Saturday 10 September 2022

মার্কিন নৌবাহিনী ভূতুড়ে নৌবহর তৈরি করছে কেন?

১০ই সেপ্টেম্বর ২০২২
 
মার্কিন নৌবাহিনীর ড্রোন জাহাজ 'নোম্যাড' এবং 'রেঞ্জার'। মার্কিন নৌবাহিনী ‘ঘোস্ট ফ্লীট ওভারলর্ড’ প্রকল্পের মাধ্যমে নৌবাহিনীর আকার বৃদ্ধি করতে চাইছে; তবে একইসাথে তুলনামূলকভাবে বাজেট নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখতে চাইছে। তাই এই ড্রোন জাহাজগুলির মাঝে বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায় এমন অনেক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। একটা ডেস্ট্রয়ার তৈরি করতে প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একই খরচে ডজনখানেক ‘ভূতুড়ে’ ড্রোন জাহাজ তৈরি করা সম্ভব। এই ডজনখানেক জাহাজ দিয়ে অনেক বেশি সমুদ্র অনেক বেশি সময় ধরে টহল দেয়া সম্ভব।

গত ২৩শে অগাস্ট মার্কিন নৌবাহিনী ‘ম্যারিনার’ নামে একটা জাহাজের উদ্ভোধন করে; যা প্রধানতঃ মনুষ্যবিহীন। ‘ঘোস্ট ফ্লীট ওভারলর্ড’ নামের প্রকল্পের অংশ এই জাহাজখানা কোন মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ভূতের মতোই সমুদ্রে চলবে বলে বলা হচ্ছে। জাহাজটা অনেক ক্ষেত্রেই নিজে নিজেই সমুদ্রে চলতে পারবে। ‘ইউএস নেভাল ইন্সটিটউট’এর খবরে বলা হচ্ছে যে, এতে এখন বিভিন্ন সেন্সর যন্ত্রপাতি, স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাডার এবং অন্যান্য বিভিন্ন উপকরণ সংযোগ করা হচ্ছে; যার বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজারে বিক্রি হয়। জাহাজটার মূল ডিজাইন ছিল সমুদ্রে তেলের রিগে মালামাল সরবরাহের কাজ করা জাহাজগুলির মতোই। নৌবাহিনীর সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক ব্রায়ান ফিতজপ্যাট্রিক বলছেন যে, জাহাজটা তৈরির মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন নৌবাহিনী এটাকে কিনে ফেলে। খবরে বলা হচ্ছে যে, ৫৯ মিটার লম্বা এই জাহাজটাতে ডাটালিঙ্ক এবং অন্যান্য সিস্টেম থাকবে; যার মাধ্যমে জাহাজটা অন্যান্য মনুষ্যবিহীন জাহাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ নৌবাহিনী এখন একত্রে কয়েকটা মনুষ্যবিহীন জাহাজ নিয়ে পরীক্ষা চালাতে সক্ষম হবে। ‘ম্যারিনার’ জাহাজখানা প্রায় একই ধরণের চারটা জাহাজের একটা। এর আগে আরও দু’টা জাহাজ ‘রেঞ্জার’ এবং ‘নোম্যাড’ ইতোমধ্যেই নৌবাহিনীর সাথে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। চতুর্থ জাহাজ ‘ভ্যানগার্ড’ এখনও তৈরি হচ্ছে। এই জাহাজগুলি মোটামুটিভাবে ৫২ থেকে ৬২ মিটার লম্বা এবং ৩’শ থেকে ৪’শ টনের মতো মালামাল বহণে সক্ষম।

