Thursday 30 December 2021

সৌদিরা নিজস্ব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে কেন?

৩১শে ডিসেম্বর ২০২১

রাজধানী রিয়াদের ২’শ ৩০ কিঃমিঃ পশ্চিমে দাওয়াদমি এলাকার ফ্যাসিলিটি। এখানেই সৌদি আরব চীনের সহায়তায় নিজস্ব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। মার্কিনীদের উপর নির্ভরশীল সৌদিরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীত। সৌদিদের এই প্রকল্প হয়তো সেই ভীতি থেকেই এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে পারছে না। এমতাবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা যেমন বাড়বে, তেমনি সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনাও বাড়বে।

 
মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘সিএনএন’ জানাচ্ছে যে, সৌদি আরব চীনের সহায়তায় নিজস্ব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। প্রতিবেদনে ধারণা করা হয় যে, সৌদি আরবের এহেন কর্মকান্ডের ফলে পারমাণবিক অস্ত্র ডেভেলপ করার পরিকল্পনা থেকে ইরানকে দূরে রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে। স্যাটেলাইট ছবিতেও দেখা যাচ্ছে যে, সৌদি আরবের কমপক্ষে একটা স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করা হচ্ছে। চীনারাই একসময় রাজধানী রিয়াদের ২’শ ৩০ কিঃমিঃ পশ্চিমে দাওয়াদমি এলাকায় সেই ফ্যাসিলিটি তৈরি করে দিয়েছিল। গত অক্টোবর এবং নভেম্বরের মাঝে নেয়া ছবিতে সেখানে ‘বার্ন অপারেশন’এর প্রমাণ পাওয়া যায়; যা কিনা বুঝিয়ে দেয় যে, সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করা হচ্ছে। মার্কিন সরকারের সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’এর ব্রিফিংএ চীন থেকে সৌদি আরবের কাছে সংবেদনশীল প্রযুক্তির বেশ কয়েকটা বড় আকারের শিপমেন্টের ব্যাপারে ইন্টেলিজেন্স উপস্থাপন করা হয়েছে।

চীনা পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র ‘সিএনএন’কে জানান যে, সৌদি আরবের সাথে চীনের সম্পর্ক কৌশলগত। সামরিক বাণিজ্যসহ অনেক বিষয়েই দুই দেশের সহযোগিতা রয়েছে। এই সহযোগিতাগুলি আন্তর্জাতিক আইন মেনেই হচ্ছ; এবং এর মাঝে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করার মতো কোন প্রযুক্তির আদানপ্রদান নেই। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি বিস্তার নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘মিসাইল টেকনলজি কনট্রোল রেজিম’ বা ‘এমটিসিআর’এ চীন এবং সৌদি আরব কেউই স্বাক্ষরকারী নয়। সৌদি আরব, ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পকে আঞ্চলিক হুমকি হিসেবে দেখেছে। অপরদিকে ইরান তার দুর্বল বিমান বাহিনীর স্থলে ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ডিটারেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

তবে এই ব্যাপারটায় শুধু চীনকেই জড়ানো ঠিক নয় বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সৌদি আরব বেশ কয়েকটা দেশের কাছ থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পাবার চেষ্টা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিডলবুরি কলেজ’এর প্রফেসর জেফরি লুইস বলছেন যে, রকেট পরীক্ষা করার সময় কিছু জ্বালানি বেঁচে যায়। এই বেঁচে যাওয়া জ্বালানি খুবই দাহ্য এবং বিপজ্জনক। কঠিন জ্বালানির ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করার সময় অনেক ক্ষেত্রেই বেঁচে যাওয়া জ্বালানিগুলিকে একটা ‘বার্ন পিট’এর মাঝে ফেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই পুড়িয়ে ফেলার অপারেশন থাকার অর্থই হলো সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার কাজ চলছে। সৌদি আরবের দাওয়াদমি এলাকার ফ্যাসিলিটির স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করলে এব্যাপারটাই নিশ্চিত হওয়া যায়। ‘আইআইএসএস’ ওয়াশিংটনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল এলম্যান এবং মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর জোসেফ এস বারমুডেজ জুনিয়র ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর সাথে সাক্ষাতে এই ফ্যাসিলিটিকে কঠিন জ্বালানির রকেট ইঞ্জিন ডেভেলপ করার কারখানা বলে মত দেন। ব্রিটেনের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সৌদিদের এই ফ্যাসিলিটির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে ‘সলিড ফুয়েল’ বা কঠিন জ্বালানির রকেট তৈরি করা হচ্ছে। তরল জ্বালানির রকেটের চাইতে কঠিন জ্বালানির রকেট সহজে লুকিয়ে রাখা যায় এবং অনেক দ্রুততার সাথে উড্ডয়ন করা যায়।

 
ভিয়েনায় ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলির পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে আলোচনা। ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প আন্তর্জাতিকভাবে যথেষ্ট প্রশ্নের মাঝে পড়লেও সৌদি প্রকল্পের ব্যাপারে ততটা চিন্তিত দেখা যায়নি কাউকেই। ইরান নিশ্চয়ই এমন কোন নিয়ন্ত্রণমূলক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চাইবে না, যা কিনা অন্যদের উপর প্রয়োগ করা হবে না।

বাইডেন প্রশাসন এখন মনে করছে যে, এর ফলে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সীমিতকরণের চেষ্টার ব্যাপ্তি আরও বাড়িয়ে সেখানে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পকেও সীমিত করার চেষ্টাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা আরও কঠিন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ইস্রাইল এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারে যথেষ্টই চিন্তিত। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে বলা হয় যে, সৌদি আরব তাদের প্রথম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা তৈরি করেছে। একই বছরের জুনে ‘সিএনএন’ আরেক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল যে, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা এব্যাপারে অবহিত রয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের সামনে গোপন ইন্টেলিজেন্স প্রকাশ করতে চাননি। ডেমোক্র্যাটরা সরকারি চ্যানেলের বাইরে থেকে এব্যাপারে জানতে পেরে ক্ষেপে যায়। ডেমোক্র্যাটরা বলতে থাকে যে, ট্রাম্প প্রশাসন সৌদিদের ব্যাপারে খুবই নরম আচরণ করছিলেন। অনেকেই বলেন যে, ট্রাম্পের নিস্তব্দতাই সৌদিদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পকে এগিয়ে নেবার পিছনে সাহস যুগিয়েছে। মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন যে, বাইডেন প্রশাসন এই আদানপ্রদানে জড়িত থাকা কিছু কোম্পানির উপর অবরোধ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে; যদিও ক্যাপিটল হিলে অনেকেই মনে করেন না যে, বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কঠোর কোন সিদ্ধান্ত নেবে।

প্রফেসর জেফরি লুইস বলছেন যে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প আন্তর্জাতিকভাবে যথেষ্ট প্রশ্নের মাঝে পড়লেও সৌদি প্রকল্পের ব্যাপারে ততটা চিন্তিত দেখা যায়নি কাউকেই। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির বিস্তার ঠেকাতে সৌদি আরব এবং ইস্রাইলের মতো আঞ্চলিক পক্ষগুলিকেও আলোচনায় আনতে হবে; কারণ এরাও নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্র নিজেরাই তৈরি করতে পারছে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এসোসিয়েট ফেলো মার্ক ফিতজপ্যাট্রিক এক লেখায় বলছেন যে, ইরান নিশ্চয়ই এমন কোন নিয়ন্ত্রণমূলক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চাইবে না, যা কিনা অন্যদের উপর প্রয়োগ করা হবে না। তবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করার ব্যাপারে ইরানের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বাইরে সৌদি আরবের আর কোন উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা, সেব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। সৌদিদের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে ব্যবহারের জন্যে কোন পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরির প্রকল্প শুরুর কথাও শোনা যায় না। তবে ২০১৮ সালে মার্কিন মিডিয়া ‘সিবিএস’কে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন যে, সৌদি আরব পারমাণবিক অস্ত্র যোগাড় করতে চায় না। তবে ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র ডেভেলপ করে, তবে সৌদি আরব নিশ্চিতভাবেই একই কাজ করবে।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্ট্রাটফর’ ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলে যে, যদি সৌদি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের অবস্থানে পৌঁছে, তবে মার্কিন প্রশাসন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে পারে। মাইকেল এলম্যান ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে এক সাক্ষাতে বলেন যে, সৌদি আরবের বিমান বাহিনীতে অত্যাধুনিক ‘এফ ১৫’, ‘টর্নেডো’ এবং ‘টাইফুন’ যুদ্ধবিমান রয়েছে এবং তাদের পাইলটেরাও যথেষ্ট ভালো। তবে তাদের লজিস্টিক্যাল সাপোর্টের ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সহায়তার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কিন্তু সৌদিরা যদি ইরানের উপর কোন হামলা করতে যায়, সেখানে কোন নিশ্চয়তা নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র সৌদিদেরকে সহায়তা দেবে। এই অনিশ্চয়তাই হয়তো সৌদিদেরকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পেতে আগ্রহী করে তুলেছে। গত সেপ্টেম্বরে ‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলার মাঝেই যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে তাদের ‘প্যাট্রিয়ট’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের সাথে অনেকেই আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসার ব্যাপারটা যুক্ত করেছে; এবং একইসাথে তা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনীদের উপর নির্ভরশীল দেশগুলিকে দুশ্চিন্তার মাঝে ফেলে দিয়েছে। ‘রাইস ইউনিভার্সিটি’র ‘জেমস এ বেকার থ্রি ইন্সটিটিউট ফর পাবলিক পলিসি’র রিসার্চ ফেলো ক্রিশ্চিয়ান আলরিকসেন বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষগুলি মোটামুটিভাবে একমত যে, যুক্তরাষ্ট্র একসময় পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলকে রক্ষায় যতটা মনযোগী ছিল, এখন ততটা নেই। সৌদিরা মনে করছে যে, ওবামা, ট্রাম্প এবং বাইডেনের পরপর তিনটা প্রশাসনের সিদ্ধান্তের মাঝেই তারা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাবার প্রবণতা দেখেছে। অন্ততঃ ট্রাম্প প্রশাসনের পর বাইডেন যখন আফগানিস্তান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত দেয়ার সময়ে নিশ্চিত করেছেন যে, তার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই সর্বাগ্রে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বন্ধুরাই হতাশ হয়েছে।

 
২০১৮ সালে মার্কিন মিডিয়া ‘সিবিএস’কে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন যে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র ডেভেলপ করে, তবে সৌদি আরব নিশ্চিতভাবেই একই কাজ করবে। সৌদিরা মনে করছে যে, ওবামা, ট্রাম্প এবং বাইডেনের পরপর তিনটা প্রশাসনের সিদ্ধান্তের মাঝেই তারা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাবার প্রবণতা দেখেছে। অন্ততঃ ট্রাম্প প্রশাসনের পর বাইডেন যখন আফগানিস্তান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত দেয়ার সময়ে নিশ্চিত করেছেন যে, তার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই সর্বাগ্রে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বন্ধুরাই হতাশ হয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে সৌদিরা নিজেদের প্রতিরক্ষা নিজেরাই নিশ্চিত করতে পারবে, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত পাঁচ বছরে সৌদি আরবের অস্ত্র আমদানি ৬১ শতাংশ বেড়েছে। আর ‘মিডিলইস্ট আই’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২১ সালেই সৌদি আরব ঘোষণা দেয় যে, তারা নিজস্ব সামরিক শিল্পে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে। এছাড়াও ২০৩০ সালের মাঝে তারা তাদের সামরিক বাজেটের ৫০ শতাংশ নিজস্ব উৎস থেকে ক্রয় করার টার্গেট ঠিক করেছে। অর্থাৎ বাইরের উৎসের উপর নির্ভরতা কমাতে পরিকল্পনা নিয়েছে সৌদি আরব। তবে কিছুদিন আগেই বাইডেন প্রশাসন সৌদিদের কাছে ট্রাম্প প্রশাসনের এক অস্ত্র বিক্রির চুক্তিতে আংশিক সম্মতি দিয়েছে। সাড়ে ৬’শ মিলিয়ন ডলারের সেই অস্ত্র চুক্তির মাঝে রয়েছে ২’শ ৮০টা ‘এআইএম ১২০সি’ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র; এবং এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ফাইটার বিমান থেকে ছোঁড়ার জন্যে ৫’শ ৯৬টা ‘এলএইউ ১২৮ মিসাইল রেইল লঞ্চার’। এই চুক্তিতে সম্মতির পর মার্কিন সিনেটে প্রবল বাকবিতন্ডা চলে। সিনেটররা ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, দুই বছর আগে সৌদি ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের ফ্যাসিলিটি তৈরির কাজ শেষ হলেও যুক্তরাষ্ট্র সেব্যাপারে চুপ ছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ডেমোক্র্যাটরা অভিযোগ করেছিল যে, সৌদি প্রকল্পে ট্রাম্প প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। এখন বাইডেন প্রশাসনের এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র এব্যাপারে অফিশিয়ালি কোন বিবৃতি দেয়নি। এমনকি অতি সংবেদনশীল প্রযুক্তির বড় কিছু শিপমেন্টের ব্যাপারে ইন্টেলিজেন্স থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র চুপ থেকেছে; যদিও সকলেই মনে করছেন যে, ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনার ক্ষেত্রে সৌদিদের এই প্রকল্প একটা বড় বাধা। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে সৌদিদেরকে সরাসরি সহায়তা দেবে কিনা, সেব্যাপারে অনিশ্চয়তাই হয়তো সৌদিদেরকে নিজস্ব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে এই প্রকল্পের ব্যাপারে কয়েক বছর ধরে ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রশাসনের নীরবতাই যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ স্বীকৃতির প্রমাণ। দু’বছর আগে ‘স্ট্রাটফর’ বলেছিল যে, সৌদিরা ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করলে যুক্তরাষ্ট্র সৌদিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তবে কি বাইডেন প্রশাসন পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের জন্যেই অপেক্ষা করছে? নাকি ইরানের সাথে আলোচনার সফলতার ব্যাপারে সন্দেহের কারণেই বাইডেন প্রশাসন সৌদিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া থেকে দূরে থাকছে? অর্থাৎ ইরানের সাথে আলোচনায় সৌদিদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে দরকষাকষির একটা সুযোগ দিচ্ছে। তথাপি অনেকেই বলছেন যে, মার্কিনীদের উপর নির্ভরশীল সৌদিরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীত। সৌদিদের এই প্রকল্প হয়তো সেই ভীতি থেকেই এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে পারছে না। এমতাবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা যেমন বাড়বে, তেমনি সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনাও বাড়বে।

Wednesday 29 December 2021

মালদ্বীপে পৌঁছেছে বাংলাদেশ?

৩০শে ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩শে ডিসেম্বর মালদ্বীপের পার্লামেন্টে শেখ হাসিনা এক বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার এই সফরটা বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্যেই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্যেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এতকাল দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলি একমাত্র ভারতের প্রভাবের মাঝে থেকেই নিজেদের নীতি নির্ধারণ করেছে। এই প্রথমবারের মতো এই সমীকরণে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

 
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিসেম্বরে দ্বিতীয়ার্ধে ছয় দিনের জন্যে মালদ্বীপ সফর করে এসেছেন। দ্বৈত কর বাতিল করে বাণিজ্য সহজীকরণ, কারাবন্দী বিনিময়, বাংলাদেশ থেকে মেডিক্যাল প্রফেশনাল নেয়া এবং যুব উন্নয়ন বিষয়ে কয়েকটা সমঝোতা স্বারক এই সফরে স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মালদ্বীপকে ১৩টা সামরিক গাড়ি উপহার দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরের মাঝে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম, পার্লামেন্ট স্পিকার মোহামেদ নাশীদ এবং প্রধান বিচারপতি আহমেদ মুতাসিম আদনানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ২৩শে ডিসেম্বর মালদ্বীপের পার্লামেন্টে শেখ হাসিনা এক বক্তব্য রাখেন। এই সফরটা বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্যেই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্যেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এতকাল দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলি একমাত্র ভারতের প্রভাবের মাঝে থেকেই নিজেদের নীতি নির্ধারণ করেছে। এই প্রথমবারের মতো এই সমীকরণে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

গত ১৩ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘আবু উবাইদাহ’ চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ সফর করা। শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর ওয়েবসাইট বলছে যে, জাহাজটা ১৮ই ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে পৌঁছায় এবং ২০শে ডিসেম্বর কলম্বো ছেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের সময় জাহাজটা সেখানেই ছিল; যদিও জাহাজটা মিডিয়াতে তেমন একটা আসেনি। তবে মালদ্বীপে বাংলাদেশের সামরিক সফর এটাই প্রথম নয়। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক মালদ্বীপ সফরের সময় ৭টা সামরিক পিকআপ ট্রাক উপহার হিসেবে প্রদান করেছিলেন।

তবে এখনও পর্যন্ত মালদ্বীপ অনেক দিক থেকেই ভারতের প্রভাবের মাঝেই রয়েছে। পুরো মালদ্বীপ জুড়ে ভারত ১০টা স্বল্প পাল্লার উপকূলীয় রাডার বসিয়েছে মালদ্বীপের সমুদ্রসীমার উপর নজরদারি করার জন্যে। ২০০৬ সালে ভারত মালদ্বীপকে ৪৬ মিটার লম্বা একটা প্যাট্রোল বোট দেয়। ২০১৩ সালে ভারত মালদ্বীপকে দু’টা ‘ধ্রুভ’ হেলিকপ্টার উপহার দেয়। ২০১৯ সালের আরও একটা প্যাট্রোল বোট দেয় ভারত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সাথে মালদ্বীপের নৌঘাঁটি ডেভেলপ করার ব্যাপারে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক মালদ্বীপের ‘উথুরু থিলা ফালহু’ নৌঘাঁটি ডেভেলপ করার জন্যে ভারত মালদ্বীপকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দেবে। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ বলছে যে, ভারত মালদ্বীপে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্যে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে। এছাড়াও করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতেও ভারত মালদ্বীপকে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। ‘ভ্যাকসিন মৈত্রী’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভারত মালদ্বীপকে ২ লক্ষ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন প্রদান করেছে।

ভারতের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্ক প্রভাব বিস্তারের হলেও মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের। মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটা গভীর, তা কয়েকটা ঘটনার মাঝেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। সমুদ্রের পানির মাঝে বসবাস করলেও মালদ্বীপে খাবারের পানির অভাব রয়েছে। প্রতিটা দ্বীপের রয়েছে আলাদা বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে সমুদ্রের পানি থেকে সুপেয় পানি তৈরির যন্ত্র আগুন লেগে নষ্ট হয়ে গেলে পুরো পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ধ্বস নামে। প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের খাবারের পানিটুকুও না থাকায় দেশটাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। এরকমই এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মালদ্বীপের সহায়তায় এগিয়ে আসে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘সমুদ্র জয়’ ১ লক্ষ লিটার খাবার পানি এবং ৫টা মোবাইল পানিশোধন প্ল্যান্ট নিয়ে রওয়ানা দেয় মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে। সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে ৩ হাজার কিঃমিঃএর বেশি সমুদ্রপথ মাত্র ৪ দিনে পাড়ি দিয়ে মালেতে পৌঁছে জাহাজখানা।

 
মার্চ ২০২১। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মেডিক্যাল দল মালদ্বীপে। ভারতের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্ক প্রভাব বিস্তারের হলেও মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের।


মালদ্বীপ অতি ছোট একটা দ্বীপ দেশ। দেশটার অতি জরুরি সেবার অনেককিছুই নিজেদের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। এর মাঝে রয়েছে প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সেবা। বাংলাদেশের মেডিক্যাল প্রফেশনালরা মালদ্বীপে সার্ভিস দিচ্ছেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে মালদ্বীপের অর্থনীতিতে ধ্বস নামার সাথেসাথে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘সমুদ্র অভিযান’ ১’শ টনের সাহায্য নিয়ে মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। এই সাহায্যের মাঝে ছিল ২০ হাজার সেট পিপিই, ৫ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ৯’শ ৬০টা সেফটি গ্লাস এবং ৪০ কার্টন জরুরি ঔষধ। এছাড়াও ৮৫ টন খাবার ছিল জাহাজে। এর পরের মাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটা পরিবহণ বিমানে করে ১১ জন ডাক্তারকে মালদ্বীপে পাঠানো হয়। ২০২১ সালের মার্চে মালদ্বীপের জনগণের মাঝে ভ্যাকসিনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘সি ১৩০’ পরিবহণ বিমানে করে সামরিক বাহিনীর ২৩ জন মেডিক্যাল প্রফেশনালকে মালদ্বীপে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশের প্রায় এক লক্ষ কর্মী মালদ্বীপের হুলহুমালে দ্বীপ তৈরিতে অংশ নিচ্ছে; যেখানে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের থাকার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্প হলো মালদ্বীপের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রকল্প। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই দ্বীপ উন্নয়নের কাজ চলছে। তবে এই দ্বীপ উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ কম নয়। মালদ্বীপে কোন নদী নেই; যেকারণে পলিমাটি জমে মালদ্বীপের ভূমির পরিধি বাড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। তাই মালদ্বীপ অন্য দেশ থেকে মাটি আমদানি করে হুলহুমালে দ্বীপ তৈরি করছে। এই জায়গাটাতেই মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল এক দশকের বেশি সময় ধরে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত আহমেদ সারীর বাংলাদেশের নৌপরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খানের কাছে বাংলাদেশ থেকে মাটি আমদানি করার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। একই বছরের অগাস্টে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত বলেন যে, তার দেশ প্রতি বছর ৪ লক্ষ টন মাটি আমদানি করছে; যার তিন চতুর্থাংশ আসছে ভারত থেকে। তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের নদীর পলিমাটি ভারতের মাটি থেকে উত্তম হওয়ায় তার দেশ বাংলাদেশ থেকে মাটি আমদানিতে বেশি আগ্রহী। ২০১৬ সালের এপ্রিলে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত মোহামেদ আসিম বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে আবারও মাটি আমদানির কথা বলেন। সর্বশেষ ২০২০এর নভেম্বর মাসে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সাথে এক ফোনালাপে আবারও মাটি আমদানি করার ইচ্ছার কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় পরেও বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে মাটি রপ্তানি হয়নি। যেহেতু বাংলাদেশের পলিমাটি দিয়ে ভারতের মাটিকে প্রতিস্থাপিত করার কথা ছিল, তাই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন খুব একটা সহজ ছিল না মোটেই। বলাই বাহুল্য যে, মালদ্বীপকে ভারত তার নিজস্ব প্রভাবের অধীন দেশ বলে মনে করে। এখানে বাংলাদেশ বা অন্য কোন দেশের প্রভাব বিস্তারকে ভারত ভালো চোখে দেখবে না। কিন্তু হয়তো এখন সেই ব্যাপারটাই ঘটতে যাচ্ছে, যা কিনা ভারত এত বছর আটকে রেখেছিল।

 
ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ 'আবু উবাইদাহ' শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের সময় জাহাজটা সেখানেই ছিল; যদিও জাহাজটা মিডিয়াতে তেমন একটা আসেনি। ভারত, শ্রীলংকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং আরও কিছু দেশ এতকাল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সফর তালিকায় ছিল; মালদ্বীপ ছিল না। জাহাজটার মালদ্বীপ সফর হয়তো 'কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ'এর ম্যারিটাইম অপারেশনেরই একটা রিহার্সাল। এটা পরিষ্কার যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি শুধুমাত্র ভারতকেন্দ্রিক আর থাকছে না।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘আবু উবাইদাহ’ মালদ্বীপ সফরে গিয়েছে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করার জন্যে নয়। ভারত, শ্রীলংকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং আরও কিছু দেশ এতকাল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সফর তালিকায় ছিল; মালদ্বীপ ছিল না। ২০২১ সালের অগাস্টে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে ‘কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ’ বা ‘সিএসসি’ নামের একটা নিরাপত্তা সহযোগিতা জোটের মাঝে বাংলাদেশের নাম চলে এসেছে। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ বলছে যে, ২০১১ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাবায়া রাজাপক্ষের প্রচেষ্টায় শুরু করা এই জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের সমুদ্র নিরাপত্তায় ভারতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে কয়েক বছর মালদ্বীপের সাথে ভারতের সম্পর্কের কিছুটা টানাপোড়েন চলায় এই কনক্লেভের কর্মকান্ড স্থগিত হয়ে যায়। ২০২০ সালে এই কর্মকান্ড আবারও নতুন উদ্যমে শুরু হয়; এর নামকরণটাও এবারেই আসে। এবারে গোটাবায়া রাজাপক্ষে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট। সেবছরের নভেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে শ্রীলংকার প্রস্তাবে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ সেইশেল এবং মরিশাসের সাথে সাথে বাংলাদেশকেও এই জোটে ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে ঢোকানো হয়। এর আগে ২০১৪ সালে সেইশেল এবং মরিশাস ‘অতিথি’ দেশ হিসেবে উপস্থিত ছিল। তবে সবচাইতে বড় ঘটনাটা ঘটে যায় ২০২১ সালের উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে। এখানেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় যে নতুন তিনটা রাষ্ট্রকে স্থায়ী সদস্য হিসেবে জোটে ঢোকানো হবে। এর সাথে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আরেকটা ঘটনা ঘটে যায়; যা কিনা এই জোটের গুরুত্বকে বাড়িয়ে তোলে। ‘সিএসসি’এর অধীনে ভারত, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের অংশগ্রহণে একটা ‘ফোকাসড অপারেশন’ চালনা করা হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, এই অপারেশনে তিন দেশের নৌশক্তি অংশ নেয়। ভারতের ‘মনোহর পারিকার ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড এনালিসিস’এর গবেষক গুলবিন সুলতানা ‘ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, প্রথমবারের মতো এই কনক্লেভের অধীনে একটা সামরিক অপারেশন করা হলো। এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্যান্য ম্যারিটাইম নিরাপত্তা জোট, যেমন ‘ইন্ডিয়ান ওশান রিম এসোসিয়েশন’এর সাথে কলম্বো কনক্লেভের একটা পার্থক্য হয়ে গেলো। তিনি মনে করছেন যে, ভারত মহাসাগরে এই জোট একটা গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা পদক্ষেপ হিসেবে সামনে আসতে যাচ্ছে; যার গুরুত্ব আরও বাড়তে যাচ্ছে সেইশেল, মরিশাস এবং বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে।

মালদ্বীপ শুধুমাত্র বাংলাদেশী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের একটা উৎস হিসেবেই ছিল এতকাল। তবে এই অবস্থানের পরিবর্তন হতে চলেছে। গত ১৯শে নভেম্বর থেকে দুই দেশের মাঝে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। বাণিজ্য সহজীকরণের জন্যে দুই দেশের মাঝে সরাসরি জাহাজ চলাচলের ব্যাপারেও ঐকমত্য হয়েছে ইতোমধ্যেই। এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হলে হয়তো বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে পলিমাটি রপ্তানিও সম্ভব হতে পারে। আর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ‘বিআইডিএস’এর এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন যে, মালদ্বীপ বাংলাদেশের কাছে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ চেয়েছে; এবং বাংলাদেশ সেটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। এর আগে বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে; যখন দেশটা ভারতের কাছ থেকে ঋণ পায়নি। আর ‘কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ’ এমন সময়ে ম্যারিটাইম অপারেশনকে এই জোটের অন্তর্ভুক্ত করলো, যখন শ্রীলংকার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এই জোটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ঢুকতে যাচ্ছে। হয়তো অতি শিগগিরই বাংলাদেশের যুদ্ধজাহাজগুলিকে মালদ্বীপ, সেইশেল এবং মরিশাস পর্যন্ত সমুদ্রে টহল দিতে দেখা যাবে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ’আবু উবাইদাহ’র মালদ্বীপ সফর হয়তো এরকম অপারেশনেরই একটা রিহার্সাল। এটা পরিষ্কার যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি শুধুমাত্র ভারতকেন্দ্রিক আর থাকছে না।

Saturday 25 December 2021

পশ্চিমা অর্থনীতিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্ট

২৫শে ডিসেম্বর ২০২১

করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণের কারণে পশ্চিমা দুনিয়ায় ক্রিসমাসের আগে আগে ৪ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। মানুষের মৃত্যুর মহামারি যতটা, তার চাইতে বেশি সম্পদের মহামারি। অপ্রতুল এবং যথেচ্ছ সমাধানের কারণে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মারাত্মক চাপের মাঝে পড়েছে। এই যথেচ্ছ সমাধানগুলিকে জোরপূর্বক বাস্তবায়নের চেষ্টা মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করছে এবং জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই পড়েছে প্রশ্নের মুখে। করোনা মহামারি বিশ্বের জনগণকে ধ্বসে পড়া পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করছে।


করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণের কারণে পশ্চিমা দুনিয়ায় ক্রিসমাসের আগে আগে ৪ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। ওয়েবসাইট ‘ফ্লাইটএওয়্যার’এর বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, ফ্লাইট বাতিলের এক চতুর্থাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ক্রিসমাসের আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রে বাতিল হয়েছে ৬’শ ৮৯টা ফ্লাইট; ক্রিসমাসের দিন আরও ৭’শ বাতিলের অপেক্ষায়। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, অনেক ফ্লাইট ক্রু এবং অপারেশনসএর সাথে জড়িত লোকজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে; অথবা তাদের নিজেদেরকে কোয়ার‍্যান্টাইন করতে হয়েছে। যদিও গবেষকেরা বলেছেন যে, ওমিক্রন আগের ভ্যারিয়্যান্টগুলির চাইতে বেশি প্রাণনাশী নয়, তথাপি এর সংক্রমণ করতে পারার সক্ষমতা অনেক বেশি থাকায় অনেকেই চিন্তা পড়েছেন। ‘ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান’এর এসোসিয়েট প্রফেসর হ্যালি প্রেসকট ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, যখন একইসাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়ে যায়, তখন এদের মাঝে স্বল্প শতাংশ মানুষও যদি হাসপাতালে যায়, সেটাও মেডিক্যাল ব্যবস্থাকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলার জন্যে যথেষ্ট।

