Friday 24 July 2020

ইন্দো-প্যাসিফিকে মার্কিন নৌশক্তির ফেরত আসার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

২৪শে জুলাই ২০২০

দক্ষিণ চীন সাগরে মহড়া দিচ্ছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'নিমিতজ' এবং 'রোনাল্ড রেগ্যান'। চীনারা তাদের অপেক্ষাকৃত স্বল্পক্ষমতার নৌবহরকে মার্কিনীদের সক্ষমতার ফাঁকফোঁকড়ের মাঝে ব্যবহার করে মার্কিন নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। আর এতে তারা বেশ সাফল্যও পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী মার্কিনীদের বন্ধু এবং প্রতিযোগী সকলেই যুক্তরাষ্ট্রের এই সীমাবদ্ধতাগুলিকে অবলোকন করছে; যা কিনা তাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করছে।


করোনা মহামারির মাঝে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি মোতায়েনের প্রতিযোগিতার খবর প্রতিনিয়তই পত্রিকাতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার উপকূলে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সবচাইতে দৃশ্যমান অস্ত্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজে করোনা সংক্রমণের মাঝে চীনারা এপ্রিলে প্রায় এক মাসের জন্যে তাদের একমাত্র বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘লিয়াওনিং’কে সমুদ্রে প্রেরণ করে। ৩০শে এপ্রিল জাহাজটা পূর্ব চীন সাগরে ‘ট্রেনিং’ মিশন শেষ করে চিংদাও বন্দরে ফিরে আসে। পূর্বের সমুদ্রে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রায় ‘অনুপস্থিতি’র মাঝে চীনাদের এই ‘শক্তি প্রদর্শন’ মার্কিন শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

৪ঠা মে জাপানের ইয়োকোসুকা বন্দর ছেড়ে যায় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রোনাল্ড রেগ্যান’। যুক্তরাষ্ট্রের ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে ‘রেগ্যান’কেই রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের বাইরে। গত ২৭ মার্চে পূর্ব এশিয়ার উপকূলে মোতায়েনকৃত যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’এ করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ আবিষ্কারের পর ‘রোনাল্ড রেগ্যান’এও সংক্রমণ ধরা পরে। প্রায় দুই মাস মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপনিবেশ গুয়ামের নৌঘাঁটিতে বসে থাকার পর ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ ১৯শে মে সমুদ্রে বের হয়। অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের আরেক যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিতজ’ ২ বছরের মেইনটেন্যান্স শেষ করে ৮ই জুন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো থেকে যাত্রা করে। জটিল প্রযুক্তির কারণে এধরণের জাহাজকে মেইনটেন্যান্স থেকে অপারেশনে আনতে অনেক সময় লাগে। এর উপর আবার ‘রুজভেল্ট’এ করোনা সংক্রমণের কারণে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে ক্রুদের টেস্ট করা এবং কোয়ার‍্যান্টিনে রাখার কারণে সমুদ্রে যেতে আরও দেরি হয়। ‘নিমিতজ’এর সমুদ্রে যাবার ৪ দিনের মাথায় ১২ই জুন ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনী একসাথে ৩টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে; বড় খবর বলে প্রচার পায় এটা। ২১শে জুন ‘নিমিতজ’ এবং ‘রুজভেল্ট’ যুদ্ধজাহাজের গ্রুপ একত্রে মহড়া দেয়া শুরু করে। ২৮শে জুন থেকে ‘নিমিতজ’ মহড়া দেয়া শুরু করে ‘রেগ্যান’এর সাথে। ‘নিমিতজ’এর ‘ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ১১’এর কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল জেমস ক্লার্ক এক বিবৃতিতে ঘোষণা দেন যে, বিশ্বে একমাত্র মার্কিন নৌবাহিনীরই এরকম শক্তি একত্রিত করার সক্ষমতা রাখে।

৬ই জুলাই মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, দু’টা মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ একত্রে দক্ষিণ চীন সাগরে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। জাহাজদু’টা হলো জাপান থেকে আসা ‘রেগ্যান’ এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তে সান ডিয়েগো থেকে আসা ‘নিমিতজ’। বলা হয় যে, ২০১৪ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো দু’টা জাহাজ একত্রে মহড়া দেয়ার ঘটনা ঘটলো। ১৭ই জুলাই তারা আবারও ঘোষণা দেয় যে, জাহাজদু’টা একই মাসে দ্বিতীয়বারের মতো একত্রে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। তবে প্রশান্ত মহাসাগরে তৃতীয় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ মিডিয়ার আলোচনার বাইরে থাকে। কারণ এরই মাঝে চুপিসারে ৯ই জুলাই জাহাজটা দেশে ফেরত যায়। ‘ইউএসএনআই নিউজ’ জানাচ্ছে যে, গত জানুয়ারিতে জাহাজটা সান ডিয়েগো ছেড়ে গিয়েছিল। মার্চ মাসে ভিয়েতনামে ভ্রমণ করার পরপরই জাহাজটাতে করোনার সংক্রমণ ধরা পরে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২’শ সংক্রমণ ধরা পরেছিল। এই সংক্রমণের খবর বের হবার পর জাহাজের কমান্ডার ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ারকে চাকুরিচ্যুত করা হয়।

২০শে জুলাই ঘোষণা দেয়া হয় যে, ‘নিমিতজ’ যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে এসে হাজির হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে ভারত মহাসাগরে প্রায় পাঁচ মাস ভেসে থাকার পর যুদ্ধজাহাজ ‘আইজেনহাওয়ার’ দেশে ফেরার পর থেকে ভারত মহাসাগরে কোন মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ নেই। ‘নিমিতজ’কে দিয়ে এই শূণ্যস্থান পূরণ করানো হচ্ছে। অর্থাৎ জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় একমাস ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর দাপিয়ে বেড়ানোর পালা শেষ হয়েছে। এর পরবর্তীতে ‘রেগ্যান’এর সাথে প্রশান্ত মহাসাগরে আরেকটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে বেশ কয়েকমাস লেগে যেতে পারে। ‘কিটসাপ সান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কার্ল ভিনসন’ ওয়াশিংটন রাজ্যের ব্রেমারটনে দেড় বছরের মেইনটেন্যান্স শেষ করে অগাস্টের শুরুতে সান ডিয়েগোতে ফেরত আসার কথা রয়েছে। এরপর এর সমুদ্রে যাবার প্রস্তুতি শুরু হবে। ‘জন সি স্টেনিস’, ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ এবং ‘জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ’ লম্বা সময়ের জন্যে ড্রাইডকে রয়েছে। নতুন জাহাজ ‘জেরাল্ড আর ফোর্ড’এর নতুন প্রযুক্তির টেস্টিং এখনও শেষ হয়নি; তাই এখনই পুরোপুরি সার্ভিসে আসছে না। ১০ মাসের মিশন শেষ করে জানুয়ারিতে সান ডিয়েগোতে ফেরত যাওয়া ‘আব্রাহাম লিঙ্কন’ খুব শিগগিরই আবার সাগরে যাচ্ছে না। ৭ মাসের মিশন শেষ করে জুনের মাঝামাঝি নরফোক নৌঘাঁটিতে ফিরেছে ‘হ্যারি এস ট্রুম্যান’। টানা ১৬১ দিন কোন বন্দরে না ভিড়ে রেকর্ড করা ‘আইজেনহাওয়ার’এর নাবিকরা ভূমিতে পা ফেলার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর সাথে সাক্ষাতে এই জাহাজের রক্ষার দায়িত্বে থাকা মার্কিন ক্রুজার ‘সান জেসিন্টো’র ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড ক্রসম্যান বলেন যে, কিছু নাবিক তার কাছে জানতে চেয়েছে যে, কোন জাহাজটা আগে বন্দরে নোঙ্গর করবে।

বিশাল সমরশক্তি থাকার পরেও মানব বাস্তবতাগুলি থেকে মার্কিনীরা বের হতে পারেনি। ১ লক্ষ টনের দৈত্যাকৃতির মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলি যতোটাই শক্তিশালী হোক না কেন, তা সমুদ্রে কতটা সময় কাটাতে পারবে, তা নির্ভর করছে নাবিকদের সক্ষমতার উপর। আর অতি জটিল এবং উচ্চমূল্যের এই প্রযুক্তিকে চালু রাখতে ব্যাপক খরচ ছাড়াও নৌবহরের একটা বড় অংশকে মেইনটেন্যান্সের মাঝে থাকতে হচ্ছে। ক’দিন আগেই উভচর এসল্ট শিপ ‘বনহোমি রিচার্ড’এ ভয়াবহ আগুন এবং ২০১৭ সালে দু’টা ডেস্ট্রয়ারের দুর্ঘটনার পর দুই বছর সার্ভিসের বাইরে থাকার ঘটনা নৌবাহিনীর অপারেশনাল দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এপ্রিল মাসে দক্ষিণ চীন সাগরে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ ফাইটার বহণে সক্ষম এরকমই একটা এসল্ট শিপ ‘আমেরিকা’ মার্কিন উপস্থিতিকে জিইয়ে রেখেছিল। চীনারা তাদের অপেক্ষাকৃত স্বল্পক্ষমতার নৌবহরকে মার্কিনীদের সক্ষমতার ফাঁকফোঁকড়ের মাঝে ব্যবহার করে মার্কিন নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। আর এতে তারা বেশ সাফল্যও পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী মার্কিনীদের বন্ধু এবং প্রতিযোগী সকলেই যুক্তরাষ্ট্রের এই সীমাবদ্ধতাগুলিকে অবলোকন করছে; যা কিনা তাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করছে।

Saturday 18 July 2020

হায়া সোফিয়ায় নামাজ আদায়ের সিদ্ধান্তের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

১৮ই জুলাই ২০২০

ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, হায়া সোফিয়ার এই সিদ্ধান্তে তুরস্ক মুসলিম আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশে এবং বিশ্বব্যাপী বেশকিছু সমর্থন যুগিয়েছে; তবে আরব বিশ্বের নেতৃত্বের সমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ক্যাথোলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ভিতের পশ্চিমা সেকুলার দুনিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের আলাদা করে কঠোর বার্তা দেয়া থেকে দূরে থেকেছে; যা চার্চের কয়েক শতকের দ্বন্দ্বের কথাকে ভুলিয়ে দেয়না। পশ্চিমাদের সাথে রুশদের চলমান টানপোড়েনের মাঝে এই ঘটনা জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে; এরদোগানও তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু ফসল ঘরে তুলে নেবেন। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নতুন কোন বিভেদের জন্ম না দিলেও মুসলিম আবেগ জড়িত থাকার কারণে তা তুর্কি জনগণকে একত্রিত করা ছাড়াও বিশ্বব্যাপী তুরস্ককে আরও গুরুত্বপূর্ণ করেছে; ব্যাপারটা কারুর পছন্দ হোক বা না-ই হোক।


১৭ই জুলাই তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান সাংবাদিকদের বলেন যে, হায়া সোফিয়াকে আবারও মসজিদে রূপান্তরিত করার ব্যাপারটা তুরস্কের সার্বভৌমত্মের ব্যাপার। তুরস্ক মনে করে না যে, এব্যাপারে আন্তর্জাতিক মতামত তুরস্কের জন্যে কোন বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। একই দিনে ‘সিএনএন’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন বলেন যে, হায়া সোফিয়াতে যেকেউ ঢুকতে পারবে এবং এর অভ্যন্তরের ঐতিহাসিক মোজাইকগুলিকে গত ৫’শ বছরের মতোই রক্ষা করা হবে। তিনি বলেন যে, তুরস্ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে করে এই মোজাইকগুলিকে নামাজের সময় ঢেকে রাখা যায়। হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার ব্যাপারটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া পুরোনো ধারণা থেকে এসেছে; বর্তমানে তুরস্কে ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, তুরস্কে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সমঅধিকার পাচ্ছে; যা কিনা ভিন্ন ধর্মালম্বী যেকোন মানুষকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারা সম্ভব। তুরস্ক ইতোমধ্যেই ক্যাথোলিক চার্চের পোপসহ অনেককেই হায়া সোফিয়াতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বলে বলেন তিনি। গত ১০ই জুলাই হায়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের পক্ষে তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালতের রায় পাবার পর থেকে প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো এই স্থাপনাকে নিয়ে চলছে ব্যাপক বাকযুদ্ধ। হায়া সোফিয়ার ইতিহাস এবং এর সাথে বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে এর গুরুত্ব আসলে কতখানি?

৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপল শহরে হায়া সোফিয়া নির্মিত হয় ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের উপাসনালয় হিসেবে। একাদশ শতকে ইস্টার্ন অর্থোডক্স থেকে ক্যাথোলিক চার্চ আলাদা হয়ে যাবার পর ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা বাইজ্যান্টাইন রাজ্যের প্রায় পুরোটাই দখল করে নেয় এবং কন্সটানটিনোপল শহর লুট করে। ক্যাথোলিক ক্রুসেডারদের তৈরি করা ল্যাটিন সাম্রাজ্যের অধীনে ১২৬১ সাল পর্যন্ত এটা ক্যাথোলিক চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ল্যাটিন সাম্রাজ্যকে বাইজ্যান্টাইনরা ফ্রাঙ্কদের (বর্তমানে ফ্রান্স) সাম্রাজ্য বলতো। ক্যাথোলিকরা ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চকে পুরোপুরি নির্মূল করে দেবার চেষ্টা করলেও ১২৬১ সালে কন্সটানটিনোপল শহর আবারও বাইজ্যান্টাইনদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সেসময় থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত হায়া সোফিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৪৫৩ সালে উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের অধীন মুসলিম সেনাবাহিনী কন্সটানটিনোপল বিজয় করে নেয়। মেহমেদ ‘আল ফাতিহ’ হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন এবং সেখানে নামাজ আদায়ের প্রচলন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফত ধ্বংসের পর মুস্তফা কেমাল আতাতুর্কের অধীনে সেকুলার তুরস্ক তৈরি হলে ১৯৩১ সালের পর থেকে হায়া সোফিয়াতে প্রথমবারের মতো সব ধরনের উপাসনা বাতিল করা হয়। ১৯৩৪ সালে এটাকে একটা জাদুঘরে রূপান্তরিত করে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। তুর্কি সংস্কৃতি এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ২০১৯ সালে ৩৭ লক্ষ পর্যটক হায়া সোফিয়া দেখতে এসেছিল।

অনেকেই বলছেন যে, হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের মাধ্যমে এরদোগান নিজ দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাকে ঢাকতে চাইছে। ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৯এর মার্চের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’ আঙ্কারা এবং ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণ হারাবার পর এরদোগান এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে জোর দিয়েছেন। ‘এরাব নিউজ’এর এক লেখায় ধর্মবিষয়ক কনসালট্যান্ট পিটার ওয়েলবি বলেন যে, বর্তমান তুরস্কের বহু ধরনের সমস্যা থাকলেও মসজিদের অভাব সেই সমস্যাগুলির মাঝে একটা নয়। তিনি বলছেন যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে তুরস্ক মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করতে চাইছে। জুনের প্রথম সপ্তাহে করা এক জনমত জরিপের বরাত দিয়ে তুর্কি পত্রিকা ‘ইয়েনি সাফাক’ বলছে যে, তুরস্কের ৭৩ শতাংশ জনগণ হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের পক্ষে; ২২ শতাংশ বিপক্ষে; ৪ শতাংশ কোন মতামত দেয়নি।

হায়া সোফিয়ার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব খুব শক্ত কোন শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হায়া সোফিয়ার ঘোষণার ব্যাপারে ‘হতাশা’ ব্যক্ত করে। ক্যাথোলিক চার্চের পোপ ফ্রান্সিস এতে ‘খুবই ব্যাথিত’ হয়েছেন বলে বলেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেফ বোরেল সাংবাদিকদের বলেন যে, ইইউএর মাঝে হায়া সোফিয়াকে আগের অবস্থানে নিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে; এবং তারা তুরস্ককে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানাবেন। তবে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারীরা তাদের আবেগ প্রকাশ করেছেন। রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল বলেন যে, তিনি ‘গভীরভাবে চিন্তিত’ হয়েছেন এবং তিনি মনে করছেন যে, এটা ‘পুরো খ্রিস্টান সভ্যতার জন্যে হুমকিস্বরূপ’। গ্রীক সংস্কৃতি মন্ত্রী লিনা মেনডোনি বলেন যে, এই সিদ্ধান্ত তুরস্ককে ছয় শতক পিছনে নিয়ে গেছে; এবং এটা ‘সভ্য দুনিয়ার প্রতি সরাসরি হুমকি’। রুশ পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির উপ-প্রধান ভ্লাদিমির জাভারভ বলেন যে, এতে মুসলিম দুনিয়ার কোন উপকার হবে না; বরং বিভিন্ন জাতিকে একে অপরের বিপক্ষে দাঁড় করাবে। হায়া সোফিয়ার ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব থেকে আসা বিভিন্ন সমর্থনের এক তালিকা তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে প্রকাশ করে ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’, যেখানে ওমান, ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার নাম রয়েছে; তবে আরব দেশগুলির নাম নেই। আরব আমিরাতের সংস্কৃতি মন্ত্রী নৌরা আল-কাবি এক টুইটার বার্তায় তুরস্কের এই সিদ্দ্বান্তের সমালোচনা করেন। ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, হায়া সোফিয়ার এই সিদ্ধান্তে তুরস্ক মুসলিম আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশে এবং বিশ্বব্যাপী বেশকিছু সমর্থন যুগিয়েছে; তবে আরব বিশ্বের নেতৃত্বের সমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ক্যাথোলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ভিতের পশ্চিমা সেকুলার দুনিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের আলাদা করে কঠোর বার্তা দেয়া থেকে দূরে থেকেছে; যা চার্চের কয়েক শতকের দ্বন্দ্বের কথাকে ভুলিয়ে দেয়না। পশ্চিমাদের সাথে রুশদের চলমান টানপোড়েনের মাঝে এই ঘটনা জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে; এরদোগানও তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু ফসল ঘরে তুলে নেবেন। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নতুন কোন বিভেদের জন্ম না দিলেও মুসলিম আবেগ জড়িত থাকার কারণে তা তুর্কি জনগণকে একত্রিত করা ছাড়াও বিশ্বব্যাপী তুরস্ককে আরও গুরুত্বপূর্ণ করেছে; ব্যাপারটা কারুর পছন্দ হোক বা না-ই হোক।

Friday 10 July 2020

ফ্রান্স কেন ১৭০ বছর পর আলজেরিয়ার বিদ্রোহীদের মস্তক ফেরত দিলো?

১০ই জুলাই ২০২০

ফ্রান্স আলজেরিয়াকে আর যা-ই হোক, তুরস্কের পক্ষে দেখতে চাইছে না। এই ব্যাপারটাই ফ্রান্সের সাথে দরকষাকষিতে আলজেরিয়াকে শক্তিশালী করেছে। অপরদিকে আলজেরিয়া তুরস্ককে সরাসরি সমর্থন না দিলেও নিজের অবস্থানকে জানান দিতে তার সীমানার বাইরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করলে তা উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থানকে হুমকির মাঝে ফেলবে। ফ্রান্সের ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা তখন লোক দেখানোই মনে হতে পারে।

গত ৩রা জুলাই ফ্রান্স আলজেরিয়ায় ঔপনিবেশিক সময়ে হত্যা করা ২৪ জন বিদ্রোহীর মস্তক ফেরত দিয়েছে। ১৮৩০ সাল থেকে ১৯৬২ সালের মাঝে ফরাসীরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ব্যক্তিদের হত্যা করে তাদের মস্তক ফ্রান্সে নিয়ে যায় এবং সেগুলিকে প্যারিসের ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’তে সাজিয়ে রাখে। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দেলমাজিদ তেবুনে এক ভাষণে বলেন যে, ১৭০ বছর ধরে এই বিদ্রোহীদেরকে কবর পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। পরদিন ৪ঠা জুলাই ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর সাথে এক সাক্ষাতে তেবুনে বলেন যে, ঔপনিবেশিক সময়ের অপরাধের জন্যে আলজেরিয়ার কাছে ফ্রান্সের পুরো ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিৎ; এখন পর্যন্ত অর্ধেকের মতো ক্ষমা প্রার্থনা পাওয়া গিয়েছে। তিনি বলেন যে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বর্তমান অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে আরও অগ্রগামী হতে পারেন। কিন্তু এতো বছর পরে কেন ঔপনিবেশিক সময়ের অত্যাচারের কাহিনীগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে? ‘সিএনএন’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর পশ্চিমা দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক সময়ের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। এতকাল পর ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সাথে এই আন্দোলনের সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে ‘সিএনএন’এর বিশ্লেষণের বাইরেও আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ পাওয়া যাবে উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন থেকে। এর মাঝে আলজেরিয়ায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য।

গত বছরের ২৩শে ডিসেম্বর আলজেরিয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল আহমেদ গাইদ সালাহ ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই মনে করেন যে, গত দুই দশক ধরে প্রেসিডেন্ট আব্দেলআজিজ বুতাফ্লিকার হাতে দেশের ক্ষমতা থাকার পিছনে জেনারেল গাইদ সালাহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০০৪ সালে বুতাফ্লিকা তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। ২০১৩ সালে তিনি উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, গত বছরের এপ্রিল মাসে বুতাফ্লিকা ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও আন্দোলনকারীরা ক্ষমতায় থাকা সকলের পদত্যাগ দাবি করছিল। কারণ বুতাফ্লিকা ক্ষমতাচ্যুত হবার পর আলজেরিয়ার নিয়ন্ত্রণ মূলতঃ জেনারেল গাইদ সালাহর হাতেই ছিল। সালাহ ১৭ বছর বয়সে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া নেতৃবৃন্দের হাতেই আলজেরিয়ার ক্ষমতা ছিল এতকাল। বুতাফ্লিকা এবং গাইদ সালাহ ছিলেন সেই জেনারেশনের শেষ নেতৃবৃন্দ। সালাহর মৃত্যুর মাত্র চারদিন আগে বুতাফ্লিকার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আব্দেলমাজিদ তেবুনে আলজেরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আরোহন করেন। সালাহর স্থলাভিষিক্ত হন ৭৪ বছর বয়সী জেনারেল সাঈদ চেংরিহা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তেবুনে এবং চেংরিহা উভয়েই আলজেরিয়ার এতকালের ক্ষমতাধর নেতৃত্বের অংশ হলেও তাদের অধীনে দেশটার রাষ্ট্রীয় নীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের অফিসের এক বার্তায় বলা হয় যে, গত ২৬শে ডিসেম্বর দেশটার শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয় যে, বিশ্বে আলজেরিয়ার অবস্থানকে পুনর্জাগরিত করতে লিবিয়া, মালি, সাহারা মরুভূমির সাহেল অঞ্চল এবং আফ্রিকাতে আলজেরিয়ার ভূমিকাকে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত পহেলা জুন আলজেরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেসিডেন্ট তেবুনের পরিদর্শনের সময় জেনারেল চেংরিহা তার ভাষণে বলেন যে, আলজেরিয়ার সংবিধান পরিবর্তনের যে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, সেটাকে সেনাবাহিনী যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি নতুন সংবিধানে আলজেরিয়ার সীমানার বাইরে সেনাবাহিনীর অংশ নেয়ার ব্যাপারটাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। লন্ডনকেন্দ্রিক মিডিয়া ‘মিডলইস্ট মনিটর’ বলছে যে, আলজেরিয়ার সংবিধান পরিবর্তনের পিছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন দেশটার সামরিক বাহিনীর চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। ‘দ্যা এরাব উইকলি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সংবিধানের নতুন পরিবর্তনে আলজেরিয়ার নিরাপত্তা চিন্তাকেই পরিবর্তন করে ফেলা হচ্ছে। নিজ সীমানার ভেতর থেকেই বাইরের হুমকি মোকাবিলা করার এতকালের চিন্তাটাকে এখন পরিবর্তন করা হচ্ছে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আলজেরিয়া এখন তার পূর্বে অবস্থিত লিবিয়া এবং দক্ষিণের মালিতে সহিংসতাকে নিষ্ক্রিয় অবস্থান থেকে না-ও দেখতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, একারণেই সংবিধান পরিবর্তনে আলজেরিয়ার সেনাবাহিনীর সমর্থন শক্তিশালী দেশগুলির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে।

৬ই জানুয়ারি লিবিয়ার ত্রিপোলি-কেন্দ্রিক ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড’ বা ‘জিএনএ’এর প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সারাজ এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু আলজেরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতের পরপরই তুরস্ক লিবিয়াতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে সেখানকার যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফ্রান্স লিবিয়াতে জেনারেল হাফতারের অধীনে ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’কে সমর্থন দিচ্ছে; এবং তারা লিবিয়াতে তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপের যারপরনাই বিরোধী। ফ্রান্স এবং তুরস্ক উভয় পক্ষই লিবিয়ার যুদ্ধে আলজেরিয়ার সমর্থন চাইছে। উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকায় আলজেরিয়ার রয়েছে সবচাইতে শক্তিধর সামরিক বাহিনী। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আলজেরিয়ার শাসকরা আলজেরিয়ার সীমানার বাইরে প্রভাব বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্সের সাথে বড় ধরণের বাণিজ্য সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলতে চাননি তারা। বুতাফ্লিকা এবং জেনারেল গাইদ সালাহর প্রস্থানের পর অনেক কিছুই নতুন করে হিসেব কষতে হচ্ছে। লিবিয়াতে তুরস্কের অবস্থান শক্ত হতে শুরু করায় ফ্রান্স শুধু উত্তর আফ্রিকা নয়, ভূমধ্যসাগরেও তার প্রভাবকে হুমকির মুখে দেখতে পাচ্ছে। ‘মিডলইস্ট মনিটর’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টে ফ্রান্সের কাছ থেকে ঔপনিবেশিক অত্যাচারের জন্যে ক্ষমা চাইবার আইন পাস করা না গেলেও আলজেরিয়া কিন্তু সেই পথে হাঁটছে না। আলজেরিয়ার দক্ষিণে মালিতে ফ্রান্স সাত বছর ধরে এক ‘শেষ না হওয়া’ যুদ্ধে আটকে রয়েছে। এমতাবস্থায় এই অঞ্চলে নতুন শক্তি হিসেবে আলজেরিয়ার আবির্ভাব ফ্রান্সকে বিচলিত করেছে। ফ্রান্স আলজেরিয়াকে আর যা-ই হোক, তুরস্কের পক্ষে দেখতে চাইছে না। এই ব্যাপারটাই ফ্রান্সের সাথে দরকষাকষিতে আলজেরিয়াকে শক্তিশালী করেছে। অপরদিকে আলজেরিয়া তুরস্ককে সরাসরি সমর্থন না দিলেও নিজের অবস্থানকে জানান দিতে তার সীমানার বাইরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করলে তা উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থানকে হুমকির মাঝে ফেলবে। ফ্রান্সের ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা তখন লোক দেখানোই মনে হতে পারে।

Sunday 5 July 2020

হিমালয়ে ভারত-চীন সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র কি পেল?

০৫ই জুলাই ২০২০
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলেই বেইজিংএ অনেকের মাঝে ধারণা জন্ম নিয়েছে; যা থেকে বের হওয়া কঠিন। কিন্তু দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন সাগরে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেই বেইজিং ভারতের সাথে স্থলসীমানা নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে, যা কিনা বেইজিংএর কৌশলগত সক্ষমতাকে বিভাজিত করেছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিতে একটা বড় সাফল্য উপহার দিয়েছে।


প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪টা জুলাই মার্কিন জাতীয় দিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে টুইটারে শুভেচ্ছাবার্তা পাবার পর মোদিকে ধন্যবাদ দিয়ে বার্তা দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ভালোবাসে। ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কথাগুলি বললেও ভারতীয় মিডিয়াতে তা ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করার হয়। চীনের সাথে চলমান সীমান্ত দ্বন্দ্বে ভারত তার প্রতিবেশীদেরকে কাছে না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই যেন কাছে টেনে নিতে চাইছে। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলছে যে, ট্রাম্পের বার্তা দেয়ার মুহুর্তটা বলে দিচ্ছে যে, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। যদিও মুহুর্তটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দিবস। চীনের সাথে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে দিল্লী এবং বেইজিংএ চলছে ব্যাপক জল্পনাকল্পনা। দুই পক্ষ যখন সীমান্তে নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই সকলে তাকিয়ে রয়েছে। হিমালয়ের পাদদেশের এই বিবাদে ওয়াশিংটনের প্রভাব আসলে কতটুকু?

চীনারা সবসময়ই বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ৫ই জুলাই চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ‘গ্লোবাল টাইমস’এর এক লেখায় বলা হয় যে, ওয়াশিংটন চাইছে ভারত এবং চীনের সংঘাত থেকে নিজেরা লাভবান হতে। যতবারই ভারতের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব হয়েছে, প্রতিবারই মার্কিনীরা ভারতের পক্ষ নিয়েছে এবং দ্বন্দ্বকে আরও উস্কে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলি ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি গড়ে তুলেছে, যার মাধ্যমে তারা ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে যে, তারা ভারতকে যথেষ্ট সমর্থন দেবে। চীনারা প্রকৃতপক্ষে ভারতের সাথে সংঘাতের বিরোধী। তবে চীনারা যে ভারতের সামরিক পদক্ষেপগুলিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘গ্লোবাল টাইমস’এর এক বিশ্লেষণে। ‘ইন্সটিটিউট অব চাইনিজ বর্ডারল্যান্ড স্টাডিজ’এর রিসার্চ ফেলো ঝাং ইয়ংপ্যান বলছেন যে, গালওয়ান নদীর কাছে শায়ক নদীর স্থানে ভারত একটা বিমানবন্দর তৈরি করেছে; সাথে রাস্তা, সেতু এবং মানুষের বসবাসের জন্যে গ্রাম তৈরি করেছে। অনেক বছর ধরেই ভারত চীনা স্থলভাগের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার চিন্তা করছিল। ১৯৬২ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় থেকে এই স্থানটা উভয় দেশের জন্যেই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বলেন তিনি। ভারত খুব সম্ভবতঃ লাদাখ এবং কাশ্মিরে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে ভৌগোলিক সুবিধা আদায় করতে চাইছে।

কেউ কেউ অবশ্য চীনকে ভারতের সাথে সমঝোতা করার উপদেশ দিচ্ছেন। ‘বাকনেল ইউনিভার্সিটি’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ঝিকুন ঝু ‘আল-জাজিরা’তে এক লেখায় বলছেন যে, চীনারা তাদের চিন্তাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে কেন্দ্রিভূত করার ফলে এশিয়ার দেশগুলিতে চীন বিরোধী চিন্তা দানা বেঁধেছে। চীনের উচিৎ অনেকগুলি শত্রু তৈরি না করে বন্ধু তৈরিতে অগ্রসর হওয়া। ভারতের সাথে সংঘাত বাড়তে থাকলে ভারত আরও শক্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে যাবে। সীমানার দেশগুলির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেইজিংএর চিন্তাবিদদের মাঝে হয়তো পূর্ণ সমঝোতা নেই। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, একটা চীনা প্রবাদ রয়েছে যে, কাছের প্রতিবেশী দূরের আত্মীয় অপেক্ষা বেশি কাছের। তিনি আরও বলছেন যে, এশিয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরাবার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো ভারত।

ভারতেও কেউ কেউ পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। দিল্লীর সাংবাদিক ভারত ভূষণ ‘দ্যা কুইন্ট’এ এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়ন হলে তা নিঃসন্দেহে চীনকে চিন্তিত করবে। কিন্তু তা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কৌশলগত চুক্তির অংশ হলেও তার বন্ধুদের জন্যে যুদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র এখন কতটা প্রস্তুত তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্রে রেখে কৌশলগত গ্রুপিং স্বপ্নের মতোই। আর যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ভারতের সীমানায় দখলীকৃত ভূমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করতে পারবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত চুক্তি হিমালয়ের পাদদেশে ভারতের কোন কাজেই আসবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে গত এক দশকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে। যেমন সীমানাতে দ্রুত সেনা মোতায়েনের সুবিধার্থে ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’ এবং ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ পরিবহণ বিমান; অতি উঁচু ভূমিতে যুদ্ধ করার সক্ষমতা সম্বলিত ‘এএইচ-৬৪ এপাচি’ ও ‘সিএইচ-৪৭ শিনুক’ হেলিকপ্টার; এবং পাহাড়ের উপর সহজে পরিবহণযোগ্য ‘এম-৭৭৭’ হাল্কা কামান। এই অস্ত্রগুলি বিক্রি করে একাধারে যুক্তরাষ্ট্র যেমন স্বল্প সময়ের মাঝে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারীর তালিকায় নাম লিখিয়েছে, তেমনি হিমালয়ের পাদদেশে ভারতকে স্থলযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার একটা সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে, যা কিনা গত পাঁচ দশকে ভারতের ছিল না।

হিমালয়ের পাদদেশে ভারতের যুদ্ধ করার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ভারত এবং চীন উভয় দেশেই ভিন্ন মতের জন্ম দিয়েছে। চীনের হুমকি মোকাবিলায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের সুর ধরেই অনেকে ওয়াশিংটনকে কাছে টেনে নিতে চাইছেন। তবে একইসাথে কেউ কেউ আবার ভারতের চিরাচরিত জোট নিরপেক্ষ চিন্তাকে তুলে আনতে চাইছেন এবং নিরাপত্তার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। অপরপক্ষে বেইজিংএ অনেকেই ভারতের সাথে যুদ্ধ এড়াতে চাইলেও সীমানাতে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে পারছেন না। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলেই বেইজিংএ অনেকের মাঝে ধারণা জন্ম নিয়েছে; যা থেকে বের হওয়া কঠিন। আর আঞ্চলিকভাবে এশিয়ার দেশগুলির উপর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই বেইজিংএর পক্ষে এশিয়ার দেশগুলিকে কাছে টেনে নেয়া কঠিন হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকার নীতিটাই বেইজিংএ হালে পানি পাচ্ছে বেশি, যা কিনা বেইজিংএর জন্যে এশিয়ার দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা কঠিন করে দিচ্ছে। এই বাস্তবতায় দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন সাগরে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেই বেইজিং ভারতের সাথে স্থলসীমানা নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে, যা কিনা বেইজিংএর কৌশলগত সক্ষমতাকে বিভাজিত করেছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিতে একটা বড় সাফল্য উপহার দিয়েছে।