Monday 28 August 2017

মিয়ানমার তার কৌশলগত অবস্থান কতটুকু বোঝে?

২৮শে অগাস্ট ২০১৭



মিয়ানমারের রাখাইনে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়েছে। জাতিগত এই সহিংসতাকে ঔপনিবেশিক শক্তিরা জিইয়ে রাখছে এই এলাকাকে (বঙ্গোপসাগর এলাকা) নিয়ন্ত্রণে রাখতে। পরাশক্তি কখনোই চায় না যে বঙ্গোপসাগরে কোন শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়ে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা কৌশলগত ব্যালান্সকে পরিবর্তন করে দেবে। ঠিক যখনই পরাশক্তি তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে, ঠিক সেসময়েই সে কোন না কোন ঝামেলা পাকিয়ে তার নিয়ন্ত্রণ পূণপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। মিয়ানমারের এই সমস্যাটাও ঠিক তেমনই। কিছুদিন পরপরই সেখানে জাতিগত সমস্যা শুরু হয়। এক্ষেত্রে সমস্যা শুরু হওয়াটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কখন এই সমস্যার আবির্ভাব হচ্ছে। মিয়ানমারের সরকার যে পরাশক্তির প্ররোচনায় রাখাইনে জাতিগত সমস্যা জিইয়ে রাখছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না। এই কার্যকলাপে মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে ভারত, যে কিনা এখন ভারত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র। সিকিম-ভুটান সীমান্তে চীনের রাস্তা নির্মাণে ভারতের বাধা দেয়া এবং এর ফলশ্রুতিতে ভারত-চীনের উত্তেজনা এবং বঙ্গোপসাগরে ভারত-মার্কিন নৌ-মহড়া “এক্সারসাইজ মালাবার-২০১৭” এই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার পরিচয় দেয়। তবে একইসাথে এই কর্মকান্ডগুলি বলে দিচ্ছে যে পরাশক্তি তার নিজ দেশে যে অস্থিরতায় রয়েছে, সেই একই অস্থিরতায় সে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তার নিয়ন্ত্রণ হারানো নিয়ে।  

  

তবে এখানে শুধু পরাশক্তির কথা বললেই হবে না, মিয়ানমারের কথাও আলোচনা আসা উচিৎ। মিয়ানমারের সরকার হয়তো ভুলে যাচ্ছে যে তাদের কৌশলগত অবস্থান তাদের এধরনের প্রক্সি-যুদ্ধকে সমর্থন করে না। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে মিয়ানমার একখানা তাসের ঘরের উপরে দাঁড়িয়ে থেকে নৃত্য করছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ভৌগোলিক সীমানার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে মিয়ানমারের রাখাইন মিয়ানমারের বাকি অংশের সাথে যতটা না সংযুক্ত, তার চাইতে বেশি ভালোভাবে সংযুক্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সাথে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মংডু শহরের সাথে মিয়ানমারের বাকি অংশের যোগাযোগের মূল মাধ্যম হলো মংডু-বুথিডুয়াং সড়ক। এই সড়ক গিয়েছে সুউচ্চ আরাকান পর্বতের মাঝ দিয়ে এবং কিছু স্থানে পাহাড় কেটে তৈরি করা টানেলের মাঝ দিয়ে। এই টানেল কোন কারণে বন্ধ হয়ে গেলে মংডুর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা মিয়ানমারের পক্ষে খুবই কঠিন হবে। শুধু তা-ই নয়, বুথিডুয়াং হয়ে যে রাস্তাটা কালাদান নদীর অববাহিকা বেয়ে দক্ষিণে চলে গিয়ে বাকি মিয়ানমারের সাথে যুক্ত হয়েছে, সেই রাস্তা থমকে দাঁড়িয়েছে সিতওয়ের উত্তরে বিরাট এক নদীর তীরে। মায়ু নদীর ঐ মোহনাতে কোন সেতু নেই, যা দিয়ে সহজে যানবাহন পার করা সম্ভব। আবার মংডু থেকে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে দক্ষিণের রাস্তাটাও ঐ একই স্থানে এসে মায়ু নদীর মোহনায় থমকে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত এলাকায় সৈন্য সমাবেশ করতে মিয়ানমারের যে লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্কের উপরে নির্ভর করতে হয়, তা অন্যন্ত দুর্বল এবং অনাকাংক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় একেবারেই অপ্রতুল।