ক্রিসমাসের ঠিক আগে আগে ব্রিটেনের রেস্টুর‍্যান্টগুলি ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের কারণে মারাত্মক সমস্যায় পতিত হয়েছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, গত বসন্তের পর থেকে সবচাইতে খারাপ অবস্থায় পড়েছে তারা। ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্স’ বা ‘ওএনএস’ বলছে যে, ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে রেস্টুর‍্যান্টগুলিতে বসা খদ্দেরের সংখ্যা ১৪ শতাংশ কমেছে। ওমিক্রনের কারণে ব্রিটিশরা এখন বাইরে গিয়ে খাচ্ছে কম; এবং বাসায় বসে কাজ করছে বেশি। লন্ডনে এই অবস্থা সবচাইতে খারাপ; সেখানে খদ্দেরের সংখ্যা কমেছে ১৮ শতাংশ। ‘ওএনএস’ আরও বলছে যে, বাসা থেকে কাজ করতে বলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই সপ্তাহে ২ শতাংশ বেড়ে ১৪ শতাংশে ঠেকেছে। ব্রিটেনের আঞ্চলিক শহরগুলিতে বেচাকেনা ভালো চললেও লন্ডনে বেচাকেনা ২৯ শতাংশ কমে গেছে। কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘অক্সফোর্ড ইকনমিক্স’এর অর্থনীতিবিদ এন্ড্রু গুডউইন বলছেন যে, যদিও সরকার বেশিরভাগ বিধিনিষেধ ক্রিসমাসের আগে চালু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তথাপি জনগণের মাঝেই সাবধানতা অবলম্বণ করার প্রবণতা বেড়েছে; এর উপর রয়েছে অবাধে চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা। তিনি মনে করছেন যে, এগুলির কারণে ব্রিটেনের জিডিপি ডিসেম্বর মাসে কমবে।

অপরদিকে আটলান্টিকে ওপাড়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ বলছে যে, মার্কিন অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় চার দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে যে, গত নভেম্বরে ব্যক্তিগত খরচার হিসেবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ; যা ১৯৮২ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। গত অক্টোবরে এটা ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। নভেম্বরে জনগণের খরচ বাড়লেও আয় সেই তুলনায় বাড়েনি। খরচ বেড়েছে দশমিক ৬ শতাংশ; আয় বেড়েছে দশমিক ৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে বেকার ভাতা দাবি করা মানুষের সংখ্যা ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১৮ লক্ষ ৫৯ হাজারে। মহামারির মাঝে এটা সর্বনিম্ন সংখ্যা হলেও সংখ্যাটা যথেষ্টই বড়। কারণ এর বাইরেও অনেকেই রয়েছে যারা বেকারত্বের এই সংজ্ঞার মাঝে না পড়লেও কোনমতে সংসার চালাচ্ছে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, ওমিক্রন ঠেকাতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইতালি, স্পেন এবং গ্রিসে মাস্ক পড়ে বাইরে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উত্তর স্পেনের কাতালোনিয়াতে রাত্রিকালীন কারফিউ বলবত করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসে চলছে কঠোর লকডাউন। জার্মানিতে ২৮ ডিসেম্বর থেকে প্রাইভেট গণজমায়েত ১০ জনের বেশি করা যাবে না; নাইট ক্লাবগুলিও বন্ধ থাকবে। ফুটবল খেলা হবে দর্শকবিহীন মাঠে। পর্তুগালে ২৬শে ডিসেম্বর থেকে বার এবং নাইট ক্লাবগুলি বন্ধ হচ্ছে; আর ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাসা থেকে কাজ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রধান এন্থনি ফাউচি বলছেন যে, ক্রিসমাসের সময় মানুষ বেশি ঘোরাঘুরি করলে পুরোপুরি ভ্যাকসিন নেয়া থাকলেও সংক্রমণ বাড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’র হিসেবে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৫৩ লক্ষ মানুষ করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছে; আক্রান্ত হয়েছে কমপক্ষে ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ই ডিসেম্বর অফিশিয়ালি করোনায় মৃতের সংখ্যা ৮ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। গত ২রা অক্টোবরে তা ৭ লক্ষ ছাড়িয়েছিল। অর্থাৎ ৭৫ দিনে বা প্রায় আড়াই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মারা গেছে ১ লক্ষ মানুষ। প্রতিদিন গড়ে এই সংখ্যা ১ হাজার ৩’শ ৩৩ জন। ২০২০ সালের মার্চের শুরু থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ মাসে মৃত্যু হয়েছিল ৭ লক্ষ মানুষের। অর্থাৎ এই সময়ের মাঝে গড়ে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২’শ ২৮ জন; যা কিনা গত আড়াই মাসের চাইতে কম! অথচ প্রথম ১৯ মাসের তুলনায় শেষ আড়াই মাসে বেশিরভাগ মানুষই ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে। ‘ব্লুমবার্গ’এর প্রতিবেদনে দেখানো হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ কমপক্ষে একবার ভ্যাকসিন নিয়েছে; ৬২ শতাংশ মানুষকে পুরোপুরিভাবে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এর মাঝে ২০ শতাংশ আবার বুস্টার ডোজও পেয়েছে। ইইউতে ৭০ শতাংশ মানুষকে দেয়া হয়ে পুরোপুরি ভ্যাকসিন; ২৬ শতাংশ বুস্টারও পেয়েছে। মাল্টিবিলিয়ন ডলারের এই ভ্যাকসিন ব্যবস্থাও মৃত্যুর মিছিল কমাতে পারছে না। থামাতে পারছে না অর্থনৈতিক নিম্নগতি।

পশ্চিমা দেশগুলিতে ভ্যাকসিন নেয়ার বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদ হয়েছে, তেমনি করোনার কারণে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপের বিরুদ্ধেও হয়েছে বিক্ষোভ। রাষ্ট্রগুলি কোন সমাধান দিতে পারেনি তাদের জনগণকে, যার মাধ্যমে সংক্রমণ বা মৃত্যু কমানো যেতে পারতো। অথচ পরীক্ষামূলক বিধিনিষেধের যাঁতাকলে পরে জনগণের আর্থিক অবস্থা হয়েছে করুণ। ভ্যাকসিনের ডোজ বৃদ্ধি করার পরেও মেলেনি কাংক্ষিত ফলাফল। অথচ এর ফলে কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রচুর লাভ করেছে; তাদের গুটিকয়েক শেয়ারহোল্ডার লাশের মিছিলের উপর হয়েছে বিলিয়নায়ার। ওমিক্রন মানুষের জীবন নিচ্ছে কম; কিন্তু দুই বছর ধরে থেকে থেকে বিধিনিষেধের পর পশ্চিমা অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টাটুকুকে ধ্বসিয়ে ফেলছে। মানুষের মৃত্যুর মহামারি যতটা, তার চাইতে বেশি সম্পদের মহামারি। অপ্রতুল এবং যথেচ্ছ সমাধানের কারণে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মারাত্মক চাপের মাঝে পড়েছে। এই যথেচ্ছ সমাধানগুলিকে জোরপূর্বক বাস্তবায়নের চেষ্টা মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করছে এবং জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই পড়েছে প্রশ্নের মুখে। করোনা মহামারি বিশ্বের জনগণকে ধ্বসে পড়া পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করছে।

Friday 24 December 2021

কনকনে ঠান্ডার মাঝে আকাশচুম্বী জ্বালানির মূল্য ইইউএর লক্ষ্যহীনতাকেই তুলে ধরে

২৫শে ডিসেম্বর ২০২১

ইইউ এখন না পারছে জাতীয়তাবাদকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বগুলিকে ঘুচতে; না পারছে পূর্ব ইউরোপের সীমান্তের সমস্যাগুলিকে সমাধান করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে। ব্রেক্সিট, করোনাভাইরাসের অব্যবস্থাপনা, ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের পর নিজেদের অনৈক্য প্রসূত এই জ্বালানি সমস্যা ইইউএর লক্ষ্যগুলিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইইউ কি সমস্যার সমাধান করার জন্যে তৈরি হয়েছিল; নাকি নতুন সমস্যার জন্ম দেয়ার জন্যে?

 
ইউরোপের অনেক অঞ্চলেই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাপমাত্রা শূণ্যের নিচে নেমে গেছে। এর মাঝেই চলছে মারাত্মক জ্বালানি সমস্যা। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জমে যাওয়া ঠান্ডার মাঝে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কোন শেষ দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানির অকশনে গ্যাসের মূল্য এবছরের মাঝেই বেড়েছে ৬ গুণ! আর বিদ্যুতের অকশনের অবস্থাও খারাপ। জার্মানিতে বিদ্যুতের মূল্য উঠেছে প্রতি মেগাওয়াট আওয়ারে রেকর্ড ২’শ ৮৯ ডলার। ফ্রান্সেও ইতিহাসের সর্বোচ্চ মূল্য উঠেছে। ‘এসএন্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস’এর হিসেবে ২২শে ডিসেম্বর ব্রিটেনে বিদ্যুতের বেইজলোড মূল্য ছিল প্রতি মেগাওয়াট আওয়ারএ প্রায় ৪’শ ৩৮ ডলার; যা ডিসেম্বর মাসের শুরুর তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। নেদারল্যান্ডসে বিদ্যুতের মূল্য ২১শে ডিসেম্বরে রেকর্ড ৪’শ ৮৭ ডলার ছোঁয়।

‘ব্লুমবার্গ’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাৎসরিক ছুটির মাসগুলির ঠিক আগেই করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণ বেড়েছে ইউরোপে; যা কিনা মূদ্রাস্ফীতিকে আরও বাড়িয়েছে। ট্রেডিং কোম্পানি ‘ট্রাফিগুরা গ্রুপ’এর প্রধান নির্বাহী জেরেমি উইয়ার নভেম্বরে সকলকে সাবধান করে বলেন যে, শীত বেশি পড়লে ইউরোপে লোড শেডিংএর কারণে ব্ল্যাকআউট হতে পারে। ফ্রান্সের বিদ্যুৎ কোম্পানি ‘ইলেকট্রিসিটে ডে ফ্রান্স এসএ’ ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা তাদের আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বন্ধ করছে; যেগুলি কিনা ফ্রান্সের মোট আণবিক বিদ্যুতের ১০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। এর ফলে গ্যাসের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোন পদ্ধতি খোলা থাকছে না। অথচ শীতকালের শুরুতে ইউরোপের গ্যাস স্টোরেজগুলিতে মাত্র ৬০ শতাংশ গ্যাসের মজুত রয়েছে। এর মাঝে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানিতে ইউরোপের সাথে চলছে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জ্বালানি ব্যবসায়ীরা মনে করছেন যে, এশিয়াতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির চাহিদা কম থাকায় ইউরোপ হয়তো এলএনজি দিয়ে নিজেদের জ্বালানির চাহিদা কিছুটা মেটাতে পারবে। তবে এশিয়া থেকে এলএনজির জাহাজগুলি ঘুরিয়ে ইউরোপে নিয়ে আসতে জানিয়ারি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। এছাড়াও ইউরোপের বাতাসের গতি কম থাকার কারণে জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিও কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে থাকবে।

ইউরোপের জ্বালানি সমস্যা এখন একটা ব্যবস্থাগত সমস্যা বলে বলছেন ব্রিটেনের বাণিজ্য এসোসিয়েশনের প্রধান এমা পিঞ্চবেক। 'বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে তিনি বলেন যে, যেসব কোম্পানি জ্বালানি সরবরাহ করে অথবা বেশি জ্বালানি ব্যবহার করে, তাদেরকে সরকারগুলি বলছে যে, তাদের কারখানাগুলি বন্ধ করে দিতে অথবা উৎপাদিত পণ্য যেন পরিবর্তন করে ফেলা হয়। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে জ্বালানির অতিরিক্ত মূল্য এবং এর ফলশ্রুতিতে চাহিদার উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব। পিঞ্চবেকের ধারণা যে, সামনের বসন্তে ব্রিটেনে জ্বালানির খরচ ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। মহামারির মাঝে জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির সাথে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি মারাত্ম পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। পুরো সমস্যাটাকে একটা ব্যবস্থাগত সমস্যা বলে ব্রিটিশ সরকারকে জ্বালানির উপর কর এবং ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করতে বলছেন তিনি।

অপরদিকে মার্কিন চিন্তাবিদেরা অনেকেই ইউরোপের সমস্যাকে রাশিয়া নির্ভরতার ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করছেন। ‘ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজ’এর এসিসট্যান্ট প্রফেসর এমিলি হল্যান্ড ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই চাইছিল যে, ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাস থেকে সরে আসুক। কিন্তু এর পিছনে বড় সমস্যা হলো জ্বালানির ব্যাপারে ইউরোপিয়দের মাঝে মতানৈক্য। ইইউ যেখানে চাইছে যে, কয়লার ব্যবহার শূণ্য করে ফেলতে, সেখানে পোল্যান্ড চাইছে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার সময়সীমা বৃদ্ধি করতে। অপরদিকে জার্মানিতে এঙ্গেলা মার্কেলের প্রাক্তন সরকার এবং বর্তমান সোশাল ডেমোক্র্যাট সরকার আণবিক শক্তিকে জলবায়ু বান্ধব শক্তি হিসেবে মনে করছে না। অথচ ফ্রান্স এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি মনে করছে যে, আণবিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রীনহাউজ গ্যাসের নির্গমণ কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে মার্কিন আণবিক শক্তি কোম্পানিগুলি ইউরোপে রাশিয়ার কাছে হারানো ব্যবসা পুনরুদ্ধার করার সুযোগ পেতে পারে। এমিলি হল্যান্ড মনে করছেন যে, ইউরোপের মতানৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ হবে ইউক্রেন, মলদোভা এবং দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে কাজ করা; কারণ এই দেশগুলি রুশ হুমকির মাঝে রয়েছে।

প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ফেলো এলেন ওয়াল্ড। তিনি এক লেখায় ইউরোপের জ্বালানির উৎসকে বৈচিত্রপূর্ণ করার উপদেশ দিচ্ছেন। তার কথায় ইউরোপ একইসাথে যেমন চাইছে জলবায়ুকে রক্ষা করতে, ঠিক তেমনি চাইছে অর্থনীতিকে গতিশীল রেখে নিজেদের জীবনমান ঠিক রাখতে। এটা করতে গেলে ইউরোপকে কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে; যেমন বায়োফুয়েল হিসেবে পাম অয়েলের ব্যবহার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। এলেন ওয়াল্ড বলছেন যে, রেইপসীড এবং সয়াবিনের চাইতে পাম থেকে প্রতি হেক্টরে ৭ থেকে ১১ গুণ তেল উৎপাদন হয়। কিন্তু ইউরোপের জলবায়ু পাম অয়েলের জন্যে উপযুক্ত নয়। ইইউ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাম অয়েলের আমদানি বন্ধ করে নিজস্ব বায়োফুয়েলের উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। অর্থাৎ নিজেদের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গিয়ে জলবায়ুর জন্যে অপেক্ষাকৃত খারাপ জিনিসটাই ইইউকে বেছে নিতে হচ্ছে।

নিজের সাথেই যুদ্ধরত ইউরোপ। বিশ্লেষকেরা যে সমস্যাগুলি বলছেন, সেগুলি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগত সমস্যা। জনগণের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানিকে অকশনে কেনাবেচার ব্যবস্থাটা যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা ইউরোপের ইতিহাসের সবচাইতে মারাত্মক জ্বালানি সমস্যাই দেখিয়ে দিচ্ছে। এর মাঝে ইউরোপ এখনও কয়লা, গ্যাস এবং আণবিক শক্তির ব্যবহারের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে একমত নয়। কনকনে ঠান্ডার মাঝে ইউরোপের মতানৈন্যকে ভূরাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চাইছে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। ইইউ এখন না পারছে জাতীয়তাবাদকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বগুলিকে ঘুচতে; না পারছে পূর্ব ইউরোপের সীমান্তের সমস্যাগুলিকে সমাধান করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে। ব্রেক্সিট, করোনাভাইরাসের অব্যবস্থাপনা, ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের পর নিজেদের অনৈক্য প্রসূত এই জ্বালানি সমস্যা ইইউএর লক্ষ্যগুলিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইইউ কি সমস্যার সমাধান করার জন্যে তৈরি হয়েছিল; নাকি নতুন সমস্যার জন্ম দেয়ার জন্যে?

