Friday 26 June 2020

ইথিওপিয়া-মিশর-সুদানের পানি-যুদ্ধ - বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রতি আরেকটা আঘাত

২৭শে জুন ২০২০
মিশর এতদিন কোন সামরিক হুমকি না দিলেও এখন কেউই এব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না। বিশেষ করে হঠাত করেই সুদান সুর পাল্টে ফেলার কারণে ঘটনা নাটকীয় মোড় নিয়েছে। বিবদমান পক্ষরা শক্তির জোরেই এই সমস্যার মিটমাট করবে কিনা, তার দায় জাতিসংঘের সাফল্য-ব্যর্থতার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে; যা কিনা করোনাভাইরাসে নুয়ে পড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রতি আরেকটা আঘাত হিসেবেই এসেছে।



২৬শে জুন ইথিওপিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গেদু আন্দারগাচিউ ‘ডিপিএ নিউজ এজেন্সি’র সাথে এক সাক্ষাতে ঘোষণা দেন যে, তার দেশ মিশর এবং সুদানের সাথে সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারলেও আগামী মাসে ‘গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁস ড্যাম’ বা ‘জিইআরডি’ নামে নীল নদের শাখা ব্লু নাইলের উপর নির্মিত বাঁধের কাজ শেষ করে ফেলবে। ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বাজেটে নির্মিত এই বাঁধের মাধ্যমে ইথিওপিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চাইছে। প্রায় এক দশক ধরে এই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে ইথিওপিয়ার সাথে মিশর এবং সুদানের কথা চালাচালি হচ্ছে। নীল নদের শেষাংশের প্রায় ১০ কোটি জনসংখ্যার দেশ মিশর বলছে যে, এই বাঁধ তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেলে মিশরে পানির স্বল্পতা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

২০১১ সালের এপ্রিল মাসে ইথিওপিয়া এই বাঁধের কাজ শুরু করে। এই বাঁধ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। ইথিওপিয়া মাত্র ৩ থেকে ৫ বছরের মাঝেই এই বাঁধের পিছনের হ্রদ ভরে ফেলে এখান থেকে উৎপাদিত ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আশেপাশের দেশগুলিতে রপ্তানি করতে চাইছে। ১৯২৯ এবং ১৯৫৯ সালের দুই চুক্তি অনুযায়ী মিশর নীল নদের ৮৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানির সাড়ে ৫৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার বা ৬৬ শতাংশ পানি পায়; আর সুদান পায় ২২ শতাংশ পানি। মিশর চাইছে যে, ইথিওপিয়া ১০ থেকে ২১ বছরের মাঝে শুধুমাত্র বর্ষার ঋতুতে এই বাঁধের পিছনে হ্রদ ভরুক। অন্যদিকে ইথিওপিয়া বলছে যে, মিশরের পানির চাহিদা পূরণ করতে গেলে ইথিওপিয়ার হ্রদ ভর্তি করা সম্ভব হবে না।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মিশরের পানির চাহিদার ৯৮ শতাংশ আসে নীল নদ থেকে; আর দেশটার ৯৫ শতাংশ মানুষ এই নদীর আশেপাশে বসবাস করে। ১৯৭১ সালে মিশর আসওয়ান বাঁধ তৈরি করার পর বিদ্যুৎ তৈরি করতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু নীল নদের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নষ্ট যায় এবং বদ্বীপের উর্বরতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন যে, ইথিওপিয়ার বাঁধ তৈরি এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থাকে আরও খারাপ করবে। ইথিওপিয়ার ব্লু নাইল নীল নদের ৮৫ শতাংশ পানির উৎস। ‘আল জাজিরা’ ইথিওপিয়ার বাঁধ নিয়ে পাঁচটা সম্ভাব্য বিশ্লেষণ করেছে। প্রথমতঃ ইথিওপিয়া যদি ২১ বছরে বাঁধের পিছনের হ্রদ পানি দিয়ে ভর্তি করে, তাহলে মিশর তার বাৎসরিক পানির চাহিদার ৫ শতাংশ হারাবে; আর আড়াই শতাংশ কৃষিজমি হারাবে। দ্বিতীয়তঃ যদি ১০ বছরে হ্রদ ভরা হয়, তাহলে মিশর ১৪ শতাংশ পানি আর ২০ লক্ষ একর বা ১৮ শতাংশ কৃষিজমি হারাবে। তৃতীয়তঃ হ্রদ ৭ বছরে ভর্তি করা হলে মিশর ২২ শতাংশ পানি হারাবে; কৃষিজমি হারাবে ৩০ লক্ষ একর বা ৩০ শতাংশ। চতুর্থতঃ হ্রদ পাঁচ বছরে ভর্তি করা হলে মিশর ৩৬ শতাংশ পানি এবং ৫০ শতাংশ কৃষিজমি হারাবে। আর শেষ হিসেবে, ইথিওপিয়া যদি মাত্র ৩ বছরের মাঝেই হ্রদ ভরে ফেলে, তাহলে মিশর ৫০ শতাংশ পানি এবং ৬৭ শতাংশ বা সাড়ে ৬৭ লক্ষ একর কৃষিজমি হারাবে।

এই দ্বন্দ্বে আরেক পক্ষ সুদান এতদিন বলে এসেছে যে, ইথিওপিয়ার বাঁধ সুদানের বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা দেয়া ছাড়াও দেশটার পূর্বের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিকে পলি থেকে বাঁচাবে। সুদান এই আলোচনায় এতদিন বাঁধের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু সবকিছু পাল্টে যায় সুদানে সাম্প্রতিক সরকার পরিবর্তনের পর থেকে। গত ১৩ই মে সুদান ইথিওপিয়ার সাথে ‘আংশিক চুক্তি’ স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়। সুদানের প্রধানমন্ত্রী আব্দ আল্লাহ হামদক বলেন যে, চুক্তিতে টেকনিক্যাল এবং আইনগত আর্টিকেল রাখা হয়নি; আর তথ্য আদানপ্রদান এবং সমন্বয়েও ঘাটতি রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, তিন দেশ একত্রে বসে সমঝোতায় আসার আগে জুলাই মাসে ইথিওপিয়ার হ্রদ ভর্তি করা উচিৎ হবে না। গত ২৪শে জুন সুদানের সেচ মন্ত্রী ইয়াসের আব্বাস এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, সমঝোতা ছাড়া ইথিওপিয়া বাঁধের কাজ শেষ করে ফেললে সুদানের বাঁধগুলি হুমকির মাঝে পড়ে যাবে। সুদান নিজেদের বাঁধের কোন সমস্যা হবেনা, এই শর্তে ইথিওপিয়ার সাথে সমঝোতায় রাজি ছিল।

আলোচনা থেকে সুদান উঠে আসার পরপরই ইথিওপিয়ার সাথে সুদানের সম্পর্ক উল্টোদিকে মোড় নেয়, যখন ২৯শে মে সুদান বলে যে, দেশটার পূর্বে ইথিওপিয়ার সীমানায় গাদারিফে ইথিওপিয়দের সশস্ত্র হামলায় তিনজন সুদানি সেনা এবং বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছে। রাজধানী খার্তুমে ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। এরপর ২২শে জুন সুদান ঘোষণা দেয় যে, গাদারিফের আনফাল সেনা ক্যাম্পে ইথিওপিয় সামরিক হামলা প্রতিহত করেছে সুদানিরা। এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিররের সময় সুদান তার সীমানায় ইথিওপিয় কৃষকদের চাষ করতে দিতো; কিন্তু বশির ক্ষমতাচ্যুত হবার পর নীতির পরিবর্তন হয়েছে এবং ২৫ বছরে প্রথমবারের মতো সুদান ইথিওপিয়ার সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছে। এই সীমান্ত সংঘর্ষকে ভূরাজনীতির অংশ হিসেবেই দেখতে হবে বলে বলছে তারা। এক দশক ধরে চলা এই উত্তেজনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে কিনা, তা নির্ভর করছে মিশরের উপর। আরব দেশগুলি ২৩শে জুন মিশরকে সমর্থন জানিয়ে ইথিওপিয়াকে বাঁধের কাজে দেরি করতে অনুরোধ করে। তারা বলছে যে, মিশর আর সুদানের সুপেয় পানির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার অর্থ হলো আরবের জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হওয়া। অপরদিকে মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ সুক্রি বলেন যে, বাঁধের ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ যদি সফল না হয়, তাহলে মিশর তার যা বলার সরাসরি এবং পরিষ্কারভাবে বলবে। মিশর এতদিন কোন সামরিক হুমকি না দিলেও এখন কেউই এব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না। বিশেষ করে হঠাত করেই সুদান সুর পাল্টে ফেলার কারণে ঘটনা নাটকীয় মোড় নিয়েছে। বিবদমান পক্ষরা শক্তির জোরেই এই সমস্যার মিটমাট করবে কিনা, তার দায় জাতিসংঘের সাফল্য-ব্যর্থতার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে; যা কিনা করোনাভাইরাসে নুয়ে পড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রতি আরেকটা আঘাত হিসেবেই এসেছে।

