Saturday 25 March 2023

ময়লার শহর প্যারিস… রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরেই আস্থার অভাব

২৫শে মার্চ ২০২৩

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তায় ময়লার স্তূপ। প্যারিসের আবর্জনার স্তূপের মাঝেই ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা এবং ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকের ভিত্তিতে পচনের প্রমাণ পাওয়া গেলেও এর সমাধান কারুর কাছেই নেই।


গত জানুয়ারি মাসে ফরাসি সরকার পেনশন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকে প্রতিবাদে দেশজুড়ে চলছে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ। শিক্ষক, ট্রেনচালক, তেলের রিফাইনারির কর্মীসহ বিভিন্ন সেক্টরের লক্ষ লক্ষ কর্মীরা কর্মবিরতি পালন করছে এবং নিয়মিতভাবে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। ২৪শে মার্চ নাগাদ ফ্রান্সের পরিচ্ছন্নকর্মীরা ১৯ দিন ধরে ধর্মঘটে রয়েছে। শহরের রাস্তাগুলিতে ময়লা আবর্জনার স্তূপের মাঝে ইঁদুরের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা; যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়াবার আশংকাও তৈরি হয়েছে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ বলছে যে, ৯ হাজার ৬’শ টনের বেশি আবর্জনা এখন প্যারিসের রাস্তাগুলিতে স্তূপীকৃত অবস্থায় রয়েছে। আর পরিচ্ছন্ন কর্মীদের শ্রমিক ইউনিয়ন বলছে যে, তারা ২৭শে মার্চের আগে ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে না।

ফ্রান্সের জ্বালানি ডিপো এবং তেলের রিফাইনারিগুলিতে দুই সপ্তাহ ধরে চলছে ধর্মঘট। কর্মীরা উৎপাদন কমানো ছাড়াও সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাতে চেষ্টা করছে। ২১শে মার্চ ফ্রান্সের দক্ষিণের জ্বালানি ডিপোতে ধর্মঘটকারী কর্মীদেরকে জোরপূর্বক কাজে ফেরত আনার চেষ্টা করলে কর্মীরা ডিপো অবরোধ করে। এতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপরে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ধর্মঘটে ফ্রান্সের দক্ষিণের প্রায় ৪০ শতাংশ পেট্রোল স্টেশনেই জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে বলে বলছে ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’। পুরো ফ্রান্সে ৮ শতাংশ পেট্রোল স্টেশনে জ্বালানি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সংকট মোকাবিলায় অনেক পেট্রোল স্টেশনেই গাড়িপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০ লিটার পেট্রোল বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।

‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ বলছে যে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর কথায়, এই পরিবর্তন ফ্রান্সের পেনশন ব্যবস্থাকে ধ্বসে পড়া থেকে বাঁচাবে এবং সরকারের খরচ কমাবে। অবসরের সময় দুই বছর বৃদ্ধি করে ৬৪ বছরে উন্নীত করার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ অতিরিক্ত দুই বছর কাজ করার পরেই পেনশন পাবার জন্যে যোগ্যতা অর্জন করবে। ম্যাক্রঁ সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করতে চাইছেন এবং সরকারের বাজেট ঘাটতিকে কমিয়ে ইইউএর টার্গেটের সাথে সমন্বয় করতে চাইছেন। পুরো ইউরোপের মাঝে ফ্রান্সে অবসরপ্রাপ্তরা অর্থনৈতিকভাবে সবচাইতে বেশি সচ্ছল। তবে এর জন্যে ‘ওইসিডি’র হিসেবে ফ্রান্সের জিডিপির সাড়ে ১৪ শতাংশ পেনশনের পিছনে খরচ করতে হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে তা মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। পেনশনের খরচ মেটাতে গিয়ে ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরো ঘাটতির মাঝে পড়তে যাচ্ছে সরকার। ২০২৫ সালের মাঝে এটা আরও বেড়ে প্রায় ১১ বিলিয়ন ইউরো এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ ২১ বিলিয়ন ইউরোতে ঠেকবে। ফ্রান্সের মানুষের গড় বয়স বাড়ার সাথেসাথে পেনশনের জন্যে অর্থায়ন করা কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। খরচ মেটাতে সরকার নতুন করে কর আরোপ বা সরকারি ঋণ বৃদ্ধি করতে চাইছে না। এর আগে ২০১৯ সালে ম্যাক্রঁর সরকার পরিবহণ খাতের পেনশন ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে পুরো ফ্রান্সজুড়ে পরিবহণ শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণেই সেবার সরকার বেশিদূর এগুতে পারেনি।

২০১৯ সালেও ফ্রান্সে পেনশন নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই মনে করছেন যে, সরকারের পেনশন ব্যবস্থা পরিবর্তনেও সমস্যার সমাধান হবে না। বরং ফ্রান্সের সামাজিক সুরক্ষা মডেলের দিনই এখন প্রায় শেষের পথে। এর মাধ্যমে ফ্রান্সে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দ্রুত নিম্নগামী হচ্ছে। একইসাথে আইনপ্রনয়ণের প্রক্রিয়াও অল্প কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। ৭০ শতাংশ জনগণ বিপক্ষে থাকলেও এখন সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৪৯’ বলে সরকার পেনশন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে আইন তৈরি করতে পারবে।

২২শে মার্চ ম্যাক্রঁ ফরাসি টেলিভিশনে এক সাক্ষাতে বলেন যে, তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসবেন না; কারণ ফ্রান্সের জাতীয় স্বার্থের জন্যে সেটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। একইসাথে তিনি ফ্রান্সের বিক্ষোভকে ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারির যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের ‘ক্যাপিটল হিল’এর অরাজকতার সাথে তুলনা করেন। ‘হ্যারিস ইন্টারএকটিভ’এর ২২শে মার্চের জরিপে বলা হচ্ছে যে, ফ্রান্সের ৭০ শতাংশ জনগণ ম্যাক্রঁর এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এর আগে ৬ই মার্চ ‘এলাবি’র জরিপে বলা হয় যে, ৬৭ শতাংশ জনগণ সরকারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। ম্যাক্রঁর বক্তব্যের পর ২৩শে মার্চ পুরো ফ্রান্স জুড়ে বিক্ষোভ হয়। ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ফরাসি পুলিশের হিসেবে ১১ লক্ষ মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে; আর ফরাসি শ্রমিক ইউনিয়নগুলির হিসেবে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। প্যারিসে ময়লার স্তূপে অগ্নিসংযোগ ছাড়াও সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪’শ ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৪’শ ৪১ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়। এর আগের ১১ই ও ১৫ই মার্চের বিক্ষোভ অপেক্ষাকৃত ছোট ছিল বলে অনেকেই সেটাকে ফরাসি সরকারের বিজয় বলে ধরে নিচ্ছিলো। কিন্তু নতুন করে সহিংস বিক্ষোভের পরে তার পুনরায় সরকারকে অস্থিরতার মাঝে ফেলেছে। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে গত ১৯শে জানুয়ারি থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত মোট ৯টা বড় আকারের বিক্ষোভ হয়েছে, যেগুলিতে সাড়ে ৩ লক্ষ থেকে শুরু করে ১৩ লক্ষ মানুষ অংশ নিয়েছে।

ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন ফরাসি টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে বলছেন যে, সহিংসতার মাত্রা যথেষ্ট বেড়ে যাওয়ায় পুলিশকে একটা সীমা পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল ফেবিয়েন রুসেল সাংবাদিকদের বলেন যে, ফরাসি সরকার সহিংসতা নিয়ে জুয়া খেলছে। মাত্র কয়েকদিনের মাঝেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ পরিণত হয়েছে পুলিশের লাঠিচার্জে। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, তারা শুধুমাত্র পেনশন ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়েই বিক্ষোভ করছে না; ফরাসি সরকার পার্লামেন্টকে বাইপাস করে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রসর হওয়াতে জনগণের আক্রোশ আরও বেড়ে গেছে। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পার্লামেন্টে পাস করাতে না পেরে গত ১৬ই মার্চ ম্যাক্রঁর সরকার ফরাসি সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৪৯’এর উপর ভিত্তি করে পার্লামেন্টকে বাইপাস করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে পেনশন ব্যবস্থার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ফ্রান্সে বিক্ষোভকারীদের অনেকেই মনে করছেন যে, সরকারের পেনশন ব্যবস্থা পরিবর্তনেও সমস্যার সমাধান হবে না। বরং ফ্রান্সের সামাজিক সুরক্ষা মডেলের দিনই এখন প্রায় শেষের পথে। এর মাধ্যমে ফ্রান্সে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দ্রুত নিম্নগামী হচ্ছে। একইসাথে আইনপ্রনয়ণের প্রক্রিয়াও অল্প কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, ২১শে মার্চ ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধে পরপর দু’টা অনাস্থা প্রস্তাব ভেস্তে গেলে বিরোধী রাজনীতিবিদদের কাছে প্লাকার্ড তুলে প্রতিবাদ করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। কারণ ৭০ শতাংশ জনগণ বিপক্ষে থাকলেও এখন সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৪৯’ বলে সরকার পেনশন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে আইন তৈরি করতে পারবে। প্যারিসের আবর্জনার স্তূপের মাঝেই ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা এবং ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকের ভিত্তিতে পচনের প্রমাণ পাওয়া গেলেও এর সমাধান কারুর কাছেই নেই।

Wednesday 22 March 2023

মার্কিন ব্যাংক দেউলিয়া… পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ?

২২শে মার্চ ২০২৩

'সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক' বা 'এসভিবি'র বাইরে ডিপোজিট তুলে ফেলার জন্যে মানুষের লাইন। তথা পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থা চলছে ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ বা জোড়াতালি দিয়ে। সকল বিশ্লেষকেরাই বলছেন যে, মার্কিন অর্থনীতি ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার উপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যাচ্ছে। কারণ সরকারি বন্ড বা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখাও এখন অনিরাপদ ঠেকছে।


‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’এর দেউলিয়া হওয়াটা ছিল ২০০৮ সালের পর থেকে সবচাইতে বড় ব্যাংক দেউলিয়ার ঘটনা। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক দেউলিয়ার ঘটনা। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাংকটার দেউলিয়ার হবার ঘটনাগুলির বর্ণনা দিয়ে বলা হয় যে, শেয়ার বাজারে ব্যাংকটার শেয়ারের মূল্য এক সপ্তাহে ৮০ শতাংশ পড়ে যায়; যার ৬০ শতাংশই পড়ে ১০ই মার্চ, বা মাত্র একদিনে! তবে সমস্যা হলো, ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ বা ‘এসভিবি’ যা করছিল, তা ব্যাংকিং সেক্টরের বহু ব্যাংকই করছিল; আর তা হলো, মানুষের কাছ থেকে ডিপোজিট হিসেবে অর্থ জোগাড় করে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা। এই বিনিয়োগের মাঝে ছিল মার্কিন সরকারের ঋণপত্র না বন্ড এবং বিভিন্ন প্রকারের ঋণ। ব্যাংকটা বিপদে পড়ে যায় যখন মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ বা ‘ফেড’ ব্যাপকহারে সুদের হার বাড়াতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ‘এসভিবি’ ক্ষতির মুখে পড়তে থাকে এবং এই খবরগুলি যখন ছড়াতে থাকে, তখন ব্যাংকের বিপুলসংখ্যক গ্রাহক একসাথে তাদের ডিপোজিট তুলতে থাকেন। এরপরই মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘এসভিবি’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। মাত্র ৩৬ ঘন্টার মাঝে ‘এসভিবি’ দেউলিয়া হয়ে যায়।

‘এসভিবি’র দেউলিয়া হবার মূল কারণ কি?

সম্পদের হিসেবে ‘এসভিবি’ ছিল মার্কিন ব্যাংকিং সেক্টরের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে চালু হওয়া ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ মূলতঃ মার্কিন প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলিকে সহায়তা দেয়ার জন্যে স্থাপিত হয়েছিল। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানিগুলির প্রায় অর্ধেকই ‘এসভিবি’র করা বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল ছিল। ‘এসভিবি’র অনেক বিনিয়োগই ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোম্পানিতে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক ধ্বসের পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ‘ডড-ফ্র্যাঙ্ক এক্ট’ নামের আইনে স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলিকে আরও কঠোর আইন মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। তবে ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান সরকারের সময়ে এর কঠোরতা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়। তবে মার্কিন কংগ্রেসে এই আইন পাস করতে গিয়ে আইনপ্রণেতাদের মাঝে যথেষ্ট দ্বন্দ্ব হয়। এর মাধ্যমে বড় ব্যাংকগুলির নিয়ম কঠোর থাকলেও অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাংকগুলি, যেগুলির সম্পদের পরিমাণ আড়াই’শ বিলিয়ন ডলারের কম, সেগুলির ক্ষেত্রে নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে ছোট আকারের ব্যাংক চালু করতে অনুপ্রেরণা দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

২০২০ সালে করোনা লকডাউনের মাঝে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির ডিপোজিট বেড়ে যায়। ‘এসভিবি’র ডিপোজিট দুই বছরে তিনগুণ হয়ে ১’শ ৮৯ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়। এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদী সরকারি ঋণপত্র বা বন্ডে। এই বিনিয়োগগুলিকে সবসময়ই নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করা হয়। সরকারি বন্ডে ১’শ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করার পর ২০২২ সালের মার্চ থেকে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ সুদের হার বাড়াতে থাকে। এর ফলে সরকারি বন্ডের মূল্য ক্রয়মূল্যের চাইতে কমে যেতে থাকে। ‘এসভিবি’র কাছে থাকা সরকারি বন্ডের মূল্য ১৭ বিলিয়ন ডলার কমে যায়। ‘এসভিবি’র মতো সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা অন্যান্য ব্যাংকগুলিও ব্যাপক হারে ক্ষতির সন্মুখীন হতে থাকে। গত ৮ই মার্চ একটা প্রতিবেদনে ‘এসভিবি’ উল্লেখ করে যে, তারা সরকারি বন্ড বিক্রি করতে গিয়ে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছে। এই খবরে ‘এসভিবি’র শেয়ারের মূল্য পড়ে যেতে থাকে। একইসাথে বিপুল সংখ্যক বড় আকারের বিনিয়োগকারী ‘এসভিবি’ থেকে তাদের ডিপোজিট তুলে নিতে থাকে। ১০ই মার্চ ‘এসভিবি’র শেয়ারমূল্যে ধ্বস নামে এবং একদিনে ৪২ বিলিয়ন ডলারের ডিপোজিট তুলে ফেলে গ্রাহকরা। সেদিনই সরকার ‘এসভিবি’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

