Wednesday 29 May 2019

“বেঙ্গল গেইট” এবং আওরঙ্গজেবের “স্বর্গ”

২৯শে মে ২০১৯


বৃষ্টিপাত, ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূ-প্রকৃতি

পৃথিবীর বহু স্থান রয়েছে যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়; কিন্তু মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়। বিষুবীয় অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গল, আফ্রিকার কঙ্গো এবং ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও, সুমাত্রা এবং পপুয়া নিউ গিনির মত এলাকাগুলি এই প্রকারের মাঝে পড়বে। ঘন বনাঞ্চল হবার কারণে এই এলাকাগুলিতে মানুষ বসবাস কঠিন। সারাবছর বৃষ্টিপাত হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চলগুলি অনেক মানুষ বাঁচিয়ে রাখার জন্যে উপযোগী নয়। আবার রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। বৃষ্টিপাত হলেও পাহাড়ি অঞ্চল বসবাসের জন্যে কম উপযোগী। প্রথম সমস্যা হলো, ঢালু অঞ্চলে হবার কারণে প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা কঠিন। আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো যাতায়াতের সমস্যা। পাহাড়ি নদীতে নৌকা চালিয়ে উজানের দিকে যাওয়া কঠিন। আর পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা তৈরি করা তো আরও কষ্টকর। জঙ্গল এবং পাহাড়ি অঞ্চলে চাষাবাদ অপেক্ষাকৃত কঠিন। আর চাষাবাদ ছাড়া বহু মানুষের জন্যে অন্নের সংস্থান করাটাও কঠিন। প্রচুর বৃষ্টি হলেও তা যথেষ্ট নয়; বৃষ্টির পানি যদি প্রাকৃতিকভাবে ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকে, তাহলেই কেবল তা চাষাবাদের জন্যে উপযোগী এলাকা হবে। আর সেখানে অনেক মানুষের থাকার ব্যবস্থাও সম্ভব।

এরপরও কথা থেকে যায়। বৃষ্টির মেঘ সমুদ্র থেকে ভূমির দিকে এগুলে যেকোন স্থানেই বৃষ্টি হয়ে ঝড়তে পারে। এই বৃষ্টি যত কম স্থানের উপরে পড়বে, সেখানে স্বাদু পানির সংস্থান সবচাইতে বেশি হবে। যদি বৃষ্টি অনেক বেশি এলাকা নিয়ে পড়ে, তবে সেই পানি ব্যবহার করতে একটা নির্দিষ্ট স্থানে বাস করলেই হবে না; ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে হবে। তবে বৃষ্টির পরিমাণ যদি অনেক বেশি হয়, সেক্ষেত্রে তা অনেক বেশি মানুষের সংস্থান করতে পারবে। বৃষ্টির নির্দিষ্ট স্থানে পড়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হলো পাহাড়-পর্বত। বৃষ্টির মেঘ উঁচু পাহাড়ে আটকে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পারে। যদি সেই পাহাড়ের পাদদেশে মানুষ বসবাস করে, তাহলে তারা সেই বৃষ্টির পানি যথেষ্ট পরিমাণে পাবে। তবে পাহাড়ের পাদদেশের আয়তন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক স্থানেই পাহাড় প্রায় সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত। তাই পাহাড়ে মেঘের ধাক্কায় যে বৃষ্টিপাত হয়, তা সরাসরিই সমুদ্রে চলে যায়। তাহলে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতে হলে পাহাড়ের পাদদেশের প্রাকৃতিক পরিস্থিতি দেখতে হবে।

একটা সমতল এলাকায় বৃষ্টির পানি পড়লে সেটা সমুদ্রে যেতে অনেক সময় নেবে। ভূমির ঢাল যত কম হবে, পানি তত ধীরে ধীরে সমুদ্রে পৌঁছাবে। আর এই ধীরে সমুদ্রে পৌঁছার মাঝে সমতলে বসবাসরত মানুষেরা সেই পানিকে ব্যবহার করতে পারবে। সেই অঞ্চলের নদী-নালা-খাল-বিল পানি ধরে রাখতে পারবে অনেক সময়; যদিও তা একসময় না একসময় সমুদ্রে পৌঁছাবে। এখানে সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ি অঞ্চলের বৃষ্টির পানি খুব দ্রুত সমুদ্রে চলে যায়; সমতলের পানি অনেক ধীরে যায় সমুদ্রে। আরও ব্যাপার রয়েছে সমতলের আয়তন নিয়ে। সমতলের আয়তন বেশি হলে সেই পানির সমুদ্রে পৌঁছাতে অনেক বেশি সময় লাগবে; আয়তন ছোট হলে দ্রুত পৌঁছাবে সমুদ্রে। আর এই সমতলের পাশে পাহাড় থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় যদি সমতল আর সমুদ্রের মাঝে থাকে, তাহলে পাহাড় বৃষ্টির মেঘকে সমতলে পৌঁছাতে দেবে না; অর্থাৎ সমতলে বৃষ্টি হবে না এবং তা মানুষ বসবাসের জন্যে কম উপযোগী হবে। অন্যদিকে সমতল যদি পাহাড় এবং সমুদ্রের মাঝে থাকে, তাহলে বৃষ্টির মেঘ পাহাড়ে বাধা পেয়ে যে বৃষ্টি হবে, তার পানি ঐ সমতলের মাঝ দিয়েই ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পৌঁছাবে। এক্ষেত্রে ঐ সমতলে থাকা মানুষ বহু সময় ধরে বহমান পানি ব্যবহার করতে পারবে।

আর এই সবকিছুর উপরে রয়েছে বাতাসের দিক। সমুদ্র থেকে বৃষ্টির মেঘ সকল দিকে ধাবিত হয় না; সকল সময়েও ধাবিত হয় না। বাতাসের দিকও সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়, যা কিনা ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ বৃষ্টির পানির পুরোপুরি ব্যবহার হতে হলে সমুদ্র থেকে বাতাসের দিক হতে হবে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের দিকে, যেখানে রয়েছে বিরাট সমতল, এবং সমতলের পর রয়েছে উঁচু পাহাড়, যেখানে বৃষ্টির মেঘ ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি ঘটায়। সেই সমতল আর সমুদ্রের মাঝে থাকবে না কোন পাহাড়, যা বৃষ্টির মেঘ সমতলে ঢোকার আগেই আটকে দিতে পারে। জঙ্গলের মাঝে মানুষ বসবাস কঠিন হবে, তাই এই পুরো এলাকা আবার জংলা অঞ্চলে হলেও সমস্যা। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস করেও অবশ্য কৃষির ব্যবস্থা করা সম্ভব।

এই দরজাটাই হলো বাংলা অঞ্চলে বৃষ্টির মেঘ ঢোকার রাস্তা। এই দরজার পূর্বে রয়েছে আরাকান পর্বত, আর পশ্চিমে পূর্ব-ঘাট পর্বত। এই “বেঙ্গল গেইট” দিয়েই ঢোকে ভারত মহাসাগর থেকে উড়ে আসা দক্ষিণ-পশ্চিমের মেঘ। একবার “বেঙ্গল গেইট” দিয়ে বৃষ্টির মেঘ ঢুকে গেলে তা তিনদিকে মেঘের মাঝে আটকা পড়ে যায়, এবং এর পুরোটাই বৃষ্টি হয়ে এই সমতলে ঝরে পড়ে; পালাবার পথ নেই! 

“বেঙ্গল গেইট”

ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টিপাতের সেই অবস্থাটাই বিরাজ করছে, যা কিনা বহু মানুষের বসবাসের জন্যে উপযোগী। এর মাঝে আবার গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রা-মেঘনা অববাহিকার গুরুত্ব সবচাইতে বেশি।

প্রথমতঃ ভারত মহাসাগরের বৃষ্টির মেঘগুলি ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে এই নদী অববাহিকা পর্যন্ত পৌঁছে; মাঝে কোন বাধা নেই। এটা সম্ভব হচ্ছে বঙ্গোপসাগরের ফানেল আকৃতির কারণে।

দ্বিতীয়তঃ উপকূলে কোন পাহাড় নেই; তাই বৃষ্টির মেঘ ভূমির অনেক ভেতর ঢুকতে পারে।

তৃতীয়তঃ ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলটা উপদ্বীপ আকৃতির; যার পূর্ব উপকূলে রয়েছে পূর্ব-ঘাট পর্বত। এই পর্বতের কারণে বৃষ্টির মেঘগুলি উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু পাহাড়ের উত্তরের দিকে বৃষ্টি খুব হয়। পূর্ব-ঘাট পর্বত যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই বৃষ্টি মেঘের সামনে সমতলে ঢোকার একটা দরজা খুলে যায়। এই দরজাটাই হলো বাংলা অঞ্চলে বৃষ্টির মেঘ ঢোকার রাস্তা। এই দরজার পূর্বে রয়েছে আরাকান পর্বত, আর পশ্চিমে পূর্ব-ঘাট পর্বত। এই “বেঙ্গল গেইট” দিয়েই ঢোকে ভারত মহাসাগর থেকে উড়ে আসা দক্ষিণ-পশ্চিমের মেঘ।

চতুর্থতঃ এই মেঘ ঢুকে যায় সমতল অববাহিকায়, এবং এর উত্তরের উঁচু হিমালয় পর্বত এবং এর শাখা প্রশাখায় মেঘ ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। পঞ্চমতঃ একবার “বেঙ্গল গেইট” দিয়ে বৃষ্টির মেঘ ঢুকে গেলে তা তিনদিকে মেঘের মাঝে আটকা পড়ে যায়, এবং এর পুরোটাই বৃষ্টি হয়ে এই সমতলে ঝরে পড়ে; পালাবার পথ নেই! উত্তর ভারতে গঙ্গা নদীর অববাহিকা জুড়ে বেশ কিছু এলাকায় এই মেঘ পৌঁছে। তবে যত উত্তর-পশ্চিমে যাওয়া যায়, বৃষ্টি কমতে থাকে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় হিমালয়ের পাদদেশে ব্যাপক বৃষ্টি হয়, যা ব্রহ্মপুত্র নদের মাধ্যমে সমতলে প্রবাহিত হয়। এরও পূর্বে হিমালয়, মেঘালয় এবং আরাকান পর্বতের মাঝে আটকা পড়ে মেঘ। এইসব পাহাড়ে বৃষ্টির পানি ব্রহ্মপুত্র, বরাক এবং অন্যান্য নদী বেয়ে সমতলে পৌঁছায়। মোটকথা “বেঙ্গল গেইট”এর ভেতর দিয়ে ঢোকার পরে এই মেঘগুলি একটা বৃষ্টির রাজ্য তৈরি করে, যা কিনা দুনিয়ার আর কোথাও দেখা যায় না।

গঙ্গা অববাহিকায় বাস করে ভারতের ৪০ কোটি মানুষ। আর গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-বরাকের মিলিত স্রোতের নদী-বিধৌত অঞ্চলে বাস করে আরও ২১ কোটির মতো মানুষ। অর্থাৎ এই “বেঙ্গল গেইট”এর মাঝ দিয়ে ঢোকা বৃষ্টির মেঘের উপর বেঁচে থাকছে ৬০ কোটিরও বেশি মানুষ। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি এই অঞ্চলে চাষাবাদের এক বিরাট সুযোগ করে দিয়েছে; যা কিনা এত বিশাল এক জনসংখ্যাকে বাঁচিয়ে রাখছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এই মৌসুমী বায়ু প্রতিবছর প্রায় একই সময়ে একই দিক থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ছোটে। আর বঙ্গোপসাগরের ফানেলের কারণে তা বাধা না পেয়ে উত্তরের দিকে যেতে থাকে। এরপর সে পেয়ে যায় “বেঙ্গল গেইট”! পুরো মেঘমালা ঢুকে যায় এই গেইট দিয়ে; আর আটকা পড়ে যায় তিন দিকের উঁচু পাহাড়ের মাঝে; বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পরে; তৈরি করে বিশাল বিশাল প্রবাহমান জলাধার, যেগুলিকে আমরা নদী বলে জানি। তিন নদীর মিলিত স্রোতেই এই অঞ্চলই পৃথিবীর সবচাইতে সম্পদশালী অঞ্চলগুলির একটা। এই সম্পদ হলো এর মৌসুমী বায়ু, ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূ-প্রকৃতি; যার সবগুলিই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত! এবং এগুলি কখনোই ফুরাবার নয়, যদি না সৃষ্টিকর্তা অন্য কিছু চান! অর্থাৎ এই অঞ্চল যে সবচাইতে সম্পদশালী হবে, তা সৃষ্টিকর্তা নিজেই ঠিক করে দিয়েছেন!
হিন্দুস্তান আর চীন – এই দুই অর্থনৈতিক দৈত্যের মাঝে বাণিজ্যের সম্পর্ক গভীর করার পিছরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আরবদের। আর আরবরা ইসলাম নেবার পর থেকে এই বাণিজ্যের প্রসার আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। ইসলামের দাওয়া পৌঁছে দেবার স্পৃহা মুসলিম বণিকদের বহুদূর নিয়ে গেছে। পুরো ভারত মহাসাগর জুড়ে তারা বসতি স্থাপন করেছিল; এনেছিল ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। হিন্দুস্তান-চীন-ইন্দোচীন-মালয়ের অর্থনীতি ছিল একই সূত্রে গাঁথা।



ঔপনিবেশিকরাও বুঝেছিল “বেঙ্গল গেইট”এর গুরুত্ব

ষোড়শ শতকে ঔপনিবেশিক শক্তিরা এখানে এসেছিল এই সম্পদের খোঁজেই। তারা জানতো এই সম্পদ ফুরাবার নয়। তাই তারা চীরজীবন এই সম্পদকে নিজেদের উন্নয়নে ব্যবহার করার লক্ষ্যে রাজনৈতিকভাবে এখানকার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলির দখল নিতে মনোযোগী হয়। পর্তুগীজরা যখন এই “বেঙ্গল গেইট”এ পৌঁছায়, তখনও তারা এখানকার সম্পদের মাপ করতে সক্ষম হয়নি। আসলে এত সম্পদ তারা জীবনে কখনও দেখেনি বলেই এই মাপ তারা করতে পারেনি। এখানকার ভাব বুঝতেই তাদের বেশকিছু সময় চলে যায়। তবে ভাব বোঝার সাথেসাথেই তারা কাজে নেমে পড়ে – এই অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতেই হবে। সপ্তদশ শতকে এখানে হাজির হয় ডাচ, ব্রিটিশ, ফরাসীরা। এরাও এই অঞ্চলের অশেষ সম্পদের লোভে পড়ে যায়। শুরু হয় এদের মাঝে দ্বন্দ্ব। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরাই টিকে যায়। এবং তারা বেঙ্গলকে পুরো ভারতের মাঝে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিতো। তাদের আগে পর্তুগীজরাও তা-ই দিয়েছিল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন যোদ্ধা; জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়েছেন। তার সেনাবাহিনীকে টিকিয়ে রাখার আর্থিক শক্তিটুকুর বেশিরভাগটাই তিনি বাংলা থেকে পেয়েছিলেন। কাজেই অবাক হবার কি আছে, যখন তিনি বাংলাকে বলেছেন “হিন্দুস্তানের স্বর্গ”? ব্রিটিশরা এই “স্বর্গ” নিয়ে এতটাই প্রেমে পড়েছিল যে, ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাকি দুনিয়ার সবকিছু ফেলে তারা তাদের সকল চিন্তাকে ভারত-কেন্দ্রিক করে ফেলেছিল। ভারতের, তথা বাংলার সম্পদকে ব্যবহার করে ব্রিটিশরা দেড়’শ বছর দুনিয়া শাসন করেছিল। দুনিয়ার ইতিহাসের সবচাইতে শক্তিশালী নৌবহর তারা তৈরি করতে পেরেছিল ভারতের সম্পদকে কাজে লাগিয়েই।

এখানেই শেষ নয়। এশিয়ার অন্য প্রান্তে রয়েছে আরেক জনবহুল অঞ্চল – চীন। আরও রয়েছে এর আশেপাশের মালয় দ্বীপপুঞ্জ এবং ইন্দোচীন উপদ্বীপ। হিন্দুস্তানের সাথে চীন এবং আশেপাশের অঞ্চলের চলেছে হাজার বছরের বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল আরব বণিকদের হাতে। আরবরা বাণিজ্য করতো; কারণ তাদের অঞ্চল ছিল মরুভূমি; ফসল ফলে না একেবারেই। তার রিযিক অন্বেষণে তারা হয়েছিল বণিক। হিন্দুস্তান আর চীন – এই দুই অর্থনৈতিক দৈত্যের মাঝে বাণিজ্যের সম্পর্ক গভীর করার পিছরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আরবদের। আর আরবরা ইসলাম নেবার পর থেকে এই বাণিজ্যের প্রসার আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। ইসলামের দাওয়া পৌঁছে দেবার স্পৃহা মুসলিম বণিকদের বহুদূর নিয়ে গেছে। পুরো ভারত মহাসাগর জুড়ে তারা বসতি স্থাপন করেছিল; এনেছিল ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। হিন্দুস্তান-চীন-ইন্দোচীন-মালয়ের অর্থনীতি ছিল একই সূত্রে গাঁথা। মুসলিমরা এই সম্পদশালী অঞ্চলের সম্পদকে বাণিজ্যের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলিমদের এই বাণিজ্য সাফল্যই ইউরোপিয়দের অনুপ্রাণিত করেছিল পূর্বের সাথে বাণিজ্য করার। এটা তারা করতে পেরেছিল ভাস্কো দা গামার ভারত মহাসাগর অভিযানের পর থেকে।

ইতিহাসে হিন্দুস্তান এবং চীনের অর্থনীতি একত্রেই ওঠা-নামা করেছে। দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক মানুষের বসবাস সবসময় এখানেই ছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানকার অর্থনীতি ছিল দুনিয়ার অর্থনীতিরও অর্ধেক। এই ব্যাপারটা পরিবর্তন করে ফেলে ঔপনিবেশিকেরা। তারা পুঁজিবাদী চিন্তার মাধ্যমে সম্পদের অসুস্থ্য বন্টন করে ইউরোপকে সম্পদশালী করে, যেখানে ইউরোপের জনসংখ্যা সারা দুনিয়ার তুলনায় কিছুই নয়। একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যা প্রয়োজন, তার চাইতে বহুগুণ সম্পদ তারা কুক্ষিগত করে সারা দুনিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্যের কারণেই হিন্দুস্তান-চীনের বিশাল জনসংখ্যা। এটা সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ঠিক করে দিয়েছেন। তাঁর তৈরি করে দেয়া এই নিয়মের হেরফের করার ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে সংঘাত এবং অশান্তি।



“আর তারা কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব সত্ত্বার পূজা করে যাদের না আকাশ থেকে তাদের কিছু রিযিক দেবার ক্ষমতা ও অধিকার আছে, না পৃথিবী থেকে?” [সূরা আন-নাহল – আয়াত ৭৩]

Wednesday 22 May 2019

আর্কটিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব কোনদিকে যাচ্ছে?

‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’এর কারণে আর্কটিকে বরফ গলার সাথেসাথে সমুদ্রপথ উন্মুক্ত হচ্ছে। এখন বছরের বেশ কয়েক মাস রুশ আর্কটিক দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারছে, যা ইতিহাসে প্রথম। এই নৌ-রুটের সাথে সাথে এর নিরাপত্তার ব্যাপারটাও রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
২৩শে মে ২০১৯

৬ই মে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও উত্তর মেরুর কাছের আর্কটিক এলাকায় রাশিয়া এবং চীনের আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে সাবধান করেন। তিনি বলেন যে, আর্কটিক এলাকা এখন বিশ্বশক্তিদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। পম্পেও ফিনল্যান্ডে ‘আর্কটিক কাউন্সিল’এর এক সভায় এই কথাগুলি বলেন। ‘আর্কটিক কাউন্সিল’এ রয়েছে আর্কটিক অঞ্চলের আটটা রাষ্ট্র এবং ঐ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের প্রতিনিধিরা। পম্পেও আর্কটিকের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে কথা না বলে বরং এই অঞ্চলকে একটা সুযোগের অঞ্চল বলে আখ্যা দেন। আর্কটিকের তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, স্বর্ণ, মৎস্য সম্পদ এবং ‘রেয়ার আর্থ’ খনিজ-কেই তিনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। একইসাথে আর্কটিকের সমুদ্র রুটের উপর বেইজিং এবং মস্কোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অত্র অঞ্চলে দক্ষিণ চীন সাগরের মতোই এক প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে বলে বলেন তিনি। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই কাউন্সিল তৈরির সময় এর মূল আলোচ্য বিষয় ছিল পরিবেশ; আর নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার কোন ব্যবস্থাই এখানে রাখা হয়নি। তাই পম্পেও-এর কথায় আলোচনায় অংশ নেয়া প্রতিনিধিরা হতবাক হয়ে যান।

শুধু তা-ই নয়, পম্পেও কানাডার মাঝ দিয়ে যাওয়া ‘নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজ’-কে আন্তর্জাতিক নৌ-রুট বলে আখ্যা দেন, যা কিনা কানাডা নিজেদের বলে মনে করে। পম্পেও-এর কথায় কানাডিয়রা বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে রাশিয়ার আর্কটিকের ‘নর্দার্ন সী রুট’ বা ‘এনএসআর’কে আন্তর্জাতিক নৌ-রুট হিসেবে আখ্যা দেবার জন্যেই যে পম্পেও কানাডার ‘নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজ’-কে আন্তর্জাতিক নৌ-রুট বলে আখ্যা দেন, তা বোঝা যাচ্ছে। তদুপরি ‘নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজ’-কে রক্ষা করার নিমিত্তে কানাডা সেখানে যতটা নিরাপত্তা কার্যক্রমে হাত দিয়েছে, তা রাশিয়ার নিরাপত্তা কার্যক্রমের সাথে তুলনীয় নয় মোটেই। ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’এর কারণে আর্কটিকে বরফ গলার সাথেসাথে সমুদ্রপথ উন্মুক্ত হচ্ছে। এখন বছরের বেশ কয়েক মাস রুশ আর্কটিক দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারছে, যা ইতিহাসে প্রথম। এই নৌ-রুটের সাথে সাথে এর নিরাপত্তার ব্যাপারটাও রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

আর্কটিকের সামরিকীকরণ
রাশিয়ার তিনি-কোণা এই ঘাঁটিগুলিকে বলা হচ্ছে ‘আর্কটিক ট্রেফয়েল’। লাল-সাদা-নীল রং-এর এই ঘাঁটিগুলির ১৪ হাজার বর্গমিটার স্থানে ১’শ ৫০ জন সেনা দেড় বছর থাকতে পারবে বলে বলা হচ্ছে।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে রুশ সেনারা সাইবেরিয়ার উত্তরে নিউ সাইবেরিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কোটেলনি দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা শুরু করে। একইসাথে সেখানে সারাবছর সাপ্লাই পৌঁছানোর জন্যে একটা বড়সড় এয়ারফিল্ড এবং উপকূলে একটা জেটি তৈরি শুরু করে। আর্কটিকে দ্বিতীয় ঘাঁটিটি তৈরি করা হয় আরও পশ্চিমে ফ্রাঞ্জ যোসেফ ল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের আলেক্সান্দ্রা ল্যান্ড-এ। এখানেও একটা আড়াই কিঃমিঃ লম্বা এয়ারফিল্ড তৈরি করা হচ্ছে। তিনি-কোণা এই ঘাঁটিগুলিকে বলা হচ্ছে ‘আর্কটিক ট্রেফয়েল’। লাল-সাদা-নীল রং-এর এই ঘাঁটিগুলির ১৪ হাজার বর্গমিটার স্থানে ১’শ ৫০ জন সেনা দেড় বছর থাকতে পারবে বলে বলা হচ্ছে। এগুলি ছাড়াও নোভায়া জেমলিয়া দ্বীপের রোগাচেভো, সাইবেরিয়ার চুকচি সাগরে কেপ শ্মিট ও র‍্যাংগেল দ্বীপ, এবং মুরমানস্ক-এর কাছাকাছি স্রেদনি-তে আরও সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা হচ্ছে।

গত মার্চে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পত্রিকা ‘ক্রাসনায়া জুএজদা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে রুশ নৌবাহিনীর নর্দার্ন ফ্লিটের কমান্ডার এডমিরাল নিকোলাই ইয়েভমেনভ বলেন যে, রুশ সাইবেরিয়ার উত্তরে তিকসি শহরে নতুন করে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে, যা কিনা আর্কটিকের ‘নর্দার্ন সী রুট’ বা ‘এনএসআর’এর আকাশের নিরাপত্তা দেবে। এয়েভমেনভ আরও বলেন যে, নির্দার্ন ফ্লিটকে ‘ব্যাসচন’ উপকূল প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দিয়ে সজ্জিত করা হবে। ‘ব্যাসচন’ ব্যবস্থার মূলে রয়েছে ৬’শ কিঃমিঃ পাল্লার জাহাজ বিধ্বংসী সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘ওনিক্স’। ২০১৮-এর সেপ্টেম্বরে এক সামরিক মহড়ায় আর্কটিকের কোতেলনি দ্বীপে ‘ব্যাসচন’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছিল বলে রুশ মিডিয়া ‘ইন্টারফ্যাক্স’ জানায়। আর একই বছরের নভেম্বর থেকে আর্কটিকে ‘টর-এম২ডিটি’ স্বল্পপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন শুরু হয়েছে বলে রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’ জানায়।

২১শে মে রুশ নৌবাহিনীর নর্দার্ন ফ্লিটের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘ইজভেস্তিয়া’ জানাচ্ছে যে, রুশ সামরিক বাহিনী পুরো আর্কটিক অঞ্চল জুড়ে ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম বসিয়েছে। এই সুবাদে পুরো উত্তর মেরু এলাকা জুড়ে শত্রুপক্ষের যেকোন সামরিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিকে অকার্যকর করে ফেলার সক্ষমতা অর্জন করেছে তারা। মোতায়েনকৃত সরঞ্জামের মাঝে রয়েছে সর্বশেষ প্রযুক্তির ‘মুরমানস্ক-বিএন’ নামের স্ট্রাটেজিক জ্যামিং সিস্টেম, যা কিনা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কিঃমিঃ দূর পর্যন্ত প্রতিপক্ষের শর্টওয়েভ রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা অকার্যকর করে দিয়ে সক্ষম। এই প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে পশ্চিমাদের ‘হাই-ফ্রিকুয়েন্সি গ্লোবাল কমিউনিকেন্স সিস্টেম’কে টার্গেট করে। ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে এই প্রযুক্তি কার্যকর হয়েছে। রুশ পত্রিকা ‘ব্যারেন্টস অবজার্ভার’ জানাচ্ছে যে, এই সিস্টেমের একটা মোতায়েন করা হয়েছে রুশ আর্কটিকের একেবারে পশ্চিমে স্ক্যান্ডিনেভিয়া (নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক)-এর কাছে কোলা উপদ্বীপের সেভেরোমোরস্ক-এ; আর আরেকটা মোতায়েন করা হয়েছে একেবারে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে কামচাটকা উপদ্বীপে। রুশ আর্কটিকে পশ্চিম এবং পূর্ব দিক থেকে ঢোকার পথগুলিকেই পাহাড়া দিচ্ছে এই স্থাপনাগুলি।

‘মুরমানস্ক-বিএন’ ছাড়াও রুশরা ‘ক্রাসুখা-২’ এবং ‘ক্রাসুখা-৪’ নামের মধ্যম-পাল্লার জ্যামিং সিস্টেম মোতায়েন করেছে। এগুলি আড়াই’শ থেকে ৩’শ কিঃমিঃ দূর পর্যন্ত শত্রুর আকাশে পরিবাহিত রাডার অকার্যকর করে ফেলতে সক্ষম। পশ্চিমাদের ‘এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ বা ‘এওয়াকস’ বিমানকে টার্গেট করে এই প্রযুক্তি তৈরি করা হলেও ‘ক্রাসুখা-৪’ স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ ব্যাহত করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়। ২০১৪ সাল থেকে এগুলি সার্ভিসে এসেছে। রুশ আর্কটিকের নোভায়া জেমলিয়া, সেভেরনায়া জেমলিয়া, নিউ সাইবেরিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং চুকোতকা-তে এই সিস্টেমগুলি মোতায়েন করা হয়েছে। এগুলি ছাড়াও সর্বশেষ প্রযুক্তির ‘দিভনোমোরইয়ে’ নামের আরও একটা জ্যামিং সিস্টেম মোতায়েন করা হয়েছে, যা কিনা আকাশে ওড়া বিমানের রাডার ও ইলেকট্রনিক্স এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগ অচল করে দিতে সক্ষম। মধ্যম-পাল্লার এই জ্যামিং সিস্টেমগুলি রুশ আর্কটিকের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিকে নিরাপত্তা দেবার উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়েছে। এগুলিকে খুব দ্রুত মোতায়েন করা এবং সরিয়ে নেয়া সম্ভব। ‘ব্যারেন্টস অবজার্ভার’ বলছে যে, গত দুই বছর ধরেই স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে বেসামরিক বিমান এবং বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ হারাবার ঘটনা ঘটছে। এবছরের মার্চে নরওয়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রুশ সামরিক বাহিনীকে তাদের জ্যামিং অপারেশন থামাবার জন্যে অনুরোধ করেছে। তারা বলছেন যে, রাশিয়া তার নিজ ভূখন্ডে নিজেদের সক্ষমতা যাচাইয়ে যেকোন কিছুই করতে পারে, কিন্তু তা নরওয়ের আকাশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে নয়।





সবকিছুর মূলেই অর্থনীতি

রুশরা আর্কটিকে তাদের অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলির নিরাপত্তা দিতেই এই সামরিকীকরণ করছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আশা করছেন যে, আর্কটিকের ‘নর্দার্ন সী রুট’ বা ‘এনএসআর’ দিয়ে মালামাল পরিবহণ ২০২৫ সাল নাগাদ ৮ কোটি টন হবে। ‘সেন্টার ফর হাই নর্থ লজিস্টিকস’এর হিসেবে ২০১৮ সালে ‘এনএসআর’ দিয়ে ২ কোটি ২ লক্ষ টন মালামাল পরিবাহিত হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ১ কোটি ৭ লক্ষ টন। রুশ মিডিয়া ‘আরবিসি’ জানাচ্ছে যে, গত মার্চে রুশ ‘ন্যাচারাল রিসোর্সেস এন্ড এনভায়রনমেন্ট মিনিস্ট্রি’ আর্কটিকে মোট ১’শ ১৮টা প্রকল্পের এক বিশাল তালিকা সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। তাদের হিসেবে এই প্রকল্পগুলিতে মোট বিনিয়োগ হবে ১০ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন রুবল বা ১’শ ৬৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এই পুরো বিনিয়োগই ‘এনএসআর’ বরাবর হবে। বর্তমানে চলমান ২৫টা প্রকল্পের মাঝে রয়েছে রুশ সরকারি কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’এর ‘নভোপোর্টোভস্কই’ তেলের খনি; রুশ সরকারি কোম্পানি ‘রজফেফত’এর ‘ভ্যানকর’ তেলের খনি; সাইবেরিয়াতে ‘গ্যাজপ্রম’এর ‘আচিমগ্যাজ’ খনি; এবং সবচাইতে বড় ‘ইয়ামাল’ এলএনজি প্রকল্প। ২০১৬ সালের মে মাসে ভ্লাদিমির পুতিন ‘নভোপোর্টোভস্কই’ তেলের খনি থেকে প্রথমবারের মতো তেল উত্তোলন এবং পরিবহন উদ্ভোধন করেন। এই প্রকল্পে মোট ১’শ ৮৬ বিলিয়ন রুবল বা ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে বলে বলেন তিনি।

রুশ ইহুদি বিলিয়নেয়ার লিওনিড মিখেলসন-এর কোম্পানি ‘নোভাটেক’-এর নেতৃত্বে ‘ইয়ামাল’ উপদ্বীপে চলছে ২৭ বিলিয়ন ডলারের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এখান থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করে তরলীকৃত করে ‘এলএনজি’ আকারে জাহাজে করে গ্যাস রপ্তানি করা হচ্ছে চীনে। ‘ইয়ামাল’এর মালিকারার ৫০ শতাংশ রয়েছে রুশ কোম্পানি ‘নোভাটেক’-এর হাতে। বাকিটার ২০ শতাংশ রয়েছে ফরাসী কোম্পানি ‘টোটাল’এর কাছে; আরও ২০ শতাংশ চীনা কোম্পানি ‘সিএনপিসি’এর কাছে; আর আর বাকি প্রায় ১০ শতাংশের মতো রয়েছে চীনা ‘সিল্ক রোড ফান্ড’এর কাছে। ‘ইয়ামাল’ বছরে প্রায় ১ কোটি ৬৫ লক্ষ টন এলএনজি উৎপাদন করতে সক্ষম। এলএনজি পরিবহণের জন্যে সেখানে তৈরি করা হচ্ছে ‘সাবেত্তা’ নামের এক সমুদ্রবন্দর। সেখান থেকে এলএনজি পরিবহণ করে চীন পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্যে দৈত্যাকৃতির একেকটা প্রায় ৩’শ মিটার লম্বা এবং ১ লক্ষ ১০ হাজার টন এলএনজি ধারণক্ষমতার ১৫টা জাহাজ তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলি কিনা আড়াই মিটার পর্যন্ত পুরু বরফ ভেঙ্গে চলতে সক্ষম। ফিনল্যান্ডে ডিজাইন করা এই জাহাজগুলিকে তৈরি করছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি দাইউ শিপবিল্ডিং। জাহাজগুলির মালিকানা রয়েছে মূলতঃ আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলির কাছে – ড্যানিশ-ক্যানাডিয়ান কোম্পানি ‘টিকে কর্পোরেশন’ এবং ‘চায়না এলএনজি’এর জয়েন্ট ভেঞ্চার (৬টা), গ্রীক বিলিয়নেয়ার জর্জ প্রকোপিউ-এর কোম্পানি ‘ডাইনাগ্যাস’ (৫টা), জাপানি কোম্পানি ‘এমওএল’ (৩টা) এবং রুশ কোম্পানি ‘সভকমফ্লট’ (১টা)।
 


‘ইয়ামাল’এর পাশেই ‘গাইদান’ উপদ্বীপে নেয়া হয়েছে ‘আর্কটিক এলএনজি-২’ নামের ২৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের আরও একখানা মেগা প্রকল্প। এর উৎপাদন ক্ষমতা হবে বছরে ১ কোটি ৯৮ লক্ষ টন এলএনজি। রুশ কোম্পানি ‘নোভাটেক’ নিজেদের কাছে ৬০ শতাংশের মতো মালিকানা রেখে বাকিটা বিক্রি করার প্রচেষ্টায় রয়েছে। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, গত এপ্রিলে ‘নোভাটেক’ চীনের দু’টা কোম্পানির (‘সিএনওডিসি’ ও ‘সিএনওওসি’) কাছে ২০ শতাংশ মালিকানা বিক্রি করেছে। এর আগেই ২০১৯-এর শুরুতে ফরসী কোম্পানি ‘টোটাল’ কিনেছে ১০ শতাংশ মালিকানা। ‘নোভাটেক’ কোম্পানির মাঝেই আবার ‘টোটাল’এর ১৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গত ডিসেম্বরেই খবর আসে যে, এই প্রকল্পে সৌদি কোম্পানি ‘আরামকো’, জাপানি কোম্পানি ‘মিতসুই’ এবং ‘রাশান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’ বিনিয়োগ করতে চাইছে। ২০২২-২৩ সাল থেকে এই প্রকল্পে উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। ক’দিন আগেই ফরাসী কোম্পানি ‘টেকনিপ’কে এই প্রকল্প তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।

চীনারা রুশ আর্কটিকে তেল-গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে বিনিয়োগ করছে। আর্কটিকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা কোম্পানি ‘সিএনওওসি’এর সাথে রুশ কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’এর এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে ইয়ামাল উপদ্বীপের পশ্চিমে কারা সাগরে ২০১৭ সাল থেকে কাজ করছে ১৫ হাজার টনের চীনা ড্রিলিং রিগ ‘নান হাই বা হাও’। ইতোমধ্যেই চীনারা সেখানে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার বা প্রায় ৪২ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস আবিষ্কার করেছে।


২০১৮-এর মার্চে ‘আইস এক্সারসাইজ-২০১৮’ নামের মহড়ার সময় মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন ‘ইউএসএস হার্টফোর্ড’ ও ‘ইউএসএস কানেকটিকাট’ এবং ব্রিটিশ রয়াল নেভির সাবমেরিন ‘এইচএমএস ট্রেনচ্যান্ট’ একত্রে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ ফুঁড়ে উঠে আসে। এধরনের মিশনের মাধ্যমে পশ্চিমারা দক্ষিণ চীন সাগরে যে কাজটা করছে, সেটাই উত্তর মেরুতে করছে; আর তা হলো, পশ্চিমাদের ঘোষিত আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে নিজেদের সামরিক জাহাজ যেতে পারার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

পশ্চিমা প্রত্যুত্তর

আর্কটিকে রাশিয়ার সামরিকীকরণের প্রত্যুত্তর হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলিও আর্কটিক এলাকায় মহড়া চালাচ্ছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ডে মার্কিন এবং ব্রিটিশ সেনারা নিয়মিত মহড়া চালাচ্ছে। সেখানে তাপমাত্রা শূণ্যের ৩০ ডিগ্রী নিচে পর্যন্ত নেমে যায়। গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে ন্যাটো ‘ট্রাইডেন্ট জাঙ্কচার’ নামে এক সামরিক মহড়া করে, যাতে অংশ নেয় ৫০ হাজার সৈন্য, ৬৫টা যুদ্ধজাহাজ, ২’শ ৫০টা যুদ্ধবিমান, ১০ হাজার গাড়ি। ১৯৮৭ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো মার্কিন নৌবাহিনী আর্কটিক অঞ্চলের কাছাকাছি একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি ছাড়াও এতে অংশ নেয় সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড। ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ‘ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজ’এর ম্যারি থম্পসন বলছেন যে, এধরনের মহড়া সংজ্ঞাগতভাবেই সীমাবদ্ধ। এই মহড়ার কারণে অত্র এলাকার সামরিক ব্যালান্সে স্থায়ী কোন পরিবর্তন সংগঠিত হবে না; স্থায়ী কোন সামরিক স্থাপনাও তৈরি হবে না। আবার এর ফলশ্রুতিতে বরফাচ্ছাদিত এলাকায় চলাচলের জন্যে কোন আইসব্রেকারও তৈরি করা হবে না।

২০১৩ সালের অগাস্টে মার্কিন নৌবাহিনীর পারমানবিক শক্তিচাইল সাবমেরিন ‘ইউএসএস সীউলফ’ যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের ওয়াশিংটনে রাজ্যের ব্রেমারটন নৌঘাঁটি থেকে যাত্রা করে এক মাস পর নরওয়ের হাকন্সভার্ন নৌঁঘাঁটিতে গিয়ে নোঙ্গর করে; যেখানে নরওয়েতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্যারি হোয়াইট সাবমেরিন পরিদর্শন করেন। মানচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব যে সাবমেরিনটার প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ইউরোপ যাবার একমাত্র পদ্ধতিই হলো উত্তর মেরুর বরফের নিচ দিয়ে যাওয়া! ২০১৮-এর মার্চে ‘আইস এক্সারসাইজ-২০১৮’ নামের মহড়ার সময় মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন ‘ইউএসএস হার্টফোর্ড’ ও ‘ইউএসএস কানেকটিকাট’ এবং ব্রিটিশ রয়াল নেভির সাবমেরিন ‘এইচএমএস ট্রেনচ্যান্ট’ একত্রে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ ফুঁড়ে উঠে আসে। এধরনের মিশনের মাধ্যমে পশ্চিমারা দক্ষিণ চীন সাগরে যে কাজটা করছে, সেটাই উত্তর মেরুতে করছে; আর তা হলো, পশ্চিমাদের ঘোষিত আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে নিজেদের সামরিক জাহাজ যেতে পারার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

সাবমেরিনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আর্কটিকে তার শক্তি প্রদর্শন করতে পারবে নিশ্চিত, তবে পানির উপরের ভাসমান জাহাজও তার দরকার হবে। আর ভাসমান জাহাজকে আর্কটিক অঞ্চলে চালাতে হলে পুরু বরফের আচ্ছাদন ভেঙ্গে চলার মতো আইসব্রেকার দরকার হবে। মার্কিন কোস্ট গার্ডের হিসেবে ২০ হাজার ব্রেকহর্সপাওয়ার বা এর চাইতে বেশি শক্তিশালী আইসব্রেকারের পক্ষেই শুধুমাত্র আর্কটিকে কাজ করা সম্ভব। আর্কটিক যে এতকাল যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে তেমন গুরুত্ব বহণ করেনি, তার প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে মাত্র ৪টা আইসব্রেকার, যা কিনা আর্কটিক অঞ্চলে চলাচলে সক্ষম। ৪৩ বছর পর গত ফেব্রুয়ারিতে অবশেষে মার্কিন সরকার দু’টা আইসব্রেকার তৈরি করার জন্যে অর্থের সঙ্কুলান করেছে। কানাডার ৫টা আইসব্রেকারের মাঝে মাত্র দু’টা আর্কটিকে চলতে পারে। তারা বর্তমানে ৬টা হেভি আইসব্রেকার তৈরি করছে, যার প্রথমটা তৈরি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ফিনল্যান্ডের ১০টা আইসব্রেকারের মাঝে মাত্র ৩টা আর্কটিকের জন্য উপযোগী; সুইডেনের ১টা; আর জাপানের ১টা।
‘এনএসআর’এর নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাশিয়া কিছু আইসব্রেকারকে অস্ত্রসজ্জিতও করছে। বর্তমানে নির্মীয়মান ‘প্রজেক্ট ২৩৫৫০’ প্রকল্পের জাহাজগুলি প্যাট্রোল জাহাজ হলেও এগুলি আর্কটিকে বরফ ভেঙ্গে চলার মতো করে তৈরি করা হচ্ছে। এগুলিকে কামান এবং ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে

 
অন্যদিকে রাশিয়ার মোট ৪৬টা আইসব্রেকারের মাঝে আর্কটিকে চলাচলের জন্যে রয়েছে ২৬টা; যার মাঝে ৬টা আবার পারমানবিক শক্তিচালিত হেভি আইসব্রেকার। আর্কটিকে বরফে কোন একটা জাহাজ আটকা পড়ে গেলে পারমাণবিক আইসব্রেকারই সবচাইতে নির্ভরযোগ্য। কারণ তেলে-চালিত হলে সেটাকে আবার তেল নিতে হবে। রুশ আর্কটিকের হাজার মাইলের বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে জ্বালানির ব্যবস্থা করাটা আরেক চ্যালেঞ্জ। আরও ১১টা আইসব্রেকার তৈরি করছে রাশিয়া; যার মাঝে পারমাণবিক আইসব্রেকার রয়েছে কমপক্ষে ৩টা। রুশ আর্কটিকের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনা এবং সামরিক ঘাঁটিগুলিকে জ্বালানি, খাবার-দাবার এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহ করে বছরব্যাপী চালু রাখতে আইসব্রেকারের কোন বিকল্প নেই। ‘এনএসআর’এর নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাশিয়া কিছু আইসব্রেকারকে অস্ত্রসজ্জিতও করছে। বর্তমানে নির্মীয়মান ‘প্রজেক্ট ২৩৫৫০’ প্রকল্পের জাহাজগুলি প্যাট্রোল জাহাজ হলেও এগুলি আর্কটিকে বরফ ভেঙ্গে চলার মতো করে তৈরি করা হচ্ছে। এগুলিকে কামান এবং ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে বলেও খবরে প্রকাশ। এগুলি ছাড়াও আর্কটিকে চলার জন্যে রাশিয়া স্পেশালিস্ট ট্যাঙ্কার জাহাজ, মাল্টি-পারপাস জাহাজ, আর্মামেন্ট সাপোর্ট শিপ এবং অন্যান্য ধরনের জাহাজ তৈরি করছে, যেগুলি ঐ অঞ্চলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। পশ্চিমাদের কাছে এগুলির ধারেকাছেও কোনকিছু নেই।

পশ্চিমা দেশগুলির আর্কটিকে তেমন কোন স্থাপনা নেই বলে তাদের হেভি আইসব্রেকারের দরকারও কম। আইসব্রেকারে বিনিয়োগই বলে দিচ্ছে কে আর্কটিককে কিভাবে দেখছে। রাশিয়ার জন্যে আর্কটিক অর্থনৈতিকভাবে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পশ্চিমা দেশগুলির জন্যে কি ততটা গুরুত্বপূর্ণ? পশ্চিমারা আর্কটিকে শুধুমাত্র প্রভাব ধরে রাখতে সামরিক খাতে কতটা বিনিয়োগ করবে? কতগুলি আইসব্রেকারই বা তারা তৈরি করবে, যেগুলির কাজ হবে শুধুমাত্র রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করা? কোন ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা পাবার আশা ছাড়াই পশ্চিমারা আর্কটিকে স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করবে কি?

আর্কটিকের ভবিষ্যৎ কি?

রাশিয়া নিজেকে বিশ্বশক্তির কাতারে নিয়ে যেতে তার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে আর্কটিকে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে আসছে রাশিয়া। বিনিয়োগকারীরাও চাইবে তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা হোক। তাই আর্কটিকের অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলির নিরাপত্তা দেবার রুশ প্রচেষ্টাকে বিনিয়োগকারীরা প্রশ্নবিদ্ধ করবে না; বরং নিরাপত্তার ব্যাপারগুলি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুরক্ষা দেবার রুশ সক্ষমতাকেই তুলে ধরবে। রুশ আর্কটিকে বিনিয়োগের এক বিশেষ দিক হলো এর উৎপাদিত বেশিরভাগ খনিজ সম্পদ চীনে রপ্তানি হবে। আর চীনা অর্থনীতির সাথে জড়িত হয়ে দুনিয়ার বড় বড় বিনিয়োগকারীরাও আরও বিত্তশালী হতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরা বরং ‘এনএসআর’কে ঝামেলা-মুক্ত দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তবে ‘এনএসআর’এর গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পশ্চিমাদের ব্যাপক বিনিয়োগ এ-ও বলে দিচ্ছে যে তারা রুশ আর্কটিককে একেবারে চীনের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে না। পশ্চিমাদের বিনিয়োগের কারণেই আর্কটিকে চীনা প্রভাব নিয়ন্ত্রণে থাকবে, যা কিনা রাশিয়াকেও নাখোশ করবে না। অন্যদিকে কানাডার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ‘নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজ’ যাতে চীনা প্রভাবের মাঝে পড়ে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্যাসেজ ব্যবহার করে চীন থেকে ইউরোপে জাহাজ যেতে পারবে অনেক তাড়াতাড়ি। কানাডার উপর প্রভাব খাটাতে পারলে এটা ‘এনএসআর’এর আরেকটা বিকল্পও হতে পারে চীনের জন্যে। আর একারণেই কানাডাকে নাখোশ করে হলেও ‘নর্থ-ওয়েস্ট প্যাসেজ’এর আন্তর্জাতিকীকরণ চাইবে যুক্তরাষ্ট্র।

চীনও চাইছে তার জ্বালানি চাহিদার একটা অংশকে মার্কিন নৌশক্তির নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে দূরে সরিয়ে নিতে। ‘এনএসআর’এর মাধ্যমে এলএনজি-বাহী জাহাজগুলি রুশ সামরিক পাহাড়ায় প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। আর এভাবেই রাশিয়ার এই নৌ-রুট হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া এর আগে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ কোন নৌপথের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ‘গ্লোবাং ওয়ার্মিং’এর কারণে খুলে যাওয়া ‘এনএসআর’ রাশিয়াকে একটা ম্যারিটাইম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিতে যাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রুশ পত্রিকা ‘দ্যা মস্কো টাইমস’এ এক লেখায় অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ‘সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান স্টাডিজ’এর এলিজাবেথ বুকানান বলেন যে, ইউরোপ এবং এশিয়ার সংযোগ হিসেবে ‘নর্দার্ন সী রুট’ বা ‘এনএসআর’ রাশিয়াকে আর্কটিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলছেন যে, ‘এনএসআর’এর ব্যবহার থেকে রাশিয়া যতটা না ট্যারিফ আয় করবে, তার চাইতে বড় ব্যাপার হবে পৃথিবীর একটা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র রুটের উপরে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারা, যা কিনা হবে ইতিহাসে প্রথম।


Monday 20 May 2019

ব্যাটল ফর দ্যা ইন্ডিয়ান ওশান – (পর্ব ১ - মুসলিম লেক)


পারস্য উপসাগরের বসরা থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত ৭০ দিনে যাওয়া যেতো। ভুমধ্যসাগরে একটা জাহাজের গতি ছিল এর প্রায় অর্ধেক। দ্রুত এবং সহজ পরিবহণের কারণেই ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের প্রসার সহজ ছিল।

২০শে মে ২০১৯

ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ রবার্ট ডি ক্যাপলান ভারত মহাসাগরকে বুঝতে গিয়ে অত্র অঞ্চলের অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন; বুঝতে চেষ্টা করেছেন এখানকার ভূমি, মানুষ, জলবায়ু, কৃষি, ভাষা, সংস্কৃতি। তাঁর কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এই মহাসাগরের মৌসুমি বায়ু। এই মৌসুমী বায়ু অন্যান্য মহাসমুদ্রেও রয়েছে; তবে সেসব সাগরের মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতি ভারত মহাসাগরের মতো পরিবর্তনশীল নয়। ভারত মহাসাগরে বছরের ছয় মাস এই বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে প্রবাহিত হয়; বাকি ছয় মাস পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে উত্তর-পূর্ব দিক হতে প্রবাহিত হয়। অন্যান্য সাগরে ঋতুর পরিবর্তনে বাতাসের গতি এবং কিছুটা ক্ষেত্রে দিক পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ভারত মহাসাগরের মতো একেবারে উল্টো দিক প্রবাহিত হয় না। তা-ও আবার এই মৌসুমী বায়ুর ধরণ অতি নিয়মিত। এটা কোন দিন থেকে দিক পরিবর্তন করবে, সেটা মোটামুটিভাবে জানাই থাকে। একারণে অত্র এলাকার মানুষ তাদের জীবন-জীবিকাকে এই মৌসুমী বায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। ক্যাপলানের কাছে এই ব্যাপারটাই ভূরাজনৈতিক দিক থেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এই মৌসুমী বায়ুকে কাজে লাগিয়েই ভারত মহাসাগরের আশেপাশে বাস করা মানুষেরা পাল তোলা জাহাজের ব্যবহার করে পরিবহণ এবং বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। সময় বুঝে জাহাজের পাল তুলে দিলেই হলো; মৌসুমী বায়ুই জাহাজকে একেবারে সাগরের ওপাড়ে নিয়ে যাবে – রেকর্ড সময়ে। পারস্য উপসাগরের বসরা থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত ৭০ দিনে যাওয়া যেতো। ভুমধ্যসাগরে একটা জাহাজের গতি ছিল এর প্রায় অর্ধেক। দ্রুত এবং সহজ পরিবহণের কারণেই ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের প্রসার সহজ ছিল।

বাণিজ্যের সাথে ইসলাম...

বাণিজ্য করতো আরবের মানুষ। মরু এলাকায় শস্য হয় খুব কম। তাই বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক কিছুই দূর দেশ থেকে কিনে আনতে হতো। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীন ছিল বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদনকারী এবং একইসাথে বড় বাজার। আর অত্র অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথে বাণিজ্যের প্রসার ঘরে আরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর আন্দ্রে উইঙ্ক বলছেন যে, ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অবস্থানে ভারত এবং এর পূর্ব-পশ্চিমে চীন এবং আরব থাকার যে ভৌগোলিক সুবিধা তৈরি হয়েছিল, তা ইসলামের অধীনেই সবচাইতে বেশি কার্যক্ষমতা লাভ করে। ইসলামিক দাওয়া পৌঁছে দেবার চেষ্টা এতে আরও গতি সঞ্চার করে। আরবের মুসলিম বণিকেরা পুরো ভারত মহাসাগর চষে বেড়িয়েছেন। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া-ফিলিপাইন এবং চীন পর্যন্ত বাণিজ্যের সাথে সাথে ইসলামের দাওয়া পৌঁছে যায়। পুরো ভারত মহাসাগর জুড়ে মুসলিম বণিকেরা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির প্রসার ঘটান। প্রতিটা বাণিজ্য কেন্দ্রে ছিল মুসলিম জনগণ এবং এর সাথে ছিল মুসলিম সংস্কৃতির উদাহরণগুলি; যেমন মসজিদ। ভারতের কর্ণাটক উপকূল, বাংলার চট্টগ্রাম বন্দর, বার্মার উপকূল, আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্বের মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, মালাক্কা, মালুকু দ্বীপপুঞ্জ, ব্রুণাই, ফিলিপাইনের মাইনিলা (বর্তমান ম্যানিলা) এবং মিন্দানাও – সকল স্থানেই মুসলিম সংস্কৃতি শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে যায়।

পূর্ব আফ্রিকার পুরো উপকূল মুসলিমদের অধীন ছিল। অষ্টম শতকেই মোজাম্বিক পর্যন্ত ইসলাম পৌঁছে যায়। আর ১০ম শতক নাগাদ ইসলাম ছিল পূর্ব আফ্রিকার একমাত্র শক্তি। ভারতের দক্ষিণের কর্ণাটকে ইসলাম পৌঁছে যায় সপ্তম শতকে। মুসলিম বণিকেরা আফ্রিকা থেকে কফি, ইন্দোনেশিয়া থেকে মসলা, আর চীন থেকে কাগজ নিয়ে আসে কর্ণাটকে। অষ্টম শতকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধু অঞ্চল ইসলামের অধীনে আসে; আর তের শতক নাগাদ পুরো ভারতেই ইসলামের শাসন কায়েম হয়ে যায়। সপ্তম শতকেই ইন্দোনেশিয়া এবং চীন পর্যন্ত ইসলামের বাণী পৌঁছে যায়। ত্রয়োদশ শতকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার উত্তরের আচেহ এলাকায় ইসলামের শাসন কায়েম হয়। চতুর্দশ শতকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বের মালুকু দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম পৌঁছায়। সেখানকার মসলা ছিল ভারত মহাসাগরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার মাঝে অন্যতম। একই সময়ে ফিলিপাইনের দক্ষিণে মিন্দানাও-এ ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায় ১৩৯০ সাল নাগাদ। মালয়, ব্রুণাই এবং ফিলিপাইনের বাকি এলাকায় ইসলাম কায়েম হয় পঞ্চদশ শতক থেকে ষোড়শ শতকের মাঝে।
ইউরোপিয়দের আগমণের আগ পর্যন্ত ভারত মহাসাগর ছিল একটা “মুসলিম লেক”। এই বিশাল মহাসমুদ্রের চারিদিকে ছিল মুসলিম সভ্যতা। অমুসলিমরা যারা এই মহাসাগরে বাণিজ্য করেছে, তারা মুসলিমদের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখেই বাণিজ্য করেছে। কোন যুদ্ধ ছিল না এই সাগরে; ছিল না যুদ্ধজাহাজ। বন্দর দখলের কোন প্রতিযোগিতাও ছিল না।

“মুসলিম লেক”?

পঞ্চদশ শতক নাগাদ ভারত মহাসাগর-সহ এর আশেপাশের লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, মালয় দ্বীপপুঞ্জের সাগরসমূহ, দক্ষিণ চীন সাগর এমনকি ফিলিপাইনের আশেপাশের সাগরগুলিতেও মুসলিম বণিকরাই মূলতঃ বাণিজ্য করতো। আর এর বেশিরভাগ অঞ্চলে ইসলামিক শাসন কায়েম হয়ে যাওয়ায় এই বাণিজ্যের ভিত ছিল বেশ শক্ত। চীনের শাসকেরা ইসলাম না নিলেও তাদের কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় লোকেরা ছিলেন মুসলিম। আর মুসলিমদের সাথে চীনারা বাণিজ্য করে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করায় চীনের উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা ছিল; মসজিদও ছিল অনেক। ভারত মহাসাগর-জুড়ে বাণিজ্য জাহাজ চলতো শুধু মুসলিমদেরই। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সেসময়ের এই ইতিহাসের নিদর্শন পাওয়া যায়। সেখানকার বাণিজের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলির মাঝে ছিল জানজিবার, মোম্বাসা, মোগাদিশু, মালিন্দি, কিলওয়া, পেমবা, ছাড়াও মোট প্রায় ৪০টার মতো বন্দর। এই বন্দরগুলিতে আজও পাওয়া যায় আরব, ভারতীয়, ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমদের এবং তাদের নিয়ে আসা সংস্কৃতিকে।

ব্রিটিশ ভূগোলবিদ এবং ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার ‘ক্লোজড সী’-এর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। ‘ক্লোজড সী’ হলো এমন এক সাগর, যার চারিপাশের স্থলভাগ একটা শক্তির নিয়ন্ত্রণে। একসময় রোমান সাম্রাজ্য পুরো ভূমধ্যসাগর নিজেদের অধীনে নিয়ে নিয়েছিল। এর উত্তরের পুরো উপকূল (বর্তমান স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস, তুরস্ক) ছিল তাদের অধীন; পুর্বের সিরিয়া উপকূল এবং দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকার পুরো উপকূলও (বর্তমান, মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো) চলে আসে তাদের দখলে। অর্থাৎ পুরো ভূমধ্যসাগরের উপকূল তাদের সাম্র্যাজের মাঝে চলে আসে। এমতাবস্থায় এই সমুদ্রে তাদের নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউই ছিল না। তাই এই সাগর ধরে রাখতে তাদের কোন নৌবাহিনীই দরকার ছিল না। উত্তর আফ্রিকার কার্থেজ সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধের সময় রোমানদের বিরাট নৌবাহিনী তৈরি করতে হয়েছিল। তবে কার্থেজদের সাথে জিতে যাবার পর এই নৌবহরের আর দরকার ছিল না। রোমানদের মতো এরকম উদাহরণ আরও রয়েছে। যেমন সপ্তদশ শতক পর্যন্ত উথমানি খিলাফতের অধীনে ছিল পুরো কৃষ্ণ সাগর। অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ রাশিয়ার অধীনে চলে যাবার পর কৃষ্ণ সাগরের নিয়ন্ত্রণ হারায় উথমানিরা। এরপর থেকেই কৃষ্ণ সাগরে রুশদের মোকাবিলায় তাদেরকে নৌবহর রাখতে হয়েছে। 

‘ক্লোজড সী’ হলো এমন এক সাগর, যার চারিপাশের স্থলভাগ একটা শক্তির নিয়ন্ত্রণে। একসময় রোমান সাম্রাজ্য পুরো ভূমধ্যসাগর নিজেদের অধীনে নিয়ে নিয়েছিল। এর উত্তরের পুরো উপকূল (বর্তমান স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস, তুরস্ক) ছিল তাদের অধীন; পুর্বের সিরিয়া উপকূল এবং দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকার পুরো উপকূল (বর্তমান, মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো) চলে আসে তাদের দখলে।

এরও আরও অনেক পর ব্রিটিশরা ভারত মহাসাগরের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল ঊনিশ শতকে। সেসময় ভারত মহাসাগর এবং তৎসংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরে ফরাসী, জার্মান, ডাচ, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, এমনকি মার্কিনীরাও পরবর্তীতে যোগ দেয়। রুশ এবং জাপানিরাও একসময় নিজেদের নৌশক্তি প্রতিষ্ঠা করে। এরপরেও ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার দরজাগুলি। দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ব্রিটিশদের হাতে; আর সুয়েজ খাল তৈরি হবার আগ পর্যন্ত ইউরোপের যেকোন জাহাজকে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে আসতে হতো। ভারত মহাসাগরের পূর্ব আফ্রিকা উপকূল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, বার্মা ছিল ব্রিটিশ অধীনে। তাই কারুর সাধ্যি ছিল না ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে। সিঙ্গাপুর ছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বিরাট ঘাঁটি; যা কিনা পূর্ব দিক থেকে ভারত মহাসাগরে ঢোকার পথ নিয়ন্ত্রণ করতো। সুয়েজ খাল খনন শেষ হয় ১৮৬৯ সালে। ব্রিটিশরা সেটারও নিয়ন্ত্রণ নেয়। এছাড়াও ভূমধ্যসাগরে জিব্রালটার, মাল্টা এবং সাইপ্রাস দ্বীপ তাদের অধীনে থাকায় সুয়েজ খাল দিয়ে ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া কারুর পক্ষে ভারত মহাসাগরে ঢোকা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ঊনিশ শতকে সম্পূর্ণ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে ছিল ভারত মহাসাগর। এই মহাসাগর হয়ে গিয়েছিল একটা “ব্রিটিশ লেক”!

তবে ইউরোপিয়দের আগমণের আগ পর্যন্ত ভারত মহাসাগর ছিল একটা “মুসলিম লেক”। এই বিশাল মহাসমুদ্রের চারিদিকে ছিল মুসলিম সভ্যতা। অমুসলিমরা যারা এই মহাসাগরে বাণিজ্য করেছে, তারা মুসলিমদের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখেই বাণিজ্য করেছে। কোন যুদ্ধ ছিল না এই সাগরে; ছিল না যুদ্ধজাহাজ। বন্দর দখলের কোন প্রতিযোগিতাও ছিল না। ইসলামিক চিন্তাতে অর্থ তেমন গুরুত্ব বহণ করে না; যেকারণে বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদশালী হলেও আট’শ বছরের মাঝে জোর করে নিজেদের একচেটিয়া বাণিজ্য ধরে রাখার চেষ্টা কেউ করেনি। অপরের গলা কেটে নিজে বিত্তবান হবার প্রবণতা ছিল না। বাণিজ্যের প্রসারে পুরো ভারত মহাসাগরের চারিদিকের মানুষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছিল। “মুসলিম লেক” পাল্টে যায় চতুর্দশ শতকের শেষে ভারত মহাসাগরে পর্তুগীজদের আবির্ভাবের পর থেকে। ভারত মহাসাগরের পরবর্তী ইতিহাস রক্তপাতের।


-------------------------------------------------------

‘Monsoon: The Indian Ocean and the Future of American Power’ by Robert D Kaplan, 2011

‘Al-Hind: The Making of the Indo-Islamic World’ by Andre Wink, 2002

‘Democratic Ideals and Reality: A Study in the Politics of Reconstruction’ by Sir Halford J Mackinder, 1919