Wednesday 29 June 2016

জার্মান জাতির একত্রীকরণ আর বাংলার মানচিত্রের “বাস্তবতা”

২৯শে জুন ২০১৬
১৭০০ সালের শুরুতে ইউরোপ। প্রুশিয়ার জন্ম হয়েছে মাত্র। জার্মানির জন্ম অতে আরও দেড়'শ বছর বাকি।


আজকে জার্মান একত্রীকরণ নিয়ে কিছু গীত গাইবো; বিংশ শতকের পূণ-একত্রীকরণ নয়, ঊনিশ শতকের একত্রীকরণের গীত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যখন ভেঙ্গে যাচ্ছে, তখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে জার্মানির কি হবে? ব্রিটেনের কি হবে, অভিবাসীদের কি হবে, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং বাকিরা কি ভোটাভুটিতে যাবে কিনা – এগুলি ছোট প্রশ্ন। আসল প্রশ্ন হলো ইউরোপ যে ভেঙ্গে যাচ্ছে, তাতে সবচাইতে বড় সমস্যায় পড়বে কারা? তারাই সমস্যায় পড়বে যারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে ব্যবহার করে তাদের হাই-টেক পণ্যের সবচাইতে বড় বাজার গড়ে তুলেছে। এটা আর কোন দেশ নয় – জার্মানি। ১৮৭০ থেকে ইউরোপের সবকিছুই জার্মানিকে ঘিরে। তাই আজকে আমাদের দেখা প্রয়োজন জার্মানি কি করে জন্ম নিল। আর একই সাথে আমাদের দেখতে হবে – জার্মানির জন্ম আমাদের কি শিক্ষা দেয়?

ন্যাপোলিয়ন – জার্মান জাতীয়তাবাদের উস্কানিদাতা

জার্মান জাতিকে একত্রিত করার পেছনে সবচাইতে বড় ক্রেডিট অবশ্যই দিতে হবে ন্যাপোলিয়ন বোনাপার্টকে। ন্যাপোলিয়নের উত্থানের আগে জার্মান জাতি পুরোটাই ছিল Holy Roman Empire-এর অধীনে, যার নেতৃত্ব ছিল আস্ট্রিয়া রাজ্যের বংশানুক্রমিক Hapsburg রাজাদের হাতে। জার্মানি বলতে ছিল কয়েক’শ ছোট বড় রাজ্যের এক জগাখিচুরি। এদের মাঝে সবচাইতে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রুশিয়া, যার অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে জন্ম হয়, আর সেই শতাব্দীর দ্বিতীয় অংশ জুড়ে ফ্রেডরিক দ্যা গ্রেটের (ক্ষমতায় ছিলেন ১৭৪০-১৭৮৬) সুযোগ্য নেতৃত্বে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। দু’টো বড় বড় যুদ্ধ – অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকারের যুদ্ধ (১৭৪০-১৭৪৮) এবং সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩) এই নতুন দেশটির উপর দিয়ে যায়। ইউরোপের অন্যান্য শক্তিগুলি এই যুদ্ধগুলির মাঝে প্রুশিয়াকে পিষে ফেলতে চাইলেও প্রুশিয়া ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকে। ন্যাপোলিয়ন ক্ষমতায় এসে ১৮০৬ সালে অস্ট্রিয়া এবং প্রুশিয়াকে যুদ্ধে হারিয়ে পুরো Holy Roman Empire-ই বাতিল করে দেন। জার্মান রাজ্যগুলিকে ভাগ ভাগ করে ন্যাপোলিয়ন এই অঞ্চলের ‘Divide and Rule’ নীতিকে নতুন রূপ দেন। কিন্তু তিনি প্রুশিয়াকে ভেঙ্গে ফেলেননি। ন্যাপোলিয়নের প্রধান শত্রু ব্রিটিশরাও ওই মুহুর্তে হয়তো চেয়েছিল যে প্রুশিয়া এক থাকুক, যাতে প্রুশিয়াকে পরবর্তীতে ন্যাপোলিয়নকে আটকানোর কাজে লাগানো যায়। ব্রিটিশ বা ফ্রেঞ্চদের কেউই হয়তো কিছুটা ধারণা করলেও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি যে প্রুশিয়া পরবর্তীতে ইউরোপের ‘জার্মান প্রবলেম’কে আরও কঠিন করবে। নাহলে প্রুশিয়াকে তারা হয়তো এক থাকতে দিতেন না।

Holy Roman Empire ভেঙ্গে দেবার ফলে জার্মান রাজ্যগুলি তাদের অভিভাবক হারায়, আর ফ্রেঞ্চ অধীনে থাকার স্বাদ পেতে শুরু করে। অধীনতা তাদের এর আগেও ছিল; যখন তারা ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত থাকার কারণে ইউরোপের অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলির খেলার গুটি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সেটা ছিল Intellectual Subjugation, যেটা অনেক জার্মানই টের পাননি। ন্যাপোলিয়নের দখলদারিত্ব জার্মানদের একেবারে অন্তরে আঘাত করলো, যা জন্ম দিল ‘জার্মান জাতীয়তা’র। এসময়েই জার্মান জনগণের মাঝে জাতিগত ক্ষোভ প্রকাশ পেতে থাকে। তবে এই ক্ষোভকে পুঁজি করে কেউ নেতৃত্ব দেবার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি তখনও। ১৮০৬-০৭ সালে ন্যাপোলিয়ন জার্মানদের ব্যবহার করে পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ করেন। ১৮১২ সালে ন্যাপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন আর সেই আক্রমণ শেষ হয় বিরাট এক বিপর্যয়ের মাঝ দিয়ে। ন্যাপোলিয়নের সাথে রাশিয়াতে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল ১২৫,০০০ জার্মান সৈন্য। ন্যাপোলিয়নের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে এই বিপর্যয় জার্মানদের মাঝে প্রচন্ড ক্ষোভের জন্ম দেয়। এসময়েই জার্মানদের উপর থেকে ন্যাপোলিয়নের গ্রিপ ছুটে যেতে থাকে। ১৮১৩ সালে ন্যাপোলিয়ন শেষ চেষ্টা করেন জার্মানদেরকে তার অধীনে নিয়ে আসার। লাইপজিগের যুদ্ধে ন্যাপোলিয়ন অস্ট্রিয়া রাশিয়া প্রুশিয়া স্যাক্সনি এবং সুইডেনের সন্মিলিত বিশাল বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে রাইন নদীর পূর্ব তীর ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই যুদ্ধে প্রুশিয়ান এবং জার্মান সৈন্যরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাতে তাদের জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত হয়। ১৮১৪-১৫ সালে ন্যাপোলিয়নের সাথে শেষ যুদ্ধগুলিতেও প্রুশিয়ান-জার্মানরা বিরাট ভূমিকা রাখে। ওয়াটারলু-র যুদ্ধে ন্যাপোলিয়ন শেষবারের মতো পরাজিত হন; সেই যুদ্ধে প্রুশিয়ার জেনারেল গেবহার্ড ভন ব্লুশারের ভূমিকা জার্মানদের বীরগাঁথা হয়ে দাঁড়ায়।

ব্রিটেন-ফ্রান্স-অস্ট্রিয়া-রাশিয়ার হাতে জিম্মি জার্মানরা

কিন্তু ন্যাপোলিয়ন পরবর্তী ইউরোপে ব্রিটেন ফ্রান্স অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া এক চুক্তির মাধ্যমে (কংগ্রেস অব ভিয়েনা, ১৮১৫) ইউরোপকে তাদের নিজের মাঝে Sphere of Influence হিসেবে ভাগ করে নেন। একেক শক্তির নিজস্ব প্রভাব খাটানোর কিছু এলাকা থাকবে, যেখানে অন্যরা নাক গলাবে না। এভাবে প্রুশিয়া সহ বেশিরভাগ জার্মান রাজ্যকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী রাজের অধীনে এনে ‘জার্মান কনফেডারেশন’ গড়ে তোলা হলো। ফলশ্রুতিতে জার্মানরা আবারও অস্ট্রিয়ার রাজার অধীন হলো। মাঝ দিয়ে প্রুশিয়ার যে উত্থান হচ্ছিল, তাকে চাপানোর চেষ্টা চললো। ন্যাপোলিয়নের সময়ে যে ‘জার্মান জাতীয়তা’র জন্ম হয়েছিল, তা ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলির সহায়তায় ক্ষমতায় থাকা রাজন্যবর্গ গায়ের জোরে থামানো চেষ্টা করলো। এই জোর খাটানোর প্রবণতা জার্মানদের জাতীয়তাকে আরও উস্কে দেয়। আর এসময়েই আবারও প্রুশিয়ার উত্থান শুরু হয়। প্রুশিয়ার অর্থমন্ত্রী কাউন্ট ভন বুলাউ বাকি জার্মান রাজ্যগুলির সাথে ১৮১৮ সালে একটা ‘কাস্টমস ইউনিয়ন’ (Zollverein, জলভেরাইন) করলেন, যার মাধ্যমে জার্মান রাজ্যগুলির মাঝে বাণিজ্য এবং যাতায়াতের বাধাগুলি একেবারেই দূর করে ফেলা হলো। বলাই বাহুল্য যে এই চুক্তির মাঝে অস্ট্রিয়াকে রাখা হয়নি। আশ্চর্য্য ব্যাপার হলো ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি তখন এর গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।

লোহার দৈত্যের অংশগুলি জোড়া লাগছে…

ন্যাপোলিয়নের সময় পর্যন্ত জার্মান রাজ্যগুলির মাঝে দিয়ে বেশ কিছু ভালো রাস্তা গিয়েছিল; যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মান ভূমির মাঝ দিয়ে সৈন্য প্রবাহের সুবিধা করা। ন্যাপোলিয়নের পর এই রাস্তাগুলির খুব একটা উন্নত হয়নি। তবুও শক্ত রাস্তা ১৮১৬ সালে ৩,৮০০ কিঃমিঃ থেকে ১৮৫২ সালে ১৬,৬০০ কিঃমিঃ-এ উন্নীত হয়। তবে রাস্তার আর এক বিকল্প হাজির হয়, যা কিনা কাস্টমস ইউনিয়নকে সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়, যা হচ্ছে – রেলওয়ে। ১৮৩৫ সালে জার্মান রাজ্যগুলিতে রেলওয়ে ছিল ৬ কিঃমিঃ, যা ১৮৩৮ সালে হয় ১৪১ কিঃমিঃ; আর ১৮৪০ সালে হয় ৪৬২ কিঃমিঃ; ১৮৬০ সালে হয় ১১,১৫৭ কিঃমিঃ। এই সময়টা ছিল শিল্পোন্নয়নের সময়। জার্মান রাজ্যগুলির সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং শিল্পাঞ্চলগুলি রেলওয়ের মাধ্যমে যুক্ত করে ফেলা হলো। রাইন, দানিয়ুব, এলব, ওডার, ওয়েজার, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নদীপথগুলিকে খালের মাধ্যমে সংযোগ করে আরও উন্নত করা হলো। নদীপথে সমুদ্রের সাথে শিল্পাঞ্চলগুলির যেমন যোগাযোগ সহজ ছিল, তার সাথে রেলওয়ে যুক্ত হবার সাথেসাথে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ব্যাপক উন্নতি হলো। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি হতে থাকলো রাজ্যগুলির; আর একে অন্যের সাথে আর্থসামাজিকভাবে আরও কাছাকাছি আসতে লাগলো। জার্মান সাহিত্যিকরা জাতীয়তাবাদী কবিতা ও গান লিখতে থাকলেন। রাইনল্যান্ডকে ফ্রান্সের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্যে কবিতা রচিত হলো। জার্মান শহরগুলির মাঝে ভ্রমণ বেড়ে গেল। ট্রাভেল গাইড লেখা হলো – কি করে জার্মানির কোথায় ট্রাভেল করা যায়; কোথায় কোন পূরাকীর্তি এবং দর্শনীয় স্থান রয়েছে; কোথায় কোন গুণী ব্যাক্তির কবর রয়েছে, ইত্যাদি। জার্মান একত্রীকরণের গ্রাউন্ডওয়ার্ক এভাবেই হলো। তবে এখানে প্রুশিয়া যে নেতৃত্ব দিচ্ছিলো, সেটা বলাই বাহুল্য। জার্মানরা প্রুশিয়ার কাছাকাছি আসতে থাকলো, আর অস্ট্রিয়ার মাল্টি-কালচারাল পরিচয় থেকে দূরে যেতে থাকলো। এবার শুধু রাজনৈতিক একত্রীকরণের বাকি।
ন্যাপোলিয়নের পতনের পরে ভিয়েনা কনভেনশনের অধীনে 'জার্মান কনফেডারেশন', যা জার্মানদেরকে অস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছিল। এটাই ছিল জার্মান জনসাধারণের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া "বাস্তবতা", যাকে অনেকেই "অপরিবর্তনীয়" বলে ভাবতো। কিন্তু অতি অল্প সময়েই সেই "বাস্তবতা"র পরিবর্তন হয়েছিল। মানচিত্র - হলুদ অংশ অস্ট্রিয়া, নীল অংশ প্রুশিয়া এবং ধূসর অংশ জার্মান রাজন্যবর্গ।


পরাশক্তিদের ভীতির “বাস্তবতা”য় পিছিয়ে যাওয়া…

১৮১৭ সালের ওয়ারটবুর্গ র‌্যালি এবং ১৮৩২ সালের হামবাক ফেস্টিভাল জার্মান জাতীয়তা উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাজন্যবর্গের চাপের মুখে এই আন্দোলনগুলি মুখ থুবরে পরে। ১৮৪৮-৪৯ সালে এই আন্দোলন বেশ শক্তিশালী হয়। ১৮৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের নতুন পার্লামেন্ট নতুন একটা সংবিধান রচনা করতে সক্ষম হয় এবং জার্মানদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে প্রুশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রেডরিক উইলিয়ামকে অনুরোধ করে। কিন্তু ফ্রেডরিক উইলিয়াম অনেক কথা ভেবে নেতৃত্ব নিলেন না। মুখে তিনি বললেন যে সব জার্মান প্রিন্সদের অনুমতি ছাড়া তিনি ক্ষমতা নিতে পারেন না, কিন্তু অন্তরে তার ভয় ছিল যে জার্মানদের নেতৃত্ব নিতে গেলে অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া ক্ষেপে যাবে। ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেসে জার্মানদের উপরে অস্ট্রিয়ার রাজের যে Sphere of Influence জারি রাখার কথা বলা হয়েছিল, সেটার নিশ্চয়তাদানকারী ছিল রাশিয়া। অর্থাৎ বৃহত শক্তিদের তুষ্ট করতেই ১৮৪৯ সালে জার্মানরা এক হতে পারলো না। ভিয়েনা কংগ্রেসের ওই Sphere of Influence যে ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তার একটা মূল স্তম্ভ ছিল জার্মানদের আর ইটালিয়ানদের বিভক্ত রাখা। ফ্রাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্টের কিছু কার্যকলাপের মাঝে কেউ কেউ পরবর্তীতে বিংশ শতকের জার্মান জাতীয়তাবাদের শেকড় খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটা অবশ্য আরেক কাহিনী।

যাহোক, ফ্রেডরিক উইলিয়াম পুরোপুরি দমে যাননি। তিনি ‘এরফুর্ট ইউনিয়ন’ নামে একটা ফেডারেশন তৈরি করতে চাইলেন যেটাতে অস্ট্রিয়াকে বাদ দিয়ে সব জার্মান রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটা ফেডারেশন গঠন করা হবে। এই চেষ্টার কথা শুনে অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া চাপ দিল এবং ১৮৫০ সালে ওলমুতজ নামে এক শহরে বসে ফ্রেডরিক উইলিয়ামকে এই চিন্তা বাদ দিতে বাধ্য করলো। জার্মানরা অনেকেই এই চুক্তিকে ‘ওলমুতজের অপমান’ বলে ডাকে। তবে এরফুর্ট আর ওলমুতজের চুক্তিগুলি সবাইকে বুঝিয়ে দিল যে জার্মানদের আর আলাদা করে রাখা সম্ভব হবে না; জার্মান একত্রীকরণ এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/7/72/BismarckRoonMoltke.jpg
বিসমার্ক, ভন রুন এবং ভন মল্টকা - এই তিনজন প্রুশিয়ান স্টেটসম্যান জার্মান একত্রীকরণে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৮৫৭ থেকে ১৮৭১ সালের মাঝে ইউরোপের ততকালীন বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করে তারা ইউরোপের তথা বিশ্বের ইতিহাসে বিরাট পরিবর্তন সাধন করেন।


১৮৫৭-১৮৭১ - পরাশক্তিদের ঘুমিয়ে থাকার সুযোগে “বাস্তবতা” পরিবর্তন

ইউরোপের রাজনীতি তখন নিয়ন্ত্রণ করতো ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া আর রাশিয়া। ১৮৫৪-৫৫ সালের ক্রিমিয়ার যুদ্ধ আর ১৮৫৯ সালের ইটালিয়ান যুদ্ধ (ইটালির দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ) ইউরোপের নেতৃত্বে থাকা এই দেশগুলির সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এই বিশৃংখলার সময়টাতেই প্রুশিয়ায় কিছু বড় পরিবর্তন সাধিত হয়, যা কিনা জার্মানির ফাউন্ডেশন গড়ে দেয়। ১৮৫৭ সালে প্রুশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রেডরিক উইলিয়ামের স্ট্রোক হয়, যার কারণে তিনি দেশ চালাতে অক্ষম হয়ে পড়েন। তার স্থানে আসেন তার ভাই, যিনি নাম নেন রাজা প্রথম উইলহেলম। নতুন রাজা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ দেন – ১৮৫৭ সালে হেলমুথ ভন মল্টকা-কে তিনি প্রুশিয়ান আর্মির চীফ অব জেনারেল স্টাফ নিয়োগ করেন, যিনি প্রুশিয়ান আর্মির অপারেশনাল কর্মকান্ড পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলেন; ১৮৫৯ সালে আলব্রেখট ভন রুন-কে নিয়োগ দেন যুদ্ধ মন্ত্রী হিসেবে, যিনি প্রুশিয়ান আর্মির ম্যানেজমেন্টে বিরাট পরিবর্তন আনেন; আর সর্বশেষ ১৮৬২ সালে নিয়োগ দেন অটো ভন বিসমার্ক-কে মিনিস্টার-প্রেসিডেন্ত হিসেবে (প্রধানমন্ত্রী), যিনি কূটনীতির মাধ্যমে তিনটি যুদ্ধের সূচনা করেন, যা কিনা জার্মান সাম্রাজ্যের জন্ম দেয় ১৮৭১ সালে। ১৮৫০ সালের পর থেকে ইউরোপের ততকালীন পরাশক্তিরা সত্যিকার অর্থেই ঘুমাচ্ছিল।

বিসমার্ক কূটনীতির মাধ্যমে তিনটি যুদ্ধের জন্ম দেন এবং জার্মানরা ভন রুন-এর মিলিটারি মডার্ননাইজেশন এবং মল্টকা-র উন্নততর স্ট্র্যাটেজির কারণে তিনটিতেই জয়লাভ করে। Bolt Action রাইফেল প্রুশিয়ান সৈন্যদের হাতে দেয়া হয়, যা বাকি ইউরোপের Muzzle-Loading রাইফেলের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। শিল্পোন্নয়নের সাথে সাথে প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্রুশিয়ান আর্মি হয়ে ওঠে ইউরোপের সেরা। –

- ১৮৬৪ সালে ডেনমার্কের সাথে প্রুশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ হয়। এর মাধ্যমে স্ক্লেসউইগ এবং হোলস্টাইন রাজ্যদু’টি প্রুশিয়া এবং অস্ট্রিয়া ডেনমার্কের কাছ তেকে দখল করে নেয়।

