Tuesday 27 September 2022

মধ্য এশিয়ার দুই দেশ তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের সীমান্ত সংঘর্ষের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
সোভিয়েতদের তৈরি করা মধ্য এশিয়ার কৃত্রিম সীমানাগুলিকে এখন বাইরের শক্তিরা ব্যবহার করছে। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ পানি উৎস ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের হাতে থাকায় এবং মধ্য এশিয়ার সাথে চীনের পশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত উইঘুর প্রদেশের যোগাযোগের মূল পথ কিরগিজস্তানের মাঝ দিয়ে বা এর পাশ দিয়ে যাওয়ায় অত্র অঞ্চলে সকলেরই আগ্রহ বেশি।

মধ্য এশিয়ার সমরখন্দে যখন আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংস্থা ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’র শীর্ষ বৈঠক চলছিল, তখন দুই সদস্য রাষ্ট্র তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের সীমান্তে মারাত্মক সংঘর্ষে ১’শ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। অনেকেই বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল দুই দেশের মাঝে সংঘর্ষের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে চলা এই সংঘর্ষে উভয় দেশই শুরুর জন্যে একে অপরকে দায়ী করেছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, দুই দেশের ৯’শ ৭০ কিঃমিঃ সীমানার মাঝে প্রায় অর্ধেকই এখনও নির্দিষ্ট করা হয়নি। ২০২১এর এপ্রিল মাসেও এরকম সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জনের মৃত্যু হয়। ২৫শে সেপ্টেম্বর তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের মাঝে এক সমঝোতা হয়; যা মোতাবেক উভয় দেশ সংঘর্ষ এলাকা থেকে নিজেদের ৪টা করে সীমানা চৌকি খালি করে ফেলবে। কিরগিজ জাতীয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কমিটির প্রধান কামচিবেক তাশিইয়েভ সাংবাদিকদের বলেন যে, এর ফলে সংঘর্ষ এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া ১ লক্ষ ৪০ হাজার কিরগিজ তাদের নিজেদের ঘরবাড়িতে ফেরত আসতে পারবে।

‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সমঝোতার পর কিরগিজ জনগণের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের অনেকেই বলছেন যে, কিরগিজ সরকার তাজিকিস্তানের ভয় দেখানোর মুখে নতি স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের কথায়, কিরগিজ সেনারা যদি ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যায়, তাহলে কিরগিজ জনগণ সেখানে নিজেদের বসতভিটায় ফেরত যেতে ভয় পাবে। আর এই সুযোগে তাজিকরা সেই এলাকাগুলি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। সমঝোতার পরদিন ২৬শে সেপ্টেম্বর কিরগিজস্তানের দক্ষিণের বাতকেন শহরে সরকারি অফিসের কাছে অনেকে জড়ো হয়ে এব্যাপারে প্রতিবাদ করে। কিরগিজ সরকার এর জবাবে বলে যে, সীমান্তের ব্যাপারে সমঝোতা একটা অস্থায়ী সমাধান। আর কিরগিজ নিরাপত্তা বাহিনী ঐ এলাকায় টহল অব্যাহত রাখবে।

‘ইউরোশিয়ানেট’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, দুই দেশের সংঘর্ষ নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে চলা এই সংঘর্ষে ক্রমান্বয়ে বড় আকারের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আর্টিলারি, মেশিন গান, সাঁজোয়া যান, এমনকি এটাক ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, এভাবে সীমান্ত সংঘর্ষ বাড়তে থাকলে দুই দেশের মাঝে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। সংঘর্ষ শুরুর মাত্র একদিন আগেই কিরগিজ প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ তুরস্কের কাছ থেকে কেনা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন পরিচালনা করার জন্যে ঘাঁটি উদ্ভোধন করেন এবং সীমান্ত রক্ষায় এগুলির গুরুত্বকে তুলে ধরেন। তাজিক পক্ষ ইতোমধ্যেই কিরগিজদের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করার অভিযোগ করেছে। গত বছরের অক্টোবরে কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন যে, তার দেশ তুরস্ক থেকে ড্রোন কিনছে।

 
সংঘর্ষ শুরুর মাত্র একদিন আগেই কিরগিজ প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ তুরস্কের কাছ থেকে কেনা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন পরিচালনা করার জন্যে ঘাঁটি উদ্ভোধন করেন। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কসহ অন্যান্য শক্তিদেরকে রুশ প্রভাব প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা দেবে। তাজিকিস্তানের সাথে সংঘর্ষে কিরগিজস্তানের তুর্কি ড্রোনের সাফল্য এই অঞ্চলের দ্বন্দ্বকে শান্তিপূর্ণ পথ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। একইসাথে কিরগিজস্তানের জন্যে তুর্কি সহায়তাকে ব্যালান্স করতে তাজিকিস্তান ইরানের মুখাপেক্ষি হতে পারে; যা কিনা মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের সাথে ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আরও বৃদ্ধি করবে।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক পত্রিকা ‘আল মনিটর’এর সাথে সাক্ষাতে মস্কো ভিত্তিক তুর্কি বিশ্লেষক কেরিম হাস বলছেন যে, ড্রোনের কারণে শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার চেষ্টাটা কমে যেতে পারে। তবে এর মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার রুশ ছায়ায় থাকা অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। কিরগিজস্তানের সাথে তাজিকিস্তান এতকাল সামরিক দিক থেকে এগিয়ে ছিল। কিন্তু এই ড্রোনের কারণে সেখানে ব্যালান্সে পরিবর্তন এসেছে। এছাড়াও অনেকেই এখন মনে করতে শুরু করেছে যে, কিরগিজস্তানকে তুরস্ক সহায়তা দিচ্ছে। তিনি বলছেন যে, এই সংঘর্ষের ফলে তাজিকিস্তান এখন তুরস্ক, ইরান বা রাশিয়ার কাছে ড্রোন চাইতে পারে। ইরান ড্রোন বিক্রি করলে ইরানের প্রভাব বাড়বে; তুরস্ক বিক্রি করলে কিরগিজস্তানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক খারাপ হবে।

দ্বন্দ্বের উৎস হিসেবে পানির ইস্যুকে উল্লেখ করা হচ্ছে। বৃষ্টিহীন মধ্য এশিয়ায় নদীর পানির বন্টন অতি সংবেদনশীল ইস্যু। অত্র অঞ্চলের বেশিরভাগ নদীর উৎপত্তিস্থল আলতায় এবং তিয়েনশান পর্বতে; যার বেশিরভাগটাই সোভিয়েত আমলের সীমানা নির্ধারণের ফলশ্রুতিতে কিরগিজস্তানে। একারণে ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও পানির দিক থেকে কিরগিজস্তান সবচাইতে ধনী। তাজিকিস্তানের দুই প্রধান নদী ভাখশ এবং শির দরিয়ার উৎপত্তি কিরগিজস্তানে। বিশেষ করে ভাখশ নদীর পানির উপর তাজিকিস্তানের বিদ্যুৎ, এলুমিনিয়াম এবং তূলার উৎপাদন নির্ভরশীল। সংঘর্ষে জড়ানো তাজিকিস্তানের সুঘদ রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ২৭ লক্ষ; অপরদিকে কিরগিজস্তানের বাতকেন অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ। সুঘদ রাজ্যের পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো কিরগিজস্তান থেকে আসা তিনটা নদী আকসু, রুসলো খোজা বকিরগন এবং ইসফারা। এই নদীর অববাহিকাগুলিতেই মূল সংঘর্ষ হয়েছে।

তুর্কি সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে উজবেক বিশ্লেষক ওতাবেক ওমোনকুলভ বলছেন যে, মধ্য এশিয়ার প্রধান সমস্যা এর সীমানাগুলি; যেগুলি সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল। পশ্চিমা ঔপনিবেশিকরা যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগাভাগি করেছিল, ঠিক সেভাবেই সোভিয়েতরা এই অঞ্চলকে ভাগ করেছিল যাতে এগুলিকে আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তারা এমনভাবে এই এলাকার সীমানাগুলি তৈরি করেছিল, যাতে করে এই রাষ্ট্রগুলি একদিন স্বাধীন হলে এরা একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়িত হবে। কিরগিজস্তানের জনগণ বেশিরভাগ তুর্কি জাতির; অপরদিকে তাজিকিস্তানের জনগণের বেশিরভাগ হলো পারসিক। তবে এই দেশগুলির সীমানায় বসবাস করা জনগণ তাজিক, কিরগিজ এবং উজবেক। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো কামাল আলম বলছেন যে, অনেকেরই ধারণা এই সংঘর্ষে পশ্চিমাদের স্বার্থ রয়েছে। রাশিয়ার প্রভাবে থাকা অঞ্চলে সমস্যা তৈরি হলে তা রাশিয়ার জন্যে চিন্তার। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এখানে না জড়ালেও মধ্য এশিয়াতে রাশিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নেয়াটা একটা কৌশল।

সোভিয়েতদের তৈরি করা মধ্য এশিয়ার কৃত্রিম সীমানাগুলিকে এখন বাইরের শক্তিরা ব্যবহার করছে। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ পানি উৎস ছোট্ট দেশ কিরগিজস্তানের হাতে থাকায় এবং মধ্য এশিয়ার সাথে চীনের পশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত উইঘুর প্রদেশের যোগাযোগের মূল পথ কিরগিজস্তানের মাঝ দিয়ে বা এর পাশ দিয়ে যাওয়ায় অত্র অঞ্চলে সকলেরই আগ্রহ বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কসহ অন্যান্য শক্তিদেরকে রুশ প্রভাব প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা দেবে। তাজিকিস্তানের সাথে সংঘর্ষে কিরগিজস্তানের তুর্কি ড্রোনের সাফল্য এই অঞ্চলের দ্বন্দ্বকে শান্তিপূর্ণ পথ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। একইসাথে কিরগিজস্তানের জন্যে তুর্কি সহায়তাকে ব্যালান্স করতে তাজিকিস্তান ইরানের মুখাপেক্ষি হতে পারে; যা কিনা মধ্য এশিয়াতে তুরস্কের সাথে ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আরও বৃদ্ধি করবে।

No comments:

Post a Comment