Saturday 28 May 2022

উত্তর আয়ারল্যান্ডের নির্বাচন – ব্রিটেনের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি চ্যালেঞ্জ?

২৯শে মে ২০২২

 
উত্তর আয়ারল্যান্ডের দেয়ালে জাতীয়তাবাদী গ্রাফিতির পাশে নির্বাচনী পোস্টার। পশ্চিমা দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ভোট যদি স্কটল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে অনুপ্রাণিত করে, তবে সেটাই ব্রিটেনের জন্যে বেশি দুশ্চিন্তার হবে। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে নিজেদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই যখন বেশিরভাগ মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ব্রিটেনের অখন্ডতা প্রশ্নাতীত থাকছে না।


ছোট্ট দেশ উত্তর আয়ারল্যান্ডের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। ১৯২১ সালের মে মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সরকারের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ব্রিটেনের অংশ হিসেবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের জন্ম দেয়া হয়েছিল। সেই সময় থেকে ১’শ ১ বছর পর প্রথমবারের মতো দেশটার পার্লামেন্টে আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এতদিন পর্যন্ত সকল নির্বাচনেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ‘ইউনিয়নিস্ট’ দলগুলি; যাদের মূল চিন্তা হলো ব্রিটেনের সাথে যুক্ত থাকা। বহু বছর ধরে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামে লিপ্ত থাকা ‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি’র রাজনৈতিক মুখপাত্র ‘সিন ফেইন’ ২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ২৭টা আসন পেয়েছে। মাত্র ১৯ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশের নির্বাচন ভূরাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ একদিকে উত্তর আয়ারল্যান্ড যেমন ব্রিটেনের একটা অংশ, অপরদিকে আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা বহুদিন থেকে উত্তর আয়ারল্যান্ডকে ব্রিটেন থেকে আলাদা করে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের সাথে একত্রীকরণের পক্ষপাতি। অর্থাৎ উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজনীতি ব্রিটেনের ভৌগোলিক অখন্ডতার সাথে সম্পর্কিত।

নির্বাচনে ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ‘ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি’ বা ‘ডিইউপি’; যারা পেয়েছে ২৫টা আসন। ‘আলস্টার ইউনিয়নিস্ট পার্টি’ বা ‘ইউইউপি’ পেয়েছে ৯টা আসন। বাকিরা পেয়েছে ২৯টা আসন। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মূলা অনুযায়ী দেশটার সরকারের শীর্ষ নেতা ‘ফার্স্ট মিনিস্টার’ এবং ‘ডেপুটি ফার্স্ট মিনিস্টার’ আসবে জাতীয়তাবাদী এবং সবচাইতে বড় ‘ইউনিয়নিস্ট’ দল থেকে। বাকি মন্ত্রীরা আসবে নির্বাচনে বেশি আসন পাওয়া দলগুলি থেকে। শীর্ষ দু’টা পদের নাম আলাদা হলেও এদের কাজ একই; এবং এদের একজন পদত্যাগ করলে আরেকজন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী ‘সিন ফেইন’ দলের কাউকে যদি সরকার প্রধান হতে হয়, তাহলে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইউনিয়নিস্ট দলের কাউকে ‘ডেপুটি’র পদটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ‘ডিইউপি’ দলের প্রধান জেফরি ডোনাল্ডসন বলে দিয়েছেন যে, ব্রেক্সিটের পর থেকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বাণিজ্য যেভাবে চলছে, সেটা তার দলের মনপূতঃ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ‘ডেপুটি’র পদ সমর্থন করবেন না। ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রোটোকল’ নামের পরিচিত এই বাণিজ্য ব্যবস্থা ‘ডিইউপি’ সমর্থন করে না।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রোটকলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই ‘ডিইউপি’র সদস্য পল গিভান ‘ফার্স্ট মিনিস্টার’এর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ইউনিয়নিস্টরা মনে করে যে, এই প্রটোকলের মাধ্যমে উত্তর আয়াল্যান্ডকে আলাদা করে দেখা হচ্ছে এবং এতে ব্রিটেনের অংশ হিসেবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। ‘ডিইউপি’ যদি ‘ডেপুটি’ পদে লোক না দেয়, তাহলে এই সমস্যা ৬ মাস পর্যন্ত চলতে পারে। বিরোধ তখনও চলতে থাকলে নির্বাচন দিতে হতে পারে; অথবা ব্রিটিশ সরকারের উত্তর আয়ারল্যান্ড সচিবকে নতুন কোন পদ্ধতি বের করতে হবে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাথে ব্রিটেনের বাকি অংশের বাণিজ্য যে নীতিতে চলছে, তার মাঝে কিছু আইন ব্রিটেন একতরফাভাবে বাতিল করতে পারে বলে জানিয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার অনেক বড় ঝুঁকি নিতে চলেছে; কারণ এর মাধ্যমে ব্রিটেন আবারও ইইউএর সাথে দ্বন্দ্বে জড়াতে পারে।

১৯৯৮ সালের ‘গুড ফ্রাইডে এগ্রিমেন্ট’এর মাধ্যমে উত্তর আয়ারল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ শেষ হয় এবং ‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি’র সদস্যরা অস্ত্র ফেলে পার্লামেন্টে এসে বসে। তবে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় জাতীয়তাবাদীরা কখনোই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক পদটা পায়নি। দেশটার রাজনৈতিক বিভেদের মাঝে জাতিগত এবং ধর্মীয় ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্যাথোলিক খ্রিস্টানদের বেশিরভাগই নিজেদেরকে আইরিশ বলে আখ্যা দেয়; অপরদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের বেশিরভাগই নিজেদেরকে ব্রিটিশ বলে আখ্যা দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাধীন দেশ রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের অংশ নয়; এবং সেখানে বেশিরভাগ জনগণই হলো ক্যাথোলিক খ্রিস্টান। ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটেনের প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানরা উত্তর আয়ারল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে সেখানে ব্রিটেনের শাসনকে মজবুত করেছে। বর্তমানে দেশটার প্রোটেস্ট্যান্ট জনগণ সেই বসতি স্থাপনকারীদেরই বংশধর।

 
ব্রেক্সিটের ভোটে ব্রিটেনের একেক অংশের ফলাফল ছিল একেক রকম। ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার ব্যাপারে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসএর জনগণ যতটা উৎসুক ছিল, স্কটিশ এবং আইরিশরা ততটা ছিল না। এখন ব্রেক্সিটের পর তারা মনে করছে যে, ব্রিটেনের সাথে একত্রে থাকাটা তাদের জন্যে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনছে না।

‘সিন ফেইন’ বলছে যে, তারা আয়ারল্যান্ডের একত্রীকরণের ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। দলটার নেতা লু ম্যাকডোনাল্ড বলছেন যে, পাঁচ বছরের মাঝে তারা আয়ারল্যান্ডের একত্রীকরণের জন্যে গণভোটের ডাক দেবেন। অপরদিকে ইউনিয়নিস্টরা বলছে যে, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে জাতীয়তাবাদীরা কম ভোট পেয়েছে; তাই গণভোটের প্রশ্নই আসে না। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২৮শে মে প্রায় ১০ হাজার ইউনিয়নিস্ট উত্তর আয়ারল্যান্ডের শতবর্ষ উদযাপন করে। অনুষ্ঠানে ‘অরেঞ্জ অর্ডার’এর গ্র্যান্ড মাস্টার এডওয়ার্ড স্টিভেনসন ঘোষণা দেন যে, উত্তর আয়ারল্যান্ড সবসময় ব্রিটেনের অংশই থাকবে।

ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নেবার যে স্বপ্ন ব্রিটেন দেখেছে, সেখানে একটা শক্ত কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে জাতীয়তাবাদ। কারণ উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিচ্ছন্নতাবাদীরা এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও স্কটল্যান্ড কিন্তু ২০১৪ সালে ব্রিটেন থেকে আলাদা হবার জন্যে গণভোটের আয়োজন করেছে; যেখানে ৪৫ শতাংশ জনগণ স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ব্রেক্সিটের পক্ষে বিপক্ষে ভোটই বলে দিয়েছে যে, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড বাকি ব্রিটেনের থেকে ভিন্নভাবে চিন্তা করছে। অর্থাৎ ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার ব্যাপারে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসএর জনগণ যতটা উৎসুক ছিল, স্কটিশ এবং আইরিশরা ততটা ছিল না। এখন ব্রেক্সিটের পর তারা মনে করছে যে, ব্রিটেনের সাথে একত্রে থাকাটা তাদের জন্যে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনছে না।