রাখাইনের সিতওয়ে বন্দরের একপাশে যেমন মায়ু নদী, অন্যপাশে রয়েছে কালাদান নদী। কালাদান নদী ব্যবহার করে ভারত তার বিচ্ছন্নতাকামী মিজোরাম এবং মণিপুর রাজ্যের লাগাম টেনে রাখতে চাইছে। কোলকাতা থেকে পরিবহণ জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে কালাদান নদী হয়ে উত্তরে যাবে এবং একটা পর্যায়ে মালামাল ল্যান্ড করাবার পরে ট্রাকে করে সেগুলি মিজোরামে নেয়া হবে। এভাবেই সিতওয়ের আশেপাশের এই নদী-বেষ্টিত অঞ্চলটা মিয়ানমারের জন্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই পুরো অঞ্চলটাই নদীর উপরে নির্ভরশীল এবং এই অঞ্চলের সাথে মিয়ানমারের বাকি অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যারপরনাই খারাপ। সিতওয়ে বন্দর নৌ-অবরোধে পড়লে মিয়ানমারের পক্ষে মংডু ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব। অথচ গোটা-দুই সাবমেরিনের মাধ্যমেই সিতওয়ে বন্দরের আশেপাশের এই এলাকাকে অবরোধে ফেলে দেয়া যায়। আর এরকম পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর পক্ষেও এই এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তার উপরে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলি মিয়ানমারের রাখাইন নীতির যেখানে ঘোর বিরোধী, সেখানে এই তিন দেশের নৌশক্তির কাছে মিয়ানমারকে অসহায়ই বলতে হবে। এই অসহায়ত্ব থেকে উদ্ধার পেতে মিয়ানমারকে আবারও তাদেরই (যুক্তরাষ্ট্র-ভারত) সরণাপন্ন হতে হবে, যারা রাখাইনের সমস্যা জিইয়ে রাখায় প্ররোচনা দিচ্ছে। 


মংডু-বুথিডুয়াং রাস্তাখানি নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সাথে জাপানি সেনাদের যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে এটা অন্ততঃ পরিষ্কার যে বিশাল উঁচু আরাকান পর্বত পাড়ি দিয়ে রাখাইন ধরে রাখাটা মিয়ানমারের পক্ষে চাট্টিখানি কথা নয়। কারণ মংডু মিয়ানমারের অভ্যন্তরের চাইতে বাংলাদেশের সীমানা থেকেই বরং বেশি কাছে অবস্থিত। মিয়ানমারকে দিয়ে রাখাইনে সমস্যা সৃষ্টি করার সময়ে মিয়ানমার সরকারকে কেউ পরামর্শ দেয়নি যে কতটা দুর্বল কৌশলগত অবস্থানে থেকে মিয়ানমার রাখাইনে এই নৃশংসতা চালিয়ে নিচ্ছে। তাদের বোঝা উচিত ছিল যে এই প্রক্সি একশনে তাদের লাভ তো কিছু হবেই না, বরং তাদের রক্তকে ব্যবহার করে মার্কিন-ভারতীয় গোয়েন্দারা নিজেদের কাজ হাসিল করে নেবে।