মনুষ্যবিহীন জাহাজের চিন্তা এবং বাস্তবায়ন

‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে চীনকে নিয়ন্ত্রণে মার্কিন নৌবাহিনী তাদের বহরের আকার বৃদ্ধি করতে চাইছে। কিন্তু বাজেটের সংকুলান সর্বদাই কঠিন ব্যাপার হিসেবে সামনে আসছে; যা কিনা বারংবার নৌবহরের আকারকে আলোচনায় নিয়ে আসছে। কর্মকর্তাদের মাঝে অনেকেই মনে করছেন যে, নৌবহরের আকার বৃদ্ধি করার একটা পদ্ধতি হতে পারে মনুষ্যবিহীন বা ড্রোন জাহাজ। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিনীরা এহেন জাহাজ তৈরির পিছনে যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে। মার্কিন নৌবাহিনীর একটা কনসেপ্ট পেপারের অংশ হিসেবে ‘ইউএসভি’ বা ‘আনম্যানড সারফেস ভেসেল’ বা মনুষ্যবিহীন জাহাজের উপর একটা গ্রাফিক প্রেজেনটেশন উপস্থাপন করা হয়। ‘ইউএসভি সিস্টেমস ভিশন’ নামের এই প্রেজেনটেশনে দেখানো হয় যে, মার্কিন নৌবাহিনী মোটামুটিভাবে চার প্রকারের মনুষ্যবিহীর ড্রোন জাহাজ ডেভেলপ করছে। সবচাইতে ছোট প্রথম ক্লাসের নৌযানগুলি হবে ৭ মিটারের নিচে লম্বা। এর উপরে দ্বিতীয় ক্লাসের নৌযানগুলি হবে ৭ মিটার থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা। তৃতীয় ক্লাসের জাহাজগুলি হবে ১২ মিটার থেকে ৫০ মিটারের মাঝে। আর চতুর্থ ক্লাসের জাহাজগুলি হবে ৫০ মিটারের উপর লম্বা। শেষ এই দুই ক্লাসের জাহাজগুলিকে মধ্যম এবং বড় আকৃতির বলা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্লাসের মাঝে পার্থক্য হবে এগুলির বহণক্ষমতা, সমুদ্রে লম্বা সময় ধরে থাকার সক্ষমতা এবং খারাপ আবহাওয়ায় টিকে থাকার সক্ষমতা।

প্রথম দুই ক্লাসের বেশকিছু ছোট নৌযান মার্কিনীরা ইতোমধ্যেই তৈরি করে মনুষ্যবিহীন নৌযানের কনসেপ্টগুলিকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছে। তৃতীয় এবং চতুর্থ ক্লাস থেকে জাহাজের জটিলতা বাড়তে থাকে। জাহাজগুলির নিয়ন্ত্রণ মূলতঃ ভূমিতে অবস্থিত কন্ট্রোল সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে করা হয়। তৃতীয় ক্লাসের অংশ হিসেবে ২০১৭ সাল থেকে নৌবাহিনী ভিন্ন দুই গবেষণা সংগঠন ‘সী হান্টার’ এবং ‘সীহক’ নামের দু’টা জাহাজ তৈরি করেছে। ছোট আকারের হলেও তিনটা খোলের উপর তৈরি হবার কারণে এই ছোট জাহাজগুলি বাজে আবহাওয়াতেও টিকে থাকতে পারে। এই জাহাজগুলির ডিজাইন করাই হয়েছে মনুষ্যবিহীন জাহাজ হিসেবে। চতুর্থ ক্লাসের অংশ হিসেবে নৌবাহিনী ‘ম্যারিনার’ তৈরি করেছে। ম্যারিনারের আগে ২০১৯ সালে তৈরি হয়েছে ‘নোম্যাড’ এবং ‘রেঞ্জার’। তবে এই জাহাজগুলি প্রথম থেকেই মনুষ্যবিহীন জাহাজ হিসেবে তৈরি করা হয়নি। তেলের রিগে কাজ করা জাহাজ থেকে পরিবর্তন করে এগুলিকে তৈরি করা হয়েছে। এগুলির মূল আকর্ষণ হলো, এগুলির ইঞ্জিন বেশ শক্তিশালী এবং জাহাজের পিছনের দিকে বড় একটা অংশ খোলা ডেক; যেখানে বিভিন্ন আকৃতির কনটেইনার রাখা সম্ভব।