- ১৮৬৬ সালে স্ক্লেসউইগ এবং হোলস্টাইন প্রদেশ নিয়ে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধের জন্ম দেন। এই যুদ্ধে প্রুশিয়া জয়ী হয়ে দু’টো প্রদেশই লাভ করে। এই যুদ্ধে হেরে অস্ট্রিয়া চিরকালের জন্যে জার্মান রাজ্যগুলিকে হারায়। যুদ্ধের সময়ে বেশিরভাগ জার্মানরা বিসমার্কের আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা করে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকে।

- ১৮৬৬ সালের যুদ্ধের সময় ফ্রান্স চেয়ে চেয়ে দেখছিল এবং দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল। ১৮৭০ সালে বিসমার্ক এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন যে ফ্রান্স নিজেই প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিল। এর ফলে সব জার্মানরা একত্রিত হয়ে প্রুশিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রুশিয়ার নেতৃত্বে জার্মান সৈন্যরা ফ্রান্সকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে রাজধানী প্যারিস দখল করে ফেলে।

- ১৮৭১ সালের ১৮ই জানুয়ারী ফ্রান্সের ভার্সাই প্যালেসে সগৌরবে জার্মান সাম্রাজ্যের ঘোষণা দেয়া হয়। ফ্রান্সের উপরে জার্মান বিজয়ের ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পতন হয়ে তৃতীয় ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকের গোড়াপত্তন হয়। অর্থাৎ ফ্রান্সের “বাস্তবতা”ও পরিবর্তিত হয়ে যায়।

জার্মান অর্থনীতি ইউরোপের অন্যান্য দেশের জন্যে হুমকি তৈরি করে শুরু থেকেই। ব্রিটেন দু’টা পণ্যের উপরে নির্ভর করে বিরাট অর্থের পাহাড় গড়েছিল, যেগুলি জার্মানির শিল্প বিপ্লবের কারণে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়; এর একটি হলো নীল (Indigo) আর আরেকটি হলো গানপাউডার। ব্রিটেনের জন্যে এই দু’টোই আসতো তাদের ভারতীয় উপনিবেশ থেকে। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স তাদের উপনিবেশে জোরপূর্বক বিক্রি করার জন্যে পণ্য তৈরি করতো; তাই তাদের পণ্যের মান ছিল খুবই নিম্ন। অন্যদিকে জার্মানির উপনিবেশ ছিল না প্রথমে (পরেও খুব কমই ছিল), তাই জার্মান পণ্য প্রথম থেকেই ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের। জার্মানদের প্রযুক্তিগত উতকর্ষ সেই থেকেই জানান দিচ্ছিলো যে তারা ইউরোপে বিরাট এক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। আর শত শত বছর ধরে শক্তিধর দেশগুলির স্বার্থে বিভক্ত থেকে জার্মানদের মাঝে যে কঠিন জাতীয়তা জন্ম নিয়েছিল, সেটার ফলাফল ইউরোপ কেন, পুরো দুনিয়ার জন্যেই ভালো হয়নি। শত বছরের শোষণ এবং বঞ্চনাকে জার্মানরা কড়ায়-গন্ডায় উঠিয়ে নিতে চেয়েছে বারংবার। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর এই চেষ্টাকে ব্রিটেন-ফ্রান্স যখন পুরোপুরি হত্যা করতে চেয়েছিল, তখন সেটা আরও বেশি উগ্র হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়।
https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/7/7c/Napoleon_III_Otto_von_Bismarck_%28Detail%29.jpg
১৮৭০ সাল। ফ্রান্সের রাজা তৃতীয় ন্যাপোলিয়ন (বাঁয়ে) বিসমার্কের কাছে তার তরবারি তুলে দিয়েছেন আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে। ১৮১৫ সালেও যেখানে জার্মানদের টিকিটাও ছিল না, সেখানে ১৮৭০ সালে প্যারিস তাদের দখলে। মাত্র ৫৫ বছরে ইউরোপের "বাস্তবতা" পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়, যা কিনা অনেকেই একসময় মনে করতো "অপরিবর্তনীয়"।

“বাস্তবতা” পরিবর্তনে কত বছর লাগে?

ন্যাপোলিয়নের পরাজয় ১৮১৫ সালে। তখনও জার্মান জাতির একত্রিত হবার চিন্তা আঁতুর ঘরেই ছিল। এমনকি ১৮৫০ সালেও জার্মান একত্রীকরণের চেষ্টা করতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষই মনে করেছিল যে বৃহত শক্তিদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একত্রীকরণ সম্ভব হবে না। এমনকি ১৮৬৬ সালে অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধেও বেশিরভাগ জার্মান মনে করেছিল যে প্রুশিয়ার সাথে তাদের যাওয়াটা ঠিক হবে না। কতবড় ভুল ছিল এই হিসেবে! মাত্র চার বছরের মাথায় ১৮৭০ সালে প্যারিস ছিল জার্মানদের দখলে আর পরের বছর জানুয়ারীতে ইউরোপের সবচাইতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে জার্মানির আবির্ভাব। জার্মানির কারণে শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আক্রমণে ফ্রান্স-ব্রিটেন বিধ্বস্ত হবার পরে দুনিয়ার কর্তৃত্ব আমেরিকার হাতে চলে যায় – যা কিনা বর্তমানের ইতিহাস গড়েছিল। জার্মানির জন্ম তাই ততটাই গুরুত্বপূর্ণ; জার্মানির জন্ম ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা কিনা ততকালীন বিশ্বের “বাস্তবতা”কে পরিবর্তন করে ফেলেছিল। এই “বাস্তবতা”র পরিবর্তন হতে কত সময় লেগেছিল? সেটাই একটু হিসেব কষা যাক।

১৮১৫ সাল থেকে ১৮৭১ হলো মাত্র ৫৫ বছর; আর ১৮৫০ থেকে ১৮৭১ হলো মাত্র ২১ বছর; আর ১৮৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল মাত্র ৪ বছর! ইতিহাস পরলে বোঝা যায় যে এই সময় কতটা ছোট। ভারত এবং পাকিস্তানের বয়স ৬৯ বছর; বাংলাদেশের বয়স ৪৫ বছর। তাহলে এই সময়গুলির সাথে আমরা যখন জার্মান একত্রীকরণের পুরো প্রসেসখানার তুলনা করি, তখন যেটা বুঝি তা হলো অত্যন্ত অল্প সময়ে বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। মাত্র ৫৫ বছরে; মানে একজন মানুষের জীবদ্দশাতেই ইউরোপের মানচিত্র এবং ব্যালান্স অব পাওয়ার পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। কি মনে করছেন – ১৮৭১ সাল বহু আগের কথা? আজকের দুনিয়া আলাদা? আজকের দুনিয়ার “বাস্তবতা” আলাদা? একটু চিন্তা করে দেখুন তো – চেকোশ্লোভাকিয়া নামে একটা দেশ ছিল না? সেটা আজ কোথায়? যুগোশ্লাভিয়া নামের দেশটা কোথায়? কসভো নামে তো কোন দেশই কিছুদিন আগেও ছিল না। এরিত্রিয়া, সাউথ সুদান, ইস্ট তিমর? কত তাড়াতাড়ি মানচিত্র পরিবর্তিত হয়ে যায়; পট পালটে যায় চোখের পলকে, যদিও সবাই আমরা মনে করি আজ যেটা আছে এটাই থাকবে – হয়তো চিরকালই থাকবে। খুব ভালোভাবেই জানি যে চিরকাল না থাকাটাই স্বাভাবিক; থাকলেই বরং অস্বাভাবিক। তারপরেও সেটাই ভাবতে থাকি; কেন ভাবি সেটাও জানি না; এই ভাবাভাবির কোন ভিত্তিও তো নেই। কিন্তু কেন এই ভিত্তিহীন চিন্তা? কেন এটা ভাবি যে যেটা আজ আছে, সেটা কালও থাকবে? পরশুও থাকবে? এর পরের দিনও? আমাদের বাপ-দাদারা কি জন্মসূত্রে বাংলাদেশী? না-তো! ১৯৭১ সালের আগে তো বাংলাদেশই ছিল না। তারা তো পাকিস্তান বা ব্রিটেনের নাগরিক – জন্মসূত্রে!! কি আশ্চর্য চিন্তাহীন আমাদের এই অবস্থান তাই না? অথচ আমরা এই চিন্তাহীন অবস্থানে থেকেই মনে করতে থাকি যে আমরা অনেক বুদ্ধি রাখি এবং আমরা “মডার্ন” এবং “এগিয়ে যাচ্ছি”। এটাই হচ্ছে আমাদের “বাস্তবতা”, যাকে আমরা এতটাই ভালোবাসি যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেটা নিয়েই পড়ে থাকি।

আমাদের “বাস্তবতা”কে আমরা চ্যালেঞ্জ করি না কেন?