Wednesday 24 June 2020

তিউনিসিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফ্রান্স ও তুরস্কের মাঝে চলছে প্রতিযোগিতা

২৪শে জুন ২০২০

ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ। দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলোচনা এমন সময়ে এলো, যখন তিউনিসিয়ার প্রতিবেশী দেশ লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের হস্তক্ষেপের পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। লিবিয়াতে কোণঠাসা হয়ে যাবার পর ফ্রান্স লিবিয়ার প্রতিবেশী তিউনিসিয়াতে তার দুর্বল হয়ে যাওয়া অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে চাইছে।


ফ্রান্স লিবিয়ার যুদ্ধে তিউনিসিয়ার সমর্থন চাইছে

গত ২২শে জুন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তিউনিসিয়ার জন্যে সাড়ে ৩’শ মিলিয়ন ইউরো সহায়তার ঘোষণা দেন। ইলাইসি প্যালেসে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদের সাথে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ম্যাক্রঁ বলেন যে, তিউনিসিয়ার স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া, সেদেশে হাসপাতাল তৈরি এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরায় শুরু করার লক্ষ্যে সহায়তা দেবে ফ্রান্স। তিনি আরও বলেন যে, এই অর্থ ২০২২ সাল পর্যন্ত তিউনিসার স্বাস্থ্যখাত এবং যুব উন্নয়নের জন্যে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দের অংশ। দুই দেশ আঞ্চলিক ইস্যু নিয়েও কথা বলেছে। ম্যাক্রঁ বলেন যে, ফ্রান্স এবং তিউনিসিয়া একত্রে দাবি করছে যে, লিবিয়াতে যুদ্ধরত পক্ষগুলি যেন আলোচনার টেবিলে বসে সকলের জন্যে নিরাপত্তা এবং লিবিয়ার সংস্থাগুলির পুনএকত্রীকরণ নিশ্চিত করে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট লিবিয়াতে বিদেশী হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানান। একইসাথে ম্যাক্রঁ লিবিয়াতে তুরস্কের ভূমিকাকে ‘বিপজ্জনক খেলা’ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন যে, এটা ঐ অঞ্চল এবং ইউরোপের জন্যে সরাসরি হুমকিস্বরূপ। তিনি বলেন যে, একই কথাগুলি ঐদিনই তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফোন করে বলেছেন। অপরদিকে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ বলেন যে, তার দেশ ফ্রান্সের সাথে অতীতের ক্ষতচিহ্ন ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাইছে। তিনি তিউনিসিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত একটা রেলওয়ে লাইন তৈরির চিন্তায় ফ্রান্সের সহায়তা দেয়াকে স্বাগত জানান। দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলোচনা এমন সময়ে এলো, যখন তিউনিসিয়ার প্রতিবেশী দেশ লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের হস্তক্ষেপের পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে তিউনিসিয়ার সাথে ফ্রান্সের সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টার ব্যাপক ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

লন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘আল এরাব উইকলি’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, লিবিয়াতে কোণঠাসা হয়ে যাবার পর ফ্রান্স লিবিয়ার প্রতিবেশী তিউনিসিয়াতে তার দুর্বল হয়ে যাওয়া অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে চাইছে। কিছুদিন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, লিবিয়াতে আরেকটা সিরিয়া তৈরি হতে চলেছে; যা খুবই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। ২৬শে মে তিউনিসিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইমেদ হাজগুই ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লির সাথে ফোনে লিবিয়া নিয়ে কথা বলেন। তারা লিবিয়ায় বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন এবং লিবিয়ার সমস্যা লিবিয়ার মানুষদের মাঝেই সমাধান হওয়া উচিৎ বলে বলেন। দুই দেশের মাঝে সামরিক সহযোগিতা আরও বাড়ানো যায় কিভাবে, তা নিয়েও তারা আলোচনা করেন।

২০১৮ সালের নভেম্বরে তিউনিসিয়ার নৌবাহিনীর ৪র্থ অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ‘সফোনিসবে’ ডেলিভারি দেয়া হয়। এই জাহাজগুলি তিউনিসিয়াকে ভূমধ্যসাগরে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তিউনিসিয়ার সামরিক বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে দিলেও ২০১৬ সাল থেকে তিউনিসিয়া নিজস্ব নৌবাহিনী গঠন করা শুরু করে। তিউনিসিয়ার জনগণের সাথে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক বেশ মধুর। সামরিক বাহিনীর শক্তিশালী হওয়ার পিছনে জনগণের সমর্থন রয়েছে; কিন্তু রাজনীতিবিদদের মাঝে এব্যাপারে রয়েছে বিরোধ।


তিউনিসিয়ার সামরিক বাহিনী গড়ে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক

ঐতিহাসিকভাবে তিউনিসিয়ার সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক বেশি গভীর থাকলেও সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ তিউনিসিয়া নিয়ে বেশ কয়েকটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা বলছে যে, একনায়ক বেন আলি তিউনিসিয়ার সামরিক বাহিনীকে ছোট করে রেখেছিলেন, যাতে সামরিক বাহিনী দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। তিউনিসিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলতঃ ন্যাশনাল গার্ডের হাতে, যা কিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালের অধীন, এবং যার মূল কাজ ছিল দেশের উপর শাসকের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। ব্যাপারটা পরিবর্তন হয়ে যায় ২০১১ সালে বেন আলির পতনের পর। যুক্তরাষ্ট্র তিউনিসিয়া নিয়ে চিন্তিত ছিল যে, ছোট হলেও তিউনিসিয়া থেকেই সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ইরাক ও সিরিয়াতে বিভিন্ন জিহাদি গ্রুপে যোগ দিয়েছে। এছাড়াও তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদ এবং অস্থিরতা মানুষকে গণতন্ত্রবিমুখ করে ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, তিউনিসিয়ার বর্তমান সরকারে ৬টা রাজনৈতিক দল থেকে ১৫ জন এমপি এবং আরও ১৭ জন স্বতন্ত্র এমপি মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন। কোন দলই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা রাখেনি; তাই কোন দলই বেশি সংখ্যক আসন পাচ্ছে না। ২০১৪ সালে ‘পিউ রিসার্চ’এর এক জরিপ বলছে যে, মাত্র ৪৮ শতাংশ তিউনিসিয়ান গণতন্ত্রকে সমর্থন করছে। ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করছে যে গণতান্ত্রিক সময়ের চাইতে একনায়কের সময়েই দেশের অবস্থা ভালো ছিল। মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী ‘এননাহদা পার্টি’র সমর্থন দুই বছরের মাঝে ৬৫ শতাংশ থেকে ৩১ শতাংশে নেমে আসে। ৮৩ শতাংশ তিউনিসিয়ান মনে করে যে, দেশের রাজনীতিতে ইসলামের আদর্শগুলি বাস্তবায়িত থাকা উচিৎ; যাদের মাঝে ৩০ শতাংশ মনে করে যে, ইসলামকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা উচিৎ। কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। ৯৫ শতাংশ মানুষ সামরিক বাহিনীর প্রশংসা করে; যেখানে মিডিয়ার পক্ষে বলে ৬২ শতাংশ মানুষ; আদালতের পক্ষে ৪৪ শতাংশ; আর ধর্মীয় নেতাদের পক্ষে মাত্র ৩৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যাপারগুলিকে পুঁজি করেই তিউনিসিয়ার সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়া শুরু করে এবং তাদের সাথে মহড়া এবং অপারেশনে অংশ নিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকে।