চতুর্থ ক্লাসের বড় জাহাজগুলির মূল সক্ষমতা হলো এগুলি বেশকিছু কনটেইনার বহণ করতে পারে। এই কনটেইনারগুলির ভেতর বিভিন্ন সামরিক মিশনের যন্ত্রপাতি বহণ করা হবে। যখন যেধরনের মিশন থাকবে, তখন সেধরনের কনটেইনার বহণ করা হবে। এগুলির মাঝে রয়েছে সাবমেরিন খুঁজতে ব্যবহার করা বিভিন্ন সরঞ্জাম, জাহাজ ধ্বংস করার ক্ষেপণাস্ত্র, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন প্রকার গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং অন্য জাহাজের জন্যে টার্গেট খোঁজার যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র বহণ এবং মালামাল পরিবহণ। তৃতীয় ক্লাসের জাহাজগুলি আবার সমুদ্রে মাইন অপসারণের কাজেও লাগানো হতে পারে।

 
সেপ্টেম্বর ২০২১। ড্রোন জাহাজ 'রেঞ্জার'এর পিছনে রাখা কনটেইনার থেকে ছোঁড়া হচ্ছে 'এসএম-৬' আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র। জাহাজগুলির মূল সক্ষমতা হলো এগুলি বেশকিছু কনটেইনার বহণ করতে পারে। এই কনটেইনারগুলির ভেতর বিভিন্ন সামরিক মিশনের যন্ত্রপাতি বহণ করা হবে। যখন যেধরনের মিশন থাকবে, তখন সেধরনের কনটেইনার বহণ করা হবে। এগুলির মাঝে রয়েছে সাবমেরিন খুঁজতে ব্যবহার করা বিভিন্ন সরঞ্জাম, জাহাজ ধ্বংস করার ক্ষেপণাস্ত্র, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন প্রকার গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং অন্য জাহাজের জন্যে টার্গেট খোঁজার যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র বহণ এবং মালামাল পরিবহণ।

ড্রোন জাহাজের সক্ষমতা

মার্কিন নৌবাহিনীর মনুষ্যবিহীন ড্রোন জাহাজ প্রকল্পের প্রধান রিয়ার এডমিরাল কেসি মোটন বলছেন যে, জাহাজগুলির মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, এগুলির একেকটার ইঞ্জিনের আকার ভিন্ন। পরবর্তীতে যেসকল মিশনের জন্যে এই জাহাজগুলিকে তৈরি করা হচ্ছে, সেই মিশনগুলিকে মাথায় রেখেই প্রধান কাজগুলি এখন সম্পাদন করা হচ্ছে। এই জাহাজগুলির কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে যে, একসময় এগুলি অন্যান্য মার্কিন যুদ্ধজাহাজের মতো ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করবে। এডমিরাল মোটন বলছেন যে, এই জাহাজগুলির কয়েকটা এখন একত্রে প্যাট্রোল দিতে পারবে; যেখানে সেই কাজটা বর্তমানে মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ারগুলি করে থাকে। কিন্তু এই ডেস্ট্রয়ারগুলি এখন অনেক ব্যস্ত; তাই এগুলিকে সকল সময়ে পাওয়া যায় না। তবে ‘ম্যারিনার’ জাহাজটা একটা ডেস্ট্রয়ারের সাথে যুক্ত হয়ে মিশনে অংশ নিতে পারবে। কিছু মিশন, যেমন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার কাজে ডেস্ট্রয়ারের জায়গায় ‘ম্যারিনার’এর মতো জাহাজগুলি প্রতিস্থাপিত হতে পারে।

জাহাজটার পিছনের খোলা ডেকে বেশ কতগুলি ২০ ফুট এবং ৪০ ফুট লম্বা কনটেইনার বহন করা যাবে। এই কনটেইনারগুলির মাঝে থাকবে বিভিন্ন সামরিক মিশনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি। যদিও এখনও পর্যন্ত নৌবাহিনী চাইছে যে জাহাজটা মহাসাগর পাড়ি দেবে, তথাপি এখনও জাহাজগুলিকে সমুদ্রের মাঝখানে কিভাবে রিফুয়েল করা হবে, সেব্যাপারে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। বর্তমানে জাহাজগুলিতে কয়েকজন নাবিক রাখতে হচ্ছে সমুদ্রে রিফুয়েলিং করার জন্যে; কারণ রিফুয়েলিং অপারেশগুলি অনেক জটিল। তবে সামনের বছরেই নৌবাহিনী মানুষ ছাড়া একটা রিফুয়েলিং অপারেশন করতে চাইছে। এছাড়াও এক বছর আগে ২০২১এর সেপ্টেম্বরে ‘রেঞ্জার’ জাহাজের উপর একটা কনটেইনার থেকে ‘এসএম-৬’ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে নতুন ধরণের যুদ্ধের দ্বার উন্মোচন করা হয়।

