Saturday 31 December 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ - ২০২৩ সালের সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি

৩১শে ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধক্ষেত্রে এখনও এতটা স্থবিরতা আসেনি যে, কোন একটা পক্ষ শান্তির জন্যে মরিয়া হয়ে যাবে। তবে ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতা পুরোপুরিভাবে নির্ভর করছে পশ্চিমা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার সক্ষমতার উপর। ইউক্রেনিয়রা নিশ্চিত যে তাদের দেশের দখলীকৃত অঞ্চল ফেরত পাবার অর্থই হবে বিজয়। কিন্তু পশ্চিমারা একমত নয় যে, প্রকৃত বিজয় কোনটা। এই অনিশ্চয়তার মাঝে ইউরোপের নিরাপত্তাও অনেকটাই ঝুলে থাকবে।

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ‘বিবিসি’ কয়েকজন বিশ্লেষকের মতামত তুলে ধরেছে; যাদের মাঝে কিছুটা মতৈক্য থাকলেও মতানৈক্যই বেশি। ব্রিটেনের ‘স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইন্সটিটিউট’এর এসোসিয়েট ডিরেক্টর মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, রুশরা যতটা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে চাইছে, ইউক্রেনিয়রা ততটাই আক্রমণে যেতে চাইছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেঃ জেনারেল বেন হজেস বলছেন যে, যদিও এখনই ইউক্রেনের জন্যে বিজয় উৎসব করা ঠিক হবে না, তথাপি যুদ্ধের গতি এখন তাদের পক্ষেই রয়েছে। শীতকালে যুদ্ধের গতি কিছু কম হতে পারে। তবে পশ্চিমা সহায়তার কারণে ইউক্রেনিয়রা রুশদের চাইতে অপেক্ষাকৃত সহজে শীতকাল অতিক্রম করতে পারবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর নেভাল এনালিসিস’এর ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান রাশিয়া-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিডল’এর এক লেখায় একমত পোষণ করে বলছেন যে, শীতকালে অপারেশন চালানো কঠিন হলেও ইউক্রেনিয়রা হয়তো আক্রমণে যাবে। একইসাথে ইউক্রেনিয়রা হয়তো রাশিয়ার ভেতরে দূরবর্তী কৌশলগত টার্গেটে হামলা করতে থাকবে। এগুলির মূল উদ্দেশ্য হলো, রাশিয়াকে শীতকাল বা শীতকালের পর আক্রমণে যাওয়ায় বাধা দেয়া। ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পর্যন্ত প্রমাণ করেছে যে, প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে দ্রুতি আনার সুযোগ তৈরি করা যায়।

মাইকেল ক্লার্কের কথায়, ইউক্রেনিয়রা এই মুহুর্তে পূর্বাঞ্চলের ডনবাসে বড় রকমের সাফল্যের খুব কাছে রয়েছে। ক্রেমিনা এবং সাতোভে শহর দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে ইউক্রেনিয়রা। এই শহরগুলি রুশদের লজিস্টিকসের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই অঞ্চলে খুব বেশি ভালো রাস্তা নেই। এই শহরদু’টা ইউক্রেনিয়দের হাতে চলে গেলে রুশদেরকে প্রায় ৬০কিঃমিঃএরও বেশি দূরের এলাকায় পিছিয়ে যেতে হবে; যেখানে তার হয়তো প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান তৈরির জন্যে ভৌগোলিক সহায়তা পেতে পারে। ক্লার্কের সাথে একমত ইস্রাইলি সামরিক বিশ্লেষক ডেভিড গেন্ডেলমান; যিনি বলছেন যে, এই অঞ্চলে ইউক্রেনিয় সফলতা রুশদের উত্তরের পুরো ফ্রন্টলাইনকেই বিপদে ফেলে দেবে।

ক্লার্ক মনে করছেন যে, একই সময়ে ইউক্রেনিয়দের পক্ষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খেরসনের আশেপাশে নতুন করে আক্রমণ শুরু করাটা কঠিন হতে পারে। তবে হঠাৎ করে ইউক্রেনিয়রা সেখানে আক্রমণ করলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ এর আগেও সেটা তারা সফলভাবে করেছে। অপরদিকে রুশরা তাদের নতুন করে মোবিলাইজ করা ৩ লক্ষ সেনাকে ব্যবহার করে শীতের পরপরই আক্রমণে যেতে চাইতে পারে। তবে এই আক্রমণে রুশদের লক্ষ্য কি হতে পারে, তা নিশ্চিত নয়। বরং স্বল্প সময়ের একটা ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাই বেশি থাকবে।

মাইকেল ক্লার্কের সাথে দ্বিমত পোষণ করে জেনারেল বেন হজেস বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা খুব সম্ভবতঃ শীতকালের মাঝেই দক্ষিণের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের জন্যে আক্রমণ শুরু করবে। এর কারণ, রুশরা খেরসন ছেড়ে দিয়ে সামরিক এবং মনোবলের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে; আর অপদিকে ইউক্রেনিয়দের মাঝে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার হয়েছে, অপরদিকে তাদের লজিস্টিকসের অবস্থা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। হজেস মনে করছেন যে, ২০২৩ সালের মাঝেই পুরো ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ইউক্রেনিয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মাইকেল কফম্যান বলছেন যে, খেরসনের আশেপাশে রুশরা অত্যন্ত শক্ত প্রতিরক্ষা তৈরি করেছে; যেগুলি অতিক্রম করতে গেলে ইউক্রেনিয়দের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন হতে হবে এবং আক্রমণ হবে ধীরগতির।
 

ডেভিড গেন্ডেলমান বলছেন যে, রুশরা তাদের মোবিলাইজ করা ৩ লক্ষ সেনার বেশিরভাগই এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করেনি। অপরদিকে খেরসন ছেড়ে আসার পর রুশদের বেশকিছু ইউনিট বেকার হয়ে গেছে। এই বাহিনীগুলিকে ব্যবহার করে রুশরা নতুন করে আক্রমণে যেতে পারে। এক্ষেত্রে বড় কোন কৌশলগত লক্ষ্য নিয়ে আক্রমণে না গেলেও সেটা হতে পারে অত্যন্ত ধীরগতির আক্রমণ; যেখানে ক্ষয়ক্ষতি হবে অনেক। রুশরা ইতোমধ্যেই বাখমুত এবং আভদিভকা এলাকায় এরূপ কৌশল বাস্তবায়ন করেছে। একইরকমের মিশন তারা শুরু করতে পারে ক্রেমিনা-সাতোভে এলাকায়। একইসাথে ইউক্রেনের ভেতরের অবকাঠামোর উপর হামলা হয়তো অব্যাহত থাকবে। অপরদিকে ইউক্রেনিয়রা হয়তো দক্ষিণ-পূর্বে মেলিটোপোল-বেরদিয়ানস্কএর দিকে আক্রমণ শুরু করতে পারে; যাতে করে ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রুশ সেনাদেরকে ডনবাস অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। এই সম্ভাবনা চিন্তা করেই রুশরা মেলিটোপোল অঞ্চলের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করছে।

মাইকেল কফম্যান বলছেন যে, ইউক্রেনিয়দের সমস্যা বিস্তর। একদিকে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে তারা দোটানায় পড়েছে যে, তারা ফ্রন্টলাইনে তাদের সেনাদের রক্ষা করবে, নাকি শহরগুলিকে রক্ষা করবে। ইউক্রেনিয়দের গোলাবারুদের ঘাটতিও রয়েছে প্রবল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যে হারে গোলাবারুদ ব্যবহার করছে, পশ্চিমা দেশগুলির গোলাবারুদ উৎপাদন করার সক্ষমতা তার থেকে কম। মার্কিনীরা তাদের স্টক থেকে গোলাবারুদ ইউক্রেনকে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ইউক্রেনকে গোলাবারুদ সরবরাহ করতে গিয়ে পশ্চিমা দেশগুলি মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদে গোলাবারুদের ঘাটতির সমস্যায় পড়েছে। তবে রুশদের গোলাবারুদের ঘাটতির খবরও শোনা যাচ্ছে। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, গোলাবারুদ উৎপাদনের চাইতে খরচের পরিমাণ বেশি। এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার গোলাবারুদ কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, তা সামনের কয়েক মাসের মাঝেই পরিষ্কার হবে। রুশরা অধিক সেনা এবং যথেষ্ট গোলাবারুদ যোগাড় করতে পারলে আক্রমণে যেতে পারে। তবে যথেষ্ট গোলাবারুদ পাওয়া না গেলে তারা ছোট ছোট আক্রমণের মাঝেই নিজেদেরকে সীমিত রাখতে পারে। মোটকথা, উভয় পক্ষেরই ফেব্রুয়ারির পর বড় আকারের আক্রমণে যেতে পারার সক্ষমতা কম।

ইউক্রেন যুদ্ধ হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা কম। কফম্যান মনে করছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে এখনও এতটা স্থবিরতা আসেনি যে, কোন একটা পক্ষ শান্তির জন্যে মরিয়া হয়ে যাবে। অগাস্টের পর থেকে ইউক্রেনিয়রা সাফল্য পাচ্ছে। এই মুহুর্তে একটা যুদ্ধবিরতি রুশদের পক্ষে যাবে। এতদিন পর্যন্ত ইউক্রেনিয়রা আশাতীত সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে; আর রুশরা প্রচলিত ধারণার কাছাকাছিও সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। তবে ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতা পুরোপুরিভাবে নির্ভর করছে পশ্চিমা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার সক্ষমতার উপর। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনিয়রা নিশ্চিত যে তাদের দেশের দখলীকৃত অঞ্চল ফেরত পাবার অর্থই হবে বিজয়। কিন্তু পশ্চিমারা একমত নয় যে, প্রকৃত বিজয় কোনটা। এই অনিশ্চয়তার মাঝে ইউরোপের নিরাপত্তাও অনেকটাই ঝুলে থাকবে।

Sunday 18 December 2022

চীনকে নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থির করছে

১৮ই ডিসেম্বর ২০২২
 
অরুণাচল প্রদেশে চীনের সাথে দ্বন্দ্বের কয়েকদিনের মাঝেই ভারত 'অগ্নি-৫' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ভারতীয়রা বলছে যে, এর পাল্লা বেইজিং পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এতকাল দিল্লীর চিন্তাবিদেরা চীনের সাথে স্থিতাবস্থায় থাকার নীতি অনুসরণ করলেও ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে ভারত দ্রুতই আধুনিক অস্ত্রের জন্যে ওয়াশিংটনের দিখে ঝুঁকছে। পশ্চিমা অস্ত্রের উপরে ভারতের নির্ভরশীলতা এবং দক্ষিণ এশিয়াতে চীনকে মোকাবিলায় ভারতের সামরিক শক্তি প্রদর্শন অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; যা প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতিরক্ষা নীতিকেও প্রভাবিত করবে।

গত ১৩ই ডিসেম্বর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, গত ৯ই ডিসেম্বর ভারত এবং চীনের সেনাবাহিনীর সদস্যরা অরুণাচল প্রদেশের ‘তাওয়াং সেক্টর’ নামের সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এতে উভয় পক্ষের সেনারা স্বল্প আহত হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টে বলেন যে, চীনা সৈন্যদের আগ্রাসী মনোভাবকে ভারতীয় সেনারা রুখে দিয়েছে। দুই পক্ষের মাঝে হাতাহাতি লড়াইয়ে ভারতীয় সেনাদের প্রতিরোধের মুখে চীনারা নিজেদের ব্যারাকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। একই দিনে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এব্যাপারে সরাসরি কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।

অরুণাচল প্রদেশে দুই দেশের মাঝে দ্বন্দ্বের পরপরই ভারত পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণে সক্ষম ‘অগ্নি-৫’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৫ হাজার কিঃমিঃ। ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘এএনআই’ বলছে যে, ভারতীয় গবেষকেরা এই ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে কিছু ধাতুর পরিবর্তে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে এর ওজন প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়ে এনেছেন। এর ফলশ্রুতিতে এর পাল্লা ৭ হাজার কিঃমিঃ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব; যা কিনা চীনের রাজধানী বেইজিংকেও এর টার্গেটের মাঝে যোগ করবে। তবে এই পাল্লা পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হবে কিনা, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। চীন এবং পাকিস্তানের দুই ফ্রন্টের হুমকি মোকাবিলায় ভারত আক্রান্ত হলে প্রত্যুত্তর দেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছে। এর অংশ হিসেবে তারা ভূমি থেকে ছোঁড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও সাবমেরিন থেকে ছোঁড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ডেভেলপ করছে।

ভারতের ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা অরুণাচল প্রদেশে চীনাদের সাথে দ্বন্দ্বে বিজয় দাবি করছে। ‘দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক লেখায় ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ‘বিজেপি’র জন্মদাতা সংস্থা ‘আরএসএস’এর সদস্য এবং ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’এর বোর্ড অব গভর্নরের সদস্য রাম মাধব বলছেন যে, লাদাখের সমস্যা যেখানে দুই বছর ধরে ঝুলে আছে, সেখানে অরুণাচল প্রদেশের দ্বন্দ্ব মাত্র দুই ঘন্টার মাঝে সমাধান হয়েছে। লাদাখের চাইতে অরুণাচল প্রদেশে ভারতের সামরিক অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী; যা এখন চীনকে মেনে নিতে হবে। কয়েক দশক ধরে ভারত চীনের সাথে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চললেও ২০১৭ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের চীন নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন। ১৯৯৩, ১৯৯৫, ২০০৫ এবং ২০১২ সালের সীমানা সমঝোতায় শান্তির কথা বলা হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। মোদির নীতি হলো ‘সশস্ত্র সহাবস্থান’, যা একসময় মাও সে তুংএর নীতি ছিল। এই নীতির হিসেবে ভারত কূটনীতিকে এগিয়ে নেবার সাথেসাথে সামরিক অবস্থানকেও শক্তিশালী করছে।

রাম মাধব ভারতের সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী বললেও সকলে তার সাথে একমত নন। অনেকেই বলছেন যে, ভারতের সামরিক সক্ষমতাকে একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বড়সড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ভারতীয় থিঙ্কট্যাংক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর সিনিয়র ফেলো মিহির শর্মা ‘ব্লুমবার্গ’এর এক লেখায় বলছেন যে, বহু বছর ধরে ভারতের সামরিক শক্তিতে কম বিনিয়োগ করা হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে ভারতের সামরিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী যদি চীন হয়, তাহলে ভারতের অবস্থান আরও দুর্বল। কিন্তু সমস্যা হলো, পাকিস্তানকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে ভারতে জনসমর্থন আদায় করা গেলেও চীনের কথা বলে সেটা এখনও ততটা সম্ভব নয়। কাজেই চীনকে মাথায় রেখে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করাটা খুব একটা সহজ নয়। অপরদিকে সমরাস্ত্রের জন্যে পশ্চিমাদের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভর করাটাও ভারতের জন্যে মোটেই সমীচিন নয়। কারণ এতে ভারতকে পশ্চিমা প্রক্সি মনে করে চীনারা আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। আর যেখানে ভারত সামরিক দ্বন্দ্বের জন্যে মোটেই প্রস্তুত নয়, সেখানে চীনকে উস্কে দেয়াটা আত্মহত্যার সামিল। একারণেই ভারতীয় নেতারা একদিকে যেমন চীনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, অপরদিকে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করছেন; যদিও দিল্লীর সকল নীতি নির্ধারকেরাই জানেন যে, পশ্চিমা সামরিক সহায়তা ছাড়া ভারতের চলবে না। কিন্তু নিজেদের সমরাস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াবার কথাগুলি যত ভালোই মনে হোক না কেন, চীনের আগ্রাসনকে মোকাবিলায় কয়েক দশক সময় নিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন করার অবস্থানে নেই ভারত। এই মুহুর্তে চ্যালেঞ্জ হলো, জনগণকে বোঝানো যে, কেন ভারত তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে পশ্চিমাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনবে।

ভারতের সাথে দ্বন্দ্বকে চীনারা পুরোপুরি ভিন্নভাবে দেখছে। প্যারিসে চীনা রাষ্ট্রদূত লু শে সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময়কালে বলেন যে, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ বলে প্রকৃতপক্ষে কোন কনসেপ্ট নেই। এটা যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশকে ব্যবহার করে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে। একসময় সবাই ‘প্যাসিফিক’ বা ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’ অঞ্চল নিয়ে কথা বলতো; ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’কে নিয়ে কেউ কথা বলেনি। এখন এখানে ভারত মহাসাগরকে এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে যে, চীনকে নিয়ন্ত্রণে তার ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’ অঞ্চলের বন্ধুরা যথেষ্ট নয়। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ বলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভারত এবং ফ্রান্সকে তাদের কৌশলের মাঝে যুক্ত করেছে। ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনারা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্যতাকে ন্যাটোর সাথে তুলনা দিলেও ভারতীয়রা তা অস্বীকার করছে। দিল্লী বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ‘কোয়াড’ কোন সামরিক সংস্থা নয়; যদিও কোয়াডের ছত্রছায়ায় বঙ্গোপসাগরে নিয়মিতই বড় আকারের নৌমহড়া চলছে। বেশিরভাগ চীনা বিশ্লেষকেরাই ভারতের সাথে চীনের সম্পর্কের অবনতিকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি যাবার কারণ হিসেবে দেখছেন।

ভারতের ডানপন্থী সরকার চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাতকে চীনের আগ্রাসী মনোভাব হিসেবে দেখছে। অপরদিকে চীনারা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতাকে চীন বিরোধী জোট হিসেবে দেখছে। এতকাল দিল্লীর চিন্তাবিদেরা চীনের সাথে স্থিতাবস্থায় থাকার নীতি অনুসরণ করলেও ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে ভারত দ্রুতই আধুনিক অস্ত্রের জন্যে ওয়াশিংটনের দিখে ঝুঁকছে। পশ্চিমা অস্ত্রের উপরে ভারতের নির্ভরশীলতা এবং দক্ষিণ এশিয়াতে চীনকে মোকাবিলায় ভারতের সামরিক শক্তি প্রদর্শন অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; যা প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতিরক্ষা নীতিকেও প্রভাবিত করবে।

Monday 12 December 2022

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ নীতি চাপের মাঝে?

১৩ই ডিসেম্বর ২০২২
 
বাংলাদেশের সামরিক মহড়াগুলিকে আরও বাস্তবধর্মী করা হচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বীপ (মহেষখালি, সন্দ্বীপ, দুবলার চর, সেন্ট মার্টিন) শত্রুর হাতে দখল হয়ে যাওয়া এবং সেগুলি পুনরূদ্ধার করা; অথবা শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে কম্বাইন্ড অপারেশন; এসল্ট রিভার ক্রসিং অপারেশন; শহর এলাকায় শত্রুর আক্রমণ রক্ষায় মহড়া; যুদ্ধক্ষেত্রে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলিকে মহড়ার মাঝে অন্তর্ভুক্ত করা; ইত্যাদি। ২০২১-২২এর শীতকালীন মহড়ায় সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনী পর্যায়ে বাস্তবমুখী লজিস্টিকস যুক্ত করেছে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রসদ সরবরাহের কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নৌ ও আকাশপথের ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র যখন বাকি দুনিয়াকে চীন এবং রাশিয়ার বিপক্ষে নিতে চাইছে, তখন কিছু দেশ, সংস্থা এবং ব্যক্তি পশ্চিমা কোয়ালিশনের সিদ্ধান্তগুলিকে নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে দেখছে। আত্মকেন্দ্রিক পশ্চিমা চিন্তাগুলি এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, সকলেই এখন নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যস্ত; আদর্শকে রক্ষার কাজ এখন কারুর কাজ নয়। অন্ততঃ আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর পলায়ন সেই ব্যাপারটাকেই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার এই যুগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ চাইছে কোন কৌশলগত জোটে যোগ না দিয়ে নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে। ব্যাপারটা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কিছু দেশের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মতোই। সেবারের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্র চাইছে তার নিজের স্বার্থ বাস্তবায়নে দুনিয়ার সকল দেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে। আর সেবারের মতো এবারও কিছু দেশ তাদের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; বাংলাদেশ এমনই একটা দেশ। এই ভূরাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের সাথে সংমিশ্রিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতা। ভারত এক্ষেত্রে চীনের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ালেও বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকতে চাইছে। বাংলাদেশের এই নিরপেক্ষ নীতি কিভাবে কাজ করছে? আর সেটা ধরে রাখার সক্ষমতা বাংলাদেশের কতটুকু রয়েছে?

মিয়ানমারের সামরিকীকরণ

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমারের একটা মনিটরিং গ্রুপ বলে যে, মিয়ানমার রাশিয়া থেকে প্রথম ব্যাচের অত্যাধুনিক ‘সুখোই-৩০’ ফাইটার বিমানের ডেলিভারি পেয়েছে। রুশ মিডিয়ার বরাত দিয়ে ‘ব্যাংকক পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৮ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সু কিএর সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েই মিয়ানমার রাশিয়া থেকে ৬টা বিমান অর্ডার করেছিল। এছাড়াও গত নভেম্বর মাসে মিয়ানমার বিমান বাহিনী চীন থেকে প্রথম ব্যাচের ৪টা ‘এফটিসি-২০০০জি’ ফাইটার বিমানের ডেলিভারি পেয়েছে। ব্রিটিশ সামরিক ম্যাগাজিন ‘জেনস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই বিমানগুলি খুব সম্ভবতঃ লাইট এটাক বিমান হিসেবে বর্তমানের ‘কে-৮’ বিমানগুলিকে প্রতিস্থাপন করবে। এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মিয়ানমার বিমান বাহিনী একসাথে ২টা চীন ও পাকিস্তানে নির্মিত ‘জেএফ-১৭’ ফাইটার বিমান, ৬টা রুশ নির্মিত ‘ইয়াকোভলেভ-১৩০’ এডভান্সড প্রশিক্ষণ ও লাইট এটাক বিমান এবং দু’টা রুশ নির্মিত ‘এমআই-৩৫পি’ এটাক হেলিকপ্টার অন্তর্ভুক্ত করে।

সুইডেনের ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইন্সটিটউট’ বা ‘সিপরি’র তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমার মোট ১৬টা ‘জেএফ-১৭’ বিমান কিনেছে চীন থেকে। এর সাথে তারা ৬০টা ‘পিএল-১২’ ও ১’শটা ‘পিএল-৫ই’ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৩০টা ‘সি-৮০২একে’ জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। এই বিমানগুলি মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর সক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘ফ্লাইট গ্লোবাল’এর হিসেবে এই বিমানগুলি ডেলিভারি পাবার আগেই মিয়ানমারের বিমান বাহিনীতে ৩১টা ‘মিগ-২৯’ যুদ্ধবিমান এবং ২৭টা ‘এফ-৭’ যুদ্ধবিমান ছিল। এর বিপরীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কাছে রয়েছে ৮টা ‘মিগ-২৯’ এবং ৪৭টা ‘এফ-৭’ যুদ্ধবিমান। এই বিমানগুলির সাথে ব্যবহারের জন্যে মিয়ানমার গত এক দশকে রাশিয়া থেকে ৮০টা ‘আর-২৭’ মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং ২’শ ২৫টা ‘আর-৭৩’ স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও কিনেছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র সংখ্যার হিসেবে বলতে গেলেও মিয়ানমার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে বেশ অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে স্বল্প পাল্লার কাঁধের উপর থেকে ছোঁড়া বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র 'কিউডব্লিউ-১৮এ'। এগুলির মাধ্যমে শত্রুর বিমান ও হেলিকপ্টারের জন্যে নিচু দিয়ে ওড়া অসম্ভব করে ফেলা যায়; যা ইউক্রেন যুদ্ধে প্রমাণিত। তবে এই কৌশলকে বাস্তবায়ন করতে হলে যে মধ্যম উচ্চতার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন, তা এখনও অফিশিয়ালি ডেলিভারি পায়নি বাংলাদেশ। মধ্য উচ্চতায় শত্রুর বিমান ঘায়েল করতে পারার সক্ষমতা বাংলাদেশের আকাশসীমানাকেও শত্রুর জন্যে মাইনফিল্ড বানিয়ে ফেলবে।

বাংলাদেশের প্রত্যুত্তর এবং ভারত ইস্যু

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারের রামু সেনানিবাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চীনে নির্মিত ‘ভিটি-৫’ লাইট ট্যাংক এবং ‘কিউডব্লিউ-১৮এ’ স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই অনুষ্ঠানগুলিকে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সামরিকীকরণের প্রত্যুত্তর বলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের এই পদক্ষেপগুলি মূলতঃ প্রতিরক্ষামূলক। কারণ একদিকে ‘ভিটি-৫’ ট্যাংকের কাজ হবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখা। আর ‘কিউডব্লিউ-১৮এ’ ক্ষেপণাস্ত্রের কাজ হবে বাংলাদেশের আকাশ সীমানার ভেতরে খুব নিচু দিয়ে ওড়া বিমান বা হেলিকপ্টারকে ভূপাতিত করা। অর্থাৎ নিজেদের ভূমি এবং আকাশসীমায় আক্রমণকারী সেনা ও বিমানের বিরুদ্ধে এগুলি কার্যকর হবে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রত্যুত্তর দিচ্ছে না। বরং এখানে বাংলাদেশ চাইছে যত কম খরচে মিয়ানমার সীমান্তকে রক্ষা করতে পারে। এক্ষেত্রে সহায়তা দেবে কক্সবাজার অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি। সেখানে সামরিক অপারেশন চালাবার মতো স্থলভাগ খুবই সংকীর্ণ; একদিকে পাহাড় এবং অপরদিকে সমুদ্র।

বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে তাদের শক্তিকে মজুত করছে অন্যদিকে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলি দেশই বাংলাদেশের ২০১৭ সালের মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট ক্রয়ের টেন্ডারের ভিত্তিতে তাদের বিমানগুলিকে বিক্রি করতে আগ্রহ দেখিয়েছে; লবিংও করেছে। এর মাঝে রয়েছে ব্রিটিশ ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’, ফরাসি ‘রাফাল’ এবং মার্কিন ‘এফ-১৬’। এটাক হেলিকপ্টার ক্রয়ের টেন্ডারেও যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; যারা তাদের ‘এএইচ-৬৪ এপাচি’ হেলিকপ্টার অফার করেছিল। কিন্তু সাড়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফটের ব্যাপারে কোন ঘোষণাই দেয়নি। অফিশিয়ালি কিছু না বলা হলেও যে ব্যাপারটা এখানে স্পষ্ট, তা হলো এই যুদ্ধবিমানের সাথে কি কি শর্ত আসবে, তা বাংলাদেশকে খুশি করেনি। পশ্চিমারা উঁচু মানের সামরিক হার্ডওয়্যার বিক্রি করার সময়ে যথেষ্ট শর্ত আরোপ করে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাছ থেকে অতি চড়া মূল্যে কেনা অস্ত্রগুলি শো-কেসে সাজানো ফুলদানির মতো হয়ে যায়। পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশ এই উদাহরণের মাঝে পড়বে। এই যুদ্ধবিমানগুলির কার্যক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এগুলির সাথে ব্যবহৃত অস্ত্রসস্ত্র। এই অস্ত্রগুলি প্রতিটা বিমানের সাথে ব্যবহারের আগে আলাদাভাবে সফওয়্যার আপগ্রেড করতে হয়। প্রতিটার জন্যে আলাদা রাজনৈতিক অনুমতির প্রয়োজন হয়।

রাজনৈতিক অনুমতি আসে সেসব দেশের পার্লামেন্ট বা সরকারের কাছ থেকে। অনুমতি না আসলে এই বিমানগুলি অতি সাধারণ অস্ত্র বহণে বাধ্য হয়। তখন এই বিমানগুলির সাথে পুরোনো মডেলের যুদ্ধবিমানের কোন পার্থক্যই থাকে না। মার্কিন যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্যে অতি সংবেদনশীল চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়; যেগুলির শর্ত একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে মানা কঠিন। শুধুমাত্র ভূরাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের একেবারে সমান্তরালে না হলে এসকল চুক্তি স্বাক্ষর করা কঠিন। এহেন চুক্তিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের শুধু খুব কাছের বন্ধুই নয়; তারা প্রতিরক্ষার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারণ করে দেয় যে, তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র কোন দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। এখানেই সমস্যা! বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিত যে, পশ্চিমা দেশ থেকে কেনা অস্ত্র বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি ভারতের বিরুদ্ধে সেই অস্ত্র ব্যবহার করতে যায়, তাহলে কি সেই অনুমতি সরবরাহকারী দেশের কাছ থেকে মিলবে? যদি ভবিষ্যতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়, তাহলে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচে কেনা এই যুদ্ধবিমানগুলি খেলনা হয়ে যাবে না তো? এই উত্তর পাওয়া যাবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের দিকে তাকালে।

 
চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত বিরোধ বহু বছর ধরেই। হিমালয়ের পাদদেশে চীনের সাথে দ্বন্দ্বে ভারত যখন বাংলাদেশকে পাশে চাইছিল, তখন নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে বাংলাদেশ তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে উদ্যত হয়; যার মাঝে ছিল কূটনৈতিকভাবে বিশ্বে নতুন কৌশলগত বন্ধু খোঁজা এবং নিজেদের সমরশক্তিকে বৃদ্ধি করা।


ভারত-চীন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থান

করোনা মহামারির লকডাউন চলার সময়েই ২০২০এর অগাস্টে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা হঠাৎ ঢাকা সফরে আসেন। পরদিন ঢাকায় ভারতের দূতাবাস থেকে বলা হয় যে, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে অফিশিয়ালি কিছুই বলা হয়নি। তবে ভারতীয় মিডিয়াতে আলোচনা শুরু হয় যে, ভারতের সাথে চীনের উত্তেজনা চলার মাঝে শ্রিংলার সফরের মাধ্যমে ভারত হয়তো বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদী সরকারের ধর্মীয় নীতি বাস্তবায়নের কারণে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। ঢাকার পক্ষ থেকে এব্যাপারে বিভিন্নভাবে ভারতকে বার্তাও দেয়া হয়েছে; যদিও অফিশিয়ালি বাংলাদেশ সরকার সর্বদাই বলেছে যে, সেগুলি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

শ্রিংলার ঢাকা সফরের তিন সপ্তাহের মাঝেই সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকার তাদের কূটনীতিকে নতুন পথে ধাবিত করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএ মোমেন তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা সফরে যান। সফরের মাঝে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঙ্কারাতে নতুন দূতাবাস ভবন উদ্ভোধন করেন। আঙ্কারার অনুষ্ঠানে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুও যোগদান করেন। তুরস্ক এই সুযোগটা হাতছাড়া করেনি। পরের ডিসেম্বরেই কাভুসোগলু ঢাকা সফর করে বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রয়ের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্ক এবং সেই একই সূত্রে ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে ঢাকা-আঙ্কারা সম্পর্কোন্নয়নের গুরুত্ব ছিল খুবই গুরুত্ববহ। বিশেষ করে হিমালয়ের পাদদেশে চীনের সাথে দ্বন্দ্বে ভারত যখন বাংলাদেশকে পাশে চাইছিল, তখন নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে বাংলাদেশ তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে উদ্যত হয়; যার মাঝে ছিল কূটনৈতিকভাবে বিশ্বে নতুন কৌশলগত বন্ধু খোঁজা এবং নিজেদের সমরশক্তিকে বৃদ্ধি করা। কাভুসোগলুর ঢাকা সফরের ছয় মাসের মাঝেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তুরস্কে নির্মিত ‘টি-৩০০ কাসিরগা’ নামের ৩০০ মিঃমিঃ মাল্টিপল রকেট লঞ্চারের ডেলিভারি পায়। ১’শ ২০ কিঃমিঃ পাল্লার এই রকেট বাংলাদেশকে নতুন এক সামরিক সক্ষমতা দেয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক আকৃতি এবং অবস্থানের কারণে এই পাল্লার রকেট দেশটাকে কৌশলগত শক্তি দিয়েছে। এগুলির মাধ্যমে দেশের সীমানার ভেতরে অবস্থান করেই আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত যোগাযোগ পথ এবং সামরিক বিমান ঘাঁটির উপরে নিখুঁতভাবে হামলা করা সম্ভব।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কটা কতটা সন্দেহের ভিতের উপরে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন ২০১৭ সালে চীন থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের পর ভারত মিয়ানমারের কাছে সাবমেরিন খোঁজার জন্যে সোনার এবং সাবমেরিন ধ্বংসী টর্পেডো বিক্রি করে। এরপর ২০১৯ সালে ভারতীয় নৌবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া একটা রুশ নির্মিত ‘কিলো-ক্লাস’এর সাবমেরিন মিয়ানমারকে দান করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। সেই সাবমেরিন মিয়ানমারের হাতে পৌঁছায় ২০২০ সালের অক্টোবরে। ভারতীয় ম্যাগাজিন ‘স্বরাজ্য’এর এক লেখায় বেশ খোলাখুলিভাবেই বলা হয় যে, বঙ্গোপসাগরে, তথা বাংলাদেশে চীনের প্রভাবকে ব্যালান্স করতেই ভারত মিয়ানমারকে সাবমেরিন দিয়েছে।

মিয়ানমার ভারতীয় সাবমেরিন হাতে পাবার কয়েকদিনের মাঝেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮শে অক্টোবর বরিশালে সেনাবাহিনীর ৭ম পদাতিক ডিভিশনের এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগদানের মাধ্যমে ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশ ‘কোনও ধরণের সংঘাতে’ জড়াতে চায় না। তবে ‘আক্রান্ত’ হলে সেটা মোকাবিলা করার মতো শক্তি অর্জন করতে চায় বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার কথাগুলি বেশ পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশ আঞ্চলিক কোন সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকতে ইচ্ছুক। আর কথাগুলি বলার জন্যে প্রধানমন্ত্রী যখন সামরিক অনুষ্ঠানকে বেছে নিয়েছেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, বাংলাদেশ তার নিরপেক্ষ নীতি বাস্তবায়নে প্রয়োজনে সামরিক সংঘাতের জন্যেও প্রস্তুত রয়েছে।

 
ভারতে অনেকেই মনে করছেন যে, চীনের সাথে যেকোন সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ যুদ্ধে চীনারা ভারতের পূর্বের সাতটা রাজ্যকে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা করে ফেলতে চাইবে। সেই লক্ষ্যে এই রাজ্যগুলিকে ভারতের সাথে যুক্ত করা মাত্র ২২ কিঃমিঃ প্রশস্ত ‘শিলিগুড়ি করিডোর’কে চীনারা টার্গেট করতে পারে। ভারতীয়রা চাইছে বাংলাদেশ তাদের নিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে এসে ভারতকে সরাসরি বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে ট্রানজিট দিক; যার মাঝে সামরিক সাপ্লাইও থাকবে।

বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে সামরিক ট্রানজিট

ভারতে অনেকেই মনে করছেন যে, চীনের সাথে যেকোন সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ যুদ্ধে চীনারা ভারতের পূর্বের সাতটা রাজ্যকে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা করে ফেলতে চাইবে। সেই লক্ষ্যে এই রাজ্যগুলিকে ভারতের সাথে যুক্ত করা মাত্র ২২ কিঃমিঃ প্রশস্ত ‘শিলিগুড়ি করিডোর’কে চীনারা টার্গেট করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায়ও এই আশংকাটাই প্রকাশ করা হয়। এই করিডোরকে অনেকেই কৌশলগত ‘চিকেন নেক’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। করিডোরের মাঝ দিয়ে যাওয়া রাস্তা, রেলপথ এবং সেতুগুলির উপরেই নির্ভর করছে ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের এঁকে দেয়া এই সীমানার উপরেই দোদুল্যমান বিশাল ভারতের রাজনৈতিক অস্তিত্ব। আর এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ; যার ভৌগোলিক সীমানার কারণেই ভারতকে সাত রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ‘চিকেন নেক’এর উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে। ভারতীয়রা চাইছে বাংলাদেশ তাদের নিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে এসে ভারতকে সরাসরি বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে ট্রানজিট দিক; যার মাঝে সামরিক সাপ্লাইও থাকবে। ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক লেখায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল মহিন্দর পাল সিং এই ট্রানজিনের ব্যাপারটাকেই চীনের হুমকির বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় পদক্ষেপ বলে আখ্যা দেন। ভারতের হিলি থেকে বাংলাদেশের গাইবান্ধা হয়ে যমুনা নদী পার হয়ে জামালপুরের উপর দিয়ে ভারতের মেঘালয়ের তুরা পর্যন্ত এই ট্রানজিট রাস্তা চলবে। অর্থাৎ পুরো বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর এলাকার দক্ষিণ দিয়ে যাবে এই পথ। ‘চিকেন নেক’ থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকবে বলে এই রাস্তার নিরাপত্তা হবে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। যুদ্ধের সময়ে ভারত এই রাস্তা দিয়ে পূর্বের সাত রাজ্যে সৈন্য ও রসদ পাঠাবে। আর বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে যাওয়ায় এই রাস্তার উপর চীনারা আক্রমণ নাও করতে পারে।

দিল্লী এবং ওয়াশিংটনের নীতি

ভারতের কাছে এই সামরিক ট্রানজিট যতটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হোক না কেন, দিল্লীর নীতিনির্ধারকেরা চিন্তা করেননি যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনার উপস্থিতি বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে দেখবে। অথবা ভারতকে এই ট্রানজিট প্রদান করার পর ঢাকায় কোন সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব কিনা। এছাড়াও চীনের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের কোন বাস্তবিক বিকল্প না আছে দিল্লীর কাছে; না আছে ওয়াশিংটনের কাছে। ওয়াশিংটনের কাছে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাটা বাংলাদেশের জনগণের মতামতের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই চীনের সাথে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সংঘাতে দিল্লীকে সামরিক ট্রানজিট প্রদান করতে ওয়াশিংটন ঢাকার উপরে সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করবে। শুধু তাই নয়, ভারতের সাথে সংঘাতে চীনকে যাতে কোন দেশ কোন রকম সহায়তা দিতে না পারে, সেদিকে যুক্তরাষ্ট্র সকল চেষ্টা করবে। বিশেষ করে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ যেন ভারতকে সমর্থন দেয়, সেব্যাপারে ওয়াশিংটন সোচ্চার হবে। ওয়াশিংটন চাইবে এই সংঘাতে পাকিস্তান নিরপেক্ষ থাকুক এবং বাংলাদেশ সরাসরি ভারতের পক্ষ নিক। তবে এহেন নীতির সাফল্য কতটুকু হবে, তা বলা মুস্কিল। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়াকে পুরোপুরিভাবে একঘরে করে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টা আরও বেশি সমস্যা পড়বে; কারণ গোটা বিশ্বের অর্থনীতির উপরে চীনের প্রভাব রাশিয়ার চাইতে বহুগুণে বেশি।

বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সংঘাত; ভারতের সুবিধা কেন?

ভূরাজনৈতিক কারণেই বাংলাদেশ যে তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াবে, তা বোঝাই যাচ্ছিলো গত কয়েক বছর ধরে। ২০১৭ সাল থেকে হিমালয়ের পাদদেশে ভারত-চীন উত্তেজনা; একই বছর মিয়ানমার থেকে সাড়ে ১১ লক্ষ মুসলিম জনগণকে উৎখাত করে বাংলাদেশে প্রেরণ; বঙ্গোপসাগরে ‘কোয়াড’ বা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-অস্ট্রেলিয়ার বার্ষিক সামরিক মহড়া; ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকারের মুসলিমদের উপরে দমনপীরন; ইত্যাদি ইস্যু বাংলাদেশকে সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করতে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের সাথে ছোটখাটো একপ্রকারের অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছিল ১৯৯০এর দশক থেকে; যদিও তা মিডিয়াতে তেমন প্রাধান্য পায়নি। ২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের পর থেকে অনেকেই মিয়ানমারের সাথে সামরিক সংঘাতে জড়াবার জন্যে বলতে থাকেন। কিন্তু এখানে ভারতের উদ্দেশ্য তারা আমলে নিতে চাননি; যদিও সেটা গোপন ছিল না।

সেসময়ে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা কতটুকু ছিল, তা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। চট্টগ্রাম বিভাগে সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের সবগুলি ইউনিট পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল। কক্সবাজারের রামুতে ১০ম পদাতিক ডিভিশন স্থাপন করা হলেও সেই ডিভিশনের সক্ষমতা তখনও খুব বেশি ছিল না। বিশেষ করে ট্যাংকের ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। বগুড়ার ১১তম পদাতিক ডিভিশন এবং সাভারের ৯ম পদাতিক ডিভিশন থেকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে টেকনাফে ট্যাংক মোতায়েন করতে হয়েছিল। এই পরিস্থিতির মোটামুটি সমাধান হয়েছে চীন থেকে ‘ভিটি-৫’ ট্যাংক আমদানি করার পর থেকে। ট্যাঙ্কগুলি মিয়ানমারের আক্রমণ (যা বেশ অবাস্তব) থেকে বাংলাদেশকে বাঁচালেও মিয়ানমারের সাথে সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে তা যথেষ্ট নয়। কারণ মিয়ানমারের হাতে এমন অনেক অস্ত্রই রয়েছে, যেগুলির মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সেনা না পাঠিয়েও যুদ্ধ করা সম্ভব। আর এই সক্ষমতা মিয়ানমার বেশ দ্রুততার সাথে যোগাড় করতে পেরেছে; যা এখনও ক্রমবর্ধমান। এই সক্ষমতার মূলে রয়েছে মিয়ানমারের নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী।

হিমালয়ের পাদদেশে ভারত-চীনের সম্ভাব্য সংঘাতের মাঝে ভারত যদি বাংলাদেশের কাছে সামরিক ট্রানজিট দাবি করে না পায়, তাহলে বাংলাদেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করার জন্যে মিয়ানমার বড় ভূমিকা রাখতে পারে। উত্তর এবং দক্ষিণে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ এড়াবার জন্যেই বাংলাদেশ বাধ্য হতে পারে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের দাবি মেনে নিয়ে ভারতের সামরিক কলামগুলিকে বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে যেতে দিতে। তবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার পর ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি হবে টালমাটাল।

 
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রুশ নির্মিত ট্যাংক বিধ্বংসী 'মেটিস এম-১'। দেশের কিছু অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, যেখানে বড় আকারের সেনা আগ্রাসনের সম্ভাবনা বেশি, সেখানে যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সবচাইতে বড় বিনিয়োগ করা হয়েছে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রের ক্ষেত্রে। উদ্দেশ্য হলো, শত্রুর জন্যে পুরো জায়গাটাই একটা মাইনফিল্ড বানিয়ে ফেলা এবং চরমতম ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন করা। ইউক্রেন আক্রমণে রাশিয়া যে ধরণের ক্ষয়ক্ষতির মাঝে পড়েছে, সেটা এরকমই একটা উদাহরণ।

বাংলাদেশ নিজেকে রক্ষা করার পন্থা খুঁজছে

প্রথমতঃ বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট বাড়িয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, সম্ভাব্য যেকোন সংঘাতের মাঝে নিজের রাজনৈতিক সমর্থন বাড়ানো এবং সামরিক বাণিজ্যের প্রসার। বিশেষ করে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করে এবং পশ্চিমা বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করতে সক্ষম, এরূপ দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ। পশ্চিমা যন্ত্রাংশ নেই, এরূপ যুদ্ধাস্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের আগ্রহ তাকে বহুদূর নিয়ে গিয়েছে। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক এখানে প্রথম সাড়িতে থাকলেও সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া, চেক রিপাবলিক, বেলারুশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ইত্যাদি দেশ এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। অস্ত্র অবরোধের মাঝে পড়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম মনে করেই ইউরোপিয় দেশ ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেন থেকেও অস্ত্র কিনেছে বাংলাদেশ; যার মাঝে প্রযুক্তিগতভাবে সংবেদনশীল দূরপাল্লার রাডার এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সামগ্রীও রয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ
বাংলাদেশ সামরিক উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে গোলাবারুদ নিজস্ব কারখানায় প্রস্তুত করার উপর জোর দিয়েছে; যাতে করে যথেষ্ট সময়ের জন্যে যুদ্ধ চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। এর মাঝে ১০৫ মিঃমিঃ ও ১৫৫ মিঃমিঃ আর্টিলারির গোলাবারুদ ছাড়াও রয়েছে স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের দিকেও এগুচ্ছে বাংলাদেশ। বিমান বাহিনীর বিমানগুলিকে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে ‘প্রিসিশন গাইডেড মিউনিশন’ বা ‘পিজিএম’এর জন্যে উপযোগী করে তোলা হয়েছে।

তৃতীয়তঃ সামরিক আগ্রাসন ঠেকাতে প্রচুর গোলাবারুদ যোগাড় করা ছাড়াও যতদূর সম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করার উপর জোর দিয়েছে। নিজস্ব পরিবহণ বিমান ব্যবহার করতে পারাটা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু। তদুপরি সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিসে একটা দুর্ঘটনার কারণে অস্ত্র বাণিজ্য জনসন্মুখে চলে আসে।

চতুর্থতঃ সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে গোপনীয়তা বৃদ্ধি করেছে। একইসাথে শত্রুকে ভুল তথ্য দেয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছে; যাতে করে শত্রুরা সামরিক সক্ষমতার সঠিক পরিমাপ করতে না পারে। সামরিক ইন্টেলিজেন্সের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হচ্ছে।

পঞ্চমতঃ সামরিক মহড়া আরও বাস্তবধর্মী করা হচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বীপ (মহেষখালি, সন্দ্বীপ, দুবলার চর, সেন্ট মার্টিন) শত্রুর হাতে দখল হয়ে যাওয়া এবং সেগুলি পুনরূদ্ধার করা; অথবা শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে কম্বাইন্ড অপারেশন; এসল্ট রিভার ক্রসিং অপারেশন; শহর এলাকায় শত্রুর আক্রমণ রক্ষায় মহড়া; যুদ্ধক্ষেত্রে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলিকে মহড়ার মাঝে অন্তর্ভুক্ত করা; ইত্যাদি। ২০২১-২২এর শীতকালীন মহড়ায় সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনী পর্যায়ে বাস্তবমুখী লজিস্টিকস যুক্ত করেছে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রসদ সরবরাহের কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নৌ ও আকাশপথের ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

ষষ্ঠতঃ সামরিক মহড়া এখন পুরো জাতীয় প্রতিরক্ষার অংশ। তাই সামরিক ছাড়াও অন্যান্য বাহিনীকেও প্রতিরক্ষার অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে। এর মাঝে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি। তাদেরকে ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং মাইন দিয়ে সজ্জিত করা। একইসাথে তাদেরকে সামরিক মহড়ার অংশ করা; যেখানে তাদের ভূমিকা হবে বাইরের আগ্রাসন প্রতিরোধ করা। ২০২০ সাল থেকে বিজিবি সেনাবাহিনীর সাথে মহড়ায় সরাসরি অংশ নিচ্ছে।

 
বর্তমানে থাকা সামরিক সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইছে বাংলাদেশ। বিদেশ থেকে নতুন অস্ত্র খুব একটা না কিনতে পারলেও বাংলাদেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের সক্ষমতা এমনভাবে বৃদ্ধি করছে, যাতে করে তা সংখ্যার দিক থেকে দুর্বলতাকে কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারে। ‘মিগ-২৯’ বিমানগুলিকে জাহাজ ধ্বংসী সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম করা ছাড়াও এগুলিকে এবং ‘ইয়াকোভলেভ-১৩০’ বিমানগুলিকে টিভি গাইডেড বোমা বহণে সক্ষম করা এবং একইসাথে এগুলিতে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করার সক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে।

সপ্তমতঃ বর্তমানে থাকা সামরিক সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার। বাংলাদেশ বিদেশ থেকে নতুন অস্ত্র খুব একটা না কিনতে পারলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের সক্ষমতা এমনভাবে বৃদ্ধি করছে, যাতে করে তা সংখ্যার দিক থেকে দুর্বলতাকে কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারে। যেমন, চীনা ও তুর্কিদের সহায়তায় ‘এফ-৭’ বিমানগুলিকে আকাশ থেকে ভূমির টার্গেটে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম করে তোলা হয়েছে। এছাড়াও ‘মিগ-২৯’ বিমানগুলিকে জাহাজ ধ্বংসী সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম করা ছাড়াও এগুলিকে এবং ‘ইয়াকোভলেভ-১৩০’ বিমানগুলিকে টিভি গাইডেড বোমা বহণে সক্ষম করা এবং একইসাথে এগুলিতে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করার সক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে। নৌবাহিনীর পুরোনো যুদ্ধজাহাজগুলিকে নতুন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত করার প্রচেষ্টাও চলছে। উপকূলীয় অঞ্চলকে শত্রুর জাহাজের জন্যে বিপজ্জনক করে ফেলা, যাতে করে তারা যেকোন প্রকারের উভচর অপারেশন করতে এলে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন হয়।

অষ্টমতঃ দেশের কিছু অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, যেখানে বড় আকারের সেনা আগ্রাসনের সম্ভাবনা বেশি, সেখানে যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করা। সবচাইতে বড় বিনিয়োগ করা হয়েছে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রের ক্ষেত্রে। ‘মেটিস এম-১’, ‘পিএফ-৯৮’, ‘আলকোটান-১০০’এর মতো ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে। এর সাথে অন্যান্য প্রকারের সাঁজোয়া যান ও সামরিক গাড়ি ধ্বংস করার জন্যে উপযুক্ত অস্ত্র যেমন রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড, অটোম্যাটিক গ্রেনেড লঞ্চার, আরমার পিয়ার্সিং বুলেট, ইত্যাদি যুক্ত হচ্ছে। ১০৫ মিঃমিঃ আর্টিলারিগুলিকে ট্যাংক বিধ্বংসী সক্ষমতা দেয়া হচ্ছে; যাতে করে এগুলিকে ‘এমবুশ’ ট্যাকটিকসএ ব্যবহার করা যায়। ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন ব্যবহারে জোর দেয়া হচ্ছে; যা কিনা শত্রুর ট্যাংক ফর্মেশনের গতি বহুলাংশে কমিয়ে দেবে এবং তাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু পথে যেতে বাধ্য করবে। উদ্দেশ্য হলো, শত্রুর জন্যে পুরো জায়গাটাই একটা মাইনফিল্ড বানিয়ে ফেলা এবং চরমতম ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন করা। ইউক্রেন আক্রমণে রাশিয়া যে ধরণের ক্ষয়ক্ষতির মাঝে পড়েছে, সেটা এরকমই একটা উদাহরণ।

নবমতঃ স্বল্প পাল্লার কাঁধের উপর থেকে ছোঁড়া বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত বৃদ্ধি করা ছাড়াও নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এর মাধ্যমে শত্রুর বিমান ও হেলিকপ্টারের জন্যে নিচু দিয়ে ওড়া অসম্ভব করে ফেলা যায়; যা ইউক্রেন যুদ্ধে প্রমাণিত। তবে এই কৌশলকে বাস্তবায়ন করতে হলে যে মধ্যম উচ্চতার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন, তা এখনও অফিশিয়ালি ডেলিভারি পায়নি বাংলাদেশ। মধ্য উচ্চতায় শত্রুর বিমান ঘায়েল করতে পারার সক্ষমতা বাংলাদেশের আকাশসীমানাকেও শত্রুর জন্যে মাইনফিল্ড বানিয়ে ফেলবে।

দশমতঃ এমন কিছু ডিটারেন্ট তৈরি করা, যার মাধ্যমে শত্রুর নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব। এর মাঝে রয়েছে শত্রুর ঘাঁটির উপরে দূরপাল্লার হামলা। বিমান বাহিনীর বিমানে লেজার, জিপিএস ও আইএনএস গাইডেড বোমা, রানওয়ে ধ্বংস করার জন্যে বোমা, বড় টার্গেট (যেমন সেতু, রেলওয়ে জংশন, কমান্ড সেন্টার, ইত্যাদি) ধ্বংস করার জন্যে দূরপাল্লার আর্টিলারি এবং স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, স্পেশাল ফোর্সের মাধ্যমে ডীপ পেনেট্রেশন স্ট্রাইক, ড্রোনের মাধ্যমে হামলা, শত্রুর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ব্যবহারে ইন্টেলিজেন্সের কার্যক্রম, ইত্যাদি।

এছাড়াও বাংলাদেশের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সাথে যেকোন মূল্যে সামরিক সংঘাত এড়ানো। এতে করে বাংলাদেশ যেমন একইসাথে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হবে, তেমনি চীনের সাথে অস্ত্র বাণিজ্যের পথটা খোলা থাকবে। কারণ চীনের সাথে বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের চালানগুলি মিয়ানমারের উপর দিয়েই আসে।

বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিক দিয়েও যথেষ্ট মনোযোগী হয়েছে; বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার নিরাপত্তা জোরদার ও সেখানে নতুন করে সহিংসতাকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা প্রতিহত করতে চাইছে। বিভিন্ন ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করার ব্যাপারেও রাষ্ট্র তার দৃষ্টি সজাগ রাখছে। মানবাধিকার এবং শরণার্থীদের অধিকারের নাম করে পশ্চিমা দেশগুলি যেন চাপ সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলে ইন্ধন যুগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার সুযোগ বাইরের শক্তিগুলি যে নেবে, সেটা পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার একটা অংশ। এখানে বাংলাদেশের সাফল্য সীমিতই থাকবে; কারণ এটা শুধুমাত্র পশ্চিমা আদর্শের বিপরীত কোন আদর্শই মোকাবিলা করতে সক্ষম।

বাংলাদেশের প্রচেষ্টা কি যথেষ্ট?

আপাতঃদৃষ্টিতে বাংলাদেশের নিজেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। কারণ এতে করে রাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতিসাধন হবে; এবং শত্রুকে দেশের সীমানা থেকে পুরোপুরিভাবে বের করে দেয়া সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। বিশেষ করে এরূপ আগ্রাসনে পশ্চিমা সমর্থন থাকলে বাংলাদেশ তার কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকা শত্রুর কাছে হারাবে। যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করতে গেলে সেই অঞ্চলগুলিকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এতকাল বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পের মতো রপ্তানিমুখী শিল্প গড়েছে; আর এখন ভারি শিল্প না থাকার কারণে সার্বভৌমত্ম রক্ষার সংকটে পড়েছে। নিজস্ব ভারি শিল্প থাকলে আজকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে অস্ত্রের জন্যে সকলের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না। বাংলাদেশ তার জিডিপি গড়েছে; কিন্তু সেটা রক্ষা করার জন্যে পশ্চিমা দেশগুলির উপরে নির্ভর করেছে। এখন সেই দেশগুলিই বাংলাদেশকে তাদের স্বার্থে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে।

বাংলাদেশের সামনে সম্ভবতঃ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পথ হলো এমন কিছু কৌশলগত পার্টনারশিপ গঠনের দিকে আগানো, যা কিনা ভারতের সাথে সম্ভাব্য সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানোকে উপেক্ষা করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে তুরস্ক, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের কথা শুরুতেই আসলেও এই দেশগুলিও ঐতিহাসিকভাবেই চিন্তাগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিপক্ষে যেতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যথেষ্ট প্রচেষ্টা এই রাষ্ট্রগুলির অফিশিয়াল এবং আনঅফিশিয়াল অবস্থানকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হতে পারে; যদিও সেটার শতভাগ নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবে না। পূঁজিবাদী চিন্তার জের ধরে প্রতিটা দেশই হয়তো তাদের জাতীয়তাবাদী স্বার্থকে অন্য যেকোন কিছুর উপর স্থান দেবে। তবে এক্ষেত্রে বন্ধু হতে পারে পশ্চিমা পুঁজিবাদী আদর্শের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। পশ্চিমা আদর্শের দুর্বলতার ফলশ্রুতিতেই বিশ্বব্যাপী বহু আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আবির্ভাব হয়েছে। পশ্চিমা নিয়মকানুনকে বাইপাস করেই অনেক রাষ্ট্র, সংস্থা এবং ব্যক্তি এমন সব কর্মকান্ড করতে পারছে, যা একসময় চিন্তা করাই অসম্ভব ছিল। একইসাথে আদর্শিক দৈন্যতার কারণেই পশ্চিমা আদর্শের ঝান্ডাবাহী যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নানা অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সমস্যার মাঝে পতিত হয়েছে। হয়তো পুঁজিবাদের এই ক্রান্তিলগ্নই হতে পারে বাংলাদেশের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার সবচাইতে বড় বন্ধু। তবে কাজটা মোটেই সহজ নয়।




সূত্রঃ

‘যেকোনও হুমকি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর’, বাংলা ট্রিবিউন, ২৮শে অক্টোবর ২০২০
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাক্ষাৎ নিয়ে কেন লুকোচুরি’, বিবিসি বাংলা, ২১শে অগাস্ট ২০২০
‘কাল তুরস্ক যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী’, কালেরকন্ঠ, ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২০
‘আঙ্কারায় বাংলাদেশের দূতাবাস কমপ্লেক্সের উদ্বোধন’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২০
‘বাংলাদেশে সমরাস্ত্র রপ্তানিতে আগ্রহী তুরস্ক’, দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩শে ডিসেম্বর ২০২০
‘Explained: Why India Is Giving A Submarine To Myanmar Despite Itself Facing Shortage’, in Swarajya Magazine, 16 October 2020
‘India gifts a submarine to Myanmar, gains edge over China’ in Hindustan Times, 21 October 2020
‘Bangladesh Army inducts new 300 mm MRLs’ in Janes, 21 June 2021
‘Taking it to next level, India readies submarine for Myanmar’ in The Economic Times, 30 July 2019
‘What if China wrings India’s ‘Chicken’s Neck’ – the Siliguri corridor? Here are some countermeasures’ by Col. Mohinder Pal Singh, in The Times of India, 09 October 2019
‘Twisting India’s Chicken’s Neck’ by Syed Fazal-e-Haider, in The Interpreter, The Lowy Institute, 15 July 2020
‘Myanmar Air Force inducts new FTC-2000Gs’ in Janes, 09 December 2022
‘Myanmar takes delivery of Russian fighter jets’ in Bangkok Post, 04 November 2022
‘Myanmar Air Force commissions 10 new aircraft to boost counter-insurgency capabilities’ in Janes, 17 Decemer 2019
‘World Air Forces directory 2022’ in Flight Global (https://www.flightglobal.com/reports/world-air-forces-directory-2022/146695.article)
‘লাইট ট্যাংক ভিটি-৫ কিউডব্লিউ ১৮ এ মিসাইল সিস্টেমের অন্তর্ভুক্তিকরণ অনুষ্ঠানে সেনা প্রধান’, ইত্তেফাক, ০৬ ডিসেম্বর ২০২২
‘BAF floats tender to purchase 8 fighters’, in New Age, 07 March 2017
‘France keen to sell weapons to Bangladesh’ in New Age, 01 November 2021
‘Many countries keen to sell weapons to Bangladesh’ in New Age, 24 September 2021
‘Purchase of US defence hardware: Dhaka, Washington closing in on deal’ in The Financial Express, 18 October 2019
‘Türkiye wants to enhance defense cooperation with Bangladesh: Envoy’, in Daily Sabah, 16 November 2022
‘Bangladesh Supplies TEBER Guidance Kit From Turkiye’, in Turkish Defence News
‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫০ বছর পূর্তি’, সময় টিভি, ১৪ই জানুয়ারি ২০২২ (https://www.youtube.com/watch?v=Eg4KrHxT5RI)
‘আধুনিক সমরাস্ত্রে চ্যালেঞ্জিং অনুশীলন সেনাবাহিনীর’, যুগান্তর, ১৮ই জানুয়ারি ২০২২
‘এবছর থেকে শীতকালীন মহড়া শুরু করেছে বিজিবি’, যমুনা টিভি, ১৩ই জানুয়ারি ২০২০ (https://www.youtube.com/watch?v=jPdQ2ezInRY)
‘যুদ্ধ প্রশিক্ষন মহড়ায় অন্যরকম সেনাবাহিনী দেখলো গ্রামবাসি’, সংবাদ, ১৪ই জানুয়ারি ২০২২
‘বাংলাদেশের জন্য ১১ টন অস্ত্র বহনকারী বিমান গ্রিসে বিধ্বস্ত, বলছেন সার্বিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী’, বিবিসি বাংলা, ১৭ই জুলাই ২০২২
‘স্পেন ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরলেন সেনাপ্রধান’, যুগান্তর, ০৪ঠা অগাস্ট ২০২২
‘বিজিবির জন্য এন্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল ক্রয় করা হচ্ছে’, সাম্প্রতিক, ০২রা নভেম্বর ২০১৯
‘বিজিবিতে এন্টি গাইডেড উইপন সংযোজন করা হয়েছে’, কালের কন্ঠ, ১৭ই জুলাই ২০২১

Saturday 10 December 2022

শি জিনপিংএর মধ্যপ্রাচ্য সফর নতুন কি দেখাচ্ছে?

১০ই ডিসেম্বর ২০২২
 
আরব নেতাদের সাথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ইরাক এবং আফগানিস্তানের ব্যর্থতা যেমন মার্কিনীদের বন্ধুদের কাছে ওয়াশিংটনের মূল্যকে কমিয়েছে, তেমনি ওয়াশিংটনের নিজস্ব রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিন রাজনীতিবিদদের অর্থহীন আদর্শিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বকে ‘নিরপেক্ষ’ নীতিতে এগুতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পশ্চিমাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের বন্ধনটা এখন নিতান্তই স্বার্থের। পশ্চিমা আদর্শের ক্রান্তিলগ্নে বাস্তবতাই এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং চীনাদের উভয়ের সামনেই বাতিঘর-স্বরূপ।

গত ৯ই ডিসেম্বর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপংএর সৌদি আরব সফরের সময় সৌদি যুবরাজ এবং বাস্তবিক শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান বা ‘এমবিএস’ বলেন যে, চীনের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের ‘নতুন যুগ’ শুরু হয়েছে। এর আগের দিন দুই দেশের মাঝে কৌশলগত সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সৌদি বাদশাহ সালমান দুই দেশের মাঝে প্রতি দুই বছর অন্তর শীর্ষ বৈঠক করার ব্যাপারে সম্মত হন। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ঘোষণাটা এমন সময়ে এলো, যখন হোয়াইট হাউজের সাথে সৌদিদের সম্পর্কের বেশকিছুটা ভাটা যাচ্ছে। পাঁচ মাস আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় এরকম স্বতস্ফূর্ততা দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ওয়াশিংটনের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করেই চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এক সংবাদ সন্মেলনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেন যে, তারা মনে করছেন না যে, রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে কোন একটা পক্ষকেই সমর্থন করে যেতে হবে; অথবা একজনের সাথে সম্পর্ক ভালো করার অর্থ এই নয় যে, বাকিদেরকে দূরে ঠেলে দিতে হবে।

শি জিনপিংএর সফরের সময় বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাঝে জ্বালানি ছাড়াও রয়েছে ‘গ্রীন হাইড্রোজেন’, তথ্য প্রযুক্তি, পরিবহণ এবং কন্সট্রাকশন। চীনা কোম্পানি ‘হুয়াই’ সৌদি আরবে ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’, ডাটা সেন্টার এবং ‘হাই-টেক কমপ্লেক্স’ তৈরি করা ক্ষেত্রে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয় যে, বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে চীনাদের সাথে সৌদিরা সহযোগিতা করবে এবং একইসাথে তেলের বাইরে অন্যান্য সেক্টরে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। তবে চীনাদের অর্থনীতি যখন মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল, তখন সহযোগিতার কেন্দ্রে যে জ্বালানি থাকবে, তা বোঝাই যায়। ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘এরাব গালফ স্টেটস ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক রবার্ট মগিয়েলনিকি ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, অনেকগুলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও জ্বালানির ব্যাপারগুলিই সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি হবে। তবে দুই দেশের প্রযুক্তিগত চুক্তিগুলি ওয়াশিংটনকে যথারীতি বিচলিত করবে। নিরপত্তার কথা বলে মার্কিনীরা আরও আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে চীনা কোম্পানির ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক স্থাপনের ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে; যা আরব দেশগুলি আমলে নেয়নি।

শি জিনপিং আরও বলেন যে, তেল ও গ্যাসের মূল্য শোধ মার্কিন ডলারের বদলে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে করার ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে চীনারা ‘সাংহাই পেট্রোলিয়াম এন্ড ন্যাচারাল গ্যাস এক্সচেঞ্জ’কে পুরোপুরি ব্যবহার করতে চাইছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সৌদি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, চীনের কাছ থেকে সৌদিরা যা আমদানি করছে, তার মূল্য পরিশোধ করতে হয়তো স্বল্প পরিমাণে তেলের বাণিজ্য ইউয়ানে করা যেতে পারে। কিন্তু মূল বাণিজ্য ইউয়ানে করার জন্যে এটা এখনই হয়তো সঠিক সময় নয়। কারণ সৌদিদের বেশিরভাগ সম্পদ এবং রিজার্ভ রয়েছে মার্কিন ডলারে। সৌদিরা প্রায় ১’শ ২০ বিলিয়ন ডলার মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে। আর সৌদিদের নিজস্ব মুদ্রা রিয়ালএর মূল্যমানও নির্ধারিত হয় ডলারের মূল্যমানের সাথে সঙ্গতি রেখে। ‘সৌদি প্রেস এজেন্সি’ বলছে যে, সৌদি আরবের সাথে চীনের ২০২১ সালের বাণিজ্যের মূল্যমান ছিল প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, শি জিনপিংএর সফর শুধুমাত্র সৌদি আরবের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলি ছাড়াও পুরো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক নেতারাই জড়ো হয়েছিলেন শি জিনপিংএর সাথে বৈঠকে যোগ দিতে; যাদের মাঝে ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি, তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, সুদানের বাস্তবিক শাসক আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি, মরক্কোর প্রধানমন্ত্রী আজিজ আখান্নুশ এবং লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নজিব মিকাতি।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে শি জিনপিংএর এই সফর ছিল সমাজতান্ত্রিক চীনের জন্যে সবচাইতে বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ। তবে ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনারা এমন এক অঞ্চলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে, যেখানকার নেতৃবৃন্দ বহু বছর ধরে মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তার উপরে নির্ভরশীল। তবে মানবাধিকার, জ্বালানি নীতি এবং মার্কিন নিরাপত্তার নিশ্চয়তার মতো ইস্যুতে সৌদিদের সাথে হোয়াইট হাউজের দূরত্ব তৈরি হবার সময়েই চীনারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে মনোযোগী হয়েছে।

‘সিএনএন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সৌদিদের সাথে চীনাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো উভয় দেশই একে অপরের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। অপরদিকে সৌদিরা অনেকেই তাদের রাজনীতিতে পশ্চিমাদের হস্তক্ষপের ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। সৌদি বিশ্লেষক আলি শিহাবি এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, মার্কিন রাজনীতিবিদেরা সৌদি আরবকে সংজ্ঞায়িত করছে মানবাধিকার দিয়ে; অথচ মার্কিনীরা নিজেরাই তাদের বিশাল সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও ইরাক এবং আফগানিস্তানে ব্যর্থ হয়েছে। সৌদিরা চীন, ভারত এবং রাশিয়ার সাথে জ্বালানির ব্যাপারে সহযোগিতা, আর অস্ত্রের ব্যাপারে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে; একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উঁচুনিচুর মাঝ দিয়েই সম্পর্ককে এগিয়ে নিচ্ছে।

চীনাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি মূলতঃ আগ্রাসী নয়। জ্বালানির জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের উপরে নির্ভরশীলতা শি জিনপিংকে সৌদি আরবে ডেকে এনেছে। ডলারকে ইউয়ান দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টাগুলি আপাততঃ দ্বিতীয় সাড়িতেই থাকছে। যদিও আপাতঃ দৃষ্টিতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাবকে প্রতিস্থাপন করতে চীনাদের অগ্রগামী দেখা যাচ্ছে, তথাপি এটা রাজনৈতিক প্রভাব নয়। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে চীনাদের কোন বক্তব্য নেই। আর নিরাপত্তার দিক থেকেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি চীনের উপরে নির্ভরশীল নয়। ইরাক এবং আফগানিস্তানের ব্যর্থতা যেমন মার্কিনীদের বন্ধুদের কাছে ওয়াশিংটনের মূল্যকে কমিয়েছে, তেমনি ওয়াশিংটনের নিজস্ব রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিন রাজনীতিবিদদের অর্থহীন আদর্শিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বকে ‘নিরপেক্ষ’ নীতিতে এগুতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পশ্চিমাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের বন্ধনটা এখন নিতান্তই স্বার্থের। পশ্চিমা আদর্শের ক্রান্তিলগ্নে বাস্তবতাই এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং চীনাদের উভয়ের সামনেই বাতিঘর-স্বরূপ।

Tuesday 6 December 2022

ইউক্রেনে আকাশ যুদ্ধ… নয় মাসের শিক্ষা কি?

জুলাই ২০২২। ইউক্রেনিয় 'বুক এম-১' মধ্যম পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে ছোঁড়া হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র। আকাশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না থাকার পরেও ইউক্রেনিয়রা সফলভাবে বড় রকমের আক্রমণে যেতে পেরেছে; যেখানে তারা কৌশলগতভাবে রুশদেরকে অবাক করে দিয়েছে এবং রুশ বিমান বাহিনী ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে খোলা আকাশের নিচে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ বড় বিমান বাহিনী রয়েছে এমন কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অপেক্ষাকৃত ছোট কোন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ভূমিতে বড় ধরণের আক্রমণে যেতে পারে।

০৬ই ডিসেম্বর ২০২২

‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক লেখায় মার্কিন বিমান বাহিনীর কর্নেল ম্যাক্সিমিলিয়ান ব্রেমার এবং মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্টিমসন সেন্টার’এর সিনিয়র ফেলো কেলি গ্রিকো বলছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দু’টা ফ্রন্টে রুশদের বিরুদ্ধে সফল আক্রমণের মাধ্যমে প্রমাণ করলো যে, পশ্চিমাদের এতদিনের চিন্তাটা ভুল; যেখানে বলা হচ্ছিলো যে, আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারলে যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতা আসবে না। মার্কিন যুদ্ধচিন্তার একেবারে উল্টো, ইউক্রেনিয়দের সাথে ছিল না আকাশে কোন বিমান বাহিনীর ছায়া; ছিল না আকাশ থেকে কোন ‘ফায়ার সাপোর্ট’। কেউ কেউ সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলেছেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে আকাশ শক্তির গুরুত্ব কমে যাবে; আবার কেউ বলছেন যে, রুশরা এতটাই বাজেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ হবে না। ব্রেমার এবং গ্রিকো বলছেন যে, এই চিন্তাগুলি খুবই মারাত্মক ভুল; যা বাস্তবতা বুঝতে না পারার কারণে তৈরি হচ্ছে।

ইউক্রেনিয়রা রুশদের অন্ধ করে দিয়েছিল

ব্রেমার এবং গ্রিকো বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা রুশদেরকে আকাশ ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার কৌশল নিয়েছিল। ইউক্রেনিয়দের শক্ত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে হটিয়ে রুশরা তাদের বিমানগুলি আকাশে ওড়াতে পারছিলো না। রুশ বিমান বাহিনী আকাশ থেকে তথ্যও সংগ্রহ করতে পারছিলো না। ড্রোন এবং স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিগুলি যথেষ্ট ভালো ইন্টেলিজেন্স দেয়নি। রুশ ‘অরলান-১০’ গোয়েন্দা ড্রোনগুলির অনেকগুলিই ইউক্রেনিয়দের হাতে ধ্বংস হয়েছে। পশ্চিমা অবরোধের কারণে এগুলিকে প্রতিস্থাপিত করাটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে রুশরা ইউক্রেনিয়দের খারকিভ অপারেশন শুরুর আগে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। রুশরা প্রায় অন্ধ ছিল। অর্থাৎ আকাশ নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং আকাশ ব্যবহার থেকে বিরত রাখাটাই ছিল ইউক্রেনের সামরিক সফলতার মূল চাবি। ইউক্রেনিয়রা যে দক্ষিণে খেরসনে আক্রমণ শুরু করছে, সেটা জানাই ছিল। তাই রুশরাও তাদের বাহিনীগুলিকে সেখানে মোতায়েন করতে থাকে। কিন্তু তারা চিন্তাও করেনি যে, উত্তর-পূর্বের খারকিভেও ইউক্রেনিয়রা হামলা করতে পারে।

খারকিভের অপারেশনে ইউক্রেনিয় ট্যাংক এবং গাড়িগুলি যখন দিনের বেলায় রাস্তা এবং খোলা প্রান্তর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলো, তখন সেগুলি রুশ বিমান বাহিনীর জন্যে সহজ টার্গেট হবার কথা ছিল। কিন্তু ইউক্রেনিয়দের কৌশল রুশ বিমান বাহিনীকে আকাশ ব্যবহার করতে বা আকাশে বেশি সময় উড়তে বাধা দিয়েছে। রুশ সেনাবাহিনী তাদের বিমান বাহিনীকে টার্গেটের তথ্য দিয়েছে এবং সেগুলিতে বিমান বাহিনী বোমা ফেলেছে। তবে টার্গেটগুলি ছিল আগে থেকে জানা টার্গেট। গোয়েন্দা ড্রোনের সংখ্যা কম থাকার কারণে রুশরা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর অগ্রসর হওয়া সম্পর্কে ভালো তথ্য পায়নি। 

জুন ২০২২। রুশ 'সুখোই-২৫' যুদ্ধবিমান ইউক্রেনিয়দের স্বল্প পাল্লার কাঁধের ওপড় থেকে ছোঁড়া বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত পাবার পরেও ঘাঁটিতে ফেরত আসতে পেরেছে। অর্থাৎ বিমানের পাইলট বেঁচে ফিরেছেন। একজন অভিজ্ঞ ফাইটার পাইলট তৈরি করতে ১০ বছর সময় এবং গড়ে কমপক্ষে ৬ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।

রুশ বিমান বাহিনী আসলে ছিল কোথায়?

ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’ ইউক্রেনের আকাশে যুদ্ধের উপর একটা গভীর বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। ইউক্রেনের ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি পুরো ইউক্রেন জুড়ে কয়েক’শ রাডারের উপর নির্ভরশীল ছিল। রুশরা তাদের ‘সুখোই-২৪’ গোয়েন্দা বিমানের মাধ্যমে প্রতিটা রাডারের অবস্থান নিশ্চিত করে। যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মাঝে রুশ ‘সুখোই-২৪’ বোমারু বিমানগুলি ১’শর মতো রাডার বোমা ফেলে ধ্বংস করে। সেসময় থেকে ইউক্রেনের ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি অনেকটাই অন্ধ হয়ে যায়; কারণ রুশদের বিমান হামলার আগাম সতর্কবার্তা আসা বন্ধ হয়ে যায়। বিমান বিধ্বংসী নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধের প্রথম কয়েক দিনে ইউক্রেনিয় বিমান বাহিনীর ‘সুখোই-২৭’ এবং ‘মিগ-২৯’ বিমানগুলিকে পুরো ইউক্রেনের আকাশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হয়। বিমানগুলি যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন হলেও তারা নিজেদের ভূমিতে অবস্থিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে পুনরায় কার্যক্ষম করার জন্যে যথেষ্ট সময় ও সুযোগ করে দেয়। এর ফলস্বরূপ মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রুশ বিমান বাহিনীর ক্ষতি বাড়িয়ে দেয়। এই সময়টাতেই রুশ বিমান বাহিনী ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে টার্গেট না করে বিপদে পড়া সেনাবাহিনীর গাড়ির বহরগুলিকে সহায়তা দেয়া শুরু করে।

‘রুসি’র প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ‘রুসি’র বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক এবং জ্যাক ওয়াটলিং ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সিলভেরাডো পলিসি একসেলেরেটর’ পরিচালিত ‘জিওপলিটিক্স ডেক্যানটেড’ নামের এক অনলাইন আলোচনায় বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম তিনদিন রুশ বিমান বাহিনী ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধবিমানগুলির সাথে আকাশেও ব্যাপক যুদ্ধ চলেছে। রুশ বিমানগুলি ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন থেকে ৩’শ কিঃমিঃ ভেতর পর্যন্ত প্যাট্রোল দিয়েছে। এই সময়টাতে বিভিন্ন কারণে ভূমিতে অবস্থিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি নিজেদের প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়নি। তবে এই অবস্থা পরিবর্তিত হতে থাকে; যখন উভয় পক্ষেরই ‘বুক’ (ন্যাটো যাকে বলে ‘এসএ-১১’), ‘অসা’ (বা ‘এসএ-৮’) এবং ‘এস-৩০০’ (বা ‘এসএ-১০)এর মতো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি ফ্রন্টলাইন বরাবর কার্যকর হতে শুরু করে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি মূলতঃ রাডার নিয়ন্ত্রিত, দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলা সম্ভব এবং মধ্যম থেকে শুরু করে আরও বেশি উচ্চতায় বিমান ধ্বংস করতে সক্ষম। রুশ বিমান বাহিনী এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এরপরে তাদের হাতে একমাত্র অপশন ছিল নিচু দিয়ে উড়ে টার্গেটে হামলা করা। নিচু দিয়ে ওড়ার ফলে বিমানগুলি রাডার নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলির হাত থেকে রেহাই পায় ঠিকই; কিন্তু ফলাফলস্বরূপ কাঁধের উপর থেকে নিক্ষেপ করা স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট হয়ে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে রুশরা নিচু দিয়ে ওড়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

রুশ বিমানগুলি নিচু দিয়ে ওড়ার সময়ে টার্গেটে নিখুঁতভাবে হামলা করতে পারেনি। কারণ নিচু দিয়ে উড়ে গাইডেড বোমাগুলি ছোঁড়া যায় না। কাজেই বাধ্য হয়ে রুশ বিমানগুলিকে তড়িঘড়ি করে সাধারণ ‘আনগাইডেড’ বোমাগুলিই ছুঁড়তে হবে। এত নিচে দিয়ে দ্রুতগতিতে ওড়ার সময়ে একটা ফাইটার বিমানের টার্গেটে নিখুঁতভাবে হামলা করা সম্ভব নয়। আর বিমানগুলির একই টার্গেটের উপরে দু’বার হামলা করাটাও বিপজ্জনক; কারণ তাতে স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বা বিমান বিধ্বংসী কামানের টার্গেট হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, যুদ্ধের প্রথম কিছুদিনের ফলাফল থেকে যে ব্যাপারটা পশ্চিমারা বুঝতে পারে তা হলো, রুশরা ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে সক্ষম হয়নি। আকাশে রুশদের একচ্ছত্র প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেনের বিমানগুলি আকাশে উড়তে পারছে। এই সময়টাতে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে কোন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেয়নি। তবে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, পশ্চিমাদের কাছে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র অনেক থাকলেও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্টই কম।

ব্রেমার এবং গ্রিকো মনে করছেন যে, রুশরা ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারেনি, এটা শুধু রুশদের ব্যর্থতা নয়। পশ্চিমারাও আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তিকে যথেষ্ট ভালোভাবে বুঝতে ব্যর্থ। স্তরীভূত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় আঘাত হানতে পারার মতো ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার, জ্যামিং সিস্টেম, এবং অন্যান্য প্রযুক্তি একত্রে সমন্বয় করে সেগুলিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোতায়েন করে এবং নিয়মিতভাবে স্থান পরিবর্তন করায়, সেখানে বিমান প্রতিরক্ষাকে ধ্বংস করতে পারাটা মোটেই সহজ নয়। সহজ কথায় বলতে গেলে, আধুনিক প্রযুক্তি এখন এতটাই সহজলভ্য হয়ে গেছে যে, শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার মিশন অনেক বেশি কঠিন হয়ে গিয়েছে। হয়তো কিছু অঞ্চলে কিছু সময়ের জন্যে আকাশ নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু পুরো আকাশের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব নয়; যা একসময় করা যেত।

আধুনিক মনুষ্যচালিত বিমানগুলি এখন অত্যন্ত মূল্যবান এবং এগুলিকে চালাতেও অত্যন্ত উঁচু মানের ট্রেনিং দরকার হয়। এর বিপরীতে স্বল্প খরচের বিমান প্রতিরক্ষার অস্ত্রগুলিকে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের জন্যে আকাশ ব্যবহার করাই দুরূহ করে ফেলা সম্ভব। মোটকথা অতি মূল্যবান অস্ত্রগুলি কম খরচের অস্ত্রগুলির কাছে হেরে যাচ্ছে। ব্রেমার এবং গ্রিকো মনে করছেন যে, সামনের দিনগুলিতে কেউ যদি প্রতিপক্ষকে আকাশ ব্যবহার না করতে দেয়ার কৌশল নিয়ে আগায়, তাহলে তাকে সেই পথ থেকে বিরত রাখার পদ্ধতি খুব কমই থাকবে।

ব্রেমার এবং গ্রিকো বলছেন যে, ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে পশ্চিমা কোয়ালিশনের যুদ্ধের সময়ে ইরাক তার ‘স্কাড’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করিয়েছে এবং প্রচুর ভুয়া টার্গেট ব্যবহার করেছে। এর ফলে পশ্চিমারা পুরো আকাশের মালিক থাকা সত্ত্বেও তারা পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হতে পারেনি যে একটা ‘স্কাড’ ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চারও তারা ধ্বংস করতে পেরেছে। ইউক্রেনিয়রাও রুশ বিমানের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার সাথেসাথেই রাডার বন্ধ করে দিয়ে স্থান পরিবর্তন করেছে। ফলে রুশরা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে সহজে খুঁজে পায়নি। ইউক্রেনের ‘এস-৩০০’ এবং ‘বুক এম-১’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাগুলি যেমন রুশ বিমানগুলিকে মধ্যম উচ্চতায় ওড়া থেকে বিরত রাখতে পেরেছে, ঠিক তেমনি ডনবাসে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রুশরাও সেখানে ‘এস-৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে ইউক্রেনের বিমান ওড়ায় বাধা দিয়েছে। ফলস্বরূপ, উভয় পক্ষই আকাশকে নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারছে না। 

মে ২০২২। ইউক্রেনিয় সেনার কাঁধে স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ইউক্রেনের ‘এস-৩০০’ এবং ‘বুক এম-১’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েই রাডার বন্ধ করে দিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে ফেলছে। এভাবে মধ্যম উচ্চতার আকাশ রুশ বিমান বাহিনীর জন্যে বিপজ্জনক হয়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রুশরা যখন নিচু দিয়ে তাদের বিমান উড়িয়েছে, তখন তারা হাজার হাজার স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে পরিণত হয়েছে।


ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

‘রুসি’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনের ‘এস-৩০০’ দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে ‘বুক’ এবং ‘অসা’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। মধ্যম পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ১৯৮০এর দশকে সার্ভিসে আসে। ইউক্রেনিয়রা সেই সোভিয়েত সময় থেকে প্রায় ১’শর মতো ‘বুক’ সিস্টেম অপারেট করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এগুলিকে ইউক্রেনিয়রা যথেষ্ট উন্নত করেছে। এই ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বেশ নির্ভরযোগ্য। ইউক্রেনিয় ক্রুরা ট্যাবলেট ব্যবহার করে সফটওয়্যারের মাধ্যমে জানতে পারছে যে, শত্রুর বিমানগুলির অবস্থান কোথায় কোথায় রয়েছে।

‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ‘ডেভিড এক্স ইউক্রেনিয়দের ট্যাবলেট ব্যবহারের কাহিনী তুলে ধরেছেন। ‘ক্রোপিভা’ নামের একটা সফটওয়্যার তৈরি করেছে ইউক্রেনিয় এনজিও ‘আর্মি এসওএস’; যারা এটাকে ডিজাইন করেছে মার্কিন ‘ব্লু ফোর্স ট্র্যাকার’ বা ‘বিএফটি’ সফটওয়্যারের আদলে; তবে এর মূল্য ‘বিএফটি’র মতো আকাশচুম্বী নয়। এই সফটওয়্যার যেকোন এন্ড্রয়েড ট্যাবলেটে কাজ করে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইউক্রেনের সামরিক ব্যবহারকারীরা এই সফটওয়্যারে যুক্ত হয়। ব্যবহারকারীরা তাদের কাছাকাছি থাকা রুশ সামরিক ইউনিটগুলিকে সফটওয়্যারের মানচিত্রে নির্দিষ্ট করে দেয়; যার মাঝে শত্রুর শক্ত অবস্থান, বিমান এবং ট্যাঙ্কও থাকে। এর মাধ্যমে যেকোন ইউক্রেনিয় সেনা পুরো যুদ্ধক্ষেত্রের একটা ছবি পেয়ে যায়; যেখানে বহু উৎস থেকে ইন্টেলিজেন্স একত্রে সমন্বিত হয়েছে। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিমান বিধ্বংসী ব্যবস্থাগুলি শত্রু বিমানের অবস্থান সকলকে জানিয়ে দেয়। এতে বাকিরা সকলে একটা আগাম সতর্কবাণী পায়। আগে থেকে বিমান হামলার ব্যাপারে তথ্য পেলে তারা সেগুলিকে ভূপাতিত করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে পারে। একইসাথে এই সফটওয়্যার রুশ বিমান বাহিনীর পক্ষে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা অনেক কঠিন করে ফেলেছে; কারণ তারা রুশ হামলার আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে যাচ্ছে। এই সফটওয়্যার ইউক্রেনের পুরোনো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সফলতার অনেকগুলি কারণের মাঝে একটা।

ইউক্রেনিয় মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এতগুলি রুশ বিমান ভূপাতিত করেছে যে, রুশরা বাধ্য হয়েছে মধ্যম বা তদূর্ধ্ব উচ্চতায় ওড়া বন্ধ করে নিচে দিয়ে উড়তে; যেখানে হাজারো স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের ফাঁদে পড়ে রুশরা। পশ্চিমা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি মিডিয়াতে যথেষ্ট কভারেজ পেলেও ইউক্রেনের মূল বিমান প্রতিরক্ষা এখনও পুরোনো সোভিয়েত আমলের।

কার ক্ষয়ক্ষতি কত?

যুদ্ধের সময়ে সকলেই তাদের নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দেখায়; আর বিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দেখায়। এর উপর উভয় পক্ষই টার্গেট ধ্বংসের ব্যাপারে শত্রুকে ভুল তথ্য সরবরাহ করে। কাজেই হিসেবটা সর্বদাই কঠিন। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই ডাচ সামরিক বিশ্লেষক স্টাইন মিতজার এবং তার দল ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষণের মাধ্যমে হিসেব করে যাচ্ছেন যে, কার ক্ষয়ক্ষতি কত হচ্ছে। ‘ওরিক্স’ ওয়েবসাইটে তারা বলছেন যে, নভেম্বর পর্যন্ত রুশরা কমপক্ষে ৬৩টা যুদ্ধবিমান হারিয়েছে; যার মাঝে রয়েছে ১১টা ‘সুখোই-৩০এসএম’, ২৩টা ‘সুখোই-২৫’, ১৭টা ‘সুখোই-৩৪’ বোমারু বিমান এবং ৮টা ‘সুখোই-২৪’ বোমারু বিমান। এছাড়াও রুশরা কমপক্ষে ৭১টা হেলিকপ্টার হারিয়েছে; যার মাঝে রয়েছে ১৬টা ‘এমআই-৮’, ১১টা ‘এমআই-২৪/৩৫’ এটাক হেলিকপ্টার, ১১টা ‘এমআই-২৮’ এটাক হেলিকপ্টার, ২৭টা ‘কামভ কেএ-৫২’ এটাক হেলিকপ্টার। এছাড়াও রুশরা কমপক্ষে ১’শ ৪৮টা গোয়েন্দা ড্রোন হারিয়েছে; যার মাঝে রয়েছে ৯৭টা ‘অরলান-১০’ (১৫ কেজি ওজনের), ১৫টা ‘এলেরন-৩’, ৮টা ‘অরলান-২০’ ম্যাপিং ড্রোন। অপরদিকে ইউক্রেন হারিয়েছে কমপক্ষে ৫৫টা যুদ্ধবিমান; যার মাঝে রয়েছে ১৫টা ‘মিগ-২৯’, ৫টা ‘সুখোই-২৭’, ১৫টা ‘সুখোই-২৫’, ১২টা ‘সুখোই-২৪’। ধ্বংসপ্রাপ্ত কমপক্ষে ২৪টা হেলিকপ্টারের মাঝে রয়েছে ১৭টা ‘এমআই-৮’ হেলিকপ্টার। এছাড়াও তারা কমপক্ষে ১৪টা ‘বায়রাকতার টিবি-২’ এটাক ড্রোন হারিয়েছে। অন্যান্য ড্রোন হারিয়েছে কমপক্ষে ৪০টা; যার মাঝে রয়েছে ১০টা ‘এ১-এসএম ফিউরি’ (সাড়ে ৫ কেজি ওজনের)।

গোলাবারুদের স্বল্পতা, নাকি ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষণে ঘাটতি?

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ব্যাপারটা এমন নয় যে, রুশদের হাতে যথেষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না। বরং তারা কোন টার্গেটের বিরুদ্ধে কোন ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করবে, সেক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমারা যদি একটা বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে, তাহলে তারা শ’খানেক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়বে সেটার বিরুদ্ধে। কিন্তু রুশরা এরকম একটা টার্গেটের বিরুদ্ধে মাত্র ২ থেকে ৩টা করে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে; যদিও তাদের যথেষ্ট সংখ্যক গোলাবারুদ ছিল। এছাড়াও ইউক্রেনের সামরিক টার্গেটগুলির ব্যাপারে রুশদের তথ্যের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু এই তথ্য তাদের সামরিক হেডকোয়ার্টার্স ঘুরে বিমান বাহিনীর হাতে যখন গেছে, তখন ২৪ ঘন্টার উপরে পার হয়ে গেছে। আর যখন রুশ বিমানগুলি হামলা করতে গিয়েছে, ততক্ষণে টার্গেট সেই জায়গা থেকে সড়ে গেছে। তবে রুশ ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষকদেরও সমস্যা রয়েছে। তারা তথ্য থেকে ধরতে পারে না যে কোন তথ্যগুলি সঠিক, আর কোনটা ভুল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা ইউক্রেনের একই সামরিক ইউনিটের উপর চারটা স্থানে চারবার হামলা করেছে; যেটা হয়তো একবার করলেই যথেষ্ট ছিল।

টার্গেট ইন্টেলিজেন্স

রুশ বিমানগুলি টার্গেট ধ্বংস করতে পেরেছে কিনা, সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্যে রুশরা অনেকাংশে নির্ভর করেছে পাইলটদের রিপোর্টিং এবং স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবির উপর। তাদের নিজস্ব স্যাটেলাইটের ‘ইলেকট্রো অপটিক্যাল’ সক্ষমতা বেশ কম। তারা প্রধানতঃ দিনের বেলাতেই ছবি তুলতে বাধ্য হচ্ছে; যেকারণে ইউক্রেনিয়দের ধোঁকা দেয়া কর্মকান্ডকে তারা বাইপাস করতে পারছে না। এই সক্ষমতার ঘাটতিগুলির প্রমাণ হলো, তারা বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট কোম্পানিগুলির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে ছবি ক্রয় করছে। টার্গেট ধ্বংসের তথ্যের আরেকটা উৎস হলো ‘সিগনালস ইন্টেলিজেন্স’; যার মাধ্যমে রুশরা ইউক্রেনিয়দের রেডিও যোগাযোগের উপর নজর রাখে এবং তথ্য নেয়ার চেষ্টা করে। ইউক্রেনিয়রা এক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, রুশ বিমান হামলার পরপরই টার্গেট ধ্বংস না হলেও তারা রেডিওতে বলেছে যে, তাদের যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে রুশরা অনেক ক্ষেত্রেই সেই ধ্বংস না হওয়া টার্গেটে আর হামলা করেনি।

ব্রেমার এবং গ্রিকো বলছেন যে, রুশদের স্যাটেলাইটগুলির ‘কভারেজ’ এবং ‘রেজোলিউশন’ উভয়ই খারাপ। এর ফলে রুশরা ইউক্রেনিয়দের খারকিভ অপারেশনের আগে সৈন্য মোতায়েনের কর্মকান্ডগুলিকে ধরতে পারেনি। রুশ বিশ্লেষক পাভেল লুজিন বলছেন যে, রাশিয়ার দু’টা ছবি তোলা স্যাটেলাইটের ‘রেজোলিউশন’ এতটাই খারাপ যে, শুধুমাত্র ক্ষেপণাস্ত্রের ফ্লাইট মিশনের জন্যে ব্যবহৃত হয়। ভূমির একটা স্থানের উপর দিয়ে দ্বিতীয়বার উড়ে যেতে এই স্যাটেলাইটগুলির ১৬ দিন লাগে। একারণে এগুলি থেকে দ্রুত তথ্য পাবার কোন পদ্ধতিই নেই।

ওয়াটলিং বলছেন যে, ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলো বেশ বড় সংখ্যক ‘ইগলা-১’ নামের স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র; যেগুলি একজন সেনা তার কাঁধের উপর থেকে ছুঁড়তে পারে। সোভিয়েত সময়ে তৈরি করা এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ইউক্রেনিয়রা ব্যবহারের উপযোগী করে রেখেছে। যুদ্ধ শুরুর পর তারা মার্কিন ‘স্টিংগার’ এবং ব্রিটিশ ‘স্টারস্ট্রীক’ ক্ষেপণাস্ত্রও পেয়েছে। তবে সংখ্যার দিক থেকে ‘ইগলা-১’ তাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র।

যদিও ইউক্রেনিয়রা যুদ্ধের মাঝে বহু রুশ বিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলি নিশ্চিত কোন রিপোর্টিংএর উপরে নির্ভর করে তৈরি করা নয়; বরং সম্ভাব্য ধ্বংস করার দাবির উপরে ভিত্তি করে তৈরি করা। শত্রুর বিমানগুলি রাডারস্ক্রীন থেকে হারিয়ে গেছে মানে এই নয় যে, সেগুলি ভূপাতিত হয়েছে। হয়তো সেগুলি রুশ আকাশসীমানায় চলে গেছে; অথবা রাডার কভারেজের নিচে নেমে গেছে। আবার অনেক সময়েই একটা বিমান আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তা সফলভাবে ঘাঁটিতে ফেরত যেতে পারে। অর্থাৎ আঘাত করতে পারলেই সেটা ধ্বংস হয়েছে, তা কখনোই বলা যাবে না।

আকাশ থেকে আকাশে যুদ্ধ

জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, ইউক্রেনিয় বিমান বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই বুঝেছিল যে, রুশ বিমান বাহিনীর ফাইটার বিমানগুলির সাথে আকাশ যুদ্ধের তারা পেরে উঠবে না। রুশ বিমানগুলির ‘আর-৭৭-১’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা ইউক্রেনিয়দের ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লার চাইতে শুধু বেশিই নয়; এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বিমানের রাডারের উপর নির্ভরশীল নয় এবং বিমানগুলি খুব সহজেই ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পর দিক পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যেতে পারে। অপরদিকে ইউক্রেনিয় বিমানগুলিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পরেও একই জায়গায় অবস্থান করতে হয়; যা বেশ বিপজ্জনক। একারণে ইউক্রেনিয়রা নিচু দিয়ে উড়ে রুশ রাডারকে এড়াবার কৌশল নেয়; যেখান থেকে তারা রুশ বিমানগুলির বিরুদ্ধে নিচ থেকে অতর্কিত হামলা করে। তবে এই কৌশলে ইউক্রেনিয়দের বিপদ ছিল যে, তারা নিজস্ব স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট হয়ে যেতে পারে; কারণ এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বন্ধু বা শত্রু চিনতে পারে না। তথাপি নিচ থেকে আক্রমণ করতে গেলে বিমানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ভালোভাবে কাজ করে না; সেগুলির দ্রুতি এবং পাল্লা কমে যায়। 

রুশ 'ক্রাশুখা-৪' ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম বা জ্যামিং সিস্টেম। এগুলি শত্রুর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, রাডার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জ্যামিং করতে সক্ষম। ইউক্রেনের সক্ষমতাকে এগুলি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। রুশদের জ্যামিং এবং শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে ইউক্রেনিয়রা তাদের তুর্কি নির্মিত ‘টিবি-২’ ড্রোনগুলির ব্যবহার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

‘ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার’ এবং জ্যামিং

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, রুশরা সর্বদাই বিপক্ষের বিমান আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার পিছনে সকল শক্তি বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে রয়েছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। যেহেতু ইউক্রেনিয়রাও সোভিয়েত ডিজাইনের অস্ত্র ব্যবহার করে, তাই রুশদের অস্ত্রগুলি ইউক্রেনিয়দের বিরুদ্ধে সফলতা পেয়েছে। এছাড়াও রুশরা বেশ শক্তিশালী ‘ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার’ ব্যবস্থা ডেভেলপ করেছে; যেগুলি শত্রুর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, রাডার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জ্যামিং করতে সক্ষম। এগুলি ইউক্রেনের সক্ষমতাকে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, ইউক্রেনিয় এবং রুশ বাহিনীগুলি যেহেতু একই প্রকারের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে, তাই রুশরা যখন জ্যামিং করছে, তখন ইউক্রেনের যোগাযোগের সাথেসাথে রুশ যোগাযোগও ব্যাহত হচ্ছে। রুশ সেনাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে যুদ্ধের প্রথম কিছুদিনের পর থেকে তারা জ্যামিংএর কার্যক্রম কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তবে ডনবাসে আক্রমণ শুরু করার সময় থেকে রুশরা তাদের জ্যামিংএর অপারেশন আবারও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। রুশদের জ্যামিং এবং শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে ইউক্রেনিয়রা তাদের তুর্কি নির্মিত ‘টিবি-২’ ড্রোনগুলির ব্যবহার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ড্রোনগুলি এরপর থেকে মূলতঃ ম্যারিটাইম এলাকায় নজরদারির জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিং

জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, রুশরা তাদের আকাশে রিফুয়েলিং বিমানগুলিকে প্রধানতঃ তাদের কৌশলগত বোমারু বিমানগুলিকে, ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমানগুলিকে এবং ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্স বিমানগুলিকে জ্বালানি দেয়ার কাজে ব্যবহার করে। এগুলির সংখ্যা বেশ সীমিত; পশ্চিমা বিমান বাহিনীগুলির মত নয়। রুশরা সাধারণতঃ তাদের ফাইটার বিমানগুলিকে আকাশে জ্বালানি সরবরাহ করে না। তাদের বেশিরভাগ ফাইটার বিমানই এরকম মিশনের জন্যে ট্রেনিং নেয় না। রিফুয়েলিং মিশন বেশ জটিল এবং ভালো পাইলটরাও এই মিশনগুলিকে হাল্কাভাবে নিতে পারে না। রাতের বেলায় অথবা বেশ চাপের মাঝে থাকা অবস্থায়, যেমন জ্বালানি যদি একেবারেই তলানিতে চলে যায়, এরকম পরিস্থিতিতে রিফুয়েলিং অপারেশন খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। পুরো ফাইটার ইউনিটিগুলিকে এই বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ না করে বিমান আক্রমণের পরিকল্পনার মাঝে আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিংএর ব্যাপারগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।

রুশরা তাদের ১৬টার মতো ‘সুখোই-৩০’, ‘সুখোই-৩৫’ এবং ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমানকে নিজেদের আকাশসীমানার ভেতরে প্যাট্রোলে রাখে সবসময়। এগুলি নিজেদের আকাশসীমানায় থাকার ফলে তারা অপেক্ষাকৃত অধিক উচ্চতায় উড়তে পারে; যেখানে জ্বালানি খরচ অপেক্ষাকৃত কম হয়। এই বিমানগুলি প্রায় ২ ঘন্টা বা এরও বেশি সময় আকাশে থাকতে পারে। অপরদিকে নিজেদের আকাশসীমানায় নিচু দিয়ে ওড়ার কারণে ইউক্রেনের বিমানগুলি খুব বেশি সময় আকাশে থাকতে পারে না। রুশরা যুদ্ধের প্রথমদিকে দিনে ২’শ থেকে ৩’শটা সর্টি ওড়ালেও অক্টোবর নাগাদ তারা দিনে প্রায় ১’শ ৪০টা করে সর্টি ওড়াচ্ছে; যা মোটেই কম নয়।

পশ্চিমারা বিমান আক্রমণে শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে বেশ বড়সড় বাহিনী ব্যবহার করে থাকে; যেকারণে সেরকম জটিল মিশন সমন্বয় করতে হলে আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। এরকম একটা মিশনে ‘ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার’ বিমান থাকে শত্রুর রাডার জ্যামিং করার জন্যে; কিছু বিমান রাডার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করে, যা রাডারের ইলেকট্রনিক সিগনালকে টার্গেট করে। রাডার এরকম ক্ষেপণাস্ত্র দেখলেই বন্ধ করে দিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে। বন্ধ করে দেয়া রাডারকে আবার অন্য কোন অস্ত্রের মাধ্যমে ধ্বংস করার প্রয়োজন হয়। এগুলিকে আবার রক্ষা করার জন্যে ফাইটার বিমান এবং পুরো মিশনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে ‘এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ থাকে। রুশরা এরকম জটিল মিশন সম্পাদন না করলেও কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটা বিমান দিয়ে এমন হামলার চেষ্টা করেছে। অনেক উচ্চতা থেকে রাডার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে; আর একইসাথে ‘সুখোই-২৫’ বিমানগুলি নিচু দিয়ে উড়ে হামলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এরকম মিশন খুবই বিপজ্জনক; কারণ নিচু দিয়ে উড়তে গেলে নিশ্চিতভাবে ইউক্রেনিয়দের স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে পরিণত হবে। বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে এই বিমানগুলিকে উড়িয়ে একটা মিশনে ব্যবহার করতে গেলে সময়ের সমন্বয়ের প্রয়োজন। কোন ঘাঁটিতে কিছু বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে; আবহাওয়ার সমস্যা থাকতে পারে। তখন মিশনের বাকি বিমানগুলিকে বেশি সময় আকাশে থাকতে হতে পারে। একারণেই এরূপ মিশনে অতিরিক্ত জ্বালানি লাগতে পারে। আকাশে ট্যাঙ্কার না থাকলে অনেক সময়ে কিছু বিমানকে ছাড়াই এরকম একটা মিশনে যেতে হতে পারে; যা কিনা মিশনের সফলতা বহুলাংশে কমিয়ে দিতে পারে।

রুশদের পাইলট ও বিমানের উপরে চাপ বাড়ছে

জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, ইউক্রেনে রুশ বিমান বাহিনীর হামলায় এটাক বিমানগুলির পাইলটদের বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। উঁচু দিয়ে ওড়া ফাইটার বিমানগুলি তেমন একটা চাপের মাঝে নেই; তাদের পাইলটদের জন্যেও এটা তেমন একটা কষ্টকর মিশন নয়। কিন্তু ভূমিতে আক্রমণ করা ‘সুখোই-২৫’ এবং ‘সুখোই-৩৪’ বিমানগুলি যেহেতু নিচু দিয়ে উড়ছে, তাই সেগুলি যথেষ্ট ঝাঁকুনির মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিমানের কাঠামো যেমন দুর্বল হচ্ছে, তেমনি পাইলটদের উপর দিয়েও ধকল যাচ্ছে বেশি। এরকম মিশনে পাইলট এক মুহুর্তের জন্যেও আরাম করতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকটা রুশ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। লম্বা সময়ের হিসেবে দেখলে এগুলিকে একটা সূত্রে গাঁথা যায়। বেশি মিশনে থাকার ফলে পাইলটদের উপর যেমন ধকল বাড়ছে, তেমনি বিমানগুলিও হয়তো তাদের ৫০ ঘন্টা, বা ১’শ ঘন্টা বা আড়াই’শ ঘন্টা ওড়ার পর মেইনটেন্যান্সের যে নিয়মগুলি ছিল, তা এড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, রুশ মেইনটেন্যান্সের লোকেরাও অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের কাজ ঠিকমতো করছে না। ইউক্রেনিয়রা এমন রুশ হেলিকপ্টার তাদের হাতে পেয়েছে, যেগুলির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মেইনটেন্যান্সের পরে যায়গামতো লাগানো হয়নি। অথচ এভাবেই বিমানগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে। 

ইউক্রেনের আকাশে রুশ 'কামভ কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার। রুশরা ইউক্রেনে বেশকিছু হেলিকপ্টার হারিয়েছে; যার মাঝে ‘কামভ কেএ-৫২’ সবচাইতে বেশি। রুশ ‘কেএ-৫২’ হেলিকপ্টারগুলি মিশনে গিয়ে ফেরত আসার সময় তার ‘ফ্লেয়ার’এর স্টক শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন এগুলি ইউক্রেনিয় ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। রুশ হেলিকপ্টারগুলি অর্থহীন হয়ে যায়নি মোটেই। তাদের অন্যান্য অস্ত্র, যেমন রকেট দিয়ে তারা শত্রুর শক্ত অবস্থানগুলিতে হামলা করতে পারছে। অথবা নিরাপদ দূরত্ব থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারছে। এই অস্ত্রগুলি শত্রুর অবস্থানকে ব্যাতিব্যস্ত রাখতে পারে; যেসময়ের মাঝে অন্যান্য আর্টিলারি যথেষ্ট নিখুঁতভাবে টার্গেটে হামলা করতে পারবে।


হেলিকপ্টার অপারেশন

রুশরা ইউক্রেনে বেশকিছু হেলিকপ্টার হারিয়েছে; যার মাঝে ‘কামভ কেএ-৫২’ সবচাইতে বেশি। জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, রুশরা তাদের ‘কামভ কেএ-৫২’ হেলিকপ্টারগুলিকে ডিজাইন করেছে স্পেশাল অপারেশন্স সেনাদেরকে সহায়তা দেয়ার জন্যে। এজন্যে এগুলিকে রাতে ওড়ার জন্যে যথেষ্ট ইলেকট্রনিক্স দেয়া হয়েছে। মিশনের চাহিদা অনুযায়ী এই হেলিকপ্টারগুলিকে শত্রু এলাকার অনেক ভেতরে যেতে হবে। নিচু দিয়ে উড়তে গেলে শত্রুর স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় আসবে বলেই এগুলিতে প্রচুর পরিমাণে প্রতিরক্ষামূলক ‘কাউন্টারমেজার’ বা ‘ফ্লেয়ার’ বহণ করা হয়; যা কিনা ক্ষেপণাস্ত্রকে ভুল দিকে ধাবিত করে। তবে এই ‘ফ্লেয়ার’এর সংখ্যা যেহেতু সীমিত, তাই শত্রুর হাতে কত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। কোন গেরিলা বাহিনীর হাতে এরকম খুব বেশি ক্ষেপণাস্ত্র থাকে না। কিন্তু ইউক্রেনের হাতে এরকম ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বিপুল পরিমাণে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলের বেশি গভীরে গেলে বহু সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়াতে হতে পারে। রুশ ‘কেএ-৫২’ হেলিকপ্টারগুলি মিশনে গিয়ে ফেরত আসার সময় তার ‘ফ্লেয়ার’এর স্টক শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন এগুলি ইউক্রেনিয় ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে।

‘কামভ ৫২’ হেলিকপ্টারগুলির ডিজাইনেও কিছু সমস্যা রয়েছে; যেকারণে এগুলি ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করলে মারাত্মক ঝাঁকুনির সন্মুখীন হয়। রুশরা এই সমস্যার সমাধান করেনি; যা সত্যিই অবাক করার মতো। এছাড়াও এই হেলিকপ্টারগুলি লেজার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পর হঠাৎ করেই স্থান ত্যাগ করতে পারে না। যেকারণে এগুলি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পরে নিজেরাই শত্রুর ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। এপ্রিল মাসের পর থেকে রুশ হেলিকপ্টারগুলি নিরাপদ দূরত্ব থেকে অপারেশন চালাচ্ছে। তবে ব্রঙ্ক বলছেন যে, রুশ হেলিকপ্টারগুলি অর্থহীন হয়ে যায়নি মোটেই। তাদের অন্যান্য অস্ত্র, যেমন রকেট দিয়ে তারা শত্রুর শক্ত অবস্থানগুলিতে হামলা করতে পারছে। অথবা নিরাপদ দূরত্ব থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারছে। এই অস্ত্রগুলি শত্রুর অবস্থানকে ব্যাতিব্যস্ত রাখতে পারে; যেসময়ের মাঝে অন্যান্য আর্টিলারি যথেষ্ট নিখুঁতভাবে টার্গেটে হামলা করতে পারবে।

রুশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং সেগুলির কার্যকারিতা

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং সুইসাইড ড্রোনগুলি নিখুঁতভাবে ইউক্রেনের স্থায়ী স্থাপনাসমূহে হামলা করতে সক্ষম হচ্ছে। বিশেষ করে এগুলি ইউক্রেনের বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্টন সেক্টরের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতে পেরেছে। দ্বিতীয়তঃ তাদের শহর এবং কৌশলগত স্থাপনাগুলিকে রক্ষা করতে গিয়ে ইউক্রেনিয়রা তাদের বড় সংখ্যক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফ্রন্টলাইনের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তৃতীয়তঃ এই ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলাকে প্রতিহত করতে গিয়ে ইউক্রেনিয়দের বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের স্টক কমে যাচ্ছে। যদি এই স্টক আবারও পুরণ করে ফেলা সম্ভব না হয়, তাহলে একসময় সেটা শেষ হয়ে যাবে এবং তখন রুশ বিমান বাহিনী মধ্যম উচ্চতা থেকে বোমা হামলা করতে সক্ষম হবে। এর ফলে রুশরা একদিকে যেমন স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে দিয়ে উড়তে পারবে, তেমনি তাদের বোমা হামলা আরও নিখুঁত হবে।

যুদ্ধের শুরুর দিকে রুশ যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনিয়দের সফলতা ছিল প্রায় ১৮ শতাংশের মতো। সেসময় তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি বেশ চাপের মাঝে ছিল। পরবর্তীতে তা অনেক উন্নতি হয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশে পৌঁছায়। সুইসাইড ড্রোনের বিরুদ্ধে এই সফলতার হার আরও বেশি। তবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে আলাদা। নিজেদের ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে কোথায় মোতায়েন করা হয়েছে, সেটার উপর নির্ভর করে রুশ ‘টচকা-ইউ’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হয়তো কিছু ধ্বংস করা সম্ভব হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ‘ইস্কান্দার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে সফলতা পাবার সম্ভাবনা বেশ কম। এই ক্ষেপণাস্ত্রের একটা ভার্সনের বিরুদ্ধে কিছু সফলতা পাওয়া সম্ভব হলেও আরেকটা ভার্সনের বিরুদ্ধে সফলতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর অর্থ হলো, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি প্রায় সর্বদাই টার্গেটে আঘাত করতে পারছে। তবে রুশদের সমস্যা হলো তাদের হাতে ‘ইস্কান্দার’ ক্ষেপণাস্ত্র খুব বেশি সংখ্যক নেই। রুশরা সম্ভবতঃ মাসে ৬টা করে এরূপ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারে। যুদ্ধের শুরুতে হয়তো তাদের হাতে প্রায় ৯’শর মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। এখন পর্যন্ত যুদ্ধে তারা তাদের স্টকের প্রায় অর্থেক ছুঁড়েছে।

ওয়াটলিং বলছেন যে, রুশরা অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র, যেমন ‘এস-৩০০’এর মতো বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ভূমির টার্গেটে ব্যবহার করছে। এগুলির প্রায় ৯০ শতাংশ স্টক রুশদের হাতে এখনও রয়ে গেছে। তারা জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করছে ভূমির টার্গেটের বিরুদ্ধে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ভূমির টার্গেটের জন্যে তৈরি করা হয়নি বিধায় এগুলির নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত হানতে পারার সম্ভাবনা কম। তবে রুশরা যদি বুঝতে পারে যে, কি ধরণের টার্গেটে হামলা করতে হবে, তাহলে তারা তাদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলিকে সেভাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করতে পারে। তারা ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর বিরুদ্ধে বেশ সফলতার সাথে ‘ক্যালিবর’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ব্যবহার করেছে। এর মাঝে ‘ক্যালিবর’এর জাহাজ ধ্বংসী ভ্যারিয়্যান্টও ছিল। এগুলির ব্যবহার নির্ভর করছে যারা পরিকল্পনা করছে, তারা কত ভালোভাবে টার্গেটকে এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ধরণকে বুঝতে পারছে। 

অক্টোবর ২০২২। সুইসাইড ড্রোন ধ্বংস করার লক্ষ্যে আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছে ইউক্রেনিয় পুলিশ সদস্যরা। ই ড্রোনগুলির পাল্লা যথেষ্ট থাকার কারণে এগুলি বিভিন্ন দিক থেকে হামলা করতে পারছে। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আগে থেকে অবস্থান নিতে পারলে ড্রোনগুলিকে গুলি করে ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু রুশ ড্রোনগুলি কোন টার্গেটে হামলা করবে, তা তো আগে থেকে জানা যাচ্ছে না। আর খুব নিচু দিয়ে ওড়ার কারণে একেবারে শেষ মুহুর্তে এগুলি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আপাততঃ ড্রোন এগিয়ে থাকলেও বিমান বিধ্বংসী সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথেসাথে এটা পরিবর্তন হতে পারে। এখানে দীর্ঘমেয়াদে কোনটাই নিশ্চিতভাবে এগিয়ে থাকবে না।


কম খরচের সুইসাইড ড্রোন… যুদ্ধের নতুন ধারা

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ইরানিরা ইয়েমেনে যেসকল সুইসাইড ড্রোন দিয়েছিল বা ড্রোন তৈরির প্রযুক্তি দিয়েছিল, সেগুলির তুলনায় রাশিয়াকে যেগুলি দিয়েছে, সেগুলির মান অনেক বেশি উন্নত। এই ড্রোনগুলির ইলেকট্রনিক্সগুলি আগের চাইতে অনেক উন্নত। এগুলির ওয়ারহেড টার্গেট ধ্বংস করার জন্যে পর্যাপ্ত। এগুলি আকাশে ধ্বংস করাটাও বেশ কঠিন। কারণ এগুলিতে চার প্রকারের ন্যাভিগেশন যন্ত্র রয়েছে। এর মাঝে একটাকে জ্যামিং করার চেষ্টা করা হলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরেকটা ব্যবহার করতে শুরু করে। আর এই ড্রোনগুলির পাল্লা যথেষ্ট থাকার কারণে এগুলি বিভিন্ন দিক থেকে হামলা করতে পারছে। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আগে থেকে অবস্থান নিতে পারলে ড্রোনগুলিকে গুলি করে ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু রুশ ড্রোনগুলি কোন টার্গেটে হামলা করবে, তা তো আগে থেকে জানা যাচ্ছে না। আর খুব নিচু দিয়ে ওড়ার কারণে একেবারে শেষ মুহুর্তে এগুলি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, ইরানের এই ড্রোনগুলিকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, এতে বিভিন্ন ধরণের ইলেকট্রনিক্স বসানো যাবে। এগুলি লেজার দ্বারা গাইড করাও সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, যদি রুশ ‘অরলান-১০’ গোয়েন্দা ড্রোন লেজারের মাধ্যমে কোন চলমান টার্গেটকে নির্দিষ্ট করে, ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন সেই টার্গেটে হামলা করতে পারবে। সুইসাইড ড্রোনের সামনে একটা ক্যামেরাও বসানো সম্ভব। তবে তখন এই ড্রোনগুলির মূল বৈশিষ্ট্যটাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ এখন যেমন এগুলি মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডলারে তৈরি করা যাচ্ছে, তখন তার মূল্য হয়ে যাবে ৮৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ ডলারের মতো। ইরান এসব ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ খুব সহজে যোগাড় করতে পারবে না। কাজেই এগুলি তখন হয়ে যাবে স্পেশাল ধরণের অস্ত্র; যা বিরাট সংখ্যায় তৈরি করা সম্ভব নয়। অথচ ইরানের ‘শাহেদ’ ড্রোনগুলির মূল শক্তিই হলো এগুলির সংখ্যা।

জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, পশ্চিমারা সকল রুশ অস্ত্রই খুলে দেখেছে এবং সেগুলিতে প্রচুর পশ্চিমা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ পাওয়া গিয়েছে। গত অগাস্টের পর থেকে রাশিয়াতে এই ইলেকট্রনিক্স চিপগুলির সরবরাহ বেড়েছে। এগুলির বেশিরভাগই বাণিজ্যিকভাবে বাজারে বিক্রি হয়; কাজেই এগুলির উপরে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব নয়। কোন অস্ত্রের মাঝে ব্যবহৃত এই ইলেকট্রনিক্স চিপগুলি যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে পুরো অস্ত্রের ডিজাইনই পরিবর্তন করতে হবে। নয়তো নতুন করে নিজেদের দরকার মতো চিপ তৈরি করতে হবে। কাজেই একটা চিপ সরবরাহে যদি সমস্যা তৈরি হয়, তাহলেই পুরো ব্যবস্থাটা সমস্যায় পড়ে যাবে। তবে কয়েক হাত ঘুরে যায় বলে এই চিপগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা কঠিন। যদিও রুশরা যে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এই চিপগুলি যোগাড় করে, সেই নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়াটা বেশ কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। বাস্তবিকপক্ষে এই কাজটা করতে বেশ বড়সড় আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে।

ব্রেমার এবং গ্রিকো বলছেন যে, এক’শ বছর আগে সামরিক বিমান সার্ভিসে আসার পর থেকে শুধুমাত্র বড় শক্তিধর দেশগুলির কাছেই আর্থিক, সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশাল এবং আধুনিক বিমান শক্তি তৈরি করার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহার, দ্রুত হ্রাস পাওয়া খরচ এবং ইন্টারনেটের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এখন মনুষ্যবিহীন বিমান তৈরি করতে সক্ষম। তুর্কি ‘টিবি-২’ ড্রোন অত্যন্ত কম খরচে ইউক্রেনের হাতে আকাশ থেকে গোয়েন্দাবৃত্তির সক্ষমতা এনে দিয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, বর্তমানে ইউক্রেনের হাতে প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন প্রকারের বাণিজ্যিক ড্রোন রয়েছে; যেগুলি আকাশ থেকে রুশ অবস্থানের ছবি তুলে এবং ইউক্রেনিয় আর্টিলারির জন্যে টার্গেট খুঁজে দিচ্ছে। ডনবাসে রুশরা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুসংহত করার পর থেকে ইউক্রেনও বাধ্য হয়েছে তাদের ড্রোনের ব্যবহারকে পরিবর্তন করতে। তারা বাধ্য হয়েছে তাদের ‘টিবি-২’ ড্রোনগুলিকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে। ইউক্রেন তাদের অনেক ড্রোন হারিয়েছে; কিন্তু সেগুলি আবারও তারা প্রতিস্থাপন করতে পারবে; তাদের ড্রোন পাইলটরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু মনুষ্যচালিত বিমানগুলির ব্যাপারটা আলাদা। মার্কিন বিমান বাহিনীর সাবেক জেনারেল ডেভিড গোল্ডফেইন ‘দ্যা মস্কো টাইমস’কে বলছেন যে, একজন অভিজ্ঞ ফাইটার পাইলট তৈরি করতে ১০ বছর সময় এবং গড়ে কমপক্ষে ৬ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।

ইউক্রেনের ড্রোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

তবে এই ‘শাহেদ’ ড্রোনগুলির একটা বৈশিষ্ট্য যেটা অনেকেই প্রথমে ধরতে পারেনি তা হলো, এর ইঞ্জিন যতটুকু তাপ উৎপাদন করে, তা ‘হীট সীকিং’ বিমান ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট হবার জন্যে যথেষ্ট। কাজেই ইউক্রেনের ‘ইগলা-১’ এবং পুরোনো ‘স্ট্রেলা’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এই ড্রোনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়। এই পুরোনো ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আধুনিক যুদ্ধবিমানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে না পারলেও এসব ড্রোনের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করবে। এছাড়াও ‘মিগ-২৯’এর ‘আর-৭৩’ ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমেও এই ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। তবে আকাশ থেকে আকাশে ছোঁড়া এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির একেকটার মূল্যই মিলিয়ন ডলার। কাজেই এগুলিকে ড্রোন ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করাটা কোন ভালো সমাধান নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সরকার ইউক্রেনকে স্বল্প পাল্লার বিমান ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে; যেগুলি ড্রোনগুলির বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফল দিতে পারে। মার্কিন ‘এভেঞ্জার’ ব্যবস্থাটা গাড়ির উপর থেকে ‘স্টিংগার’ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। গাড়ির উপরে থাকার কারণে এগুলি পায়ে হাঁটা সেনাদের চাইতে দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে পারে। তবে রাতের বেলায় অপারেট করতে গেলে সেনাদেরকে নাইট ভিশন গগলস দিতে হবে। সমস্যাটার কোন সমাধান নেই তা নয়; তবে পুরো ইউক্রেন জুড়ে এমন হামলা ঠেকাতে কতটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব, সেটা একটা প্রশ্ন। পশ্চিমারা এটা নিয়ে তেমন একটা ভাবেনি এতকাল।

ওয়াটলিং বলছেন যে, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে আর্টিলারি দেয়ার ক্ষেত্রে একটা ভুল করেছে। তারা ১৪ প্রকারের আর্টিলারি পাঠিয়েছে সেখানে; যেগুলির প্রতিটা অপারেট করার ম্যানুয়াল আলাদা। ইউক্রেনিয়দের এগুলি অপারেট করতে গিয়ে শুধু সেনাদেরকেই নয়, তাদের মেইনটেন্যান্স লোকজনকেও ট্রেনিং দিতে হচ্ছে। এগুলির ভিন্ন প্রকারের গোলাবারুদ যোগাড় করা এবং ফ্রন্টলাইনে ব্যবহার করাটা একটা বড় লজিস্টিক্যাল সমস্যা। যদি পশ্চিমারা বিমান বিধ্বংসী ব্যবস্থা দেয়ার ক্ষেত্রে একই রকম ভুল করে, তাহলে তা আরও মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করবে। কারণ পশ্চিমাদের অনেক বিমান বিধ্বংসী ব্যবস্থার জন্যে যথেষ্ট গোলাবারুদ স্টকে নেই; আর এগুলির ট্রেনিং আরও বেশি জটিল।

পশ্চিমারা অনেকেই বলছে যে, ইউক্রেনকে মার্কিন 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান দেয়া উচিৎ। তবে, ‘এফ-১৬’ বিমানের চাকার ব্যবস্থাটা খুব একটা শক্তিশালী করে তৈরি করা হয়নি। ইউক্রেনের বর্তমান বিমানঘাঁটিগুলির রানওয়ে থেকে ‘এফ-১৬’ ওড়াবার চেষ্টা করলে তা বিমানগুলিকে কাঠামোগতভাবে দুর্বল করে ফেলতে পারে। এছাড়াও এগুলি ওড়ার জন্যে অনেক দীর্ঘ এবং খুব ভালো পেভমেন্টের রানওয়ে দরকার হয়। এবং যথেষ্ট সংখ্যায় মূল্যবান গ্রাউন্ড সাপোর্ট যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। এই ব্যবস্থাগুলি যেকোন একটা দেশই নিতে পারে; তবে তা শান্তিকালীন সময়ে সম্ভব; যখন নিজেদের মাথার উপরে বোমা পড়ছে, তখন নয়।  

 
ইউক্রেনের জন্যে পশ্চিমা যুদ্ধবিমান কতটা বাস্তবসম্মত?


ব্রেমার এবং গ্রিকো বলছেন যে, ইউক্রেনকে যদি পশ্চিমারা আধুনিক যুদ্ধবিমান দেয়, তাহলে সেটা প্রতিপক্ষকে আকাশ ব্যবহার থেকে বিরত রাখার বর্তমান কৌশল থেকে দূরে ঠেলে দেবে। বর্তমান কৌশল যে সফল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু পশ্চিমা চতুর্থ জেনারেশনের ফাইটার বিমান হলো আকাশ নিয়ন্ত্রণ কৌশলের অংশ। তারা মনে করছেন না যে, ইউক্রেনের উচিৎ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আকাশ নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় নামা। রুশরা আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে মৌলিক একটা পরিবর্তনের কারণে। এই কারণটা হলো, এখন থেকে আক্রমণের চাইতে প্রতিরোধই বেশি শক্তিশালী। রুশরা একারণেই আক্রমণে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে; অর্থাৎ আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। ইউক্রেন যদি একই চেষ্টা করতে যায়, তাহলে তারাও ব্যর্থ হবে। যুক্তরাষ্ট্রও যদি তাদের নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করে মনুষ্যবিহীন অপেক্ষাকৃত কম খরচের বিপুল পরিমাণ ড্রোনের দিকে না আগায়, তাহলে তাদেরকে সামনের দিনগুলিতে অতিরিক্ত মূল্যবান এবং সংখ্যায় কম মনুষ্যচালিত বিমানের উপরে নির্ভর করতে হবে; যুদ্ধ দীর্ঘ হলে যেগুলিকে প্রতিস্থাপন করা অত্যধিক কষ্টকর।

অপরদিকে জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, পশ্চিমারা যখন কেউ কেউ বলছেন যে, ইউক্রেনকে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান দেয়া উচিৎ, তা একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়। কারণ মধ্যম মেয়াদে ইউক্রেনের এমন একটা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন, যেখানে পশ্চিমা যুদ্ধবিমানও থাকবে। ভূমি থেকে ছোঁড়া বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতে পশ্চিমারা খুব বেশি বিনিয়োগ করেনি; কারণ গত ৩০ বছর ধরে পশ্চিমারা আকাশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। কাজেই এগুলি খুব বেশি দিন সরবরাহ করে ইউক্রেনকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। স্বল্প সংখ্যায় হলেও ইউক্রেনের প্রয়োজন এমন একটা স্বক্ষমতা, যা কিনা রুশ ফাইটার বিমানের সাথে মোটামুটিভাবে পাল্লা দিতে পারবে। ‘মিগ-৩১’ ফাইটারগুলি যুদ্ধে যোগ দেয়ার পর ইউক্রেনের জন্যে অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেছে। কারণ এই বিমানগুলি অতি দূরপাল্লার ‘আর-৩৭’ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত। এই ক্ষেপণাস্ত্র এখন ‘সুখোই-৩৫’ বিমানও বহণ করছে। যদি রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের কয়েক মাসের একটা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে এর মাঝে ইউক্রেনকে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানের জন্যে প্রস্তুত করা যেতে পারে। সংখ্যার দিক থেকে এই বিমানগুলি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অনেক ইউরোপিয় দেশ ব্যবহার করে; যেগুলি কিছুদিনের মাঝেই ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ বিমান দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। এই ‘এফ-১৬’গুলি মোটামুটি ভালো অবস্থায় রয়েছে এবং এগুলি ন্যাটোর ব্যবহৃত সকল অস্ত্র বহণে সক্ষম। এটা ইউক্রেনকে সাশ্রয়ী খরচে ভালো একটা সক্ষমতা দিতে পারে।

তবে ব্রঙ্ক বলছেন যে, এই বিমানগুলির সমস্যা হলো, এগুলি ওড়ার জন্যে অনেক দীর্ঘ এবং খুব ভালো পেভমেন্টের রানওয়ে দরকার হয়। এবং যথেষ্ট সংখ্যায় মূল্যবান গ্রাউন্ড সাপোর্ট যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। এই ব্যবস্থাগুলি যেকোন একটা দেশই নিতে পারে; তবে তা শান্তিকালীন সময়ে সম্ভব; যখন নিজেদের মাথার উপরে বোমা পড়ছে, তখন নয়। ইউক্রেনিয়রা যদি ‘এফ-১৬’এর জন্যে উপযুক্ত করে রানওয়ে তৈরি করতে শুরু করে, তাহলে রুশরা তা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখতে পারবে এবং তারা সেই রানওয়েকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ডিজাইনগত কারণেই ‘এফ-১৬’ বিমানের চাকার ব্যবস্থাটা খুব একটা শক্তিশালী করে তৈরি করা হয়নি। ইউক্রেনের বর্তমান বিমানঘাঁটিগুলির রানওয়ে থেকে ‘এফ-১৬’ ওড়াবার চেষ্টা করলে তা বিমানগুলিকে কাঠামোগতভাবে দুর্বল করে ফেলতে পারে। এই জায়গাটায় ‘এফ-১৬’এর স্থলে ‘এফএ-১৮’ হয়তো অপেক্ষাকৃত ভালো হতে পারে। কিন্তু ‘এফএ-১৮’এর সংখ্যা আবার অনেক কম। এই বিমান ব্যবহার করা যেকোন দেশ বা বাহিনীই এগুলি ইউক্রেনকে দেবার জন্যে যথেষ্ট ভালো অবস্থানে নেই। এছাড়াও ওয়াশিংটনে এই বিমান এবং বিমানের সাথে প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল কনট্রাক্টর লোকজন সরবরাহ করার জন্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতজনের রয়েছে, তা চিন্তা করার মতো।

ব্রঙ্ক বলছেন যে, ইউক্রেনের জন্যে সবচাইতে বেশি উপযোগী বিমান হলো সুইডেনের ‘সাব জেএএস-৩৯ গ্রিপেন’। ইউক্রেনিয়রা এই মুহুর্তে যে ধরণের অপারেশন চালাচ্ছে, ঠিক এমন ধরণের অপারেশনের জন্যেই ‘গ্রিপেন’ বিমান ডিজাইন করা হয়েছিল। কিছুদিন আগ পর্যন্তও জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার কারণে সুইডেনের প্রতিরক্ষানীতি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থাৎ প্রয়োজনে তারা কারো সহায়তা ছাড়াই রুশ আগ্রাসন মোকাবিলা করবে। এই নীতির অধীনে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘাঁটি, এমনকি হাইওয়ে থেকে যুদ্ধবিমান ওড়াবে। একারণেই ‘গ্রিপেন’কে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যার কারণে তা যেকোন আমেরিকান বা ইউরোপিয় যুদ্ধবিমানের চাইতে অপেক্ষাকৃত সহজে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। মাত্র ছয়জন লোক এই বিমানের মেইনটেন্যান্স করতে পারে; যার মাঝে একজনের মাত্র হতে হবে উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত; বাকিরা তেমন কোন ট্রেনিং না থাকলেও চলে। বিমানের অভ্যন্তরের যন্ত্রগুলি পর্যন্ত পৌঁছাতে ক্রুদের কোন রেঞ্চও ব্যবহার করতে হয়না। স্টার্ট নিতে বাইরে থেকে কোন বৈদ্যুতিক ব্যবস্থারও দরকার হয় না। মাত্র দু’টা গাড়ির প্রয়োজন এই বিমানকে যুদ্ধের জন্যে পুনরায় ওড়ার উপযোগী করতে। এই বিমানগুলি ব্রিটিশ ‘মিটিঅর’ ক্ষেপণাস্ত্রও বহণ করতে সক্ষম; যা কিনা ইউরোপিয়দের হাতে থাকা সবচাইতে দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র; যদিও সেটা ইউক্রেনকে দেয়া যাবে কিনা, তা ইউরোপিয় সরকারগুলির রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপরে নির্ভর করবে। ‘গ্রিপেন’ রুশ যুদ্ধবিমানগুলিকে মোকাবিলা করার জন্যে যথেষ্ট উপযোগী। তবে সুইডেন বহুকাল নিরপেক্ষ দেশ ছিল। সেখান থেকে হঠাৎ করেই তারা ইউক্রেনকে ‘গ্রিপেন’ যুদ্ধবিমান দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাবে, এটা মনে করাটা কঠিন। তবে যদি আগামী ছয় মাসের মাঝে ইউক্রেনের জন্যে কোন যুদ্ধবিমানের কথা বলা হয়, তাহলে সেখানে ‘গ্রিপেন’ ছাড়া আর কোন বিমানই প্রস্তুত নয়। 

এপ্রিল ২০২২। বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বাঁচতে ইউক্রেনিয় 'সুখোই-২৫' এটাক বিমান ফ্লেয়ার ছড়াচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, যারা শত্রুকে আকাশ ব্যবহারে বাধা দিতে চাইছে, তাদের কাজগুলি যারা শত্রুর আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে, তাদের কাজের চাইতে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে।  


আকাশ যুদ্ধে নতুন যুগের সূচনা?

ইউক্রেনের আকাশে রুশদের ব্যর্থতা অনেকের কাছেই বেশ পরিষ্কার; তবে এর কারণ সকলের কাছে এক নয়। ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক আলোচনায় মার্কিন বিমান বাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল ফিলিপ ব্রীডলাভ বলছেন যে, তারা ধারণা করেছিলেন যে, রুশরা ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু সেটা তারা পারেনি। এই যুদ্ধটা আগের সকল যুদ্ধ থেকে আলাদা। এটা এমন একটা পরিস্থিতি, যেন একেবারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখায় ফিরে যাওয়া। একই আলোচনায় মার্কিন বিমান বাহিনীর প্রাক্তন লেঃ কর্নেল টাইসন ওয়েটজেল বলছেন যে, রুশরা ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে না পেরে মারাত্মক ভুল করেছে। তবে তিনি স্বীকার করছেন যে, আকাশ যুদ্ধ এখন অনেক সস্তা হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে আকাশ নিয়ন্ত্রণে নেয়া আরও কঠিন হতে পারে। স্পেনের ‘এল পাইস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনিয় সেনারা সবচাইতে বেশি ভয় পায় রুশ ড্রোনগুলিকে; বিশেষ করে বাণিজ্যিক ড্রোনগুলি; যেগুলিকে পরিবর্তন করা হয়েছে বোমা ফেলার জন্যে।

ব্রেমার এবং গ্রিকো বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, একটা ছোট শক্তির রাষ্ট্র কিভাবে একটা বৃহৎ রাষ্ট্রের শক্তিশালী বিমান বাহিনীকে আকাশ থেকে দূরে রাখতে পেরেছে; আকাশের নিয়ন্ত্রণ শত্রুর হাতে ছেড়ে দেয়নি। স্তরীভূত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ইউক্রেনিয়রা তাদের আকাশকে রুশ বিমান বাহিনীর জন্যে ‘মাইনফিল্ড’ বানিয়ে ফেলেছে। ইউক্রেনের ‘এস-৩০০’ এবং ‘বুক এম-১’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েই রাডার বন্ধ করে দিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে ফেলছে। এভাবে মধ্যম উচ্চতার আকাশ রুশ বিমান বাহিনীর জন্যে বিপজ্জনক হয়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রুশরা যখন নিচু দিয়ে তাদের বিমান উড়িয়েছে, তখন তারা হাজার হাজার স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও ইউক্রেনিয়রা নিজেদের দেশে যুদ্ধ করার কারণে কিছু সুবিধা ভোগ করছে। ইউক্রেন বিমান বাহিনীর মূখপাত্র ইউরি ইহনাত ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা নিজেদের আকাশে যুদ্ধ করছে; যেখানে প্রতিটা এলাকা তাদের পরিচিত। অপরদিকে শত্রুদেরকে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা এলাকার ভেতরে ঢুকতে হচ্ছে। ব্রেমার এবং গ্রিকোর মতে, এটা নতুন যুগের সূচনা, যেখানে প্রতিরোধকারীরা নিশ্চিতভাবেই আক্রমণকারীর চাইতে বেশি শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বিপুল সংখ্যক স্বল্প খরচার ড্রোন প্রতিরোধকারীদের হাতে বড় একটা সক্ষমতা এনে দিয়েছে।

মার্কিন বিমান বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ লেঃ জেনারেল ক্লিনটন হাইনোট ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক আলোচনায় বলেছেন যে, যারা শত্রুকে আকাশ ব্যবহারে বাধা দিতে চাইছে, তাদের কাজগুলি যারা শত্রুর আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে, তাদের কাজের চাইতে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। জেনারেল হাইনোটের মতে, যদি উভয় পক্ষই আকাশ ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই অবস্থাটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সুবিধাজনক হয়, তাহলে মার্কিনীদের উচিৎ উভয় পক্ষের জন্যে আকাশ ব্যবহার কঠিন করে ফেলার কৌশলের দিকেই অগ্রসর হওয়া।

ইউক্রেনের আকাশ যুদ্ধ থেকে শিক্ষা


যদিও বিভিন্ন দেশ এবং বাহিনী ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা নেবে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হতে এখনও বাকি রয়েছে, তথাপি কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটা দাগ টানাই যায়, যা কিনা যে কারুর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।

প্রথমতঃ আকাশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না থাকার পরেও ইউক্রেনিয়রা সফলভাবে বড় রকমের আক্রমণে যেতে পেরেছে; যেখানে তারা কৌশলগতভাবে রুশদেরকে অবাক করে দিয়েছে এবং রুশ বিমান বাহিনী ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে খোলা আকাশের নিচে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ বড় বিমান বাহিনী রয়েছে এমন কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অপেক্ষাকৃত ছোট কোন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ভূমিতে বড় ধরণের আক্রমণে যেতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ আকাশ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্যে এখন আর অতি মূল্যবান যুদ্ধবিমান না হলেও চলে। বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হওয়া ড্রোন এখন ফ্রন্টলাইনের সেনাদেরকে টার্গেটিংএর তথ্য এনে দিচ্ছে; যা কিনা নিজেদের আর্টিলারির নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত হানার সক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

তৃতীয়তঃ বিপক্ষের আকাশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার সক্ষমতা কতটুকু হবে, তা নির্ভর করছে বিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতার উপর। শত্রুর পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা না গেলে তা যুদ্ধক্ষেত্রে বড় রকমের হারের কারণ হতে পারে; যা ইতিহাস থেকে সকলেই জানেন।

চতুর্থতঃ সুসাইড ড্রোনের মূল ব্যাপারটাই হলো স্বল্প খরচ এবং বিপুল সংখ্যা। খরচ বেড়ে গেলে সংখ্যা কমে আসবে; এর কার্যকারিতাও কমে যাবে। বিশেষ মিশনের জন্যে আলাদা সক্ষমতার ড্রোন ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু সংখ্যার খেলায় ড্রোনের সক্ষমতা বৃদ্ধির সীমা রয়েছে। একইভাবে ড্রোনগুলিকে আকাশে ধ্বংস করার সক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আপাততঃ ড্রোন এগিয়ে থাকলেও বিমান বিধ্বংসী সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথেসাথে এটা পরিবর্তন হতে পারে। এখানে দীর্ঘমেয়াদে কোনটাই নিশ্চিতভাবে এগিয়ে থাকবে না।

পঞ্চমতঃ একটা সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা নির্ভর করে তার একেকটা সামরিক ইউনিটের মাঝে সমন্বয়ের উপর। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকবেই। তবে নিজেদের বাহিনীগুলি একটা আরেকটাকে কতটা সহায়তা দিতে পারে, সেটার উপরে নির্ভর করবে সার্বিক সাফল্য। এক্ষেত্রে আকাশের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় কাজ করা বিমান প্রতিরক্ষা রাডার, মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান বিধ্বংসী কামান, স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, জ্যামিং সিস্টেমস, একস্থান থেকে অন্যস্থানে দ্রুত স্থানান্তরের সক্ষমতা, নিজেদের ফাইটার বিমানের ভূমিতে থাকা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে একত্রে কাজ করার সক্ষমতা, নিজেদের বিমানগুলিকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা এবং যেকোনভাবে আকাশে ওড়াবার সক্ষমতা তৈরি, শত্রুর স্যাটেলাইটকে বোকা বানাবার জন্যে ভুয়া টার্গেট, সিগনালসএর মাধ্যমে শত্রুকে ভুল তথ্য সরবরাহ করা এবং শত্রুর সিগনালসএর উপরে নজরদারি, নিজেদের যোগাযোগের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষণ সক্ষমতা, ইত্যাদির একত্রে সমন্বয়ের মাধ্যমেই একটা রাষ্ট্র তার আকাশ সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে সক্ষম। এখানে কোন একটা জিনিসকে অন্যটা থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না।



সূত্রঃ

‘Success denied: Finding ground truth in the air war over Ukraine’ by Col. Maximilian Bremer & Kelley Grieco, in Defense News, 21 September 2022
‘The Russian Air War and Ukrainian Requirements for Air Defence’ by Justin Bronk, Nick Reynolds & Jack Watling, in RUSI, 07 November 2022
‘How the Russian Air Force Failed in Ukraine’ in Geopolitics Decanted, 18 November 2022 (https://podcasts.apple.com/gb/podcast/how-the-russian-air-force-failed-in-ukraine/id1614010500?i=1000586627593)
‘US Air Force needs to embrace air denial as a core mission’ by Col. Maximilian Bremer & Kelley Grieco, in Defense News, 08 September 2022
‘Mutual Denial of Air Superiority Could Benefit US in Future Conflict, Top USAF Planner Says, in Air & Space Forces Magazine, 06 September 2022
‘Air denial: The dangerous illusion of decisive air superiority’ by Col. Maximilian Bremer & Kelley Grieco, in The Atlantic Council, 30 August 2022
‘There’s A Good Reason The Russian Air Force Is Faltering. Ukrainian Air-Defense Crews Have Better Apps’ by David Axe, in Forbes, 18 October 2022
‘In Denial About Denial: Why Ukraine’s Air Success Should Worry the West’ by Col. Maximilian Bremer & Kelley Grieco, in War on the Rocks, 15 June 2022 (https://warontherocks.com/2022/06/in-denial-about-denial-why-ukraines-air-success-should-worry-the-west/)
‘Attack On Europe: Documenting Ukrainian Equipment Losses During The 2022 Russian Invasion Of Ukraine’ in Oryx (https://www.oryxspioenkop.com/2022/02/attack-on-europe-documenting-ukrainian.html)
‘Attack On Europe: Documenting Russian Equipment Losses During The 2022 Russian Invasion Of Ukraine’ in Oryx (https://www.oryxspioenkop.com/2022/02/attack-on-europe-documenting-equipment.html)
‘The Air-to-Air War in Ukraine No One Saw Coming’ by Sebastian Roblin, in 1945, 01 September 2022 (https://www.19fortyfive.com/2022/09/the-air-to-air-war-in-ukraine-no-one-saw-coming/)
‘Russia’s aerial warfare in Ukraine falters’ in El Pais English, 16 October 2022