ব্রিটেনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে ইউরোপের মূল ভূখন্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি গত কয়েক’শ বছরে বিভিন্ন সময়ে আইরিশ ক্যাথোলিকদেরকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। সেই হিসেবে আয়ারল্যান্ড সর্বদাই ব্রিটেনের অস্তিত্বের প্রতি একটা হমকি হয়ে কাজ করেছে। আইরিশ দ্বীপে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্যেই ব্রিটেন উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। একুশ শতকেও সেই ইতিহাসই বয়ে বেড়াচ্ছে উত্তর আয়ারল্যান্ড। তবে পশ্চিমা দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ভোট যদি স্কটল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে অনুপ্রাণিত করে, তবে সেটাই ব্রিটেনের জন্যে বেশি দুশ্চিন্তার হবে। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে নিজেদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই যখন বেশিরভাগ মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ব্রিটেনের অখন্ডতা প্রশ্নাতীত থাকছে না।

Tuesday 17 May 2022

রাশিয়ার উপর অবরোধের ব্যাপারে জাপান বাস্তববাদীই থাকছে

১৭ই মে ২০২২

১২ই মে ২০২২। ইইউএর নেতৃবৃন্দের সাথে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা। ইউরোপই যখন নিজেদের গণতান্ত্রিক আদর্শকে সমুন্নত রাখাতে গিয়ে রাশিয়ার জ্বালানির উপর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে, তখন জাপানকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনাটাই অবান্তর। কারণ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলি যে নিজেদের অর্থনীতিকে অন্য সকল বিষয়ের উপরে রাখবে, সেটাই স্বাভাবিক।


গত ১২ই মে জাপানের রাজধানী টোকিওতে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইয়েন এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেলএর সাথে এক যৌথ সংবাদ সন্মেলনে জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেন যে, ইউক্রেনে হামলার কারণে ইইউ এবং জাপান একত্রে রাশিয়ার উপর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে এবং একইসাথে তারা জ্বালানি সরবরাহ উন্নয়নে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। কিশিদা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কথা বললেও জাপান বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে না। কিশিদার সংবাদ সন্মেলনের দু’দিন আগে ১০ই মে জাপানের অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী কোইচি হাগিউদা সাংবাদিকদের বলেন যে, জাপান তার অর্থনীতির উপর প্রভাব বিবেচনা করেই রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা বন্ধ করবে। হাগিউদা বলছেন যে, তারা কিছু সময় নিয়ে রুশ জ্বালানি তেল আমদানি কমাতে বা পুরোপুরি বন্ধ করতে পদ্ধতি ডেভেলপ করতে চাইছেন, যাতে করে জাপানের ব্যবসা এবং জনগণের জীবনের উপর এর প্রভাবগুলি সর্বনিম্ন রাখা সম্ভব হয়; কারণ বিকল্প উৎস নিশ্চিত না করে জাপান হঠাৎ করেই রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধ করতে পারবে না।

‘আল জাজিরা’ জানাচ্ছে যে, ২০২১ সালে জাপান রাশিয়া থেকে তার মোট তেলের ৪ শতাংশ এবং মোট গ্যাসের ৯ শতাংশ আমদানি করেছিল। কিছুদিন আগেই ‘জি-৭’এর সহযোগী দেশগুলির সাথে আলোচনায় ইউক্রেন হামলার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করতে রাজি হয়েছিল জাপান। শিল্পমন্ত্রীর সংবাদ সন্মেলনের একদিন আগেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, জাপান ধীরে ধীরে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধ করবে। শিল্পমন্ত্রী হাগিউদা দৃঢ়ভাবে বলেন যে, বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ তেল এবং গ্যাস উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ দেশ; তাদের উচিৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে একটা নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা। যুক্তরাষ্ট্রে তরলীকৃত গ্যাস প্রকল্প রয়েছে, যেখানে বেশ স্বল্প সময়ের মাঝে উৎপাদন বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে। জাপান সরকার সেখানে বিনিয়োগ করতে রাজি আছে।

গত ৯ই মে প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সাংবাদিকদের বলেন যে, রাশিয়ার পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ‘সাখালিন-১’ এবং ‘সাখালিন-২’ জ্বালানি প্রকল্পে জাপানের যে বিনিয়োগ রয়েছে, সেগুলি জাপান তুলে নেবে না। এই প্রকল্পগুলি থেকে জাপান তেল এবং গ্যাস আমদানি করে থাকে। রাশিয়ার জ্বালানি প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগের ব্যাপারে এই কথাগুলি নতুন নয়। এর আগে গত ১৫ই এপ্রিল জাপানি শিল্পমন্ত্রী হাগিউদা সাংবাদিকদের বলেন যে, জাপান যদি রাশিয়ার জ্বালানি প্রকল্প থেকে সড়ে আসে এবং জাপানের অংশটা যদি রাশিয়া বা তৃতীয় কোন দেশ কিনে নেয়, তাহলে সেটা রাশিয়ার উপর অবরোধকে দুর্বল করে ফেলবে। কারণ এতে রুশ সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং তা রাশিয়াকে সহায়তা দেবে। জাপানের বিনিয়োগের অংশটা যদি তৃতীয় কোন দেশ কিনে নেয়, তাহলে জাপানের বিনিয়োগ তুলে নেয়াটা রাশিয়ার জন্যে কোন ক্ষতি বয়ে আনবে না। 

সাখালিন দ্বীপে রাশিয়ার হাইড্রোকার্বন প্রকল্পে জাপানের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। জাপান বলছে যে, জাপানের বিনিয়োগের অংশটা যদি তৃতীয় কোন দেশ কিনে নেয়, তাহলে জাপানের বিনিয়োগ তুলে নেয়াটা রাশিয়ার জন্যে কোন ক্ষতি বয়ে আনবে না। তাই তারা সেখান থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নেবে না বলে জানিয়েছে।


জাপান পশ্চিমা দেশগুলির নীতি সরাসরি অনুসরণ করছে না। ১৩ই মে ব্রিটিশ ডাচ কোম্পানি ‘শেল’ ঘোষণা দেয় যে, তারা রাশিয়াতে তাদের তেল বিপনন ব্যবসা রুশ কোম্পানি ‘লুকঅয়েল’এর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ব্রিটিশ তেল কোম্পানি ‘বিপি’ ও ‘শেল’, মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’ এবং নরওয়ের কোম্পানি ‘ইকুইনর’ ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা রাশিয়া থেকে তাদের বিনিয়োগ সড়িয়ে নেবে। আর ফরাসি কোম্পানি ‘টোটাল’ ঘোষণা দেয় যে, তারা রাশিয়াতে নতুন কোন বিনিয়োগে যাবে না। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলি নিজেরাই এখনও রুশ জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করতে পারছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে ইইউএর দেশগুলি রাশিয়া থেকে প্রতি মাসে ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানি আমদানি করেছে। অথচ ২০২১ সালে জ্বালানির মূল্য অপেক্ষাকৃত কম থাকায় তখন তারা প্রতি মাসে রাশিয়া থেকে সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি আমদানি করেছিল।

‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, একটা প্রধান জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশের উপর অবরোধ দেয়া যে কতটা কঠিন, তা এখন সকলেই টের পাচ্ছে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে রুশ সরকারের কর থেকে আয় ১’শ ৮০ বিলিয়ন ডলার হতে চলেছে; যা কিনা আগের বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি! অবরোধের কারণে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল রপ্তানি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ কমেছে। চীন এবং ভারতের মতো দু’টা বড় অর্থনীতি রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করেনি। তবে এশিয়াতে রাশিয়ার জ্বালানি বিক্রির দুর্বলতা হলো পাইপলাইনের অপ্রতুলতা। শুধুমাত্র তেলের জাহাজ দিয়ে তেল রপ্তানি করাটা ব্যয়সাধ্য। একারণে স্বল্পমেয়াদে মূল্যস্ফীতির কারণে রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি থেকে আয় বৃদ্ধি হলেও মধ্যমেয়াদে জ্বালানি রপ্তানির অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া রাশিয়ার পক্ষে এশিয়াতে রপ্তানি বৃদ্ধি করাটা কঠিন। ‘ক্লিয়ারভিউ এনার্জি পার্টনার্স’এর প্রধান নির্বাহী কেভিন বুক ‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’কে বলছেন যে, ইইউ যেভাবে পরিকল্পনা করে রাশিয়ার জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে, সেটা মোটেই পরিকল্পিত হবে না। কারণ একদিকে ইউরোপ যেমন মূল্যস্ফীতির মারাত্মক প্রভাবকে এড়াতে পারছে না; অরপদিকে ইইউএর মাঝেই অবরোধের ব্যাপারে একাত্মতা এখনও গড়ে ওঠেনি। আর যদি ইইউএর অবরোধ কার্যকর করা হয়, তাহলে মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে।

জাপান সরকার আদর্শিক নয়, বরং বাস্তববাদী হবারই চেষ্টা করছে। তারা একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউএর মতো বাণিজ্য সহযোগীদের দূরে ঠেলে দিতে চাইছে না, তেমনি রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে নিজেদের অর্থনীতিকেও ক্ষতির মাঝে ফেলতে উচ্ছুক নয়। এটা পরিষ্কার যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে রাশিয়ার অর্থনীতির উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। আর জাপানের মতো অনেক দেশই, বিশেষ করে চীন এবং ভারত, রাশিয়ার জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতাকে দোষের কিছু মনে করছে না। অন্ততঃ ইউরোপই যখন নিজেদের গণতান্ত্রিক আদর্শকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে রাশিয়ার জ্বালানির উপর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে, তখন জাপানকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনাটাই অবান্তর। কারণ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলি যে নিজেদের অর্থনীতিকে অন্য সকল বিষয়ের উপরে রাখবে, সেটাই স্বাভাবিক।

Monday 16 May 2022

‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার কেন স্পেন এবং মরক্কোর মাঝে সম্পর্ককে উত্তপ্ত করছে?

১৬ই মে ২০২২

 
‘পেগাসাস’এর ব্যবহার স্পেন এবং মরক্কোর সম্পর্কের মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; যা এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ইস্রাইলের অবস্থান জানান দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ইস্রাইল তার নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কৌশলগত দরকষাকষি বৃদ্ধি করেছে। বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমতে থাকার সাথেসাথে ইস্রাইল এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত; যা কিনা নতুন নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার জন্ম দিচ্ছে।


গত ২রা মে স্পেনের ক্যাবিনেট মন্ত্রী ফেলিক্স বোলানিয়স তড়িঘড়ি করে আয়োজিত এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, সেদেশের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মারগারিতা রোবলসএর ফোন ইস্রাইলের ডেভেলপ করা ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ২০২১ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর ফোন দু’বার এবং জুন মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ফোন একবার আক্রান্ত হয়। এই কর্মকান্ডের মাধ্যমে দুই মন্ত্রীর ফোন থেকে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য চুরি করা হয়। তিনি বলেন যে, এই কাজটা স্পেনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে থেকে করা হয়েছে। বোলানিয়স বলেননি যে, কে এই স্পাইওয়্যারের পিছনে থাকতে পারে। তবে তিনি বলেন যে, স্পেনের আইনবিভাগ এবং পার্লামেন্ট এব্যাপারে তদন্ত করছে। এই ঘটনার জের ধরে ১০ই মে স্পেন সরকার ঘোষণা দেয় যে, দেশটার ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিএনআই’এর প্রধান পাজ এস্তেবানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যদিও এই বরখাস্তকে সরকার ‘প্রতিস্থাপন’ বলে আখ্যা দিয়েছে, তথাপি সরকার দেশটার ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিএনআই’এর কর্মকান্ডের ব্যার্থতাকে তুলে ধরেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ফোনের উপর যে গোয়েন্দাবৃত্তি হয়েছে, সেটা বুঝতে কেন এক বছর সময় লেগেছে, সেব্যাপারে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রশ্ন করছেন।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২১এর মাঝামাঝি সময়ে স্পেনের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক খুবই খারাপ পর্যায়ে ছিল। একইসাথে স্পেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাতালোনিয়া অঞ্চলের আটককৃত নেতাদের ছেড়ে দেয়া নিয়ে সেসময় অভ্যন্তরীণভাবেও উত্তাল ছিল স্পেন। স্পেন এবং মরক্কোর দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে ছিল মরক্কোর নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিম সাহারা অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের নেতাকে স্পেনে চিকিৎসার জন্যে ঢুকতে দেয়া এবং এরপর মরক্কোর মূল ভুখন্ডে স্প্যানিশ ছিটমহল সেউতাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ৮ হাজার উদ্বাস্তুর আগমণ। মরক্কো সরকার অস্বীকার করেছিল যে, তারা উদ্বাস্তুদেরকে স্পেনের ছিটমহলে ঢুকতে কোনপ্রকার সহায়তা দিয়েছিল।

‘এনপিআর’এর সাথে এক সাক্ষাতে মাদ্রিদের সাংবাদিক হোজে বাউতিস্তা বলছেন যে, ২০২১ সালে প্যারিসভিত্তিক তদন্তমুখী সংবাদ সংস্থা ‘ফরবিডেন স্টোরিজ’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে; যেখানে বলা হয় যে, মরক্কো ইস্রাইলি ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ১০ হাজারের বেশি মানুষের উপর গোয়েন্দাবৃত্তি করছে। এগুলির মাঝে ২’শ মোবাইল ফোন নম্বরের মালিক হলেন স্প্যানিশ নাগরিকেরা; যাদের মাঝে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী। গত বছর মে এবং জুন মাসে স্পেনের সাথে মরক্কোর কূটনৈতিক সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে; যার মূল কারণ ছিল মরক্কোর নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিম সাহারা অঞ্চল; যা কিনা একসময় স্প্যানিশ উপনিবেশ ছিল। ২০২০এর ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পশ্চিম সাহারার উপর মরক্কোর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার ঘোষণা দেন। এর বিনিময়ে মরক্কো ইস্রাইলকে স্বীকৃতি দেয়। এতে মরক্কো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থানকে অনেক শক্তিশালী মনে করতে শুরু করে। অনেকেই মনে করেছিলেন যে, জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে আসার পর ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন; কিন্তু বাইডেন সেটা করেননি। অপরদিকে স্পেন পশ্চিম সাহারার ইস্যু থেকে দূরে থাকতে পারছে না; কারণ তারা ঔপনিবেশিক সময় থেকেই পশ্চিম সাহারার সাহরাউই জনগণের সাথে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছে। পশ্চিম সাহারা ইস্যুতে স্পেন সর্বদাই নিরপেক্ষ একটা অবস্থানে থাকার চেষ্টা করেছে; যদিও সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম সাহারাকে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেয়ার মরক্কো সরকারের সিদ্ধান্তকেই মেনে নেয়ার কথা বলছে স্প্যানিশরা। বাউতিস্তা মনে করছেন যে, ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যারের এই ইস্যু পশ্চিম সাহারার ক্ষেত্রে স্প্যানিশ সরকারের অবস্থানকে পরিবর্তন করতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করছে স্প্যানিশরা ‘পেগাসাস’এর উৎসটা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে কিনা; যা খুব একটা সহজ কাজ হবে না।

 
স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজের সোশালিস্ট সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের নেতৃত্বে থাকা বামপন্থী দল ‘ইআরসি’র নেতা পেরে আরাগোনেসএর সমর্থনের উপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। তবে ‘ইআরসি’ দল বেশ বাস্তববাদী। তারা হয়তো ইন্টেলিজেন্স প্রধানকে বরখাস্তের ব্যাপারটাকে ভালোভাবেই নেবে। তারা ভালো করেই জানে যে, বর্তমানে ক্ষমতাসীন বামপন্থী দলের উপর ‘ইআরসি’র যতটা প্রভাব রয়েছে, ডানপন্থীরা ক্ষমতায় আসলে সেটা থাকবে না।

স্পেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাতালোনিয়াতে ‘পেগাসাস’এর ভূমিকা

