Saturday 27 February 2021

ভারতের দূরপ্রাচ্যে গমন ... বৃদ্ধি পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা

২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২১


 ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা মস্কো ঘুরে এলেন। সফরে শ্রিংলা রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ২০২০ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক বাতিল হয়ে যাওয়ায় শ্রিংলার সফরের গুরুত্ব ছিল বেশি। সফরকালীন আলোচনার বিষয়বস্তুর মাঝে রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সাথে ভারতের কৌশলগত যোগাযোগ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন মিডিয়াতে হাইলাইট করা হয়। ভারতীয় অর্থনৈতিক মিডিয়া ‘মিন্ট’ বলছে যে, এই সফরের একটা মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘চেন্নাই ভ্লাডিভস্টক ম্যারিটাইম করিডোর’এর চিন্তাটাকে আরও এগিয়ে নেবার মাধ্যমে দু’দেশের মাঝে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা; যা বর্তমানে ১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলারের মাঝে রয়েছে। রুশ পত্রিকা ‘কমারস্যান্ট’এর সাথে এক সাক্ষাতে শ্রিংলা বলেন যে, এই ম্যারিটাইম করিডোরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরকে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরই নয়, রাশিয়ার উত্তরের ‘নর্দার্ন সি রুট’এর সাথে যুক্ত করা যাবে। শ্রিংলা মনে করিয়ে দেন যে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদি ভ্লাডিভস্টকে পুতিনের সাথে আলোচনার সময় রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের বন্দর ভ্লাডিভস্টককে ইউরেশিয়ার সাথে ইন্দোপ্যাসিফিকের যোগসূত্র বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যকে নিয়ে ভারতের এই পরিকল্পনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে কতটুকু?

ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ভিভেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অজয় কুমার চতুর্বেদি বলেন যে, ‘চেন্নাই ভ্লাডিভস্টক ম্যারিটাইম করিডোর’কে এগিয়ে নেবার মাধ্যমে ভারত চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’কে চ্যালেঞ্জ করবে। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সাখালিন দ্বীপে এবং ভিয়েতনামের উপকূলে তেল গ্যাস প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারত এই কর্মকান্ডকে এগিয়ে নিচ্ছে। সাখালিনের প্রকল্পে বিনিয়োগের সময় ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলে যে, রাশিয়ার তেল গ্যাস নিয়ে ভারত এবং চীন প্রতিযোগিতা করছে।

‘সাখালিন ১’ প্রকল্পে ভারত যেমন নতুন নয়, তেমনি ভারত একাও এখানে তেমন শক্তিশালী কোন বিনিয়োগকারী নয়। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার এক খবরে বলা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা হলো মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’। ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ নিয়ে তারাই মূলত এই প্রকল্পের অপারেটর। জাপানের ‘সোডেকো’র হাতে রয়েছে ৩০ শতাংশ মালিকানা; ভারতের ‘ওএনজিসি’র হাতে রয়েছে ২০ শতাংশ মালিকানা; আর রাশিয়ার ‘রজনেফত’এর হাতে রয়েছে বাকি ২০ শতাংশ। ২০০১ সালে ‘ওএনজিসি’ ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে এই প্রকল্পের ২০ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়। ২০১৭ সালে নতুন করে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ২০৫১ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।

প্রকল্পের ওয়েবসাইট বলছে যে, ১৯৯৬ সালে এখানে তেল গ্যাসের জন্যে ড্রিলিং শুরু হয় এবং ২০০১ সালে তেল গ্যাস আহরণ শুরু হয়। ২০০৪ সালে সাখালিন দ্বীপের খনির সাথে ২’শ ৩০ কিঃমিঃ পাইপলাইন যুক্ত করে ‘দে কাস্ত্রি’ নামের টার্মিনালের সাথে যুক্ত করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তেলের জাহাজ ভর্তি করা শুরু হয়। দৈনিক আড়াই লক্ষ ব্যারেল উৎপাদন সক্ষমতার এই প্রকল্প থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩’শ ৮০টা জাহাজ ভর্তি করে তেল রপ্তানি করা হয়েছে। টার্মিনালে সাড়ে ৬ লক্ষ ব্যারেল তেল ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মোট ৫টা তেলের জাহাজ এই প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা হয়; যেগুলির একেকটার ধারণক্ষমতা ১ লক্ষ টন, এবং এগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে শীতকালে যখন সমুদ্র বরফাচ্ছাদিত থাকবে, তখনও যেন তেল রপ্তানি করা যায়। এছাড়াও শীতকালে অপারেশন চালাবার জন্যে দু’টা আইসব্রেকার জাহাজও রাখা হয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে। এভাবে সারা বছর তেলের সরবরাহ নিশ্চিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

‘সাখালিন ১’ এখানে একমাত্র তেল গ্যাস প্রকল্প নয়। এর পাশেই ‘সাখালিন ২’ প্রকল্প হলো ব্রিটিশ কোম্পানি ‘শেল’এর তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজি প্রকল্প। কোম্পানির ওয়েবসাইট বলছে যে, ‘শেল’এর বিনিয়োগ এখানে সাড়ে ২৭ শতাংশ; রাশিয়ার ‘গ্যাজপ্রম’এর বিনিয়োগ ৫০ শতাংশ; জাপানের ‘মিতসুই’ সাড়ে ১২ শতাংশ; এবং ‘মিতসুবিশি’ ১০ শতাংশ। প্রায় ১ কোটি ১৫ লক্ষ টনের বাৎসরিক সক্ষমতার এই প্রকল্পের গ্যাস রপ্তানি শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। মূলতঃ জাপান, কোরিয়া এবং চীন হলো এই প্রকল্পের গ্যাসের সবচাইতে বড় ক্রেতা। বিশ্বের মোট এলএনজি রপ্তানির ৪ শতাংশ এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসে। এটা পরিষ্কার যে, সাখালিনের দু’টা প্রকল্পের মূল বিনিয়োগকারী হলো মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’ এবং ব্রিটিশ কোম্পানি ‘শেল’। রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের বরফাচ্ছাদিত এই এলাকায় পশ্চিমা বিনিয়োগের ব্যাপারে কথা হয়েছে খুব কমই। চীনের সীমানার বেশ কাছাকাছি হওয়ায় পশ্চিমাদের জন্যে এখানে প্রভাব ধরে রাখাটা রাশিয়ার সাথে শত্রুতার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘কার্নেগি মস্কো সেন্টার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে যত বিনিয়োগ হয়, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই নামে বা বেনামে চীনা বিনিয়োগ। দূরপ্রাচ্যের মার্কিন বন্ধু দেশ জাপান এবং কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা একদিকে যেমন চাইছে অত্র অঞ্চলে চীনা প্রভাব কমাতে; অন্যদিকে রাশিয়ার উপর মার্কিন অবরোধের কারণে এধরনের কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে চীনের সাথে মার্কিন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির কারণে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করাটা রাশিয়াকে চাপের মাঝে রাখার চাইতে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। রাশিয়াও চাইছে দূরপ্রাচ্যে চীন ছাড়াও অন্যরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসুক। ‘কার্নেগি’র প্রতিবেদনে কয়েকটা পক্ষের চিন্তার সমন্বয় লক্ষ্যনীয়। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে ভারতের বিনিয়োগকে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ভালো চোখে দেখছে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই চাইছে অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ভারত এই ভূরাজনৈতিক খেলায় একজন অংশগ্রহণকারী মাত্র। দূরপ্রাচ্যে নিজস্ব বিনিয়োগ করে পশ্চিমাদের সহায়তা ছাড়া সেটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা ভারতের কতটুকু রয়েছে, তা বিতর্কসাপেক্ষ। তেমনি ভারত মহাসাগরেই যেখানে চীনা প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় ‘কোয়াড’ জোটের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে ভারত, সেখানে দূরপ্রাচ্যে চীনা বিনিয়োগকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এজেন্ডা বাস্তবায়ন বাস্তবতার সাথে যায় না; বরং এহেন প্রকল্পে অংশ নেবার মাধ্যমে নিজেদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর ভারতের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

Tuesday 23 February 2021

মার্কিন সোশাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর যুদ্ধ ঘোষণার উদ্দেশ্য কি?

২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০২১ 

 



গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ‘ফেইসবুক’ অস্ট্রেলিয়ার ব্যবহারকারীদের জন্যে সংবাদ মিডিয়ার কনটেন্ট দেখা বা শেয়ার করার সক্ষমতা বন্ধ করে দেয়। কয়েক মাস ধরে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ‘ফেইসবুক’এর যে টানাপোড়েন চলছিল, তার ফলাফল ছিল এটা। অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতারা আলোচনা করছেন যে, সংবাদ মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়ার মাঝে সম্পর্ককে নতুন করে কিভাবে ব্যালান্স করা যায়। প্রস্তাবিত নতুন আইনের অধীনে ‘ফেইসবুক’ এবং ‘গুগল’এ সার্চ রেজাল্টে বা নিউজ ফিডে সংবাদ কনটেন্ট দেখালে সংবাদ মাধ্যমকে অর্থ দেবে সোশাল মিডিয়া কোম্পানি। ২৩শে ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার ট্রেজারার বা অর্থমন্ত্রী জশ ফ্রাইডেনবার্গ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, তিনি মার্ক জুকারবার্গের সাথে কথা বলেছেন এবং জুকারবার্গ তাকে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, সামনের দিনগুলিতে অস্ট্রেলিয়ার ব্যবহারকারীদের উপর থেকে ফেইসবুকের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে; কারণ ‘ফেইসবুক’ আবারও অস্ট্রেলিয়াকে বন্ধু হিসেবে নিচ্ছে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতারা মনে করছেন যে, ডিজিটাল যুগে আয়ের বন্টনে সমতা আসা প্রয়োজন। কারণ সোশাল মিডিয়ার আবির্ভাবের পর থেকে সংবাদ মাধ্যমগুলির আয়ে ভাটা পড়েছে। ‘ফেইসবুক’ বলছে যে, মিডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে তারা আর্থিকভাবে খুব বেশি লাভবান না হওয়ায় কোম্পানিগুলির সাথে চুক্তি করতে চাইছে না তারা। ‘ফেইসবুক’এর মাত্র ৪ শতাংশ পোস্ট মিডিয়া থেকে আসা। ‘ফেইসবুক অস্ট্রেলিয়া’র প্রধান নির্বাহী উইলিয়াম ইসটন বলছেন যে, বিগত বছরে ‘ফেইসবুক’ অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া কোম্পানিগুলিকে ৫ বিলিয়ন ‘ক্লিক’ যোগাড় করে দিয়েছে; যা দিয়ে মিডিয়া কোম্পানিগুলির পোস্ট বহু মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। সেই হিসেবে ‘ফেইসবুক’এরই মিডিয়া কোম্পানিগুলির কাছ থেকে ৪’শ ৭ মিলিয়ন ডলার পাওয়া উচিৎ। বর্তমানে মার্কিন এবং ব্রিটিশ ব্যবহারকারীদের জন্যে ‘ফেইসবুক’ ‘নিউজ ট্যাব’ তৈরি করেছে; যার মাধ্যমে মিডিয়া কোম্পানিগুলির খবর শেয়ার করছে ‘ফেইসবুক’ এবং বিনিময়ে মিডিয়া কোম্পানিগুলি অর্থ পাচ্ছে।

সার্চ ইঞ্জিন কোম্পানি ‘গুগল’ ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার সাথে সম্পর্ক কর্তনের চিন্তা করার পর আবারও ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখাচ্ছে। তবে গত কয়েকদিনের মাঝেই ‘গুগল’ অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটা মিডিয়া কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে। সার্চ ইঞ্জিনে মিডিয়া কোম্পানিগুলির কনটেন্ট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মিডিয়া এসোসিয়েশন ‘নিউজ মিডিয়া এলায়েন্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৮ সালে নিউজ মিডিয়ার কারণে ‘গুগুল’ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। ‘গুগল’এর ব্যবহারকারীদের তথ্য ব্যবহার করে ‘গুগল’ যে আরও আয় করে, তা এই হিসেবে ধরা হয়নি। অথচ পুরো যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ মিডিয়া একত্রে সেবছর আয় করেছে মাত্র ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। ‘নিউজ মিডিয়া এলায়েন্স’এর প্রেসিডেন্ট ডেভিড চ্যাভার্ন বলছেন যে, তথ্য চায় বিনা খরচায় পাঠকের কাছে পৌঁছাতে; কিন্তু সাংবাদিকদের তো এই কাজের বিনিময়ে অর্থ দরকার। যদি মিডিয়া কোম্পানিগুলি সাংবাদিকতার উন্নয়নে কাজ করে আর সোশাল মিডিয়া এর বিনিময়ে কোন অর্থ দিতে না চায়, তাহলে মিডিয়ার কাজ কঠিন হয়ে যায়। ‘গুগল’ বলছে যে, এই প্রতিবেদনে সঠিক তথ্য ফুটে ওঠেনি। ‘গুগল’ প্রতিমাসে মিডিয়া কোম্পানিগুলিকে ১০ বিলিয়ন ‘ক্লিক’ দিচ্ছে। এই ‘ক্লিক’ ব্যবহার করে মিডিয়া কোম্পানিগুলি পাঠক পাচ্ছে এবং বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। ‘কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর বিল গ্রুসকিন ‘দ্যা গার্ডিয়ান’কে বলেন যে, এই গবেষণার ভিত বেশ দুর্বল। তিনি বলছেন যে, সোশাল মিডিয়াকে আরও নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। তবে মিডিয়া গ্রুপগুলিরও উচিৎ আরও শক্ত তথ্যের উপর তাদের প্রতিবেদনকে দাঁড় করানো।

