।

হংকং ভিত্তিক পত্রিকা ‘এশিয়া টাইমস’এর এক লেখায় কানাডা কেন্দ্রিক গবেষক তিলোত্তমা রানী চারুলতা বলছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির আক্রমণ বৃদ্ধি পাবার সাথেসাথে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আক্রমণও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেসময়েই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলা নিক্ষেপ এবং আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে থাকে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে জানা যায় যে, আরাকানের প্রায় ৫২ শতাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির হাতে। একারণে সামনের দিনগুলিতে সীমানা লঙ্ঘনের ঘটনা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই সীমানায় বিজিবি এবং কোস্ট গার্ডের সদস্যদের সংখ্যা বাড়িয়েছে। তবে সীমান্তে সেনা মোতায়েন করাটা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বাংলাদেশ সরকারের ভিন্ন কৌশল অবলম্বনের পক্ষপাতি; যার মাঝে সাধারণ কূটনীতি ছাড়াও সামরিক কূটনীতিকে ব্যবহার করার কথাও বলা হচ্ছে। কারণ এই মহুর্তে বাংলাদেশের সামরিক এবং জাতীয় শক্তি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে দৃশ্যমান নয় বলেই তারা সীমানা অতিক্রম করার সাহস পাচ্ছে। তবে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের জড়ানো একেবারেই ঠিক হবে না বলে তিনি বলছেন। কারণ এতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মি, উভয়েরই লাভ হবে।

ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ভুললে চলবে না

মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত উত্তেজনা এমন সময়ে চলছে, যখন চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলির উত্তেজনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর থেকে রাশিয়ার সাথে চীনের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোপ্যাসিফিকের সকল দেশের উপর চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মাঝে কোন একটা পক্ষকে বেছে নিতে। অর্থাৎ প্রতিটা দেশের উপরেই যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত দিকনির্দেশনা নির্দিষ্ট করার জন্যে চাপ দিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পশ্চিম সীমানায় মিয়ানমার অতি গুরুত্বপূর্ণ দাবার গুটি। একদিকে চীন যেমন রাখাইন প্রদেশ থেকে সমুদ্রপথে তেল-গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত মালাক্কা প্রণালিকে বাইপাস করতে চাইছে, তেমনি চীনের পশ্চিম সীমান্তে মার্কিনপন্থী কোন সরকার যেন ক্ষমতা না নেয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে চাইছে। সেই হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা অং সান সু কিএর গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতা থেকে অপসারণ চীনের জন্যে সুবিধা বয়ে এনেছে। তবে রাখাইনে চীনের তেল-গ্যাসের পাইপলাইন বরাবর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সশস্ত্র কার্যকলাপ এবং এই বিদ্রোহীদের পশ্চিমা শক্তিদের প্রক্সি হয়ে কাজ করার সম্ভাবনা চীনকে বিচলিত রেখেছে। আর একইসাথে এই সংঘাতে আরও শরণার্থী বাংলাদেশের দিকে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হলে বাংলাদেশও চীনের বিরুদ্ধাবস্থান নিতে পশ্চিমাদের চাপের মাঝে পড়তে বাধ্য। স্বাভাবিকভাবেই আরাকান আর্মির আক্রমণ বৃদ্ধির অর্থই হবে বাংলাদেশের উপরে ভূরাজনৈতিক পক্ষাবলম্বনের চাপ সৃষ্টি হওয়া।

একদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তাভাবনার অংশ হিসেবে অনেকে চাইছেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সরাসরি যোগ দেয়া; বিশেষ করে আকাশসীমানা লংঘনের জের ধরে মিয়ানমারের বিমান ভূপাতিত করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘাতে যুক্ত হওয়া। এবং এর ফলাফল হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শত্রু আরাকান আর্মিকে সামরিক ও লজিস্টিক্যাল সহায়তা দিয়ে পুরোপুরিভাবে যুদ্ধে যোগদান করা। এতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদী ফাটল দেখা দেবে, তেমনি যুদ্ধ চালিয়ে নিতে বাংলাদেশ পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন অস্ত্রের উপরে নির্ভরশীল হবে। অপরদিকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথপন্থী চিন্তাভাবনার অংশ হিসেবে অনেকেই যেকোন পদ্ধতিতে কৌশলগত জোট এড়িয়ে চলতে চাইছেন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করাটা সমীচিন হবে না বলে তারা বলছেন যে, মিয়ানমারে নিজস্ব যেকোন সংঘাতে জড়ানো হবে একটা ভূরাজনৈতিক ফাঁদ। তবে তাদের সমাধানের মাঝে উদ্বাস্তু সমাধানের কোন সুরাহা নেই। তারা শরণার্থীদের ব্যাপারে পশ্চিমাদের সহায়তা চাওয়া এবং দন্তহীন জাতিসংঘের কাছে ধর্না দেয়ার পক্ষপাতি। অপরদিকে যারা মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধের পক্ষপাতি, তারা ধরেই নিচ্ছেন যে, শরণার্থী সমস্যার কোন সমাধান আর সম্ভব নয়। অর্থাৎ কোন পক্ষই উদ্বাস্তু সমাধানের সুরাহা চাইছে না। উল্টো উভয় পক্ষই শরণার্থীদের বাংলাদেশে রেখে বাংলাদেশের নীতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট।

অনেকেই আশা করেছিল যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দ্বন্দ্বের কথা তুলবেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। তিনি বাংলাদেশের মূল সমস্যাটাই তুলে ধরেছেন; যা হলো মিয়ানমারের মুসলিম শরণার্থীদের ফেরত যেতে না পারা এবং তাদের ফেরত যাওয়ায় অনিশ্চয়তা তৈরির জন্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সহিংসতার সৃষ্টি।

যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক 'এএইচ-৬৪ এপাচি' এটাক হেলিকপ্টার। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে চাইছে এবং দু'টা প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্যে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশে অনেকেই এই চুক্তিগুলির ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে। কারণ এই চুক্তিগুলি স্বাক্ষরের অর্থ হলো বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের মাঝে চলে যাবে এবং তখন যুক্তরাষ্ট্রের চীন ও রাশিয়া-বিরোধী জোটে অংশ নেয়া ছাড়া বাংলাদেশের সামনে কোন পদ্ধতিই থাকবে না। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অস্ত্র শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতাই তৈরি করে না, সেই দেশের পররাষ্ট্রনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে।


বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বাণিজ্যের প্রচেষ্টা

গত এপ্রিল মাসে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের ৮ম নিরাপত্তা সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র আবারও নতুন করে বাংলাদেশে অস্ত্র রপ্তানির প্রস্তাব নিয়ে আসে এবং একইসাথে দু’টা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যে বাংলাদেশের উপর যথারীতি চাপ প্রয়োগ করে। নিরাপত্তার দিক দিকে বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব যথেষ্ট। ‘প্রথম আলো’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সংলাপের মাঝে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থা ‘র‍্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন’এর উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ, বাংলাদেশের সামরিক সদস্যদের জন্যে মার্কিন প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশের সমুদ্র নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা, বেসামরিক নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা, শরণার্থী ইস্যু, ইত্যাদি বিষয়ে কথা হয়। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘আইপিএস’এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্র তার চাপ অব্যাহত রেখেছে। ‘আইপিএস’কে মূলতঃ চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার একটা অংশ হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফর্মেশন এগ্রিমেন্ট’ বা ‘জিসোমিয়া’ এবং ‘একুইজিশন এন্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’ বা ‘আকসা’ নামের দু’টা চুক্তি বাংলাদেশ দ্রুত স্বাক্ষর করুক। কিন্তু বাংলাদেশে অনেকেই এই চুক্তিগুলির ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে। কারণ এই চুক্তিগুলি স্বাক্ষরের অর্থ হলো বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের মাঝে চলে যাবে এবং তখন যুক্তরাষ্ট্রের চীন ও রাশিয়া-বিরোধী জোটে অংশ নেয়া ছাড়া বাংলাদেশের সামনে কোন পদ্ধতিই থাকবে না। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অস্ত্র শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতাই তৈরি করে না, সেই দেশের পররাষ্ট্রনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। পাকিস্তান এবং তুরস্কের ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা না থাকলে ক্রয়কারী দেশ মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত ‘এএইচ-৬৪ এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার এবং ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের কাছে বিক্রির জন্যে ওয়াশিংটনের লবি সচল রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ‘এমআই-২৮এনই’ হেলিকপ্টার এবং চীন থেকে ‘জে-১০’ যুদ্ধবিমান কিনতে পারে বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে এই লবি আরও বেশি সচল হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দু’টা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর না করার ফলে এই ক্রয় প্রকল্পগুলি বেশিদূর এগোয়নি। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রগুলি চীন এবং রাশিয়ায় তৈরি। এর মাঝে রয়েছে রুশ ‘মিগ-২৯’ ও ‘ইয়াক-১৩০’ যুদ্ধবিমান, চীনা ‘এফ-৭’ যুদ্ধবিমান, ‘এফএম-৯০’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, নৌবাহিনীর অনেকগুলি ফ্রিগেট, এলপিসি, সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজগুলিতে ব্যবহৃত ‘সি-৮০২’ ও ‘সি-৭০৪’ জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, সেনাবাহিনীর প্রায় সকল ট্যাংক, ‘ডব্লিউএস-২২’ রকেট আর্টিলারি ও আর্টিলারি লোকেটিং রাডার, ইত্যাদি। এর সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে তুরস্কে তৈরি ‘টি-৩০০ টাইগার’ রকেট আর্টিলারি, সার্বিয়ার তৈরি ‘নোরা বি-৫২’ আর্টিলারি, জার্মান ‘উরলিকন জিডিএফ০০৯ স্কাইগার্ড’ অটোম্যাটিক এয়ার ডিফেন্স কামান, ইত্যাদি। ইতালি থেকে ক্রয় করা দূরপাল্লার রাডার এবং তুরস্কের সহায়তায় চীনে নির্মিত ‘এফ-৭’ বিমানগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি আকাশ সক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় কোন অস্ত্রের চালান নেই। তবে সাম্প্রতিক উত্তেজনা এবং ইন্দোপ্যাসিফিকে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা নিশ্চিত করছে যে, বাংলাদেশ অতি শীঘ্রই আরও অস্ত্র কেনা এবং প্রযুক্তির দিক থেকে সক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে। নতুন সহযোগী হিসেবে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ন সহায়তা দিলেও সংখ্যার দিক থেকে চীনকে যে কেউ প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হবে না, তা নিশ্চিত।

বাংলাদেশের নীতির ব্যাপারে ওয়াশিংটন এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ লবির আগ্রহ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তবে সমস্যা হলো, এরা কেউই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত মিয়ানমারের ১১ লক্ষের বেশি বাস্তুচ্যুত মুসলিম শরণার্থীর সসন্মানে ফেরত যাবার ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয়। একদল চাইছে মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে চীনের সাথে সম্পর্ককে দীর্ঘমেয়াদে নষ্ট করতে। অপর পক্ষ চাইছে শরণার্থী সমস্যাকে জিইয়ে রেখে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীলতাকে বজায় রাখতে। তবে বাংলাদেশে এখন প্রায় সকলেই বুঝতে পারছেন যে, জাতিসংঘ বা পশ্চিমারা শরণার্থী সমস্যা নিরসনে মোটেই আন্তরিক নয়; তারা কেবলই তাদের স্বার্থ দেখছে। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের মুসলিম শরণার্থীরা পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার শিকার। লিবারাল এই বিশ্বব্যবস্থায় সকলেই মানবাধিকারের কথা বললেও সকলেই মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। অন্ততঃ মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে সামরিক সরকারের অভিযান পশ্চিমে যতটা মিডিয়া কভারেজ পেয়েছে, তার সিকিভাগও পায়নি রাখাইনের মুসলিমদের উপর গণহত্যা। সমস্যাটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নয়, বরং পশ্চিমা দ্বিমুখী বিশ্বব্যবস্থা, যার দুর্বল হবার লক্ষণ এখন সর্বত্র দেখা যাচ্ছে।



সূত্রঃ

‘Mortar fired from Myanmar kills Rohingya youth in Bangladesh’ in Al-Jazeera, 17 September 2022

‘Bangladesh should revisit its Myanmar policy: Daily Star contributor’ by Tasnim Tayeb in The Straits Times, 20 September 2022

‘Govt, army say ready to respond’ in The New Age, 21 September 2022

‘Bangladesh’s fragile national security’ by Anu Anwar, in Dhaka Trubune, 20 September 2022

‘Why Bangladesh shouldn't fall into trap of war with Myanmar’ by Kamal Uddin Mazumder, in Independent Australia, 24 September 2022

‘Myanmar, Bangladesh must solve border tensions peacefully’ by Tilottoma Rani Charulata in Asia Times, 22 September 2022

‘US wants to sell high-tech weapons to Bangladesh’ in Prothom Alo English, 08 April 2022

‘Tensions as Bangladesh accuses Myanmar of firing in its territory’ in Al-Jazeera, 23 September 2022

‘At UNGA, PM Hasina urges immediate end to Russia-Ukraine war’ in Dhaka Tribune, 24 September 2022

‘Boeing bags deal to supply Apache choppers to Bangladesh’ in New Age, 24 January 2020

‘Russia Plays Down Bangladesh Mi-28NE ‘Deal’ in Aviation Week, 07 January 2022

‘Bangladesh to get 8 Mi-28NE helicopters’ in Air Recognition, 27 December 2021

‘Turkey-Bangladesh defense co-op ensures mutual benefits: Analysts’ in The Daily Sabah, 16 January 2022

‘Aung San Suu Kyi defends Myanmar from accusations of genocide, at top UN court’ in UN News, 11 December 2019

Saturday 24 September 2022

‘এসসিও’ কি পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হতে পারবে?

২৪শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এতগুলি দেশ ‘এসসিও’র সাথে যুক্ত হতে চাইছে। তবে রাশিয়া ও চীনের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের মাঝেও এতগুলি দেশ যে ‘এসসিও’তে যোগদানের চেষ্টা করছে, তা পশ্চিমা লিবারাল আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার আকর্ষণীয়তার উপর মরিচা পড়ার দিকেই ইঙ্গিত দেয়।


সেপ্টেম্বরের ১৫-১৬ তারিখে মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের সমরখন্দে অনিষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’র ২২তম শীর্ষ বৈঠক। তিন বছরের মাঝে প্রথমবারের মতো সংস্থার সদস্য দেশগুলির শীর্ষ নেতারা সামনাসামনি বৈঠকে বসেছেন। এবারের বৈঠকে সংস্থার ৬টা সদস্য দেশ ছাড়াও ৪টা অবজার্ভার দেশ এবং ৯টা ডায়ালগ পার্টনার দেশ যোগ দেয়। বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ৩০ শতাংশ জিডিপি এই সংস্থার মাঝে একত্রিত হয়েছে। এই বৈঠক এমন সময়ে আয়োজিত হলো, যখন রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার জের ধরে পশ্চিমারা রাশিয়ার উপরে অত্যন্ত কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়েছে এবং চীনের সাথে পশ্চিমাদের ব্যাপক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এই বৈঠকের মাধ্যমে রাশিয়া অন্যান্য সদস্য দেশগুলিকে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, ‘এসসিও’র মাঝ দিয়ে পশ্চিমাদের নেতৃত্বের বিশ্বব্যবস্থার একটা বিকল্প তৈরি হতে পারে।

সংস্থার লক্ষ্য দোদুল্যমান?