গত ১৮ই এপ্রিল কানাডার ‘ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো’র সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ‘দ্যা সিটিজেন ল্যাব’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে; যেখানে বলা হয় যে, স্পেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল কাতালোনিয়ার কমপক্ষে ৬৫ জন ব্যক্তির মোবাইল ফোনে ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার পাওয়া গিয়েছে। এই ব্যক্তিদের মাঝে রয়েছে কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট পেরে আরাগোনেস এবং বেশ ক’জন আইনজীবি, সাংবাদিক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিক। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মাঝে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে কাতালান নেতাদের উপর গোয়ান্দাগিরির ব্যাপারটা নিয়ে স্পেনের সোশালিস্ট সরকার বেশ চাপের মাঝে ছিল। বরখাস্তের পাঁচ দিন আগে গত ৫ই মে স্পেনের ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিএনআই’এর প্রধান পাজ এস্তেবান পার্লামেন্টের তদন্ত কমিটির সামনে বলেন যে, আইন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ১৮ জন কাতালান নেতার উপর গোয়েন্দাবৃত্তি করা হয়েছিল।

ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, তারাই ২০২০এর জুনে স্পেনের পত্রিকা ‘এল পায়িস’এর সাথে যুক্ত হয়ে প্রকাশ করেছিল যে, স্পেনের স্বাধীনতাকামী কাতালোনিয়া অঞ্চলের শীর্ষ নেতাদের উপর নজরদারি করার জন্যে ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছিলো। ‘পেগাসাস’ হলো ইস্রাইলি কোম্পানি ‘এনএসও’র ডেভেলপ করা গোয়েন্দাবৃত্তির একটা সফটওয়্যার; যা কারো মোবাইল ফোনে ঢোকানো গেলে সেই মোবাইল ফোন থেকে ই-মেইল পড়া ছাড়াও, মোবাইলে রাখা ছবি এবং মেসেজও ডাউনলোড করা সম্ভব। এছাড়াও ‘পেগাসাস’ সেই ফোনের অডিও রেকর্ডার এবং ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেই ফোনকে একটা গোয়েন্দাবৃত্তির বস্তুতে পরিণত করতে পারে। কোম্পানিটা বলছে যে, এই স্পাইওয়্যার তারা কোন রাষ্ট্রের সরকার ছাড়া কারুর কাছে বিক্রি করে না। কাতালান নেতাদের উপর গোয়েন্দাবৃত্তির কাজটা খুব সম্ভবতঃ ২০১৯এর এপ্রিল এবং মে মাসে করা হয়েছিল। এর প্রায় দু’বছর আগে কাতালানরা স্পেন থেকে আলাদা হবার জন্যে একটা গণভোট আয়োজন করেছিল। কাতালানদের উপর গোয়েন্দাবৃত্তির ব্যাপারটা হয়তো স্প্যানিশ ইন্টেলিজেন্সই করেছে। কিন্তু স্প্যানিশ মন্ত্রীদের উপর গোয়েন্দাবৃত্তির ব্যাপারটা পুরোপুরি আলাদা। সরকার বলছে যে, রাষ্ট্রের কাঠামোর বাইরে থেকে কেউ এটা করেছে; যার অর্থ হলো অন্য কোন রাষ্ট্র এটা করেছে। এখানে মরক্কোর নাম আসলেও মরক্কো সরকার বলছে যে, সাংবাদিকরা এখন পর্যন্ত মরক্কোর সাথে ‘পেগাসাস’এর নির্মাতা ‘এনএসও’র কোন সম্পর্ক দেখাতে পারেনি। আর মরক্কো সরকার অন্য কোন রাষ্ট্রের নেতৃত্বের উপর নজরদারি করে না বলেও বলছেন তারা।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, স্পেনের সোশালিস্ট সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের নেতৃত্বে থাকা বামপন্থী দল ‘ইআরসি’র নেতা পেরে আরাগোনেসএর সমর্থনের উপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। যেকারণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সানচেজ আগের কনজারভেটিভ প্রশাসনের চাইতে কাতালোনিয়ার ব্যাপারে অনেকটাই ছাড় দেয়ার নীতিতে এগিয়েছেন। যদিও তিনি কাতালোনিয়ায় গণভোট হবার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন, তথাপি তিনি তাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। ২০২১ সালে কাতালোনিয়ার ৯ জন শীর্ষ নেতাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে সানচেজের সরকারকে বিরোধীদের চরম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। এখন এই গোয়েন্দাবৃত্তির খবরগুলি স্পেনের সোশালিস্ট সরকারের উপর ‘ইআরসি’র বিশ্বাসকে ভেঙ্গে দেবে। তবে কাতালোনিয়ার ‘ইআরসি’ দল বেশ বাস্তববাদী। তারা হয়তো ইন্টেলিজেন্স প্রধানকে বরখাস্তের ব্যাপারটাকে ভালোভাবেই নেবে। তারা ভালো করেই জানে যে, বর্তমানে ক্ষমতাসীন বামপন্থী দলের উপর ‘ইআরসি’র যতটা প্রভাব রয়েছে, ডানপন্থীরা ক্ষমতায় আসলে সেটা থাকবে না। স্পেনের কনজারভেটিভ বিরোধী দল বলছে যে, ইন্টেলিজেন্স প্রধান এস্তেবানের ‘মস্তক’ কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের হাতে তুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সানচেজ তার রাজনৈতিক অবস্থানকে বাঁচাচ্ছেন।

 

মরক্কো এবং জিব্রালটারের নিয়ন্ত্রণ

কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিব্রালটার প্রণালির দক্ষিণ প্রান্তের মালিক মরক্কো অনেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৭০৪ সাল থেকে ব্রিটেন জিব্রালটারে সামরিক ঘাঁটি রেখে চলেছে। আর এই প্রণালির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে ব্রিটেন সকল কিছুই করেছে। ১৮৮৪ সালে বার্লিন কনফারেন্সে ব্রিটিশদের সমর্থনে স্পেন মরক্কোর দক্ষিণের পশ্চিম সাহারা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পায়। ১৯০৫ সালে জার্মানি মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করলে ব্রিটেনের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। ১৯১১ সালে জার্মানি আবারও মরক্কোতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে ব্রিটেন আবারও হুমকি দেয়। ১৯৭৫ সালে স্প্যানিশরা পশ্চিম সাহারা ছেড়ে দেয়ার পর থেকে সেখানে দ্বন্দ্ব চলছে। এবং সেসময় থেকেই পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্বে স্পেন একটা ভূমিকা রেখে চলছে। বর্তমানে মরক্কোর নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিম সাহারার স্বাধীনতাকামী ‘পলিসারিও ফ্রন্ট’এর ব্যাপারে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি স্পেন যেমন সর্বদাই জড়াচ্ছে, ঠিক তেমনি এখন স্পেনের রাজনীতিতেও মরক্কোর নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে মরক্কো স্পেনের ছিটমহল সেউতাতে হাজারো শরণার্থীকে ঠেলে দিয়ে স্পেনকে চাপের মাঝে ফেলেছে। হয়তো সেকারণেই স্পেন সরকার পশ্চিম সাহারার ব্যাপারে মরক্কো সরকারের নীতির সাথে সমান্তরালে থাকার চেষ্টা করেছে। ১৯৭০এর দশকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ব্রিটেনের প্রস্থানে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধির সাথেসাথে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মরক্কোর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। কারণ সেসময় থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরে মার্কিন উপস্থিতি রাখার জন্যে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমানগুলির জন্যে মরক্কো একটা ‘দরজা’র ভূমিকা পালন করে আসছে। পশ্চিম সাহারায় স্বাধীনতাকামী বামপন্থী ‘পলিসারিও ফ্রন্ট’এর সাথে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দেয়। এখনও মরক্কোর প্রধান সামরিক সরঞ্জামগুলি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি।

একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোকে পশ্চিম সাহারার প্রকৃত মালিক বলে ঘোষণা দিচ্ছে, ঠিক তার প্রতিদানে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে মরক্কোর পররাষ্ট্রনীতিতে ইস্রাইলের তৈরি ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যারের নাম আসতে শুরু করেছে। পশ্চিম সাহারা ইস্যুতে স্পেনের সাথে ইউরোপিয় ইউনিয়ন থাকলেও মরক্কোর পক্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষে সেখানে যুক্ত হয়েছে ইস্রাইল। তবে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিব্রালটার প্রণালির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন পরিষ্কার। মরক্কো এবং স্পেনের মাঝে পশ্চিম সাহারা, শরণার্থী এবং এখন ‘পেগাসাস’ ইস্যুতে উত্তেজনায় এ ব্যাপারটা প্রকাশ পাচ্ছে। ‘পেগাসাস’এর ব্যবহার স্পেন এবং মরক্কোর সম্পর্কের মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; যা এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ইস্রাইলের অবস্থান জানান দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ইস্রাইল তার নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কৌশলগত দরকষাকষি বৃদ্ধি করেছে। বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমতে থাকার সাথেসাথে ইস্রাইল এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত; যা কিনা নতুন নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার জন্ম দিচ্ছে।

Saturday 14 May 2022

ইথিওপিয়ায় হঠাৎ যুদ্ধবিরতির কারণ কি?

১৫ই মে ২০২২
যুদ্ধবিরতির পর জাতিসংঘের ট্রাকগুলি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে তিগ্রে অঞ্চলে পৌঁছাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলি যখন ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ইথিওপিয়ার সরকারের ‘মানবিক’ যুদ্ধবিরতি অনেকেই পছন্দ করছে।  ড্রোন ব্যবহারে ইথিওপিয়া সরকার যখন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চাপই ইথিওপিয়ার সরকারকে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।

 
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ঠিক একমাস পর ২৪শে মার্চ ইথিওপিয়ার সরকার দেশটার উত্তরের তিগ্রে অঞ্চলের নেতৃত্বের সাথে চলা ১৭ মাসের গৃহযুদ্ধে সকলকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করেই একতরফাভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। সরকার বলে যে, এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা যাবার একটা সুযোগ করে দেবে। এর চার দিন পর তিগ্রে অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘টিপিএলএফ’ এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পক্ষে বিবৃতি দেয়। একইসাথে তারা বলে যে, তারা শান্তিচুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী, তবে খুব বেশি একটা নয়। ২৫শে এপ্রিল তিগ্রে বিদ্রোহীরা আফার অঞ্চল থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়; যা কিনা ইথিওপিয়ার সরকার তিগ্রে অঞ্চলে মানবিক সহায়তা যেতে দেবার জন্যে শর্ত হিসেবে দেখছিল।

৫ই মে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফানে দুজাররিক সাংবাদিকদের বলেন যে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে চার দফায় সড়কপথে ১’শ ৬৯টা ট্রাকে করে মোট ৪ হাজার ৩’শ টন দ্রব্য সেখানে পরিবহণ করা সম্ভব হয়েছে। তথাপি এই ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। আর বিশেষ করে ইথিওপিয় সরকার তিগ্রে অঞ্চলে বিদ্যুৎ, টেলিকম এবং ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করে দেয়ায় সেখানে যেকোন কিছু করাই কঠিন হয়ে গেছে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘ডব্লিউএফপি’র হিসেবে তিগ্রে অঞ্চলে দিনে ১’শ ট্রাক মালামাল নেয়া প্রয়োজন; আর পরিবহণ চালিয়ে নেয়ার জন্যে সপ্তাহে ২ লক্ষ লিটার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন। জানুয়ারি মাস থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত আকাশপথে তিগ্রে অঞ্চলে মোট ৪’শ ২৮ মেট্রিক টন খাদ্য পাঠানো গেছে; যা কিনা মাত্র ১১ ট্রাকের সমপরিমাণ!

অনেকেই বলছেন যে, তিগ্রে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছে ড্রোন। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কেউ স্বীকার না করলেও ইথিওপিয়া সরকারকে তুরস্ক, ইরান, চীন এবং সম্ভবতঃ আরব আমিরাত মনুষ্যবিহীন ড্রোন সরবরাহ করেছে। ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ বা ‘আইসিজি’র এক বিশ্লেষণে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে যে, ২০২১এর জুনে তিগ্রেরা সরকারি বাহিনীকে তাদের অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। এরপর তারা তিগ্রে অঞ্চল থেকে বের হয়ে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার মাত্র ১’শ কিঃমিঃএর মাঝে পৌঁছে যায়। তবে সরকারি বাহিনী বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ড্রোন ব্যবহার শুরুর পর থেকে তিগ্রে বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। অপরদিকে তিগ্রে অঞ্চলের পক্ষে শক্তিশালী কোন দেশ দেশ অবস্থান না নেয়ায় এবং তিগ্রেদের সাথে যোগ দেয়া অরোমো অঞ্চলের গেরিলারা খুব একটা শক্তিশালী ভূমিকা না রাখতে পারায় তিগ্রেদের জয়লাভের আশা স্তিমিত হয়ে যায়। ২০২১এর ২২শে ডিসেম্বর ইথিওপিয়ার সরকার ঘোষণা দেয় যে, সরকারি বাহিনী তিগ্রে অঞ্চলের ভেতরে আর ঢুকবে না।

 
তিগ্রের পশ্চিমাঞ্চল এখন এরিত্রিয়া সমর্থিত আমহারাদের দখলে; যার ফলে তিগ্রেরা সুদানের সাথে সরাসরি স্থলযোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন। সরকারের শর্তের বেড়াজালে পড়ে তিগ্রেরা যদি সামনের দিনগুলিতে সুদানের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পশ্চিমাঞ্চল দখল করতে চায়, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।

‘আইসিজি’ বলছে যে, ইথিওপিয়ার অর্থনীতি হয়তো যুদ্ধবিরতির পিছনে ভূমিকা রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই দেশটার মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে খরা, ঋণ পরিশোধ করতে না পারা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আইএমএফএর চাপ প্রয়োগ শুরু হয়েছে। অপরদিকে তিগ্রেরা চাইছে তাদের অঞ্চলের পশ্চিমাংশ ফেরত পেতে, যা কিনা যুদ্ধের শুরুতেই পার্শ্ববর্তী দেশ এরিত্রিয়ার সহায়তায় আমহারা অঞ্চলের মিলিশিয়ারা দখল করে নেয় এবং ৭ লক্ষ তিগ্রেকে জোরপূর্বক ঘরছাড়া করে। এর ফলে তিগ্রেরা তাদের প্রতি সদাচরণ করা সুদানের সীমানার সাথে যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে সীমান্ত শহর হুমেরা দখল করে রাখার মাধ্যমে এরিত্রিয়া এবং আমহারা তিগ্রে অঞ্চলকে বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং যেকোন ত্রাণের জন্যে তিগ্রেকে ইথিওপিয়া সরকারের মর্জির উপর নির্ভরশীল করে। এখন ইথিওপিয়া সরকার সেই ত্রাণের বিনিময়ে তিগ্রেদের কাছ থেকে অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চাইছে। তিগ্রের পশ্চিমাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব খুব সহজেই চলে যাচ্ছে না। সরকারের শর্তের বেড়াজালে পড়ে তিগ্রেরা যদি সামনের দিনগুলিতে সুদানের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পশ্চিমাঞ্চল দখল করতে চায়, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।

ইথিওপিয়া সরকারের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার একমাস পর এবং তিগ্রে বাহিনীর আফার অঞ্চল ত্যাগ করার চার দিন পর ২৯শে এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন এক বার্তায় ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদের সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন যে, ইথিওপিয়া সরকারের অনেকগুলি পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধ শেষ হবার একটা আশা তৈরি হয়েছে; যেগুলির মাঝে রয়েছে জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া, কিছু রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়া, এবং একটা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করা। একইসাথে তিনি তিগ্রেদের প্রশংসা করেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্যে এবং আফার অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে নেয়ার জন্যে। সবশেষে তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একটা একত্রিত সার্বভৌম ইথিওপিয়া চায়, যেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাঝে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাতে করে দেশটার বিভাজনগুলি কাটিয়ে ওঠা যায়।

যুদ্ধবিরতি পুরোপুরিভাবে কার্যকর করাটা যে খুব একটা সহজ নয়, তার প্রমাণ মিলে খুব দ্রুতই। ব্লিনকেনের বিবৃতির দিনই ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আমহারা অঞ্চলে অরোমিয়ার সাথে সীমান্তে কিছু সশস্ত্র গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, শেওয়া রাবিত শহরে দুই গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। তবে এতে কোন গ্রুপগুলি জড়িত ছিল, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে; কারণ একপক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করছে।