‘ফেইসবুক’ অস্ট্রেলিয় মিডিয়াকে আটকাতে গিয়ে তাদের ডোমেইন বন্ধ করেনি; বরং ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এআই’এর মাধ্যমে মিডিয়া কনটেন্ট বন্ধ করতে চেয়েছে। এখানেই হয়ে গেছে বিপত্তি। ‘ফেইসবুক’এর ‘এআই’ নিউজ মনে করে অস্ট্রেলিয়ার সরকারি কিছু পেইজ বন্ধ করে দেয়। এর মাঝে ছিল অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য দপ্তর এবং জরুরি সেবাদানকারী সংস্থার ফেইসবুক পেইজ। অনেকেই কোম্পানির এহেন সিদ্ধান্তকে ‘অগণতান্ত্রিক’ বা ‘একনায়কোচিত’ বলে আখ্যা দিয়েছে। কেউ কেউ এই দাবিও করতে শুরু করেছেন যে, মিডিয়াগুলি বন্ধ করে দেয়ায় মিথ্যা বানোয়াট খবরে ভরে যাচ্ছে ‘ফেইসবুক’। তবে উল্টোদিকে কেউ কেউ বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তাবিত আইনের পিছনে মিডিয়া টাইকুন রুপার্ট মারডকের হাত রয়েছে। মারডকের ‘নিউজ কর্প’ অস্ট্রেলিয়ার প্রধান পত্রিকাগুলির অনেকগুলিরই মালিক। অস্ট্রেলিয়ার বৃহৎ মিডিয়া কোম্পানি ‘নাইন এন্টারটেইনমেন্ট’ বলছে যে, অস্ট্রেলিয়ার সরকার ও ‘ফেইসবুক’এর আলোচনার খবরে তারা খুশি হয়েছে। তারা আশা করছে যে, অচিরেই এই আলোচনা নতুন একটা বাণিজ্যিক চুক্তির দিকে এগুবে। তবে এই পুরো ব্যাপারটা ‘ফেইসবুক’এর দুর্নামের কারণ হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন যে, ‘ফেইসবুক’ গায়ের জোরে নিজের স্বার্থকে ধরে রাখতে চাইছে। আর অস্ট্রেলিয়ার সাথে সমমনা দেশগুলি ব্যাপারটাকে খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে, এবং তাদের দেশেও একই ধরনের আইন তৈরি করার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াকে উদাহরণ হিসেবে দেখছে।

গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, ‘ফেইসবুক’এর সাথে অস্ট্রেলিয়া সরকারের দ্বন্দ্বকে যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটা বেসরকারি কোম্পানির সাথে অস্ট্রেলিয় সরকারের ব্যবসায়িক লেনদেন হিসেবে দেখছে। এই ব্যবসায়িক লেনদেনের মাঝে যারা যুক্ত রয়েছে, তারাই যেকোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। প্রাইসের কথায় পরিষ্কার যে, মার্কিন সরকার এই দ্বন্দ্বে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে দাঁড়াতে চাইছে না। ‘ফেইসবুক’ এবং ‘গুগল’এর মালিক ‘এলফাবেট’ উভয়েই মার্কিন কোম্পানি। ২০২০ সালে ‘এলফাবেট’ আয় করে প্রায় ১’শ ৮২ বিলিয়ন ডলার। আর ‘ফেইসবুক’ আয় করে ৮৬ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্লোবাল ফিনান্স ম্যাগাজিন’এর হিসেবে ২০২০ সালের শেষে ‘এলফাবেট’এর বাজারমূল্য ছিল ১১’শ ১৬ বিলিয়ন ডলার; আর ‘ফেইসবুক’এর বাজারমূল্য ছিল ৭’শ ৯৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সবচাইতে দামি কোম্পানিগুলির মাঝে ‘এলফাবেট’ ৫ম; আর ‘ফেইসবুক’ ৭ম। সবচাইতে দামি ১০টা কোম্পানির মাঝে ৬টাই মার্কিন; যার মাঝে ‘এপল’, ‘আমাজন’ এবং ‘মাইক্রোসফট’ও রয়েছে।

অপরদিকে ব্রিটেন সরাসরি অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে কথা বলেছে এবং সোশাল মিডিয়াকে একটা শৃংখলার মাঝে আনার প্রচেষ্টার আভাস দিয়েছে। ১৯শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি ‘রয়টার্স’কে বলেন যে, ব্রিটেন অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার সাথে ‘ফেইসবুক’এর সমস্যার সমাধান চায়। তবে শেষ পর্যন্ত এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, একটা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের মাঝে যেন একটা ব্যালান্স থাকে। ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ বলছে যে, আরও কিছু দেশ অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করতে যাচ্ছে। ব্রিটিশ কমনওয়েলথের আরেক সদস্যরাষ্ট্র কানাডা অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করতে চাইছে। কানাডার মন্ত্রী স্টিফেন গাইলবল্ট বলেন যে, ‘ফেইসবুক’ যা করেছে তা একেবারেই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’। কানাডা এই যুদ্ধের সন্মুখে রয়েছে; এবং ভীত হবে না। ‘ফেইসবুক’ এবং ‘গুগল’কে আয় শেয়ার করতে বাধ্য করতে কিছুদিন আগেই গাইলবল্ট অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ফিনল্যান্ডের মন্ত্রীদের সাথে বসে একটা কোয়ালিশন তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি আশা করছেন যে, ১৫টা দেশ এই কোয়ালিশনে যুক্ত হতে পারে। তিনি প্রশ্ন করেন যে, ‘ফেইসবুক’ কি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি এবং অন্যান্য সকল রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে? ক্লেভারলি এবং গাইলবল্টের কথাগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, ব্রিটিশ কমনওয়েলথের দেশগুলি ‘ফেইসবুক’ এবং ‘গুগল’এর বিরুদ্ধে একটা আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন তৈরি করতে চাইছে; যার মূলে থাকবে নতুন কিছু আইন। আন্তর্জাতিক আইনকে নিজের প্রভাব বৃদ্ধিতে ব্যবহার করতে চাইছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’। এক্ষেত্রে ইউরোপিয় পুঁজিবাদের পুরোনো স্তম্ভ সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করে আইনগত নেতৃত্ব নেয়ার মাধ্যমে মূলতঃ মার্কিন নেতৃত্বে থাকা সোশাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে বাকি দুনিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে তাদের সাথে চাইছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কোন সুযোগই হাতছাড়া করতে চাইছে না; বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে, যার মাধ্যমে ব্রিটেন একসময় দুনিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছে।

Saturday 20 February 2021

ফ্রান্স কি উগ্রপন্থী সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে?

২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২১


 
ফ্রান্সের পার্লামেন্টে নতুন একটা আইন পাস করা নিয়ে আলোচনার সূচনা হয়েছে। গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৩’শ ৪৭ ভোট বনাম ১’শ ৫১ ভোটে ‘প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিগুলির উপর সন্মানের সমর্থনে’ এই নতুন বিল পাস হয়। ৬৫ জন ভোট দানে বিরত থাকে। এই আইনের মাধ্যমে ফ্রান্সের মসজিদ, স্কুল এবং স্পোর্টস ক্লাবগুলির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হবে। এটা প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পের অংশ, যার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে উগ্রবাদী ইসলাম থেকে ফ্রান্সকে এবং ফ্রান্সের সেকুলার আদর্শকে রক্ষা করা। বার্তা সংস্থা ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, নিম্নকক্ষের পর এই বিল উচ্চকক্ষে যাবে ৩০শে মার্চ; যেখানে এই বিল প্রায় নিশ্চিতভাবেই পাস হবে। তবে ফ্রান্সের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর এই আইন ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে বলে মনে করছেন অনেকেই। একইসাথে ইসলামের প্রতি ফরাসিদের উগ্রপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিরও বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এতে।

এই আইনের বিপক্ষে থাকা রাজনীতিবিদেরা বলছেন যে, আইনে যা প্রস্তাব করা হয়েছে, তা মূলতঃ অন্যান্য আইনে ইতোমধ্যেই রয়েছে। এখানে অন্য কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতে পারে। বিল উত্থাপন করা ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন পার্লামেন্টে ভোটাভুটির কিছুদিন আগেই বিরোধী দলীয় উগ্র ডানপন্থী নেতা মারিন লা পেনএর দিকে আঙ্গুল তাক করে বলেন যে, লা পেন উগ্রবাদী ইসলামের প্রতি বেশ ‘নরম’ অবস্থান নিয়েছেন। তার ‘ভিটামিন দরকার’। এই মন্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে, ম্যাক্রঁর সরকার উগ্রবাদী ইসলামের ব্যাপারে উগ্র ডানপন্থীদের চাইতে বেশি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ২০২২ সালের নির্বাচনের আগে ডানপন্থী ভোটারদেরকে ম্যাক্রঁর দিকে টেনে আনা এর লক্ষ্য হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। অপরদিকে মারিন লা পেন নতুন আইনকে দুর্বল বলছেন। ‘বিএফএম’ টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লা পেনের উগ্র ডানপন্থী ‘ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট জরডান বারডেলা বলছেন যে, নতুন আইন ‘টার্গেট মিস’ করেছে; কারণ এটা উগ্রবাদী ইসলামী আদর্শকে সরাসরি আক্রমণ করেনি। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, নতুন বিলে মুসলিম বা ইসলামের নাম উচ্চারিত হয়নি। সমর্থকেরা বলছেন যে, এই বিলে ফ্রান্সের সেকুলার আদর্শ এবং লিঙ্গ সমতাকেই রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ম্যাক্রঁ এই বিলকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আইন বলছেন; কারণ উগ্রবাদীদেরকে তিনি ফ্রান্সের সমাজের বিরোধিতাকারী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।

নতুন আইনে তিন বছর বয়স থেকে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে সেকুলার আদর্শ শেখাতে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে; যাতে করে শিশুর পরিবার নিজ বাড়িতে আলাদা করে কোন আদর্শিক শিক্ষা দিতে না পারে। বাড়িতে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এতে বাড়িতে শিক্ষা নেয়া ৬২ হাজার শিশুর শিক্ষা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকারি অর্থে চলা মসজিদ এবং মসজিদের ব্যবস্থাপনায় থাকা বিভিন্ন এসোসিয়েশনকে সেকুলারিজম মেনে চলার জন্যে ফরাসি সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। নিয়মের বাইরে গেলে সরকারি অর্থ ফেরত দিতে হবে। আর দেশের বাইরে থেকে অর্থায়ন হলেও ১২ হাজার ডলারের বেশি অর্থ পেলে সরকারকে জানাতে হবে; এবং বছরওয়ারি খরচের হিসেব দিতে হবে সরকারকে। পুলিশ অফিসার এবং কারাগারের কর্মচারীদের ফ্রান্সের সেকুলার সংবিধান এবং আদর্শের প্রতি নতুন করে আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নিতে হবে। সরকারি অফিসে কাজ করা বা সরকারের জন্যে কাজ করা কোন ব্যক্তি তার বিশ্বাস বোঝা যায়, এমন কোন কাপড় পরতে পারবে না। এর মাধ্যমে মূলতঃ মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরাকেই বারন করা হয়েছে। একইসাথে সকল সরকারি কর্মচারীদেরকেও সেকুলারিজমের প্রশিক্ষণ দেবার কথা বলা হয়েছে। যেসকল খেলাধূলার এসোসিয়েশনকে উগ্রপন্থী বলে মনে হবে, সেগুলিকেও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আনা হবে। কোন ডাক্তার যদি কোন নারীর কুমারিত্বের সার্টিফিকেট দেয়, তবে তাকে ১৮ হাজার ডলার জরিমানা এবং ১ বছরের কারাদন্ড দেয়া হবে। কোন ব্যক্তির একসাথে দুই স্ত্রী থাকবে পারবে না; যদি কোন অভিবাসী এটা করে, তবে তাকে থাকার অনুমতি দেয়া হবে না। কোন বিবাহকে যদি জোরপূর্বক বলে মনে হয়, তাহলে আইনশৃংখলা বাহিনীকে অবহিত করা যাবে। নতুন এই আইনকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ১৯০৫ সালের সেকুলারিজম আইনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে; যার মাধ্যমে চার্চ এবং রাষ্ট্রকে আলাদা করা হয়েছিল।

বিল পাস হবার আগেই শ’দেড়েক মানুষ প্যারিসের রাস্তায় বিলের বিপক্ষে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে গত অক্টোবরে নিহত হওয়া ফরাসি শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির এলাকার বাসিন্দা জেইনেব বুয়াবিবি বলছেন যে, এক ব্যাক্তির কর্মকান্ডের জন্যে পুরো মুসলিম সমাজকে আক্রমণ করাটা একেবারেই অনুচিত। তিনি বলছেন যে, মুসলিম নাম হবার কারণে ইউনিভার্সিটিতে এবং কর্মক্ষেত্রে তাকে বিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে। অনেকেই তাকে বলেছেন যে, ‘তুমি তোমার দেশে ফেরত যাও’; যদিও বুয়াবিবির জন্ম ফ্রান্সে। আর এরকম আইন পাস হলে মুসলিমবিদ্বষ আরও বেড়ে যেতে পারে। গত ১০ই ফেব্রুয়ারি এই বিলের বিপক্ষে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ১’শ জন ইমাম, ৫০ জন মুসলিম শিক্ষক এবং ৫০ জন এসোসিয়েশন প্রেসিডেন্ট।

ফ্রান্সে কত মুসলিম রয়েছে, তার সঠিক হিসেব কেউ দিতে না পারলেও তা ৩০ থেকে ৬৫ লক্ষের মাঝে হতে পারে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ফ্রান্সের সেকুলার আইনে জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। ফরাসি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটুট মনটেইন’এর করা এক জনমত জরিপে বলা হচ্ছে যে, ফ্রান্সের মুসলিমদের ২৯ শতাংশ ইসলামের শরীয়া আইনকে ফরাসি রিপাবলিকের আইনের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ৬৫ শতাংশ মুসলিম হিজাব পরার পক্ষে। উল্টোদিকে ‘লে মন্ড’ পত্রিকার জন্যে করা এক জরিপে বলা হচ্ছে যে, ৬০ শতাংশ ফরাসি মনে করে যে, ফ্রান্সের সেকুলার আদর্শের সাথে ইসলাম সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এমতাবস্থায় ফ্রান্সের নতুন আইন নিশ্চিতভাবেই মুসলিমদের বিশ্বাসগত বাধ্যবাধকতার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে, যা কিনা পশ্চিমা সেকুলার আদর্শের স্তম্ভ ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী। অপরপক্ষে ম্যাক্রঁর সরকার যখন নির্বাচনে জিততে উগ্র ডানপন্থীদের দলে টানার চেষ্টা করছেন, তখন গণতান্ত্রিকভাবেই এক উগ্রপন্থী সেকুলার রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে ফ্রান্স।

Thursday 18 February 2021

ডলার ছাপিয়ে চলছে যুক্তরাষ্ট্র ..... কিন্তু এভাবে কতদিন?

১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২১

মার্কিন সরকারের নিজের ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ নেয়া এবং শূণ্য থেকে ডলার তৈরি করে ঘাটতি পূরণ করার এহেন কাহিনী গায়ের জোরে এক মুদ্রাব্যবস্থাকে ধরে রাখাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ এই ব্যবস্থাকে সমর্থনও করে যাচ্ছেন এই ভেবে যে, এটা কখনোই ভেঙ্গে পড়বে না। কিন্তু করোনা মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের গায়ের জোর কেন, কোনকিছুই আসলে স্থায়ী নয়। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ডলারের স্থায়িত্ব কতদিন, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ডলারের উপর বিশ্ব অর্থনীতির নির্ভরশীলতা কতদিন যুক্তরাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখবে, সেব্যাপারে আলোচনা হতে পারে।


নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন করোনাভাইরাসের মহামারি এবং এর ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট মহামন্দা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বাঁচাতে ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৯’শ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ প্রস্তাব করেছেন। এর মাঝে ১ ট্রিলিয়ন বা ১ হাজার বিলিয়ন ডলার নগদ অর্থ সহায়তা হিসেবে খেটে খাওয়া মানুষকে দেয়া হবে। ৪’শ বিলিয়ন খরচ করা হবে ভ্যাকসিন এবং মেডিক্যাল ব্যবস্থার উন্নয়নের পিছনে। আরও ৪’শ ৪০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য এবং ছোট ব্যবসাগুলিকে, যারা পুঁজি বাজার থেকে ঋণ পাবে না। ‘কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস’ বা ‘সিবিও’এর হিসেবে এই প্রণোদনা প্যাকেজ ২০২১ সালের পুরো মার্কিন জিডিপির প্রায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে সমস্যা সেখানে নয়, ‘সিবিও’ হিসেব করে বলছে যে, ২০২১ সালে সরকারের পুরো রাজস্ব হবে খুব বেশি হলে সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন বা ৩৫’শ বিলিয়ন ডলার হবে। অর্থাৎ ১৯’শ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ মার্কিন সরকারের বাৎসরিক রাজস্বের ৫৪ শতাংশ। অথচ এই ‘রেসকিউ প্যাকেজ’ আসলে করোনাভাইরাসের কারণে বেড়ে যাওয়া খরচের উপরে যোগ হওয়া খরচ। ২০২১ সালে সরকারের বাজেট ঘাটতি হবে ২৩’শ বিলিয়ন ডলার; যা জিডিপির ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। আর রাষ্ট্রীয় ঋণ দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১’শ শতাংশ বা জিডিপির সমান। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ।

‘সিএনএন’এর এক লেখায় ‘কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর জেফরি সাক্স বলছেন যে, বাইডেন তার করোনা প্রণোদনার ব্যাপারে বেশ শক্ত যুক্তি রেখেছেন; এবং একইসাথে দীর্ঘমেয়াদী উত্তোরণের পিছনেও কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই অর্থ আসবে কোত্থেকে? বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামো উন্নয়নে আরও ২ ট্রিলিয়ন বা ২ হাজার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সাক্স বলছেন যে, তিন পদ্ধতিতে এই কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। প্রথমতঃ মার্কিন সরকার আরও ঋণ করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ বা ‘ফেড’ আরও ডলার ছাপাতে পারে। আর তৃতীয়তঃ সরকার ট্যাক্স বাড়াতে পারে। সরকার ঋণ করতেই পারে। কিন্তু যখন রাষ্ট্রীয় ঋণ জিডিপির সমান, তখন ঋণ করার সীমা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। আর ‘ফেড’ ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে জানুয়ারি ২০২১ সালের মাঝে প্রায় ১৮’শ বিলিয়ন ডলার ছাপিয়েছে! বর্তমানে বাজারে থাকা মোট ডলার হলো ৫ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন বা ৫২’শ বিলিয়ন। অর্থাৎ ২০২০ সালের এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র বাজারের মোট ডলারের ৩৪ শতাংশ ছাপিয়েছে! ২০০৮ সালে ‘ফেড’এর মোট ছাপানো ডলারের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮’শ ৪৭ বিলিয়ন ডলার। সাক্স বলছেন যে, ঋণ করার যেমন সীমা রয়েছে, তেমনি ডলার ছাপানোরও সীমা রয়েছে। কারণ ডলার বেশি ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি হবে। তিনি বলছেন যে, ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বেড়েছে, যা কিনা সামনের দিনগুলিতে আরও বেশি মুদ্রাস্ফীতির দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এটা নিশ্চিত যে, ঋণ করে আর ডলার ছাপিয়ে সরকারের বাজেট ঘাটতি দূর করা যাবে না। তাই জনগণের উপর করের বোঝাও বাড়াতে হবে।

জেফরি সাক্সের কথার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের মূল্যের দিকে তাকালে। ‘গোল্ড হাব’এর হিসেবে, ২০২০এর অগাস্টে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্য আউন্স প্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ডলার পেরিয়ে যায়। ২০১৯এর ডিসেম্বরে তা ছিল প্রায় ১৪’শ ৭৯ ডলার। অর্থাৎ ২০২০ সালের আট মাসে স্বর্ণের মূল্য ৩৭ শতাংশ বেড়ে যায়! তবে এরপর কিছুটা কমে এসে স্বর্ণের মূল্য ২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১৭’শ ৮০ ডলার হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্যও বেড়েছে। ‘ট্রেডিং ইকনমিকস’এর হিসেবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গমের মূল্য যেখানে ছিল সর্বোচ্চ ৫’শ ৮০ ডলার, সেখানে ২০২১এর জানুয়ারিতে তা ৬’শ ৭৮ ডলারে উঠে যায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে গমের মূল্য বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গমের মূল্য ৬’শ ৪৮ ডলারের কাছাকাছি রয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা সর্বোচ্চ ৫’শ ৬৩ ডলার ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসেও মূল্য ১৫ শতাংশ বেশি রয়েছে।

 
২০২০এর অগাস্টে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্য আউন্স প্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ডলার পেরিয়ে যায়। স্বর্ণের মূল্য বহুবার কমেছে বা বেড়েছে। আসলে স্বর্ণ আগের জায়গাতেই আছে; ডলারের মূল্য কমেছে বা বেড়েছে। ‘ফেড’ যখন ইচ্ছে ডলার ছাপিয়ে বা বাজার থেকে ডলার কিনে বাজারে ডলারের মূল্য ঠিক রাখার চেষ্টা করেছে।

‘ইউএসএ টুডে’র এক প্রতিবেদনে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেড’এর ডলার ছাপানোকে ‘জাদু’র সাথে তুলনা করা হয়। যখনই ডলারের দরকার পরবে, তখনই ‘ফেড’ কম্পিউটারের কিছু বাটন চাপ দিয়ে একেবারে শূণ্য থেকে ডলার তৈরি করে নেয়। ইলেকট্রনিক ডিপোজিটের মতো ‘ফেড’ ‘ভার্চুয়াল প্রিন্টিং’এর মাধ্যমে ডলার তৈরি করে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ‘অক্সফোর্ড ইকনমিক্স’ বলছে যে, এটা করোনা মহামারি এবং এর ফলশ্রুতিতে মহামন্দা থেকে উত্তোরণের জন্যে একটা উপায়। নিউ ইয়র্কের ‘বার্ড কলেজ’এর অর্থনীতিবিদ পাভলিনা চেরনেভা বুঝিয়ে বলেন যে, একজন ব্যক্তি অর্থ দরকার হলে যেভাবে চেক লিখে একাউন্ট থেকে অর্থ তুলতে পারে, তেমনি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিও ‘ফেড’ থেকে ঋণ নিতে পারে। মার্কিন কংগ্রেস বিশাল রাষ্ট্রীয় ঋণের অনুমোদন দিচ্ছে; আর সেটা পূরণ করে দিচ্ছে ‘ফেড’। ‘ফেড’এর ডলার ছাপানোর এই পদ্ধতির সমালোচক প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেনশনিয়াল প্রার্থী রন পল ‘ইউএসএ টুডে’কে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মিথ্যা অর্থ দিয়ে কাজ করছে। এখানে মাপকাঠিটাও বানোয়াট; যা কিনা সত্যিকার অর্থেই অবিশ্বাস্য! ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের ক্রেডিট কার্ডের বিল একটা বাটন চেপেই দিয়ে দিয়ে পারছেন না; নিজেদের কষ্ট করে আয় করে সেখান থেকে দিতে হচ্ছে। অথচ মার্কিন সরকার একটা বাটন চেপেই তার ঋণ পরিশোধ করে ফেলতে পারছে; কারণ সরকারের নিজস্ব ব্যাংক ডলার ছাপাচ্ছে!

মার্কিন সরকার ঋণ নেবার জন্যে ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করে। সেটা কিনে নেয় বিনিয়োগকারীরা। এর বিনিময়ে তারা সরকার থেকে সুদ আয় করে। মার্কিন সরকারের ‘গভর্নমেন্টে একাউন্টাবিলিটি অফিস’ বা ‘জিএও’এর ২০১৯ সালের হিসেবে সরকারের ইস্যু করা মোট ট্রেজারি বন্ডের প্রায় ১৪ শতাংশ ‘ফেড’ কিনেছে; বাকিটা কিনেছে মার্কিন এবং অন্য দেশের বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে মার্কিন সরকারের ইস্যু করা বেশিরভাগ ট্রেজারি বন্ড কিনেছে মার্কিন সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’। অর্থাৎ মার্কিন সরকারের একটা প্রতিষ্ঠান আরেকটা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিচ্ছে! আর সেই ঋণের অর্থ এসেছে শূণ্য থেকে! রন পল বলছেন যে, এভাবে ডলার ছাপানোর অর্থ হলো অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে বেলুনের মতো হয়ে যাবে। বাজারে পণ্য যা রয়েছে, তার চাইতে ডলার বেশি হয়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে মুদ্রাস্ফীতি হবে। এক ডলারে আগে যত পণ্য কেনা যেত, এখন তার চাইতে অনেক কম কেনা যাবে। রন পলের উল্টো কথা বলছেন ‘মডার্ন মনেটারি থিওরি’র অনুসারীরা। তারা বলছেন যে, বর্তমান ব্যবস্থায় ডলার ছাপিয়ে সরকার সর্বদাই তার ঋণগুলি শোধ করতে পারবে। কাজেই বাজেট ঘাটতি বা অনেক বেশি ঋণ কোন সমস্যা নয়। কিন্তু বিশ্বের সকল দেশ দরকার হলেই নিজের অর্থ নিজে ছাপিয়ে নিতে পারে না। আর বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং সুপারপাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ঋণ পেতে পারে, তা দুনিয়ার আর কেউ পেতে পারে না। সকলেই মার্কিন সরকারের ট্রেজারি বন্ড কিনতে চায়। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ঋণ প্রায় ২৭ ট্রিলিয়ন বা ২৭ হাজার বিলিয়ন ডলার! এই ঋণ যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ১’শ ২৭ শতাংশ! সরকারি ও বেসরকারি মিলে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ঋণ দেশটার জিডিপির ৩’শ ১৯ শতাংশ বা তিন গুণেরও বেশি! এই ঋণের বেশিরভাগটাই স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে আসেনি। যখনই দরকার হয়েছে, তখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ বা ‘ফেড’ শূণ্য থেকে ডলার তৈরি করে দিয়েছে! এই ডলারই ১৯৭১ সাল থেকে সারা বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে চলছে।


যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলছে ঋণের উপর। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০১৯ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি ঋণ ছিল জিডিপির প্রায় ১’শ ৯২ শতাংশ! মার্কিন ‘ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট’এর হিসেব বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ঋণ প্রায় ২৭ ট্রিলিয়ন বা ২৭ হাজার বিলিয়ন ডলার! ‘ফ্রেড ইকনমিক ডাটা’ বলছে যে, এই ঋণ যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ১’শ ২৭ শতাংশ! অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি মিলে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ঋণ দেশটার জিডিপির ৩’শ ১৯ শতাংশ বা তিন গুণেরও বেশি! এই ঋণের বেশিরভাগটাই স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে আসেনি। যখনই দরকার হয়েছে, তখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ বা ‘ফেড’ শূণ্য থেকে ডলার তৈরি করে দিয়েছে! এই ডলারই ১৯৭১ সাল থেকে সারা বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে চলছে। সেবছরের অগাস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ১৯৪৪ সালে করা ‘ব্রেটন উডস’ চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়। সেই চুক্তি মোতাবেক মার্কিন ডলারের মূল্য স্বর্ণের সাথে যুক্ত করা ছিল। স্বর্ণকে মুদ্রা ব্যবস্থার মাপকাঠি হিসেবে রাখাকে বলা হতো ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’। কিন্তু চুক্তি থেকে বের হয়ে যাবার পর মার্কিন ডলারের মূল্যের কোন হদিসই থাকলো না। বরং অন্যান্য মুদ্রার মূল্য নির্ধারিত হতে থাকলো মার্কিন ডলারের বিপরীতে। ডলারই হয়ে গেল বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থার মাপকাঠি। ‘ম্যাক্রোট্রেন্ডস’এর এক হিসেবে দেখানো হচ্ছে যে, ১৯৪৪ সালে এক আউন্স স্বর্ণ কিনতে লাগতো প্রায় ৫’শ ডলারের মতো। সেটা ২০২১ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ছিল ১৭’শ ৭২ ডলার ৮০ সেন্ট। এর মাঝে স্বর্ণের মূল্য বহুবার কমেছে বা বেড়েছে। আসলে স্বর্ণ আগের জায়গাতেই আছে; ডলারের মূল্য কমেছে বা বেড়েছে। ‘ফেড’ যখন ইচ্ছে ডলার ছাপিয়ে বা বাজার থেকে ডলার কিনে বাজারে ডলারের মূল্য ঠিক রাখার চেষ্টা করেছে। মার্কিন সরকারের নিজের ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ নেয়া এবং শূণ্য থেকে ডলার তৈরি করে ঘাটতি পূরণ করার এহেন কাহিনী গায়ের জোরে এক মুদ্রাব্যবস্থাকে ধরে রাখাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ এই ব্যবস্থাকে সমর্থনও করে যাচ্ছেন এই ভেবে যে, এটা কখনোই ভেঙ্গে পড়বে না। কিন্তু করোনা মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের গায়ের জোর কেন, কোনকিছুই আসলে স্থায়ী নয়। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ডলারের স্থায়িত্ব কতদিন, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ডলারের উপর বিশ্ব অর্থনীতির নির্ভরশীলতা কতদিন যুক্তরাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখবে, সেব্যাপারে আলোচনা হতে পারে।

Monday 15 February 2021

তুরস্ক কেন বাইডেন প্রশাসনকে ছাড় দিতে চাইছে?

১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

২০১৬ সাল। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তুরস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তুরস্ক কি সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবার আশাই করে যাবে? নাকি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কক্ষপথ থেকে বের হবার চেষ্টা করবে? পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে এবং বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বিস্তারে মনোনিবেশ করলেও এখনও যে তা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে বাইপাস করতে পারেনি, তা পরিষ্কার।

 গত ১০ই ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, রুশ নির্মিত ‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর যে অবরোধ দিয়েছে, তা উঠিয়ে নেয়া হবে না। এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে আহ্বান জানাচ্ছে যাতে তুরস্ক এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না রাখে। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই বার্তা আসলো তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের একদিন পরই, যেখানে তিনি ‘এস ৪০০’এর ব্যাপারে আলোচনায় বসার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। একইসাথে বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তুর্কি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলে যে, ‘এস ৪০০’ ইস্যুতে তুরস্ক ছাড় দেয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে এগুলিকে ব্যবহার করার মাধ্যমে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে। গত ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তুরস্কের প্রতিরক্ষা ক্রয় দপ্তরের উপর অবরোধ আরোপ করে। নতুন বাইডেন প্রশাসনের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক বেশ ঠান্ডাভাবেই শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বা পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন এখনও তুরস্কের নেতৃত্বের সাথে সরাসরি কথা বলেননি। তবে ফেব্রুয়ারির শুরুতেই মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান কথা বলেছেন তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনের সাথে। তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মূল দরকষাকষির জায়গাটা ‘এস ৪০০’এর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; এখানে কুর্দি প্রশ্নটাও জড়িত।

২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার কুর্দি সশস্ত্র গ্রুপ ‘ওয়াইপিজি’কে ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস’ বা ‘এসডিএফ’ নামে ডাকে। তুরস্ক বলছে যে, ‘ওয়াইপিজি’র মূল নেতৃত্ব হলো ‘পিকেকে’র হাতে; যাদের বিরুদ্ধে তুরস্ক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের আভিযোগ করে আসছে বহুদিন থেকেই। তুরস্কের দুশ্চিন্তা হলো, ‘ওয়াইপিজি’র জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন শেষ পর্যন্ত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটা আলাদা কুর্দি সায়ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবে। ৯ই ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ‘হুরিয়েত ডেইলি নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের সবচাইতে সংবেদনশীল দিক হলো ‘ওয়াইপিজি’র জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। ‘ওয়াইপিজি’ হলো ‘পিকেকে’র সিরিয় অংশ মাত্র। আইসিসের সাথে যুদ্ধ করার নিমিত্তে যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়াইপিজি’কে সমর্থন দিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র যে বলছে যে, ‘ওয়াইপিজি’র সাথে ‘পিকেকে’র কোন যোগাযোগ নেই, এটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন একটা কথা। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স ‘ওয়াইপিজি’ এবং ‘পিকেকে’র মাঝে যোগাযোগ সম্পর্কে অবগত নয়, এটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। হুলুসি আকার বলেন যে, তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে বারংবার বলেছে যে, আইসিসের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে তুরস্কের সাথে সহযোগিতা করতে; ‘ওয়াইপিজি’র সাথে নয়। তবে ‘এস ৪০০’এর ব্যাপারে ছাড় দেবার আভাস দিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন যে, ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র, যেগুলি একসময় সোভিয়েত ব্লকে ছিল, তারা এখনও রুশ অস্ত্র ব্যবহার করছে। এবং সেগুলি ন্যাটোর সিস্টেমের মাঝেই অপারেট করছে। গ্রিস রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনে সেগুলিকে ক্রিট দ্বীপে মোতায়েনের মাধ্যমে একটা সমাধানে পৌঁছেছে। তুরস্কও তেমনি একটা সমাধানে পৌঁছার জন্যে আলোচনা করতে রাজি আছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সর্বদাই অপারেশনাল রাখতে হবে। বরং হুমকি বিবেচনায় এগুলিকে অপারেশনাল করা হবে। এগুলি অপারেশনাল রাখার ব্যাপারে তুরস্কই সিদ্ধান্ত নেবে।

আঙ্কারার ‘ফরেন পলিসি ইন্সটিটিউট’এর প্রফেসর হুসেইন বাগচি ‘ডেইলি সাবাহ’র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, তুরস্কের রুশ ‘এস ৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র মূলতঃ ন্যাটোর সমস্যা; যা এতো সহজেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে তুরস্ককে কোনরূপ ছাড় দেয়ার দরকার মনে করছে না। তুরস্ক এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে প্রাধান্য নয়; প্রাধান্য এখন চীন, ইইউ, ন্যাটো এবং রাশিয়া। অপরদিকে তুরস্ক চাইছে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের দ্বন্দ্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো কুর্দি গ্রুপগুলি। কুর্দি গ্রুপ ‘ওয়াইপিজি’র সাথে তুরস্কের অভ্যন্তরের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত ‘পিকেকে’র সরাসরি যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়াইপিজি’কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তুরস্ক এব্যাপারে ছাড় না দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সমস্যা তৈরি করতে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সমস্যার আসলেই যেন কোন শেষ নেই। ৯ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন সিনেটররা একটা চিঠি দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। চিঠিটা লেখেন ডেমোক্র্যাট সিনেটর রন ওয়াইডেন এবং রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও। ৫৪ জন সিনেটর সেটাতে স্বাক্ষর করেন। চিঠিতে অভিযোগ করা হয় যে, তুরস্ক ক্রমেই একটা একনায়কোচিত নেতৃত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেখানে বিরোধীদেরকে চাপের মুখে রাখা হচ্ছে। এবং সেখানে গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে অথবা চুপ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই চিঠির জবাবে তুরস্কের পার্লামেন্টের ৮৭ জন সদস্য একটা বিবৃতি দেন। এরা সকলেই ‘টার্কি ইউএস পার্লামেন্টারি ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপ’এর সদস্য। তারা সমালোচনা করে বলেন যে, কৌশলগত সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা এটা আশা করেন না। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পারস্পরিক সন্মান প্রদর্শনের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দেন। একইসাথে তারা বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ৬ই জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেসে হামলাকারীদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিলেও ২০১৬ সালে তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত থাকা ফেতুল্লা গুলেনের অনুসারীদেরকে মানবাধিকার কর্মী বলে আখ্যা দিচ্ছে। সেই অভ্যুত্থান চেষ্টায় ২’শ ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। গুলেনের সমর্থকদের কথাগুলিকে তুলে ধরে মার্কিন সিনেটররা একাধারে যেমন দ্বিমুখী নীতি নিয়েছেন, তেমনি তা ২০১৬ সালের সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত না থাকার মার্কিন বিবৃতিগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

তুর্কি পার্লামেন্টের সদস্যরাও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখারই পক্ষপাতি। পার্লামেন্টের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের চিঠির সমালোচনা করেছেন সম্পর্কোন্নয়নের উদ্দেশ্যেই; শত্রু ভেবে নয়। তারা বলেছেন যে, ২০১৬ সালের অভ্যুত্থান চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল; তবুও তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু হিসেবেই দেখতে চাইছেন। তারা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাথে দ্বিমুখী আচরণ করছে; তবুও তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চাইছেন। তুরস্ক সরকার ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনকে ছাড় দিতে চাইছে; যদিও যুক্তরাষ্ট্র কুর্দি গ্রুপ ‘ওয়াইপিজি’কে সমর্থন দিয়ে আসছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পের সহযোগিতা হারাতে চাইছে না তুরস্ক। হুসেইন বাগচি বলছিলেন যে, তুরস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তুরস্ক কি সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবার আশাই করে যাবে? নাকি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কক্ষপথ থেকে বের হবার চেষ্টা করবে? পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে এবং বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বিস্তারে মনোনিবেশ করলেও এখনও যে তা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে বাইপাস করতে পারেনি, তা পরিষ্কার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের জনগণের মাঝে যে ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষার উদ্ভব হয়েছে, তা কতোদিন মার্কিন নীতির শৃংখলের মাঝে আটকে থাকবে, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বাস্তবিকপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী প্রভাব হারাবার বাস্তবতায় সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়।

Sunday 14 February 2021

চীনের উপর ব্রিটেন চাপ বৃদ্ধি করছে কেন?

১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

চীনা মিডিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে ব্রিটেন একদিকে যেমন চীনকে বাধ্য করছে প্রতিক্রিয়া দেখাতে, তেমনি হংকং এবং উইঘুর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিয়ে এসে চীনকে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইছে। ব্রিটেনের আদর্শিক এই আক্রমণের বিরুদ্ধে চীন এখনও কোন জবাব তৈরি করতে পারেনি। চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনায় এগিয়ে থাকতে ব্রিটেন এই ইস্যুগুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। হংকং এবং উইঘুরের জনগণের জন্যে ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে নয়, বরং পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নিতে ব্রিটেন চীনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে।


গত ১১ই ফেব্রুয়ারি চীনের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘ন্যাশনাল রেডিও এন্ড টেলিভিশন এডমিনিস্ট্রেশন’ ‘এনআরটিএ’ জানায় যে, ব্রিটিশ মিডিয়া ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ’কে চীনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চীনা এই সিদ্ধান্তকে এক সপ্তাহ আগের ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এর আগে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘অফকম’ ঘোষণা দেয় যে, ব্রিটেনে চীনা সরকারি মিডিয়া ‘চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক’ বা ‘সিজিটিএন’এর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। সংস্থাটা বলে যে, তাদের তদন্তে বের হয়ে এসেছে যে, ‘সিজিটিএন’এর এডিটিংএর কাজ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ‘স্টার চায়না মিডিয়া লিমিটেড’এর করার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ‘সিজিটিএন’এর নিয়ন্ত্রণ ছিল অন্য কোথাও। এটা ব্রিটিশ আইনের পরিপন্থী থাকায় তারা এর লাইসেন্স বাতিল করেছে। ‘সিএনএন’ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলছে যে, ‘সিজিটিএন’এর মূল নিয়ন্ত্রক হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। তবে কর্মকর্তারা বলছেন যে, ‘সিজিটিএন’ আদালতে যেতে পারবে এবং আবারও লাইসেন্সের জন্যে আপিল করতে পারবে। ২০২০ সালে ‘অফকম’ অভিযোগ করে যে, হংকংএর আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে ‘সিজিটিএন’ মূলতঃ চীনা সরকারকে সমর্থন করেছে এবং বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এড়িয়ে গেছে। এটা ব্রিটিশ মিডিয়ার নিরপেক্ষতার আইনের পরিপন্থী বলে বলছেন তারা। ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন যে, ব্রিটিশরা একদিকে মিডিয়ার স্বাধীনতার কথা বলছে; আর অন্যদিকে ‘সিজিটিএন’এর লাইসেন্স বাতিল করছে। এটা দ্বিমুখী নীতি ছাড়া কিছুই নয়। এছাড়াও এক বিবৃতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘বিবিসি’র কর্মকান্ডের সমালোচনা করে। বলা হয় যে, ‘বিবিসি’র প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের জন্যে চীনকে দায়ী করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয় যে, এর জন্যে ‘বিবিসি’র উচিৎ চীনের বিরুদ্ধে এধরণের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা এবং জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া। ব্রিটেন এবং চীনের এহেন কাদাছোঁড়াছুড়ি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এর আগে ২রা ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ এক প্রতিবেদনে বলে যে, ২০২০ সালে ব্রিটিশ সরকার তিনজন চীনা নাগরিককে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগে দেশ থেকে বহিষ্কার করে, যারা সাংবাদিক ভিসায় সেদেশে কাজ করছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয় যে, তিনটা চীনা মিডিয়ার জন্যে কাজ করা এই ব্যক্তিরা প্রকৃতপক্ষে চীনা গোয়েন্দা সংস্থা ‘মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটি’ বা ‘এমএসএস’এর এজেন্ট ছিল বলে বের করেছে ব্রিটিশ অভ্যন্তরীণ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘এমআই৫’। চীনা দূতাবাস ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’এর এই রিপোর্টকে ‘ঠান্ডাযুদ্ধের মানসিকতা’র সাথে তুলনা করে। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, কিছুদিনের মাঝেই ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস এক্ট’ আইনে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ১৯১১ সালে তৈরি এই আইন ১৯৮৯ সালে একবার ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করা হয়। এখন পরিবর্তিত বাস্তবতায় আইনে আবারও পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে, যাতে গোয়ান্দাবৃত্তির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়। অর্থনৈতিক গোয়েন্দাবৃত্তি এবং বিদেশী লবিস্ট গ্রুপগুলির কর্মকান্ডকে এর মাধ্যমে আরও কঠোরভাবে নজরদারির অধীনে আনার কথা বলা হচ্ছে।

ফেব্রুয়ারির শুরুতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউজ অব লর্ডসে ভোটাভুটি হয়; যার লক্ষ্য ছিল সিদ্ধান্ত নেয়া যে ব্রিটিশ হাইকোর্টকে চীনের মানবাধিকারের ব্যাপারে জড়িত করা হবে কিনা। লর্ডসএর সিদ্ধান্ত ছিল যে, চীনের সাথে ব্রিটেনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের শর্ত হিসেবে চীনের মানবাধিকার ইস্যুকে সামনে আনা উচিৎ। তারা প্রশ্ন করছে যে, একটা দেশ যদি গণহত্যায় জড়িত হয়, তাহলে তাদের সাথে বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত? তবে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্যরা বলছেন যে, গণহত্যার মতো ইস্যুতে জটিল তদন্ত করার মত সক্ষমতা হাইকোর্টের নেই। ব্রিটিশ মন্ত্রীরা বলছেন যে, পার্লামেন্টের কমিটিরই এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ; হাইকোর্টের নয়। তবে পার্লামেন্টের কট্টরপন্থীরা উইঘুরে চীনের কর্মকান্ডের ব্যাপারে সরকারের আরও কঠোর ভূমিকা চাইছেন।

৮ই ফেব্রুয়ারি চীনের উইঘুরের মুসলিমদের বিরুদ্ধে চীনা সরকারের অত্যাচারের উপর ‘বিবিসি’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তি ছিল ‘গ্লোবাল লিগ্যাল একশন নেটওয়ার্ক’ নামের এক এনজিওর কমিশন করা একটা আইনী মতামত। এর সাথে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্ট’ এবং জার্মানি ভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস’। ‘বিবিসি’ বলছে যে, উইঘুরের ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হাইকোর্টকে জড়িত করার যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটাকে বাইপাস করবে এই আইনী মতামত। এটা কোন আদালতের রায় না হলেও এর উপর ভিত্তি করে আইনী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ছয় মাস ধরে সরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষাবিদ, চ্যারিটি এবং বিভিন্ন মিডিয়ার কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রমাণাদিকে ব্যবহার করে এই আইনী মতামত তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাক্ষ্য, স্যাটেলাইট ছবি এবং চীনা সরকারের দলিলপত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ‘গ্লোবাস টাইমস’এর এক লেখায় উইঘুরের ব্যাপারে ‘বিবিসি’র নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার জন্যে চীনা সরকারকে আহ্বান জানানো হয়। তবে চীনের মাঝে অনেকেই চাইছেন ব্রিটেনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। ‘গ্লোবাল টাইমস’এর আরেক লেখায় ‘চাইনিজ একাডেমি অব সোশাল সাইন্সেস’এর এসোসিয়েট প্রফেসর লি গাং বলছেন যে, চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কোন্নয়ন ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে থেকে দুই দেশের সহযোগিতা ‘সোনালী অধ্যায়’ পার করছে। কিছু টানাপোড়েন থাকলেও দুই দেশের সম্পর্ক শক্ত ভিতের উপরেই রয়েছে। লি গাং বলছেন যে, কিছু ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আদর্শের ব্যাপারে কথা বলে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ করতে চাইতে পারে। আর রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হলে এর প্রভাব অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপরেও পড়তে বাধ্য।

পশ্চিমা আদর্শের ধারক ও বাহক হিসেবে ব্রিটেন পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় নিজের প্রভাব আরও বৃদ্ধি করতে চাইছে। এর অংশ হিসেবে চীনের সাথে এমন একটা সম্পর্ক চাইছে ব্রিটেন, যা ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে; যদিও অর্থনৈতিকভাবে চীনের অর্থনীতি অনেক বড়। ‘ব্রিটিশ চেম্বার অব কমার্স ইন চায়না’র প্রধান নির্বাহী স্টিভ লিঞ্চ ‘সিজিটিএন’কে বলছেন যে, ইইউএর বাইরে চীন ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী। চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি একদিকে যেমন করোনাভাইরাস পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনীতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হবে, তেমনি ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের বৈশ্বিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘হাউজ অব কমন্স’ লাইব্রেরির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেন এবং চীনের মোট বাণিজ্য এখন প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড বা ১’শ ১০ বিলিয়ন ডলার। এর মাঝে চীনে ব্রিটেনের রপ্তানি প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার এবং ব্রিটেনে চীনের রপ্তানি প্রায় ৬৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ব্রিটেনের এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ বিলিয়ন ডলারের উপর। চীন হলো ব্রিটেনের ষষ্ঠ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। আর ব্রিটেনের আমদানির জন্যে চীন হলো চতুর্থ বৃহত্তম আমদানি উৎস। এমতাবস্থায় চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতিকে ব্যালান্স করতে রাজনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে থাকতে চাইছে ব্রিটেন। চীনা মিডিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে ব্রিটেন একদিকে যেমন চীনকে বাধ্য করছে প্রতিক্রিয়া দেখাতে, তেমনি হংকং এবং উইঘুর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিয়ে এসে চীনকে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইছে। ব্রিটেনের আদর্শিক এই আক্রমণের বিরুদ্ধে চীন এখনও কোন জবাব তৈরি করতে পারেনি। চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনায় এগিয়ে থাকতে ব্রিটেন এই ইস্যুগুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। হংকং এবং উইঘুরের জনগণের জন্যে ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে নয়, বরং পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নিতে ব্রিটেন চীনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে।

Wednesday 10 February 2021

নাভালনি ইস্যু ইউরোপের বিভাজনকে আবারও সামনে নিয়ে এলো

১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

ইইউএর জন্যে নাভালনি ইস্যু এবং ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন একই সূত্রে গাঁথা। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থের কাছে ইইউএর স্বার্থ যখন গৌন হয়ে যাচ্ছে, তখন ইইউএর স্থায়িত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। ইইউএর অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তার অবস্থানকে ধরে রাখতে চাইছে; যা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সুপারপাওয়ার।

অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সেবাস্টিয়ান কুর্জ গত ৬ই ফেব্রুয়ারি জার্মান পত্রিকা ‘ওয়েম আম সনটাগ’এ প্রকাশিত এক সাক্ষাতে বলেন যে, ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনেকগুলি দেশের স্বার্থের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই ইইউএর উচিৎ হবে না রাশিয়াতে বিরোধী রাজনীতিবিদ আলেক্সি নাভালনির কারাদন্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এই প্রকল্পকে বিপদে ফেলে দেয়া। তিনি বলেন যে, এটা একটা ইউরোপিয় প্রকল্প; যারা এটাকে রুশ স্বার্থের প্রকল্প হিসেবে দেখছেন, তারা ভুল করছেন। তবে চ্যান্সেলর নাভালনির কারাদন্ডাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং বলেন যে, রাশিয়ার উচিৎ নাভালনিকে মুক্ত করে দেয়া। ৭ই ফেব্রুয়ারি আরেক জার্মান পত্রিকা ‘বিল্ড আম সনটাগ’এ প্রকাশিত এক সাক্ষাতে জার্মান অর্থমন্ত্রী পিটার আল্টমায়ার বলেন যে, নাভালনি ইস্যুকে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইনের সাথে একত্রে দেখা ঠিক হবে না। তিনি বলেন যে, বহুদিন ধরে চলে আসা ব্যবসা একটা বিষয়; আর মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে জার্মানির প্রতিক্রিয়া আরেকটা বিষয়। এর আগে ৫ই ফেব্রুয়ারি জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল রাশিয়া থেকে জার্মানিসহ তিন দেশের কূটনীতিবিদ বহিষ্কারের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নাভালনির ইস্যুর সাথে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ প্রকল্পকে একত্রে না দেখার আহ্বান জানান। রাশিয়া অভিযোগ করে যে, সুইডেন, পোল্যান্ড ও জার্মানির সেই কূটনীতিবিদেরা নাভালনির পক্ষে রাস্তায় বিক্ষোভে জড়িয়েছিল। নাভালনি ইস্যু ভূরাজনৈতিকভাবে একটা অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, যা শুধুমাত্র রাশিয়ার রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়।

‘ডয়েছে ভেলে’ বলছে যে, আলেক্সি নাভালনি ২০০৮ সালে তার ব্লগের মাধ্যমে রুশ রাজনীতি এবং সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে আলোচনায় আসেন। প্রাক্তন এই আইনজীবি ২০১১ সাল থেকে বেশ ক’বার বিক্ষোভ করার ফলশ্রুতিতে কারাগারে যান। ২০১৩ সালে তিনি মস্কোর মেয়রের পদের জন্যে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান। রুশ সরকারি মিডিয়াতে আসতে বাধা দেয়ায় নাভালনি সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে পুতিনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে থাকেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে রুশ প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে অংশ নেবার ঘোষণা দেবার পর বিভিন্ন মামলার ফাঁদে পড়ে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে সক্ষম হননি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে এক রাসায়নিক হামলায় তার এক চোখ মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে রুশ সরকার তাকে চিকিৎসার জন্যে স্পেনে যেতে অনুমতি দেয়। তবে ২০১৯ সালে তিনি আরও কয়েকবার গ্রেপ্তার হন এবং এই সময়ের মাঝেই তিনি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন। তিনি অভিযোগ করেন যে, রুশ সরকারই তাকে আক্রান্ত করেছে। সেবছরের ডিসেম্বরে তার অফিসে পুলিশের হামলার পর ২০২০ সালের মার্চে তার এবং তার পরিবারের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়। অগাস্ট মাসে তার মুখপাত্র জানান যে, হঠাত মারাত্মক অসুস্থ্য হবার কারণে জরুরি ভিত্তিতে তাকে জার্মানিতে চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হয়েছে। জার্মান সরকার বলে যে, নাভালনিকে ‘নোভিচক’ নামের নার্ভ এজেন্টের মাধ্যমে আক্রান্ত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি দেশে ফেরত আসলে আইন ভেঙ্গে জার্মানিতে বেশি সময় থাকার কারণে তাকে দুই বছর ৮ মাস কারাদন্ড দেয়া হয়। নাভালনির এই কারাদন্ডাদেশের পরই তার সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে আসে।

‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, এই পাইপলাইন বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে, যা রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করবে। রুশ সরকারি কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’এর তত্বাবধানে নির্মিত হওয়া এই পাইপলাইন ইতোমধ্যেই মার্কিন অবরোধের শিকার হয়েছে। মার্কিনীরা বলছে যে, এই পাইপলাইন নির্মিত হলে ভূরাজনৈতিকভাবে জার্মানি রাশিয়ার উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এর মাধ্যমে জার্মানি এবং ন্যাটোর উপর ক্রেমলিনের প্রভাব অনেক বেড়ে যেতে পারে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই প্রকল্পকে ‘ইউরোপের জন্যে খারাপ চুক্তি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, বাইডেন প্রশাসন খুব সম্ভবতঃ এই প্রকল্পে কাজ করা কোম্পানিগুলির উপর আরও অবরোধ দিতে চলেছে। ৬ই ফেব্রুয়ারি রুশ জাহাজ ‘ফরচুনা’ ডেনমার্কের সমুদ্রসীমায় পাইপ বসাবার কাজ চালাচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে বলা হয়। ১২’শ ৩০ কিঃমিঃ লম্বা এই ডাবল পাইপলাইন বাস্তবায়ন হলে জার্মানিতে রুশ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ দ্বিগুণ হবে। এখন মাত্র ১’শ ৫০ কিঃমিঃ পাইপলাইন বসানো বাকি রয়েছে।
 


জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ ৫ই ফেব্রুয়ারি বলেছেন যে, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে ইউরোপের বৈঠকের আগে ইউরোপের জ্বালানি নীতির ব্যাপারে একমত হবার দরকারের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। এর আগে পহেলা ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের ইউরোপিয়ার এফেয়ার্স মন্ত্রী ক্লিমেন্ট বিউন ‘ফ্রান্স ইন্টার’ রেডিওতে এক সাক্ষাতে বলেন যে, জার্মানির উচিৎ রাশিয়ার সাথে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ প্রকল্প বাতিল করে দেয়া। ফ্রান্স সবসময়ই বলে আসছিল যে, এই প্রকল্পের ব্যাপারে ফ্রান্সের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রায় এক বছর মার্কিন অবরোধের কারণে কাজ থেমে থাকার পর গত ডিসেম্বর থেকে পাইপলাইনের কাজ আবারও শুরু হয়েছে। ক্লিমেন্ট বিউন বলেন যে, নাভালনি ইস্যুতে ইইউ রাশিয়ার উপর নতুন করে অবরোধ দেয়ার চিন্তা করছে। এই পাইপলাইন নিয়ে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পোল্যান্ড, তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র এবং ইউক্রেন তাদের দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করেছে।

ইইউএর জন্যে নাভালনি ইস্যু এবং ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন একই সূত্রে গাঁথা। ব্রাসেলস ইতোমধ্যেই বলেছে যে, ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ প্রকল্প ইউরোপের প্রকল্প নয়; এটা একটা জার্মান প্রকল্প। ২১শে জানুয়ারি ইইউ পার্লামেন্টের এক ভোটাভুটিতে বিপুল ভোটে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইনের বিরুদ্ধে রেজোলিউশন পাস হয়। কেউ কেউ বলছেন যে, জার্মানি বা ইউরোপের জন্যে এই পাইপলাইন অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়। তবে এই প্রকল্পে কাজ করা কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ইইউএর কোন ব্যবস্থা গ্রহণের কার্পণ্য থেকে বোঝা যায় যে, ইইউএর মাঝে জার্মানির প্রভাব কতটুকু। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থের কাছে ইইউএর স্বার্থ যখন গৌন হয়ে যাচ্ছে, তখন ইইউএর স্থায়িত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। ইইউএর অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তার অবস্থানকে ধরে রাখতে চাইছে; যা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সুপারপাওয়ার।

Monday 8 February 2021

পাকিস্তানের ‘লুক আফ্রিকা’ নীতির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

০৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

জানুয়ারি ২০২০, নাইরোবি, কেনিয়া। ‘পাকিস্তান আফ্রিকা ট্রেড ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্স’ নামে একটা সন্মেলন। ‘লুক আফ্রিকা ইনিশিয়েটিভ’এর অধীনে পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দরগুলি আফ্রিকার জন্যে মধ্য এশিয়ার দেশগুলি এবং চীনের পশ্চিমাঞ্চলের বাজার ধরার দরজা হতে পারে।

 
পাকিস্তানের পত্রিকা ‘দ্যা নিউজ’ বলছে যে, ২০১৭ সালের অগাস্টে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় ‘লুক আফ্রিকা ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটা পরিকল্পনা নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের প্রধান বাণিজ্য সহযোগীদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নতুন বাজার খোঁজা। পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক বাণিজ্য যেখানে প্রায় ৮৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে আফ্রিকার সাথে বাণিজ্য মাত্র ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। একই নীতির অধীনে ২০১৯ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দেয় যে, পররাষ্ট্র দপ্তর ছয়টা নতুন বাণিজ্য সেকশন ইউরোপ থেকে আফ্রিকায় স্থানান্তরিত করছে। এই সেকশনগুলি উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়া ও সুদানে; পূর্ব আফ্রকার ইথিওপিয়া, সুদান ও তাঞ্জানিয়ায়; এবং পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগালে স্থাপন করা হচ্ছে। একই চেষ্টার অংশ হিসেবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে ‘পাকিস্তান আফ্রিকা ট্রেড ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্স’ নামে একটা সন্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আফ্রিকার মোট ২৬টা দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। পাকিস্তানের ম্যারিটাইম এফেয়ার্স সচিব রিজওয়ান আহমেদ সন্মেলনে বলেন যে, পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দরগুলি আফ্রিকার জন্যে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির এবং চীনের পশ্চিমাঞ্চলের বাজার ধরার দরজা হতে পারে। পাকিস্তানি সচিবের কথাগুলি পাকিস্তানের কৌশলগত চিন্তাকেই প্রতিফলিত করে। পাকিস্তানের ‘লুক আফ্রিকা ইনিশিয়েটিভ’এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে কতটুকু?

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দৈন্যতা

আফ্রিকার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়নের কেন্দ্রে রয়েছে দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। পাকিস্তানের অর্থনীতি এশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলির উপর বেশ নির্ভরশীল। দেশটার বাণিজ্য ঘাটতি যথেষ্ট। ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের রপ্তানি যেখানে ছিল প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার, সেখানে আমদানি ছিল ৬১ বিলিয়ন ডলারের উপর। প্রতিমাসে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করতে হয় প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার। ‘পাকিস্তান ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স’এর হিসেবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেশটার মাসিক বাণিজ্য ঘাটতি গিয়ে দাঁড়ায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের উপর। ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যোগ দিয়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হয়। রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা আসে এবং আমদানি বাড়তে থাকায় খুব দ্রুত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে দেশটা। তবে ২০১০ সালের পর থেকে ঋণের বোঝা কিছুটা কমে আসে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হিসেবে যেখানে ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় জিডিপির ৮৮ শতাংশে, সেখানে ২০১০ সালের দিকে তা ৬০ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে তা আবারও বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালে তা জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ হয়ে যায়। ১৫ই জানুয়ারি ‘আইএমএফ’এর ৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের শর্ত হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা দেন যে, বিদ্যুতের ট্যারিফ প্রতি ইউনিটের জন্যে ১ রুপি ৯০ পয়সা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ‘দ্যা নিউজ’ পত্রিকা বলছে যে, এই বৃদ্ধি ৩ রুপি ৩০ পয়সা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ মাত্র। এছাড়াও জানুয়ারির শেষে ‘এআরওয়াই নিউজ’এর এক খবরে পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, পেট্রোলের মূল্য লিটারপ্রতি ২ রুপি ৭০ পয়সা বৃদ্ধি করে ১’শ ১১ রুপি ৯০ পয়সা এবং ডিজেলের মূল্য ২ রুপি ৮৮ পয়সা বৃদ্ধি করে ১’শ ১৬ রুপি ৭ পয়সা করা হয়েছে। ‘এশিয়া টাইমস’ বলছে যে, ২০১৮ সালে ক্ষমতার আসার পর থেকে ইমরান খানের সরকার প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার ঋণ যোগ করেছেন; যার মাঝে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে নেয়া সাড়ে ৫ বিলিয়ন; চীন থেকে নেয়া ৬ দশমিক ৭ বিলয়ন; এবং ‘আইএমএফ’ ও বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে নেয়া ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ‘আইএমএফ’এর কাছ থেকে ১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেবার পরেও দেশটার মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশের উপর। পাকিস্তানি রুপির মূল্য এতটাই কমে গিয়েছে যে, ২০১০ সালের আগে ৫০ রুপিতে এক মার্কিন ডলার পাওয়া গেলেও বর্তমানে ১’শ ৬০ রুপি ব্যয় করতে হচ্ছে।

অর্থনৈতিক দৈন্যতা কাটিয়ে উঠতেই পাকিস্তান আফ্রিকার দিকে তাকাচ্ছে। গত ৭ই জানুয়ারি ইসলামাবাদে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি আফ্রিকার ৮টা দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠক করেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া বাকি দেশগুলি ছিল উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকার। মন্ত্রী আফ্রিকার সাথে কৃষি, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি এবং পর্যটন উন্নয়ন বিষয়ে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেন। একইসাথে পাকিস্তান আফ্রিকার সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করতে চায় বলে উল্লেখ করেন কোরেশি। এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তান জিবুতিতে নতুন কূটনৈতিক মিশন চালু করার ঘোষণা দেয়; এবং আরও মিশন চালু করবে বলেও বলা হয়। ‘গালফ নিউজ’ বলছে যে এর কিছুদিন আগেই শাহ মাহমুদ কোরেশি আফ্রিকায় পাকিস্তানের ১৪টা কূটনৈতিক মিশনের প্রধানদের সাথে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। তিনি সেই বৈঠকে অর্থনৈতিক কূটনীতির উপর জোর দেন। ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনকে পুঁজি করে আফ্রিকার দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে বাণিজ্য, অর্থের আদানপ্রদান, বিনিয়োগ, পর্যটন এবং প্রযুক্তি দেয়ানেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াবার উপর জোর দেন। তবে আফ্রিকায় পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়ন শুধুমাত্র বাণিজ্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়।

 
২০১৩ সাল। ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে পাকিস্তানি শান্তিরক্ষীদের মেডাল প্রদান করা হচ্ছে। শান্তিরক্ষী মিশনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আফ্রিকার দেশগুলিতে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে চাইছে পাকিস্তান।


নিরাপত্তা সহযোগিতা ও সামরিক প্রশিক্ষণ

অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার চিন্তা থেকে শুরু হলেও পাকিস্তান এই প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে; বিশেষ করে নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘের হিসেবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শান্তিরক্ষী মিশনে পাকিস্তানের মোট ৪ হাজার ৭’শ ৩৭ জন সেনা মোতায়েন রয়েছে; যার প্রায় সবাই রয়েছে আফ্রিকার মাটিতে। এর মাঝে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে রয়েছে প্রায় ১২’শ; ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে রয়েছে প্রায় ১৯’শ; দারফুরে রয়েছে প্রায় ১ হাজার; দক্ষিণ সুদানে রয়েছে প্রায় আড়াই’শ; মালিতে রয়েছে প্রায় দেড়’শ সেনা। আফ্রিকার অনেক দেশের সেনারা পাকিস্তানের সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার সামরিক ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়েব’ বলছে যে, ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে পাকিস্তানের এমনই এক সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক দক্ষিণ আফ্রিকার সেনারা পাকিস্তানে এবং পাকিস্তানের সেনারা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রশিক্ষণ নেয়। ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ৪০ জনের মতো সেনা পাকিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। এছাড়াও উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দ পারস্পরিক সফর বিনিময় করেছেন নিয়মিতই। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজও নিয়মিত বিরতিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও আফ্রিকার অন্যান্য দেশও পাকিস্তানের দিকে তাকাচ্ছে প্রশিক্ষণের জন্যে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সাল পাকিস্তান সফরের সময় পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সমঝোতা করেন। ২০১৯ সালের জুলাইএ পাকিস্তান নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল জাফর মাহমুদ আব্বাসির পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া সফরের সময় কেনিয়া সরকার পাকিস্তানের সাথে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি করার আগ্রহ ব্যাক্ত করে।

তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর এক লেখায় ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর ভিজিটিং ফেলো কামাল আলম বলছেন যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখন তার আন্তর্জাতিক অবস্থানকে বেশ শক্তিশালী করেছে। দুনিয়ার তিন ডজন দেশ তাদের সেনাদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণের জন্যে পাঠাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সহায়তার উপর নির্ভরশীলতা কমেছে পাকিস্তানের। অন্যদিকে আফগানিস্তানে বহুদিন ধরে যুদ্ধ করার কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতাকে অনেক দেশই গুরুত্ব সহকারে দেখছে এবং পাকিস্তানিদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে চাইছে। এছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে লম্বা সময় পাকিস্তানিরা শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করার কারণে পাকিস্তানের সামরিক একাডেমিগুলিকে শান্তিরক্ষী প্রশিক্ষণের জন্যে প্রধান কেন্দ্র হিসবে দেখছে অনেক দেশ।

 
নভেম্বর ২০২০। নাইজেরিয়ার জন্যে তৈরি করা ‘জেএফ ১৭’ ফাইটার বিমান। নাইজেরিয়ায় পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামের রপ্তানি বাড়ছে, তথাপি বাকি আফ্রিকায় পাকিস্তানের অস্ত্র বাণিজ্য এখনও উল্লেখ করার মতো নয়।


আফ্রিকার অস্ত্রের বাজারে পাকিস্তান

বহুদিন ভারতের সাথে সামরিক প্রতিযোগিতার কারণে পাকিস্তান তার সামরিক শিল্পকে গড়ে তুলেছে। এখন সেই শিল্পকে ব্যবহার করেই পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্র অর্জন করা ছাড়াও অন্তর্জাতিকভাবে বন্ধু তৈরি করতে চাইছে। ২০১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া পাকিস্তান থেকে ১০টা ‘সুপার মুশশাক’ প্রশিক্ষণ বিমান কেনার চুক্তি করে। এরপর ২০১৯ সালে নাইজেরিয়া ১’শ ৮৪ মিলিয়ন ডলারে পাকিস্তানের কাছ থেকে ৩টা ‘জেএফ ১৭’ ফাইটার বিমান এবং বিমানগুলির জন্যে বিভিন্ন অস্ত্র কেনার চুক্তি করে। ‘ডিফেন্স ওয়ার্ল্ড’ বলছে যে, নাইজেরিয়া ইতোমধ্যেই পাকিস্তান থেকে আরও ‘জেএফ ১৭’ বিমান কেনার জন্যে আলোচনা চালাচ্ছে। তবে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াতে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করার ব্যাপারটাকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি। ভারতের ‘ইকনমিক টাইমস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনের সহায়তায় পাকিস্তান ভারতের সামরিক সরঞ্জামের বাজারকে টার্গেট করে এগুচ্ছে।

 
জানুয়ারি ২০২০। ভারত মহাসাগরের সেইশেল দ্বীপপুঞ্জে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর জাহাজ। সফরকালে জাহাজগুলি আফ্রিকার উপকূলে বিভিন্ন স্থানে শুভেচ্ছা সফর সফর ছাড়াও সাধারণ জনগণের জন্যে মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করে। সেসব দেশের জনগণের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাতেই এক সফরের আয়োজন করে পাকিস্তান নৌবাহিনী। তবে পাকিস্তানের কৌশলগত চিন্তায় এখনও পূর্ব আফ্রিকার উপকূলই প্রাধান্য পাচ্ছে।


নৌ কূটনীতি

‘গালফ নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাপ্লাই জাহাজ ‘নাসর’ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আফ্রিকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। নৌবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, জাহাজটা বন্যা ও খরায় আক্রান্ত মানুষকে সহায়তা দিতে পূর্ব আফ্রিকার জিবুতি ও সুদান এবং পশ্চিম আফ্রিকার নিজের যাবে। এছাড়াও জাহাজটা কেনিয়ার মোম্বাসা বন্ধর সফর করবে। এর আগে ২০১৯এর নভেম্বর থেকে ২০২০এর জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তান নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘আসলাত’ এবং সাপ্লাই জাহাজ ‘মোয়াউইন’ পুরো আফ্রিকা প্রদক্ষিণ করে। সফরকালে জাহাজগুলি মরক্কো, মৌরিতানিয়া, ঘানা, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া ও সেইশেল দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ করে। সফরকালে জাহাজগুলি বিভিন্ন স্থানে শুভেচ্ছা সফর ছাড়াও সাধারণ জনগণের জন্যে মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করে। সেসব দেশের জনগণের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাতেই এই সফরের আয়োজন করে পাকিস্তান নৌবাহিনী।

চীনা সরকারি মিডিয়া ‘গ্লোবাল টাইমস’এর সাথে এক সাক্ষাতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল আমজাদ খান নিয়াজি পাকিস্তান নৌবাহিনীর আফ্রিকা প্রদক্ষিণের মিশনকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, এই মিশন ছিল পাকিস্তান সরকারের ‘এনগেজ আফ্রিকা’ নীতির অংশ। সরকারের আফ্রিকা নীতি যে নৌবাহিনীর প্রধান মিশনগুলির মাঝে পড়ছে না, তা ২০১৮এর ডিসেম্বরে প্রকাশ করা পাকিস্তানের ‘ম্যারিটাইম ডকট্রাইন’ থেকেই বোঝা যায়। প্রথমবারের মতো প্রকাশ করা এই নীতিতে আফ্রিকার উল্লেখ নেই বললেই চলে। এই নীতির বর্ণনা দিতে গিয়ে নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার মুহাম্মদ আজম খান ‘গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস’এর এক লেখায় শুধুমাত্র পূর্ব আফ্রিকার উপকূলের কথাই উল্লেখ করেন।

পাকিস্তানের চিন্তা এখনও পূর্ব আফ্রিকা নিয়ে

২০১৯এর জুলাইএ পাকিস্তানের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদ’এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আফ্রিকায় পাকিস্তানের রপ্তানি বৃদ্ধি করার উপর জোর দেয়া হয়। তবে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আফ্রিকায় ভারতের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যতটা শক্তিশালী নৌবাহিনীর প্রয়োজন, পাকিস্তানের পক্ষে তা তৈরি করা কষ্টকর। এছাড়াও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের কেনিয়া এবং তাঞ্জানিয়ার উপকূলীয় শহরগুলিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনগণের বসবাস থাকায় সেখানে ভারতের প্রভাব তৈরি করাটা সহজ হয়েছে। সেখানে ভারতীয় পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকাটা পাকিস্তানের পণ্যের জন্যে বেশ কঠিন হবে। তবে বলাই বাহুল্য যে, প্রতিবেদনে মূলতঃ ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলিকে নিয়েই কথা বলা হয়েছে। পাকিস্তানের কৌশলগত চিন্তায় এখনও পূর্ব আফ্রিকার উপকূলই প্রাধান্য পাচ্ছে। পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ার বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকা, মরক্কো, নাইজেরিয়া এবং মিশর আফ্রিকায় পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী। ‘অবজারভেটরি অব ইকনমিক কমপ্লেক্সিটি’র হিসেবে পুরো আফ্রিকা থেকে পাকিস্তান যে ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কেনে, তার ৮৪ শতাংশই এই পাঁচ দেশ থেকে আসে; যদিও আফ্রিকার ১৪টা দেশে পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। আফ্রিকায় পাকিস্তানের মোট ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির ৪৬ শতাংশই যায় পূর্ব আফ্রিকার ৭টা দেশে।

নতুন নৌশক্তির উদ্দেশ্য কি?

১৯৯০এর দশক পর্যন্ত পাকিস্তানের নৌবাহিনীর মূল সমুদ্রগামী জাহাজ বলতে ছিল ১৯৭০এর দশকে ব্রিটেনে তৈরি ৬টা ‘টাইপ ২১’ ফ্রিগেট এবং ১৯৮০এর দশকে চীন থেকে ক্রয় করা ১৫ হাজার টনের সাপ্লাই জাহাজ ‘নাসর’। ২০০৪ সাল থেকে চীনের সহায়তায় ‘জুলফিকার ক্লাস’এর ৪টা ফ্রিগেট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৩ সালের মাঝে এই ফ্রিগেটগুলি পাকিস্তানের হাতে আসে। প্রায় একই সময়ে ২০১০ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর ‘অলিভার পেরি ক্লাস’এর পুরোনো একটা ফ্রিগেট পায় পাকিস্তান। ২০১৩ সালে তুরস্কের কোম্পানি ‘এসটিএম’এর সহায়তায় ১৭ হাজার টনের একটা সাপ্লাই জাহাজ তৈরি করা শুরু করে পাকিস্তান। ২০১৮ সালে ‘মোয়াউইন’ নামের এই জাহাজটা কমিশনিং করা হয়। ২০১৭ সালে হল্যান্ডের ‘ডামেন’ শিপইয়ার্ড থেকে ‘ইয়ারমুক ক্লাস’এর ২টা কর্ভেট অর্ডার করে পাকিস্তান। ২০২০এ এগুলি কমিশনিং করা হয়। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে চীন থেকে ৪টা ‘টাইপ ০৫৪ এপি ক্লাস’এর ফ্রিগেট অর্ডার করে পাকিস্তান। ২০২১ সালের মাঝেই সবগুলি জাহাজের কাজ শেষ হবার কথা রয়েছে। ২০১৮ সালে পাকিস্তান তুরস্কের কাছ থেকে ‘মিলজেম ক্লাস’এর ৪টা কর্ভেট অর্ডার করে। ২০১৯ থেকে এগুলির কাজ শুরু হয়ে ২০২৪এর মাঝে শেষ হবার কথা রয়েছে। নৌবাহিনীর জাহাজ ক্রয়ের এই প্রক্রিয়ার ফলাফলস্বরূপ ১৯৯০এর দশকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর সমুদ্রগামী জাহাজ যেখানে ছিল ৬টা ফ্রিগেট ও ১টা সাপ্লাই জাহাজ, সেখানে ২০২০ সাল নাগাদ তা দাঁড়ায় ৮টা ফ্রিগেট, ২টা কর্ভেট, ২টা সাপ্লাই জাহাজে। এক দশকের মাঝে পাকিস্তান নৌবাহিনীর দূরদেশের বন্দরে পাঠাবার মতো জাহাজের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আরও ৪টা ফ্রিগেট ও ৪টা কর্ভেট বর্তমানে তৈরি হচ্ছে; যেগুলি বছর পাঁচেকের মাঝেই সার্ভিসে আসবে। তখন সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা আরও বাড়বে।

গত বেশ কয়েক দশক ধরেই পাকিস্তান নৌবাহিনীর মূল শক্তি সাবমেরিন। কিছুদিন আগ পর্যন্তও পাকিস্তান নৌবাহিনীর মূল শক্তি ছিল ৫টা সাবমেরিন। সমুদ্রগামী জাহাজ পাকিস্তানের শক্তিশালী হস্ত ছিল না কখনোই। সামরিক বাজেটের প্রায় সবটাই গিয়েছে সেনা এবং বিমান বাহিনীর কাছে। কারণ মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভারতের সাথে স্থলসীমানা রক্ষা। পাকিস্তানের জনগণের কাছে নৌবাহিনীর গুরুত্ব কখনোই খুব বেশি ছিল না। ‘গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ এখনও নিজ চোখে সমুদ্র দেখেনি। তাই দেশটাকে ‘ম্যারিটাইম নেশন’ হিসেবে তৈরি করতে এখনও বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে।

 
সেপ্টেম্বর ২০১৯। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্যে ‘মিলজেম ক্লাস’ কর্ভেট তৈরি উদ্ভোধন করছেন। ভারতের প্রভাবকে ব্যালান্স করে আফ্রিকার মাটিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চীন এবং তুরস্কের মতো দেশগুলির সহায়তা চাইবে পাকিস্তান।

আফ্রিকায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি?

আফ্রিকায় পাকিস্তানের কূটনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রে অর্থনীতি থাকলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাশ্মিরকে সবসময়ই আলোচনার বিষয়বস্তু করেছে পাকিস্তান। কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে পাকিস্তান। ২০১৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর দু’টা জাহাজ পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়া ভ্রমণ করে। ‘দ্যা নিউজ’ বলছে যে, সেই ভ্রমণে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমান্ডার মৌরিতানিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে কাশ্মিরে ভারতের আগ্রাসী কর্মকান্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলেন। ‘দ্যা ফ্রন্টিয়ার পোস্ট’ বলছে যে, এই জাহাজগুলি পরবর্তী জানুয়ারি মাসে যখন তাঞ্জানিয়া সফর করে, তখনও পাকিস্তানি কমান্ডার কাশ্মির ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা বলছে যে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে কেনিয়ার নৌবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল লেভি ফ্রাঙ্কলিন মাঘালু যখন পাকিস্তান সফর করেন, তখন পাকিস্তান নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল জাফর মাহমুদ আব্বাসি কাশ্মির ইস্যুকে তুলে ধরেন এবং সেখানে ভারতের ‘আর্টিকেল ৩৭০’ বাতিল করার পর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলেন। তবে এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পাকিস্তানের জন্যে বা কাশ্মিরের জন্যে কতটুকু সুবিধা এনে দিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। ২০১৯ সালের অগাস্টে কাশ্মির ইস্যু নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনার মুহুর্তে দক্ষিণ আফ্রিকা নিরপেক্ষ থেকেই দুই দেশকে আলোচনার পথ অনুসরণ করতে বলেছে। ভারতের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। স্বাভাবিকভাবেই কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা শক্ত কোন বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকে।

আফ্রিকায় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কি?

পাকিস্তানের ‘লুক আফ্রিকা’ বা ‘এনগেজ আফ্রিকা’ নীতি মূলতঃ দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যতা থেকে মুক্তি পাবার একটা প্রচেষ্টা। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখনও কাশ্মিরের পক্ষে ফাঁপা জনসমর্থন আদায়ের মাঝেই সীমিত। আফ্রিকার সাথে ভারতের বাৎসরিক বাণিজ্য ৬২ বিলিয়ন ডলারের উপরে; যার ধারেকাছেও নেই পাকিস্তান। তাই আফ্রিকায় পাকিস্তানের প্রভাব এখনও উল্লেখ করার মতো নয়। তবে পাকিস্তান তার নামকরা ইন্টেলিজেন্সের কারণে আফ্রিকায় নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার একটা জোর প্রচেষ্টা চালাতে পারে। পাকিস্তানের চিন্তাবিদেরা ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব কমাবার কৌশল হিসেবে আফ্রিকায় বাণিজ্য বৃদ্ধির কথা বললেও তা মূলতঃ পূর্ব আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। যদিও পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামের রপ্তানি বাড়ছে, তথাপি বাকি আফ্রিকায় পাকিস্তানের অস্ত্র বাণিজ্য এখনও উল্লেখ করার মতো নয়। ভারতকে মোকাবিলার জন্যে তৈরি করা অস্ত্রগুলি আফ্রিকার দেশগুলির জন্যে সকল ক্ষেত্রে উপযোগী নয়। তারপরেও ভারতীয় চিন্তাবিদেরা আফ্রিকায় পাকিস্তানের অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। পাকিস্তানের নৌবাহিনী আফ্রিকা প্রদক্ষিণ করে আসলেও আফ্রিকা নিয়ে পাকিস্তানের চিন্তা এখনও যথেষ্টই সংকীর্ণ। আফ্রিকার উপকূলে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রভাবের তুলনায় তা এখনও উল্লেখ করার মতো কিছু নয়।

তথাপি পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি কমার সাথেসাথে পাকিস্তানের মতো দেশের প্রভাব তৈরি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আফ্রিকায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে অংশ নেবার ফলে আফ্রিকার দেশগুলির সাথে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একটা নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যা পাকিস্তান এখন ব্যবহার করতে চাইছে। ভারতের প্রভাবকে ব্যালান্স করে আফ্রিকার মাটিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চীন এবং তুরস্কের মতো দেশগুলির সহায়তা চাইবে পাকিস্তান। রূঢ় অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে আফ্রিকা নীতিকে হাল্কা করে দেখাটা পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও সমুদ্র না দেখলেও একটা শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ার দিকে এগুচ্ছে পাকিস্তান, যা কিনা পাকিস্তানের জন্মের পর সাত দশকে প্রথমবারের মতো দেশটার দৃষ্টিকে ভারত এবং আফগানিস্তানের স্থলসীমানা থেকে মহাসাগরের দিকে নিয়ে যাবে। আফ্রিকার সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জই পাকিস্তানকে এই কঠিন লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাবে। আর এতে আফ্রিকার মাটিতে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার ফলাফল হিসেবে নতুন ভূরাজনৈতিক খেলায় পাকিস্তানও যোগ হবে। আফ্রিকার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিরা পাকিস্তানের প্রভাব বিস্তারকে কিভাবে দেখবে, সেটাও হবে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

Tuesday 2 February 2021

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২১

গণতন্ত্র নয়, বরং চীনের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই মিয়ানমারের সামরিক শাসকদেরকে পশ্চিমারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হবে। আর সু চি ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনের পক্ষে কথা বলে তার গণতান্ত্রিক স্বরূপ দেখিয়েছেন। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের আদর্শ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে দাঁড়াতেই পারছে না।

 
পহেলা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। তবে তা না হয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিসহ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে এক বছরের জন্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। গত নভেম্বরে একচ্ছত্রভাবে নির্বাচনে জেতে সু চির ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি’ বা ‘এনএলডি’। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দাবি করে যে, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। তবে মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশন কারচুপির অভিযোগ বাতিল করে দেয়। নির্বাচনে ‘এনএলডি’ মোট ২’শ ২৪টা আসনের মাঝে ১’শ ৩৮টা আসন পায়। বাকি সকল দল মিলিয়ে পায় মাত্র ৩০টা আসন। ২০০৮ সালে সামরিক বাহিনীর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে রচিত সংবিধান অনুযায়ী ৫৬টা আসন সামরিক বাহিনীর জন্যে বরাদ্দ থাকে। ২০১৯ সালে ‘এনএলডি’ সংবিধানে পরিবর্তন আনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে লাগবে ৭৫ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর জন্যে বরাদ্দ রাখা ২৫ শতাংশ আসন বাদে সকল আসনই একটা দলকে পেতে হবে। তবে সামরিক বাহিনীর সমর্থিত ‘ইউএসডিপি’ দল মাত্র ৩০টা আসন পেলেও তা সংবিধান পরিবর্তন রুখে দেবার জন্যে যথেষ্ট। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৪১৭’ এবং ‘আর্টিকেল ৪১৮’এর বরাত দিয়ে ক্ষমতা দখল করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এই অভ্যুত্থানের ভূরাজনৈতিক প্রভাব কতটুকু, তা নিয়ে এখন শুরু হয়েছে আলোচনা।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, অনেকেই এই অভ্যুত্থানে অবাক হয়েছে। কারণ সংবিধান অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল। স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছাড়াও দুইজন ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন সামরিক বাহিনী থেকে আসতো। কেউ কেউ মনে করছেন যে, ২০১১ সাল থেকে সামরিক বাহিনীর প্রধান থাকা সিনিয়ন জেনারেল মিং অং হিয়াংএর অবসরের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে অভ্যুত্থানের সম্পর্ক থাকতে পারে।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’ বা ‘সিএফআর’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, সু চি কার্যত মিয়ানমারের বেসামরিক প্রধানই ছিলেন। নিজের দলের মাঝে তার ক্ষমতা ছিল একচ্ছত্র এবং সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা তিনি করেননি। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা তো তিনি করেনইনি, বরং সামরিক বাহিনীর ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনকে তিনি সমর্থন করে গেছেন। মিয়ানমারের মিডিয়ার স্বাধীনতাকেও তিনি দমিয়ে রেখেছিলেন। রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানকে তিনি সমর্থন করে গেছেন। গত বেশ কয়েক বছর ধরে সু চির গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টাটা পুরোপুরি ব্যর্থ ছিল। তবে অভ্যুত্থানের কারণে ‘এনএলডি’র নেতৃত্বে জনগণের মাঝে অসন্তোষ যেমন দানা বেঁধে উঠতে পারে, তেমনি দেশটার বহু জাতিগত বিরোধ থামাতে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলি ভেস্তে যেতে পারে।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর সামরিক বাহিনীর অত্যাচারকে সমর্থন করে সু চি তার নোবেল বিজয়ী পরিচয়কে ধ্বংস করেছেন। প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিবিদ বিল রিচার্ডসন এক বার্তায় বলেন যে, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক চিন্তাগুলি এগিয়ে নিতে ব্যর্থতার কারণে সু চির উচিৎ অন্য কারুর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া। তবে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সু চিকে সমর্থন করে মিয়ানমারের উপর নতুন করে অবরোধ দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বব মেনেনডেজ বলছেন যে, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা না ছাড়লে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের উচিৎ মিয়ানমারের উপর কঠোর অবরোধ আরোপ করা।

‘সিএফআর’ বলছে যে, পশ্চিমা দেশগুলি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলি তেমন কঠোর ভাষায় কথা বলছে না। চীন এবং বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই মিয়ানমারকে স্থিতিশীল দেখতে চায় বলে বলেছে। বাংলাদেশ আশা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন। একইসাথে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সু চি স্টেট কাউন্সিলর থাকার সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে হতাশা এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কথাও উল্লেখ করা হয়। মিয়ানমারে সবচাইতে বড় বিনিয়োগকারী দেশ সিঙ্গাপুর যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত কোন কথা বলা থেকে তারা বিরত থাকে।

মিয়ানমারের সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী হলো চীন। মিয়ানমার থেকে চীনে রপ্তানি করা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হলো প্রাকৃতিক গ্যাস; যার সবচাইতে বড় রিজার্ভ হলো রাখাইন উপকূলে। চীন এবং থাইল্যান্ডে প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস রপ্তানি করছে মিয়ানমার। ইউরোপিয়ান কমিশনের হিসেবে মিয়ানমারের সাথে ইইউএর মোট বাণিজ্য প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার; যার মাঝে ইইউতে মিয়ানমারের রপ্তানি প্রায় ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপে মিয়ানমারের মূল রপ্তানি দ্রব্য হলো তৈরি পোষাক এবং পাদুকা। তবে করোনা মহামারির মাঝে পশ্চিমা বাজারে মিয়ানমারের তৈরি পোষাকের সরবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের মোট রপ্তানির মাত্র ৩ শতাংশের ক্রেতা। অপরদিকে চীন ৩৩ শতাংশ, থাইল্যান্ড ১৮ শতাংশ এবং জাপান ৮ শতাংশের ক্রেতা। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা ভারত, হংকং, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া। মোটকথা মিয়ানমারের মূল বাণিজ্য সহযোগী হলো এশিয়ার দেশগুলি। ‘মিয়ানমার টাইমস’ বলছে যে, সেদেশে সবচাইতে বড় বিনিয়োগকারী দেশ হলো সিঙ্গাপুর। দেশটাতে গণতন্ত্রায়ন শুরু হবার পর থেকে রাখাইনে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উপেক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু এই দেশগুলি সেদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং সেখানে চীনের একচেটিয়া প্রভাব অনেকটাই কমাতে সহায়তা করেছে। এখন মিয়ানমারের উপর পশ্চিমা অবরোধ বিনিয়োগকারী দেশগুলিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ভূরাজনীতি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘স্ট্রাটফর’ বলছে যে, মিয়ানমারের উপর অবরোধ দেয়া ছাড়া বাইডেন প্রশাসনের সামনে খুব বেশি পথ খোলা নেই। কিন্তু এহেন অবরোধে সেখানে মার্কিন প্রভাব আরও কমে গিয়ে চীনা প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি হয়ে দাঁড়াবে। ‘স্ট্রাটফর’এর কথা বোঝা যাচ্ছে যে, গণতন্ত্র নয়, বরং চীনের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই মিয়ানমারের সামরিক শাসকদেরকে পশ্চিমারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হবে। আর সু চি ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনের পক্ষে কথা বলে তার গণতান্ত্রিক স্বরূপ দেখিয়েছেন। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের আদর্শ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে দাঁড়াতেই পারছে না।