জার্মান জাতীয়তাবাদের গুণগান গাওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং এই ঘটনাপ্রবাহ আমাদের যা বলে তা হলো – “বাস্তবতা” হলো মানুষের মনের সৃষ্টি, যা সে নিজের জন্যে তৈরি করেনা; তৈরি করে অন্যের জন্য, যাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। “বাস্তবতা”র “অপরিবর্তনীয়তা”কে পুঁজি করেই নিয়ন্ত্রকেরা নিয়ন্ত্রণে থাকে। যতক্ষণ জনগণ “বাস্তবতা”কে “অপরিবর্তনীয়” মনে করে, ততোদিন সে এই “বাস্তবতা”র ঘোর থেকে বের হতে পারে না। নিয়ন্ত্রিত জনগণ যখন “বাস্তবতা”কে চ্যালেঞ্জ করে, তখন সেটা দৌড়ে পালায় এবং পরিবর্তন সাধিত হয়। দাসত্বের শৃংখল-মুক্ত হতে প্রথম কাজই হলো “বাস্তবতা”কে চ্যালেঞ্জ করা; “বাস্তবতা”র সাথে আপোষ করা নয়।

বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল কবে? ১৯৭১ সালে? না তো! তাহলে বাংলাদেশের জন্ম কি মানচিত্র ছাড়াই হয়েছিল? তা-ও তো না। তাহলে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পতাকার মাঝে যে মানচিত্রটি ছিল, সেটা কোন দেশের মানচিত্র? তাহলে দেশের জন্মের আগেই দেশের মানচিত্রের জন্ম? সেটা কি করে সম্ভব? সেটাও সম্ভব, যদি আমরা মেনে নিয়ে থাকি যে বাংলাদেশের মানচিত্র হলো সেই দেশের মানচিত্র, যে দেশ থেকে বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে জন্ম নিয়েছিল – তার মানে পাকিস্তান। তাহলে ১৯৭১ সালে আমরা পতাকার মাঝে যে দেশের মানচিত্র রেখেছিলাম সেটা কি পাকিস্তানের মানচিত্র ছিল? সেই মানচিত্র এঁকেছিলেন কে? মাউন্টব্যাটেন এবং র‌্যাডক্লিফ। এঁনারাই পাকিস্তানের মানচিত্র বানিয়েছিলেন, যে মানচিত্র আমরা বাংলাদেশের পতাকার মাঝেও রেখেছিলাম। বলাই বাহুল্য যে ১৮৭১ সালে জার্মানির জন্ম হলেও জার্মানির মানচিত্র কিন্তু বহুবার পরিবর্তন হয়েছে। পোল্যান্ডের মানচিত্র বহুবার পরিবর্তন হয়েছে; অস্ট্রিয়ারও তাই; ইটালিরও তাই। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বহুবার পরিবর্তন হয়েছে। জার্মান মানচিত্র শেষ পরিবর্তন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে জার্মানির পূণ-একত্রীকরণের সময়ে। এর অর্থ হলো একটা দেশের জন্মের সাথে এর রাজনৈতিক মানচিত্র সারাজীবনের জন্যে fixed না-ও হয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক মানচিত্র মাটি-বালু-পানির উপরে কল্পিত কিছু দাগ মাত্র – এগুলি মহাকাশে স্যাটেলাইট থেকে দেখা যায় না কোনদিনই।

“বাস্তবতা”কে চালেঞ্জ করার মাঝেই মুক্তি…

ঠিক এই ভয়টাই দিল্লীতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোক পেয়ে থাকেন, যখন বাংলাদেশের সুবোধ শিশুরা মানচিত্র অংকন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট করে এঁকে ফেলে। আমাদের কাছে এটা নিতান্তই শিশুতোষ ভুল হলেও দিল্লীর চিন্তাবিদদের তখন হার্ট এটাক হয়ে যায়। তারা এর মাঝে ভারতের integrity এবং অস্তিত্বের হুমকি দেখেন। বাংলাদেশের বাইরে ভারতই একমাত্র দেশ যাদের বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে হয়; বাংলাদেশের মানচিত্র না আঁকলে ভারতের মানচিত্র আঁকা হয় না। আর এটাই আসল বাস্তবতা – যা আমরা দেখি না। আমরা শুধু দেখি সেটাই, যা আমাদের মুখে তুলে দেয়া হয়।

আমাদের নিজেদের intellectual subjugation-এর যে কথা এর আগে বলেছি, সেটা থেকে বের হবার পথে “বাস্তবতা”কে চ্যালেঞ্জ করতেই হবে। আর সেখানেই রয়েছে মুক্তি।

Saturday 25 June 2016

বাংলাদেশের “মিরাক্কেল”-এর উপরে টিকে আছে ভারত?

২৬শে জুন ২০১৬

http://www.thedailystar.net/sites/default/files/customphp/photo/2010/08/14/2010-08-14__si02.jpg
বাংলাদেশের কোন "মিরাক্কেল"-এর জন্যে ভারত বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ? আর এই "মিরাক্কেল" কি চিরস্থায়িত্ব পাবে?


ভূরাজনীতির ভাষাগুলি একটু অন্যরকম। এই ভাষা কিছু চিন্তার উপরে প্রতিষ্ঠিত, যা কিনা সাধারণ মানুষের কাছে উদ্ভট ঠেকে। এরকম ঠেকার কারণ সাধারণ মানুষ “বাস্তবতা”র জঞ্জাল থেকে বের হয়ে চিন্তা করতে পারে না। তারা এ-ও ভাবতে পারে না যে “বাস্তবতা” আসলে তৈরি করা একটা ভূবন, যা যেকোন সময়েই পরিবর্তিত হতে পারে। মানুষের মাঝে বাস্তবতার স্থায়িত্বকালকে চিরস্থায়িত্ব দেয়াতেই শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার আসল ভিত্তি। যা-ই হোক, ভূরাজনীতির ভাষায় বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করতে গেলে কিছু ব্যাপার সামনে আসবে যা কিনা সাধারণ মানুষ দেখবে না, অথবা তৈরি করা বাস্তবতার মারপ্যাঁচ থেকে বের হতে না পেরে আসল অবস্থা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে না।

আমরা প্রথমে দেখে নিই যে সাধারণ মানুষ কি দেখে। ভারত বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে কি কি কারণে? সাধারণ মানুষ এর উত্তর কিভাবে দেবে? তারা ভাববে, ভারত কৃতজ্ঞ থাকবে, কারণ –

১. বাংলাদেশ ভারতকে ফারাক্কা ব্যারাজ বানাতে দিয়েছে এবং চার দশক ধরে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের পরেও কঠিন কোন কূটনীতির আশ্রয় নেয়নি। ফারাক্কা ব্যারাজের উপরে ভিত্তি করে কৃত্রিম স্থানে ব্রিটিশদের তৈরি কোলকাতা বন্দর টিকে আছে; কোলকাতা বন্দরের উপরে টিকে আছে ভারতের পূর্বাংশ। শুধু ফারাক্কাই নয়, তিস্তাসহ পঞ্চাশোর্ধ অভিন্ন নদীর উপরে ভারত বাঁধ দিয়েছে, অথচ বাংলাদেশ কিছুই বলেনি ভারতকে।

২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুগ যুগ ধরে চলা ভারতের subversion-এর কোন প্রতিবাদ বাংলাদেশ করেনি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারত বুদ্ধিজীবি, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া কর্মী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এনজিওকর্মী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞাপণ নির্মাতা, অনলাইন একটিভিস্ট, ব্যাবসায়ী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ইত্যাদি সেক্টরে হাজার হাজার এজেন্ট তৈরি করেছে তাদের এই subversion-কে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্যে। বাংলাদেশ এগুলির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ তো নেয়ই নি, বরং মেনে নিয়েছে এবং সহায়তা করেছে ভারতীয়দের।

৩. ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে ফেন্সিডিলের কারখানা বসিয়ে সেখানে তৈরি ফেন্সিডিল বাংলাদেশে পাঠিয়ে এদেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে শক্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

৪. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র পাঠিয়ে দেশের ভিতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে ভারত। কিন্তু বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের অস্ত্র, ট্রেনিং এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে এদেশকে ভাগ করতে চেয়েছে ভারত। বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে কিছু করেনি।

৬. বাংলাদেশের পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে গিয়ে প্রচুর বাধার সন্মুখীন হয়েছে সর্বদা। অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেই গিয়েছে। ভারত যখন তখন চাল, পিঁয়াজ এবং গরু রপ্তানি আটকে দিয়ে বাংলাদেশকে ব্ল্যাকমেইল করেছে, তবুও বাংলাদেশ ভারতকে বন্ধু ভেবেই গেছে; কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

৭. বাংলাদেশে ভারতের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত মানুষের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের জন্যে পঞ্চম বৃহত্তম রেমিট্যান্সের উৎস। ভারতের এক্সিকিউটিভরা বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করলেও বাংলাদেশ কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

৮. সীমান্তে বিএসএফ নিয়মিত গোলাগুলি করে এদেশের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে, অথচ বাংলাদেশ এব্যাপারে কঠোর হবার চেষ্টাই করেনি।

৯. বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতের ব্যাপক subversion চালানো সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভারতের সামরিক বাহিনীর সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেছে।

১০. ভারত সর্বদাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে subversion ব্যবহার করে দেশের সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছে; বাংলাদেশ কিছুই বলেনি।

১১. প্রতি বছর বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ভারতে ট্যুরিজম ও চিকিতসার জন্যে গিয়ে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করছে।

১২. বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্কের কারণে ভারত তার বেশিরভাগ সামরিক শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোতায়েন রাখতে পারছে।

১৩. বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ ভারতীয় জেলেরা চুরি করে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করেছে।

১৪. বাংলাদেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি তৈরি করে সেটা নিয়ে ভারত বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এটা কঠিনভাবে নেয়নি কখনোই, যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নাক গলানোর একটা অধিকার আমরাই দিয়েছি।

১৫. উপরের এতকিছুর পরেও বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে; তা-ও আবার বিনে পয়সায়। সেই ট্রানজিটের জন্যে দরকারি বিনিয়োগও বাংলাদেশ ঋণ নিয়ে করছে। অর্থাৎ ভারতকে ট্রানজিট দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ঋণে জর্জরিত হচ্ছে।

ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি… এই লিস্ট আরও অনেক বড় করা সম্ভব। কিন্তু এগুলি জিওপলিটিক্সের ভাষায় কিছুই নয়। সেই ভাষায় অনেক খবরই খবর নয়; আবার অনেক ব্যাপারই খবর হওয়ার কথা না থাকলেও সেটা গুরুত্বপূর্ণ খবর। বিশেষ একটা দিক থেকে দেখা হয় বলেই সাধারণের সাথে এই পার্থক্য। একটা উদাহরণ দেয়া যায়, যা বোঝা সহজ – নভেম্বর মাসে বৃষ্টি হলেও বলা যায় যে এই বৃষ্টি স্থায়ী হবে না, কারণ এই ঋতুতে যে বৃষ্টি হয়না, সেই তথ্য জানা রয়েছে। আবার জুলাই মাসে বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টি যে চলতে পারে কয়েকদিন ধরে, সেটা মোটামুটিভাবে বলা যায়, কারণ তথ্যটা জানা যে এই ঋতুতে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়। এই তথ্যই মানুষকে একটা বিশেষ দিক থেকে চিন্তা করায়। এই তথ্য না থাকলে তার আবহাওয়ার পূর্বাভাষ ঠিক হবে না। ভূরাজনীতিও সেরকমই। কিছু বিশেষ তথ্য একটা বিশেষ দিক থেকে মানুষকে চিন্তা করাবে। তাই সাধারণভাবে যেই equation মিলে না, সেটা তখন মোটামুটি সহজেই মিলে যাবে।

