Tuesday 31 July 2018

একটা বিমান বাহিনী কিভাবে তৈরি হয়?

হিটলার ইয়ুথ-এর ছেলেরা বিমানের মডেল বহন করছে। জার্মানিতে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে পাইলট ট্রেনিং-এর এক বিরাট প্রকল্প নেয়া হয়, যার নেতৃত্ব দেয় হিটলার ইয়ুথ-এর ফ্লাইং ডিভিশন। এদের ট্রেনিং-এর কারণে পরবর্তীতে খুব তাড়াতাড়ি জার্মান বিমান বাহিনীর ভিত গড়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। 
০১ অগাস্ট ২০১৮




একটা বিমান বাহিনী তৈরি হয় তিনটা জিনিসের যোগসূত্রে – ম্যান, মেশিন এবং ডকট্রাইন। রাষ্ট্রের বিমান বাহিনী এই তিনের সমন্বয় ঘটাবে সেই রাষ্ট্রের চিন্তার উপরে ভিত্তি করে। এই পুরো ব্যাপারটার সবচাইতে ভালো উদাহরণ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কয়েকটা বিমান বাহিনীর ভিত কি করে গঠন করা হয়েছিল, তা আলোচনায় আনা যেতে পারে।

পাইলট ট্রেনিং-এর ভিত গড়ে দেয়া হয় যেভাবে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অনেক আগ থেকেই জার্মানরা অল্প বয়সের ছেলেদের (১৪ বছর থেকে শুরু) মাঝে আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা দিতে থাকে। ১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার ক্ষমতায় আসীন হবার পর নাজি পার্টির ‘হিটলার ইয়ুথ’ উইং-কে আরও শক্তিশালী করা হয়। হিটলার ইয়ুথের একটা ফ্লাইং ডিভিশন তৈরি করা হয়, যারা অল্প বয়সের ছেলের রিক্রুট করে গ্লাইডার ডিজাইন ও তৈরি করা এবং গ্লাইডারের মাধ্যমে ফ্লাইং ট্রেনিং দিতো (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির কোন বিমান বাহিনী রাখা নিষেধ ছিল, কিন্তু গ্লাইডারের ব্যাপারে কোন নিষেধ ছিল না) এবং বেসিক এরোনটিক্যাল ট্রেনিং-ও দিতো। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সারা জার্মানি জুড়ে বহু গ্লাইডার ক্লাব গড়ে ওঠে। ১৯৩২ সালে নাজি পার্টিরও একটা ফ্লাইং কোর (ন্যাশনাল সোশালিস্ট ফ্লাইং কোর বা এনএসএফকে) তৈরি করা হয়। ১৯৩৫ সালে হিটলার অফিশিয়ালি ভার্সাই চুক্তির অবমাননা করে জার্মান বিমান বাহিনী বা লুফতওয়াফে-এর গোড়াপত্তনের ঘোষণা দেবার সময় জার্মানদের কাছে ইতোমধ্যেই অনেক যুবকের একটা পুল রেডি হয়ে ছিল, যাদের বেশ সহজেই ট্রেনিং-এ নিয়ে নেয়া যেতো। পাইলট ট্রেনিং-এর সময় কমে গিয়েছিল তাদের।এনএসএফকেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করে অল্প বয়সের ছেলের মাঝেফ্লাইং-এর একটা সংস্কৃতি তৈরি করার উদ্দেশ্যে, যেমন – বিমানের মডেলের ফ্লাইট প্রতিযোগিতা (যাদের বয়স একটু কম ছিল), গ্লাইডার ফ্লাইটের প্রতিযোগিতা (যাদের বয়স একটু বেশি ছিল), ইত্যাদি। ‘ফ্লাইং ডে’ নামের কিছু ইভেন্টও চলতো। ১৯৩৬ সালের এরকম এক ইভেন্টে ১,৫৫০ জন ছেলে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রতিযোগিতাতে দেখা হতো যে কার তৈরি মডেল বিমান কতদূর পর্যন্ত উড়তে পারে। এদের অনেককেই লুফতওয়াফের বিমান তৈরির কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়; অনেককে বিমান বাহিনীর বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা দেয়া হয়।এনএসএফকে-এর কার্যকলাপের কারণে জার্মানি যখন ১৯৪০ সালে ব্রিটেনের সাথে আকাশযুদ্ধে (ব্যাটল অব ব্রিটেন) অবতীর্ণ হয়, তখন জার্মানদের ভালো পাইলটের অভাব হয়নি।
   
  
 
জার্মান বিমান বাহিনীর ডাইভ বম্বার জুঙ্কার্স-৮৭ 'স্টুকা'। এধরনের বিমান শুধু জার্মানরাই তৈরি করেছিল। জার্মান বিমান বাহিনীর ডকট্রাইন ছিল সেনাবাহিনীকে সহায়তা দেয়া, যাতে সেনাবাহিনী ভার্সাই চুক্তির প্রতিশোধ নিয়ে সারা ইউরোপ দখল করতে পারে। একারণে জার্মান বিমানগুলি ছিল স্বল্প পাল্লার এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা।  

বিমান বাহিনীর দাপ্তরিক ভিত (ডকট্রাইন)

১৯৩৩ সালের মার্চে হিটলার ‘এয়ার মিনিস্ট্রি’ গঠন করে হেরমান গোরিং-কে এর দায়িত্বে দেন; তার ডেপুটি করা হয় এরহার্ড মিলচ-কে। গোরিং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বিমান বাহিনীর প্রথিতযশা পাইলট ছিলেন। এয়ার মিনিস্ট্রির মূল কাজ ছিল জার্মান বিমান বাহিনীর প্রতিষ্ঠা এবং এর জন্যে দরকারি সকলকিছু করা। নতুন বিমান ডিজাইন এবং তৈরি করার দায়িত্বও ছিল এই মিনিস্ট্রির। সকল বিমানের ডিজাইন করা হয়েছিল বেসামরিক বিমানের নাম করে।

এখানে ডকট্রাইনাল কিছু ব্যাপার আলোচনা না করলেই নয়।

- জার্মান বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ লোক এসেছিল সেনাবাহিনী থেকে। তাই তাদের চিন্তায় সেনাবাহিনীর সহায়তাটা ছিল প্রবল। জার্মান বিমানগুলি ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের সহায়ক মাত্র। জার্মানরা দুই ইঞ্জিনের উপরে বিমান তেমন একটা তৈরি করতো না, যেগুলি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেশি ভেতরে বোমা ফেলার জন্যে যেতো না। এর পেছনে মূল চিন্তাটা ছিল ভার্সাই চুক্তির প্রতিশোধ নেয়া এবং সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুরো ইউরোপ দখল করে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিধর জাতি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। ইউরোপের পুরো স্থলভাগের কর্তৃত্ব নেয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

- অপরদিকে ব্রিটিশ-মার্কিনিরা স্ট্রাটেজিক বম্বিং নিয়ে চিন্তা করেছিলো। তারা কয়েক হাজার মাইল দূরে জার্মান অর্থনৈতিক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটে বোমা ফেলার উদ্দেশ্যে বিমান ডিজাইন করেছিল। তাই তাদের ল্যাঙ্কাসটার, স্টার্লিং, বি-১৭, বি-২৪ বোমারু বিমানগুলি ছিল চার ইঞ্জিনের এবং অনেক বড়; তাদের পি-৫১, পি-৪৭ ও পি-৩৮ ফাইটারগুলিকেও বেশি তেল বহণ করে বোমারু বিমানের সাথে বহুদূর যাবার জন্যে ডিজাইন করা হয়েছিল।

- তবে ব্রিটিশ-মার্কিন এই ডকট্রাইন ১৯৪১ সালের পরে কার্যকারিতা পেয়েছিল। অন্যদিকে জার্মানরা যুদ্ধ শুরুর আগেই তাদের ডকট্রাইন তৈরি করে ফেলেছিল এবং তাদের বিমানগুলি সেভাবেই ডিজাইন করেছিল।

- জার্মান বিমান বাহিনীর মেশারস্মিট-১০৯ ও ফকে-উলফ-১৯০ ফাইটার এবং হাইঙ্কেল-১১১, জুঙ্কার্স-৮৮ ও ডর্নিয়ার-১৭ বম্বারগুলি ছিল স্বল্প-পাল্লার। তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিমান ছিল জুঙ্কার্স-৮৭ ‘স্টুকা’, যা ডাইভ-বম্বিং-এর জন্যে ব্যবহৃত হতো। মিত্রবাহিনীর এমন কোন বিমানই ছিল না।

- ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সে আবার ‘ডে হাভিলান্ড মসকিটো’ এবং ‘ব্রিস্টল বিউফাইটার’এর মতো দুই ইঞ্জিনের বিমানকে দ্রুতগামী বোমারু বিমান হিসেবে ব্যবহার করেছিলো, যা কিনা নিচু দিয়ে উড়ে টার্গেটের উপরে হামলা করতো। দ্রুত সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বোমা ফেলে দ্রুত প্রস্থান করাই ছিল এগুলির কাজ। কাজটা ছিল চোরাগুপ্তা ধরনের। 
  

মার্কিন বিমান বাহিনীর বি-১৭ স্ট্র্যাটেজিক বম্বার। মার্কিন ডকট্রাইন ছিল দূরপাল্লার ভারী বোমারু বিমানের সাহায্যে জার্মান অর্থনৈতিক এবং শিল্পের কাঠামোকে ধ্বংস করা, যাতে করে যুদ্ধ শেষে দুনিয়ার ক্ষমতায় পশ্চিমাদের হাতেই থেকে যায়। 



- আবার ব্রিটিশ বিমান বাহিনী জার্মানিতে বোমা ফেলতো রাতের বেলা; কোন ফাইটার এসকর্ট ছাড়া। অন্যদিকে আমেরিকানরা দিনের বেলায় বোমা ফেলতো ফাইটার এসকর্ট সহ। দিনের বেলায় বোমা ফেলতে যে শক্তির দরকার, তা রয়াল এয়ার ফোর্স যোগাড় করতে পারেনি। তাই তারা রাতের অন্ধকারের আড়ালেই কাজ করতে চেয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকানরা যেহেতু নতুন সুপারপাওয়ার হবার পথে, তাই তারা দিনের বেলায় শক্তি প্রদর্শনের দিকেই বেশি আগ্রহী ছিল।

- সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল ৩৬ হাজার ইলিউশিন-২/ইলিউশিন-১০ ‘স্টুরমোভিক’ ট্যাঙ্ক ডেস্ট্রয়ার, যা জার্মান আর্মার্ড ফর্মেশনকে যুদ্ধক্ষেত্রে হারাবার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। বিশাল স্থলবাহিনী ব্যবহার করেই তার পূর্ব ইউরোপসহ জার্মানি নিজেদের দখলে নিয়ে সেখানে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করেছিল।

- জাপানি মিতসুবিসি এ৪এম, জি৪এম, জি৩এম এবং অন্যান্য বেশিরভাগ বিমান ছিল হাল্কা গড়নের, তবে যেন প্রচুর তেল নিতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলির দূরত্বকে মাথায় রেখে এগুলি ডিজাইন করা হয়েছিল। তাই এগুলি হাল্কা অস্ত্র বহণ করতো এবং তেমন একটা গুলি হজম করতে পারতো না। তবে সিঙ্গাপুরের কাছে রয়াল নেভির দুইটা ব্যাটলশিপকে জাপানি বিমান যখন ডুবিয়ে দেয়, তখন জাপানিদের দূর-পাল্লার বিমান বানাবার ডকট্রাইনের সাফল্যই কিন্তু সামনে আসছিলো। তবে সেটা পরবর্তীতে আরও শক্তিশালী মার্কিন বিমানের সামনে ভস্ম হয়ে যায়।

- জার্মান বিমান বাহিনী এবং সোভিয়েত বিমান বাহিনী তৈরি হয়েছিলো যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে জেতানোর জন্যে। জাপানি বিমানগুলিকে ডিজাইন করা হয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের কৌশলগত খনিজগুলিকে আয়ত্বে আনার চিন্তা থেকে। অন্যদিকে ব্রিটিশ-মার্কিন বিমান বাহিনী তৈরি হয়েছিল জার্মানির অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিকে পঙ্গু করে দেবার জন্যে, যাতে পরবর্তীতে বিশ্ব-কর্তৃত্ব পশ্চিমাদের হাতেই থাকে। আর ব্রিটিশ-মার্কিনীদের পার্থক্য ছিল দিবা-রাত্রে। আমেরিকানরা দিনের আলোতে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে জানিয়ে দিল যে ব্রিটিশদের আজ যুদ্ধ জিততে রাতের অন্ধকারের আশ্রয় লাগে; কারণ ব্রিটিশ সামাজ্যে আজ আর সূর্য ওঠেনা! সূর্য এখন আমেরিকানদের!

বিশ্বযুদ্ধের মাঝে বিমান বাহিনীগুলির ভিত গড়তে গিয়ে এই ডকট্রাইন ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রগুলি তাদের চিন্তাকে এই ডকট্রাইনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। যার চিন্তা যেমন হবে, তার বিমানের ডিজাইনও তেমনই হবে। আর তার পাইলটদের ট্রেনিং-ও তেমনই হবে।

জার্মান বিমান বাহিনীর ট্রেনিং প্রসেস

যুদ্ধেরপ্রথম কয়েক বছরে (১৯৪২-এর আগ পর্যন্ত) জার্মান পাইলটদের ট্রেনিং ছিল নিম্নরূপ-

- ৬ মাসের জন্যে রিক্রুট ট্রেনিং ডিপো (ফ্লিজার এরসাতজ আবটাইলুং)-এ পাঠানো হতো। অনান্য বিমান বাহিনীর বুট-ক্যাম্পের মতো এটা। এখানে শারীরিকভাবে প্রস্তুত করা ছাড়াও আকাশযুদ্ধের উপরে কিছু লেকচার দেয়া হতো।

- এরপর দুই মাসের জন্যে পাইলটদের ‘ফ্লুগান ওয়ার্টার কোম্পানি’ নামের ইউনিটে পাঠানো হতো, যেখানে সাধারণ এরোনটিক্যাল বিষয়ের উপরে শেখানো হতো।

- এরপর পাইলটদের প্রাথমিক বা এলিমেন্টারি ফ্লাইং স্কুল (এ/বি শুলে)-এ পাঠানো হতো, যেখানে ক্লেম-৩৫, ফকে উলফ-৪৪ এবং বুকার-১৩১ প্রশিক্ষণ বিমানে ওড়া শেখানো হতো। এরোডাইনামিক্স, এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, এলিমেন্টারি ন্যাভিগেশন, মিটিওরোলজি, ফ্লাইং প্রসিজার এবং মোর্স রিসিভিং-এর উপরে ট্রেনিং নেবার পরে ‘এ২’ লাইসেন্স দেয়া হতো।

- আর ‘বি’ লাইসেন্স পাবার জন্যে পাইলটদের হাইয়ার পার্ফরমেন্স বিমানে যেমন – আরাদো-৬৬, গোথা-১৪৫, আরাদো-৭৬, জুঙ্কার ডব্লিউ-৩৩ ও ডব্লিউ-৪৪ ভারি বিমান, দুই ইঞ্জিনের ফকে উলফ এফডব্লিউ-৫৮ অথবা পুরোনো বিমান, যেমন হাইঙ্কেল-৫১, আরাদো-৬৫ বা হেনশেল-১২৩ বিমানে ট্রেনিং দেয়ার জন্যে পাঠানো হতো। ১০০ থেকে ১৫০ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতার পর ‘বি-২’ ট্রেনিং শেষে পাইলটদের পাইলটস লাইসেন্স এবং পাইলটস উইং দেয়া হতো।

- ফাইটার এবং ডাইভ বম্বার ট্রেনিং-এর জন্যে এই লাইসেন্স পাবার পর ঐ স্পেশালিস্ট ইউনিটে পাঠানো হতো। দুই ইঞ্জিনের

- ফাইটার, বম্বার এবং রেকনাইসেন্স বিমানে ট্রেনিং-এর জন্যেও আলাদা স্পেশালিস্ট ইউনিটে পাঠানো হতো। এসব স্কুলে ছয় মাসের ট্রেনিং-এ ৫০ থেকে ৬০ ঘন্টা ওড়ার পরে ‘সি’ বা এডভান্সড পাইলটস লাইসেন্স দেয়া হতো। বম্বার পাইলটদের অপারেশনাল বিমানের পুরোনো ভার্সনে (হাইঙ্কেল-১১১, জুঙ্কার্স-৫২, জুঙ্কার্স-৮৬, ডর্নিয়ার-১৭) ট্রেনিং দেয়া হতো। এই ট্রেনিং শেষে পাইলটরা দিনে বা রাতে মোটামুটি দক্ষতার সাথে বিমান চালাতে পারতো, ইন্সট্রুমেন্ট ফ্লাইং-এ অল্প কিছু ট্রেনিং হতো তার এবং ভালো আবহাওয়ায় সিম্পল ক্রস-কান্ট্রি ন্যাভিগেশন ফ্লাইট চালাতে পারতো।

- ‘সি’ স্কুলের পরে দুই ইঞ্জিনের ফাইটার পাইলটদের স্পেশালিস্ট ইউনিটে পাঠানো হতো এবং বাকিরা বম্বার ও রেকনাইস্যান্স ইউনিটে যেতো, যেখানে আরও ৫০ থেক ৬০ ঘন্টা ওড়ার প্রশিক্ষণ পেতো সে। স্পেশালিস্ট ট্রেনিং-এ লেটেস্ট ডিজাইনের বিমানে কম্বাইন্ড ক্রু ট্রেনিং দেয়া হতো এবংরাতের বেলায় ও খারাপ আবহাওয়ায় ন্যাভিগেশন ট্রেনিং-এ বেশি গুরুত্ব নিয়ে শিক্ষা পেতো।

- স্পেশালিস্ট ট্রেনিং-এর পর ক্রুরা একত্রেই থাকতো এবং একত্রে তাদের কোন অপারেশনাল ইউনিটে পাঠানো হতো। কিছু পাইলটকে অবজার্ভার ট্রেনিং-এ আরও নয় মাসের জন্যে পাঠানো হতো, যেখানে তারা ব্লাইন্ড ফ্লাইং এবং ন্যাভিগেশনে আরও স্পেশালিস্ট হয়ে উঠতো। এরা বোমারু বিমান বা রেকনাইস্যান্স বিমানের ক্যাপ্টেন হতো। যুদ্ধের মাঝে ১৯৪২ সালের পর থেকে অবজার্ভার ট্রেনিং-এর গুরুত্ব কমতে কমতে ১৯৪৪ সাল নাগাদ ৫ মাসের ট্রেনিং-এ এসে ঠেকে।

- স্পেশালিস্ট ট্রেনিং শেষে পাইলটদের বিভিন্ন অপারেশনাল গ্রুপের অধীনে অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে (এরগেনজুং সাইনহাইটেন) দেয়া হতো। এখানে তারা ঐ ইউনিটের অপারেশনাল ট্যাকটিক্যাল মেথডগুলি শিখতো।



প্রথম দিন থেকে এই অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে আসতে একজন ফাইটার বা ডাইভ বম্বার পাইলটের ১৩ মাসের মতো সময় লাগতো, যার মাঝে তার ১০০ থেকে ১৫০ ঘন্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা হতো। আর বম্বার ও রেকনাইস্যান্স পাইলটের লাগতো ২০ মাস সময়, যার মাঝে তার ২২০ থেকে ২৭০ ঘন্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা লাগতো। ১৯৪২ সালের আগ পর্যন্ত লুফতওয়াফের এই ট্রেনিং প্রসেসই ছিল। ১৯৪২ সাল থেকে সোভিয়েত ফ্রন্টের চাপে পুরো ট্রেনিং প্রসেসই ভেঙ্গে পড়ে।
   
  
জার্মান বিমান বাহিনীর সেরা পাইলটের অভাব ছিল না। বহু পাইলটের নামের পাশে প্রচুর 'কিল' যোগ হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল - যুদ্ধের শুরুতে জার্মান বিমান বাহিনীর ট্রেনিং এবং বিমানের মান অপেক্ষাকৃত ভালো থাকা এবং সুনির্দিষ্ট ডকট্রাইন অনুযায়ী অপারেট করা। জার্মানরা অনেক আগ থেকেই তাদের ট্রেনিং অপারেশন চালাবার ফলে যুদ্ধের শুরুর দিকে ভালো পাইলটের অভাব হয়নি তাদের। 
 

জার্মান ট্রেনিং-এর অবনতি এবং ধ্বংস

১৯৪১ সালের ২২শে জুন জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়নে হামলা করে। প্রথম ছয় মাসে তারা ২,২০০ পাইলট হারায়। এর পরে ১৯৪২ সালের প্রথম ছয় মাসেও প্রায় একই সংখ্যক পাইলট হারায় তারা। এর মাঝে আবার সোভিয়েত ফ্রন্টে জার্মান সেনাবাহিনীর কিছু ইউনিট আটকে পড়ার কারণে তাদেরকে আকাশ থেকে সাপ্লাই দিতে দুই ইঞ্জিনের ট্রেনিং প্রোগ্রাম থেকে বিমান এবং প্রশিক্ষকদের রুশ ফ্রন্টে পাঠানো হয়। এরপর থেকে যুদ্ধে চাপে সেই বিমান এবং প্রশিক্ষকদের আর ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। আর রুশ ফ্রন্টে যুদ্ধের কারণে যখন জ্বালানি তেলের সরবরাহের উপরে চাপ পড়ে, তখন ট্রেনিং ইউনিটেই জ্বালানি তেলের বরাদ্দ কমানো হয় সবচাইতে বেশি। এসময় আধাআধি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ‘এ’ এবং ‘বি’ টাইপের লাইসেন্সধারী পাইলটের একটা আধিক্য তৈরি হয় এবং অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলটের ক্রাইসিস দেখা দেয়। ১৯৪২ সালের জুলাই-এ পাইলট ট্রেনিং-এর ডিরেক্টর জেনারেল কুয়েল লুফতওয়াফের প্রধান রাইখমার্শাল হেরমান গোরিং-এর কাছে গিয়ে আসছে মহাবিপদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, ‘সি’ টাইপের ট্রেনিং-এর অবস্থা শোচনীয় অবস্থায় ঠেকেছে। গোরিং শর্টকাট সমাধান খুঁজতে গিয়ে পুরো ‘সি’ টাইপ ট্রেনিং প্রোগ্রাম-ই বাদ দিয়ে দেন এবং এই ট্রেনিং নেবার জন্যে পাইলটদের সরাসরি অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে পাঠিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে ‘সি’ টাইপের ট্রেনিং দেবার জন্যে যথেষ্ট বিমান এবং প্রশিক্ষক না থাকায় তাদের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে ওঠে। অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিট এই চাপ নিতে না পেরে অপারেশনাল গ্রুপের কাছে ট্রেনিং-এর জন্যে পাইলট পাঠাতে থাকে। ফলশ্রুতিতে মারাত্মক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেখানে বম্বার এবং রেকনাইস্যান্স পাইলটদের পার্ফরমেন্স খুব খারাপ হয়ে যেতে থাকে।

১৯৪৪ সালের শুরুতে জার্মান অপারেশনাল ফাইটার ইউনিটগুলিতে মাত্র ১৬০ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা নিয়েই পাইলটরা যোগদান করতে থাকে। অথচঃ ঐ একই সময়ে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্স এবং আমেরিকার আর্মি এয়ার ফোর্সে ফাইটার পাইলট হতে দ্বিগুণেরও বেশি ঘন্টা উড্ডয়নের প্রয়োজন হতো। ১৯৪৪-এর প্রথম ৬ মাসে জার্মান ফাইটারের ইন্টারসেপ্টর ইউনিটিগুলি ২,০০০-এরও বেশি পাইলট হারায়। দিনের বেলায় মার্কিন বোমারু বিমানের সাথে আসা পি-৫১ ফাইটারগুলি জার্মান বিমান বাহিনীর যেকোন ফাইটারের চাইতে ভালো ছিল। এর উপরে মার্কিন পাইলটের মান তখন যথেষ্ট ভালো। অন্যদিকে জার্মান পাইলটদের ট্রেনিং-এর অবস্থা দিনকে দিন আরও খারাপ হচ্ছিল। ১৯৪৪-এর মাঝামাঝি সময়ে ‘বি’ ট্রেনিং ইউনিটগুলি বাদ দিয়ে দেয়া হয় এবং সকল পাইলটকে মাত্র ১১২ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতাসহ অপারেশনাল ইউনিটে পাঠানো হতে থাকে। আর ঐ বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ জ্বালানি স্বল্পতায় এলিমেন্টারি এবং স্পেশালিস্ট ট্রেনিং প্রসেস বাদ দিয়ে সকলকে ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

হিটলার ইয়ুথ ফ্লাইটের শেষ দিনগুলি

হিটলার ইয়ুথের ফ্লাইং ডিভিশনের সদস্যদের ১৯৪৩ সাল থেকে বিমান-ধ্বংসী কামান চালাতে নিয়োগ দেয়া হয়; তাদের সাথে বহু বেসামরিক নাগরিককেও এই ট্রেনিং দেয়া হয়, কারণ সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত সকলকেই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। যেসব ছেলেরা বয়সে একটু বড় ছিল, তারা কামান চালনা করতো, আর কম বয়সের ছেলেরা ফিজিক্যাল কমিউনিকেশন (কুরিয়ার) এবং সার্চলাইট চালনার কাজ করতো। বোমা হামলায় যোগাযোগ ধ্বংস হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। তখন এই ছেলেরাই যোগাযোগ সচল রাখতো। আকাশে মার্কিন বিমান বাহিনীর নতুন ডিজাইনের ফাইটারের (পি-৫১, পি-৪৭ এবং পি-৩৮) কাছে জার্মান ফাইটারগুলি হেরে যাচ্ছিল। তখন এই কম বয়সীদের বাহিনীর চালনা করা বিমান-ধ্বংসী কামানগুলি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে একেবারে শেষের দিকে মেশারস্মিট এমই-২৬২ এবং হাইঙ্কেল এইচই-১৬২ নামের জেট ফাইটারগুলি তৈরি করা শুরু হয়েছিল। হাইঙ্কেল-১৬২-এর নাম দেয়া হয়েছি ‘পিপলস ফাইটার’ (ভোকস যাগের), এবং এই বিমান চালনার জন্যে অল্প বয়সের ছেলের ট্রেনিং দেয়া শুরু করা হয়েছিল। হাইঙ্কেলের বিমানটা যথেষ্ট ভালো একটা ফাইটার হলেও মাত্র ৩২০টা ফাইটার যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর জন্যে যথেষ্ট ছিল না। আর তখন জার্মান বিমান বাহিনীর পাইলটের মান ছিল একেবারেই নিম্নমানের। তদুপরি, অনেক ক্ষেত্রেই বিমান পাওয়া গেলেও চালানোর পাইলট পাওয়া যায়নি! অর্থাৎ ম্যান এবং মেশিনের মাঝে সমন্বয় ভেঙ্গে পড়েছিল।
    
  
মার্কিন বিমান বাহিনীর পাইলট ক্যাপ্টেন ফ্রেড ক্রিশ্চেনসেন (১৯৪৪)। তার পি-৪৭ বিমানে অঙ্কিত ২২টা স্বস্তিকার মানে হলো তিনি ২২টা জার্মান বিমান ভূপাতিত করেছেন। মার্কিনীরা তাদের সবচাইতে ভালো পাইলটদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো নতুন পাইলট ট্রেনিং দেবার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে জার্মান পাইলটদের সর্বোত্তমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছিল। তাদের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে খুব কমই গিয়েছিল।  
 

জার্মান পাইলটের মান

জার্মান ফাইটার পাইলটদের একটা নাম হয়ে গিয়েছিল ‘কিল’-এর সংখ্যার জন্যে। ২,৫০০ পাইলট কমপক্ষে ৫টা বিমান ভূপাতিত করার দাবি করে। ১০০টার বেশি বিমান ভূপাতিত করার পাইলটের সংখ্যা ছিল ১০৩। ৪০ থেকে ১০০ ‘কিল’-এর দাবি ছিল ৩৬০ জন পাইলটের। ২০ থেকে ৪০ ‘কিল’এর দাবি ছিল ৫০০ জন পাইলটের। ৪৫৩ জন ফাইটার (দিনের বেলার ফাইটার) পাইলটকে ‘নাইটস ক্রস অব দ্যা আয়রন ক্রস’ পুরষ্কার দেয়া হয়েছিল; আরও ৮৫ জন নাইট ফাইটার পাইলট (১৪ জন ক্রু-সহ) একই সন্মান পেয়েছিল। যুদ্ধের শুরুতে এটাই ছিল জার্মানির সর্বোচ্চ সামরিক সন্মান। জার্মান বিমান বাহিনী যুদ্ধে মোট ৭০ হাজার বিমান ভূপাতিত করার দাবি করে; যার মাঝে ৪৫ হাজার ছিল সোভিয়েত, আর ২৫ হাজার ছিল ব্রিটিশ-মার্কিন। ১৮ হাজার ৬০০-এর মতো জার্মান পাইলট যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে। 

জার্মান বিমান বাহিনীর সাথে রয়াল এয়ার ফোর্স এবং মার্কিন বিমান বাহিনীর ট্রেনিং-এর দৈর্ঘ্যের একটা তুলনাচিত্র। যেখানে যুদ্ধের শুরুতে ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জার্মানরা ব্রিটিশ এবং মার্কিন ট্রেনিং-এর চাইতে বেশি লম্বা ট্রেনিং নিতো, সেখানে পুরো চিত্রই পাল্টে যায় ১৯৪২-৪৩ সালে। যুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানরা ভালো বিমান তৈরি করতে পারলেও সেগুলি চালাবার মতো পাইলটই তাদের ছিলনা। 


জার্মান পাইলটদের ‘কিল’এর এই দাবি পশ্চিমা ঐতিহাসিকেরা অনেকেই প্রশ্ন করেছেন। তবে এর স্বপক্ষে যুক্তিও রয়েছে যথেষ্ট। প্রথমতঃ যুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মান পাইলটের মান ছিল অন্যদের চাইতে অনেক ভালো, কারণ তারা অনেক আগ থেকেই পাইলট তৈরি করে আসছিল। যেমন যুদ্ধের শুরুতে প্রচন্ড চাপের মুখে ব্রিটেনের রয়াল এয়ার ফোর্সের পাইলটেরা মাত্র ১৬০ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা নিয়েই জার্মান বিমান বাহিনীকে মোকাবিলা করতে গিয়েছিল। ১৯৪১ সালের পর থেকে এই ট্রেনিং-কে ৩২০ ঘন্টার উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ বিমান বাহিনীর ট্রেনিং-এর অবস্থাও ছিল খুবই খারাপ।দ্বিতীয়তঃ পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধপ্রস্তুতির কারণে জার্মান বিমান বাহিনী যুদ্ধের শুরুতে বেশ ভালো মানের ফাইটার তৈরি করতে পেরেছিল। অন্যদিকে অন্য দেশগুলি ছিল একেবারেই প্রস্তুতিহীন; তাই তাদের শুরুর দিকের বিমানগুলি ছিল নিম্নমানের। তৃতীয়তঃ যেখানে ব্রিটিশ-আমেরিকান সেরা পাইলটদেরকে দেশে ফেরত নিয়ে আসা হতো নতুন পাইলটদের ট্রেনিং দেবার জন্যে, সেখানে জার্মান বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠ পাইলটদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখা হয়েছিল তারা মারা যাবার আগ পর্যন্ত। ব্রিটিশ-মার্কিন পাইলটেরা তাদের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে বিতরণ করে পাইলট তৈরিতে সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে জার্মান পাইলটদের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে ততটা যায়নি।

জার্মান বিমান বাহিনীর ডকট্রাইনগত সমস্যা

জার্মান পাইলট ট্রেনিং এবং বিমান নির্মান শিল্প তাদের রাষ্ট্রের চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। কারণ তাদের চিন্তায় যেখানে সেনাবাহিনী দ্বারা সারা ইউরোপ দখলের দিকে লক্ষ্যস্থির ছিল, সেখানে অনেকগুলি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে পারার মতো ট্রেনিং কাঠামো তাদের থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা ছিল শুধুই স্বপ্ন। রাশিয়া, ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত জনবল, খনিজ সম্পদ, ভূমি, শিল্প এবং অর্থনৈতিক শক্তির সাথে পেরে ওঠা জার্মানির একার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিলনা। তাই সকলের সাথে একত্রে লড়তে গিয়ে তাদের ট্রেনিং কাঠামো এবং বিমান নির্মাণ শিল্প ভেঙ্গে পড়েছিল। একইসাথে এতগুলি ফ্রন্টে একত্রে যুদ্ধ করার জন্যে দরকারি খনিজ সম্পদের জোগান তারা দিতে অক্ষম ছিল।
     
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের মাটিতে পাইলট ট্রেনিং-এর জন্যে যথেষ্ট এয়ারফিল্ড এবং ট্রেনিং বিমান না থাকায় বেশিরভাগ পাইলট ট্রেনিং-এর আয়োজন করা হয় ব্রিটেনের বাইরে। ঐ এলাকাগুলি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে থাকায় পাইলটরা তেমন কোন চাপ ছাড়াই ট্রেনিং নিতে পেরেছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালের মাঝে পাইলট ট্রেনিং এতটাই সাফল্যজনক ছিল যে, ১৯৪৪ সাল থেকে পাইলট ট্রেনিং কমিয়ে দেয়া হয়েছিল! 
  

ব্রিটিশ অভিজ্ঞতা

যুদ্ধের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা জার্মানদের সাথে পেরে উঠছিল না একেবারেই। তারা তাদের পাইলট ট্রেনিং-এর জন্যে ৯টা দেশের উপরে নির্ভর করেছিল। পাইলট ট্রেনিং-এর জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক এয়ারফিল্ড ব্রিটেনে ছিল না। এরপরেও ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫-এর মাঝে মোট ১৫৩টা ফ্লাইং স্কুলে ১৪,৪০০ পাইলটকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল ব্রিটেনে। মোট ট্রেনিংপ্রাপ্ত ১ লক্ষ ১০ হাজার ৬০০ পাইলটের মাঝে এই সংখ্যা মাত্র ১৩%। সর্বোচ্চ সংখ্যক ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল কানাডার ৯২টা স্কুলে– ৫৪,১০০, যা কিনা মোট ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাইলটের ৪৯%। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিং পেয়েছিল ১১,৮০০ জন (১১%), অস্ট্রেলিয়াতে ট্রেনিং পেয়েছিল ১০,৫০০ জন (৯%), দক্ষিণ আফ্রিকা এবং রোডেশিয়াতে মোট ১৪,৮০০ জন (১৩%), নিউজিল্যান্ডে ৪,২০০ জন (৪%), ভারতে ৭০০ জন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ১০০ জন। ব্রিটেনের সাহায্যকারী এই দেশ/অঞ্চলগুলি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে ছিল বিধায় সেখানে পাইলটরা মোটামুটি শান্তিতেই ট্রেনিং নিতে পেরেছে। এভাবে ট্রেনিং নেবার জন্যে যথেষ্ট ভালো ফ্লাইং কন্ডিশনও ব্রিটিশরা পেয়েছিল; কাজেই ট্রেনিং-এ আবহাওয়ার কারণে সময়ক্ষেপণ ছিল কম। অন্যদিকে জার্মান পাইলটরা মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমানের হামলার মাঝেই ট্রেনিং নিচ্ছিল।

ব্রিটেনের আকাশে যখন জার্মান বিমান হামলা করছিল (ব্যাটল অব ব্রিটেন), তখন ব্রিটিশদের পাইলটের ব্যাপক ঘাটতি ছিল; চাপের মুখে পাইলটের মানও ছিল অতি সাধারণ। কিন্তু ১৯৪৩ সাল থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাইলটের সারপ্লাস পরিলক্ষিত হচ্ছিল। বিমানের মান ভালো হচ্ছিল, আর ভালো বিমান চালাতে পাইলটের ট্রেনিং-এর মানও ভালো হতে হতো। যুদ্ধের প্রথমে পরিলক্ষিত ক্ষতির চাইতে পরবর্তীতে ক্ষতির পরিমাণ কমতে থাকে; কাজেই বদলি পাইলটের দরকারও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৪৪ সালের শুরু থেকে পাইলট ট্রেনিং-এর হার কমিয়েই দেয়া হয়! অর্থাৎ যুদ্ধ জেতার জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক ভালো পাইলট ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালের মাঝেই তৈরি করে ফেলা সম্ভব হয়েছিল! শেষের দেড় বছর শুধু যুদ্ধ শেষ করতে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

ব্রিটেনের কোন হিটলার ইয়ুথ ছিল না; তবে ব্রিটিশরা যুদ্ধ প্রস্তুতিও বন্ধ করেনি একেবারে। রয়াল এয়ার ফোর্সের রেগুলার পাইলটরা দুই বছরের ট্রেনিং পেতো আরএএফ কলেজে। এছাড়াও আরও বেশি সংখ্যক পাইলট তৈরি হতো এক বছরের শর্ট সার্ভিস ট্রেনিং-এর মাধ্যমে। এদের ট্রেনিং হতো ফ্লাইং ট্রেনিং স্কুলে। ১৯২৫ সাল থেকে আরও একট নতুত ধাপে পাইলট ট্রেনিং শুরু হয় – স্পেশাল রিজার্ভ স্কোয়াড্রন এবং অক্সিলারি স্কোয়াড্রন। এদেরকে সপ্তাহান্তে পার্ট টাইম ট্রেনিং দেয়া হতো। তবে ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯-এর মাঝে এই প্রোগ্রামগুলিকে ত্বরান্বিত করা হয়। ১৯৩৬ সালে ট্রেনিং কমান্ড এবং আরএএফ ভলান্টিয়ার রিজার্ভ গঠন করা হয়। এরা বেসামরিক ফ্লাইং স্কুলগুলিতে ট্রেনিং নিতো। ছুটির দিনে এরা বিমান ওড়াতো এবং সন্ধ্যায় অনান্য ক্লাসে প্রশিক্ষণ নিতো। এদেরকে পরবর্তীতে বিমান বাহিনীতে নেয়া অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। তারপরেও যুদ্ধ শুরুর সময় (১৯৩৯ সালে) যথেষ্ট এয়ারফিল্ড, ট্রেনিং বিমান এবং প্রশিক্ষকের অভাবে বেশি সংখ্যক পাইলট তৈরি করা যাচ্ছিলো না। তবে এই কাঠামোটাই ১৯৪১ সাল থেকে ব্যবহার করে পাইলট ট্রেনিং-এ ব্যাপক সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল।
   
 
শ্রীলঙ্কা বিমান বাহিনীর এফ-৭ যুদ্ধবিমান। দেশটির গৃহযুদ্ধের শুরুতে বিমান বাহিনীতে পাইলট ছিল ৪০ জনেরও কম। এমতাবস্থায় নতুন বিমান কিনলেও তা চালাবার জন্যে পাইলট ছিল না তাদের। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী ভাড়া করা পাইলট দিয়ে চালাতে হয়েছিল তাদের। 
 

আরও কিছু উদাহরণ

১৯৮০-এর দিকে মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদ (কেউ কেউ বলে চাদ) ব্রিটেন-ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্রের ধস্তাধস্তির মাঝে পড়ে গৃহযুদ্ধে পতিত হয়। তখন শাদের একনায়ক ইদ্রিস দেবি, যিনি ফরাসীদের কাছে পাইলট ট্রেনিং নেবার কারণে বিমান বাহিনীর গুরুত্ব বুঝতেন। তিনি শাদের বিমান বাহিনী তৈরি করার লক্ষ্যে আগানো শুরু করেন। কিন্তু যেহেতু নিজের দেশের কোন পাইলটই নেই, তাই ভাড়াটে পাইলট দিয়েই তিনি শাদের বিমান বাহিনী তৈরি করেন। আজও শাদের বিমান বাহিনী বিদেশী পাইলটের উপরে বেশ নির্ভরশীল।

শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ শুরুর সময়ে শ্রীলঙ্কার বিমান বাহিনীতে তেমন কোন সংখ্যক পাইলটই ছিল না। তাই বিদেশী ভাড়া করা পাইলটের উপরেই নির্ভর করতে হয়েছে তাদের। ১৯৮৫ সালে যখন শ্রীলঙ্কা ইতালি থেকে Siai Marchetti বিমান কেনে, তখনও তাদের মোট পাইলটের সংখ্যা ছিল ৪০-এরও কম। এই সংখ্যক পাইলট দিয়েই তাদের এটাক এয়ারক্রাফট, পরিবহণ বিমান এবং হেলিকপ্টার অপারেট করতে হয়েছিল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘কিলো ফ্লাইট’ তৈরি করতে বাংলাদেশের হাতে ছিল ৩ জন বিমান বাহিনীর পাইলট এবং ৬ জন বেসামরিক পাইলট। এই সবগুলি উদাহরণেই একটা ব্যাপার নিশ্চিত, আর তা হলো – পাইলটের স্বল্পতা এতটাই ছিল যে, আরও বেশি সংখ্যক বিমান পেলেও সেগুলি ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না।

আর এই তিন উদাহরণের প্রত্যেকটাই অন্য দেশে তৈরি বিমানের উপরে নির্ভরশীল ছিল বিধায় ঐ দেশগুলি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।

এই দীর্ঘ আলোচনাকে সংক্ষেপে বলতে গেলে –

- একটা বিমান বাহিনীকে গড়তে গেলে প্রথমেই তার ডকট্রাইন স্থির করতে হবে, যা কিনা সেই রাষ্ট্রের চিন্তার উপরে নির্ভরশীল। সেই চিন্তাটা যেমন, তার বিমানের ডিজাইন, ফর্মেশন এবং ট্রেনিং হবে তেমনি।

- ট্রেনিং এমন একটা ব্যাপার, যার একটা দফারফা না করে কোন যুদ্ধ করাটা বোকামি। পাইলট তৈরি করতে সময় লাগে। সেটা হিসেবে না এনে যুদ্ধে গেলে আধাআধি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের উপরে নির্ভর করতে হতে পারে। এদের হাতে ভালো অস্ত্র দিলেও এর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত হবে না।

- যথেষ্ট সংখ্যক ও নিরাপদ এয়ারফিল্ড এবং এয়ারস্পেস ছাড়া ভালো ট্রেনিং-এর আশা করা যায় না।

- অভিজ্ঞদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে নতুনদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। অভিজ্ঞদের ভালো যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করে কিছু সাফল্য পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ হারতে হতে পারে।

- ট্রেনিং অনেক অল্প বয়সে শুরু করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। অল্প বয়সের ছেলেদের মানসপটে পাইলট হবার আকাংক্ষা যে ভালোমতো তৈরি করতে পারবে, তার বিমান বাহিনী ততো শক্তিশালী হবে।

- বেসামরিক জনগণের পাইলট ট্রেনিং-এ ভূমিকা থাকলেও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাই হবে মূল বিষয়। রাষ্ট্রের চিন্তা বিমান বাহিনীর ডকট্রাইন এবং ট্রেনিং প্রসেসে প্রতিফলিত হবে।

- অন্য দেশের তৈরি বিমানের উপরে নির্ভরশীল হতে হলে ঐ দেশের ডকট্রাইনই মেনে চলতে হবে; এভাবে নিজেদের ডকট্রাইন হবে স্বল্প মেয়াদী, যাকে ডকট্রাইন বলাটাই ভুল হবে

Saturday 28 July 2018

যুদ্ধ এক – অস্ত্র অনেক, কেন?

২৮শে জুলাই ২০১৮


  
ডিঙ্গো নামের এই কুকুর-পরিবারের প্রাণীটি অস্ট্রেলিয়ার স্থলভাগে সবচাইতে ভয়ংকর স্তন্যপায়ী প্রাণী। অস্ট্রেলিয়াতে বনের রাজা হতে হলে ডিঙ্গো হলেই চলবে, যদিও সুন্দরবনে হতে হবে টাইগার বা আফ্রিকায় হতে হবে লায়ন।


বনের রাজা কে?


অস্ট্রেলিয়া একটা মহাদেশ হলেও তা মূলতঃ একতা বিশাল দ্বীপ; এবং বাকি দুনিয়া থেকে সমুদ্র দ্বারা আলাদা। অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে মারাত্মক প্রাণী কোনটা – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কুমীর, হাঙ্গর, সাপ, জেলিফিশ, আক্টোপাস, মৌমাছি, মাকড়ষা, পিঁপড়া, ইত্যাদির নাম আসবে। এখানে স্থলভাগের বড় কোন জন্তুর নাম আসবে না সহজে, কারণ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সবচাইতে ভয়ঙ্কর স্তন্যপায়ী প্রাণী হলো ডিঙ্গো নামের কুকুর-পরিবারের একটা জন্তু। ফেরাল ক্যাট নামের একটা বিড়াল আছে, যা পাখি ধরে খায়। কিন্তু সেখানে বড় কোন বিড়াল নেই – যেমন বাঘ বা সিংহ বা চিতা বা লেপার্ড। সেখানে বনে রাজা বড় কোন পশু নয়। ডিঙ্গোর মতো প্রাণী আফ্রিকা বা আমাজন বা সুন্দরবনে হয়তো টিকতে পারবে না; তবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তাকে হারাবার কেউ নেই। একেকটা জঙ্গলের বাস্তবতা একেক রকম। মূলকথা, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বনের রাজা হতে টাইগার বা লায়ন হবার দরকার নেই। এই হিসেবটা জঙ্গলের বাইরের জঙ্গলেও প্রচলিত। কারণ সবগুলি একই সৃষ্টির অংশ।
 
   
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপের আকাশে ব্রিটিশ হকার হারিকেন বিমানগুলি খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঠিকই চালিয়ে নিয়েছিল। এই বিমানের গতি (ঘন্টায় ৫৩১ কিঃমিঃ) জাপানি জেরো ফাইটারের কাছাকাছি ছিলো (৫৩৩ কিঃমিঃ থেকে ৫৬৫ কিঃমিঃ)।


বিশ্বযুদ্ধে আকাশের রাজত্ব কে করেছে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একেক যুদ্ধক্ষেত্রে একেক ধরনের যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়েছিল। ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে জার্মান বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব ব্রিটিশ-মার্কিন যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছিল, জাপানের সাথে যুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সেগুলি মোতায়েন করা হয়নি। জার্মান বিমান বাহিনীর মূল ফাইটার বিমান ছিল মেশারস্মিট বিএফ-১০৯, যে বিমানের সর্বোচ্চ গতি একসময় ঘন্টায় ৪৭০ কিঃমিঃ থাকলেও খুব দ্রুতই পরের ভার্সনের বিমানগুলির গতি ৫৬০ কিঃমিঃ পার হয়ে ৬২৪ কিঃমিঃ, এমনকি ৭২৯ কিঃমিঃ পর্যন্ত যায়। বিএফ-১০৯-এর সাথে আরেকটা ফাইটার বিমান ফকে-উলফ এফডব্লিউ-১৯০ প্রচুর তৈরি করা হয়েছিল, যার গতি ৬৫০ কিঃমিঃ থেকে ৬৮৫ কিঃমিঃ পর্যন্ত ছিল। এই বিমানগুলিকে মোকাবিলা করার জন্যে ব্রিটিশদেশ হকার হারিকেন বিমানগুলির গতি ছিল ৫১৯ কিঃমিঃ থেকে ৫৩১ কিঃমিঃ পর্যন্ত; অর্থাৎ জার্মান বিমানগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ হেরে যাবার সম্ভাবনা এর ছিল বেশি। ব্রিটিশরা তাই দ্রুত সুপারম্যারিন স্পিটফায়ার বিমানের উৎপাদন বাড়িয়েছিল, যার গতি ছিল ঘন্টায় ৬০২ কিঃমিঃ থেকে ৭২১ কিঃমিঃ পর্যন্ত। কিন্তু স্পিটফায়ারগুলি যথেষ্ট সংখ্যায় তৈরি করতে সময় লেগেছিল। স্পিটফায়ারের কারখানাগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে করতে যে সময় লেগেছিল, সেসময়ে হারিকেনগুলিই ঠেকনা দিয়েছিল। যখন স্পিটফায়ারগুলি যথেষ্ট সংখ্যায় পাওয়া যেতে থাকলো, তখন হারিকেনগুলিকে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয় – যেমন আফ্রিকা এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।

প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের মূল যুদ্ধবিমান ছিল মিতসুবিসি এ-৬এম ‘জেরো’। এর গতি ৫৩৩ কিঃমিঃ থেকে ৫৬৫ কিঃমিঃ-এর মতো ছিল; অর্থাৎ ৬০০ কিঃমিঃ-এর নিচে। ব্রিটিশরা এই যুদ্ধক্ষেত্রে হারিকেনগুলিকে পাঠিয়েছিল আর মার্কিনীরা পাঠিয়েছিল কার্টিস পি-৪০ (৫২০ কিঃমিঃ থেকে ৫৬৩ কিঃমিঃ), বেল পি-৩৯ এয়ারাকোবরা (৬১২ কিঃমিঃ), গ্রুম্মান এফ-৪এফ ওয়াইল্ডক্যাট (৫৩৩ কিঃমিঃ) এবং গ্রুম্মান এফ-৬এফ হেলক্যাট (৬১২ কিঃমিঃ)। পরবর্তীতে ভট এফ-৪ইউ কর্সেয়ার বিমানগুলি (৬৭১ কিঃমিঃ থেকে ৭১৮ কিঃমিঃ) গতিকে আরও এগিয়ে নেয়। কর্সেয়ার ছাড়া বাকি বিমানগুলির গতি ছিল ৬৫০ কিঃমিঃ-এর নিচে; তবে তারপরেও বিমানগুলি জাপানি জেরো ফাইটারের সাথে যুদ্ধ করে জিততে পারতো। অন্যদিকে ৬৫০ কিঃমিঃ ইউরোপের যুদ্ধ জেতার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। মার্কিনীরা ইউরোপে তিনটা ফাইটার বিমান ব্যবহার করেছিল – নর্থ আমেরিকান পি-৫১ মাসট্যাং (৬২৪ কিঃমিঃ থেকে ৭০৩ কিঃমিঃ), রিপাবলিক পি-৪৭ থান্ডারবোল্ট (৬৯০ কিঃমিঃ থেকে ৬৯৭ কিঃমিঃ) এবং লকহিড পি-৩৮ লাইটনিং (৬৩৬ কিঃমিঃ থেকে ৬৭৬ কিঃমিঃ)। এই বিমানগুলির গতি ছিল মোটামুটিভাবে ৬৫০ কিঃমিঃ থেকে ৭০০ কিঃমিঃ-এর মতো। আর তাই এই বিমানগুলি জার্মান বিমান বাহিনীর বারোটা বাজাতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।
   
  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত কার্টিস পি-৪০ বিমান। এই বিমানে ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়েছিল ১,২০০ হর্সপাওয়ারের রাইট, অথবা ১,০৫০ থেকে ১,২০০ হর্সপাওয়াররের প্র্যাট এন্ড হুইটনি, অথবা ১,১৫০ হর্সপাওয়ারের এলিসন, অথবা ১,৩০০ থেকে ১,৩২৫ হর্সপাওয়ারের প্যাকার্ড। অর্থাৎ যে ইঞ্জিন পাওয়া গিয়েছিল, সেটাই ব্যবহৃত হয়েছিল এতে। বেশি শক্তিশালী (১,৫০০ থেকে ২,০০০ হর্সপাওয়ার) ইঞ্জিনগুলি ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রের বিমানগুলির জন্যে দেয়া হচ্ছিলো।  


ইঞ্জিনের উৎপাদন বনাম বিমানের উৎপাদন

পি-৫১-এ ব্যবহৃত হয়েছিল ১,৫২০ থেকে ১,৬৫০ হর্সপাওয়ারের এলিসন ইঞ্জিন; পি-৪৭-এ ব্যবহৃত হয়েছিল ২,০০০ থেকে ২,৫৩৫ হর্সপাওয়ারের প্র্যাট এন্ড হুইটনি ইঞ্জিন; আর পি-৩৮-এ ব্যবহৃত হয়েছিল ১,২২৫ থেকে ১,৬০০ হর্সপাওয়ারের দুইটা এলিসন ইঞ্জিন। বাকি বিমানগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছিল – পি-৪০ (১,২০০ হর্সপাওয়ারের রাইট, অথবা ১,০৫০ থেকে ১,২০০ হর্সপাওয়াররের প্র্যাট এন্ড হুইটনি, অথবা ১,১৫০ হর্সপাওয়ারের এলিসন, অথবা ১,৩০০ থেকে ১,৩২৫ হর্সপাওয়ারের প্যাকার্ড), পি-৩৯ (১,১৫০ থেকে ১,৩২৫ হর্সপাওয়ারের এলিসন), এফ-৬এফ (২,০০০ থেকে ২,২০০ হর্সপাওয়ারের প্র্যাট এন্ড হুইটনি), এফ-৪ইউ (২,০০০ থেকে ২,৩০০ হর্সপাওয়াররের প্র্যাট এন্ড হুইটনি)। এখান থেকে যা পরিষ্কার হয় তা হলো, বিমানের ইঞ্জিনের উৎপাদনের সাথে বিমানের উৎপাদনের একতা সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল। সবগুলি মডেলের ইঞ্জিন একই সংখ্যায় তৈরি করা যায়নি। কর্মক্ষমতা বাড়ানোটা যুদ্ধের সময়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে যায়। সেটা ধরে রাখতেই এক প্রকারের ইঞ্জিন বা এক প্রকারের বিমান তৈরি করা হয়নি। আর একারণেই ইউরোপে মার খাওয়া বিমান এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভালোই চালিয়ে নেয়া গিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সবচাইতে মারাত্মক প্রাণীর মতোই। ইউরোপে বনের রাজা হতে গতি দরকার ছিল ৬৫০ কিঃমিঃ থেকে ৭০০ কিঃমিঃ; অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে ৫৫০ কিঃমিঃ থেকে ৬০০ কিঃমিঃ-ই ছিল যথেষ্ট। একই যুদ্ধ; বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র!

http://www.airliners.net/photo/Mali-Air-Force/Embraer-A-29B-Super-Tucano-EMB-314/4115817
এমব্রায়ার-৩১৪ সুপার টুকানো বিমানগুলি আফ্রিকার বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে যেতে পারে, যদিও এশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে সুপারসনিক জেট বিমানের কাছে তা কিছুই নয়। মোটকথা যুদ্ধের সময় সকল যুদ্ধক্ষেত্রে সমহারে শক্তি মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। তাই যেসব যুদ্ধাস্ত্র একেবারে বাতিল মনে হবে, সেটারও ব্যবহার দেখা যাবে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে।
   

হিসেব পুরোনো হলেও সর্বদাই কার্যকর

যুদ্ধ যে সময়েই হউক না কেন, এই হিসেবগুলি থাকবেই। পুরোনো ইঞ্জিনগুলির উৎপাদন হঠাতই পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে নতুন ইঞ্জিন তৈরি করা যাবে না। তাই পুরোনো ইঞ্জিন উৎপাদন চলবে; সেকারণে পুরোনো বিমানের উতপাদনও চলবে। যারা যুদ্ধ করবে, তারাও এই ব্যাপারটাকে খেয়ালে রাখবে। যে যুদ্ধক্ষেত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে বেশি শক্তিশালী এবং অপেক্ষাকৃত দামি বিমানগুলি দেয়া হবে। বাকিগুলিতে কম শক্তিশালী বিমান দিয়েই চালিয়ে নেয়া হবে।

আজকের এশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে হয়তো মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড হবে এফ-১৮ বা এফ-১৬ বা এফ-১৫। অন্যদিকে আফ্রিকায় এফ-৭, এফ-৫, মিরেজ-৩ বিমানগুলিও খারাপ করবে না। এমনকি এমব্রায়ার-৩১৪ সুপার টুকানো বা এয়ার ট্রাক্টর এটি-৮০২ বা আইওম্যাক্স আর্কেঞ্জেলের মতো প্রপেলার বিমানও চালিয়ে নেবে স্থানবিশেষে। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে যতদিন পর্যন্ত এলটিটিই-এর হাতে বিমান-ধ্বংসী মিসাইল পড়েনি, ততোদিন শ্রীলঙ্কার বিমান বাহিনী ইতালির সিয়াই মার্চেট্টি এসএফ-২৬০ এবং আর্জেন্টিনার আইএ-৫৮ পুকারার মতো বিমান দিয়েই চালাচ্ছিল। প্রথম মিসাইল হামলার পর থেকে শ্রীলংকার বিমান বাহিনী ইস্রাইলের আইএআই কাফির, রাশিয়ার মিগ-২৭ এবং চীনের এফ-৭ জেট বিমান কেনে।  


 
ক্যামেরুন নৌবাহিনীর চীনা নির্মিত প্যাট্রোল বোট CNS Le Ntem (P-108)। এই জাহাজের সামনে রয়েছে ৭৬ মিঃমিঃ কামান, যা কিনা ৪৭ মিটার একটা বোটের জন্যে বেশ শক্তিশালী কামান। আফ্রিকার গিনি উপকূলে ৭৬ মিঃমিঃ কামান একটা শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র। মিসাইল থাকলে তো আরও বেশি। এই কামানের কারণে একটা প্যাট্রোল বোটও গুরুত্বপূর্ণ একটা যুদ্ধজাহাজ। সকল যুদ্ধক্ষেত্রে রাজা হতে সমান শক্তির দরকার হয় না। তাই এক যুদ্ধ; অনেক যুদ্ধক্ষেত্র। এক যুদ্ধ; অনেক অস্ত্র।

নৌ অস্ত্রের ক্ষেত্রেও একই হিসাব চলবে। একস্থানে যেখানে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে প্রতিযোগিতা হবে, সেখানে অন্যখানে প্যাট্রোল বোটই বনে যাবে রাজা। সেখানে কোন প্যাট্রোল বোটে কতো মিঃমিঃ ক্যালিবারের কামান রয়েছে, সেখানে প্রতিযোগিতা হবে। ৭৬ মিঃমিঃ কামান থাকলে উপরে থাকা যাবে; ১০০ মিঃমিঃ কামান আরও উপরে তুলবে; ১২৭ মিঃমিঃ কামান রাজা বানাবে! আর কারো কাছে মিসাইল থাকলেও সে হবে সেই বনের রাজা! সাপ্লাই কম থাকায় সে মিসাইল গুণে গুণে ব্যবহার করবে। ৩০ মিটার-৫০ মিটার জাহাজের মাঝে ১০০ মিটারের জাহাজ হবে কমান্ডশিপ। জাহাজে হেলিকপ্টার থাকলে তা হবে ট্রাম্পকার্ড।

মোটকথা যুদ্ধের সময় সকল যুদ্ধক্ষেত্রে সমহারে শক্তি মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। তাই যেসব যুদ্ধাস্ত্র একেবারে বাতিল মনে হবে, সেটারও ব্যবহার দেখা যাবে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে। এবং যেহেতু কৌশলগত কারণে সেই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা যাবে না, তাই যুদ্ধ চালিয়ে নিতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী অস্ত্রই সেখানে চলবে।

এক যুদ্ধ; অনেক যুদ্ধক্ষেত্র। এক যুদ্ধ; অনেক অস্ত্র। সময় ভিন্ন; হিসেব এক।

Saturday 7 July 2018

ব্রিটেন যেভাবে ব্রাজিলের জন্ম দিয়েছিল


ব্রাজিলের প্রথম পতাকা - ১৮২২ সাল। রাজা পেদ্রোর অধীনে ব্রাজিলের এই পতাকার সবুজ এবং হলুদ রঙ রাজা এবং রানীর পর্তুগীজ এবং অস্ট্রিয়ান রাজবংশের রঙ থেকে নেয়া। ব্রাজিলের আজকের পতাকাতেও এই রঙ চলছে। 
 
৭ই জুলাই ২০১৮

ব্রাজিল বিশ্ব মানচিত্রের বড় একটি দেশ। আমাজন নদী এবং আমাজন জঙ্গলের দেশ ব্রাজিল। ৮৫ লক্ষ বর্গ কিঃমিঃ-এর চেয়েও বড় ব্রাজিলের এলাকা, যা প্রায় ৫৮টা বাংলাদেশের সমান! ২১ কোটির মতো এর জনসংখ্যা, যা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম জনবহুল দেশ। ২,১৪০ বিলিয়ন ডলারের এর অর্থনীতি, যা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম। তবে ১০,২২৪ মার্কিন ডলারের মাথাপিছু আয় অনেক দেশের চাইতেই কম। ৫ কোটিরও বেশি মানুষ সেখানে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তবুও ব্রাজিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে বেশ এগিয়ে। দেশটি পৃথিবীর নবম বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারী দেশ। এর প্রতিরক্ষা ইন্ডাস্ট্রির খ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। ব্রাজিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হাল্কা অস্ত্র রপ্তানিকারক। ব্রাজিলের বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমব্রায়ার বিমান তৈরি করে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে। ব্রাজিলের সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩ লাখের কিছু বেশি। তবে রিজার্ভ ১৩ লাখেরও বেশি। ২৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট পৃথিবীর ১১ বৃহত্তম। ৬০ হাজার নাবিকের ব্রাজিলিয়ান নৌবাহিনী পৃথবীর সবচাইতে বড় নৌবাহিনীগুলির একটি। ফ্রিগেট-কর্ভেট-ওপিভি মিলিয়ে এসকর্ট জাহাজ রয়েছে ১৪টা, সাবমেরিন ৫টা, বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজ ৫টা। ৭৭ হাজার সেনার বিশাল বিমান বাহিনীতে স্বল্প ক্ষমতার ৯০টা হাল্কা ফাইটার এবং ৩১টা প্রপেলার কাউন্টার ইন্সারজেন্সি বিমান ছাড়া বাকিটা মূলত ১৩০টা পরিবহণ বিমান, ৯৪টা হেলিকপ্টার এবং ১৭৫টা প্রশিক্ষণ বিমান।

এতবড় দেশ; এতবড় অর্থনীতি; প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রাজিলের নাম এতো কম শোনা যায় কেন? হ্যাঁ, ‘ব্রিকস’ নিয়ে কিছুদিন বেশ হৈচৈ হলেও সেটা এখন ফাইলবন্দীই বলা চলে। ব্রাজিলের এই বাস্তবতা বুঝতে ব্রাজিলের জন্মের দিকে তাকাতে হবে। তার জন্মই বলে দেয় যে ব্রাজিল কি করবে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় অবতরণের পর থেকে ইউরোপিয়রা আমেরিকায় নিজেদের দখলদারিত্ব কায়েমের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, তার মাঝে অগ্রগামী ছিল পর্তুগীজরা। তারা দক্ষিণ আমেরিকায় বর্তমান ব্রাজিলের উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ১৮০৭ সাল পর্যন্ত ব্রাজিল পর্তুগালের একটা বড় উপনিবেশের ভূমিকাই পালন করেছে। তবে হিসেব পাল্টে যায় রাজা ষষ্ঠ জনের সময়কালে।

ষষ্ঠ জন (ষষ্ঠ জোয়াও) পর্তুগাল এবং ব্রাজিলের অধিকর্তা হন বটে, তবে ন্যাপোলিয়নের আবির্ভাবে তার ভাগ্যে উত্থান-পতন চলতে থাকে। ফরাসী-স্প্যানিসরা পর্তুগাল আক্রমণ করলে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় জন ব্রাজিলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। 
  

পর্তুগালের রাজা, নাকি ব্রাজিলের রাজা?

পর্তুগালের প্রিন্স ষষ্ঠ জন (ষষ্ঠ জোয়াও)-এর জন্ম ১৭৬৭ সালে। দেশ চালাচ্ছিলেন তার মা প্রথম মারিয়া। তবে ১৭৮৬ সাল থেকে রানী মারিয়ার মানসিক সমস্যা সকলের সামনে দৃশ্যমান হতে থাকে। সেই একই বছর তিনি তার স্বামী তৃতীয় পিটারকে হারান। ১৭৮৮ সালে মারিয়ার বড় ছেলে হোজে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জন হয়ে যায় সিংহাসনের পরবর্তী প্রার্থী। ১৭৯২ সালে পর্তুগীজ রাষ্ট্রীয় লোকজনের সিদ্ধান্তে ১৭ জন ডাক্তার একত্রে রানীকে রাজ্য চালানোর জন্যে মানসিকভাবে অযোগ্য ঘোষণা করেন। তারা জনকে ক্ষমতা নিতে বলে। ২৫ বছর বয়সে জন পর্তুগালের ‘প্রিন্স রিজেন্ট’ বা নায়েব উপাধি নিয়ে দেশ শাসন শুরু করেন।

তখন ফরাসী বিপ্লবের পরপর ইউরোপ অস্থির। ব্রিটেন ইউরোপে রাজতন্ত্রের পূনপ্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর; পর্তুগাল ও স্পেন তার সাথে রয়েছে। চতুর্দিকে যুদ্ধ চালাচ্ছে ফ্রান্সের রেভোলিউশনারি সরকার। ফ্রান্স-স্পেনের সীমান্তে তখন চলছে যুদ্ধ। ১৭৯৫ সালে স্পেন ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে হেরে গেলে ভূরাজনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন হয়। স্পেন ফ্রান্সের সাথে শান্তি চুক্তি করে ফ্রান্সের দলে ভিড়ে গেলেও ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে বলে পর্তুগাল চুক্তি করেনি; তারা ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মাঝে নিরপেক্ষ থাকার নীতি নেয়। এই নীতি পর্তুগালকে বাঁচাতে পারেনি। ১৭৯৯ সালে ন্যাপোলিয়ন ফ্রান্সে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নিলে পর্তুগালের উপর কালো ছায়া নেমে আসে। ন্যাপোলিয়ন স্পেনকে বাধ্য করেন পর্তুগালকে আল্টিমেটাম দিতে, যাতে পর্তুগালের ব্রিটেনের সংগ পরিত্যাগ করে। ১৮০১ সালে ফ্রান্সের সমর্থনে স্পেন পর্তুগাল আক্রমন করে আলোচনার টেবিলে বসাতে বাধ্য করে।

জন সকল দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তার স্ত্রী কারলোটা জোয়াকিনা ছিলেন স্প্যানিস রাজবংশের। তিনি চাইছিলেন তার স্বামী জনকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে সিংহাসন নিয়ে নিতে। ফ্রান্স এবং স্পেনের চাপের মুখে জন ব্রিটেনের সাথে গোপনে চুক্তি করেন। চুক্তি মোতাবেক ফ্রান্স-স্পেন যদি পর্তুগালে হামলা করে বসে, তাহলে ব্রিটিশরা পর্তুগালের রাজপরিবারকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ব্রাজিলে চলে যেতে সহায়তা করবে। ১৮০৭ সালের অক্টোবরে খবর আসে যে ফরাসী সেনাবাহিনী পর্তুগালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১৬ই নভেম্বর ব্রিটিশ রয়াল নেভির একটা স্কোয়াড্রন সাত হাজার সৈন্য নিয়ে লিসবন বন্দরে এসে পৌঁছায়। ফরাসী জেনারেল জঁ-আন্দোশে জুনো ৩০শে নভেম্বর লিসবন পৌঁছে দেখেন যে পর্তুগীজ রাজপরিবার তল্পিতল্পাসহ জাহাজে উঠে পালিয়েছে। পর্তুগীজ জনগণ এটা মেনে নিতে পারেনি যে তাদের নেতা এভাবে তাদের ছেড়ে যাবেন। ১৫টা জাহাজে বেশ কয়েক হাজার মানুষ গাদাগাদি করে উঠে রওয়ানা দেয়। এই সংখ্যা কত ছিল সেটা কেউ সঠিক বলতে না পারলেও সেটা ১৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে।

ষষ্ঠ জন-এর কোর্ট, রিও ডি জানেইরো, ব্রাজিল। জন তল্পিতল্পা সহ ব্রাজিলে পালিয়ে যাবার পর রাষ্ট্র পরিচালনার সকলকিছু ব্রাজিলের মাটিতে তৈরি করতে হয়েছিল। ১৩ বছর রিও থেকে শাসন করার পরে জন পর্তুগালে চলে গেলেও নতুন রাষ্ট্র ব্রাজিলের ভিত ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে।
  

ব্রাজিল – নতুন রাষ্ট্র তৈরির ভিত যেভাবে হলো

ব্রাজিল তখন ছিল পর্তুগীজ উপনিবেশ। এর মূল শহর রিও ডি-জানেইরো, যার জনসংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের মতো। সেখানে রাজপরিবারসহ পুরো সরকারের সংকুলান হবার কোন অবস্থাই ছিল না। রাতারাতি শহরের বিরাট সংখ্যক বাড়িঘর দখল নিয়ে নেয়া হয়। রাজপরিবার এবং সম্ভ্রান্ত লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয় কোনরকমে। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে রিও-তে। বহু অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার, ক্যান্টনমেন্ট ছাড়াও মিলিটারি একাডেমি, অপেরা হাউজ, মেডিক্যাল স্কুল, অস্ত্র কারখানা, প্রিন্টিং প্রেস, ইত্যাদি গড়ে উঠে। হঠাত উচ্চবংশীয় মানুষের ঢল আসায় দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে হু-হু করে। তবে সবচাইতে বড় যে ব্যাপারটি হয় তা হলো, রিও যেখানে ছিল একটা ঔপনিবেশিক শহর, সেটা মুহুর্তের মাঝে হয়ে যায় একটা রাষ্ট্রের রাজধানী শহর। রিও-তে রাজধানী স্থানান্তর হওয়ায় সেখানে প্রায় সোয়া তিন লাখেরও বেশি ক্রীতদাসের আগমণ ঘটে। জন রিও-তে নেমেই ব্রাজিলের বন্দরগুলিকে ‘ওপেন’ ঘোষণা দেন, যার মাধ্যমে ব্রাজিলে ব্রিটিশ জাহাজের অবতরণ সহজ হয়ে যায়। রিও-তে জন-এর অবতরণের কারণেই ব্রাজিল পর্তুগাল থেকে আলাদা হবার জন্যে প্রস্তুত হয়। নতুন দেশের নামকরণ করা হয় ‘ইউনাইটেড কিংডম অব পর্তুগাল, ব্রাজিল এবং এলগার্ভেস’। বলাই বাহুল্য যে দেশের নামকরণ ব্রিটিশদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।


  
১৮০৭ সালে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে রাজপরিবারকে রক্ষা করতে রাজা ষষ্ঠ জন তল্পিতল্পাসহ পর্তুগাল থেকে পালিয়ে যান। তাদের সহাহতা দেয় ব্রিটিশ রয়াল নেভি। ব্রাজিলের মাটিতে নেমেই জন ব্রিটেনকে বাণিজ্যিক এবং সামরিক সুবিধা দিতে থাকেন। একারণেই দক্ষিণ আমেরিকার স্প্যানিস উপনিবেশ ব্রিটিশরা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করলেও ব্রাজিলকে ভাঙ্গেনি। তবে ব্রাজিলকে পর্তুগাল থেকে আলাদা করে দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে বড় রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করেছে।  


ব্রিটিশরা যেভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলো

একই সময়ে ব্রিটিশরা তখন আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকায় বাকি স্প্যানিস উপনিবেশগুলিকে স্পেন থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল। জন-এর স্প্যানিস স্ত্রী কারলোটা এবার আর্জেন্টিনায় স্প্যানিস উপনিবেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন এবং জনকে বাধ্য করেন উরুগুয়েতে যুদ্ধে (১৮১৭-১৮২১) অংশ নিতে। ব্রিটিশরা এসময়ে ব্রাজিলের সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে গায়ানার উপকূলের কিছু এলাকা দখল করে নেয় এবং ব্রাজিলের সাথে অযাচিত পদ্ধতিতে একচেটিয়া বাণিজ্য করে।

১৮১৫ সালে ন্যাপোলিয়নের পতন এবং ১৮১৬ সালে পর্তুগীজ রানী মারিয়ার মৃত্যুর পরে পর্তুগীজ রাষ্ট্রীয় লোকজন জনকে পর্তুগালে ফেরত আসার জন্যে চাপ দেয়। ১৮২১ সালের জুলাই মাসে জন ব্রাজিল থেকে লিসবনে এসে পৌঁছান। তিনি প্রায় ১৩ বছর ব্রাজিলে কাটান। তিনি এখন পর্তুগালের রাজা। ব্রাজিল ত্যাগের আগেই পর্তুগাল এবং ব্রাজিলে লিবারাল গোষ্ঠী ব্যাপক ক্ষমতা অর্জন করে এবং রাজার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কর্তন করে। সেসময় পর্তুগালের শাসনভার ন্যাস্ত ছিল ব্রিটিশ সামরিক অফিসার মার্শাল উইলিয়াম কার বেরেসফোর্ড। জন পর্তুগালে ফেরত যাবার পর প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের ছায়াতলেই তাকে থাকতে হয়েছে।

ব্রাজিলের রাজা পেদ্রোর অভিষেক অনুষ্ঠান, ১৮২২ সাল। পর্তুগালের সংবিধানের উপরে শপথ নিতে পেদ্রোকে বাধ্য করা হয়। পর্তুগালের সাথে ব্রাজিলের সম্পর্কও কর্তন হয়ে যায়নি অত সহজে। পেদ্রোর কন্যা পরবর্তীতে পর্তুগালের রানীও হন। তাদের সূত্রেই ১৯১০ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের শেষ রাজার শাসন চলেছিল।
 

ব্রাজিল – নতুন দেশ, নতুন রাজা, নতুন পতাকা

জন তার ছেলে পেদ্রোকে রিও-তে রেখে আসেন এবং বলে আসেন যে, পেদ্রো যেন ব্রাজিলের রাজা হয়ে যান; নাহলে অন্য কেউ পেদ্রোর স্থান নিয়ে নেবে। ব্রাজিলের জনগণ এতদিন রাষ্ট্রের মূলে থাকার সুবিধা পেয়েছে। এখন তারা রাজার পর্তুগালে চলে যাওয়াটা ভালোভাবে দেখেনি। ব্রাজিলে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা মূলত সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। তারা পেদ্রোকে রাজা হিসেবে রেখে ১৮২২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পর্তুগালের সংবিধানের উপরে শপথ নিতে পেদ্রোকে বাধ্য করা হয়।

ব্রাজিলের জন্যে নতুন পতাকা নির্ধারিত হয়। পতাকার সবুজ জমিন এসেছে রাজা পেদ্রোর ব্রাগাঞ্জা বংশ (হাউজ অব ব্রাগাঞ্জা) থেকে আর হলুদ রঙ এসেছে পেদ্রোর স্ত্রী অস্ট্রিয়ার প্রিন্সেস মারিয়া লিওপোলডিনা-এর হ্যাপসবার্গ বংশ থেকে। ১৮৮৯ সালে ব্রাজিলিয়ান রিপাবলিক ঘোষণার আগ পর্যন্ত ব্রাজিলের এই পতাকাই থাকে। তবে ১৮৭০ সালে পতাকার মাঝের ১৯টি তারা থেকে ২০টি তারা করা হয় ব্রাজিলের রাজ্যের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে। ব্রাজিল রিপাবলিকের পতাকায় ২১টি তারা স্থান পায়, যা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একই থাকে। তবে ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে কয়েকদিনের জন্যে আরেকটা পতাকার ডিজাইন আনা হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার আদলে তৈরি করা হয়েছিল। ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব ব্রাজিল’এর সেই পতাকা প্রতিযোগিতায় টেকেনি; বরং সেই পুরোনো ব্রাজিল রাজের পতাকাকেই পরিবর্তন করে নিয়ে নতুন পতাকা আঁকা হয়। ব্রাজিলের জনগণের মূল এখনও সেই পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়া-সহ ইউরোপের বাকি দেশগুলি। ঊনিশ এবং বিংশ শতকে ইউরোপ থেকে বহু মানুষ ব্রাজিলে এসে বসবাস শুরু করেছে। তাদের আকর্ষণ করেছে ব্রাজিলের ইউরোপিয়ান ভিত। তাদের কাছে ব্রাজিল হয়ে ওঠে বিষুবীয় অঞ্চলের ইউরোপ। ব্রাজিলের পতাকায় কেউ কেউ মানচিত্র বসাতে চেয়েছিল। সেটা সফল না হলেও পতাকায় ‘সাউদার্ন ক্রস’ তারকামন্ডলী এঁকে দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্রাজিলের উপস্থিতি শুধুমাত্র দক্ষিণ গোলার্ধেই থাকবে।

ব্রাজিল রিপাবলিকের পতাকা (১৮৮৯-১৯৬০ সাল)। এই পতাকায় তারার সংখ্যা ছিল ২১টি। পরবর্তীতে আরও দুইবার পতাকাতে পরিবর্তন আনা হয় ২২তম এবং ২৩তম প্রদেশের কারণে। তবে সবুজ এবং হলুদ বহাল রাখা হয়, যা ব্রাজিল রাজের রাজবংশের প্রতিনিধিত্ব করে। 
 

ব্রিটেন যেভাবে ব্রাজিল তৈরি করেছে

পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়া উভয়েই বেশিরভাগ সময়ে ব্রিটেনের সাথে থেকেছে। তারা হয় ফ্রান্স বা রাশিয়া বা জার্মান আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্রিটেনের সাথে থেকেছে। ব্রিটেন ইউরোপে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সকে নিয়ন্ত্রণ করতে পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়াকে ব্যবহার করেছে। পরবর্তীতে জার্মানিকে নিয়ন্ত্রণ করতেও একই কাজ করেছে। ব্রাজিলের পর্তুগাল থেকে আলাদা হওয়াটা ব্রিটেনকেই সুবিধা দিয়েছে সবচাইতে বেশি। ন্যাপোলিয়ন ব্রিটেনের সাথে সারা বিশ্বে যুদ্ধে জড়িয়েছেন ঠিকই; তবে ব্রিটেনই এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছিল। ন্যাপোলিয়নের উত্থান ছিল এক ব্যক্তির উত্থান। স্পেনের সাথে যুদ্ধের সুবাদে পুরো ল্যাটিন আমেরিকার বাণিজ্যই ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। পর্তুগালের রাজাকে রিও-তে বসিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করা, আর্জেন্টিনায় ব্রিটিশ সৈন্য নামিয়ে পুরো স্প্যানিস দক্ষিণ আমেরিকায় বিদ্রোহ উস্কে দেয়া, অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ প্রিন্সেসের সাথে ব্রাজিলের হবু রাজা পেদ্রোর বিয়ের ব্যবস্থা করে ব্রিটেনের বন্ধু অস্ট্রিয়ার জনগণকে দক্ষিণ আমেরিকায় আসতে আগ্রহী করে তোলা – এগুলি সকলই ছিল সুপারপাওয়ার হিসেবে ব্রিটেনের কর্মকান্ড। ব্রাজিলে পর্তুগালের রাজা, স্পেনে জন্ম নেয়া পর্তুগালের রানী এবং অস্ট্রিয়ার প্রিন্সেসের আগমনের ফলে ব্রাজিলের জনসংখ্যা বাকি ল্যাটিন আমেরিকার চাইতে অনেক বেড়ে যায়। আরও এসেছে ইতালি এবং জার্মানি থেকে। ১৮৮০ থেকে ১৯৬৯-এর মাঝে মোটামুটি ৯০ বছরে পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি এবং জার্মানি থেকে ৪১ লাখেরও বেশি লোক ব্রাজিলে এসেছে। এছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকে এসেছিল সাড়ে ১০ লাখ মানুষ। ব্রাজিল হয়ে ওঠে ল্যাটিন আমেরিকার সবচাইতে জনবহুল দেশ। ব্রাজিল কোনভাবে ভেঙ্গে ছোটও হয়নি। অন্যদিকে স্প্যানিসদের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলি অনেকগুলি দেশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় সেগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আবার পর্তুগালের সাথে ব্রাজিলের সম্পর্কও কর্তন হয়ে যায়নি অত সহজে। পেদ্রোর কন্যা পরবর্তীতে পর্তুগালের রানীও হন। তাদের সূত্রেই ১৯১০ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের শেষ রাজার শাসন চলেছিল।


১৮৮৯ সালের নভেম্বরে কয়েক দিনের জন্যে 'ইউনাইটেড স্টেটস অব ব্রাজিল'এর পতাকা। বলাই বাহুল্য যে এই পতাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার আদলে তৈরি করা। এই পতাকা ব্রাজিলকে নিয়ে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ।


ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটিশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব

ল্যাটিন আমেরিকায় এই কর্মকান্ডের মাঝে ব্রিটেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে ব্রিটেনের কাছ থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কলম্বিয়া, পেরু, বলিভিয়া এবং ব্রাজিলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হতে থাকে, যা তাকে ব্রিটেনের সামনে দাঁড় করায়। পানামকে যুক্তরাষ্ট্র নিজ হাতে তৈরি করেছে পানাম খাল তৈরি করার নিমিত্তে। এই খালের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলের মাঝে সামুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। অন্যদিকে ব্রিটেন ক্যারিবিয়ান সাগরে কিছু দ্বীপ দখলে রেখে এই অঞ্চলের সমুদ্র বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চেয়েছে। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের হাতে রেখে ম্যাজেলান প্রণালীর সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। চিলিকে নিজেদের অধীনে রেখে পুরো ল্যাটিন আমেরিকার উপরেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।



ব্রাজিলের জন্ম ব্রিটেনের নীতির মাঝ দিয়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার বেশিরভাগ শক্তি হারিয়েছে বটে, তবে একেবারে মৃত হয়ে যায়নি। এখনও ব্রিটিশরা প্রভাবের জন্যে মার্কিনীদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ল্যাটিন আমেরিকার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ-মার্কিনীরা। ব্রাজিল আকারে বড় হলেও সুপারপাওয়ারের রাজনীতির শিকার। কারণ সুপারপাওয়ারের হাতেই তার জন্ম হয়েছিল প্রায় দু'শ বছর আগে। কিন্তু দু'শ বছর পরেও ব্রাজিল সুপারপাওয়ারের দিকেই চেয়ে থাকে। বিশ্বরাজনীতিতে ব্রাজিলের পদচারণা সুপারপাওয়ারের ইচ্ছার ব্যাতিরেকে নয়। 


আরও পড়ুনঃ
ভেনিজুয়েলা-কলম্বিয়া-ইকুয়েডরের পতাকা একইরকম কেন?
আর্জেন্টিনা কি পারবে?

Wednesday 4 July 2018

ভেনিজুয়েলা-কলম্বিয়া-ইকুয়েডরের পতাকা একইরকম কেন?

ঊনিশ শতকে গ্র্যান কলম্বিয়া তৈরি হয় স্পেন থেকে আলাদা হয়ে। এরপরে গ্র্যান কলম্বিয়া ভেঙ্গে তৈরি হয় ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডর। দেশগুলির পতাকায় মিল এতটাই যে, এদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। 


 ০৫ জুলাই ২০১৮
 
দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি একসময় ছিল স্প্যানিস এবং পর্তুগীজ উপনিবেশ। পঞ্চদশ শতকের শেষে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অভিযানের পর থেকে ঐ এলাকার মানুষগুলিকে প্রায় নির্মূল করে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা সেখানে বসতি গড়ে। জনসংখ্যার পুরোটাই প্রকৃতপক্ষে ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত। এদের ভাষা এবং সংস্কৃতি একই। তবুও অনেকগুলি দেশে বিভক্ত এই মহাদেশ। অনেকগুলি পতাকা; জাতীয় সঙ্গীত; জাতীয় প্রতীক। এই বিভক্তির কারণ খুঁজতে যেতে হবে অষ্টম শতাব্দীতে, যখন ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি আলাদা হবার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
  
স্প্যানিস সামরিক অফিসার ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা ব্রিটিশদের সহায়তায় স্পেনের কাছ থেকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিকে আলাদা করার ব্যবস্থা করেন। তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে সবচাইতে বেশি লাভবান হয়েছে তৎকালীন সুপারপাওয়ার ব্রিটেন। স্প্যানিসরা ফ্রাঞ্চিসকোকে ব্রিটিশ গুপ্তচর সন্দেহ করতো।


ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা – যিনি দক্ষিণ আমেরিকাকে স্পেন থেকে আলাদা করেন

১৭৫০ সালে ভেনিজুয়েলাতে জন্ম নেয়া স্প্যানিস সামরিক অফিসার ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা বহু দেশের বহু যুদ্ধে অংশ নেন। মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্প্যানিসরা সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের কিছু উপনিবেশ বাগিয়ে নিতে চায়। ১৭৮১ থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে স্প্যানিস বাহিনীর অধীনে যুদ্ধে করেন ফ্রাঞ্চিসকো। ১৭৮১ সালে ফ্রাঞ্চিসকোকে ব্রিটিশ উপনিবেশ জামাইকাতে গোয়েন্দাগিরি করতে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি তার কর্মসম্পাদনের মাঝে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ফিলিপ অলউডের সাথে এক চুক্তিও করে ফেলেন। চুক্তি মোতাবেক ব্রিটিশদেরকে তিনি স্পেনের সাথে বাণিজ্যের আড়ালে স্পেনে যাবার একটা চ্যানেল খুলে দেন। স্প্যানিসরা পরবর্তীতে ফ্রাঞ্চিসকোকে গুপ্তচর আখ্যা দেয় এবং অবিশ্বাস করতে থাকে। ফ্রাঞ্চিসকো স্পেন এবং ফ্রান্সের এক যৌথ অপারেশনে অংশ নেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশদের সবচাইতে শক্ত ঘাঁটি জামাইকাকে দখল করা। পুরো দলের মাঝে ফ্রাঞ্চিসকোরই ব্রিটিশদের সম্পর্কে সবচাইতে ভালো ধারণা ছিল, কারণ তাকে ব্রিটিশদের উপরে গোয়ান্দাগিরিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এই অভিযান চলার মাঝেই কিভাবে যেন ব্রিটশরা আগেভাগে পরিকল্পনা জেনে ফেলে এবং আগেই আক্রমণ করে বসে; ভেস্তে যায় অভিযান। জামাইকা ব্রিটিশদের হাতেই থাকে। আভিযান ব্যর্থ হবার পর ফ্রাঞ্চিসকোর বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আবারও গভীর হয়। ফ্রাঞ্চিসকো ১৭৮৩ সালের জুলাই মাসে স্প্যানিস কিউবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান, এবং পরের বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি জর্জ ওয়াশিংটন, হেনরি নক্স, থমাস পেইন, আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন, স্যামুয়েল এডামস এবং থমাস জেফারসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।

ফ্রাঞ্চিসকো কি ব্রিটিশ গুপ্তচর ছিলেন?

১৭৮৫ সালে ফ্রাঞ্চিসকো লন্ডনে আসেন। সেখান থেকে মার্কিন দূতাবাসের এক সামরিক কূটনীতিবিদ কর্নেল উইলিয়াম স্টিফেন স্মিথের সাথে তিনি প্রুশিয়া যান সামরিক মহড়া দেখতে। পুরো ইউরোপ ঘুরে তিনি অনেকের সাথে বন্ধুত্ব করেন।স্প্যানিয়ার্ডরা সবসময়েই তার উপরে নজর রাখছিল। তারা ফ্রাঞ্চিসকোকে গ্রপ্তার করার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু শক্তিশালী বন্ধুরা ফ্রাঞ্চিসকোকে রক্ষা করে। ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা অনেকদিন থেকেই দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশের একটা বড় অংশের দায়িত্বে থাকা ‘ক্যাপ্টেন্সি জেনারেল অব ভেনেজুয়েলা’র কর্তৃত্ব নিতে এক পরিকল্পনা করেন। এই ক্যাপ্টেন্সির অধীনে বর্তমান ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, পানামা, ইকুয়েডর এবং পেরুর বিরাট অঞ্চল ছিল। তিনি ১৭৯০ সালে প্রথম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদের সাথে দক্ষিণ আমেরিকায় আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাটা আলোচনা করেন। তখন ব্রিটিশদের সাথে স্প্যানিয়ার্ডদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। তবে দু’দেশের সম্পর্কে বসন্ত এসে গেলে এই প্রকল্পে ব্রিটিশরা আগ্রহ হারায়।

১৭৯১ থেকে ১৭৯৭ পর্যন্ত সময় ফ্রাঞ্চিসকো ফ্রান্সে কাটান এবং সেখানকার ফরাসী বিপ্লবে সরাসরি অংশ নেন। তিনি ফরাসি বিপ্লবের বিপক্ষে রাজতন্ত্রকামীদের সাথে থাকেন। একাধিকবার বিপ্লবীদের হাতে গ্রেপ্তার হবার পরেও তাকে নিয়ে কি করা হবে, সেটা ঠিক করতে না পেরে তাকে বারংবার ছেড়ে দেয়া হয়। ছাড়া পাবার পরেও তিনি তার কর্মকান্ড অব্যহত রাখেন এবং ১৭৯৬-৯৭ সালের মাঝে দু’দু’বার রাজতন্ত্রপন্থীদের পক্ষে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। অবশেষে সকল চেষ্টা ভেস্তে গেলে ১৭৯৮ সালে গোপনে ব্রিটেনে পালিয়ে যান, যেখানে সবসময়ই তার নিরাপদ আশ্রয় আপেক্ষা করছিল। ব্রিটেন সবসময়েই ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে রাজতন্ত্রীদের সহায়তা দিয়েছিল। আর ১৭৯৯ সাল থেকে ফরাসী বিপ্লব থেকে উত্থিত ন্যাপোলিয়ন আবির্ভূত হন ব্রিটেনের বিশাল শত্রু হিসেবে।

ল্যাটিন আমেরিকায় ফ্রাঞ্চিসকোর প্রথম অভিযান - যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা


তার দক্ষিণ আমেরিকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৮০১ সালে ব্রিটিশদের সহায়তা চান ফ্রাঞ্চিসকো। স্পেন তখন ব্রিটেনের শত্রু দেশ, কেননা ১৭৯৬ থেকে ফ্রান্সের সাথে স্পেন হাত মিলিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট দ্যা ইয়াংগার ১৮০৫ সালে রিয়ার এডমিরাল হোম রিগস পপহ্যামকে দায়িত্ব দেন ফ্রাঞ্চিসকোর পরিকল্পনাটি খতিয়ে দেখার জন্যে। পপহ্যাম ব্রিটিশ নেতৃত্বকে বোঝান যে, দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিস উপনিবেশকে স্পেন থেকে আলাদা করতে গেলে ভেনিজুয়েলা নয়, বরং বর্তমান আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সের ফলাফল বয়ে আনার সম্ভাবনা বেশি। সেখানে ব্রিটিশ হামলা হলে স্প্যানিস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উস্কে দেয়া যাবে অপেক্ষাকৃত সহজে।

ফ্রাঞ্চিসকো এতে মনোক্ষুন্ন হলেন। তিনি তার পরিকল্পনা পাল্টে ১৮০৫-এর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সরণাপন্ন হলেন। ফ্রাঞ্চিসকো মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন এবং পররাষ্ট্র সচিব জেমস ম্যাডিসনের সাথেও একান্ত বৈঠক করেন। যুক্তরাষ্ট্র ফ্রাঞ্চিসকোকে সরাসরি সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানান, কারণ ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তখনও পক্ষ নেয়নি। ফ্রাঞ্চিসকো থেমে যাননি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ এবং জনবল যোগাড় করায় মনোনিবেশ করেন, যা ব্যবহার করে তিনি ভেনিজুয়েলাতে সামরিক অপারেশনে যাবেন। দু’শ-এর মতো ভাড়াটে সৈন্য এ অভিযানে যেতে রাজি হয়। তার সাথে থাকে ফ্রাঞ্চিসকোর পুরোনো বন্ধু মার্কিন কর্নেল উইলিয়াম স্টিফেন স্মিথ। মার্কিন ব্যবসায়ী স্যামুয়েল ওগডেনের কাছ থেকে তিনি ২০টি কামানের একটা জাহাজ ভাড়া নেন; নাম দেন ‘লিয়্যান্ডার’। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে ফ্রাঞ্চিসকো আরও দু’টা জাহাজ সাথে নেন। এই সময়েই তিনি ভেনিজুয়েলার পতাকার ডিজাইন করে ১২ই মার্চ উত্তোলন করেন। পতাকাটা ছিল তিনটি রঙের সমান্তরাল দাগ – হলুদ, নীল এবং লাল। তবে ফ্রাঞ্চিসকোর মিশন সফল হলো না। ১৮০৬ সালের ২৮শে এপ্রিল ভেনিজুয়েলার উপকূলে অবতরণ করতে গিয়ে ফ্রাঞ্চিসকো স্প্যানিশ নৌবাহিনীর কাছে তার ক্যারিবিয়ান থেকে সংগৃহীত দু’টি জাহাজই হারান। ৬০ জন নাবিক বন্দী হয়, যাদের বিচারের পরে ১০ জনের মৃত্যুদন্ড দিয়ে মরদেহ কয়েক খন্ড করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফ্রাঞ্চিসকো অবশ্য লিয়্যান্ডার-এ চড়ে প্রাণ নিয়ে পালান। তাকে পলায়নে সহায়তা দেয় ব্রিটিশ রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজ ‘লিলি’। ব্রিটিশরা ফ্রাঞ্চিসকোকে ব্রিটিশ উপনিবেশ বার্বাডোসে নিয়ে যায়, এবং ফাঞ্চিসকোকে আরেকবার সামরিক অভিযানে সহায়তা দিতে আগ্রহী হয়।

ফ্রাঞ্চিসকোর দ্বিতীয় অভিযান - যুক্তরাষ্ট্রের স্থানে ব্রিটেন

১৮০৬ সালের ২৪শে জুলাই ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেন থেকে ফ্রাঞ্চিসকোর নতুন অভিযানের শুরু হয়। তার যুদ্ধজাহাজ লিয়্যান্ডার-এর সাথে রয়েছে রয়াল নেভির ৪টা যুদ্ধজাহাজ। ফ্রাঞ্চিসকোর ভাড়াটে সেনারা এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনীর নাবিকেরা উপকূলে নেমে কিছুদিন তাদের দখলের চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু স্প্যানিশ সৈন্যদের সংখ্যাধিক্যের কারণে অগাস্টের মাঝেই তিনি তার অভিযান গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। এই ব্যর্থ অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ফ্রাঞ্চিসকোকে সহায়তা করার জন্যে কর্নেল উইলিয়াম স্মিথ এবং ব্যবসায়ী স্যামুয়েল ওগডেনের বিরুদ্ধে মামলা করে। অভিযোগ ছিল যে, তারা দস্যুতা করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষতাকে নষ্ট করেছেন। আদালতে হাজির হয়ে কর্নেল স্মিথ বীরদর্পে বলেন যে, তিনি এই অপারেশনে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন এবং পররাষ্ট্র সচিব জেমস ম্যাডিসনের নির্দেশে। এই রাজনীতিবিদেরা উভয়েই আদালতে যেতে অস্বীকৃতি জানান এবং ফলশ্রুতিতে স্মিথ এবং ওগডেন উভয়কেই নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। আসলে এই অপারেশনটা প্রথমে ছিল মার্কিন। এরপর প্রথম ব্যর্থতার পর ব্রিটিশরা সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলাতেই যতো বিপত্তির সৃষ্টি হয়। ভেনিজুয়েলাকে স্পেন থেকে আলাদা করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উভয়েই সেটার নিয়ন্ত্রণ চাইছিল।


  
আর্জেন্টিনার প্রতিষ্ঠাতা হোজে ডে স্যান মার্টিন এবং চিলির প্রতিষ্ঠাতা বার্নার্ডো ও'হিগিন্স আন্দিজ পর্বত পাড়ি দিচ্ছেন চিলির উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশরা আর্জেন্টিনায় অভিযান চালানোর পর পুরো ল্যাটিন আমেরিকা স্প্যানিস শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। আপাতদৃষ্টিতে ব্রিটিশ অপারেশনকে ব্যর্থ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ল্যাটিন আমেরিকাকে স্পেন থেকে আলাদা করাই ছিল ব্রিটিশ পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বাধীনতাকামী নেতারা বিরাট ভূমিকা পালন করে। 


ব্রিটিশরা কি দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যার্থ হয়েছিল?

এর মাঝেই ১৮০৬-০৭ সালের মাঝে ব্রিটিশ সরকার বর্তমান আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সে একটা সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। স্প্যানিসদের বেশিরভাগ সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত ছিল ভেনিজুয়েলাতে; আর্জেন্টিনার আশেপাশে শক্তি ছিল খুবই কম; যেকারণেই ব্রিটিশরা সেখানে অপারেশনে যায়। এরপরেও সরাসরি সাফল্য না পেয়ে ব্রিটিশরা সেখান থেকে চলে আসে। ফ্রাঞ্চিসকো এবার লন্ডন যান এবং নতুন করে ভেনিজুয়েলা আভিযানের জন্যে ব্রিটিশ সহায়তা চাইতে থাকেন। কিন্তু ঠিক সেসময় বিরাট এক রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়ে যায়। ১৮০৫ সালে ফরাসী-স্প্যানিস নৌবহর ব্রিটিশদের হাতে ত্রাফালগার-এর যুদ্ধে পরাজিত হলে পর্তুগীজরা আত্মায় শক্তি পায় এবং ব্রিটিশদের পক্ষে চলে যায়। এতে ন্যাপোলিয়ন ক্ষেপে গিয়ে স্পেন এবং পর্তুগালে সৈন্য পাঠান। এভাবে স্পেন হয়ে যায় ব্রিটিশ বন্ধু; এবং দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিস উপনিবেশকে স্পেন থেকে আলাদা করার পরিকল্পনা মুলতুবি করা হয়। কিন্তু ততদিনে যা হবার, তা হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আক্রমণের ফলশ্রুতিতে ভেনিজুয়েলা এবং আর্জেন্টিনায় বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। ১৮১০ সালের মে মাসে আর্জেন্টিনায় বিদ্রোহীরা স্প্যানিস নেতৃত্বের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়। আর্জেন্টিনার বিদ্রোহীরা হোজে ডে স্যান মার্টিনের নেতৃত্বে এরপর চিলি এবং পেরুকে স্পেন থেকে আলাদা করে ফেলে।

প্রায় তিন’শ বছর ধরে ব্রিটিশরা দক্ষিণ আমেরিকায় বড় কোন অপারেশনে যায়নি। ন্যাপোলিয়নের অভিযানকে উপজীব্য করে ব্রিটিশরা স্পেনের উপনিবেশগুলিকে স্পেন থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়া শুরু করে। সেই প্রক্রিয়াতে ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা সহায়তা করেছিলেন শুধু। মিরান্ডার আঁকা পতাকাকেই পরবর্তীতে ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডর নিজেদের জাতীয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেয়। ১৮১০ সালের ১৯শে এপ্রিল ভেনিজুয়েলার কারাকাসে বিদ্রোহীরা স্প্যানিস নেতৃত্বকে বন্দী করে ফেলে। সিমন বলিভার এবং আন্দ্রেস বেলোর নেতৃত্বে তারা লন্ডনে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি চায় এবং সরাসরি ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ কামনা করে। তারা ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডাকেও তাদের সাথে ভেনিজুয়েলাতে নিয়ে আসে। ১৮১১ সালের জুলাই মাসে স্বাধীন ভেনিজুয়েলার ঘোষণা দেয়া এবং ফ্রাঞ্চিসকোর ব্যবহার করা তিন রঙের ভেনিজুয়েলার পতাকাকে অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু ১৮১২ সালে এক প্রতিবিপ্লবের মাঝ দিয়ে স্পেনপন্থীরা আবারও ক্ষমতা দখল করে নেয়। ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা স্প্যানিসদের সাথে চুক্তি করতে গেলে সিমন বলিভার এতে নাখোশ হন। বলিভারের হিসবে সেটা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। ফ্রাঞ্চিসকোকে তারা স্প্যানিস নেতৃত্বের হাতে তুলে দেয়, আর এর বিনিয়মে চুক্তি মোতাবেক সিমন বলিভারকে নিরাপদে স্পেনে ভ্রমণ করার অনুমতি দেয় স্প্যানিয়ার্ডরা। ১৮১৬ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা বিচারাধীন অবস্থায়ই স্পেনে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার লাশ গণকবরে দাফন করা হয়, যাতে কোনটা তার কবর, সেটা যেন খুঁজে পাওয়া না যায়।
  

জার্মান দার্শনিক উলফগ্যাং ফন গোথে ভেনিজুয়েলার পতাকার রংগুলি বেছে নিতে সহায়তা করেছিলেন। পতাকার ডিজাইন করেছিলেন ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা। পরবর্তীতে এই তিন রঙের পতাকাই ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরের পতাকায় স্থান পায়। উৎস একই বলে ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশগুলির মাঝে পার্থক্য করা কঠিন।

যেভাবে তিন দেশের পতাকা আঁকা হলো

ফ্রাঞ্চিসকো ভেনিজুয়েলার পতাকার ধারণাকে আকারে রূপ দিতে কথা বলেছিলেন জার্মান দার্শনিক জোহান উলফগ্যাং ফন গোথে এবং রুশ কূটনীতিবিদ সাইমন রোমানোভিচ ভরনজফের সাথে। গোথের সাথে ফ্রাঞ্চিসকোর পতাকা নিয়ে কথা হয় ১৭৮৫ সালে। গোথে তাকে বলেন যে, তিনটা মূল রঙ থেকেই আলোর সৃষ্টি হয় – হলুদ, নীল এবং লাল। এই তিনটা রঙ আলাদাভাবে শুরু হলেও শেষ হয় এক লক্ষ্যে। ফ্রাঞ্চিসকোরও তাই এরকমই এক লক্ষ্যে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ। ফ্রাঞ্চিসকো চাইছিলেন আমেরিকাতে পুরো স্প্যানিস উপনিবেশ মিলিয়ে বিশাল এক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। একেবারে বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম এবং মধ্যাংশ থেকে শুরু করে মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, কিউবা সহ, দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর মিলে সেই রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ফ্রাঞ্চিসকো। ব্রিটিশদের কাছে উপস্থাপিত তার পরিকল্পনা তেমনই ছিল। মূলতঃ স্পেন থেকে আলাদা হবার কাজটাই তিনি করেছিলেন। বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ স্থানে উপস্থিত থাকায় স্পেন তাকে ব্রিটিশ গুপ্তচর হিসেবে মনে করতো। ফরাসী বিপ্লবের সময়ে বিপ্লবের বিপক্ষের রাজতন্ত্রকামীদের (যাদেরকে ব্রিটিশরা সহায়তা করতো) পক্ষে একাধিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা তার স্প্যানিস দোষারোপকে মুছে ফেলতে সহায়তা করে না। স্পেন ন্যাপোলিয়নের পক্ষে থাকার সময় তিনি ব্রিটিশদের সহায়তায় ল্যাটিন আমেরিকার বিদ্রোহ উস্কে দেন। এরপর স্পেন ব্রিটিশদের পক্ষে গেলেও তার কর্মকান্ড চালিয়ে যান, এবং স্পেন থেকে তার সকল ল্যাটিন আমেরিকার উপনিবেশ আলাদা করে ফেলেন। তিনি স্থিতিশীল কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি; যে কাজটা পরে সিমন বলিভার করেছিলেন।
 

ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সিমন বলিভারের ছবির সামনে কথা বলছেন। সিমন বলিভার ল্যাটিন আমেরিকার জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে স্বীকৃত হলেও তিনি আসলে কয়েকটা দেশের জন্মদাতা। ফ্রাঞ্চিসকো ডে মিরান্ডা যেখানে ল্যাটিন আমেরিকাকে স্পেন থেকে আলাদা করেছিলেন, বলিভার সেই আলাদা হওয়া ল্যাটিন আমেরিকাকে টুকরো টুকরো করায় অংশ নিয়েছেন।

 
সিমন বলিভার এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভক্তি

সিমন বলিভার ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিস অঞ্চলগুলিকে টুকরো টুকরো করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৮১৯ সালে রিপাবলিক অব কলম্বিয়া তৈরি করে নিজে প্রেসিডেন্ট হন, এবং দুই জন ভাইস প্রেসিডেন্টের অধীনে দেশটাকে দুই ভাগ করেন। একটার নাম দেয়া হয় ভেনিজুয়েলা, আর আরেকটা নিউ গ্রানাডা (পরবর্তীতে কলম্বিয়া)। তবে দেশগুলি যে একই উৎস থেকে এসেছিল, তা ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরের পতাকা দেখলেই বোঝা যায়। তিন দেশের পতাকাতেই একই রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, যা কিনা ফ্রাঞ্চিসকোর আঁকা। বলিভার এবং ফ্রাঞ্চিসকোর চিন্তাধারায় কিছুটা দ্বিমত ছিল। যেখানে ফ্রাঞ্চিসকো ছিলেন ব্রিটিশপন্থী, বলিভার ছিলেন সমাজতন্ত্রী। বলিভারের সমাজন্তন্ত্রী চিন্তাধারা তার শিক্ষক ডন সিমন রদ্রিগেজ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল। তারা দু’জনে মিলে ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন এবং ১৮০৫ সালে মিলানে ইতালির রাজা হিসেবে ন্যাপোলিয়নের রাজকীয় অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। রদ্রিগেজ ১৭৯৭ সালেই স্প্যানিস শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জড়িত থাকার অপরাধে ভেনিজুয়েলা ছেড়েছিলেন। বলিভার ১৮২১ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নামানুসারে ‘গ্র্যান কলম্বিয়া’ নামে আরেকটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাঝে ছিল বর্তমানের ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, পানামা, ইকুয়েডর। আর্জেন্টিনার জেনারেল হোজে ডে স্যান মার্টিন-এর সাথে একত্রিত হয়ে বলিভার পেরু এবং ইকুয়েডরকে আলাদা করেন। সকলের কাছে এই কাজটি ছিল স্পেন থেকে মুক্ত করার কাজ। প্রকৃতপক্ষে তারা আলাদা কয়েকটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যাদের মাঝে আলাদা হবার কোন কারণই ছিল না। আলাদা আলাদা নেতৃত্ব দেয়া হয় এসব স্থানে, যারা খুব শিগগিরই নিজেদের আখের গোছাতে আলাদা রাষ্ট্র চাইতে থাকেন। ১৮২৫ সালের ৬ই অগাস্ট নতুন আরেকটি দেশের জন্ম দেয়া হয়; যার নামকরণ করা হয় সিমন বলিভারের নামে – বলিভিয়া। এই সবগুলিই তখন ছিল গ্র্যান কলম্বিয়ার অধীনে, যার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন বলিভার। কিন্তু ১৮৩০ সালের মাঝেই গ্র্যান কলম্বিয়া ভেঙ্গে ভেনিজুয়েলা, নিউ গ্রানাডা (কলম্বিয়া) এবং ইকুয়েডর তৈরি হয়; প্রত্যেকটির একচ্ছত্র অধিপতি হন বলিভারেরই সমালোচকেরা, যারা একসময় বলিভারের একনায়কোচিত কার্যকলাপের বিরোধী ছিলেন।
  
খুব অল্প সময়ের মাঝেই ল্যাটিন আমেরিকার পুরো এলাকা স্প্যানিসদের হাতছাড়া তো হয়ই, তদুপরি অনেকগুলি দেশে বিভক্ত হয়ে যায়। সুপারপাওয়ার ব্রিটেন ল্যাটিন আমেরিকাকে একত্রিত দেখতে চায়নি।


ব্রিটেন – সুপারপাওয়ারের রাজনীতিই সবকিছু

ন্যাপোলিয়নের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশরা দক্ষিণ আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করেনি। গায়ানা উপকূলের অল্প কিছু অঞ্চল ডাচ এবং ফ্রেঞ্চদের অধীনে ছাড়া এর প্রায় পুরোটাই ছিল পর্তুগাল এবং স্পেনের অধীনে। ১৮৩০ সাল নাগাদ পর্তুগীজদের অধীনে ব্রাজিল ছাড়াও সৃষ্টি হয় রিও ডে লা প্লাটা (আর্জেন্টিনা), উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, চিলি, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এবং ভেনিজুয়েলা। ব্রিটিশরাও গায়ানা উপকূলে একটা উপনিবেশ করে ফেলে। স্প্যানিস উপনিবেশিক এলাকাটা কেটে টুকরা টুকরা করে ৯টা দেশ তৈরি হলেও ব্রাজিল একত্রেই থাকে; কেউ একে ভাঙ্গেনি। কারণ ব্রাজিল ছিল ব্রিটিশদের বন্ধু পর্তুগালের উপনিবেশ। ব্রিটিশরা চায়নি ব্রাজিল ভেঙ্গে যাক।

ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি স্বপ্নে পাওয়া জাতীয়তার উপরে প্রতিষ্ঠিত। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা নিজেদের মাঝে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে গিয়ে দেশগুলিকে টুকরো টুকরো করেছে। আলাদা করে জাতীয় পতাকা ডিজাইন করার সময় রয়েছে কার? ফ্রাঞ্চিসকো তো কষ্ট করে ডিজাইন করেই দিয়ে গেছেন; তাই ওটার উপরেই কেটে-চিরে দাঁড়িয়ে আছে আজকের পতাকাগুলি। এই পতাকাকে ঘিরেই কতনা আবেগ; উচ্ছ্বাস! কেউ চিন্তাও করেনি যে ৯টা পতাকা মানে ৯টা আলাদা জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত তারা; যদিও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আকৃতি, সকলকিছুই এক! এদের সকলেই একবাক্যে ফ্রাঞ্চিসকো, বলিভার, স্যান মার্টিন-এর মতো কয়েক ব্যক্তিকেই স্মরণ করে; কারণ তাদের সকলেরই জন্ম এদের হাতে। আর এরা আবার কাজটা সম্পাদন করেছে তৎকালীন সুপারপাওয়ার ব্রিটিশদের হাত ধরে। ব্রিটিশরা স্পেন থেকে ল্যাটিন আমেরিকার অঞ্চলকে আলাদা করলেও এদেরকে একত্রে বিরাট এক দেশ হিসেবে দেখতে চায়নি। ছোট ছোট দেশে বিভক্ত হয়ে তারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের মাঝে ব্যাস্ত থেকেছে। জাতীয় পতাকা, সঙ্গীত এবং প্রতীকগুলি তাদের সেই ইন্ধন যুগিয়েছে। হাল্কা বিষয়গুলি তাদের আবেগকে নাড়া দিয়েছে এবং আবেগ হয়েছে তাদের চালিকাশক্তি। ফ্রাঞ্চিসকো, বলিভার, স্যান মার্টিন-এর সৃষ্ট দেশগুলি ভূরাজনীতিতে তাই শিশুই রয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ
আর্জেন্টিনা কি পারবে?