২০০১ সালে গঠিত এই সংস্থার শুরুতে চীন এবং রাশিয়ার সাথে এর সদস্য ছিল মধ্য এশিয়ার চারটা দেশ কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তান। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে রাশিয়ার উদ্যোগে ভারত এবং পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে সংস্থার অবজার্ভার দেশ হিসেবে রয়েছে ইরান, বেলারুশ, মঙ্গোলিয়া এবং আফগানিস্তান। তবে আগামীতে ইরানও সংস্থার পূর্ণ সদস্য হতে যাচ্ছে। এছাড়াও মিশর, তুরস্ক এবং সৌদি আরবসহ নয়টা দেশ সংস্থার ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে রয়েছে। সংস্থার জন্মের সময় এর প্রধান লক্ষ্য নির্ধারিত হয় সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে। প্রধানতঃ ইউরেশিয়ার এই দেশগুলি নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় যাতে অন্য কোন দেশ হস্তক্ষেপ না করে, তা নিশ্চিতে এই সংস্থা গঠন করে। এর অধীনে অনেকগুলি বড় আকারের যৌথ সামরিক মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার কাছে নিরাপত্তা ইস্যুগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরবর্তীতে সংস্থার এজেন্ডাতে নিরাপত্তার ইস্যু অনেক ইস্যুর মাঝে একটা হয়ে দাঁড়ায়। মধ্য এশিয়াতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগের কারণে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির কাছে সামরিক উদ্দেশ্যের চাইতে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে থাকে।

সংস্থার সদস্য দেশগুলির মাঝে কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের মাঝে সীমান্ত সংঘর্ষ চলছে এবং আঞ্চলিকভাবে দুই ডায়ালগ পার্টনার দেশ আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝেও চলছে উত্তেজনা। এই দ্বন্দ্বগুলি দেখিয়ে দেয় যে, ‘এসসিও’ প্রতিষ্ঠিত হবার সময়ে এর যে লক্ষ্যগুলি নির্ধারণ করা হয়েছিল, এখন পরিস্থিতি এর চাইতেও অনেক বেশি জটিল হয়ে গেছে।

‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘এসসিও’র সদস্যদের ন্যাটোর মতো কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ন্যাটোর ‘আর্টিকেল ৫’এ বলা হয়েছে যে, একজন সদস্য আক্রান্ত হলে বাকিরাও সেটাকে নিজেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবেই দেখবে। ‘ইস্তাম্বুল কুলতুর ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর মেনসুর আকগুন বলছেন যে, ‘এসসিও’ হলো একটা ‘হাইব্রিড জোট’, যা মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে রাজনৈতিক শূণ্যস্থান পূরণে বিভিন্ন সহযোগিতার পথ বেছে নিয়েছে। তারা আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সদস্য দেশগুলির সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে। এবং একইসাথে অত্র অঞ্চলের বাইরের আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে একটা সমন্বিত কন্ঠ তুলে ধরছে। যে সংস্থার মাঝে ভারত এবং পাকিস্তান একত্রে রয়েছে, তা কখনোই ন্যাটোর মতো সামরিক দিকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পারবে না।

অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইস্ট এশিয়া ফোরাম’এর এক লেখায় জাপানের ‘ইউনিভার্সিটি অব শুকুবা’র প্রফেসর তিমুর দাদাবায়েভ তার বিশ্লেষণে বলছেন যে, এবারের বৈঠকে রুশ এজেন্ডার সাথে সকলে কতটা একমত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ তুরস্ক, চীন এবং ইরান রুশদের সাথে কিছুটা একমত পোষণ করলেও বাকিরা ততটা আগ্রহ দেখায়নি। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার বক্তব্যে মূলতঃ পশ্চিমাদের সাথে সহাবস্থানের পক্ষেই কথা বলেছেন। কারণ চীনা অর্থনীতি পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

 
রুশদের ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনারা মৌন সম্মতিই দিয়েছে। তবে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন করে চীনারা তাদের অর্থনীতিকে পশ্চিমা অবরোধের শিকার হিসেবে দেখতে চায় না; বিশেষ করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের আগে শি জিনপিং এহেন কোন পদক্ষেপ নিতে চাইবেন না। আপাততঃ রাশিয়ার কাছ থেকে বাজারের চাইতে কম মূল্যে তেল-গ্যাস আমদানি করেই চীনারা খুশি। চীন জানে যে রাশিয়া ধ্বংস হলে মধ্য এশিয়াতে চীনের সকল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য হুমকির মাঝে পড়ে যাবে এবং চীনাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ও অবাস্তব হয়ে দাঁড়াবে। অপরদিকে রাশিয়া দুর্বল হয়ে গেলে মধ্য এশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে প্রভাব বিস্তার করা তুরস্ক অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়া এবং চীনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে।

রাশিয়া এবং চীন – প্রতিদ্বন্দ্বী না সহযোগী?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইয়র্কটাউন ফাউন্ডেশন’এর প্রধান সেথ ক্রপসি হংকং ভিত্তিক পত্রিকা ‘এশিয়া টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, রুশদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, শি জিনপিং ইউক্রেনের নাম একবার উচ্চারণ না করলেও তিনি যুদ্ধের ব্যাপারে তার উদ্বেগ জানিয়েছেন। অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকই বলা শুরু করেছেন যে, পুতিনের সাথে শি জিনপিংএর বন্ধুত্ব বুঝি টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে গেছে। সেথ ক্রপসি বলছেন যে, প্রকৃতপক্ষে রুশদের ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনারা মৌন সম্মতিই দিয়েছে। তবে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন করে চীনারা তাদের অর্থনীতিকে পশ্চিমা অবরোধের শিকার হিসেবে দেখতে চায় না; বিশেষ করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের আগে শি জিনপিং এহেন কোন পদক্ষেপ নিতে চাইবেন না। আপাততঃ রাশিয়ার কাছ থেকে বাজারের চাইতে কম মূল্যে তেল-গ্যাস আমদানি করেই চীনারা খুশি। পুতিন তার বক্তব্যে তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের নীতিকে সমর্থন করলেও শি জিনপিং ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন দেননি। এ থেকে যারা মনে করছেন যে, চীনারা রাশিয়ার ধ্বংস চাইছে, তারা বড় ভুল করছেন। চীন রাশিয়াকে প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স এবং সামরিক সহায়তা দেয়া থেকে বিরত থেকেছে ঠিকই, কিন্তু বাকি সকল ক্ষেত্রে দুই দেশের বাণিজ্য আগের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। চীনাদের ভাষ্য অনুযায়ী শি জিনপিং রাশিয়ার প্রধান স্বার্থকে সমর্থন করে কথা বলেছেন। চীনারা বারংবার বলেছে যে, ন্যাটোর পূর্বদিকের সীমানা বিস্তারের কারণেই ‘পূর্ব ইউরোপের সমস্যা’ তৈরি হয়েছে। শি জিনপিং বারংবার বলেছেন যে, চীনারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে। পশ্চিমা লিবারাল আদর্শের পুঁজিবাদ এবং দ্বিমুখী মানবাধিকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকার পক্ষপাতি নয় তারা।

সেথ ক্রপসি বলছেন যে, চীন জানে যে রাশিয়া ধ্বংস হলে মধ্য এশিয়াতে চীনের সকল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য হুমকির মাঝে পড়ে যাবে এবং চীনাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ও অবাস্তব হয়ে দাঁড়াবে। অপরদিকে রাশিয়া দুর্বল হয়ে গেলে মধ্য এশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে প্রভাব বিস্তার করা তুরস্ক অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়া এবং চীনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। চীন বরং শক্তিশালী রাশিয়ার কাছ থেকে সুবিধাই পাবে। রাশিয়া ইউক্রেনে পশ্চিমাদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকার অর্থ হলো, পশ্চিমারা সামরিক শক্তি রাশিয়া এবং চীনের মাঝে ভাগ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমাদের সাথে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য চীনের অর্থনীতিকে বড় একটা সহায়তা প্রদান করবে। ‘এসসিও’র বৈঠকে পুতিন এবং শি জিনপিং যা বলেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে সারা বিশ্বকে দেখাবার জন্যে। তাদের মাঝে আসল কথাগুলি তারা গত ছয় মাসের মাঝে ফোনালাপেই সেড়ে ফেলেছেন।

মধ্য এশিয়ার দেশগুলির ভিন্ন এজেন্ডা


কাজাখস্তানের পত্রিকা ‘আস্তানা টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ত তোকাইয়েভ ‘এসসিও’র বৈঠকে তার দেশের কিছু এজেন্ডা তুলে ধরেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ট্রানজিট সুবিধা আদানপ্রদান, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং খাদ্যের মতো বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দেয়ার জন্যে তিনি সদস্য দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানান। সংস্থার সদস্যদেশগুলির ২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সামষ্টিক অর্থনীতির উল্লেখ করে তোকাইয়েভ বলেন যে, সংস্থার উচিৎ হবে একে একটা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলা। এই দেশগুলির কাছে রয়েছে জ্বালানি, কয়লা, রেয়ার আর্থ মেটাল এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিশাল উৎস। ট্রানজিটের উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন যে, চীন এবং ইউরোপের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হলো মধ্য এশিয়া। এছাড়াও কাস্পিয়ান সাগরের মাঝ দিয়ে ট্রানজিট এবং মধ্য এশিয়ার সাথে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগের গুরুত্বও তিনি তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন যে, কাজাখস্তান থেকে তুর্কমেনিস্তান এবং ইরান হয়ে যে পরিবহণ করিডোর রয়েছে, তার মাধ্যমে পূর্ব এশিয়ার সাথে সবচাইতে কম সময়ে মধ্য এশিয়ার যোগাযোগের উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। তিনি উজবেকিস্তানের সীমানা থেকে আফগানিস্তানের মাঝ দিয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের গুরুত্বের কথাও তুলে ধরেন। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘এসসিও’র সদস্য দেশগুলি বিশ্বের সবচাইতে বড় খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশ। তোকাইয়েভ তার আরেকটা এজেন্ডা হিসেবে মধ্য এশিয়ার পানির বন্টনের ইস্যুকে তুলে আনেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের পানিসম্পদের উৎস অন্য আরেক দেশে; তাই সদস্য দেশগুলির মাঝে সুষ্ঠু পানি বন্টনের উপরে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।

 
কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ত তোকাইয়েভ ‘এসসিও’র বৈঠকে তার দেশের কিছু এজেন্ডা তুলে ধরেন। উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান ‘এসসিও’কে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে দেখতে চাইছে। মধ্য এশিয়ার এই দেশগুলি রাশিয়া এবং চীনের ভূরাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের জন্যে ব্যবহৃত হোক, এটা তারা চাইছে না।

মধ্য এশিয়ার আরেক সদস্য দেশ উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিইয়োয়েভ চীন থেকে কিরগিজস্তান হয়ে উজবেকিস্তান পর্যন্ত রেললাইন তৈরির প্রকল্পকে ঐতিহাসিক বলে আখ্যা দেন। মিরজিইয়োয়েভ ‘এসসিও’র সদস্য দেশগুলির মাঝে শিল্প ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন একটা অর্থনৈতিক ডায়ালগ খোলার আবেদন করেন। এই ডায়ালগের মাধ্যমে তিনি সদস্য দেশগুলির মাঝে বাণিজ্য সহজীকরণ ছাড়াও নির্ভরযোগ্য সাপ্লাই চেইন তৈরি, যৌথভাবে আমদানি বিকল্প উৎপাদন প্রকল্প এবং বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার কথা বলেন। চীনা সরকারি থিংকট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকনমি এন্ড পলিটিক্স’এর কাজাখ বিশ্লেষক ঝুমাবেক সারাবেকভ ‘আস্তানা টাইমস’কে বলেন যে, ২০২১ সালে ‘এসসিও’র সদস্য দেশগুলির বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল প্রায় ৭’শ ট্রিলিয়ন ডলার; যার মাঝে মাত্র ৭ ট্রিলিয়ন বা মাত্র ১ শতাংশ সদস্য দেশগুলির মাঝে হয়। উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান ‘এসসিও’কে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে দেখতে চাইছে। মধ্য এশিয়ার এই দেশগুলি রাশিয়া এবং চীনের ভূরাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের জন্যে ব্যবহৃত হোক, এটা তারা চাইছে না।

ভারতের প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় হর্ষ পান্ত বলছেন যে, ‘এসসিও’র মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার সাথে ভারতের যুক্ত হবার চেষ্টাটা অবাস্তব নয়। আর যেহেতু ভারত এই সংযুক্তি চাইছে সদস্য দেশগুলির স্থলভাগের উপর দিয়ে, তাই সংস্থার মাঝেই ভারত তার স্বার্থ বাস্তবায়নকে দেখতে পাচ্ছে। তবে ভারত যে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির মতোই ‘এসসিও’কে পশ্চিমা বিরোধী সংস্থা হিসেবে গড়ার রাশিয়া এবং চীনের লক্ষ্যের সাথে একমত নয়, তা পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার। পান্ত বলছেন যে, এবারের শীর্ষ বৈঠকে সদস্য দেশগুলির ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা দেখে বোঝা যায় যে, সামনের দিনগুলিতে এর কর্মকান্ডগুলি বাস্তবায়ন করা আরও জটিল হবে।

দন্তহীন বাঘ

প্রফেসর তিমুর দাদাবায়েভ বলছেন যে, মধ্য এশিয়ার দেশগুলি ‘এসসিও’র ভৌগোলিক পরিধিকে বৃদ্ধি করতে চাইছে। বিশেষ করে ইরান এবং বেলারুশ একারণে সংস্থার অন্তর্গত হতে চলেছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালদ্বীপ ও মিয়ানমারকেও ডায়ালগ পার্টনার করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ‘এসসিও’র সাথে ‘ইকনমিক এন্ড সোশাল কমিশন ফর এশিয়া প্যাসিফিক’ বা ‘এসক্যাপ’ এবং জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কোর সাথে সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির এজেন্ডাই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং একইসাথে সংস্থার পশ্চিমা-বিরোধী প্রতিচ্ছবিকে প্রতিস্থাপন করে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটা প্রতিচ্ছবি স্থান করে নিয়েছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলির এজেন্ডাগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ‘এসসিও’কে তারা দখছে একটা আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে; রাজনৈতিক জোট হিসেবে নয়।

‘এসসিও’র এবারের বৈঠকে তুর্কি প্রসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান যোগদান করেন এবং তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, তুরস্ক ‘এসসিও’র পূর্ণ সদস্য দেশ হতে ইচ্ছুক। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এটা তুরস্কের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের একটা প্রতিফলন। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও ‘এসসিও’র ডায়ালগ পার্টনার হতে চাইছে; যাদের লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে। যদিও অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, ‘এসসিও’ পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হতে পারে কিনা, তথাপি সংস্থাটা যে পরিবর্তিত বাস্তবতা এড়াতে পারেনি, তা কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের মূলতঃ অর্থনৈতিক এজেন্ডার পিছনে ছোটা দেখেই বোঝা যায়। নিরাপত্তাকে কেন্দ্রে রেখে ‘এসসিও’র জন্ম হলেও এখন তা বহুবিধ লক্ষ্যে বিভক্ত। পশ্চিমা জোটের মতো ‘এসসিও’র নেই কোন আদর্শিক লক্ষ্য। একদিকে ন্যাটোর মতো পারস্পরিক কোন নির্ভরশীলতা না থাকার কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মতো বিপরীতমুখী দেশগুলিও বিভিন্ন সুবিধা পেতে এখানে যুক্ত হয়েছে, অপরদিকে চীন এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে মধ্য এশিয়ার দেশগুলি এই সংস্থার মাঝে ব্যালান্স খুঁজে পেয়েছে। ‘এসসিও’ মূলতঃ চীন এবং রাশিয়ার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরলেও তা এই দুই দেশের রাজনৈতিক সক্ষমতার সীমানাকেও নির্দেশ করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য, জ্বালানি সরবরাহ এবং ট্রানজিট সুবিধা পাবার জন্যে অনেক দেশই হয়তো সংস্থার সদস্য হতে চাইবে, কিন্তু ন্যাটো সদস্যদের মতো নিরাপত্তাগত বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে বহু লক্ষ্যের মাঝে বিভক্ত ‘এসসিও’ একটা দন্তহীন বাঘই থেকে যাবে। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এতগুলি দেশ ‘এসসিও’র সাথে যুক্ত হতে চাইছে। তবে রাশিয়া ও চীনের সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের মাঝেও এতগুলি দেশ যে ‘এসসিও’তে যোগদানের চেষ্টা করছে, তা পশ্চিমা লিবারাল আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার আকর্ষণীয়তার উপর মরিচা পড়ার দিকেই ইঙ্গিত দেয়।



সূত্রঃ
‘SCO Summit: President Tokayev Focuses on Transit and Transport, Food and Energy Security’ in The Astana Times, 17 September 2022
‘In search of a new identity for SCO’ by Timur Dadabaev in East Asia Forum, 20 September 2022
‘SCO summit did not show what you think it showed’ by Seth Cropsey in Asia Times, 21 September 2022
‘Can the SCO be Turkey’s alternative to the West?’ in Al-Jazeera, 21 September 2022
‘India and the SCO: A Parade of Disconnect’ by Harsh V. Pant, in Observer Research Foundation, 22 September 2022

Thursday 22 September 2022

ন্যান্সি পেলোসির আর্মেনিয়া সফরের গুরুত্ব কতটুকু?

২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
বর্তমান অস্ত্রবিরতির উপরে কেউই আস্থা রাখতে পারছে না। আজেরবাইজান যখন রুশদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছে এবং তুরস্কের সহায়তায় ইইউতে গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে ভূরাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চাইছে, তখন আর্মেনিয়রাও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের দুই দিনের যুদ্ধ এবং পেলোসির আর্মেনিয়া সফর ককেশাসে আরেক দফা উত্তেজনার দ্বার উন্মুক্ত করলো।



মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসি গত ১৮ই সেপ্টেম্বর আজেরবাইজান ঘুরে এসেছেন। তার এই সফরের সময়টা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; কারণ মাত্র কিছুদিন আগে ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর আজেরবাইজান তার প্রতিবেশী দেশ আর্মেনিয়ার সাথে দুই দিনের একটা সীমান্ত যুদ্ধ শেষ করেছে। সফরকালে তিনি সাম্প্রতিক যুদ্ধকে আর্মেনিয়ার উপর আজেরবাইজানের ‘বেআইনী এবং মারাত্মক হামলা’ বলে উল্লেখ করেন; যদিও উভয় পক্ষই এই যুদ্ধ শুরুর জন্যে অপরপক্ষকে দায়ী করেছে। পেলোসি বলেন যে, আজেরবাইজানের যে ‘হামলা’য় প্রায় ২’শত মানুষের প্রাণ গেছে, তার ব্যাপারে তিনি বলিষ্ঠভাবে নিন্দা জানাচ্ছেন। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, পেলোসি যখন এই কথাগুলি বলছিলেন, তখন তার পাশে ছিলেন আর্মেনিয়ার পার্লামেন্টের স্পীকার আলেন সিমোনিয়ান; যিনি আজেরবাইজানের সাথে সামরিক দ্বন্দ্বে রাশিয়ার সহয়তা না পাওয়ায় নাখোশ হয়েছেন। রুশ বার্তা সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’ বলছে যে, তিনি এর আগের সপ্তাহে রুশদের সাথে সামরিক চুক্তিকে গুলি করতে না পারা পিস্তলের সাথে তুলনা করেছেন; যা কিনা দরকারের সময়ে কাজে লাগে না। উল্লেখ্য যে, অর্থোডক্স খ্রিস্টান আর্মেনিয়া রাশিয়ার অনেক পুরোনো বন্ধু এবং রাশিয়ার সাথে আর্মেনিয়ার সামরিক চুক্তি রয়েছে, যা মোতাবেক আর্মেনিয়ার উপর সামরিক হামলা হলে রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কথা। এর আগে গত অগাস্টেই ৮২ বছর বয়সী প্রবীন রাজনীতিবিদ পেলোসি তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাইওয়ান সফর করে চীনাদেরকে ক্ষেপিয়েছেন। এখন তার আর্মেনিয়া সফরকে অনেকেই দেখছেন রাশিয়ার একটা পুরোনো বন্ধুকে ওয়াশিংটনের দিকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে; বিশেষ করে মস্কো যখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত।

ন্যান্সি পেলোসি বলেন যে, আজেরবাইজান যে এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, সেব্যাপারে কথা বলাটা প্রয়োজন। তার এই কথায় আজেরবাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, আজেরবাইজানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন এবং অন্যায্য যে অভিযোগ তিনি করেছেন, তা মেনে নেয়া যায় না। এই ঘটনা আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। বক্তব্যে আরও বলা হয় যে, পেলোসি সর্বদাই আর্মেনিয়া-ঘেঁষা একজন রাজনীতিবিদ বলে পরিচিত। আর তিনি তার সফরসঙ্গী হিসেবে তেমনই কংগ্রেস সফস্যদেরকে নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, বক্তব্যে আরও বলা হয় যে, পেলোসি ন্যায়ের কথা বললেও আজেরি এলাকা আর্মেনিয়রা যে প্রায় ৩০ বছর ধরে দখলে রেখেছিল এবং আজেরিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানো ছাড়াও তাদেরকে জোরপূর্বক বাড়িঘরছাড়া করেছিল, সেব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। পেলোসির বক্তব্যে অত্র এলাকায় শান্তির পরিবর্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, পেলোসি যেভাবে আজেরবাইজানকে যুদ্ধের জন্যে দায়ী করেছেন, তা ওয়াশিংটনের অফিশিয়াল বক্তব্যের বিপরীতে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন এক বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভকে ফোন করে অস্ত্রবিরতি বাস্তবায়ন করার অনুরোধ করেন এবং আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়ার সাথে সমস্যার সমাধান করার কথা বলেন।

বাকুর থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার অব এনালিসিস অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’এর ফরিদ শাফিইয়েভ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, পেলোসি আর্মেনিয়ায় এসেছেন মূলতঃ আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে আর্মেনিয়দের সমর্থন পেতে। ক্যালিফোর্নিয়াতে তার নির্বাচনী এলাকায় আর্মেনিয়দের প্রভাব যথেষ্টই বেশি। অপরদিকে ইয়েরেভানের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রিজিওনাল স্টাডিজ সেন্টার’এর ডিরেক্টর রিচার্ড জিরোগোসিয়ান ‘পলিটিকো’কে বলছেন যে, ককেশাসে মার্কিনীরদের ফোকাস বৃদ্ধি শুধু ভূরাজনৈতিক কারণে নয়, আদর্শিক কারণেও। এটা শুধু রাশিয়ার কারণে নয়, আর্মেনিয়ার কারণেও। পেলোসির সফর হয়তো মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের একটা শুরু। 