‘ম্যারিনার’ জাহাজখানার আরও একখানা বর্ণনা দিয়েছে ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’। যদিও জাহাজটা মনুষ্যবিহীন বলা হচ্ছে, তথাপি এটা পুরোপুরি মনুষ্যবিহীন নয়। বরং এটাকে বলা যায় এমন একটা জাহাজ, যা কিনা দরকার হলে মানুষও চালায়। জাহাজের ব্রিজে বড় একটা লাল সুইচ রয়েছে; যার মাধ্যমে জাহাজটাকে সফটওয়্যার চালিত থেকে মনুষ্যচালিত করে ফেলা যায়। বিশেষ কোন সমস্যা হলেই অবশ্য এই সুইচ টেপা হয়। সাধারণতঃ অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতার ক্যাপ্টেনরাই এই সুইচ বেশি টিপে থাকে। তবে নৌবাহিনী ভবিষ্যতে পুরোপুরি মনুষ্যবিহীন জাহাজ তৈরি করতে চাইছে।

 
ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ড্রোন জাহাজ 'সী হান্টার' নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। মার্কিন নৌবাহিনী চাইছে যে, তারা এমন কিছু জাহাজ তৈরি করবে, যেগুলি কোন ধরণের মেইনটেন্যান্স ছাড়াই এক বছর সমুদ্রে অপারেট করতে সক্ষম হবে। ছোট জাহাজ ‘সী হান্টার’ এবং ‘সীহক’এর ক্ষেত্রে তারা এই ব্যাপারটা অনেকটাই পেরেছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত বড় ‘নোম্যাড’ এবং ‘রেঞ্জার’এর মতো জাহাজগুলির ব্যাপারে তারা এখনও সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। বিশেষ করে এই বড় জাহাজগুলিকে সমুদ্রের মাঝে রিফুয়েলিং করতে এখনও ক্রু বহণ করতে হচ্ছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন মেনে চলতে গিয়েও মার্কিন নৌবাহিনী সকল ক্রু জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতে পারছে না; যদিও জাহাজগুলি ৯০ শতাংশের বেশি সময় ক্রুদের সহায়তা ছাড়াই চলছে।


‘রিমপ্যাক ২০২২’ মহড়ায় ড্রোন জাহাজ – নেটওয়ার্কই আসল ইস্যু

মাত্র কিছুদিন আগেই ‘নোম্যাড’ এবং ‘রেঞ্জার’ ড্রোন জাহাজ দু’টা মার্কিন নেতৃত্বের বড় আকারের সামরিক মহড়া ‘রিম অব দ্যা প্যাসিফিক ২০২২’ বা ‘রিমপ্যাক ২০২২’এ অংশ নেয়। এই জাহাজ দু’টার সাথে আরও দু’টা অপেক্ষাকৃত ছোট মনুষ্যবিহীন জাহাজ অংশ নেয়; যেগুলি হলো ‘সী হান্টার’ এবং ‘সীহক’। ফিতজপ্যাট্রিক ‘ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট’কে বলছেন যে, সেই মহড়া থেকে তারা ৪’শ টেরাবাইট তথ্য পেয়েছেন; যা কিনা এখন বিশ্লেষণ করে দেখা হবে।