তবে এর বাইরেও কিছু বড় কারণ রয়েছে; বিশেষ করে বড় পরিসরের কারণগুলিকে বাদ দেয়া যাবে না। নিউইয়র্কের ‘ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর রিচার্ড স্কুয়ির ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, প্রথম বড় কারণ হলো, গত কয়েক বছরের মাঝে, বিশেষ করে করোনাভাইরাসের লকডাউনের সময় মার্কিন ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ ব্যাপকহারে ডলার ছাপিয়েছে। এই ডলার ছাপাবার উদ্দেশ্য ছিল করোনার খারাপ অবস্থা থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে উদ্ধার করা এবং সরকারের বাজেটের ঘাটতি পূরণ করা। এর ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, তেমনি মুদ্রাস্ফীতি রোধে ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ সুদের হার বাড়াতে শুরু করে; যার ফলে সরকারি বন্ডের মূল্য পড়ে যায়। বাজারে প্রচুর ডলারের ছড়াছড়ির এই পরিস্থিতিতে কিছু ব্যাংক বেশ ভালো অবস্থানে চলে যায়; আর কিছু বেশ খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে। দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকগুলি বিশেষ কিছু সেক্টরের উপর নির্ভরশীল ছিল, যেখানে সরকারি বন্ডের মূল্য পড়ে যাবার প্রভাবটা ছিল অনেক বেশি। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন যে, মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিরাপদ; তিনি ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তার সরকার বলছে যে, করদাতাদের অর্থে দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকগুলিকে তারা বাঁচাবে না। কিন্তু মাল্টিমিলিয়ন ডলারের কর্পোরেট ডিপোজিটগুলিকে রক্ষা করে সরকার প্রকারান্তরে করদাতাদের অর্থ ব্যয় করে এই কোম্পানিগুলিকে বাঁচাচ্ছে।


ব্যাংক দেউলিয়া হলে মার্কিন সরকার কি সেটাকে বাঁচাবে?

প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সদস্য গ্যারি কোহন ‘সিএনএন’কে ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, একটা ব্যাংক মানুষের কাছ থেকে ডিপোজিট আকারে যত অর্থ যোগাড় করে, তার বেশিরভাগটাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে এবং খুব স্বল্প পরিমাণ অর্থই নিজের কাছে রেখে দেয়। সাধারণতঃ একটা ব্যাংকের মোট ডিপোজিটের খুব কম অংশই একদিনে ব্যাংক থেকে বের হয়। কিন্তু যখন একটা ব্যাংক সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সকলেই একসাথে সেই ব্যাংক থেকে তাদের ডিপোজিট তুলে ফেলতে চায়। কিন্তু একটা ব্যাংক কখনোই এতটা ডিপোজিট ফেরত দেবার অবস্থায় থাকে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকে রাখা ডিপোজিটের আড়াই লক্ষ ডলার পর্যন্ত ইন্সুরেন্সের আওতায় থাকে। অর্থাৎ একজন ডিপোজিটর ব্যাংকে যত অর্থই রাখুন না কেন, আড়াই লক্ষ ডলার তিনি নিশ্চিতভাবে ফেরত পাবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফেডেরাল ডিপোজিটরি ইন্সুরেন্স কর্পোরেশন’ বা ‘এফডিআইসি’ নামের সংস্থা এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করে। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘এসভিবি’র মোট ১’শ ৫১ বিলিয়ন ডলারের ডিপোজিট ছিল, যা কিনা ‘এফডিআইসি’র ইন্সুরেন্সের বাইরে ছিল। অর্থাৎ এগুলি ছিল আড়াই লক্ষ ডলারের চাইতে বড় ডিপোজিট।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রাক্তন কর্মকর্তা নিকি হেলি বলছেন যে, মার্কিন করদাতারা একটা দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকের দায় নেবে না। অর্থাৎ ‘এসভিবি’কে বাঁচাবার দায়িত্ব সরকারের নেয়া উচিৎ নয়। তবে গ্যারি কোহন বলছেন যে, ব্যাংকিং ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারকেরা সকলেই জনগণকে ব্যাংকে অর্থ রাখার জন্যে আগ্রহী রাখতে চায়। কারণ ব্যাংকের মাধ্যমেই মার্কিন অর্থনীতিতে ডলার আবর্তিত হয়। তবে দেউলিয়া হওয়া ‘এসভিবি’র বেশিরভাগ ডিপোজিটই ইন্সুরেন্সের আওতায় পড়েনি। যারা এই ডিপোজিট রেখেছিল, এর একটা বড় অংশ ছিল বিভিন্ন কোম্পানির কর্মচারীদের বেতনের অর্থ। খেটে খাওয়া মানুষের বেতনের অর্থ এখানে রয়েছে বলেই এক্ষেত্রে সরকারের কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে একটা ব্যাংক যাতে সহজে দেউলিয়া না হয়, সেই লক্ষ্যে ব্যাংকের পুঁজি কত হতে হবে, তা নিয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মাঝে যথেষ্ট বিরোধ রয়েছে।

গ্যারি কোহন বলছেন যে, ২০১৮ সালে ব্যাংকিং আইন পরিবর্তন করার সময়ে অনেকেই বলেছেন যে, ব্যাংকের পুঁজি অনেক বেশি বা নিয়মনীতি খুব বেশি কঠোর হওয়া উচিৎ নয়। তারা চাইছেন আরও বেশি সংখ্যক ছোট ছোট ব্যাংক গড়ে উঠুক। বেশি কঠোর নীতি থাকলে ব্যাংকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। আর ‘এসভিবি’ ব্যাংকের যথেষ্ট পুঁজি ছিল; এর পরেও তারা দেউলিয়া হয়েছে। এর সাথে ২০১৮ সালের আইন পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক নেই। তবে জো বাইডেন প্রশাসনের কেউ কেউ দাবি করছেন যে, ২০১৮ সালে ‘ডড-ফ্র্যাঙ্ক এক্ট’এর আইনগুলিকে পরিবর্তন করার জন্যেই এমনটা ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন যে, তিনি কংগ্রেসকে আনুরোধ করেছেন যাতে করে ব্যাংকিংএর আইনগুলিকে আরও কঠোর করে ফেলা হয়; এর ফলশ্রুতিতে ব্যাংক দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা অনেক কমে আসবে।