ভূরাজনীতির ভাষায় চিন্তা করলে আমরা দেখি যে, ভারত মূলত যেকারণে বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে, তা হলো –

- বাংলাদেশ ভারতের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। ভারতের সবচাইতে বড় ভয় হলো তার ভৌগোলিক অখন্ডতা থাকবে কি থাকবে না। বহু ভাষা, গোত্র, বর্ণ, ধর্ম এবং জাতীয়তার ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশ সর্বদা এই ক্ষেত্রে ভারতের integrity-কে “নিরবে” সন্মান করে গেছে। একবারের জন্যেও ভারতের অখন্ডতা নিয়ে বাংলাদেশ কোন “প্রকাশ্য বিবৃতি” দেয়নি। ভারতের সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি এবং মানবাধিকার লংঘন নিয়ে বাংলাদেশ কোন উদ্বেগ জানায়নি কখনোই। বাংলাদেশ সাহায্য না করলে ভারতের পক্ষে তাদের অনেকগুলি প্রদেশ টিকিয়ে রাখা কঠিন হতো। এমনকি ভারতের সমস্যায় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকলেও ভারতের বিপদ হয়ে যেত। আর একবার ভারতের একটা রাজ্য আলাদা হয়ে গেলে বা কোন ধর্মীয় বা বর্ণভিত্তিক কোন গোত্র বিদ্রোহ করে বসলে সেটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তো। অর্থাৎ ভারতের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যেত। বাংলাদেশ কখনোই ভারতের অস্তিত্বের বিপক্ষে কাজ করেনি। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতের জন্যে সবচাইতে বড় উপহার। এর জন্যেই ভারত বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। বাংলাদেশের দয়ার উপরে বেঁচে আছে ভারত। এটাই হচ্ছে সেই “মিরাক্কেল”, যার কারণে এত শত বিভক্ত ভারত এখনো এক খন্ডে রয়েছে। আর ভারত সরকার আশা করবে যেন এই “মিরাক্কেল” কখনোই বন্ধ না হয়; বাংলাদেশের মানুষের এই দয়া যে শেষ না হয় কখনোই; তারা যেন দয়া করে যেতেই থাকে; যেতেই থাকে; যেতেই থাকে।

ভূরাজনীতির ভাষা এমনই। যেসব তথ্য এবং খবর উপরে বর্ণিত এই বিশেষ দিকটির কাছ দিয়ে যাবে, সেটা ভূরাজনীতির জন্যে খবর; যেগুলি ধারেকাছে থাকবে না, সেগুলি তেমন গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়।

পশ্চিমা ভূরাজনীবিদেরা আগামী কয়েক দশকের পূর্বাভাষ দিতে গিয়ে ভারতকে শক্তিশালী* দেশের তালিকায় রাখেননি। এর কারণ তারা মনে করেননা যে অভ্যন্তরীণভাবে এতটা দুর্বল একটি দেশ** সামনের দিনের বাস্তবতায় টিকে থাকতে পারবে। প্রতিবেশীদের subversion-এর মুখে পড়লে ভারতের যে টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, তা তারা বুঝতে পারছেন বলেই ভারতকে তারা সামনের দিনগুলিতে গোণায় ধরছেন না। এখন যেটা প্রশ্ন, তা হলো কি দেখে ভূরাজনীতিকেরা মনে করছেন যে ভারতের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে? তারা যেই চশমাটা দিয়ে দেখছেন, তা তাদের দেখাচ্ছে যে ভারতের প্রতিবেশীরা তাদের দীর্ঘদিনের intellectual subjugation থেকে মুক্ত হবার দ্বারপ্রান্তে। ভারতের অস্তিত্বের “মিরাক্কেল”-এর আয়ু শেষ! আটলান্টিকের ওপাড়ের বড়ভাইও তাকে বাঁচাতে পারবে না। এটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

*পড়ুনঃ “শক্তিশালী ভারতের ভয়” – সাম্প্রতিক দেশকাল, ০১ অক্টোবর ২০১৫
**পড়ুনঃ “চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র” – সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৬ জুন ২০১৬


Thursday 9 June 2016

বিংশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে রাস্তা তৈরির সাথে আমাদের সম্পর্ক কোথায়?



০৯ জুন ২০১৬


এক মার্কিন লেখকের বইয়ে পড়ছিলাম, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর মোটরগাড়ি শিল্পের উন্নতির সাথেসাথে যুক্তরাষ্ট্রের জেলাগুলির মাঝে দূরত্ব কমে গেল’। এই বাক্যটি থেকে আমরা কি কি পাই? চলুন এক ধরনের ভাব সম্প্রসারণের চেষ্টা করা যাক।

প্রথমতঃ যুক্তরাষ্ট্র রাস্তার উপরে নির্ভরশীল দেশ। মোটরগাড়ির ব্যাপক প্রসারের পর থেকেই দূরত্ব কমেছে যুক্তরাষ্ট্রে। মোটরগাড়ি যেহেতু রাস্তা দিয়ে চলে, তাই সেখানে একইসাথে কয়েক লক্ষ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। তার মানে দেশটির বিশালত্বের কারণে যে দূরত্ব, তা কমানোর জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে রাস্তা তৈরি করতে হয়েছিল। রেল আরও আগে থেকেই ছিল বটে, কিন্তু একথার মানে দাঁড়ায় যে রেল দেশের সকল স্থানকে যুক্ত করতে পারেনি, যেটা রাস্তা করেছিল। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থায় রাস্তার গুরুত্ব বাড়তে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এবং রাস্তার উপরেই সেদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার নির্ভরশীলতা তৈরি হলো ওই সময় থেকেই।

দ্বিতীয়তঃ রেল যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ওঠায়নি। যেহেতু কথাটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের সময় নিয়ে, তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে এর কিছুদিন আগেও, ঊনিশ শতকেও (যখন গাড়ির প্রচলন হয়নি তেমন) সেদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ খারাপই ছিল। রাজ্যগুলি এবং জেলাগুলিকে একত্রিত করার খুব সহজ একটা উপায় ছিল না তাদের কাছে। এটা বুঝতে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না, শুধু ম্যাপে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল আকৃতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

http://static2.tripoto.com/media/filter/medium/img/15546/TripDocument/indian_railway_passengers.jpg
ভারতে রেল ডেভেলপ করলেও পাকিস্তানে একেবারেই করেনি। পাকিস্তানে ডেভেলপ করেছিল রাস্তা আর গাড়ির বাজার।

তৃতীয়তঃ যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতে কিন্তু রাস্তা তৈরি হয়নি; তৈরি হয়েছে রেল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের হয়ে আমাদের কাছাকাছি আসা যাক – একেবারে ভারতীয় উপমহাদেশে। ভারতে এখনও পৃথিবীর সবচাইতে বিশাল রেল নেটওয়ার্কগুলির একটি রয়েছে। এটা কি ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে তৈরি হয়েছিল? হয়তো অনেকটা তা-ই; কিন্তু এর মূল যে ব্রিটিশ আমলে গাঁড়া হয়েছে, সেটা কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া রেল নেটওয়ার্ক আমরা বাংলাদেশেও দেখি। ১৯৪৭ সালে যা রেল নেটওয়ার্ক ছিল, তার থেকে আমরা কিন্তু খুব কমই বাড়িয়েছি। আমরা বলি যে সেটা আমরা বাড়াতে পারিনি, কিন্তু আসলে বাড়াতে পারিনি, নাকি বাড়াইনি, সেটা একটু পরই আলোচনা করবো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কি ভারত গাড়ি দিয়ে ছেয়ে গিয়েছিল? অবশ্যই না; কারণ এটা ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ; এখানকার ‘দাস’দের মাঝে কয়জন গাড়ি কিনতে পারবে? ঠিক! তার মানে এখানে গাড়ির বাজার তেমন একটা ছিল না। প্রাইভেট কার তো খুব কম সংখ্যক হবে; ট্রাক-বাস কি সমস্যা করলো তাহলে? ট্রাক-বাস-সহ অন্যান্য গাড়ির বাজার এখানে থাকলে কি ব্রিটেনের লাভ হতো না? সেখানেই আসল প্রশ্ন। ব্রিটেনে তৈরি পণ্য কিন্তু ভারতেই বিক্রি হতো। কাজেই ব্রিটেনে গাড়ি তৈরির বড় শিল্প থাকলে সেই পণ্য ব্রিটেন এখানে বিক্রি করে লাভ করবে না – এটা কিভাবে হয়? আসলে নিজেদের দেশে গাড়ির শিল্প তেমন গড়ে না ওঠায় ব্রিটিশরা তাদের ভারতীয় উপনিবেশে গাড়ির বাজার ‘ডেভেলপ’ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের মতোই বিশাল হওয়া সত্ত্বেও ভারতে কিন্তু যোগাযোগের ব্যাপারে গাড়ি বিরাট ভূমিকা পালন করেনি। ব্রিটিশরা ‘কম খরচের’ রেলকেই এখানে জারি রেখেছিল। তবে সবচাইতে কম খরচের নৌপথকে ধ্বংস করতে কিন্তু ভুলে যায়নি, যা নিয়ে এর আগেই অনেক লিখেছি