প্রায় তিন দশক আর্মেনিয়ার সাথে সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ২০২০ সালের যুদ্ধের পর থেকে আজেরবাইজান তার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। সেপ্টেম্বরের দুই দিনের যুদ্ধ আজেরবাইজানকে একটা ধারণা দিয়েছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে রুশরা আর্মেনিয়াকে রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা নিতে পারে।

আফগানিস্তানে মার্কিনীদের অবস্থানের সময় আজেরবাইজান যুক্তরাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসেবে কাজ করেছে। আজেরবাইজানের আকাশসীমা ব্যবহার করে মার্কিনীর আফগানিস্তানে সেনা আনানেয়া করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আজেরবাইজানের সবচাইতে কাছের বন্ধু হলো তুরস্ক। ২০২০ সালে আর্মেনিয়ার সাথে ৪৪ দিনের যুদ্ধে জয়ের পিছনে আজেরবাইজানকে সবচাইতে বেশি সহায়তা দিয়েছিল তুরস্ক। অপরদিকে রাশিয়া ককেশাস এলাকাকে তার নিজের উঠান মনে করে থাকে। আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের সীমানায় যুদ্ধবিরতি পাহাড়া দেয়ার দায়িত্ব হলো রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর। তবে ২০১৮ সালে ‘ভেলভেট রেভোলিউশন’এর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী নিকল পাশিনিয়ানের সরকারকে পশ্চিমারা গণতান্ত্রিক উত্থানের ফলাফল হিসেবেই দেখেছে। পেলোসি তার সফরের সময় আর্মেনিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে মার্কিন সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন।

পেলোসির সফরের ব্যাপারে আজেরবাইজের বন্ধু তুরস্ক কঠোর বার্তা দিয়েছে। ১৯শে সেপ্টেম্বর তুর্কি ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, পেলোসির একপেশে বক্তব্যগুলি আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের কূটনীতিকে ‘স্যাবোটাজ’ করেছে; যেকারণে এই বক্তব্যগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। একইসাথে তিনি ওয়াশিংটনকে আহ্বান জানান তারা যেন পরিষ্কার করে যে, পেলোসির কথাগুলি মার্কিন সরকারের বক্তব্য কিনা। অপরদিকে মস্কোতে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন যে, পেলোসি ঢোল পিটিয়ে তার আগমণ জানান দিয়েছেন। এমনটা না করে বরং চুপচাপ কার্যকর পদক্ষেপ নিলে আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের সংকটের সমাধান মিলতে পারে।

‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে পেলোসির সফরের সময়ে অনেকেই প্রকাশ্যে রাশিয়া বিরোধী বার্তা দেয়। কেউ কেউ পুতিনের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড নামিয়ে ফেলে। রুশ সাংবাদিকদেরকেও হেনস্তা হতে হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে। আর্মেনিয়দের মাঝে অনেকেই মনে করা শুরু করেছে যে, রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব আর্মেনিয়াকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে আজেরবাইজান তুরস্কের সহায়তায় দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে। এমতাবস্থায় অনেকেই ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকতে চাইছে।

প্রায় তিন দশক আর্মেনিয়ার সাথে সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ২০২০ সালের যুদ্ধের পর থেকে আজেরবাইজান তার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। সেপ্টেম্বরের দুই দিনের যুদ্ধ আজেরবাইজানকে একটা ধারণা দিয়েছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে রুশরা আর্মেনিয়াকে রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা নিতে পারে। বর্তমান অস্ত্রবিরতির উপরে কেউই আস্থা রাখতে পারছে না। আজেরবাইজান যখন রুশদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছে এবং তুরস্কের সহায়তায় ইইউতে গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে ভূরাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চাইছে, তখন আর্মেনিয়রাও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের দুই দিনের যুদ্ধ এবং পেলোসির আর্মেনিয়া সফর ককেশাসে আরেক দফা উত্তেজনার দ্বার উন্মুক্ত করলো।

Wednesday 21 September 2022

মার্কিনীরা তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকার মাধ্যমে চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিততে চাইছে

২১শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
সকল বাহিনীর সকল ইউনিটের মাঝে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তথ্য আদানপ্রদান, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ ও ‘ম্যাশিন লার্নিং’এর মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ এবং বিদ্যুৎগতিতে সেই তথ্য ব্যবহার করে শত্রুকে আক্রমণ করতে পারার মতো নতুন কনসেপ্ট খুবই আকর্ষণীয় বটে, কিন্তু বাহিনীগুলি যখন পুরোনো ধ্যানধারণার মাঝে গড়ে উঠেছে, তখন এর বাস্তবায়ন যারপরনাই কঠিন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ২০২২এর মার্চে উপ প্রতিরক্ষা সচিব ক্যাথলিন হিকস মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্যে ‘জয়েন্ট অল ডোমেইন কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল’ বা ‘জেএডিসিসি’ বা ‘জ্যাডসি২’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছেন। ‘জ্যাডসি২’ হলো আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্যের ব্যাপক ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে একটা প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে পুরো মার্কিন সামরিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অটোমেশনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলি ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ এবং ‘ম্যাশিন লার্নিং’ ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করবে এবং নিরাপদ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অতি দ্রুততার সাথে সেগুলি কাজে লাগিয়ে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করবে। মার্কিন জয়েন্ট চীফস অব স্টাফএর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মাইলি বলছেন যে, ‘জ্যাডসি২’এর মাধ্যমে তথ্যের আদানপ্রদান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে অভূতপূর্ব গতিতে; এবং এর মাধ্যমে শত্রুর যেকোন নির্দিষ্ট হুমকির বিরুদ্ধে সকল সক্ষমতা একত্রে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীর যেকোন ইউনিট কোন একটা টার্গেট খুঁজে পেলে তার তথ্য সকলের সাথে একটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শেয়ার করবে। এই তথ্য ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর মাধ্যমে অতি দ্রুত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে যে, কোন বাহিনীর কোন ইউনিটের মাধ্যমে সেই টার্গেটকে আক্রমণ করলে সবচাইতে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। সেনাবাহিনীর প্রতিটা সৈন্য, ট্যাংক, হেলিকপ্টার, আর্টিলারি, বা বিমান বাহিনীর প্রতিটা বিমান, ড্রোন, স্যাটেলাইট, রাডার, ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্স, অথবা নৌবাহিনীর যেকোন যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, বিমান এই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকবে এবং সকলে একত্রে এখানে তথ্য সরবরাহ করবে। অর্থাৎ এভাবে প্রতি মুহুর্তে হাজারো উৎস থেকে তথ্য আসতে থাকবে এবং ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ এই তথ্যগুলিকে বিশ্লেষণ করতে থাকবে। যেহেতু প্রত্যেক বাহিনীর সকল ইউনিট নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত থাকবে, তাই যে ইউনিট কোন বিশেষ তথ্য ব্যবহারের জন্যে সবচাইতে উপযুক্ত থাকবে, তাকেই নির্দেশ প্রদান করা হবে। প্রায় সায়েন্স ফিকশনের মতো শোনালেও মার্কিন বাহিনী ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায়ে চীন এবং রাশিয়াকে হারাতে এই প্রকল্পই বাস্তবায়ন করতে চাইছে।