পশ্চিমা দেশগুলি যখন ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ইথিওপিয়ার সরকারের ‘মানবিক’ যুদ্ধবিরতি অনেকেই পছন্দ করছে। অন্ততঃ মার্কিন সরকারের কাছে ইথিওপিয়া সরকারের পক্ষ নেয়াটা অনেক সহজ হয়েছে; যেখানে ওয়াশিংটনের পছন্দের নোবেল বিজয়ী আবি আহমেদের সরকারের ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবরগুলি যুক্তরাষ্ট্রকে পীড়াদায়ক অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। ড্রোন ব্যবহারে ইথিওপিয়া সরকার যখন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চাপই ইথিওপিয়ার সরকারকে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। তবে বলাই বাহুল্য যে, যুদ্ধবিরতি কোন শান্তি চুক্তি নয়; অস্থির আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির একটা প্রতিফলন মাত্র। দেশটার জাতিগত বিরোধগুলি যুদ্ধের মাঝে দগদগে ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে; যা মুছে ফেলা কঠিন। এই বিভেদগুলিই পূর্ব আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন’ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার জ্বালানি হয়েছে।

Sunday 8 May 2022

রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে আফ্রিকা

০৮ই মে ২০২২

আফ্রিকা-রাশিয়া বৈঠক; সচি, রাশিয়া। ২০১৯ সাল। আফ্রিকাতে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করে অন্য কোন শক্তি আসার ব্যাপারটা পশ্চিমাদের কাছে, তথা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভীতির কারণ। এমতাবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও পশ্চিমারা আফ্রিকাতে রুশ অবস্থানকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আফ্রিকাতে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও তা ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত; যা এখন পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।  

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, দুই মাসে ইউরোপে সূর্যমুখীসহ ভোজ্যতেলের মূল্য ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় অনেক দেশই নিজেদের মজুত নিশ্চিত করতে রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া সাম্প্রতিক সময়ে পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের মূল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যদিও রাশিয়া থেকে খাদ্য আমদানিতে বাধা দেয়া হয়নি, তথাপি রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের কারণে রুশ বিক্রেতাদেরকে মূল্য পরিশোধ করা কঠিন হয়ে গেছে এবং জাহাজের ইন্সুর‍্যান্সও পাওয়া যাচ্ছে না। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউএনডিপির আফ্রিকা বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ রেইমন্ড গিলপিন ৬ই মে জেনেভায় এক সাংবাদিকদের বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের অবরোধের কারণে আফ্রিকা অভূতপূর্ব সংকটের মাঝে পড়েছে। করোনার লকডাউন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকা যখন মারাত্মক সমস্যায় পতিত ছিল, তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য, সার ও জ্বালানির মূল্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বিশেষ করে আফ্রিকার তিনটা দেশের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে মূদ্রাস্ফীতির ফলাফল সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হবে; যেগুলি হলো আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে এবং পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওন। আফ্রিকার অনেক দেশই খাদ্য এবং সারের জন্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল। এই দুই দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভুট্টা, রাই সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের প্রধান যোগানদাতা। আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের দরকারের প্রায় ৮০ শতাংশ গম এই দুই দেশ থেকে আমদানি করে থাকে।

জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আহুন্না এজিয়াকোনওয়া বলছেন যে, এখন আফ্রিকার দেশগুলির জন্যে খাদ্য সরবরাহের রাতারাতি কোন বিকল্প নেই। গিলপিন বলছেন যে, পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, মধ্য আফ্রিকা এবং পূর্ব আফ্রিকার ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে সামাজিক সংঘাত চলছিল আরও আগে থেকেই; অর্থনৈতিক সমস্যা সেটাকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। শহরাঞ্চলে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে; সহিংস প্রতিবাদ এবং সংঘাতেও রূপ দিতে পারে। আর যে দেশগুলিতে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে নির্বাচনের কথা রয়েছে, সেগুলি বিশেষভাবে বিপদের মাঝে রয়েছে। গত এপ্রিলে আইএমএফও বলেছে যে, মূল্যস্ফীতির কারণে আফ্রিকায় সামাজিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এর আগে মার্চ মাসে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘ডব্লিউএফপি’র প্রধান ডেভিড বীসলি বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাবের যে সমস্যা চলছিল, তা অভূতপূর্ব আকার ধারণ করতে পারে। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বলেন যে, খাদ্য, জ্বালানি এবং পরিবহণ খরচের মারাত্মক বৃদ্ধির কারণে যারা না খেয়ে থাকছে, তাদের জন্যে আরও কম খাবার থাকবে।

 
আফ্রিকার অনেক দেশই খাদ্য এবং সারের জন্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল। এই দুই দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভুট্টা, রাই সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের প্রধান যোগানদাতা। আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের দরকারের প্রায় ৮০ শতাংশ গম এই দুই দেশ থেকে আমদানি করে থাকে।

উত্তর আফ্রিকার সাথে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাণিজ্য

‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ বা ‘আইসিজি’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কিছু দেশ সরাসরিই রাশিয়া পক্ষ নিয়েছে; আর বাকিরা রাশিয়া এবং পশ্চিম উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলার নীতিতে এগুচ্ছে। আর এরই মাঝে বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, পশ্চিমা দেশগুলি এখন তাদের নিজেদের এলাকা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের কথা নিয়ে চিন্তা করার সময় এখন তাদের নেই। উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া যুদ্ধরত দুই দেশ থেকে মাত্র ৩ শতাংশ গম আমদানি করে থাকে; কাজেই তারা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের গমের মজুদ রয়েছে। আর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে খাদ্য আমদানির উচ্চমূল্য তাদেরকে খুব বেশি সমস্যায় ফেলবে না। মরক্কোর ক্ষেত্রেও প্রায় একইরকম; কারণ দেশটার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গম রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসে। তবে মরক্কো তাদের ৪০ শতাংশ গম আমদানি করে; এবং সাম্প্রতিক সময়ে খরার কারণে গমের ফলন খারাপ হয়েছে। এমতাবস্থায় সরকার আটার উপর ভর্তুকি তিনগুণ বাড়িয়েছে। এই খরচাগুলি সরকার কোথা থেকে জোগাড় করবে সেটা না বললেও মরক্কোকে খুব সম্ভবতঃ আইএমএফ এবং আন্তর্জাতিক বন্ডের বাজার থেকে ঋণ নিতে হবে। মরক্কো জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়নি। তবে এই অবস্থান নেয়ার জন্যে মরক্কোর পশ্চিমা বন্ধুরা দেশটার তেমন সমালোচনা করেনি। বিতর্কিত পশ্চিম সাহারা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও মরক্কো চিন্তিত থাকতে পারে; কারণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ভেটো প্রদানের মাধ্যমে মরক্কোর চেষ্টাকে রুখে দিতে পারে। মস্কো এখন পর্যন্ত পশ্চিম সাহারা ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে।

অপরদিকে মিশরের ব্যাপারটা যথেষ্ট বিপজ্জনক; তারা তাদের ৮০ শতাংশ গমই রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে আমদানি করে। রুটির মূল্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও যুদ্ধের কারণে ভুট্টার মূল্য বৃদ্ধিতে দেশটাতে পশুখাদ্য উৎপাদনেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের আগে মিশরের পর্যটন ভিত্তিক অর্থনীতিতে রুশ এবং ইউক্রেনিয়ান পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এপ্রিল মাসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতার দেশটাকে ২২ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগের আস্বাস দিলেও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে দরিদ্র্য জনগণের জীবন আরও দুর্বিসহ হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের উপর জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে মিশর রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করার পরপরই মার্কিনীরা মিশরের কাছে ‘এফ-১৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রির ইচ্ছা পোষণ করা শুরু করে। অনেকেই মনে করছেন যে, এটা হলো মিশরের কাছে রুশ ‘সুখোই ৩৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রি বন্ধের একটা প্রচেষ্টা। কিন্তু এই প্রচেষ্টার পর মিশরের সাথে রাশিয়ার ‘টু প্লাস টু’ কূটনৈতিক বৈঠকে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের আলোচনা বলে দিচ্ছে যে, মার্কিন কূটনৈতিক সাফল্য কতটা সফল হয়েছে।