চতুর্থতঃ ভারতের মতো পাকিস্তানে কিন্তু রেল ডেভেলপ করেনি। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে যাবার পরেও নতুন দেশ ভারতে কিন্তু রেলের ব্যবহার কমেনি একবিন্দু, বরং সেই গুরুত্ব এখনও জারি আছে। তাহলে পাকিস্তান কি দোষ করলো? সেখানে কেন রেল গুরুত্বপূর্ণ হলো না? পূর্ব বাংলায় না হয় নদীর সংখ্যা বেশি ছিল, কিন্তু এই যুক্তি তো পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সাজে না? সেখানে কেন রেল পাত্তা পেল না? কেন আজও পাকিস্তানে ৯৬% পরিবহণ রাস্তা দিয়ে হয় এবং কেন মাত্র ৪% রেল দিয়ে হয়? যেখানে আমরা জানি যে রেল কতটা সাশ্রয়ী।

https://s-media-cache-ak0.pinimg.com/736x/7d/ed/2b/7ded2bfc2906f0de3c8770b57e10037e.jpg
১৯৬১ সালে ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পাকিস্তানে আসেন। আইয়ূব খান রাণীকে রাস্তায় ঘোরান ঠিকই, কিন্তু সেটা তিনি করেন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ক্যাডিলাক গাড়িতে করে। বুঝতে বাকি থাকেনা যে দুনিয়ার চাবির হাতবদল হয়েছে।

পঞ্চমতঃ পাকিস্তানে মার্কিন গাড়ি বাজার পেয়েছিল; ভারতে পায়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে ভারতে গাড়ি তৈরি হলো ব্রিটিশ ডিজাইনের Ambassador, আর পাকিস্তানে পাওয়া গেল মার্কিন ডিজাইনের যত গাড়ি সম্ভব সব। ব্রিটিশ ডিজাইনের গাড়ি কিন্তু ভারতেই তৈরি হতে লাগলো; ব্রিটিশরা ভারতে গাড়ি বিক্রির ব্যবসা তেমন করতে পারেনি। অন্যদিকে পাকিস্তানের কথা কিন্তু আলাদা। তারা ভারতের মতোই ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়া সত্ত্বেও গাড়ি তৈরি করা দূরে থাক, তাদের রাস্তা আমদানি করা মার্কিন গাড়ি দিয়ে ভরে গেল। এটা কি কোন কাকতালীয় ব্যাপার ছিল? অবশ্যই না।

ষষ্ঠতঃ পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ১৯৪৭ সালের পর ব্রিটেন থেকে পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের তূলার উপরে নির্ভর করে ব্রিটিশ টেক্সটাইল শিল্প গড়ে উঠেছিল, যার বাজার ছিল ভারতে। আবার ভারতীয় উপমহাদেশে (প্রধানত পূর্ব বাংলায়) উতপাদিত পাটের উপরে নির্ভর করে ব্রিটেনের ডান্ডি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল পাটের শিল্প। পশ্চিম বাংলায়ও পাটের শিল্প গড়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলার পাটের উপরে নির্ভর করে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ব্রিটেন এই এলাকায় তার কাপড়ের ব্যবসার অনেকটাই হারায়। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে ওঠে তূলা-সূতা-টেক্সটাইল শিল্প আর পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠে পাটের শিল্প সাথে কিছু টেক্সটাইলও। এর ফলশ্রুতিতে ব্রিটেনে ডান্ডির পাটের কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের পাকিস্তান অংশের সাথে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক যোগাযোগের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায় এভাবে। অর্থাৎ পাকিস্তান ব্রিটেন থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়, কিন্তু সেটা কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে ঘটেনি।

সপ্তমতঃ ভারত ভাগের সাথে সাথে ব্রিটেন তার ভারতীয় ব্যবসা আরেকজনের কাছে হারায়। ১৯৪৭ সালের আগে পাকিস্তানের (যুক্ত পাকিস্তানের) মানুষ রান্না করার সময় তেল ব্যবহার করতো না? অবশ্যই করতো। সেটা কি সয়াবিন তেল ছিল? সেখানেই প্রশ্ন। পাকিস্তান আমলেই এদেশে খাবার তেলের ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকে। বলাই বাহুল্য যে সয়াবিন তেল যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য। ব্রিটিশদের কিন্তু কোন খাবার তেলের ব্যবসা ছিল না। উপরে বলেছি যে তাদের ব্যবসা ছিল টেক্সটাইল আর পাটের। ঊনিশ শতক পর্যন্ত ব্রিটিশদের আরও কয়েকটি ব্যবসা ছিল – ইন্ডিগো (নীল), গানপাউডার এবং আফিম। ইন্ডিগো এবং গানপাউডারের ব্যবসা জার্মানদের শিল্পের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়; আর আফিম আস্তে আস্তে মরে যায় বাজার ধরে না রাখতে পারার কারণে। বলাই বাহুল্য যে এই সবগুলি বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। ভারতকে ছেড়ে যাবার সাথে সাথে ব্রিটেনের সবগুলি প্রধান ব্যবসাই প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে চলে যায়। পাকিস্তান তৈরির সাথে সাথে মারা যায় ব্রিটেনের শেষ ব্যবসা দু’টি – টেক্সটাইল এবং পাট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝ দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজের পতন হয় শুধু উপনিবেশগুলি হারাবার সাথে সাথে নয়, উপনিবেশের সাথে যেসব ব্যবসা ব্রিটেনকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে দুই শতক দুনিয়া শাসন করতে সাহায্য করেছিল, সেগুলোও। চাবি চলে গেল আরেকজনের কাছে।

অষ্টমতঃ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নতুন প্রভূ বেছে নেয়; ভারত আগের প্রভূর হাত ধরে থাকে। উপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার যে পাকিস্তান ব্রিটেনের শেষ প্রতিপত্তিগুলি ধ্বংস করতে মার্কিনীদের সহায়তা করেছে এবং মার্কিনীদের বিভিন্ন পণ্যের – যেমন সয়াবিন তেল, গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ইত্যাদির বাজার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করেছে। মার্কিন বন্ধু রাষ্ট্রগুলিও এখানে বাজার দখল করে ব্রিটেনকে তাড়িয়েছে। জাপান, পশ্চিম জার্মানি, হল্যান্ড, ইত্যাদি দেশগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র এখানে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ এক প্রভূর প্রস্থানের সাথেসাথে আরেক প্রভূর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। এই কাজটা করেছে পাকিস্তানের শাসকবর্গ, আর নীরবে মেনে নিয়েছে দেশের জনগণ। পাকিস্তানের যে ঘটনাগুলির বর্ণনা দিলাম, সেগুলি ভারতে হয়নি, কারণ ভারত ব্রিটেনের হাত তখনও ছাড়েনি। পাকিস্তানের মুসলিম লীগে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ঢুকে পড়তে পেরেছিল, সেটা কিন্তু ভারতের কংগ্রেসের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কতটা আগ্রহী ছিল, সেটা ১৯৪১ সাল থেকে চার্চিল আর রুজভেল্টের চিঠিগুলি দেখলেই বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের উপরেই তখন নির্ভর করছিল যে ব্রিটেন হিটলারের হাত থেকে রক্ষা পাবে কিনা। ব্রিটেনকে মার্কিন সাহায্যের শর্ত হিসেবে উপনিবেশগুলি ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এভাবেই ১৯৪৫-এর পর থেকে বহু দেশের জন্ম হয় এবং সকলেই মার্কিন নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের সদস্য হয়ে নতুন প্রভূর কাছে নতি স্বীকার করে। এভাবেই দুনিয়ার চাবি হাতবদল হয়।

নবমতঃ যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে গাড়ির বাজার তৈরি করতে হিমসিম খেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে তার গাড়ির বাজার তৈরি করতে পেরেছিল কারণ তারা একইসাথে পাকিস্তানের নেতৃত্বকে রেল নেটওয়ার্ক ডেভেলপ করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছিল। পূর্ব বাংলা ছিল এক অদ্ভূত জায়গা। এখানে অলি-গলি পাকস্থলি সকল জায়গায় ছিল পানি – নদী-নালা-খাল-বিল-হাওড় ইত্যাদি। এখানে রাস্তা বানানো যেমন কঠিন, নৌকা দিয়ে যাতায়াতও তেমনি সহজ। এখানেই যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ির বাজার ধরা খেয়ে যায়। আকারে ছোট হওয়ার কারণেও এখানে গাড়ির বাজার বড় করাটা ছিল কঠিন। পশ্চিম পাকিস্তান সেই তুলনায় বিরাট (এবং মরুপ্রায়) হওয়ায় সেখানে গাড়ির বাজারের সম্ভাবনা ছিল অনেক ভালো। গাড়ির বাজার ডেভেলপ করা তো গেল এক কথা, কিন্তু আরেকটা ব্যাপার থাকে সেই ম্যারিটাইম দিকটা নিয়ে, সেটা নিয়ে এর আগেই কথা বলেছি; যার কারণে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই নদী-কেন্দ্রিক কোনকিছুই পূর্ববাংলায় ডেভেলপ হতে দেয়নি। এর আগে এক লেখায় বিখ্যাত ভূরাজনীতিবিদ জর্জ ফ্রীডম্যানের উল্লেখ করে বলেছি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই ম্যারিটাইম দেশ তৈরির আভাস দেখবে, সেখানেই সে হস্তক্ষেপ করে সেখানে সবকিছু ভন্ডুল করে দেবে।
http://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2015/11/24/traffic-police-road-repair.jpg/ALTERNATES/w640/traffic-police-road-repair.jpg
পানির দেশে রাস্তা তৈরি এবং মেরামত কঠিন হলেও রাস্তা তৈরির মাঝেই উন্নতি লুক্কায়িত আছে - এই কথাটাই আমাদের মনের মাঝে গেঁথে দেয়া হয়েছে অতি সযতনে! এর সাথে সাথে তৈরি হয়েছে গাড়ির বাজার, তেলের বাজার এবং গুডবাই হয়েছে পশ্চিমাদের ভীতি - ম্যারিটাইম শক্তির আবির্ভাবের সম্ভাবনা। দাসত্বের শৃংখল এভাবেই পায়ে পড়ানো হয়!