ছয় সপ্তাহ ধরে চলা ‘রিমপ্যাক ২০২২’ মহড়া থেকে অনেকেই বিভিন্ন শিক্ষা নিতে চাইছে। ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে নৌবাহিনীর সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক ব্রায়ান ফিতজপ্যাট্রিক বলছেন যে, এবারের মহড়ায় সবচাইতে বড় পাওয়া ছিল নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা এই ড্রোনগুলির ব্যাপারে কি কথা বলছেন। তারা জিজ্ঞেস করছেন না যে, এই ড্রোন জাহাজগুলি কিভাবে চালনা করা হচ্ছে; বরং তারা জিজ্ঞেস করছেন যে, এই জাহাজগুলি তাদেরকে কি ধরণের সহায়তা দিতে পারে। এই ড্রোন জাহাজগুলি হঠাত করেই কোন নিয়ন্ত্রণ সমস্যার মাঝে পড়ে যাবে কিনা, সেব্যাপারে তারা চিন্তা করছেন না। অর্থাৎ এই জাহাজগুলির ব্যাপারে কর্মকর্তাদের ধারণার বেশ খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়াও নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা একসাথে দুই ধরণের দু’টা ড্রোন জাহাজের নিয়ন্ত্রণ পাবার জন্যে অনুরোধ করেছেন। অর্থাৎ একটা মার্কিন ডেস্ট্রয়ার থেকেই একটা ছোট ড্রোন জাহাজ, যেখন ‘সী হান্টার’ এবং ‘সীহক’এর মাঝে একটা; এবং একটা বড় ড্রোন জাহাজ, যেমন ‘নোম্যাড’ এবং ‘রেঞ্জার’এর মাঝে একটা একসাথে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিনা। ফিতজপ্যাট্রিক বলছেন যে, এটা এখন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ছোট জাহাজগুলি নৌবাহিনীর একটা প্রকল্প থেকে আসা; বাকিগুলি অন্য প্রকল্প থেকে আসা। এই প্রকল্পগুলি ভিন্ন নেটওয়ার্কএর মাধ্যমে জাহাজগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে। কাজেই একটা ডেস্ট্রয়ার থেকে ভিন্ন রকমের ড্রোন জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

এছাড়াও নৌবাহিনী এবং পেন্টাগনের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকেও এই ড্রোন জাহাজগুলির কর্মকান্ড দেখাবার ব্যাপারে উৎসুক রয়েছে নৌবাহিনী। নৌবাহিনীর অপারেশন্স প্রধান এডমিরাল মাইকেল গিলডে ছোট আকারের ড্রোন জাহাজগুলির দরকারের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নন। অপদিকে মহড়ার সময় একটা ড্রোন জাহাজ নিয়ে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এরকম একটা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোর কমান্ড সেন্টার থেকে একটা ডেস্ট্রয়ারে ট্রান্সফার করার সময় সেটা সফল হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত জাহাজটার নিয়ন্ত্রণ স্যান ডিয়েগোতেই থেকে যায়।

 
২২শে জুন ২০২২। ড্রোন জাহাজ 'রেঞ্জার' 'রিমপ্যাক ২০২২' মহড়ায় অংশ নেয়ার জন্যে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে। পিছনে বহন করছে বিভিন্ন আকৃতির চারটা কনটেইনার। ‘রিমপ্যাক ২০২২’এর একটা ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, নেটওয়ার্ক নিয়ে যেকোন সময় সমস্যা হতেই পারে। আর এই নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা হলো সবচাইতে সংবেদনশীল একটা আলোচনা। তথাপি মার্কিনীরা এই সমস্যাগুলিকে যতটা সম্ভব সমাধান করে ফেলতে চাইবে। কারণ ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে বাজেট ঘাটতি এবং রিক্রুটিং সমস্যা নৌবাহিনীকে বেশ ভোগাচ্ছে। এমতাবস্থায় মনুষ্যবিহীন প্রকল্পগুলিই মার্কিনীদের সামনে একমাত্র ভরসা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বড় আকারের মহড়ায় ড্রোন জাহাজের ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশন’এর ম্যাগাজিন ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স’এ ছোট ড্রোন জাহাজ ‘সী হান্টার’ ও ‘সীহক’এর ‘রিমপ্যাক ২০২২’তে অংশ নেয়ার বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়। জাহাজ দু’টা প্রথমবারের মতো এত লম্বা মিশনে বের হয়েছে। এই জাহাজগুলির ইউনিটের (আনম্যানড সারফেস ভেসেল ডিভিশন ওয়ান) প্রধান কমান্ডার জেরেমায়া ডেলি বলছেন যে, এই মিশনে ‘সীহক’এর সাথে ছিল সাবমেরিন খুঁজে পাবার জন্যে জাহাজ পিছন থেকে টানা (টোউড এরে) সোনার। অপরদিকে ‘সী হান্টার’ বহণ করেছে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করার (আইএসআর) জন্যে যন্ত্রপাতি। কিছু সময়ের জন্যে মহড়া এলাকার কাছাকাছি একটা টাইফুন আঘাত হানার কারণে ড্রোন জাহাজগুলিকে খারাপ আবহাওয়াও সহ্য করতে হয়েছে। তবে সেই আবহাওয়া ছোট জাহাজগুলির সহ্যক্ষমতার মাঝেই ছিল।

