Thursday 15 September 2016

আফ্রিকা আমাদের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৬
আফ্রিকার মাটিতে শান্তিরক্ষীরা একটা চমতকার ভাবমূর্তি তৈরি করে এসেছেন, সেটা ঠিকমতো কাজে লাগাতে গেলে আমাদের চিন্তাটাকে আরও বেশকিছুটা প্রসারিত করতে হবে। আফ্রিকা আমাদের জন্যে কততা গুরুতপূর্ণ, তা ভাবার সময় এখনই।


১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশ নামে নতুন জন্ম নেয়া দেশটিকে পরাশক্তিরা যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। সদ্য স্বাধীন দেশটিতে মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি ছিল। এই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অন্য দেশগুলি বাংলাদেশের জনগণকে জিম্মি করে নিজেদের কাজ হাসিল করেছে। আর এই কাজে যুক্তরাষ্ট্রের আগে আর কেউ এগিয়ে ছিলনা। চার দশক পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের declassify করা নথিগুলি আমাদের জানান দেয় যে তারা সেসময় খাদ্য নিয়ে কি পরিমাণ রাজনীতি করেছে। খাদ্যশস্য দেবার চুক্তি করার আগে শর্ত পূরণ করিয়েছে। বামপন্থী কিউবার কাছে পাটজাত পণ্য বিক্রি করার ‘অপরাধে’ ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ তিন সপ্তাহ দেরি করিয়েছে, যা কিনা ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষে বহু মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল। কি দম্ভটাই না তাদের ছিল তখন। ঢাকায় তাদের অফিসের সামনে একটি পোস্টার কেন লাগানো হয়েছিল, তা কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছিল। সরকারের সদস্যরা কেন উমুক দেশকে সমর্থন করেছিলেন, তার জন্যে আমাদের কূটনীতিককে ডেকে শাসিয়েছে; খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়েছে। সরকারী দলের লোকেরা কেন আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলে, এ নিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে। এই দম্ভ আজ কোথায়? এখন নিজেদের দূরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। এক দেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে আরেক দেশের সাহায্য নিতে হচ্ছে। এজন্যেই প্রশ্ন করেছিলাম আগের এক লেখায় – আমরা হেরে যাওয়া দলের খেলোয়াড় কেন থাকবো?

মানবতার জন্যে আফ্রিকা

যাই হোক, বাংলাদেশ যে বহু দূর এসেছে, তা এখন আর বলে দিতে হবে না। ১৯৭০-এর দশকে কিসিঞ্জার সাহেবের “Basket Case” এখন খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে চাইছে। খাবারের কষ্ট কেমন, সেটা এই দেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। এদেশের ভুভুক্ষু মানুষগুলিকে জিম্মি করে খাদ্যশস্যের জাহাজ নিয়ে রাজনীতি চলেছে একসময়। সারা দুনিয়াতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে শোষণ করেছে তারা। আমরা এই জঘন্য মানসিকতা তাদের কাছ থেকে শিখবো না অবশ্যই। আর এই জঘন্য চিন্তা যেহেতু এখন পুরোপুরি নিম্নমুখী, তাই আঙ্গুরের আশায় তাদের দিকে তাকিয়ে থাকার দিন শেষ। আমরা বিপদের সময়ে নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপকে সাহায্য করেছি; সামনের দিনগুলিতেও করবো। ভারতের চোখ রাঙ্গানিতে কাজ হবে না। আমাদের সৈন্যদের পরিশ্রমে আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষ শান্তিতে ফিরেছে। জাতিসঙ্ঘের সমস্যাসঙ্কুল মিশনের কাঁটাতারে আটকে না গেলে আমরা হয়তো আরও ভালো কাজ করতে পারতাম। যা-ই হোক; কাজ আমরা করেছি; করছি। কালো মানুষগুলিকে বন্ধুর মতো নিতে আমাদের কষ্ট হয়নি। পশ্চিমা বর্ণবাদ আমাদের সৈনিকদের মাঝে কাজ করেনি। আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে। মার্কিনীরা ১৯৭০-এর দশকে থাইল্যান্ডকে যেভাবে রঙ্গিন “বৃন্দাবন” বানিয়েছিল তাদের ভিয়েতনামে যুদ্ধরত সৈন্যদের যৌন-আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে, আমরা সেটা আফ্রিকাতে করতে পারিনি আমাদের ইসলামিক বিশ্বাসের কারণে। মার্কিন ব্যবস্থাতে দুনিয়া চললেও আমাদের বিশ্বাসকে মুছে ফেলতে পারেনি তারা। তাই আফ্রিকার দেশে দেশে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে বাংলায়। কালো কালো শিশুদের মাঝে সেনারা তাদের দেশে ফেলে আসা সন্তানদের দেখতে পেয়েছেন; পশ্চিমা পাদ্রীদের মতো pedophilia কেইস আমরা হতে পারিনি। মার্কিন মুল্লুকের সাদা-কালো বৈষম্য আমাদের কখনো স্পর্শ করেনি, কারণ ইসলামে সাদা-কালো ব্যাপারটার অস্তিত্বই নেই; তাই এখানে অনেক ফেয়ার-এন্ড-লাভলি মাখিয়েও আমাদের সৈন্যদের হাতে আফ্রিকাকে ধ্বংস করানো যায়নি।
  
আফ্রিকাতে বাংলাদেশের নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। এটা সম্ভব হতো না যদি আমাদের সৈন্যরা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে অনাচারে লিপ্ত হতো। কালো মানুষগুলির সাথে আত্মার বন্ধন তৈরির একটা সুযোগ সেখানে তৈরি করা হয়েই গেছে। এখন সেটাকে সামনে এগিয়ে নেবার পালা। আমরা আফ্রিকার মানুষগুলির সাথে দায়িত্বপূর্ণ মনোভাব দেখালে আমাদের দরকারগুলিকেও তারা গুরুত্বের সাথে দেখবে। সামনের দিনগুলিতে আমাদের জন্যে আফ্রিকার গুরুত্ব বাড়তেই থাকবে। সেই অনুযায়ী এখন থেকেই তৈরি হতে হবে আমাদের।

উন্নয়নের জন্যে আফ্রিকা

আফ্রিকার এই দেশগুলি অনেক সময়েই অজন্মার কারণে খাদ্যসংকটে পতিত হয়েছে। পশ্চিমা সম্পদশালীদের সম্পদ কুক্ষিগত করার কারণে, আর Consumerism-এর নামে হাজার হাজার টন খাদ্য অপচয় করার কারণে আফ্রিকাতে দুর্ভিক্ষে মারা গেছে বহু মানুষ। আমরা আমাদের উদ্ধৃত্ত খাদ্যশস্য আফ্রিকাতে পাঠালে এটা সবদিক থেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। আমরা তো আর ঘুর্নিঝড় সিডরের পর ভারত আমাদের সাথে চাল নিয়ে যে কূটনীতি করেছিল, সেটা আফ্রিকার সাথে করবো না। বাংলাদেশের অনেক পণ্যই এখন বাজার খুঁজছে পৃথিবীব্যপী। গত দুই দশকে যে পরিমাণ শিল্পায়ন এই দেশে হয়েছে, তাতে অল্প কিছু অদরকারী পণ্য এবং কিছু হাই-টেক পণ্য বাদ দিলে বেশিরভাগ জিনিসই এই দেশে তৈরি হয়ে থাকে। ভারত তার নিজের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যকে ভয় পায় বলেই এখন আফ্রিকাতে এসব পণ্যের বাজার তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের কর্পোরেট গ্রুপগুলির একটা বড় রপ্তানি আয় আসছে আফ্রিকা থেকে, যা দিনে দিনে বাড়ছে। জাহাজ-ভর্তি পণ্য যাচ্ছে আফ্রিকাতে। আফ্রিকাতে ইলেকট্রনিক্স পণ্য নিয়ে ঢুকেছে ওয়াল্টন। ইথিওপিয়ার মোটসাইকেল বাজারে ঢুকেছে রানার মোটরসাইকেল। কেনিয়া, উগান্ডা, মোজাম্বিক, তাঞ্জানিয়া-সহ পূর্ব-আফ্রিকার দেশগুলি ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়াতে বাংলাদেশ তৈরি জাহাজ রপ্তানি হয়েছে। আফ্রিকার অনেক দেশেই ঔষধের বিরাট ঘাটতি রয়েছে, যা আমরা মেটাতে পারি। আমাদের ঔষধে আফ্রিকার মানুষের জীবন বাঁচলে সেটা আমাদের সাফল্যের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় দিক হবে। আমাদের কৃষি প্রযুক্তি আফ্রিকার খাদ্য-সংকট মেটাতে সহায়তা করতে পারে। নির্মাণ সামগ্রী তৈরিতে আমরা অগ্রগতি করতে পেরেছি; তাই আমরা সেক্ষেত্রে আফ্রিকাকে প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে পারি। আমরা নদীর দেশের মানুষ হওয়ায় পশ্চিম আফ্রিকার নিজের নদী, মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো নদী এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার নীল নদে আমরা আমাদের নদীব্যবস্থাপনা এবং নৌ-পরিবহণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। বর্তমানে কঙ্গো নদে না থাকলেও নীল নদ (দক্ষিণ সুদান) এবং নিজের নদীতে (মালি) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দু’টি কনটিনজেন্ট কাজ করছে।
    
ভূগোলের সাথে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে আজকে আফ্রিকার গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের আলাদাভাবে চিন্তা করতে হচ্ছে। অথচ ভূগোল পড়লে খুব সহজেই বোঝা হয়ে যেত যে আফ্রিকাকে ছাড়া আমরা সামনের দিনগুলিতে হোঁচট খাবো।

আর আমাদের যেগুলি নেই, তা আফ্রিকাতে রয়েছে ভুরি ভুরি। বাংলাদেশ আস্তে আস্তে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতের দিকে যাচ্ছে। আফ্রিকা এক্ষেত্রে আমাদের সহায়ক হতে পারে কয়লা সরবরাহ করে। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মোজাম্বিক থেকে কয়লা আমদানির বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। আর আমাদের নতুন গঠিত ভারী শিল্পগুলিতে লোহা সরবরাহ করার জন্যে গিনি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা হতে পারে ভালো একটি উতস। ছোট্ট দেশ গিনিতে রয়েছে ১৮০ কোটি টন লোহার খনি! উপরন্তু সারা দুনিয়ার ২৫% বক্সাইট (এলুমিনিয়ামের খনি) রয়েছে এই দেশেই! গিনির প্রতিবেশী দেশ সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া এবং আইভোরি কোস্টে আমাদের সৈন্যরা শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করছে বহু বছর ধরে। এছাড়াও আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর খনি আফ্রিকাতে প্রচুর রয়েছে, যেমন কঙ্গো ও জাম্বিয়ার কপার (তামা), কঙ্গোর জিঙ্ক (দস্তা), দক্ষিণ আফ্রিকার নিকেল ও ক্রোমিয়াম, কঙ্গো, জাম্বিয়া এবং ক্যামেরুনের কোবাল্ট, ইত্যাদি। বাংলাদেশ সামনের দিনগুলিতে যেদিকে এগুতে চাইছে, তাতে আফ্রিকার খনিগুলি আমাদের জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় হবে। বাংলাদেশের বাইরে কোন এলাকায় যদি বিনিয়োগ করতে হয়, সেক্ষেত্রে আফ্রিকা হওয়া উচিত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকায় বিনিয়োগই পারবে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে কৌশলগত পণ্যগুলির সরবরাহ নিশ্চিত করতে।

এক মহাদেশ; অনেক করণীয়……

১. সামনের দিনগুলিকে চিন্তা করে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা ডেস্ককে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আফ্রিকাতে আমাদের মিশনগুলিকে সকল দিক থেকে শক্তিশালী করতে হবে। ভালো নেগোশিয়েটরদেরকে আফ্রিকায় পোস্টিং দিতে হবে। আফ্রিকায় পূর্ব অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত লোকদের প্রাধান্য দিতে হবে।
   
আফ্রিকায় আমাদের হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন থাকলেও সেই সৈন্যদের নিরাপত্তা এবং সেই দেশগুলিতে বাংলাদেশীদের এবং তাদের কর্মকান্ডের নিরাপত্তা দেবার কথা আমরা চিন্তাই করিনি। আফ্রিকাতে আমাদের কর্মকান্ডের ব্যাপকতাই আমাদের একটা 'আফ্রিকা কমান্ড' তৈরির দিকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।

২. বহু বছর যাবত আফ্রিকাতে বাংলাদেশের আট থেকে নয় হাজার সৈন্য মোতায়েন রয়েছে, কিন্তু আমাদের সামরিক বাহিনীতে কোন ‘আফ্রিকা কমান্ড’ নেই। আফ্রিকাতে কর্মরত আমাদের সৈন্য এবং সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং লজিস্টিক্যাল ব্যাকআপ দেবার ব্যবস্থা করতে এর কোন বিকল্প নেই।

৩. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা ডেস্ক, সামরিক বাহিনী আফ্রিকা কমান্ড এবং শিল্পক্ষেত্রে আফ্রিকাতে বাণিজ্য করতে ইচ্ছুক কর্পোরেটদের কৌশলগতভাবে এক লক্ষ্যের ছত্রছায়ায় বিবেচনা করে ঢালাওভাবে সাজাতে হবে। এই কাজটাকে শক্ত ভিত্তি দিতে ‘আফ্রিকা স্টাডি গ্রুপ’ তৈরি করতে হবে, যেখানে থাকবে আফ্রিকা থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা নেয়া সামরিক সদস্যরা, কূটনীতিকেরা, বাণিজ্য প্রতিনিধিরা, শিক্ষাবিদেরা এবং আরও অনান্য সদস্যরা। এরা আফ্রিকা আফ্রিকার উপরে গবেষণা ছাড়াও আমাদের অভিজ্ঞতাকে আরও তীক্ষ্ণ করবেন এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে পরামর্শ দেবেন। আফ্রিকা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাকে তারা মানুষের মাঝে ছড়াবেন বই-পুস্তকের মাধ্যমে, পত্র-পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে, বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারণী সংগঠন এবং ব্যবসায়িক সংগঠনে তারা কথা বলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবেন।

৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভূগোল না পড়ার দৈন্যদশা নিয়ে এর আগেও লিখেছি। আফ্রিকার ভূগোলকে নখদর্পনে আনতে হবেবিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আফ্রিকা সম্পর্কে পড়াতে হবে। বিজনেস স্কুলগুলিতে ছাত্রদের Strategic Perspective দিতে হবে; বোঝাতে হবে যে আফ্রিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকা নিয়ে কেইস স্টাডি দিতে হবে ছাত্রদের; শিখতে হবে আফ্রিকায় ব্যবসা এগিয়ে নিতে কি করতে হবে। সোশাল সাইন্সে আফ্রিকা সম্পর্কে পড়াতে হবে। আফ্রিকার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। আফ্রিকায় অভিজ্ঞতাসম্পন্নদেরকে গেস্ট লেকচারার হিসেবে নিয়ে আসতে হবে; সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে আফ্রিকা নিয়ে।

৫. কর্পোরেটদের মাঝে আফ্রিকার গুরুত্বটা ছড়াতে হবে, যাতে তাদের অফিসেও ‘ম্যানেজার, আফ্রিকা বিজনেস’ নামে কেউ একজন থাকেন, যার কাজই হবে আফ্রিকার পেছনে ছোটা।
    
পূর্ব আফ্রিকার দেশ তাঞ্জানিয়ার জন্যে তৈরি করা ক্যাটামারান জাহাজ পরিবহণ করা হচ্ছে। আফ্রিকাতে বাংলাদেশের ছোটখাটো একটা ব্যবসায়িক ভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে কিছু কর্মকান্ডের মাঝ দিয়ে। এর সাথে যোগসূত্র দরকার আফ্রিকা থেকে আমরা কি কি পেতে পারি সেটার। আর সেটার জন্যে আফ্রিকার সাথে যোগসূত্র তৈরি করবে আমাদের বাণিজ্যিক জাহাজের বহর। এটা এই ২০১৬ সালে বুঝতে না পারলে একসময় বুঝতে পারবো যে ২০১৬ সালে আমরা ভুল করেছিলাম। 
৬. আফ্রিকা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে; তাই এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সাথে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন হয়ে পড়ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে আমাদের কোন জাহাজ নেই। একারণেই এর আগের এক লেখায় আফ্রিকার বন্দরে আমাদের জাহাজের প্রতিযোগিতা নিয়ে লিখেছিলাম। ২০১৬ সালের শেষে এসে যদি আমরা আমাদের জাহাজগুলি অর্ডার করতে না পারি, তাহলে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি চালু হবার সময়ে আমাদের হাতে কোন জাহাজ থাকবে না। এই বিদ্যুতকেন্দ্রগুলিতে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা লাগবে; যা আনতে লাগবে প্রচুর জাহাজ। কয়লা আনা-নেয়ার জন্যে ২০ থেকে ৫০ হাজার টনের জাহাজ যেমন লাগবে, তেমনি এগুলি থেকে কয়লা খালাশ করে নদীতে পরিবহণ করতেও লাগবে শত শত লাইটার জাহাজ। এগুলির জন্যে কাজ এখনই শুরু করতে হবে, নাহলে অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে।

৭. বাংলাদেশে অনেক আফ্রিকান লোকেরা বসবাস করছেন। তারা পড়াশোনা করতেই হোক, আর ফুটবল খেলতেই হোক, তাদের কিছু অভিজ্ঞতা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সামরিক একাডেমিগুলিতেও আফ্রিকান সামরিক সদস্যরা ট্রেনিং পাচ্ছেন। এই লোকগুলিকে আফ্রিকার সাথে ব্রিজ হিসেবে ব্যবহার করার একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। এদেশের রাস্তায় আফ্রিকার কালো মানুষগুলিকে বাংলাদেশের মানুষ দূরের মহাদেশের মানুষ হিসেবেই দেখে; ভারতীয়দের মতো রাস্তায় বর্ণবাদী আচরণ করে না। মুসলিম হবার কারণে আমরা এব্যাপারে সাংস্কৃতিক দিক থেকে এগিয়ে আছি। আমাদের জন্যে কালোদের সাথে মেশাটা অপেক্ষাকৃত সহজ।

৮. আফ্রিকা সাথে নেটওয়ার্ককে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে দরকার হবে শক্তিশালী নৌবাহিনী, এবং দরকার বিশেষে সেনা ও বিমান বাহিনী। নিরাপত্তা দিতে না পারলে যে কেউ আমাদের কৌশলগত এই লাইফলাইন কেটে ফেলতে পিছপা হবে না। আফ্রিকা মিশনগুলিরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর বলাই বাহুল্য যে শক্তিশালী ইন্টেলিজেন্সের উপস্থিতি ছাড়া উপরের কোনটিই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

আফ্রিকার কৌশলগত গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হলে আমাদের সামনের দিনগুলিতে অনেক বাজে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। একুশ শতকে পৃথিবীর কোন স্থান আর দূরে নেই; আর আমরা বটমলেস বাস্কেট নই যে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কি? আসলে ব্রিটিশদের ঢুকিয়ে দেয়া সেই চিন্তা আজ আর খাটেনা। আদার ব্যাপারীও খোঁজ রাখে দুনিয়ার কোথায় আদার মূল্য কত।

আফ্রিকার কাছে আমরা অনুকরণীয়, পশ্চিমা বিশ্ব নয়। আফ্রিকানরা জানে পশ্চিমারা কিভাবে যুগের পর যুগ সেই মহাদেশে যুদ্ধ বাধিয়ে রেখে খণিজ সম্পদ শোষণ করেছে। আফ্রিকানরা বরং হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতেই বেশি আগ্রহী। তারা আমাদেরকেই অনুসরণ করতে চায়। আমাদের সৈন্যরা সেই মহাদেশে আমাদের একটা দিককে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে এসেছে, যেখান থেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের সকলের। কর্পোরেট হাউজগুলির কাছে আফ্রিকার গুরুত্ব আরও বাড়তে হবে; কৌশলগত দিকটা না ধরতে পারলে ব্যবসা করবেন কি করে তারা? অন্যের বাড়িয়ে বুয়া হিসেবে খাটার সময় আমাদের আর নেই; একুশ শতক আমাদেরকে সেই ভুলকে শোধরানোর সুযোগ দেবে না। আমাদের প্রতিবেশীরা আফ্রিকাতে আমাদের আগে ঢুকে সেখানকার দরজা আমাদের জন্যে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করবে। তাই আমাদের শক্তি দিয়েই ঢুকতে হবে।

Saturday 3 September 2016

আমরা হেরে যাওয়া দলের খেলোয়াড় হতে চাই না

৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৬

  
রোম সাম্রাজ্যের থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে, যা কিনা আজকের দুনিয়ার জন্যে প্রযোজ্য। কিন্তু আমাদের মাথায় একটা উদ্ভট চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে ইতিহাস মানেই "ব্যাকওয়ার্ড" বা "আউটডেটেড"


‘ব্যাকওয়ার্ড’ সময়ের কিছু উদাহরণ

খ্রীষ্টপূর্ব ২৬৪ সাল। ইতালির দক্ষিণে সিসিলি দ্বীপের মেসিনা শহরের মারমেনটাইন রক্ষাকর্তারা সিরাকিউজের (সিসিলির আরেক শহর) রাজা হিয়েরোর থেকে বাঁচার জন্যে শক্তিশালী কার্থেজ রাজ্যের (বর্তমান উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়াতে ছিল যার ঘাঁটি) বাড়ানো সাহায্যের হাত ধরে ফেললেন। কার্থেজরা যেই না হিয়েরোকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠালেন, ঠিক তখনই মারমেনটাইনরা বুঝতে পারলেন যে কার্থেজরাই যে এখন মেসিনার প্রভূ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন বিপদ কার্থেজদের থেকে বাঁচার জন্যে এবার মারমেনটাইনরা রোমান সিনেটের সরণাপন্ন হলেন। রোম তখনও প্রজাতন্ত্র এবং উঠতি শক্তি; সাম্রাজ্য হয়ে ওঠেনি। রোমান সিনেটে আলোচনার পরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, যা কিনা পরবর্তীতে রোম এবং কার্থেজের যুদ্ধে রূপ নেয় এবং দুনিয়ার ইতিহাস পরিবর্তন করে। এবার আরও ৪৪ বছর পরে খ্রীষ্টপূর্ব ২২০ সালের কথা। স্পেনের সেগুনটাম শহরে কার্থেজ জেনারেল হ্যানিবল (Hannibal Barca) হামলা করলে সেগুনটাম সাহায্য চাইলো রোমের কাছে। রোম হ্যানিবলের কর্মকান্ডকে তাদের স্বার্থের বিরূদ্ধ হিসেবে দেখলো; আবারো যুদ্ধ শুরু।

উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলি দু’টি বিখ্যাত যুদ্ধের শুরুর ঘটনা। যুদ্ধদু’টি প্রথম ও দ্বিতীয় পুনিক বা কার্থেজ যুদ্ধ (First and Second Punic Wars or Carthage Wars) নামে ইতিহাসে পরিচিত। বর্তমান থেকে দুই হাজার বছরের বেশি পুরোনো হলেও এখান থেকে শেখার অনেক কিছু রয়েছে। যুদ্ধদু’টি রোমকে একটা শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত করে। বর্ণিত ঘটনাগুলি যুদ্ধের পূর্বাভাস দিলেও যেটা চোখ এড়িয়ে যায়না তা হলো ভূমধ্যসাগরের ছোট দেশগুলির কর্মকান্ডে রোম এবং কার্থেজের মতো শক্তিশালী দেশের নাক গলানোর বিষয়, এবং ছোট দেশগুলির মেরুদন্ডহীন নেতৃত্বের বিপদে পড়লেই আশেপাশের শক্তিশালী রাজধানী শহরগুলিতে সাহায্যের জন্যে দৌড়ে যাওয়া। চব্বিশ বছর এবং আঠারো বছর ধরে চলা ওই যুদ্ধদু’টিতে কার্থেজের শোচনীয় পরাজয়ের সাথে সাথে রোমের সাথে আশেপাশের দেশগুলির এধরণের নির্ভরশীলতার সম্পর্ক বাড়তেই থাকে। এই নির্ভরশীলতার সম্পর্কই রোমকে শক্তিশালী করতে থাকে। খ্রীষ্টপূর্ব ১৯৯ সালে গ্রীক রাজ্যগুলির কোন্দলের মাঝে পারগামামের (বর্তমান তুরস্কের মাঝে একটা রাজ্য) রাজা প্রথম এট্টালাস রোমকে যুদ্ধে ডেকে আনে। এর ফলশ্রুতিতে গ্রীক রাজ্যগুলি রোমের হাত থেকে আর কখনোই বের হতে পারে না। খ্রীষ্টপূর্ব ১৯২ সালে রাজা তৃতীয় এন্টিওকাসকে ঠেকাতে ইটোলিয়ান লীগের পক্ষে যুদ্ধে নামে রোম। খ্রীষ্টপূর্ব ১৭১ সালে রোম মেসিডোনিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে আবারো সৈন্য পাঠায়। তিন বছর পরে যুদ্ধ শেষে রোমানরা মেসিডোনিয়ার নেতৃত্ব দেবার মতো সকলকে নির্মূল করে এবং দেশটাকে চার ভাগে ভাগ করে ফেলে। খ্রীষ্টপূর্ব ১৪৯ সালে আন্দ্রিসকাস নামে একজন মেসিডোনিয়াকে একত্রিত করার চেষ্টা করলে রোমানরা আবারো সৈন্য প্রেরণ করে। এই যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে রোমানরা মেসিডোনিয়াকে সামরিকভাবে দখল করে সেখানে স্থায়ীভাবে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে রাখে। এর আগের প্রতিটি যুদ্ধের শেষেই রোমানরা সৈন্য সরিয়ে নেয়। মেসিডোনিয়ায় অবস্থিত এই বাহিনীই পুরো এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে এবং বিভিন্ন সময়ে গ্রীকদের সমস্যাগুলিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে থাকে। গ্রীকদের স্বার্থপরতা এবং নিজেদের মাঝে শত্রুতার সম্পর্ক রোমকে সবসময়েই হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছে। তাই কয়েকটি যুদ্ধের পরে প্রত্যেকটি গ্রীক রাজ্যে রোমানদের নিজস্ব লোক বসাতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। তারা বিপদের গন্ধ পাবার মুহূর্তেই রোমের সিনেটের সরণাপন্ন হতো। এদের সকলের সার্বভৌমত্ব থাকতো রোমের হাতে। রোমানরা হয়ে ওঠে ওই এলাকার ‘পুলিশম্যান’। আসলে তারা পুরো ভূমধ্যসাগর এলাকারই পুলিশম্যান হয়ে দাঁড়ায়। রোমের মানচিত্রে আমরা কিন্তু এই এলাকাগুলিই দেখি।
   
আজকের বিশ্বে মার্কিন সামরিক শক্তির মানচিন্ত্র দেখলে রোমান সাম্রাজ্যের মানচিত্রের কথাটাই মনে পড়ে যায়। এটা একুশ শতকের রোমের মানচিন্ত্র। (উল্লেখ্য যে এই মানচিত্রে সোমালিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ সুদানসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশকে দেখানো হয়নি। আর বিভিন্ন দেশের সাথে মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং ঘাঁটি করার অধিকারের চুক্তি দেখানো হয়নি)

‘মডার্ন’ সময় যেন ‘ব্যাকওয়ার্ড’ সময়েরই প্রতিচ্ছবি

যাই হোক, আজকাল আমাদের মনের মাঝে এমন একটা চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এখন চলছে ‘মডার্ন’ যুগ; পুরোনো যুগ হচ্ছে ‘ব্যাকওয়ার্ড’ এবং ‘অন্ধকারের যুগ’; সেখান থেকে শেখার কিছু নেই। কিন্তু এই চিন্তা যে কতটা ভুল, সেটা কয়েকটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেন কুয়েতকে দখল করে নিলে সৌদি সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে ডেকে আনে। সেই যুদ্ধের পর থেকে সৌদি আরব থেকে ঘাঁটি সরিয়ে নিলেও কুয়েত, বাহরাইন এবং কাতারে যুক্তরাষ্ট্র বিরাট সামরিক ঘাঁটি রেখে চলেছে, যেখান থেকে যেকোন দিকে হামলা চালানো যায়। ২০০১ সালে বিন লাদেনকে তাড়া করার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এসে হাজির হয় এবং নিজেদের সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে। পনের বছর পরে এখনও যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সৈন্য মোতায়েন রেখেছে। আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপের সময় কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান এবং পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। কিরগিজস্তানের ঘাঁটি আজও আছে। আর আফগানিস্তানের ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও হামলা হয়ে থাকে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র নির্মূলের অজুহাতে ইরাক হামলা করে সরকার পরিবর্তন করে। এক যুগ পরে এখনও ইরাকী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে চলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সন্ত্রাসীদের আটকানোর অজুহাতে পশ্চিম আফ্রিকার মালিতে হস্তক্ষেপ করে ফ্রান্স, আর তাতে লজিস্টিক সাপোর্ট দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর এরকম উদাহরণগুলির মাঝে সবচাইতে বড়টি হচ্ছে সিরিয়া, যেখানে অত্যাচারী প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সকল তাঁবেদার সরকারকে একত্র করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে; এমনকি ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী রাশিয়াকেও তাদের পক্ষে যুদ্ধে জড়াতে সক্ষম হয়েছে। আর দুনিয়াব্যাপী দখলদারিত্ব কায়েম করতে কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, কিরগিজস্তান, জিবুতি, দিয়েগো গার্সিয়া, ওকিনাওয়া, কোরিয়া, ইত্যাদি স্থানে যুক্তরাষ্ট্র খোলাখুলিভাবে বড় ধরনের সামরিক ঘাঁটি ছাড়াও আরও বহু স্থানে ড্রোন এবং স্পেশাল ফোর্সের ঘাঁটি চালনা করছে চুপিসারে। চুক্তি সই করার মাধ্যমে যেকোন দেশের সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারছে, বা যেকোন দেশের সামরিক বাহিনীকে ট্রেনিং দেয়ার নাম করে তাদের উপরে নিজেদের intellectual leadership প্রতিষ্ঠা করতে পারছে [1], বা ‘শান্তিরক্ষা’র কথা বলে আফ্রিকার যেকোন স্থানে যেকোন দেশের সৈন্যবাহিনীকে দিয়ে নিজেদের কাজ করিয়ে নিচ্ছে [2], অথবা চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জাপান, কোরিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে।[3] রোমান সিনেটের চাতুরীর মতো যুক্তরাষ্ট্রও অনেক দেশের জাতীয়তাবোধকে উস্কে দিয়ে বিভক্ত এবং অপেক্ষাকৃত কম শক্তির অনেক দেশ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারগুলির নেতৃত্ব কিছু ঘটার আগেই ওয়াশিংটনের দ্বারে ধর্ণা দেয়। ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসির অনেক উদাহরণই দেওয়া সম্ভব; স্থান সংকুলান না হবার ভয়ে দিচ্ছি না।

রোমের ইতিহাস লিখতে গিয়ে খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের রোমের মানচিত্রে যদি রোমের উপরে নির্ভরশীল গ্রীক রাজ্যগুলিকে অন্তর্ভূক্ত দেখানো হয়্‌, তাহলে কোন ধরনের ‘ভদ্রতা’র খাতিরে আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রে তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলি দেখানো হয় না, সেটা বলা দুষ্কর। আসলে আমাদের চিন্তা থেকে এই দখলদারিত্বকে সরিয়ে রাখার একটা চমতকার পদ্ধতি হলো মানচিত্রে সবাইকে ‘সার্বভৌম’ হিসেবে দেখানো। বর্তমান দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সত্যিকারের’ মানচিত্র যে সকল বিবেচনায় রোমান এবং মোঙ্গল সাম্রাজ্যের মানচিত্রকে হার মানাবে, সেটা বলাই বাহুল্য। এটাই একুশ শতকের রোমান সাম্রাজ্য!
  
মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জিবিগনিউ ব্রেজিনস্কি যেভাবে মার্কিন আধিপত্ত্বের কথা বলেছেন, সেটা মার্কিন-বিরোধীরাও বলতে পারবেন না। আসলে তিনি শুধু সত্য কথাগুলিই বলেছেন, যা কিনা আমাদের মন অস্বীকার করে শান্তি পেতে যায়। আমরা অনেকেই মার্কিনীদের একুশ শতকের সাম্রাজ্যের নাগরিকত্ব পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করি।

একুশ শতকের রোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি

মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জিবিগনিউ ব্রেজিনস্কি (Zbigniew Brzezinski, বানান ঠিক আছে!) তার বিখ্যাত বই “The Grand Chessboard: American Primacy and Its Geostrategic Imperatives”-এ মার্কিন সাম্রাজ্যের ধরণখানা ব্যাখ্যা করে বলেছেন –

“American global power is exercised through a global system of distinctively American design that mirrors the domestic American experience. Central to that domestic experience is the pluralistic character of both the American society and its political system.”

এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিনীদের নিজস্ব এক ব্যবস্থার মাধ্যমে, যা কিনা তাদের নিজেদের দেশে তারা প্রয়োগ করে থাকে। মার্কিনীরা সারা দুনিয়াতে নিজেদের ব্যবস্থা প্রয়োগ করার মাধ্যমেই দুনিয়ার কর্তৃত্ব করে। এই ব্যবস্থার প্রয়োগ তারা করে থাকে দেশে দেশে প্রভাবশালী কিছু লোককে তাদের নিজেদের পক্ষে কাজ করিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলে। ব্রেজিনস্কি বলছেন, “It likewise relies heavily on the indirect exercise of influence on dependent foreign elites, while drawing much benefit from the appeal of its democratic principles and institutions.” রোমানরাও দেশে দেশে তাদের তাঁবেদার সরকার বসিয়ে তাদের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এই দালালরা বিপদে পড়লেই রোমান সৈন্যবাহিনী হাজির হয়ে যেত!

এ তো গেলো রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কথা। এর বাইরেও রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব। “Cultural domination has been an unprecedented facet of American global power. Whatever one may think of its aesthetic values. America’s mass culture exercises a magnetic appeal, especially on the world youth. Its attraction may be derived from the hedonistic quality of the lifestyle it projects, but its global appeal is undeniable. American television programs and films account for about three-fourths of the global market. American popular music is equally dominant, while American fads, eating habits, and even clothing are increasingly imitated worldwide. The language of the Internet is English, and an overwhelming proportion of the global computer chatter also originates from America, influencing the content of global conversation. Lastly, America has become a Mecca for those seeking advanced education, with approximately half a million foreign students flocking to the United States, with many of the ablest never returning home. Graduates from American universities are to be found in almost every Cabinet on every continent,” বলছেন ব্রেজিনস্কি। এখানে শেষ লাইনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন যে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা লোকজনকে পাওয়া যাবে বহু দেশের সরকারে। এটা কতটুকু গুরুত্ববহ সেটাও তিনি বলে দিচ্ছেন – “American political leaders have become the object of careful study and political imitation.” অর্থাৎ মার্কিন নেতৃত্বকেই দুনিয়ার কাছে উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা হচ্ছে, কেননা, “the American political experience tends to serve as a standard for emulation।” অর্থাৎ মার্কিন নেতাদের কপি করলেই মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কপি করা হয়ে যাবে! রোমের সাথে এই ব্যাপারখানার কতটা মিল – রোমান নাগরিকত্ব পাবার আশায় মানুষ মারামারি করেছে; যুদ্ধ করেছে! আজ যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা দেশে অভিবাসী প্রত্যাশীদের অবস্থা দেখলে কি রোমের কথাই মনে পড়ে না?

ব্রেজিনস্কি অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়েও বলেছেন। “The appeal and impact of the democratic American political system has also been accompanied by the growing attraction of the American entrepreneurial economic model, which stresses global free trade and uninhibited competition.” অর্থাৎ সারা বিশ্বে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মার্কেটিং করার সাথে সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও মার্কেটিং করা হয়েছে। তিনি বলছেন যে এমনকি ইউরোপেও মার্কিন অর্থনৈতিক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সেখানে “মার্কিনীদের নির্দয়রকমের প্রতিযোগিতামূলক সংস্কৃতি”কে অনেকেই নিজেদের মডেল হিসেবে দেখছেন। এমনকি জাপানেও আজকাল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর এই ব্যবস্থার ফলে যার হাতে বেশি অর্থ থাকবে, তার হাতেই থাকবে ক্ষমতা। যার হাতে বেশি ক্ষমতা থাকবে, সে সারা বিশ্বের ব্যবসা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে চাইবে। রোমান সাম্রাজ্যেও ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছিল। রোমান এলিট সমাজ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দেশে দেশে ট্যাক্স কালেক্টরের দায়িত্ব পেত। তারা সেখান থেকে বিরাট অর্থের মালিক হয়ে উচ্চ সুদে (৪৮% পর্যন্ত!!) অর্থ ধার দিত এবং ইতালিতে দাসদের নিয়ে গিয়ে জলপাই চাষ করাতো। সকল কিছুর মালিকানা থাকতো রোমান এলিটদের।

আর উপরে বর্ণিত মার্কিন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কপি করার প্রবণতা জন্ম দেয় বিশ্বব্যাপী মার্কিন একচ্ছত্রবাদের। “As the imitation of American ways gradually pervades the world, it creates a more congenial setting for the exercise of the indirect and seemingly consensual American hegemony.” ব্রেজিনস্কি আরও বলছেন, “American global supremacy is thus buttressed by an elaborate system of alliances and coalitions that literally span the globe.” শেষ কথাটি বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোয়ালিশন, চুক্তি এবং এলাকাভিত্তিক বন্ধুত্ব, যেগুলিকে মার্কিনী আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে এগুলির সদস্য সকল দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা। এর উপরে রয়েছে বিভিন্ন বিশেষ সংস্থা, যার উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর কথা, যেগুলির মাধ্যমে আমেরিকা দুনিয়াতে তার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে।

“America stands at the centre of an interlocking universe, one in which power is exercised through continuous bargaining, dialogue, diffusion, and quest for formal consensus, even though that power originates ultimately from a single source, namely, Washington, D.C.” ব্রেজিনস্কি বলছেন যে সারা বিশ্বে মার্কিনীদের এই সাম্রাজ্য টিকে থাকে সর্বদা দামাদামি করে, কথাবার্তা-আলোচনা চালিয়ে; তারা কাউকেই আলাদা থাকতে দেবে না; সকলকেই ওয়াশিংটনের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করবে। ব্রেজিনস্কি কোন মার্কিন-বিরোধী মানুষ নন; বরং জিমি কার্টারের সরকারে (১৯৭৭-১৯৮১) তিনি ছিলেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার! তার মুখ থেকে কথাগুলি উদ্ভট ঠেকে আমাদের কাছে, কারণ আমরা সকলেই নিজেদের মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন থাকাতে কোন সমস্যা খুঁজে পাইনা। একু শতকের রোমের সিটিজেন হতে পেরে আমরা গর্বিত বোধ করি।
   
মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ রবার্ট ক্যাপলান একুশ শতকে মার্কিন আধিপত্য ধরে রাখার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে রোমান সাম্রাজ্য থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন। রোমান সাম্রাজ্যের মতো যেন মার্কিন সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে না যায়, সেজন্য তিনি থিউরি দিচ্ছেন। কিন্তু যা বলার তা কিন্তু বলা হয়েই গেছে - মার্কিন সাম্রাজ্য আজ মুমূর্ষু!

যা উপরে ওঠে, তা নিচেও নেমে আসে

আজকের লেখাটা রোমান সাম্রাজ্য দিয়ে শুরু করেছি, তার কারণ মার্কিন সাম্রাজ্যের সাথে রোমের মিল রয়েছে। এই মিল বহু ক্ষেত্রেই রয়েছে। তবে যেখানে রোমের পতন হয়েছে, সেখানে মার্কিনীরা এখনও দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানেই আসল মজাটা – রোমের পতন আমাদের শেখায় যে কেউই সারাজীবন উপরে থাকে না। মার্কিনীদের নেতৃত্বে পশ্চিমা সভ্যতা যে ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থায়, তা নিয়ে এর আগে লিখেছি। এবার সেটা নিয়ে আরেকজন মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদের উদ্ধৃতি দেব। বলা বাহুল্য যে তিনিও কিন্তু ব্রেজিনস্কির মতোই মার্কিন-বিরোধী লোক নন, বরং তিনি ওয়াশিংটনে অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি – রবার্ট ডি. ক্যাপলান।

রবার্ট ক্যাপলান তার “The Revenge of Geography: What the Map Tells Us about Coming Conflicts and the Battle Against Fate” বইতে একজন ইতিহাসবিদের এক থিউরির উল্লেখ করেছেন মার্কিন সাম্রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখার একটি কৌশল খুঁজতে। বলাই বাহুল্য যে তিনি কিন্তু আমাদের মতো দু’হাজার বছর আগের ইতিহাসকে ‘ব্যাকওয়ার্ড’ বলে ফেলে দেননি! তিনি এডওয়ার্ড এন. লুটওয়ার্কের লেখা বই “The Grand Strategy of the Roman Empire: From the First Century A.D. to the Third” থেকে বলছেন যে রোমান সাম্রাজ্য তিনটি আলাদা ধাপ পার করেছে –

প্রথম ধাপে, রোমের সর্বোচ্চ সময়ে সকলে রোমকে ভয় করতো। তখন রোম তার শক্তিকে হিসেব কষে ব্যবহার করতো। একটা বড় সৈন্যবাহিনী তারা পুষে রাখতো ইতালিতে, যাদেরকে দরকারবিশেষে ভূমধ্যসাগরের যেকোন এলাকায় মোতায়েন করা হতো।

দ্বিতীয় ধাপে, রোম তার শক্তি হারাতে শুরু করেছে। তখন পুরো ভূমধ্যসাগর জুড়ে রোমানদের সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে রাখতে হতো।

তৃতীয় ধাপে, রোমানদের সাম্রাজ্য বাঁচানো হয়ে দাঁড়ায় মূখ্য কাজ। রোমের সীমানায় প্রচুর সৈন্য মোতায়েন রাখতে হচ্ছিল আক্রমণকারী জার্মানিক লোকদের থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে।

ক্যাপলান মার্কিন সাম্রাজ্যকে রোমের সাথে তুলনা করে বলেছেন যে মার্কিনীরা ঠিক রোমের মতোই প্রথম ধাপ পার করে দ্বিতীয় ধাপে চলেছে। এখন আর তাদের কেউ ভয় পায়না। তাই সারা বিশ্বে, বিশেষত মুসলিম বিশ্বে তাদের প্রচুর সেনা মোতায়েন করে রাখতে হচ্ছে; সর্বদা যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।[3] কারণ সামনের দিনগুলিতে ইসলামকেই মার্কিনীরা তাদের প্রতিস্থাপকরূপে দেখতে পাচ্ছেন। ক্যাপলান ভয় পাচ্ছেন যে মার্কিন মুল্লুক একেবারে দুই মহাসাগরের মাঝখানে হলেও তার সাথে বিশাল স্থল সীমান্ত রয়েছে মেক্সিকোর, যেখান থেকে কোন এক সময় মার্কিনীদের শেষ ঘন্টা বেজে যেতে পারে। মেক্সিকানরা যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোতে ঢুকে পড়ছে বহুদিন থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে অনেকেই স্প্যানিস ভাষা বলে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও মেক্সিকো আগামী কয়েক দশকে মার্কিনীদের মাথাব্যাথার কারণ হবে। ব্রেজিনস্কি যেমন বলেছিলেন যে সকলে মার্কিন নাগরিক হতে চায় – সেটাই মার্কিন সাফল্য; ঠিক এটাকেই ক্যাপলান বলছেন যে সামনের দিনগুলিতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ক্যাপলান বলছেন যে মেক্সিকানরা মার্কিনীদের রোমের মতো তৃতীয় ধাপে নিয়ে যেতে পারে, যখন মেক্সিকোকে নিয়েই মার্কিনীদের ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই তিনি চিন্তা করছেন যে কি করে যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় স্টেজেই ধরে রাখা যায়, অথবা উল্টো ঘুরিয়ে প্রথম স্টেজে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা।

এর আগে আমি আলফ্রেড মাহানের থিউরি নিয়ে লিখেছিলাম। মাহানের থিউরি মার্কিনীদের জন্যে দরকার ছিল যখন তারা তাদের সাম্রাজ্যকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু সেই দিন মার্কিনীদের আর নেই। ক্যাপলান বলছেন যে মাহানকে অনুসরণ না করে মার্কিনীদের অনুসরণ করতে হবে ব্রিটিশ জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট জুলিয়ান করবেটকে। করবেট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্যে তার থিউরি দিয়েছিলেন এমন এক সময়ে, যখন ব্রিটিশদের শক্তি কমে যাচ্ছিল। তিনি ব্রিটিশদেরকে মার্কিন এবং জাপানিদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে বন্ধুদের শক্তিকে নিজেদের কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। আজকে মার্কিনীরাও ক্যাপলানের কথামতো সেটাই করছে। সারাবিশ্বে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করে বন্ধুদের শক্তিকে তারা কাজে লাগাচ্ছে। তবে তাদের সবচাইতে বড় সমস্যা হলো বন্ধুরাও আজ জানে যে মার্কিনীদের সেই শক্তি আজ আর নেই।[4] তাই তারাও মার্কিনীদের সাথে যথাসম্ভব দরকষাকষি করে চলে। এই মুহূর্তে পুরোপুরি না হলেও খুব শিগগিরই এমন সময় আসতে যাচ্ছে যখন মার্কিনীদের একার পক্ষে বড় কোন যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখনই দুনিয়াতে মার্কিনীদের চাওয়ার বাইরে বহুকিছু হয়ে যাচ্ছে, যা একসময় চিন্তাই করা যেত না। ব্রেজিনস্কির “The Grand Chessboard” প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে; আর ক্যাপলানের “The Revenge of Geography” প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালে। দু’টা বই ইতিহাসের সাক্ষী যে মার্কিন শক্তি এই সময়ের মাঝে কতটা কমে গেছে।

হেরে যাওয়া দলে কেনো থাকবো?

বাংলাদেশে ফুটবলের করুণ অবস্থা কেন হলো? বহু লোকই তো রাত জেগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখে। তাহলে তারা দেশের ফুটবলে কেন আগ্রহী নয়? দেশের ফুটবলের মান খারাপ বলে? মান খারাপের অর্থটা আসলে কি? অর্থটা হলো এরা জিততে পারে না। এরা জিততে পারে না; তাই মানুষ এদের খেলা দেখা ছেড়ে দিয়েছে। ক্রিকেটে বাংলাদেশ অনেক খেলাই জিততে পারে; তাই ক্রিকেট এখন সেইরকম ক্রেইজ। এটা হচ্ছে একটা মানুষের চিরায়ত এক স্বভাব – সে জিততে চায়; হারতে চায় না।

উপরে এত্তোএত্তো লেখা লিখেছি এই গল্পটা বলবো বলেই। মানুষ হেরে যাওয়া দলে থাকতে চায় না। মার্কিনীদের তোয়াজ করে চলার দিন শেষ। তাদের ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতাকে আজ স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে মৃতপ্রায় ধনকুবেরকে মাঝে মাঝে কিছু মহিলা বিয়ে করে সম্পত্তির লোভে। আশা করি আমরা সেরকম কিছু চিন্তা করছি না। আমরা হেরে যাওয়া দলের খেলোয়াড় হতে চাই না। কোন দল জিততে যাচ্ছে, সেটা মার্কিনীরা জানে। তাই তাদেরকে আটকাতেই তাদের দিবারাত্র পরিশ্রম



[1] ‘মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ২২শে অক্টোবর ২০১৫

[2] ‘পূর্ব আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ছদ্মযুদ্ধ’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ২৮শে জুলাই ২০১৬

[3] ‘জাপানি নৌশক্তির উত্থানের নেপথ্যে’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ২৮শে এপ্রিল ২০১৬

‘চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৬ই জুন ২০১৬

[4] ‘প্রশ্নের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৬