তার উপরে মিয়ানমার সরকার ভেবে দেখেছে কি, যে সিতওয়ে বন্দরে অবরোধের মুখে পড়ে এবং মংডুর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুরো রাখাইনই যদি তাদের হাতছাড়া হবার উপক্রম হয়, তাহলে মিয়ানমারের কাচিন এবং কারেন বিদ্রোহীরা কি করবে? চীনের ভূমিকাই বা তখন কি হবে? রাখাইনে সমস্যা জিইয়ে রাখলে রাখাইন হারাবার সাথে সাথে মিয়ানমার নামের দেশটারই যে অস্তিত্ব থাকবে না, তা কি মিয়ানমার সরকার ভেবে দেখেছে? আশেপাশের শক্তিরা তখন মিয়ানমারকে ছিঁড়ে খাবে। মিয়ানমার সরকার ভারত-মার্কিন ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে এবং নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে – এটা বোঝাবার মতো লোক সম্ভবত নে পি ডাউ-তে নেই।

Tuesday 15 August 2017

একুশ শতকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির গুরুত্ব

১৬ই অগাস্ট ২০১৭

বাংলাদেশের সীমানা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে দু’টা রাষ্ট্রের জোর সামরিক কর্মকান্ড চললেও এদেশের মানুষ মুভি দেখার মতো করে তাকিয়ে আছে! এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকাটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তারা অনুধাবনই করতে পারছে না! অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসেই ভূরাজনীতির কিছু চমৎকার উদাহরণ রয়েছে, যা উল্লেখ করার মতো। বঙ্গবন্ধুর নাম এসে যায় সেসব ভূরাজনীতির আলোকে।



বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতি ও ঘুমন্ত জনতা

কিছুদিন আগেই জুলাই মাসে বঙ্গোপসাগরে পরাশক্তি এবং তার দোসর ভারত আয়োজন করেছিল সামরিক মহড়া “মালাবার-২০১৭”। বাংলাদেশ বাণিজ্য-নির্ভর দেশ; দেশটার ৯০ শতাংশের উপরে বণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। এই সমুদ্রপথ গিয়েছে বঙ্গোপসাগরের মাঝ দিয়ে, যেকারণে বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে ওঁতপ্রোঁতভাবে জড়িত। আর বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথের উপরে পরাশক্তি এবং তার দোসরেরা যখন অস্ত্রের ঝনঝনানি নিয়ে মেতেছে, তখন এদেশের মানুষ নিশ্চিন্ত থাকবে – এটা কোন যুক্তির কথা হতে পারে না! ‘আমার উঠানে ডাকাতের সরদার মদের আসর বসালেও আমি নিশ্চিন্ত থাকবো’ –এটা কোন ধরনের মানসিকতা? বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে উদাসীনতা এদেশের জনগণের জন্যে বিপদ ডেকে নিয়ে আসছে।

চীন-ভারত সীমান্তে উত্তেজনার ব্যাপারটাও সেরকমই।[1] বাংলাদেশের সীমানা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে দু’টা রাষ্ট্রের জোর সামরিক কর্মকান্ড চলছে, আর এদেশের মানুষ মুভি দেখার মতো করে তাকিয়ে আছে! এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকাটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তারা অনুধাবনই করতে পারছে না! বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় বেশিরভাগ মানুষই ঐদাসীন্যের চরম উদাহরণ রেখে চলেছেন এবং আমজনতার মতোই নির্বোধ চিত্তে ঘটনা দেখছেন। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসেই ভূরাজনীতির কিছু চমৎকার উদাহরণ রয়েছে, যা উল্লেখ করার মতো। সেই আলোচনায় যাবার আগে কিছু ঘটনার পর্যালোচনা জরুরি।

বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালে এবং ১৯৫৭ সালে চীনে যান। চীনের সাথে বঙ্গবন্ধুর সুসম্পর্কে ভাটা ফেলার চেষ্টা চলেছে ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে। মার্কিনীরা চেয়েছিল বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ককে তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। আবার ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশ চীন থেকে দূরে থাকুক। যেকারণে শুধু ১৯৭৫ পরবর্তী সময়েই বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ককে এগুতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে এখানকার রাষ্ট্র এবং জনগণ চীনকে কখনোই প্রত্যাখ্যান করেনি; ওয়াশিংটনের ছলচাতুরি এবং ভারতের বারংবার হস্তক্ষেপের কারণেই চীনের সাথে বাংলাদেশের দূরত্ব রয়ে গিয়েছিল।


বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অগ্রগতি

২০১৬-এর জানুয়ারীতে বাংলাদেশে চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত চাই জি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের চীনা ভাষায় অনূদিত একটা কপি প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে বঙ্গবন্ধুর চীন সফর নিয়ে একটা বই প্রকাশ করা হবে, সেটারও চীনা ভাষায় অনূবাদের দরকার হবে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালে এবং ১৯৫৭ সালে চীনে যান। বঙ্গবন্ধুর চীন সফরকে পাকিস্তান সরকার তখন ভালো চোখে দেখেনি, কারণ তখন চীন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী। তিনি লেখেন, “আমার পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করলাম, পাওয়ার আশা আমাদের খুবই কম। কারণ, সরকার ও তার দলীয় সভ্যরা তো ক্ষেপে অস্থির। কমিউনিস্ট না হলে কমিউনিস্ট চীনে যেতে চায়? শান্তি সন্মেলন তো না, কমিউনিস্ট পার্টির সভা, এমনি নানা কথা শুরু করে দিল”। [2] ভূরাজনীতি যে পরিবর্তিত হয়, সেটা খুব সহজেই বোঝা যায় চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক থেকে। যেখানে ১৯৫০-এর দশকে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে চীনে যেতে দেবে কিনা, সেটাতে সন্দেহ ছিল, সেখানে ১৯৭১ সালেই চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক বেশ গাড় হয়ে যায়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের জের ধরেই পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্কোন্নয়ন হতে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সম্পর্ক ওঠা-নামার ব্যাতিক্রম হয়নি।

চীনের সাথে বঙ্গবন্ধুর এই সম্পর্কে ভাটা ফেলার চেষ্টা চলেছে ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে। মার্কিনীরা চেয়েছিল বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ককে তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। আবার ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশ চীন থেকে দূরে থাকুক। যেকারণে শুধু ১৯৭৫ পরবর্তী সময়েই বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ককে এগুতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে এখানকার রাষ্ট্র এবং জনগণ চীনকে কখনোই প্রত্যাখ্যান করেনি; ওয়াশিংটনের ছলচাতুরি এবং ভারতের বারংবার হস্তক্ষেপের কারণেই চীনের সাথে বাংলাদেশের দূরত্ব রয়ে গিয়েছিল। তবে এই ছলচাতুরি পেরিয়ে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। এবং ২০১৬ সালে এসে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী অনূবাদ এই বার্তাই বহণ করে। চীন বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহযোগী। এবং একইসাথে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একটা বড় অংশ চীনাদের যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত। অন্যভাবে বলতে গেলে, ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে চীনের সহায়তাতেই বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা উল্টে যায়। ১৯৭০-এর দশকে ভারত যেমন মনে করতো যে তারা যেকোন সময় ‘সিকিম-স্টাইলে’ বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারবে, সেটা চীনা সহায়তাতেই উল্টে যায়। ভারত অনেক আগেই বুঝে গেছে যে বাংলাদেশ এখন আর ভারতের গিলে ফেলার মতো অবস্থায় নেই (Too big to swallow); বাস্তবতা পাল্টে গেছে। তবে এখনও কেউ কেউ বাংলাদেশের অসহায়ত্বের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে পালে হাওয়া লাগাবার একটা বৃথা চেষ্টা করছেন।
 
আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাউয়ারি বোরেমেদ্দিন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধু (১৯৭৪)। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, সেটা ভারত তার স্বার্থবিরোধী হিসেবে দেখেছিল। কারণ বাংলাদেশের মানুষের ইসলামিক চেতনার উত্থানকে ভারত ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তার জন্যে বিপজ্জনক হিসেবে দেখেছে। একারণেই এদেশে ভারতের লবি গ্রুপগুলি বঙ্গবন্ধুর মুসলিম দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টাকে প্রতিহত করার যারপরনাই চেষ্টা করেছে।


ইসলামিক চেতনার ভূরাজনীতি

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের মাঝেই চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে যেতে না পারলেও আরও কিছু কাজ করে গিয়েছেন, যা কিনা ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী করেছিল। ১৯৭১ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ চরমে। তখন কিছু মুসলিম দেশের সরকার আমেরিকাপন্থী, আর কিছু দেশের সরকার সোভিয়েতপন্থী। তবে সেসব দেশের মুসলিম জনগণ সর্বদাই ছিল শাসকদের থেকে বিচ্ছিন্ন। ইসলামের বিশ্বাসের চেতনার কারণেই মুসলিমদের মাঝে বিভেদকে তারা পছন্দ করেনি; এবং বিভাজনের রাজনীতিকে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেখেছে। বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়েও ইসলামকে খুঁজে পেয়েছেন; লিখেছেন, “চীনে কনফুসিয়ান ধর্মের লোকেরা সংখ্যায় বেশি। তারপর বৌদ্ধ, মুসলমানের সংখ্যাও কম না, কিছু খ্রিস্টানও আছে। একটা মসজিদে গিয়েছিলাম, তারা বললেন, ধর্ম কর্মে বাধা দেয় না এবং সাহায্যও করে না”। [2] কিন্তু মাওলানা ভাসানীর সাথে যে মানুষটা জেলের ভেতরে জামাতে নামাজ পড়তো এবং নিয়মিত কুরআন পাঠ করতো [2], তাকে কেন ইসলাম-বিদ্বেষী তকমা নিতে হয়েছে?

১৯৭১-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, সেটা ভারত তার স্বার্থবিরোধী হিসেবে দেখেছিল। কারণ বাংলাদেশের মানুষের ইসলামিক চেতনার উত্থানকে ভারত ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তার জন্যে বিপজ্জনক হিসেবে দেখেছে। একারণেই এদেশে ভারতের লবি গ্রুপগুলি বঙ্গবন্ধুর মুসলিম দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টাকে প্রতিহত করার যারপরনাই চেষ্টা করেছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলি একইসাথে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পিছনে কাজ করেছে। লাহোরে ইসলামিক সামিট কনফারেন্সে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে ইন্দোনেশিয়া অনেক চেষ্টা করেছে। [3] ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ সফরে আসেন মিশরের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং সৌদি সরকারের একজন প্রতিনিধি। কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ জাবের আল-আহমেদ আল-সাবাহ-ও ঢাকা সফরে আসেন আলজেরিয়া, লেবানন, সেনেগাল, সোমালিয়া এবং প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নাড়লেও মুসলিম ভাইদের একে অপরের সাথে মিলিত হবার বাসনা কখনোই দমে যায়নি। যেকারণে প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ার নির্যাতিত মানুষের সাথে এদেশের মানুষ সর্বদাই সুর মিলিয়েছে।

ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে ভারতের ভয় ছিল যেকারণে

বঙ্গবন্ধুর আরও একটা দিক অনেকেই হিসেব করেনা, তা হলো, তার সন্মোহনী ক্ষমতা। আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের কংগ্রেস পার্টির দহরম মহরম ছিল বেশি। আর ভারতে চার দশকের বেশি সময় কংগ্রেস পার্টি ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগকে তথা বঙ্গবন্ধুকে ভারত-ঘেঁষা তকমাই নিতে হয়েছে। অথচ সকলেই ভুলে যায় যে মহত্মা গান্ধীর খুনের পেছনে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সরাসরি ইন্ধন ছিল।[4] অর্থাৎ কংগ্রেসের মাঝে বিভিন্ন গ্রুপ ছিল। এই গ্রুপগুলি সবসময়ই হিসেব কষেছে কংগ্রেসের সামনের দিনগুলিতে নেতৃত্ব কে দেবে। ইন্দিরা গান্ধীর পর কংগ্রেসে যে তেমন কোন বড় নেতৃত্ব আসবে না, সেটা মোটামুটি বুঝে গিয়েছিল অনেকেই। আর বাংলাদেশের সাথে ভারতের, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের সুসম্পর্কের কারণে ঐ গ্রুপগুলি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের, বিশেষ করে শেখ পরিবারের দিকে দৃষ্টি রেখেছিল সবসময়। তারা শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বকে আঞ্চলিক হুমকি হিসেবে দেখেছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু যখন পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছিলেন, তখন ভারতের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল! পাকিস্তানে বাঙ্গালী (অবশ্যই মুসলিম) প্রধানমন্ত্রী? তা-ও আবার শেখ মুজিবুর রহমান? পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাঙ্গালী হলে ভারতের বাঙ্গালীদের কি হবে? ভারতের মুসলিমদেরই বা কি হবে? সেই গ্রুপগুলি শেখ মুজিবের মাঝে ভারতের অস্তিত্ব বিপন্ন হবার ভয় দেখেছিল। তারা জানতো যে পশ্চিম পাকিস্তানে এমন কোন নেতা নেই যে কিনা ভারতের জনগণের বড় একটা অংশের সমর্থন আদায় করতে পারবে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বেলায় ব্যাপারটা কিন্তু তা ছিল না। ১৯৪৭ সালে কোলকাতা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু কতটা ব্যাথিত হয়েছিলেন [2], সেটা দেখলেই বোঝা যায় যে বঙ্গবন্ধুর মানুষের প্রতি ভালোবাসা র‍্যাডক্লিফ-মাউন্টব্যাটেনের কৃত্রিম সীমানা ছাপিয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় আল্লাহাবাদে বঙ্গবন্ধু মুসলিমদের রক্ষায় যে ভূমিকা [2] রেখেছিলেন, সেটা ঐ গ্রুপগুলি জানতো। তারা বঙ্গবন্ধুর মাঝে পুরো ভারতের মুসলিমদের নেতৃত্ব দেবার সক্ষমতা দেখতে পেয়েছিল। বাংলার সুলতানদের ইতিহাস তারা ভোলেনি; তাই বঙ্গবন্ধুকেও তারা শত্রু হিসেবেই দেখেছে।
 
জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধু (১৯৭৪)। বাংলাদেশে ভারতপন্থীরা আল্ট্রা-সেকুলাররা এবং পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলামী একইসাথে বঙ্গবন্ধুর লাহোর গমনের বিরোধিতা করেছে এবং বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়নে বাধা দিয়েছে। বলাই বাহুল্য যে এরা দু’পক্ষই ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে। ভারতকে টিকিয়ে রাখার পরাশক্তির এই চেষ্টাকে এখনও জিইয়ে রেখে চলেছে জামাত-ই-ইসলামী। উপমহাদেশে মুসলিম উত্থান ঠেকাবার পরাশক্তির শেষ সম্বল এরা।


বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান রাজনীতির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ভারতকে যেভাবে ব্যালান্স করেছিলেন, সেটা দিল্লীতে অনেকেই গিলতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত ভালো সম্পর্কই রেখেছিল। ১৯৭৫ অগাস্ট-পরবর্তী সরকারের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশে তার অবস্থানকে পাকাপোক্ত রাখতে চেয়েছিল। পরবর্তী সামরিক অভ্যুত্থানগুলিতে থেকেও ভারতকে আলাদা করা যাবে না। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে বঙ্গবন্ধুর লাহোর গমন করেন, যা পাকিস্তানে অনেকেই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছিলেন। সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিরোধিতা করেছিল পাকিস্তানের ‘জামাত-ই-ইসলামী’ এবং ‘তেহরিক-ই-ইস্তিকলাল’। বিরোধীদলীয় পত্রিকা ‘নাওয়াই-ই-ওয়াক্ত’ একই সুরে কথা বলেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে ভারতপন্থীরা আল্ট্রা-সেকুলাররা এবং পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলামী একইসাথে বঙ্গবন্ধুর লাহোর গমনের বিরোধিতা করেছে এবং বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়নে বাধা দিয়েছে। বলাই বাহুল্য যে এরা দু’পক্ষই ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে। ভারতকে টিকিয়ে রাখার পরাশক্তির এই চেষ্টাকে এখনও জিইয়ে রেখে চলেছে জামাত-ই-ইসলামী। উপমহাদেশে মুসলিম উত্থান ঠেকাবার পরাশক্তির শেষ সম্বল এরা।

বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন যে একটা নতুন রাষ্ট্রকে দাঁড় করাতে হলে প্রচন্ড পরিশ্রমের গত্যন্তর নেই, কিন্তু একইসাথে ভারতের পেটে ঢুকে গেলে সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হবে। এই লক্ষ্যেই তিনি ভারতকে সর্বদা ব্যালান্স করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি পছন্দ করতেন না এবং জানতেন যে সকলকিছুর মূলেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কলকাঠি; তারপরেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে ব্যালান্স করার জন্যে। তবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কোন্নয়নকে ভারত একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পিছনে ভারতের ইন্ধন দেবার মূল আগ্রহটা ছিল পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলার সুযোগের কারণে। সেখানে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি গুরুত্বপূর্ণ হলেও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলার সুযোগ না আসলে ভারত হয়তো অতটা ঝুঁকি নিতো না, যতটা তারা নিয়েছিল।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হবার ফলে ভারত যে স্বস্তি পেয়েছিল, সেটারই উল্টোটা তৈরি হয় যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন শুরু করেন। বস্তুতঃ ১৯৭৪ সালেই ভারত বুঝে যায় যে বঙ্গবন্ধু ভারতের জন্যে হুমকি হতে চলেছেন। এসময়েই ভারতের ঐ গ্রুপগুলি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে।


 
পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়াও পাকিস্তান তৈরি করছে (অনেক ক্ষেত্রেই চীনের সহায়তায়) নিজস্ব ফাইটার বিমান JF-17, ট্রেইনার বিমান Super Mushshak, ট্যাঙ্ক Al-Khalid, ব্যালিস্টিক মিসাইল, ক্রুজ মিসাইল, ইত্যাদি। পাকিস্তান তার এই সক্ষমতা তৈরিতে বাংলাদেশের অবদানকে অস্বীকার করতে পারে না কোনভাবেই। একুশ শতকে এসে বাংলাদেশের উচিত তার হিস্যা দাবি করা। এই হিস্যা হওয়া উচিত সেই দিকগুলিতে, যেখানে পাকিস্তান বাংলাদেশের চাইতে ভালো করেছে - যেমন সামরিক ইন্ডাস্ট্রিতে।


একুশ শতকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উদাহরণ

বাংলাদেশের ভূরাজনীতি এখন সেই স্থানেই এসেছে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকান্ডগুলি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। বঙ্গোপসাগরে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত যখন একযোগে কাজ করছে, তখন বাংলাদেশের একটা শক্ত ভূরাজনৈতিক অবস্থান জরুরি হয়ে পড়েছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ; একইসাথে মুসলিম বিশ্বের সাথেও বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর হওয়াটা জরুরি। এমতাবস্থায় পরাশক্তি এবং তার দোসর ভারতের ইন্ধনপ্রাপ্তদের সাথে সুর মিলিয়ে ভারতের স্বার্থ বাস্তবায়নের দিন শেষ। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের সাথে বঙ্গবন্ধুর দরকষাকষির মূলে ছিল পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায্য হিস্যা। বঙ্গবন্ধু জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশের জন্যে পাকিস্তানের ৫৬% সম্পদ চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের উন্নয়নে বাংলাদেশের বিরাট ভূমিকা রয়েছে, যা কিনা পরাশক্তির ইন্ধনপুষ্ট পাকিস্তানের নেতৃত্ব বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। এভাবে পাকিস্তানের উন্নয়নে বাংলাদেশের মানুষের যে হক রয়েছে, তা আদায় করা হয়নি কখনোই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তান এমন একটা জিনিস পেরেছে, যা বাংলাদেশ পারেনি ৪৬ বছরে – সামরিক সক্ষমতা। পাকিস্তানের সাথে থাকার সময়ে পূর্ব বাংলার মানুষের যে দাবিগুলি ছিল, তার মাঝে একটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন। পাকিস্তানের পশ্চিমাপুষ্ট নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার মানুষকে সর্বদাই ঠকিয়েছে; প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও তা-ই। বিভাজনের পরে বাংলাদেশ সামরিক দিক থেকে উন্নতি করতে না পারলেও পাকিস্তান প্রভূত উন্নতি করেছে সামরিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার দিক থেকে। পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়াও পাকিস্তান তৈরি করছে (অনেক ক্ষেত্রেই চীনের সহায়তায়) নিজস্ব ফাইটার বিমান JF-17, ট্রেইনার বিমান Super Mushshak, ট্যাঙ্ক Al-Khalid, ব্যালিস্টিক মিসাইল, ক্রুজ মিসাইল, ইত্যাদি। পাকিস্তান তার এই সক্ষমতা তৈরিতে বাংলাদেশের অবদানকে অস্বীকার করতে পারে না কোনভাবেই। একুশ শতকে এসে বাংলাদেশের উচিত তার হিস্যা দাবি করা। এই হিস্যা হওয়া উচিত সেই দিকগুলিতে, যেখানে পাকিস্তান বাংলাদেশের চাইতে ভালো করেছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি; তাই বলে বাংলাদেশের জনগণ কি সেটা ভুলে গেছে? মার্কিনপন্থী জামাত-ই-ইসলামীর এবং ভারতপন্থী আল্ট্রা-সেকুলারদের বঙ্গবন্ধুকে “ভারতের দালাল” হিসেবে প্রচার করার মাঝে বঙ্গবন্ধুর সেই প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবি কি ঢাকা পড়ে যায়? নাকি তাঁর ভারতের বাঙ্গালীদের বিপ্লবী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবার সম্ভাবনাকে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা করে? অথবা তাঁর পুরো পাকিস্তান ছাড়াও ভারতের কোটি কোটি নির্যাতিত মুসলিমদের অবিসংবাদিত নেতা হবার মতো মহাবিপদ থেকে ভারতকে রক্ষা করে? নাকি ভারতের সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয়?

পৃথিবীর একমাত্র পারমাণবিক বোমা হামলা হয়েছে জাপানের উপরে; যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা। লাখো মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটেছে এতে। ১৯৪৫-পরবর্তী সময়ে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিতে বাধ্য ছিল। তবে একুশ শতকে এসে যখন জাপানের সামরিক শক্তির পুণরুত্থান দেখা যাচ্ছে, তখন অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাপান তার এই সামরিক সক্ষমতা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক প্রযুক্তি নিয়েই। জাপান এখন সামরিক ইন্ডাস্ট্রির ‘পাওয়ারহাউজ’। বাংলাদেশকেও জাপানকে অনুসরণ করতে হবে সামরিক প্রযুক্তি এগিয়ে নিতে। পাকিস্তানের কাছ থেকে সামরিক প্রযুক্তি আমদানি একদিকে যেমন ভারতকে ব্যালান্স করার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, একইসাথে বাংলাদেশের মানুষের হক আদায়ের জন্যে জরুরি। জামাত-ই-ইসলামীর মত পরাশক্তির দালালেরা চাইবেই বিভাজনের রাজনীতি বহাল থাকুক। কিন্তু তাই বলে এই অঞ্চলের মুসলিমদের হক আদায় হবে না – এটা তো হতে পারে না।

------------------------

[1] ‘আঞ্চলিক যোগাযোগের ভূরাজনীতি – হিমালয়ে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব’, সাম্প্রতিক দেশকাল, ১০ অগাস্ট ২০১৭

[2] ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ – শেখ মুজিবুর রহমান

[3] ‘The Bangladesh Military Coup and the CIA Link’ – B. Z. Khasru

[4] ‘ভারত স্বাধীন হল’ – মৌলানা আবুল কালাম আজাদ