দশমতঃ যোগাযোগের ক্ষেত্রে মার্কিনীরা এদেশের মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। এখানে মোটামুটি ধরে নেয়া যায় যে বাংলাদেশে রাস্তা তৈরির সংস্কৃতি এসেছে পাকিস্তান থেকে। কিছু কথার প্রচলন করা হয়েছে, যেমন – “এত্ত ব্যাকওয়ার্ড জায়গা; নৌকা দিয়ে যেতে হয়”। পাকিস্তানের মতো মরু এলাকার মানুষেরাই এই ‘চিন্তা’র বাহক হবার জন্যে ছিল পারফেক্ট! আর বাংলাদেশ হবার পরে এদেশেও সেই একই মার্কিন ‘চিন্তা’ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় – “রাস্তাঘাট (আসলে শুধুই রাস্তা, ঘাট নয়) তৈরির মাধ্যমেই উন্নতি সম্ভব”। এদেশে মার্কিন এবং ১৯৬০-১৯৭০-এর দশক থেকে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত জাপানে তৈরি গাড়ি দিয়ে ভরে যায়। রাস্তা না থাকলে গাড়ি বিক্রি কি করে সম্ভব?

শেষতঃ ‘চিন্তা’ না থাকলে দাসত্ব বরণ নিশ্চিত! আমরা একটা মাত্র বাক্য দিয়ে শুরু করেছিলাম এই লেখা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ-অর্থনীতির একটা ঐতিহাসিক বর্ণনা দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে মোটামুটিভাবে আমরা বিংশ শতকে বিশ্ব-নিয়ন্ত্রণের চাবি হস্তান্তর থেকে শুরু করে এদেশে মার্কিন প্রভাব এবং আমাদের নতুন প্রভূর আনুগত্য স্বীকারের কাহিনী পর্যন্ত স্বল্প পরিসরে আলোচনা করলাম। যে ভাব সম্প্রসারণের কথা বলেছিলাম, সেটা আসলে কি? এটাই হচ্ছে ‘চিন্তা’। এই ‘চিন্তা’টাকে একটু এক্সারসাইজ করলে ওই একই বাক্য থেকে আরও অনেক কিছুই বের করা সম্ভব। এটাই ‘চিন্তা’। এই ‘চিন্তা’র আবার একটা শক্ত ভিত্তি লাগে, নাহলে এটা মানুষকে ঘোরাতে থাকে এবং কোন উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন করতে দেয় না। ‘চিন্তা’ থাকা মানেই শক্তিশালী হওয়া, আর না থাকা মানে অন্যের দাসত্ব স্বীকার করে নেয়া।

Thought is Power.


Friday 3 June 2016

ভূগোল শিক্ষার আকাল এবং অন্ধ জাতির নেপথ্যে

০৩ জুন ২০১৬

http://www.kalerkantho.com/assets/news_images/2014/10/21/7_141651.jpg
পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করাটা যেন একেবারে জীবন-মরন সমস্যা। দেশকে গড়তে এই 'পরীক্ষার রেজাল্ট'-কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যাবস্থার গুরুত্ব কতটুকু?


পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমরনায়কদের তালিকায় যাদের নাম পাওয়া যাবে, তারা সকলেই যেসব গুণ রাখতেন, তার মাঝে ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অন্যতম। আলেক্সান্ডার দি গ্রেট খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে যখন যুদ্ধে বের হয়েছিলেন, তখনই বিভিন্ন যুদ্ধে প্রমাণ করেছিলেন যে geographical features তিনি কতটা ভালো বুঝতেন। ভূগোল জানা না থাকলে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে হ্যানিবল বার্কা উত্তর আফ্রিকা থেকে জিব্রালটার পার হয়ে আল্পস পর্বত ডিঙ্গিয়ে রোম আক্রমণ করতে পারতেন না। মরুভূমির পথকে সেইরকমভাবে না বুঝলে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে খালিদ বিন ওয়ালিদ মেসোপটেমিয়া থেকে পানিবিহীন মরু অতিক্রম করে সিরিয়ার ইয়ারমুকে উপস্থিত হতে পারতেন না। নেপোলিয়নের পক্ষেও উলম ও অস্টারলিটজ-এর মতো বিজয় অর্জন সম্ভব ছিল না পুরো ইউরোপের মানচিত্রকে একত্রে চোখের সামনে চিন্তা করতে না পারলে। অর্থাৎ সামরিক দিক থেকে সফলতা পেতে ভূগোল বোঝা ফরয কাজ। একটা জাতির সবাইকে ভূগোলের মাস্টার হবার দরকার নেই। কিন্তু কিছু প্রধান বিষয়ে শিক্ষা সকলেরই নিতে হয়, যা না হলে পরবর্তীতে advanced studies-এর জন্যে লোকই পাওয়া যাবে না। প্রাথমিক আগ্রহ থেকেই একজন মানুষের কোন একটি বিষয়ে আরও বিশদ জানার আগ্রহ হয়। কিন্তু সেই প্রাথমিক আগ্রহই যদি থামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আর বিষদ জানার কেউ থাকবে না। ভূগোল তেমনই একটা বিষয়। সকলের যেমন আইনস্টাইন হতে হয় না, আবার একইভাবে আইনস্টাইনকেও একসময় নামতা শিখে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ সকলের জন্যে নামতা শেখাটা সমাজে একটা আইনস্টাইন তৈরির জন্যে জরুরি।

ভূগোল হচ্ছে এমন একটা বিষয়, যা আমাদেরকে situational awareness দেয়। অর্থাৎ আমার আশেপাশের তুলনায় আমি কোথায় আছি, সেটা বোঝাটা ভূগোলেরই অংশ। এই অর্থে ভূগোল শুধু যোদ্ধাদের জন্যে নয়, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী – এরকম সকল ক্ষেত্রে উন্নত মানুষ তৈরির জন্যে জরুরি। আর এসকল ক্ষেত্রে উন্নত মানুষ তৈরি করতে না পারলে জাতি হয় অন্ধের মতো। অন্ধ যেভাবে ছড়ি দিয়ে তার আশপাশ বোঝার চেষ্টা করে, ঠিক তেমনি অবস্থা হয় সেই জাতির। সেসময় যে-ই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সে তারই হাত ধরতে বাধ্য হয়; কারণ সে তো দেখতে পাচ্ছে না। আসলে ব্যাপারটা শুধু ভূগোলের ক্ষেত্রে নয়। ভূগোল হলো একটা মানুষ গড়ার ছোট্ট একটা হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার আবার হাতিয়ার সংক্রান্ত বিষয়ের অন্তর্গত – সেটা হচ্ছে শিক্ষা।

ভূগোল তো উন্নত শিক্ষারই অংশ

উন্নত শিক্ষায় ভূগোল থাকবেই; তবে সেখানে আরও অনেক কিছুই থাকবে। যে চিন্তা থেকে উন্নত শিক্ষার জন্ম হয়, সে চিন্তা ভূগোল বাদ দেবে না কোন কালেই। উন্নত চিন্তার শিক্ষা জন্ম দেবে এমন সব নাগরিকের, যারা কিনা উন্নত চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে। ভূগোল জানা সেই উন্নত চিন্তার একটা অপরিহার্য অংশ। একটা জাতিকে উন্নত চিন্তা থেকে দূরে রাখতে তার শিক্ষা ব্যবস্থার বারোটা বাজাতে হবে। সেটা কিভাবে করা? কেউ কি নিজের গলা নিজে কাটবে? কাটবে; যদি তাকে শেখানো যায় যে নিজের গলা কাটাটাই উত্তম কাজ! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সেটা করা সম্ভব এবং সেটা করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ আমাদের দেশেও!

http://www.prohornews.com/source/upload/20140608152525.jpg
বই পড়ার আগে এখন আমরা চিন্তা করি সেটা জীবিকা অর্জনে কতটা সাহায্য করবে। বই পড়াটা এখন জীবনের উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত নয়।

একটা জাতির শিক্ষার বারোটা বাজাতে শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে এমন কিছু মানুষকে হাত করতে হবে, যারা স্বেচ্ছায় সেই গলা কাটার কাজটি করবে। তারপরের কাজটি খুব কঠিন নয়। যারা এই গলা কাটার ব্যাপারটা ধরতে পারবে, সেই লোকগুলিকে দূরে সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা বাড়া ভাতে ছাই না ফেলে। এই প্রসেসটা পূর্ণ করতে একটা জেনারেশন পুরোপুরি লেগে যাবে, কারণ একটা জেনারেশনকে এই গলা কাটার ট্রেনিং দিতে হবে। মোটামুটিভাবে ১৫-২০ বছরের মাঝে এই ব্যাপারটা একটা আকৃতি নিতে থাকবে। প্রসেসটা চালু করাটা তেমন কঠিন নয়। শুধু ধরিয়ে দিতে হবে যে যেসব বিষয় পড়ে জীবিকা অর্জন করা সম্ভব নয়, সেসব বিষয় পড়ে পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই। ব্যাস! হয়ে গেল! ওই বাতিল বিষয়ের লিস্টে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকবে; ভূগোলও থাকবে। আবার বিষয়গুলির ডিজাইনও অন্যরকম হয়ে যাবে। বইগুলি হয়ে যাবে বাস্তবতা বিবর্জিত। কল্পনাপ্রবণ গল্প-কবিতা দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা ভর্তি করা হবে। নৈতিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দেয়, এমন এমন সব ব্যাপার দিয়ে বইগুলি ভর্তি থাকবে, যা সামাজিক অসমাঞ্জস্যতা এবং অপরাধের কারণ হবে। সরকারের নিয়মের বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ভাবে বিষয় ও বই পড়াতে পারবে, যেখানে কি শেখানো হচ্ছে, তা দেখার কেউ থাকবে না। অর্থাৎ যে কেউ ইচ্ছামতো সমাজের কিছু টার্গেটেড গ্রুপের মাঝে নিজের বিশেষ প্রজেক্ট চালাতে পারবে। এর ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হবে (একেক গ্রুপে ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, অভিভাবক, কর্মচারী, নির্ভরশীল গোষ্ঠী থাকবে), যারা একে অপর থেকে আলাদা মনে করবে, এবং জাতীয় একাত্মতায় সমস্যার জন্ম দেবে। নিজেদের মনগড়া স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জন্ম দেবে। শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ব্যবসার মতো। কত টাকা খরচ করে পড়াশোনা করলাম, আর কতদিনে সেই টাকা চাকরির মাধ্যমে উঠে আসবে- সেগুলি হয়ে যাবে মূল চিন্ত্যনীয় বিষয়। বই পড়ার আগে চিন্তা করবে যে এটা পড়লে টাকা উপার্জনের নতুন কোন পন্থা পাওয়া যাবে কিনা; না হলে সে বই কিনবে না। তাই বইয়ের দোকানগুলিও সেরকম বই-ই সামনে সাজিয়ে রাখবে। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করার পেছনেই থাকবে তার পুরো চেষ্টা; তার পুরো সময় চলে যাবে পরীক্ষা-ভিত্তিক পড়াশোনায়। যা পড়ে পরীক্ষায় নম্বর বাড়ে না, সেটা পড়ার কোন সময়ও তার থাকবে না। মোট কথা, জীবিকা উপার্জনের জন্যে; পেটের দায়ে পড়া। জ্ঞান অর্জন; দেশ গড়া; জাতিকে শক্তিশালী করা; নৈতিকভাবে নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা – এগুলি উদ্দেশ্য ধূলায় লুটাবে। সেই জাতি তখন একটা সময়ে গিয়ে সমরবিদ, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী – এরকম কোন ক্যাটাগরিতেই উন্নত মানুষ জন্ম দিতে অক্ষম হবে। পুরো জাতিই উদ্দেশ্যহীনভাবে ভুল পথে হাঁটবে।

‘গলা কাটা লোক’

উপরে একটা জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেবার যে বর্ণনা দিয়েছি, সেটা Subversion-এর একটা অংশ। এই প্রসেস পৃথিবীর বহু দেশে চালানো হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। জেমস বন্ডের espionage নিয়ে সবাই ব্যাস্ত থাকলেও এই গুরুগম্ভীর ব্যাপারগুলিই ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলির আসল কাজ হিসেবে পরিগণিত। যুদ্ধ না করে যুদ্ধজয়। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হওয়ায় এর পেছনে চেষ্টাও বেশি, বাজেটও বেশি, এবং পুরো প্রসেসটা গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা থাকে। এই প্রসেস সাধারণ মানুষের পক্ষে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে প্রসেসের রেজাল্ট দেখে খুব সহজেই বোঝা যাবে যে প্রসেস কার্যকরভাবে চলছে। উপরে এই উপসর্গগুলি নিয়েই কথা বলেছি। এই প্রসেসের মাধ্যমে একটা জাতিকে চিন্তা থেকে দূরে রাখা হয়, যাতে করে সে জাতিকে তার বিপদের সময়ে হাত বাড়ালে সে কোন চিন্তা না করেই সেই হাত ধরে ফেলে; একেবারে অন্ধের মতো। তার গাইড তাকে যেদিকে নেবে, সে সেদিকেই যাবে। শিক্ষা হচ্ছে একটা জাতির দৃষ্টিশক্তির মতো। এই দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস করতে দরকার হবে কিছু ‘গলা কাটা লোক’, যাদের কথা উপরে বলেছি। এরা এজেন্ট হয়ে কাজ করবে দেশের ভেতরে, যা কেউই বুঝতে পারবে না। এদেরকে সর্বোপরি কার্যকর করে তুলতে ১৫-২০ বছর লেগে যাবে। সিস্টেমের মাঝে চিন্তাহীন লোকদের দিয়ে কাজগুলি করিয়ে নেয়া হবে। কারণ যে চিন্তা করতে পারে, সে তো এসব কাজে বাধা দেবে। যেহেতু আরেকজনের মাধ্যমে কাজটি করিয়ে নেয়া হবে, তাই কারা আসল কাজ করছে, সেটা সরাসরি দেখা যাবে না। এই বাজে কাজটা করার জন্যে যাদের রিক্রুট করা হবে, তার প্রধান যোগ্যতাই হবে দেশদ্রোহিতা। এই এজেন্টদেরকে সময়মতো এবং জায়গামতো ডাকা হবে এবং এরা এদের দেশদ্রোহী কাজ চালিয়ে নেবে।

এতক্ষণে বাংলাদেশের পাঠক বুঝে যাবেন যে তিনি যে সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে এই প্রসেসখানা কতটা গভীরভাবে চলেছে। এবং সেখানে কেউ বাধা দেয়নি, বা চেষ্টা করেনি, বা বাধা দেবার সুযোগ পায়নি। চিন্তা করে দেখুন তো, আপনার পাশের মানুষটিকে শিক্ষার উদ্দেশ্য কি বলা হয়েছে? জীবিকা উপার্জনের বাইরে শিক্ষা নেবার চেষ্টা কতটুকু করা হয়েছে? ‘এটা পড়ে চাকরি পাওয়া যাবে না; এটা পড়ে জীবনে দাঁড়ানো যাবে না; এটা না পড়লে পরিবারের মুখ থাকবে না’ – এগুলি বলা হয়েছে কিনা? ‘পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে; জিপিএ-৫ পেতে হবে, নাহলে ভবিষ্যত অন্ধকার’- এগুলি বলা হয়েছে কিনা? এই ধারণাগুলি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ কথা না বলে এবং ভেড়ার পালের মতো মেনে নেয়। এই ব্যাপারগুলি চলছে ধীরে ধীরে – গত ২০-২৫ বছর ধরে। এদেশের যুবসমাজকে অন্ধ করে গড়ে তোলা হয়েছে। জীবিকা অর্জন ছাড়া তার আর কোন যোগ্যতা নেই; আসলে সেটাতেও সে দক্ষ নয়। একটা প্রশ্ন করার ক্ষমতা তার নেই; কারণ সে চিরকাল উত্তরই মুখস্ত করেছে। দেশকে উপরে ওঠানো; বিপদে দেশকে রক্ষা করা; দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া –এগুলি কাজে সে পুরোপুরিভাবে অক্ষম। সে নিজের উদ্দেশ্য যেমন জানে না, দেশের উদ্দেশ্যও না। এরাই হবে এদেশের ভবিষ্যত। এরাই জাতির উদ্দেশ্য ঠিক করবে একটা সময়।

শিক্ষার সাথে ভূ-রাজনীতির সম্পর্কটা আসলে কি?

এর মাঝেও অবশ্য কিছু rotten apple পাওয়া যাবে, যাদেরকে Subversion-এর মাধ্যমে পুরোপুরি কাবু করা যায়নি। তারা এই প্রসেস ধরতে পারবে এবং প্রশ্ন করে বসবে। কারণ তারা অন্ধ হলেও তাদের অন্য ইন্দ্রিয়গুলি কাজ করছিলো। অন্য ইন্দ্রিয়গুলি এই শিক্ষার প্রসেসের বাইরে থেকে আসতে পারে। তাই সেই ইন্দ্রিয়গুলিকে ভোঁতা করতে আরেকটি প্রসেস লাগে, যদিও সেটাও শিক্ষার সাথে সমান্তরালে চলে। সেটাও subversion-ই অংশ। বেঁচে থাকলে সেটা নিয়ে আরেকদিন লিখবো আশা রাখি। subversion-এর অন্য বিষয়গুলি নিয়েও লিখবো আশা রাখি। subversion-এর উপরে লেখা বই সম্পর্কে মানুষ আজ অজ্ঞ। সেটাও ওই একই বৃহত পরিকল্পনারই অংশ; যাতে কেউ হঠাত করে ঘুম থেকে জেগে না যায়। তবে এতক্ষণ শিক্ষা নিয়ে যে প্যাঁচাল পারলাম, সেটার সাথে ভূরাজনীতির কি সম্পর্ক আছে যে এই লেখাটা লিখলাম? সেটাই বলছি।

আমরা সবাই অস্বস্তিত ভুগছি যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিরাট সমস্যায় পতিত। কিন্তু যেহেতু আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করা হয়েছে, তাই আমরা এর কোন সমাধান দিতে পারিনা। দশ জনে দশটা সমাধান নিয়ে আসবে; কেউ কেউ আবার উমুক-তুমুক দেশের উদাহরণও নিয়ে আসবেন। এর কারণ হলো কারুরই সমাধান দেবার ক্ষমতা নেই। স্ট্র্যাটেজিক জায়গাগুলিতে বসিয়ে দেয়া এজেন্টদেরকে এড়িয়ে কিছুই করা সম্ভব হবে না। আর সিস্টেমটা ডিজাইন করা হয়েছে এমনভাবে যে তাদেরকে বাইপাস করার কোন সুযোগ থাকবে না। এই এজেন্টদের মাঝেও আবার গ্রুপিং তৈরি করা থাকবে, যাদের কাজ হবে একে অপরের সাথে ঝগড়া করে দেশকে পিছিয়ে দেয়া। শিক্ষা পিচিয়ে যাওয়া মানেই দেশ দুর্বল হওয়া। এখন এটা প্রাথমিকভাবে বোঝাই যায় যে এই দেশ দুর্বল হলে সরাসরি লাভবান কারা হচ্ছে। তবে যারা সরাসরি লাভবান হচ্ছে, তাদের লাভালাভ স্বল্প সময়ের। যেটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে না তা হলো পরোক্ষভাবে কারা লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি আজকে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের শক্তিশালী ভাবতে আরম্ভ করে, তাহলে তো বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাবে। এই ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেলে তো এটাকে আবার নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক কষ্ট হবে (অথবা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবেই না কখনো)। শুধু তা-ই নয়, একবার এই ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেলে এটা বাকি বিশ্বের জন্যে ‘বাজে’ উদাহরণ হয়ে যাবে। তখন তো পুরো বিশ্বই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যালান্স রেখে দুনিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা যাদের উদ্দেশ্যের মাঝে পড়ে, প্রকৃত সুবিধা তারাই পাবে। বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ গায়ের জোরে হয় না; হয় চিন্তার জোরে। তাই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মানেই দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ।