Saturday 3 September 2022

যুক্তরাষ্ট্র কেন তাইওয়ানকে নতুন করে আরও অস্ত্র দিচ্ছে?

০৩রা সেপ্টেম্বর ২০২২
 
মার্কিন নির্মিত 'এজিএম-৮৪ হারপুন' জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; যা কিনা তাইওয়ানকে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন চীনা পণ্যের উপর শুল্ক আরোপের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিকে সমুন্নত রাখলেও কঠিন সরবরাহ পরিস্থিতির মাঝেও তাইওয়ানকে অস্ত্র সরবরাহের নীতিতে অটল থাকার সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের ব্যাপারে অর্থনৈতিক অবরোধ নয়, বরং সামরিক পদক্ষেপকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে; যা কিনা সামনের দিনগুলিতে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

২রা সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে নতুন করে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি কোঅপারেশন এজেন্সি’ বলছে যে, নতুন অস্ত্রের প্যাকেজের মাঝে রয়েছে ৬’শ ৫৫ মিলিয়ন ডলারের ‘রাডার ওয়ার্নিং সিস্টেম’, ৩’শ ৫৫ মিলিয়ন ডলারের ৬০টা ‘এজিএম-৮৪এল হারপুন’ জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৮৬ মিলিয়ন ডলারের ১’শটা ‘সাইডওয়াইন্ডার’ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয় যে, এই অস্ত্র বিক্রি তাইওয়ানের নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী নীতির মাঝেই পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণার সাথেসাথে চীন সরকার তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। ৩রা সেপ্টেম্বর এক টুইটার বার্তায় ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংগিউ বলেন যে, চীনারা তাইওয়ানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির ঘোর বিরোধী এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্কের মারাত্মক অবণতি হওয়া ছাড়াও তাইওয়ান প্রণালিতে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। বার্তায় তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলে আখ্যা দিয়ে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলাচ্ছে। এর ফলে তা চীনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এতে তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামীদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। লিউ পেংগিউ যুক্তরাষ্ট্রকে ‘এক চীন নীতি’র প্রতিশ্রুতি ধরে রাখার আহ্বান জানান। তিনি বার্তায় এও বলেন যে, চীন অটলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের আইনগত ও অতি প্রয়োজনীয় প্রত্যুত্তর দেবে। অপরদিকে তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং তাইওয়ানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে চীনের একতরফা উস্কানিমূলক সামরিক কর্মকান্ড এবং স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের মুখে তাইওয়ান নিজেকে রক্ষা করতে প্রস্তুত রয়েছে।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনের এই কর্মকান্ড হঠাত করেই ঘটেনি। অগাস্ট মাসে মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান ভ্রমণ করে এসেছেন; যে সময় থেকে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পেলোসির সফরের আগেই চীন যুক্তরাষ্ট্রকে এই সফরের ব্যাপারে সাবধান করেছিল এবং পেলোসির সফরের পর বেশ কিছুদিন ধরেই চীনারা তাইওয়ানের আশেপাশে ব্যাপক সামরিক মহড়া চালিয়েছে। পেলোসির সফরের পরপর আরও ক’জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নর তাইওয়ান সফর করেছেন; যেগুলির প্রত্যেকটার ব্যাপারেই চীন নিন্দা জানিয়েছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, চীনারা এই সফরগুলিকে কেন্দ্র করে যেসব সামরিক কর্মকান্ড চালিয়েছে, তা ছিল নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।

‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তাইওয়ানকে এবারে যেসকল অস্ত্র দেয়ার অঙ্গীকার করা হলো, তা প্রকৃতপক্ষে বহু আগেই তাইওয়ানের পক্ষে থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের পর থেকে তাইওয়ানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ১৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির কথা বললেও সেগুলির মাঝে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি অস্ত্র এখনও আটকে রয়েছে। এর মাঝে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর কারণে অনেক অস্ত্রই তাইওয়ানের কাছে না গিয়ে ইউক্রেনে গিয়েছে। আটকে থাকা অস্ত্রের মাঝে রয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ৬৬টা ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান, ৬’শ ২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ‘প্যাট্রিয়ট’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার খুচর যন্ত্রাংশ, ২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ‘হারপুন’ জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ‘স্ট্যান্ডঅফ ল্যান্ড এটাক মিলাইল, এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ’। এছাড়াও রয়েছে ‘স্টিংগার’ ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, ‘হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম’ বা ‘হিমারস’, ‘পালাদিন’ হাউইটজার আর্টিলারি, ‘এমএস ১১০’ আকাশ থেকে গোয়েন্দা তথ্য যোগাড়ের প্রযুক্তি, এবং সেনাবাহিনীর জন্যে কিছু যোগাযোগ প্রযুক্তি। যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ান বিজনেস কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট রুপার্ট হ্যামন্ড চ্যাম্বার্স বলছেন যে, আটকে থাকা অস্ত্রের সরবরাহের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের প্রকৃতপক্ষে তেমন কিছুই করার নেই। কারণ এখানে মূল সমস্যা হলো আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনের সমস্যা। বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মাইক ম্যাককাউল বলছেন যে, সেমিকন্ডাক্টরের ঘাটতি ছাড়াও সরকারি লালফিতা ও উৎপাদনের চাহিদার সমস্যা রয়েছে; যেগুলি সমাধান করা মোটেই সহজ হবে না। শুধু তাইওয়ান নয়; জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের জন্যে অর্ডার করা অনেক অস্ত্রও ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের কিছু দেশ ‘এফ-১৬’ বিমান অর্ডারের ক্ষেত্রে তাইওয়ানের চাইতে এগিয়ে আছে; তাই তাইওয়ানের বিমানগুলির ডেলিভারি ২০২৬ সালের আগে শুরু হচ্ছে না।

‘বিবিসি’ বলছে যে, অস্ত্র বিক্রির সাথে আরও যুক্ত হয়েছে চীনা পণ্যের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দেবার জন্যে অতিরিক্ত শুল্ক, যা কিনা ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সময় আরোপ করা হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসন এখন ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্ককে আরও চাপের মাঝে ফেলবে।

‘বিবিসি’ আরও বলছে যে, জো বাইডেনের প্রশাসন নতুন করে ইউক্রেনের কাছে ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করার প্রস্তাব কংগ্রেসে পেশ করেছে। আর ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ১৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে। এই বাস্তবতায় মার্কিন অস্ত্রের ক্রেতাদের মাঝে অর্ডারের ক্রম এবং সরবরাহ চেইনের সমস্যা, বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহের মারাত্মক ঘাটতি সত্ত্বেও তাইওয়ানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার নীতি বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে রাজি নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের বাজারে অস্থিরতা, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং এর ফলশ্রুতিতে ব্যাপক সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে উপেক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধির নীতিতে এগুচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার জন্যে চীনের সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের ব্যাপারে আরও আগ্রাসী নীতিতে এগুতে আগ্রহী করেছে। বাইডেন প্রশাসন চীনা পণ্যের উপর শুল্ক আরোপের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিকে সমুন্নত রাখলেও কঠিন সরবরাহ পরিস্থিতির মাঝেও তাইওয়ানকে অস্ত্র সরবরাহের নীতিতে অটল থাকার সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের ব্যাপারে অর্থনৈতিক অবরোধ নয়, বরং সামরিক পদক্ষেপকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে; যা কিনা সামনের দিনগুলিতে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment