Sunday 31 May 2020

হংকং নিয়ে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব কোন দিকে যাচ্ছে?

করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠছে, তখন দুই দেশের দ্বন্দ্বের নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, এখন থেকে হংকং আর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল নয়। র ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হংকংএর কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে এবং সেখানে বিনিয়োগও ব্যাহত হতে পারে। এর অর্থনৈতিক ফলাফলের চাইতে ভূরাজনৈতিক ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন কিছু করলে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য, মহামারি এবং প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে রয়েছে। 


৩১শে মে ২০২০


গত ২৭শে মে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এক বার্তায় ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে হংকং আর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল নয়। তিনি বলেন যে, তিনি মার্কিন কংগ্রেসকে এই কথাই বলে এসেছেন। পম্পেওর এই ঘোষণা ছিল চীনা সরকারের হংকংএর জন্যে নতুন নিরাপত্তা আইন তৈরির পদক্ষেপের ফলাফল। পম্পেও বলেন যে, এটা এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, হংকংকে চীন নিজের মতো করে গড়ে নিতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, এতকাল বৈশ্বিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে হংকংকে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে আসছিল। তবে এই নতুন আইনের কারণে হংকংএর স্বায়ত্বশাসন ব্যাহত হবে বিধায় হংকংএর বিশেষ সুবিধা পাবার ব্যাপারটা রহিত করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। আইনগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র হংকংকে এই সুবিধা দিচ্ছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময় থেকেই। তবে ২০১৯ সাল থেকে এই আইনগত সুবিধা হংকং পাবে কিনা, তা নির্ভর করছিল হংকংএর স্বায়ত্বশাসনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। এই সময় থেকেই হংকংএর স্বায়ত্বশাসনকে যুক্তরাষ্ট্র স্বায়ত্বশাসন আখ্যা দেবে কিনা, তা হয়ে গিয়েছিল শর্তসাপেক্ষ। যদি মার্কিন সরকার কংগ্রেসকে বোঝাতে না পারে যে, হংকংএর স্বায়ত্বশাসন এখনও বলবত রয়েছে, তাহলে কংগ্রেস হংকংএর বিশেষ সুবিধা কেড়ে নিতে পারে। এর অর্থ হলো, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র হংকং এবং চীনের মাঝে কোন পার্থক্য করবে না। এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হংকংএর কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে এবং সেখানে বিনিয়োগও ব্যাহত হতে পারে। হংকংকে চীনা এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ব্যাবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সুবিধা পাবার জন্যে।

অপরদিকে চীনা সরকার বলছে যে, নতুন আইনের মাধ্যমে হংকংএ সহিংসতা বন্ধ করা যাবে। এতে শুধুমাত্র কিছু সমস্যা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিই বিপদে পড়বে। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ থেকে চীনাদের অধীনে যাবার সময় চীনারা ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’র অধীনে হংকংকে যথেষ্ট স্বায়ত্বশাসন দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে হংকংএর গণতন্ত্রকামীরা বলছে যে, নতুন আইনের মাধ্যমে চীন হংকংএর স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিতে চাইছে। হংকংএর গণতন্ত্রী আন্দোলনকারীদের নেতা জশুয়া ওয়ং বলছেন যে, চীনের নিরাপত্তা আইন হংকংএর ব্যাবসার ব্যাপক ক্ষতি করবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার নেতৃবৃন্দকে হংকংএর সাথে ব্যবসার জন্যে বিশেষ সুবিধা বাতিলের আহ্বান জানান। হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস ধরে রাখার মাধ্যমেই ব্যাবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন বলে বলছেন তিনি। নিজেদের কূটনৈতিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হংকংএ মার্কিন সরকারের মালিকানায় থাকা সাড়ে ৬’শ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাতীত ব্রিটেন এবং কমনওয়েলথের অন্তর্গত কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া চীনের পদক্ষেপের ব্যাপারে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছে। তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মত কঠোর পদক্ষেপ নেবার কোন হুমকি এখনও দেয়নি। ব্রিটেন বলছে যে, তারা হয়তো হংকংএর বাসিন্দাদের জন্যে ভিসা সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারে।

হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস চলে যাবার সম্ভাবনার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর অর্থনৈতিক ফলাফলের চাইতে ভূরাজনৈতিক ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন কিছু করলে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য, মহামারি এবং প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে রয়েছে। এখন প্রশ্ন আসবে যে, হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস কেড়ে নেবার ফলে হংকংবাসীদের স্বায়ত্বশাসন এবং স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন সুবিধা হবে কিনা; অথবা এতে শুধু হংকংএর জনগণের কষ্টই শুধু বাড়বে কিনা। ২৯শে মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে, হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র কিছু গুরুত্বপূর্ণ চীনা ব্যক্তিত্বের উপর অবরোধ আরোপ করতে পারে। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, ৩১শে মে চীনা মিডিয়াতে মার্কিন ঘোষণার ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘পিপলস ডেইলি’তে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত চীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ বলছে যে, চীন ইতোমধ্যেই সবচাইতে খারাপ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এব্যাপারে যতদূরই এগিয়ে যাক না কেন, চীন প্রতিযোগিতায় থাকবে।

করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠছে, তখন দুই দেশের দ্বন্দ্বের নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত কয়েক হাজার চীনা গ্র্যাজুয়েট ছাত্রকে সেদেশ থেকে বের করে দেয়া হতে পারে বলে বলছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা ছাত্রদের মাঝে কেউ যদি এমন কোন চীনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসে থাকে, যার কিনা চীনা সামরিক বাহিনী বা চীনা ইন্টেলিজেন্সের সাথে যোগাযোগ রয়েছে, তাহলে সেই ছাত্রের ভিসা বাতিল হয়ে যেতে পারে। মার্কিন কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের বিরোধী; কারণ চীনা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্যে বড়সড় আয়ের উৎস। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ২০১৮ সালে সাড়ে ৩ লক্ষের বেশি চীনা ছাত্রের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। চীনা ছাত্ররা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা মোট বিদেশী ছাত্রের এক-তৃতীয়াংশ। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, যেসব ছাত্রদের গোয়েন্দা কর্মকান্ডে জড়াবার সম্ভাবনা বেশি, শুধুমাত্র তাদেরকেই বের করে দেবার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। হংকংএর আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও ছাত্রদের বহিষ্কার করার এই পদক্ষেপ চীনা সরকারকে প্রতিশোধমূলক কোন পদক্ষেপে প্ররোচিত করতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুই দেশের মাঝে দূরত্ব বাড়াটা এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে, যেখানে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দ্রুত কমছে এবং একইসাথে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। উত্তেজনা প্রশমণের পিছনে প্রচেষ্টা চললেও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দেশ সাংঘর্ষিক অবস্থানেই থেকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষুন্ন হওয়া ছাড়াও আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন শক্তির আবির্ভাবের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। আর চীনের সাথে বিরোধের জের ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাবার কারণে এই সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, যা কিনা বৈশ্বিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। 

Sunday 24 May 2020

‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তিকে বিদায় দিল যুক্তরাষ্ট্র - বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের আরেকটা ধাপ সম্পন্ন হলো

২৪শে মে ২০২০
   
মার্কিন বিমান বাহিনীর ৬০ বছরের পুরোনো 'ওসি-১৩৫বি' গোয়েন্দা বিমান, যা 'ওপেন স্কাইজ' চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। মার্কিন চিন্তাবিদদের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীই এখন চীন। ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তিতে ইউরোপ, রাশিয়া থাকলেও চীন নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার নিজের তৈরি করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই বের হয়ে যাচ্ছে; যা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার স্থায়িত্বকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ইউরোপের ছোট দেশগুলির যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতার দিন যেমন ঘনিয়ে আসছে, তেমনি কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
 
গত ২১শে মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তি থেকে বের করে আনার ঘোষণা দেন। এই চুক্তির অধীনে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে রাশিয়ার সমঝোতা হয় যে, তারা একে অপরের আকাশসীমায় গোয়েন্দা বিমান ওড়ার অনুমতি দেবে। হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন যে, রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে রাশিয়া এই চুক্তি মানছে না। কাজেই যতদিন রাশিয়া এই চুক্তি অনুযায়ী না চলবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র এর থেকে বাইরে থাকবে। ট্রাম্পের বক্তব্যের পরদিন ফরাসী পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয় যে, ফ্রান্সের সাথে জার্মানি, বেলজিয়াম, স্পেন, ফিনল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, চেক রিপাবলিক এবং সুইডেন এই চুক্তিকে সন্মান করে যাবে। ফরাসীরা বলছে যে, রাশিয়া যে চুক্তি পুরোপুরি মানছে না, এই ব্যাপারটাতে তার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমত; তদুপরি তারা এই চুক্তিতে থাকবে। অপরদিকে রাশিয়ার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেন যে, ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়াটা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যে হুমকিস্বরূপ। আর রাশিয়া এই চুক্তি মানছে না বলে যুক্তরাষ্ট্র যে অভিযোগ করছে, সেব্যাপারে তিনি বলেন যে, ওয়াশিংটন এই অভিযোগের সমর্থনে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মাঝে স্বাক্ষরিত এবং ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া ‘নিউ স্ট্র্যাটেজিক আর্মস রিডাকশন টকস’ বা ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারেও সন্দেহ তৈরি হলো। এটা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবায়ন হবার কথা রয়েছে। ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া নিজেদের কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা সাড়ে ১৫’শএর মাঝে সীমাবদ্ধ্ব করতে সম্মত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো অংশীদাররা রাশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগগুলির ক্ষেত্রে একমত হলেও তারা চুক্তি থেকে মার্কিনীদের বের হয়ে যেতে মানা করেছিল। ন্যাটোর এক কর্মকর্তা ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, ২০১৮ সালে শীর্ষ বৈঠকে যখন কথা উঠেছিল যে রাশিয়া কিছু বিশেষ স্থানেই শুধু এই চুক্তির বাস্তবায়ন করছে, তখনই নিরাপত্তার অবমূল্যায়নের ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

১৯৫৫ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের মার্কিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রস্তাব দেয় যে একে অপরের আকাশসীমায় গোয়েন্দা বিমান প্রেরণের মাধ্যমে উভয় পক্ষের সন্দেহ দূরীকরণ করা যেতে পারে। একে অপরের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হওয়া যাবে যে একজন অপরের উপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে না। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ বলেন যে, সোভিয়েতরা মার্কিন কনসেপ্ট বা চিন্তার সাথে একমত নয়। তবে আইজেনহাওয়ারের এই প্রস্তাবের ৩৪ বছর পর আরেকজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এধরনেরই আরেকটা প্রস্তাব নিয়ে আসেন, যার মাধ্যমে ন্যাটো এবং সোভিয়েত নেতৃত্বে থাকা ওয়ারস প্যাক্টের মাঝে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের খাতিরে নিজেদের আকাশসীমায় অপরের গোয়েন্দা বিমান ওড়ানোর কথা বলা হয়। এই আলোচনা চলার মাঝেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়; তবে আলোচনা চলে। অবশেষে ১৯৯২ সালের মার্চে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াসহ ২৪টা দেশ ‘ওপেন স্কাইজ ট্রিটি’ স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে সকল দেশের জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন আদায় এবং সকল শর্ত চুড়ান্ত হবার পর ২০০২ সালের ২রা জানুয়ারি এই চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হয়। এই কর্মকান্ড বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র ‘ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি’ বা ‘ডিটিআরএ’ নামের একটা সংস্থা গঠন করে। এই সংস্থার অধীনে দু’টা ‘ওসি-১৩৫বি’ গোয়েন্দা বিমান রয়েছে। রাশিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং ইউক্রেনের কিছু গোয়েন্দা বিমানকে এই চুক্তির অধীনে প্রতিপক্ষের দেশের আকাশসীমায় ছবি তোলার সার্টিফিকেট দেয়া হয়। পশ্চিমা দেশগুলিও এই কাজে নিজেদের বিমান নিয়োজিত করে। ক্যামেরাগুলি বাজারে পাওয়া বাণিজ্যিক ক্যামেরা হবার শর্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা দেবার আগ পর্যন্ত এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ছিল ৩৫।

চুক্তি থেকে বের হয়ে যাবার কথা অনেক আগ থেকেই চলছিল। চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত বিমানগুলি প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো, এবং এগুলির রক্ষণাবেক্ষণের পিছনে অনেক খরচ করতে হয়। গত অক্টোবরে মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, প্রেসিডেন্টের উচিৎ ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়া এবং এই কাজ থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েক’শ মিলিয়ন ডলারকে অন্য গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ব্যবহার করে মার্কিন সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তবে যারা চুক্তির পক্ষে রয়েছেন, তাদের পক্ষেও রয়েছে যুক্তি। কানাডিয়ান সামরিক বিশ্লেষক স্টেফান ওয়াটকিন্স চুক্তির সুফলগুলি নিয়ে বলেন যে, এই চুক্তির কারণে পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিরা রুশ প্রতিনিধিদের সাথে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আলোচনা করতে পারছেন। এর মাধ্যমে তারা ওপাড়ের অবস্থার একটা ধারণা পান। ওপাড়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা, অথবা সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে কিনা, সেব্যাপারে তারা তথ্য পেয়ে থাকেন। নিজেদের মাঝে যোগাযোগের ফলে পারস্পরিক বিশ্বাসের দিক থেকে উন্নয়ন হয়। অপরদিকে ‘সেন্টার ফর স্ট্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর এরোস্পেস বিশেষজ্ঞ টড হ্যারিসন বলছেন যে, এই চুক্তির অধীনে ৩০ সেন্টিমিটার রেজোলিউশনের ছবি তোলা যায়, যা বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবির চাইতে আলাদা কিছু নয়। স্যাটেলাইট ব্যবহারের যুক্তির সমালোচনা করে মার্কিন ‘কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস’এর পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এমি উলফ বলছেন যে, স্যাটেলাইটের ছবিগুলি বহুদূর থেকে তোলা হয় বিধায় বায়ুমন্ডলের ধূলাবালির কারণে ছবির মান ভালো হয়না; অন্যদিকে বিমানগুলি ভূমির অনেক কাছ দিয়ে ওড়ে বিধায় সেগুলি অনেক ভালো মানের ছবি দেয়। তাছাড়া বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের ছবি কেউ পরিবর্তন বা বিকৃত করেও সরবরাহ করতে পারে। যেসব দেশের স্যাটেলাইট থেকে ছবি তোলার সক্ষমতা নেই, সেসব দেশ বিমান থেকে তোলা ছবির উপর নির্ভর করতে পারে। এভাবে পুরো ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। টড হ্যারিসন বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার পুরোনো ‘ওসি-১৩৫বি’ বিমানগুলি অবসরে পাঠিয়ে দিলেও নিজেরা চুক্তির মাঝে থাকতে পারে। এতে অন্য দেশগুলি এই চুক্তির সুবিধাগুলি পাবে। আর যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের বিমান ব্যবহার করেও এই কাজ সম্পাদন করতে পারে।

করোনাভাইরাসের মহামারির মাঝে অর্থনৈতিক ধ্বসের পরেও প্রতিরক্ষা বাজেটের কতটা আগের মতোই রাখা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। আর তন্মধ্যে রুশ সহযোগিতার ব্যাপারে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তির পিছনে কয়েক’শ মিলিয়ন ডলার খরচ করাটা ট্রাম্প সরকারের কাছে সমর্থনযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থ খরচে ইউরোপের দেশগুলির নিরাপত্তা দেবার ব্যাপারটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ; কারণ এই দেশগুলির অনেকগুলিই এখন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পক্ষে থাকছে না। ন্যাটোর সদস্য হিসেবে ইউরোপের দেশগুলি নিজেদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করছে না; যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ন্যাটো দেশগুলির টানাপোড়েন চলছে বেশকিছুদিন ধরেই। আর করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ইউরোপের অনেক দেশই চীনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়েছে; যা ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। অথচ মার্কিন চিন্তাবিদদের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীই এখন চীন। ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তিতে ইউরোপ, রাশিয়া থাকলেও চীন নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার নিজের তৈরি করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই বের হয়ে যাচ্ছে; যা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার স্থায়িত্বকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ইউরোপের ছোট দেশগুলির যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতার দিন যেমন ঘনিয়ে আসছে, তেমনি কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে।


Friday 22 May 2020

মালদ্বীপে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ঘনীভূত হচ্ছে

২৩শে মে ২০২০
   
মে মাসের স্যাটেলাইট ছবি। ‘ফেইধু ফিনোলহু’ দ্বীপে রেজর্ট তৈরির কাজ করতে গিয়ে দ্বীপকে বড় করছে চীনা কোম্পানি। রেজর্ট তৈরির জন্যে আরও অনেকেই মালদ্বীপে দ্বীপ লীজ নিলেও চীনাদের এই লীজ নেয়া এবং দ্বীপ উন্নয়নের কাজের ব্যাপারে ভারতীয় চিন্তাবিদেরা বিশেষভাবে চিন্তিত।

মে মাসে স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষকরা বলেন যে, মালদ্বীপে চীনারা একটা দ্বীপের উন্নয়ন কাজ বেশ এগিয়ে নিয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যেখানে এই দ্বীপের আকৃতি ছিল মাত্র ৩৮ হাজার বর্গ মিটার, সেখানে ২০২০এর ফেব্রুয়ারিতে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ বর্গ মিটার। ‘ফেইধু ফিনোলহু’ নামে রাজধানী মালের কাছাকাছি অবস্থিত এই দ্বীপটা একসময় ছিল একটা জনমানবশূণ্য দ্বীপ। মালদ্বীপের পুলিশ ওয়েলফেয়ার কোম্পানির অধীনে থাকা এই দ্বীপটাকে ২০১৭ সালে একটা চীনা কোম্পানির কাছে রেজর্ট তৈরির জন্যে ৪ মিলিয়ন ডলারে ৫০ বছরের জন্যে লীজ দেয়া হয়। এই সময়ের মাঝে পুলিশ ওয়েলফেয়ার সেই কোম্পানির কাছ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলার পাবে। মালদ্বীপে দ্বীপ লীজ দেয়াটা নতুন নয়। এই লীজের আগে পাঁচ বছরের মাঝে কয়েক ডজন মানবশূণ্য দ্বীপ রেজর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে দেশী এবং বিদেশী কোম্পানির কাছে লীজ দেয়া হয়। তবে ২০১৬ সালে লীজ দেয়ার নিয়মকানুনে কিছু পরিবর্তন এনে ‘ক্লোজড’ বিডিংএর অনুমোদন দেয়া হয়। রেজর্ট তৈরির জন্যে আরও অনেকেই মালদ্বীপে দ্বীপ লীজ নিলেও চীনাদের এই লীজ নেয়া এবং দ্বীপ উন্নয়নের কাজের ব্যাপারে ভারতীয় চিন্তাবিদেরা বিশেষভাবে চিন্তিত। মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগ ভারতীয়দের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ‘ইন্ডিয়া টুডে’র এক প্রতিবেদনে চীনা এই প্রকল্পকে ভারত মহাসাগরে চীনাদের প্রভাব বৃদ্ধির প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করা হয়। তবে মালদ্বীপে ভারত এবং চীনের এই দ্বন্দ্বকে বুঝতে হলে আরও অনেকগুলি ক্ষেত্রের দিকে তাকাতে হবে।

মালদ্বীপে চীনাদের প্রভাব বৃদ্ধির শুরু ২০০৯ সালের পর থেকে; যখন প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। গাইয়ুমের উত্তরসুরী মোহামেদ নাশীদ ভারত-ঘেঁষা বলেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে মোহাম্মেদ ওয়াহিদ হাসান প্রেসিডেন্ট হবার পর পরিস্থিতি বেশ কিছুটাই পাল্টে যায়। মোহামেদ নাশীদের সমর্থকেরা ওয়াহিদের সরকারকে কাজ করতে না দিলেও কিছু ব্যাপারে ওয়াহিদ সরকারের সিদ্ধান্ত মালদ্বীপের রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস দেয়। ‘দ্যা ইকনমিক টাইমস’ বলছে যে, ২০১০ সালের জুনে মালদ্বীপের মূল বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ দেয়া হয় ভারতীয় কোম্পানি ‘জিএমআর গ্রুপ’কে। ৫’শ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প ভারতকে দেয়ার জন্যে সেসময় প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশীদের সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তবে মোহাম্মেদ ওয়াহিদ হাসানের সরকার ২০১২ সালের নভেম্বরে এই প্রকল্প বাতিল করলে ভারতীয় কোম্পানি সিঙ্গাপুরের আদালতে মামলা করে। তবে বিমানবন্দরের কাজ ভারতীয়দের না পাওয়াটা ভূরাজনীতিতে মালদ্বীপের অবস্থান পরিবর্তিত হবার লক্ষণ হিসেবে আবির্ভূত হয়। যা সবসময় ভারত তার নিজের প্রভাবের জায়গা মনে করতো, তার ব্যাপারে এখন অতটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
   
মালদ্বীপের মতো ছোট্ট দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ না হলে এখানে সাড়ে তিন কিঃমিঃ লম্বা বিশাল রানওয়ের আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরির প্রশ্নই উঠতো না। রয়াল নিয়জিল্যান্ড এয়ার ফোর্সের পরিবহণ বিমান এবং এয়ার সিলনের বাণিজ্যিক ফ্লাইটই বলে দিচ্ছে যে, এই বিমানবন্দরের বেসামরিক এবং সামরিক কোন বিভেদ নেই। এখন বেসরকারি বিমানবন্দর হওয়া সত্ত্বেও কৌশলগত দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন।

মালদ্বীপে বিমানবন্দরের ভূরাজনীতি

মালদ্বীপে বিমানবন্দর তৈরির ইতিহাসটা আলোচনায় আনা যেতে পারে। মালদ্বীপের এই বিমানবন্দর শুধু বেসামরিক বিমানবন্দরই নয়; একমাত্র বড় বিমানবন্দর। ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়া থেকে এই মালে বিমানবন্দরের দূরত্ব প্রায় ১৩’শ কিঃমিঃ। ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে মালের দূরত্ব প্রায় ৫’শ কিঃমিঃ; আর শ্রীলংকার কলম্বো থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৭’শ কিঃমিঃ। শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের মাঝ দিয়ে যাওয়া পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্য রুটগুলির একটা মালে থেকে মাত্র ৪’শ কিঃমিঃএর দূরত্বে মালদ্বীপের উত্তরের দীপগুলি এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যায়। লাক্ষাদ্বীপের আগাত্তিতে ভারতের একটা বিমানবন্দর থাকলেও সেখানে লজিস্টিক্যাল কারণে নিয়মিত বিমান ওঠানামা করানো কঠিন। অন্যদিকে মালে বিমানবন্দর ২০১৯ সালে ৫৪ হাজার ফ্লাইটে ৪৮ লক্ষ যাত্রী এবং প্রায় ৬৫ হাজার টন মালামাল হ্যান্ডলিং করেছে। মালদ্বীপের সর্বউত্তরে হানিমাধুতে আরেকটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকলেও সেটা লজিস্টিক্যাল দিক থেকে মালে বিমানবন্দরের ধারেকাছেও নয়। মালদ্বীপের দক্ষিণে কাধধুতে একটা এবং হুলুওয়ারোলুতে আরেকটা ছোট বিমানবন্দর রয়েছে।

মালদ্বীপের মূল দ্বীপ মালের সাথে লাগোয়া মালে এটলএর একটা অংশ হুলহুলে দ্বীপে ১৯৬০ সালের অক্টোবরে একটা বিমানবন্দর তৈরি করা হয়। প্রায় ৩ হাজার ফুট লম্বা এই রানওয়েতে ১৯শে অক্টোবর রয়াল নিউজিল্যান্ড এয়ার ফোর্সের একটা পরিবহণ বিমান অবতরণ করে। প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট ছিল এয়ার সিলনের; ১৯৬২ সালের এপ্রিলে। মালদ্বীপের শেষ সুলতান মোহাম্মদ ফরীদ দিদিএর অধীনে প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম নাসিরের তত্বাবধানে ১৯৬৬ সালে এই বিমানবন্দরের রানওয়ে উন্নয়নের কাজ করা হয়। ১৯৭২ সালের দিকে মালদ্বীপে পর্যটকদের ঢল আসতে থাকলে নতুন একটা আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরির গুরুত্ব বোঝা যেতে শুরু করে। ১৯৮১ সালে মালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু করা হয়। ২০১০ সালের জুলাই মাসে নাশীদ সরকার বিশ্বব্যাংকের অধীন ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স কর্পোরেশন’ বা ‘আইএফসি’র উপদেশে বিমানবন্দরটাকে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কাজ যৌথভাবে পায় মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টস এবং ভারতের জিএমআর গ্রুপ। ভারতীয়দের হাতে থাকে ৭৭ শতাংশ মালিকানা; মালয়েশিয়ার হাতে ২৩ শতাংশ। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট নাশীদ এই বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ইব্রাহিম নাসির বিমানবন্দর। মালদ্বীপের মতো ছোট্ট দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ না হলে এখানে সাড়ে তিন কিঃমিঃ লম্বা বিশাল রানওয়ের আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরির প্রশ্নই উঠতো না। পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্যেই এই বিমানবন্দরের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছিল। রয়াল নিয়জিল্যান্ড এয়ার ফোর্সের পরিবহণ বিমান এবং এয়ার সিলনের বাণিজ্যিক ফ্লাইটই বলে দিচ্ছে যে, এই বিমানবন্দরের বেসামরিক এবং সামরিক কোন বিভেদ নেই। এখন বেসরকারি বিমানবন্দর হওয়া সত্ত্বেও কৌশলগত দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন।

২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম সিঙ্গাপুরের সরকারি কোম্পানি ‘সুবর্ন জুরং’এর কাছে বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপনার কাজ দেয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সৌদি আরব বিমানবন্দরের উন্নয়নে ১’শ মিলিয়ন ডলার দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। ওপেক ফান্ড দেয় ৫০ মিলিয়ন ডলার। একইসাথে আবুধাবি এবং কুয়েতও এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে। নতুন টার্মিনালের ডিজাইন এবং কন্সট্রাকশনের কাজ পায় সৌদি বিল্লাদিন গ্রুপ। রানওয়ের উন্নয়ন এবং পানি থেকে ওঠানামা করতে পারা ৮৫টা বিমানের ধারণক্ষমতার সীপ্লেন টার্মিনালের কনসালট্যান্সির কাজ পায় মার্কিন কোম্পানি ‘ল্যানড্রাম এন্ড ব্রাউন’; ৩৪’শ মিটার লম্বা রানওয়ে তৈরির কাজ পায় চীনা কোম্পানি ‘বেইজিং আরবান কন্সট্রাকশন গ্রুপ’। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন বিমানবন্দরের নাম আবারও পরিবর্তন করে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম নাসিরের পরিবারের নামানুসারে রাখেন ভেলানা বিমানবন্দর। ২০১৯ সালে বিমানবন্দরের নতুন রানওয়েতে বিমান ওঠানামা শুরু হয়। মালদ্বীপে বিমানবন্দরের মূল উন্নয়নের কাজ ভারতীয়রা না পেলেও তা কিন্তু চীনারাও পায়নি। বরং সেটা গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু দেশ সৌদি আরব, আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরের কাছে। চীনারা রানওয়ে উন্নয়নের কাজে থাকলেও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল না তারা।
  
মালদ্বীপের রাজধানী মালে শহর। মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পে চীনারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। বেশি সংখ্যক পর্যটকের উৎস হওয়ায় চীনারা মালদ্বীপের অর্থনীতিতে বড় অবদানের অংশীদার হয়ে গিয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামার কারণে মালদ্বীপের অর্থনীতি ২০২০ সালে সাড়ে ৮ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।

মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবে মালদ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র ৫ লক্ষ ১৫ হাজারের মতো। অথচ দেশটাতে একবছরে পর্যটকের সংখ্যা দেশটার মোট জনসংখ্যার তিন গুণেরও বেশি! মালদ্বীপের ৩০ শতাংশ লোকের বাসবাস রাজধানী মালেতে; বাকিরা প্রায় ২’শ দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পুরো দেশের ভূমি ৩’শ বর্গকিঃমিঃএরও কম! মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ১২ হাজার ডলার। মালদ্বীপের অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল পর্যটনের উপর। দেশটার জিডিপির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ৪৫ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান এই সেক্টরে। মালদ্বীপের ৪০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই সেক্টরের মাধ্যমে। গত প্রায় এক দশক ধরেই মালদ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা প্রতিবছরই গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে। মালদ্বীপের মিডিয়া ‘এডিশন’ বলছে যে, দেশটায় মোট হোটেল শয্যার সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজারের মতো। ২০১৯ সাল জুড়ে প্রায় ৬০ শতাংশের মতো হোটেল রুম ভর্তি ছিল। কাজেই মালদ্বীপের অর্থনীতির চাবি এই পর্যটন শিল্পের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পে চীনারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। মালদ্বীপের সরকারের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, ২০১৯ সালে ২ লক্ষ ৮০ হাজারের বেশি চীনা পর্যটক মালদ্বীপে ভ্রমণ করেছে। একই বছরে মালদ্বীপে রেকর্ড ১৭ লক্ষেরও বেশি পর্যটক এসেছিল। এর মাঝে ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার বা ৪৯ শতাংশ এসেছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। মালদ্বীপের মিডিয়া ‘আভাস’ বলছে যে, একটা দেশ থেকে সবচাইতে বেশি পর্যটক আসার কথা বলা হলে সেটা চীন; মোট পর্যটকের প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মাঝে মালদ্বীপে চীনা পর্যটকের সংখ্যা ৬৭ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ২ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ ৩২ হাজার হয়ে যায়; যদিও এরপর থেকে চীনা পর্যটকের সংখ্যা মোটামুটিভাবে ৩ লক্ষ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষের কাছাকাছিই ছিল। তবে ভারত মালদ্বীপে চীনা পর্যটকদের দৌরাত্মকে ব্যালান্স করতে সেখানে ভারতীয় পর্যটকদের যাতায়াত সহজ করেছে। এর ফলে ২০১৯ সালে মালদ্বীপে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা আগের বছরের চাইতে ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার হয়। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজারের মতো। আর ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১ হাজারের মতো। অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০১৯এর মাঝে মালদ্বীপে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পরেও এখনও তা মোট পর্যটকের ১০ শতাংশ; অর্থাৎ চীনের চাইতে কম। বেশি সংখ্যক পর্যটকের উৎস হওয়ায় চীনারা মালদ্বীপের অর্থনীতিতে বড় অবদানের অংশীদার হয়ে গিয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামার কারণে মালদ্বীপের অর্থনীতি ২০২০ সালে সাড়ে ৮ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
  
মালদ্বীপের উন্নয়ন কাজে বাংলাদেশী কর্মীদের অবদান অনস্বীকার্য। খুব কম পারিশ্রমিকে এবং অপ্রতুল আবাসস্থলে থাকার পরেও তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করছে হুলহুমালে দ্বীপ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর এই শ্রমিকেরাই সবচাইতে বেশি বিপদে রয়েছে। ভারত যেখানে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের নাগরিকদের সেখান থেকে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে, বাংলাদেশ সেখানে নিজেদের সামরিক বিমান এবং সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের মেডিক্যাল কর্মী এবং ত্রাণ সামগ্রী দিতে; যা কিনা ভারতকে আরও বিচলিত করেছে।


বিদেশী কর্মীর উৎসে উত্থান পতন

অন্যদিকে মালদ্বীপের পর্যটন শিল্প, তথা পুরো অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে বিপুল সংখ্যক বিদেশী কর্মীর উপর। মালদ্বীপের মিডিয়া ‘এডিশন’ বলছে যে, মালদ্বীপে বৈধভাবে কর্মরত রয়েছে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৬’শ বিদেশী কর্মী। এর বাইরেও অবৈধভাবে কাজ করছে ৬৩ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই বিদেশী কর্মীদের মাঝে বেশিরভাগই হলো বাংলাদেশী। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহর সরকার ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে যে কোন একটা দেশ থেকে দেড় লক্ষের বেশি কর্মী না নেবার কথা ঘোষণা করে। তবে প্রকৃতপক্ষে এই ঘোষণাটা ছিল বাংলাদেশীদের টার্গেট করে। মালদ্বীপের অর্থমন্ত্রী আহমেদ ফাইয়াজ বলেন যে, দেড় লক্ষের এই কোটা পার হয়ে যাবার কারণে মালদ্বীপ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মালদ্বীপে বাংলাদেশের দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এটিএম মোশফিকুর রহমান বলেন যে, মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশের দূতাবাসকে এব্যাপারে কিছুই বলেনি। আর যেহেতু মালদ্বীপে বাংলাদেশীদের সংখ্যা এক লক্ষের বেশি নয়, তাই দেড় লক্ষের এই কোটা বাস্তব নয়। আর প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী এই মুহুর্তে মালদ্বীপে ‘অবৈধ’ভাবে রয়েছে। তিনি বলেন যে, অনেক সময় চাকুরিদাতা কোম্পানি বেতন ঠিকমতো দেয়না। তখন কর্মীরা চাকুরি পরিবর্তন করে; এবং ‘অবৈধ’ আখ্যা পায়। বাংলাদেশ দূতাবাস মালদ্বীপকে অনেকদিন থেকেই এই ৪০ হাজার কর্মীকে ‘বৈধতা’ দেবার কথা বলে আসছে। মালদ্বীপের বর্তমান সরকার বাংলাদেশী কর্মীদের ব্যাপারে যেকথাই বলুক না কেন, মালদ্বীপের উন্নয়ন কাজে বাংলাদেশী কর্মীদের অবদান অনস্বীকার্য। খুব কম পারিশ্রমিকে এবং অপ্রতুল আবাসস্থলে থাকার পরেও তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করছে হুলহুমালে দ্বীপ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর এই শ্রমিকেরাই সবচাইতে বেশি বিপদে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপের জনগণ এবং এই শ্রমিকদের জন্যে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়। এটা সম্ভব হয়েছে দুই দেশের মানুষের মাঝে দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের কারণে। ভারত যেখানে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের নাগরিকদের সেখান থেকে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে, বাংলাদেশ সেখানে নিজেদের সামরিক বিমান এবং সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের মেডিক্যাল কর্মী এবং ত্রাণ সামগ্রী দিতে; যা কিনা ভারতকে আরও বিচলিত করেছে। এর আগে ২০০৪ সালে এশিয়ান সুনামির সময় এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মালদ্বীপের ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট অচল হয়ে গেলে বাংলাদেশ মালদ্বীপকে বিমান বাহিনীর পরিবহণ বিমান এবং নৌবাহিনীর জাহাজে করে ত্রাণ পাঠিয়েছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মালদ্বীপ সফর করে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা দপ্তরের জন্যে ৭টা সামরিক ট্রাক উপহার হিসেবে দিয়ে আসেন।

মালদ্বীপের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুকের তথ্য অনুসারে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপে বৈধ বিদেশী কর্মীদের মাঝে সবচাইতে বেশি প্রায় ৬ থেকে ৯ হাজার ছিল শ্রীলঙ্কান। ১৯৯৮ সাল থেকে ভারতীয় কর্মী বাড়তে থাকে; ১৯৯৭ সালে ৫ হাজার থেকে ২০০৭ সালে তা প্রায় ২৩ হাজারে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশী কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ হাজার। ২০০৪ থেকে তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে এবং ২০০৮ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ হাজার হয়ে যায়। সেসময় ভারতীয় কর্মী ছিল প্রায় ২২ হাজার এবং শ্রীলঙ্কান প্রায় ১০ হাজার। বাংলাদেশী কর্মীদের এই সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো মালদ্বীপের কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি। পর্যটন সেক্টরে ২০০৩ সালে ১০ হাজার বিদেশী কর্মী কাজ করছিল; যা ২০১১ সাল নাগাদ বেড়ে ১৪ হাজারের মতো হয়। অন্যান্য সার্ভিসে বিদেশী কর্মী ৪ বা ৫ হাজার থেকে বেড়ে ৬ থেকে ১০ হাজার হয়। কিন্তু কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিদেশী কর্মী ২০০২ সালে ৫ হাজার থেকে বেড়ে ২০০৮ সাল নাগাদ প্রায় ৩৫ হাজার হয়ে যায়। মালদ্বীপে কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি এতটা বড় হলো কি করে? এই উত্তর পেতে তাকাতে হবে মালদ্বীপে বিনিয়োগের উৎসের দিকে।
  
হুলহুলের সাথে রাজধানী মালের যোগাযোগ স্থাপন করে দিয়েছে চীনের নির্মিত ‘সিনামালে’ সেতু। ২’শ ১০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত এই সেতুর খরচের ১’শ ২৬ মিলিয়ন চীনারা অনুদান হিসেবে দিয়েছে; আর ৭২ মিলিয়ন দিয়েছে ঋণ হিসেবে। এই সেতু তৈরির মাঝে তিনটা সরকার ক্ষমতায় ছিল; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়নি। চীনারা মালদ্বীপে নতুন করে কিছু করেনি; তারা শুধু মালদ্বীপের দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা রাষ্ট্রীয় দ্বীপ উন্নয়নের কাজে যোগ দিয়েছে মাত্র।

চীনা ঋণের ফাঁদে?

২০১৮ সালের নভেম্বরে মোহামেদ সলিহর নতুন সরকার ক্ষমতা নেবার পর পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় যে, চীনা ঋণে জর্জরিত মালদ্বীপকে চীনারা ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের বিল ধরিয়ে দিয়েছে। এই কথাগুলি বলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশীদ, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। ‘রয়টার্স’ নাশীদের কথার উপর ভিত্তি করেই বলে যে, মালদ্বীপে চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং লীঝং লিখিতভাবে এই অর্থ ফেরত চান। মালদ্বীপের কর্মকর্তারা বলছেন যে, মালদ্বীপের মতো অর্থনীতির পক্ষে চীনা ঋণ ফেরত দেয়া কঠিন হবে। চীনা রাষ্ট্রদূত মালদ্বীপের মিডিয়া ’আভাস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে নাশীদের এই দাবিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, এধরনের কোনকিছুই মালদ্বীপের কাছে দাবি করা হয়নি; আর মালদ্বীপের কাছে চীনের পাওনা রয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো; নাশীদ যা বলছেন তা নয়। এর মাঝে সমুদ্রের মাঝ দিয়ে ‘সিনামালে’ সেতু তৈরি, বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ, এবং সমুদ্র থেকে ভূমি মুক্ত করে সেখানে দু’টা রেসিডেনশিয়াল টাওয়ার ব্লক তৈরিতে চীন ঋণ দিয়েছে ৬’শ মিলিয়ন ডলার; আর বাকি ৯’শ মিলিয়ন ডলার বাণিজ্যিক ঋণ হিসেবে মালদ্বীপের সরকারি কোম্পানিগুলিকে দেয়া হয়েছে, যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে বাসস্থান তৈরিতে। মালদ্বীপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মালদ্বীপ মনেটারি অথরিটির গভর্নর আহমেদ নাসিরও চীনা ঋণের ব্যাপারে এই অংকই বলেছেন। কিন্তু চীনাদের ঋণেই কি মালদ্বীপ জর্জরিত? মালদ্বীপের সকল প্রকল্পই কি চীনাদের প্রকল্প?

২০০০ সালের দিকে মালদ্বীপের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ছিল সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ; এটা ২০০৮ সালে প্রায় ৭ শতাংশ হয়ে যায়। আর ২০১১ সাল নাগাদ তা জিডিপির ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কন্সট্রাকশন সেক্টরে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যাটাও এর সাথেই যায়; ২০০২ সালে ৫ হাজার কর্মী থেকে ২০০৮ সালে তা হয়ে যায় ৩৫ হাজার। চীনারা তখনও কিন্তু মালদ্বীপে বিনিয়োগ শুরু করেনি। ২০০৭ সালে বেইজিংএ মালদ্বীপের দূতাবাস খোলা হলেও মালদ্বীপে চীনের দূতাবাস খোলা হয় মাত্র ২০১১ সালে। অর্থাৎ মালদ্বীপে বিনিয়োগ এবং কন্সট্রাকশন সেক্টরের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি খুঁজতে বেইজিং নয়, অন্য কোথাও খুঁজতে হবে।
   


হুলহুমালে প্রকল্পই হচ্ছে সেই প্রকল্প, যা মালদ্বীপে নতুন করে বিদেশী কর্মীদের ঢল এনেছে। এই প্রকল্প মহাসাগরের জলরাশির মাঝে শুধু একটা নতুন দ্বীপ তৈরিই নয়; এটা মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প; সেদেশের মানুষের আশা। তাই দুই দশকের বেশি সময় ধরে হুলহুমালে শহরের কাজ চলছে। মাঝে পাঁচটা সরকার এবং বহু রাজনৈতিক টানাপোড়েন গিয়েছে; গিয়েছে বহু ভূরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। প্রকল্পে পরিবর্তন এসেছে; কনট্রাক্টর পরিবর্তন হয়েছে; অর্থায়নকারী পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়নি। বিমানবন্দর নিয়ে রাজনীতি হয়েছে; ভারতীয়রা বাদ পড়েছে; কিন্তু প্রকল্প বাতিল হয়নি।

হুলহুমালে - মালদ্বীপের আশা

১৯৯০এর দশকের মাঝামাঝি মালে বিমানবন্দরের উত্তরে সমুদ্র থেকে ভূমি মুক্ত করে নতুন একটা দ্বীপ তৈরির পরিকল্পনা শুরু করা হয়। উদ্দেশ্য, নতুন একটা শহর তৈরি করা এবং মালে দ্বীপের মাত্র ৫ দশমিক ৮ বর্গকিঃমিঃ জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের জন্যে স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করা। প্রায় দু’শ দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলিকেও এখানে নিয়ে এসে নাগরিক সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়। প্রথম ফেইজে মাটি ফেলে ১’শ ৮৮ হেক্টর ভূমি সমুদ্রের নিচ থেকে মুক্ত করে আনার কাজ শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। ২১ মিলিয়ন ডলার খরচে বেলজিয়ামের ‘ড্রেজিং ইন্টারন্যাশনাল’ ড্রেজিং করে বালু ভরাটের কাজ করে। এই কাজ শেষ হয় ২০০২ সালে। ২০০১ সালের মাঝে সিঙ্গাপুরের একটা কোম্পানির তত্বাবধানে প্রথম মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়। ২০০৪ সালের মাঝামাঝি কিছু নতুন বাসস্থানের উদ্বোধনের মাধ্যমে নতুন শহর ‘হুলহুমালে’র জন্ম দেয়া হয়। প্রথমদিকে এখানে শুধু থাকার ব্যবস্থার কথা বলা হলেও পরবর্তীতে এখানে পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকমিউনিকেশন, ফিনান্স, ইন্ডাস্ট্রি, হাসপাতাল এবং শিক্ষার অবকাঠামো যোগ করার পরিকল্পনা করা হয়। এখানে বিজনেস পার্ক, আইটি পার্ক, ক্রুজ টার্মিনাল, মারিনা, পর্যটন জোন, থিম পার্ক, হোটেল, শপিং মল, অফিস বিল্ডিং, ইত্যাদি তৈরির জন্যে বিনিয়োগের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই শহরে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। পরিবেশগত দিক থেকেও হুলহুমালেকে এমন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে।

প্রথম ফেইজের কাজ শেষ হতে দশ বছর লেগে যায়। এই ফেইজে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেইজের জমি ভরাটের কাজ শুরু হয়। মাত্র ৭৭ দিনের মাঝে ২’শ ৪৪ হেক্টর জমি সমুদ্র থেকে মুক্ত করা হয়। সমুদ্রের প্রায় ৬০ মিটার নিচ থেকে সাকশন ড্রেজারের মাধ্যমে ৬০ লক্ষ কিউবিক মিটার বালু তুলে এখানে ফেলা হয়। বেলজিয়ামের কোম্পানি ‘ডিইএমই’এর অধীন ‘ড্রেজিং ইন্টারন্যাশনাল’ ৫০ মিলিয়ন ডলার খরচে এই কাজ করে। এই ফেইজে পরবর্তীতে মাস্টার প্ল্যানে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বেশিরভাগ জনগণের জন্যে যাতে গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিসগুলি দেয়া সম্ভব হয়, সেজন্য এই পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে বলেন ‘হাউজিং ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহামেদ সায়মন। দ্বিতীয় ফেইজে প্রায় ২ লক্ষ মানুষের স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকারি অফিসগুলিও হুলহুমালেতে স্থানান্তর করার কথা রয়েছে। আগে পরিকল্পনা না থাকলেও এখন হুলহুমালেতে উঁচু দালান তৈরি করা হচ্ছে। ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এর হেং চিয়ে কিয়াং এন্ড লো বুন ইয়াংএর উপদেশ, তত্ত্বাবধান এবং ডিজাইনে এই কাজগুলি সম্পাদন করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ফেইজে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তিন লেনের রাস্তা তৈরির কাজ করছে ভারতীয় কোম্পানি ‘মোহন মুথা এক্সপোর্টস’ এবং ‘অশোকা বিল্ডকন’।
  
৪’শ ৩৪ মিলিয়ন ডলার খরচে ১৬টা ২৫ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিংএর প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না’র ঋণে। নতুন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ সলিহর সরকার ২০১৯এর শুরুর দিকে রেসিডেশিয়াল প্রকল্পগুলিতে পরিবর্তন এনে দুই রুমের এপার্টমেন্টের পরিবর্তে ৩ রুমের এপার্টমেন্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তা-ই নয়, চীনা প্রকল্পে তৈরি হয়ে যাওয়া বিল্ডিংগুলিতে এপার্টমেন্টের ডিজাইনে পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়।

বর্তমানে হুলহুমালেতে মালদ্বীপের সর্বোচ্চ ২৫ তলা অফিস বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে। আর ৬২টা ২৫ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ফেইজের অধীনে ৩৫ হাজার হাউজিং ইউনিট তৈরির টার্গেট রয়েছে। ৪’শ ৩৪ মিলিয়ন ডলার খরচে ১৬টা ২৫ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিংএর প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না’র ঋণে। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ‘চায়না স্টেট ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানি’। এখানে সাড়ে ৫’শ বর্গফুট আয়তনের এবং দুই বেড ও দুই বাথরুমের ছোট ফ্ল্যাটে ৭ হাজার পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হবে। এছাড়াও মালদ্বীপ পোর্টস লিমিটেড তৈরি করছে ৩টা ১৪ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিং, যেখানে ৫’শ ৩৪টা এপার্টমেন্ট থাকবে। নতুন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ সলিহর সরকার ২০১৯এর শুরুর দিকে রেসিডেশিয়াল প্রকল্পগুলিতে পরিবর্তন এনে দুই রুমের এপার্টমেন্টের পরিবর্তে ৩ রুমের এপার্টমেন্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তা-ই নয়, চীনা প্রকল্পে তৈরি হয়ে যাওয়া বিল্ডিংগুলিতে এপার্টমেন্টের ডিজাইনে পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়। ‘এইচডিসি’র নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুহাইল আহমেদ বলেন যে, তৈরি করা এই এপার্টমেন্টগুলি মালদ্বীপের মানুষের লাইফস্টাইলের সাথে যায় না বিধায় এগুলিকে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মালদ্বীপের একটা সাধারণ পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর সাথে দু’টা শিশু থাকে। এর বাইরে রাজধানী থেকে তাদের বাবা-মা অনেক সময়েই ভিজিট করেন; কাজেই তিন রুমের এপার্টমেন্টই মালদ্বীপের জন্যে বেশি চলনসই। সাড়ে ৫’শ বর্গফুটের এপার্টমেন্টগুলি খুবই সংকীর্ণ এবং এখানে লিফটের সংখ্যাও কম। তবে সুহাইল এটাও বলেন যে, বর্তমান সরকার এই প্রকল্পকে থামিয়ে দিতে চায় না। আর এপার্টগুলিকে ২৫ তলা উঁচু না করেই হুলহুমালেতে ১ লক্ষ ৬০ হাজার মানূষের বসবাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

বাসস্থান তৈরি ছাড়াও আরও অনেক প্রকল্প রয়েছে হুলহুমালেতে। ২০০৯ সালে মার্কিন কোম্পানি ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’এর সাথে ২’শ মিলিয়ন ডলারের ‘গাফারু’ বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ২০১১ সালে আলোচনা ভেস্তে গেলে প্ল্যান্টের কাজ পায় চীনা কোম্পানি ‘এক্সইএমসি’। ২০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ ছাড়াও ৩০ মেগাওয়াট এলএনজি চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে তারা। তবে চীনারা একা নয়; অন্যরাও হুলহুমালেতে বেশকিছু কাজ পেয়েছে। ২০১৬ সালে ভারতীয় কোম্পানি ‘আরপিপি গ্রুপ’এর অধীন ‘রেনাটাস প্রজেক্ট’ ৭২টা লাক্সারি এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ পায়। মালদ্বীপের নিজস্ব কোম্পানি ‘ব্যাচ কন্সট্রাকশন’কে দেয়া হয় ৬৯টা মিক্সড এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ; ‘দামাস কোম্পানি’ পায় ৯৫টা মিক্সড এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ; ‘এপোলো হোল্ডিংস’ পায় ৯৭টা এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ। হুলহুমালে ছাড়াও অন্য দ্বীপগুলিতেও অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে। ২০১৯ সালে আমিরাতের ৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তায় মালের দেড়’শ কিঃমিঃ উত্তরে রা এটলের ভান্ধু দ্বীপে আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির একটা কেন্দ্র তৈরি করা হয়। পুরো মালদ্বীপ জুড়ে হাইব্রিড পাওয়ার জেনারেশনের জন্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাপান সরকার ৫৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছে।

হুলহুমালে প্রকল্পই হচ্ছে সেই প্রকল্প, যা মালদ্বীপে নতুন করে বিদেশী কর্মীদের ঢল এনেছে। এই প্রকল্প মহাসাগরের জলরাশির মাঝে শুধু একটা নতুন দ্বীপ তৈরিই নয়; এটা মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প; সেদেশের মানুষের আশা। তাই দুই দশকের বেশি সময় ধরে হুলহুমালে শহরের কাজ চলছে। মাঝে পাঁচটা সরকার এবং বহু রাজনৈতিক টানাপোড়েন গিয়েছে; গিয়েছে বহু ভূরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। প্রকল্পে পরিবর্তন এসেছে; কনট্রাক্টর পরিবর্তন হয়েছে; অর্থায়নকারী পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়নি। বিমানবন্দর নিয়ে রাজনীতি হয়েছে; ভারতীয়রা বাদ পড়েছে; কিন্তু প্রকল্প বাতিল হয়নি। এই শহরের সাথে হুলহুলে দ্বীপে অবস্থিত মালে বিমানবন্দরের সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে। আর হুলহুলের সাথে রাজধানী মালের যোগাযোগ স্থাপন করে দিয়েছে চীনের নির্মিত ‘সিনামালে’ সেতু। ২’শ ১০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত এই সেতুর খরচের ১’শ ২৬ মিলিয়ন চীনারা অনুদান হিসেবে দিয়েছে; আর ৭২ মিলিয়ন দিয়েছে ঋণ হিসেবে। এই সেতু তৈরির মাঝে তিনটা সরকার ক্ষমতায় ছিল; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়নি। চীনারা মালদ্বীপে নতুন করে কিছু করেনি; তারা শুধু মালদ্বীপের দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা রাষ্ট্রীয় দ্বীপ উন্নয়নের কাজে যোগ দিয়েছে মাত্র। এখানে চীনারা ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ভারত, সৌদি আরব, আমিরাত, কুয়েত, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম এবং আরও অনেকেই রয়েছে। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞ সফল করতে হাজারো কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতীয়দের কাছে চীন এবং সৌদি গ্রুপ কারুর বিনিয়োগই পছন্দনীয় হয়নি। ‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি বলেন যে, চীন এবং সৌদি আরব মালদ্বীপে একটা বাজে ভূমিকা নিয়েছে, যার মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে। চেলানির চিন্তাগুলি ভারতের রাষ্ট্রচিন্তারই প্রতিফলক। শুধু চীনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগই নয়, মালদ্বীপে বাংলাদেশী কর্মীদের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং সেখানে চীনা পর্যটকদের আনাগোণাকেও ভারত হুমকি হিসেবে দেখছে। মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় মালদ্বীপকে ভারত তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে আরও বড় হুমকি হিসেবে দেখেছে। একইভাবে মালদ্বীপের ব্যাপারে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অবস্থানকেও ভারত সবসময় সন্দেহের চোখে দেখেছে।
  
মালদ্বীপের ব্যাপারে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব ভিন্ন। বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথগুলির একটা মালদ্বীপের উত্তর সীমানা ঘেঁষে গিয়েছে; আর ভারত মহাসাগরের ব্রিটিশ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়াও মালদ্বীপ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে খেয়াল রাখছে, তা ছোট্ট দেশটার অপেক্ষাকৃত বৃহৎ বিমানবন্দরের কাজের ভাগবাটোয়ারা দেখলেই বোঝা যায়। চীনের প্রভাবকে কমাতে ভারতকে অখুশি করাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ খুব কমই খুন্ন হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তাহীনতা বরং ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি টেনেছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যালান্স করতে মালদ্বীপে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলির বিনিয়োগ টেনে এনেছে।



সমুদ্র বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে মালদ্বীপ

মালদ্বীপের অর্থনীতিতে অন্য যেকোন দেশের বিনিয়োগকে ভারত নিজের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে। ভারত মালদ্বীপের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়নি কখনোই; বরং দেশটাকে নিরাপত্তার দিক থেকে নিজের প্রভাবে রাখাতেই তার আগ্রহ ছিল সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপ সফর করেন। দ্বিতীয়বার নির্বাচন জেতার পর এটা ছিল মোদির প্রথম বৈদেশিক সফর। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মালদ্বীপের এর আগের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিনের সময়ে ২০১৭এর ফেব্রুয়ারিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর ভারতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপক অবণতি ঘটে। ইয়ামিন ভারতীয় নাগরিকদের চাকুরির ভিসা নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে এগিয়ে যান; যেগুলি ভারত ভালো চোখে দেখেনি। মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ নির্বাচনে চীন বিরোধী একটা অবস্থান নেয়ায় ভারত স্বস্তিতে আছে। সলিহ ক্ষমতায় গিয়েই প্রথম ভারত সফর করেছিলেন।

গত জুনের মালদ্বীপ সফরের সময় মোদি মালদ্বীপে ভারতের রাডার স্টেশন উদ্বোধন করেন। এ পর্যন্ত মালদ্বীপে ভারত ইলেকট্রনিক্সের তৈরি ১০টা রাডার বসানো হয়েছে। মালের কাছাকাছি ভিলিংগিলি দ্বীপে ‘মালদ্বীপ ম্যারিটাইম রেসকিউ কোঅরডিনেশন সেন্টার’এর কন্ট্রোল সেন্টারের সাথে এই রাডারগুলি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত। মোদির সফরের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখালে সাংবাদিকদের বলেন যে, এই রাডারগুলি মালদ্বীপের সমুদ্রসীমা পাহাড়া দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হবে। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘ডেকান হেরাল্ড’ বলছে যে, এই রাডারগুলি একইসাথে ভারতের কৌশলগত সম্পদ। কারণ এগুলি ভারতীয় নৌবাহিনীকে অত্র এলাকা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা দিয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাকে সুসংহত করবে। আগের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিন এই রাডার প্রকল্পকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা ট্রিবিউন’ বলছে যে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইব্রাহিম সলিহ ক্ষমতা নেবার ছয় মাস পর ২০১৮এর এপ্রিল থেকে এই প্রকল্প আবারও এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় ফেইজের কাজের মাঝে ছিল ৭টা নতুন রাডার বসানো এবং প্রথম ফেইজের পুরাতন ৩টা রাডার আপগ্রেড করা। এই ১০টা রাডার ভারতের উপকূলের ৪৬টা রাডারের সাথে একত্রে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। একই প্রকল্পের অধীনে ভারত সেইশেলে ১টা, মরিশাসে ৮টা এবং শ্রীলঙ্কাতে ৬টা রাডার স্থাপন করছে। মোদি তার মালদ্বীপ সফরের সময় মালদ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্যে একটা প্রশিক্ষণ ঘাঁটিরও উদ্বোধন করেন। একইসাথে দুই দেশ ‘হোয়াইট শিপিং’ নিয়ে একটা সমঝোতা স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে মালদ্বীপের সীমায় যেকোন বেসামরিক জাহাজের তথ্য মালদ্বীপ ভারতীয় নৌবাহিনীকে সরবরাহ করবে। ভারতের ৪৬টা রাডার প্রথম ফেইজে বসানো হয়েছে; যার মাঝে ৩৬টা বসানো হয়েছে ভারতের মূল ভুখন্ডে; ৬টা লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জে এবং ৪টা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। এর সাথে ১৬টা কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টারও রয়েছে। দ্বিতীয় ফেইজে আরও ৩৮টা রাডার এবং ৫টা কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার বসাবার কাজ চলমান রয়েছে। ভারতের এই ‘কোস্টাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম’ বা ‘সিএসএস’এর মাঝে রয়েছে উপকূলীয় রাডার সিস্টেম; ‘অটোম্যাটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম’ বা ‘এআইএস’; ‘ইলেক্ট্রো অপটিক সিস্টেম’; আবহাওয়ার তথ্য নেবার সিস্টেম; এবং কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে ভিএইচএফ রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম। রাডার ছাড়াও মালদ্বীপের নৌসীমা পাহাড়া দেয়ার জন্যে ভারত মালদ্বীপকে প্যাট্রোল বোটও সরবরাহ করেছে। ২০০৮ সালে মুম্বাইএ সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নেয়া সন্ত্রাসীদের সমুদ্রপথে ছোট নৌকার মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করার খবর প্রকাশ পাবার পর থেকে ভারত তার পুরো উপকূলব্যাপী সারভেইল্যান্স রাডার বসানো শুরু করে, যাতে উপকূলের কাছাকাছি ছোটছোট নৌকাও যেন বাদ না যায়। সেই সময় থেকে পুরো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে ভারত রাডার বসানো ছাড়াও হোয়াইট শিপিংএর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের চুক্তি করছে এবং ছোট দেশগুলিকে প্যাট্রোল বোট সরবরাহ করছে। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় চিন্তাবিদদের নিরাপত্তাহীনতার চিন্তার ব্যাপারটা মালদ্বীপের ভূরাজনীতিকে জটিল করেছে।
  
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় ত্রাণ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজের মালদ্বীপ সফর। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ভারত এবং চীনকে; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারেনি। আর এই বাস্তবতাই অঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানকে মালদ্বীপের ভূরাজনৈতিক হিসেবের মাঝে রাখবে। পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া চীনের পক্ষে আরব সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ কোন মিশন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারত সর্বদাই পাকিস্তানকে ব্যালান্স করতে গিয়ে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে বাধ্য হবে। আর একইসাথে চীনকে ব্যালান্স করতে গিয়ে সৌদি আরব এবং আমিরাতকে মেনে নিতে বাধ্য হবে।



এই রাডার নেটওয়ার্ক থেকে পাওয়া তথ্য ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘ইনফরমেশন ফিউশন সেন্টার, ইন্ডিয়ান ওশান রিজিয়ন’ বা ‘আইএফসি, আইওআর’এ সরাসরি সরবরাহ করা হবে। এই অঞ্চলে ‘হোয়াইট শিপিং’এর সমঝোতা হয়েছে যে দেশগুলির সাথে, তারা ‘আইএফসি, আইওআর’কে তথ্য দেবে। ভারতীয় নৌবাহিনীর বরাত দিয়ে ‘দ্যা নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ বলছে যে, ‘আইএফসি, আইওআর’এ নিজেদের নৌবাহিনীর লোক পোস্টিং দেয়ার জন্যে ৫টা বড় নৌবাহিনী এগিয়ে এসেছে। এই দেশগুলি হলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের গুরগাঁওতে ‘আইএফসি, আইওআর’এর চালু করা এই সেন্টারে ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে প্রথম বিদেশী লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে একজন ফরাসী সামরিক অফিসারকে পোস্টিং দেয়া হয়। এই কর্মকান্ডকে বাস্তবায়ন করতে ভারত ২২টা দেশের সাথে তথ্য সরবরাহ করার সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে; একইসাথে ৩০টা দেশের সাথে একটা ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাইছে তারা, যাতে পুরো ভারত মহাসাগরের সকল জাহাজের তথ্য সাথেসাথেই পাওয়া যায়। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে ভারত এই নেটওয়ার্কের কাজ করলেও শক্তিশালী দেশগুলি এর সাথে যুক্ত হতে যে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি তা মোটামুটিভাবে পরিষ্কার। সবাই এটা বুঝতে পারছে যে, এ নেটওয়ার্ক আঞ্চলিক নয়, বরং ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার চিন্তার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হচ্ছে। এটার বেশি প্রয়োজন ভারতের; অন্য দেশগুলির নয়।

তবে মালদ্বীপের ব্যাপারে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব ভিন্ন। বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথগুলির একটা মালদ্বীপের উত্তর সীমানা ঘেঁষে গিয়েছে; আর ভারত মহাসাগরের ব্রিটিশ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়াও মালদ্বীপ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে খেয়াল রাখছে, তা ছোট্ট দেশটার অপেক্ষাকৃত বৃহৎ বিমানবন্দরের কাজের ভাগবাটোয়ারা দেখলেই বোঝা যায়। চীনের প্রভাবকে কমাতে ভারতকে অখুশি করাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ খুব কমই খুন্ন হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তাহীনতা বরং ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি টেনেছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যালান্স করতে মালদ্বীপে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলির বিনিয়োগ টেনে এনেছে। আর হুলহুমালে দ্বীপে মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলি ভূরাজনৈতিকভাবে এতটাই শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, তা বন্ধ করার কোন পদ্ধতি কেউ নিয়ে আসেনি; বরং এই প্রকল্পে অংশ নিতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করেছে। আর এত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পে বিদেশী কর্মী, বিশেষ করে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ ঠেকাবার পদ্ধতিও খুব একটা নেই। মালদ্বীপের অবস্থানই মালদ্বীপের গুরুত্ব পাবার কারণ। কিন্তু পর্যটন শিল্প বৃদ্ধি না পেলে মালদ্বীপের অবকাঠামো উন্নয়নের কোন প্রশ্নই আসতো না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়লেও দেশটাকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কমেনি; বরং বেড়েছে। চীনের অর্থনৈতিক উত্থান এবং ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর আনাগোণা মালদ্বীপের গুরুত্বকে আরও বৃদ্ধি করেছে। এতদিন মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টাকে কেউ চ্যালেঞ্জ না করলেও এখন সেই সমীকরণ পাল্টে গেছে। ছোট্ট এই দ্বীপ দেশে নিজ প্রভাব ধরে রাখতে ভারতকে চীন ছাড়াও সৌদি আরব, আমিরাত, বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চীন এবং বাংলাদেশ মালদ্বীপকে মেডিক্যাল সহায়তা প্রদান করেছে; যা ভারতকে আরও বেশি বিচলিত করেছে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ভারত এবং চীনকে; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারেনি। আর এই বাস্তবতাই অঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানকে মালদ্বীপের ভূরাজনৈতিক হিসেবের মাঝে রাখবে। পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া চীনের পক্ষে আরব সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ কোন মিশন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারত সর্বদাই পাকিস্তানকে ব্যালান্স করতে গিয়ে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে বাধ্য হবে। আর একইসাথে চীনকে ব্যালান্স করতে গিয়ে সৌদি আরব এবং আমিরাতকে মেনে নিতে বাধ্য হবে।

Monday 18 May 2020

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র - নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার শুরু?

১৮ই মে ২০২০
       
২০১৩ সালের মে মাসে ‘এক্স-৫১’ নামের হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলের টেস্ট করা হয় মার্কিন ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান থেকে। এক দশকের বেশি সময় ধরে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সাম্প্রতিককালে এই অস্ত্র ডেভেলপ করার পিছনে গুরুত্ব বাড়িয়েছে রাশিয়া এবং চীনের হাইপারসনিক প্রকল্পের সাফল্য, যদিও মার্কিনীরা এখনও এই অস্ত্র কোথায় কিভাবে ব্যবহৃত হবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
১৫ই মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একটা ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে, যেটাকে তিনি ‘সুপার ডুপার মিসাইল’ বলে আখ্যা দিতে চান। হোয়াইট হাউজে নতুন গঠন করা ‘স্পেস ফোর্স’এর পতাকা উন্মোচন অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এক্ষেত্রে কিছু করবার ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রকে এহেন ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে হচ্ছে। ট্রাম্প মূলতঃ মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণাধীন ‘হাইপারসনিক’ অস্ত্রের কথাই বলছিলেন। ‘পপুলার মেকানিকস’ এই অস্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলছে যে, এটা এমন একটা অস্ত্র, যা কিনা শব্দের ৫ গুণ বা ‘মাক ৫’ থেকে শুরু করে ২০ গুণ বা ‘মাক ২০’ গতিতে চলতে পারে। ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যে অস্ত্র ডেভেলপ করছে, তা প্রতিপক্ষের অস্ত্রের প্রায় তিনগুণ বেশি গতিতে চলতে পারবে। যেখানে রাশিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ‘মাক ৫’ এবং চীনের ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ‘মাক ৫’ থেকে ‘মাক ৬’, সেখানে মার্কিন অস্ত্রের গতি হবে ‘মাক ১৭’। ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিরক্ষা সচিব মার্ক এসপার ট্রাম্পের কথার সাথে সুর মিলিয়ে ট্রাম্পের দাবিকে সমর্থন দেন। তবে ট্রাম্পের এই দাবিগুলি হঠাত করেই আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র এধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। তবে প্রতিরক্ষানীতিতে প্রাধান্য না থাকার কারণে এর ডেভেলপমেন্ট রাশিয়া এবং চীনের থেকে পিছিয়ে পড়ছিল। এখন রাশিয়া এবং চীনের ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে।

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কেন দরকার?

এবছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে হাইপারসনিক অস্ত্রের উপর মার্কিন ‘কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস’এর এক প্রতিবেদনে এই অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের পিছনে চিন্তাগুলিকে লিপিবদ্ধ করা হয়। ২০০০এর দশকের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র প্রচলিত অস্ত্রের অধীনে দ্রুত আঘাত হানার একটা কৌশল বের করতে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ডেভেলপমেন্ট শুরু করেছিল। এই অস্ত্র দুই ধরনের। একটা হলো হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল। এটা একটা রকেটের সাথে সংযুক্ত থাকে। রকেট এটাকে অনেক উপরে উড়িয়ে নিয়ে একটা গতি ধরিয়ে দেয়; এরপর এটা রকেট থেকে আলাদা হয়ে গ্লাইড করে অতি দ্রুতগতিতে লক্ষ্যে আঘাত হানে। আর দ্বিতীয় ধরনের অস্ত্র হলো হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। এটা বর্তমানে ব্যবহৃত ক্রুজ মিসাইলের মতোই একটা জেট ইঞ্জিনের সহায়তায় চলে; তবে এটা সাধারণ জেট ইঞ্জিনের থেকে বেশ আলাদা; যেটাকে ‘স্ক্র্যামজেট’ ইঞ্জিন বলে। হাইপারসনিক অস্ত্রের উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের জেনারেল জন হাইটেন বলেন যে, যেসব ক্ষেত্রে অন্যান্য অস্ত্র ঠিকমতো কাজ করবে না বা ব্যর্থ হবে বা হাতের কাছে থাকবে না, তখন অনেক দূরের অবস্থানে শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থার শত্রছায়ায় থাকা লক্ষ্যবস্তুকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের সুযোগের ‘উইন্ডো’র মাঝে হাইপারসনিক অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সমালোচকেরা বলছেন যে, হাইপারসনিক অস্ত্রের নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য এখনও সংজ্ঞায়িত হয়নি; এটা মার্কিন সামরিক সক্ষমতায় নতুন কিছু যোগ করবে না; আর ডিটারেন্স তৈরি করার ক্ষেত্রেও এর কোন ভূমিকা থাকবে না।

এতকাল হাইপারসনিক অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের জন্যে তেমন একটা বাজেট না পাওয়া গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া এবং চীনের এহেন অস্ত্রের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার পর পেন্টাগন এবং কংগ্রেস উভয়েই বেশ নড়েচড়ে বসেছে। রাশিয়া এবং চীন ২০২০ সালের মাঝেই অপারেশনাল হাইপাসনিক অস্ত্র মোতায়েন করে ফেলতে পারে; যার মাঝে পারমাণবিক অস্ত্র বহণে সক্ষম ক্ষেপ্ণাস্ত্রও থাকতে পারে। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর সিনিয়ন ইঞ্জিনিয়ার জর্জ নাকুজি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু পারমাণবিক অস্ত্রের ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে না, তাই মার্কিন অস্ত্রগুলির টার্গেটিং আরও নিখুঁত হতে হবে। অন্যদিকে রুশ এবং চীনাদের অস্ত্রগুলি পারমাণবিক সক্ষমতার হবার কারণে সেগুলির টার্গেটিং অতটা নিখুঁত না হলেও চলবে। ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইন্সটিটিউট অব সিকিউরিটি স্টাডিজ’এর প্রাক্তন সদস্য জো স্ট্যানলি লকম্যান বলছেন যে, মার্কিন অস্ত্রগুলি প্রচলিত ওয়ারহেড বহণ করবে বিধায় এর টার্গেটিংএর পিছনে মার্কিন গবেষকদের আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। কারণ প্রচলিত অস্ত্রের টার্গেট হয় অনেক ছোট। তবে কেউ কেউ মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এধরনের অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টে পিছিয়ে নেই; বরং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে আলাদা। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর জেমস একটন বলছেন যে, রাশিয়া এবং চীনের লক্ষ্য হাইপারসনিক মিসাইলকে পারমাণবিক অস্ত্র বহণে নিযুক্ত করা; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এধরনের মিসাইলকে প্রচলিত অস্ত্র বহণের জন্যে প্রস্তুত করা। রাশিয়া ও চীনের লক্ষ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য সরাসরি তুলনা করা যায় না। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন থেকেই প্রচলিত অস্ত্রের উপর পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে; যা যুক্তরাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে এগিয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলকে ৪ হাজার কিঃমিঃ পাল্লায় পরীক্ষা করেছে; যেটা চীন মাত্র ২ হাজার কিঃমিঃএর কম পাল্লায় পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।
  
মার্কিন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘এজিএম-১৮৩এ’ ‘এআরআরডব্লিউ’। এই প্রকল্পটাকেই বিমান বাহিনী এগিয়ে নিতে চাইছে, কারণ এটাতে খরচ কম হবে এবং এধরণের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান এবং ‘এফ-১৫’ ফাইটার বিমানে বেশি সংখ্যায় বহণ করা সম্ভব হবে।
 প্রযুক্তিগত দিক থেকে হাইপারসনিকের সম্ভাবনা কতটুকু?

তবে ক্ষেপণাস্ত্রের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যে পেন্টাগনের বাজেট বৃদ্ধি পাবার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০২০ সালের সামরিক বাজেটে সকল ধরনের হাইপারসনিক অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের জন্যে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ চাওয়া হলেও ২০২১ সালের বাজেটে এই অর্থ বাড়িয়ে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পেন্টাগন হাইপারসনিক অস্ত্রের জন্যে নির্দিষ্ট কোন প্রকল্প নেয়নি; এর অর্থ হলো, হয় তারা এই অস্ত্রের ব্যবহার কোথায় হবে সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়; অথবা এর দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের ব্যাপারে এখনও দোটানায় রয়েছে। কংগ্রেস যে ব্যাপারগুলি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে, তার প্রথমটা হলো, এই ক্ষেপণাস্ত্র কি ধরনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে? হাইপারসনিক অস্ত্র কি এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচাইতে সহজ পদ্ধতি? মার্কিন কৌশলগত চিন্তার মাঝেই বা এই অস্ত্রকে কিভাবে দেখা হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত মিশন না থাকলে এই অস্ত্রের বাজেটকে অন্যান্য বাজেটের সাথে কিভাবে তুলনা করা হবে? কোন প্রকল্পকে কোন প্রকল্পের উপর বা নিচে স্থান দেয়া হবে? এর ডেভেলপমেন্টের পিছনে প্রযুক্তিই বা কতটুকু বাস্তবসম্মত? আর তৃতীয়ত, এরূপ অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের ফলে কৌশলগত স্থিতিশীলতা কিভাবে প্রভাবিত হবে? আর চতুর্থত, অন্যান্য দেশের সাথে উত্তেজনা যাতে না বাড়ে, সেই উদ্দেশ্যে নতুন কোন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির দিকে যাবার প্রয়োজন রয়েছে কিনা, যা একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে করা হয়েছিল?

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রকল্পগুলির ব্যাখ্যা দিয়েছে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘পপুলার মেকানিকস’। মার্কিন সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী একত্রে ডেভেলপ করছে একটা হাইপারসনিক অস্ত্র, যা গত ১৯শে মার্চ হাওয়াইএর কাউয়াই দ্বীপের ‘প্যাসিফিক মিসাইল রেঞ্জ ফ্যাসিলিটি বারকিং স্যান্ডস’এ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা করা ‘কমন হাইপারসনিক গ্লাইড বডি’ নামে পরিচিত এই অস্ত্রটা মূল ক্ষেপণাস্ত্রের একটা অংশ। রকেটের সাথে জুড়ে দিয়ে এটাকে উৎক্ষেপণ করা হয়। তবে এই পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে মার্কিনীরা কোন কথাই বলছে না। এই হাইপারসনিক অস্ত্র বর্তমানে ব্যবহৃত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে আলাদা। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড প্রায় মহাকাশের কক্ষপথে চলে যায়; এরপর সেখান থেকে ‘মাক ২৪’ পর্যন্ত গতিতে লক্ষ্যের দিকে ধেয়ে আসে। অন্যদিকে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মূলতঃ বায়ুমন্ডলে অবস্থান করেই ওড়ে। সেনা এবং নৌবাহিনী একত্রে এই ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করলেও সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভবতঃ বহণ করা হবে বড় আকৃতির ট্রাকের উপর; আর নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ‘আরলেই বুর্ক-ক্লাস’ ডেস্ট্রয়ার, ‘টিকনডেরোগা-ক্লাস’ ক্রুজার, ‘জুমওয়াল্ট-ক্লাস’ ডেস্ট্রয়ার এবং ‘ভার্জিনিয়া-ক্লাস’ সাবমেরিনে বহণ করা হতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্র টেস্টিংএর পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলকে বুস্টার রকেটের সাথে জুড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ অস্ত্র হিসেবে টেস্ট করা হতে পারে। তবে সেটার খবর পেতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

অন্যদিকে মার্কিন বিমান বাহিনীও বেশ হাঁকডাক দিচ্ছে। ২৭শে এপ্রিল বিমান বাহিনী এক বার্তায় হাইপারসনিক স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলির কাছ থেকে। এই তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বিমান বাহিনীর ক্রয় বিভাগের দায়িত্বে থাকা সহকারি সচিব উইল রোপার বলেন যে, এর মাধ্যমে তারা বুঝতে পারবেন যে, কতটা দ্রুত তারা এধরনের একটা ক্রুজ মিসাইল ডেভেলপ করতে পারবেন। তবে তিনি এ-ও বলেন যে, স্ক্র্যামজেট প্রযুক্তি এখন এতটাই এগিয়েছে যে, এধনের ক্ষেপণাস্ত্র এখন বেশ দ্রুতই ডেভেলপ করা সম্ভব। রোপারের কথায় এটা পরিষ্কার যে, বিমান বাহিনী এখন এমন একটা প্রযুক্তির দিকে যাচ্ছে, যা কিনা এখন পর্যন্ত ডেভেলপ করা রকেট বুস্টারের মাধ্যমে চলা হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলএর একটা বিকল্প। রোপার এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, রকেট বুস্টার ব্যাবহার করা গ্লাইড মিসাইলগুলি বায়ুমন্ডলের একেবারে সর্বশেষ প্রান্ত দিয়ে ওড়ে, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব থাকে খুব কম। অন্যদিকে স্ক্র্যামজেটে চলা ক্রুজ মিসাইল ওড়ে বায়ুমন্ডলের এমন স্থান দিয়ে, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব থাকে অনেক বেশি। একারণে দুই ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র দুই প্রকারের টার্গেট এবং মিশন নিতে সক্ষম। রোপার বলেন যে, বিমান বাহিনী চাইছে না প্রযুক্তিগত এই প্রতিযোগিতার মাঝে কোন একটা স্থানে পিছিয়ে পড়তে। একইসাথে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর চাইছে যে, আরও কিছু কোম্পানি এই প্রযুক্তি ডেভেলপমেন্টে এগিয়ে আসুক। হাতে গোণা কিছু কোম্পানি গ্লাইড ভেহিকলের প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছে বিধায় তারাই সেগুলি তৈরি করছে; অন্য কেউ এখানে ঢুকতেই পারছে না। উইল রোপার বলেন যে, ক্রুজ মিসাইল ডেভেলপ করতে গিয়ে আরও কিছু কোম্পানি এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারবে। রোপার বলেন যে, তিনি মনে করেছিলেন যে, গ্লাইড ভেহিকলের প্রযুক্তি থেকে স্ক্র্যামজেটের প্রযুক্তি পিছিয়ে রয়েছে; কিন্তু সেটা আসলে সত্যি নয়। এই প্রযুক্তিটা এখন বেশ অগ্রসর হয়েছে এবং এটা এখন ব্যাবহারের জন্যে প্রস্তুত।
  
রুশ ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমান বহণ করছে ‘কিনঝাল’ নামের স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ক্রুজ মিসাইল। ‘কিনঝাল’ ইতোমধ্যেই কমপক্ষে ১২ বার ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, চীনাদের এই প্রকল্প রুশদের প্রকল্পগুলির চাইতে চিন্তাগত দিক থেকে এগিয়ে; কারণ চীনাদের দূরপাল্লার হাইপারসনিক অস্ত্রগুলি চীনের আশেপাশে মার্কিন সামরিক অবস্থানগুলির জন্যে হুমকি তৈরি করছে; যার ফলে মার্কিনীরা এর প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছে।

মার্কিন, চীনা এবং রুশ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পগুলি কতদুর এগুলো?

মার্কিন ‘ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি’ বা ‘ডারপা’ এবং ‘এয়ার ফোর্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ এই প্রকল্পে সহায়তা দেবে বলছে। ‘ডারপা’র ‘হাইপারসনিক এয়ার ব্রিদিং ওয়েপন কনসেপ্ট’এর উপর ভিত্তি করে প্রাইভেট কোম্পানির দু’টা দল স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে। একদলে রয়েছে রেইথেয়ন এবং নর্থরোপ-গ্রুমান; আর অন্য দলে রয়েছে লকহীড মার্টিন ও এরোজেট রকেটডাইন। বর্তমানে মার্কিন বাহিনী ‘এয়ার লঞ্চড র‍্যাপিড রেসপঞ্জ ওয়েপন’ বা ‘এআরআরডব্লিউ’ নামে একটা প্রকল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে। কিছুদিন আগেই তারা ‘হাইপারসনিক কনভেনশনাল স্ট্রাইক ওয়েপন’ বা ‘এইচসিএসডব্লিউ’ নামের আরেকটা প্রকল্প বাতিল করে বাজেটের সমন্বয় আনার লক্ষ্যে। ‘এআরআরডব্লিউ’ প্রকল্পটাকেই বিমান বাহিনী এগিয়ে নিতে চাইছে, কারণ এটাতে খরচ কম হবে এবং এধরণের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান এবং ‘এফ-১৫’ ফাইটার বিমানে বেশি সংখ্যায় বহণ করা সম্ভব হবে। ‘এআরআরডব্লিউ’ এবং বাতিল করা ‘এইচসিএসডব্লিউ’, দু’টাই একই কোম্পানি লকহীড মার্টিন ডেভেলপ করেছে।

২০১৯এর জুন মাসে বিমান বাহিনী ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান থেকে ‘এআরআরডব্লিউ’এর সফল পরীক্ষা চালাবার কথা ঘোষণা করে। ২০১৮ সালের অগাস্টে লকহীড মার্টিন ৪’শ ৮০ মিলিয়ন ডলারের এই কাজ পায় প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাছ থেকে। এর আগে একই বছরের এপ্রিল মাসে ‘এইচসিএসডব্লিউ’ প্রকল্পের অধীনে ৯’শ ২৮ মিলিয়ন ডলারের কাজ পেয়েছিল লকহীড মার্টিন; যা পরবর্তীতে বাতিল হয়ে যায়। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের বরাত দিয়ে ‘সিএনবিসি’ বলছে যে, ‘এআরআরডব্লিউ’এর পরীক্ষা এখনও চলমান রয়েছে; এবং আরও কয়েক বছর এই পরীক্ষা চলবে। এই মুহুর্তে রুশ এবং চীনাদের ডেভেলপ করা হাইপারসনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রতিরক্ষা নেই। অথচ রাশিয়ার দু’টা ক্ষেপণাস্ত্র ২০২০ সালের মাঝেই সার্ভিসে আসতে পারে বলে মনে করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। এর মাঝে একটা হলো ‘এভানগার্ড’ নামের হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল; আরেকটা আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ‘কিনঝাল’ নামের স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ক্রুজ মিসাইল। ‘কিনঝাল’ ইতোমধ্যেই কমপক্ষে ১২ বার ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অপরদিকে ২০১৮ সালের অগাস্টে চীন তাদের প্রথম হাইপারসনিক পরীক্ষা চালিয়েছে। পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘সিএনবিসি’ বলছে যে, চীনাদের এই প্রকল্প রুশদের প্রকল্পগুলির চাইতে চিন্তাগত দিক থেকে এগিয়ে। ‘নাসা’র প্রাক্তন কর্মকর্তা মাইকেল গ্রিফিন মনে করছেন যে, চীনাদের দূরপাল্লার হাইপারসনিক অস্ত্রগুলি চীনের আশেপাশে মার্কিন সামরিক অবস্থানগুলির জন্যে হুমকি তৈরি করছে; যার ফলে মার্কিনীরা এর প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলিই বরং যুকরাষ্ট্রের জন্যে বড় হুমকি; হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়।

যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে বহুদিন ধরেই। তবে সেটা তারা কি কাজে লাগাবে, সেব্যাপারে প্রতিরক্ষা দপ্তর একটা নিশ্চিত সংজ্ঞা দাঁড় করাতে পারেনি। কিন্তু উদ্দেশ্য থাকুক আর না থাকুক, ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতাতে টিকে থাকতেই যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে চীন এবং রাশিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রত্যুত্তর দিতে। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্য রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পুরোপুরি আলাদা। তদুপরি, এই অস্ত্র না থাকলে একটা রাষ্ট্র যেন শক্তিশালীই হতে পারবে না। এই অস্ত্রের সামরিক উদ্দেশ্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, এর রাজনৈতিক গুরুত্ব সেটার চাইতে কম নয়। অন্ততঃ ট্রাম্পের কাছে তার ‘সুপার ডুপার মিসাইল’এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। তদুপরি এই ক্ষেপণাস্ত্র ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় নতুন অস্ত্র হিসেবে দেখা দিতে পারে। আর এই প্রতিযোগায় এগিয়ে থাকার অদম্য বাসনা কৌশলগত উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যেতে পারে। এতে উদ্দেশ্যবিহীন একটা অস্ত্র প্রতিযগিতায় পতিত হতে পারে বৈশ্বিক ব্যবস্থা; যা কিনা করোনা দুর্যোগের মাঝে আরও দুর্বল হয়েছে।

Saturday 9 May 2020

করোনাভাইরাস চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বকে আরও উস্কে দিয়েছে

১০ই মে ২০২০
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার সাথেসাথে চীনা সরকার অভ্যন্তরীন ভোগ বাড়াবার তাগিদ দিয়েছিল। করোনার প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চীনাদের এই প্রচেষ্টা আরও বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ চীন ক্রমেই নিজের অর্থনীতিকে পশ্চিমা দেশগুলিতে রপ্তানির নির্ভরশীলতা থেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করবে। পশ্চিমাদের সাথে চীনের এই পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা এতদিন সরাসরি কোন সংঘাতকে দূরে রেখেছিল। কিন্তু করোনা দুর্যোগের পটভূমিতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বাধ্যবাধকতা কমে আসায় তার স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছে অনিশ্চয়তা এবং সংঘাতের অধিকতর সম্ভাবনা। 


৮ই মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে, তিনি চীনের সাথে স্বাক্ষরিত প্রথম দফা বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে দেবেন কিনা, সেব্যাপারে দোটানায় রয়েছেন। তিনি বলছেন যে, চীন যদি চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির টার্গেট মেটাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তিনি চুক্তি বাতিল করে দিতে পারেন। উভয় দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিরা কথা বলে ঠিক করেছেন যে, দু’দেশই চুক্তি অনুযায়ী তাদের বাধ্যবাধকতাগুলি সময়মতো পূরণ করবে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে যে, দুই দেশ চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবেশ উন্নয়নের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চুক্তি অনুযায়ী চীনের ধাধ্যবাধকতা রয়েছে দুই বছরের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ২’শ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করার। এর মাঝে কৃষিজ দ্রব্য, তৈরি পণ্য, জ্বালানি এবং সার্ভিস রয়েছে। এই চুক্তির ফলে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য যুদ্ধে কিছুটা হলেও বিরতি আসে।

বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে করোনা যুদ্ধ

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারির মাঝে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় দেশ এই সংকট মোকাবিলায় কাছাকাছি না এসে বরং উগ্র জাতীয়বাদের আগুন জ্বালিয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চীনের চেষ্টাকে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা করা হলেও চীন জোর গলায় এই সমালোচনার জবাব দিয়েছে। তারা বলছে তারা মার্কিনীদের মিথ্যা অপবাদের জবাব দিচ্ছে মাত্র। মার্চ মাসে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, মার্কিন সেনাবাহিনীর হাত হয়েই চীনে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে। এর কিছুদিন পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে ডাকতে থাকেন, যাতে ভাইরাসের উতপত্তিস্থলের জন্যে দায় চীনের উপর বর্তায়। এরপর ট্রাম্প চীনে মৃতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং সংক্রমণের শুরুর দিকে চীনের ভূমিকার সমালোচনা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প এবং পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও কোন প্রমাণ দেখানো ছাড়াই দাবি করতে থাকেন যে, ভাইরাসের উতপত্তিস্থল ছিল উহানের গবেষণাগার। এর জবাবে চীনারা বলে যে, এই কথাগুলি ট্রাম্পের নির্বাচনী কৌশলের অংশ। অপরিকে চীনা সরকারি মিডিয়াতে মাইক পম্পেওকে ‘শয়তান’, ‘উন্মাদ’ এবং ‘মানবজাতির শত্রু’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। তবে ‘সিএনএন’ বলছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবতঃ করোনা ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চলেছেন। এই ব্যবস্থার মাঝে অবরোধ, ঋণ ফেরত না দেয়া এবং বাণিজ্য নীতিতে পরিবর্তন আনার কথা থাকতে পারে। চীনের উপর চাপ সৃষ্টি করার কাজে সমর্থন আদায়ে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলির সাথে কথা বলছে।

তবে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব করোনাভাইরাসের কারণে শুরু হয়নি। গত দুই বছর ধরেই দুই দেশের মাঝে চলছে তুমুল বাণিজ্য যুদ্ধ। তবে এবারের এই দ্বন্দ্ব আগের চাইতে আলাদা বলে মনে করছেন ‘হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনলজি’র প্রফেসর ডেভিড জোয়াইগ। তিনি বলছেন যে, ২০১৬ সালে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর আগে মূল ইস্যু ছিল মানুষের কর্মসংস্থান; ২০২০ সালে আলোচ্য বিষয়বস্তু হলো মানুষের জীবন। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের মাঝে এই রোগের সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে এবং এত ফলে মৃত্যুবরণ করেছেন কমপক্ষে ২ লক্ষ ৭৬ হাজার মানুষ। মার্কিন লেবার ডিপার্টমেন্ট বলছে যে, এপ্রিল মাসে ২ কোটির বেশি মার্কিন নাগরিক বেকারত্বের মাঝে পতিত হয়েছে। চীনের ‘রেনমিন ইউনিভার্সিটি’র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর শি ইয়িনহংএর মতে চীন-মার্কিন সম্পর্ক ১৯৭২ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। দুই দেশের মাঝে প্রতিযোগিতা এখন বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং রাজনীতির মাঝে ছড়িয়েছে। আর লকডাউনের কারণে ফ্লাইট বন্ধ হওয়া এবং চীনের কারখানাগুলির উপর নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ার কারণে দুই দেশের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন ‘ফক্স নিউজ চ্যানেল’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, জানুয়ারি মাসে চীনের সাথে বাণিজ্যচুক্তির ব্যাপারে তিনি খুবই আশাবাদী থাকলেও এখন অতটা আশাবাদী নন তিনি। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, চুক্তি অনুযায়ী প্রথম বছরে চীনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে ৭৭ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন পণ্য আমদানি করার। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারি থেকে মাত্র উঠে এসেই চীন এই টার্গেট বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়।

অপরদিকে দুই দেশের দ্বন্দ্বের নতুন সেক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মিডিয়া। ৮ই মে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি জানায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত চীনা সাংবাদিকরা যারা কোন মার্কিন মিডিয়ার জন্যের কাজ করে না, তাদের ভিসার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৯০ দিন পর্যন্ত করে দেয়া হয়েছে। এর আগে মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকতো না। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রায় মাসখানেক ধরে দুই দেশের মাঝে মিডিয়া নিয়ে চলা দ্বন্দ্বের ফলাফল। চীনা এবং মার্কিন সাংবাদিকদের একে অপরের দেশে চালানো কর্মকান্ডকে টার্গেট করেই এই দ্বন্দ্ব চলছিল। মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন যে, চীনে মিডিয়ার যে স্বাধীনতা নেই, সেটাকে ব্যালান্স করতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত মার্চে মার্কিন সরকার ঘোষণা দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা সরকারি পাঁচটা সংবাদ মিডিয়ার জন্যে কাজ করা চীনা সাংবাদিকদের সংখ্যা ১’শর বেশি হতে পারবে না; যা ঐ সময় ছিল ১’শ ৬০। এর জবাবে চীনা সরকার ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর জন্যে কাজ করা সকল মার্কিন সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দেয়। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সংবাদ মাধ্যম নিয়ে দুই দেশের এই দ্বন্দ্ব তাদের মাঝে অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত এবং সর্বোপরি ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অংশ বই অন্য কিছু নয়।

মার্কিন জনমতে পরিবর্তন

৬ই মে হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন যে, করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের উপর ‘ইতিহাসের সবচাইতে বড় হামলা’, যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পার্ল হারবারে জাপানিদের হামলা বা ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার চাইতেও বেশি ক্ষতি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তিনি বলেন যে, এই মহামারি হবারই কথা ছিল না। যেখানে এর সূত্রপাত হয়েছিল, সেখানেই সেটা থামিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল; কিন্তু সেটা করা হয়নি। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ এখন মহামারির সাথে; চীনের সাথে নয়।

শুধু প্রেসিডেন্টই নয়; মার্কিন জনমতও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। ‘পিউ রিসার্চ’এর এপ্রিল মাসের এক জরিপ বলছে যে, ৬৬ শতাংশ মার্কিন জনগণ চীনের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত খারাপ ধারণ পোষণ করছে; যা ২০০৫ সাল থেকে এই জরিপ শুরু হবার পর থেকে সর্বোচ্চ। মাত্র চার ভাগের এক ভাগ মার্কিনী চীনের ব্যাপারে ভালো কথা বলছেন। অপরদিকে চীনারা মনে করছে যে, ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চীনের উহানের জনগণ এতটা কষ্ট সহ্য করার পর এখন ভাইরাস ঠেকাতে যথেষ্ট চেষ্টা না করার অপবাদ নিতে হচ্ছে তাদের। ডেভিড জোয়াইগ বলছেন যে, ব্যাপারটা পরিষ্কার যে, যখন বাইরে থেকে চীনের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করা হয়, তখন চীনের জনগণ জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠে। তারা মনে করতে থাকে যে, চীনা হবার কারণেই তাদেরকে আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। আর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায়। অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চীনা সরকার জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিচ্ছে। চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’এর প্রধান সম্পাদক হু শিজিন বলছেন যে, উহানে প্রথমদিকে কিছু ভুল হলেও চীনা জনগণ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চীনের ভূমিকায় যথেষ্ট খুশি। আর চীনের সফলতার আয়নার মাঝেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে দেখছে। পুরো ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে সরকারি মিডিয়া ‘সিসিটিভি’ মন্তব্য করছে যে, চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাই চীনের সফলতা মূল কারণ। দেশটার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের কারণেই ভাইরাস মোকাবিলা করা গিয়েছে।

অন্যদিকে ব্রিটিশ মিডিয়া ‘বিবিসি’ বলছে যে, বহু মার্কিনী চীনের বিরুদ্ধে বৈরী চিন্তা ধারণ করলেও এটাও ঠিক যে ৬৫ শতাংশ মার্কিনী মনে করছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন যথেষ্ট দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ‘বিবিসি’ এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এবছরের শেষের দিকে ট্রাম্পের জন্যে একটা কঠিন নির্বাচন অপেক্ষা করছে। মন্দার অর্থনীতির মাঝে তিনি আবারও নির্বাচনে জিততে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তবে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনও চীনের বিরুদ্ধে জনমতকে নিজের নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করতে চাইছেন।

তদুপরি মার্কিনীদের মাঝেই অনেকেই চীনকে আরও সুযোগ দিতে উচ্ছুক। তারা চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের ফলাফলের ব্যাপারে ভীত। ‘ইউএস-চায়না বিজনেস কাউন্সিল’ বা ‘ইউএসসিবিসি’র প্রেসিডেন্ট ক্রেইগ এলেন বলছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি চীনাদেরকে বাণিজ্য চুক্তি মোতাবেক শর্তপূরণের সময় না দিয়ে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান, তাহলে সেটা ভীষণ অস্থিরতার জন্ম দেবে। চুক্তিটা চালু হয়েছে মাত্র ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে, যখন বিশ্বব্যাপী মহামারি শুরু হয়েছে। চীন তার নিজের বাধ্যবাধকতা মেনে চলছে কিনা, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। হোয়াইট হাউজের অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ল্যারি কুড্রো ‘ব্লুমবার্গ টেলিভিশন’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, চীনের ইচ্ছে রয়েছে তাদের বাধ্যবাধকতাগুলি মেনে চলার।

এই বিভেদ অত সহজে কমার সম্ভাবনা নেই

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর অধীনে চীনাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তাগুলিকে আরও এগিয়ে নেয়া হয়েছে। ‘চীনা স্বপ্ন’ এবং ‘জাতীয় পুনরুজ্জীবন’এর চিন্তাগুলি বাস্তবায়নের পথে চীনারা বিশ্বব্যাপী তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করছে এবং জাতীয় স্বার্থকে শক্ত হাতে তুলে ধরতে চাইছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। ইউরোপ থেকে বলা হচ্ছে যে, চীনারা করোনাভাইরাসের ব্যাপারে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। পশ্চিমা কিছু দেশ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে চীনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করছে। এমনকি চীন বিভিন্ন দেশকে মেডিক্যাল সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করার পরও অনেকে বেইজিংএর ‘মাস্ক কূটনীতি’র সমালোচনা করেছেন। প্রফেসর শি ইয়িনহংএর মতে, করোনাভাইরাসের মহামারি চলে যাবার পরেও এই প্রতিযোগিতা থেকে যাবে। মহামারির কঠিন স্মৃতি মানুষের হৃদয়ে গভীর দাগ কেটেছে, যা কয়েক প্রজন্ম ধারণ করবে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথেসাথে বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বিস্তারের আকাংক্ষা মার্কিন প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বৈশ্বিকভাবে মার্কিন নেতৃত্ব যখন হুমকির মাঝে, তখন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কোন বিষয়েই ছাড় দিতে রাজি নয়। মার্কিন সরকার চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে সব চেষ্টাই করবে, তা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে মার্কিন-চীন পাল্টাপাল্টি অভিযোগই বলে দিচ্ছে; চীনারা এক্ষেত্রে নিজেদের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে চীনা অর্থনীতি এখনও পশ্চিমা দেশগুলিতে রপ্তানির উপরই নির্ভরশীল। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার সাথেসাথে চীনা সরকার অভ্যন্তরীন ভোগ বাড়াবার তাগিদ দিয়েছিল। করোনার প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চীনাদের এই প্রচেষ্টা আরও বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ চীন ক্রমেই নিজের অর্থনীতিকে পশ্চিমা দেশগুলিতে রপ্তানির নির্ভরশীলতা থেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করবে। পশ্চিমাদের সাথে চীনের এই পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা এতদিন সরাসরি কোন সংঘাতকে দূরে রেখেছিল। কিন্তু করোনা দুর্যোগের পটভূমিতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বাধ্যবাধকতা কমে আসায় তার স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছে অনিশ্চয়তা এবং সংঘাতের অধিকতর সম্ভাবনা।




Tuesday 5 May 2020

বাংলাদেশের ‘আন্দামান প্যাট্রোল ফোর্স’ কোথায়?

০৫ই মে ২০২০

সমুদ্রে টহল দিচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সাম্প্রতিক শরণার্থী সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আন্দামান সাগরের মতো কৌশলগত একটা সাগরকে বাংলাদেশ কতটা হাল্কাভাবে নিয়েছে এতকাল। বাংলাদেশের ‘আন্দামান প্যাট্রোল ফোর্স’ বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থকে রক্ষায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে কাজ করবে।
  
শরণার্থীদের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে রাজনীতি

বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগরের মাঝ দিয়ে পূর্ব এশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পুরোটাই যায়? বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগর পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের শরণার্থীরা মালয়েশিয়া গিয়ে আবার বাংলাদেশে আসে? বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগরকে নিয়ে বাংলাদেশের কোন মাথাব্যাথা নেই, যদিও বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম? উত্তর বঙ্গোপসাগর নয়; আন্দামান সাগর। আন্দামান সাগরের উত্তরে মিয়ানমার; পূর্বে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড; দক্ষিণে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ; পশ্চিমে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এপ্রিলের ১৬ তারিখে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে খবর আসে যে, বঙ্গোপসাগরে একটা ট্রলারে গাদাগাদি করে অমানবিক পরিবেশে সমুদ্রে ভাসছে ৩’শ ৮২ জন শরণার্থী। বাংলাদেশের কোস্ট গার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ জানাচ্ছে যে, এই শরণার্থীরা প্রায় দুই মাস ধরে সমুদ্রে ভাসছিল। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ের মাঝে নৌকাটা মার্চ থেকে মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছাবার উদ্দেশ্যে দু’বার আন্দামান সাগর পারপার করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা এই মুসলিম শরণার্থীদেরকে পাচারকারীরা পাঠিয়েছিল মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ঐ একই দিনে মালয়েশিয়ার বিমান বাহিনী মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমায় লাংকাউইএর কাছাকাছি ২’শ মানুষবাহী দ্বিতীয় ট্রলারটা দেখতে পেয়ে নৌবাহিনীকে জানালে নৌবাহিনী সেটাকে ফেরত পাঠায়। মালয়েশিয়ার সরকার বলছে যে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডও মালয়েশিয়ার মতোই শরণার্থীদেরকে দেশে ঢুকতে দেয়নি। এই দুই দেশে প্রত্যাক্ষ্যাত হয়েই ট্রলারগুলি বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালাতে থাকে। এই সময় থেকেই শুরু হয় রাজনীতি।

২৪শে এপ্রিল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশলেতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে সমুদ্রে ভাসমান পাঁচ শতাধিক শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার অনুরোধ জানান। আরেক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)এর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন যে, মিয়ানমারের গণহত্যার কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশকে অনেক বড় বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছে। কিন্তু শরণার্থী বোঝাই ট্রলারকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদেরকে সাগরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো অজুহাত নেই। ২৭শে এপ্রিল ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে ফোন করে রোহিঙ্গাদের গ্রহণে অনুরোধ জানান। জবাবে ব্রিটিশ মন্ত্রীকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিস্তারিত তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও মানবিক কারণে ইতোমধ্যে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও বাংলাদেশকেই অনুরোধ করা হচ্ছে। অথচ ঐ ভাসমান রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থান যে এলাকায় সেই দেশগুলিকে কেউ আশ্রয় দিতে বলছে না, তারা নিজেরাও এগিয়ে আসছে না। মন্ত্রী ভাসমান রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে ব্রিটিশ রয়াল নেভিকে এগিয়ে আসতে উপদেশ দেন।

পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ১১ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু হয়েছে। একসময় এই শরণার্থীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কৌশলগতভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। এখন সমুদ্রে ভাসমান শরণার্থীদের নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভূরাজনৈতিক খেলা। পশ্চিমা শক্তিগুলি এই শরণার্থীদের ব্যবহার করে বাংলাদেশকে এবং বঙ্গোপসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। চীনের উত্থানের পর থেকে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনের কিউকপিউতে চীনারা তৈরি করেছে তেলের টার্মিনাল, যেখানে ২৫ মিটার ড্রাফটের তেলের ট্যাঙ্কার ভিড়তে পারে। এখানে নামিয়ে দেয়া তেল এবং বঙ্গোপসাগর থেকে ওঠানো প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পৌঁছাচ্ছে। আবার অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে কমাতে ভারত রাখাইনে ‘কালাদান প্রকল্প’র নামে সিতওয়ে বন্দর এবং কালাদান নদীকে ব্যবহার করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্থলবেষ্টিত রাজ্য মিজোরামের সীমানা পর্যন্ত পরিবহণ করিডোর তৈরি করছে। ভূরাজনৈতিকভাবে এহেন প্রতিযোগিতাপূর্ণ এলাকায় পশ্চিমারা কলকাঠি নাড়ছে; আর শরণার্থীদের চাপিয়ে দিয়ে বিপদে ফেলছে বাংলাদেশকে। ‘ক্যারট এন্ড স্টিক’ খেলার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
  
আন্দামান সাগরের মানব পাচারের রুট ম্যাপ। ভূরাজনৈতিকভাবে এহেন প্রতিযোগিতাপূর্ণ এলাকায় পশ্চিমারা কলকাঠি নাড়ছে; আর শরণার্থীদের চাপিয়ে দিয়ে বিপদে ফেলছে বাংলাদেশকে। ‘ক্যারট এন্ড স্টিক’ খেলার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।

বাংলাদেশ কি ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হয়েই থাকবে?