‘এসভিবি’ এমন কিছু করেনি, যা কিনা মার্কিন ব্যাংকগুলি করছিলো না। অর্থাৎ ‘এসভিবি’র মতো আরও অনেক ব্যাংক রয়েছে, যারা একই সমস্যায় পতিত। ‘এসভিবি’র পতনের মাত্র দুই দিনের মাথায়, ১২ই মার্চ, ‘সিগনেচার ব্যাংক’ নামের আরেকটা ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। এই ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম দেউলিয়া হবার ঘটনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিন্তায় পড়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেউলিয়া হওয়া দু’টা ব্যাংকের সকল ডিপোজিটই ইন্সুরেন্সের অধীনে আসবে; অর্থাৎ যাদের একাউন্টে আড়াই লক্ষ ডলারের বেশি অর্থ ছিল, তারাও ইন্সুরেন্সের আওতায় পড়বে। তবে ১৩ই মার্চ মার্কিন সরকারের রাজস্ব সচিব জ্যানেট ইয়েলেন সরাসরিই বলেন যে, সরকার এই ব্যাংকগুলিকে বাঁচাবে না। তবে জ্যানেট ইয়েলেন যাই বলুন না কেন, বাইডেন প্রশাসন যখন আড়াই লক্ষ ডলারের সীমা অতিক্রম করে দেউলিয়া ব্যাংকের ডিপোজিট ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তখন অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে, সরকার প্রকৃতপক্ষে সাধারণ করদাতাদের অর্থ ব্যয় করে এই ব্যাংকগুলি বা ব্যাংকের গ্রাহকদেরকে বাঁচাচ্ছে। এই গ্রাহকগুলির মাঝে সিলিকন ভ্যালির বিভিন্ন কোম্পানি ছিল, যারা মাল্টিমিলিয়ন ডলার ডিপোজিট রেখেছিল এই ব্যাংকগুলিতে। অর্থাৎ সরকার প্রকারান্তরে করদাতাদের অর্থ ব্যয় করে এই কোম্পানিগুলিকে বাঁচাচ্ছে।

কেউ কেউ বলছেন যে, প্রযুক্তি সেক্টরের ব্যাংক হবার কারণেই বাইডেন প্রশাসন ‘এসভিবি’কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। ‘বিএনই ইন্টেলিনিউজ’এর সম্পাদক বেন আরিস ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের সাথে প্রযুক্তি যুদ্ধে মনোনিবেশ করছে, তখন হোয়াইট হাউজ চাইছে না যে, মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি আর্থিক সমস্যায় পড়ে যাক। একারণেই সরকার এই সেক্টরের ডিপোজিট যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রেখেছে এবং ইন্সুরেন্সের সীমা ছাড়িয়ে ডিপোজিটগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

২০শে মার্চ বিশ্বের বৃহৎ ব্যাংকগুলির একটা, সুইজারল্যান্ডের ‘ক্রেডিট সুইস’ ব্যাংককে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে জোরপূর্বক কিনে নেয় ‘ইউবিএস’ ব্যাংক। সুইজারল্যান্ডের সরকার বলছে যে, একটা অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়ানোর এটাই ছিল একমাত্র পথ। সকলেই এখন যা কিছু বলছেন, তার সাথে বলছেন যে, ‘তার বিশ্বাস’ এটা বা ওটা হবে। এর অর্থ হলো পুরো ব্যবস্থাটাই বিশ্বাসের সমস্যা পড়েছে। বিশ্বাস যেমন অর্জন করা সম্ভব, তেমনি খুব স্বল্প সময়ের মাঝে হারানোও সম্ভব।


মার্কিন এবং ইউরোপের ব্যাংকিং সেক্টরের উপর প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক দেউলিয়া হবার প্রভাব সারা দুনিয়াতেই পড়েছে। অনেকেই এতে বিচলিত হয়েছেন; আর একারণেই রাজনীতিবিদেরা মানুষকে আস্বস্ত করতে চাইছেন। ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মেয়ার পার্লামেন্টে বলেন যে, ফ্রান্স ২০০৮ সালের আর্থিক দুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ইউরোপের ব্যাংক এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়েছে; বিশেষ করে ফরাসি ব্যাংকগুলির এখন যেধরনের রক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তা যথেষ্ট শক্তিশালী। তিনি শক্তভাবে বলেন যে, ফরাসি ব্যাংকের এপ্রকারের কোন ঝুঁকি নেই। কিন্তু রাজনীতিবিদদের কথায় সকলে আস্বস্ত নয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টক এক্সচেঞ্জের ‘বাডের ব্যাংক’এর পুঁজি বাজার বিশ্লেষণ প্রধান রবার্ট হালভার ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, ২০০৮ সালের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলিকে আবারও হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে; যাতে করে একটা ছোট্ট মাছি বড় হতে হতে হাতি না হয়ে যায়। সেবার ‘লিহমান ব্রাদার্স’এর দেউলিয়া হওয়াটা প্রায় পুরো আর্থিক বাজারকেই ধ্বসিয়ে দিয়েছিল। একারণেই বাজারে যথেষ্ট ভয় বিদ্যমান রয়েছে।

রাজনীতিবিদেরা যাই বলুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক দেউলিয়া হবার ঘটনা যে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে, তা এখন পরিষ্কার। ২০শে মার্চ বিশ্বের বৃহৎ ব্যাংকগুলির একটা, সুইজারল্যান্ডের ‘ক্রেডিট সুইস’ ব্যাংককে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে জোরপূর্বক কিনে নেয় ‘ইউবিএস’ ব্যাংক। ‘ইউবিএস’ হলো সুইজারল্যান্ডের সবচাইতে বড় ব্যাংক; আর ‘ক্রেডিট সুইস’ হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক। এই ঘটনায় আর্থিক বাজারের বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে গেলেও সরকার এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলি বলছে যে, মূল উদ্দেশ্য হলো ডিপোজিটগুলিকে রক্ষা করা এবং পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখা। সুইজারল্যান্ডের সরকার বলছে যে, একটা অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়ানোর এটাই ছিল একমাত্র পথ। সুইজারল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী ক্যারিন কেলার সাটার সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, শুধু সুইজারল্যান্ড নয়, বিশ্বব্যাপী আর্থিক সমস্যা এড়ানোর জন্যেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কাজে ১’শ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। আর এই একত্রীরণের ফলে ‘ইউবিএস’এর ক্ষতি বেশি হলে সরকার ৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণের নিশ্চয়তা দেবে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০০৮ সালে দেউলিয়া হওয়া মার্কিন ব্যাংক ‘লিহমান ব্রাদার্স’এর তুলনায় ‘ক্রেডিট সুইস’এর আকার দ্বিগুণ। শুধু তাই নয়, সুইজারল্যান্ডের এই ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ব্যবসা অনেক বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক ‘জে সাফরা সারাসিন’এর প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্সটেন ইউনিস ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, সকলেই এখন যা কিছু বলছেন, তার সাথে বলছেন যে, ‘তার বিশ্বাস’ এটা বা ওটা হবে। এর অর্থ হলো পুরো ব্যবস্থাটাই বিশ্বাসের সমস্যা পড়েছে। বিশ্বাস যেমন অর্জন করা সম্ভব, তেমনি খুব স্বল্প সময়ের মাঝে হারানোও সম্ভব। সরকারের হস্তক্ষেপে আর্থিক বাজারে স্বস্তি ফিরবে বলে তিনি আশা করছেন এবং তারও বিশ্বাস মানুষের আস্থা ফিরে আসবে এবং সমস্যা বহুদূর পর্যন্ত গড়াবে না। কিন্তু এটা কখনোই শতভাগ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে, এটা হবেই।

মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ ব্যাপকহারে ডলার ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করেছে; আবার মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়াতে মনোনিবেশ করেছে; যা কিনা ব্যাংকিং সেক্টরকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা এখন পরিষ্কার যে, মার্কিন, তথা পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থা চলছে ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ বা জোড়াতালি দিয়ে। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার উপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যাচ্ছে। কারণ সরকারি বন্ড বা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখাও এখন অনিরাপদ ঠেকছে। সাধারণ জনগণের এই ভীতি ছোট্ট একটা সমস্যাকে পুরো আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বসে রূপ দিতে পারে।


মার্কিন সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কি করবে?

বেন আরিস বলছেন যে, মুদ্রাস্ফীতি কমাতে গিয়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সুদের হার বাড়াতে থাকলো, তখন তারা চিন্তা করেনি যে, এর প্রভাব ব্যাংকিং সেক্টরের উপর কিভাবে পড়বে। ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ এখন দোটানায় পড়েছে যে, তারা কি সুদের হার কমিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরকে বাঁচাবে, নাকি মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়াতেই থাকবে? এই পরিস্থিতিটা তাদের জন্যে সত্যিই মারাত্মক। কারণ ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্জয় মুদ্রাস্ফীতির চাইতে আরও মারাত্মক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। একইসাথে সুদের হার বাড়াতে থাকলে বাজারে একটা আলোচনা তৈরি হয় যে, সুদের হার বুঝি বাড়তেই থাকবে। সেই হিসেবে বাকি সকলকিছুও পরিবর্তিত হতে থাকে। শেষপর্যন্ত দেখা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতিও খুব একটা কমে না।

অর্থনীতিবিদ নুরিয়েল রুবিনি ‘ব্লুমবার্গ’কে বলছেন যে, ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’এর সামনে সুদের হার বাড়ানো ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এখন বিপুল পরিমাণ ঋণ; ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহ ঋণ, কর্পোরেট ঋণ, ব্যাংকের ঋণ, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ, সরকারি ঋণ। একারণেই যদি পরিস্থিতি কঠিন হয়, তবে সেটা অনেক বেশি কঠিনই হবে; এবং সেটা হবে দীর্ঘমেয়াদী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বাড়ার সাথেসাথে সরকারি বন্ডের মূল্য প্রায় ২০ শতাংশ পড়ে গেছে। এর ফলে শুধুমাত্র মার্কিন ব্যাংকগুলিকেই ৬’শ ২০ বিলিয়ন ডলারের লোকসান গুণতে হবে। এই ব্যাংকগুলির পুঁজি প্রায় ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার, বা ২২’শ বিলিয়ন ডলার। কাজেই এই লোকসান তাদের পুঁজির প্রায় ২৮ শতাংশকে নিঃশেষ করে ফেলবে; যা এখনও বাস্তবে রূপ নেয়নি। অনেক ছোট ব্যাংকের পুঁজির প্রায় অর্ধেকই ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। এছাড়াও পুরো অর্থ ব্যবস্থায় ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের দীর্ঘমেয়াদী বন্ড রয়েছে; যেগুলি ডলারের সাথে সম্পর্কিত। ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’এর সুদের হার বাড়ানোর কারণে এই সবগুলিই মূল্য পড়ে যাবার ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থাৎ এর ফলস্বরূপ শুধুমাত্র মার্কিন অর্থনীতিতেই ৩ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান গুণতে হবে। এগুলির অনেক লোকসানই এখনও বাস্তবে রূপ নেয়নি। এতকাল মানুষ মনে করতো যে, সরকারি বন্ড একটা নিরাপদ বিনিয়োগ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সকলেই বুঝতে পারছে যে, সরকারি বন্ড নিরাপদ নয়। কারণ যদিও এটার মূল্য ফেরত না পাবার সম্ভাবনা নেই, তথাপি বাজারে এর মূল্য বেশ দ্রুতই কমে যেতে পারে; যা থেকে বাঁচা যাচ্ছে না। গত এক বছরের মাঝে ১০ বছর মেয়াদী বন্ডের মূল্যে ২০ শতাংশ পড়ে গেছে। কাজেই যারা রিটায়ার করার পর তাদের পেনশনের অর্থ বন্ডে বিনিয়োগ করেছে, তাদেরকে এখন ভিন্ন পথ দেখতে হবে।

এটা এখন পরিষ্কার যে, মার্কিন, তথা পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থা চলছে ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ বা জোড়াতালি দিয়ে। সকল বিশ্লেষকেরাই বলছেন যে, মার্কিন অর্থনীতি ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। যেকারণেই এই সেক্টরের ব্যাপারে সকলেই সংবেদনশীল। কিন্তু এই সেক্টরের নীতি নিয়ে মার্কিন রাজনীতিবিদদের মাঝে মেরুকরণ চলছে; যা আরও বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণের একটা অংশ। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার উপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যাচ্ছে। কারণ সরকারি বন্ড বা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখাও এখন অনিরাপদ ঠেকছে। সাধারণ জনগণের এই ভীতি ছোট্ট একটা সমস্যাকে পুরো আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বসে রূপ দিতে পারে। রিচার্ড স্কুয়ির বেশ পরিষ্কারভাবেই বলেছেন যে, করোনাভাইরাসের সময় ব্যাপকভাবে ডলার ছাপানোটাই শেষ পর্যন্ত ব্যাপক মূদ্রাস্ফীতির জন্ম দিয়েছে। আর মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে আর কোন পদ্ধতি না পেয়ে সুদের হার বাড়াতে মনোনিবেশ করেছে; যা কিনা ব্যাংকিং সেক্টরকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বেন আরিস বলছেন যে, ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয় মুদ্রাস্ফীতির চাইতে আরও মারাত্মক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। অপরদিকে নুরিয়েল রুবিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ছোট একটা ব্যাংক দেউলিয়া হলে একইরকম আরও বেশকিছু ব্যাংক দেউলিয়া হতে শুরু করবে; যা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে ধ্বসিয়ে ফেলবে এবং অর্থনীতিকে মন্দার মাঝে পতিত করবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মাঝে এই মন্দা পুরো অর্থনীতিকে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলবে। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, একটা শক্ত ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচা আর সম্ভব নয়।

Saturday 18 March 2023

সৌদি-ইরান সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চীনের জন্যে কতবড় সাফল্য?

১৮ই মার্চ ২০২৩

যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের বিরাগভাজন হচ্ছে। একইসাথে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে; যা চীনকে সুযোগ করে দিয়েছে। তবে এখনও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইন্টেলিজেন্স এবং অস্ত্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল।

গত ১১ই মার্চ চারদিনের গোপন আলোচনার পর বেইজিংএ ইরান এবং সৌদি আরবের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয়া হয়। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে শিয়া ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদন্ডের প্রতিবাদে তেহরানে সৌদি দূতাবাসে আগুন দেয়ার পর থেকে দুই দেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এখন বলা হচ্ছে যে, উভয় দেশই দুই মাসের মাঝে অপর দেশে দূতাবাস খুলবে। ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের আলী সামখানি বেইজিংএ সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সমঝোতা গোটা মুসলিম বিশ্বের সাথে ইরানের সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টার একটা অংশ। উভয় দেশই তাদের জাতীয় স্বার্থে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়েছে। একইসাথে এই সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যে বাইরের শক্তিদের প্রভাবকে ব্যালান্স করবে বলে বলেন তিনি। একইসাথে তিনি বলেন যে, এই সমঝোতার ফলে ইস্রাইল নাখোশ হবে।

‘আল জাজিরা’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এই সমঝোতা সরাসরি প্রতিফলিত হবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে; যেখানে সৌদি আরব এবং ইরান উভয়েই জড়িত। একইসাথে লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইরাক ও সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতেও এই সমঝোতার প্রভাব পড়তে পারে। তবে দুই দেশের মাঝে সমঝোতায় কেউ অবাক হয়নি; কারণ অনেক আগ থেকেই দুই দেশের মাঝে আলোচনা চলছিল। বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে ইরাকের মধ্যস্ততায় আলোচনার সুবাদে উভয় দেশের কর্মকর্তারা বাগদাদে পাঁচবার মিলিত হয়েছেন। একইসাথে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ওমানেও বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছেন। তবে কেউই আশা করেননি যে, এই সমঝোতাটা হবে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপস্থিতি ছাড়াই।

‘আল জাজিরা’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে ‘আব্রাহাম একর্ড’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে, তখন ইরানের সাথে সৌদিদের সম্পর্কোন্নয়ন ইস্রাইলের কাছে শ্রুতিমধুর হবার কথা নয়; কারণ এর মাধ্যমে ইরানকে একঘরে করার ইস্রাইলি চেষ্টায় ভাটা পড়বে। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জন কার্বি সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতাকে স্বাগত জানাচ্ছে; বিশেষ করে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ বন্ধে এবং আঞ্চলিক উত্তজনা নিরসণে এই সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে। তবে তিনি বলেন যে, এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রকারের হাত ছিল না।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘গালফ রিসার্চ সেন্টার’এর চেয়ারম্যান আব্দুলআজিজ সাগের ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, এই সমঝোতার মূলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে; যার মাঝে উভয় দেশের সার্ভভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সৌদিরা চাইছে যাতে ইরান সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। এছাড়াও জ্বালানি ও নৌ নিরাপত্তা এবং ইয়েমেন, লেবানন এবং সিরিয়াতে ইরানের ভূমিকার ব্যাপারে সৌদিরা নিশ্চিত হতে চাইছে। আর চীনের সকল জ্বালানির প্রায় ৩৬ শতাংশ যখন উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসে, তখন এই সমঝোতায় চীনের স্বার্থ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।

সৌদি আরবের ইন্টেলিজেন্সের প্রাক্তন প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে বলছেন যে, চীন যে এখানে মধ্যস্ততা করতে পারে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কোন দেশেরই সৌদি আরব এবং ইরান উভয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। এছাড়াও তিনি বলেন যে, যেহেতু সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলা হয়নি, তাই এই সমঝোতা ইস্রাইলের উপরে কতটা প্রভাব রাখতে পারে, তা বলা যাবে না। আর ইস্রাইল যদি ইরানের উপর হামলা করতেই চায়, তাহলে তারা ছুতো খুঁজবে না। ২০০৫ সাল থেকেই ইরানের উপরে ইস্রাইলের হামলার কথা বলা হলেও সেটা আজ অবধি ঘটেনি।

‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে কথা বলতে গিয়ে জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কারপো’র জ্যেষ্ঠ গবেষক সেবাস্টিয়ান সন্স বলছেন যে, তার মনে হয় না যে, এটা কৌশলগত কোন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এটা মূলতঃ দুই দেশের স্বল্পমেয়াদী স্বার্থকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছে। সোদিরা বরাবরই তেলের বাজারে উচ্চমূল্য দেখতে চায়। সেই হিসেবেই তারা রাশিয়া এবং ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছে। একইসাথে চীন সৌদি আরব এবং ইরানের মাঝে চলমান আলোচনার যে বাস্তবতা ছিল, সেটার সুযোগ নিয়েছে। এখন এই সমঝোতার সফলতা যে সকলেই দাবি করতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার ‘জি-জিরো মিডিয়া’তে বলছেন যে, এতকাল যাবত চীনারা নিজেদের উঠানের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কোন রাজনৈতিক আলোচনায় মধ্যস্ততা করার চেষ্টা করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি এবং ইরানের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়। তবে এখানে চীনের জড়িত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই মুহুর্তে ওয়াশিংটনের সাথে বেইজিংএর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে।

আব্দুলআজিজ সাগের বলছেন যে, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে ফেলে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিতে মোতায়েনকৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে ফেলে। এছাড়াও ২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনার উপর হামলার পর সৌদিরা সেই হামলায় ইরানের জড়িত থাকার প্রমাণ দিলেও যুক্তরাষ্ট্র কোন পদক্ষেপই নেয়নি; যেগুলি সৌদিদের কাছে ভুল বার্তা দিয়েছে। এর ফলে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য বন্ধু কিনা। একারণে সৌদিরা আঞ্চলিক নিরাপত্তার দিক থেকে অপশন বৃদ্ধি করতে চাইছে। যার ফলস্বরূপ, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি রাশিয়ার সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকা ছাড়াও চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখেছে।

ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, ইন্দোপ্যাসিফিকে ‘কোয়াড’ এবং ‘অকাস’এর মাধ্যমে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সামরিক সহায়তা দিয়ে নিরাপত্তার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ থাকছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে জো বাইডেন প্রশাসন ভুল অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের বিরাগভাজন হচ্ছে। একইসাথে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে; যা চীনকে সুযোগ করে দিয়েছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে চীনারা শান্তি প্রস্তাব দেয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। সামনের দিনগুলিতে মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংএর কূটনৈতিক কর্মকান্ড আরও বাড়বে। তবে এখনও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইন্টেলিজেন্স এবং অস্ত্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল।

Saturday 11 March 2023

যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রযুক্তির দ্বন্দ্ব আরও উত্তপ্ত হচ্ছে

১১ই মার্চ ২০২৩

চীনের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় অগ্রগামিতা তার সম্পদ বা অস্ত্র নয়; বরং তা হলো বিশ্বব্যাপী তার বন্ধু। পশ্চিমা আদর্শের নেতৃত্বের কারণে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিনীদের বন্ধুর অভাব নেই; সেটা যতটাই স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক না কেন। চীন এক্ষেত্রে দুনিয়াকে বিকল্প কোন আদর্শ অফার করতে পারেনি; যা কিনা চীনের বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে পারতো।

গত ৮ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে নেদারল্যান্ডসের সরকার সবচাইতে উন্নত মাইক্রোচিপ প্রযুক্তির রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। দেশটার বাণিজ্যমন্ত্রী লিসি স্রাইনমাখার ডাচ পার্লামেন্টের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠিতে বলেন যে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই প্রযুক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। তবে তিনি সেখানে চীনের নাম উল্লেখ করেননি। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘এএসএমএল’ অন্তর্ভুক্ত হবে; যারা সেমিকন্ডার তৈরিতে পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রের ডিজাইনার ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। কোম্পানি বলছে যে, তাদের ‘ডীপ আলট্রা ভায়োলেট’ বা ‘ডিইউভি’ নামের প্রযুক্তির ‘লিথোগ্রাফি’ যন্ত্র রপ্তানি করতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। ‘লিথোগ্রাফি’ যন্ত্রের মাধ্যমে সিলিকনের উপর লেজার ব্যবহার করে সার্কিট ছাপানো হয়; যার ফলে সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোচিপ তৈরি হয়।

সেমিকন্ডাক্টর হলো এমন জিনিস, যা ছাড়া মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সর্বশেষ প্রযুক্তির সামরিক যন্ত্রপাতি তৈরি করা অসম্ভব। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেন যে, ডাচদের লক্ষ্য হলো চীনকে উন্নত হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তিনি বলেন যে, চীনারা আশা করবে নেদারল্যান্ডস ‘অন্যান্য দেশকে’ অনুসরণ করে রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে না। এখানে চীনারা ‘অন্যান্য দেশ’ বলতে যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝিয়েছে। চীন সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি কুক্ষিগত করে রাখার অভিযোগ করে। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত জানুয়ারি মাসে মার্কিনীরা ডাচ এবং জাপানিদের সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছায় বলে জানা যায়; যার মাধ্যমে চীনে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সর্বশেষ প্রযুক্তি রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। তবে সর্বশেষ প্রযুক্তি না পেলেও চীন অপেক্ষাকৃত পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেতে পারবে। শুধু তাই নয়, সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের লোকেরা বলছেন যে, চীনারা ‘এএসএমএল’এর আগের প্রযুক্তিগুলি ক্রয় করতে পারবে। একমাত্র চীনই পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, জাপান এবং কিছু ইইউ দেশ উন্নততর ‘১০ ন্যানোমিটারের নিচের’ প্রযুক্তিতে চলে যাচ্ছে। ‘এএসএমএল’এর প্রযুক্তি ‘৩ ন্যানোমিটারের নিচের’। তবে চীনারা সর্বশেষ প্রযুক্তি না পেলে সেটা তাদের সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির জন্যে ভালো খবর নয় এবং ভবিষ্যতে তা চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে ব্যাহত করতে পারে। নতুন মার্কিন আইন নিশ্চিত করতে চাইছে যে, চীন যেন ‘১৪ ন্যানোমিটারের নিচের’ প্রযুক্তি বা ‘১২৮ লেয়ার ৩ডি এনএএনডি’এর চাইতে উন্নততর প্রযুক্তি না পায়।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ডাচ সরকার ২০১৯ সাল থেকেই চীনে ‘এএসএমএল’এর ‘এক্সট্রিম আলট্রা ভায়োলেট’ বা ‘ইইউভি’ প্রযুক্তির যন্ত্র রপ্তানি করার উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে মার্কিন সরকার চীনে প্রযুক্তি রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এই নিয়ন্ত্রণের ফলে পৃথিবীর যেকোন দেশে মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা সেমিকন্ডাক্টর চীনে রপ্তানি করতে গেলে সরকারের অনুমতি লাগবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত তাদের বন্ধু দেশগুলিকেও খুশি করতে পারেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী এক সপ্তাহ আগেই বলেছেন যে, সেমিকন্ডাক্টরের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ফলে তা একদিকে যেমন ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করবে, তেমনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে। এছাড়াও তা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগুরুত্বপূর্ণ করবে। দক্ষিণ কোরিয় কোম্পানি ‘স্যামসাং’ পৃথিবীর সবচাইতে বড় সেমিকন্ডাক্টর তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ বলছে যে, চীনা কোম্পানিগুলি এখন অতি দ্রুত সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্র যোগাড় করতে মরিয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন আইনগুলি বাস্তবায়নে কিছুটা ঘোলাটে পরিস্থিতি থাকবে, ততক্ষণ তারা এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। ‘এএসএমএল’এর যথেষ্ট ব্যবসায়িক স্বার্থ এখানে জড়িত। কোম্পানিটার ৩৪ শতাংশ আয় আসে সর্বশেষ ‘ডিইউভি’ প্রযুক্তি বিক্রি করে; আর ৪৬ শতাংশ আয় আসে এর আগের ‘ইইউভি’ প্রযুক্তি থেকে। উভয় প্রযুক্তিই এখন চীনে যাচ্ছে না।

‘এশিয়া টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনারা সোলার প্যানেলের যন্ত্রপাতি রপ্তানির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। সারা দুনিয়ার সবচাইতে বড় ১০টা সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারকই চীনা। সোলার প্যানেল তৈরির সকল কাজের মাঝে ৮০ শতাংশই চীনাদের নিয়ন্ত্রণে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় জেনিফার লী বলছেন যে, চীনাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল মার্কিনীদের সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপের একটা প্রত্যুত্তর। মার্কিন কংগ্রেসে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্যে আইন পাস করে জীবাশ্ম জ্বালানির উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে বলা হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে যে, সোলার এবং বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এখন সমস্যা হলো, চীনারা শুধু সোলারই নয়, বায়ুশক্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী; যার ফলে মার্কিন নীতি বাস্তবায়ন এখন চীনের সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হবে। এছাড়াও কিছুদিন আগেই চীনারা বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ব্যাটারির প্রযুক্তি যাতে মার্কিনীদের কাছে চলে না যায়, সেব্যাপারে কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এগুলি প্রমাণ করে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মার্কিন সরকার চীনকে নিয়ন্ত্রণে যে বহু ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা বিভিন্ন সেক্টরকে প্রভাবিত করবে।

‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো ডেক্সটার রবার্টস ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে ডাচদের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা বড় বিজয়; আর চীনের জন্যে খারাপ সংবাদ। তবে এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হলো। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর ডিরেক্টর গ্রেগোরি এলেন ‘দ্যা টাইম’এর এক লেখায় বলছে যে, গোয়েন্দা বেলুন বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর যে প্রতিযোগিতাকে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ‘প্রযুক্তি যুদ্ধ’র অংশ বলা হচ্ছে, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে একা নয়। চীনের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় অগ্রগামিতা তার সম্পদ বা অস্ত্র নয়; বরং তা হলো বিশ্বব্যাপী তার বন্ধু। যে ব্যাপারটা এলেন বলেননি তা হলো, পশ্চিমা আদর্শের নেতৃত্বের কারণে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিনীদের বন্ধুর অভাব নেই; সেটা যতটাই স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক না কেন। চীন এক্ষেত্রে দুনিয়াকে বিকল্প কোন আদর্শ অফার করতে পারেনি; যা কিনা চীনের বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে পারতো।

Saturday 4 March 2023

ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প … ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংঘাত কি আসন্ন?