লিবিয়া থেকে আসা জিহাদী গ্রুপগুলির সাথে তিউনিসিয়ার সেনাদের ব্যাপক সংঘর্ষে নিয়মিত প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে থাকে। মার্কিন সেনারাও সেখানে সরাসরি জড়িত থাকলেও তা পত্রিকার খবরে আসতে দেয়া হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন হোয়াইট হাউজে আসার পর থেকে তিউনিসিয়ার জন্যে সামরিক সহায়তা কমে গেলেও তিউনিসিয়া নিজের নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করতে থাকে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মার্কিনীরা তিউনিসিয়াকে সরবরাহ করেছে। এর মাঝে রয়েছে ৮০টারও বেশি হেলিকপ্টার; যার মাঝে ২৪টা ‘ওএইচ-৫৮ডি কিওওয়া ওয়ারিয়র’, ৮টা ‘ইউএইচ-৬০এম ব্ল্যাক হক’, ৩৬টা ‘ইউএইচ-১’ রয়েছে। এছাড়াও ৯টা ‘সি-১৩০’ পরিবহণ বিমান দেয়া হয় তিউনিসিয়াকে; যার মাঝে ২০১৪ সালে দেয়া হয় সর্বশেষ মডেলের ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’। এবছরের এপ্রিল মাসে একটা ‘সি-১৩০জে’ বিমান করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ২২ হাজার কিঃমিঃ উড়ে চীন থেকে মেডিক্যাল সাপ্লাই নিয়ে আসে। এই ফ্লাইটের মাঝে বিমানটা দু’বার কাজাখস্তানে রিফুয়েলিং করে। নিরাপত্তা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রকস’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তিউনিসিয়ার রাস্তায় সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়; যা কিনা দেশের মানুষ ভালোভাবে দেখেছে। অন্যদিকে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ বলছে যে, তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক দলগুলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্যে প্রতিযোগিতা করছে। একদিকে ‘নিদা তিউনেস’ এবং ‘এননাহদা পার্টি’ সামরিক বাহিনীর উপর তাদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে; অন্যদিকে বিরোধীরা চাইছে এতে বাধা দিতে।

মার্কিনীরা তিউনিসিয়ার উপকূল সন্ত্রাসীমুক্ত রাখতে তিউনিসিয়ার নৌবাহিনীকে কমপক্ষে ২২টা ছোট বোট দেয়। তবে ২০১৬ সাল থেকে তিউনিসিয়া নিজস্ব নৌবাহিনী গঠন করা শুরু করে। প্রথমবারের মতো নেদারল্যান্ডসের ‘ডামেন’ শিপইয়ার্ড থেকে অত্যাধুনিক চারটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল অর্ডার করে তারা। ৭২ মিটার লম্বা এবং প্রায় ১৩’শ টনের হেলিকপ্টার ও ড্রোন বহনে সক্ষম এই জাহাজগুলি তিউনিসিয়াকে ভূমধ্যসাগরে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ২০১৮ সালের মাঝেই ‘ডামেন’ চারটা জাহাজই ডেলিভারি দিয়ে দেয়। এর আগ পর্যন্ত তিউনিসিয়ার ফরাসী ও জার্মান নির্মিত পুরোনো ফাস্ট এটাক ক্রাফটগুলি শুধুমাত্র তিউনিসিয়ার উপকূলের কাছাকাছি অঞ্চল পাহাড়া দিতে সক্ষম ছিল। শুধু তাই নয়, তিউনিসিয়া নিজেরাই ৩টা ছোট আকৃতির ২৬ মিটার লম্বা প্যাট্রোল বোট তৈরি করে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা জানান দেয়।

সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক তিউনিসিয়ার সাথে সামরিক সম্পর্ক গভীর করেছে। ২০১৪ সালে তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনী তুরস্ক থেকে ১’শটা ‘কিরপি’ আর্মার্ড ভেহিকল অর্ডার করে। ২০১৬ সাল থেকে এর ডেলিভারি শুরু হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের তিউনিসিয়া সফরের সময়ে দুই দেশের মাঝে কয়েকটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাঝে আগের ৩’শ মিলিয়ন ডলার সহায়তার সাথে আরও ৩’শ মিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়। তুরস্ক তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের মাঝে তুরস্ক তিউনিসিয়াকে ২’শ মিলিয়ন ডলারের নিরাপত্তা সহায়তা দেয়।

গত মার্চেই ‘ডিফেন্স নিউজ’ জানায় যে, তুরস্কের প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘টিএআই’ তিউনিসিয়ার কাছে ২’শ ৪০ মিলিয়ন ডলারে ৬টা ‘আনকা-এস’ সার্ভেইল্যান্স ড্রোন এবং তিনটা কন্ট্রোল স্টেশন বিক্রির ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করেছে। তুর্কি কর্মকর্তারা বলছেন যে, তারা এই ক্রয়াদেশের জন্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছিলেন। আর তারা তিউনিসিয়ার কাছে অস্ত্র বহণকারী ড্রোন বিক্রি করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘আনকা-এস’ ড্রোনের বৈশিষ্ট্য হলো এটা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়; যার ফলশ্রুতিতে এই ড্রোন নিয়ন্ত্রক স্টেশন থেকে বেশ দূরে গিয়েও কাজ করতে সক্ষম। অর্থাৎ এই ড্রোনগুলি তিউনিসিয়ার উপকূলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলির উপর নজরদারি করতে সক্ষম হবে।

তিউনিসিয়ার মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী ‘এননাহদা পার্ট’র প্রধান রাচেদ ঘানুচির সাথে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান। আঙ্কারার সাথে ‘এননাহদা পার্টি’র সম্পর্ক যে বাস্তবতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তা জুন মাসে পার্লামেন্টে ফ্রান্সের কাছ থেকে ঔপনিবেশিক সময়ের অপরাধের ক্ষমা চাওয়ার বিলে ‘এননাহদা’র সমর্থন না দেয়াই প্রমাণ করে।



লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের আবির্ভাব তিউনিসিয়ার রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে

লিবিয়াতে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের ঠিক আগেআগে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান হঠাত করেই তিউনিসিয়ার রাজধানীতে আবির্ভূত হন। এরদোগানের সাথে বৈঠকের পর তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ সাংবাদিকদের বলেন যে, লিবিয়ার সাথে তুরস্কের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তা ঐ দুই দেশের ব্যাপার এবং তাতে তিউসিয়ার কিছু বলার নেই। অপরদিকে এরদোগান বলেন যে, লিবিয়ার ব্যাপারে আলোচনায় আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া এবং কাতারকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ ছিল, কারণ এই দেশগুলি লিবিয়া সমাজ এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে ভালোভাবে বোঝে। এরদোগানের এই সফরের পর তুরস্ক শুধু কথায় নয়, কার্যত তিউনিসিয়াকে লিবিয়ার ব্যাপারে জড়িত হতে বাধ্য করেছে। ‘রয়টার্স’ খবর দিচ্ছে যে, গত ৮ই মে তুরস্কের একটা পরিবহণ বিমান ত্রিপোলির বিমানন্দর অনিরাপদ বলে তিউনিসিয়ার দক্ষিণে লিবিয়ার সীমানার কাছাকাছি জিয়েরবা বিমানবন্দরে অবতরণ করার অনুমতি চায়। তিউনিসিয়া বিমানটাকে নামতে দেয়। এই বিমানে লিবিয়ার জন্যে মেডিক্যাল সামগ্রী ছিল বলে বলা হয়; এবং এই সামগ্রীগুলি লিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্যে তিউনিসিয়াকে অনুরোধ করা হয়। তিউনিসিয়ার বিরোধী দল ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’র নেতারা অভিযোগ করেন যে, তুরস্ক তিউনিসিয়াকে লিবিয়ার যুদ্ধের লজিস্টিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।

ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত আরেক পত্রিকা ‘আল মনিটর’ বলছে যে, লিবিয়ার যুদ্ধ তিউনিসিয়ার রাজনীতিকে ঘোলাটে করে ফেলেছে। কারণ তিউনিসিয়াতে সকলেই লিবিয়ার যুদ্ধে কোন না কোন পক্ষ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টে বর্তমানে সবচাইতে বেশি আসন দখন করে আছে ‘এননাহদা পার্ট’, যারা মুসলিম ব্রাদারহুডের চিন্তার সাথে একমত পোষণ করে। ‘এননাহদা’ লিবিয়ার যুদ্ধে ত্রিপোলির ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড’ বা ‘জিএনএ’ সরকারকে সমর্থন করছে। একইসাথে তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘একে পার্ট’র সাথেও তাদের বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে তিউনিসিয়ায় ২৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এবং ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত প্রাক্তন একনায়ক জিনে এল আবিদিন বেন আলির সমর্থকদের থেকে গঠন করা ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’ বা ‘পিডিএল’ লিবিয়ার জেনারেল হাফতারের পক্ষ সমর্থন করছে। তিউনিসের ‘কলাম্বিয়া গ্লোবাল সেন্টার্স’এর প্রধান ইউসেফ শেরিফ বলছেন যে, সকলেই আসলে তিউনিসিয়াকে লিবিয়াতে যাবার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখে। লিবিয়া থেকে সন্ত্রাসীরা যাতে তিউনিসিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে, এই অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র তিউনিসিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে। তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক সেইফ এদ্দিন ত্রাবেলসির মতে, লিবিয়াতে ‘জিএনএ’এর সাম্প্রতিক সফলতা তিউনিসিয়ার নিরাপত্তাকে আরও সুসংহত করবে। তিনি বলেন যে, তিউনিসিয়া আর লিবিয়া একই সূত্রে গাঁথা। লিবিয়াতে যা কিছুই ঘটবে, সেটাই তিউনিসিয়াকে প্রভাবিত করবে। লিবিয়ার ঘটনার ব্যাপারে তিউনিসিয়ার জনগণ চিন্তিত থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। হাফতারের বিরুদ্ধে লিবিয়াতে ‘জিএনএ’র বড় বিজয়ের পরপরই ‘এননাহদা পার্টি’র প্রধান এবং পার্লামেন্টের স্পিকার রাচেদ ঘানুচি ত্রিপোলি সরকারের প্রধান ফায়েজ আল-সারাজকে ফোন করে অভিনন্দন জানান। কিন্তু এই ব্যাপারটা তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ একেবারেই পছন্দ করেননি। তিউনিসিয়ার সংবিধান অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি প্রেসিডেন্টের হাতে। সাইয়েদ ঈদ উল-ফিতরের এক বার্তায় জোর গলায় বলেন যে, সকলেরই জানা উচিৎ যে তিউনিসিয়া একটাই এবং এর একজনই প্রেসিডেন্ট।

তিউনিসিয়ার প্রধানমন্ত্রী এলিয়েস ফাখফাখ। দেশের এলিট ক্লাসের বেশিরভাগ ব্যক্তিরই কোন না কোনভাবে ফ্রান্সের সাথে যোগসূত্র রয়েছে। ফাখফাখ ফ্রান্সের লিয়ঁ এবং প্যারিস থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ব্যবসায় বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদ এবং অস্থিরতা মানুষকে গণতন্ত্রবিমুখ করে ফেলেছে। মাত্র ৪৮ শতাংশ তিউনিসিয়ান গণতন্ত্রকে সমর্থন করছে; অপরদিকে ৮৩ শতাংশ মনে করে দেশের রাজনীতিতে ইসলামের আদর্শগুলি বাস্তবায়িত থাকা উচিৎ। রাজনীতিবিদেরা জনগণের আস্থায় না থাকলেও সামরিক বাহিনীর উপর আস্থা ৯৫ শতাংশ মানুষের; যা তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বিরাট পরিবর্তন এনেছে।



তিউনিসিয়ায় ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের প্রভাব

তিউনিসিয়ার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি হওয়ায় সেখানকার রাজনীতিতে ফ্রান্সের প্রভাব ব্যাপক। দেশের এলিট ক্লাসের বেশিরভাগ ব্যক্তিরই কোন না কোনভাবে ফ্রান্সের সাথে যোগসূত্র রয়েছে। ‘পিডিএল’এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বেন আলি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হামেদ কারুয়ি ফ্রান্সে মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এলিয়েস ফাখফাখ ফ্রান্সের লিয়ঁ এবং প্যারিস থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ব্যবসায় বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইমেদ হাজগুই ফ্রান্সে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের মাঝের দল ‘তাহিয়া তিউনেস’এর নেতা এবং গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউসেফ চাহেদ ফ্রান্সে কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। বিলিয়নায়ার ব্যবসায়ী, মিডিয়া টাইকুন এবং ২০১৯ সালের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে প্রার্থী নাবিল কারুয়ি ফ্রান্সের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকুরি করে ক্যারিয়ার শুরু করেন।

‘পিডিএল’এর নেতা আবির মুসি ৩রা জুন লিবিয়াতে বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে বিল উত্থাপন করেন। বিলটা শেষ পর্যন্ত পাস না হলেও তর্ক বিতর্কের সময় আবির মুসি ‘এননাহদা’র নেতা রাচেদ ঘানুচিকে তুরস্ক এবং কাতারের অনুগত বলে অভিযোগ করেন। এরপর এই বিলের পাল্টা জবাব হিসেবে পার্লামেন্টে ১৯ আসনের অধিকারী দল ‘কোয়ালিশন আল কারামা’ আরেকটা বিল উত্থাপন করে, যা পাস হলে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের কাছ থেকে ঔপনিবেশিক সময়ের অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইবার দাবি জানানো হবে। ১৪ ঘন্টা তুমুল বাকযুদ্ধের পর সাংসদরা এই বিল রুখে দেয়। ৭৭ জন সাংসদ এই বিলের পক্ষে ভোট দেয়; মাত্র ৫ জন ভোট দেয় বিপক্ষে। কিন্তু ৪৬ জন ভোটদানে বিরত থাকার কারণে বিল পাসের জন্যে দরকার ১’শ ৯ ভোট পাওয়া যায়নি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল যে, মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী ‘এননাহদা’ এই বিল পাসের বিপক্ষে কথা বলে। তারা বলে যে, এই বিল পাস হলে তা তিউনিসিয়ার অর্থনীতিকে আঘাত করবে এবং দেশটার গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপিয় বন্ধুদের দূরে ঠেলে দেবে। ১৮৮১ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স তিউনিসিয়ার ঔপনিবেশিক শাসক ছিল। এই বিল পাস না হওয়ায় এখনও তিউনিসিয়ার উপর ফ্রান্সের প্রভাব টের পাওয়া যায়।

তিউনিসিয়াতে ফ্রান্সের কি স্বার্থ রয়েছে?

তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুস্তফা আব্দেলকাবির ‘দ্যা এরাব উইকলি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, তিউনিসিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ফ্রান্সের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে দেশটার কৌশলগত অবস্থান লিবিয়াতে যুদ্ধরত সকল পক্ষের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন যে, লিবিয়াতে তুরস্কের স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে কিছু রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়াতে তুরস্কের অবস্থানকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেয়ায় তা পশ্চিম লিবিয়া নিয়ে ফ্রান্সের পরিকল্পনাকে হুমকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। লিবিয়ার সাথে তুরস্কের সমুদ্রসীমার চুক্তি ফ্রান্সের জন্যে সরাসরি হুমকি তৈরি না করার পরেও ফরাসীরা গ্রীস এবং গ্রীক সাইপ্রাসের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করে তুরস্কের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অপারেশন ইরিনি’ নামে এক মিশন শুরুর ঘোষণা দেয়। আমিরাতের ‘দ্যা ন্যাশনাল’ পত্রিকা বলছে যে, ইইউ সদস্য দেশগুলির মাঝে অনৈক্যের কারণে এই মিশন শুরু করাটা খুবই কঠিন হয়েছে। ‘ইরিনি’র অধীনে নৌ মিশনের নেতৃত্বে থাকা ইতালি এখনও ঠিক করতে পারেনি যে, তারা এই মিশনে কিভাবে অংশ নেবে। মে মাসে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইজি ডি মাইও পার্লামেন্টে বলেন যে, ‘ইরিনি’র জন্যে পরিকল্পিত একটা নৌজাহাজ, ৩টা বিমান এবং ৫’শ সামরিক সদস্য মোতায়েনের ব্যাপারটা ইতালি সরকার খতিয়ে দেখছে। আর এই প্রস্তাব পার্লামেন্টের হাউজগুলিতেও অনুমোদন পেতে হবে। বর্তমানে শুধুমাত্র ফ্রান্স এবং গ্রীসই অপারেশন ‘ইরিনি’র অধীনে লিবিয়ার উপকূলে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। উভয় দেশই লিবিয়াতে তুরস্কের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে এবং লিবিয়ার সাথে তুরস্কের সমুদ্রসীমা বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করেছে।

