Tuesday 26 June 2018

আর্জেন্টিনা কি পারবে?

২৬শে জুন ২০১৮
আর্জেন্টিনা কি পারবে? কি পারবে? বাংলাদেশের মানুষকে এই প্রশ্ন করলে তাদের বেশিরভাগের চিন্তায় থাকবে – আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে কি না। যারা এধরনের চিন্তা করছেন, তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে আর্জেন্টিনা একটা দেশের নাম; ফুটবল টিমের নাম নয়।


কি পারবে আর্জেন্টিনা?


আর্জেন্টিনা কি পারবে? কি পারবে? বাংলাদেশের মানুষকে এই প্রশ্ন করলে তাদের বেশিরভাগের চিন্তায় থাকবে – আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে কি না। যারা এধরনের চিন্তা করছেন, তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে আর্জেন্টিনা একটা দেশের নাম; ফুটবল টিমের নাম নয়। আর্জেন্টিনার ভূমি রয়েছে প্রায় ২৮ লক্ষ বর্গকিঃমিঃ-এর মতো, যা বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১৯ গুণ বড়। তবে জনসংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লাখের মতো, যা বাংলাদেশের প্রায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। এর অর্থনীতি আকার প্রায় ৬২৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্বিগুণেরও বেশি। ১৪,০০০ ডলারের মাথাপিছু আয় থাকার পরেও দেশের অর্থনীতি এতটা খারাপ অবস্থায় রয়েছে যে, তাদের সামরিক বাহিনী টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে গিয়েছে। ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্রের শিকার, এবং ৬ দশমিক ২ শতাংশ সবচাইতে খারাপ দারিদ্রের মাঝে রয়েছে। ২০১০ সালে ৫৩০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি থেকে ২০১৬-তে মাত্র ৫৪৬ বিলিয়নে পৌঁছায়। এর মাঝে দুই বছর অর্থনৈতি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক।

তাহলে আর্জেন্টিনার এই ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি নিয়ে কি পারার কথা হচ্ছে? আর্জেন্টিনার উপকূলের অদূরে রয়েছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, যা আর্জেন্টিনার নয়; ব্রিটেনের। ব্যাপারটা বোঝানোর জন্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভারতের অধীনে, তাহলে সেটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে কেমন লাগতে পারে? ঠিক তেমনটাই আবেগ রয়েছে আর্জেন্টিনার। কিন্তু আর্জেন্টিনা কি পারবে ব্রিটেনের কাছ থেকে এই দ্বীপকে বাগিয়ে নিতে?
  
 
অক্টোবর ২০১৬। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আয়ার্সে উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ পতাকা পোড়াচ্ছে। ব্রিটিশরা ফকল্যান্ডে সামরিক মহড়া দেবে - এই ঘোষণার প্রতিবাদ এটি। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা ঠিকই ফকল্যন্ড দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে তারা ধরে রাখতে পারবে না, তা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল।


ফুটবল বিশ্বকাপ নয়, ফকল্যান্ড নিজের দখলে নিতে পারবে আর্জেন্টিনা?

১৯৮২ সাল। আর্জেন্টিনা তার উপকূলে ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নিয়েছে। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশিক রাজত্বের বেশিরভাগটাই ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হারিয়েছে। তবুও ব্রিটিশ ইজ্জত বলে কথা। ব্রিটিশরা স্বল্প সময়ের মাঝে তাদের যতটুকু সামরিক সক্ষমতা রয়েছে, ততটাই কাজে লাগিয়ে দ্বীপগুলি পুনর্দখল করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু প্রায় ১৪ হাজার কিঃমিঃ দূরে পুরো আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আসা ব্রিটিশদের সক্ষমতা ছিল সীমিত। তাই তারা তাদের সকল ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগে উদ্যোগী হয়। এর মাঝে একটা ছিল ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটিশদের জন্যে একটা বন্ধু খোঁজা, যে কিনা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সহায়তা দিয়ে ব্রিটিশদের সক্ষমতায় ফাঁকফোকড়গুলিকে বন্ধ করতে পারবে। আরেকটি উদ্যোগ ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে নিজের পক্ষে কাজ করানো।

বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা মূলতঃ মার্কিনীদের তৈরি। তারা ব্রিটিশদের ব্যবস্থাগুলিকে নিজেদের মতো করে তৈরি করিয়ে নিয়েছে। দুর্বল দেশগুলি অস্ত্রের জন্যে অন্যের উপরে নির্ভরশীল থাকবে– এটা অবশ্য ব্রিটিশ সময়ের চিন্তা হলেও মার্কিনীরা এটা অব্যহত রেখেছে। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় আর্জেন্টিনার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ছিল ফ্রান্সের তৈরি ‘এক্সোসেট’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিমান থেকে লঞ্চ করা ভার্সনেরই আর্জেন্টিনা সবচাইতে বড় ব্যবহার করেছিল। আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনীর ছোঁড়া দু’টি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে দু’টি ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস হয়। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ রাষ্ট্রের কিছু লোক চাইছিলো আর্জেন্টিনা পর্যন্ত এই এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের চালান বন্ধ করে দিতে। এই চালানগুলি আসতো বিমানে। চার্লস হিউসডন নামের এক ব্রিটিশ এয়ার ফ্রেইটের ব্যবসা করতেন, যিনি ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ এটর্নি জেনারেল মাইকেল হাভার্স-এর বন্ধু। হিউসডন এয়ার ফ্রেইটের আদি-নক্ষত্র জানতেন। তিনি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের চালান বন্ধ করার একটা পরিকল্পনা এটর্নি জেনারেলকে বলার পরে সেটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার পর্যন্ত যায়।
 
 
আর্জেন্টিনার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ছিল ফ্রান্সে নির্মিত 'এক্সোসেট' ক্ষেপণস্ত্র। ফ্রান্সের সরবরাহকৃত 'সুপার এটেনডার্ড' বিমান থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়। মাত্র ৫টা ক্ষেপণাস্ত্র ব্রিটিশদের মাঝে যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল, দুই ডজন কি করতে পারতো, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ফ্রান্স ৫টার বাইরে একটাও সরবরাহ করেনি। এমনকি ৫টার মাঝে প্রথমে কাজ করেছে মাত্র ২টা; বাকি ৩টা কাজ করাতে অনেক কষ্ট করতে (সময় ক্ষেপণ) হয়েছে ফরাসিদের। 


ফ্রান্স কি ব্রিটেনের পক্ষে ছিল, নাকি আর্জেন্টিনার?

পরিকল্পনাটা ছিল এরকম। নিজেদের অনুগত একটা কোম্পানি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র শিপমেন্ট করার জন্যে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করবে। এটা এমন একটা সময় যখন নিজেদের “নিরপেক্ষ” দেখাতে ফরাসিরা নিজেদের বিমানে আর্জেন্টিনায় এই ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাবে না। লোডমাস্টারের যোগসাজসে বিমানটার কোর্স পরিবর্তন করে ট্রানজিটে বার্মুদা বা অন্য কোন স্থানে নামানো হবে। থ্যাচার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া মিতেরাঁর কাছে এক গোপন চিঠি লিখে দক্ষিণ আমেরিকায় এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের চালান দেরি করানোর অনুরোধ করেন। ফ্রান্স যাতে পেরুর কাছে এই অস্ত্র বিক্রি না করে, সেটার অনুরোধ করেন থ্যাচার। কারণ পেরু থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র নিশ্চিতভাবেই আর্জেন্টিনায় যাবে। যুদ্ধের আগে ফ্রান্স আর্জেন্টিনার কাছে ৫টি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছিল, যা কেউ তেমন গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। যখন ১৯৮২-এর মে মাসে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আর্জেন্টিনা ২টি ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস করে ফেলে, তখন সকলে নড়েচড়ে বসে। ফ্রান্স ঘোষণা দেয় যে তারা আর্জেন্টিনার কাছে কোন অস্ত্র বিক্রি করবে না। একইসাথে ফ্রান্স ব্রিটেনের কাছে তথ্য দেয় যে তারা আর্জেন্টিনার কাছে কি কি ধরনের অস্ত্র বিক্রি করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ফরাসি সামরিক স্থাপনাগুলিকেও ফ্রান্স ব্রিটেনের ব্যবহার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়। তবে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় কিছু লোকজন মনেপ্রাণে ব্রিটেনের বিপক্ষে ছিলেন।

ফরাসি সরকারের অজানা ছিল না যে একটা ফরাসি সরকারি কোম্পানির (৫১ শতাংশ শেয়ার) একটা টেকনিক্যাল দল আর্জেন্টিনাকে সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের পুরো সময় আর্জেন্টিনাতে অবস্থান করে। দলটি এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু সমস্যা দূর করে অস্ত্রটিকে বিমান থেকে লঞ্চ করার জন্যে কর্মক্ষম করে তোলে। ফরাসি সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য এগুলি জানতো না বলে দাবি করে। তবে মাত্র ৫টি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আর্জেন্টিনা যে কিছু করতে পারবে না, তা ব্রিটিশরা জানতো। তাই তাদের মূল ফোকাস ছিল কিভাবে আর্জেন্টিনাকে নতুন করে এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র পাওয়া থেকে দূরে রাখা যায়। ফরাসিরা যে দুই পক্ষকে খুশি রাখছে, সেটা ব্রিটিশরা জানতো; তারপরেও ফরাসিদের সাথে তাদের নতুন করে কোন শত্রুতা হয়নি। ফরাসিরা থ্যাচারের সাথে দরকষাকষিতে এগিয়ে ছিল। তারা আর্জেন্টিনার কাছে নতুন করে আর এক্সোসেট বিক্রি করেনি। আবার পুরোনো এক্সোসেটগুলিকে কর্মক্ষম করার মাধ্যমে তারা আর্জেন্টিনারও পক্ষেও থাকার ভান করেছে। তারা আর্জেন্টিনাকে এমন কোন সহায়তা দেয়া থেকে বিরত থাকে, যা কিনা যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে ফেলতে পারতো। আরও দুই ডজন এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র হয়তো রয়াল নেভির বারোটা বাজাতে পারতো। কিন্তু সেটা মিতেরাঁ-থ্যাচারের দরকষাকষিতেই ব্যবহৃত হয়েছিল কেবল।
 
  
ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর 'নিমরড' গোয়েন্দা বিমান। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় এরকম একটা বিমান আর্জেন্টিনার প্রতিবেশী দেশ চিলির প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ স্যান ফেলিক্সে মোতায়েন করা হয়। চিলির সহায়তায় ব্রিটিশরা আগে থেকেই আর্জেন্টিনার বিমান হামলার ওয়ার্নিং পেয়ে যেতো। চিলির এই সহায়তা ছাড়া ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ জেতা কঠিন হয়ে যেতো। 


দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রিটেনের শক্ত ঘাঁটি – চিলি

পুরো যুদ্ধের সময় চিলি ছিল ব্রিটেনের খুব কাছে বন্ধু। তবে সন্মুখে চিলি ল্যাটিন আমেরিকার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার কথা বলে ব্রিটেন-আর্জেন্টিনার যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকে। যুদ্ধের শুরুতেই সিডনি এডওয়ার্ডস নামের ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের এক অফিসারকে গোপনে চিলিতে প্রেরণ করা হয়। তিনি চিলির বিমান বাহিনীর প্রধান জেনারেল ফার্নান্দো মাত্থেই-এর সাথে সাক্ষাৎ করে সহায়তা চান। চিলির প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের কাছাকাছি স্যান ফেলিক্স দ্বীপে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের একটা ‘নিমরড’ গোয়েন্দা বিমান মোতায়েন করা হয়। সিডনি এডওয়ার্ডস-এর গোয়েন্দা রিপোর্টগুলি ছিল অত্যন্ত গোপনীয় এবং খুব কম লোকই জানতো এর ব্যাপারে। এই রিপোর্টগুলি পরিচিত ছিল “সিডগ্রামস” নামে। এই বার্তাগুলিতে আর্জেন্টিনার দক্ষিণের উশুয়াইয়া, রিও গালেগোস, রিও গ্রান্দে এবং কমোডোরো রিভাদাভিয়া বিমান ঘাঁটিগুলিতে আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনীর কর্মকান্ড রিপোর্ট করা হতো। বিশেষতঃ এই ঘাঁটিগুলি থেকে যুদ্ধবিমান উড়লেই সেই ওয়ার্নিং চলে যেতো ফকল্যান্ডস-এর অদূরে অবস্থান নেয়া রয়াল নেভির কাছে। রয়াল নেভির বিমান প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিল হাতে গোনা ২৮টি সী হ্যারিয়ার বিমানের হাতে। বিপক্ষে ছিল আর্জেন্টিনার বিমান এবং নৌবাহিনীর মোটামুটি ১১৫টির মতো ফাইটার বিমান। সংখ্যায় অল্প হওয়ায় রয়াল নেভির পক্ষে সম্ভব ছিল না যে সারাক্ষণ এই বিমানগুলি আকাশে টহল দেবে। কারণ আকাশে উড়লে সেগুলি নামার পরে মেইনটান্সের কারণে কয়েকটা বিমান রেডি থাকবে না। ঐ সময়ে আর্জেন্টিনার বিমান হামলা হলে সবগুলি বিমান ইন্টারসেপ্ট করার লক্ষ্যে উড়তে পারবে না। অর্থাৎ তাদের ফ্লিটকে রক্ষা করা সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। তাই ব্রিটিশরা পরিকল্পনা করে কি করে আগেভাগে আর্জেন্টিনার বিমান হামলার খবর পাওয়া যায়। তখন সে অনুযায়ী হ্যারিয়ার বিমান জাহাজ থেকে ওড়ানো যাবে। আর্জেন্টিনার উপকূল থেকে ফকল্যান্ডের দূরত্ব কমপক্ষে ৩৫০ কিঃমিঃ। অর্থাৎ একটা ফাইটার বিমানের ফকল্যান্ডের কাছাকাছি ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে হামলা করতে কমপক্ষে ২০ মিনিট সময় লাগবে। আগেভাগে জানতে পারলে এটা বিমান প্রতিরক্ষাকে প্রস্তুত করার জন্যে মোটামুটি যথেষ্ট। চিলি ব্রিটিশদেরকে এই সহায়তাটাই করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস (এসএএস) কমান্ডোদের অবতরণ করিয়ে আর্জেন্টিনার দক্ষিণের রিও গ্রান্দে বিমান ঘাঁটিতে অবস্থিত এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র বহণকারীসুপার এটেনডার্ড ফাইটার বিমান ধ্বংস করার জন্যে অত্যন্ত সাহসী একটা মিশন পরিকল্পনা করে ব্রিটিশরা। মিশনটির আগে তথ্য সংগ্রহ করার একটা অপারেশন চালানো হয়, যা সফল হয়নি। কমান্ডোরাসীমান্ত অতিক্রম করে চিলিতে ঢুকে যায় এবং তখন চিলি সরকার তা আলাদা কিছু নয় বলে ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। চিলির নৌবাহিনীর জন্যে ব্রিটিশ নৌবাহিনী থেকে কেনা রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার ‘টাইডপুল’ চিলি সরকার – কিছুদিন পরে ডেলিভারি দিলেও চলবে, এই হিসেবে – ব্রিটিশদের আরও কিছুদিন ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। জাহাজটি ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্যবহার করে ব্রিটিশ রয়াল নেভি।


 

কৌশলগত ম্যাজেলান প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর্জেন্টিনার সাথে চিলির রয়েছে দ্বন্দ্ব। ব্রিটেন চিলির পক্ষে থাকায় চিলি এই দ্বন্দ্বে শক্তি পায়। ম্যাজেলান প্রণালী থেকে পূর্বেই রয়েছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, যা ব্রিটিশদের হাতে রয়েছে। ম্যাজেলানের আরও দক্ষিণের ড্রেইক প্যাসেজ দিয়েও জাহাজ যেতে পারে। তবে সেখানে আবহাওয়া আরও খারাপ থাকে।


ফকল্যান্ড আর্জেন্টিনার হাতে গেলে কি হতো?

চিলি এবং ফ্রান্সের সাথে ফকল্যন্ড যুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনের সম্পর্ক কিছু আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসে। প্রথমতঃ দক্ষিণ আমেরিকাতে ব্রিটিশ প্রভাব ধরে রাখতে চিলি ব্রিটেনকে সহায়তা করছে। চিলি ১৮৭৯-৮৩ সালে সংঘটিত ‘ওয়ার অব দ্যা প্যাসিফিক’এ পেরু এবং বলিভিয়ার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে চিলি তার ব্রিটেনে নির্মিত অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলি ব্যবহার করে পেরুর পুরো নৌবাহিনীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। উভয় দেশ একত্রে চিলির কাছে সামরিক পরাজয় বরণ করে এবং এর ফলশ্রুতিতে চিলি বলিভিয়া এবং পেরুর কাছ থেকে আতাকামা মরুভূমির বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয়। ঐ অঞ্চল ছিল বলিভিয়ার জন্যে সমুদ্রে পৌঁছানোর একমাত্র উপায়। একইসাথে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খণিজ সম্পদ ছিল, যা পুরোটাই চিলির হস্তগত হয়। বলিভিয়া এবং পেরুর পক্ষ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেসময় থেকেই পেরুকে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র তার বলয়ে নিয়ে আসতে থাকে। পেরুকে অস্ত্রসস্ত্র সরবরাহ করে ব্রিটিশদের বন্ধু চিলির বিরুদ্ধে ব্যালান্স তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র।
 

বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপথগুলির মাঝে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণের সমুদ্রপথের বাণিজ্যিক গুরুত্ব তেমন একটা নেই। কিন্তু এর কারণ কিন্তু মধ্য আমেরিকার পানামা খাল, যা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। ইউরোপিয়রা সর্বদাই আটলান্টিক হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের যাবার জন্যে পানামা খালের একটা বিকল্প রাখতে চাইবে।


চিলির সাথে ইউরোপের যোগাযোগ ছিল দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণের ম্যাজেলান প্রণালী এবং এরও দক্ষিণের ড্রেইক প্যাসেজ হয়ে, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল মুলতঃ চিলি এবং কিছুটা আর্জেন্টিনার হাতে। আর ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ হলো সেই সমুদ্রপথের পূর্ব প্রান্তে। অন্যদিকে পেরুর সাথে ইউরোপের যোগাযোগ বর্তমানে পানামা খাল-এর মাধ্যমে, যা ১৯১৪ সালের আগ পর্যন্ত ছিল না। ১৮৭৯-৮৩-এর যুদ্ধে পেরুর জন্যে অস্ত্র পানামা যোজকের ভূমি পার হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে এসে জাহাজে উঠতো। পানামা খাল তৈরি হবার আগ পর্যন্ত পেরুকে অনেক ক্ষেত্রেই চিলির নিয়ন্ত্রণে থাকা ম্যাজেলান প্রণালি ব্যবহার করতে হতো। ইউরোপ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে সরাসরি যোগাযোগের পথ হলো পানামা খাল হয়ে, যা যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ম্যাজেলান প্রণালি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে না। বরং সেখানে চিলির সহায়তায় ফকল্যান্ড থেকে ব্রিটিশরা ম্যাজেলানকে নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড নিজেদের দখলে রাখতে পারলে ব্রিটশরাও প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছাতে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত পানামা খালের উপরে নির্ভরশীল হয়ে যেতো। আর পানামা খালে কোন ধরনের সমস্যা হলে সকল জাহাজকে ম্যাজেলান প্রণালি হয়ে যাতায়াত করতে হবে। সেই ঘটনা ঘটার আগে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই ম্যাজেলানের গুরুত্ব থাকবে না; এটাই স্বাভাবিক।

ম্যাজেলান প্রণালির সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর্জেন্টিনার সাথে চিলির বিবাদ রয়েছে। আর্জেন্টিনা যদি ফকল্যান্ড দখলে রাখতে পারতো, তাহলে চিলিও পরবর্তীতে টার্গেট হতো আর্জেন্টিনার; যার সুবাদে ম্যাজেলান প্রণালির নিয়ন্ত্রণ চিলির কাছ থেকে আর্জেন্টিনার কাছে চলে যেতো। আবার ফকল্যান্ড আর্জেন্টিনার হওয়া মানে মানচিত্রের পরিবর্তন, যা কিনা বলিভিয়া এবং পেরুকে ১৮৭৯-৮৩-এর প্যাসিফিক যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিতো এবং চিলিকে চাপের মুখে ফেলতো। প্যাসিফিকের যুদ্ধে আর্জেন্টিনাও গোপনে বলিভিয়া এবং পেরুর সাথে কথা বলেছিলো। তবে চিলি ব্যাপক সামরিক সাফল্য পাওয়ায় আর্জেন্টিনা পিছু হটে যায়। ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টিনার পক্ষে গেলে আতাকামা নিয়ে বিবাদে আর্জেন্টিনা নিশ্চিতভাবেই পেরু এবং বলিভিয়ার পক্ষ নিতো। আবার এসব সংঘাত চলার সময় আর্জেন্টিনাকে অনেক শক্তিশালী এবং আগ্রাসী হতে দেখে এই এলাকার সবচাইতে বড় দেশ ব্রাজিলও বসে থাকতো না। ব্রিটেন কোনভাবেই এভাবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা সমুদ্রপথকে ছেড়ে দিতো না।
  
নভেম্বর ২০১৫। কৌশলগত ম্যাজেলান প্রণালী অতিক্রম করছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'জর্জ ওয়াশিংটন। ফকল্যান্ড এবং চিলির মাধ্যমে এই প্রণালীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ব্রিটেন। আর ফ্রান্স আর্জেন্টিনাকে 'কোনরকম' সহায়তার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ফকল্যান্ড ব্রিটেনের হাতে থাকলে ফ্রান্স এর বিরোধিতা করবে না। 

 

অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রশান্ত মহাসাগরে বেশকিছু উপনিবেশ রয়েছে। ফরাসীরাও ফকল্যন্ড ব্রিটিশদের হাতে থাকায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে যে পানামা খাল ছাড়াও ফ্রান্স থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছার আরেকটা পথ ইউরোপীয়দের হাতেই রইলো। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু ম্যাজেলান প্রণালিকে ভুলে যায়নি। মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলি তেমন কোন কারণ ছাড়াই এই প্রণালি দিয়ে আটলান্টিক এবং প্যাসিফিকের মাঝে যাতায়াত করে; যদিও পানামা খাল দিয়ে যাওয়াটা তাদের জন্যে হাজার গুণ সহজ হতো। ২০১৭-এর ডিসেম্বরেও মার্কিন উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘ওয়াসপ’ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্যাসিফিকে যেতে পানামা খাল ব্যবহার না করে ম্যাজেলান প্রণালি ব্যবহার করে। ২০১৫-এর অক্টোবর-নভেম্বরে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ (CVN 73) তার পুরো ব্যাটলগ্রুপ-সহ ম্যাজেলান প্রণালি পার হয়। ২০০৪ সালে আরেক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রোনাল্ড রেগ্যান’ (CVN 76) এই প্রণালি পার হয়। ২০১৪-এর অগাস্টে উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘আমেরিকা’ (LHA 6) ম্যাজেলান প্রণালি পারি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র একা নয়, ২০১৩ সালের অক্টোবরে চীনা নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধজাহাজের একটা গ্রুপ ম্যাজেলান প্রণালি পারি দেয়। ম্যাজেলানের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বোঝাটা খুব কঠিন নয়।



১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফূটবল। আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড। ম্যারাডোনার 'হ্যান্ড অব গড' গোল। আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডের সাথে জিতেছিল ফুটবলে; কিন্তু ফকল্যান্ড যুদ্ধে নয়! আর্জেন্টিনা বাকি বিশ্বের কাছে একটা ফুটবল দল। ভূরাজনীতিতে আর্জেন্টিনার অংশগ্রহণ ততটুকুই, যতটুকু সুপারপাওয়ার তাকে করতে দেবে। ফুটবলের কাপ আর্জেন্টিনার হাতে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু ভূরাজনীতির কাপ দেয়া যাবে না! আর্জেন্টিনা আসলে কি পারবে, এই প্রশ্নটা একটা ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন। আর্জেন্টিনাকে দিয়ে সেটাই পারানো হবে, যেটা সুপারপাওয়ার চায়। বিশ্বের আমজনতার কাছে তাই আর্জেন্টিনা একটা ফুটবল দলই থাকবে। একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র ভূরাজনীতি বুঝবে – এটাই স্বাভাবিক। ফুটবল খেলা নয়, বরং ভূরাজনীতির খেলায় কাকে কি ধরনের চরিত্র দেয়া হয়েছে, সেটা বোঝাটা ভূরাজনীতি বোঝার অংশ।


আর্জেন্টিনা পশ্চিমা আদর্শিক শক্তিগুলির হাতে বন্দী। যে তাকে অস্ত্র সরবরাহ করবে, সে-ও তাকে এমনভাবে সরবরাহ করবে, যেন সে যুদ্ধে জিততে না পারে। যে সুপারপাওয়ার তাকে সহায়তা করবে, সে তাকে ততটাই সহায়তা করবে, যতটা করলে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ শক্তির কাছ থেকে যথেষ্ট দরকষাকষির সুযোগ পাওয়া যায়। আর্জেন্টিনাকে কেউ জেতাবে না; ব্যবহার করবে। ভূরাজনীতিতে আর্জেন্টিনার অংশগ্রহণ ততটুকুই, যতটুকু সুপারপাওয়ার তাকে করতে দেবে। ফুটবলের কাপ আর্জেন্টিনার হাতে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু ভূরাজনীতির কাপ দেয়া যাবে না! আর্জেন্টিনা আসলে কি পারবে, এই প্রশ্নটা একটা ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন। আর্জেন্টিনাকে দিয়ে সেটাই পারানো হবে, যেটা সুপারপাওয়ার চায়। বিশ্বের আমজনতার কাছে তাই আর্জেন্টিনা একটা ফুটবল দলই থাকবে। একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র ভূরাজনীতি বুঝবে – এটাই স্বাভাবিক। ফুটবল খেলা নয়, বরং ভূরাজনীতির খেলায় কাকে কি ধরনের চরিত্র দেয়া হয়েছে, সেটা বোঝাটা ভূরাজনীতি বোঝার অংশ।

Thursday 21 June 2018

‘এয়ারক্রাফট ফেরি’ আসলে কি জিনিস?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী এক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল, যার মাধ্যমে ফ্যাক্টরি থেকে যুদ্ধবিমান উড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত নেয়া হয়। এই নেটওয়ার্ক সমুদ্রপথের বিপদগুলিকে এড়িয়ে চলে এবং একইসাথে দ্রুততম সময়ের মাঝে যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়।

২১শে জুন ২০১৮


বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিমান পরিবহন


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। উত্তর আমেরিকার বিমান কারখানাগুলি থেকে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রগুলি পর্যন্ত বিমানগুলি কিভাবে নেয়া হবে? জার্মান সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ এবং লং-রেঞ্জ ম্যারিটাইম বোমারু বিমানগুলি ব্রিটেনকে অবরোধ দিয়ে রেখেছে। যেকোন জাহাজ ব্রিটেনের কাছে ঘেঁষতে গেলেই ডুবিয়ে দিচ্ছে জার্মানরা। এমতাবস্থায় যুদ্ধবিমানের মতো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য কি জাহাজে পরিবহণ ঠিক হবে? এই চিন্তা থেকেই যুদ্ধবিমানগুলিকে উত্তর আমেরিকা থেকে উড়িয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া পর্যন্ত আনার ব্যবস্থা করা হয়। একটি রুট ছিল কানাডা-গ্রিনল্যান্ড-আইসল্যান্ড-স্কটল্যান্ড, যার মাধ্যমে বিমানগুলিকে ব্রিটেনে পাঠানো হতো। আরেকটা ছিল মার্কিন পশ্চিম উপকূল থেকে হাওয়াই দ্বীপ হয়ে প্যাসিফিকের আরও কিছু দ্বীপ হয়ে নিউজিল্যান্ড-আস্ট্রেলিয়া, যা কিনা সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছে। আরও দু’টা রুট ছিল আফ্রিকা হয়ে, যা কিনা উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়ার যুদ্ধের জন্যে। আরও দু’টা রুট ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যে। এর একটা ছিল আলাস্কা থেকে বেরিং প্রণালি পার হয়ে সাইবেরিয়া হয়ে মস্কো। আরেকটা ছিল মধ্যপ্রাচ্য-ইরান হয়ে ককেশাস দিয়ে বাকু-স্টালিনগ্রাদ। আফ্রিকা পর্যন্ত যেতে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া হতো দু’টা রুটে, যার একটা ১৯৪১ থেকেই চালু হয়েছিল। এই রুটটা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ হয়ে ব্রাজিল হয়ে দক্ষিণ আটলান্টিক পাড়ি দেয়। আটলান্টিক পাড়ি দিতে এসেনশন দ্বীপ হয়ে লাইবেরিয়ায় নামতো বিমানগুলি। সেখান থেকে আফ্রিকার মাঝ দিয়ে অনেকগুলি বিমান ঘাঁটি হয়ে উত্তর আফ্রিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং চীনে যেত বিমানগুলি।
    

দক্ষিণ আটলান্টিকের এয়ার রুটখানা ব্রাজিল এবং পশ্চিম আফ্রিকার মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করে। ব্রাজিল যুদ্ধে প্রথমদিকে নিরপেক্ষা থাকলেও যুদ্ধে যোগদানের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে নিজ দেশের মাটিতে মার্কিন সামরিক বিমান ঘাঁটি মেনে নেয়। যুদ্ধের শুরুতে মার্কিন সেনাবাহিনীর দক্ষ লোকের ব্যাপক অভাব থাকায় প্রাইভেট কোম্পানি 'প্যান আমেরিকান' ব্রাজিল এবং আফ্রিকায় বিমানবন্দর তৈরি করা ছাড়াও বিমান 'ফেরি' করার এই নেটওয়ার্ক ম্যানেজ করে।



ফ্লোরিডা থেকে ব্রাজিল

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে বিমানগুলির আসল যাত্রা শুরু হতো। ফ্লোরিডা থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত দূরত্ব বিশাল। সেসময়ের বেশিরভাগ বিমানের পক্ষে অতদূর উড়ে যাওয়া কঠিন ছিল। অতটা দূর কভার করার লক্ষ্যে মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে বেশকিছু বিমান ঘাঁটি তৈরি করা হয়। পুয়ের্তো রিকো, এন্টিগা, ত্রিনিদাদ এবং ব্রিটিশ গায়ানাতে (বর্তমানে গায়ানা) চারটা বিমান ঘাঁটি তৈরি করে মার্কিনীরা। এর মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকি তিনটি ১৯৪০ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯১৭-১৯২২ সালের মাঝে তৈরি ৫০টি পুরোনো ডেস্ট্রয়ার দেবার বদলে পায় আমেরিকানরা। ফ্লোরিডা থেকে পুয়ের্তো রিকোর দূরত্ব ১,৫৭১ কিঃমিঃ; পুয়ের্তো রিকো এন্টিগা থেকে ৫৮৪ কিঃমিঃ দূরে। ত্রিনিদাদ পুয়ের্তো রিকো থেকে ১,০৮৫ কিঃমিঃ দূরে; আর ব্রিটিশ গায়ানা ১,৬৪৩ কিঃমিঃ দূরে। অর্থাৎ মোটামুটিভাবে ১ হাজার থেকে ১,৬০০ কিঃমিঃ দূরত্বের ভেতরে একটি করে বিমান ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছিল। বিমানগুলি একটা ঘাঁটি থেকে অন্য ঘাঁটিতে ব্যাঙএর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলতো; তেল ফুড়িয়ে গেলে তেল নিতো; পাইলট বদল করতো; কোন মেইনটেন্যান্স ইস্যু তৈরি হলে সেগুলি সমাধান করে নিতো।

ব্রাজিল যেকারণে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হলো

উপরে উল্লিখিত ঘাঁটিগুলি মার্কিন এবং ব্রিটিশ উপনিবেশে অবস্থিত ছিল। কিন্তু ব্রাজিল তো সেসময় স্বাধীন দেশ। ব্রাজিল যুদ্ধে কোন পক্ষে থাকবে, তা নিয়ে প্রচুর বাদানুবাদ হয়েছিল খোদ ব্রাজিলেই। শেষ পর্যন্ত ১৯৪২ সালের ২২শে অগাস্ট মার্কিন-ব্রিটিশ চাপের মুখে ব্রাজিল জার্মানি-ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু যুদ্ধ ঘোষণা করার আগেই ১৯৪১ সালের মাঝে উত্তর ব্রাজিলে মার্কিনীরা ৫টি সামরিক বিমান ঘাঁটি তৈরি করে ফেলে। এই কাজটা মূলতঃ সম্পাদন করে মার্কিন প্রাইভেট বিমান কোম্পানি ‘প্যান আমেরিকান’ বা ‘প্যাম-এম’। প্যান-এম-এর ব্রাজিলিয়ান সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ‘প্যানএয়ার দো ব্রাজিল’ মার্কিন সরকারের ১৯৪০ সালের ‘এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা এডিপি’-এর অধীনে এই ঘাঁটিগুলি তৈরি করে অপারেট করে। সেসময় যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনী জনবল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলো; তাই তাদের পক্ষে এই প্রোগ্রামে জনবল দেয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না। তাই প্রাইভেট কোম্পানি এই কাজগুলি সম্পাদন করে রাষ্ট্রীয় সংস্থার কাজ করে। আমাপা, বেলেম, সাও লুইস, ফোর্তালেজা, নাতাল, রেসিফ এবং ফার্নান্দো দে নোরোনিয়া দ্বীপে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪-এর ভেতরে মোট ৭টি ঘাঁটি তৈরি করা হয় এয়ারক্রাফট ফেরি করার লক্ষ্যে।
 
 

১৯৪৩ সাল। ব্রাজিলের বেলেম-এ Val de Cans বিমান ঘাঁটিতে রিফুয়েলিং করার জন্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বি-২৫ এবং বি-২৪ বোমারু বিমান। বিমানগুলি ফুয়েল নিয়ে আরও দক্ষিণে ব্রাজিলের অন্য ঘাঁটিগুলিতে যাবে; তারপর এসেনশন দ্বীপ হয়ে এগুলি আফ্রিকার পথে পাড়ি জমাবে। ব্রাজিলের এই সহায়তা না পেলে ব্রিটিশদের উত্তর আফ্রিকায় জেনারেল রমেলকে হারানো আরও কঠিন হতো।


আফ্রিকা মহাদেশ পাড়ি

আফ্রিকার ফরাসি উপনিবেশগুলি ব্রিটেনের পক্ষে যাবে কিনা, তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আফ্রিকার বিটিশ উপনিবেশগুলিকেই মূলত ব্যবহার করা হয়েছিল বিমান পরিবহণের জন্যে। লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, ঘানা, নাইজেরিয়া, সুদান হয়ে বিমানগুলি মিশরে পৌঁছাতো। ব্রাজিলের উপকূল থেকে লাইবেরিয়ার দূরত্ব ৩,০৭৯ কিঃমিঃ। এ-দুয়ের মাঝে ছিল এসেনশন দ্বীপ, যা ব্রাজিলের উপকূল থেকে ২,২৬১ কিঃমিঃ দূরত্বে। সিঙ্গেল ইঞ্জিন ফাইটার এবং দুই ইঞ্জিনের বিমানগুলি এসেনশন দ্বীপ হয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিত। লাইবেরিয়া থেকে ঘানা আক্রা ১,১৩০ কিঃমিঃ; ঘানার আক্রা থেকে নাইজেরিয়ার কানো ১,২৪২ কিঃমিঃ এবং মাইদুগুরি ১,৬১৩ কিঃমিঃ। সুদানের তিনটি ঘাঁটি নাইজেরিয়ার কানো থেকে ১,৫০০-২,৬০০ কিঃমিঃ দূরত্বে। সুদান থেকে ইথিওপিয়া, মিশর, জেদ্দা, ইয়েমেন যেতো বিমানগুলি। এসব ঘাঁটি থেকে প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরান, বাহরাইন, ওমান, করাচি হয়ে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন যেতো বিমান। করাচি থেকে দিল্লী, আগ্রা, কোলকাতা হয়ে আসাম, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম যেতো বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধে যোগদানের জন্যে। আর আসাম থেকে অরুণাচল হয়ে চীনের কুনমিং যেতো চীন ফ্রন্টে যুদ্ধ করার জন্যে।
 

তাকোরাদি এয়ার রুট বলে পরিচিত এই রুটটা আফ্রিকার মাঝ দিয়ে কয়েক হাজার মাইল গিয়েছিল। এই নেটওয়ার্ক জিইয়ে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ ছিল। সবগুলি ঘাঁটিতে রিফুয়েলিং, মেইনটেন্যান্স ছাড়াও পাইলটদের থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
 

আকাশে বিমান পরিবহনই আসলে বিমান ফেরি

এভাবে একস্থান থেকে অন্যস্থানে বিমান পাঠানোর পদ্ধতিকেই ‘ফেরি’ বলা হয়। প্রতিটা যুদ্ধবিমানের স্পেসিফিকেশনের মাঝে একটা প্যারামিটার থাকে ‘ফেরি রেঞ্জ’। এর অর্থ হলো অবতরণ না করে একটা বিমান কতদূর যেতে পারে। ফেরি করার সময় বিমানগুলিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ তেল ভর্তি করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার করা ফাইটার বিমানগুলির চাইতে এখনকার ফাইটার বিমানগুলির ফেরি রেঞ্জ অনেক বেশি। রেঞ্জ বাড়ানোর লক্ষ্যে অতিরিক্ত ফুয়েল ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হতো বিশ্বযুদ্ধের সময়; যা এখনও করা হয়। আর এখন রেঞ্জ বাড়াতে এয়ার-টু-এয়ার রিফুয়েলিং করা হয়। তবে মূল ব্যাপারটা একই রয়েছে; আর তা হলো – ফ্যাক্টরি থেকে বিমানগুলি যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছাবে। যেসব স্থান দিয়ে উড়বে বিমানগুলি, সেসব স্থান নিজেদের অনুকূলে হতে হবে, অর্থাৎ সেসব স্থানে নিজেদের বন্ধু থাকতে হবে। বিভিন্ন স্থানে বিমানবন্দরগুলিতে নিজেদের বিমান ওঠা-নামার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হাজার হাজার বিমান ফেরি করতে হয়েছিল। আর তাই ফেরি রুটগুলিতে স্থাপিত ঘাঁটিগুলিতে পাইলটের স্কোয়াড্রন রাখা হতো। বিমান ল্যান্ডিং-এর পরে পাইলট পরিবর্তন হয়ে আরেক স্কোয়াড্রন বুঝে নিতো বিমান। তারাই পরের ঘাঁটি পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যেত; আর সেখান থেকে পরিবহণ বিমানে করে পাইলটরা নিজেদের ঘাঁটিতে ফেরত আসতো। এভাবে প্রতি ঘাঁটিতে পাইলটদের থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও তেল ভরা এবং অন্যান্য সার্ভিসিং-এর ব্যবস্থা রাখা হতো। এই ঘাঁটিগুলিতে তেল সরবরাহ করাটা আবার আরেক লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বপূর্বে সাইবেরিয়ার ঘাঁটিগুলিতে তেল সরবরাহ ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ; বিশেষ করে শীতকালে, যখন সমুদ্র বরফে ছেয়ে যেতো। পুরো রুটে এয়ার ট্রাফিল কন্ট্রোল এবং কমিউনিকেশন স্থাপনও ছিল জরুরি।



ব্রাজিলের মাটিতে বিমান ঘাঁটি তৈরি করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ব্রাজিল ছিল মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমানের সাপ্লাই চেইন-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র তার কৌশলগত সরঞ্জামের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজ করা জানে। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাটেরিয়ালের সাপ্লাই নিশ্চিত করতে এই পুরো সাপ্লাই চেইন-এরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে ওভারফ্লাইট, বেইসিং রাইটস, রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটি, মেইনটেন্যান্সসহ এই পুরো নেটওয়ার্ক নিজেদের পক্ষে থাকতে হবে। নাহলে দামি দামি খেলনাগুলি শোকেসে স্থান পাবে; কাজে লাগবে না।


যুদ্ধবিমানের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট

বিমান ফেরি করাটা এক ধরনের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট। একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র তার কৌশলগত সরঞ্জামের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজ করা জানে। তার সাপ্লাই চেইন অন্য শক্তির হাতে জিম্মি থাকলে সে কখনোই শক্তিশালী হতে পারে না। রাষ্ট্রের জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাটেরিয়াল আনা-নেওয়ার সাপ্লাই চেইন ম্যানেজ করা শিখতে হবে। জানতে হবে কোথা থেকে ম্যাটেরিয়াল আসছে; কে পৌঁছে দিচ্ছে; কিভাবে পৌঁছে দিচ্ছে; কোন রুটে সেগুলি আসছে; কোন এলাকার উপর দিয়ে উড়ে আসছে সেগুলি; কোথায় অবতরণ করছে; কোথায় রিফুয়েলিং করছে; কোথায় সার্ভিসিং করছে। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাটেরিয়ালের সাপ্লাই নিশ্চিত করতে এই পুরো সাপ্লাই চেইন-এরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে ওভারফ্লাইট, বেইসিং রাইটস, রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটি, মেইনটেন্যান্সসহ এই পুরো নেটওয়ার্ক নিজেদের পক্ষে থাকতে হবে। নাহলে দামি দামি খেলনাগুলি শোকেসে স্থান পাবে; কাজে লাগবে না।

Wednesday 13 June 2018

'সী-বেইস' যেভাবে বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা দিতে পারে

১৩ই জুন ২০১৮

পারস্য উপসাগরে মার্কিন ‘মোবাইল সী-বেইস’ 
  
পারস্য উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর মোবাইল সী-বেস 'হারকিউলিস'-এর উপরে স্পেশাল ফোর্সের Mark-III patrol boat এবং Black Hawk হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে। একটা বেসামরিক বার্জ থেকে অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মাঝে সামরিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়, যা কিনা সাগরের মাঝে যেকোন স্থানে বসানো যায়। মেশিন গান, বিমান-বিধ্বংসী কামান, মর্টার এবং এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল দিয়ে সাজানো হয় এই প্ল্যাটফর্ম। তবে এর সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র ছিল এর এটাক হেলিকপ্টার এবং আর্মড প্যাট্রোল বোটগুলি। 
 

১৯৮৭ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার পারস্য উপসাগরে তেলের জাহাজ চলাচল নিশ্চিত করার ছুতোয় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে। Operation Earnest Will and Operation Prime Chance নামের দু’টা অপারেশনের মাধ্যমে এই সামরিক অবস্থানের কাজ চলে। পারস্য উপসাগরের পানিতে ইরানের ভাসিয়ে দেয়া মাইন থেকে জাহাজগুলিকে রক্ষা করতে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল জর্জ ক্রিস্ট এক নতুন ধরনের পরিকল্পনা দেন। মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ দিয়ে তেলের জাহাজ রক্ষা করা ছাড়াও তিনি আলাদাভাবে পারস্য উপসাগরে হেলিকপ্টার, ছোট বোট এবং স্পেশাল ফোর্সের সেনাদের মোতায়েন করেন। ইরানের ছোট ছোট বোট থেকে জাহাজগুলিকে রক্ষা করতে বড় যুদ্ধজাহাজের চাইতে এই ছোট ফোর্সগুলিই বেশি কার্যকর হবে বলে তিনি মনে করেছিলেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় সৌদি আরব এবং কুয়েত উভয় দেশেই মার্কিন সৈন্যদের না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তাহলে এই ছোট ফোর্স কোথায় থাকবে? এই সুযোগখানা করে দেয় মার্কিন বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি Brown & Root (বর্তমানে Kellogg Brown & Root)। ১৯৬২ সালে Haliburton নামের আরেক কোম্পানি Brown & Root-কে কিনে ফেলে এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি Haliburton নামেই সকলের কাছে পরিচিত ছিল। ২০০৭ সালে কোম্পানি দু’টি আলাদা হয়ে যায়। যাইহোক, এই কোম্পানিটি মার্কিন সরকারকে যুদ্ধের সহায়তা হিসেবে পারস্য উপসাগরে তাদের ব্যবহার করা দু’টা কন্সট্রাকশন বার্জ লিজ দিয়ে দেয়। Hercules এবং Wimbrown VII নামের বার্জ দু’টিকে মার্কিনীরা সমুদ্রের মাঝখানে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। বার্জদু’টিতে লম্বা সময়ের জন্যে মানুষ বসবাসের সুবিধা ছিল। একই সাথে সেখানে হেলিকপ্টার ডেক ছিল এবং যন্ত্রপাতি মেরামতের যথেষ্ট সুবিধা ছিল। Hercules-এর আকৃতি (৪০০ ফুট লম্বা এবং ১৪০ফুট প্রস্থ) ছিল সামরিক ব্যবহারের জন্যে বেশ উপযোগী। Wimbrown VII ছিল একটু ছোট (২৫০ ফুট লম্বা এবং ৭০ ফুট প্রশস্ত)। Wimbrown VII-কে কার্যকর করে তুলতে অবশ্য বেশকিছু কনভার্সন কাজ করতে হয়েছিল। দু’টি বার্জে যথাক্রমে ১৭৭ জন এবং ১৩২ জন সেনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দু’টা বার্জ মিলে মোটামুটি ১৬০ কিঃমিঃ ব্যাসের একটা এলাকা টহল দেবার পরিকল্পনা করা হয়; একেকটা ৮০ কিঃমিঃ করে পাহাড়া দেবে। বার্জগুলি থেকে মোটামুটি ৮০ কিঃমিঃ ব্যাসার্থের মাঝে কাজ করবে হেলিকপ্টার এবং ছোট বোটগুলি। যেহেতু রাত দিন ২৪ ঘন্টাই টহল দিতে হবে, তাই বার্জগুলিকে সমুদ্র পরিবহণের রুটের উপরে রাখা হলো – যাতে দরকার হলে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি হস্তক্ষেপ করা যায়। আর রাতের বেলায় টহল দেবার ব্যবস্থাও করতে হলো। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে ব্যবহৃত রিভারাইন প্যাট্রোল বোট (PBR) নিয়ে আসা হলো এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের AH-6 ছোট এটাক হেলিকপ্টার বসানো হলো এতে। নৌবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স Navy SEALS-এর সাথে ম্যারিন ফোর্সের একটা প্লাটুনও মোতায়েন করা হলো। বার্জগুলিকে ইরানি হামলা থেকে রক্ষা করতে মেটাল প্লেট এবং বালুর বস্তা দিয়ে পরিখার মতো দেয়াল তৈরি করা হলো। Hercules-এর উপরে ব্যবহার করা হয়েছিল ২০ হাজার বালুর বস্তা। এগুলির ভারে নিচু হয়ে যাওয়া বার্জের ডেকের উপরে সমুদ্রের ঢেউএর ঝাপটা লাগতে থাকে। বার্জের ডেকের উপরে সৈন্যদের হাতে দেয়া হলো ১২.৭ মিঃমিঃ মেশিন গান, ৪০মিঃমিঃ MK-19 গ্রেনেড লঞ্চার, TOW ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মিসাইল, ৮১ মিঃমিঃ মর্টার এবং বিমান বিধ্বংসী Stinger মিসাইল। ২৫মিঃমিঃ চেইন গান এবং ২০মিঃমিঃ বিমান-বিধ্বংসী কামানও বসানো হয়েছিল বার্জগুলিতে। জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল থেকে বাঁচতে এন্টি-মিসাইল রাডার রিফ্লেক্টরও স্থাপন করা হয়েছিল। Explosive Ordnance Disposal (EOD) Team-এর কিছু সদস্য ছাড়াও ম্যারিন কোরের একটা কমিউনিকেশন ডিটাচমেন্ট ছিল বার্জগুলিতে, যাদের কাজ ছিল ঐ এলাকায় সকল পক্ষের যোগাযোগের উপর নজরদারি করা।
  
পারস্য উপসাগরে মার্কিন মোবাইল সী-বেইস Wimbrown VIII-এর পাশে স্পেশাল ফোর্সের Mark-III patrol boat দেখা যাচ্ছে। ডান পাশে সী-বেইসের বালুর বস্তার পরিখার মাঝে মেশিন গান, ৮১মিঃমিঃ মর্টার এবং ৪০মিঃমিঃ গ্রেনেড লঞ্চার দেখা যাচ্ছে।


কিছুদিন পরপরই বার্জগুলির স্থান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ৮০কিঃমিঃ ব্যাসার্ধের এলাকায় হেলিকপ্টারগুলি আক্রমণ চালাবে। Mark III প্যাট্রোল বোটগুলি কাজ করবে এই ব্যাসার্ধের মাঝে। আর ৮ কিঃমিঃ ব্যাসার্ধের এলাকায় টহল দেবে Seafox এবং PBR ছোটবোটগুলি। ১৯৮৭ সালের অগাস্টের মাঝেই এই যুদ্ধের কনসেপ্ট দাঁড় করিয়ে ফেলা হয় এবং ওয়াশিংটনে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সামনে তুলে ধরা হয়। এবং এগুলির নামকরণ করা হয় Mobile Sea Base (MSB)। বেশিরভাগ কর্মকর্তাই এই কনসেপ্টকে নিতে পারেননি। তারা যুক্তি দিলেন যে, এই ঘাঁটিগুলি ইরানি নৌ এবং বিমানবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হবে এবং এর উপরে থাকা বিভিন্ন বাহিনীর সেনাদের মাঝে একত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকায় বিশৃংখলার সৃষ্টি হবে। তবে এদের অনেকেই হিসেব করেননি যে, ইরানের বিমান এবং সেনাবাহিনীর বেশিরভাগই সেসময় ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় রয়েছে, এবং এদেরকে এই বার্জগুলির বিরুদ্ধে মোতায়েন সম্ভব হবে না। আর সেসময় ইরানের কাছে জাহাজ-ধ্বংসী মিসাইল তেমন একটা ছিল না। জেনারেল ক্রিস্টের হিসেব ছিল যে, ইরানিরা এই বার্জগুলির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে চলবে। আর এই বার্জের পক্ষে সবচাইতে বড় যুক্তি ছিল টাকার অংকটা। দু’টা বার্জ হারানো অবশ্যই বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধজাহাজ হারানোর মতো হবে না। মার্কিন সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার চেয়ারম্যান জয়েন্ট চীফ আব-স্টাফ এডমিরাল উইলিয়াম ক্রো এই প্রকল্পে সমর্থন দেয়াতে এটা এগিয়ে যায়। এলুমিনিয়ামের তৈরি স্পেশাল ওয়ারফেয়ারের ৬৫ফুট Mark III প্যাট্রোল বোটগুলির ড্রাফট ছিল মাত্র সাড়ে ৫ ফুট; যেকারণে সমুদ্রে অপারেট করতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছিল। কিন্তু মার্কিনীদের কিছু করার ছিল না। কারণ এর কোন বিকল্পও তখন তাদের কাছে ছিল না। এই বোটগুলিকে ৪০মিঃমিঃ কামান, ১২.৭মিঃমিঃ মেশিন গান এবং ৪০মিঃমিঃ গ্রেনেড লঞ্চারে সজ্জিত করার পর ইরানি বোটগুলির বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী একটা প্ল্যাটফর্ম দাঁড়িয়ে যায়। যদিও গতি কমিয়ে ২৫ নটিক্যাল মাইলে আনতে হয়েছিল, তথাপি অস্ত্রের শক্তি বেশি থাকায় সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল তারা। মার্কিন সেনাবাহিনীর ১৬০তম স্পেশাল অপারেশনস এভিয়েশন রেজিমেন্টকে দায়িত্ব দেয়া হয় বার্জগুলিতে হেলিকপ্টার দেবার। রাতের বেলায় অপারেট করার জন্যে হেলিকপ্টারগুলিকে নাইট ভিশন গগলস এবং ফরওয়ার্ড লুকিং ইনফ্রারেড দ্বারা সজ্জিত করা হয়। একেকটা বার্জে ৩টা করে হেলিকপ্টার রাখার ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ প্রায় ৩৫ কিঃমিঃ দক্ষিণে অবস্থান নিয়ে বার্জগুলির নিরাপত্তায় সহায়তা করে।
   
 
পারস্য উপসাগরের মাঝে মোবাইল সী-বেইসে মার্কিন সেনাবাহিনীর OH-58 এটাক হেলিকপ্টার। এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল সজ্জিত এই হেলিকপ্টারগুলি ছিল সী-বেইসের প্রধানতম অস্ত্র। 


AH-6 এটাক হেলিকপ্টার-এর স্থলে পরবর্তীতে মার্কিন সেনাবাহিনীর OH-58 হেলিকপ্টার আনা হয়েছিল। এই হেলিকপ্টারগুলি আরও বড় এবং রাতে চলার জন্যে আরও ভালো ইলেকট্রনিক্স ছিল এতে; অস্ত্রের দিক থেকেও ছিল আরও শক্তিশালী। Hellfire এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল বহন করতো এগুলি। এছাড়াও মার্কিন নৌবাহিনীর ফ্রিগেটগুলি থেকে ওড়া Sea Hawk হেলিকপ্টারগুলির রাডার খুব ভালো থাকায় এগুলি হেলিকপ্টার এবং বোট অপারেশনে বেশ সাহায্য করেছিল। মার্কিন বাহিনীর হাতে ইরানের নৌশক্তির একটা অংশব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের অবসানের পর থেকে সহিংসতা কমতে থাকে, এবং বার্জগুলি ১৯৮৮-এর ডিসেম্বর এবং ১৯৮৯-এর জুলাই-এ Brown & Root –এর কাছে ফেরত দেয়া হয়। এই অপারেশনে নতুন কিছু ব্যাপার নিয়ে আসা হয়; যেমন-

১) Mobile Sea Base (MSB) নামের প্ল্যাটফর্মের কনসেপ্ট নতুন ছিল। মার্কিনীরা ‘ব্রাউন ওয়াটার নেভি’এর কনসেপ্ট-এ অভ্যস্ত হয় ভিয়েতনামে, যেখানে তারা ব্যাপকভাবে ছোট বোট, হেলিকপ্টার এবং মোবাইল বেইজ ব্যবহার করেছিল। সে হিসেবে এই প্ল্যাটফর্ম নতুন কিছু নয়। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহার করা মোবাইল বেইজগুলি তৈরি হয়েছিল নৌবাহিনীর ল্যান্ডিং শিপ-কে কনভার্ট করে। আর এবারে প্রাইভেট কোম্পানির বার্জ ব্যবহার করা হয় মার্কিন সরকারি কাজে।

২) নৌবাহিনীর প্ল্যাটফর্মে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারও অপারেট করেনি কখনও। অন্যাদিকে ম্যারিন কোরের হ্যারিয়ার বিমান এবং হেলিকপ্টার সর্বদাই ব্যবহার করা হয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে।

৩) সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার হলেও সেগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল পুরোপুরি ম্যারিটাইম কাজে। মেশিন গান, কামান, রকেট এবং হেলফায়ার মিসাইল ব্যবহার করা হয় শত্রুপক্ষের নৌবাহিনীকে আক্রমণ করতে। 



মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীর মোবাইল সী-বেইস Tun Azizan । ১০২ মিটার লম্বা এই জাহাজ প্যাট্রোল বোট এবং ওপিভির মতো অনান্য যুদ্ধজাহাজের কমান্ড শিপ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে ৯৯ জনের থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও এর সাপ্লাই, লজিস্টিকস এবং হেলিকপ্টার ফ্যাসিলিটি অন্যান্য ছোট যুদ্ধজাহাজের সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। 


মালয়েশিয়ার ‘সীবেইস’

মালয়েশিয়া সরকার কিছুটা একইরকম কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করছে কয়েক বছর ধরে। ২০১৫-এর জুলাই মাসে Tun Sharifah Rodziah নামের একটা অয়েল রিগ প্ল্যাটফর্মকে নৌবাহিনীর বেইজ হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। বাতিল হয়ে যাওয়া এই প্ল্যাটফর্মটি ছিল মালয়েশিয়ার তেল কোম্পানি পেট্রোনাস-এর। এর আগে একই বছরের মে মাসে Tun Azizan নামের একটি জাহাজকে কনভার্ট করে ফরওয়ার্ড বেইজ হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। পেট্রোনাস মালয়েশিয়ার আশেপাশের সমুদ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই কর্মকান্ডগুলির অর্থায়ন করে। মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাতুক সেরি হিসামুদ্দিন হুসেইন ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশের পূর্বে সুলু সাগরে জঙ্গী তৎপরতার পর এই ‘সী বেইজিং’এর প্রস্তাব করেন। Tun Azizan নামের জাহাজটি ছিল মালয়েশিয়ার শিপিং কোম্পানি Malaysia International Shipping Corporation Berhad (MISC)-এর একটি কার্গো জাহাজ। পেট্রোনাসের অর্থায়নে জাহাজটি Malaysia Marine and Heavy Engineering (MMHE)-এর সহায়তায় কনভার্ট করা হয়। ১০২ মিটার লম্বা জাহাজটিতে ৯৯ জনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইসাথে পানি, তেল, গোলাবারুদ এবং অনান্য সাপ্লাই-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে একটা হেলিকপ্টার ডেক এবং হ্যাঙ্গারও রয়েছে; কমান্ড এবং কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতিও রয়েছে। যেসব জাহাজে হেলিকপ্টার নেই, সেগুলি এই জাহাজ থেকে হেলিকপ্টার সাপোর্ট পায়। আবার ফ্লাইট ডেক থাকা ৯১ মিটার লম্বা Kedah-class ওপিভি-গুলি এই জাহাজের হেলিকপ্টারের সাথে কাজ করে হেলিকপ্টারের সক্ষমতা বাড়ায়। ছোট প্যাট্রোলবোটগুলি একে কেন্দ্র করে অপারেট করতে পারে। এই ছোট বোটগুলি Tun Azizan থেকে লজিস্টিক সাপোর্ট পায় সমুদ্রে বেশি সময় থাকার জন্যে। এগুলির কমান্ড ও হয় বড় জাহাজটি থেকে। এই জাহাজটি থেকে কিছুটা আলাদা হলো Bunga Mas Lima(BM5) এবং Bunga Mas Enam (BM6)। ১৩৩ মিটারের ৯ হাজার টনের এই দু’টি জাহাজকে ২০০৯ সালে ডেভেলপ করা হয় মালয়েশিয়ার উপকূল থেকে দূরে গভীর সমুদ্রে অপারেট করার জন্য। ৭০০ কন্টেইনার বহন ক্ষমতার এই শিপগুলিকে কনভার্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যখন ২০০৮ সালে সোমালিয়ার উপকূলে মালয়েশিয়ার জাহাজ হাইজ্যাক হবার পর সমুদ্রেপথের নিরাপত্তা দিতে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠানো শুরু হয়। জাহাজগুলিতে অতিরিক্ত সেনা বহনের ব্যবস্থা করা ছাড়াও rigid hull inflatable boat এবং হেলিকপ্টার অপারেট করার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজগুলি বেসামরিক লোকেরা চালান; তবে এর মূল শক্তি হলো মালয়েশিয়ান স্পেশাল ফোর্স এবং এর হেলিকপ্টার। সোমালিয়ার উপকূলে KD Sri Inderasakti, KD Mahawangsa এবং KD Sri Inderapura জাহাজগুলি পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। ১৯৮৩ সালে জার্মানি থেকে কেনা KD Sri Inderasakti, KD Mahawangsa জাহজদু’টি ১০০ মিটার লম্বা ৪,৩০০ টনের লজিস্টিক সাপোর্ট জাহাজ, যেগুলি সর্বোচ্চ ৬০০ সৈন্য নিতে পারে, ১০টা কন্টেইনার নিতে পারে এবং বেশকিছু গাড়িও বহন করতে পারে। আর KD Sri Inderapura জাহাজটি মার্কিন নৌবাহিনীর উভচর Newport-class LST জাহাজ ছিল, যা ২০০৯ সালে আগুনে পুরে বাতিল হয়ে যায়। মেইনটেন্যান্স এবং অনান্য মিশনের চাপে জাহাজ সংকটে Bunga Mas Lima (BM5) এবং Bunga Mas Enam (BM6) জাহাজকে কনভার্ট করা হয়।তাছাড়া উপরে তিনটি জাহাজের একটাতেও হেলিকপ্টার হ্যাঙ্গার নেই, যা ছাড়া বাজে আবহাওয়ায় হেলিকপ্টার মেইন্টেন্যান্স সম্ভব নয়। তাই নতুন কনভার্ট করা জাহাজগুলিতে হ্যাঙ্গার স্থাপন করা হয়। বর্তমানে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীতে লজিস্টিক সাপোর্ট দেবার মতো পাঁচটা জাহাজ আছে, যেগুলির প্রত্যেকটিরই যুদ্ধ করার সক্ষমতা রয়েছে - KD Sri Inderasakti, KD Mahawangsa, Bunga Mas Lima (BM5), Bunga Mas Enam (BM6) এবং Tun Azizan ।এই প্রত্যেকটা জাহাজই হেলিকপ্টার সাপোর্ট করতে পারে।প্রত্যেকটা জাহাজেই কমান্ড-কন্ট্রোলের ফ্যাসিলিটি রয়েছে এবং এগুলিকে কেন্দ্র করে অনান্য যুদ্ধজাহাজ অপারেট করতে পারে। এগুলি মোবাইল সী-বেইস হিসেবে কাজ করছে।
 
মালয়েশিয়ার সী-বেইস Tun Sharifah Rodziah নতুন এক চিন্তার ফসল। পেট্রোনাসের পুরোনো অয়েল রিগ প্ল্যাটফর্ম এখন হেলিকপ্টার, প্যাট্রোল বোট এবং সৈন্যদের ঘাঁটি। গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটের নিরাপত্তা দিতে এধরনের প্ল্যাটফর্ম নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।


তবে Tun Sharifah Rodziah নামের প্ল্যাটফর্মটা সত্যিই আলাদা। পারস্য উপসাগরে মার্কিন অপারেশনের সাথে এই প্ল্যাটফর্মের কিছু মিল রয়েছে। এটাকে তার স্থান থেকে সরানো যায় ঠিকই, তবে এর নিজের চলার ক্ষমতা নেই। একে মোটামুটিভাবে অস্থায়ী বেইস হিসবে ব্যবহার করা যায়; যা উপকূল থেকে দূরে গুরুত্বপূর্ণ শিপিং রুট বা স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা দিতে পারে। এতে সেনাদের থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও কমান্ড-কন্ট্রোল, কমিউনিকেন্স, সার্ভেইল্যান্স এবং লজিস্টিক্যাল সাপোর্টের ব্যবস্থা রয়েছে। মালয়েশিয়ার সেনাবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ম্যারিন পুলিশ-সহ বিভিন্ন এজেন্সি এই ঘাঁটি ব্যবহার করে। ২৪ ঘন্টা সার্ভেইল্যান্সের মাধ্যমে সমুদ্রে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। কিছু ইন্টারসেপ্টর বোট এই বেইস-এ থাকে, যেগুলি যেকোন সময় দরকারমতো পাঠানো হয়। গভীর সমুদ্রে এরকম বেইস ছাড়া এই ছোট বোটগুলি মোতায়েন করা কঠিন। মালয়েশিয়ান নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল দাতুক সেরি আহমাদ কামরুলজামান আহমাদ বদরুদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে গিয়েই সুযোগ হাজির হয়েছে, যা তারা কাজে লাগিয়েছেন। সুলু সাগরে জঙ্গি সংগঠনের আবির্ভাব না হলে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী হয়তো এমন প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতো না। তবে এখন সমুদ্র অনেক নিরাপদ করা যাচ্ছে।
  

বাংলাদেশের উপকূলে জেগে উঠছে নতুন নতুন অনেক দ্বীপ। এসব দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে যাচ্ছে নতুন এক অর্থনীতি। এসব দ্বীপ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের মাঝে স্ট্র্যাটেজিক স্থাপনা, মাছের ক্ষেত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলির নিরাপত্তা এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়ার সী-বেইসগুলি বাংলাদেশের সমুদ্র নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।




বাংলাদেশ তার সমুদ্র সম্পদকে রক্ষায় যা করতে পারে…

পারস্য উপসাগরে মার্কিন অভিজ্ঞতা এবং মালয়েশিয়ার সুলু সাগরের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্যে চমৎকার উদাহরণ হতে পারে। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে সী-বেইস-এর অবতারণা করতে পারে। এর সপক্ষে কিছু শক্তিশালী দিক রয়েছে।

প্রথমতঃ বঙ্গোপসাগরে নতুন নতুন দ্বীপের আবির্ভাব হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই দ্বীপগুলির নিরাপত্তা খুব শিগগিরই ব্যবস্থা করা জরুরি। নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের প্যাট্রোল বোটগুলিকে সমুদ্রে বেশি সময়ের জন্য অপারেট করার একটা পদ্ধতি হতে পারে এ ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলি।

দ্বিতীয়তঃ বঙ্গোপসাগরে অতি গুরুত্বপূর্ণ কুতুবদিয়া আউটার এঙ্করেজ ছাড়াও নতুন নতুন অনেক স্ট্র্যাটেজিক স্থাপনা বসানো হচ্ছে, যেমন – মাতারবাড়ি ডীপ সী পোর্ট, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল, ইত্যাদি। এর বাইরেও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস আহরণের জন্যে চেষ্টা চলছে, যেগুলির সাথে বিভিন্ন স্থায়ী স্থাপনা লাগবে। সী-বেইসের মাধ্যমে মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের এই স্থাপনাগুলির ২৪ ঘন্টা নিরাপত্তা দেয়া সহজ হবে।

তৃতীয়তঃ বাংলাদেশের বাণিজ্যের ৯০%-এর বেশি সমুদ্রপথে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার ভেতরে সী-বেইস স্থাপনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র রুটের ২৪ ঘন্টা নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হতে পারে।

চতুর্থতঃ বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার নিরাপত্তা প্রদানে সক্ষমতা বাড়াতে সী-বেইস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। বিপদে পড়া মাছ ধরার ট্রলারগুলিকেও সহায়তা দেয়া সহজ হতে পারে।



মে ২০১৭ - বাংলাদেশ নৌবাহিনী যুদ্ধজাহাজ বিএনএস স্বাধীনতা মালয়েশিয়ার লুমুত নৌঘাঁটিতে। মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গোপসাগর এবং মালয়েশিয়ার পূর্বের সুলু সাগরের নৌ-নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা যায়। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার কাছে প্রস্তাব রাখতে পারে, যাতে মালয়েশিয়ার সী-বেইস প্ল্যাটফর্মের সাথে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর একজন অফিসার, অথবা একটা নাবিকের গ্রুপ, অথবা একটা ছোট যুদ্ধজাহাজ, অথবা একাধিক যুদ্ধজাহাজ এটাচ করা যায়। শেষোক্ত (যুদ্ধজাহাজ) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার পূর্বের সুলু সাগরে নিরাপত্তা দেবার জন্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এসেট অফার করতে পারে। এতে সুলু সাগরের নিরাপত্তা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতার নতুন দুয়ার খুলে যাবে। একইসাথে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশের সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা নতুন এক মাত্রা পাবে।


বাংলাদেশের কাছে মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হবে; কারণ এই মুহুর্তে মালয়েশিয়া বিভিন্ন প্রকারের সী-বেইস অপারেট করছে। তারা কার্গো শিপ থেকে কনভার্ট করা লজিস্টিক জাহাজ যেমন অপারেট করছে, তেমনি অয়েল রিগ থেকে কনভার্ট করা প্ল্যাটফর্মও অপারেট করছে। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার কাছে প্রস্তাব রাখতে পারে, যাতে এই জাহাজ এবং প্ল্যাটফর্মের সাথে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর কিছু এলিমেন্টকে এটাচ করা যায়। এই এলিমেন্ট হতে পারে একজন অফিসার, একটা নাবিকের গ্রুপ, একটা ছোট যুদ্ধজাহাজ, অথবা একাধিক যুদ্ধজাহাজ। শেষোক্ত (যুদ্ধজাহাজ) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার পূর্বের সুলু সাগরে নিরাপত্তা দেবার জন্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এসেট অফার করতে পারে। এতে সুলু সাগরের নিরাপত্তা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতার নতুন দুয়ার খুলে যাবে। একইসাথে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশের সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা নতুন এক মাত্রা পাবে।


আরও পড়ুনঃ
"সী-বেইসিং" - সমুদ্রেই ঘাঁটি!