Friday 17 December 2021

নতুন জার্মান পররাষ্ট্রনীতি… কতটা বাস্তবসম্মত?

১৭ই ডিসেম্বর ২০২১

পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে যৌথ সংবাদ সন্মেলন করছেন নতুন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক এবং পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিবিগনিউ রাউ। ইইউএর মাঝে পোল্যান্ডের অবস্থান শক্তিশালী ইইউএর বিরুদ্ধে। কারণ শক্তিশালী ইইউএর মাঝে পোল্যান্ড শক্তিশালী জার্মানিকে দেখতে পাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইউরোপের লিবারাল আদর্শের দেশগুলির মাঝে এখনও অবিশ্বাস বিদ্যমান। ইইউএর ভঙ্গুর এই পরিস্থিতিতে নতুন জার্মান কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা কতটুকু হতে পারে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নয়।

 
জার্মানির নতুন কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বিভিন্ন ইউরোপিয় দেশ ভ্রমণ করা শুরু করেছেন। ‘গ্রীন পার্টি’র নেতা হিসেবে ভ্রমণের শুরুতেই তিনি বলেন যে, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলাকে তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য দেবেন। কারণ ভবিষ্যতের কোন সমস্যাই মানবজাতির জন্যে জলবায়ু সমস্যার চাইতে বড় নয়। এর আগের সকল জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো তিনিও প্যারিস দিয়ে তার যাত্রা শুরু করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, ফ্রান্সের চাইতে কাছের বন্ধু নেই জার্মানির। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছেন যে, প্যারিস এবং ব্রাসেলসে ইইউ এবং ন্যাটোর হেডকোয়ার্টার্স সফরে তিনি বেলারুশ এবং ইউক্রেনের ব্যাপারে ইউরোপের নীতির একাত্মতা নিয়ে কথা বলেন। প্যারিস সফরে তিনি চীনা মহিলা টেনিস খেলোয়াড় পেং শুইএর ইস্যুতে একাত্মতা ছাড়াও বেইজিংএ শীতকালীন অলিম্পিক কূটনৈতিকভাবে বর্জনের বিষয়ে আলোচনা করেন। বেয়ারবক পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করেন যে, ইউরোপ যেসকল আদর্শিক স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলিকে ভেঙ্গে যেতে দিতে পারে না; বিশেষ করে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার।

তবে বেয়ারবকের পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ সফর অতটা মধুর ছিলনা। বেয়ারবক পোল্যান্ডের বার্তা সংস্থা ‘টিভিপি’কে বলেন যে, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পোল্যান্ডে জার্মানির কর্মকান্ডের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা, দায়িত্ব নেয়া এবং ক্ষতিপূরণের ব্যাপারগুলি রয়েছে। দুই দেশের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে তোলাকে তিনি ঐতিহাসিক কাজ বলে আখ্যা দেন। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিবিগনিউ রাউ বলেন যে, পোল্যান্ডের জনগণের চিন্তায় সুবিচারের ব্যাপারটা প্রোথিত হতে হলে অনেকগুলি ইস্যুর সমাধান প্রয়োজন। তিনি বলেন যে, পোল্যান্ড নতুন সরকারের কাছ থেকে দায়িত্ব স্বীকার এবং ক্ষতিপূরণ চায়। পোলিশ মিডিয়া ‘এনএফপি’ বলছে যে, ওয়ারশ সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে বার্লিনের কাছ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ চাইলেও এর আগের এঙ্গেলা মার্কেলের সরকার এর কোন আইনী ভিত্তি নেই বলে প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়াও পোল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত পোল্যান্ডের আইনকে ইইউএর আইনের উপরে স্থান দেয়ার পর থেকে ইইউএর সাথে পোল্যান্ডের যে টানাপোড়েন চলছে, সেব্যাপারেও বেয়ারবক আলোচনা করেন। তবে তিনি ওয়ারশ সফরে সাংবাদিকদের এব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। অপরদিকে পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাউ রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প বাতিল করে দেয়ার দাবি জানান। ‘এনএফপি’ বলছে যে, পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যান ইয়ারোস্লাভ কাচিনস্কি ইইউএর আরও শক্তিশালীকরণকে জার্মানির আরও শক্তিশালী হওয়া হিসেবে দেখছেন। তিনি ৫ই ডিসেম্বর ইউরোপের ডানপন্থী নেতা ফ্রান্সের মারিন লা পেন এবং হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবানকে নিয়ে বৈঠক করেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর সাথে এক সাক্ষাতে জার্মান ‘সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বা ‘এসপিডি’র পররাষ্ট্রনীতির মুখপাত্র নিলস শ্মিড বলেন যে, ‘এসডিপি’, ‘গ্রীন পার্টি’ এবং ‘ফ্রি ডেমোক্র্যাটস’ বা ‘এফডিপি’এর নতুন কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি আগের নীতিকেই এগিয়ে নেবে; বড় রকমের পরিবর্তনের আশংকা নেই। ইউরোপ এবং আন্তআটলান্টিক নীতির ব্যাপারে সকলের ঐকমত্য রয়েছে। নতুন ক্ষেত্র হিসেবে তিনি ইন্টারনেট কোম্পানিগুলিকে শৃংখলার মাঝে আনা, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ‘ফাইভ জি’ এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো নতুন প্রযুক্তিকে নিয়মের অধীনে আনতে, এমনকি মহামারি নিয়ন্ত্রণে এবং নতুন ঔষধ ডেভেলপ করতে তিনি ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার উপর গুরুত্ব দেন। তবে তিনি বলেন যে, সবচাইতে বড় পরিবর্তনটা আসতে পারে চীন নীতির ক্ষেত্রে। এর মূল কারণ হলো চীন ইউরোপের জন্যে যেমন হুমকি, তেমনি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা ছাড়াও পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।

জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’ বা ‘ডিজিএপি’র প্রধান নির্বাহী ক্যাথরিন ক্লুভার এশব্রুক এক লেখায় বলছেন যে, নতুন জার্মান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি এঙ্গেলা মার্কেলের সুযোগসন্ধানী এবং মার্কেন্টিলিস্ট পররাষ্ট্রনীতি থেকে অনেক আলাদা হতে চলেছে। তিনি বলছেন যে, জার্মান সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং সমমনা দেশগুলিকে একত্রিত করে চীনের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে, যাতে তারা অর্থনৈতিক ভ্যালু চেইনগুলিকে ঠিক রেখেই মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনগুলিকে রক্ষা করতে পারে। তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইউরোপের নিয়মকানুন এবং স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করার ক্ষমতার উপর জোর দেবে; যেমন প্রযুক্তি, সাইবারস্পেস এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে। তবে সেটা সম্ভব হবে যদি জার্মানি নিজেদের ডিজিটাল এবং ডাটা সক্ষমতাকে দ্রুত উন্নত করতে সক্ষম হয়। আর জলবায়ুভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব পেতে গেলে জার্মানিকে অভ্যন্তরীণ জলবায়ু লক্ষ্য ঠিক এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে তিন দলের কোয়ালিশনের মাঝে পার্থক্যগুলি লক্ষ্যনীয় এবং কিছু ক্ষেত্রে নীতি পরিষ্কার নয়; যেমন রাশিয়া এবং তুরস্কের ক্ষেত্রে নীতির স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে; প্রতিরক্ষানীতিও একেবারেই উচ্চাভিলাসী নয়। জিডিপির ৩ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করার কথা বলা হয়েছে; তবে কোন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই বাজেট ব্যবহৃত হবে, তা নিশ্চিত করে বলা হয়নি। আগামী বছর জার্মানি প্রথমবারের মতো তার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ করতে যাচ্ছে; যেখানে সরকার হয়তো বাধ্য হবে জার্মানির নিজস্ব স্বার্থগুলিকে উল্লেখ করতে। এর মাধ্যমে জার্মানি হয়তো অবশেষে একটা ‘স্বাভাবিক’ পররাষ্ট্রনীতির খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে।

ব্রাসেলসের ‘সেন্টার ফর রাশিয়া ইউরোপ এশিয়া স্টাডিজ’এর প্রতিষ্ঠাতা থেরেসা ফ্যালন সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, জার্মানি তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী চীনের ব্যাপারে যে আদর্শিক নীতিতে যেতে চলেছে, সেটা খুব সহজে বাস্তবায়নযোগ্য। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, এঙ্গেলা মার্কেলের সরকারও ক্ষমতা নেয়ার শুরুতে আদর্শিক কথা বলে তিব্বতের দালাই লামার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল; পরে বাস্তবতা মেনে নিয়ে চীনের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে নেয়ার নীতিতে এগিয়েছে। বিশ্লেষকেরা জার্মানির নতুন কোয়ালিশন সরকারের চীন নীতি নিয়ে আলোচনা করলেও জার্মানির সীমানাতেই যে বড় সমস্যা রয়েছে, তা নিয়ে খুব একটা কথা বলছেন না। ইইউএর মাঝে পোল্যান্ডের অবস্থান শক্তিশালী ইইউএর বিরুদ্ধে। কারণ শক্তিশালী ইইউএর মাঝে পোল্যান্ড শক্তিশালী জার্মানিকে দেখতে পাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইউরোপের লিবারাল আদর্শের দেশগুলির মাঝে এখনও অবিশ্বাস বিদ্যমান। ইইউএর ভঙ্গুর এই পরিস্থিতিতে নতুন জার্মান কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা কতটুকু হতে পারে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নয়।

Thursday 16 December 2021

ভারত কি ৫০ বছর আগে এই বাংলাদেশই চেয়েছিল?

১৬ই ডিসেম্বর ২০২১

১৬ই ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশের বিজয় দিবস প্যারেডে অংশ নিচ্ছে ভারতীয় সামরিক কনটিনজেন্ট। বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পেতে সহায়তা দেবার ৫০ বছর পর ভারত দেখতে পাচ্ছে যে, আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা নিঃসন্দেহে ভারতের প্রভাবকে প্রতিস্থাপন করছে। নিজের প্রভাব ধরে রাখতে দিল্লীকে হিসেব করতে হচ্ছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে বাস্তবতা মেনে নিয়ে তারা বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করবে, নাকি শত্রুতা সৃষ্টি করে নিজেদের দুর্বল ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে? এই উভয় সংকটই বলে দিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে সামনের দিনগুলিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

 
১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসের ৫০তম বার্ষিকীতে অতিথি হয়ে আসেন ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ। এর আগে একই বছরের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে এসেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের সামরিক কনটিনজেন্ট ভারতের সামরিক প্যারেডে অংশ নিয়েছে। আর ভারতের সামরিক কনটিনজেন্ট বাংলাদেশের বিজয় দিবস প্যারেডে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের কর্মকর্তারা বারংবার বলছেন যে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তথাপি দুই দেশের মাঝে ইস্যুগুলিকে নিয়ে আলোচনা করলে সম্পর্কের গভীরতার ক্ষেত্রে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। অর্থশতক আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারত সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। ভারত চেয়েছিল পাকিস্তানকে দুই ভাগ করে দুর্বল করতে এবং এর একাংশকে নিজের প্রভাবে নিয়ে আসতে। ৫০ বছর আগে ভারত যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছিল, সেই লক্ষ্য কি বাস্তবায়ন হয়েছে? ভারত কি আজ বাংলাদেশে তার স্বার্থগুলিকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে? বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে ভারতের বিবৃতির জবাবে বাংলাদেশ থেকে যখন বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ তার নাগরিকদের মাঝে কাউকে সংখ্যালঘু হিসেবে দেখে না, তখন দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, এই পার্থক্য দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে কতটা প্রভাব রাখবে?

সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি যখন দুই দেশের মাঝে দেয়াল গড়ছে

বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের অনুষ্ঠান দূর্গাপুজার পুজামন্ডপে হামলার পরদিন ১৪ই অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি সাংবাদিকদের বলেন যে, তারা বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হামলার খবর পেয়েছেন, যা তাদেরকে দুশ্চিন্তা দিয়েছে। একই দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিন্দুদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও প্রতিনিধিদের সাথে পুজার শুভেচ্ছা জানানোর অনুষ্ঠানে বলেন যে, ভারতকে সাবধান থাকতে হবে যে, সেখানেও যাতে এমন কোনকিছু যেন না করা হয়, যা বাংলাদেশের উপরেও প্রভাব ফেলে এবং বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আঘাত আসে। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ বলছে যে, শেখ হাসিনা এমন সময়ে কথাগুলি বলেছেন, যখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ্য বাংলাদেশে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে, ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতা নেবার পর থেকে ভারতের মুসলিমদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইন, যার মাধ্যমে আসামে অগুণিত বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমকে বেআইনী বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে এবং ‘আর্টিকেল ৩৭০’ পরিবর্তনের মাধ্যমে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিশেষ স্ট্যাটাস বাতিল করে সেখানে অন্য অঞ্চলের হিন্দুদের বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা বাংলাদেশে মুসলিম বিরোধী কর্মকান্ড বলে পরিচিতি পেয়েছে।

২০২০এর অগাস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবু ধাবিতে মধ্যপ্রাচ্যের ‘গালফ নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন যে, তিনি বুঝতে পারছেন না যে, ভারত কেন তাদের দেশে নাগরিকত্ব আইনের সূচনা করেছে। কারণ এটার কোন প্রয়োজন ছিল না। তিনি আরও বলেন যে, এই আইনের কারণে ভারতের জনগণ অনেক সমস্যায় পতিত হয়েছে। ভারতের ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ পত্রিকা বলছে যে, ভারতের নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশে যথেষ্ট অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে এই আইন পাসের পর থেকে তিনজন বাংলাদেশী মন্ত্রী তাদের ভারত সফর বাতিল করেছেন বলে পত্রিকাটা। প্রতিবেদনে পরিষ্কার করে বলা হয় যে, এই নাগরিকত্ব আইনের লক্ষ্য হলো ডিসেম্বর ২০১৪এর আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে অত্যাচারিত হয়ে বিতাড়িত হওয়া হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া। এই আইনে বাংলাদেশের নাম রাখার কারণে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতৃবৃন্দের বারংবার আসাম রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল ‘বেআইনী অভিবাসী’কে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলায় ২০১৯ সাল থেকে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। পত্রিকাটা আরও বলে যে, নাগরিকত্ব আইনের ব্যাপারটা শেখ হাসিনা প্রথমবার সেবছরের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে এবং দ্বিতীয়বার অক্টোবরে নতুন দিল্লীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে নিয়ে আসেন।

 
ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আসছে ভারতীয় পিঁয়াজ। ২০২০এর সেপ্টেম্বরে ভারত বাংলাদেশে পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে অনুরোধ জানানো হয়। ভারতের এহেন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে পিঁয়াজের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায় এবং সরকারকে বহু দেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি করে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হয়। ভারতে বিজেপির মতো একটা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের অবির্ভাব এমন সময়ে ঘটেছে, যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে অনেকগুলি অপশন হাজির হয়েছে; যা কিনা গত পাঁচ দশকে কখনোই আসেনি। সম্পর্কোন্নয়নের পাতলা চাদরের নিচে ঢাকা পড়ে রয়েছে গভীর সন্দেহ।

ভ্যাকসিন, পিঁয়াজ, পানি, সীমান্ত হত্যা… সমস্যা বিস্তর; কিন্তু সমাধান নেই

২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে আরেক টানাপোড়েন শুরু হয় দুই দেশের মাঝে। ভারতের ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘সেরাম ইন্সটিটিউট’এর প্রধান নির্বাহী আদার পুনাওয়ালা বলেন যে, ভারতের সকলে ভ্যাকসিন পাবার পরেই অন্যদের কাছে ভ্যাকসিন বিক্রি করা হবে। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই বক্তব্য বাংলাদেশে অস্থিরতার জন্ম দেয়; কারণ এর আগের বছরেই বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে অক্সফোর্ড এবং ‘এসট্রাজেনেকা’র ডেভেলপ করা ৩ কোটি ভ্যাকসিন কেনার জন্যে চুক্তি করে। অনেকেই সেসময় ভারতকে অনির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী বলে আখ্যা দিতে থাকে। পরবর্তীতে পুনাওয়ালা বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানি ব্যাহত হবে বলে ঘোষণা দিলেও ব্যাপারটা দুই দেশের সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এটাই ভারতের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রথম উদাহরণ নয়। ২০২০এর সেপ্টেম্বরে ভারত বাংলাদেশে পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে অনুরোধ জানানো হয়। ভারতের এহেন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে পিঁয়াজের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায় এবং সরকারকে বহু দেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি করে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হয়। ২০২০এর ডিসেম্বরে দুই দেশের মাঝে ভার্চুয়াল বৈঠকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং পরিবহণ করিডোর নিয়ে কথা হয়; কিন্তু তিস্তা নদীর পানি বন্টনের ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর সিনিয়র ফেলো জয়ীতা ভট্টাচার্য বলছেন যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পানি বন্টনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। তিস্তার পানির ব্যাপারে এই রাজ্য তাদের অবস্থান না পাল্টালে বাংলাদেশের সাথে পানি বন্টন করা কঠিন।

‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভারত যখন বাংলাদেশের সাথে তিস্তা সমস্যা সমাধান করতে পারছে না, তখন একই নদীতে ১ বিলিয়ন ডলারের সেচের প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে চীন। পানি সমস্যা ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলি করে মানুষ হত্যা করার ব্যাপারটাও বাংলাদেশের জনগণের কাছে অসহনীয় একটা ব্যাপার হিসেবে ঠেকছে। একই সময়ে চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্য বা ৮ হাজার ২’শ পণ্যের জন্যে চীনের বাজারে শুল্কমুক্তভাবে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের অনেকগুলি অবকাঠামো প্রকল্পে চীনারা বিনিয়োগ করেছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা উইলসন সেন্টার’এর বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন যে, নাগরিকত্ব আইনের কারণে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে চীনারা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জন্যে সুবিধা করে দিয়ে ঢাকার আরও কাছাকাছি যেতে চাইছে। পাকিস্তানও চাইছে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে। ২০২০এর জুলাই মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। ঘটনাটা ভারতকে বড় কোন দুশ্চিন্তায় না ফেললেও ভারতীয় মিডিয়াতে এর ফলাও করে প্রচার বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্ভাব্য সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে ভারতীয়তের অস্বস্তিকেই দেখিয়ে দেয়।

 
বাংলাদেশের সামরিক শক্তির উন্নয়নের ব্যাপারে ভারতীয়রা সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছে; যদিও বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ভারতের সামরিক শক্তির সাথে তুলনা করার পর্যায়ে নেই। ভারতে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, কেন বাংলাদেশের সাবমেরিন দরকার। ভারতে অনেকেই মনে করেছেন যে, বাংলাদেশের কাছে সাবমেরিন বিক্রির মাধ্যমে চীন ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলছে।

বাংলাদেশের অস্ত্র ক্রয়ে ভারত খুশি হতে পারে না কেন?

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক যতই মধুর বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের সামরিক শক্তির উন্নয়নের ব্যাপারে ভারতীয়রা সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছে; যদিও বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ভারতের সামরিক শক্তির সাথে তুলনা করার পর্যায়ে নেই। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীন থেকে ২টা সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়ার পর ভারতীয় চিন্তাবিদদের প্রতিক্রিয়া ছিল উল্লেখ করার মতো। ভারতের ‘ডব্লিউআইওএন’ টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশের কাছে সাবমেরিন বিক্রির মাধ্যমে চীন ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলছে; কারণ একইসাথে ভারতের পূর্বে পাকিস্তানে চীনের শক্ত অবস্থান রয়েছে। সেখানে বলা হয় যে, চীনারা এমন এক অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে, যেটা ভারত নিজের প্রভাবের অন্তর্গত বলে মনে করে। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক জয়দেব রানাদে বলছেন যে, সাবমেরিন হলো এমন একটা যুদ্ধাস্ত্র, যার মূল ব্যবহার হলো চুপিসারে হত্যা করা। এটা সাধারণতঃ জলদস্যু পাকরাও করতে বা উপকূল টহলে ব্যবহৃত হয় না। তিনি বলেন যে, ভারত সরকার এটাকে বিপদ হিসেবে না দেখলেও এটা একটা চিন্তার কারণ হবে অবশ্যই। কারণ বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার সাথেসাথে বঙ্গোপসাগরের নৌশক্তির ব্যালান্স পাল্টে গেছে; যদিও সাবমেরিনগুলি পুরোনো। তবে রানাদে মনে করেন না যে, যতক্ষণ ঢাকার সরকার ভারতের বন্ধু, ততক্ষণ ভারতের কোন দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।

ভারতে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, কেন বাংলাদেশের সাবমেরিন দরকার; যখন দেশটার সাথে ভারত এবং মিয়ানমার কোন দেশেরই সমুদ্রসীমার বিরোধ নেই। ভারতীয় মিডিয়া ‘ক্যাচ নিউজ’এর সাথে সাক্ষাতে বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন যে, বাংলাদেশ বিভিন্ন ছুতোতে সাবমেরিন কিনতে চাইতে পারে; আর চীনও কম দামে বিক্রয় করার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তার ধারণা ২০১৩ সাল থেকে যখন বাংলাদেশ সরকার সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা শুরু করে, তখন থেকেই ভারতীয় কর্মকর্তারা হয়তো বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তারা কেন সাবমেরিন কিনতে চাইছেন। তার ধারণা যদিও বাংলাদেশের হাতে সাবমেরিন ভারতের ইন্টেলিজেন্সের জন্যে একটা আলাদা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, তথাপি তিনি মনে করেন না যে, এটা ভারতের জন্যে হুমকি। তবে তিনি বলছেন যে, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব কমাতে অর্থনৈতিকভাবে চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় ভারত পারবে না। আর যেহেতু বহুকাল যাবত বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে ভারতকে শত্রু হিসেবে দেখা হয়েছে, তাই সামরিক দিক থেকেও ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে চীনকে প্রতিস্থাপন করা কঠিন।

ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল ভারতের ‘সংসদ টিভি’র সাথে সাক্ষাতে বলেন যে, বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনাটা ভারতের জন্যে নতুন এক চ্যালেঞ্জের শুরু। বাংলাদেশ যদি রাশিয়া থেকে সাবমেরিন ক্রয় করতো, তাহলে তা ভারতের জন্যে চিন্তার কারণ হতো না। তবে তিনি মনে করেন না যে, সাবমেরিনগুলি বাংলাদেশের কোন কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে। তিনি মনে করেন না যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভারতের সাথে মিল থাকবেই; তবে চিন্তার ব্যাপার হলো, যেখানে ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার একটা দেশ চীনের স্বার্থের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছে। এতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে আন্তর্জাতিক ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বিনা সিক্রি বলেন যে, বাংলাদেশ এবং ভারতের জনগণের মাঝে সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, তা চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তিনি মনে করছেন যে, ভারতের উচিৎ বাংলাদেশকে সরাসরিই বলা যে, বাংলাদেশের স্বার্থ হওয়া উচিৎ ভারতের পাশে থাকা; অন্য কোন দেশকে এখানে যুক্ত করে নতুন করে সমীকরণ তৈরি না করা। ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সোসাইটি ফর পলিসি স্টাডিজ’এর ডিরেক্টর প্রাক্তন নৌবাহিনী কমোডোর উদয় ভাস্কর বলেন যে, যে মুহুর্তে কাছাকাছি কোন সাবমেরিন থাকবে, সেই মুহুর্ত থেকে একটা নৌবাহিনীর কাজ হয় সেই সাবমেরিনের উপর তথ্য যোগাড় করা। সেই সাবমেরিন একটা বন্ধু বা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের হোক না কেন, সেটার উপর নজরদারি করাটা একটা দায়িত্ব।

 
মার্চ ২০২১। করোনা মহামারিতে মালদ্বীপকে সহায়তা দেয়ার জন্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল দল মালদ্বীপে। ভারতের কাছে না পেয়ে শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছ থেকে দুই’শ মিলিয়ন ডলারের মুদ্রা ঋণ পেয়েছে। এই কর্মকান্ডগুলি বাংলাদেশের জনগণের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষারই প্রতিফলন।

ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের আভাস


ভারতে বিজেপির মতো একটা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের অবির্ভাব এমন সময়ে ঘটেছে, যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে অনেকগুলি অপশন হাজির হয়েছে; যা কিনা গত পাঁচ দশকে কখনোই আসেনি। সম্পর্কোন্নয়নের পাতলা চাদরের নিচে ঢাকা পড়ে রয়েছে গভীর সন্দেহ। ভারতের কাছে না পেয়ে শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছ থেকে দুই’শ মিলিয়ন ডলারের মুদ্রা ঋণ পেয়েছে। আবার মালদ্বীপকে করোনা সহায়তা প্রদান করেছে বাংলাদেশ। এই কর্মকান্ডগুলি বাংলাদেশের জনগণের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষারই প্রতিফলন। হিমালয়ের পাদদেশে লাদাখে চীনের সাথে সামরিক উত্তেজনার মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান দেখে অবাক হয়েছে ভারত। বাংলাদেশ সেসময় শুধু ভারতের পাশে দাঁড়ানো থেকে বিরতই থাকেনি; চীনের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্কোন্নয়নও করেছে। একই সময়ে বাংলাদেশের অবস্থান নেপালকেও সুযোগ দিয়েছে ভারতের সাথে কালাপানি সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বে শক্ত অবস্থান নিতে। শুধু তাই নয়, পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে এমনভাবে, যাতে বাংলাদেশকে দোষারোপ করার কোন পদ্ধতিই ভারতের কাছে ছিল না। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে থাকার কথা বলে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে। এমনকি বাংলাদেশের সাবমেরিনকে ব্যালান্স করতে মিয়ানমারকে রুশ নির্মিত একটা পুরোনো সাবমেরিনও দিয়েছে। আবার মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজগুলির জন্যে সমুদ্রের গভীরে বাংলাদেশের সাবমেরিন খুঁজে পাবার সুবিধার্থে ভারতে নির্মিত সোনার যন্ত্রও বিক্রি করেছে। ভারত চেয়েছিল মিয়ানমারে তার প্রভাব বৃদ্ধির মাধ্যমে শুধু চীনকেই নয়, বাংলাদেশকেও ব্যালান্স করতে। তবে যে ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার তা হলো, ভারতের পক্ষে এখন বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পেতে সহায়তা দেবার ৫০ বছর পর ভারত দেখতে পাচ্ছে যে, আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা নিঃসন্দেহে ভারতের প্রভাবকে প্রতিস্থাপন করছে। এখানে পাকিস্তানের ভূমিকা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানের প্রভাব কমাতে গিয়েই ভারত বাংলাদেশের প্রভাবকে মেনে নিতে বাধ্য হবে। এমতাবস্থায় নিজের প্রভাব ধরে রাখতে দিল্লীকে হিসেব করতে হচ্ছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে বাস্তবতা মেনে নিয়ে তারা বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করবে, নাকি শত্রুতা সৃষ্টি করে নিজেদের দুর্বল ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে? এই উভয় সংকটই বলে দিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে সামনের দিনগুলিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

Wednesday 15 December 2021

আমিরাত ‘এফ ৩৫’ যুদ্ধবিমান ত্যাগ করতে রাজি; তবে চীনকে নয়

১৫ই ডিসেম্বর ২০২১

আমরাত মার্কিন ‘এফ ৩৫’ বিমান তারা ত্যাগ করতে রাজি থাকলেও চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে তারা ত্যাগ করতে রাজি নয়। মার্কিন কর্মকর্তারা যখন তাদের বন্ধু দেশগুলির উপর চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিতে চাপ দিচ্ছেন, তখন আমিরাতের অবস্থান দেখিয়ে দেয় যে, কেউই তাদের ডিমগুলি আজ এক ঝুড়িতে রাখতে রাজি নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ঝুড়িটা এখন আগের মতো নিরাপদ নয়।

 
১৪ই ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা দেয় যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ২৩ বিলিয়ন ডলারের একটা সামরিক ক্রয় যুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে; যার মাঝে ছিল ‘এফ ৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান। একজন আমিরাতি কর্মকর্তা ‘সিএনএন’কে জানান যে, ‘প্রাযুক্তিক প্রয়োজন’, ‘সার্বভৌম অপারেশনাল সীমাবদ্ধতা’ এবং ‘লাভ খরচার বিশ্লেষণ’এর পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন যে, ক্রয় চুক্তি বাস্তবায়নে একে অপরের প্রতিরক্ষার নিরাপত্তাজনিত অবস্থানগুলির ব্যাপারে একটা সমঝোতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল আমিরাত এবং যুক্তরাষ্ট্র। তবে উন্নততর প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনও আমিরাতের পছন্দের সরবরাহকারী এবং ভবিষ্যতে হয়তো ‘এফ ৩৫’এর ব্যাপারে আলোচনা পুনরায় শুরু করা যেতে পারে। একইদিনে পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কার্বি সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং আমিরাতের সম্পর্ক কৌশলগত এবং একটা সামরিক চুক্তির চাইতে অনেক বেশি জটিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের শর্ত বাস্তবায়নে চাপ দেবেই। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এই শর্তগুলি শুধু আমিরাতের জন্যে নয়, বরং সকল দেশের জন্যেই প্রযোজ্য; কারণ এগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তিকে রক্ষা করার জন্যেই প্রয়োগ করা হয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, এগুলি আলোচনার উর্ধ্বে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের নতুন ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র মাঝে পড়তে চায়না আমিরাত

‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২০ সালের অগাস্টে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সমঝোতার মূল স্তম্ভই ছিল আমিরাতের কাছে ‘এফ ৩৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রয়। এটা ছিল আরব দেশগুলির কাছে বিক্রয়কৃত অস্ত্রের মাঝে সবচাইতে উন্নত প্রযুক্তি। তখন থেকেই মার্কিন রাজনীতিবিদদের অনেকেই এই চুক্তির ব্যাপারে নিজেদের সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও আমিরাতের কাছে ‘এফ ৩৫’ যুদ্ধবিমান, ‘এমকিউ ৯বি’ ড্রোন এবং গোলাবারুদ বিক্রয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন যাবতই চীনা টেলিকম কোম্পানি ‘হুয়াই’কে আমিরাতের টেলিকম নেটওয়ার্ক থেকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে আমিরাতের উপর চাপ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, চীনা প্রযুক্তি মার্কিন অস্ত্র ব্যবস্থাগুলির জন্যে হুমকি। আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন উপসহকারি পররাষ্ট্র সচিব মিরা রেজনিক ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, ‘এফ ৩৫’ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের সামরিক প্রযুক্তির মাঝে মুকুটের মণির মতো; এটাকে তারা রক্ষা করবেনই। তবে আমিরাতের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সংশয়ের ব্যাপারে সন্দিহান। আমিরাতের নেতৃত্বের উপদেষ্টা আনওয়ার গারগাশ বলছেন যে, তাদের কাছে সংশয় হলো আরেকটা ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’এর মাঝে আটকে যাওয়া; যেখানে চীন হলো আমিরাতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী, আর যুক্তরাষ্ট্র হলো কৌশলগত সহযোগী। তিনি বলছেন যে, একটা ছোট দেশ হিসেবে তারা বড় দুই দেশের প্রতিযোগিতার কারণে সমস্যায় পড়বেন; কিন্তু তারা এই প্রতিযোগিতাকে কমাতে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারবেন না।

 
ইস্রাইলি প্রধানমন্ত্রী সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাবার ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যেমন চিন্তার মাঝে পড়েছিল, সেটা আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাবার সাথেসাথে। একারণেই আমিরাত চাইছে ইরান এবং তুরস্কের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা কমাতে এবং ইস্রাইলের কাছাকাছি যেতে।

নভেম্বর মাসে ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আবু ধাবির ৮০ কিঃমিঃ দূরে ‘খলিফা পোর্ট’এ চীনারা একটা বহুতল ভবন নির্মাণের জন্যে বড় একটা গর্ত করেছে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা বলছেন যে, এই কর্মকান্ডের কোন সামরিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মার্কিনীরা হুমকি দেয় যে, সেখানে কোন চীনা সামরিক উপস্থিতি দুই দেশের সম্পর্ককে সমস্যায় ফেলবে। একারণেই মার্কিন কর্মকর্তারা চীনাদের এই কর্মকান্ড বন্ধ করতে আমিরাতের উপর চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে। ৯ই ডিসেম্বর আনওয়ার গারগাশ ওয়াশিংটনের ‘এরাব গালফ স্টেটস ইন্সটিটিউট’কে বলেন যে, আমিরাত চীনাদের এই কর্মকান্ড বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। তবে এব্যাপারে আমিরাতের অবস্থান হলো, এটা কোন সামরিক স্থাপনা নয়। তিনি আরও বলেন যে, বাইডেন প্রশাসনের জন্যে তার বন্ধুদের সংশয়ের কথা শোনার পরেও একেবারেই আমলে না নেয়াটা বোকামি। মার্কিন প্রেসিডেণ্ট জো বাইডেন আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে সাক্ষাতে আমিরাতে চীনা অবস্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সংশয় প্রকাশ করলে বিন জায়েদ বলেন যে, তিনি বাইডেনের কথাগুলি পুরোপুরিভাবেই শুনতে পেয়েছেন। ‘মিডলইস্ট আই’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৬ থেকে ২০২০এর মাঝে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সরবরাহ ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে একইসাথে ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ চিন্তার অংশ হিসেবে চীনারা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন কাজে অংশ নিচ্ছে।

মার্কিনীদের প্রস্থান এবং আমিরাতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা চিন্তায় পরিবর্তন

বিশ্বব্যাপী সামরিক অবস্থান কমিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করার অংশ হিসেবে গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, তারা ইরাক, কুয়েত, জর্দান এবং সৌদি আরব থেকে ৮টা ‘প্যাট্রিয়ট’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা এবং সৌদি আরব থেকে আরেকটা অত্যাধুনিক ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নিচ্ছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে আরও ৩টা ‘প্যাট্রিয়ট’ ব্যাটারি সরিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তগুলি মধ্যপ্রাচ্যে তার উপর নির্ভরশীল দেশগুলিকে চিন্তায় ফেলেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব কমার সাথেসাথে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলি নতুন বন্ধু খুঁজছে।

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আমিরাত বর্তমানে পুরোনো বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র, নতুন বন্ধু ইস্রাইল এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের মাঝে ব্যালান্স করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আনওয়ার গারগাশ বলছেন যে, ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়াও আমিরাত আঞ্চলিকভাবে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্যে ইরান, তুরস্ক এবং সিরিয়াকে সাথে চাইছে। যুবরাজ বিন জায়েদের ভাই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শেখ তাহনুন বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ডিসেম্বরের শুরুতেই ইরান সফর করেছেন। নভেম্বরের শেষে যুবরাজ বিন জায়েদ তুরস্ক সফর করে এসেছেন। আর ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটও আমিরাত সফর করছেন। ইরান তার বাণিজ্যের একটা বড় অংশ আমিরাতের মাধ্যমে করে থাকে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০১৯ সালে আমিরাত থেকে ইরানে রপ্তানি অনেক কমে গেলেও ৭ বিলিয়ন ডলার ছিল। ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে দুবাইএর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর গাওদাত বাহগাত ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’কে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাবার ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যেমন চিন্তার মাঝে পড়েছিল, সেটা আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাবার সাথেসাথে। একারণেই আমিরাত চাইছে ইরান এবং তুরস্কের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা কমাতে এবং ইস্রাইলের কাছাকাছি যেতে।

 
ফ্রান্স থেকে কেনা কাতারি বিমান বাহিনীর 'রাফাল' যুদ্ধবিমান। আমিরাত তার নির্ভরশীলতাগুলিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে; এক ঝুড়িতে সবগুলি ডিম না রাখার নীতি নিয়ে এগুচ্ছে তারা। ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারটা এই কৌশলেরই অংশ। নিশ্চিতভাবেই ফ্রান্সের চাইতে চীনের ব্যাপারে বেশি আপত্তি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

ফ্রান্স থেকে ‘রাফাল’ বিমান ক্রয়… ‘এফ ৩৫’এর প্রতিস্থাপন?

২রা ডিসেম্বর আমিরাৎ ফ্রান্সের কাছ থেকে ৮০টা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের জন্যে ১৯ বিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি করে। আমিরাতি সামরিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’ বলছে যে, এই চুক্তি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমিরাত চীনের সাথে ‘ফাইভ জি’ প্রযুক্তির টেলিকম চুক্তি বাতিল করবে না, যখন যুক্তরাষ্ট্র আমিরাতের কাছে ‘এফ ৩৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। ‘রাফাল’ বিমানে মার্কিন অস্ত্র বহণের ব্যবস্থা রাখা এবং বিমানের উন্নয়ন চালিয়ে নিতে পারার ব্যাপারে আমিরাতের শর্ত না মানার কারণে ২০১১ সালে ফ্রান্সের সাথে আমিরাত আলোচনা বাতিল করেছিল। কুয়েতি সামরিক বিশ্লেষক আলি আল হাশিম বলছেন যে, আমিরাত এখন প্রথমে ফ্রান্সের কাছ থেকে যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে। তবে এতকাল ফ্রান্সের সাথে আলোচনার পর এতগুলি বিমানের ব্যাপারে চুক্তি হঠাৎ করেই আসেনি বলে বলছেন সামরিক বিশ্লেষক ব্রেনডন প্যাট্রিক। এই ‘রাফাল’গুলি সম্ভবতঃ আমিরাতের ৮০টা মার্কিন নির্মিত ‘এফ ১৬’ বিমান এবং ৫৩টা ফরাসি নির্মিত ‘মিরাজ ২০০০’ বিমানকে প্রতিস্থাপিত করবে। এর ফলে আমিরাতের বিমান বাহিনী মার্কিন নির্মিত বিমানের চাইতে ফরাসি বিমানের উপর বেশি নির্ভরশীল হবে। তবে গাওদাত বাহগাত মনে করছেন না যে, আমিরাত ‘এফ ৩৫’এর চিন্তা একেবারেই বাদ দিয়ে দিয়েছে। তার কথায়, আমিরাত তার নির্ভরশীলতাগুলিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে; এক ঝুড়িতে সবগুলি ডিম না রাখার নীতি নিয়ে এগুচ্ছে তারা। ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারটা এই কৌশলেরই অংশ। তিনি বলেন যে, নিশ্চিতভাবেই ফ্রান্সের চাইতে চীনের ব্যাপারে বেশি আপত্তি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। আমিরাতের বার্তা সংস্থা ‘ওয়াম’কে আমিরাতের বিমান বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল ইব্রাহিম নাসের আল আলাউই বলছেন যে, ফ্রান্সের সাথে চুক্তি ‘এফ ৩৫’এর প্রতিস্থাপন হিসেবে নয়। বরং এটা হলো বিমান বাহিনীতে নতুন সক্ষমতা যুক্ত করা। এই কথাগুলির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলিরও মিল পাওয়া যায়। মিশর তাদের বিমান বাহিনীর মূল শক্তি মার্কিন বিমানের উপরে নির্ভরশীল হলেও তারা আগে কেনা ২৪টা ‘রাফাল’এর সাথে আরও ৩০টা যোগ করছে। কাতারও ৩৬টা মার্কিন ‘এফ ১৫কিউএ’ বিমানের সাথেসাথে ২৪টা ব্রিটিশ নির্মিত ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ এবং ৩৬টা ফরাসি ‘রাফাল’ও কিনছে।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর এসোসিয়েট ফেলো নেইল কুইলিয়াম ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, ইরানের বৈরিতাকে ব্যালান্স করতে আমিরাত সকল চেষ্টাই করবে; তবে এখানে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রই আমিরাতের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। যে ব্যাপারটাতে সকলেই একমত তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনতে চাওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল দেশগুলির মাঝে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে; যা তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা চিন্তায় পরিবর্তন এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশগুলির সম্পর্ক এখনও সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের উপর কেউই এখন আগের মতো নির্ভর করতে পারছে না; বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার পর। এই নতুন আঞ্চলিক নীতির অংশ হিসেবেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে। এর ফলাফলস্বরূপ, আমিরাতের মতো দেশগুলির উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দিনে দিনে কমছে। একারণেই মার্কিন ‘এফ ৩৫’ বিমান তারা ত্যাগ করতে রাজি থাকলেও চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে তারা ত্যাগ করতে রাজি নয়। মার্কিন কর্মকর্তারা যখন তাদের বন্ধু দেশগুলির উপর চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিতে চাপ দিচ্ছেন, তখন আমিরাতের অবস্থান দেখিয়ে দেয় যে, কেউই তাদের ডিমগুলি আজ এক ঝুড়িতে রাখতে রাজি নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ঝুড়িটা এখন আগের মতো নিরাপদ নয়।

Monday 13 December 2021

বাইডেনের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে রয়েছে

১৩ই ডিসেম্বর ২০২১

প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, নিজ দেশে গণতান্ত্রিক সমস্যার মাঝে বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা। পশ্চিমা দেশগুলিতেই যখন গণতন্ত্র মুমুর্ষু, তখন বাকি দুনিয়াতে গণতন্ত্রের তল্পিবাহক হবার মতো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন পশ্চিমা রাষ্ট্রের রয়েছে কি? গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার মতো শক্তি বাইডেনের কতটুকু রয়েছে? উত্তরটা যথেষ্টই কঠিন। কারণ গণতন্ত্রকে ‘লাইফ সাপোর্ট’এ রাখা হয়েছে; অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

 
গত ৯ এবং ১০ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে ‘সামিট ফর ডেমোক্র্যাসি’ বা ‘গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। এই অনুষ্ঠানের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে যেমন ব্যাপক আলোচনা চলছে, তেমনি এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য নিয়েও উত্তপ্ত বাক্য আদান প্রদান হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কথায়, গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠকের লক্ষ্য ছিল এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দেয়া, যেখানে নেতৃবৃন্দ নিজেদের একার এবং যৌথ অঙ্গীকার, সংস্কার, এবং নতুন কোনকিছু আরম্ভ করার ঘোষণা দেবে, যেগুলির মূল লক্ষ্য হবে নিজেদের দেশে এবং বিদেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে রক্ষা করা। এছাড়াও আরও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে যে, এই ফোরামের মাধ্যমে সাহসী এবং নতুন চিন্তা, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং মানবাধিকারকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। তবে সমস্যা হলো, বাইডেন প্রশাসন এই বৈঠকে ডেকেছেন এমন সকল ব্যক্তিদের, যাদের নিজেদের শাসন নিয়েই ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে।

‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় সাংবাদিক এবং লেখক দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বাউসুনারুকে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোটা ছিল কৌতুককর। তিনি বলেন যে, আফগানিস্তানকে তালিবানদের হাতে তুলে দিয়ে এবং সৌদি আরবের কাছে ৬’শ ৫০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো মনে করছিলেন যে, স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের বিরুদ্ধে মারাত্মক পদক্ষেপ নেয়া এই ব্যক্তিগুলিকে ডেকে এনে গণতন্ত্র রক্ষায় তাদেরই মতো লোকগুলিকে কিভাবে প্রতিহত করা যায়, সেব্যাপারে দুই দিনের একটা ভার্চুয়াল বৈঠক করাটা ভালো একটা চিন্তা হতে পারে। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আমন্ত্রিত ১’শ ১০টা দেশের মাঝে ৩০ শতাংশের বেশি দেশ মার্কিন সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’এর হিসেবে জনগণকে আংশিক স্বাধীনতা দেয়; আর তিনটা দেশ জনগণকে কোনরূপ স্বাধীনতাই দেয় না; যেগুলি হলো, এঙ্গোলা, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এবং ইরাক। তালিকার এক ডজনেরও বেশি দেশকে সুইডেনের ‘ভি ডেম ইন্সটিটিউট’ নামক সংস্থা ‘নির্বাচনী একনায়কতন্ত্র’ বলে আখ্যা দেয়; যার মাঝে রয়েছে ভারত, ফিলিপাইন এবং কেনিয়া। চৌধুরীর কথায়, তালিকায় থাকা দেশগুলিই শুধু নয়, তালিকায় না থাকা দেশগুলিও তাকে অবাক করেছে। যেমন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি; যদিও একই রকমের কর্মকান্ড করার পরেও মোদি, দুতার্তে এবং বাউসুনারুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আবার পাকিস্তানকে কি কারণে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, সেটাও অজানা; তবে পাকিস্তান এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাইডেনের লজ্জাকে লাঘব করে। মার্কিন বন্ধু দেশ একদলীয় শাসনের অধীনে থাকা সিঙ্গাপুরকেও ডাকা হয়নি।

৯ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘ইসলামাবাদ কনক্লেভ ২০২১’ অনুষ্ঠানে এক বক্তব্যে বলেন যে, পাকিস্তান কোন রাজনৈতিক জোটে যোগ দিতে চায় না; বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে দূরত্ব কমাতে চেষ্টা করতে চায়। ইমরান খান আরও বলেন যে, পাকিস্তানের উচিৎ হবে এধরনের জোট তৈরি বন্ধ করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো; কারণ কারুরই উচিৎ নয় কোন জোটে যোগ দেয়া। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে ঠান্ডা যুদ্ধ সারা বিশ্বের জন্যে দুর্যোগ নিয়ে এসেছিল। এবং একারণেই পাকিস্তান চাইছে না আরেকটা নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে আটকা পড়তে। পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা বলছে যে, ইমরান খানের এই কথাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠকে পাকিস্তানের যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পরের দিনই এসেছে। এই বৈঠকে চীনের প্রতিনিধিত্ব করতে বেইজিং থেকে কাউকে না ডেকে তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়; যা পাকিস্তানকে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। এই মুহুর্তে চীন হলো পাকিস্তানের সবচাইতে কাছের বন্ধু; আর রাশিয়ার সাথেও পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়ন হচ্ছে।

 
বাইডেন যে ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছেন তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বন্ধুগুলির মাঝেই রয়েছে মোদির ভারত; যেখানে মানুষের উপাসনা করার অধিকার নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এই কর্মকান্ডগুলিকে মেনে নিচ্ছে, কারণ চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত হলো মার্কিনীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। এখানে ভূরাজনীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলছেন যে, বাইডেনের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের ব্যাপারেই ছিল না। এটা ছিল চীন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন একটা জোট তৈরির চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া মিলে যেমন ‘কোয়াড’ জোট গঠন করা হয়েছে চীনকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে, ঠিক তেমনি গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক ছিল ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেল’ বা বিশাল পরিসরে আরেকটা ‘কোয়াড’ গঠন করা। বাইডেন বলছেন যে, গণতন্ত্র হেরে যাচ্ছে চীন এবং রাশিয়ার জন্যে। কিন্তু তিনি যে ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছেন তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বন্ধুগুলির মাঝেই রয়েছে মোদির ভারত; যেখানে মানুষের উপাসনা করার অধিকার নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এই কর্মকান্ডগুলিকে মেনে নিচ্ছে, কারণ চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত হলো মার্কিনীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। এখানে ভূরাজনীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

৪ঠা ডিসেম্বর চীনের ‘স্টেট কাউন্সিল’এর তথ্য দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে বলা হয় যে, চীন একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে তাদের গণতন্ত্র কাজ করছে; অর্থাৎ তা পশ্চিমা গণতন্ত্রের মতো অকার্যকর অবস্থায় নেই। মার্টিন গিলেনস এবং বেঞ্জামিন পেইজের দুই দশকের ১৮’শ মার্কিন আইনের উপর করা এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, সাধারণ জনগণের আইনের ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই। শুধুমাত্র স্বল্প সংখ্যক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং সম্পদশালী ব্যক্তির দ্বারাই এই আইনগুলি তৈরি হয়েছে। অপরদিকে গত অক্টোবরে ‘পিউ রিসার্চ’এর প্রকাশ করা এক গবেষণায় বলা হয় যে, অর্ধেকের বেশি মার্কিনী গণতন্ত্রের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট। আর ৮৫ শতাংশ জনগণ তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুরোপুরি বা বড় রকমের পরিবর্তন চাইছে। ৬৬ শতাংশ জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছে; আর ৭৬ শতাংশ মানুষ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিবর্তন চায়। শুধু মার্কিনীরাই নয়; একই গবেষণার অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ফলাফলও প্রায় একই। ইতালি, স্পেন, গ্রিস, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের ফলাফলগুলিও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীনতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে ইতালি এবং স্পেনে যথাক্রমে ৮৯ শতাংশ এবং ৮৬ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুরোপুরি বা বড় রকমের পরিবর্তন চাইছে।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, নিজ দেশে গণতান্ত্রিক সমস্যার মাঝে বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা। সন্মেলনে কারা যোগদান করবে, সেই হিসেব করতে গিয়ে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। তুরস্ক এবং হাঙ্গেরিকে বাদ দিয়ে নাইজেরিয়া এবং ফিলিপাইনকে আমন্ত্রণ জানানোর সমালোচনা করা হয় প্রতিবেদনে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক পশ্চিমা চিন্তাবিদদের যেমন অস্বস্তির মাঝে ফেলেছে, তেমনি পশ্চিমা মিডিয়াগুলিকেও ফেলেছে ধোঁয়াশার মাঝে। অপরদিকে চীনা শ্বেতপত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জনগণের তৈরি আইনের সংজ্ঞা হিসেবে চীনারাও গণতান্ত্রিক দেশ। আর সেক্ষেত্রে জনগণের মাঝে কতজন মানুষ সেই আইন তৈরি করতে পারবে, সেব্যাপারে পশ্চিমারা চীনাদের থেকে খুব একটা এগিয়ে নেই মোটেই। প্রশ্নটা শুধু পশ্চিমা গণতন্ত্র বা চীনা গণতন্ত্রকে নিয়ে নয়; বরং খোদ গণতন্ত্রকে নিয়েই। দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলছেন যে, গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেই বিশ্বব্যাপী জনগণ এমন কিছু রাজনীতিবিদের কথায় সায় দিচ্ছে, যারা গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আরও বেশি দুর্বল করে ফেলছে। ‘ফ্রিডম হাউস’এর হিসেবে গত ১৫ বছরের মাঝে বর্তমানে সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশে জনগণের স্বাধীনতা পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রিত। আর ‘পিউ রিসার্চ’এর গবেষণা দেখিয়ে দিচ্ছে গণতান্ত্রিকতার উপর পশ্চিমা দেশগুলির জনগণের আস্থাহীনতাকে। পশ্চিমা দেশগুলিতেই যখন গণতন্ত্র মুমুর্ষু, তখন বাকি দুনিয়াতে গণতন্ত্রের তল্পিবাহক হবার মতো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন পশ্চিমা রাষ্ট্রের রয়েছে কি? গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার মতো শক্তি বাইডেনের কতটুকু রয়েছে? উত্তরটা যথেষ্টই কঠিন। কারণ গণতন্ত্রকে ‘লাইফ সাপোর্ট’এ রাখা হয়েছে; অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

Friday 10 December 2021

বাইডেন এবং পুতিনের বৈঠক … ছাড় দেয়ার প্রবণতা নেই কেন?

১১ই ডিসেম্বর ২০২১

পুতিন বাইডেনকে আলোচনায় বসিয়ে রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছেন। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন রাশিয়াকে আরেকটা সমমানের শক্তি হিসেবে দেখতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। অন্ততঃ একসাথে দু’টা শক্তির বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে যে চ্যালেঞ্জিং হবে, সেব্যাপারে কারুরই সন্দেহ নেই।

গত ৭ই ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার উপর এমন সকল অর্থনৈতিক অবরোধ আসবে, যা কিনা ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পরও রাশিয়ার উপর আরোপ করা হয়নি। দুই ঘন্টার রূদ্ধদ্বার এই বৈঠকের পর হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে বৈঠকের আলোচ্য বিষয়াবলির উল্লেখ করা হয়। বাইডেন একইসাথে বলেন যে, রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির জন্যে যে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন তৈরি করেছে, সেটা চালু করার আশাও পুতিন ছেড়ে দিতে পারেন, যদি তিনি ইউক্রেন আক্রমণে এগিয়ে যান। অপরদিকে ক্রেমলিন থেকে বলা হচ্ছে যে, পুতিন বাইডেনকে বলেন যে, পূর্ব ইউরোপ এবং বিশেষ করে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের সামরিক অবস্থান রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মাঝে ফেলেছে; যেটাকে তারা ‘লাল দাগ’ হিসেবে বলছেন। তবে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এটা এখনই বলা যাচ্ছে না যে, এই বৈঠক ইউক্রেনের উত্তেজনা প্রশমণে কতটা ভূমিকা রাখবে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, পুতিন তার উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার করেননি। যেকারণে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না যে, রাশিয়া কি আসলেই আগামী বছরের শুরুতে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসবে, নাকি পশ্চিমাদের কাছ থেকে নিজেদের দাবিগুলি আদায়ের লক্ষ্যেই রাশিয়া একটা সমস্যা তৈরি করেছে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা বলছেন যে, বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের সীমানায় প্রায় ৭০ হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছে; যা সামনের দিনগুলিতে ১ লক্ষ ৭৫ হাজারে উঠতে পারে।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ার উপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার চাপে রাশিয়া ক্রিমিয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, এবারে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অবরোধের কথা চিন্তা করছে, তার মাঝে রয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে রুশ কোম্পানিগুলির জন্যে পুঁজি যোগাড় করা কঠিন করে ফেলা; এবং রুশ রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া। আরও কঠিন শাস্তি হিসেবে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে বের করে দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে। তবে ইউরোপিয়রা এই শাস্তির ব্যাপারে একমত নন; তারা বলছেন যে, এটা করা হলে রাশিয়ার প্রত্যুত্তরও যথেষ্ট কঠিন হতে পারে।

মার্কিনীরা বলছে যে, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ার সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে আড়াই বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এর মাঝে রয়েছে আকাশ নিরাপত্তার রাডার, কাউন্টার আর্টিলারি রাডার, ড্রোন, যোগাযোগ ব্যবস্থার যন্ত্রপাতি, নৌবাহিনীর জন্যে প্যাট্রোল বোট, এবং ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। তবে ইউক্রেনে মার্কিন সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে কোন আলোচনা নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ইউক্রেনকে রক্ষা করতে না পারলে তা রাশিয়ার সামনে পশ্চিমা দুর্বলতাকেই তুলে ধরবে বলে অনেকেই মনে করবে; বিশেষ করে চীন এই ধারণা পোষণ করবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সিনেটের সামনে বলেন যে, রাশিয়া ক্ষেপে যেতে পারে মনে করে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া অনেক অস্ত্রই স্টোর করে রেখেছে। তবে চাপের মুখে পড়লে ইউক্রেন হয়তো তাদের ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কাজে লাগাতে পারে।

৭ই ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক ফোরামে বলেন যে, রাশিয়ার সাথে সমস্যাটা আসলে ইউক্রেনের চাইতেও বড়। আন্তর্জাতিক সীমানাকে যে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যাবে না, এব্যাপারে দুনিয়ার নিয়মকানুনকে রক্ষা করার ব্যাপারটা এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’এর ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস একই ফোরামে বলেন যে, আগামী কয়েক মাসের মাঝে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সীমানায় জলা জায়গাগুলি জমে বরফ হলে গেলেই পুতিন হয়তো তার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পুতিন মনে করছেন যে, জার্মানি চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের রিটায়ারমেন্টের পর কিছুটা বিক্ষিপ্ত রয়েছে। আর ফ্রান্সও আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। আর গত দুই বছরের তুলনায় রাশিয়ার বর্তমান অর্থনীতি বেশ ভালো; বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি রাশিয়াকে একটা সুযোগ দিচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ বাইডেনের অবরোধের হুমকিকে উড়িয়ে দিয়েই বলেন যে, রাশিয়ার জন্যে অবরোধ নতুন কিছু নয়। তিনি আরও বলেন যে, রুশ সেনারা রুশ ভূমিতেই রয়েছে; তারা কারুর জন্যেই হুমকি নয়।

‘এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যদিও অনেকেইর ধারণা পুতিন রাশিয়ার কূটনৈতিক ক্ষতি করে ইউক্রেন আক্রমণ করবেন না; তথাপি ওয়াশিংটনে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে, এবার পুতিন হয়তো ধোঁকা দিচ্ছেন না। ‘কার্নেগি মস্কো সেন্টার’এর তাতিয়ানা স্তানোভায়া মনে করছেন যে, পুতিন পুরো হিসেবই পাল্টে দিয়েছেন। কাজেই এবার হয়তো রাশিয়া এখন মরিয়া কোন পদক্ষেপই নেবে। অপরদিকে বাইডেন যখন বলেছেন যে, তিনি কারুর ‘লাল দাগ’ মানবেন না, তখন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ব্লিনকেনকে বলছেন যে, রাশিয়া ন্যাটোর কাছ থেকে নিশ্চয়তা চাইছে যে, ন্যাটো রাশিয়ার সীমানার আরও বেশি কাছে আসার চেষ্টা করবে না। স্তানোভায়া মনে করছেন যে, পুতিন হয়তো বলতে চাইছেন যে, ন্যাটো তাকে এই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দিলে তিনি ইউক্রেনে হামলা করবেন। তবে ইউক্রেনকে যে ন্যাটোর ভেতর ঢোকানো হচ্ছে না, সেব্যাপারে পশ্চিমারা একমত। আর ইউক্রেনকে রক্ষায় মার্কিন সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটাও মার্কিন কর্মকর্তারা নাকচ করে দিয়েছেন। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিয়ে রাশিয়াকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে? নাকি ইউক্রেনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে দেশটার উপর রাশিয়ার আক্রমণকে বৈধতা দেবে? মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এখনও নিশ্চিত নয় যে, পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করবেন কিনা। কিন্তু যেব্যাপারে সকলেই একমত তা হলো, পুতিন বাইডেনকে আলোচনায় বসিয়ে রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছেন। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন রাশিয়াকে আরেকটা সমমানের শক্তি হিসেবে দেখতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। অন্ততঃ একসাথে দু’টা শক্তির বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে যে চ্যালেঞ্জিং হবে, সেব্যাপারে কারুরই সন্দেহ নেই।

Thursday 9 December 2021

চীনা অর্থনীতির গতি কি মন্থর হয়ে আসছে?

০৯ই ডিসেম্বর ২০২১

চীনের 'এভারগ্র্যান্ড' কোম্পানির দৈত্যাকৃতির রিয়েল এস্টেট প্রকল্প। চীনা অর্থনীতি পুঁজিবাদের সমস্যাগুলি থেকে মুক্ত নয়। লাগামহীন ঋণের উপর নির্ভরশীল হবার কারণেই চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টর সমস্যায় পতিত; যা পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে অনুসরণ করারই ফলাফলস্বরূপ।

 
গত ৬ই ডিসেম্বর চীনা সরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চাইনিজ একাডেমি অব সোশাল সায়েন্সেস’ বা ‘সিএএসএস’এর এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২২ সালে চীনের আর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে কোভিড দুর্যোগের পর ২০২১ সালে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দেশটার। এর ফলে ২০২০ থেকে ২০২২এর মাঝে গড় প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ। তবে ‘সিএএসএস’ বলছে যে, আগামী বছর চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টরের সমস্যাগুলি চলমান থাকবে এবং তা প্রাদেশিক সরকারগুলির বাজেটকে প্রভাবিত করবে। রিয়েল এস্টেট সমস্যা, স্থবির রপ্তানি এবং করোনাভাইরাসের কারণে কড়াকড়ি আরোপে জনগণের খরচ করার প্রবৃত্তি কমে যাওয়ায় ‘সিএএসএস’ চীনা সরকারকে ২০২২ সালের প্রবৃদ্ধির টার্গেট ২০২১ সালের চাইতে কম রাখতে পরামর্শ দিয়েছে। একইসাথে তারা সরকারকে রিয়েল এস্টেট বাজারকে বাঁচাতে হস্তক্ষেপ করতে উপদেশ দেয়। তাদের কথায়, বড় শহরগুলিতে ভূমির নিলাম বাজারে বিপর্জয় এবং ছোট শহরগুলিতে রিয়েল এস্টেটের মূল্য দ্রুত কমে যাওয়া থামাতে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনের বিশাল রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ‘এভারগ্র্যান্ড’ ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে না পারার কারণে চীন সরকার রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলির জন্যে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন করে ফেলেছে। এর ফলে রিয়েল এস্টেট সেক্টর অর্থায়ন পেতে হিমসিম খাচ্ছে। এতে ব্যাংকিং সেক্টরও সমস্যায় পতিত হয়েছে। এছাড়াও মারাত্মক জ্বালানি সমস্যায় পতিত হয়েছে চীন।

নানামুখী চ্যালেঞ্জে চীনা অর্থনীতি

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে চীনের জ্বালানি সমস্যাকে ব্যাখ্যা করা হয়। ২০৬০ সালের মাঝে চীন সরকার গ্রীন হাউজ গ্যাসের নির্গমণ শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে চীনা সরকার তাদের প্রাদেশিক সরকারগুলির উপর পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে চাপ প্রদান করা শুরু করে। একারণে অনেক অঞ্চলেই বিদ্যুতের ব্যবহারকে র‍্যাশনিং ব্যবস্থার অধীনে আনা হয়। এতে বহু বাড়িঘর অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়া ছাড়াও সিমেন্ট, স্টিল এবং এলুমিনিয়াম শিল্পের মতো বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করা অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মাঝে ৩০ শতাংশ কয়লা উৎপাদনকারী শানজি প্রদেশে বন্যা হওয়ায় কয়লার মূল্য আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। এরই মাঝে যুক্ত হয় ‘এভারগ্র্যান্ড’এর সমস্যা। রিয়েল এস্টেট এই কোম্পানি ৩’শ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেউলিয়া হবার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ‘ফ্যান্টাসিয়া’ নামের আরেকটা ডেভেলপার কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে; আর ‘সাইনিক হোল্ডিংস’ও একই পথে যাবার কথা বলছে।

 
চীনের সাংহাই শহরের মারাত্মক দূষণ।  পুঁজিবাদী আদর্শকে অনুসরণ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় চীনের পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটেছে। আর এই বিপর্যয় এড়াতে গিয়েই মারাত্মক জ্বালানি সংকটে পড়ে চীনা জনগণ অন্ধকারে রাত কাটাচ্ছে।

‘দ্যা ইকনমিস্ট’ পত্রিকার ‘ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’এর ইউ সু বলছেন যে, রিয়েল এস্টেট সেক্টর স্থবির হয়ে আসলে এর সাথে যুক্ত কন্সট্রাকশন কনট্রাক্টর, বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াস প্রস্তুতকারক এবং বাড়িঘরের অভ্যন্তরের ফার্নিশিংএর ব্যবসাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে চীনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিরেক্টর জৌ ল্যান বলছেন যে, ‘এভারগ্র্যান্ড’এর সমস্যা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবার কিছু নেই। কারণ এই কোম্পানির ঋণ অনেক ব্যাংকের মাঝে ছড়িয়ে আছে। কোন একটা ব্যাংক এখানে বড় সমস্যায় পড়বে না। অর্থাৎ আর্থিক সেক্টরে ‘এভারগ্র্যান্ড’এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ‘বিবিসি’ বলছে যে, চীনের বড় প্রযুক্তি কোম্পানি, গেমিং কোম্পানি এবং শিক্ষা সেক্টর সরকারের নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়েছে। সরকার সামাজিক দিকনির্দেশনাকে পরিবর্তন করতে পাঁচ বছর মেয়াদী এই নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ডগুলি বাস্তবায়ন করছে। অর্থাৎ এই নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ড আরও কয়েক বছর ধরে চলবে। তবে একইসাথে অনেকগুলি নীতির পরিবর্তনের স্বল্পমেয়াদী প্রভাব অবশ্যই দেখা যাবে।

চীনা সরকার চিন্তিত; সেকারণেই তারা তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনছে

চীনা সরকার ইতোমধ্যেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ৬ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘পিপলস ব্যাংক অব চায়না’ তার নীতিতে পরিবর্তন এনেছে। ১৫ই ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি তাদের রিজার্ভ থেকে শূণ্য দশমিক ৫ শতাংশ করে কমিয়ে ফেলতে পারবে। রিজার্ভ হলো ব্যাংকগুলির পুঁজির একটা অংশ যা ব্যাংক সবসময় ধরে রাখতে বাধ্য। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলি নতুন করে অর্থ যোগার করা ছাড়াই আরও অতিরিক্ত ১’শ ৮৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সক্ষম হবে। ‘সিএনএন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এবছরে দ্বিতীয়বার চীনা বাণিজ্যিক ব্যাংকের রিজার্ভের বাধ্যবাধকতা কমানো হলো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ‘পলিটব্যুরো’র এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ২০২২ সালে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সরকার আরও সাহসী সিদ্ধান্ত নেবে। অস্ট্রেলিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাককুয়ারি গ্রুপ’এর অর্থনীতিবিদ ল্যারি হু মত দিচ্ছেন যে, এর আগে কখনোই চীনা নেতৃত্ব ‘স্থিতিশীলতা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’এর মতো কথা বলেনি। এর অর্থ হতে পারে যে, চীনা শীর্ষ নেতৃত্ব সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতার ব্যাপারে যথেষ্টই চিন্তিত।

‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও চীন সরকার অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থেকেছে। ২০২০এর প্রথম ভাগের পর থেকে চীনা সরকার সুদের হার কমায়নি। এমনকি অর্থনীতিতে বড় রকমের কোন প্রণোদনার বন্যাও বইয়ে দেয়নি। তারা শুধুমাত্র করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ব্যবসাগুলিকে কিছু সমর্থন দিয়েছে। ২০২০ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে চীন প্রায় সকল বড় অর্থনীতিকে ছাপিয়ে যায়। তবে তার অর্থনীতি ২০২১ সালে কিছু সমস্যায় পতিত হয়; যার মাঝে রয়েছে নিজেদের জ্বালানি সংকট, আন্তর্জাতিক শিপিং সাপ্লাইএর বিলম্ব এবং অভ্যন্তরীণ রিয়েল এস্টেট সমস্যা। এছাড়াও দেশটার প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি এবং আরও কিছু বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উপর সরকারের চাপপ্রয়োগের ব্যাপারটাও অনেক বিশ্লেষকদের চিন্তিত করেছে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ‘এভারগ্র্যান্ড’ গত ৩রা ডিসেম্বর ঘোষণা দেয় যে, তারা হয়তো তাদের সকল ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। এই ঘোষণায় ৬ই ডিসেম্বর হংকংএর পুঁজি বাজারে কোম্পানির শেয়ারের মূল্য একদিনে ২০ শতাংশ পড়ে যায়।

বিশ্লেষকেরা ভয় পাচ্ছেন যে, ‘এভারগ্র্যান্ড’এর সমস্যা হয়তো চীনের পুরো রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে আক্রান্ত করে ফেলতে পারে। আর চীনের জিডিপির ৩০ শতাংশই রিয়েল এস্টেট সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। এতকাল ‘পলিটব্যুরো’র সদস্যরা বলেছেন যে, রিয়েল এস্টেট সেক্টরকে নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং সেব্যাপারে শি জিনপিং নিজেও যথেষ্ট কঠোর ছিলেন। কিন্তু এবছরই প্রথমবারের মতো তারা রিয়েল এস্টেট সেক্টরের ব্যাপারে কঠোর কোন কথা বলেননি। ‘সিটি গ্রুপ’এর বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ব্যাংকের রিজার্ভের বাধ্যবাধকতা কমানো এবং ‘পলিটব্যুরো’র বিবৃতিতে বাসস্থানের চাহিদাকে সমর্থন দিয়ে যাবার কথায় বোঝা যাচ্ছে যে, সামনের দিনগুলিতে রিয়েল এস্টেট সেক্টরের ব্যাপারে চীনা সরকার আরও নরম সুরেই কথা বলবে।

 
চীনারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকেই এগুচ্ছে এবং স্বল্পমেয়াদী সমস্যাগুলির সমাধান করতে যেয়ে তারা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে না। আর নিজেদের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের মাঝে রেখে তারা সমস্যাগুলিকে বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখতে পারবে।

চীনা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন; তবে ধ্বস নয়

চীন ভিত্তিক বাজার গবেষণা সংস্থা ‘চায়না বেইজ বুক ইন্টারন্যাশনাল’এর প্রধান নির্বাহী লেল্যান্ড মিলার ‘ব্লুমবার্গ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, তিনি মনে করেননা যে বর্তমানে চীনে যে অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি হচ্ছে, তা পূর্বে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো কোনো ঘটনার মতো। তার মতে, আজকে চীনে যা ঘটছে, তার প্রভাব আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হবে। এর মূল কারণ হলো সারা বিশ্বের হিসেবটাই এখন পাল্টে গেছে; যা কিনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে। ওয়াল স্ট্রীটের পুঁজিপতিরা মনে করছিলেন যে, কোভিডের লকডাউনের পর চীনারা বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রণোদনার ঘোষণা দেবে; কিন্তু সেটার ঘোষণা এখনও আসেনি। কারণ চীনারা মনে করছে যে, ধীরস্থির কম প্রবৃদ্ধিই চীনের অর্থনীতির জন্যে ভালো হবে। মিলার আরও বলছেন যে, চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টর যখন মুষরে পড়ছে, সেখানে অভ্যন্তরীণ বেসরকারি কনজাম্পশন বা খরচ বেড়ে গিয়ে সেটাকে প্রতিস্থাপন করার কোন সম্ভাবনা আসলে নেই। সরকার মানুষের খরচ বৃদ্ধি করতে পারার জন্যে বড় কোন সহায়তা দেয়নি। রাষ্ট্রের সম্পদকে জনগণের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। আর বাইরের বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের জন্যে বর্তমানে চীনের আর্থিক সেক্টর ছাড়া অন্য সেক্টরগুলিতে বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত। তবে মিলার মনে করেন না যে, ‘এভারগ্র্যান্ড’এর সমস্যা চীনের অর্থনীতির জন্যে বিশাল কোন সমস্যা বয়ে নিয়ে আসবে। এর কারণ হলো, চীনা অর্থনীতি পশ্চিমা অর্থনীতির মতো মুক্তভাবে চলে না। এখানে সরকার ইচ্ছে করলেই অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে স্বল্প পরিসরে আটকে দিয়ে বাকি অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারে। চীনা সরকার ‘এভারগ্র্যান্ড’এর ব্যাপারে প্রথমেই সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে চীনা জনগণকে শিক্ষা দিচ্ছে যাতে তারা রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের আগে হিসেব করে সিদ্ধান্ত নেয়।

‘কর্নেল ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর এবং মার্কিন থিংকট্যাংক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর সিনিয়র ফেলো এসওয়ার প্রসাদ ‘ব্রুকিংস’এর এক আলোচনায় বলেন যে, যেটা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, চীনারা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। একইসাথে তারা মধ্যমেয়াদে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে চিন্তাভাবনা না করে কেনাবেচাকে নিরুৎসাহিত করা ছাড়াও পরিবেশের উপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রভাবকে কমাতে চাইছে। এই মধ্যমেয়াদী লক্ষ্যগুলিকে বাস্তবায়ন করতে চীন স্বল্প মেয়াদে কিছু প্রবৃদ্ধিকে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। চীনা সরকার জনগণকে বোঝাতে চাইছে যে, যেসব কোম্পানির বিনিয়োগের উৎস ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিৎ নয়। আর একইসাথে কেউ যদি মনে করে যে, কোন কোম্পানি নিজেদের খারাপ ব্যবস্থাপনার জন্যে দেউলিয়া হয়ে গেলে সরকার তাদেরকে উদ্ধার করবে, সেটা একেবারেই সঠিক নয়। তবে বহু মানুষের পুঁজি রিয়েল এস্টেট সেক্টরে আটকে থাকার ব্যাপারটা চীনা সরকারের চিন্তার কারণ হিসেবে রয়েছে। প্রফেসর প্রসাদ মনে করছেন না যে, রিয়েল এস্টেটের সমস্যাগুলি পুরো আর্থিক সেক্টরকে প্রভাবিত করবে।

 
চীনে 'মার্সিডিস' কোম্পানির কারখানা। চীনের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোকে হিসেবে ধরেই অনেক পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ভবিষ্যৎবাণী করছেন যে, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে যাচ্ছে। মূলতঃ এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পশ্চিমা পুঁজিপতিদের; যারা চীনে শতশত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে মুনাফার আশায়। তারা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় শংকিত; যদিও সেই প্রবৃদ্ধি সকল বৃহৎ অর্থনীতি থেকে বেশি। ওয়াল স্ট্রীটের পুঁজিপতিরা শংকায় রয়েছে যে, তাদের ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ বুঝি ডিম দেয়া বন্ধ করে দিচ্ছে!

‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’!

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’ এবং ‘রোডিয়াম গ্রুপ’এর এক যৌথ প্রতিবেদনে চীনের দুই নৌকায় পা রাখার ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন এতকাল মনে করছিল যে, তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সংকীর্ণ নীতিকে তারা সমান্তরালে রেখেই এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে শুরু করে চীনাদের ভবিষ্যৎ জিডিপি পূর্বাভাসই বলে দিচ্ছে যে, চীনারা তাদের এতকালের পথ থেকে সরে আসছে। এই প্রতিবেদনের সাথে পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা মোটামুটিভাবে একমত যে, চীনারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকেই এগুচ্ছে এবং স্বল্পমেয়াদী সমস্যাগুলির সমাধান করতে যেয়ে তারা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে না। আর নিজেদের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের মাঝে রেখে তারা সমস্যাগুলিকে বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখতে পারবে।

চীনের অর্থনীতি এখনও পশ্চিমা দেশগুলিতে রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দা চীনা পণ্যের বাজারকে চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলছে। চীনা অর্থনীতি পুঁজিবাদের সমস্যাগুলি থেকে মুক্ত নয়। লাগামহীন ঋণের উপর নির্ভরশীল হবার কারণেই চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টর সমস্যায় পতিত; যা পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে অনুসরণ করারই ফলাফলস্বরূপ। পুঁজিবাদী আদর্শকে অনুসরণ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় চীনের পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটেছে। আর এই বিপর্যয় এড়াতে গিয়েই মারাত্মক জ্বালানি সংকটে পড়ে চীনা জনগণ অন্ধকারে রাত কাটাচ্ছে। চীনের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোকে হিসেবে ধরেই অনেক পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ভবিষ্যৎবাণী করছেন যে, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে যাচ্ছে। মূলতঃ এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পশ্চিমা পুঁজিপতিদের; যারা চীনে শতশত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে মুনাফার আশায়। তারা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় শংকিত; যদিও সেই প্রবৃদ্ধি সকল বৃহৎ অর্থনীতি থেকে বেশি। ওয়াল স্ট্রীটের পুঁজিপতিরা শংকায় রয়েছে যে, তাদের ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ বুঝি ডিম দেয়া বন্ধ করে দিচ্ছে!