‘আইসিজি’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, আমদানিকৃত জ্বালানির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তিউনিসিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। দেশটা তাদের ৫০ শতাংশ গ্যাস এবং ৭০ শতাংশ জ্বালানি তেল বাজার মূল্যে যথাক্রমে আলজেরিয়া এবং খোলা বাজার থেকে ক্রয় করে। ২০২২ সালের বাজেটে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৭৫ ডলার ধরা হয়েছিল। এখন ১’শ ডলার মূল্যের কারণে জ্বালানি আমদানির খরচ ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন থেকে বেড়ে গিয়ে এবছরে ৪ বিলিয়ন ডলার হতে চলেছে। বাজেটের উপর চাপ কমাতে সরকার ইতোমধ্যেই জ্বালানির মূল্য কয়েক দফা বৃদ্ধি করেছে; যা কিনা জনগণের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে দেশটা তাদের গমের একটা বড় অংশ আমদানি করে, যার অর্ধেকই আসে ইউক্রেন থেকে। বর্তমান গমের মজুদ জুন মাস পর্যন্ত চলবে। সাম্প্রতিক সময়ে গত ছয় মাসের বাকি ৩’শ মিলিয়ন ডলার আমদানিমূল্যের অর্ধেক চেয়েছে ইউক্রেন; যা না দিলে তারা তিউনিসিয়াকে আর গম সরবরাহ করবে না। কাজেই জুন মাসে নতুন ফসল ঘরে তুলতে পারার আগেই গমের অপ্রতুলতা দেখা দিতে পারে।

 
ইউক্রেনের মাটিতে ব্যাপক ক্ষতির মাঝে পড়ার পরেও আফ্রিকাতে রাশিয়া তার সামরিক ও ব্যবসায়িক অবস্থানগুলিকে চালিয়ে নিচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে আফ্রিকার আরও দেশের সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা চুক্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

আফ্রিকার মাটিতে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব

ফরাসি বার্তা সংস্থা ‘আরএফআই’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, গত ১২ই এপ্রিল আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন রাশিয়ার সাথে একটা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি মোতাবেক দুই দেশ সামরিক তথ্য আদান প্রদান, প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়া ক্যামেরুনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। আর জাতিসংঘে সাম্প্রতিক ভোটাভুটিতে ক্যামেরুন রাশিয়ার বিপক্ষে যায়নি। বর্তমানে আফ্রিকার দেশ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, লিবিয়া, মালি এবং আরও কিছু দেশে রুশ সরকারের সমর্থনপুষ্ট ভাড়াটে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর সদস্যরা সরকারি বাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দিচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ল’ফেয়ার ইন্সটিটিউট’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনের মাটিতে ব্যাপক ক্ষতির মাঝে পড়ার পরেও আফ্রিকাতে রাশিয়া তার সামরিক ও ব্যবসায়িক অবস্থানগুলিকে চালিয়ে নিচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে আফ্রিকার আরও দেশের সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা চুক্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে রুশরা শূণ্যস্থান পূরণ করেছে এবং মালিতে ফ্রান্সকে প্রস্তিস্থাপিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক বা মালির মতো দেশগুলির উপর থেকে পশ্চিমা সহায়তা সড়িয়ে নেবার হুমকি তাদের অবস্থানকে পরিবর্তন করাবে না; বরং তাতে সেখানে রুশ প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাবে এবং মার্কিন অবস্থান দুর্বল হবে। শুধু তাই নয়, এতে সেসব দেশের জনগণের উপর আরও বেশি দুর্ভোগ নেমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র বরং চিন্তা করতে পারে যে, আফ্রিকার দেশগুলিতে রুশ প্রভাবের স্থানে অন্য কারুর অবস্থান নেয়াটা পশ্চিমাদের জন্যে কতটা ভয়াবহ হবে। সেই হিসেবে মধ্যম মেয়াদে আফ্রিকাতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘ল’ফেয়ার ইন্সটিটিউট’ আরও বলছে যে, সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটার উপর থেকে ৭’শ মিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সহায়তা এমন সময়ে সড়িয়ে নেয়, যখন সেখানে অর্থনৈতিক দৈন্যতা এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিলো। এতে বোঝা যায় যে, ওয়াশিংটনের সুদান নীতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয় এবং সেখানকার গণতন্ত্রকামীদের জন্যে মার্কিন সমর্থনের কথাগুলি নিছক গালগপ্প ছাড়া আর কিছুই নয়। সুদানের উপর মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাব অধিক থাকায় এবং এই দেশগুলি ওয়াশিংটনের বন্ধু হওয়ায় মার্কিনীরা হয়তো তাদের মাধ্যমেই সুদানের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে। সুদানের মতো দেশগুলির নেতারা পশ্চিমা সহায়তা নয়, বরং ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়েই বেশি চিন্তিত থাকে। সুদানের সামরিক সরকারকে মার্কিন বন্ধু দেশ মিশর, আমিরাত, সৌদি আরব, এমনকি ইস্রাইল সহায়তা প্রদান করছে।

 
আফ্রিকা হলো ইউক্রেন যুদ্ধের ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’। আফ্রিকার দিকে তাকাবার মতো সময় এখন পশ্চিমাদের কাছে নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক অসন্তোষ যখন আফ্রিকাকে ঘিরে ফেলছে, তখন সমস্যার সমাধান দিতে না পারার কারণে সেখানে পশ্চিমারা শুধু প্রভাব হারাবেই। একইসাথে যে ভয়ে পশ্চিমারা রাশিয়াকে আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত করতে চাইছে না, সেই ভীতিই বাস্তবে রূপ নেবে।


আফ্রিকা – ইউক্রেন যুদ্ধের ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’

‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২রা মার্চ জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে আফ্রিকার ৫৪টা দেশের মাঝে ২৬টা দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়নি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর ৭ই এপ্রিল জাতিসংঘের আরেক ভোটে আফ্রিকার ৩৩টা দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়নি। আফ্রিকার দেশগুলি রাশিয়া থেকে সাহায্য না পেলেও তারা খাদ্য এবং অস্ত্র আমদানির জন্যে রাশিয়ার উপরে যথেষ্টই নির্ভরশীল। জাতিসংঘের হিসেবে আফ্রিকার ১৪টা দেশ তাদের অর্ধেক গমের জন্যে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল; অপরদিকে সোমালিয়া ৯০ শতাংশ এবং ইথিওপিয়া শতভাগ নির্ভরশীল। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসেবে রাশিয়ার সাথে আফ্রিকার বাণিজ্য ৪ বিলিয়ন ডলার; যার ৯০ শতাংশই হলো গমের বাণিজ্য। আর ইউক্রেনের সাথে আফ্রিকার বাণিজ্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার; যার ৫০ শতাংশ গম।

আফ্রিকার অনেক দেশই গৃহযুদ্ধ দ্বারা জর্জরিত অথবা প্রায় যুদ্ধাবস্থার মাঝে রয়েছে। এই যুদ্ধের অস্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই রুশ নির্মিত। তবে এই যুদ্ধগুলিতে পশ্চিমাদের স্বার্থ রয়েছে। যুদ্ধরত এই দেশগুলি একদিকে যেমন পশ্চিমাদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে, অন্যদিকে তারা রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার জন্যে। ‘ল’ফেয়ার ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, আফ্রিকাতে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করে অন্য কোন শক্তি আসার ব্যাপারটা পশ্চিমাদের কাছে, তথা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভীতির কারণ। এমতাবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও পশ্চিমারা আফ্রিকাতে রুশ অবস্থানকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আফ্রিকাতে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও তা ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত; যা এখন পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আফ্রিকার অনেকগুলি দেশই যেমন তাদের বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতিসংঘে রাশিয়ার বিপক্ষে যায়নি, তেমনি পশ্চিমা দেশগুলিও বাস্তবতা মেনে নিয়ে আফ্রিকাতে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপন করার চাইতে মহাদেশটার নিরাপত্তাকেই তাদের স্বার্থের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। ‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, আফ্রিকা হলো ইউক্রেন যুদ্ধের ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’। আর ‘আইসিজি’ বলছে যে, আফ্রিকার দিকে তাকাবার মতো সময় এখন পশ্চিমাদের কাছে নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক অসন্তোষ যখন আফ্রিকাকে ঘিরে ফেলছে, তখন সমস্যার সমাধান দিতে না পারার কারণে সেখানে পশ্চিমারা শুধু প্রভাব হারাবেই। একইসাথে যে ভয়ে পশ্চিমারা রাশিয়াকে আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত করতে চাইছে না, সেই ভীতিই বাস্তবে রূপ নেবে।

Wednesday 4 May 2022

মিশর … নিয়ন্ত্রিত স্থিতিশীলতা কতদিন?