বিশ্বব্যাপী করোনা দুর্যোগের মাঝেই কিছু দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের খেলায় মেতেছে। বিশেষ করে বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এই খেলা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এই খেলায় তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশকে তারা এমনই এই গুটি হিসেবে দেখছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি শক্তিশালী দেশগুলির ক্রীড়নক হয়েই থাকবে, নাকি নিজের শক্তির জানান দেবে? নিজের সারভাইভাল নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশকে নিজের শক্তির জানান দিতে হবে।

প্রথমতঃ আন্দামান সাগরে শরণার্থীবাহী ট্রলারগুলি ভাসছে দুই মাস ধরে। এতে দু’টা ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া যায়। এক, ভারত, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার এতে কোন মাধাব্যাথা নেই। এবং দুই, এই সাগরে একটা ট্রলার দুই মাস ধরে ঘুরলেও সেটার খবর নেবার কেউ নেই। অর্থাৎ এই সাগরে মানব পাচার ধরার জন্যে দায়িত্ব কেউ নেয়নি। সকলেই নিজের সমুদ্রসীমাটুকু পাহাড়া দিয়েই দায় সাড়ছে। আর শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার কারণে এদের দায়ভার বাংলাদেশের উপরে চাপাবার কথা বলে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে চাচ্ছে শক্তিশালী দেশগুলি। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে বাংলাদেশের উদ্যোগে আন্দামান সাগরে প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করা।

দ্বিতীয়তঃ আন্দামান সাগর হয়ে বাংলাদেশের সাথে পূর্ব এশিয়ার সম্পূর্ণ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। পূর্বগামী বাংলাদেশের পরিবহণ জাহাজগুলি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং মিয়ামনারের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাঝ দিয়ে পার হয়। কোলকাতাগামী জাহাজগুলিও এই রুট ব্যবহার করে। শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যগামী জাহাজগুলি নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝ দিয়ে যায়। আর বঙ্গোপসাগরে ভারতের পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলিতে জাহাজ যায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে। এই সাগরে একটা ট্রলার দুই মাস এমনি এমনি ভাসতে পারলে বাণিজ্য জাহাজগুলি কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। বাংলাদেশের কৌশলগত চিন্তায় এই সমুদ্র রুটের নিরাপত্তার ব্যাপারটা কি কখনো এসেছিল? আন্দামান সাগরে প্যাট্রোল বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখার জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয়।
 

আন্দামান সাগর হয়ে বাংলাদেশের সাথে পূর্ব এশিয়ার সম্পূর্ণ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। এই সাগরে একটা ট্রলার দুই মাস এমনি এমনি ভাসতে পারলে বাণিজ্য জাহাজগুলি কতটা নিরাপদ, তা সন্দেহাতীত নয়। বাংলাদেশের কৌশলগত চিন্তায় এই সমুদ্র রুটের নিরাপত্তার ব্যাপারটা কি কখনো এসেছিল? আন্দামান সাগরে প্যাট্রোল বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখার জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয়।

কিভাবে এই প্যাট্রোল হবে?
প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। সেই হিসেবে ভারতের আন্দামান দ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডের ফুকেট, মালয়েশিয়ার কেলাং, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়ার বন্দরগুলিতে বাংলাদেশের নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের প্যাট্রোল জাহাজগুলি নিয়মিতই সফর করতে পারে। এই সবগুলি বন্দরই আন্দামান সাগরের চারিদিকে ছড়িয়ে। কাজেই এই সাগরে বাংলাদেশের নিয়মিত প্যাট্রোল একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারতো, যদি রাষ্ট্রের কৌশলগত চিন্তার মাঝে আন্দামান সাগর স্থান পেতো। আন্দামান সাগর থেকে বিতাড়িত শরণার্থীদের যে বাংলাদেশেই পাঠানো হবে, সেটা সম্পর্কে আগেভাগে তথ্য হাতে পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আন্দামান সাগর এবং এর চারিদিকের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যথেষ্ট তথ্য পাবার ব্যবস্থা থাকবে হবে বাংলাদেশের হাতে। এই তথ্যের সাথে প্যাট্রোলের সমন্বয়ের মাধ্যমে আশেপাশের দেশগুলিকে সাথে দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতকে এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে সহায়তা দেবার জন্যে রাজি করাতে হবে। তারা যদি লাখো শরণার্থীর দায় নিতে না চায়, তাহলে আন্দামান সাগর টহল দিতে বাংলাদেশকে তাদের অবশ্যই লজিস্টিক্যাল এবং ইন্টেলিজেন্স সাপোর্ট দিতে হবে।

বাংলাদেশ যদি করোনা দুর্যোগ থেকে বৈশ্বিক পাওয়ার ব্যালান্সের ‘ভূমিকম্পসম’ পরিবর্তন বুঝতে পারে, তাহলে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, শক্তিশালী দেশগুলির খেলার গুটি হওয়াটা বাংলাদেশের জন্যে কোন অপশন নয়। বরং নিজের শক্তিকে জানান দিয়ে এটা বলে দিতে হবে যে, এদেশের সাথে ‘ক্যারট এন্ড স্টিক’ খেলতে গেলে যে কারুরই হাত পুড়বে। সাম্প্রতিক শরণার্থী সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আন্দামান সাগরের মতো কৌশলগত একটা সাগরকে বাংলাদেশ কতটা হাল্কাভাবে নিয়েছিল এতদিন। বাংলাদেশের ‘আন্দামান প্যাট্রোল ফোর্স’ বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থকে রক্ষায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে কাজ করবে।

Sunday 3 May 2020

করোনা পরিস্থিতিতেও অস্ট্রেলিয়ার শিপইয়ার্ডগুলি ব্যস্ত কেন?

৪ঠা মে ২০২০
   
এপ্রিল ২০২০; করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির মাঝেও অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর জন্যে ‘আরাফুরা-ক্লাস’এর অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলের কীল লেইং। এই জাহাজগুলি অস্ট্রেলিয়ার ৮০ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধজাহাজ তৈরির পরিকল্পনার অংশ। জাহাজগুলি অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীকে নতুন ধরনের সক্ষমতা দেবে; যা কিনা দেশটার নিরাপত্তা চিন্তাকেই প্রতিফলিত করে। দক্ষিণ চীন সাগর এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলায় এই জাহাজগুলি সমমনা দেশের জাহাজগুলির সাথে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তর ২৭শে মার্চ ঘোষণা দেয় যে, রয়াল অস্ট্রেলিয়ান নেভির জন্যে ১২টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলের তৃতীয়টার কাজ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়টার কাজ শুরু হয় ৯ই এপ্রিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, ২০২২ সালে এই জাহাজগুলির প্রথমটা পাবার সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়া নতুন ধরনের এক সক্ষমতা পেতে যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ৮০ মিটার লম্বা ১৬’শ টনের এই জাহাজগুলি জার্মান কোম্পানি ‘লুরসেন’এর ডিজাইনে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ‘এএসসি’ শিপইয়ার্ড এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ‘সিভমেক’ শিপইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে। ‘লুরসেন’ শুধু জাহাজই তৈরি করছে না, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় শিপইয়ার্ডটাও তারা তৈরি করছে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, এই জাহাজগুলি বিভিন্ন মিশন প্যাকেজ বহন করার মাধ্যমে কয়েক ধরনের বিশেষায়িত কাজ করতে সক্ষম হবে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ‘এএসসি’ শিপইয়ার্ডকে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘ব্রিটিশ এরোস্পেস সিস্টেমস’এর কাছে বিক্রি করে দেয় আরেকটা বড় প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এই শিপইয়ার্ডে তৈরি হতে যাচ্ছে ৯টা ‘হান্টার-ক্লাস’ ফ্রিগেট, যা ‘টাইপ-২৬’ নামে ব্রিটিশ রয়াল নেভির জন্যে ৮টা এবং ‘রয়াল কানাডিয়ান নেভি’র জন্যে ১৫টা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে এই জাহাজের ডিজাইন এবং প্রোটোটাইপ তৈরির কাজ চলছে। প্রথম জাহাজটার কাজ শুরু হবে ২০২২ সালে। ২৬ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে; যার মাঝে ১ হাজার গ্র্যাজুয়েট কর্মী থাকবে। এই দুই প্রকল্প ছাড়াও ৫০ বিলিয়ন ডলারের আরেক প্রকল্পের অধীনে তৈরি হচ্ছে ১২টা ‘এটাক-ক্লাস’ সাবমেরিন। ফরাসী কোম্পানি ‘নেভাল গ্রুপ’এর ডিজাইনে এই সাবমেরিনগুলিও তৈরি হবে অস্ট্রেলিয়াতে। বর্তমানে এর ডিজাইনের কাজ চলছে ফ্রান্সে। করোনাভাইরাসের লকডাউনের মাঝেও অস্ট্রেলিয়ার শিপইয়ার্ডগুলিতে কাজ চলছে সমানে। বাজেটেরও কোন ঘাটতি নেই। কেন এতগুলি জাহাজ তৈরি করছে তারা? কি ধরনের সক্ষমতার কথাইবা বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী? একসাথে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ প্রকল্পগুলির নেপথ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা নীতি।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা নীতি

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ‘ডিফেন্স হোয়াইট পেপার’ নামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে; যেখানে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামনের দিনগুলিতে প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়। এতে ২০২৫-২৬ সাল নাগাদ অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাজেট দাঁড়াবে প্রায় ৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৬-১৭ সালে ছিল ৩২ বিলিয়ন। জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার প্রত্যয় ব্যক্ত করার সাথে সাথে নৌবাহিনীর শক্তিকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়। অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল বলেন যে, যেহেতু অস্ট্রেলিয়া একটা দ্বীপ দেশ, তাই তার একটা শক্তিশালী নৌবাহিনী থাকা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে নৌবাহিনীর ‘কলিন্স-ক্লাস’এর ৬টা সাবমেরিনকে প্রতিস্থাপন করে ‘এটাক-ক্লাস’এর ১২টা সাবমেরিন কেনার কথা বলা হয়, যাতে খরচ হবে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ৮টা ‘এনজাক-ক্লাস’এর ফ্রিগেটকে প্রতিস্থাপন করতে ৯টা নতুন ফ্রিগেট তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও ১২টা নতুন অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল, ৭টা ‘পি-৮এ’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান, ৭২টা ‘এফ-৩৫এ’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান এবং ১২টা ‘ইএ-১৮জি গ্রাউলার’ ইলেকট্রনিক এটাক বিমান ক্রয় করার কথা বলা হয়।

‘হোয়াইট পেপার’এ মূলতঃ যে চ্যালেঞ্জগুলির কথা বলা হয়, সেগুলি হলো, প্রথমতঃ চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব; দ্বিতীয়তঃ জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন দেশের মাঝে প্রতিযোগিতার কারণে আন্তর্জাতিক আইনের উপরে ভিত্তি করে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক ব্যবস্থার দুর্বল হওয়া; তৃতীয়তঃ সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি; চতুর্থতঃ সম্পদের অসম বন্টন, সামাজিক অসঙ্গতি ও জলবায়ুগত কারণে অত্র অঞ্চলের কিছু দেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে; পঞ্চমতঃ অনেকগুলি দেশের সমরশক্তির সক্ষমতার ব্যাপক বৃদ্ধি; আর ষষ্ঠতঃ সাইবারস্পেসে হামলার আশংকা বৃদ্ধি। অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব ভূখন্ডে আরেকটা দেশের সামরিক হামলার আশংকা না থাকলেও অন্য কোন স্থানে অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থ হুমকির মাঝে পড়লে সেখানে হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়। বৈশ্বিক শক্তি অনেকগুলি দেশের হাতে ছড়িয়ে যাওয়ায় অনিশ্চয়তা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সমুদ্রসীমা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মাঝে প্রতিযোগিতা উত্তেজনার কারণ হতে পারে; এবং সকলেই সমান্তরালে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কারণে অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ব্যাহত করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মাঝে দ্বন্দ্ব সামনের দিনগুলিতে নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে বলে প্রতিবেদনটাতে বলা হয়। এতে আরও বলা হয় যে, দুই দশকের মাঝে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সারা দুনিয়ার অর্ধেক সাবমেরিন অপারেট করবে; আর এই অঞ্চলের দেশগুলির হাতে থাকবে দুনিয়ার অর্ধেক আধুনিক যুদ্ধবিমান। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা না থাকলেও পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, সাইবারস্পেস এবং মহাকাশে এই দেশগুলির দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাবে বলে বলা হয়।

‘হোয়াইট পেপার’এ লক্ষ্য হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রের নিরাপত্তায় অংশ নেয়ার কথা বলা হয়। একইসাথে পপুয়া নিউ গিনি, তিমর-লেস্তে এবং প্রশান্ত মহাসাগরী দ্বীপ দেশগুলির নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে অস্ট্রেলিয়া তাদের প্রধান নিরাপত্তা সহযোগী হতে চায়। আরেকটা লক্ষ্য হিসেবে বলা হয় যে, আন্তর্জাতিক আইনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রতি কোন হুমকি অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থবিরুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সাথে অস্ট্রেলিয়া একত্রে হস্তক্ষেপ করবে।

ঠিক এই ব্যাপারটাই দেখা যায় ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর জন্যে অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ক্রয়ের প্রকল্পে। গত অগাস্টে ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষা সচিব ডেলফিন লরেনজানা ঘোষণা দেন যে, অস্ট্রেলিয় সরকারের অর্থায়নে ৬টা প্যাট্রোল ভেসেল ক্রয় করা হবে। অস্ট্রেলিয়ার ‘অস্টাল’ কোম্পানির ফিলিপাইন শিপইয়ার্ডে এই জাহাজগুলি তৈরি হবে বলে বলা হয়। প্রায় ৫’শ ৭১ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ফিলিপাইনের আপাততঃ কোন অর্থ বিনিয়োগ দরকার নেই। চীনকে মোকাবিলায় এই জাহাজগুলি নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ চীন সাগরে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজগুলি যেসকল দেশের নৌবাহিনীর সাথে কাজ করবে বলে বলা হচ্ছে, তার একটা হলো ফিলিপাইন।
  
এপ্রিল ২০২০; দক্ষিণ চীন সাগরে টহল দিচ্ছে মার্কিন এম্ফিবিয়াস এসল্ট শিপ ‘আমেরিকা’, ক্রুজার ‘বাংকার হিল’ এবং ডেস্ট্রয়ার ‘ব্যারি’; সাথে অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিগেট ‘পারামাত্তা’ (সর্ববামে)। প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ায় দক্ষিণ চীন সাগরে টহল দেয়ার জন্যে মার্কিন সক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বদাই কাছে পেলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ব্যাপারটা অস্ট্রেলিয়াকে ভাবাবে। এমনই একটা পরিস্থিতি পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে; যা কিনা অস্ট্রেলিয়া স্বাগত জানাবে।

অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কে কি ভাবছে?

অন্যদিকে চীন অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা চিন্তাকে নিজেদের স্বার্থবিরুদ্ধ মনে করছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং সরাসরিই বলেন যে, দক্ষিণ চীন সাগর এবং চীনের সামরিক শক্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাথা ঘামানোটা চীন ভালো চোখে দেখছে না। তিনি আশা করেন যে, বিভিন্ন দেশ অত্র এলাকায় সামরিক মহড়া এবং প্যাট্রোল দেয়া বন্ধ করবে এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা বন্ধ করবে। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা চিন্তার ব্যাপারে চীনের অসন্তোষ প্রকাশের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র ‘স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ডিফেন্স স্টাডিজ সেন্টার’এর জন ব্ল্যাক্সল্যান্ড বলেন যে, চীন যে এধরণের কথাই বলবে, তা জানাই ছিল। বরং অত্র অঞ্চলের সব দেশই চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত।

যুক্তরাষ্ট্রের থিংকট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো জন লী বলছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সাথে নিরাপত্তা সম্পর্কটাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। একই ধরনের আদর্শিক লক্ষ্য থাকার কারণে উভয় দেশই একত্রে কাজ করবে। অত্র অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার নৌশক্তি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যাকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের পক্ষে রাখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানকে মার্কিন নেতৃত্বের অধীনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়ার হিসেবে দেখতে। তিনি আরও বলছেন যে, যদি চীনের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে জাপানের শক্তি বৃদ্ধি হয়, তাহলে চীনাদের এই কৌশলকে অনেকেই ভুল বলে গণ্য করতে পারেন। আর এই শক্তিগুলির সামষ্টিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেই বেইজিংএর আগ্রাসী ভূমিকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। তবে জন লীর চিন্তায় বেইজিংকে চাপে ফেলে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার জন্যে যে চেষ্টার কথা বলা হয়েছে, সেটা চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ, ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং সাম্প্রতিককালে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে কাদাছোঁড়াছুড়ির ফলে এখনও অসফল।

তবে চীনকে মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রের উপরই নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। গত জুলাই মাসে লন্ডনে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, এশিয়া-প্যাসিফিক এলাকায় ব্রিটেনকে সামরিকভাবে আরও বেশি যুক্ত হতে হবে। তিনি বলেন যে, এটা সন্দেহাতীত যে, বর্তমানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কৌশলগত পরিস্থিতিতে সবচাইতে বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে চীনের ব্যাপক সামরিকীকরণ এবং চীনের সাথে আশেপাশের দেশগুলির বিরোধ দেখতে পাচ্ছে। চীন এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলছে। এমতাবস্থায় মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের সাথে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট’ বা ‘এফপিডিএ’ ব্যবহার করে চীনের সামরিক উত্থানের হুমকি মোকাবিলা করার কথা বলেন রেইনল্ডস। তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজ মোতায়েনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান এবং সেখানে ব্রিটিশ সামরিক উপস্থিতিকে আরও বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান। একইসাথে এব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। দুই দেশের সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, বিশ্বের খুব কম দু’টা দেশের মাঝেই ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো কাছাকাছি সম্পর্ক রয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়া একে অপরকে বিশ্বাস করে।

   
অস্ট্রেলিয়ার আশেপাশে প্রায় ১৪টার মতো ছোট দ্বীপ দেশকে অস্ট্রেলিয়া অর্থ এবং নিরাপত্তা সহায়তা দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরিভাবে কৌশলগত; আর এর মূলে রয়েছে চীনের প্রভাব বিস্তারকে ঠেকানো। কার কতটুকু সহায়তা প্রয়োজন, সেই হিসেব করে কখনোই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।


প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৈদেশিক সহায়তার কূটনীতি

সামরিক বাজেটের বাইরে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বৈদেশিক সহায়তা। গত বছরের জুনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের সময় আড়াই’শ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই প্রতিশ্রুত অর্থ ১০ বছরে খরচ করা হবে। সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষের এই দ্বীপপুঞ্জের জিডিপি প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু গর আয় প্রায় ২ হাজার ৪’শ ডলার। ১০ বছরে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলার দেশটার জন্যে খুব বেশি কিছু নয়। তবে গত ছয় বছরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল অস্ট্রেলিয়ার মোট বৈদেশিক সহায়তার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার থিংকট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর জনাথন প্রাইক বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরিভাবে কৌশলগত; আর এর মূলে রয়েছে চীনের প্রভাব বিস্তারকে ঠেকানো। কার কতটুকু সহায়তা প্রয়োজন, সেই হিসেব করে কখনোই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। একারণেই দেখা যাবে যে, অস্ট্রেলিয়া তার বেশিরভাগ সহায়তা দিচ্ছে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়। এই এলাকাগুলিতেই অস্ট্রেলিয়ার প্রভাব এবং গুরুত্ব সবচাইতে বেশি।

২০১৭ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দানের ঘোষণার মাধ্যমে চীন অস্ট্রেলিয়ার নিজের উঠানেই অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে চাইছে। ঐ একই বছর অস্ট্রেলিয়া এই অঞ্চলের জন্যে মাত্র ৮’শ ১৫ মিলিয়ন ডলারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অর্থাৎ চীন অস্ট্রেলিয়ার চার গুণ সহায়তা দিতে চাইছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ছয় বছরে অস্ট্রেলিয়া এই অঞ্চলে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে; যেখানে চীন প্রায় সাত বছরে দিয়েছিল সোয়া ১ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ থেকে ২০১৬এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ফ্রান্স এখানে তাদের সহায়তা যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে।

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’ বলছে যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে অস্ট্রেলিয়ার সহায়তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনতে পারেনি। কারণ অস্ট্রেলিয়া সহায়তা দিয়েছে এমন সব সেক্টরে, যা অস্ট্রেলিয়রা মনে করছে দেয়া উচিৎ; যেমন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুশাসন। অন্যদিকে চীনারা এই ছোট দেশগুলিকে জিজ্ঞেস করছে যে, তাদের কোন সেক্টরে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর ফলাফল হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই চীনারা এসব দেশে বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার ঠিক উত্তরেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচাইতে বড় দ্বীপ পপুয়া নিউ গিনির কথা বলা যেতে পারে। ৮৬ লক্ষ মানুষের এই দেশের জিডিপি ২১ বিলিয়ন ডলার; মাথাপিছু গড় আয় আড়াই হাজার ডলার। তবে দেশটার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। চীন মূলতঃ পপুয়া নিউ গিনিতেই সবচাইতে বড় বিনিয়োগ করছে। ২০১৭ সালে সেখানে চীনারা ৮৫ মিলিয়ন ডলার খরচে রাস্তা উন্নয়নের কাজ শেষ করেছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া এ পর্যন্ত ২’শ ১৯ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং এইডসএর সংক্রমণ রোধে। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ সহায়তা হলো অনুদান; চীনাদের বেশিরভাগ ঋণ। আইএমএফএর হিসেবে এই অঞ্চলের ১৪টা দেশের মাঝে ৬টাই ঋণের অর্থ ফেরত দেয়ার যোগ্যতা প্রায় হারিয়েছে; আরও ৩টা দেশ যোগ্যতা হারাবার পথে রয়েছে। সুতরাং এই দেশগুলিকে দেয়া চীনা ঋণের কি হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে শ্রীলংকা ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না পারার পর চীনারা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় সেটা উদাহরণ হিসেবেই সামনে আসছে।    
জুন ২০১৭; চীনা নৌবাহিনীর কয়েকটা যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশ ভানুয়াতু সফর। অস্ট্রেলিয়া তার আশেপাশের দ্বীপ দেশগুলিকে নিজের প্রভাবের অঞ্চল হিসেবে দেখে। একইসাথে অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র বাণিজ্য রুটগুলির কয়েকটা এই দ্বীপগুলির মাঝ দিয়ে যাবার কারণে অস্ট্রেলিয়ার কাছে এগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। চীনারা এই দ্বীপগুলিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করার অস্ট্রেলিয়ার সাথে চীনের দ্বন্দ্বও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্বীপগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন?

পপুয়াতে রয়েছে স্বর্ণ, তামা, নিকেল, গ্যাস, ইত্যাদি খণিজ সম্পদ। একারণে সেখানে বিনিয়োগ করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে চীনের জন্যে। আবার প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলিতে অনেক চীনারাও বসবাস করে; যারা বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা করার জন্যে অথবা কাজের জন্যে সেখানে গিয়েছিল। তবে ‘সিএনএন’ বলছে যে, এই অঞ্চলে চীনের আনাগোণা বৃদ্ধির আরও বড় কারণ হতে পারে কূটনীতি। বিশ্বের মাত্র ১৬টা দেশ তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে; এর মাঝে ৬টা দেশই হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। বহু বছর ধরেই চীনারা তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয়া দেশগুলিকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পপুয়া নিউ গিনি তাদের দেশে তাইওয়ানের প্রতিনিধির বিভিন্ন কূটনৈতিক অধিকার কেড়ে নেবার পর তাইওয়ান অভিযোগ করে যে, চীনা সরকারের চাপের কারণেই পপুয়া এটা করেছে। গত সেপ্টেম্বরে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সরকার তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। চীন সলোমোনের সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী; আর তারা চীনা বিনিয়োগ থেকেও বঞ্চিত হতে চায় না। ডিসেম্বরে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের রাজনীতিবিদদের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলে যে, চীন এবং তাইওয়ান পাল্টাপাল্টি অবস্থানে থেকে তাদেরকে লক্ষ লক্ষ ডলার ঘুষ সেধেছে তাদের পক্ষে থাকার জন্যে।

তবে এই দ্বীপগুলি নিয়ে বিরোধের পিছনে আরেকটা কারণ হিসেবে ‘সিএনএন’ বলছে যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১৪টা দেশের পুরো জনসংখ্যা একটা চীনা শহরের জনসংখ্যার সমান হলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চীনের ভোট এবং এই দেশগুলির ভোট সমান ওজনের। সেই হিসেবে এই দেশগুলি তাদের আকৃতির তুলনায় চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর বাইরেও এই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়াবার পিছনেও চীনের আকাংক্ষা থাকতে পারে। ২০১৮ সালে ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূলের কাছে ভানুয়াতু দ্বীপের সাথে চীনের স্থায়ী সামরিক ঘাঁটির ব্যাপারে কথা হচ্ছে; যা উভয় দেশই অস্বীকার করে। ২০১৮ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইকনমিক এন্ড সিকিউরিটি রিভিউ কমিশন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনারা সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পুরো এলাকায় চীনাদের নজরদারি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যাবে; আর তা অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের জন্যে হুমকি হওয়া ছাড়াও অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ঢোকা বা বের হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের মাঝে তিনটাই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দিয়ে গিয়েছে। চীনারা এই বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি না করলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই অস্ট্রেলিয়া হুমকির মাঝে পড়বে।

যা চিন্তা তা-ই কাজ। গত অগাস্টে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস আনুষ্ঠানিকভাবে পপুয়া নিউ গিনির প্রায় ৩’শ কিঃমিঃ উত্তরে মানাস দ্বীপের ‘লোমব্রুম’এ নতুন নৌঘাঁটির প্রথম ধাপের উদ্ভোধন করেন। পপুয়ার সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী এই ঘাঁটি অস্ট্রেলিয় এবং মার্কিন নৌবাহিনী ব্যবহার করবে। লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, কৌশলগতভাবে এই ঘাঁটি সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল; এখনও রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দ্বীপে জাপানের বড় আকারের সামরিক ঘাঁটি ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া এই ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয় সরকার ‘প্যাসিফিক ম্যারিটাইম সিকিউরিটি প্রোগ্রাম’এর আওতায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৩টা দেশকে ২১টা ‘গার্ডিয়ান-ক্লাস’ প্যাট্রোল বোট অনুদান দিচ্ছে। এর আগে ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের আইনে সকল দেশকে উপকূল থেকে ২’শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রে ‘এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন’এর অধিকার দেয়ার পর ১৯৮৫ এবং ১৯৯৭ সালের মাঝে অস্ট্রেলিয় সরকার ১২টা দেশকে ২২টা ‘প্যাসিফিক-ক্লাস’ প্যাট্রোল বোট তৈরি করে দান করেছিল। সেই বোটগুলিকে প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যেই ৩’শ ৩৫ মিলিয়ন ডলার খরচে ৪০ মিটার লম্বা এই বোটগুলি তৈরি করছে অস্ট্রেলিয়ার ‘অস্টাল’ শিপইয়ার্ড। এই দ্বীপ দেশগুলি থেকে যাতে ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান দিয়ে সমুদ্রে টহল বৃদ্ধি করা যায়, সেই প্রচেষ্টাও রয়েছে এই প্রকল্পের মাঝে।
   
নভেম্বর ২০১৮; পপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্সবির উপকূলে ‘এপেক’ শীর্ষ বৈঠকের নিরাপত্তা দিচ্ছে রয়াল অস্ট্রেলিয়ান নেভির হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘এডেলেইড’। পপুয়াতে এই বৈঠকের মাঝ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের দড়ি টানাটানির কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়; যেখানে চীনারা চাইছিলো পোর্ট মোর্সবির উন্নয়নের চেহাড়া দেখাতে; আর অস্ট্রেলিয়া চাইছিলো দেখাতে যে, অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা সহায়তা ছাড়া অত্র অঞ্চলের দেশগুলি অসহায়।

২০১৮ সালের নভেম্বরে পপুয়া নিউ গিনির রাজধানী পোর্ট মোর্সবিতে ‘এশিয়া-প্যাসিফিক ইকনমিক কোঅপারেশন’ বা ‘এপেক’ ফোরামের শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সহ ২১টা দেশের শীর্ষ নেতারা যোগ দেন। প্রায় ১৫ হাজার গেস্টের থাকার সংকুলান না হওয়ায় বন্দরে ৩টা ক্রুজ লাইনার জাহাজ ভিড়িয়ে রাখা হয়। এই বৈঠকের নিরাপত্তার খাতিরে যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান এবং স্পেশাল ফোর্সসহ প্রায় ৪ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়। ফিলিপাইনের মিডিয়া ‘র‍্যাপলার’ বলছে যে, এই বৈঠকের নিরাপত্তার দায়িত্বের পুরোটাই নেয় অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া দেড় হাজার সেনাসহ রয়াল অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্সের ‘এফএ-১৮ সুপার হর্নেট’ ফাইটার বিমান, ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান এবং নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘এডেলেইড’কে মোতায়েন করে। অস্ট্রেলিয়ার সাথে নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রও এই নিরাপত্তা মিশনে অংশ নেয়। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা থিংকট্যাঙ্ক ‘অস্ট্রেলিয়া ডিফেন্স এসোসিয়েশন’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নেইল জেমস বলেন যে, পপুয়া নিউ গিনির মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যদি বিদেশী নিরাপত্তা বাহিনীকে নিজ দেশে আসতে দিতে না চায়, তাহলে তারা কখনোই ‘এপেক’এর মতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে সক্ষম হবে না। এটা কৌশলগত এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও ভালো হবে না। তবে ‘এপেক’ বৈঠকের পিছনে অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও চীনের অবদানও ছিল। বৈঠকের আগে চীনাদের অর্থায়নে পোর্ট মোর্সবির চেহাড়ার বেশ পরিবর্তন সাধিত হয়। চীনা অর্থে রাস্তা ও কনভেনশন সেন্টারের উন্নয়ন করা হয়; গেস্টদের আনা নেয়ার জন্যে কেনা হয় বাস। অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, দেশের বহু মানুষের যখন মৌলিক চাহিদাই পূর্ণ হচ্ছে না, তখন পপুয়ার মানুষের কাছে এরকম জাঁকজমকের অর্থ কতটুকু? পপুয়াতে এই বৈঠকের মাঝ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের দড়ি টানাটানির কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়; যেখানে চীনারা চাইছিলো পোর্ট মোর্সবির উন্নয়নের চেহাড়া দেখাতে; আর অস্ট্রেলিয়া চাইছিলো দেখাতে যে, অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা সহায়তা ছাড়া অত্র অঞ্চলের দেশগুলি অসহায়।

অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বেশি বাণিজ্য এশিয়ার সাথে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে পূর্ব এশিয়ায় যাবার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দু’টা নৌপথ পপুয়া নিউ গিনি এবং সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যায়। নিউ গিনি দ্বীপ ও নিউ ব্রিটেন দ্বীপের মাঝে দিয়ে দক্ষিণ রুটটা; আর নিউ ব্রিটেন ও সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত বোগেনভিল দ্বীপের মাঝ দিয়ে উত্তর রুটটা গিয়েছে। মানাস দ্বীপের নৌঘাঁটিটা এই দুই সমুদ্র বাণিজ্য রুটের ঠিক মাঝখানে হওয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বন্দরগুলি থেকে জাহাজ মূলতঃ ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা ও লম্বক প্রণালী এবং তিমর সাগর ও আরাফুরা সাগরের মাঝ দিয়ে যায়। এই পথগুলির উপর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া।

কিন্তু চীন থেকে অস্ট্রেলিয়া কতটুকু দূরে থাকবে?

অস্ট্রেলিয়ার ‘এসবিএস নিউজ’ জানাচ্ছে যে, চীন হলো অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী। দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য দেড়’শ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অস্ট্রেলিয়ার মোট বাণিজ্যের ২৩ শতাংশই চীনের সাথে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; যার সাথে বাণিজ্য ৬৪ বিলিয়ন ডলার; এরপর জাপানের সাথে ৬১ বিলিয়ন; দক্ষিণ কোরিয়া সাথে ৩২ বিলিয়ন; এবং ব্রিটেনের সাথে ২৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। সিঙ্গাপুরের সাথেও বাণিজ্য যথেষ্ট। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ বাণিজ্য পূর্ব এশিয়ার সাথেই। এখানকার বেশিরভাগ দেশের সাথেই অস্ট্রেলিয়ার রয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। ২০০৭ সালেই চীনারা অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে জাপানকে অতিক্রম করে। অপরদিক থেকে অস্ট্রেলিয়া চীনের জন্যে সপ্তম বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী। অস্ট্রেলিয়ার ‘মনাশ ইউনিভার্সিটি’র বাণিজ্য বিশ্লেষক জিওভানি ডে লিয়েতো বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার সকল রপ্তানি পণ্যকে ‘পাথর এবং শস্য’এর মাঝে চিন্তা করা যায়। অর্থাৎ লৌহ আকরিক, কয়লা, স্বর্ণ এবং গ্যাস হলো খণিজ পণ্য; আর গরুর গোশত, পশম, তুলা, ছোলা, ডাল, গম, চিনি এবং মদ হলো কৃষিজ পণ্য। তবে অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রার উৎস হলো শিক্ষা। লাখো শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়াতে আসছে ইংরেজি শিখতে এবং উচ্চশিক্ষার্থে। পর্যটনেও বড় আয় রয়েছে আস্ট্রেলিয়ার। অন্যদিকে আমদানির কথা চিন্তা করলে অস্ট্রেলিয়রা বিদেশ ভ্রমণেই খরচ করে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার; গাড়ি আমদানিতে যায় ২১ বিলিয়ন; পেট্রোলিয়াম পণ্যে ১৫ বিলিয়ন; টেলিকম যন্ত্রপাতিতে ১২ বিলিয়ন; আর পণ্য পরিবহণে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের জুনে চীনা নৌবাহিনীর তিনটা যুদ্ধজাহাজ অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দর ঘুরে আসে। অস্ট্রেলিয়ার জনগণের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকলেও এটা নিশ্চিত যে চীনের সাথে কোনরূপ সহিংসতা অস্ট্রেলিয়ার বাস্তবতা নয়। তবে এটা পরিষ্কার যে, অস্ট্রেলিয়া অত্র অঞ্চলে তার নিরাপত্তাকে হাল্কাভাবে নিচ্ছে না। চীনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে সে পাশে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতেই সে জাহাজ নির্মাণে বিনিয়োগ করছে। এই জাহাজ শুধু নিজের নৌবাহিনীর জন্যেই নয়; দক্ষিণ চীন সাগরের আশেপাশের দেশগুলির জন্যেও তৈরি করতে চাইছে তারা। একইসাথে অস্ট্রেলিয়া তার সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পপুয়া নিউগিনি এবং সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের মতো দেশগুলিকে আর্থিক এবং নিরাপত্তা সহায়তা দিয়ে নিজের সাথে রাখতে চাইছে। চীন অস্ট্রেলিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাত না চাইলেও প্রভাব বিস্তারের খেলায় অস্ট্রেলিয়া যেমন তাইওয়ান ইস্যুতে চীনকে শান্তি দেবে না, তেমনি চীনও অস্ট্রেলিয়ার উঠানে ছোট দ্বীপদেশগুলিকে বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে কিনে ফেলতে চাইবে। অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বদাই কাছে পেলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ব্যাপারটা অস্ট্রেলিয়াকে ভাবাবে। এমনই একটা পরিস্থিতি পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে; যা কিনা ব্রিটিশ কমোনওয়েলথের অন্তর্গত অস্ট্রেলিয়া স্বাগত জানাবে। ব্রিটেনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার কারণে ব্রিটনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার এই সম্পর্ক আরও গভীর হবে। এটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হবে যে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ অস্ট্রেলিয়ার নামমাত্র রানীই শুধু নন।