০৪ঠা মার্চ ২০২৩

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার 'সেন্ট্রিফিউজ' পরিদর্শনে দেশটার প্রেসিডেন্ট। ইস্রাইলের পক্ষ থেকে ইরানে হামলার কথা বলাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও বলেন যে, ইস্রাইলের যা করা প্রয়োজন, তাদের তা করা উচিৎ; যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সমর্থন দেবে। কিন্তু ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই হিসেব করে চলছে। কারণ ইরানের উপর যেকোন হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করবে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ দ্বন্দ্বের মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা যুদ্ধ মোটেই কেউই চাইছে না।

বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশ যে, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘আইএইএ’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা জানুয়ারি মাসে ইরানের ‘ফোরদো’ পারমাণবিক স্থাপনায় ইউরেনিয়ামের মাঝে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ বিশুদ্ধ্বতা পেয়েছেন। কয়েক বছর ধরে ইউরেনিয়াম ‘এনরিচমেন্ট’এর মাধ্যমে ইরান এই অবস্থানে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে যতটা বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন, ইরান তার খুব কাছাকাছি পোঁছে গেছে। ইউরেনিয়াম হলো একপ্রকারের খনিজ, যা বিশুদ্ধ বা ‘এনরিচ’ করলে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে ‘এনরিচড’ ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। ‘সেন্ট্রিফিউজ’ নামের এক যন্ত্রের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম থেকে ‘ইউ২৩৫’ অংশগুলি আলাদা করে ফেলার ব্যাপারটাকেই বলা হয় ‘এনরিচমেন্ট’। যে ইউরেনিয়ামের মাঝে ৩ থেকে ৫ শতাংশ ‘ইউ২৩৫’ রয়েছে, সেগুলি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে ৯০ শতাংশের বেশি ‘ইউ২৩৫’ প্রয়োজন।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইরানের ভাষ্য হলো, ‘আইএইএ’র প্রতিবেদনে আসা সংখ্যা মূলতঃ অনিচ্ছাকৃত ওঠানামার কারণেই পাওয়া গেছে। ২০১৫ সালে ইরান পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চুক্তি করে পারমাণবিক প্রকল্প স্থগিত করে; বিনিময়ে ইরানের উপরে নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই তুলে নেয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন সরকার চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় এবং ইরানের উপরে পুনরায় অবরোধ আরোপ করে। এর প্রতিবাদে ইরান আবারও ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করা শুরু করে। প্রায় দুই বছর ধরে প্রকাশ্যেই তারা ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করছে। জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন ইরানের সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে চাইলেও গত এক বছর ধরে তা থেমে রয়েছে।

গত ২০শে ফেব্রুয়ারি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি সাংবাদিকদের বলেন যে, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের ইস্যুগুলি ‘টেকনিক্যাল’ আলাপ এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতে না তুলে মিডিয়ার সামনে তুলে নিয়ে আসার অর্থ হলো ‘আইএইএ’ তাদের পেশাদারিত্ব হারিয়েছে। একইসাথে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার মুখপাত্র বেহরুজ কামালভান্দি সরাসরিই বলেছেন যে, ইরান কখনোই ৬০ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করেনি। পহেলা মার্চ ইরানের বার্তা সংস্থা ‘ইরনা’কে ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেন যে, ‘আইএইএ’র নমুনা এতটাই নগন্য যে, তা খালি চোখে দেখাই সম্ভব নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কি পরিমাণ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচ’ করার পর মজুত করা হয়েছে।

তবে ২৬শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন মিডিয়া ‘সিবিএস’এর সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স ‘সিআইএ’র প্রধান উইলিয়াম বার্নস বলেন যে, তাদের বিশ্বাস ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এখনও পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেননি; যা কিনা ২০০৩ সালের পর থেকে ইরান স্থগিত করেছে। তবে এর বাইরে আরও দু’টা যায়গায় তারা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। প্রথমতঃ ইরান যদি ইচ্ছা করে, তাহলে কয়েক সপ্তাহের মাঝেই ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচমেন্ট’ পেরিয়ে যেতে পারবে। আর দ্বিতীয়তঃ তারা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকেও যথেষ্ট অগ্রগামী হয়েছে। কাজেই যদিও ইরান এখনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি, তথাপি অন্যান্য ব্যাপারগুলি পুরো পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জিং করে ফেলেছে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তা কলিন কাহল মার্কিন কংগ্রেসের কমিটির সামনে বলেন যে, ইরানের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতার মাঝে যে দূরত্ব, তা ১২ মাস থেকে কমে গিয়ে ১২ দিনে নেমে এসেছে।

পহেলা মার্চ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, বাইডেন প্রশাসনের নীতি হলো, ইরানকে কোন অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্র পেতে না দেয়া। এই লক্ষ্যে তাদের বিশ্বাস কূটনীতিই সবচাইতে ভালো পদ্ধতি। কারণ এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন; যাতে করে ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র পাবার মতো অবস্থানে যেতে না পারে। তবে তারা অন্য কোন পদ্ধতিই হিসেব থেকে বাদ দেননি। তবে প্রাইস বলেন যে, ২৮শে ফেব্রুয়ারির ‘আইএইএ’র প্রতিবেদনে কি ছিল, সেটা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারবেন না; কারণ সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। তবে তারা ইরানের প্রায় ৮৪ শতাংশ ইউরেনিয়াম ‘এনরিচমেন্ট’এর ব্যাপারে মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলি দেখেছেন। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপিয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশগুলির সাথে কথা বলেই এগুবে।

তবে ইস্রাইলি ও মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ইরানের হাতে ১০টা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে যথেষ্ট ‘এনরিচড’ ইউরেনিয়াম থাকবে। ইরান যদি রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করে তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার উপর ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সিদ্ধান্ত এগিয়ে আসবে। যদিও রাশিয়া ইরানের কাছে ‘এস-৪০০’ বিক্রি করার কথা প্রকাশ করেনি, তথাপি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এবং ইরান কাছাকাছি চলে এসেছে। এরকম একটা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ইরানে কার্যকর হতে দুই বছরের কম সময় লাগতে পারে। ইরানি পার্লামেন্টের একজন সদস্য বলেছেন যে, মার্চ মাসেই ইরান রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক ‘সুখোই-৩৫’ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে। ইরান ইতোমধ্যেই রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেয়েছে। ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক সপ্তাহ আগেই তেল আভিভের এক নিরাপত্তা আলোচনায় বলেন যে, যত বেশি সময় অপেক্ষা করা হবে, ইরানের উপর হামলার ব্যাপারটা ততটাই কঠিন হয়ে যাবে। ব্রিটিশ সামরিক থিংকট্যাঙ্ক ‘জেনস’এর জেরেমি বিনি বলছেন যে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইস্রাইল আকাশ থেকে আকাশে জ্বালানি সরবরাহ করার বিমান পেতে চলেছে, যা ইরানের অভ্যন্তরে ইস্রাইলের হামলা করার সক্ষমতাকে অনেকটাই এগিয়ে নেবে।

‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ইস্রাইলের পক্ষ থেকে ইরানে হামলার কথা বলাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও ১৯শে ফেব্রুয়ারি বলেন যে, ইস্রাইলের যা করা প্রয়োজন, তাদের তা করা উচিৎ; যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সমর্থন দেবে। কিন্তু ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই হিসেব করে চলছে। কারণ ইরানের উপর যেকোন হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করবে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ দ্বন্দ্বের মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা যুদ্ধ মোটেই কেউই চাইছে না।