এই প্রকল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মার্কিন সামরিক বাহিনীর যেকোন অংশের যোগাড় করা তথ্য অপর যেকোন অংশ ব্যবহার করতে পারবে অতি দ্রুততার সাথে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে একটা বাহিনী অপর বাহিনীর সক্ষমতাকে মুহুর্তের মাঝেই ব্যবহার করে ফেলতে পারবে। তবে এই প্রকল্প একদিকে যেমন অত্যন্ত উচ্চাভিলাসী, অপরদিকে এর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বহুবিধ। গত জুলাই মাসে মার্কিন বিমান বাহিনী এবং মহাকাশ বাহিনীর প্রধান সাইবার উপদেষ্টা ওয়ান্ডা জোন্স-হীথ এক অনুষ্ঠানে বলেন যে, প্রত্যেকটা বাহিনীই ‘জ্যাডসি২’কে আলাদাভাবে বুঝেছে। তিনি বলেন যে, তিনি তিনটা বাহিনীর প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা দেখেছেন। এবং যে ব্যাপারটা তিনি নিশ্চিত হয়েছেন তা হলো, এই পরিকল্পনাগুলি একটা আরেকটার সাথে সমন্বয় করা যাবে না। ‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘জ্যাডসি২’এর অধীনে মার্কিন সেনাবাহিনী ‘প্রজেক্ট কনভারজেন্স’ নামে এক প্রকল্পের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। তারা অন্য বাহিনীর সাথে এ নিয়ে মহড়া দিয়েছে। আর ২০২২ সালে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলিকেও মহড়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছে। বিমান বাহিনী এগুচ্ছে ‘এডভান্সড ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বা ‘এবিএমএস’ প্রকল্প নিয়ে। বিমান বাহিনীর সচিব ফ্রাঙ্ক কেন্ডাল ২০২১ সালে এই প্রকল্পের ব্যাপারে তার সংশয় প্রকাশ করলেও ২০২২ সালে তিনি আরও আশাবাদী হয়েছেন। নৌবাহিনীর প্রকল্প হলো ‘প্রজেক্ট ওভারম্যাচ’; যার ব্যাপারে প্রায় কোনকিছু জানা যায় না। তারা তাদের পরিকল্পনাকে একেবারেই গোপন রেখেছে।

 
মার্কিন সামরিক বাহিনী বহুকাল ধরে ছোট ছোট সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর এখন হঠাত করেই বড় আকারের চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। ‘জ্যাডসি২’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে তারা ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের সাথে এবং ইউরোপে রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্বে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে থাকবে।

প্রকল্পের বাজেট এবং টাইমলাইন নিয়ে অনিশ্চয়তা

‘জ্যাডসি২’এর ব্যাপারে ওয়ান্ডা জোন্স-হীথএর সমালোচনাটাই প্রথম নয়। মার্কিন কংগ্রেসেও অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, তিনটা বাহিনী সর্বদাই নিজস্ব সংস্কৃতিতে চলেছে এবং এর সংকীর্ণতা থেকে বের হতে পারেনি। এখন সেই একই বাহিনীগুলি তাদের সংস্কৃতির পরিবর্তন না করেই কিভাবে কোন ধরণের সমস্যা ছাড়াই সকল ধরণের তথ্য নিজেদের মাঝে আদানপ্রদান করবে, তা কেউই বুঝতে পারছেন না। বিশেষ করে অনেকগুলি বাহিনী এবং এজেন্সি এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে আলাদা বাজেটে কাজ করছে বলে পুরো পরিকল্পনায় কত খরচ হচ্ছে, বা পুরো প্রকল্প কবে শেষ হবে, এবং এর ফলাফল হিসেবেই বা কি পাওয়া যাবে, তা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। প্রতিরক্ষা দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারির অধীনে কমান্ড এন্ড কন্ট্রোলের ডিরেক্টর আরসেনিও গুমাহাদ জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে বলেন যে, মার্কিন সামরিক বাহিনী বহুকাল ধরে ছোট ছোট সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর এখন হঠাত করেই বড় আকারের চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। ‘জ্যাডসি২’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে তারা ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের সাথে এবং ইউরোপে রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্বে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে থাকবে।

মার্কিং থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা হাডসন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো ব্রায়ান ক্লার্ক প্রতিরক্ষা বিষয়ক পত্রিকা ‘সিফোরআইএসআরনেট’কে বলছেন যে, এই মুহুর্তে একটা সমস্যা হলো, প্রকল্পের মূল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বিভিন্ন বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সএর হাতে। বড় কোন মহড়া দিতে হলে আঞ্চলিক যৌথ কমান্ডের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে। যেমন ইন্দোপ্যাসিফিকের চাহিদাগুলি ইন্দোপ্যাসিফিকের কমান্ডারই জানে। কাজেই ইন্দোপ্যাসিফিকে যদি ‘জ্যাডসি২’এর কর্মক্ষমতা নিয়ে মহড়া দেয়া হয়, তাহলে সেটা সেই অঞ্চলের কমান্ডারের হাতেই দিতে হবে। বাহিনীর কমান্ডাররা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু আঞ্চলিক কমান্ডারের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে না পারলে স্বল্প মেয়াদে প্রকল্প এগুবে না। এছাড়াও আরেকটা সমস্যা হলো, পেন্টাগনকে বুঝতে হবে যে, এধরণের বড় আকারের মহড়া দিতে হলে বাজেট যেমন বৃদ্ধি করতে হবে, তেমনি পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যেও সামরিক বাহিনীর একটা বড় অংশকে ছাড় দিতে হবে। এই মুহুর্তে পেন্টাগনের বাজেটের ১ শতাংশেরও কম পরীক্ষানিরীক্ষার পিছনে ব্যয় করা হয়।

মার্কিন সিনেট ২০২৪ সালের মাঝে ইন্দোপ্যাসিফিকে ‘জ্যাডসি২’এর জন্যে একটা যৌথ হেডকোয়ার্টার্স করার নির্দেশ দিয়েছে এবং অতিরিক্ত ২’শ ৪৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। তবে কথা থেকেই যায় যে, ‘জ্যাডসি২’ অত্যন্ত জটিল একটা প্রকল্প। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ‘সিফোরআইএসআরনেট’কে বলছেন যে, বাহিনীগুলি হয়তো আলাদাভাবে নিজেদের প্রকল্পগুলির সমস্যা দূর করছে। কিন্তু এই প্রকল্পের অনেক কিছুই রয়েছে যেগুলি একত্রে শুরু করতে হবে।

এই নেটওয়ার্ক কোন কারণে অকার্যকর হলে কি হবে?

‘জ্যাডসি২’ ব্যবস্থার জটিলতার সমালোচনা করেছেন অনেকেই। জটিল সমস্যাগুলির সমাধান করার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর সাইবার অফিসার ক্যাপ্টেন ম্যাগি স্মিথ এবং প্রযুক্তি কোম্পানি ‘ম্যানডিয়্যান্ট’এর সিনিয়র ইন্টেলিজেন্স এনালিস্ট জেসন এটওয়েল মার্কিন সামরিক একাডেমি ‘ওয়েস্ট পয়েন্ট’এর ‘মডার্ন ওয়ার ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় প্রশ্ন করছেন যে, যদি কোন কারণে এই নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে যায়, তাহলে এর কোন বিকল্প থাকবে কি? কেউ কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, সাইবার হামলার কারণে এই নেটওয়ার্ক ধ্বসে পড়বে না? ইউক্রেন যুদ্ধের উদাহরণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, একটা ব্যবস্থার উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল থাকলে কি বিপদে পড়তে হতে পারে। যুদ্ধের শুরুতেই স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী হ্যাকিংএর শিকার হয় এবং তাদের ইউনিটগুলি প্রায় পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উল্টোদিকে রুশদের যোগাযোগ ব্যবস্থাও মারাত্মক সমস্যায় পড়ে এবং এর ফলে রুশ সেনারা অনিরাপদ সেলফোন ও রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে; যা কিনা ইউক্রেনিয়রা ধরে ফেলে রুশ ইউনিটগুলির অবস্থান নিখুঁতভাবে জেনে যায় এবং সেগুলিকে জ্যামিংও করতে সক্ষম হয়। রুশ সেনারা তাদের যোগাযোগের যন্ত্রগুলি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এখান থেকে শিক্ষনীয় বিষয় হলো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর সেনাদের আস্থা একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা ফেরত আনাটা কঠিন হবে।

 
মার্কিনীরা ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয় পেতে ‘জ্যাডসি২’এর মতো এতটাই জটিল এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার বাজেট, এমনকি টাইমলাইন নিয়েও কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। তদুপরি রয়েছে নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা, অকার্যকর হয়ে গেলে সম্ভাব্য প্রতিস্থাপক, নিজ সহকর্মীকে বিশ্বাস না করে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়ার মতো সিদ্ধান্তগত চ্যালেঞ্জ। সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো, নিজেদের সক্ষমতাকে বাড়াতে গিয়ে উচ্চাভিলাসী ‘জ্যাডসি২’ প্রকল্প মার্কিন বাহিনীর দুর্বলতা হিসেবে পরিচিত হয়ে যাবে না তো?

ক্যাপ্টেন স্মিথ এবং জেসন এটওয়েল আরও বলছেন যে, এই প্রযুক্তিগুলি ব্যবহার করার সময় কেউ যেমন বেশি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করতে পারে, আবার কিছু সিদ্ধান্ত কয়েকটা স্তরের নেতৃত্বের অনুমতির মাঝে আটকে যেতে পারে। এছাড়াও বাহিনীর কর্মকর্তারা নিজেদের অধস্তন কমান্ডারদের উপদেশ উপেক্ষা করে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর সিদ্ধান্ত নিতে কতটা প্রস্তুত থাকবে, সেটাও দেখার বিষয় হবে। এছাড়াও সকল ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত যে সঠিক হবে, তার কি নিশ্চয়তা রয়েছে? সাম্প্রতিক সময়ে বহু প্রকারের ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের পরেও অনেক সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। ‘জ্যাডসি২’ কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, এর ফলাফল আগের চাইতে ভুল কমিয়ে দেবে? আর যুদ্ধক্ষেত্রের প্রচন্ড চাপের মাঝে কমান্ডাররা সর্বোচ্চ হাই-টেক প্রযুক্তির চাইতে কার্যকারিতার উপরেই বেশি নির্ভর করতে চাইতে পারে। সর্বক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ প্রযুক্তি প্রয়োগ করাটাই হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটা নতুন প্রযুক্তি যত ভালোই মনে হোক না কেন, বুঝতে হবে যে সেটা কোন একটা সময়ে পুরো সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে কিনা।

পুরোনো চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না কেউই

যুক্তরাষ্ট্রের ‘আর্মড ফোর্সেস কমিউনিকেশন্স এন্ড ইলেকট্রনিক্স এসোসিয়েসন’এর নিরাপত্তা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘সিগনাল’এর এক প্রতিবেদনে ‘জ্যাডসি২’এর সঠিক বাস্তবায়নের সমস্যাগুলির ব্যাপারে আলোচনা করা হয়। ‘জ্যাডসি২’এর অধীনে বিমান বাহিনীর প্রকল্প হলো ‘এডভান্সড ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বা ‘এবিএমএস’। এই প্রকল্পের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে ৫০৫তম কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল উইংএর অধীনে, যার অধিনায়ক কর্নেল ফ্রেডারিক কোলম্যান বলছেন যে, বিমান বাহিনীর কাছে ‘কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল’ ব্যাপারটা খুবই কম গুরুত্ব পায়। সকলেই মনে করে যে, এটা এমনি এমনি হয়ে যাবে। সকলেই এর গুরুত্বের কথা বললেও সকলেই মনে করে যে এটা যেকেউই করতে পারবে। ৫০৫তম উইংএর অধীনে ৮০৫তম কমব্যাট ট্রেনিং স্কোয়াড্রনের প্রধান লেঃ কর্নেল জন ওহলান্ড বলছেন যে, এখনও ‘জ্যাডসি২’ একটা কনসেপ্ট মাত্র। বাস্তবায়নের দিক থেকে এটা ‘জ্যাডসি২’ নয়; বরং ‘স্যাডসি২’। এর অর্থ হলো ‘সার্ভিস অল ডোমেইন কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল’; যা বাস্তবিকপক্ষে শুধুমাত্র বিমান বাহিনীর নিজস্ব একটা ব্যবস্থা। এখানে যদি অন্য বাহিনীর কেউ যুক্ত হতে চায়, তাহলে তাদেরকেই ঠিক করতে হবে যে তারা কিভাবে বিমান বাহিনীর সাথে যুক্ত হবে। কর্নেল কোলম্যান বলছেন যে, এই মুহুর্তে বিমান বাহিনী সর্বদাই অন্যান্য বাহিনীর সাথে যৌথভাবে কাজ করছে; তথ্য আদানপ্রদান করছে। তবে ‘জ্যাডসি২’তে যে ব্যাপারটা নতুন, তা হলো অন্য বাহিনীর অস্ত্রের কমান্ডের দায়িত্ব নেয়া। এটা শুধুমাত্র কোন টেকনিক্যাল সমস্যা নয়। এখানে আইন পরিবর্তন করতে হবে; কার দায়িত্ব কতটুকু, সেখানে নতুন করে ভাবতে হবে; যৌথ কমান্ডের পরিকল্পনা নতুন করে করতে হবে। লেঃ কর্নেল ওহলান্ড বলছেন যে, বিমান বাহিনীর মাঝেই বিভিন্ন ইউনিটগুলি একটা আরেকটার সাথে যুক্ত হতে হিমসিম খাচ্ছে; বাকি বাহিনীগুলিতেও একই সমস্যা। এই মুহুর্তে প্রতিটা বাহিনীই তাদের নিজস্ব সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করছে।

সকল বাহিনীর সকল ইউনিটের মাঝে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তথ্য আদানপ্রদান, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ ও ‘ম্যাশিন লার্নিং’এর মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ এবং বিদ্যুৎগতিতে সেই তথ্য ব্যবহার করে শত্রুকে আক্রমণ করতে পারার মতো নতুন কনসেপ্ট খুবই আকর্ষণীয় বটে, কিন্তু বাহিনীগুলি যখন পুরোনো ধ্যানধারণার মাঝে গড়ে উঠেছে, তখন এর বাস্তবায়ন যারপরনাই কঠিন। একেকটা বাহিনী যখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকেই কাটিয়ে উঠতে হিমসিম খাচ্ছে, তখন একটা যৌথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সকল তথ্য মুহুর্তের মধ্যে আদানপ্রদান করা অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতো। মার্কিনীরা ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয় পেতে ‘জ্যাডসি২’এর মতো এতটাই জটিল এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার বাজেট, এমনকি টাইমলাইন নিয়েও কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। তদুপরি রয়েছে নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা, অকার্যকর হয়ে গেলে সম্ভাব্য প্রতিস্থাপক, নিজ সহকর্মীকে বিশ্বাস না করে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়ার মতো সিদ্ধান্তগত চ্যালেঞ্জ। সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো, নিজেদের সক্ষমতাকে বাড়াতে গিয়ে উচ্চাভিলাসী ‘জ্যাডসি২’ প্রকল্প মার্কিন বাহিনীর দুর্বলতা হিসেবে পরিচিত হয়ে যাবে না তো?



সূত্রঃ

‘DoD Announces Release of JADC2 Implementation Plan’ in US Department of Defense, 17 March 2022

‘They’re ‘all different’: Air Force adviser says services diverge on JADC2’ in Defense News, 28 July 2022

‘Pentagon’s secret JADC2 plan ‘evolving,’ official says, as lawmakers seek audit’ in Defense News, 12 July 2022

‘Senators look past Europe, push Pentagon JADC2 vision for Indo-Pacific’ in C4ISRNet, 17 August 2022

‘A Solution Desperately Seeking Problems: The Many Assumptions of JADC2’ by Maggie Smith and Jason Atwell in Modern War Institute at West Point, 05 March 2022

‘Preventing JADC2 From Becoming 'Sad C2'’ in Signal, AFCEA International, 14 September 2022