০৪ঠা মে ২০২২

২রা মে ২০২২। কায়রোতে ঈদের জামাত। সবশেষে ঈদের দিন খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়। এর ফলে ঈদের জামাতে লাখো মুসল্লির জমায়েত হয়। মার্কিন সরকার এবং কংগ্রেস এল সিসির সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে ইচ্ছুক বলেই মার্কিন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিবেদনে মিশরের অবস্থান খুব খারাপ অবস্থানে নয়; যদিওবা মানবাধিকার সংস্থাগুলি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করছে। ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে জনবহূল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মিশরের সরকার জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার বিনিময়ে আপাততঃ ধরে রেখেছে; যা কিনা মার্কিন সরকারের কাছে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

 
এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপন মিশরে অন্যান্য অনেক দেশের মতোই ছিল না। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণকে উল্লেখ করে মিশরের সরকার ধর্মীয় উপাসনার ক্ষেত্রে বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই এই বিধিনিষেধগুলি আসতে থাকে। রমজান মাসে মসজিদে রাত্রিকালীন তারাবির নামাজ আদায় করাটা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নামাজ ৩০ মিনিটের মাঝে সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর রমজানের শেষ ১০ দিনে রাতের বেলায় মসজিদে তাহাজ্জুদ নামাজ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ঈদের নামাজের ব্যাপারে আসে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি। খোলা ময়দানে ঈদের জামাত নিষিদ্ধ করা ছাড়াও শুধুমাত্র সরকারের অনুমোদিত কিছু মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করার নির্দেশনা দেয়া হয়। তদুপরি নামাজের খুতবাতে কি থাকবে, সেটাও সরকার ঠিক করে দেবে বলে বলা হয়। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘মিডলইস্ট আই’ বলছে যে, মিশরে এই মুহুর্তে করোভাইরাসের সংক্রমণ তেমন কিছু নয়। আর উপাসনা বাদে কনসার্ট ও ফুটবল খেলা এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ সরকার অনুমোদিত মসজিদের ইমামরা তাদের যার যার মসজিদের দরজায় তালা দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি ছবি তুলে সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করছে। এই ব্যাপারগুলি মিশরে ব্যাপক জনরোষের সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা সরকার এই বিধিনিষেধগুলি দিচ্ছে বড় কোন জনসমাবেশ এড়াবার উদ্দেশ্যে; কারণ সরকার হয়তো ভাবছে যে, ধর্মীয় উপাসনাকে কেন্দ্র করে গণজমায়েত অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে পুঁজি করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে পারে।

ব্যাপক জনরোষের ফলস্বরূপ সরকার রমজানের শেষ তিন রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছিল; সেটাও আবার স্বল্প সংখ্যক সরকারি অনুমোদিত মসজিদে। ২৭শে এপ্রিল ‘এরাব নিউজ’ বলছে যে, প্রথমে সরকার বলেছিল যে, মাত্র ১০ মিনিটের মাঝেই নামাজ শেষ করতে হবে। এরপর সেই বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করে সরকারি বার্তায় বলা হয় যে, নামাজের ৩০ মিনিট আগে মসজিদ খোলার সময় দেয়া হয়েছে। আর সবশেষে ঈদের দিন খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়। এর ফলে ঈদের জামাতে লাখো মুসল্লির জমায়েত হয়।

২০১৩ সালে আব্দেল ফাত্তাহ এল সিসিএর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিশরে সরকার বিরোধী জনসমাবেশ একপ্রকার নিষিদ্ধ রয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে মিশরের ইতিহাসের সবচাইতে বড় সরকার বিরোধী জনসমাবেশ আয়োজিত হয়েছিল মসজিদগুলিতে জুমআর নামাজের পর। একজন প্রাক্তন সরকার নিযুক্ত ইমাম এসাম তেলাইমা ‘মিডলইস্ট আই’কে বলছেন যে, মিশরের সরকার যেকোন জনসমাবেশের ব্যাপারে মারাত্মক শঙ্কিত থাকে। এটা অদ্ভূত যে সরকার সমজিদের ভিতরে ঈদের নামাজ পড়তে বিধিনিষেধ দেয়নি; কিন্তু খোলা যায়গায় নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে। অথচ করোনাভাইরাসের কথাই যদি বলা হয়, তাহলে তো খোলা স্থানে নামাজ পড়াটাই বেশি উপযুক্ত হবার কথা ছিল।

মসজিদ ব্যাতীত করোনার বিধিনিষেধ কি অবস্থায় রয়েছে, সেটার বর্ণনা দিয়েছে ‘গালফ নিউজ’। তারা বলছে যে, মিশরে এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ একেবারেই নেই। এজন্যেই দুই বছরের মাঝে এবারের ঈদের আমেজ অনেক বেশি। বিশেষ করে মিশরের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘খাক’ তৈরি করা বেকারি দোকানগুলি খুব ব্যস্ত রয়েছে। করোনার বিধিনিষেধগুলি তুলে নেয়ার পর থেকে দোকানগুলিতে উপচে পড়া ভীড় হচ্ছে। দোকান এবং রেস্টুরেন্টগুলিকে রাত ২টা পর্যন্ত খোলা রাখা অনুমতি দেয়া হয়েছে। রমজানের মাঝে রাস্তায় দান করার কর্মসূচীগুলিকেও সরকার অনুমোদন দিয়েছে। গত মার্চ মাস থেকেই করোনার বিধিনিষেধগুলি সরকার উঠিয়ে নিতে থাকে। এপ্রিল মাস পর্যন্ত মিশরে ৩ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষকে করোনার সম্পূর্ণ টিকা দেয়া হয়েছে; এর মাঝে ২০ লক্ষাধিক মানুষকে বুস্টার টিকা দেয়া হয়েছে।

মার্কিন ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’এর এক লেখায় মিশরের সরকারের রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়তে দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়। কারণ এর আগের দুই বছর করোনার কারণে মসজিদে তারাবির নামাজ পড়তেই দেয়া হয়নি। ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’এর ২০২২ সালের প্রতিবেদনে মিশরের বর্তমান ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সবচাইতে খারাপ ১৫টা দেশের মাঝে রাখা হয়নি; যেখানে চীন এবং পাকিস্তানের নাম রয়েছে। তবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থানে থাকা ১২টা দেশের মাঝে মিশরের নাম রাখা হয়। এই প্রতিবেদনে মূলতঃ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথাই উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ মিশরের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের চাইতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারের ব্যাপারটা একেবারেই অবহেলিত রয়েছে। তবে পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মিশরে কোথায় এবং কখন নামাজ পড়তে হবে, তা নির্দিষ্ট করে দিয়ে দেশটার সরকার মানুষের ধর্মীয় অধিকারের উপর অগ্রহণযোগ্য বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। প্রতিবেদনে মিশরের সরকারের এহেন বিধিনিষেধকে বাকস্বাধীনতা হননের আরেকটা পদ্ধতি বলে উল্লেখ করা হয়। ২১শে এপ্রিল নামাজের সময়ের ব্যাপারে সোশাল মিডিয়ায় এক ভিডিওতে সমালোচনা করার অপরাধে সাফা আল কোরবিজি নামের এক মহিলা সাংবাদিককে আইন শৃংখলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ভুয়া খবর রটানোর অভিযোগ দায়ের করে।

কনসার্ট, ফুটবল খেলা এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ উঠে গেলেও তারাবি, তাহাজ্জুদ এবং ঈদের নামাজ পড়ার ব্যাপারে মিশর সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ এল সিসির সামরিক সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে দুশ্চিন্তাকেই তুলে ধরে। অন্ততঃ ২০১১ সালের আরব বসন্তের মতো আরেকটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সরকার এড়াতে চাইছে। কিন্তু দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গমের সরবরাহে ঘাটতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এল সিসির অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। মার্কিন সরকার এবং কংগ্রেস এল সিসির সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে ইচ্ছুক বলেই মার্কিন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিবেদনে মিশরের অবস্থান খুব খারাপ অবস্থানে নয়; যদিওবা মানবাধিকার সংস্থাগুলি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করছে। ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে জনবহূল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মিশরের সরকার জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার বিনিময়ে আপাততঃ ধরে রেখেছে; যা কিনা মার্কিন সরকারের কাছে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।