‘রিমপ্যাক ২০২২’ মহড়ায় অনেকগুলি দেশ অংশ নিচ্ছিলো এবং একেকটা দেশের জাহাজগুলি আলাদা নেটওয়ার্কের অংশ ছিল। কাজেই এহেন মহড়ায় নেটওয়ার্ক এবং যোগাযোগে কিছু সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে বলছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। মার্কিন ৩য় নৌবহরের সহকারি চিফ অব স্টাফ ক্যাপ্টেন ড্যান ব্রাউন বলছেন যে, ডাটা শেয়ারিং হোক অথবা ভয়েস কমিউনিকেশন্সই হোক, যোগাযোগ হলো এমন একটা জায়গা, যেখানে সক্ষমতার ঘাটতি সবচাইতে বড়।

মার্কিন নৌবাহিনী ‘ঘোস্ট ফ্লীট ওভারলর্ড’ প্রকল্পের মাধ্যমে নৌবাহিনীর আকার বৃদ্ধি করতে চাইছে; তবে একইসাথে তুলনামূলকভাবে বাজেট নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখতে চাইছে। তাই এই ড্রোন জাহাজগুলির মাঝে বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায় এমন অনেক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। একটা ডেস্ট্রয়ার তৈরি করতে প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একই খরচে ডজনখানেক ‘ভূতুড়ে’ ড্রোন জাহাজ তৈরি করা সম্ভব। এই ডজনখানেক জাহাজ দিয়ে অনেক বেশি সমুদ্র অনেক বেশি সময় ধরে টহল দেয়া সম্ভব। মার্কিন নৌবাহিনী চাইছে যে, তারা এমন কিছু জাহাজ তৈরি করবে, যেগুলি কোন ধরণের মেইনটেন্যান্স ছাড়াই এক বছর সমুদ্রে অপারেট করতে সক্ষম হবে। ছোট জাহাজ ‘সী হান্টার’ এবং ‘সীহক’এর ক্ষেত্রে তারা এই ব্যাপারটা অনেকটাই পেরেছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত বড় ‘নোম্যাড’ এবং ‘রেঞ্জার’এর মতো জাহাজগুলির ব্যাপারে তারা এখনও সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। বিশেষ করে এই বড় জাহাজগুলিকে সমুদ্রের মাঝে রিফুয়েলিং করতে এখনও ক্রু বহণ করতে হচ্ছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন মেনে চলতে গিয়েও মার্কিন নৌবাহিনী সকল ক্রু জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতে পারছে না; যদিও জাহাজগুলি ৯০ শতাংশের বেশি সময় ক্রুদের সহায়তা ছাড়াই চলছে। তবে যে ইস্যুটা এখনও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো নেটওয়ার্ক। ‘রিমপ্যাক ২০২২’এর একটা ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, নেটওয়ার্ক নিয়ে যেকোন সময় সমস্যা হতেই পারে। আর এই নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা হলো সবচাইতে সংবেদনশীল একটা আলোচনা। তথাপি মার্কিনীরা এই সমস্যাগুলিকে যতটা সম্ভব সমাধান করে ফেলতে চাইবে। কারণ ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে বাজেট ঘাটতি এবং রিক্রুটিং সমস্যা নৌবাহিনীকে বেশ ভোগাচ্ছে। এমতাবস্থায় মনুষ্যবিহীন প্রকল্পগুলিই মার্কিনীদের সামনে একমাত্র ভরসা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment