Sunday 30 October 2016

আর্জেন্টিনার মেসির মুখে বাংলার বাঘ?

৩০শে অক্টোবর ২০১৬
তারা জানবে একুশ শতকের বাঘের নাম, যে কিনা শুধু গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ত্রাসই নয়, মহাসমুদ্র সাঁতড়ে দুনিয়ার অপর প্রান্তে গিয়ে তার অবস্থান জানান দিতে পারে!



চিন্তার নিয়ন্ত্রণ


বাংলাদেশকে এদেশের মানুষ কেমন দেশ হিসেবে তুলে ধরবে, সেটা নির্ভর করবে দেশের মানুষ দেশ সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে কি বিশ্বাস করে। অর্থাৎ নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করে। এই মূল্যায়ন কিভাবে হবে, সেটা নির্ভর করবে দেশের সমাজ দেশের মানুষকে কি ধরনের চিন্তা দিচ্ছে। চিন্তাকে মানুষের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াটা অনেকভাবেই করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে মিডিয়া যেন সবসময় এগিয়েই থাকে। ঊনিশ শতকে ছাপা মিডিয়া আসার পর, আর বিংশ শতকের শুরুতে ইলেকট্রনিক মিডিয়া আসার পর মিডিয়ার গুরুত্ব শুধুই বেড়েছে। আর মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারার ক্ষমতা মিডিয়াকে শুধু শক্তিশালীই করেনি, তৈরি করেছে শক্তিশালী জাতি-গোত্র-ব্যক্তির যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে। মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলে দিনরাত যুদ্ধ। যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা চায় না মিডিয়া তাদের চিন্তা ছাড়া অন্য কোন চিন্তা প্রচার করুক, আর যারা ক্ষমতা থেকে দূরে, তারা চায় মিডিয়ার দখল নিতে। বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরে নয়; তাই বাকি পৃথিবীর নিয়মকানুন (সে যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন) বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। এলাকাভিত্তিক এবং দেশভিত্তিক পার্থক্য থাকলেও মূলতঃ পার্থক্য সামান্যই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে আমরা একই ধরনের চিন্তার প্রসার দেখি। খুব কম মানুষই প্রশ্ন করে যে একই চিন্তা মানুষের মাঝে এলো কোত্থেকে? একটা সুন্দর ব্যাখ্যা অবশ্য দাঁড় করানো হয়ে থাকে, যাকে আদর করে নাম দেয়া হয়েছে গ্লোবালাইজেশন। অবশ্য যারা এর সৃষ্টি করেছেন, আজ তারাই প্রশ্ন তুলছেন যে এটা কার নিয়ন্ত্রণে। নিয়ন্ত্রণ – সেটাই কি আসল উদ্দেশ্য ছিল না? সেটা নিয়েই আজকের এই কথা।

কিছু শক্তিশালী মিডিয়া আমাদের দেশে এই নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ডই করে যাচ্ছে। মানুষকে নিয়ন্ত্রণমূলক চিন্তা দিলে মানুষ নিয়ন্ত্রণে থাকবে – এটাই হলো মূল কথা। মানুষের চিন্তার একটা লিমিট ঠিক করে দেয়া। যারা সৃজনশীল কাজ করেন, তারা হয়তো মনে করতে পারেন যে অনেক ক্রিয়েটিভ কাজ করার সুযোগ তারা পাচ্ছেন। তবে ব্যাপারটা আসলে কি তাই? একজন সৃজনশীল মানুষকে যখন বলা হচ্ছে কিছু একটা ডিজাইন করে দিতে, তিনি তার সবটুকু সৃজনশীলতা নিংড়ে সেটা ডিজাইন করে দিচ্ছেন। খুব ভালো কথা; ক্রিয়েটিভ আউটপুট। কিন্তু তিনি একবারও প্রশ্ন করেননি যে, যেটা নিয়ে ডিজাইন করতে বলা হলো, সেটাকে কেন নির্বাচন করা হয়েছে। এই প্রশ্নটা যাতে তিনি না করেন, সেই ব্যবস্থাটার নামই হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ। আমাদের দেশের বেশ কিছু শক্তিশালী মিডিয়া সেই কাজটাই করে।

প্রতিদিনের সকালটা নষ্ট করে দেয়া…

প্রায় প্রতিদিনই একটা করে খবর আসে, যা কিনা মানুষের প্রতিদিনের সকালটা নষ্ট করে। একটা মানুষ যখন সকালে একটা বাজে চিন্তা দিয়ে দিন শুরু করে, তার সারাদিন কেমন যাবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা মানুষের সকালটায় তার চিন্তার ভিত্তিটাকে দুর্বল করে দেয়া গেলে সে সারাদিন আর শক্তিশালী কোনকিছু দিতে পারবে না – এটাই হলো সেই চিন্তার ভিত, যদি না সে দিনের মাঝে অন্য কোন উতস থেকে শক্তিশালী কিছু পেয়ে যায়। উদাহরনস্বরূপ, প্রতিদিনই খবর ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন সূচক বা ইনডেক্স নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১১০ নম্বরে, নতুবা ১৪০, অথবা একেবারে ১৭৬। যে মানুষটা এই সূচকে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে সারাদিনে দেশের সম্পর্কে পজিটিভ চিন্তা করতে পারবে না। তার মাথায় শুধু থাকবে আজকের দিনের কাজটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে পারলেই হলো। আগামীকাল বা পড়শু আরও উপরে থাকবো, বা এক মাস পর আজকের অবস্থান থেকে উপরে থাকতেই হবে – এধরনের কোন চিন্তা থাকবে তার জন্যে সেকেন্ডারি। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পদ্ধতি এটা, যার মাধ্যমে আমাদের অবস্থান সবসময় ১১০ বা ১৪০ বা ১৭৬ই থাকবে, কোনদিনই এগুবে না। যদি কখনো এগিয়েই যাই, তাহলে নিয়মগুলি পরিবর্তন করা হবে সূচকে আবারো আগের অবস্থানে ফেরত আনতে। এটাই নিয়ন্ত্রণ।

যা সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয়…

এসব সূচক যাদের তৈরি, তাদের নিজেদের তৈরি করা কিছু সূচকই আবার গোপন রাখা হয়; বাকিগুলি সামনে আনা হয়। যেমন কয়জন জানেন যে বাংলাদেশের অর্থনীতি কাজাকস্তান, গ্রীস, পর্তুগাল, রোমানিয়া, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরী, পেরুর মতো আরও অনেক দেশের অর্থনীতি থেকে বড়? কয়জন জানেন যে ভারত মহাসাগরে সমুদ্রসীমা থাকা দেশগুলির মাঝে কয়টি দেশের অর্থনীতি ২২০ বিলিয়ন ডলার বা তার চাইতে বেশি? আর কয়টি দেশ আছে, যাদের অর্থনীতি ২০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে এবং একইসাথে যাদের জনসংখ্যা ১০০ মিলিয়নের বেশি? কয়টি দেশে বৃষ্টিপাতের আধিক্য আছে এবং একইসাথে তিন-তিনটি প্রধান নদীর সংগমস্থলে তিন-তিনটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে, যা কিনা নদীপথে (সবচাইতে সস্তা যোগাযোগ ব্যবস্থা) দেশের অভ্যন্তরের সাথে সরাসরি সংযুক্ত? কয়টি দেশ আছে পুরো দুনিয়াতে, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে দেশের স্থলভাগ প্রতি বছর বড় হচ্ছে? কয়টি দেশ আছে, যেখানে প্রায় পুরো দেশই চাষযোগ্য? কয়টি দেশের জনগোষ্ঠীকে ভৌগোলিকভাবে ভাগ করা সম্ভব নয় (অর্থাৎ জনগণ কতটা homogenous)? এগুলির সাথে এখন ২২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি যোগ করুন তো? এটাই কি প্রতিদিনের সংবাদ হওয়া উচিত ছিল না?

উপরে যে কয়টি দেশের নাম উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে কাজাকস্তান একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, যার সমুদ্র পর্যন্ত যেতে রাশিয়ার সহায়তা লাগে। হাঙ্গেরী এবং চেক রিপাবলিকেরও একই অবস্থা। রোমানিয়ার খোলা সমুদ্রে যেতে তুরস্কের অনুমতি লাগে। এই দেশগুলির বেশ কতগুলির সামনের দিনের অর্থনীতি আশাব্যাঞ্জক নয়; জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে; অগ্রগতি ঋণাত্মক। আর বাংলাদেশ গত দুই দশকে পিছনে তাকায়নি। সারা দুনিয়ার অর্থনীতি দুইবার উঠেছে, দুইবার নেমেছে; অথচ বাংলাদেশের এতে যেন কিছুই হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব শীঘ্রই ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং চিলির অর্থনীতিকে অতিক্রম করতে যাচ্ছে। আইএমএফ-এর হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি পৃথিবীর ৪৬তম। কিন্তু এখানে আঞ্চলিক ব্যাপারগুলিকে জুড়ে দিলে হিসেব পালটে যাবে। যেমন বাংলাদেশ একইসাথে পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সাথে সমুদ্রপথে সবাসরি যুক্ত এবং এদের সকলের একেবারে মধ্যিখানে। এই অঞ্চলগুলিতে যেতে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক bottleneck বাইপাস করতে পারে। আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে এই সক্ষমতা আরও বাড়বে। বর্তমান দুনিয়াতে ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র হচ্ছে ইউরেশিয়া+আফ্রিকা। বাংলাদেশ এই কেন্দ্রের যতটা কাছে অবস্থিত, ইউরোপ এবং আমেরিকার দেশগুলি সেই তুলনায় দূরে; সরাসরি সমুদ্র যোগাযোগ নেই বা তেমন ভালো নয়। অনেকগুলি আঞ্চলিক bottleneck তাদের অতিক্রম করতে হয়। ভারত মহাসাগর এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মহাসাগর। এই মহাসাগরের সাথে সরাসরি যুক্ত কয়টি দেশের অর্থনীতি ২২০ বিলিয়ন ডলারের উপরে এবং জনসংখ্যা ১৬০ মিলিয়নের উপরে? উপরে যে শক্তিশালী ফ্যাক্টরগুলি উল্লেখ করেছি সেগুলি যোগ করে দিই এর সাথে? এখন এই দেশকে কতটা দুর্বল মনে হচ্ছে?
 
বাংলাদেশে এসে মেসি হয়তোবা তার জনপ্রিয়তাটা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। তবে সেটা বাংলাদেশের প্রমোশনের জন্যে যথেষ্ট কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। মেসিই হতে পারে বাংলাদেশের সেই brand ambassador যাকে আর্জেন্টিনার মানুষ এবং বাংলাদেশের মানুষ উভয়েই পছন্দ করে।

বাংলাদেশের লিওনেল মেসি…

এর আগে আফ্রিকা নিয়ে লিখেছিলাম। আফ্রিকা আমাদের থেকে অনেক দূরে – এটাই হচ্ছে সেই নিয়ন্ত্রণমূলক subversion. প্রকৃতপক্ষে যা আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, তার কোন দূরত্ব নেই, বিশেষতঃ যখন আমাদের ভূকৌশলগত অবস্থান এতটা শক্তিশালী। এই অবস্থানকে অস্বীকার করা মানেই সেই নিয়ন্ত্রকের ফাঁদে পা দেয়া। তারা এটাই চায় – সারাজীবন তাদের পা ধরে বসে থাকতে হবে আমাদের; অথর্ব দেশ; ব্যর্থ রাষ্ট্র। এগুলি গীত শোনার সময় এখন আর আমাদের নাই। এখন সময় চিন্তা করার লিওনেল মেসিকে নিয়ে। মেসির আর্জেন্টিনা থেকে বাংলাদেশের সয়াবিন আসে। ব্রাজিল থেকে আমাদের ৮৬% চিনি আমদানি হয়। চিলি থেকে আসে কপারের একটা অংশ, যা দিয়ে এদেশের সকল প্রকার ইলেকট্রিক্যাল তার এবং যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। বাংলাদেশের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ইকুয়েডরে জাহাজ রপ্তানি করেছে। আরও অনেক সুযোগ অপেক্ষা করছে সেখানে আমাদের জন্যে। মেসি আমাদের কাছে ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিনিধি, যাকে পরিচয় করানোর কিছু নেই। কিন্তু আর্জেন্টিনার মানুষ কি জানে এখানে মেসির জনপ্রিয়তা কতটুকু? ব্রাজিলের মানুষ কি জানে এখানে মানুষ বিশ্বকাপের সময় তাদের দেশের পতাকা তৈরি করে (যদিও বানাতে গিয়ে ভুল হয়)? আমরা আর্জেন্টিনার মানুষের জন্যে মেসিকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করি না কেন, যা আর্জেন্টিনার মানুষের সাথে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেবে? তাদের দেশের মানুষের কাছে বাংলাদেশকে নতুন করে চেনাবার চেষ্টা করি না কেন আমরা? মেসিই হতে পারে বাংলাদেশের সেই brand ambassador যাকে আর্জেন্টিনার মানুষ এবং বাংলাদেশের মানুষ উভয়েই পছন্দ করে।
 
ব্রাজিলের নৌবাহিনীর সাথে আমাদের নৌবাহিনী বেশ কয়েক বছর ধরে লেবাননের উপকূলে কাজ করছে। এতদিনে ব্রাজিলের নৌবাহিনীর প্রায় সবাই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নাম জেনে গেছে। কাজেই যেদিন ব্রাজিলের কোন বন্দরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজের ফ্লোটিলা শুভেচ্ছা সফরে যাবে, সেদিন সেখানে তারা পুরোনো অনেক বন্ধুকেই খুঁজে পাবে। কোটি কোটি টাকা ভারতীয় নর্তক-নর্তকীদের পেছনে না ঢেলে মেসির আর্জেন্টিনাতে আর ল্যাটিন আমেরিকায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শুভেচ্ছা সফরের পেছনে ঢাললে একটা গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-কৌশলগত দুয়ার খুলে যাবে।

আমরা কেন ব্রাজিলিয়ানদের বলি না যে বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশে ফুটবল খেলা নিয়ে যে পাগলামি হয়, সেটা তাদের মিডিয়াতে নিয়ে আসতে? এই দেশগুলির মানুষের কাছে বাংলাদেশকে কিভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেটা আমরা না জানলেও অনুমান করতে পারি – খুব একটা ভালো কিছু না। ব্রাজিলের নৌবাহিনীর সাথে আমাদের নৌবাহিনী বেশ কয়েক বছর ধরে লেবাননের উপকূলে কাজ করছে। এতদিনে ব্রাজিলের নৌবাহিনীর প্রায় সবাই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নাম জেনে গেছে। কাজেই যেদিন ব্রাজিলের কোন বন্দরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজের ফ্লোটিলা শুভেচ্ছা সফরে যাবে, সেদিন সেখানে তারা পুরোনো অনেক বন্ধুকেই খুঁজে পাবে। ব্রাজিলের নৌবাহিনী অনেক পুরোনো; তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ওই এলাকা সম্পর্কে শিখতে পারবো। আর একইসাথে আমাদের দেশের নাম সেখানে জানিয়ে আসা ছাড়াও আমাদের দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প সম্পর্কে ল্যাটিন আমেরিকায় একটা জানান দিয়ে আসতে পারবো আমরা। কোটি কোটি টাকা ভারতীয় নর্তক-নর্তকীদের পেছনে না ঢেলে মেসির আর্জেন্টিনাতে আর ল্যাটিন আমেরিকায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শুভেচ্ছা সফরের পেছনে ঢাললে একটা গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-কৌশলগত দুয়ার খুলে যাবে। তারা জানবে একুশ শতকের বাঘের নাম, যে কিনা শুধু গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ত্রাসই নয়, মহাসমুদ্র সাঁতড়ে দুনিয়ার অপর প্রান্তে গিয়ে তার অবস্থান জানান দিতে পারে!

কূপমুন্ডুক চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার সময় হয়েছে আমাদের। মেসির মাঝে শুধু আবেগ না খুঁজে বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে। দেশকে এবং দেশের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে “দুর্বল দেশ” চিন্তা পরিত্যাগ করতে হবে। দূরত্ব কোন বাধা নয়; রবার্ট ক্লাইভের কাছে অষ্টাদশ শতকে দূরত্ব বাধা হয়নি। অথচ আমাদের মাথায় ঠিকই সেটা গুঁজিয়ে দিয়েছে তারা। বাংলাদেশের মানুষকে তারা বারংবার মনে করিয়ে দেয় যে দেশটা গরীব; অথচ ২০ কোটি অভুক্ত মানুষের দেশকে বলে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ভারত। পশ্চিমা প্রেসক্রিপশনে দেশ চালাবার সময় বহু আগেই গেছে। এখন এগুলি নিয়ে পত্রিকায় হাহুতাশ দেখলে হাসিই পায়। ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক অবস্থানে থেকে মিউ মিউ করার সময় এখন নয়। শক্তিশালী দেশের মানুষ হাহুতাশ করে না; বাঘের গর্জন দেয়।

Monday 24 October 2016

আমাদের শিল্পোন্নয়নের “হার্ট” কোথায়?

একটা ইঞ্জিনের মূল বডি এটা, যাকে ইঞ্জিন ব্লক বলে। এর উপরে ছিদ্রগুলি দিয়ে ঢুকে লাইনার, আর লাইনারের মধ্যে দিয়ে ওঠানামা করে পিস্টন। আমরা এখন লাইনার এবং পিস্টন তৈরি করি। ইঞ্জিনটার বাঁ পাশে দু'টা বড় ছিদ্র দেখা যাচ্ছে, যার নিচেরটা দিয়ে ক্র্যাংকশাফটের একটা অংশ বের হয়ে থাকে। এই শাফট-এর মাধ্যমেই মেকানিক্যাল শক্তি ইঞ্জিন থেকে বাইরে বের হয়। এই ইঞ্জিনই হচ্ছে শিল্পোন্নয়নের "হার্ট"
২৪শে অক্টোবর ২০১৬

হার্ট ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না, ঠিক তেমনি ইঞ্জিন ছাড়া এই একুশ শতকে কোন দেশ উন্নতি করতে পারে না। হার্টের মতোই একটি ইঞ্জিন অন্য সকল কিছুকে চালাতে থাকে। হার্ট যেভাবে ধমনীর মাধ্যমে রক্ত পাম্প করে, ঠিক তেমনি ইঞ্জিন মেকানিক্যাল শক্তিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানোর ব্যবস্থা করে অসার বস্তুতে প্রাণ এনে দেয়। বাংলাদেশে ইঞ্জিনের সবচাইতে বেশি ব্যবহার যেসব স্থানে, তার মাঝে সামনের সাড়িতে রয়েছে পানি সেচ। আমাদের প্রতিবেশীরা পঞ্চাশোর্ধ সংখ্যক নদীর উপরে উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহারের পরেও গত কয়েক দশকে কৃষিতে যে বিপ্লব ঘটে গেছে, তার মূলের কারণগুলির মাঝে একটি হলো এই পানি সেচ। নদী ড্রেজিং করা হয়নি প্রায় চার দশক ধরে (কিছুদিন আগে যা শুরু হয়েছে), যেটার কারণে খাল কেটেও পানির সংকুলার হয়নি; বর্ষার পর বৃষ্টির পানি আর অবশিষ্ট ছিল না। কাজেই পানির যোগাড় হয়েছে মাটি খুঁড়ে। যদিও এটা মোটেই ভালো কোন পদ্ধতি নয়, তারপরেও এটা ছাড়া আর কোন পদ্ধতি তখন কারও জানা ছিল না। এই সেচের উপরে ভিত্তি করে এক বিশাল অর্থনীতি সচল রয়েছে আজ। সেচের পাম্পগুলির বেশিরভাগই ডিজেল ইঞ্জিনে চলে; কিছু চলে বিদ্যুতে। ডিজেল ইঞ্জিনের জন্যে ডিজেল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়েছে; বিদ্যুতের জন্যে বিশেষ সময়ে আলাদাভাবে বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ইঞ্জিনের সাথে সংযুক্ত পাম্প বিভিন্ন কারণে বিকল হয়ে যায়; সেই পাম্পগুলি মেরামত এবং পরবর্তীতে পাম্প তৈরি করার শিল্প তৈরি হয়েছে। ইঞ্জিনের লাইনার এবং পিস্টনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, যেগুলি নিয়মত বিকল হয়, সেগুলি মেরামত এবং তৈরির জন্যে শিল্প হয়েছে। পানি সরবরাহের জন্যে লোহা এবং প্লাস্টিকের পাইপ তৈরির শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ডিজেল সরবহারের জন্যে জাহাজ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। সড়ক পরিবহণের ক্ষেত্রে ট্রাকের বডি তৈরির শিল্প দাঁড়িয়েছে। এই সবগুলি লোহার শিল্পের উপরে ভিত্তি করে আবার শিপব্রেকিং শিল্প দাঁড়িয়েছে (যদিও শিপব্রেকিং থেকে আরও অনেক শিল্প উপকৃত হয়েছে)। বিদ্যুতচালিত পাম্পের ক্ষেত্রেও অনেক কিচু ঘটেছে, তবে যেহেতু বিদ্যুতের ব্যাপারটা অনেক বড় পরিসরের আলাপ, তাই আর উল্লেখ করলাম না (তবে বৈদ্যুতিক মোটরকে বাদ দিচ্ছি না)। মোটকথা এ এক বিরাট কাহিনী – পুরোটার মূলে রয়েছে একটা কাজ – শুষ্ক মৌসুমে জমিতে পানি সেচ করা। এত্তোবড় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড; এত্তো এত্তো শিল্প গড়ে উঠলো! কিন্তু আসল জিনিস কই?? ইঞ্জিন কই?? সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেচের কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১৭ লক্ষ ইঞ্জিন!! যে ১৭ লক্ষ ইঞ্জিনের উপরে নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে; অর্থনীতিতে লক্ষ কোটি টাকা সঞ্চালিত হয়েছে, সেই ইঞ্জিনই তো উপরের এই লিস্টের মাঝে নেই!! হার্ট নেই; হাত-পা তৈরি করে বসে আছি আমরা!! হার্টখানা আমদানি করতেই আমাদের সুখ!!
  
 একটা ইঞ্জিন তৈরির ফুল অটোমেটিক পদ্ধতির একটা ভিডিও দিয়ে দিচ্ছি প্রসেসটা বোঝার জন্য। কিছু কিছু ইঞ্জিন তৈরির ক্ষেত্রে অতটা অটোমেটেড প্রসেস নেয়া হয়না উতপাদনের সংখ্যার কারণে। তবে যেগুলি বেশি সংখ্যায় তৈরি হয়, সেগুলি অটোমেটেড প্রসেসে খরচ বাঁচে।

এত বড় বাজার বিদেশীর জন্যে?

ঊনিশ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল এই ইঞ্জিনের আবির্ভাবেই। আমাদের তো আর নতুন করে সেই ইঞ্জিন আবিষ্কার করতে হচ্ছে না। আমাদের শুধু যেটা দরকার ছিল তা হলো ঐ ১৭ লক্ষ ইঞ্জিনের অন্তত কয়েক লক্ষ (পুরোটা করতে পারলে অবশ্য সমস্যা নাই) দেশে তৈরি করা। আমরা এই ইঞ্জিন তৈরি করতে পারলে আজও আমাদের মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন নিয়ে টানাটানি করতে হতো না; কয়েক লক্ষ ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার আমদানি করতে হতো না; গাড়ি বানাতে পারবো কি পারবো না, সেটাও চিন্তা করতাম না। এদেশে ইঞ্জিনের ব্যবহার মোটেই কম না – এ এক বিশাল বাজার। এর উপরেও রয়েছে ৩০ হাজারের উপরে জলযান, যেগুলি সবগুলিই ইঞ্জিনচালিত; রয়েছে ৬০ হাজারের উপরে ইঞ্জিনচালিত মাছ ধরার নৌকা। লক্ষ লক্ষ মোটরগাড়ি, লক্ষ লক্ষ মোটরসাইকেল, অজানা সংখ্যক অনান্য যানবাহন, লক্ষ লক্ষ জেনারেটর – এর প্রত্যেকটিই আমদানি করা ইঞ্জিনচালিত। এদেশের বিরাট জনসংখ্যা এই বাজারকে ধরে রাখবে বহুকাল। বিদেশীরা এই বাজার হারাতে চায় না; আর আমরাও এই বাজার বিদেশীদের হাতে রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
   
 মার্সিডিস এএমজি-৬৩ ইঞ্জিনের এসেম্বলি লাইন। এখানে একজন কর্মী একাই একটা ৪-লিটার ৪৫১ হর্স-পাওয়ারের ভি-৮ (৮টা সিলিন্ডার) ইঞ্জিন এসেম্বলি করে ফেলছেন। এটা খুবই হাই-পার্ফরমেন্স ইঞ্জিন, তাই তৈরি হয় সংখ্যায় কম; কাজেই ফুল অটোমেটিক প্রসেস এখানে নেয়া হয়নি।

এই সুযোগ হাতছাড়া করার সময় এখন নয়…

ইঞ্জিন ছাড়া একটা জাতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। উন্নয়নের এটা একটা পূর্বশর্তের মতো। (আশা করি পরবর্তী আরও কয়েকটি লেখায় এই পূর্বশর্তগুলি নিয়ে লিখবো।) বিদ্যুত ছাড়া শিল্প হয় না; জেনারেটর ছাড়া বিদ্যুত হয় না; ইঞ্জিন ছাড়া জেনারেটর হয় না। যানবাহন ছাড়া পণ্য পরিবহণ হয় না; ইঞ্জিন ছাড়া আজ যানবাহন হয় না (দয়া করে রিক্সা-বাইসেকেলের কথা মনে করাবেন না)। টাকা উঠে আসবে কি-না, এটা কোন কথা হতে পারে না। ব্রিটিশরা যখন এদেশের মানুষকে চা খাইয়েছিল, তখন এখান থেকে মুহুর্তের মাঝে টাকা উঠানোর কথা তারা চিন্তা করেনি; তারা জানতো যে টাকা একসময় এমনিতেই উঠে আসবে; কিন্তা চা খাওয়ানোর অভ্যাস না করাতে পারলে বাজারই গড়বে না। বাংলাদেশেও বহু উদাহরণ রয়েছে। একসময় এখানে টিস্যু পেপারের কোন বাজার ছিল না। সয়াবিন তেলের বদলে মানুষ সরিষার তেল দিয়ে রান্না করতো। বেবি ডায়াপারের কোন প্রশ্নই আসতো না মাত্র কয়েক বছর আগেও। মোট কথা বাজার তৈরি করা হয় পরে; আগে বাজার তৈরি করে প্রডাক্ট আনার চেষ্টা করলে সারাজীবন অন্যের পিছন পিছন চলতে হবে। একুশ শতকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অতি-গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত অবস্থানে এটা আমাদের অপশন নয়। ইঞ্জিন তৈরি করতে হবে; ইঞ্জিনের চাপে বাজার তৈরি হবে।
যেসব স্থানে ইঞ্জিন তৈরির বিরাট সুযোগ রয়েছে আমাদের –

১. সেচের জন্যে ডিজেল ইঞ্জিন (সেচ পাম্প)

২. পাওয়ার টিলার এবং ট্রাক্টর

৩. মোটরসাইকেল

৪. কমার্শিয়াল মোটরগাড়ি

৫. জেনারেটর

৬. মেরিন ইঞ্জিন

 এই ভিডিওখানা থেকে মোটামুটিভাবে ধারণা পাওয়া যাবে যে অলটারনেটর বা মোটর কিভাবে তৈরি করা হয়। এটা 'মডার্ন' প্রসেস। প্রসেস মডার্ন হতে পারে, কিন্তু আসলে কাজগুলি আগের মতোই আছে। সাইজে অনেক বড় হয়ে গেলেও যে একই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়, সেটা নিচের ভিডিওতে দেখা যাবে। আর এই পদ্ধতি যে ফ্যানের মোটর তৈরি থেকে মোটেও আলাদা নয়, সেটা এর পরের ভিডিওতে দেখা যাবে।

এখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মোটর/অলটারনেটরের উতপাদন প্রসেস বোঝা যাবে। বিরাট আকৃতির মোটর; প্রসেস দেখলে অনেক হাই-টেক ঠেকবে। কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যাবে সে আসলে ঐ একই পদ্ধতি।



  

এই ভিডিওতে বিআরবি ফ্যানের উতপাদন প্রসেস দেখে বুঝতে পারা যাবে যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মোটরের উতপাদন প্রসেসের সাথে এর পার্থক্য কতটা সামান্য।
 

শিল্পোন্নয়নের আরেক ভিত্তি – বৈদ্যুতিক মোটর

উপরে লিখেছি যে ইঞ্জিন ছাড়া বিদ্যুত তৈরি হয় না। আসলে সেই ইঞ্জিনটা হলো জেনারেটরের অংশ। ইঞ্জিনটা মেকানিক্যাল শক্তি তৈরি করে; আর সেই মেকানিক্যাল শক্তি থেকে বিদ্যুত তৈরি করে অলটারনেটর (Alternator)। অলটারনেটর লাগানো থাকে ইঞ্জিনের ক্র্যাংকশাফট-এর সাথে; ইঞ্জিন ঘুরলে অলটারনেটর-এর মাঝের অংশটিও ঘুরে এবং বিদ্যুত উতপন্ন হয়। এই যন্ত্রটি (অলটারনেটর) অত্যন্ত সাধারণ একটা যন্ত্র, যা তৈরি করা খুব সহজ। এর প্রযুক্তিখানা হলো ইলেকট্রিক মোটরের ঠিক উল্টোটা। যেখানে অলটারনেটর মেকানিক্যাল শক্তি থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি উতপাদন করে, সেখানে মোটর বৈদ্যুতিক শক্তি থেকে মেকানিক্যাল শক্তি উতপন্ন করে। যে মোটর তৈরি করতে পারে, তার কাছে অলটারনেটর একই জিনিস। আবার এই দুইটি জিনিস (মোটর এবং অলটারনেটর) আরও একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের খুব কাছের – ট্রান্সফরমার। আমাদের দেশে যে বৈদ্যুতিক ফ্যান তৈরি হয়, তা আসলে মোটর। আর ফ্যানের এই মোটর আমাদের দেশেই তৈরি হয়। আবার বাংলাদশে খুবই উন্নত ট্রান্সফরমার তৈরি হয় (বিদেশে রপ্তানিও হয়)। অথচ কোন উদ্ভট এক কারণে যারা এই ফ্যানের মোটর বানায় বা যারা ট্রান্সফরমার বানায়, তারা কেউই অন্য কোন মোটর তৈরি করে না। ইউরোপের একটি কোম্পানি বাংলাদেশে পানির পাম্পের সাথে মোটর বিক্রি করে বিরাট ব্যবসা করে ফেললো; আর আমরা হাততালি দিয়েই ঠান্ডা থাকলাম। সেই কোম্পানি নাকি বাংলাদেশে ১০ লক্ষের বেশি মোটর বিক্রি করেছে, যার একটা বড় অংশ নিয়োজিত রয়েছে মাটির নিচ থেকে পানি তোলার কাজে। চিন্তা করে দেখুন তো বাংলাদেশে কতগুলি মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিং রয়েছে? এবার ভাবুন তো এই বিল্ডিংগুলির ছাদের উপরে পানির ট্যাঙ্কে পানি কি করে ওঠে? প্রত্যেক বাড়িতে পানি ব্যবস্থাপনার জন্যে একটি বা দু’টি করে পাম্প (মোটর) থাকে। সবাই যে পানি পাম্পটাকে পাম্প বলে চিনে, সেটা আসলে একটা বৈদ্যুতিক মোটর, যার শাফট-এর সাথে ইম্পেলার (Impeller) নামে একটি অতি সাধারণ যন্ত্র লাগানো থাকে, যেটিকে আসলে আমরা পাম্প বলে চিনি। (ডিজেল ইঞ্জিনের সাথে ইম্পেলার লাগালে সেটা সেই সেচ পাম্পের মতো কাজ করে।) মোটরে বিদ্যুত সংযোগ দিলে শাফট ঘোরে, অর্থাৎ মেকানিক্যাল শক্তি উতপন্ন হয়। এই মেকানিক্যাল শক্তি ইম্পেলারকে ঘোরালে মেকানিক্যাল শক্তি হয়ে যায় হাইড্রলিক শক্তি, অর্থাৎ পানির শক্তি। এর ফলেই পানিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয়। আমাদের দেশে এই ইম্পেলার-খানা তৈরি করা হয়; কিন্তু মোটরখানা বিদেশীদের ব্যবসার জন্যেই আমরা রেখে দিয়েছি!

 

এনার্জিপ্যাকের কাস্ট রেজিন ট্রান্সফরমার (সিআরটি) তৈরির একটা ভিডিও। এটা বেশ এডভান্সড এক ধরনের ট্রান্সফরমার। তবে প্রসেস দেখলে বোঝা যাবে যে বৈদ্যুতিক মোটর বা অলটারনেটর তৈরির প্রসেস থেকে এই প্রসেস খুব একটা দূরে নয়।
 

ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন…

কাজেই ইঞ্জিনের সাথে অলটারনেটর লাগালে তৈরি হয় বিদ্যুত, আর মোটরের সাথে (বা ইঞ্জিনের সাথে) ইম্পেলার লাগালে টানা যায় পানি। আর মোটর এবং অলটারনেটর আসলে একই জিনিস। এখন যদি আমরা মোটরের সাথে বা অলটারনেটরের সাথে গিয়ার চাকা (বর্তমানে দেশে তৈরি হয়, তবে প্রযুক্তি আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে হবে) লাগিয়ে অন্য কিছু ঘোরাবার চেষ্টা করি? এখানেই হলো শিল্পোন্নয়নের আরেক চাবি। যা কিছু ঘোরে বা নড়াচড়া করে, সেটা যদি বিদ্যুতের সাহায্যে নড়াচড়া করে, তাহলে সেখানে অবশ্যই একটা মোটর আছে। এসেম্বলি লাইন এবং প্রসেস চালু থাকে মোটরের কারণে। ফর্কলিফট চলে মোটরে (কারণ সেটা ব্যাটারি-চালিত গাড়ি)। বয়লারের পানি ঢোকানো-বের করা হয় মোটরের (পাম্পের) সাহায্যে। ক্রেন চলে মোটরে। যেকোন মেশিন চলে মোটরে, যেমন লেদ মেশিন, শিয়ারিং মেশিন, কাটিং মেশিন, বোরিং মেশিন, ইত্যাদি। আগেই বলেছি যে, যে ফ্যানের মোটর বানাতে পারে, সে অন্য মোটরও বানাতে পারবে – প্রযুক্তি অত্যন্ত সাধারণ। যতো উন্নত কারখানাই হোক না কেন, সেটাতে মোটর ছাড়া কাজ হয় না। রোবটের হাত-পা নাড়ানো হয় কি করে? কয়েকটি মোটর সেখানে কাজ করে। অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট তৈরি করতেও মোটর লাগবে।

একটা গ্যাস বা তেল বা কয়লা বা হাইড্রো বা পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত কি করে তৈরি হয়? প্রথমে মেকানিক্যাল শক্তি তৈরি করা হয়, যা কিনা একটা আলটারনেটরের মাঝের অংশটিকে ঘোরায় এবং অলটারনেটর বিদ্যুত তৈরি করে। অবশ্য সবাই বিদ্যুতকেন্দ্রের আলটারনেটরকে জেনারেটর হিসেবেই চেনে। শিল্প, দোকানপাট, বাড়িঘরে যে ব্যাকআপ জেনারেটর থাকে, সেটাও একইভাবে কাজ করে। কাজেই যেটা বোঝা যাচ্ছে তা হলো শিল্প স্থাপনে মোটর একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশনের পূর্বশর্ত। আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন করতে না পারলে হাই কোয়ালিটি জিনিস তৈরি করা কঠিন, সময়সাপেক্ষে এবং অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবই না। আমাদের নতুন করে মোটর আবিষ্কার করতে হবে না; শুধু উতপাদনে যেতে হবে; সর্বশেষ প্রযুক্তি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে, যা কিনা আমরা বহু শিল্পের জন্যেই করেছি। ফ্যানের মোটর তৈরি করে ফুলস্টপ দেয়াটা বোকার স্বর্গে বসবাস। এভাবে একটা জাতি গরমকালে কিছুটা স্বস্তি পাবে, কিন্তু সামনে এগুতে পারবে না। সব ধরনের মোটর এবং অলটারনেটর তৈরি করতে হবে। এগুলিরও একটা লিস্ট করে ফেলা যাক –

১. পানি তোলার এবং পানি সেচের মোটর (পাম্প)

২. জেনারেটর (ইঞ্জিন + অলটারনেটর)

৩. ইন্ডাস্ট্রিয়াল মোটর

৪. ফ্যান, ট্রান্সফরমার, ইত্যাদি (বর্তমানে তৈরি হচ্ছে)

ইঞ্জিন যদি হার্ট হয়, তাহলে মোটর এবং অলটারনেটর হবে সেই হার্টের ভালভ। একটা গাড়ি যখন চলে, তখন সেই গাড়িতে এয়ার কন্ডিশনার চলে কি করে? রেডিও চলে কি করে? কারণ ইঞ্জিনের শাফট-এর সাথে একটা অলটারনেটর লাগানো থাকে, যা কিনা বিদ্যুত উতপাদন করে। একেকটা গাড়ি একেকটা বিদ্যুতকেন্দ্র। একেকটা জেনারেটর একেকটা বিদ্যুতকেন্দ্র। বিদ্যুত না থাকলে প্রস্তরযুগে ফিরে যেতে হবে। আর সেই বিদ্যুতের দায়িত্ব আমরা কখনোই অন্য কারুর হাতে তুলে দিতে পারি না। হাত-পা তৈরি করছি আমরা; সেটা চলবে। তবে এখন “হার্ট” তৈরি করার পালা। ইঞ্জিন, মোটর, অলটারনেটর – এগুলি না হলে দেশের শিল্পোন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হবে না। ভাগারের উপরে বিল্ডিং যেমন স্থায়ী হয় না, তেমনি ইঞ্জিন, মোটর, অলটারনেটর ছাড়া একটা দেশের উন্নয়ন বেলুনের মতো ফুলবে, কিন্তু কোনদিনই দৃঢ় হবে না।

Tuesday 11 October 2016

আমাদের ব্লু ইকনমিতে চীন যে ভূমিকা রাখতে পারে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করছেন চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী চ্যাং ওয়ানকুয়ান। বাংলাদেশের সাথে চীনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পর্ক একটা গভীরতায় পৌঁছেছে, যেটাকে ভিত্তি করে সামনের দিকে এগুনো সম্ভব। নিরাপত্তা এমন একটি বিষয় যেখানে আস্থা না থাকলে সম্পর্ক তৈরি করা কঠিন। বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে যে গুরুত্ব বহণ করছে, সেটাকে প্রকৃত মূল্যায়ন করতে হলে যেসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি দরকার, সেসব ক্ষেত্রে চীনাদের সহায়তা করতে পারার সক্ষমতা সবচাইতে বেশি। ব্লু ইকনমি তার মাঝে অন্যতম।
১১ই অক্টোবর ২০১৬


চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে মিডিয়াতে অনেক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, যেখানে কি কি বিষয়ে চুক্তি হতে পারে, তা নিয়ে বিরাট লিস্ট উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর বেশিরভাগই হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। রেলপথ, বিদ্যুত বিতরণ, জ্বালানি পরিবহণ, পানি সরবরাহ, কনটেইনার ডিপো, এক্সপ্রেসওয়ে, মেরিন ড্রাইভ, আইটি অবকাঠামো, মংলা বন্দরের উন্নয়ন, কয়লা খনি উন্নয়ন এই প্রকল্পগুলির মূল। চীন বাংলাদেশের সবচাইতে বড় বিনিয়োগ পার্টনার হতে চলেছে – শুধু এই কারণে নয়, এই সফর ভূরাজনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্টের আগমণের উপরে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানসহ এই এলাকার সব দেশকেই গভীর নজর রাখবে।

বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে কেবল চীনেরই। এমনকি চীনের অর্থনীতির গতি কমার পরেও এটাই বাস্তবতা রয়ে গেছে। চীনারা এশিয়া এবং আফ্রিকাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। সেসব বিনিয়োগের একটি বড় অংশ গেছে অবকাঠামো খাতে। এই খাতে চীনা বিনিয়োগ নতুন কিছু নয়। তবে আমাদের এটা খেয়াল রাখতে হবে যে এই অবকাঠামো তৈরিতে আমাদের এখানেও একসময় স্থবিরতা আসবে। পরবর্তী অবকাঠামো প্রকল্পগুলি গুরুত্ব হারাতে থাকবে। পদ্মা নদীর উপরে প্রথম সেতু অর্থনীতির জন্যে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ হবে, দ্বিতীয় সেতুটি ততটা হবে না। একইভাবে বিভিন্ন রাস্তা এবং রেলপথের ব্যাপারও তা-ই। কাজেই আমাদের এটা চিন্তা করতে হবে যে চীনাদের হাতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ যতদিন থাকবে ততদিন আমরা কি ধরনের বিনিয়োগ তাদের কাছ থেকে আশা করবো। বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থান আফ্রিকার দেশগুলির মতো নয়। কাজেই আফ্রিকার দেশগুলির মতো শুধু অবকাঠামো বিনিয়োগে আমাদের খুশি থাকাটা চিন্তাহীনতার লক্ষণ। শিল্পোন্নয়নের পরিধি বাড়িয়ে দেশকে শক্তিশালী করতে আমাদের সামনের দিনগুলির চাহিদার দিকে দেখতে হবে।
 
পশ্চিমা বিশ্বে কৌশলগত দিক থেকে যেসব স্থাপনাগুলির গুরুত্ব সবচাইতে বেশি বলে ধারণা করা হয়, তার একটি হলো ডাটা সেন্টার। ফেইসবুকে এত্তো এত্তো ছবি আপলোড করেন প্রতিদিন - এগুলি কোন হার্ডডিস্কে থাকে? সেই হার্ড ডিস্ক কোথায়? আমরা সেই প্রশ্ন কখনোই করি না। আমাদের দেশে কালিয়াকৈরে চীনা সহায়তায় সর্বোচ্চ মানের ডাটা সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এই ডাটা সেন্টার যাতে না তৈরি করা হয়, সেজন্য অনেক subversion শুরু হয়ে গেছে!

প্রযুক্তি নিয়ে ভাবতে হবে…

ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ পশ্চিমা দেশগুলি থেকে পাওয়া কঠিন। ঠিক একারণেই পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে আমাদের রাশিয়ার কাছে যেতে হয়েছে। আমাদের সামরিক সরঞ্জামের বেশিরভাগই চীন এবং রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের সামরিক সরঞ্জাম তৈরির সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা-ই। চীনের সহযোগিতায় খুলনা শিপইয়ার্ড বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে ৫টি প্যাট্রোল বোট তৈরি করেছে। এখন দুর্জয়-ক্লাসের ৬৪ মিটারের দু’টি গাইডেড-মিসাইল এলপিসি তৈরি করছে তারা। সামনের দিনগুলিতে কর্ভেট এবং ফ্রিগেটও তৈরি করবে এই শিপইয়ার্ড। এগুলির জন্যে চীনাদের সহায়তা ছাড়া গত্যন্তর নেই, কারণ পশ্চিমারা মুসলিম দেশের সামরিক শিল্প তৈরিতে সহায়তা করতে চায় না। তবে সামরিক সরঞ্জাম তো আসলে বড় অর্থে প্রযুক্তির অংশ। এই প্রযুক্তি বেসামরিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক দরকার হচ্ছে আমাদের। কালিয়াকৈরে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফোর টিয়ার ডাটা সেন্টারে চীনারা ১৫৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এখানে এদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকবে। সারা দেশের সরকারী অফিসগুলিকে ফাইবার অপটিক কেবলে যুক্ত করার প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজ ‘ইনফো সরকার-২’ বাস্তবায়নে চীনা সরকার প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। ইনফো সরকার-৩ প্রকল্পের জন্যেও এবার ১৫০ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হচ্ছে। চীন তথ্য প্রযুক্তিতে ব্যাপক উন্নতি করেছে। চীনের তথ্য প্রযুক্তি বাংলাদেশে এনে শিল্প স্থাপনের কোন প্রকল্প নেয়া গেলে এবং সরকারি পরিকল্পনায় এধরণের কিছু থাকলে উতফুল্ল হবার কারণ বাড়তো বৈকি।

টেক্সটাইল, লেদার, ইত্যাদি রপ্তানি পণ্যে বিনিয়োগ ছাড়াও বড় শিল্প স্থাপনে চীনারা সহায়তা দিচ্ছে। পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের অংশ হিসেবে ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল সার কারখানায় চীনারা ৫’শ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পেও চীনের সহযোগিতা আশা করাটা দোষের কিছু হবে না, কারণ এই সেক্টরে পশ্চিমারা বিনিয়োগ-বিমুখ। এই সেক্টরে আমাদের প্রযুক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কৃষিজ যন্ত্রপাতি, যেমন ট্রাক্টর তৈরি করার জন্যে চীনাদের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। বর্তমানে আমরা এই ক্ষেত্রে পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর। বেলারুশ থেকে প্রতিনিধিদল এসেছিল এই সেক্টরে বিনিয়োগ করতে, যা এখন পর্যন্ত কোনদিকেই এগোয়নি। আমরা বর্তমানে এই সেক্টরের বহু যন্ত্রাংশ তৈরি করার সক্ষমতা রাখি। তাই এখন এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আমাদের জন্যে একটি ন্যায্য দাবি। চীনারা এক্ষেত্রে সহায়তা করলে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের জন্যে বিরাট অগ্রগতি হবে। ইলেকট্রনিক্স শিল্পে, বিশেষত বর্তমানে নির্মীয়মান হাই-টেক পার্কগুলিতে চীনা বিনিয়োগ আশা করা যেতে পারে। এরপর রয়েছে বিদ্যুত উতপাদন, যা বর্তমানে সরকারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। বড়পুকুরিয়া কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিটে চীনারা বিনিয়োগ করেছে। পটুয়াখালী, মাতারবাড়ী এবং বাঁশাখালীতে তিনটি বড় কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে চীনারা বিশাল বিনিয়োগ করছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াতে আরেকটি বিদ্যুতকেন্দ্রে চীনাদের বিনিয়োগ চাওয়া হচ্ছে। তবে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি বহুলাংশে বদলে দেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চরিত্র। এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের ব্লু ইকনমি। তাই এক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগের গুরুত্ব অনেক।
    
৮৮ হাজার টনের কয়লাবাহী জাহাজ 'করোনা কুইন'। এরকম অনেক জাহাজ আমাদের দরকার হবে যখন আমাদের কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি চালু হবে। নিজেদের জাহাজ না থাকলে দেশের নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে। আমাদের দেশের নাব্যতা বা অন্য কোন টেকনিক্যাল কারণে এধরণের বড় জাহাজ তৈরি করা কঠিন হতে পারে। এক্ষেত্রে চীনারা আমাদের সহায়তা করতে পারে।

কয়লা নিয়ে কথা…


বাংলাদেশে ডিসেম্বর ২০০৬-এ যেখানে ৮৩% বিদ্যুত উতপাদিত হতো গ্যাস থেকে, সেখানে ২০১৪-এর ডিসেম্বরে এসে এটা কমে হয়ছিল ৬০%; আর পিডিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ৫ই অক্টোবর ২০১৬ তারিখে পিক আওয়ারে উতপাদিত ৮ হাজার ৭৪৮ মেগাওয়াটের মাঝে গ্যাস থেকে বিদ্যুত উতপাদিত হয়েছিল ৫ হাজার ৫৬ মেগাওয়াট বা প্রায় ৫৮%। গ্যাস থেকে বিদ্যুত উতপাদন কমতে থাকলেও এটা এখনও বড় অংশ। অপরপক্ষে কয়লা থেকে বিদুত উতপাদিত হয়েছে ২%-এরও কম বা ১৬৬ মেগাওয়াট। সরকার ২০২১ সাল নাগাদ ৭ হাজার মেগাওয়াট বা প্রায় ৩০% বিদ্যুত কয়লা থেকে উতপাদন করার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র এবং কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের অর্থ হলো ৬০% বিদ্যুত উতপাদন করতে জ্বালানি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে না। অন্যদিকে ৩১% বিদ্যুত উতপাদিত হচ্ছে তেল থেকে, যা আমদানি-নির্ভর। এই আমদানি করা হচ্ছে সমুদ্রপথে। গ্যাসের একটি বড় অংশও আসবে আমদানি করা তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজি থেকে। সরকার কয়েকটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। সামনের দিনগুলিতে আমদানি করা কয়লা থেকে বিদ্যুত উতপাদন করতে হলে বছরে দুই থেকে আড়াই কোটি টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্যের ৯০%-এর বেশি সম্পাদিত হচ্ছে সমুদ্রপথে, যার প্রায় ৯৩% হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬ কোটি ৪২ লক্ষ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি চালু হলে সমুদ্রপথ, তথা বঙ্গোপসাগরের উপরে আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়বে বহুগুণে। কয়লা, তেল এবং এলএনজি মিলিয়ে বেশিরভাগ বিদ্যুতই তখন উতপাদিত হবে সমুদ্রপথে আমদানি করা জ্বালানি দ্বারা। কিন্তু আমাদের তো জাহাজই নেই। (বাণিজ্যিক জাহাজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এর আগেও লিখেছি।) আর আমরা এ-ও আশা করতে পারি না যে আমাদের দেশের কলকারখানাগুলি চালু রাখতে আমাদের সমুদ্রপথের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা অন্য কেউ দেবে। তাই বঙ্গোপসাগরের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইনের নিরাপত্তা দেয়াটা তখন জাতীয় নিরাপত্তায় আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। আগামী কয়েক বছরের মাঝেই সমুদ্র নিরাপত্তার এই বিষয়টি আমাদেরকে বঙ্গোপসাগরসহ পুরো ভারত মহাসাগর নিয়েই ভাবাবে।

বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো জাহাজের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমছে। মেরিন একাডেমি থেকে পাস করে নাবিকরা বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই অবস্থার পরিসমাপ্তি করতে দ্রুত আরও অনেক জাহাজ দরকার। আর কতোকাল বিদেশী জাহাজের উপরে নির্ভর করে থাকতে হবে আমাদের? চীনের সহায়তায় জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আরও অনেক জাহাজ দরকার। বিন্দু-বিন্দু হারে এই বহর তৈরি করার ফুরসত নেই। এটা জাতীয় নিরাপত্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক; তাই বসে থাকা অর্থহীন।

সমুদ্রপথের নিরাপত্তা…

প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের পরিবহণ ক্ষমতা বাড়াবার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের পর এই প্রথম ১৮৪ মিলিয়ন ডলার ঋণে চীন থেকে প্রতিটি ৩৯ হাজার টন ধারণক্ষমতার ৬টি জাহাজ কেনা হচ্ছে। তবে দুই কোটি টন কয়লা পরিবহণের জন্যে এটি তেমন কিছু নয়। এক’শ মিলিয়ন ডলারে প্রতিটি ১ লক্ষ টন ধারনক্ষমতার দু’টি অপরিশোধিত তেলবাহী মাদার ট্যাংকারও কেনা হচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হচ্ছে, যেটি এর সক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে নিয়ে যাবে; বহুগুণে বাড়বে তেল পরিবহণের গুরুত্ব। পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের বৃদ্ধির সাথে সাথে তেলের জাহাজ আরও লাগবে আমাদের। আরও বহু জাহাজ আমাদের সংগ্রহ করতে হবে, যেখানে বড় জাহাজ ক্রয়ে (যা পানির গভীরতা বা অন্য টেকনিক্যাল কারণে আমাদের দেশে তৈরি করা কঠিন) চীনাদের সহায়তা দরকার হতে পারে। বর্তমান সরকার ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়ন করতে দেশের সমুদ্র-নিরাপত্তার উপরে গুরুত্ব দিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডকে শক্তিশালী করা হচ্ছে, যা চীনাদের সহায়তা ছাড়া করাটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। নৌবাহিনীর জন্যে প্রায় দু’শ মিলিয়ন ডলারে কেনা হচ্ছে দু’টি সাবমেরিন, যা এই বছরের কোন এক সময়েই আসার কথা রয়েছে। দু’টি কর্ভেট তৈরির পর আরও দু’টি কর্ভেট এখন চীনে নির্মীয়মান। চীনা সহায়তায় আমাদের যুদ্ধজাহাজ তৈরির সক্ষমতা বাড়ছে।
 

চীনে নির্মিত টাইপ-০৫৬ কর্ভেট বিএনএস প্রত্যয়। ৯০ মিটারের এই যুদ্ধজাহাজ আমাদের দেশে তৈরি করতে পারলে খরচ অনেক কম পড়তো, এবং একইসাথে আমদের জাহাজ নির্মাণের অভিজ্ঞতা বাড়তো। খুলনা শিপইয়ার্ডের এই সক্ষমতা তৈরি করার আমাদের চীনা সহায়তা প্রয়োজন। বর্তমানে খুলনাতে দুর্জয়-ক্লাসের দু'টি গাইডেড মিসাইল এলপিসি তৈরি হচ্ছে।

সমুদ্রপথ যত গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকবে, নৌবাহিনীর গুরুত্বও ততো বাড়তে থাকবে। আমরা নিজেদের দেশে নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি করতে পারলে খরচ অনেক কম পড়বে। আর এক্ষেত্রে চীনারা হতে পারে প্রযুক্তি পার্টনার। খুলনা শিপইয়ার্ডে বর্তমানে নির্মীয়মান দুর্জয়-ক্লাসের জাহাজই আমাদের শেষ চেষ্টা হওয়া উচিত নয়। কর্ভেট এবং ফ্রিগেট তৈরির দিকে দ্রুত যেতে হবে আমাদের। কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের এগুতে হবে। একটা পুরোপুরি শেষ হবে; এরপর আরেকটা শুরু করবো – এই থিউরিতে দুনিয়া কোনদিনও চলেনি; একটি কাজ আরেকটির জন্যে থেকে থাকতে পারে না। বিশেষতঃ সেটা যখন জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হয়। কাজেই নৌবাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা বৃদ্ধি একই সাথে হতে হবে। খুলনা শিপইয়ার্ড এবং চট্টগ্রাম ড্রাইডকের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা চীনাদের সহায়তা চাইতে পারি। চট্টগ্রাম ড্রাইডককে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার সরকারি সিদ্ধান্ত এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
 
চীনারা নৌশক্তির দিক থেকে গত দুই দশকে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ এবং উপকূলীয় সম্পদের নিরাপত্তা দিতে এয়ার ডিফেন্স ফ্রিগেট দরকার হবে। চীনাদের চাইতে কম খরচে এধরনের যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করার সক্ষমতা আর কারো আছে কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয়।

সমুদ্রবন্দর এবং উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা

এর আগেও লিখেছি যে সমুদ্রবন্দরগুলির কারণে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা আমাদের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তায় বিমান প্রতিরক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামোগুলির নিরাপত্তা প্রদান করা আমাদের জন্যে ফরয কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যমুনা এবং পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার জন্যে যেমনি সেনাবাহিনী ইউনিট তৈরি করেছে, ঠিক তেমনি উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যেও বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক জরুরি। কক্সবাজার এবং বরিশাল বিমানবন্দরের উন্নয়নের সাথে সাথে এখানে বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি, যাতে বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলির উপরে বিমান প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। যারা এখন মনে করছেন যে আমাদের আবার বিমান প্রতিরক্ষা কেন লাগবে, তাদের জন্যে প্রশ্ন – যদি ভারত তার সমুদ্র এবং বিমান প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজের দেশে মার্কিন ঘাঁটির অনুমতি দিতে পারে, তাহলে কোন যুক্তিতে তারা বাংলাদেশের বিমান প্রতিরক্ষা নিয়ে চিন্তিত নন? তারা এই দেশের নিরাপত্তা কি অন্য কোন দেশের হাতে দেখতে আগ্রহী? অন্য দেশের উপরে নির্ভরশীলতাই কি তারা চাননি সবসময়? পদ্মা সেতু দেশের নিজস্ব অর্থে তৈরি করাতে তাদের পরনির্ভরশীল এজেন্টের চেহারাটাই তখন প্রকাশ পেয়েছিল। যাই হোক, দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপত্তা যে সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে, তা সরকারের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কথাতেই প্রতীয়মান। বিমানবন্দরের উন্নয়নের সাথে সাথে এখানে শক্তিশালী রাডার নেটওয়ার্ক বসানো গুরুত্বপূর্ণ। চীন এবং রাশিয়ার রাডার এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে যেহেতু আমাদের সমুদ্রবন্দরের কর্মকান্ডের বড় অংশ সমুদ্রের মাঝখানে (বহিঃনোঙ্গরে) হয়, তাই সমুদ্রের বিমান প্রতিরক্ষা দিতে নৌবাহিনীর জাহাজের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। গভীর সমুদ্রের সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে সমুদ্র প্রতিরক্ষার গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। সরকার যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার লাইসেন্স দিচ্ছে, তখন এই ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপত্তাহীনভাবে আমারা আমাদের নাগরিকদের সমুদ্রে পাঠাতে পারি না। এয়ার ডিফেন্স ফ্রিগেট এক্ষেত্রে ভালো সমাধান হতে পারে। চীনের কাছে এই ব্যাপারে সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। শিপইয়ার্ডের ডেভেলপমেন্টের সাথে যুক্ত করে লাইসেন্স প্রডাকশনের মাধ্যমে টেকনলজি-ট্রান্সফার করতে পারলে এই পদক্ষেপ খুবই ফলপ্রসু হবে। জাহাজের নিরাপত্তার পূর্ণ হবে না যদি হেলিকপ্টার যোগ না করা হয়। আমাদের নৌবাহিনীতে হেলিকপ্টারের সংযোজন একটি বড় ঘটনা ছিল। কিন্তু এখন আমাদের সেই আবেগঘন মুহূর্ত থেকে বের হয়ে সামনের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের আরও হেলিকপ্টার দরকার, যা কিনা সমুদ্রে সার্ভেইল্যান্স ছাড়াও এন্টি-সাবমেরিনের কাজ করবে। বঙ্গোপসাগরে বিদেশী সাবমেরিনের গোপন আনাগোনা শোনা যায় বহুদিন ধরে। সমুদ্রে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আহরণ করতে শুরু করার পরে আমাদের স্থাপনার আশেপাশে দিয়ে বিদেশী সাবমেরিনের এধরনের গোয়েন্দা কার্যকলাপ আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই হেলিকপ্টার নিশ্চিত দরকার। চীনারা আমাদের এই চাহিদা পূরণে সহায়তা করতে পারে, যদিও আমাদের অন্য দেশ থেকেও হেলিকপ্টার সংগ্রহের চেষ্টা করে যেতে হবে।
    
চীনারা ড্রোন প্রযুক্তিতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে। আমাদের সমুদ্রসীমায় দীর্ঘ সময় ধরে সার্ভেইল্যান্স চালানোর ক্ষেত্রে চীনাদের দূরপাল্লার ড্রোন খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।


আকাশ প্রতিরক্ষা ছাড়া আমাদের সমুদ্র নিরাপত্তা অর্থহীন হবে। এই নিরাপত্তার প্রথম টিয়ারে পড়বে ট্যাকটিক্যাল ফাইটার, যা কিনা অল্প খরচে বেশি সংখ্যক যোগাড় করা যেতে পারে। চীনারা আমাদেরকে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এফ-৭ বিমান সরবরাহ করেছে। এখন সময় এসেছে বাজেটের দিকে খেয়াল রেখেই প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নততর বিমান কেনা। চীনাদের কাছে এর সমাধান আছে বলেই সরবরাহকারী হিসেবে তারা সামনের সারিতে থাকবে।

বিমান শক্তিকে প্রাধান্য দেয়া…

তবে শুধুমাত্র গ্রাউন্ড বা সী-বেজড এয়ার ডিফেন্স যথেষ্ট হবে না যদি না বিমান শক্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। বঙ্গোপসাগরের উপরে এয়ার সার্ভেইল্যান্স বাড়াতে আরও সার্ভেইল্যান্স বিমান দরকার। একইসাথে দূরপাল্লার ড্রোনের দিকে আমরা যেতে পারি। ড্রোন বহু ঘন্টা আকাশে থাকতে পারে; তাই সার্ভেইল্যান্সে এর গুরুত্ব অপরিসীম। সার্ভেইল্যান্স বিমান এবং ড্রোনের ক্ষেত্রেও আমরা চীনের কাছে সহায়তা পেতে পারি। তবে শক্তিশালী কোন অবস্থান না নিতে পারলে সার্ভেইল্যান্সের গুরুত্ব নেই। এক্ষেত্রে শক্তিশালী ফাইটার স্কোয়াড্রনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের এফ-৭ বিমানের পক্ষে এই কাজটা বেশ কঠিন। মাত্র ৮টি মিগ-২৯ বিমানের পক্ষেও সারা দেশের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ কঠিন। যেহেতু অত্যাধুনিক ফাইটার বিমানের ক্ষেত্রে খরচের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে, তাই চীনারা এক্ষেত্রে সবচাইতে ভালো সমাধান দিতে পারে। কম খরচের ট্যাকটিক্যাল ফাইটার আমরা এমন একটি সংখ্যায় কিনতে পারবো, যা কিনা ৪.৫ বা ৫ম জেনারেশনের এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটারের ক্ষেত্রে কঠিন, যদিও সেটা আমাদের শেষ পর্যন্ত লাগবেই। যাই হোক, চীনাদের আধুনিক ট্যাকটিক্যাল ফাইটারের বহর থেকে আমরা যা পাবো, তা অন্য কোন দেশ থেকে পাবার আশা করাটা কঠিন। উপকূলী অঞ্চলের উপরে এয়ার ডিফেন্স নিশ্চিত করতে দুই থেকে তিনটি স্কোয়াড্রন ফাইটার-ইন্টারসেপ্টর বিমান জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের ব্লু ইকনমিতে চীনের অংশগ্রহণকে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখবে না। কিন্তু আমাদের সামনে পথ খোলা আছে খুব কমই। চীন আমাদের এমন কিছু ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারছে, যেগুলি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। রেল-রাস্তা, সেতু, টানেল, ফ্লাইওভারের মতো প্রকল্পগুলি মানুষ সরাসরি অনুভব করে, কারণ তারা সেগুলির সুফল কোন হিসেব কষা ছাড়াই দেখতে পায়। কিন্তু রাষ্ট্রের জন্যে অপেক্ষাকৃত কম দৃশ্যমাণ প্রকল্পগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব বহণ করে – সেগুলি সাধারণ জনগণ বুঝুক আর না বুঝুক। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করেই রাষ্ট্র প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃশ্য-অদৃশ্য সমস্যা মোকাবিলা করে। বঙ্গোপসাগরে শক্তিধর দেশগুলির প্রতিযোগিতা থাকবেই; যা কিনা সেসব সমস্যার জন্ম দেবে; আবার সমস্যার সমাধানও দেবে। চীনারা আমাদের জন্যে কি সমস্যা বয়ে আনবে, নাকি সুযোগ তৈরি করবে – সেটা বাইরের কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমাদের শুনতে হবে না। আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দেবো, নাকি দেশের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেবো।