Sunday 27 December 2020

২০২১ সালে ইন্দোপ্যাসিফিকে উপস্থিতি বাড়াবে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

২৭শে ডিসেম্বর ২০২০


 
২০২০ সাল যখন শেষের দিকে চলে আসছিল, তখন থেকেই ২০২১ সালের শুরুতে ব্রিটিশ রয়াল নেভির নতুন নির্মিত দৈত্যাকৃতির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর ভারত মহাসাগরে মোতায়েন নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ হিসেবে এই সামরিক কর্মকান্ড ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন আনবে। ‘নিকেই এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে ব্রিটেনকে ‘কোয়াড’ জোটের পঞ্চম সদস্য হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ‘কোয়াড’ হলো এক কৌশলগত জোট, যার মাঝে রয়েছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া। ২০২০ সালে ‘কোয়াড’ তার সত্যিকারের আকার নিতে শুরু করে, যখন ভারত অবশেষে বঙ্গোপসাগরে অনুষ্ঠিত ‘এক্সারসাইজ মালাবার’ নৌমহড়াতে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ অস্ট্রেলিয়াকে আমন্ত্রণ জানায়। ‘নিকেই এশিয়া’ বলছে যে, আপাততঃ ব্রিটিশ নৌবাহিনী হয়তো মার্কিন নৌবাহিনীর সহায়ক হিসেবেই কাজ করবে। করোনা সংক্রমণের কারণে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন পূর্ব এশিয়াতে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এর সমান্তরালে জুলাই মাসে মার্কিন নৌবাহিনীর আরেক উভচর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘বনহোমি রিচার্ড’ মারাত্মক অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, একটা রাষ্ট্র একটা অঞ্চলে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, তার একাংশ নির্ধারিত হবে সেখানে তার সামরিক শক্তি মোতায়েনের সক্ষমতার উপর। ব্রিটিশরা চাইছে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এশিয়াতে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে।

জাপানের ‘কিওদো নিউজ’ বলছে যে, এশিয়াতে ব্রিটেনের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের পিছনে জাপানের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তারা বলছে যে, ‘কুইন এলিজাবেথ’ ২০২১ সালে জাপানি এবং মার্কিন নৌবাহিনীর সাথে মহড়া দেবে। আর জাপান সফরের সময় এর ‘এফ ৩৫বি’ স্টেলথ যুদ্ধবিমানগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে আইচি প্রিফেকচারে অবস্থিত ‘মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ’এর কারখানায় পাঠানো হবে। অর্থাৎ জাহাজটার ইন্দোপ্যাসিফিকে স্থায়িভাবে মোতায়েনের পিছনে জাপানের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। এছাড়াও জাহাজটার মূল রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ওমানের দুকমে বিশাল ড্রাইডক তৈরি করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সরকার দুকমের লজিস্টিকস ঘাঁটি তিনগুণ করার লক্ষ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমে ওমানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ট্রেনিং কর্মকান্ডও বৃদ্ধি পাবে।

ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের সাথে চীনের ব্যাপারে ব্রিটিশ নীতির যোগাযোগ রয়েছে। হংকংএ চীনা দমনপীড়নের ব্যাপারে ব্রিটিশ রাজনৈতিক অবস্থান চীনের বিরক্তির উদ্রেক করেছে। একইসাথে তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতেও ব্রিটেন চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে তা একইসাথে ব্রিটেনকে পূর্ব এশিয়াতে নিজের অবস্থান জানান দিতে সহায়তা করেছে। চীনারা এশিয়াতে রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজের আবির্ভাবকে ‘সামরিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’এর লেখায় সামরিক বিশ্লেষক সং ঝংপিং বলছেন যে, ‘কুইন এলিজাবেথ’ যুদ্ধজাহাজ এবং এর বিমানগুলি এখনও পুরো যুদ্ধ সক্ষমতা অর্জন করেনি। তিনি বলেন যে, এমতাবস্থায় জাহাজটাকে ইন্দোপ্যাসিফিকে পাঠালে এর দুর্বলতাগুলিই প্রকাশ পাবে। তবে চীনারা ব্রিটিশদের এই সিদ্ধান্তকে পছন্দ করেনি মোটেই। গত জুলাই মাসে ব্রিটেনের ‘দ্যা সানডে টাইমস’ পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে লন্ডনে চীনা রাষ্ট্রদূত লিউ শিয়াওমিং পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের পরিকল্পনা বাতিল করার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে, চীনকে ভয় দেখাতে এটা করা হলে তা হবে অনেক বড় ভুল। ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন বিশ্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাচ্ছে; তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পথ নয়। এছাড়াও তিনি লন্ডনকে উপদেশ দিয়ে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বিরুদ্ধে ‘দল বাঁধা’ ব্রিটেনের ঠিক হচ্ছে না।

২০০৯ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ‘কুইন এলিজাবেথ’এর কমিশনিং করা হয়। এরপর থেকে জাহাজটা অপারেশনে যাবার জন্যে বিভিন্ন ট্রেনিংএ অংশ নিচ্ছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির মাঝেই এই ট্রেনিং অব্যাহত রাখা হয়; যা কিনা ব্রিটেনের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের গুরুত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০২১ সালের ইন্দোপ্যাসিফিক মিশন হবে জাহাজটার জন্যে প্রথম অপারেশনাল মিশন। এটা ৬৫ হাজার টনের জাহাজ একই রকমের দু’টা জাহাজের একটা। অপর জাহাজটা হলো ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’; যা ২০২৩ সালের আগে অপারেশনাল হবে না। ২০২১ সালে ‘কুইন এলিজাবেথ’এর সাথে কোন কোন জাহাজ থাকবে, সেটা এখনই বলা না গেলেও সাধারণভাবে জাহাজটার ব্যাটল গ্রুপের মাঝে একটা ‘টাইপ ২৩’ ফ্রিগেট, একটা ‘টাইপ ৪৫’ ডেস্ট্রয়ার, একটা সাবমেরিন এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ থাকার কথা রয়েছে বলে বলছে ‘নেভি রেকগনিশন’। তবে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ব্যাটল গ্রুপ তৈরি করা হলে সেখানে মার্কিন এবং ডাচ নৌবাহিনীর জাহাজও ছিল। অর্থাৎ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর নিরাপত্তা শুধু ব্রিটিশ জাহাজের হাতেই থাকছে না। মিশনের সময় জাহাজটা মোট ১৪টা ব্রিটিশ বিমান বাহিনী এবং মার্কিন ম্যারিন কোরের ‘এফ ৩৫’ বহণ করবে। এছাড়াও জাহাজটা ৯টা হেলিকপ্টার বহণ করবে; যার মাঝে ৬টা ‘মারলিন এইচএম২’ সাবমেরিন ধ্বংসী হেলিকপ্টার; আর ৩টা ‘ক্রোসনেস্ট’ আর্লি ওয়ার্নিং হেলিকপ্টার। এছাড়াও দরকার বিশেষে জাহাজটা স্পেশাল ফোর্সের ‘মারলিন এইচসি৪’ ও ‘ওয়াইল্ডক্যাট এএইচ১’ হেলিকপ্টার, বিমান বাহিনীর ‘শিনুক’ পরিবহণ হেলিকপ্টার এবং সেনাবাহিনীর ‘এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার বহণ করতে পারে। জাহাজটা সর্বোচ্চ ২৪টা এবং জরুরি ভিত্তিতে ৩৬টা ‘এফ ৩৫বি’ বহণ করতে সক্ষম।

১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেন সুয়েজ খালের পূর্বে তার বেশিরভাগ অঞ্চল ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের উপর তার নিরাপত্তার জন্যে নির্ভরশীল থাকলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই ব্রিটেন বিশ্বব্যাপী তার ভূমিকাকে নতুন করে দেখতে থাকে। এটাই সেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা, যার ফসল হিসেবেই ১৯৯০এর দশকের শেষে দু’টা বড় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতার চাপে ব্রিটেন এই জাহাজগুলির নিরাপত্তার জন্যে আদর্শিক দিক থেকে একই চিন্তার দেশগুলির উপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দোপ্যাসিফিকে ব্রিটেন প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না। তথাপি অপরের শক্তির উপর ভিত্তি করে প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা বিপজ্জনক হলেও ব্রিটেনের চোখে এটা শতবছরের মাঝে সবচাইতে বড় সুযোগ।

Saturday 26 December 2020

২০২০ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ এবং ২০২১ সালের সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক উত্তাপের স্থানসমূহ

২৬শে ডিসেম্বর ২০২০

রাসায়নিক দ্রব্য ছড়িয়ে রাস্তা থেকে করোনভাইরাস দূরীকরণের চেষ্টা করা হলেও ২০২০ সালে পশ্চিমা পুঁজিবাদের গভীর সমস্যাগুলি আরও নোংড়াভাবে উঠে এসেছে। বছরের সবচাইতে বড় ঘটনা ছিল পশ্চিমা আদর্শের অধোগতি।



করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক ধ্বস এবং আদর্শিক অধোগতি

নিঃসন্দেহে ২০২০ সালের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং ফলাফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী মহামারি। সমাধানহীন অবস্থায় বিচলিত বিশ্ব নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ‘সামাজিক দূরত্ব’ নিশ্চিত করতে ‘লকডাউন’ নামে এক পদ্ধতির আবিষ্কার করে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’এর ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ‘লকডাউন’এর ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি স্থবির হয়ে যায় এবং সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ধ্বস নামে। তেলের বাজার এবং শেয়ার বাজারে ঐতিহাসিক দরপতন ঘটে। ‘লকডাউন’ উঠিয়ে নেয়ার জন্যে পশ্চিমা বিশ্বের স্বাধীনচেতা মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করলে পশ্চিমা আদর্শের ভিত আরও দুর্বল হতে থাকে। কোটি কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারালেও গুটিকয়েক বিলিয়নায়াররা এই সুযোগে তাদের সম্পদ আরও বাড়িয়ে নেয়; যা কিনা সম্পদের অসম বন্টনকে আরও বাজেভাবে উপস্থান করেছে। করোনাভাইরাসের সবচাইতে বড় প্রভাব হলো, তা পশ্চিমা পুঁজিবাদী আদর্শের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলাফল ২০২১ সাল জুড়ে দেখা যাবে।

বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করার আগেই করোনার দ্বিতীয় ডেউ আঘাত হানে ইউরোপে। ২০২১ সালের প্রথম অংশেও বিশ্ব দ্বিতীয় ঢেউকেই মোকাবিলা করবে। এরই মাঝে ভাইরাসের নতুন জাতের আবির্ভাব হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহুর্তে এর গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট করা না গেলেও তা যে অর্থনীতির উপর সবচাইতে বড় আঘাত হানবে, তা নিশ্চিত।

মহামারির কারণে মেডিক্যাল সুরক্ষা সামগ্রী এবং টেস্টিং কিট নিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা; চীন এবং তুরস্ক এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে আখ্যা দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা চালান। চীনারাও এই ভাইরাসের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে হয়েছে বলে দাবি করতে থাকে। দুই দেশের মাঝে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে এই দ্বন্দ্ব আরও অস্থিরতার জন্ম দেয়।

মহামারিতে লাখো মানুষের মৃত্যুর মাঝে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির মাঝে শুরু হয় মুনাফাবৃত্তির প্রতিযোগিতা। ভ্যাকসিন ডেভেলপ করার ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা আরও গতিশীল হয়; বিশেষ করে রাশিয়া এবং চীন ভ্যাকসিন তৈরিতে মনোনিবেশ করার পর থেকে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা এবং আরও কয়েকটা দেশ নিজেদের জনসংখ্যার বহুগুণ ভ্যাকসিন অর্ডার করার ফলে ভ্যাকসিন নিয়ে আসন্ন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া যায়। তদুপরি আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণে ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যমূলক করার প্রচেষ্টা শুরু হওয়ায় এই প্রতিযোগিতা ২০২১ সালে একটা বাজে দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে।

মহামারির মাঝেই ফ্রান্সে ইসলাম বিদ্বেষী ভূমিকা নেয়া এক শিক্ষককে হত্যা করাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মাঝে ফ্রান্স বিরোধী আবেগ দৃশ্যমান হয়। এতে বেশিরভাগ মুসলিম দেশের সরকার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কথা না বললেও তা মুসলিম বিশ্বের অতি সংবেদনশীল জায়গাটাকে দেখিয়ে দেয়। ইউরোপের লিবারাল আদর্শিক অবস্থানের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের জনগণের এই অবস্থান ২০২১ সালের আদর্শিক সংঘাতের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। 

দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন এবং অস্ট্রেলিয় যুদ্ধজাহাজ। ভাইরাসের সংক্রমণে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলি অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সময় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনারা শক্তি প্রদর্শন করে। এতে পূর্ব এশিয়াতে স্বল্প সময়ের জন্যে মার্কিন অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।


দক্ষিণ চীন সাগর

করোনা মহামারির মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও গতিশীল হয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলি অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সময় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনারা শক্তি প্রদর্শন করে। এতে পূর্ব এশিয়াতে স্বল্প সময়ের জন্যে মার্কিন অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হংকংএ চীনা সরকারের কঠোর নীতির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের হস্তক্ষেপের কারণেও থেকে থেকে উত্তেজনা চলে।

বছরের শেষের দিকে ‘আরসেপ’ নাম নিয়ে আবির্ভাব হয় নতুন অর্থনৈতিক জোটের, যেখানে আসিয়ানের সাথে যোগ দেয় চীন, জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে এই জোটের বাইরে রাখা হয়। এই জোট রাজনৈতিক কোন পরিবর্তন না আনলেও যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে রেখেই বিশ্বের সবচাইতে বড় অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

ভারত মহাসাগর

হিমালয়ের পাদদেশে লাদাখ অঞ্চলে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ভারত এবং চীনের মাঝে চলে ব্যাপক উত্তেজনা। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অস্ত্র এবং ভারতের তৈরি করা সীমান্ত অবকাঠামো আকসাই চিন অঞ্চলে চীনা অবস্থানের উপর হুমকি তৈরি করলে বহু দশকে প্রথমবারের মতো চীনারা তাদের স্থল সীমানা নিয়ে ব্যস্ত হতে বাধ্য হয়। এই উত্তেজনার ফলে চীনারা তাদের সীমান্তে নতুন করে অবকাঠামো তৈরি করা শুরু করেছে, যা এখানকার সামরিক ব্যালান্সকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং উত্তেজনাকে ২০২১ সালে টেনে নিয়ে যাবে। হিমালয়ের ইস্যুতে ভারত তার প্রতিবেশী কোন দেশ থেকেই সমর্থন না পাওয়ায় ভারতের জন্যে এমন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যা ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বঙ্গোপসাগরে ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২০’এ অস্ট্রেলিয়ার যোগদানের মাধ্যমে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে ‘কোয়াড’ জোট পূর্ণতা পায়। ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তৈরি করা এই জোট ভারত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়া তথা ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর হাতকে শক্তিশালী করবে। ২০২১ সালে ভারত মহাসাগরে ব্রিটেন তার দৈত্যাকৃতির নতুন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’ মোতায়েন করতে যাচ্ছে, যা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে নতুন অস্থিরতার জন্ম দেবে।

হিমালয়ের উত্তেজনা এবং বঙ্গোপসাগরে ‘কোয়াড’ জোটের অস্ত্রের ঝনঝনানি দক্ষিণ এশিয়াতে তুরস্ককে একটা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার ভিত তৈরি করে দিয়েছে। কাশ্মির ইস্যু এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুকেও তুরস্ক এক্ষেত্রে ব্যবহার করবে। 

জানুয়ারি ২০২০। ত্রিপোলির উপকূলে তুর্কি যুদ্ধজাহাজ। লিবিয়ার যুদ্ধ তুরস্ককে লিবিয়ার উপকূলে একটা স্থায়ী সামরিক উপস্থিতির সুযোগ করে দিয়েছে; যা ফ্রান্স হুমকি হিসেবে দেখেছে।  


ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগর

২০২০ সালে ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগর অঞ্চলে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের উপর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ছিল সবচাইতে বেশি। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার কারণে ফ্রান্স, গ্রীস, মিশর এবং অন্যান্য দেশের সাথে থেকে থেকে বিবাদে জড়িয়েছে তুরস্ক। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্কের হস্তক্ষেপের পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং হাফতার বাহিনী জয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে ত্রিপোলিতে তুরস্কের একটা সামরিক অবস্থান নিশ্চিত হয়; যা ফ্রান্স হুমকিস্বরূপ দেখতে থাকে। এরপর থেকে লিবিয়ার উপকূলে নিয়মিত বিরতিতে গ্রিক এবং ফরাসি যুদ্ধজাহাজের সাথে তুর্কি জাহাজের বিবাদ চলতে থাকে। ২০২১ সালেও এই বিবাদ চলবে। লিবিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতি তৈরি হওয়ায় তিউনিসিয়া এবং আলজেরিয়াকে নিয়ে ফ্রান্স এবং তুরস্কের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

হাফতার বাহিনীর পক্ষে মিশরীয়রা সরাসরি হস্তক্ষপের হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের আলোচনায় যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হয়। উল্টো মিশর নীল নদের উপর ইথিওপিয়ার তৈরি করা বাঁধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। ইথিওপিয়ার সরকার বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসলে মিশর এবং সুদানের সাথে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তবে সেই উত্তেজনাও অন্যদিকে ধাবিত হয় যখন ইথিওপিয়ার সরকার জাতিগত তিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযান শুরু করে। গৃহযুদ্ধের আশংকায় ইথিওপিয়াতে আঞ্চলিক শক্তিগুলির হস্তক্ষেপ ছাড়াও কৌশলগত বাব এল মান্ডেব প্রণালী সংলগ্ন লোহিত সাগর এবং পুরো ‘হর্ন অব অফ্রিকা’ অঞ্চলে অস্থিরতার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বছরের শেষের দিকে সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হলে অত্র অঞ্চলের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। সোমালিয়াতে তুরস্কের সামরিক অবস্থান এক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে; আর একইসাথে সৌদি আরব এবং আমিরাতের জোট তুরস্কের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আরও জোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এভাবে ২০২১ সালে ভারত মহাসাগরে তুরস্কের একটা অবস্থান তৈরি হবার পদ্ধতি তৈরি হয়ে গেলো।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিয়মিত হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের তুর্কি চেষ্টা ইউরোপের সাথে তুরস্কের উত্তেজনা জিইয়ে রাখে। এর মাঝেই বিশাল এক বিস্ফোরণে লেবাননের বৈরুত বন্দরের উল্লেখযোগ্য অংশ ধ্বংস হয়ে গেলে বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ফ্রান্স, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়। তুরস্ক এবং গ্রীসের পাল্টাপাল্টি সামরিক মহড়ায় উত্তপ্ত থাকে সমুদ্র। ইস্তাম্বুলের হায়া সোফিয়াতে নামাজ পড়া শুরু হলেও ইউরোপের সাথে তুর্কিদের একটা চাপা উত্তেজনা শুরু হয়। 

আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের পর আজেরিদের উল্লাস। আজেরিদের পক্ষে তুর্কিদের সমর্থন ককেশাসে তুরস্কের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। 


ইউরেশিয়া

ককেশাসে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে শুরু হয় যুদ্ধ। তুর্কি সহায়তায় এবং রুশ নিরপেক্ষতায় আজেরিরা বড় একটা জয় ঘরে তুলে নেয়। এই যুদ্ধ ককেশাসে তুর্কি অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে এবং মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের নতুন করে অবস্থান তৈরির ভিত তৈরি করেছে। এই যুদ্ধ ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, যা ২০২১ সালের সম্ভাব্য সংঘাতগুলিকে প্রভাবিত করবে। অপরদিকে মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানে রাজনৈতিক পরিবর্তন চীনের উইঘুর সীমান্তে নতুন এক ভূরাজনৈতিক খেলার জন্ম দিতে যাচ্ছে। বেলারুশে ব্যাপক অস্থিরতা চললেও সেখানে রাজনৈতিক পরিবর্তন সংগঠিত হয়নি। আর ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের সখ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডনবাসে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রাশিয়া এবং তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে হাইড্রোকার্বন পাইপলাইনের জন্যে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আর যদিও রাশিয়া থেকে তুরস্ক ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র বছর শেষে তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তথাপি তুরস্ক এবং রাশিয়ার সম্পর্ক খুব শক্ত ভিতের উপর নয়। ভূকৌশলগত কারণে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাগুলি রাশিয়ার স্বার্থের পরিপন্থী। লিবিয়া এবং সিরিয়াতে রাশিয়া এবং তুরস্ক বিপরীত পক্ষে রয়েছে। একারণেই ২০২১ সালে সিরিয়ায় ইদলিবের যুদ্ধ নতুন করে শুরু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে লিবিয়া এবং আজেরবাইজানে তুরস্কের সমর্থন যুদ্ধের মোড় ঘোরার কারণে তা তুরস্ককে সিরিয়াতে অভিযান শুরু করতে আত্মবিশ্বাসী করবে।

পশ্চিম আফ্রিকা

পশ্চিম আফ্রিকায় দেশ মালিতে সামরিক অভ্যুত্থান গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দেশটাতে ফ্রান্সের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। একইসাথে তা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। আলজেরিয়া তার সংবিধান পরিবর্তন করে নিজ সীমানার বাইরে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে; যা সাহারা অঞ্চলে আলজেরিয়াকে নতুন শক্তি হিসেবে অবির্ভূত করছে। তুরস্কও পশ্চিম আফ্রিকাতে তার রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্যে কূটনৈতিক কর্মকান্ড বাড়িয়েছে।

পশ্চিম আফ্রিকার ফরাসি ভাষাভাষী দেশগুলিতে রাশিয়াও তার প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষ করে সেসব দেশের গৃহযুদ্ধে সমরাস্ত্র বিক্রয় এবং ভাড়াটে সেনা মোতায়েন করে ফ্রান্সের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে রাশিয়া। অত্র অঞ্চলে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে ব্যাপক তথ্যযুদ্ধও চলমান। শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সোশাল মিডিয়ার ব্যবহার নতুন এক প্রতিযোগিতার দ্বারকে জনসন্মুখে আনলো। 

রাস্তায় শেতাঙ্গ পুলিশের হাতে একজন কৃষ্ণাঙ্গের বিচার বহির্ভূত হত্যার পর থেকে পুরো যুক্তরাষ্ট্র কেঁপে ওঠে। মহামারির ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেই রাস্তায় লাখো মানুষের সমাবেশ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়। সারা বিশ্ব টেলিভিশনে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জাতিগত কলহকে প্রত্যক্ষ করে; যা ছিল ঐতিহাসিক।



আটলান্টিকের ওপাড়ে

নির্বাচনের বছরে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই ছিল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ নিয়ে হোয়াইট হাউজের সাথে লিবারালদের বছরব্যাপী দ্বন্দ্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। এর উপর রাস্তায় শেতাঙ্গ পুলিশের হাতে একজন কৃষ্ণাঙ্গের বিচার বহির্ভূত হত্যার পর থেকে পুরো যুক্তরাষ্ট্র কেঁপে ওঠে। মহামারির ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেই রাস্তায় লাখো মানুষের সমাবেশ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়। সারা বিশ্ব টেলিভিশনে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জাতিগত কলহকে প্রত্যক্ষ করে; যা ছিল ঐতিহাসিক।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কলহের সর্বশেষ রূপ ছিল হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনে জিতলেও একটা বিভক্ত রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেবার কঠিন দায়িত্ব পান তিনি। একইসাথে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির আবির্ভাবে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠেছে, তখন বাইডেন প্রশাসনের জন্যে ২০২১ সাল যে বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে, তা বলাই বাহুল্য। 

মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল আরব দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। মার্কিন দুর্বলতার কারণে ইস্রাইল তার নিরাপত্তার জন্যে এখন আরব দেশগুলি এবং তুরস্কের উপর নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। এতে মুসলিম দেশগুলির সরকারগুলিকে জনগণের অসন্তোষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।


মধ্যপ্রাচ্য

মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল আরব দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন এর সাফল্য দাবি করলেও তা প্রকৃতপক্ষে নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতার ফলাফল। মার্কিন দুর্বলতার কারণে ইস্রাইল তার নিরাপত্তার জন্যে এখন আরব দেশগুলি এবং তুরস্কের উপর নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। এতে মুসলিম দেশগুলির সরকারগুলিকে জনগণের অসন্তোষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ২০২১ সালেও এই প্রবাহ চলবে।

বছরটা শুরু হয়েছিল ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ইরানের প্রভাবশালী সামরিক অফিসার কাশেম সুলাইমানিকে মার্কিন ড্রোন হামলায় হত্যার মাধ্যমে। আর বছর শেষ হয়েছে ইরানের অভ্যন্তরে দেশটার পারমাণবিক প্রকল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মোহসেন ফাখরিজাদেহএর হত্যার মাধ্যমে; যা কিনা ইস্রাইলের কাজ ছিল বলেই সকলে ধারণা করেন। এছাড়াও সাইবার হামলায় ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সেন্টিফিউজের স্থাপনা ধ্বংস হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নির্বাচন চালিয়ে নেবার প্রচেষ্টা, মহামারির ভয়াবহতা গোপনের চেষ্টা, অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় রাস্তায় বিক্ষোভ, ভুলবশতঃ ইউক্রেনের বেসামরিক বিমান ভূপাতিত করে অস্বীকার করা এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পাল্টে ক্ষতিপূরণ প্রদান, ইত্যাদি ঘটনা ২০২০ সালে ইরানকে আরও দুর্বল করেছে। ইরান তার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেবার লক্ষ্যেই ফাখরিজাদেহ হত্যার প্রতিশোধ নেয়া থেকে এখনও বিরত থেকেছে। তারা হয়তো আশা করছে যে, নতুন মার্কিন প্রশাসন ইরানের উপর অবরোধ তুলে নিতে সচেষ্টা হবে। তবে বাইডেন প্রশাসনকে ট্রাম্প প্রশাসনের রেখে যাওয়া বাস্তবতাগুলি নিয়েই কাজ করতে হবে।

বাইডেন প্রশাসনের নীতি পরিবর্তনকে মাথায় রেখে ইতোমধ্যেই তুরস্ক এবং সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ শুরু করেছে। এতে সবচাইতে বড় হুমকিতে পড়বে ইরান। সিরিয়ার ইদলিবে বছরের শুরুতে তুর্কি সমর্থিত বাহিনীর সাথে রুশ এবং ইরান সমর্থিত বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তবে উপসংহারে না পৌঁছানো এই সংঘাত আবারও শুরু হবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। ইরান বাইডেন প্রশাসনের মাঝে অবরোধ উঠিয়ে নেয়ায় আশার আলো দেখলেও ইরাক এবং সিরিয়াতে ইরানের অবস্থানকে তুর্কি এবং সৌদি গ্রুপের প্রভাব বিস্তার থেকে রক্ষা করার জন্যে ইরানের পক্ষে রাশিয়া ছাড়া আর কেউই থাকবে না। বিশেষ করে ইস্রাইলের সাথে আরব দেশগুলির সখ্যতা তৈরি হওয়ায় ২০২১ সালে ইরানের জন্যে আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখা কঠিন হবে।

Friday 25 December 2020

সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করবে কে?

২৫শে ডিসেম্বর ২০২০

সোমালিয়ার উপকূলে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘মাকিন আইল্যান্ড’। কেউ কেউ মনে করছেন যে, মার্কিনীরা চলে যাবার পরে আল শাবাবের আক্রমণ আবারও বেড়ে যেতে পারে। তবে যে ব্যাপারটা আলোচনায় আসেনি তা হলো, সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান কে নিতে পারে।


সোমালিয়ার উপকূলে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলি ব্যস্ত রয়েছে। উভচর এসল্ট শিপ ‘মাকিন আইল্যান্ড’ এবং সী বেইজ শিপ ‘হার্শেল উডি উইলিয়ামস’ সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার কাজ করছে। এর আগে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারির ১৫ তারিখের মাঝে সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার নির্দেশ দেন। মার্কিন সামরিক বাহিনীর বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, সোমালিয়াতে ৭’শ মার্কিন সেনা রয়েছে, যাদের কিছু অংশ মার্কিনীরা পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলিতে, মূলতঃ জিবুতি এবং কেনিয়াতে সরিয়ে নিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে একইভাবে সৈন্য সরিয়ে নেবার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বরাবরই এসব সামরিক মিশনগুলিকে ব্যয়সাধ্য এবং অকার্যকর বলে আখ্যা দিয়েছেন। গত নভেম্বরেই ট্রাম্প প্রতিরক্ষা সচিবের পদ থেকে মার্ক এসপারকে অব্যাহতি দেন। এসপার চাইছিলেন যে, সোমালিয়াতে মার্কিন সেনারা থাকুক। পেন্টাগনের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনাদের অন্য দেশে সরিয়ে নেয়া মানে এ নয় যে, মার্কিন নীতির পরিবর্তন হয়েছে। এতে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গী গ্রুপগুলির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখবে এবং একইসাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান সমুন্নত রাখবে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, মার্কিন এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত খারাপ সময়ে এসেছে; যখন দুই মাসের মাঝে সোমালিয়াতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে চলেছে; আর প্রতিবেশী ইথিওপিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একইসাথে বহু বছর ধরে পার্শ্ববর্তী জিবুতি, কেনিয়া এবং সেইশেল দ্বীপ থেকে মার্কিন বিমান হামলার পরেও আল শাবাব জঙ্গী গোষ্ঠিকে দমন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেদনে আশংকা করা হচ্ছে যে, এখন মার্কিনীরা চলে যাবার পরে আল শাবাবের আক্রমণ আবারও বেড়ে যেতে পারে। তবে প্রতিবেদনে যে ব্যাপারটা আলোচনায় আসেনি তা হলো, সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান কে নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সোমালিয়ার রাজনৈতিক এলিটরা মার্কিন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সোমালিয়ার পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক সিনেট কমিটির সদস্য আইয়ুব ইসমাঈল ইউসুফ ‘রয়টার্স’কে পাঠানো এক বার্তায় বলেন যে, আল শাবাবের সাথে যুদ্ধের এমন এক সময়ে সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার দুখঃজনক। সোমালিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি অনেক বড় অবদান রেখেছে এবং সোমালি সেনাদের ট্রেনিংএর পিছনে অনেক বড় সহায়তা দিয়েছে। তিনি তার এক টুইটার বার্তায় নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ট্যাগ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযোগ পেশ করেন। তবে এহেন মতামত কি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারছে যে, সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
১৮ই ডিসেম্বর সেন্ট্রাল সোমালিয়ার মুদুগ অঞ্চলের গালকায়ো শহরের একটা স্টেডিয়ামে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়। ১৪ বছর ধরে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় যুদ্ধ করার পরেও সোমালিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং তার আশেপাশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিজেদের জীবনের ব্যাপারে নিশ্চিত নন। মার্কিন সেনারা সোমালিয়া থেকে সরে গেলে এই পরিস্থিতি আর কতটা পরিবর্তন হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন কি?


সোমালিয়ার যুদ্ধের অবস্থা


সোমালিয়াতে আফ্রিকান ইউনিয়নের ব্যানারে কয়েকটা দেশের ২১ হাজার ৫’শ ২৪ জন সেনা মোতায়েন রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন মিশন ইন সোমালিয়া’ বা ‘আমিসম’ নামের এই মিশনে আফ্রিকার ১০টা দেশের ২২ হাজারেরও বেশি সেনা এবং পুলিশ মোতায়েন থাকলেও সবচাইতে বেশি সেনা এসেছে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে। ‘আমিসম’এর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, সোমালিয়াতে প্রতিবেশী উগান্ডার রয়েছে সবচাইতে বেশি ৬ হাজার ২’শ ২৩ জন সেনা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৪’শ ৩২ জন সদস্য এসেছে বুরুন্ডি থেকে। ইথিওপিয়ার রয়েছে ৪ হাজার ৩’শ ৯৫ জন সেনা। এই মিহুর্তে একটা ব্যাটালিয়ন উঠিয়ে নেবার পর এই মিশনে কেনিয়ার সেনা রয়েছে ৩ হাজার ৬’শ ৬৪ জন। সিয়েরা লিওন থেকে ৮’শ ৫০ জন সেনা এসে কেনিয়ার উঠিয়ে নেয়া ব্যাটালিয়নের স্থান নিয়েছে। এছাড়াও জিবুতির রয়েছে ৯’শ ৬০ জন সেনা। এই সেনাদের বাইরেও সোমালিয়ার যুদ্ধে কেনিয়া নিয়োজিত করেছে তাদের সেনাবাহিনীর ৫০তম এয়ার ক্যাভালরি ব্যাটালিয়ন; যাতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ‘এমডি ৫০০’, ‘এমডি ৫৩০এফ’ এবং ‘এএইচ ১এফ কোবরা’ এটাক হেলিকপ্টার। ‘আফ্রিকা ইইউ পার্টনারশিপ’ প্রকল্পের ওয়েবসাইট বলছে যে, ‘আমিসম’কে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। ২০১৯ সালে ইইউএর বাৎসরিক সহায়তার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ২’শ ৫৩ মিলিয়ন ডলারে। এতকিছুর পরেও সোমালিয়ার প্রতিবেশী এই দেশগুলির সেনারা নিয়মিতভাবে আল শাবাবের বড় আকারের হামলার শিকার হয়েছে। এসব হামলায় মোট কতজন সেনা মৃত্যুবরণ করেছে তার বিশ্বাসযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। তবে এই সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার ৪’শ থেকে ১ হাজার ৮’শ বলে ২০১৯এর এক গবেষণায় প্রকাশ করে ‘দ্যা গ্লোবাল অবজারভেটরি’। এত বিপুল সংখ্যক আফ্রিকান সেনা মোতায়েন এবং হতাহতের পরেও মাত্র কয়েক’শ মার্কিন সেনা উঠিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা কেউ কেউ মানতে পারছেন না। সোমালিয়ার পুরো নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের প্রশিক্ষণে তৈরি করা হয়েছে সোমালিয়ার স্পেশাল ফোর্স ‘দানাব ব্রিগেড’। ১১’শ সেনার এই ‘দানাব ব্রিগেড’ই সোমালিয়ার সেনাবাহিনীর মাঝে সবচাইতে ভালো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ‘দানাব’এর প্রাক্তন কমান্ডার কর্নেল আহমেদ আব্দুল্লাহি শেখ ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, যদি মার্কিন সেনারা পুরোপুরি চলে যায়, তাহলে আল শাবাবএর বিরুদ্ধে অপারেশন বেশ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন যে, প্রায় তিন বছর ‘দানাব’এ থাকাকালীন তার অধীনে শতাধিক সেনা মৃত্যুবরণ করেছে; মার্কিন সেনা মারা গিয়েছিল মাত্র দুইজন। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য রয়েছে যে ২০২৭ সালের মাঝে ‘দানাব’এর সদস্যসংখ্যাকে ৩ হাজারে উন্নীত করা। মার্কিনীরা সোমালিয়াতে না থাকলে সেটা বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন কর্নেল শেখ।

প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাল্টি বিলিয়ন ডলার খরচের পরেও সোমালিয়াতে এত বছরে কেন শান্তি ফিরে এলো না। গত ১৮ই ডিসেম্বর সেন্ট্রাল সোমালিয়ার মুদুগ অঞ্চলের গালকায়ো শহরের একটা স্টেডিয়ামে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়। হামলার টার্গেট ছিল গত সেপ্টেম্বর থেকে আসীন হওয়া সোমালিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহামেদ হুসেইন রোবলে। প্রধানমন্ত্রী বেঁচে গেলেও তার নিরাপত্তা বাহিনীর ৪ জন এবং সেনাবাহিনীর ২১তম ডিভিশনের কমান্ডার নিহত হন বলে বলছে সোমালি পুলিশ। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্টেডিয়ামে নির্বাচনী বক্তব্য দিতে যাচ্ছিলেন। আল শাবাব এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে বলছে বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’। ১৪ বছর ধরে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় যুদ্ধ করার পরেও সোমালিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং তার আশেপাশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। মার্কিন সেনারা সোমালিয়া থেকে সরে গেলে এই পরিস্থিতি আর কতটা পরিবর্তন হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন কি?

 
সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা

ভূকৌশলগতভাবে সোমালিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। তাই কোন শক্তিই সোমালিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চাইছে না। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাব এল মান্ডেব প্রণালী এবং আদেন উপসাগরের পাশে অবস্থিত হওয়ায় ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে সমুদ্র যোগাযোগের পথের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে সোমালিয়া এবং এর পার্শ্ববর্তী জিবুতি ও এরিত্রিয়া। এছাড়াও সোমালিয়া থেকে প্রকৃতপক্ষে আলাদাই রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সোমালিল্যান্ড। বাব এল মান্ডেব প্রণালীর উত্তর পাড়ে রয়েছে ইয়েমেন। প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ জিবুতিতে ফরাসিরা একটা সামরিক ঘাঁটি রেখেছিল বহু আগে থেকেই। ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১এর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রও ২০০২ সালে জিবুতিতে ফরাসি সামরিক ঘাঁটির পাশে আরেকটা ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। এই ঘাঁটি থেকে মার্কিনীরা ইয়েমেন এবং সোমালিয়াতে বিমান হামলা চালনা করে। সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুতা প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে জিবুতিতে জাপান একটা সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে ২০১১ সালে। এরপর ২০১৬ সালে চীনারাও জিবুতিতে একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে।

২০১৪ সালে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সাথে মনসুর হাদি সরকারের যুদ্ধ শুরু হলে অত্র অঞ্চলের হিসেব পাল্টে যায়। ২০১৫ সালে এরিত্রিয়ার আসাব বন্দর এলাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা শুরু করে। এছাড়াও আদেন উপসাগরে সকোত্রা দ্বীপেও আমিরাতিরা ইন্টেলিজেন্স স্থাপনা বসিয়েছে বলে কেউ কেউ দাবি করছে। এরপর ২০১৭ সালে আমিরাতিরা সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশ সোমালিল্যান্ডে বারবেরা সমুদ্রবন্দর উন্নয়নের জন্যে চুক্তি করে। এতে সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আমিরাতের সম্পর্কের অবনতি হয়। আমিরাত সোমালিয়ার উত্তরের আরেকটা স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ পুন্টল্যান্ডের বোসাসোতে সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে চেয়েছিল। মোগাদিশুর কেন্দ্রীয় সরকার সেটার ব্যাপারেও বাধা প্রদান করেছিল। আমিরাত পুন্টল্যান্ডের ম্যারিটাইম পুলিশ ফোর্স নামের একটা মিলিশিয়াকেও অর্থায়ন করে থাকে, যা পুন্টল্যান্ডের নেতৃত্বকে নিরাপত্তা দেয়। আমিরাতের এই প্রচেষ্টাগুলিকে সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার সোমালিয়াকে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা হিসেবেই দেখেছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে সোমালি সরকার আমিরাতের একটা বিমান থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার অর্থ জব্দ করে। সোমালিয়া অভিযোগ করে যে, এই অর্থ সোমালিয়ার বিচ্ছন্নতাকামী প্রদেশগুলিকে ঘুষ হিসেবে দেবার চেষ্টা চলছিল। অপরদিকে আমিরাত পাল্টা অভিযোগ করে যে, সোমালি সরকার কাতারের অর্থ দ্বারা পুষ্ট।

সোমালিয়ার গুরুত্ব পুরোপুরি পাল্টে যায় তুরস্কের আবির্ভাবের মাধ্যমে। ২০১০ সালের মে মাসে সোমালিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে তুরস্কের সাথে সোমালিয়ার একটা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ২০১১ সালে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান প্রথমবারের মতো মোগাদিশু ভ্রমণ করেন। সেসময় ‘বিবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলু বলেন যে, সোমালিদের সাথে বন্ধন বৃদ্ধি করতে এবং সেখানকার চলমান দুর্ভিক্ষে মানবিক সহায়তা দিতে তুরস্কের শীর্ষ নেতৃত্ব সোমালিয়া গিয়েছিল। সোমালিয়াতে কেউ যেতে পারে না, এমন চিন্তাটাও তারা ভাঙতে চেয়েছেন। ২০১২ সালে সোমালিয়ার প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠা হয় এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন হাসান শেখ মোহামুদ। এসময় থেকেই তুরস্কের সাথে সোমালিয়ার সম্পর্কের উন্নয়ন হতে থাকে। ২০১৩ সালে তুর্কি কোম্পানি ‘ফাভোরি’ মোগাদিশু এয়ারপোর্টের উন্নয়নের কাজ পায় এবং একইসাথে টারকিশ এয়ারলাইন্স প্রথম বিমান সংস্থা হিসেবে মোগাদিশুতে ফ্লাইট অপারেট শুরু করে। একই বছর সোমালি পার্লামেন্ট তুর্কি কোম্পানি ‘আল বায়রাক’কে ২০ বছরের জন্যে মোগাদিশু সমুদ্রবন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়। ২০১৪ সালে তুরস্কের ট্রেনিং একাডেমিতে সোমালি সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্যে দুই দেশের মাঝে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মোগাদিশুতে ৪’শ হেক্টর বা ৪ বর্গ কিঃমিঃ জমির ওপর তুরস্কের বিশাল সামরিক ঘাঁটি ‘তুর্কসোম’ উদ্ভোধন করা হয়। এই ঘাঁটিতে একসাথে দেড় হাজার সোমালি সেনা এবং অফিসারের প্রশিক্ষণ দেবার জন্যে ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১২ সপ্তাহ ট্রেনিং দেবার মাধ্যমে প্রতি বছর সোমালি সেনাবাহিনীর তিনটা ব্যাটালিয়ন তৈরি করতে চাচ্ছে তুরস্ক। একসাথে ২’শ তুর্কি সামরিক সদস্য এখানে কাজ করছে। এটা তুরস্কের বাইরে সেদেশের সবচাইতে বড় সামরিক ঘাঁটি। সর্বশেষ ২০২০এর জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঘোষণা দেন যে, সোমালিয়া তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

এই অঞ্চলের আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র মিশরও প্রভাব বিস্তারের খেলা থেকে পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। ৬ই ডিসেম্বর মিশরের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেরিফ ইসার নেতৃত্বে একটা উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক দল সোমালিয়া সফর করে আসে। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, এই দলটা সোমালিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহামেদ আব্দিরিজাকএর সাথে দেখা করে আঞ্চলিক ইস্যুগুলি নিয়ে আলোচনা করে এবং পুরো ‘হর্ন অব আফ্রিকা’র উপর এই ইস্যুগুলির প্রভাব কি হতে পারে, তা নিয়ে কথা বলে। ‘ইজিপশিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন এফেয়ার্স’এর সদস্য রোখা হাসান বলছেন যে, মিশর সোমালিয়ার সাথে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে সোমালিয়াতে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি দেখে মিশরও বাধ্য হচ্ছে সোমালিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে। গত মার্চে আরব লীগের বৈঠকে মিশর নীল নদের উপর ইথিওপিয়ার বাঁধ দেয়ার ব্যাপারে আরব দেশগুলির ঐকমত্য চাইলে সোমালিয়া মিশরকে সমর্থন দেয়নি। আর মে মাসে আমিরাতের মতো মিশরও সোমালিয়ার ফেডারেল রাজ্য পুন্টল্যান্ডের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলছিল; যা দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। ‘এরাব সেন্টার ফর পলিটিক্যাল স্টাডিজ’এর উপ প্রধান মুখতার ঘোবাশি বলছেন যে, হতে পারে যে সোমালিয়াতে মিশরের কূটনীতিকেরা মোগাদিশুতে মিশরের একটা সামরিক ঘাঁটির ব্যাপারে কথা বলেছেন। তবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর ওমর মাহমুদ মনে করছেন না যে, সোমালিয়ার সাথে মিশরের সম্পর্কের বড় কোন পরিবর্তন হয়েছে।

 

