Thursday 25 November 2021

জাপান কি তার প্রতিরক্ষানীতিকে পরিবর্তন করছে?

২৫শে নভেম্বর ২০২১

সাম্প্রতিককালে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ অস্ট্রেলিয়ার সাথে জাপানের চুক্তিও দেখিয়ে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য শক্তিরাও চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপানকে ব্যবহার করতে চাইছে। ব্রিটেনও জাপানের সাথে আরও গভীর সামরিক সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলছে। চুক্তিগুলির ফলস্বরূপ জাপানের উঠানে পশ্চিমাদের সাথে চীনাদের দ্বন্দ্ব জাপানকেও জড়াতে বাধ্য করবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের ব্যাপারে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জাপান এবং চীনের মাঝে উত্তেজনাকে যেমন বাড়াবে, তেমনি পূর্ব এশিয়াতে পশ্চিমাদের অবস্থানও সুসংহত করবে।

 
জাপানের সামরিক বাজেট দেশটার জিডিপির ১ শতাংশের বেশি হবে না বলে একটা অলিখিত সিদ্ধান্ত জাপান সরকার মেনে চলেছে। তবে গত মে মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও কিশি ‘নিকেই এশিয়া’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, জাপান জিডিপির সাথে অনুপাত রেখে কখনোই তার সামরিক বাজেটের পরিকল্পনা করে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই কথাই বলে দিচ্ছে যে, জাপান তার প্রতিরক্ষা বাজেটকে জিডিপির ১ শতাংশের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে না। নোবুও কিশি চীনা হুমকি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ নতুনভাবে সামরিক বাজেট তৈরির কথা বলেন। শুধু সামরিক বাজেট বৃদ্ধিই নয়, প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, নতুন প্রতিরক্ষানীতি তৈরির কাজে হাত দিয়েছে জাপান; যা ২০২২ সালে গতি পাবে।

২০১৪এর জুলাই মাসে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সরকার দেশটার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের রচনা করে দেয়া যুদ্ধবিরোধী সংবিধানের একটা নতুন ব্যাখ্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৬ সালের মার্চে প্রবল বাধার মুখে নতুন আইন হিসেবে জাপানের পার্লামেন্টে এই সিদ্ধান্তগুলিকে পাস করানো হয়। জাপানে অনেকেই এই আইনকে ‘যুদ্ধ আইন’ বলে আখ্যা দেয়। তারা বলছিলেন যে, এর ফলশ্রুতিতে অন্যের শুরু করা যুদ্ধে জাপানকে জোর করে জড়ানো হতে পারে। ‘জাপান টাইমস’ বলছে যে, এই আইনের ফলস্বরূপ কোরিয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ালে জাপানের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধে জড়াতে পারে। এছাড়াও এতদিন পর্যন্ত জাপানের আশেপাশে জাপানিরা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতে পারতো; এখন নতুন আইনে তৃতীয় কোন দেশেও পারবে।

২০২০এর নভেম্বরে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া তাদের একে অপরের সামরিক সদস্য এবং যন্ত্রপাতিকে রক্ষা করার ব্যাপারে চুক্তি করে। ‘দ্যা জাপান নিউজ’ বলছে যে, চুক্তি মোতাবেক, শান্তিকালীন সময়ে জাপানের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ার সময় এবং জাপানের আশেপাশের সমুদ্রে অস্ট্রেলিয়ার সার্ভেইল্যান্স অপারেশন চালনার সময় জাপান তার সামরিক শক্তিকে অস্ট্রেলিয়ার সম্পদ রক্ষায় ব্যবহার করবে। জাপানের আশেপাশের সমুদ্রের মাঝে পূর্ব চীন সাগরও রয়েছে, যেখানে জাপানের সাথে চীনের রয়েছে সমুদ্রসীমা এবং আকাশসীমা নিয়ে বিরোধ। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইস্টএশিয়া ফোরাম’এর লেখায় ‘ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস’এর প্রফেসর অরেলিয়া জর্জ মুলগান বলছেন যে, এভাবেই একটু একটু করে জাপান আঞ্চলিকভাবে তার সামরিক ভূমিকাকে বৃদ্ধি করেছে; আর এই কাজ করার জন্যে তাদের যুদ্ধবিরোধী সংবিধানকেও পরিবর্তন করতে হয়নি। চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পরই অস্ট্রেলিয়া জাপানের সবচাইতে কাছের সহযোগী হিসেবে নাম লেখালো। এর ফলশ্রুতিতে অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যথেষ্ট ঘন ঘন জাপানের মাটিতে এবং এর আশেপাশের সমুদ্রাঞ্চলে সামরিক মহড়ায় অংশ নেবে। এছাড়াও আরও যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এতকাল জাপান তার নিরাপত্তার জন্যে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রকেই কাছের বন্ধু মনে করলেও এখন অন্যান্য দেশকেও তার নিজের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছে। জাপান ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে ‘কোয়াড’ জোটের অংশ হয়েছে, যা কিনা একটা চীন বিরোধী জোট হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।

গত জুনে জাপানের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াসুহিদে নাকাইয়ামা মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তাইওয়ানকে রক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ‘ওয়ান চায়না’ নীতি নিয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি নিজেও এতকাল তাইওয়ানকে ‘লাল দাগ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। নাকাইয়ামা প্রশ্ন বলেন যে, ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো তাইওয়ানের ব্যাপারে নীতি কতটা সঠিক ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে। ভৌগোলিকভাবে তাইওয়ান জাপানের খুবই কাছে; তাইওয়ানে কিছু ঘটলে তা জাপানের ওকিনাওয়ার উপর প্রভাব ফেলবে। মহাকাশ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, পারমাণবিক এবং প্রচলিত অস্ত্রের দিক থেকে চীনের আগ্রসী চিন্তা এবং ইচ্ছার ব্যাপারে তিনি সকলকে ‘জেগে উঠতে’ বলেন। এছাড়াও তিনি সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের আশেপাশে চীন এবং রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়ার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, রাশিয়া এবং চীনের সহযোগিতা এক নতুন হুমকির সৃষ্টি করেছে। এজন্যে তিনি আরও শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে চান।

মার্কিন বিমান বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা রায়ান এশলি ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় বলছেন যে, সাম্প্রতিককালে জাপানের রাজনীতিবিদদের মাঝে অর্থনীতিকেন্দ্রিক চিন্তার বদলে বাস্তবতাকেন্দ্রিক চিন্তাকে শক্তিশালী দেখা যাচ্ছে। এতকাল ক্ষমতাসীন এলডিপি দলের বেশিরভাগ সদস্যই চাইতেন বেইজিংএর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিতে; তবে বর্তমানে লিবারাল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাতে অংশ নেয়াতেই তারা এখন বেশি আগ্রহী। এই হিসেবেই জাপান এখন তাইওয়ানের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে। জাপানিরা মনে করছে না যে, তাইওয়ানের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করলে জাপানের জন্যে নতুন কোন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ ডেকে আনবে। কারণ চীনারা আগে থেকেই জাপানের আশেপাশে ব্যাপক সামরিক অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। আপাততঃ হয়তো তাইওয়ানের ব্যাপারে কূটনীতি বা নিরাপত্তা বিষয়ে জাপানের নীতির কোন পরিবর্তন হবে না। তবে জাপানি নেতৃত্বের তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া এবং চীনের হাত থেকে তাইওয়ানের রক্ষা করার ব্যাপারে জাপানি সরকারের ইচ্ছা প্রকাশ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীনা সামরিক নেতৃত্বের জন্যে স্বল্পমেয়াদে মাথাব্যাপার কারণ হবে; এমনকি সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রযুক্তি দেয়ানেয়ার চুক্তির চাইতেও তা বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।

‘নিকেই এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন তার সামরিক শক্তি ব্যাপক বৃদ্ধি করলেও ভৌগোলিকভাবে চীনের দুর্বলতা রয়েছে। তাইওয়ান এবং জাপানের দ্বীপগুলি চীনের প্রশান্ত মহাসাগরে বের হবার পথগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কিন সামরিক চিন্তাবিদেরা জাপানের নৌবাহিনীর সাবমেরিনগুলিকে ব্যবহার করে এই দ্বীপগুলির মাঝের প্রণালিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। আর সাম্প্রতিককালে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ অস্ট্রেলিয়ার সাথে জাপানের চুক্তিও দেখিয়ে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য শক্তিরাও চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপানকে ব্যবহার করতে চাইছে। ব্রিটেনও জাপানের সাথে আরও গভীর সামরিক সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলছে। চুক্তিগুলির ফলস্বরূপ জাপানের উঠানে পশ্চিমাদের সাথে চীনাদের দ্বন্দ্ব জাপানকেও জড়াতে বাধ্য করবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের ব্যাপারে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জাপান এবং চীনের মাঝে উত্তেজনাকে যেমন বাড়াবে, তেমনি পূর্ব এশিয়াতে পশ্চিমাদের অবস্থানও সুসংহত করবে।

Saturday 20 November 2021

পোল্যান্ড এবং বেলারুশের সীমানায় তুরস্কের স্বার্থ কি?

২০শে নভেম্বর ২০২১

পোল্যান্ড সীমান্তে সেনাদের জলকামান থেকে বাঁচতে চেষ্টা করছেন এক শরণার্থী। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষেও একুশ শতকের ধ্বসে পরা বিশ্বব্যবস্থায় তুরস্ক পশ্চিমাদের কাছে তার মূল্য ধরে রাখতে চাইছে। অন্ততঃ ইইউএর সীমান্তে প্রচন্ড শীতের মাঝে শরণার্থীদের উপর জলকামানের ব্যবহার ইইউএর মানবাধিকারের স্তম্ভকে যতক্ষণ নাড়া দেবে, ততক্ষণ তুরস্ক ইইউএর সাথে কূটনৈতিক দরকষাকষির সুযোগ পাবে। আর তুরস্কের সাথে ইইউএর দ্বন্দ্বের তালিকা এখন বেশ বড়।

 
পোল্যান্ড এবং বেলারুশের সীমানায় মধ্যপ্রাচ্যের হাজার হাজার শরণার্থীদের উপর যখন পোলিশ সেনারা জলকামান, পেপার স্প্রে এবং অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করছে, তখন কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন যে, এর সমস্যার পিছনে শুধুমাত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই রয়েছেন কিনা। ব্রিটেনের ‘দ্যা স্পেকট্যাটর’ পত্রিকার এক লেখায় ‘বলকান ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং নেটওয়ার্ক’এর ফেলো ইয়ানিস বাবুলিয়াস বলছেন যে, এই ভূরাজনৈতিক খেলায় তুরস্ককে বাদ দিয়ে ভুল হবে। কারণ বেলারুশের সীমানায় মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীরা পৌঁছেছে তুরস্কের ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’এর মাধ্যমে।

তুর্কি কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘হুরিয়েত ডেইলি নিউজ’ জানাচ্ছে যে, ১০ই নভেম্বর তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিবিগনিউ রাউএর সাথে ফোনে কথা বলেন। এই কথোপকথনে কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্ক এই সমস্যার অংশ না হলেও কেউ কেউ তা বোঝাতে চাইছে। তিনি তুরস্ক এবং ‘টারকিশ এয়ারওয়েজ’এর বিরুদ্ধে অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দেন। একইসাথে তিনি বলেন যে, জনগণকে এই অভিযোগের ব্যাপারে সত্যটা জানাতে হবে। তিনি পোল্যান্ডের টেকনিক্যাল তদন্ত দলকে তুরস্কে আমন্ত্রণ জানান। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন কথোপকথন মাত্র একমাস আগের বৈঠকের সময়েও অন্যরকম ছিল। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই কাভুসোগলু পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ সফর করেন এবং পোল্যান্ডের সীমান্ত ইস্যুতে তুরস্কের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেন। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যৌথ ঘোষণায় বলেন যে, তাদের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস একত্রে এধরণের হুমকি মোকাবিলায় এবং ইইউএর ভেতর ঢোকার উদ্দেশ্যে মানব পাচারের রুটগুলি খুঁজে বের করবে। জিবিগনিউ রাউ বলেন যে, তিনি কাভুসোগলুকে শরণার্থীদের বিমানে করে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে যাবার ব্যাপারে আরও মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, শরণার্থীদের নিয়ে আসা ফ্লাইটগুলি অনেক ক্ষেত্রেই ইস্তাম্বুলকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে। কাভুসোগলু বলেন যে, নয় মাসে ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ মিনস্কে ৬’শ ইরাকি নাগরিককে নিয়ে গিয়েছে; যাদের অর্ধেকই আবার ফিরে এসেছে। এই সফরের সময় পোলিশ মন্ত্রী রাউ বলেন যে, দুই দেশের বাণিজ্য এখন প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার; যা শীঘ্রই ৯ বিলিয়নে যাবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।

তুরস্কের প্রতি ইইউএর হুমকি

৮ই নভেম্বর ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন বলেন যে, ইইউ খতিয়ে দেখছে যে, তৃতীয় কোন দেশের এয়ারলাইন্স, যারা কিনা “মানব পাচারে জড়িত” রয়েছে, তাদের উপর অবরোধ দেয়া বা তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করা যায় কিনা। ‘ইইউ অবজারভার’ বলছে যে, ভন ডার লেইয়েন যে তৃতীয় দেশের এয়ারলাইন্সের কথা বলেছে, তা হলো ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’। আর ‘পলিটিকো ইউরোপ’এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, মিনস্কে যাবার প্রধান বিমান রুটটাই হলো তুরস্ক থেকে। ১০ই নভেম্বর পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাটিউজ মোরাউইয়েকি পার্লামেন্টের এক জরুরি বৈঠকে অভিযোগ করে বলেন যে, পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, তুরস্কের কর্মকান্ডগুলি বেলারুশ এবং রাশিয়ার সাথে সমন্বয় করা; যা পোলিশরা পছন্দ করছে না। তিনি আরও বলেন যে, মাত্র এক বা দুইমাস আগেই তুরস্ক পোল্যান্ডের সাথে একসাথে কাজ করতে চায় বলে মনে হয়েছিল। তুরস্কের দাবানল ঠেকাতে সহায়তা এবং তুর্কি পর্যটন শিল্পে সহায়তা দেয়াটা খুব সম্ভবতঃ একমুখী সহায়তা ছিল। এই ব্যাপারটা তুরস্ক সরকারকে জানানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

 
কেউ কেউ বলছেন যে, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মাঝে সমন্বয় করে তুরস্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে বেলারুশে তুর্কি বিমানের ফ্লাইট বন্ধ করেছে। ইইউএর বিভাজনের সময়েই ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে যুক্তরাষ্ট্র ব্যালান্স দেখতে চায়। সেই জায়গাটাতেই তুরস্ক জড়িত থাকতে চাইছে, ঠিক যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একটা শূন্যস্থান রেখে যাচ্ছে। যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধজাহাজ বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নয়, বরং নিজস্ব বেসামরিক এয়ারলাইন্স ব্যবহার করেই তুরস্ক এই কাজটা করেছে। একুশ শতকে যুদ্ধের নতুন সংজ্ঞায় শরণার্থীরা যেমন বেলারুশ এবং রাশিয়ার কাছে অস্ত্র, তেমনি ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ হয়েছে তুরস্কের অস্ত্র।

একইদিন ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’এর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, তারা সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংবেদনশীলতার সাথে সহযোগিতা করে আসছে। একইসাথে বিবৃতিতে বলা হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। ‘এএফপি’ জানাচ্ছে যে, বেলারুশের রাজধানীতে যাবার সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত আকাশ নেটওয়ার্ক হলো ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’। এছাড়াও তুরস্কে রয়েছে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ লক্ষ শরণার্থী এবং অভিবাসী। এবং এখনও দেশটা ইউরোপ অভিমুখী শরণার্থীদের যাতায়াতের একটা গুরুত্বপূর্ণ রুট। ‘মিডলইস্ট আই’এর এক প্রতিবেদনে ফ্লাইটের তথ্য দিয়ে বলা হয় যে, গত ৩১শে অক্টোবর থেকে ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ ইস্তাম্বুল থেকে মিনস্কে সাপ্তাহিক ফ্লাইটের সংখ্যা ১৪ থেকে ১০এ নামিয়ে আনে। ভিসা ফ্রি ট্রাভেল সুবিধা থাকার কারণে বেলারুশ তুর্কি পর্যটকদের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য।

তুরস্কের ‘ইউ টার্ন’

১২ই নভেম্বর তুরস্কের বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা মধ্যপ্রাচ্যের তিনটা দেশ ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের নাগরিকদের তুরস্ক থেকে বেলারুশে যাওয়া বন্ধ ঘোষণা করে। এই খবর পাবার পর ইউরোপিয়ান কাউন্সিনের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল এক টুইটার বার্তায় তুর্কি সরকারকে ধন্যবাদ জানান। পরদিন বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’র সাথে এক সাক্ষাতে তুর্কি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিন বলেন যে, পোল্যান্ডের সীমান্তে মানবিক দুর্যোগের ব্যাপারে তুরস্ক বা ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’কে দোষারোপ করাটা সমীচিন নয়। ভ্রমণকারীরা বেলারুশ গিয়ে সেখান থেকে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া বা অন্যান্য ইইউ দেশে যাচ্ছে। এর জন্যে তুরস্ক বা ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’কে দোষারোপ করাটা পুরোপুরি অবান্তর। তিনি আরও বলেন যে, তারা নিশ্চিত করতে চান যে, যারা তুরস্ক হয়ে বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে, তারা যেন যাওয়া এবং ফেরত আসার টিকিট সাথে রাখে; অর্থাৎ তারা যেন ফেরত আসে। কিন্তু কেউ যদি বেলারুশে গিয়ে হারিয়ে যায়, তাহলে সেটা তুরস্কের দায় নয়। ‘আল মনিটর’এর সাথে এক সাক্ষাতে ‘পোলিশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স’এর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান ক্যারল ওয়াসিলেউস্কি বলেন যে, যদিও তুর্কিরা বলছে যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনকিছু করেনি, তথাপি পোলিশ সমাজের কাছে ব্যাপারটা সেভাবে ঠেকেনি। তিনি বলেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। পোল্যান্ডের কৌশলগত সংস্কৃতিতে এর একটা প্রভাব থাকবে। পোলিশরা মনে রাখবে যে, পোল্যান্ডের দুর্যোগের সময় তুরস্ক পাশে থাকেনি। ওয়াসিলেউস্কি মনে করছেন যে, বর্তমানের এই বিরোধ স্বল্প সময়ই স্থায়ী হবে; কূটনীতির মাধ্যমে তা সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু পোল্যান্ডের কর্মকর্তাদের মাঝে যারা একসময় তুরস্কের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের পক্ষপাতি ছিলেন না, তারা এখন এই উদাহরণ টেনে বলতে পারবে যে, তুরস্ক প্রকৃতপক্ষে কোন নির্ভরযোগ্য বন্ধু নয়।

কেউ কেউ বলছেন যে, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মাঝে সমন্বয় করে তুরস্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে বেলারুশে তুর্কি বিমানের ফ্লাইট বন্ধ করেছে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স নিউজ’এ মতামত দিতে গিয়ে তুর্কি পার্লামেন্টের প্রক্তন সদস্য এবং বর্তমানে ‘ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্র্যাসিস’এর সিনিয়র ডিরেক্টর আইকান এরদেমির বলছেন যে, যদিও ওয়াশিংটন বা ব্রাসেলস কেউই সরাসরি ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ নিয়ে কথা বলেনি, তথাপি আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, হুমকি দিয়েই ফ্লাইটগুলি বন্ধ করা হয়েছে। কারণ ভন ডার লেইয়েনের হুমকির দু’দিনের মাথায় মেভলুত কাভুসোগলু যেমন দায় স্বীকার করেননি, তেমনি ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ও বলেছে যে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবান্তর। অথচ এর দু’দিনের মাথাতেই ইস্তাম্বুল থেকে মিনস্কে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশের নাগরিকদের যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়।

তুরস্ক আসলে কি চাইছে?

কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত মে মাসেই যেখানে পোল্যান্ডের সাথে তুরস্কের ২৪টা ‘বায়রাকতার টিবি২’ মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান কেনার চুক্তি হয়েছে, সেখানে মাত্র কয়েক মাসের মাঝেই তুরস্কের সাথে পোল্যান্ডের সম্পর্ক এই পর্যায়ে কিভাবে আসতে পারে? আর পোল্যান্ডের সীমান্তে তুরস্কের স্বার্থই বা কি? কেনই বা আরেকটা ন্যাটো সদস্য দেশের সাথে তুরস্কের সমন্বয় এত কঠিন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক ফোকাসের দিকে তাকালেই। পোল্যান্ডের সীমান্ত সমস্যায় তুরস্কের প্রভাব খাটাবার চেষ্টার আলোচনাটা এমন সময়ে এলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ফোকাস হলো চীন। মার্কিনীরা ইউরোপ সহ দুনিয়ার সকল অঞ্চলে তাদের সামরিক অবস্থান কমিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করছে। আর এমন একটা অবস্থায় পূর্ব ইউরোপে উত্তেজনা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যে, ইউরোপিয়রাই তাদের নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিক। তথাপি যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সীমান্তে একটা দ্বন্দ্বে আটকে থাকলে তা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নীতিকে প্রভাবিত করবে।

ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তুরস্ক যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপের ঢাল হিসেবে কাজ করেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কাছে তুরস্কের যে মূল্য ছিল, তা এখন নেই। কারণ বর্তমানে রুশ হুমকিকে ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলি ততটা বড় হিসেবে দেখছে না। ইইউ এবং ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে জার্মানি এবং তার পার্শ্ববর্তী পোল্যান্ডের মাঝে চিন্তার ব্যাপক ফারাক রয়েছে। ইইউএর প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি তার বেশিরভাগ গ্যাস আমদানি করে থাকে রাশিয়া থেকে। অপরদিকে রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় পোল্যান্ড চাইছে তাদের দেশে ন্যাটোর সেনা মোতায়েন থাকুক। ইইউএর এই বিভাজনের সময়েই ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে যুক্তরাষ্ট্র ব্যালান্স দেখতে চায়। ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনও সেটাই চায়; তাই তারাও পোল্যান্ডকে সীমান্ত শক্তিশালী করতে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে। সেই জায়গাটাতেই তুরস্ক জড়িত থাকতে চাইছে, ঠিক যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একটা শূন্যস্থান রেখে যাচ্ছে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষেও একুশ শতকের ধ্বসে পরা বিশ্বব্যবস্থায় তুরস্ক পশ্চিমাদের কাছে তার মূল্য ধরে রাখতে চাইছে। অন্ততঃ ইইউএর সীমান্তে প্রচন্ড শীতের মাঝে শরণার্থীদের উপর জলকামানের ব্যবহার ইইউএর মানবাধিকারের স্তম্ভকে যতক্ষণ নাড়া দেবে, ততক্ষণ তুরস্ক ইইউএর সাথে কূটনৈতিক দরকষাকষির সুযোগ পাবে। আর তুরস্কের সাথে ইইউএর দ্বন্দ্বের তালিকা এখন বেশ বড়। তবে যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধজাহাজ বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নয়, বরং নিজস্ব বেসামরিক এয়ারলাইন্স ব্যবহার করেই তুরস্ক এই কাজটা করেছে। একুশ শতকে যুদ্ধের নতুন সংজ্ঞায় শরণার্থীরা যেমন বেলারুশ এবং রাশিয়ার কাছে অস্ত্র, তেমনি ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ হয়েছে তুরস্কের অস্ত্র।

Friday 19 November 2021

রাশিয়া কেন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মহাকাশে নিজেদের স্যাটেলাইট ধ্বংস করছে?

২০শে নভেম্বর ২০২১

‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতেই রাশিয়া মহাকাশে স্যাটেলাইট ধ্বংসের প্রকল্পে নেমেছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রও রুশ কর্মকান্ডকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দিয়ে বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদায় করছে। মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারাও মহাকাশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা না বলে রুশ হুমকি মোকাবিলার পাল্টা কৌশলের উপরেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। মহাকাশে কোন আন্তর্জাতিক আইনের অনুপস্থিতি এতকাল সমস্যা সৃষ্টি না করলেও ভেঙ্গে পড়া বিশ্বব্যবস্থায় তা দুশ্চিতার কারণ হচ্ছে।


মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা গত ১৫ই নভেম্বর বলে যে, রাশিয়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব একটা পুরোনো স্যাটেলাইট ধ্বংস করেছে। এর ফলে মহাকাশ জুড়ে হাজারো ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়েছে; যেগুলি অন্যান্য স্যাটেলাইটের জন্যে হুমকির সৃষ্টি করেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন প্রশ্ন করেন যে, রুশরা তো জানতো যে এধরণের কর্মকান্ডে কিরকম ধ্বংসাবশেষ তৈরি হবে। তাহলে তারা কি করে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নিজেদের মহাকাশচারীদেরকেই বিপদে ফেললেন? মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, রুশদের এই কর্মকান্ড ভয়ঙ্কর এবং একপরকার ভন্ডামি। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সাথে নিয়ে এই দায়িত্বজ্ঞানশূণ্য কাজের জবাব দেবে। মার্কিন স্পেস ফোর্সের ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টর মেজর জেনারেল লেয়া লডারবেক একটা মহাকাশ কনফারেন্সে বলেন যে, এটা খুব সম্ভবতঃ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা বার্তা ছিল। রাশিয়া ডিটারেন্টকে চিন্তা করে মার্কিন মহাকাশ সক্ষমতাকে প্রতিরোধ এবং দুর্বল করার লক্ষ্যেই রাশিয়া এটা করেছে।

মার্কিন স্পেস কমান্ডের হিসেব মতে, এটা ছিল ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে স্যাটেলাইট ধ্বংস করার চতুর্থ পরীক্ষা। এর আগে ২০০৭ সালে চীনারা প্রথমবারের মতো তাদের ‘ফেনইউন ১সি’ স্যাটেলাইট ধ্বংস করে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘অপারেশন বার্নট ফ্রস্ট’এর মাধ্যমে একটা গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ধ্বংস করে। ২০১৮ সালে ভারত তাদের নিজস্ব ‘মাইক্রোস্যাট আর’ ধ্বংস করে। আর সর্বশেষ রুশরা তাদের ‘কসমস ১৪০৮’ স্যাটেলাইট ধ্বংস করলো। মার্কিনীরা বলছে যে, রুশ স্যাটেলাইট ধ্বংসের ফলে তৈরি হওয়া কমপক্ষে ১০ সেন্টিমিটার আকৃতির ১৫’শ ধ্বংসাবশেষ এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ ২০১৮ সালে ধ্বংস করা মার্কিন স্যাটেলাইট থেকে উৎপন্ন হওয়া ১’শ ৭৩টা ধ্বংসাবশেষের মাঝে একটাও এখন মহাকাশে নেই। ২০০৭ সালে চীনা স্যাটেলাইটের ৩ হাজার ৬’শ ৭৯টা ধ্বংসাবশেষের মাঝে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৩টা এখনও মহাকাশে ঘুরছে। ২০১৮ সালের ভারতীয় স্যাটেলাইটের ১’শ ৬৮টা ধ্বংসাবশেষের একটা এখনও মহাকাশে রয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেই ২০০৭ সালে চীনা স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনকে স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছিল।

মার্কিন বিবৃতির প্রত্যুত্তরে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু বলেন যে, মহাকাশের এই ধ্বংসাবশেষ মহাকাশের কোন কর্মকান্ডকেই হুমকির মাঝে ফেলবে না। ১৯৮০এর দশকের একটা স্যাটেলাইটকে রুশরা নিখুঁতভাবে ধ্বংস করেছে। তবে ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এরকম স্যাটেলাইট ধ্বংসকারী পরীক্ষা মহাকাশে ধ্বংসাবশেষের আরও বড় সমস্যার মাঝে একটামাত্র। মহাকাশে মানুষের পদচারণা বাড়ছেই; যা এই সমস্যাকে আরও গভীর করছে। মহাকাশে বর্তমানে বিশাল এক জঙ্গল অবস্থান করছে। এর মাঝে রয়েছে বিভিন্ন স্টেজের রকেট; যেগুলি কয়েক দশক ধরে মহাকাশে ঘুরতে থাকে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার মহাকাশের পরীক্ষার পর পেন্টাগন মহাকাশে তাদের সম্পদগুলিকে রক্ষা করার জন্যে নড়েচড়ে বসেছে। ১৭ই নভেম্বর মার্কিন স্পেস ফোর্সের লেঃ জেনারেল নিনা আরমাইনো লাস ভেগাসে একটা মহাকাশ কনফারেন্সে বলেন যে, রাশিয়া মূলতঃ একটা অস্ত্র পরীক্ষা দেখিয়েছে। তারা যদি একটা রুশ স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে পারে, তাহলে একটা মার্কিন স্যাটেলাইটও ধ্বংস করতে পারবে। শুধু রাশিয়া নয়; চীনও এটা পারবে। প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, গত জুলাই মাসে চীনারা একটা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, যা মহাকাশে পুরো পৃথিবী ঘুরে এসেছে। রাশিয়া এবং চীনের এই পরীক্ষাগুলি পেন্টাগনের টনক নড়িয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব অস্টিন সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশের ‘সশস্ত্রীকরণ’এর ব্যাপারে চিন্তিত। যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ সাধ্যমতো বিভিন্ন প্রকারের হুমকি মোকাবিলায় কাজ করছে। জেনারেল আরমাইনো বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইবে তাদের মহাকাশের সম্পদগুলিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন করে ফেলা অথবা সেগুলিকে বাজে টার্গেট হিসেবে পেশ করা। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে; একইসাথে কক্ষপথের ভিন্নভিন্ন স্তর তৈরি করবে; হাইব্রিড সক্ষমতাসহ ছোট স্যাটেলাইট ডেভেলপ করবে; এবং বাণিজ্যিক সক্ষমতাকেও এর সাথে যুক্ত করবে। এগুলি করতে রাশিয়ার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র পূর্বাভাষ সক্ষমতাকে টার্গেট করা কঠিন হয়ে যাবে।

কানাডার ‘অটাওয়া ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর পল রবিনসন রুশ মিডিয়া ‘আরটি’র এক লেখায় বলছেন যে, এই মুহুর্তে মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে কোন চুক্তি নেই। অর্থাৎ মহাকাশ এখন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন মহাকাশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করে না। কিন্তু রুশ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দেখিয়ে দেয় যে, হয়তো যুক্তরাষ্ট্র এব্যাপারে চিন্তা করলে ভালো করবে। রবিনসন বলছেন যে, যদিও রুশ এই পরীক্ষা মহাকাশের ধ্বংসাবশেষের সমস্যাকে খারাপ করেছে, তথাপি আন্তর্জাতিক কোন আইন না থাকার কারণে বলা যাচ্ছে না যে, রুশরা বেআইনী কিছু করেছে। তিনি বলছেন যে, মহাকাশের ‘সামরিকীকরণ’ এবং ‘সশস্ত্রীকরণ’এর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। সামরিক যোগাযোগের জন্যে মহাকাশ বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ‘সশস্ত্রীকরণ’ মাত্র শুরু হতে চলেছে, যার মাধ্যমে মহাকাশে ধ্বংস সক্ষমতা তৈরি করা হচ্ছে। মার্কিনীরা মনে করছে যে, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থাকতে থাকতে তাদের উচিৎ মহাকাশে এগিয়ে যাওয়া; কারণ মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শেষপর্যন্ত কেউই আটকাতে পারবে না।

২০০৮ সালে চীন এবং রাশিয়া ‘ট্রিটি অন প্রিভেনশন অব দ্যা প্লেসমেন্ট অব ওয়েপন্স ইন আউটার স্পেস’ এবং ‘থ্রেট অর ইউজ অব ফোর্স এগেইনস্ট আউটার স্পেস অবজেক্ট’ নামে দু’টা চুক্তির খসরা তৈরি করলেও যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর থেকে জাতিসংঘেও দুই পক্ষ মহাকাশ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ প্রযুক্তিতে ব্যাপকভাবে এগিয়ে আছে এবং বিশ্বব্যাপী তার সামরিক কর্মকান্ড মহাকাশের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। তাই তারা রাশিয়া বা চীনের সাথে মহাকাশ নিয়ন্ত্রণের কোন চুক্তিতে যেতে অনিচ্ছুক। এমতাবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতেই রাশিয়া মহাকাশে স্যাটেলাইট ধ্বংসের প্রকল্পে নেমেছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রও রুশ কর্মকান্ডকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দিয়ে বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদায় করছে। মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারাও মহাকাশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা না বলে রুশ হুমকি মোকাবিলার পাল্টা কৌশলের উপরেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। মহাকাশে কোন আন্তর্জাতিক আইনের অনুপস্থিতি এতকাল সমস্যা সৃষ্টি না করলেও ভেঙ্গে পড়া বিশ্বব্যবস্থায় তা দুশ্চিতার কারণ হচ্ছে।

Thursday 18 November 2021

পোল্যান্ড এবং বেলারুশের সীমান্তে ব্রিটেন কি চাইছে?

১৮ই নভেম্বর ২০২১

পোল্যান্ড বেলারুশ সীমান্তে শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় ব্রিটেন পোল্যান্ডের সাথে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। অমানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করে ঠান্ডায় জমে যাওয়া শরণার্থীদেরকে শক্তি প্রয়োগে ঠেকিয়ে রাখতে পোল্যান্ডকে সমর্থন এবং টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে ব্রিটেন প্রমাণ করছে যে, তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কৌশল বিশ্বব্যাপী আদর্শকে পূনপ্রতিষ্ঠা করার জন্যে নয়; নিছক ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলিকে বিশ্বের সবচাইতে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।

 
পোল্যান্ড বেলারুশ সীমান্তে শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় ব্রিটেন পোল্যান্ডের সাথে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ১৩ই নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক লেখায় বলেন যে, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো অসহায় শরণার্থীদেরকে খুব সুচতুরভাবে ব্যবহার করে একটা সমস্যার জন্ম দিয়েছেন। তিনি সমস্যা সমাধানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানান। ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইইউ এই সমস্যাকে বেলারুশ সরকারের ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। তারা বলছে যে, বেলারুশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরণার্থীদের পোল্যান্ডের সীমানায় জড়ো করে চাপ সৃষ্টি করছে। লিজ ট্রাসের জবাবে পরদিন রুশ পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন যে, এই সমস্যার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কোন দায়বদ্ধতা নেই। তিনি উল্টো বলেন যে, বরং ইরাকে ব্রিটিশ হামলাই ছিল সুচতুরভাবে করা। ইরাকের জনগণের মৃত্যু, রাষ্ট্রের পতন, অগুণিত শরণার্থী, আইসিসের উত্থান, মানবাধিকার দুর্যোগের জন্যে ব্রিটেন পুরোপুরিভাবে দায়ী। যতক্ষণ পর্যন্ত লন্ডন এই অপরাধগুলির জন্যে দায়বদ্ধতা নিচ্ছে না, ততক্ষণ তাদের প্রতিনিধিদের অন্য কারুর দিকে আঙ্গুল তাক করার অধিকার নেই। ভ্লাদিমির পুতিন একই দিনে রুশ টেলিভিশনের এক স্বাক্ষাতে জাখারোভার কথাগুলিকেই সমর্থন দেন। তিনি বলেন যে, পোলিশ সেনারা শরণার্থীদের পেটাচ্ছে, তাদের মাথার উপর দিয়ে গুলি ছুঁড়ছে এবং রাতের বেলায় বাতি এবং সাইরেন দিয়ে তাদের দূরে রাখছে। এই কর্মকান্ডগুলি পশ্চিমা দেশগুলির মানবাধিকারের কথাগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

পোল্যান্ডই কেন?


এই সমস্যার মাঝে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাটিউজ মোরাউইয়েকি ন্যাটোকে জড়িত হবার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন যে, পোল্যান্ড নিজেদের সমস্যাগুলি জনসন্মুখে বলেছে সেটাই যথেষ্ট। এখন পোল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে বাস্তব সহায়তা আশা করছে। ১২ই নভেম্বর ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ জানায় যে, ব্রিটিশ সরকার পোল্যান্ডের সীমানা রক্ষায় ১০ জন ব্রিটিশ সেনা পাঠিয়েছে। এই সেনারা সীমানা প্রাচীর আরও শক্তিশালী করতে ইঞ্জিনিয়ারিং সহায়তা দেবে। তবে এরপর আর কোন সৈন্য পাঠাবার উদ্দেশ্য ব্রিটেনের নেই বলে জানায় তারা। ইতোমধ্যেই পোলিশ সরকার বেলারুশের সীমানায় ২০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। পোলিশ সরকার ব্রিটেনের কাছে সহায়তা চাইলেও ইইউএর সীমানা ব্যবস্থাপনা সংস্থা ‘ফ্রনটেক্স’এর সহায়তা চায়নি। পত্রিকাটা বলছে যে, কি কারণে পোল্যান্ড ব্রিটেনের সহায়তা চেয়েছে তা পরিষ্কার না হলেও ইইউএর সাথে উভয় দেশই দ্বন্দ্বে জড়াবার পর থেকে তাদের মাঝে সখ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ বলছে যে, যখন শরণার্থীরা মারা যাচ্ছে, তখন তাদের সহায়তা না দিয়ে ব্রিটিশ সেনা পাঠিয়ে সীমানা প্রাচীর শক্তিশালী করাটা মানুষের জীবনের প্রতি মারাত্মক অবহেলা এবং অভিবাসী প্রত্যাশী মানুষের অধিকারের প্রতি চরম অবহেলাকে দেখিয়ে দেয়।

 
সমতলভূমি হওয়ায় দেশটা পশ্চিম ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে একটা খোলা জায়গা। এই অবস্থানটাই পোল্যান্ডকে অষ্টাদশ শতকের পর থেকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। অষ্টাদশ শতকে রাশিয়া এবং প্রুশিয়া এবং ঊনিশ শতকে জার্মানির আবির্ভাবের পর থেকে জার্মানি, রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া মিলে পোল্যান্ডের ভূখন্ড ভাগাভাগি করে ফেলে। এর ফলশ্রুতিতে ষোড়শ শতকের শক্তিশালী পোলিশ লিথুয়ানিয়ান সাম্রাজ্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যান্য শক্তিদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।

পোল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটার এধরনের সমস্যার একটা প্রধান কারণ। পোল্যান্ডের ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জের একটা বর্ণনা দিয়েছে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্ট্রাটফর’। দেশটা উত্তর ইউরোপের সমতলভূমির উপর অবস্থিত; যার পূর্ব এবং পশ্চিমে তেমন কোন বড় ভৌগোলিক বাধা নেই। তবে এর উত্তরে বল্টিক সাগর এবং দক্ষিণে কার্পেথিয়ান পর্বতমালা দেশটাকে উত্তর-দক্ষিণে সংকুচিত করে রেখেছে। সমতলভূমি হওয়ায় দেশটা পশ্চিম ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে একটা খোলা জায়গা। এই অবস্থানটাই পোল্যান্ডকে অষ্টাদশ শতকের পর থেকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। অষ্টাদশ শতকে রাশিয়া এবং প্রুশিয়া এবং ঊনিশ শতকে জার্মানির আবির্ভাবের পর থেকে জার্মানি, রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া মিলে পোল্যান্ডের ভূখন্ড ভাগাভাগি করে ফেলে। এর ফলশ্রুতিতে ষোড়শ শতকের শক্তিশালী পোলিশ লিথুয়ানিয়ান সাম্রাজ্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যান্য শক্তিদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবের অধীন হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পোল্যান্ড ১৯৯৯ সালে ন্যাটোতে যুক্ত হয় এবং ২০০৪ সালে ইইউতে যুক্ত হয়। বিপুল পশ্চিমা বিনিয়োগে পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি হতে থাকে। রাশিয়ার ভীতি পোল্যান্ডকে ন্যাটোর সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল করেছে এবং দেশটাতে ইউরোপের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। একইসাথে ইউক্রেনকে পশ্চিমা ধাঁচে নিয়ে এসে পোল্যান্ড তার পূর্ব সীমানাকে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে।

জার্মান রুশ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের অবস্থান


পোল্যান্ড একদিকে যেমন উত্তর ইউরোপের সমতলভূমির উপর বড় একটা দেশ, তেমনি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বল্টিক সাগরে পোল্যান্ডের রয়েছে উপকূল এবং বড় সমুদ্রবন্দর। বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের রয়েছে ঐতিহাসিক উপস্থিতি। ২০১৮ সালে ব্রিটেন এস্তোনিয়ার স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করে। সেই অনুষ্ঠানে এস্তোনিয়ানরা মনে করে যে, ১৯১৮-১৯ সালের সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌ এবং বিমান শক্তি এস্তোনিয়ার স্বাধীনতা অর্জনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এস্তোনিয়ার স্বাধীনতা ছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সামরিক মিশনের ফলাফলস্বরূপ যুদ্ধ। ব্রিটিশরা তখন রাশিয়ার উত্তরে মুরমানস্ক এবং আর্কেঞ্জেলস্ক এবং দক্ষিণে ইউক্রেনে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। প্রায় একইসাথে চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে সদ্য গঠিত দ্বিতীয় পোলিশ রিপাবলিকের সাথে লেনিনের বলশেভিক রাশিয়ার যুদ্ধ। পোল্যান্ডের সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, ১৯২০ সালের অগাস্টে সোভিয়েত বাহিনীর হাত থেকে পোলিশরা যখন তাদের রাজধানী ওয়ারশ মুক্ত করার চেষ্টা করছিল, তখন ব্রিটিশরা পোল্যান্ডকে ১’শটা যুদ্ধবিমান এবং বেশকিছু কামান এবং বন্দুক সরবরাহ করেছিল। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন বল্টিকে তার প্রভাবকে আরও বাড়াতে চেষ্টা করে। তবে জার্মানি এবং রাশিয়ার কারণে এই প্রভাব সবসময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের সাথে পোল্যান্ডের সম্পর্কটা দৃঢ় হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ব্রিটেন যুদ্ধে যোগ দেয়। ব্রিটেন পোল্যান্ডকে নিরাপত্তা দিতে না পারলেও হাজার হাজার পোলিশ নাগরিক ব্রিটেনের নিরাপত্তার জন্যে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং জীবন দেয়। ‘দ্যা ফার্স্ট নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলিশ ইন্টেলিজেন্স ছিল ইউরোপের সবচাইতে সফল ইন্টেলিজেন্স সংস্থা। কর্নেল স্টানিসলাউ গানোর নেতৃত্বে এই ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ছিল ব্রিটিশ তথা মিত্রবাহিনীর ইন্টেলিজেন্সের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মূল অফিস ছিল পশ্চিম লন্ডনের হ্যামারস্মিথের সেন্ট পলস স্কুল। বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৫১ সালে ব্রিটেনে পোলিশ নাগরিক ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার; যা পোল্যান্ডের ইইউতে যোগদানের পর ২০১১ সাল নাগাদ ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ২০০৪ সালে পোলিশরা ব্রিটেনের ১৩তম বিদেশী নাগরিকের গ্রুপ ছিল; ২০০৮ সাল নাগাদ তারা হয়ে যায় বৃহত্তম।

 

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় এসোসিয়েট ফেলো ডানকান ডিপ্লেজ বলছেন যে, ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করার পর ছোট বল্টিক রাষ্ট্রগুলি দুশ্চিন্তায় পরে যায়। বিশেষ করে রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পর এই দুশ্চিন্তা জেঁকে বসে। উত্তর এস্তোনিয়ার শহরগুলিতে রুশ নাগরিকের অধিক্য সবসময়ই এস্তোনিয়ানদের ভয়ের মাঝে রাখছে। ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় এই দেশগুলি রুশ আক্রমণের শিকার হলে ন্যাটোর অন্যান্য দেশ এখানে হস্তক্ষেপ করবে। আর বল্টিকে সম্ভাব্য যেকোন হস্তক্ষেপে ব্রিটেন নেতৃত্ব দেবে। ২০১৭ সাল থেকে ব্রিটেন ন্যাটোর ‘ফ্রেমওয়ার্ক নেশনস কনসেপ্ট’ বা ‘এফএনসি’এর অধীনে বল্টিকে সামরিক মিশন প্রেরণ করছে। ২০১৯ সালে ‘অপারেশন কাবরিট’এর অধীনে ব্রিটেন এস্তোনিয়াতে ৯’শ সেনা প্রেরণ করে। ১৬তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেডের প্রায় ২’শ সেনা আকাশ থেকে প্যারাশুট জাম্প করে। সেবছরের এপ্রিল মাস থেকে রয়াল এয়ার ফোর্সের ৪টা ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ যুদ্ধবিমান এস্তোনিয়াতে মোতায়েন করা হয়। তবে ব্রিটিশ বিমান শক্তি মোতায়েনের এরকম কার্যক্রম নিয়মিত চলছে ২০০৪ সাল থেকেই। ২০২০এর জুলাই মাসে রয়াল এয়ার ফোর্স বলে যে, তাদের ‘টাইফুন’ বিমানগুলি তিনটা রুশ যুদ্ধবিমানকে লিথুয়ানিয়ার কাছাকাছি আকাশে বাধা দেয়। এরকম ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটছে। বিশেষ করে বল্টিক সাগরে ন্যাটোর সামরিক মহড়া সর্বদাই মস্কোর জন্যে বিরক্তির কারণ। আবার প্রত্যুত্তর হিসেবে রাশিয়াও অত্র অঞ্চলে নিয়মিত সামরিক মহড়া চালায়। বল্টিকে ব্রিটিশ বিমানগুলির সাথে জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ এবং অন্যান্য মোট ১৪টা দেশের যুদ্ধবিমানও আকাশ পাহাড়া দেয়। তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ার জনসংখ্যা যথাক্রমে ২৮ লক্ষ, ১৯ লক্ষ এবং ১৩ লক্ষ। ছোট্ট এই দেশগুলির বিমান বাহিনীতে কোন ফাইটার বিমান নেই। তাই দেশগুলি নিরাপত্তার জন্যে ন্যাটোর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাই ব্রিটেনকে বল্টিক সাগরে গুরুত্বপূর্ণ করে রেখেছে।

বল্টিকের নিরাপত্তায় ন্যাটোর মাঝে নেতৃত্ব ব্রিটেনের হাতে

বল্টিক সাগরের উপকূলে ব্রিটেনের বর্তমান সামরিক অবস্থানকে বুঝতে হলে ন্যাটোর ‘এফএনসি’এর দিকে তাকাতে হবে। সুজারল্যান্ডের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ’ বা ‘সিএসএস’এর এক প্রতিবেদনে ‘জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি এফেয়ার্স’ বা ‘এসডব্লিউপি’এর রেইনার গ্লাটজ এবং ‘সিএসএস’এর মার্টন জাপফে ন্যাটোর ‘এফএনসি’এর একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘এফএনসি’এর অধীনে ২০১৩ সাল থেকে ন্যাটোর তিন সীমানা অঞ্চলের নিরাপত্তা দিতে তিনটা দেশের নেতৃত্বে তিনটা নিরাপত্তা কাঠামো পরিকল্পনা করা হয়। এই তিনটা কাঠামোর নেতৃত্বে রয়েছে জার্মানি, ব্রিটেন এবং ইতালি। জার্মানির নেতৃত্বে গ্রুপটা মোট ১৬টা সামরিক সক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছে; এর মাঝে ন্যাটোর যে দেশ এই সক্ষমতাগুলির যেটা দিতে পারবে, তারা সেটাতে অংশ নেবে। জার্মানির নেতৃত্বে এই গ্রুপের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে একটা সমন্বিত সেনাবাহিনী তৈরি করা। ইতালির নেতৃত্বে গ্রুপটা কাজ করবে ইউরোপের দক্ষিণ সীমান্তে; মূলতঃ উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে। তবে এই গ্রুপটা খুব বড় কোন লক্ষ্য রেখে এগুচ্ছে না। উত্তর ইউরোপে যে গ্রুপটা বড় লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে, সেটা হলো ব্রিটেনের নেতৃত্বে থাকা ‘জয়েন্ট এক্সপিডিশনারি ফোর্স’ বা ‘জেইএফ’। ২০১২ সালে পরিকল্পিত হওয়া ‘জেইএফ’এর মাঝে ২০১৪ সালে যুক্ত হয় নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ নরওয়ে এবং তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া। ২০১৭ সালে ন্যাটোর বাইরের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডও যুক্ত হয়। এদের একটা লক্ষ্য ছিল ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন। তবে এই দেশগুলির সবগুলিরই মূল লক্ষ্য ছিল উত্তর ইউরোপে রাশিয়ার আগ্রাসী অবস্থানকে মোকাবিলা করা। ব্রিটেন ‘জেইএফ’ নামের এই গ্রুপের কাঠামোটাকে এমনভাবে ডিজাইন করেছে যে, যেকোন দেশ যেকোন সময়ে এই মাঝে যুক্ত হতে পারবে। ‘জেইএফ’এর মূল কর্মক্ষেত্র হলো নরওয়ের উপকূল এবং বল্টিক সাগর। নিয়মিতভাবেই ‘জেইএফ’এর মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে বল্টিকে এবং নরওয়ের উপকূলে। ব্রিটেন এর মাধ্যমে পোল্যান্ডের সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চাইবে।

 
এপ্রিল ১৮০১ সাল। কোপেনহাগেনের যুদ্ধে ব্রিটিশরা ড্যানিশ নৌবাহিনীকে পরাজিত করে বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের স্বার্থ কয়েক শতক ধরে। সপ্তদশ শতক থেকে ঊনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত কাঠের পালতোলা জাহাজের যুগে ব্রিটেনের একটা বড় বাণিজ্য ছিল বল্টিকের সাথে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ তৈরির উপকরণের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসতো সুইডেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া, পোল্যান্ড, নরওয়ে থেকে। এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে ব্রিটেন স্প্যানিশ, ডাচ এবং ড্যানিশদের সাথে যুদ্ধও করেছে।


বল্টিকে ব্রিটেনের ঐতিহাসিক স্বার্থ

বল্টিক সাগরে ব্রিটেনের স্বার্থ কয়েক শতক ধরে। সপ্তদশ শতক থেকে ঊনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত কাঠের পালতোলা জাহাজের যুগে ব্রিটেনের একটা বড় বাণিজ্য ছিল বল্টিকের সাথে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ তৈরির উপকরণের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসতো সুইডেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া, পোল্যান্ড, নরওয়ে থেকে। এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে ব্রিটেন স্প্যানিশ, ডাচ এবং ড্যানিশদের সাথে যুদ্ধও করেছে। ১৭১৮ থেকে ১৭২৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা বল্টিকে টহল দিয়েছে রুশ হামলা থেকে সুইডিশ উপকুলকে রক্ষা করতে। স্থলভাগে রুশদের আগ্রাসী কর্মকান্ড ব্রিটিশরা থামাতে না পারলেও ১৭৫০এর দশকে প্রুশিয়াকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে বল্টিকে প্রভাব ধরে রাখে। বল্টিক সাগরে ঢোকার পথের নিয়ন্ত্রণ মুলতঃ ডেনমার্ক এবং সুইডেনের হাতে; কারণ কোপেনহাগেন শহর এবং সুইডেনের মালমো শহরের পাশ দিয়েই জাহাজগুলিকে বল্টিক সাগরে ঢুকতে বা সেখান থেকে বের হতে হয়। মাত্র ৩ থেকে ৫ কিঃমিঃ চওড়া এই প্রণালির নিয়ন্ত্রণ যাতে অন্য কারুর হাতে চলে না যায়, সেজন্য ব্রিটেন দু’বার কোপেনহাগেন আক্রমণ করে। ১৮০১ সালে প্রথমবার রুশ প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্যে ড্যানিশ নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্রিটেন। রুশ রাজা জার পল হত্যার পর বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিভাবে ব্রিটেনের হাতে যায়। অনেকেই মনে করে থাকেন যে, জার পলের হত্যার পিছনে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটওয়ার্থ জড়িত ছিলেন। এর ছয় বছর পর ১৮০৭ সালে ব্রিটেন আবারও কোপেনহাগেন আক্রমণ করে যাতে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্স ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ড্যানিশ যুদ্ধজাহাজগুলিকে বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যবহার করতে না পারে।

ঊনিশ শতকে জার্মানির আবির্ভাবের পর ব্রিটিশ নৌবাহিনী বল্টিকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘অপারেশন রেড ট্রেক’ নামে বল্টিকে বলশেভিক বিরোধী মিশন শুরু করে; যার ফলশ্রুতিতে এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়ার জন্ম দেয় ব্রিটেন। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ নৌবাহিনী এস্তোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদেরকে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাড়ে ছয় হাজার রাইফেল, ২’শ মেশিন গান এবং দু’টা কামান সরবরাহ করে। এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়া ব্রিটিশদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিল যে, তাদের নতুন তৈরি করা নৌবাহিনীর পতাকাগুলিও ছিল ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার আদলে তৈরি। ব্রিটিশ সহায়তা ছাড়া এই দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জন যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখাও ছিল পুরোপুরিভাবে অবাস্তব।

‘রুসি’র ডানকান ডিপ্লেজ বলছেন যে, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র তিনটা বল্টিক রাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ছেড়ে দিলে অনেকেই তা মানতে পারেননি। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এই দেশগুলিকে ন্যাটোর মাঝে এনে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও পুরোনো ক্ষতগুলিকে সাড়াতে সহায়তা করবে। 

মার্চ ২০২১। ব্রিটেনের নেতৃত্বে থাকা ‘জয়েন্ট এক্সপিডিশনারি ফোর্স’ বা ‘জেইএফ’ মহড়া দিচ্ছে বল্টিক সাগরে। ব্রিটেন শুধু বল্টিক সাগরে নিজের অবস্থানই ধরে রাখতে চাইছে না; ইউরোপের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ককেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। ব্রিটেন এখন ওয়ারশতে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাইছে। বেলারুশের সাথে পোল্যান্ড এবং বল্টিক রাষ্ট্রগুলির সীমান্ত সমস্যায় ব্রিটেন অগ্রগামী ভূমিকা নিতে চাইছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাকি বিশ্ব থেকে তার বাহিনী সরিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করতে। পূর্ব ইউরোপের উত্তেজনার উপর ব্রিটেনের প্রভাব যত বেশি থাকবে, যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপ নীতির জন্যে ব্রিটেনের উপর ততটাই নির্ভর করতে বাধ্য হবে।

ব্রিটেন আসলে কি চাইছে?

ব্রিটেন শুধু বল্টিক সাগরে নিজের অবস্থানই ধরে রাখতে চাইছে না; ইউরোপের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ককেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। রাশিয়ার ব্যাপারে জার্মানি এবং পোল্যান্ডের নীতির পার্থক্য রয়েছে। জার্মানরা যখন রুশ গ্যাসের উপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে, তখন পোলিশরা রুশ হুমকি মোকাবিলায় নিজ দেশে ন্যাটোর সেনা মোতায়েন চেয়েছে। আর ছোট্ট বল্টিক রাষ্ট্রগুলি নিজেদের কোন নিরাপত্তা কাঠামো না থাকায় ন্যাটোর উপর সম্পূর্ণই নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য। ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পোল্যান্ডের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। ব্রিটেন এখন ওয়ারশতে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাইছে। বেলারুশের সাথে পোল্যান্ড এবং বল্টিক রাষ্ট্রগুলির সীমান্ত সমস্যায় ব্রিটেন অগ্রগামী ভূমিকা নিতে চাইছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাকি বিশ্ব থেকে তার বাহিনী সরিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করতে। পূর্ব ইউরোপের উত্তেজনার উপর ব্রিটেনের প্রভাব যত বেশি থাকবে, যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপ নীতির জন্যে ব্রিটেনের উপর ততটাই নির্ভর করতে বাধ্য হবে। আর ইউরোপ নীতি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদের বিশ্বব্যাপী বন্টনকে প্রভাবিত করবে বলেই যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে। ব্রেক্সিটের পর যে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নীতি নিয়ে ব্রিটেন এগুচ্ছে, তার ফলাফলই এখন দেখছে মানুষ বেলারুশের সীমানায়। অমানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করে ঠান্ডায় জমে যাওয়া শরণার্থীদেরকে শক্তি প্রয়োগে ঠেকিয়ে রাখতে পোল্যান্ডকে সমর্থন এবং টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে ব্রিটেন প্রমাণ করছে যে, তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কৌশল বিশ্বব্যাপী আদর্শকে পূনপ্রতিষ্ঠা করার জন্যে নয়; নিছক ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলিকে বিশ্বের সবচাইতে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।

Wednesday 17 November 2021

চীনারা কি গুলি না চালিয়েই যুদ্ধ জিতে যাচ্ছে?

১৭ই নভেম্বর ২০২১

চীনা মাছ ধরার জাহাজের বহর। চীনারা মিলিশিয়া জাহাজগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অঞ্চলে পাঠিয়ে অন্য দেশের জাহাজকে সমস্যায় ফেলে বলতে পারে যে, এরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবার মিলিশিয়াদের কেউ হতাহত হলে চীনা সরকার তাদের নাগরিকদের রক্ষা করতে জনমত তৈরি করতে পারবে। চীনাদের এই ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’র কোন প্রত্যুত্তর এখনও মার্কিনীরা দিতে পারেনি। উল্টো মার্কিন সহায়তা না পেয়ে ছোট দেশগুলি মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি হতাশাই ব্যক্ত করেছে।


ফিলিপাইনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফিলিপাইন কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্স’এর অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল এডিলবার্তো আদান ‘দ্যা ম্যানিলা টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, চীনারা সাগরে কোন গোলাগুলি ছাড়াই যুদ্ধ জিতে চলেছে। চীনারা ফিলিপাইনের ‘এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন’ বা ‘ইইজেড’এর মাঝেই ভয় দেখিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করছে; যাকে তিনি ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। চীনা হুমকি মোকাবিলায় তিনি ফিলিপাইনের জন্যে শুধু বন্ধু বা পার্টনারই চাইছেন না, এমন কোন মিত্র চাইছেন, যে কিনা চীনারা আক্রমণ করলে ফিলিপাইনকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করবে এবং চীনাদের ‘গ্রে জোন’ কৌশল মোকাবিলায় ফিলিপিনোদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ‘গ্রে জোন’ হলো এমন একটা কৌশল, যার মাধ্যমে যুদ্ধ আর শান্তির মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করা কঠিন হয়ে যায়। অর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে শুরু করে তথ্য যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ, হাল্কা প্রকৃতির কিছু সহিংস কর্মকান্ড এতে থাকতে পারে। এছাড়াও নতুন প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সাইবার হামলার মাধ্যমে একটা দেশকে অকার্যকর করে ফেলা সম্ভব। ফিলিপাইনের সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন ভাইস চিফ অফ স্টাফ জেনারেল আদান ফিলিপাইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ বছর আগে স্বাক্ষরিত ‘মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি’ বা ‘এমডিটি’কে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন করার পক্ষপাতি। ‘এমডিটি’ চুক্তিকে আগ্রাসী রাষ্ট্রের অপ্রচলিত এবং ‘হাইব্রিড’ কৌশলের বিরুদ্ধে ডিটারেন্ট হিসেবে কাজ করতে হবে। ফিলিপাইনের উপর প্রচলিত সামরিক হামলা হলে চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দেবে। কিন্তু ‘গ্রে জোন’ কৌশল অবলম্বণ করার ফলে চীনারা ‘এমডিটি’ চুক্তিকে বাইপাস করতে পারছে। এই ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’ চীনারা তাদের ‘ম্যারিটাইম মিলিশিয়া’কে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে; যারা মূলতঃ সরকারি বাহিনী। ফিলিপাইনের জাহাজে ধাক্কা দেয়া এবং দল বেঁধে চীনা জাহাজের ইইজেডএর ভিতরে ঢুকে অবস্থান করার মতো ঘটনার ব্যাপারে ফিলিপাইন সরকার বেইজিংএর কাছে প্রতিবাদ করেছে; কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। জেনারেল আদান বলছেন যে, একারণেই ফিলিপাইনের উচিৎ ‘এমডিটি’র মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া।

গত মার্চে ২’শ চীনা মাছ ধরার ট্রলার একত্রে দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের কাছাকাছি এসে হাজির হয়। ফিলিপাইন বলছে যে, সেই জায়গা ফিলিপাইনের ইইজেডএর মাঝে পড়ে। তাদের কথায়, ট্রলারগুলি দেখে মনে হয় না যে, এগুলি মাছ ধরতে এসেছে। এগুলি বরং চীনের ‘ম্যারিটাইম মিলিশিয়া’ দ্বারা পরিচালিত। ‘বিবিসি’ বলছে যে, পাঁচ বছর আগে আন্তর্জাতিক আদালত দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ শতাংশ এলাকাকে চীনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে রায় দেয়। তবে বেইজিং তাদের নিজেদের আঁকা ‘নাইন ড্যাশ লাইন’এর মাঝে সকল সমুদ্রাঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে। এই অঞ্চলের মাঝে চীনারা কৃত্রিমভাবে দ্বীপ উন্নয়ন করেছে এবং নিয়মিত সামরিক প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করেছে। এর আগে ২০১৯এর ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার কাছে নতুনা সাগরে চীনা মাছ ধরার ট্রলারের বড় একটা বহর কোস্ট গার্ডের জাহাজের পাহাড়ায় হানা দেয়। ইন্দোনেশিয়ার সরকার এই হুমকি মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে নৌবাহিনীর জাহাজ প্রেরণ করে। কিন্তু উভয় পক্ষ সমুদ্রে বেশ কিছুদিন ধরে উত্তেজনাকর অবস্থানে থাকে। পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়া সেই অঞ্চলে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় নিজেদের মাছ ধরার জাহাজের বহর মোতায়েনের পরিকল্পনা শুরু করে বলে দেশটার মিডিয়া ‘মঙ্গাবে’ জানায়।

শুধু কাছের সমুদ্রেই নয়, চীনারা পাড়ি জমিয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কিঃমিঃ দূরের দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে। ২০২০এর সেপ্টেম্বরে প্রায় ৩’শ চীনা মাছ ধরার জাহাজ হাজির হয় দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর সমুদ্রসীমায়। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, জাহাজগুলি গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কাছে মাছ ধরার পর পেরুর উপকূলে হাজির হয়। ইকুয়েডরের নৌবাহিনীর অপারশনসএর কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল ড্যানিয়েল গিনেজ বলেন যে, এভাবে মাছ ধরলে কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। চীনারা এখানে প্রতিবছরই মাছ ধরতে আসছে। একই বছরের জুন মাসে ৩’শ ৪০টা জাহাজ একত্রে গালাপাগোস এবং ইকুয়েডরের কাছে মাছ ধরতে এসেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু এবং ইকুয়েডরের অর্থনীতি সামুদ্রিক মাছ ধরার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। চীনাদের কর্মকান্ড এই দেশগুলির অর্থনীতিকে আঘাত করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের হিসেবে এই দুই দেশ মিলে বছরে প্রায় ৪৫ লক্ষ টন মাছ ধরে; যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান। তবে চীনারা এক বছরে এরও চার গুণ মাছ ধরে। পুরো বিশ্বের মোট মৎস্য সম্পদের তিন ভাগের এক ভাগই চীনারা খাচ্ছে। লন্ডনের ‘ওভারসীজ ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট’এর হিসেবে চীনাদের রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার জাহাজের বিশাল মাছ ধরার বহর। তাদের জাহাজের আকৃতিও বড় হচ্ছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার উপকূলে চীনারা ৬টা জাহাজ পাঠিয়েছে বলে ২০২০এর জুলাইএ আফ্রিকার মিডিয়াগুলি প্রতিবেদন করে। তারা বলে যে, এই জাহাজগুলি বছরে ১২ হাজার টন পর্যন্ত মাছ ধরতে সক্ষম, যা লাইবেরিয়ার স্বাভাবিক মাছ ধরার সক্ষমতার দুই গুণ!

সমুদ্র এখন চীনের অর্থনীতিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনাদের সাথে বাকিদের চলছে ব্যাপক দ্বন্দ্ব। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি চীনের কৌশলকে ‘গ্রে জোন’ বা ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ বলছে। সামরিক ম্যাগাজিন ‘মিলিটারি রিভিউ’এর এক লেখায় গবেষক শুজিয়ান লুও এবং জনাথন প্যানটার বলছেন যে, চীনারা তাদের ম্যারিটাইম মিলিশিয়া ব্যবহার করে ‘গ্রে জোন’ কর্মকান্ড চালাচ্ছে; কারণ পরিস্থিতি বুঝে বেইজিং বলতে পারে যে, এদের সাথে সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। চীনারা মিলিশিয়া জাহাজগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অঞ্চলে পাঠিয়ে অন্য দেশের জাহাজকে সমস্যায় ফেলে বলতে পারে যে, এরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবার মিলিশিয়াদের কেউ হতাহত হলে চীনা সরকার তাদের নাগরিকদের রক্ষা করতে জনমত তৈরি করতে পারবে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনারা ট্রলারের বহরের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই কোস্ট গার্ডের জাহাজ পাঠায়। নৌবাহিনীর জাহাজ না পাঠিয়ে সাদা রঙএর কোস্ট গার্ডের জাহাজ পাঠানোটাও ‘গ্রে জোন’ কৌশলের অংশ। এই জাহাজগুলি স্বল্প অস্ত্রে সজ্জিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি চীনা জাহাজগুলি অনেক নৌবাহিনীর ফ্রিগেটের চাইতেও বড়। প্রতিপক্ষের মাছ ধরার ট্রলার বা ছোট প্যাট্রোল বোটকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। চীনাদের এই ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’র কোন প্রত্যুত্তর এখনও মার্কিনীরা দিতে পারেনি। উল্টো মার্কিন সহায়তা না পেয়ে ছোট দেশগুলি মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি হতাশাই ব্যক্ত করেছে।

Tuesday 16 November 2021

তুর্কিরা কেন ট্যাংক বাহিনী শক্তিশালী করছে?

১৬ই নভেম্বর ২০২১

তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের 'আলতায়' ট্যাঙ্কের পরীক্ষামূলক প্রোটোটাইপ। সিরিয়ার যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই হয়তো তুর্কিদের বুঝিয়েছে যে, পুরোনো ট্যাঙ্ক দিয়ে সামনের দিনগুলিতে সকল কাজ করা যাবে না; নতুন ট্যাংক লাগবে। সেকারণেই ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্পে হয়তো গতি এসেছে। তুর্কিরা জার্মান ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্সের দিকেই তাকিয়ে ছিল; কারণ সেগুলি বিশ্বসেরা। তুরস্কের ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্প শুধু একটা জাতীয় গৌরবের বিষয় নয়। তুরস্ক তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বাহিনীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সেকারণেই তারা শুধু নতুন ট্যাংক নিয়েই ব্যাস্ত নয়, পুরোনো ট্যাঙ্কগুলি নিয়েও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে।

 
২০২০এর শেষের দিকে ককেশাসে নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে ঘটে যাওয়া যুদ্ধে একটা ব্যাপার নিয়ে সবচাইতে বেশি আলোচনা হয়েছে; আর তা হলো মনুষ্যবিহীর ড্রোন বিমান। অনেক বিশ্লেষকেরাই ড্রোন যুদ্ধকে যেমন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, তেমনি কেউ কেউ আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের যাত্রা শেষ হয়ে আসছে বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন যে, আকাশ থেকে ছুঁড়ে দেয়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ট্যাঙ্কগুলিকে অসহায় করে ফেলেছিল। হয়তো এখন থেকে ট্যাঙ্কগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ষা করা খুবই কঠিন হয়ে যাবে। অর্থাৎ ট্যাঙ্কগুলি বাহিনীর শক্তিশালী স্তম্ভ না হয়ে বরং দুর্বল অংশ হয়ে দেখা দেবে। তবে কিছু বিশ্লেষকেরা যুক্তি দিয়েছেন যে, সকল যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তবতা একরকম হবে না; এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের ব্যবহার থাকবেই। অন্ততঃ কিছু রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর নতুন প্রযুক্তির ট্যাঙ্ক ডেভেলপ করা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, তারা অন্ততঃ মনে করছে না যে, ট্যাঙ্কের ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ। এই দেশগুলির মাঝে রয়েছে তুরস্ক; যারা ট্যাঙ্কের পিছনে যথেষ্ট সম্পদ বিনিয়োগ করেছে।

তুরস্কের স্বপ্নের ট্যাংক ‘আলতায়’…

গত মার্চ মাসে ‘ডিফেন্স নিউজ’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানায় যে, তুর্কি কোম্পানি ‘বিএমসি’ দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি ‘দুসান’ এবং ‘এসএন্ডটি ডাইনামিকস’এর সাথে এক চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক ‘বিএমসি’ তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের ট্যাংক ‘আলতায়’এর জন্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলি থেকে ‘ডিভি২৭কে’ ডিজেল ইঞ্জিন এবং ‘ইএসটি১৫কে’ ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্সের সরবরাহ পাবে। ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কে জার্মানির ‘এমটিইউ’ কোম্পানির ইঞ্জিন, ‘রেঙ্ক’এর ট্রান্সমিশন এবং ‘রেইনমেটাল’ কোম্পানির ১’শ ২০মিঃমিঃ কামান ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু তুরস্ক সিরিয়ার যুদ্ধে জড়াবার পর জার্মানি তুরস্কের উপর অস্ত্র অবরোধ আরোপ করে। এর ফলশ্রুতিতে জার্মানি তুরস্ককে প্রযুক্তি সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয় এবং ট্যাঙ্কের প্রকল্প থেমে যায়। তুরস্ক নিজস্ব ইঞ্জিন ডেভেলপ করার প্রকল্প হাতে নিলেও তা শেষ হতে আরও অনেক সময় লেগে যেতে পারে। জার্মান প্রযুক্তির উপর অবরোধ বাইপাস করার জন্যেই তুরস্ক দক্ষিণ কোরিয়ার সরণাপন্ন হয়।

কোরিয়া তাদের নিজস্ব ডিজাইনের ‘কে২ ব্ল্যাক প্যান্থার’ ট্যাংক ডেভেলপ করছে। তারাও নিজস্ব প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে গিয়ে সমস্যায় পতিত হয়। ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় সামরিক বিশ্লেষক সেবাস্টিয়ান রোবলিন জানাচ্ছেন যে, কোরিয়ার সেনাবাহিনী চাইছিল এমন একটা ট্রান্সমিশন, যা ১০ হাজার কিঃমিঃ কোনপ্রকার সমস্যা ছাড়াই চলতে পারবে। কিন্তু ‘এসএন্ডটি ডাইনামিকস’এর ‘ইএসটি১৫কে’ ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্স ছোটখাটো সমস্যার কারণে এই মানদন্ডে পাস করেনি। তবে তুরস্কের সেনাবাহিনী তাদের ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের জন্যে ৬ হাজার ৭’শ কিঃমিঃএর মানদন্ড রাখার কারণে তারা কোরিয়ার ট্রান্সমিশন নিতে আগ্রহী হয়। তুর্কি কোম্পানি ‘বিএমসি’ নিজেরাই ‘বাটু’ নামে ১৫’শ হর্সপাওয়ারের একটা ইঞ্জিন ডেভেলপ করছে; যা হয়তো পুরোপুরি অপারেশনে আসতে কয়েক বছর লেগে যাবে। তাই আপাততঃ তারা কোরিয় ইঞ্জিনের উপরেই নির্ভর করবে। তুর্কিরা পশ্চিমা ধাঁচের ৬৫ থেকে ৭২ টনের একটা ভারি ট্যাঙ্ক ডেভেলপ করার লক্ষ্যেই ‘আলতায়’ প্রকল্পে হাত দিয়েছে। গতি, গোলাবর্ষণের শক্তি এবং মূল্যমানের দিক থেকে তা মার্কিন ‘এম১ আব্রামস’, জার্মান ‘লেপার্ড ২’ এবং ব্রিটিশ ‘চ্যালেঞ্জার ২’এর মতোই হবে। তুরস্কের ‘আসেলসান’ কোম্পানির ডেভেলপ করা ‘ভালকান ৩’ ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ‘আক্কর’ ‘একটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম’ বা ‘এপিএস’ এই ট্যাঙ্কের সক্ষমতাকে অনেক এগিয়ে নেবে। ‘এপিএস’ হলো ট্যাংক বা অন্যান্য গাড়ির জন্যে এমন একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র ট্যাঙ্কে আঘাত করার আগেই তাকে ঘায়েল করে ফেলা হবে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ‘আক্কর’কে ডেভেলপ করা হয়েছে ‘পুলাট’ সিস্টেম থেকে; যা বর্তমানে তুরস্কের অন্যান্য ট্যাঙ্কে বসানো হচ্ছে।

‘আলতায়’ ট্যাংক ডেভেলপ করতে গিয়ে তুরস্ক ট্যাঙ্কের বর্ম নিয়েও সমস্যায় পড়েছিল। ফ্রান্সের কাছ থেকে বর্মের প্রযুক্তি আনার কথা থাকলেও ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সাথে ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব শুরু হলে ফ্রান্স প্রযুক্তি সরবরাহ করতে গরিমসি শুরু করে। অগত্যা তুরস্ক নিজেই বর্ম প্রযুক্তি ডেভেলপ করা শুরু করে। তুর্কি কোম্পানি ‘রকেটসান’ বোরন কার্বাইড ব্যবহার করে ‘নন এক্সপ্লোসিভ রিয়্যাকটিভ আর্মার’ বা ‘নেরা’ বর্ম প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছে। এই বর্ম ট্যাঙ্ককে আক্রমণকারী রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র বা শেলকে মূল ট্যাঙ্ককে ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখবে। ‘টারকিশ ডিফেন্স নিউজ’এর সম্পাদক ইউসুফ মেতিন ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের বর্মের বর্ণনা দিয়েছেন। ট্যাঙ্কের সামনে এবং উপরের দিকে থাকবে ৮’শ মিঃমিঃ ‘নেরা’ বর্ম। কিছুটা নিচের দিকে থাকবে ‘ইআরএ’ বর্ম; যা প্রায় ৫’শ থেকে ৬’শ মিঃমিঃএর মতো হবে। ট্যাঙ্কের উপরের দিকের ১’শ ৫০ মিঃমিঃ বর্ম তুলনামূলকভাবে খুবই শক্তিশালী; যা আক্রমণকারী বিমান বা হেলিকপ্টারের গুলি মোকাবিলা করতে পারবে। ‘আলতায়’এর প্রথম ভার্সন হবে ‘টি১’, যার ৪০টা তৈরি হবে; ‘টি২’ তৈরি হবে ২’শ ১০টা; যেগুলির কামানের ব্যারেল দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার ব্যবস্থা থাকবে। ‘টি৩’ ভার্সনের একটা পরীক্ষামূলক কপি চাওয়া হয়েছে; যেটাতে রুশ ‘টি১৪ আরমাতা’ ট্যাঙ্কের আদলে টারেটের ভিতর কোন মানুষ থাকবে না।

তুরস্কের ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্প শুধু একটা জাতীয় গৌরবের বিষয় নয়। তুরস্ক তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বাহিনীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সেকারণেই তারা শুধু নতুন ট্যাংক নিয়েই ব্যাস্ত নয়, পুরোনো ট্যাঙ্কগুলি নিয়েও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে। বিভিন্ন হিসেবে তুরস্কের প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার ট্যাংক রয়েছে। তবে এর বেশিরভাগই পুরোনো মার্কিন এবং জার্মান ডিজাইনের; যেগুলি আধুনিক সমরে বিপক্ষের আধুনিক ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তুরস্ক চাইছে এই পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকেই নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতে। তুরস্ক তার ট্যাংক উন্নয়ন প্রকল্পগুলিকে সাজিয়েছে সিরিয়াতে তাদের সামরিক অপারেশনের অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে। সেখানে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বড় কোন সামরিক শক্তি নয়; বরং কুর্দি বিদ্রোহীরা এবং আইসিস। বিমান শক্তি না থাকলেও তাদের হাতে ছিল শক্তিশালী ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র। তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে এই ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলিকে বাধা হিসেবে দেখছে। একইসাথে তুরস্কের উপর ইউরোপিয় অবরোধের কারণে ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গেছে। একারণেই পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকে নতুন করে সাজাতে বাধ্য হচ্ছে তুরস্ক। ‘আলতায়’ ট্যাংক’ হয়তো তুরস্ক হাতে পাবে ঠিকই; কিন্তু তত সময় পর্যন্ত তুরস্কের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন তো থেমে থাকবে না।

 
সিরিয়ার ইদলিবে তুরস্কের 'এম ৬০টিএম' ট্যাংক; যার উন্নয়ন করা সিস্টেমগুলি দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। ‘আলতায়’ ট্যাংক’ হয়তো তুরস্ক হাতে পাবে ঠিকই; কিন্তু তত সময় পর্যন্ত তুরস্কের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন তো থেমে থাকবে না। তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলিকে বাধা হিসেবে দেখছে। একইসাথে তুরস্কের উপর ইউরোপিয় অবরোধের কারণে ‘আলতায়’ ট্যাঙ্কের প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গেছে। একারণেই পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকে নতুন করে সাজাতে বাধ্য হচ্ছে তুরস্ক।

পুরোনো ট্যাঙ্কগুলিকেই উন্নয়নে বাধ্য হচ্ছে তুরস্ক

২০২০এর জুলাইতে ‘ডেইলি সাবাহ’ তুরস্কের ‘প্রেসিডেন্সি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ‘এসএসবি’এর বরাত দিয়ে জানায় যে, তুর্কি সেনাবাহিনীর সকল ‘এম৬০টি’ ট্যাংকগুলিকে ‘এম৬০টিএম’ পর্যায়ে উন্নীত করার কাজ শেষ হয়েছে। ‘এসএসবি’র প্রধান ইসমাঈল দেমির বলেন যে, তুরস্ক বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে নিজেদের ট্যাঙ্কগুলিকে ‘এপিএস’ দ্বারা সজ্জিত করার সক্ষমতা রাখে। ‘ফিরাত প্রজেক্ট’ নামের এই প্রকল্পের অধীনে ২০১৭ সালের মে মাসে তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘আসেলসান’কে এই ট্যাঙ্কের উন্নয়নের কাজ দেয়া হয়েছিল। দেমির বলেন যে, একসময় তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের অক্ষমতার কারণে ট্যাঙ্কগুলির উন্নয়নের জন্যে ইস্রাইলের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। তবে এক দশকে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বাইরের দেশের উপর নির্ভরশীলতা কমেছে। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কগুলির প্রতি হুমকির ব্যাপারে আগাম সতর্কতা পাবার প্রযুক্তি সংযোজিত করা ছাড়াও ট্যাঙ্ক ধ্বংসী অস্ত্রকে বোকা বানানো এবং ট্যাঙ্কের কামানের নিজস্ব টার্গেটিংএর জন্যে ইমেজিং সিস্টেমেরও উন্নয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ট্যাঙ্কগুলির স্বল্প থেকে মধ্যমপাল্লায় গোলাবর্ষণের সক্ষমতা বৃদ্ধি; স্বল্প থেকে দূরপাল্লায় ট্যাঙ্কের বেঁচে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি; এবং ট্যাঙ্কের মেইনটেন্যান্সের সুবিধা বৃদ্ধি করা। এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কাজগুলি তুরস্কের নিজস্ব ডিজাইনের ট্যাংক ‘আলতায়’এর জন্যে পথ উন্মোচন করেছে। সেনাবাহিনীর ‘এম৬০’ ট্যাংক ছাড়াও ‘লেপার্ড’ ট্যাঙ্কগুলিরও উন্ননের কাজ চলছে। ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, সিরিয়ার অভ্যন্তরে তুরস্কের ‘পিস স্প্রিং’, ‘অলিভ ব্রাঞ্চ’ এবং ‘ইউফ্রেতিস শিল্ড’ অপারেশনগুলির সময়ে উন্নয়ন করা ট্যাঙ্কগুলি বেশ ভালো ফলাফল দেখিয়েছে। কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘পিকেকে’ এবং আইসিসের বিরুদ্ধে চালিত অপারেশনের সময় ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে এই ট্যাঙ্কগুলি ভালোভাবে বেঁচে ছিল। এছাড়াও শহর অঞ্চলে ট্যাঙ্কগুলির অপারেশনসও ভালো হয়েছিল বলে বলা হয়। যেসব নতুন প্রযুক্তি ‘এম৬০টিএম’ ট্যাঙ্কে সংযুক্ত করা হয়েছে, তার মাঝে রয়েছে নতুন ‘লেজার ওয়ার্নিং সিস্টেম’; যার মাধ্যমে কোন লেজার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ট্যাঙ্ককে টার্গেট করলেই ট্যাঙ্কের ক্রুরা বুঝে যাবে যে তাকে টার্গেট করা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে ‘সার্প’ ‘স্ট্যাবিলাইজড রিমোট ওয়েপন সিস্টেম’; যা মূলত রিমোট কন্ট্রোল মেশিন গান; ‘টেলিস্কোপিক পেরিস্কোপ সিস্টেম’, যা ট্যাঙ্কের ক্রুদের ভেতর থেকে বাইরে সকল দিকে দেখার সুবিধা দেয়; ‘পুলাট’ ‘এপিএস’; যা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করবে। আরও রয়েছে ‘পজিশন এন্ড ওরিয়েন্টেশন ডিটেকশন সিস্টেম’, ‘ইয়ামগোজ’ ‘ক্লোজ ডিসট্যান্স সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম’, ‘ট্যাঙ্ক ড্রাইভার ভিশন সিস্টেম’, ‘প্রোটেকশন প্রাইমার’, ‘এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম’ এবং ‘অক্সিলারি পাওয়ার ইউনিট’।

‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১০ সালের এপ্রিল নাগাদ ইস্রাইল তুরস্কের জন্যে মোট ১’শ ৭০টা ‘এম৬০ এ১’ ট্যাংককে ‘এম৬০টি’ পর্যায়ে উন্নয়ন করে দিয়েছিল। ২০০২ সাল থেকে ইস্রাইলের কোম্পানি ‘ইস্রাইল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ’ প্রায় ৭’শ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এই কাজ করে। ১ হাজার হর্সপাওয়ারের নতুন ‘এমটিইউ’ ইঞ্জিন এবং ‘রেঙ্ক’এর ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্স যুক্ত করে ট্যাঙ্কগুলিকে সেবার আরও শক্তিশালী এবং দ্রুতগামী করা হয়েছিল। বর্মও উন্নত করা হয়েছিল। তবে ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন উভয়ই ছিল জার্মান প্রযুক্তির। রাতের বেলায় অপারেশন চালাবার জন্যে ‘থারমাল সাইট সিস্টেম’ প্রযুক্তিও যুক্ত করা হয়েছিল। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, তুর্কি ট্যাঙ্কগুলি সিরিয়ার অভ্যন্তরে অপারেশনে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতির মাঝে পড়েছিল বলেই জরুরি ভিত্তিতে ট্যাঙ্কগুলির উন্নয়নের কাজ হাতে নেয়া হয়। ২০১৭ সালে শুরু করা প্রকল্পে ৪০টা ‘এম৬০ এ৩’, ১’শ ২০টা ‘এম৬০ টি’ এবং ৪০টা ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাঙ্ককে উন্নয়নের কথা বলা হয়। তুর্কি সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন যে, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ট্যাঙ্কগুলির বেঁচে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকল্পের শুরুতে অনেকেই মনে করছিলেন যে, ট্যাঙ্কগুলিতে বিদেশী প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হবে।

তুর্কি সামরিক ওয়েবসাইট ‘ডিফেন্স তুর্ক’ বলছে যে, ২০০৫ সাল থেকে জার্মানি নিজেদের ব্যবহৃত সাড়ে ৩’শ ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাংক তুরস্ককে সরবরাহ করে। এই ট্যাংকগুলিকে উন্নয়নের কথা বিভিন্ন সময়ে বলা হলেও খুব একটা কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়নি। ২০১৯ সালে ‘লেপার্ড’ ট্যাঙ্কের উপর কিছু ‘এক্সপ্লোসিভ রিয়্যাকটিভ আর্মার’ বা ‘ইআরএ’এ সহ ছবি সোশাল মিডিয়ায় চলে আসে। ‘ইআরএ’ হলো এক ধরনের বর্ম, যা ট্যাঙ্কের গায়ের উপর বসিয়ে দেয়া হয় এবং কোন ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র এই ‘ইআরএ’এর উপর আঘাত করলে এটা নিজে বিস্ফোরিত হয়ে মূল ট্যাঙ্কের বর্মকে রক্ষা দেয়। ২০২০ সালে তুর্কি কোম্পানি ‘রকেটসান’এর প্রচারপত্রের মাঝে ‘ইআরএ’ একটা পণ্য হিসেবে তালিভুক্ত হলে বোঝা যায় যে, তারাই ‘লেপার্ড’ ট্যাংক নিয়ে কাজ করছিল। ২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা দেয়া হয় যে, তুরস্ক মোট ৪০টা ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাঙ্ককে ‘লেপার্ড ২এ৪ টি১’এ উন্নীত করবে; যার মাধ্যমে ট্যাঙ্কের রক্ষাকারী বর্ম উন্নত করা ছাড়াও ট্যাঙ্কের জন্যে নতুন টারেট দেয়া হচ্ছে। টারেটের প্রযুক্তি খুব সম্ভবতঃ কোরিয়ার ‘কে২’ ট্যাংক থেকে আসছে।

 
চীনাদের তৈরি 'টাইপ ১৫' বা 'ভিটি ৫' হাল্কা ট্যাংক; যার মূল উদ্দেশ্য হলো হিমালয়ের উচ্চতায় যুদ্ধ করা। কেউ কেউ বলছেন ট্যাঙ্কের দিন শেষ; আবার অনেকেই বলছেন ট্যাংকের ব্যবহার ভবিষ্যতেও চলবে। যুদ্ধক্ষেত্রের ধরণই বলে দিচ্ছে যে, বিশ্বের কোথায় ট্যাংক গুরুত্বপূর্ণ থাকবে, আর কোথায় অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। আর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বলে দিচ্ছে যে, কোন যুদ্ধক্ষেত্র কখন গরম হয়ে উঠতে পারে। অন্ততঃ ট্যাংক ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পগুলির দ্রুততাই বলে দিতে পারে কোন যুদ্ধক্ষেত্র কত দ্রুত উত্তপ্ত হতে চলেছে।

তুরস্কের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের ভবিষ্যৎ

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ক্যালেব লারসন ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, তুরস্কের ট্যাংক বাহিনীর একটা বড় অংশ হলো ১৯৫০এর দশকে ডিজাইন করা মার্কিন ‘এম৪৮’ এবং ‘এম৬০’ ট্যাংক। এর সাথে রয়েছে জার্মানির তৈরি ‘লেপার্ড ১’ এবং ‘লেপার্ড ২’ ট্যাংক; এগুলিও পুরোনো হয়ে গেছে। পুরোনো মার্কিন ট্যাঙ্কগুলি ২০১৬ সালে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন একটা ভালো করেনি। প্রায় ডজনখানেক ট্যাংক ধ্বংস হয়েছিল সেখানে। এমনকি তুরস্কের সেরা জার্মান ‘লেপার্ড ২এ৪’ ট্যাঙ্কও ধ্বংস হয়েছে সেখানে। এই ট্যাঙ্কগুলিকে বিভিন্নভাবে ব্যাপক উন্নয়নের মাঝ দিয়ে নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই হয়তো তুর্কিদের বুঝিয়েছে যে, পুরোনো ট্যাঙ্ক দিয়ে সামনের দিনগুলিতে সকল কাজ করা যাবে না; নতুন ট্যাংক লাগবে। সেকারণেই ‘আলতায়’ ট্যাংক প্রকল্পে হয়তো গতি এসেছে। তুর্কিরা জার্মান ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন গিয়ারবক্সের দিকেই তাকিয়ে ছিল; কারণ সেগুলি বিশ্বসেরা। ভারতের ‘অর্জুন’ ট্যাংক এবং ফ্রান্সের ‘লেকলার্ক’ ট্যাঙ্কেও ‘রেঙ্ক’এর ট্রান্সমিশন ব্যবহার করা হয়েছে। কোরিয়রাও মূলতঃ জার্মান প্রযুক্তিকেই অনুসরণ করে নিজেদের গিয়ারবক্স ডেভেলপ করেছে; যা নিয়ে এখনও তারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

তুর্কিরা নিশ্চিত যে, সামনের দিনগুলিতে তাদেরকে মধ্যপ্রাচ্যে এবং হয়তো ককেশাস বা আফ্রিকাতেও যুদ্ধে জড়াতে হবে। অন্ততঃ উসমানি খিলাফতের ইতিহাসকে পুঁজি করে স্বপ্ন দেখা তুরস্ক তেমনই একটা ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে লালন পালন করছে। এই আকাংক্ষা একদিকে যেমন তুরস্কের পশ্চিমা বন্ধুদের কাছে অগ্রহণযোগ্য, তেমনি তুরস্কের বর্তমান নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতার জন্যেও বড় চ্যালেঞ্জ। তুরস্ক এব্যাপারেও নিশ্চিত যে, ট্যাংক ছাড়া তার সেনা অভিযানগুলি সম্ভব নয়। তুরস্কের মতো আরও কিছু দেশ মনে করছে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের প্রয়োজন যথেষ্টই রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং কোরিয় উপদ্বীপে ট্যাঙ্কের কদর কমেনি বিন্দুমাত্র। নিজেদের বিশাল স্থলসীমানা রক্ষায় রুশরাও সামনের দিনগুলিতে ট্যাংক তৈরি করে যাবে। চীনারা হিমালয়ের উচ্চতায় সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যে ৭০ টনের ট্যাঙ্কের বদলে ৩৬ টনের ‘টাইপ ১৫’ বা ‘ভিটি ৫’ হাল্কা ট্যাংক ডেভেলপ করছে। ইন্দোনেশিয়াও জঙ্গলে যুদ্ধের জন্যেও তুরস্কের সহায়তায় ৩৫ টনের হাল্কা ‘কাপলান এমটি’ বা ‘হারিমাউ’ ট্যাংক ডেভেলপ করছে। এখানকার সেনাবাহিনীগুলি মনে করছে যে, সামনের দিনগুলিতে শতশত বা হাজার হাজার ট্যাঙ্কের সমন্বয়েই যুদ্ধ সংঘটিত হবে। অপরদিকে ইউরোপিয়রা ট্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে ফেলছে; তারা মনে করছে যে, ড্রোন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো নতুন প্রযুক্তিই যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে বেশি। মার্কিন ম্যারিন কোরও তাদের ট্যাংকগুলিকে ফেলে দিচ্ছে। তারা মনে করছে যে, চীনকে মোকাবিলায় প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপগুলিতে যুদ্ধ করতে তাদের ট্যাঙ্কের চাইতে বেশি দরকার হবে ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। যুদ্ধক্ষেত্রের ধরণই বলে দিচ্ছে যে, বিশ্বের কোথায় ট্যাংক গুরুত্বপূর্ণ থাকবে, আর কোথায় অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। আর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বলে দিচ্ছে যে, কোন যুদ্ধক্ষেত্র কখন গরম হয়ে উঠতে পারে। অন্ততঃ ট্যাংক ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পগুলির দ্রুততাই বলে দিতে পারে কোন যুদ্ধক্ষেত্র কত দ্রুত উত্তপ্ত হতে চলেছে।

Monday 15 November 2021

ইরানের লক্ষ্য আসলে কি?

১৫ই নভেম্বর ২০২১

ইরানের 'আইআরজিসি'র ছোট ছোট বোটগুলি মহড়া দিচ্ছে। ইরানের কৌশলের মাঝে রয়েছে মাইন, জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং শতশত ছোট বোট ব্যবহারের মাধ্যমে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে ফেলা; যাতে বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। ইরানের ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’র উদ্দেশ্য হলো একটা ‘গ্রে জোন’ তৈরি করা; যা যুদ্ধ এবং শান্তির মাঝামাঝি থাকবে। এতে ভীতি প্রদর্শন এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অগ্রগামী অবস্থান নেয়া হবে; এবং একইসাথে দ্বন্দ্বকে পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয়া থেকে বিরত রাখা হবে। শুধু তাই নয়, নিশ্চিত করা হবে যাতে নিজেদের উপর বড় কোন প্রতিশোধমূলক হামলা না আসে।

 
ইরানের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য অর্জনে ইরান কি কি কর্মকান্ড চালাচ্ছে, তা নিয়ে ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মাঝে মোটামুটি ঐকমত্য থাকলেও লক্ষ্যটা আসলে কি, সেব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে। মার্কিন চিন্তাবিদেরা ইরানের লক্ষ্যকে আগ্রাসী মনে করলেও ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা সেটাকে ডিটারেন্ট হিসেবে দেখছেন। অর্থাৎ মার্কিনীরা যেখানে আলোচনা করছেন যে, ইরানের আগ্রাসী কর্মকান্ড কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব ক্ষুন্ন করছে, সেখানে ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা বলছেন যে, মার্কিন প্রভাব থেকে মুক্ত হতে ইরান তার ডিটারেন্ট তৈরিতে বাধ্য হচ্ছে। মূলতঃ ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখতে ইচ্ছুক নয় বলেই দুই ঘরানার চিন্তাবিদদের মাঝে মতপার্থক্য থেকে যাচ্ছে।

ইরান ‘ফরওয়ার্ড ডিফেন্স’ কৌশল কি আগ্রাসী?

ইরানের আঞ্চলিক কৌশল নির্ধারণের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে নিয়ে ‘মিডলইস্ট স্টাডিজ এসোসিয়েসন’এর এক আলোচনায় কথা বলেছেন মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর আমর ইয়োসেফ। তিনি বলছেন যে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টাটা আঞ্চলিক সুযোগের কারণে যতটা হয়েছে, তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণেও ততটা হয়েছে। তিনি ইরানের রাজনীতিতে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘ইসলামিক রিপাবলিকান গার্ড কোর’ বা ‘আইআরজিসি’র সাথে পুনর্গঠনকামী রাজনৈতিক গ্রুপের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেন। তিনি বলছেন যে, ২০০৫ সাল থেকে মার্কিন হুমকি মোকাবিলায় ইরান ‘মোজাইক ডিফেন্স’এর কৌশল অবলম্বন করেছে। এই কৌশলের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত এবং অপ্রচলিত বাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানের মূল ভূখন্ডে হামলা করাটা কঠিন করে ফেলা। তবে আরব বসন্ত শুরুর পর ২০১২ সাল থেকে ইরান তার কৌশলের মাঝে আক্রমণাত্মক অংশটা যুক্ত করেছে। ‘ফরওয়ার্ড ডিফেন্স’ নামে পরিচিত এই কৌশলে বলা হয় যে, ইরানের উচিৎ ইরানের সীমানার বাইরে যুদ্ধ করা, যাতে ইরানের অভ্যন্তর নিরাপদ থাকে। ‘হাইব্রিড’ ধরনের এই কৌশলে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক প্রক্সি গ্রুপ, ড্রোন, নৌ গেরিলা এবং সাইবার যুদ্ধ। এই কৌশলের মূলে প্রথমতঃ রয়েছে গেরিলা, সন্ত্রাস এবং স্পেশাল অপারেশনের মাধ্যমে চালিত অপ্রচলিত যুদ্ধ এবং সাথে রয়েছে ইন্টেলিজেন্স অপারেশন, তথ্য ও সাইবার যুদ্ধ। আর দ্বিতীয়তঃ এতে রয়েছে আক্রমণাত্মক অংশ, যার স্তম্ভ হলো নিজেদের দুর্বলতা। এভাবে চালিত ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’র উদ্দেশ্য হলো একটা ‘গ্রে জোন’ তৈরি করা; যা যুদ্ধ এবং শান্তির মাঝামাঝি থাকবে। এতে ভীতি প্রদর্শন এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অগ্রগামী অবস্থান নেয়া হবে; এবং একইসাথে দ্বন্দ্বকে পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয়া থেকে বিরত রাখা হবে। শুধু তাই নয়, নিশ্চিত করা হবে যাতে নিজেদের উপর বড় কোন প্রতিশোধমূলক হামলা না আসে। এই কৌশল বাস্তবায়নে সবচাইতে বড় ভূমিকা হলো ‘আইআরজিসি’র। ইরানের জন্যে সিরিয়া এবং ইরাকে আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবার সমান্তরালেই ইরানের রাজনীতিতে ‘আইআরজিসি’র ক্ষমতা বেড়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আয়াতুল্লাহ খামেনি ‘আইআরজিসি’র নেতাদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন যে, নিজেদের সীমানার মাঝে সীমাবদ্ধ থেকে সীমানার প্রতি হুমকিকে অবহেলা করা যাবে না। ‘আইআরজিসি’র দায়িত্ব হলো সুদূরপ্রসারী আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন; যা হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’।

 
ইরানের প্রযুক্তি সহায়তায় হিযবুল্লাহর নিজস্ব নির্মিত রকেট। এই রকেটগুলি কি ইরানের আগ্রাসী নীতির অংশ, বাকি ডিটারেন্স, তা নিয়ে পশ্চিমাদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। ব্রিটিশরা বলছে যে, শত্রুদেরকে মোকাবিলায় ইরান শক্তিশালী ডিটারেন্স তৈরি করেছে। এই ডিটারেন্সের অংশ হলো ইরান এবং লেবাননে অবস্থিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট; যেগুলি যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা, আরব দেশগুলির অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং ইস্রাইলের শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে।

ইরানের কৌশল কি শুধুই ডিটারেন্ট?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের জাতিরাষ্ট্রগুলির সৃষ্টি যেহেতু ব্রিটেনের হাতেই হয়েছে, তাই ব্রিটিশ চিন্তাবিদদের মধ্যপ্রাচ্যের ধারণা বাকিদের থেকে আলাদা। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ইরানের কৌশল মূলতঃ ডিটারেন্স। ইরানের অভ্যন্তরে দু’টা গ্রুপ রয়েছে, যার একপক্ষ মূলতঃ জাতীয়তাবাদী; যাদের লক্ষ্য হলো ইরানকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দেখা। অপরপক্ষ হলো বিপ্লবী; যারা চাইছে ইরানকে শিয়া মুসলিমদের নেতৃত্বে দেখতে। এই দু'টা লক্ষ্যই বহিঃশত্রুর হুমকির মাঝে রয়েছে; কারণ ইরান মনে করে যে, এই হুমকির মাধ্যমে ইরানের স্বাধীনভাবে কাজ করাকে বাধা দেয়া হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইরানের মূল লক্ষ্য হলো বিপ্লব পরবর্তী ইরানের সংবিধান এবং তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইরানের সামনে প্রধান বাধা হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রাইল। এই শত্রুদেরকে মোকাবিলায় ইরান শক্তিশালী ডিটারেন্স তৈরি করেছে। এই ডিটারেন্সের অংশ হলো ইরান এবং লেবাননে অবস্থিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট; যেগুলি যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা, আরব দেশগুলির অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং ইস্রাইলের শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। এছাড়াও ইরাকে অবস্থিত ইরানের মিলিশিয়ারা ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির উপর হামলা করবে; এবং ‘আইআরজিসি’র নৌবাহিনী হরমুজ প্রণালীতে মার্কিন নৌশক্তির অবাধে চলাচলকে বিঘ্নিত করবে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কিনীরা আঞ্চলিকভাবে নিজেদের সামরিক কর্মকান্ডকে চালিয়ে নিতে পারবে না। ইরান মোটামুটি নিশ্চিত যে, এই কৌশলের ফলে ইরানের মূল ভূখন্ডে স্থলসেনার হামলার সম্ভাবনা তেমন নেই। তবে সম্ভাবনা রয়েছে বড় ধরনের বিমান হামলার; কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনা বা ভৌগোলিক অঞ্চল দখল করার সম্ভাবনাও রয়েছে; এছাড়াও ইরানের অভ্যন্তরে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা হতে পারে। ইরান সরকার মনে করে যে, সে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সামাল দিতে সক্ষম। একইসময়ের মাঝে তারা আঞ্চলিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি আরোপ করে জয়পরাজয় অনিশ্চিত করে ফেলতে পারবে। ফলশ্রুতিতে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হবে প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুরা। এই শক্তিশালী ডিটারেন্ট সক্ষমতা রেখেই ইরান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্রাইল, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে লেবানন এবং ইয়েমেনের মতো আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে ব্যস্ত রেখে তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে সিরিয়া এবং ইরাকে প্রভাব ধরে রাখাটা ইরান নিজস্ব নিরাপত্তার একটা বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখে; যেখানে অবস্থান ধরে রাখতে ইরানকে নিজস্ব সম্পদ খরচ করতে হচ্ছে।

আক্রমণাত্মক, নাকি প্রতিরক্ষামূলক কৌশল?

ইরানি চিন্তাবিদেরাও প্রায় একইভাবে চিন্তা করছেন। তেহরানের ‘আলামেহ তাবাতাবাঈ ইউনিভার্সিটি’র এসিসট্যান্ট প্রফেসর হাদি আযিলি এবং ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর রিসার্স ফেলো মাহসা রুহি ‘আইআইএসএস’এর এক লেখায় বলছেন যে, পশ্চিমারা কেউ কেউ মনে করেন যে, ইরানের কৌশল মূলতঃ আক্রমণাত্মক; বাকিরা মনে করেন যে, আসলে তা প্রতিরক্ষামূলক। তারা বলেন যে, নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যে ইরানের পারসিক সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার কথা পশ্চিমারা যখন বলেন, সেটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি ইরানের কৌশল পুরোপুরি প্রতিরক্ষামূলক, সেটাও পুরোপুরি সঠিক নয়। তাদের কথায়, ইরানের কৌশলের মাঝে রয়েছে ‘ফরওয়ার্ড ডিফেন্স’, তথাপি এটা মূলতঃ ডিটারেন্ট ভিত্তিক বা প্রতিরক্ষামূলক। নিজেদের প্রচলিত সামরিক সক্ষমতার মারাত্মক ঘাটতি মোকাবিলা করতে গিয়েই ইরান অপ্রচলিত পদ্ধতির দিকে ধাবিত হয়েছে; যার মাঝে রয়েছে রাষ্ট্রের বাইরেও বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রুপের সাথে জোট বাঁধা। এই পদ্ধতিগুলিকেই ইরান নিজেদের রক্ষায় ডিটারেন্ট হিসেবে দেখেছে। মূল উদ্দেশ্য হলো ইরানের উপর কেউ হামলা করার চিন্তা করলে হামলাকারীর খরচ অত্যধিক বৃদ্ধি করে দেয়া; যার ফলশ্রুতিতে হামলার পরিকল্পনাকারী সহজে হামলা করবে না। এধরনের চিন্তার জন্ম হয়েছে ১৯৭৯এর বিপ্লবের পর থেকে। বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ইরানের শাহএর সরকার যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছের বন্ধু রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু বিপ্লবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৮০ সালে ইরাকের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং আরব দেশগুলি ইরাকের পক্ষ নেয়। কারণ ইরানের আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি সরকারের বিপ্লবের মাধ্যমে শিয়া ধর্মীয় চিন্তাগুলি আঞ্চলিকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার কথাগুলি আরব সরকারগুলির জন্যে হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। যুদ্ধের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরাককে ‘স্কাড বি’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে; যা সাদ্দাম হোসেনের সরকার ইরানের শহরগুলির উপর ব্যবহার করে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হবার এই বিভীষিকাই পরবর্তীতে ইরানকে একইধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে উৎসাহিত করে। তবে ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে ইরান পরবর্তীতে নিজস্ব সামরিক শিল্প তৈরির দিকে মনোযোগী হয়। তবে নতুন সামরিক প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপে ইরানকে সেসব অস্ত্রই ডেভেলপ করতে হয়েছে, যেগুলি স্বল্প খরচে বেশি কৌশলগত সুবিধা দেবে। ইরানের মূল সামরিক লক্ষ্য হলো ‘এন্টি একসেস, এরিয়া ডিনাইয়াল’ বা ‘এটুএডি’ কৌশল বাস্তবায়ন করা। এই কৌশলের মাধ্যমে ইরান আঞ্চলিকভাবে কোন আগ্রাসী শক্তির সামরিক অবস্থান নেয়া কঠিন করে ফেলবে; যাতে করে সেই শক্তির পক্ষে ইরানের মূল ভূখন্ডে হামলা করাটা কঠিন হয়ে যায়। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এই কৌশলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়াও কৌশলের মাঝে রয়েছে মাইন, জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং শতশত ছোট বোট ব্যবহারের মাধ্যমে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে ফেলা; যাতে বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। তবে আযিলি এবং রুহি বলছেন যে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পারমাণবিক অস্ত্র বহণ করার জন্যে তৈরি করা হয়নি কখনোই; এবং তারা মনে করেন না যে, এই কৌশল পরিবর্তিত হবার আদৌ কোন সম্ভাবনা রয়েছে। তারা বলছেন যে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব কমিয়ে আনলেই যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি ইরানের সরকারকে দুর্বল করা বা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। অপরদিকে আঞ্চলিক অবস্থান ধরে রাখতে পারলে তা ইরানের ডিটারেন্টকে শক্তিশালী করছে। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনে প্রক্সি মিলিশিয়া তৈরি করার মাধ্যমে ইরান তার ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’ বৃদ্ধি করেছে; যা কিনা ইরানের মূল ভূখন্ডের উপর হুমকি কমিয়েছে।

 
ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মানচিত্র। ইরানের মূল সামরিক লক্ষ্য হলো ‘এন্টি একসেস, এরিয়া ডিনাইয়াল’ বা ‘এটুএডি’ কৌশল বাস্তবায়ন করা। এই কৌশলের মাধ্যমে ইরান আঞ্চলিকভাবে কোন আগ্রাসী শক্তির সামরিক অবস্থান নেয়া কঠিন করে ফেলবে; যাতে করে সেই শক্তির পক্ষে ইরানের মূল ভূখন্ডে হামলা করাটা কঠিন হয়ে যায়। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এই কৌশলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

‘আলসার স্ট্র্যাটেজি’

‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় মার্কিন ‘নেভাল ওয়ার কলেজ’এর ‘জে সি উইলি চেয়ার অব ম্যারিটাইম স্ট্র্যাটেজি’ জেমস হমস বলছেন যে, ইরানের কৌশল হলো ‘আলসার’এর মতো। স্বল্প সক্ষমতার কারণেই ইরান ‘ওয়ার বাই কনটিনজেন্ট’ কৌশল অবলম্বণ করছে; যা দু’শ বছর আগে ব্রিটেন করেছিল ন্যাপোলিয়নের অধীনে পুরো ইউরোপের বিরুদ্ধে। এই কৌশলের মাধ্যমে ব্রিটেন তার প্রধানতম লক্ষ্যগুলি অর্জন করার পর তার হাতে যতটুকু সম্পদ রয়েছে, সেই সম্পদটুকুই ব্যয় করেছে ন্যাপোলিয়নের বাহিনীর সাথে সরাসরি স্থলযুদ্ধে। এই যুদ্ধটা ব্রিটেন করেছিল ফ্রান্সের অধীনে থাকা স্পেনের মাটিতে। স্বল্প সম্পদ ব্যবহার করেই ব্রিটেন স্প্যানিশ জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ন্যাপোলিয়নের কয়েক লাখ সেনার বিশাল সেনাবাহিনীকে ১৮০৮ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের জন্যে স্পেনে আটকে রেখেছিল। এই বাহিনী বাকি ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিল; যা পরবর্তীতে ন্যাপোলিয়নের পক্ষে ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা কঠিন করে ফেলেছিল। ন্যাপোলিয়ন নিজেই স্পেনের অবস্থাকে “স্প্যানিশ আলসার” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। হমস বলছেন যে, ইরানও ব্রিটিশদের কৌশল অবলম্বণ করে মার্কিন নৌবাহিনীর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে মধ্যপ্রাচ্য টহল দিতে বাধ্য করছে; যখন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই জাহাজগুলিকে বিশ্বের অন্য স্থানগুলিতে মোতায়েন রাখতে। তিনি হিসেব করে দেখাচ্ছেন যে, মার্কিন নৌবাহিনীর মোট ১১টা বড় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। খুব ভালো কোন দিনে হয়তো এগুলির চারটাকে সমুদ্রে পাওয়া যাবে অপারেশনের জন্যে; বাকিগুলি হয় মেইনটেন্যাস, বা ওভারহলিংএ রয়েছে, অথবা মিশনের জন্যে রেডি হচ্ছে, অথবা সবেমাত্র লম্বা মিশন শেষ করে বিশ্রামে যাচ্ছে। এছাড়াও ছোট আকারের উভচর বিমানবাহী জাহাজ রয়েছে ৮টা; যার মাঝে সর্বোচ্চ ৩টা অপারেশনে থাকে। এর মাঝে একটা জাহাজ আবার কিছুদিন আগেই আগুনে ধ্বংস হয়ে গেছে। দুই ধরনের মিলিয়ে মোট সাতটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ যেকোন সময়ে অপারেশনের জন্যে পাওয়া যাবে; যার দু’টা মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। অর্থাৎ মার্কিন নৌবাহিনীর শক্তির মূলে থাকা ৭টা জাহাজের মাঝে ২টা মোতায়েন থাকছে মধ্যপ্রাচ্যে; বাকি ৫টা দিয়ে বাকি বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। এই সমীকরণটা বর্তমানে শুধুমাত্র ইরানের কারণেই বাস্তবতা হয়ে রয়েছে মার্কিনীদের জন্যে।

মার্কিন বনাম ব্রিটিশ চিন্তার পার্থক্য

ইরানের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণেই পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মাঝে মত পার্থক্য রয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে মার্কিনীরা ব্রিটিশ প্রভাবের জায়গাগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার যে চেষ্টাটা করেছে, তা আটলান্টিকের দুই পাড়ের দুই শক্তির মাঝে টানাপোড়েন তৈরি করেছে। যদিও ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন একপক্ষে থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করেছে, তথাপি দু’শ বছর ধরে নিজের শাসনে থাকা বিশ্বব্যবস্থাকে মার্কিনীদের হাতে ছেড়ে দিতে ব্রিটেন প্রস্তুত ছিল না। ব্রিটেন নিশ্চিত করেছে যে, বিশ্বব্যাপী অনেকগুলি দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘ওয়ারশ’ জোটে যেমন যোগ দেবে না, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা জোটেরও বাইরে থাকবে। ‘নিরপেক্ষ’ এই দেশগুলির নিয়ন্ত্রণের জন্যে ঠান্ডা যুদ্ধের দুই মেরুর জোটের মাঝে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে। এখানেই ছিল ব্রিটেনের প্রভাব ধরে রাখার রাজনৈতিক সক্ষমতা। এই দেশগুলিকে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে যাওয়া থেকে বিরত রাখার বিনিময়ে ব্রিটেন বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে। এখন একুশ শতকে বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলির সামনে যখন মার্কিন এবং চীনা ক্যাম্পে যোগদান করার অপশন দেয়া হচ্ছে, তখন ব্রিটেন নিশ্চিত করতে চাইছে যে কিছু দেশ কোন পক্ষেই থাকবে না। অর্থাৎ ঠান্ডা যুদ্ধের মতোই কিছু দেশ কোন জোটেই যোগ দেবে না। এই দেশগুলির ‘নিরপেক্ষতা’ একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদকে বিভাজিত করে ওয়াশিংটনের জন্যে বিরক্তির কারণ হবে, অন্যদিকে তা লন্ডনের জন্যে ভূরাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখার হাতিয়ার হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত মার্কিনীদের মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান ধরে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকবে, ততদিন ব্রিটেন মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে। ‘রুসি’র জ্যাক ওয়াটলিং যখন বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে একটা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মেনে নিয়ে আলোচনায় এগুনোই পশ্চিমাদের জন্যে শ্রেয়, তখন তা বহুদিনের ব্রিটিশ চিন্তাটাকেই প্রতিফলিত করে। জেমস হমস ইরানের কৌশলকে যথার্থই ‘আলসার স্ট্র্যাটেজি’ বলেছেন। আর ব্রিটিশরা চায় পরিবর্তিত বিশ্ব ভূরাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের এই ‘আলসার’ যেন মার্কিনীদের বৈশ্বিক নীতিকে প্রভাবিত করে যেতে থাকে।

Sunday 14 November 2021

সাইবার যুদ্ধে মার্কিনীরা কেন আক্রমণে যেতে চাইছে?

১৪ই নভেম্বর ২০২১

মার্কিন 'কলোনিয়াল পাইপলাইন' সিস্টেম; যা যুক্তরাষ্ট্রের পুরো পূর্ব উপকূলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ করে। গত মে মাসে হ্যাকাররা এর নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা যে নিশ্ছিদ্র নয়, তা পেন্টাগনের ‘জিরো ট্রাস্ট’ নীতিই বলে দিচ্ছে। একইসাথে মার্কিন সাইবার কমান্ডের প্রতিপক্ষের নেটওয়ার্কের ভিতর অবস্থান করা এবং নিজেদের নেটওয়ার্কে হামলার আগেই হামলা ঠেকিয়ে দেয়ার নীতির দিকে ধাবিত হওয়া বলে দিচ্ছে যে, প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং আক্রমণাত্মক সাইবার ‘ডিটারেন্ট’ তৈরির দিকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেশি। 


গত মে মাসে রুশ হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘কলোনিয়াল পাইপলাইন’ নেটওয়ার্কে ‘র‍্যানসমওয়্যার’ দিয়ে হামলা করে। এর ফলশ্রুতিতে বিশাল এলাকায় জ্বালানি তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং তেলের মূল্য আকাশচুম্বি হয়। শেষ পর্যন্ত ৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে হ্যাকারদের কাছ থেকে নেটওয়ার্ক উদ্ধার হয়। ‘কলোনিয়াল পাইপলাইন’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম পরিশোধিত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন; যা টেক্সাসের হিউস্টন থেকে শুরু হয়ে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৯ হাজার কিঃমিঃ লম্বা এই পাইপলাইন দিয়ে দৈনিক গড়ে প্রায় ১০ কোটি গ্যালন পরিশোধিত তেল সরবরাহ হয়। গত অক্টোবরে মার্কিন বিমান বাহিনী সচিব ফ্রাঙ্ক কেন্ডাল ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ট্রান্সপোর্টেশন এসোসিয়েশন’এর এক অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে এই ঘটনার ব্যাপারে বলেন যে, এই পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে একটামাত্র পাসওয়ার্ডের জন্যে। তিনি বলেন যে, এটা আইসবার্গের চূড়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্র তার তথ্যকে রক্ষা করতে না পারলে শত্রুরা তথ্য চুরি করবে বা মার্কিন সামরিক অপারেশন বিঘ্নিত করবে। একই অনুষ্ঠানে বিমান বাহিনীর জেনারেল জ্যাকিলিন ভ্যান ওভোস্ট বলেন যে, হ্যাকাররা যদি জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হয়, তাহলে ধারণা করা যায় যে, লেগে থাকলে পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা কি করতে সক্ষম হবে। সামরিক ম্যাগাজিন ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’ বলছে যে, এই সাইবার হামলা সামরিক স্থাপনার উপর না হলেও বাণিজ্যিক সংস্থার সাইবার নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই কোম্পানিগুলি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের লজিস্টিকস মেরুদন্ডের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মার্কিন সামরিক বাহিনীর ‘ট্রান্সপোর্ট কমান্ড’ বেসামরিক সংস্থার কাছ থেকে জ্বালানি তেল নেয়া ছাড়াও বিমান পরিবহণ, নৌ পরিবহণ এবং অন্যান্য সার্ভিসের জন্যে নির্ভরশীল। ফ্রাঙ্ক কেন্ডাল বলেন যে, পেন্টাগনের এই বাণিজ্যিক সহযোগীদের কর্মকান্ড বিঘ্নিত হলে যুদ্ধের সময় মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন যে, ট্রাক ও লজিস্টিকস কোম্পানিগুলির অর্ধেকেরও চিফ ইনফর্মেশন সিকিউরিটি অফিসার নেই। শান্তির সময়ে এই সমস্যাগুলি হয়তো সমাধান করা যাবে; কিন্তু যুদ্ধের সময়ে জয় পরাজয়ের সিদ্ধান্ত এখানেই হয়ে যাবে।

পেন্টাগনের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে ‘ডিরেক্টরেট অব অপারেশনাল টেস্ট এন্ড ইভ্যালুয়েশন’ বা ‘ডিওটিএন্ডই’। এর কাজ হলো সামরিক প্রযুক্তিগুলির সাইবার নিরাপত্তা পরীক্ষা করা। এই কাজের জন্যে তাদের সাথে কাজ করে গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’র ‘রেড টিম’ বা সার্টিফাইড হ্যাকার গ্রুপ। তবে সংস্থার প্রধান নিকোলাস গুয়েরটিন বলছেন যে, এই গ্রুপটা এখন সাধ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে; কারণ তাদের সক্ষমতা সীমিত। তিনি অক্টোবর মাসে মার্কিন সিনেটের কাছে এক লিখিত বক্তব্যে বলেন যে, ‘রেড টিম’এর আরও সক্ষমতা দরকার এবং তাদের সহায়তার জন্যে আরও অটোমেশনও প্রয়োজন।

অক্টোবর মাসে ‘টেকনেট সাইবার’এর এক অনুষ্ঠানে মার্কিন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ লেঃ জেনারেল জন মরিসন বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে যারা সাইবার নিরাপত্তা দিচ্ছে, তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন যে, এই মুহুর্তে বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থাপনার নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে; যেগুলির মূলতঃ আলাদা দায়িত্ব, মানদন্ড এবং কর্মকান্ড রয়েছে। এগুলি একটা আরেকটা থেকে ভিন্ন। যখন কোন সাইবার হামলা হয়, তখন মার্কিন সাইবার কমান্ডের নিরাপত্তা দল সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু এই দলের সক্ষমতাও সীমিত। কাজেই এই ছোট নেটওয়ার্কগুলির প্রাথমিকভাবে নিজস্ব নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টাটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা করা সম্ভব হবে যদি সকল নেটওয়ার্ক একই রকমের মানদন্ড অনুসরণ করে। তিনি বলেন যে, সেনাবাহিনী চায় তাদের ব্রিগেড কমব্যাট টিমগুলি যুদ্ধ করুক; তথ্য ও সাইবার বিশ্লেষণে সময় পার না করুক। এই কাজটা ডিভিশন লেভেলে করা অপেক্ষাকৃত সহজ; কারণ তাদের হাতে কিছুটা সময় থাকবে। আবার আঞ্চলিক সাইবার সেন্টারেও করা সহজ; কারণ তাদের হাতে আরও বেশি সময় থাকবে। জেনারেল মরিসন বলেন যে, পেন্টাগনের তথ্য নেটওয়ার্ক রক্ষায় সেনাবাহিনী জনবল নিয়োগ দিচ্ছে। মূলতঃ ছোট নেটওয়ার্কগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধিই এর লক্ষ্য।
 
‘জেনসাইবার’ নামের প্রকল্পের অধীনে ৪৬টা রাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পুয়ের্তো রিকোতে মোট ১’শ ৪৬টা ক্যাম্পে কাজ চলছে। লুবার বলেন যে, ‘এনএসএ’র পরবর্তী জেনারেশনের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তৈরিতে তারা স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং অধ্যাপকদের কাজে লাগাচ্ছেন। যেখানে যথেষ্ট পারশ্রমিক না দিতে পারার কারণে মার্কিন সরকার সেরা মেধাগুলিকে নিজেদের অধীনে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বেসরকারি সেক্টরের ব্যবসায়িক লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করেই যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে তার কাজ গুছিয়ে নেবে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি এবং বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়ন না করে পেন্টাগন এক চুলও এগুতে পারছে না; যা মার্কিন সামরিক শক্তির প্রধানতম দুর্বলতা হয়ে দেখা দিচ্ছে। 


সাইবার নিরাপত্তা এখন মার্কিনীদের বড় সমস্যা

প্রতিরক্ষা মিডিয়া ‘সিফোরআইএসআরনেট’এর ‘সাইবারকন’ অনলাইন প্যানেল আলোচনায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ বা ‘এনএসএ’র সাইবার নিরাপত্তা ডিরেক্টরেটের ডেপুটি ডিরেক্টর ডেভিড লুবার মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা কর্মকান্ডের কিছু পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দেন। ‘এনএসএ’ পৃথিবীব্যাপী ইলেকট্রনিক সিগনালসএর উপর নজরদারি করে। প্রায় একই ধরনের কাজ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও করে থাকে। এই দুই তথ্যের মাঝে সমন্বয় করতে ‘এনএসএ’ ‘সাইবারসিকিউরিটি কল্যাবরেশন সেন্টার’ তৈরি করেছে, যার সহায়তায় সরকারি এবং বেসরকারি তথ্য বিশ্লেষনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাচ্ছে তারা। গত দুই বছরের মাঝে তারা ৫০টারও বেশি সাইবার হুমকির আগাম পূর্বাভাস দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা রুশ এবং চীনা হ্যাকারদের গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্কে ঢোকার পদ্ধতি এবং ‘ম্যালওয়্যার’ সম্পর্কেও আগাম ধারণা দিয়েছে। একইসাথে লুবার বলেন যে, ইরান বা উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা অর্থের জন্যে যে কাজটা করে, সেটাও একটা হুমকি। মার্কিন কোস্ট গার্ডের সাইবার কমান্ডের প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাইক রায়ান বলেন যে, তাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ হলো সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষ জনবল রিক্রুট করা। তারা যথেষ্ট পারিশ্রমিক তাদের দিতে পারেন না। তবে অনেকেই নিঃস্বার্থেই তাদের সাথে কাজ করেন। তবুও আর্থিক দিকটা চিন্তা করেই কোস্ট গার্ড বোনাসের ব্যবস্থা করছে। ‘এনএসএ’র ডেভিড লুবার রিক্রুটের ব্যাপারে কিছু কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করেন। তারা ৩’শ ৪০টা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে পড়ার জন্যে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করছে। প্রত্যেক গ্রীষ্মে প্রায় ৩’শ ছাত্রকে ‘এনএসএ’ ইন্টার্নিশিপের অধীনে ১২ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এদের মাঝে ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ ছাত্র শেষ পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েশনের পর সংস্থায় চাকুরি নেয়। এছাড়াও ‘এনএসএ’ কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রদেরকে ‘সামার ক্যাম্প’এর মাধ্যমে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত বিষয়ে অনুপ্রাণিত করছে; একইসাথে তাদেরকে সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ‘জেনসাইবার’ নামের এই প্রকল্পের অধীনে ৪৬টা রাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পুয়ের্তো রিকোতে মোট ১’শ ৪৬টা ক্যাম্পে কাজ চলছে। লুবার বলেন যে, ‘এনএসএ’র পরবর্তী জেনারেশনের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তৈরিতে তারা স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং অধ্যাপকদের কাজে লাগাচ্ছেন।

সাইবার আক্রমণেও ধার দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

১০ই নভেম্বর ‘সাইবারকন’ অনুষ্ঠানে কথা বলেন মার্কিন সাইবার কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার লেঃ জেনারেল চার্লস মুর জুনিয়র। তিনি মার্কিন সামরিক সাইবার সক্ষমতার একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা ১৪টা অতিরিক্ত সাইবার কমব্যাট টিম তৈরি করছেন; যেগুলি আগামী ১৮ মাসের মাঝে কর্মক্ষম হবে। এর মাঝে অর্ধেকের কাজই হবে মহাকাশের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তিনি একইসাথে মার্কিন সাইবার কমান্ডের আক্রমণাত্মক মিশনগুলির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, তারা প্রতিপক্ষের নেটওয়ার্কে সর্বদাই তাদের অবস্থান রাখছেন এবং এতে প্রতিপক্ষ কিভাবে চিন্তা করছে এবং তারা কি কি সাইবার অস্ত্র ডেভেলপ করছে, সেব্যাপারে আগে থেকেই জানতে পারছেন এবং নিজেদের নেটওয়ার্ককে প্রস্তুত করতে পারছেন। কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষের প্রত্যুত্তর দেখেও তারা বুঝতে পারছেন যে, তারা কতটুকু সফল। প্রতিপক্ষের মাঝে উত্তর কোরিয়ার সাইবার আক্রমণ নিয়ে কথা বলেন জেনারেল মুর। তিনি বলেন যে, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা অন্যান্য রাষ্ট্রের হ্যাকার থেকে আলাদা। তারা মূলতঃ আয় করার জন্যে হ্যাকিং করে; রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করতে চায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা নষ্ট করার পিছনে আগ্রহী নয়।

মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা সাইবার নিরাপত্তায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী বলে বলছেন। অক্টোবরে পেন্টাগনের হবু চিফ ইনফর্মেশন অফিসার জন শেরমান সিনেট কমিটির সামনে বলেন যে, তাইওয়ান নিয়ে যদি কোন যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তাহলে যেকোন সম্ভাব্য চীনা সাইবার হামলা প্রতিরোধে পেন্টাগনের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি বলেন যে, তারা চীনাদেরকে পিছু হটে কর্মকান্ড চালাতে বাধ্য করবেন। ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’ বলছে যে, শেরমানের কথাগুলি সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন কৌশল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মার্কিন সাইবার কমান্ডের জেনারেল পল নাকাসোনি গত জুন মাসে বলেন যে, তারা ‘ডিফেন্ড ফরওয়ার্ড’ কৌশলে যাচ্ছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেটওয়ার্ক পর্যন্ত পৌঁছাবার আগেই তারা সাইবার হামলা প্রতিরোধ করবেন। এই বিবৃতিগুলি আসছে এমন সময়ে যখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, চীনাদের তুলনায় মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা যথেষ্ট কিনা। মার্কিন সেনাবাহিনীর চিফ ইনফর্মেশন অফিসার রাজ লেয়ার মার্কিনীদের তুলনায় চীনারা বেশি সক্ষম, এই কথাটাকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে আখ্যা দেন। শেরমান একইসাথে চীনা ইলেকট্রনিক্সের ব্যাপারেও তার সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, তার ধারণায় যেকোন চীনা হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যারকে মার্কিন সিস্টেমের ধারেকাছেও আসতে দেয়া ঠিক হবে না।
 
সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি এখন মার্কিনীদের বড় সমস্যা। মার্কিন সংস্থা ‘ডিওটিএন্ডই’এর কাজ হলো সামরিক প্রযুক্তিগুলির সাইবার নিরাপত্তা পরীক্ষা করা। এই কাজের জন্যে তাদের সাথে কাজ করে গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’র ‘রেড টিম’ বা সার্টিফাইড হ্যাকার গ্রুপ। তবে সংস্থার প্রধান নিকোলাস গুয়েরটিন বলছেন যে, এই গ্রুপটা এখন সাধ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে; কারণ তাদের সক্ষমতা সীমিত। তদুপরি যুদ্ধ করতে গেলে বন্ধু দেশগুলির সাইবার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু নিজেদের সামরিক বাহিনীর নেটওয়ার্কগুলির মাঝে সমন্বয়ই যখন মার্কিনীদের জন্যে কঠিন হচ্ছে, তখন মার্কিন বন্ধু দেশগুলির নীতি পরিবর্তন করিয়ে তাদেরকে একই সাইবার নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় আনা কতটা কঠিন হতে পারে, তা অনুমেয়।


তবে দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে...

‘সিফোআইএসআরনেট’এর ‘সাইবারকন’ অনুষ্ঠানে আসেন মার্কিন সরকারের সাইবার নীতি বিষয়ক প্রধান উপসহকারী প্রতিরক্ষা সচিব মিয়েকে ইওইয়াং। তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বী মোকাবিলা করতে হলে নিজেদের বন্ধুদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বন্ধুদের সাইবার নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ; কারণ একত্রে যুদ্ধ করতে হলে নিজেদের মাঝে তথ্য আদানপ্রদান ছাড়াও কমান্ড এন্ড কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে একই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বীরা নেটওয়ার্কের দুর্বল জায়গাটা দিয়েই ভেতরে ঢুকে পরবে। যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবেই ন্যাটো, ইউরোপ এবং ইন্দোপ্যাসিফিকের বন্ধুদের কাছ থেকে সাইবার নিরাপত্তা দেয়ার অনুরোধ পাচ্ছে। ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি কোঅপারেশন এজেন্সি’র মাধ্যমে এই বন্ধুদেরকে সহায়তা দিতে পেন্টাগনকে আরও ভালোভাবে কাজ করতে হবে বলে বলেন তিনি; যাতে বন্ধুরা নিজেদের সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে পারে। এই কাজটা করতে গেলে আবশ্যিকভাবেই বেসরকারি সহায়তার প্রয়োজন। যেহেতু পেন্টাগন মেধাবি জনবলকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দিতে পারে না, তাই সবচাইতে ভালো লোকগুলিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই পাওয়া যায়। তিনি বেসরকারি সেক্টরকে কিভাবে পেন্টাগনের সাথে কাজ করানো যায়, সেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার কথা বলেন। তবে নির্দিষ্ট করে কোন প্রকল্পের কথা তিনি বলেননি।

মিয়েকে ইওইয়াং সাইবার নীতির ফোকাস হিসেবে নির্বাচনের নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, একসময় অনেকেই সাইবার হ্যাকিংকে একটা অপরাধ এবং বিরক্তির কাজ হিসেবে দেখতো; যেখানে পেন্টাগনের জড়িত হবার দরকার রয়েছে বলে কেউ মনে করতো না। কিন্তু ‘র‍্যানসমওয়্যার’এর মাধ্যমে ‘কলোনিয়াল পাইপলাইন’ হ্যাকিংএর মত উদাহরণ দেখিয়ে দেয় যে, এটা এখন কেন পেন্টাগনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির একটা।

যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদের সাইবার নিরাপত্তা কেন, নিজেদের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তার ব্যাপারেই যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। ‘সাইবারকন’ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন পেন্টাগনের সাইবার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ডেপুটি চিফ ইনফর্মেশন অফিসার ডেভিড ম্যাকিওয়ন। তিনি বলেন যে, গত ফেব্রুয়ারিতে ‘সোলার উইন্ডস’ হ্যাকিংএর ঘটনা প্রকাশ হবার পর থেকে পেন্টাগন ‘জিরো ট্রাস্ট’ নীতিতে যাচ্ছে। ‘সোলার উইন্ডস’ ঘটনায় রুশ হ্যাকাররা মার্কিন বেসরকারি সফটওয়ার কোম্পানির নেটওয়ার্কে ঢুকে সেখান থেকে সরকারি বহু সংস্থার নেটওয়ার্কে ঢুকে পরে এবং সেখানে কয়েক মাস অবস্থান করে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নজরদারি চালিয়ে যায়। মার্কিনীরা ধরেই নিচ্ছে যে, প্রতিপক্ষরা মার্কিন নেটওয়ার্কে ঢুকে পরতে পারবে এবং সেখানে তারা অবস্থান করবেই। এতকাল তারা সাইবার নিরাপত্তায় ‘সীমানা রক্ষা’ করেছেন; অর্থাৎ নেটওয়ার্কে ঢোকার জায়গায় পাহাড়া দিয়েছেন। এখন তারা চাইছেন যে, তারা নেটওয়ার্কের ভিতরে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবেন। এর মাধ্যমে নেটওয়ার্কের একটা স্থান থেকে অন্য স্থানে ঢুকতে হলে পাসওয়ার্ড লাগবে; অর্থাৎ নেটওয়ার্কে কেউ কেউকে বিশ্বাস কবে না। তবে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন খুব সহজ হবে না; কারণে এখনও নিজেদের নেটওয়ার্কগুলির মাঝে সমন্বয় সময়সাপেক্ষ। তিনি বলেন যে, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মাঝে তারা হয়তো এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা যে নিশ্ছিদ্র নয়, তা পেন্টাগনের ‘জিরো ট্রাস্ট’ নীতিই বলে দিচ্ছে। একইসাথে মার্কিন সাইবার কমান্ডের প্রতিপক্ষের নেটওয়ার্কের ভিতর অবস্থান করা এবং নিজেদের নেটওয়ার্কে হামলার আগেই হামলা ঠেকিয়ে দেয়ার নীতির দিকে ধাবিত হওয়া বলে দিচ্ছে যে, প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং আক্রমণাত্মক সাইবার ‘ডিটারেন্ট’ তৈরির দিকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেশি। এই নীতির পিছনে মূল কারণ হলো নিজেদের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা। যুক্তরাষ্ট্রকে শুধুমাত্র পেন্টাগনের নেটওয়ার্ককেই রক্ষা করতে হবে না, বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা দিতে হবে; যাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পেন্টাগনের নেটওয়ার্কে ঢোকা সম্ভব। আবার গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে চীন বা রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে পারবে না। ভৌগোলিক কারণেই মার্কিনীদেরকে অবশ্যই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বহু দেশের সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিজেদের নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া বন্ধু দেশগুলির সাইবার নিরাপত্তাও একই গুরুত্ব পেতে হবে। কিন্তু নিজেদের সামরিক বাহিনীর নেটওয়ার্কগুলির মাঝে সমন্বয়ই যখন মার্কিনীদের জন্যে এতটা কঠিন হচ্ছে, তখন মার্কিন বন্ধু দেশগুলির নীতি পরিবর্তন করিয়ে তাদেরকে একই সাইবার নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় আনা কতটা কঠিন হতে পারে, তা অনুমেয়। শুধু তাই নয়, বন্ধুদের সাইবার নিরাপত্তা দিতে উপসহকারী প্রতিরক্ষা সচিব মিয়েকে ইওইয়াং বেসরকারি সেক্টরের সহায়তা চাইছেন। যেখানে যথেষ্ট পারশ্রমিক না দিতে পারার কারণে মার্কিন সরকার সেরা মেধাগুলিকে নিজেদের অধীনে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বেসরকারি সেক্টরের ব্যবসায়িক লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করেই যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে তার কাজ গুছিয়ে নেবে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি এবং বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়ন না করে পেন্টাগন এক চুলও এগুতে পারছে না; যা মার্কিন সামরিক শক্তির প্রধানতম দুর্বলতা হয়ে দেখা দিচ্ছে। নিজ নেটওয়ার্ক রক্ষা না করতে পারার এই দুর্বলতাই এখন সাইবার যুদ্ধকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ থেকে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা নয়, বরং প্রতিপক্ষের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক এবং লজিস্টিক্যাল ক্ষতি করার মাঝেই থাকবে কৌশলগত সফলতা। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিতে পারার সক্ষমতা কার কতটুকু থাকবে, সেটাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের সেই সাইবার যুদ্ধে কে এগিয়ে থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আরও একটা সমস্যা রয়েছে; তা হলো নির্বাচনের নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের গণতান্ত্রিকতাকে রক্ষা করা, যা ২০২০ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। অর্থাৎ গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতার মাঝে সাইবার যুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষা এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আলাদা বোঝা!