সোমালিয়ার সাথে প্রতিবেশীদের সম্পর্ক

সোমালিয়ার দক্ষিণে কেনিয়ার সাথে মোগাদিশু সরকারের রেষারেষি চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই; যদিও সোমালিয়ার অভ্যন্তরে কেনিয়ার কয়েক হাজার সেনা রয়েছে। গত ১৫ই ডিসেম্বর সোমালিয়ার সরকার টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে কেনিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। কেনিয়া থেকে সোমালিয়ার সকল কূটনীতিকদের দেশে ফিরে আসতে বলা হয়েছে; আর একইসাথে সোমালিয়াতে কেনিয়ার সকল কূটনীতিককেও এক সপ্তাহের মাঝে দেশত্যাগ করতে বলা হয়েছে। সোমালিয়ার তথ্যমন্ত্রী ওসমান দুবে রাষ্ট্রীয় ‘এসএনটিভি’তে বলেন যে, কেনিয়া সোমালিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে এবং তারা সোমালি সরকারের বারংবার অনুরোধকে এড়িয়ে গেছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, যদিও ঠিক কোন বিষয়গুলি নিয়ে সোমালিয়া বিরক্ত হয়েছে সেটা দুবে বলেননি, তথাপি একটা ধারণা করা যায় যে, এটা সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী সোমালিল্যান্ডের জন্যেই হয়েছে; কারণ ওই মুহুর্তে সোমালিল্যান্ডের নেতা মুসা বিহি আব্দি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি সফর করছিলেন। পরদিন ১৬ই ডিসেম্বর কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনইয়াট্টা বলেন যে, তার দেশ সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসাতে আগামী মার্চের মধ্যেই একটা কনসুলেট খুলবে। এছাড়াও কেনিয়ার সরকারি বিমান সার্ভিস নাইরোবি এবং হারগেইসার মাঝে ফ্লাইট শুরু করবে। সোমালি সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণার পর কেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইরাস ওগুনা বলেন যে, এই কূটনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে সরকার একটা কমিটি গঠন করেছে। তিনি বলেন যে, কেনিয়ার সরকার ২ লক্ষ সোমালি শরণার্থীকে কেনিয়ার অভ্যন্তরে থাকতে দিয়ে দয়ার উদাহরণ দেখিয়েছে। তবে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও আগ থেকেই খারাপ হচ্ছিল। ৩০শে নভেম্বর সোমালিয়া কেনিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিঃষ্কার করে এবং নিজের রাষ্ট্রদূতকে কেনিয়া থেকে ডেকে পাঠায়। সোমালিয়ার অভিযোগ ছিল যে, কেনিয়া তার সীমান্তে অবস্থিত সোমালি প্রদেশ জুবাল্যান্ডের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। জুবাল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আহমেদ মাদোবে জুবাল্যান্ডের উপর মোগাদিশুর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার অভিযোগ করে আসছেন। কেনিয়ার অভ্যন্তরে আল শাবাবের হামলা বন্ধে কেনিয়া জুবাল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাদোবের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। জুবাল্যান্ডের একজন মন্ত্রীকে মোগাদিশু সরকার বিভিন্ন অপরাধের কারণে গ্রেপ্তার করতে চাইছে; কিন্তু কেনিয়া সরকার তাকে আশ্রয় দিয়েছে। এছাড়াও দুই দেশের সমুদ্রসীমা নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সোমালিয়া ভারত মহাসাগরের উপকূলে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে সচেষ্ট হওয়ায় তা কেনিয়ার সাথে সম্পর্ককে টানাপোড়েনের মাঝে ফেলেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ওমর মাহমুদ বলছেন যে, জুবাল্যান্ডের অনেক রাজনীতিবিদই মোগাদিশুতে ফেরার আগে নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে নাইরোবিকে ব্যবহার করেছেন। সোমালিয়া কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে কেনিয়ার নীতির পরিবর্তন ঘটাতে চাইছে। তবে তিনি বলছেন যে, সোমালিয়াতে কেনিয়ার সেনাদের অবস্থানের ব্যাপারটা এখনও অনিশ্চিত। যদি কেনিয়ার সেনা প্রত্যাহারের কথা ওঠে, তবে সেটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।

সোমালিয়ার পশ্চিমে রয়েছে ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়াতে তিগ্রে অঞ্চলের বিদ্রোহীদের সাথে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ; যা দীর্ঘায়িত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় সোমালিয়াতে ইথিওপিয় সেনাদের অবস্থান শংকার মাঝে পড়তে পারে। ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর ডিরেক্টর ভানডা ফেলবাব ব্রাউন এক লেখায় বলছেন যে, সোমালিয়ার সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বহু বছর ট্রেনিং দেবার পরেও গোত্রভিত্তিক বাহিনীই রয়ে গেছে; আল শাবাবের বিরুদ্ধে যাদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা যথেষ্টই কম। একারণে সোমালিয়ার নিরাপত্তার জন্যে ইথিওপিয়ার সেনাদের গুরুত্ব অনেক। যদিও ২০১৬ সালের পর থেকে ‘আমিসম’এর সেনারা কোন বড় আক্রমণে না গিয়ে গ্যারিসনে বসে সময় কাটিয়েছে, তথাপি এই সেনাদের উপস্থিতি সোমালিয়ার মিলিশিয়াদেরকে শক্তি যোগায়। তিগ্রে অঞ্চলে ইথিওপিয় সরকারের অভিযান শুরুর পর থেকে সোমালিয়াতে অবস্থানরত ইথিওপিয় সেনাদের মাঝে তিগ্রেদের নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। ফেলবাব ব্রাউন বলছেন যে, তিগ্রে অঞ্চলের সংঘাত আরও গভীর হলে এবং ইথিওপিয়া সরকার তিগ্রেদের দমন করতে যদি সোমালিয়া থেকে সেনা হ্রাস করতে উদ্যত হয়, তবে ‘আমিসম’এর নিরাপত্তা সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। তদুপরি, ইথিওপিয়া সেনা সরিয়ে নিতে চাইলে জিবুতি, উগান্ডা এবং বুরুন্ডির মতো দেশগুলিও তাদের সেনা সরিয়ে নিতে চাইতে পারে। ২০২১ সালে ‘আমিসম’এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা নবায়ন করা হবে কিনা, তা নির্ভর করছে ইথিওপিয়ার অংশ নেবার উপর। তবে কেনিয়ার ভূমিকার মতো ইথিওপিয়ার ভূমিকা মোগাদিশু সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী নয়। সোমালিয়ার স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যগুলির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ইথিওপিয় সেনারা সরাসরি সহায়তা করেছে। এমনকি জুবাল্যান্ডের নির্বাচনের সময় কেনিয়ার সেনাদের সাথে প্রায় সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছিল ইথিওপিয় সেনারা। এর মূল কারণ ইথিওপিয়াও সোমালিয়ার মতো ফেডারেল রাষ্ট্র এবং সোমালিয়াতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ইথিওপিয়ার জন্যে খারাপ উদাহরণ।

 
সোমালি সেনারা ‘ক্যাম্প তুর্কসোম’এ ট্রেনিং নিচ্ছে। তুর্কিরা সোমালিয়ার মাঝে একটা সামরিক সংস্কৃতি তৈরি করতে চাচ্ছে; যার মাধ্যমে কৌশলগত ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে তারা একটা সত্যিকারের বন্ধু পাবে।


সোমালিয়ায় বাড়ছে তুরস্কের প্রভাব

সোমালিয়ার বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ সোমালিয়াতে তুর্কি রাষ্ট্রদূতের কাছে এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, তারা জানতে পেয়েছেন যে তুরস্ক সোমালিয়ার স্পেশাল পুলিশ ফোর্স ‘হারমাআদ’এর জন্যে ১ হাজার ‘জি৩’ এসল্ট রাইফেল এবং দেড় লক্ষ বুলেট সরবরাহ করছে। চিঠিতে তারা বলেন যে, সোমালিয়ার নির্বাচনের আগে সংবেদনশীল সময়ে এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আসাতে তারা চিন্তিত। সোমালিয়ার ‘ওয়াদাজির’ পার্টির চেয়ারম্যান আব্দিরাহমান আব্দিশাকুর ওয়ারসামি ‘রয়টার্স’এর কাছে এই চিঠির সত্যতা স্বীকার করেন। চিঠিতে তারা আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট মোহামেদ আব্দুল্লাহি মোহামেদ ইতোমধ্যেই ভীতি প্রদর্শন এবং আঞ্চলিক নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে ‘হারমাআদ’কে ব্যবহার করেছেন; কাজেই নিঃসন্দেহে সেই একই ‘হারমাআদ’ এবং তুর্কি অস্ত্র আসন্ন নির্বাচনকে হাইজ্যাক করতে ব্যবহৃত হবে। তারা এই অস্ত্রের চালান নির্বাচনের পর দেয়ার জন্যে তুরস্ককে অনুরোধ জানান। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহি মোহামেদের সরকারের সাথে তুরস্কের বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক চলছে। তুরস্কের অর্থায়নে সোমালিয়াতে হাসপাতাল, স্কুল এবং অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও সোমালি ছাত্রদের তুরস্কে পড়াশোনার জন্যে স্কলারশিপের ব্যবস্থাও করেছে তুরস্ক। কিন্তু তুর্কিদের সাথে সোমালিদের এই সখ্যতা আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে পড়ে গেছে; যেখানে একপক্ষে রয়েছে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত, আর অপরপক্ষে রয়েছে তুরস্ক ও কাতার।

তুরস্কের সরকারি বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে সামরিক ঘাঁটি ‘তুর্কসোম’এর সরেজমিন বর্ণনা দেয়া হয়। সেখানে সোমালি সেনাদেরকে তুর্কি ভাষা পড়তে, লিখতে এবং বলতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থী সেনারা তুরস্কের মিলিটারি একাডেমিতে যে সামরিক সঙ্গীত গাওয়া হয়, সেই সঙ্গীত গায়। এমনকি সেনাদের খাবার পরিবেশন করেন তুর্কি বাবুর্চি, যিনি তুর্কি খাবারই পরিবেশন করেন সোমালি সেনাদের জন্যে। সেনারা প্রশিক্ষণের জন্যে যে অস্ত্র ব্যবহার করছে, তা হলো তুর্কি সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত ‘এমপিটি ৭৬’ রাইফেল। সোমালি প্রশিক্ষণার্থী সেনা হাসান আব্দুল্লাহ আহমেদ বলেন যে, ৫’শ বছর আগে অটোমান সাম্রাজ্যের মতোই তুর্কি ভাইরা সোমালিদের জন্যে দরজা খুয়ে দিয়েছে। সারা দুনিয়া যখন সোমালিদের সামনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন তুর্কি ভাইরাই সোমালিদের হিসেব ছাড়া সহায়তা দিয়েছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তুরস্ক প্রায় আড়াই হাজার সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় তুর্কি বিশ্লেষক ক্যান কাসাপোগলু বলছেন যে, তুরস্ক ‘তুর্কসোম’ ঘাঁটির মাধ্যমে ১০ হাজার সেনাকে ট্রেনিং দিতে চাচ্ছে, যারা তৈরি করবে তুর্কি ভাষাভাষী সোমালি সেনাবাহিনী। স্পেশাল ফোর্সের ট্রেনিংএর জন্যে এই সেনাদেরকে তুরস্কেও পাঠানো হচ্ছে। তুর্কিরা সোমালিয়ার মাঝে একটা সামরিক সংস্কৃতি তৈরি করতে চাচ্ছে; যার মাধ্যমে কৌশলগত ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে তারা একটা সত্যিকারের বন্ধু পাবে।

সোমালিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান কে নেবে?

যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছে না। জিবুতি এবং কেনিয়াতে মার্কিন ঘাঁটিগুলি থেকে যাবে। তবে সোমালিয়াতে মার্কিন অবস্থানকে কে প্রতিস্থাপন করবে, সেটা নিয়েই হবে আলোচনা। তুরস্ক সোমালিয়াতে সেই অবস্থানটা নেবার চেষ্টাতেই সেখানে সামরিক ঘাঁটি ছাড়াও বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছে। ক্যান কাসাপোগলু বলছেন যে, তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে তার সামরিক ঘাঁটি তৈরি করছে; যেমন লিবিয়া। সোমালিয়া যেহেতু বাব এল মান্ডেব প্রণালী এবং আদেন উপসাগর দিয়ে যাওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের উপর অবস্থিত, তাই সেখানে তুরস্ক তার অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু লিবিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে যে, এর ফলে তুরস্ককে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করতে হবে। আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে যে, তাদের নীতির মাধ্যমে তারা সোমালিয়ার ফেডেরাল রাজ্যগুলিকে, বিশেষ করে উত্তরের সোমালিল্যান্ড এবং পুন্টল্যান্ডকে সোমালিয়া থেকে আলাদা করে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। অপরদিকে সোমালিয়ার নিরাপত্তায় কয়েক হাজার সেনা মোতায়েনের পরেও কেনিয়া মোগাদিশু সরকারের বন্ধু হতে পারেনি। সোমালিয়ার সাথে কেনিয়ার সীমান্তে একটা বাফার বাজ্য তৈরি করার চেষ্টায় কেনিয়া সরকার জুবাল্যান্ড রাজ্যের সাথে আলাদাভাবে সখ্যতা তৈরি করেছে। হাইড্রোকার্বনে পূর্ণ সমুদ্রসীমা নিয়েও বিরোধ রয়েছে তাদের মাঝে। একইসাথে আমিরাতের নীতি অনুসরণ করে সোমালিল্যান্ডকেও আলিঙ্গন করেছে কেনিয়া। এক্ষেত্রে সোমালিয়ার বন্ধু থেকেছে ইথিওপিয়া; যারা নিজেদের ফেডেরাল অবস্থার কথা চিন্তা করে সোমালিয়ার ফেডারেশন টিকিয়ে রাখতে সরাসরি সহায়তা দিয়েছে। একারণেই ইথিওপিয়ার তিগ্রে অঞ্চলের গৃহযুদ্ধ সোমালিয়ার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ১৪ বছর মার্কিন এবং ইউরোপিয় সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা সত্ত্বেও সোমালিয়ার যুদ্ধ শেষ হয়নি। বরং বিস্তর অঞ্চল এখনও আল শাবাবএর দখলে; এখনও সোমালিয়ার নেতৃবৃন্দ নিরাপদে ঘোরাফিরা করতে অক্ষম। এমতাবস্থায় তুরস্ক মোগাদিশু সরকারের পিছনে বিনিয়োগ করছে। তুরস্কের জাতীয় আকাংক্ষা তুরস্ককে অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন অব আফ্রিকা’তে টেনে এনেছে। সোমালিয়াতে শক্তিশালী অবস্থান মানেই ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরে স্থায়ী উপস্থিতির একটা সুযোগ। আল শাবাব, আমিরাত এবং কেনিয়ার সাথে সোমালিয়ার দ্বন্দ্বকে তুরস্ক সুযোগ হিসেবেই নিয়েছে; যদিও এই সুযোগ কাজে লাগানো বেশ কঠিন কাজ।

Tuesday 22 December 2020

‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’... নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার শুরু?

২২শে ডিসেম্বর ২০২০

‘ফেইস রেকগনিশন’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে চীনে ‘সোশাল রেটিং’ বা ‘সোশাল ক্রেডিট’এর যে ব্যবহার শুরু হয়েছে, তা চীনাদেরকে ‘এআই’ ডেভেলপমেন্টে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠির দৈনন্দিন জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ডে প্রযুক্তির ব্যবহার একটা নৈতিক প্রশ্নের অবতারণা করেছে, যা বিশ্বকে বিভাজিত করছে।


মার্কিন বিমান বাহিনী বলছে যে, গত ১৫ই ডিসেম্বর তারা প্রথমবারের মতো একটা সামরিক বিমানের কোপাইলট হিসেবে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এআই’, অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করেছে। বিমান বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ডিজিটাল যুগে তাদের জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে একটা বড় ধাপ এগিয়েছে। মার্কিনীরা মনে করছে যে, ‘এআই’এর ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির সাথে এগিয়ে থাকার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিমান বাহিনীর ‘এয়ার কমব্যাট কমান্ড ইউ ২ ফেডেরাল ল্যাবরেটরি’র গবেষকেরা ‘আরটাম’ নামের এই এলগোরিদম ডেভেলপ করে। মার্কিন বিমান বাহিনীর বরাত দিয়ে ‘সিএনএন’ বলছে যে, একটা মহড়ার মাঝে বিমান বাহিনীর ‘ইউ ২’ কৌশলগত গোয়েন্দা বিমানে এই পরীক্ষা সফলভাবে চালনা করা হয়, যেখানে ‘এআই’ একজন মানুষের জন্যে বরাদ্দকৃত কাজগুলি সম্পাদন করে। বিমান চালনার কর্মকান্ডের মাঝে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সেন্সরগুলি পরিচালনা এবং ট্যাকটিক্যাল ন্যাভিগেশন বা দিকনির্দেশনার কাজগুলি ‘আরটাম’ সম্পাদন করে। অপরপক্ষে বিমানের মূল পাইলট খেয়াল রাখছিলেন যে কোন শত্রু বিমান এসে পড়ে কিনা। বিমান বাহিনীর ক্রয় পরিদপ্তরের সহকারি সচিব উইল রোপার এক বার্তায় বলেন যে, ‘এআই’এর সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে ব্যর্থতা মানেই হলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হার স্বীকার করে নেয়া।

‘এআই’এর সাথে পশ্চিমা স্বাধীনচেতাদের দ্বন্দ্ব

‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর বহু খাত প্রতিদিনই খুলছে, যা মাত্র কিছুদিন আগেই ছিলই না। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে ‘এআই’এর ব্যবহার ব্যাপক বেড়ে গেছে। সিয়াটলের সফটওয়্যার কোম্পানি ‘রিয়েল নেটওয়ার্কস’ একটা ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা বিভিন্ন বাণিজ্যিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে মাস্ক পড়ার বাধ্যবাধকতা মনে করিয়ে দেবে। ‘মাস্ক চেক’ নামের ‘এআই’ ভিত্তিক এই ব্যবস্থা প্রথমে একটা ট্যাবলেটের ক্যামেরা ব্যবহার করে নিশ্চিত করে যে, এর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মানুষটা মাস্ক পড়েছে কিনা অথবা সঠিকভাবে সেটা মুখের উপর লাগিয়েছে কিনা; যেমন, মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকলেও নাক বের হয়ে আছে কিনা। এরপর দরকার অনুযায়ী এই ব্যবস্থাটা সতর্কবার্তা দেবে এবং সঠিকভাবে মাস্ক পড়ার নিয়ম দেখিয়ে দেবে। ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘রিয়েল নেটওয়ার্কস’এর চিফ টেকনলজি অফিসার রেজা রাসুল বলছেন যে, এই ‘এআই’ প্রকৃতপক্ষে মানুষের চেহারা বিশ্লেষণ করে পরিচয় খুঁজে না বা কোনকিছু রেকর্ড করে না। তবে এর ব্যবহারকারী চাইলে ব্যক্তির ছবি তুলে তা আরও কিছু সেবা দিতে সক্ষম। যেমন মানুষের বয়স এবং লিঙ্গ বোঝার মাধ্যমে তা তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম, যার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা সম্ভব যে, কো ধরণের মানুষের মাঝে মাস্ক পড়ার প্রচলন কেমন। তবে ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এখানেই আসল আলোচনার বিষয়টা চলে আসছে। এই ব্যবস্থায় যত বেশি তথ্য রেকর্ড করার ব্যবস্থা করা হবে, ততটাই তা একটা পুলিশ রাষ্ট্রের কথা মনে করিয়ে দেবে। এছাড়াও ‘মাস্ক চেক’ ব্যবস্থার মাঝে না থাকলেও কেউ কেউ ইতোমধ্যেই চিন্তা করছেন যে, এর মাঝে একটা অপশন থাকতে পারে, যার মাধ্যমে মুখে মাস্ক না থাকলে ‘এআই’ ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় দরজা আটকে দিয়ে প্রতিষ্ঠানে ঢোকার পথে বাধা প্রদান করবে। সেকুলার আদর্শের পশ্চিমা স্বাধীনচেতা সমাজে অনেকেই চান না যে, সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান তাদেরকে বাধ্য করুক মাস্ক পড়তে। চীনে 'ফেইস রেকগনিশন' প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই মানুষের ব্যক্তিগত কর্মকান্ডের উপর নজরদারি করার কথা আলোচনায় এসেছে। আপাততঃ পশ্চিমা সেকুলার আদর্শের সাথে খুব সামান্য ব্যবধান রেখে চলছে ‘এআই’। তবে পশ্চিমা সমাজের অধঃগামিতা অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে, যা ‘এআই’এর ক্ষেত্রকে আরও বাড়াচ্ছে। নিরাপত্তার কথা বলে পশ্চিমা বিশ্বেও অনেকেই চীনাদের মতো না হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘ফেইস রেকগনিশন’ প্রোগ্রামের ব্যবহার করতে ইচ্ছাপোষণ করছেন।
ডিসেম্বর ২০২০। মনুষ্যবিহীন ‘এআই’ চালিত ড্রোন ‘ভ্যালকাইরি’র সাথে ফর্ম্যাশন ফ্লাইটে মার্কিন বিমান বাহিনীর মনুষ্য চালিত ‘এফ৩৫’ এবং ‘এফ২২’ যুদ্ধবিমান। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর সবচাইতে জটিল কাজগুলি হচ্ছে প্রতিরক্ষা শিল্পে। ‘এআই’ বর্তমানে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে একটা নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে।



‘এআই’এর আসল ক্ষেত্র হলো প্রতিরক্ষা

‘জাপান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক সেক্টর প্রতি বছর ‘এআই’এর পিছনে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। তবে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর সবচাইতে জটিল কাজগুলি হচ্ছে প্রতিরক্ষা শিল্পে। ‘বিজনেস ওয়্যার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডিফেন্স প্ল্যাটফর্ম’ বা ‘এআইডিপি’ নামের একটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এন্ডি খাজা ‘বিজনেস ভিউ’ ম্যাগাজিনের ২০২০ সালের সেরা উদ্যোক্তা হয়েছেন। ‘এআইডিপি’র কর্মকান্ডের পরিধি হলো প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ। কোম্পানিটা তাদের কাজকে কেন্দ্রীভূত করেছে ‘ইসাবেলা’ নামের একটা ‘এআই’ ডেভেলপ করার পিছনে। কোম্পানির ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, ‘ইসাবেলা’ ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থেকে ওপেন সোর্স তথ্য পড়ছে এবং জমিয়ে রাখছে। এর মাধ্যমে প্রোগ্রামটা বিভিন্ন ভাষার তথ্য থেকে শিখবে। এই প্রোগ্রামটার তথ্য সংরক্ষণের কোন সীমা নেই। অন্যান্য প্রযুক্তি এবং যন্ত্র ‘ইসাবেলা’র সাথে যুক্ত হয়ে এর প্রসেসিং ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারবে। ২০২৫ সালে ‘ইসাবেলা’কে তারা সবার সন্মুখে উন্মোচন করবে বলে বলছেন এন্ডি খাজা।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার ‘এআই’এর পিছনে ব্যাপক বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর ২০১১ সালে যেখানে ‘এআই’, ‘বিগ ডাটা’ এবং ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’এর পিছনে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল, তা ২০১৬ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের একটা মেমোর মাধ্যমে ‘প্রজেক্ট ম্যাভেন’ নামের একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট ‘গুগল’এর ডেভেলপ করা ‘এলগোরিদমিক ওয়ারফেয়ার’ নামে পরিচিত এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ড্রোনগুলির পাঠানো ভিডিও চিত্র থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বস্তুর পরিচয় বের করার ব্যবস্থা করা হয়। এতে কোন মানুষের সরাসরি সংযুক্তি ছাড়াই মাঠ পর্যায়ের ইন্টেলিজেন্স পাচ্ছে সামরিক বাহিনী। মার্কিন বিমান বাহিনী গত ৯ই ডিসেম্বর সফলভাবে মনুষ্যবিহীন স্টেলথ ড্রোন ‘এক্সকিউ ৫৮এ ভ্যালকাইরি’র ‘এআই’ চালিত ফ্লাইটের পরীক্ষা চালিয়েছে। পরীক্ষায় মানুষ চালিত ‘এফ২২’ এবং ‘এফ৩৫’ যুদ্ধবিমানের সাথে সমন্বয় করে ‘ভ্যালকাইরি’ ড্রোনটা ফর্ম্যাশন ফ্লাইট চালনা করে। মার্কিন নৌবাহিনীও ‘এআই’এর ব্যবহারে বেশ এগিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী সাবমেরিনের পিছু নেবার জন্যে ‘সী হান্টার’ নামের একটা মনুষ্যবিহীন যুদ্ধজাহাজ তারা তৈরি করে ২০১৬ সালে। ৪০ মিটার লম্বা এবং মাত্র ১’শ ৪৫ টন ওজনের এই জাহাজ টানা ৭০ দিন সমুদ্রে টহল দিতে পারে এবং একবার জ্বালানি নিয়ে প্রায় ১০ হাজার নটিক্যাল মাইল চলতে সক্ষম। মানুষ না থাকার ফলে জাহাজটা সমুদ্রে দিনের পর দিন টহল দেবার ধকল খুব সহজেই সামলে নেবে। জাহাজ পরিচালনার কাজগুলি ‘এআই’ করবে। তবে একজন মানুষ খেয়াল রাখবে এবং শুধু সিদ্ধান্ত দেবার ব্যাপারটা দেখবে। নেভাল ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক এইচ আই সাটন গত সেপ্টেম্বরে ‘ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় চীনা সোশাল মিডিয়া ‘উইয়েবো’তে পোস্ট করা একটা ছবির বরাত দিয়ে বলেন যে, মার্কিন ‘সী হান্টার’ প্রকল্পের কপি হিসেবে চীনারাও একটা মনুষ্যবিহীন যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছে।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় বলা হয় যে, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বর্তমানে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে একটা নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে। আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার জন্যে মার্কিন স্পেশাল অপারেশনস কমান্ডএর কমান্ডার জেনারেল রিচার্ড ক্লার্ক সেনাদের মাঝে ডাটা সাইন্টিস্ট, কোডার এবং মিড লেভেল ম্যানেজার ডেভেলপ করার কথা বলেন। তিনি বলেন যে, ‘এআই’তে বিনিয়োগ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথই খোলা নেই। তবে কেউ কেউ বলছেন যে, ‘এআই’ ডেভেলপ করতে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে। গত বছর ‘ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট’এর এক আলোচনায় মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল ব্রায়ান লুজি বলেন যে, নিজেদের ক্রয় পরিদপ্তরের জটিলতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তুলনায় ‘এআই’ ডেভেলপ করার ব্যাপারে পিছিয়ে আছে।

‘বস্টন কলেজ’এর প্রফেসর থমাস ড্যাভেনপোর্ট ‘মার্কেট ওয়াচ’এর এক লেখায় বলছেন যে, চীন যখন নিজেদের ‘এআই’ কৌশলকে বাস্তবায়নে নেমেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলের ব্যাপারেই এখনও নিশ্চিত নয়। চীনারা সাম্প্রতিক সময়ে ‘এআই’এর পিছনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশা করছে। প্রতিরক্ষা এবং ইন্টেলিজেন্সসহ জনগণের উপর সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও চীনারা ‘এআই’ ব্যবহারে পিছপা হচ্ছে না। ‘ফেইস রেকগনিশন’ ব্যবহার করে রাস্তায় নিয়ম ভঙ্গকারীকে পাকরাও করা এবং মানুষের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাকে ‘সোশাল ক্রেডিট’ বা ‘সোশাল রেটিং’ করার ব্যাপারে চীনারা বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। অপরদিকে ‘এআই’এর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর ছাড়া বাকি গবেষণাগুলি হচ্ছে মূলতঃ বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টরে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট সেক্টর গবেষনার পিছনে ৫৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যার অনেকটাই গিয়েছে ‘এআই’ খাতে। তবে এই গবেষণার একটা বড় অংশ গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে; বিশেষতঃ চীনে। ব্যক্তির কর্মকান্ডের সাথে মিল রেখে বিজ্ঞাপন দেয়া, সার্চ ইঞ্জিনের ফলাফল উন্নত করা, মানুষের চেহারা খুঁজে বের করা এবং তাদের লেবেলিং করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্মার্ট পণ্য উৎপাদনের পিছনে এই গবেষণা গিয়েছে। তদুপরি ড্যাভেনপোর্ট মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ‘এআই’ প্রযুক্তিতে চীনের থেকে এগিয়ে আছে; তবে চীনারা সরকারিভাবে যেভাবে উঠেপরে লেগেছে, তাতে ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি উল্টে যেতে পারে। 


মার্কিন নৌবাহিনীর ডেভেলপ করা ‘এআই’ চালিত মনুষ্যবিহীন জাহাজ ‘সী হান্টার’কে কপি করেছে চীনারা। ‘এআই’ এখন এমন এক প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে চলেছে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা এগিয়ে থাকার মাঝেই নিজেদের অস্তিত্বকে দেখতে পাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিযোগিতায় নৈতিকতা হতে চলেছে দ্বিতীয় সাড়ির চিন্তা।



‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় ‘এআই’এর ভবিষ্যৎ কি?

মার্কিন সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার জয়েন্ট চিফস অব স্টাফএর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মাইলি কিছুদিন আগেই ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এ কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, বেসামরিক সমাজিক ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ছাড়াও সামরিক ক্ষেত্রে ‘এআই’এর ব্যবহার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মাঝে যেসকল সামরিক দ্বন্দ্ব হবার সম্ভাবনা থাকবে, তাতে ‘এআই’ এবং রোবোটিক্সএর অনেক বড় ভূমিকা থাকবে; এমনকি বেশিরভাগ সামরিক বাহিনীতেই হয়তো রোবোটের ব্যাপক ব্যবহার থাকবে। ২০২০এর শুরুতে পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনারা ‘এআই’কে ভবিষ্যতের সামরিক এবং শিল্প শক্তির অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছে। জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে বেইজিং ‘এআই’এর উপর বিশ্বব্যাপী কৌশলগত বিনিয়োগ করছে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত পাঁচ বছরে চীন ‘এআই’ ব্যবহার করে মনুষ্যবিহীন জাহাজ তৈরি করেছে, যা ব্যবহার করে দক্ষিণ চীন সাগর তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে চীনারা নিজেদের ভৌগোলিক দাবিগুলিকে সমুন্নত রাখতে চাইছে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর জন্যে মনুষ্যবিহীন ট্যাঙ্কও তারা ডেভেলপ করেছে।

সকলেই বুঝতে পারছেন যে, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বিশ্ব আরও অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে। গত ১৮ই ডিসেম্বর চীনের শিংহুয়া ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত এক ফোরামে চীনের প্রাক্তন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফু ইয়িং বলেন যে, ‘এআই’এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের একত্রে বসে কিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম তৈরি করতে হবে, যা কিনা ‘এআই’ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হবে। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে চীনা প্রতিনিধি হিসেবে ফু ইয়িং এবং মার্কিং প্রতিনিধি হিসেবে থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর প্রেসিডেন্ট জন এলেন ‘এআই’এর সামরিক ব্যবহারের ব্যাপারে তিন দফা আলোচনা করেছেন। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কোন টার্গেটগুলি ‘এআই’ অস্ত্রের বাইরে থাকা উচিৎ, আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে এগুলির ব্যবহারের পরিসীমা, মানুষের দেখাশুনা, ইত্যাদি। উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে, ‘এআই’এর ডেভেলপমেন্টের গতি আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বগুলিকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেবে; আর এর মাধ্যমে সাধারণ বেসামরিক জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়েই ‘এআই’কে আরও নতুন ধরনের অস্ত্র হিসেবে ডেভেলপ করছে এবং একে অপরের এই প্রচেষ্টার উপর কড়া নজর রাখছে। ঠান্ডা যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতার মতো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা অসম্ভব নয়। বেশিরভাগ ‘এআই’ অস্ত্র এখনও ডেভেলপমেন্টের শুরুর দিকে রয়েছে। সামরিক বাহিনীর মাঝে ছড়িয়ে দেবার আগেই দুই দেশের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হওয়া উচিৎ বলে তারা মন্তব্য করেন। জন এলেন বলছেন যে, নিরাপত্তার ব্যাপারটা যদি চিন্তার শীর্ষে চলে যায়, তাহলে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকার লক্ষ্য ভবিষ্যতে বিপদ এড়ানোর পথকে বাধাগ্রস্ত করবে।
 

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক ভাষণে বলেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ হবে ড্রোনের মাঝে। এক রাষ্ট্রের ড্রোন যখন অপর রাষ্ট্রের ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করে ফেলবে, তখন যুদ্ধ বন্ধ করে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না। মানুষের দুর্বলতাগুলিকে অতিক্রম করে ‘এআই’ চালিত রোবোটের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার যে ভবিষ্যৎবাণী প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলি উচ্চারণ করছে, তাতে হত্যা করার সিদ্ধান্ত কি কোন যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে চলবে নৈতিক এবং আদর্শিক দ্বন্দ্ব।
 

হত্যা করার সিদ্ধান্ত কি যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিৎ?

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন যে, যে রাষ্ট্র ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’এর ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে, সে রাষ্ট্র দুনিয়া শাসন করবে। ‘এআই’এর ডেভেলপমেন্টের কারণে বিপুল সুযোগ এবং হুমকির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যা কিনা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ হবে ড্রোনের মাঝে। এক রাষ্ট্রের ড্রোন যখন অপর রাষ্ট্রের ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করে ফেলবে, তখন যুদ্ধ বন্ধ করে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না। পুতিন তার কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করেন ডিসেম্বরের শুরুতে ‘এআই জার্নি’ নামের এক অনলাইন কনফারেন্সে। তিনি বলেন যে, ‘এআই’ কোন ফ্যাশন নয় অথবা শুধুমাত্র গর্ব করার জন্যে তৈরির বিষয় নয়, যে তা সময়ের সাথে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে, যখন বড় রাষ্ট্র বা কর্পোরেট শক্তি প্রযুক্তির উন্নয়নের সময় ঘুমিয়ে ছিল; পরবর্তীতে রাতারাতি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেছে। তিনি সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ‘এআই’এর কারণে যেসব জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তা মানুষ আগে কখনোই দেখেনি। পুতিনের কথাগুলি ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার কথা যেমন মনে করিয়ে দেয়, তেমনি নতুন কিছু জটিলতার কথা সামনে আনে, যা এই প্রতিযোগিতা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। যেমন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে কিনা, যা মানুষের মৌলিক কোন চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক?

‘এআই’কে বলা হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাসে তৃতীয় বিপ্লব; এর আগের দু’টা ছিল গানপাউডার বা বারুদ এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি। অনেকেই বলছেন যে, ‘এআই’এর ব্যবহারে খুব শিগগিরই যুদ্ধক্ষেত্রে রোবোট সেনা দেখা যাবে। কিন্তু একটা যন্ত্রকে কতটুকু পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর একেক জন একেকভাবে দিচ্ছেন। মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবসায় অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা পামার লাকি ’ওয়েব সামিট’এর এক আলোচনায় প্রশ্ন করছেন যে, মানুষের জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত কি একটা যন্ত্রের কাছে ছেড়ে দেয়া উচিৎ? একটা যন্ত্রকে তো কোর্ট মার্শাল করা সম্ভব নয়। যন্ত্রকে যুদ্ধাপরাধের কারণে কারাগারে প্রেরণও সম্ভব নয়। লাকি মনে করছেন যে, ‘এআই’ ব্যবহারের মাধ্যমে ডাটা এনালিসিসের যে কাজগুলি একজন মানুষের পক্ষে করা কঠিন, তা করে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু কোন মানুষকে হতাহত করার সিদ্ধান্ত মানুষের হাতেই থাকা উচিৎ। তিনি এও মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও যাতে সেপথেই হাঁটে, তা নিশ্চিত করার জন্যে তাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করা দরকার। তবে পামার লাকির এই চিন্তাগুলি বাস্তবায়ন যে অতটা সহজ নয়, তা এখন নিশ্চিত।

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘পলসন ইন্সটিটিউট’এর প্রযুক্তি বিষয়ক উইং ‘মার্কোপোলো’র ফেলো ম্যাট শীহান ‘বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি একসময় বড় কাজগুলি ধরার জন্যে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্যে কাজ করেছে; এবং একইসাথে বড় বাজার হিসেবে চীনে কাজ করতে গিয়ে চীনা নেতৃত্বের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেছে। এভাবে কোম্পানিগুলি যখন বিপুল সম্পদের মালিক এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হয়ে যায়, তখন তারা নিজস্ব একটা সিভিল সোসাইটি তৈরি করে ফেলে। এই সোসাইটির চাপের মুখে অনেক সময়েই এই কোম্পানিগুলি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। মার্কিনীদের সাথে চীনাদের ‘গ্রেট পাওয়ার’ দ্বন্দ্বে নিজেদের ব্যবসা ধরে রাখতে এরা হিমসিম খাচ্ছে। ‘গুগল’ যদিও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত ‘প্রজেক্ট ম্যাভেন’ ডেভেলপ করেছিল, তথাপি ২০১৮ সালে ‘গুগল’এর ৩ হাজার কর্মী এর বিরুদ্ধে পিটিশন স্বাক্ষর করার পর কোম্পানি নৈতিকতার কথা বলে প্রকল্প থেকে বের হয়ে যায়। একই বছর ‘গুগল’ মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাউড কম্পিউটিং প্রকল্প ‘ জয়েন্ট এন্টারপ্রাইজ ডিফেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ বা ‘জেডাই’ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ‘গুগল’এর কর্মীরা প্রতিবাদ করার পর তারা ঘোষণা দেয় যে, এই প্রকল্প তাদের কর্পোরেট আদর্শের সাথে যায় না।

প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ই একসময় পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল। এখন ‘এআই’এর ক্ষেত্রেও এই প্রতিযোগিতাই সকল পক্ষকে গতিশীল করছে। বৈশ্বিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যখন কিছু কোডিং প্রোগ্রামের মাঝে চলে যাচ্ছে, তখন মাল্টিবিলিয়ন ডলারের সামরিক শক্তি দ্বিতীয় সাড়ির শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে। মানুষের দুর্বলতাগুলিকে অতিক্রম করে ‘এআই’ চালিত রোবোটের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার যে ভবিষ্যৎবাণী প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলি উচ্চারণ করছে, তাতে হত্যা করার সিদ্ধান্ত কি কোন যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে চলবে নৈতিক এবং আদর্শিক দ্বন্দ্ব। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিযোগিতায় আদর্শিক অবস্থান কতটা শক্তভাবে ধরে রাখা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। একারণেই কেউ কেউ চাইছেন, প্রতিযোগিতা ঠান্ডা যুদ্ধে রূপ নেবার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের আলোচনার মাধ্যমে ‘এআই’এর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করা। তবে সেখানেও কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তথা পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক দুর্বলতার সুযোগ না নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি, বিশেষতঃ চীন এবং রাশিয়া, আলোচনার প্রতি কতটা আগ্রহী হবে? নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় নৈতিকতা যখন দ্বিতীয় সাড়ির চিন্তায় রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন মানবজাতি এমন এক মহাবিপদের মাঝে পড়তে যাচ্ছে, যা থেকে বের হবার কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান বর্তমান বিশ্বের সেকুলার রাজনৈতিক চিন্তার মাঝে নেই।

Saturday 19 December 2020

আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সোশাল মিডিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়েছে ফ্রান্স ও রাশিয়া

২০শে ডিসেম্বর ২০২০ 

 ফেইসবুকের এই ব্যবস্থা গ্রহণে রুশ অপারেশন বেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, তবে একইসাথে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে দুর্বল হওয়া ফ্রান্সের অনৈতিক অবস্থানও জনসন্মুখে এসে গেল। এতে শুধু ফ্রান্সই ইমেজ সংকটে পড়েনি, গণতন্ত্রের ঝান্ডাবাহী পশ্চিমা লিবারাল চিন্তার দেশগুলি আফ্রিকার প্রাক্তন উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনভাবে চলতে দেবার বেলায় কতটা লিবারাল, তা আরও একবার প্রকাশ পেল।

গত ১৫ই ডিসেম্বর সোশাল মিডিয়া কোম্পানি ফেইসবুক ঘোষণা দেয় যে, তারা বেশকিছু একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে, যেগুলির রুশ এবং ফরাসি সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রয়েছে। অভিযোগে বলা হয় যে, এসব একাউন্ট থেকে ভুয়া আইডির মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, প্রথমবারের মতো ফেইসবুক কোন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ থাকা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো। ফেইসবুক রুশ যে গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, তারা ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে জড়িত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। ফেইসবুক বলছে যে, মোট ২’শ ৭৪টা একাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে; সাথে এদের দ্বারা চালিত বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেইজ ছাড়াও ‘ইন্সটাগ্রাম’ একাউন্টও রয়েছে। ‘ইন্সটাগ্রাম’ হলো একটা ছবি শেয়ারিং ওয়েবসাইট, যা ফেইসবুক ২০১২ সালে ১ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। এক সংবাদ সন্মেলনে ফেইসবুকের কর্মকর্তারা বলেন যে, এই অপারেশনগুলি সবচাইতে বেশি টার্গেট করেছে পশ্চিম আফ্রিকার মালি এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিককে। এছাড়াও বুরকিনা ফাসো, নিজের, আলজেরিয়া, আইভোরি কোস্ট এবং শাদ কমবেশি আক্রান্ত হয়েছে। নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ গ্রুপ ‘গ্রাফিকা’ বলছে যে, ফেইসবুকের এহেন ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো তৃতীয় কোন রাষ্ট্রে দু’টা প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার চিত্র ফুটে উঠলো। আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রভাব বিস্তারের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুধু ফেইসবুকই নয়, টুইটার, ইউটিউব এবং বিভিন্ন আর্টিকেলের মাঝেও দেখা যাচ্ছে। ‘গ্রাফিকা’র চিফ ইনোভেশন অফিসার ক্যামিল ফ্রাঁসোয়া বলছেন যে, যখন গণতান্ত্রিক সরকারগুলি মিথ্যা বানোয়াট খবর প্রচারে মনোনিবেশ করে, তখন তাদের জন্যে নিজেদের দেশে অন্য কারুর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে নিন্দা করাটা কঠিন হয়ে যায়।

বন্ধ করা ফরাসি একাউন্টগুলির মাঝে রয়েছে ৮৪টা ফেইসবুক একাউন্ট, ১৪টা ‘ইন্সটাগ্রাম’ একাউন্ট এবং কতগুলি ফেইসবুক গ্রুপ ও পেইজ। এদের প্রায় হাজার পাঁচেক ফলোয়ার ছিল। ফরাসিরা আফ্রিকান মানুষের ভুয়া বেশ ধরে ফরাসি এবং আরবি ভাষায় আফ্রিকায় ফ্রান্সের নীতি, সেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আফ্রিকার নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা, ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও আফ্রিকায় প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলিতে ফরাসি সামরিক বাহিনীর কর্মকান্ডের পক্ষে পোস্ট দিচ্ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির জনগণকে টার্গেট করা একটা ফেইসবুক পোস্টে বলা হয় যে, ‘মালির জন্যে রুশ সাম্রাজ্যবাদীরা হলো গ্যাংগ্রিনের মতো! জারিস্ট ব্রেইনওয়াশ থেকে সাবধান থাকুন!’ ফেইসবুক বলছে যে, যদিও এই একাউন্টগুলি নিজেদের পরিচয় এবং সমন্বয় গোপন করতে চাইছিল, তথাপি তাদের তদন্তে পাওয়া গেছে যে, এই ব্যক্তিদের সাথে ফরাসি সামরিক বাহিনীর যোগসাজস রয়েছে। ফেইসবুকের ব্যবস্থা নেবার পরদিন ফরাসি সরকার এই ঘটনায় তাদের নিজেদের জড়িত থাকার ব্যাপারে কোনকিছু না বলে শুধু বলে যে, আফ্রিকায় মিথ্যা বানোয়াট খবর মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, ফরাসি সরকার এই প্রতিবেদন খতিয়ে দেখছে। এই মুহুর্তে তারা কাউকে দায়ি করতে পারছেন না; বরং তারা বলছেন যে, যেহেতু অনেকগুলি পক্ষ এখানে জড়িত, তাই কাউকে নির্দিষ্ট করা কঠিন। তাদের পার্টনারদের সাথে ফ্রান্স আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

অপরপক্ষে রুশদের মূল লক্ষ্য ছিল সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ২৭শে ডিসেম্বরের আসন্ন নির্বাচন। একটা রুশ পোস্টে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফস্টিন আরশাঞ্জ তুয়াদেরার পক্ষ নিয়ে বলা হয় যে, শান্তির পক্ষে প্রেসিডেন্ট তুয়াদেরা যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তার কারণে পরবর্তী প্রজন্ম ভালো জীবন পাবে। রুশ নেটওয়ার্কগুলি রাশিয়ার ডেভেলপ করা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের পক্ষেও পোস্ট দেয়। বন্ধ করা রুশ একাউন্টগুলির প্রায় ৬০ লক্ষ ফলোয়ার ছিল। রুশরা লিবিয়ার রাজনৈতিক আলোচনাকে টার্গেট করে অপারেশন চালাচ্ছিল। লিবিয়ার এই ফেইসবুক পেইজগুলিতে ১৩ লক্ষ ফলোয়ার ছিল। এছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার গিনি উপকূলের দেশ ইকুয়েটোরিয়াল গিনিতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চলছে বলেও তথ্য ছড়ায় রুশরা। রুশরা অবশ্য সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে অন্য কোন দেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করার ব্যাপারটা সরাসরিই অস্বীকার করেছে। রুশ এবং ফরাসি নেটওয়ার্কগুলি একে অপরের পোস্টে কমেন্ট করছিল এবং একে অপরের ফ্রেন্ড লিস্টে ঢোকার চেষ্টা করছিল। তারা একে অপরকে ভুয়া একাউন্ট বলে অভিযোগ করছিল। ফেইসবুক বলছে যে, ২০১৭ সাল থেকে ফেইসবুক ১’শ নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থা নিয়েছে, যার মাঝে মাত্র একটাতে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করছিল। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যখন রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে মিথায় বানোয়াট তথ্য দিয়ে সোশাল মিডিয়া ভরিয়ে দেয়, তখন সাধারণ জনগণ এর শিকারে পরিণত হয়।

ফরাসি পত্রিকা ‘লে ওপিনিওন’এর এক লেখায় ফরাসি সাংবাদিক জঁ ডমিনিক মারশে ফরাসি সামরিক বাহিনীর এই ‘সমন্বিত ভুয়া কর্মকান্ড’র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, এধরণের কর্মকান্ড এতদিন রাশিয়ার কাছ থেকে আসতো; এখন ফরাসি সেনাবাহিনী এহেন কর্মকান্ডে জড়িয়েছে। ফরাসি পত্রিকায় সেদেশের সরকারের আফ্রিকা নীতি নিয়ে সমালোচনা করা হলেও এগুলি মূলতঃ ফ্রান্সের দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় নীতিরই ফলাফল। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে নিয়মিত সামরিক হস্তক্ষেপ করায় এমনিতেই ফরাসিরা ইমেজ সংকটে রয়েছে। তদুপরি ফ্রান্সের সামরিক হস্তক্ষেপের পর থেকে পশ্চিম আফ্রিকার মালি এবং আশেপাশের নিজের, বুরকিনা ফাসো, আইভোরি কোস্টে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার কারণে আফ্রিকায় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক নীতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আফ্রিকায় ফ্রান্সের এই দুর্বল অবস্থানের সুযোগ নিয়ে অন্যান্য প্রভাবশালী রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করতে চাইছে; ফেইসবুকে এই দ্বন্দ্ব সেই ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় সোশাল মিডিয়ার গুরুত্ব যে বাড়ছে, তা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির সুনির্দিষ্ট অপারেশনই বলে দিচ্ছে। ফেইসবুকের এই ব্যবস্থা গ্রহণে রুশ অপারেশন বেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, তবে একইসাথে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে দুর্বল হওয়া ফ্রান্সের অনৈতিক অবস্থানও জনসন্মুখে এসে গেল। এতে শুধু ফ্রান্সই ইমেজ সংকটে পড়েনি, গণতন্ত্রের ঝান্ডাবাহী পশ্চিমা লিবারাল চিন্তার দেশগুলি আফ্রিকার প্রাক্তন উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনভাবে চলতে দেবার বেলায় কতটা লিবারাল, তা আরও একবার প্রকাশ পেল।

Friday 18 December 2020

হ্যাকিং যুদ্ধ... প্রকাশ পাচ্ছে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার চেহারা

১৮ই ডিসেম্বর ২০২০
পাল্টাপাল্টি সাইবার হামলার এই নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় আইনের শাসন একটা কল্পনার বিষয়বস্তু। বিশাল সামরিক বাহিনী এবং সর্বোচ্চ সামরিক বাজেটও ডিজিটাল সম্পদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেবার জন্যে যথেষ্ট নয়।

গত ১৩ই ডিসেম্বর ‘রয়টার্স’ খবর দেয় যে, মার্কিন সরকারের বেশ কয়েকটা দপ্তর একটা বড় ধরনের সাইবার হ্যাকিংএর শিকার হয়েছে, যার মাঝে রয়েছে মার্কিন রাজস্ব দপ্তর, বাণিজ্য দপ্তরের অধীন ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন এন্ড ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশন’ এবং ‘ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’। এছাড়াও সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ‘ফায়ার আই’ও আক্রান্ত হয়েছে বলে বলা হয়। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, এই হ্যাকিংএর পিছনে রুশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসভিআর’এর হাত রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। ‘এপিটি২৯’ বা ‘কোজি বেয়ার’ নামের একটা হ্যাকার গ্রুপ কাজটা করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ন্যাটো, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ব্রিটিশ ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’, হোম অফিস, আঞ্চলিক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ডেভেলপার কোম্পানি ‘এসট্রাজেনেকা’, এমনকি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘জিসিএইচকিউ’ এই সফটওয়্যারের ব্যবহারকারী। প্রাথমিক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ‘সোলার উইন্ডস’এর ব্যবস্থাপনায় চালিত ‘ওরাইয়ন’ নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রায় ১৮ হাজার কম্পিউটার এই হ্যাকিংএর শিকার হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক এই দপ্তরগুলিতে কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে কেউ সুনির্দিষ্ট কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। ‘সোলার উইন্ডস’ হলো একটা সফটওয়্যার ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান, যারা মূলতঃ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা, আইটি সিস্টেম এবং অবকাঠামো নিয়ে কাজ করে থাকে। ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া এই ব্যবসার হেডকোয়ার্টার্স টেক্সাসের অস্টিনে এবং এর জনবল তিন হাজারের বেশি। ২০১৯ সালে কোম্পানিটা ৯’শ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করে। ‘মাইক্রোসফট সিকিউরিটি রেসপন্স সেন্টার’ বলছে যে, সফটওয়্যারের আপডেট করার সময়ই সন্তর্পণে হ্যাকাররা ব্যবহারকারীদের কম্পিউটারে ‘ম্যালওয়্যার’ ঢুকিয়ে দেয়। এরপর এই সুযোগে তারা খুব সম্ভবতঃ ব্যবহারকারীদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়। আপাতঃ ধারণায় বলা হচ্ছে যে, এই সাইবার হামলা খুব সম্ভবতঃ গত মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে মাসের পর মাস ধরে চলেছে। বলা হচ্ছে যে, এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচাইতে মারাত্মক সাইবার হামলার মাঝে একটা।

মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সামরিক ম্যাগাজিন ‘সিফোরআইএসআরনেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন সরকারি দপ্তরগুলিতে হ্যাকিংএর এই ঘটনার ফলে এটা পরিষ্কার হচ্ছে যে, বেসামরিক সরবরাহকারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সেবার উপর নির্ভরশীল থাকার ফলে প্রতিরক্ষা দপ্তর মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। সরকারি নির্দেশে বিভিন্ন দপ্তরগুলি যখন ‘সোলার উইন্ডস’এর ‘ওরাইয়ন’ সফটওয়্যার ব্যবহার থেকে সড়ে আসছে, তখন সামরিক বাহিনীতে এই সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। মার্কিন সেনা, নৌ, বিমান, ম্যারিন এবং স্পেস, সবগুলি বাহিনীই এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এছাড়াও পেন্টাগন এবং গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ বা ‘এনএসএ’ও এই সফটওয়্যারের ব্যবহারকারী। কি পরিমাণ তথ্য চুরি হয়েছে, অথবা তথ্যের গোপনীয়তা কি পর্যায়ে ছিল, তা এখনই নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।

হ্যাকাররা কি পেলো?

বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, সবচাইতে চিন্তার বিষয় হলো, সরকারি ইমেইল এবং তথ্য হ্যাকাররা অনেক লম্বা সময়ের জন্যে নাগালের মাঝে পেয়েছিল। ‘কার্নেগি ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর সাইবার পলিসি ইনিশিয়েটিভএর ফেলো জন বেইটম্যান মনে করছেন যে, বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী সংস্থাগুলিকে যখন সবচাইতে শক্তিশালী হ্যাকাররা আক্রমণ করছে, তখন যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় পেলে আক্রমণকারীরাই জয়ী হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তার সক্ষমতার পরিসীমাটা প্রকাশ পাচ্ছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ‘সাইবার স্টেটক্রাফট ইনিশিয়েটিভ’এর ডিরেক্টর ট্রে হার বলছেন যে, চুরি করা তথ্য হ্যাকারদের কাছে স্বর্ণখনির মতো হবে। মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতিগত দিকগুলি উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

‘বিজনেস ইনসাইডার’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনএসএ’এর প্রাক্তন হ্যাকার ডেভিড কেনেডি বলছেন যে, হ্যাকাররা এতটা কষ্ট করে মার্কিন নেটওয়ার্কের ভেতর এতটা সময় কাটিয়েছে; যার অর্থ হলো, তারা নিশ্চয়ই দামি কিছু পেয়েছে। তিনি বলেন যে, অন্য রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স সাধারণতঃ এরকম হ্যাকিংই চায়, কারণ এর মাধ্যমে তারা এমন শক্ত ইন্টেলিজেন্স পায়, যা সাধারণতঃ সহজে পাওয়া যায় না এবং সেই রাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতি সম্পর্কেও তারা জানতে পারে।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত সাইবার নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর টেকনলজি এন্ড সিকিউরিটি’র প্রধান ফিলিপ রেইনার মনে করছেন যে, তৃতীয় পক্ষের লেখা কোডের উপর মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এবং সরকারি দপ্তরগুলির ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা তাদেরকে সর্বদাই বিপদের মাঝে রাখবে। তিনি বলছেন যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের আসলে তৃতীয় পক্ষের তৈরি পণ্য এবং সেবার উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায়ই নেই। যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তারা এটা জানে এবং এটাকে তারা ব্যবহার করছে। এই অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হতে থাকবে বলে তিনি মনে করছেন। সাইবার নিরাপত্তা রেটিং এজেন্সি ‘বিটসাইট টেকনলজিস’এর ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যাকব ওলকট বলছেন যে, পুরো সামরিক বাহিনীতে বহু কর্মকান্ডকে এখন ‘সেবা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে; মনে করা হচ্ছে যে, এই ‘সেবা’গুলি তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে ক্রয় করা সম্ভব। মার্কিন সিনেটর এঙ্গাস কিং বলছেন যে, তিনি চিন্তা করতেই ভয় পাচ্ছেন যে, কতগুলি কোম্পানি মার্কিন সরকারকে বিভিন্ন পণ্য এবং সার্ভিস বিক্রি করছে। বর্তমানে শুধুমাত্র পেন্টাগনের সাথেই ব্যবসা করছে ৩ লক্ষ কোম্পানি!

যুক্তরাষ্ট্র এখন কি করবে?

নিরাপত্তা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক লেখায় মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ডিফেন্স প্রায়রিটিজ’এর ফেলো বনি ক্রিস্টিয়ান মত দিচ্ছেন যে, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রধানতম কাজগুলির একটা হওয়া উচিৎ সাইবার নিরাপত্তা। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন সরকারের অডিট রিপোর্টগুলি বলছে যে, নিরীক্ষণকারীরা খুব সাধারণ সরঞ্জামাদি ও কৌশল ব্যবহার করেই মার্কিন সামরিক বাহিনীর পরীক্ষাধীন থাকা অস্ত্রগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিল। তিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদকে অন্য দেশের উপর আক্রমণাত্মকভাবে ব্যবহার করে প্রতিশোধমূলক হামলা ডেকে না এনে বাইডেনের উচিৎ হবে নিজেদের সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালী করা।

তবে ১৭ই ডিসেম্বর মার্কিন হবু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বক্তব্যের মাধ্যমে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবার মুহুর্ত থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর কোন ধরনের হামলা হলে চুপচাপ বসে থাকবেন না। তিনি আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তিনি সরকারের সকল ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার বাধ্যতামূলক করবেন এবং বেসরকারি সরবরাহকারীদের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করা ছাড়াও সাইবার নিরাপত্তায় অবকাঠামো এবং জনবলের পিছনে বিনিয়োগ করবেন। তিনি আরও বলেন যে, তার সরকার এমন ব্যবস্থা নেবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পক্ষে এহেন কর্মকান্ড অনেক কঠিন হয়ে যায়। এই কাজগুলি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধু দেশগুলির সহায়তা নেবে। মার্কিন ডেমোক্র্যাট সিনেটর মিট রমনি ‘সিএনএন’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উচিৎ শক্ত কিছু বলা। তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন যে, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, একটা রুশ বোমারু বিমান যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ এবং দেশের রাজধানীর উপর দিয়ে উড়ে গেল; অথচ ট্রাম্প এসময় কিছুই করলেন না। রমনির কথাগুলি বুঝিয়ে দেয় যে, সাইবার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা ছাড়াও বাইডেনের সরকারের উপর এই সাইবার যুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবার জন্যে চাপ থাকবে।

পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় নিরাপত্তা এখন নতুন সংজ্ঞা নিচ্ছে। কম্পিউটার এবং সাইবার স্পেস এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র, যার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা। প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষয়ক্ষতি করতে এখন অপরের রাজধানী শহরের উপর বোমা ফেলতে হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, হামলা যে হয়েছে, সেটা বুঝে উঠতেই লেগে যাচ্ছে মাসের পর মাস। তদুপরি কে এটা করেছে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যেমন কঠিন, তেমনি হামলাকারীরা চুরি করা তথ্য কোথায় কিভাবে ব্যবহার করবে, সেটাও অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে। নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শক্তভাবে ব্যবস্থা নেবার কথা বললেও মার্কিন সরকার যখন বেসরকারি সেবা প্রদানকারীদের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে, তখন সরকারের সাথে কাজ করা লাখ লাখ মার্কিন কোম্পানির সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটা ততটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এহেন সাইবার সংঘাতের সম্ভাবনা দিনে দিনে বাড়তে থাকবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। হামলার পিছনে সন্দেহভাজন রুশ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে নিয়ে কথা হলেও মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের হ্যাকিং অপারেশন আলোচনায় আসছে কমই। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস করার পিছনে মার্কিন সাইবার ইন্টেলিজেন্সের হাত ছিল বলে খবরে এসেছে। পাল্টাপাল্টি সাইবার হামলার এই নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় আইনের শাসন একটা কল্পনার বিষয়বস্তু। বিশাল সামরিক বাহিনী এবং সর্বোচ্চ সামরিক বাজেটও ডিজিটাল সম্পদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেবার জন্যে যথেষ্ট নয়।

Tuesday 15 December 2020

তুরস্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের গভীর বিশ্বাসগত পার্থক্যকেই তুলে ধরে

১৫ই ডিসেম্বর ২০২০


২০১৯এর জুলাই। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের তিন বছরপূর্তিতে রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘এস ৪০০’এর তুরস্কে অবতরণ। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, তুরস্ক এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে ভবিষ্যতের অভ্যুত্থান ঠেকাতে। কিন্তু এই ব্যবস্থা ন্যাটোর অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের বিমানও টার্গেট করতে সক্ষম; যা তুরস্কের অন্য কোন ক্ষেপণাস্ত্র পারে না।


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজ ছাড়ার প্রায় শেষ মুহুর্তে এসে গত ১৪ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞার মাঝে পড়েছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা ক্রয় দপ্তর ‘প্রেসিডেন্সি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ এবং এর প্রধান ইসমাঈল দেমির সহ মোট চারজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এর ফলে তুরস্কের এই দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তি ক্রয়ের লাইসেন্স পাবে না। একইসাথে উল্লিখিত চারজন কর্মকর্তার যেসকল সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তা আটকে দেয়া ছাড়াও তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছিল, তার সর্বাগ্রে রয়েছে তুরস্কের রুশ ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এক বিবৃতিতে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহুবার সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুরস্ককে জানিয়েছে যে, ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের ফলে মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি এবং জনবল হুমকির মাঝে পড়বে। একইসাথে তা রুশ প্রতিরক্ষা সেক্টরকে অর্থায়ন করবে এবং তুরস্কের সামরিক বাহিনী এবং সামরিক শিল্পে রাশিয়ার ঢোকার ব্যবস্থা করবে। তিনি বলেন যে, এরপরও তুরস্ক এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় এবং পরীক্ষা করা থেকে বিরত থাকেনি। অথচ ‘এস ৪০০’এর বিকল্প হিসেবে ন্যাটোর নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল, যা তুরস্কের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারতো। তিনি তুরস্ককে যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে কাজ করায় ব্রতী হবার আহ্বান জানান। অপরপক্ষে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন যে, তুরস্কের ‘এস ৪০০’ কেনার ব্যাপারটার যৌক্তিকতা রয়েছে। একইসাথে বিবৃতিতে বলা হয় যে, তুরস্ক তার সুবিধামত যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের জবাব দেবে। বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বানও জানানো হয়। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সময়ে পররাষ্ট্রনীতির যে সিদ্ধান্তগুলি আসছে, সেগুলিকে কাঁধে নিয়েই পরবর্তী জো বাইডেন প্রশাসনকে কাজ শুরু করতে হবে।

‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ‘এফ ৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে বের করে দেয়। তবে এর পরবর্তীতে আর কোন বড় পদক্ষেপ নেয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকে। গত অক্টোবর মাস থেকে তুরস্ক ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা শুরু করে। মার্কিন কংগ্রেস থেকে এব্যাপারে আহ্বান করা হয় যে, ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস এডভারসারিজ থ্রু স্যাংসন্স এক্ট’ বা সিএএটিএসএ’ বা ‘কাটসা’ আইনের অধীনে তুরস্কের উপরে অবরোধ আরোপ করা হোক। এই আইনের অধীনে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কাজের জন্যে যেকোন রাষ্ট্রকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়। যদিও বাইডেনের নির্বাচন জয়ী দল বলে এসেছে যে, তারাও তুরস্কের ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের বিরোধী, তথাপি এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের সম্পর্কের মাঝে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা দেয়ালকে আরও উঁচু করলো।

 
২০১৩ সাল। ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপে গ্রিস রুশ নির্মিত ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা করছে। গ্রিস এবং বলকানের অন্যান্য দেশগুলি রুশ সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করলেও ন্যাটো তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। মূলতঃ তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যালান্স করে রাখার জন্যেই গ্রিস ‘এস ৩০০’ ক্রয় করেছে, এবং ন্যাটো তা সহ্য করেছে।


তুরস্ক বরাবরই বলে আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ‘প্যাট্রিয়ট’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানাবার ফলেই তুরস্ক রুশ ‘এস ৪০০’ ক্রয়ে বাধ্য হয়েছে। তুরস্ক আরও বলে আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলির মাঝেই দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে; গ্রিস রুশ নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করলেও তাকে কোন অবরোধের মাঝে পড়তে হয়নি। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গ্রিক সাইপ্রাস ১৯৯৭ সালে রাশিয়া থেকে দূরপাল্লার ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করে। পরে তুরস্কের প্রতিবাদের জেরে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটাকে গ্রিসের ক্রিট দ্বীপে মোতায়েন করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এই ব্যবস্থাকে গ্রিকরা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে বলে বলছে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’। ২০১৫ সালে গ্রিস রুশ সহায়তায় এই ব্যবস্থাটার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করে এবং নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় করে। এছাড়াও গ্রিকরা রাশিয়া থেকে ‘টর এম১’ এবং ‘অসা একেএম’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করেছে। গত নভেম্বর মাসে তুরস্ক বলে যে, গ্রিস তার রুশ নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ক্রিট দ্বীপে ন্যাটোর মহড়ার মাঝে পরীক্ষা করেছে।

এর আগে গত ১৬ই অক্টোবর তুরস্ক ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ব্যাপারটা নিশ্চিত করে বলেন যে, তুরস্ক এই পরীক্ষা চালিয়ে যাবে এবং এই পরীক্ষার জন্যে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি চাইবে না। অক্টোবরের ‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পিছনে ক্রিট দ্বীপে ফ্রান্স এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুদ্ধবিমান মোতায়েনকে কারণ হিসেবে দেখায় তুরস্ক। তুরস্কের সেই পরীক্ষার প্রায় দু’মাস পর যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। অক্টোবরে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র জনাথন হফম্যান বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের সম্ভাব্য এই পরীক্ষার খবর এসেছে। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে প্রতিরক্ষা দপ্তর এর কড়া প্রতিবাদ জানাবে।

 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময় ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমান দ্বারা পার্লামেন্ট ভবন এবং প্রেসিডেন্টের বিমান আক্রান্ত হলেও তুর্কি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেই বিমানগুলিকে টার্গেট করতে পারেনি। এই ব্যবস্থাটা ন্যাটোর তৈরি করা; যার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হয় যে ন্যাটোর একটা সামরিক সরঞ্জাম অপরটার উপর হামলা করবে না। এরদোগান হয়তো ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের মাধ্যমে আরেকটা অভ্যুত্থানই প্রতিরোধ করতে চাইছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গ্রিস কেন ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে রাশিয়ার কাছ থেকে? ‘সিএসআইএস’ অবশ্য এব্যাপারে কোন বিশ্লেষণ দেয়নি।

গ্রিস ছাড়াও পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ব্যাপকভাবে রুশ অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। চেক রিপাবলিক, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং স্লোভাকিয়া এখনও রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। গ্রিস এবং তুরস্কের রুশ সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির উত্তর পাওয়া যাবে অত্র অঞ্চলের ইতিহাসের দিকে। পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই একসময় ইস্তাম্বুলের উসমানি খিলাফতের অধীনে ছিল। রাশিয়া, অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ চার শতক ধরে যুদ্ধ করে উসমানিদের কাছ থেকে বলকান অঞ্চল ছিনিয়ে নেয় এবং সেখানে অনেকগুলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা থাকলেও সকলেই ইসলামের ঝান্ডাবাহী উসমানি খিলাফতের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। বলকানে তৈরি করা রাষ্ট্রগুলির মাঝে রয়েছে গ্রিস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, মন্টিনেগ্রো, কসোভো। এই দেশগুলির বেশিরভাগ জনগণ বিশ্বাসগত দিক থেকে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী হবার কারণে রাশিয়ার চার্চের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। একারণেই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি বলকানে তাদের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সাবধানে এগিয়েছে; অনেক ক্ষেত্রে ছাড়ও দিয়েছে। রুশ অস্ত্র ব্যবহারে ছাড় দেয়াটাও এই দেশগুলিকে ন্যাটোর অংশ করে নেবার নীতির অংশ ছিল।

সাইপ্রাস নিয়ে ১৯৭০এর দশক থেকেই গ্রিস এবং তুরস্কের দ্বন্দ্ব চলছে। গ্রিস এবং তুরস্ক উভয়েই ন্যাটোর তৈরি সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে; যার একটা অপরটাকে টার্গেট করতে পারবে না। মূলতঃ ন্যাটোর তৈরি তুর্কি বিমানগুলিকে টার্গেট করার জন্যেই গ্রিস ‘এস ৩০০’ কিনেছে রাশিয়ার কাছ থেকে। অর্থাৎ রুশ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি গ্রিসের জন্যে তুরস্কের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ। আর একারণেই ন্যাটো গ্রিসের সাথে রাশিয়ার বহু বছরের সামরিক সম্পর্ককে সহ্য করে চলছে। গ্রিসের সামরিক বাহিনীতে রুশ নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ন্যাটো হুমকি মনে না করলেও তুর্কি বাহিনীতে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে ন্যাটো হুমকি হিসেবে দেখছে। এই দ্বিমুখী নীতি মূলতঃ কয়েক শতক ধরে চলে আসা চিন্তারই ফলাফল; যার মাঝ দিয়ে ইস্তাম্বুলকে রুশ এবং পশ্চিমারা কেউই বন্ধু হিসেবে নেয়নি। রুশ ‘এস ৪০০’ ক্রয়ের জন্যে তুরস্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা দেখিয়ে দেয় যে, আঙ্কারার সেকুলার নেতৃত্বের মাঝেও পশ্চিমারা উসমানি খিলাফতের ছায়াই দেখতে পাচ্ছে। তুরস্ক হয়তো নিজস্ব সামরিক শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির উপর তার নির্ভরশীলতা বহুলাংশেই কমিয়ে ফেলতে পারবে; কিন্তু তুর্কিদের মুসলিম পরিচয়ের ব্যাপারে পশ্চিমাদের কয়েক’শ বছরের অস্বস্তি যে মুছে ফেলতে পারবে না, তা নিশ্চিত।

Saturday 12 December 2020

ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের কৌশলগত সহযোগিতার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

১৩ই ডিসেম্বর ২০২০
ককেশাস এবং লিবিয়াতে তুর্কি সহায়তায় আজেরি এবং লিবিয়দের সাফল্য ইউক্রেনিয়ানদের ডনবাসে সফলতা পাবার আকাংক্ষা যুগিয়েছে। তবে ককেশাসের বাস্তবতা যেমন রাশিয়াকে নিরপেক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, তা ডনবাসের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল দেবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, ককেশাস এবং লিবিয়ার যুদ্ধ ইউক্রেনকে সহায়তা দেবার ক্ষেত্রে তুরস্ককে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।


গত ২৭শে নভেম্বর ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা তুরস্কের সরকারি বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে দেয়া এক সাক্ষাতে বলেন যে, তুরস্কের সাথে তার দেশের সম্পর্ক এখন সবচাইতে ভালো। দুই দেশের মাঝে বোঝাপড়া, নেতৃত্বের সমঝোতা এবং যৌথ প্রকল্পের ঝুড়ি নিয়ে খুশি হবার কারণ রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, দুই দেশের মাঝে ভালো সম্পর্ক শুধু তাদের দ্বিপাক্ষিক দিক থেকেই ভালো তা নয়; পুরো অঞ্চলের জন্যেও তা ভালো। ইউক্রেন এই সম্পর্কে তার বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে থাকবে বলে বলেন তিনি। ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের সুসম্পর্কের এই কথাগুলি এমন সময়ে আসছে, যখন বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যুতে তুরস্কের সাথে রাশিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স, মিশর, ইরান এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। মাত্র কিছুদিন আগেই ককেশাসে তুর্কি সমর্থনে নাগোর্নো কারাবাখে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজেরবাইজান একটা সামরিক জয় ঘরে তুলে নিয়েছে। এর আগে তুর্কি সমর্থনে লিবিয়ার ত্রিপোলি সরকারও জেনারেল হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এছাড়াও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান নিয়ে গ্রিসের সাথে বিরোধ এবং সিরিয়াতে তুর্কি সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে রাশিয়া এবং ইরানের সাথে বিরোধ আঞ্চলিক ভূরাজনীতিকে উত্তপ্ত রেখেছে। তদুপরি এই প্রতিটা ইস্যুতেই ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তারের খেলায় ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের বিরোধ চরমে উঠেছে। লিবিয়ার ত্রিপোলি সরকারের জন্যে তুর্কি সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে ইউরোপিয় ইউনিয়নের নৌ অবরোধ নিয়েও তুরস্কের সাথে ইউরোপের বিরোধ চলছে; তুরস্কের উপরও অবরোধ আরোপের ব্যাপারে কথা চলছে। এরূপ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

২০১৫ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পরোশেঙ্কোর সময়ে ইউক্রেন তুরস্কের সাথে বেশ কয়েকটা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১৮ সালে ৬৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ইউক্রেন তুরস্কের কাছ থেকে ৬টা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন এবং ২’শ ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় করে। ২০১৯ সাল থেকেই ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এই ড্রোনগুলিকে নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা চালাচ্ছে। নতুন প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সস্কিও তুরস্কের সাথে গত ফেব্রুয়ারিতে এবং অক্টোবর মাসে তার তুরস্ক সফরের সময় সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। নভেম্বরে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর প্রধান রুসলান খোমচাক ঘোষণা দেন যে, ২০২১ সালে ইউক্রেন আরও ৫টা ‘বায়রাকতার’ ড্রোন কেনার পরিকল্পনা করছে। এছাড়াও তুর্কি কোম্পানি ‘বায়কার মাকিনা’র সাথে যৌথ উদ্যোগে ইউক্রেন নিজেদের কারখানায় ৪৮টা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন তৈরি করতে চাইছে। রুশ মিডিয়া ‘আরআইএ নভোস্তি’ বলছে যে, ককেশাসে ড্রোন ব্যবহারে আজেরিদের ব্যাপক সাফল্য ইউক্রেনের সামরিক নেতৃবৃন্দের কাছে উদাহরণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ডনবাসের রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নতুন করে ইউক্রেনের সামরিক হামলার আশঙ্কা করছে। ২রা ডিসেম্বর থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী মার্কিন ‘এমকিউ ৯’ ড্রোনের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে। কিছু রুশ মিডিয়া এও দাবি করছে যে, ইউক্রেন এবং তুরস্ক যৌথভাবে ক্রিমিয়া এবং ডনবাস পুনর্দখল করতে চাইছে। 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকায় ইউক্রেন এবং তুরস্কের নিরাপত্তা সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে স্থিতাবস্থায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একইসাথে ইউক্রেনের ইঞ্জিন নির্মাণ প্রযুক্তি তুরস্ককে তার কৌশলগত দুর্বলতাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা দিতে পারে। এই ব্যাপারগুলি ২০২১ সালে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হতে পারে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক পত্রিকা ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় ফেহিম তেস্তেকিন প্রশ্ন করছেন যে, তুর্কি সহায়তা নিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার কাছ থেকে ডনবাস পুনর্দখল করতে পারবে কিনা। তুরস্ক সফরের সময় ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা বলেন যে, তার দেশ চাইছে রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ইস্যুতে তুরস্ক নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক। তেস্তেকিন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়াকে ব্যালান্স করতে ইউক্রেনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন মূলতঃ ন্যাটোর কৌশল। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমদানির ব্যাপারে তুরস্ক রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চললেও রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করে নেয়াটা তুরস্ক মেনে নিতে পারেনি কখনোই। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্বই প্রকৃতপক্ষে তুরস্কের সাথে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন যে, সিরিয়া এবং লিবিয়াতে রাশিয়া যেহেতু তুরস্কের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, হয়তো সেকারণেই তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে শক্তিশালী দেখতে চাইছে। তবে ককেশাসের যুদ্ধে রাশিয়া সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও ডনবাসের ব্যাপারটা আলাদা; কারণ ডনবাস রাশিয়ার সীমানার উপর অবস্থিত।

ইউক্রেনের সাথে তুর্কি সামরিক সহযোগিতা শুধু একমুখী নয়। সোভিয়েত সময় থেকে ইউক্রেন বেশকিছু প্রযুক্তির মালিক হয়েছে, যা তুর্কিরা বেশ গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে। ইঞ্জিন প্রযুক্তিতে তুরস্ক এখনও পশ্চিমা দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি; যার ফলশ্রুতিতে তুরস্ক তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পশ্চিমা অবরোধের হুমকিতে পড়ছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় তুর্কি বিশ্লেষক ক্যান কাসাপোগলু মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তুরস্কের ‘বায়কার মাকিনা’র তৈরি নতুন বৃহদাকৃতির ড্রোন ‘আকিনচি’তে খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনে তৈরি ‘ইভচেঙ্কো প্রগ্রেস এএল ৪৫০টি’ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। অপরদিকে ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, বিমানের ইঞ্জিন ডেভেলপ এবং তৈরি করার ক্ষেত্রে দুই দেশের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সহযোগিতা দেখা যাচ্ছে। তুর্কি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সিফোর ডিফেন্স’এর বিশ্লেষক ওজগুর একসি বলছেন যে, ইউক্রেনের কাছে এমন কিছু প্রযুক্তি রয়েছে, যা তুরস্কের জন্যে জরুরি দরকার। তুরস্কের ‘গেজগিন’ ক্রুজ মিসাইলে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউক্রেনের ‘ইভচেঙ্কো প্রগ্রেস এএল ৩৫’ ইঞ্জিন। ‘গেজগিন’ হলো মার্কিন ‘টোমাহক’ ক্রুজ মিসাইলের আদলে তৈরি তুর্কি মিসাইল, যা পাল্লা হবে প্রায় ১ হাজার কিঃমিঃ।

ককেশাস এবং লিবিয়াতে তুর্কি সহায়তায় আজেরি এবং লিবিয়দের সাফল্য ইউক্রেনিয়ানদের ডনবাসে সফলতা পাবার আকাংক্ষা যুগিয়েছে। তবে ককেশাসের বাস্তবতা যেমন রাশিয়াকে নিরপেক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, তা ডনবাসের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল দেবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, ককেশাস এবং লিবিয়ার যুদ্ধ ইউক্রেনকে সহায়তা দেবার ক্ষেত্রে তুরস্ককে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। অপরদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকায় ইউক্রেন এবং তুরস্কের নিরাপত্তা সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে স্থিতাবস্থায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একইসাথে ইউক্রেনের ইঞ্জিন নির্মাণ প্রযুক্তি তুরস্ককে তার কৌশলগত দুর্বলতাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা দিতে পারে। এই ব্যাপারগুলি ২০২১ সালে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হতে পারে।