গত ১৯শে জুন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু ইতালি ভ্রমণকালে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘অপারেশন ইরিনি’র ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, এই মিশনের মাধ্যমে সিরিয়া থেকে লিবিয়ায় যুদ্ধবিমান উড়িয়ে আনাকে বাধা দেয়া হয়নি। আবুধাবি থেকে আকাশপথে অস্ত্র আসার ব্যাপারটাও এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন যে, ‘ইরিনি’ লিবিয়ার সমস্যার কোন সমাধান দেয় না এবং লিবিয়ার উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও নিশ্চিত করেনা। ‘দ্যা এরাব উইকলি’ বলছে যে, ফরাসী এবং গ্রীকদের অবস্থানের কারণেই ন্যাটোকে এই মিশনের অংশ করার মার্কিন এবং তুর্কি চেষ্টা সফল হচ্ছে না। লিবিয়ার জেনারেল হাফতারের অধীন ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’কে ফ্রান্স সমর্থন দিয়ে চলেছে বলেই ইইউএর মাঝ থেকে হাফতারের বাহিনীর বিরোধিতা করার চেষ্টাকে ফ্রান্স বারংবার বাধাগ্রস্ত করেছে। আব্দেলকাবির বলছেন যে, ২০১১ সালে লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির সরকারকে অপসারণের পিছনে ফ্রান্সের সমর্থনই ছিল সবচাইতে জোরালো। তারা মনে করেছিল যে, গাদ্দাফিকে সরানোর পর লিবিয়াতে ফ্রান্সের একটা শক্ত ভিত প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু লিবিয়ার যুদ্ধে অনেকগুলি রাষ্ট্র যুক্ত হওয়ায় ফ্রান্স তার কাংক্ষিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর আফ্রিকা কমান্ডের অপারেশনস ডিরেক্টর ব্র্যাডফোর্ড গেরিং বলছে যে, লিবিয়াতে রুশ সামরিক অবস্থান শক্তিশালী হবার সাথেসাথে তা ইউরোপের দক্ষিণ সীমানার জন্যে হুমকি সৃষ্টি করছে। তথাপি তুরস্কের জন্যে মার্কিন সমর্থন পরিষ্কার হতে থাকায় ফ্রান্স হয়তো লিবিয়াতে রুশ সামরিক অবস্থানের বিপক্ষে কথা নাও বলতে পারে।

তিউনিসিয়ার কৌশলগত অবস্থান ফ্রান্সের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিউনিসিয়ার উত্তর উপকূল থেকে ইতালির দক্ষিণের সিসিলি দ্বীপের উপকূলের দূরত্ব মাত্র ১’শ ৬০ কিঃমিঃ। সিসিলি প্রণালী নামে পরিচিত এই সরু নৌপথের মাঝ দিয়েই ফ্রান্সের সাথে সুয়েজ খাল, তথা ভারত মহাসাগর এবং পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ। একারণেই ফ্রান্স তিউনিসিয়াকে কাছে রাখতে চাইছে। লিবিয়ার যুদ্ধে তুর্কি সমর্থনে ‘জিএনএ’এর সাম্প্রতিক বিজয়ের পর কৌশলগত এই নৌপথের নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের কাছে হারাবার ভয় পেয়ে বসেছে ফ্রান্সকে।



তিউনিসিয়ার ভূকৌশলগত অবস্থান ফ্রান্স ও তুরস্ককে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে


উসমানি খিলাফতের সময় ষোড়শ শতক থেকেই তিউনিসিয়ার সাথে ইস্তাম্বুলের গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। তুরস্ক সেই সম্পর্ককেই আবার জাগিয়ে তুলতে চাইছে। তবে আঙ্কারার সাথে তিউনিসিয়ার মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী ‘এননাহদা পার্টি’র সম্পর্ক যে বাস্তবতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তা জুন মাসে পার্লামেন্টে ফ্রান্সের কাছ থেকে ঔপনিবেশিক সময়ের অপরাধের ক্ষমা চাওয়ার বিলে ‘এননাহদা’র সমর্থন না দেয়াই প্রমাণ করে। তথাপি এই বিল তিউনিসিয়ার জনগণের ঔপনিবেশিক সময়ের প্রতি ঘৃণা এবং ঔপনিবেশিক সময় থেকে টেনে আনা সম্পর্কের ইতি টানার ইচ্ছেরই বহিঃপ্রকাশ; যা কিনা ফ্রান্সকে বিচলিত করেছে। তিউনিসিয়ার সামরিক বাহিনীর দ্রুত উন্নয়ন, জনগণের মাঝে তাদের জনপ্রিয়তা এবং তাদের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের ব্যাপারটাও ফ্রান্সকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। কারণ এতে লিবিয়ায় তুরস্কের সামরিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।

তিউনিসিয়ার কৌশলগত অবস্থান ফ্রান্সের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিউনিসিয়ার উত্তর উপকূল থেকে ইতালির দক্ষিণের সিসিলি দ্বীপের উপকূলের দূরত্ব মাত্র ১’শ ৬০ কিঃমিঃ। সিসিলি প্রণালী নামে পরিচিত এই সরু নৌপথ ভূমধ্যসাগরের পূর্ব এবং পশ্চিম ভাগকে যুক্ত করেছে। আর এর মাঝ দিয়েই ফ্রান্সের সাথে সুয়েজ খাল, তথা ভারত মহাসাগর এবং পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ। একারণেই ফ্রান্স তিউনিসিয়াকে কাছে রাখতে চাইছে। লিবিয়ার যুদ্ধে তুর্কি সমর্থনে ‘জিএনএ’এর সাম্প্রতিক বিজয়ের পর কৌশলগত এই নৌপথের নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের কাছে হারাবার ভয় পেয়ে বসেছে ফ্রান্সকে। আর একইসাথে ইতালিকে পাশে না পাওয়ায় ফ্রান্সের হতাশা চরমে পৌঁছেছে। তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র গ্রীসকে সাথে করেই ফ্রান্স লিবিয়ার উপকূল পাহাড়া দেবার যে মিশনে মনোনিবেশ করেছে, তা ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যখন গত ১০ই জুন লিবিয়ার উপকূলে ফরাসী এবং তুর্কি যুদ্ধজাহাজের মাঝে অসৌজন্যমূলক পরিস্থিতির সূচনা হয়। তুরস্ক যদি লিবিয়াতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনে মনোযোগী হয়, আর ফ্রান্স ও গ্রীস যদি তুরস্ককে একাজে বাধা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে, তাহলে সামনের দিনগুলিতে দুই পক্ষের মাঝে সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে।



Saturday 20 June 2020

জন্মের পর থেকে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জে ভারত

২০শে জুন ২০২০

লাদাখের সীমান্ত বিরোধ ভারতকে এমন এক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মাঝে ফেলেছে, যেখানে বহুদূরের মার্কিন সহায়তা পেলেও নিজস্ব স্থলসীমানায় অবস্থিত চারটা দেশ চীন, পাকিস্তান, নেপাল এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে নিশ্চিত নয় ভারত, যা কিনা দেশটার জন্মের পর থেকে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।


১৬ থেকে ১৮ই জুনের মাঝে তিন দফা আলোচনার পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ জানাচ্ছে যে, আটককৃত দু’জন অফিসারসহ ১০ জন ভারতীয় সেনাকে ফেরত দিয়েছে চীনারা। ১৫ই জুন ভারতীয়রা জানায় যে, চীনাদের সাথে লাদাখ সীমান্তে গালওয়ান উপত্যকায় উভয় পক্ষের প্রায় ৫’শ সেনার ব্যাপক সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে, যাদের মাঝে একজন কর্ণেলও রয়েছেন। দুই দেশের মাঝে চার দশকে এটা সবচাইতে মারাত্মক সীমান্ত সংঘর্ষ। ১৮ তারিখ পর্যন্ত ভারতীয়রা বলে আসছিলো যে, চীনাদের হাতে কোন ভারতীয় সেনা আটক নেই। উত্তেজনা প্রশমণে উভয় পক্ষ মে মাসের শুরু থেকে সাত বার আলোচনায় বসেছে। ২০শে জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অফিস থেকে এক বার্তায় বলা হয় যে, ভারতীয় সেনাদের বীরত্বের কারণেই চীনারা ভারতের সীমানার অভ্যন্তরে ঢুকতে পারেনি। আর মোদির সরকার চীনাদেরকে ইচ্ছেমতো দুই দেশের বিরোধপূর্ণ সীমানা পরিবর্তন করতে দেবে না। যদিও এর আগে ১৭ই জুন নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দেন যে, তার সরকার চীনাদের উচিৎ জবাব দেবে, তথাপি গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনাদেরকে বীরের মতো সীমানা রক্ষা করার বার্তা দিয়ে মোদি তার কঠোর হুমকি থেকে বেশ খানিকটা সরেই এসেছেন। আঞ্চলিক বাস্তবতা যে ভারতের যথেষ্টই বিপক্ষে যাচ্ছে, তা প্রতিবেশী নেপাল এবং বাংলাদেশের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।

গত ৯ই জুন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নেপাল ও চীনের সীমান্তে লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত একটা রাস্তা উদ্ভোধন করেন। নেপাল এই অঞ্চলকে তার নিজের সীমানার অভ্যন্তরে বলে মনে করে। ১৯৫০এর দশক থেকেই নেপাল চাইছে উভয় দেশ আলোচনায় বসে যাতে বাউন্ডারির সমস্যাগুলির সুরাহা করে। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেপালকে আলোচনায় বসার সময় দেয়নি। ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনারা এই অঞ্চল দখল করে নেয়। ১১ই মে নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গিয়াওয়ালি নিজে কাঠমুন্ডুতে ভারতের রাষ্ট্রদূত ভিনায় মোহন কোয়াত্রাকে ডেকে প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই কেবল তারা নেপালের সাথে আলোচনায় বসবে। অপরদিকে নেপাল বলছে যে, করোনাভাইরসের সমস্যা শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতে পারবে না। ১৩ই জুন নেপালের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থনে দেশটার নতুন মানচিত্রকে সংবিধানের অংশ করে প্রস্তাব পাস হয়; এই মানচিত্রে কালাপানি, লিপুলেখ গিরিপথ এবং লিম্পিয়াধুরা এলাকাগুলি নেপালের অংশ দেখানো হয়। ১৯শে জুন নেপালের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে এই প্রস্তাব পাশ হলে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র বিষ্ণু রিজাল ঘোষণা দেন যে, নেপাল কালাপানিতে একটা সেনা ক্যাম্প তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। ১৭ই মে নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল পুর্ন চন্ত্র থাপা কালাপানি সীমান্ত এলাকা সফর করেন। নেপালের সাথে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা যখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যাস্ত চীন।

১৬ই জুন বেইজিং সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্য, বা ৫ হাজার ১’শ ৬১টা পণ্যের জন্যে চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেবে। ব্যাপারটা ভারতীয়দেরকে বিচলিত করেছে। ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঠিক যেসময় লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত এবং চীনের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে, তখনই চীন হয়তো বাংলাদেশকে তার পক্ষে টানতে চাইছে। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে গড়ে তোলা সুসম্পর্ক এখন হুমকির মুখে পড়ছে বলে প্রতিবেদনে আশংকা করা হয়। এই সম্পর্ক গত বছরই চাপের মাঝে পড়েছে, যখন ভারতে ‘এনআরসি’ এবং এর পরবর্তীতে ‘সিএএ’ আইন নিয়ে ঢাকায় অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এছাড়াও গত ১৯শে মে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশকে ‘সিসটার সিটি’ নামের এক কনসেপ্টে যুক্ত হবার জন্যে আহ্বান করা হয়। এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের সমস্যা দূরীকরণে চীনা শহরগুলির উদাহরণকে ব্যবহার করার জন্যে প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে দুই দেশের জনগণের মাঝে সম্পর্কোন্নয়ন হবে বলে আশা করা হয়। এই ব্যাপারটাও ভারতীয়রা সহজভাবে নিতে পারেনি। ভারতের শীর্ষস্থানীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় এব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একইসাথে বাংলাদেশের সাথে চীনের বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কেন দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন সৃষ্টি করছে না, সেব্যাপারেও হতাশা প্রকাশ করা হয়।

গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাদের প্রাণহানির পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এক টুইটার বার্তায় মার্কিন সরকারের সমবেদনা জ্ঞাপণ করেন। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, গত দুই দশকে ভারত ওয়াশিংটনের সাথে নিবিড় রাজনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে; যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের সবচাইতে বড় অস্ত্র সরবরাহকারীদের একটা। ভারতীয় চিন্তাবিদদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করার পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা রাও ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে বলেন যে, এসময় ভারতের উচিৎ কৌশলগত সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারস্পরিক স্বার্থের জোরালো সমন্বয় করা। একইসাথে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং আসিয়ানের সাথেও সম্পর্ক গভীর করা। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশীদের ব্যাপারে তিনি কোন কথাই বলেননি। অর্থনৈতিক দৈন্যতা, সামাজিক অস্থিরতা, জাতিগত ও ধর্মীয় অসন্তোষের মাঝে করোনা দুর্যোগে ভারত যখন নাকাল, তখনই শুরু হলো এই সীমান্ত সংঘাত। ভারতের জন্যে ভৌগোলিক সীমানাগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭এ জন্মের পর থেকেই নিজস্ব ভৌগোলিক অখন্ডতা ভারতকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাচ্ছে। একারণেই স্থলসীমানাবেষ্টিত ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্কের স্থিতাবস্থা ভারতের জন্যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। লাদাখের সীমান্ত বিরোধ ভারতকে এমন এক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মাঝে ফেলেছে, যেখানে বহুদূরের মার্কিন সহায়তা পেলেও নিজস্ব স্থলসীমানায় অবস্থিত চারটা দেশ চীন, পাকিস্তান, নেপাল এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে নিশ্চিত নয় ভারত, যা কিনা দেশটার জন্মের পর থেকে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।

Thursday 18 June 2020

ককেশাসে বাড়ছে ভূরাজনৈতিক তাপমাত্রা

১৮ই জুন ২০২০

২০১৭ সালে তুরস্ক এবং আজেরবাইজানের সেনাবাহিনীর মাঝে যৌথ মহড়া। ২০১০ সালে দুই দেশের মাঝে কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার অধীনে এক দেশ বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে অপর দেশ তাকে সকল ধরনের সহায়তা দেবে। নিয়মিত বিরতিতে দুই দেশের মাঝে চলছে সামরিক মহড়া। এই মহড়াগুলি আজেরবাইজানকে নাগোর্নো কারাবাখে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করছে।


গত ২রা মে আজেরবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে একটা ভিডিওতে দেখানো হয় যে, আজেরবাইজানের নাখচিভান ছিটমহলে বেশকিছু অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করা হয়েছে। তুর্কি থিংকট্যাঙ্ক ‘ইডিএএম’এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক জান কাসাপোগলু বলছেন যে, এই ভিডিওতে তুরস্কে নির্মিত ‘টিআরজি-৩০০ কাপলান’ ৩০০ মিঃমিঃ রকেট আর্টিলারি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। এর নির্মাতা কোম্পানি ‘রকেটসান’ বলছে যে, এই রকেটের পাল্লা ১’শ ২০ কিঃমিঃ এবং এর সক্ষমতা রয়েছে এর ১’শ ৫ কেজি ওয়ারহেডকে টার্গেটের ১০ মিটারের মাঝে ফেলার। এই রকেটগুলি সৈন্যদের ব্যারাক, কমান্ড সেন্টার, রাডার, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট ধ্বংসে বিশেষভাবে কার্যকর। কাসাপোগলু মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, গত ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ার ইদলিবের যুদ্ধে তুর্কি সেনাবাহিনী এই রকেটগুলিকে ব্যবহার করেছিল। নাখচিভান ছিটমহলে এই রকেট মোতায়েন করার ফলে অত্র অঞ্চলের সামরিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে। আজেরবাইজানের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র আর্মেনিয়ার সাথে বিরোধপূর্ণ নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তুমুল বিরোধ রয়েছে। ১৯৯০এর দশক থেকে চলা একরকম যুদ্ধাবস্থাতে বর্তমানে অস্ত্রবিরতি থাকলেও এই স্থিতাবস্থা কতদিন এভাবে থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। কাসাপোগলু বলছেন যে, নাখচিভান ছিটমহলে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আজেরবাইজান এখন নাগোর্নো কারাবাখে আর্মেনিয় সেনাদের সাপ্লাই লাইনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আজেরবাইজান সামরিক খাতে ব্যাপক ব্যয় করেছে। একইসাথে তুরস্কের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাঝে দুই দেশ যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে; যার মাধ্যমে আজেরবাইজানের যুদ্ধ করার সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তুর্কি মিডিয়া ‘ইয়েনি সাফাক’ গত বছর মে মাসে আজেরবাইজানের রাজধানী বাকুর কাছকাছি ‘মুস্তফা কেমাল আতাতুর্ক ২০১৯’ নামের এক সামরিক মহড়ার খবর দেয়। এই মহড়ায় ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ভেহিকল এবং আর্টিলারির সমন্বয়ে গঠিত আজেরবাইজানের সেনাবাহিনীর মেকানাইজড ফর্মেশনগুলি বড় আকারের আক্রমণাত্মক কৌশলের মহড়ার দেয়। এই মহড়াগুলি আজেরবাইজানকে নাগোর্নো কারাবাখে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করছে।

আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার উদ্ভট বাউন্ডারি। সোভিয়েতরাই বর্তমান ককেশাসের বাউন্ডারিগুলি এঁকেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় থেকেই এই সীমানা নিয়ে আর্মেনিয় এবং আজেরিদের মাঝে শুরু হয় জাতিগত সংঘাত। আর্মেনিয়ার নেতৃত্বের সাথে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের সম্পর্ক খুবই গভীর। তৃতীয় শতাব্দী থেকেই আর্মেনিয়া একটা ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। তাই ধর্মীয় বিষয়গুলি কখনোই আর্মেনিয়ার রাজনীতির বাইরে ছিল না।




আজেরবাইজান ও আর্মেনিয়ার সংঘাতের ঐতিহাসিক পটভূমি

আর্মেনিয়া ককেশাসের অংশ। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে আর্মেনিয়ার মানুষ খ্রিষ্ঠান হওয়া শুরু করে। সেই সময় থেকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্য এবং পারসিক সাম্র্যাজ্যের মাঝে আর্মেনিয়া নামে একটা খ্রিষ্ঠান রাজ্য তার উপস্থিতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়। তবে ৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝি আর্মেনিয়াসহ পুরো ককেশাস ইসলামের অধীনে চলে যায়। ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গল আক্রমণের পর থেকে এই অঞ্চলের ধরণ পাল্টে যায়। তুর্কিরা এখানকার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি ইস্তাম্বুলে উসমানি খিলাফতের আবির্ভাবের পর থেকে ককেশাস অঞ্চল পারস্য এবং উসমানিদের মাঝে প্রতিযোগিতার বস্তু হয়ে যায়। এরপর অষ্টাদশ শতকে রুশদের আবির্ভাবের পর অত্র অঞ্চলে ত্রিমুখী প্রভাবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। তবে বিংশ শতকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরির পর ককেশাস অঞ্চল পুরোটাই সোভিয়েত শক্তির পদানত হয়। সোভিয়েতরাই বর্তমান ককেশাসের বাউন্ডারিগুলি এঁকেছিল। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের সীমানা এঁকে দেন; যেখানে নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চলকে আজেরবাইজানের মাঝে রাখা হয়। আর্মেনিয়রা এটা পছন্দ করেনি; তারা চেয়েছিল যে, খ্রিষ্টান অধ্যুষিত নাগোর্নো কারাবাখ আর্মেনিয়ার অধীন হোক; মুসলিম অধ্যুষিত আজেরবাইজানের অধীন নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় থেকেই এই সীমানা নিয়ে আর্মেনিয় এবং আজেরিদের মাঝে শুরু হয় জাতিগত সংঘাত। আর ১৯৯০এর শুরুতে তা রূপ নেয় পুরোপুরি যুদ্ধে। সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকার কারণে আর্মেনিয়রা বেশ শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনী গঠন করতে পারে; যা কিনা আজেরিরা পারেনি। তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও আর্মেনিয়া তার সামরিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নাগোর্নো কারাবাখকে আজেরিদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে এখানে থেকে থেকে সংঘাত চলছে। আর্মেনিয়ার নেতৃত্বের সাথে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের সম্পর্ক খুবই গভীর। তৃতীয় শতাব্দী থেকেই আর্মেনিয়া একটা ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। তাই ধর্মীয় বিষয়গুলি কখনোই আর্মেনিয়ার রাজনীতির বাইরে ছিল না।

আজেরবাইজানের বাকুর তেলখনিগুলি থেকে কয়েকটা তেলের পাইপলাইন বের হলেও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তুরস্কের মাঝ দিয়ে ভূমধ্যসাগরের চেইহান বন্দর পর্যন্ত যাওয়া পাইপলাইন। এই পাইলাইনের মাধ্যমে তেল বিক্রির অর্থ ব্যবহার করেই আজেরিরা তাদের সামরিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে থাকে। রাশিয়া আর আর্মেনিয়াকে বাইপাস করে জর্জিয়ার মাঝ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই পাইপলাইন। ২০০৮ সালে জর্জিয়াতে রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের পর এই পাইপলাইন করিডোর হুমকির মাঝে পড়েছে।



বাকুর তেলের ভূরাজনীতি

ঊনিশ শতকের শেষের দিকে আজেরবাইজানের বাকু তেলখনি থেকে তেল উত্তোলন শুরু করে রুশরা। বিংশ শতকের শুরুতে সারা বিশ্বের মোট তেল বাণিজ্যের অর্ধেক আসতো বাকু থেকে। ১৯১৮ সালে উসমানি খিলাফত ধ্বংসের কাছাকাছি সময়ে উসমানি সেনারা আজেরিদেরকে সাথে নিয়ে বাকুর নিয়ন্ত্রণ নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফত ধ্বংস করে ব্রিটিশরা এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু ১৯২০ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত সৈন্যরা বাকুর দখল নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাকুর তেলখনিগুলি জার্মানদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত বিজয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাকুর তেল পশ্চিমা দেশগুলিতে রপ্তানি করার পিছনে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ শুরু হয়। ১৯৯৭ সালে রুশ বিনিয়োগে বাকু থেকে রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরের বন্দর নভোরোসিস্ক পর্যন্ত তেলের পাইপলাইন চালু হয়। ১ লক্ষ ব্যারেল সক্ষমতার এই পাইপলাইনের চাইতে আরও বেশি সক্ষমতার আরেকটা পাইপলাইন তৈরি করা হয় রাশিয়াকে বাইপাস করে বাকু থেকে জর্জিয়ার সুপসা বন্দর পর্যন্ত। ১৯৯৯ সালে চালু হওয়া এই পাইপলাইনের সক্ষমতা হলো ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ব্যারেল। তবে এই দুই পাইপলাইনের চাইতে আরও অনেক বড় এক প্রকল্প গ্রহণ করা হয় আরও আগেই। ১৯৯৩ সালে রাশিয়াকে বাইপাস করে আজেরবাইজানের বাকু তেলখনি থেকে তেল তুরস্কের ভূমধ্যসাগরের চেইহান বন্দরে খালাস করার লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়। রাশিয়া এবং আর্মেনিয়াকে এক্ষেত্রে বাইপাস করে জর্জিয়াকে বেছে নেয়া হয়। তবে ২০০৩ সালের আগে এই পাইপলাইনের কাজ শুরু হয়নি। ২০০৬ সালের মে মাসে ১২ লক্ষ ব্যারেল সক্ষমতার এই পাইপলাইন পুরোপুরি চালু হয়। মার্কিন ‘এনার্জি ইনফর্মেশন এডমিনিস্ট্রেশন’র হিসেবে ২০০৪ সালে যেখানে আজেরবাইজানের তেলের উৎপাদন ছিল দৈনিক প্রায় ৩ লক্ষ ব্যারেল, তা ২০০৭ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৭ লক্ষ ব্যারেলের বেশি। এই পাইপলাইন চালুর মাধ্যমে বাকুর তেলখনিগুলির উপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কমে যায়। তেল বিক্রির অর্থের উপর ভর করে আজেরবাইজানের জিডিপি বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবে ২০০৪ সালে ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে লাফ দিয়ে ২০১৪ সালে ৭৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়। অর্থাৎ মাত্র দশ বছরে জিডিপি ৮ গুণ বেড়ে যায়! তবে তেলের বাজারে ব্যাপক দরপতনের পর দেশটার জিডিপি ৪৮ বিলিয়নে নেমে আসে। তেল বিক্রির এই অর্থ আজেরবাইজানের সামরিক সক্ষমতাকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। জর্জিয়ার অর্থনীতিও একই সময়ে ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়। আর আর্মেনিয়ার অর্থনীতি সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে হয়ে যায় ১২ বিলিয়ন ডলার।

নাগোর্নো কারাবাখকে ঘিরে আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের যুদ্ধের কারণে বাকু থেকে তেলের পাইপলাইনগুলি খোলা সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছানোটা হয়ে গিয়েছিল কঠিন। এক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের কাজ করে জর্জিয়া। ২০০৩ সালে জর্জিয়াতে পশ্চিমাদের সমর্থিত ‘রোজ রেভোলিউশন’এর মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট মিখাইল শালিকাশভিলি পশ্চিমাদের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেন। তবে একইসাথে রাশিয়ার সাথে জর্জিয়ার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। জর্জিয়ার মাঝ দিয়ে যাবার কারণে বাকু থেকে আসা পাইপলাইনগুলিকে নাগোর্নো কারাবাখের সংঘাত স্পর্শ করতে পারেনি। তবে এই প্রকল্পগুলিকে রাশিয়া নিজ অঞ্চলে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখেছে। ২০০৮ সালের অগাস্টে মাত্র ৩৭ লক্ষ জনসংখ্যার জর্জিয়া রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। জর্জিয়ার ভেতরে আবখাজিয়া এবং সাউথ অসেটিয়া অঞ্চলকে রাশিয়া সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জর্জিয়া থেকে আলাদা করে ফেলে এবং এদেরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। সেসময় আজেরবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে যে, তারা জর্জিয়ার অখন্ডতায় বিশ্বাসী। ২০০৮ সালে রাশিয়ার জর্জিয়া অভিযান নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে আজেরবাইজানের নিরাপত্তাহীনতাকে জাগিয়ে তুলে। ২০১০ সালের অগাস্টে আজেরবাইজান তুরস্কের সাথে দশ বছর মেয়াদী ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ এন্ড মিউচুয়াল সাপোর্ট’ নামের এক চুক্তি করে; যার অধীনে এক দেশ বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে অপর দেশ তাকে সকল ধরনের সহায়তা দেবে। ২০২০ সালের অগাস্টে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার কথা রয়েছে।

২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে চার দিনের যুদ্ধের মাঝে নাগোর্নো কারাবাখের আকাশে ইস্রাইল নির্মিত ‘হারোপ’ লোইটারিং সুইসাইড ড্রোন। এই যুদ্ধ তুরস্ক এবং ইস্রাইলকে ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। আজেরবাইজানের জন্যে এই দুই দেশের সমর্থন অত্র এলাকার সামরিক ব্যালান্সকে যে পরিবর্তন করে দিয়েছে, তা এই যুদ্ধের মাঝেই বোঝা গিয়েছে। ভবিষ্যতের যেকোন সংঘাতেও এই দুই দেশের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে, তা নিশ্চিত।



২০১৬ সালের এপ্রিলের ‘চার দিনের যুদ্ধ’

২০১৬ সালের এপ্রিলে নাগোর্নো কারাবাখের সীমান্তে আজেরিদের সাথে আর্মেনিয়দের ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হয়। মোটামুটি ৪ দিনের জন্যে দুই দেশের মাঝে যুদ্ধাবস্তা বিরাজ করে। উভয় পক্ষেই হতাহতের পরষ্পবিরোধী দাবি তোলা হয়। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে, আজেরবাইজান এই যুদ্ধে ক্ষুদ্র, কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর ফেলো জাউর শিরিইয়েভ বলেন যে, এই যুদ্ধের মাধ্যমে আজেরবাইজান এতদিনের স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে তা বাকি বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধের সময় তুরস্ক আজেরবাইজানের সাথে থাকার ঘোষণা দিলে রাশিয়া তুরস্ককে সতর্ক করে বলে যে, তুরস্কের উচিৎ এই সংঘর্ষে শুধু একপক্ষকে সমর্থন না করা। একইসাথে রুশরা বলে যে, তুরস্কের উচিৎ তার আশেপাশের দেশগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন না দেয়া। এখানে উল্লেখ্য যে, রাশিয়া সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরোধী গ্রুপগুলিকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবেই রুশরা ককেশাস অঞ্চলকে তাদের প্রভাবের এলাকা হিসেবেই দেখে থাকে। ২০১৬ সালের এপ্রিলের যুদ্ধ তুরস্ক এবং ইস্রাইলকে ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। আজেরবাইজানের জন্যে এই দুই দেশের সমর্থন অত্র এলাকার সামরিক ব্যালান্সকে যে পরিবর্তন করে দিয়েছে, তা এই যুদ্ধের মাঝেই বোঝা গিয়েছে। ভবিষ্যতের যেকোন সংঘাতেও এই দুই দেশের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে, তা নিশ্চিত। ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ক্রিস্টিন ফিলিপ ব্লুমায়ের মতামত দেন যে, ২০১৬ সালের যুদ্ধের সময় রুশ কর্মকর্তাদের কথাবর্তা বলে দিয়েছিল যে, রুশরা আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ব্লুমায়েরের সেই মন্তব্যের পর আরও চার বছর পেরিয়ে গেছে। আর ভূরাজনৈতিকভাবে রাশিয়া এবং তুরস্কের সম্পর্কেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আবারও যদি আজেরবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার সংঘাত শুরু হয়, তবে সেখানে রাশিয়া চুপচাপ বসে থাকবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। আর যদি আর্মেনিয়রা যুদ্ধে হেরে যাবার অবস্থায় চলে যায়, তাহলেও কি রুশরা বসে থাকবে কিনা?

রুশ নেতৃত্বে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ‘সিএসটিও’এর অধীনে থাকা ৬টা দেশের সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা সম্পর্ক অনেক গভীর। ১৯৯৪ সালে ৯টা দেশ এর মাঝে থাকলেও ১৯৯৯ সালে আজেরবাইজান এবং জর্জিয়া এই সংগঠন থেকে বের হয়ে যায়। ২০০৬ সালে ইউক্রেনও বের হয়ে যায় এখান থেকে। বর্তমানে রাশিয়া ছাড়াও আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তান এর সদস্য। আর্মেনিয়ার মিডিয়া ‘আজাতুতইয়ুন’ বলছে যে, ‘সিএসটিও’এর সদস্য হবার কারণে আর্মেনিয়া নামমাত্র মূল্যে বা বিনা পয়সায় রুশ অস্ত্র পায়।

২০১৬ সালে আর্মেনিয়ার সামরিক প্যারেডে রুশ নির্মিত ‘ইস্কান্দার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে আর্মেনিয়রা আজেরবাইজানের তেলের স্থাপনাগুলির উপর হামলা করতে সক্ষম হবে।



আর্মেনিয়ার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি কি যথেষ্ট?

মাত্র ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার আর্মেনিয়ার জিডিপি ১৩ বিলিয়ন ডলার। বাইরের সহায়তা ছাড়া নিজের শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলা আর্মেনিয়ার জন্যে যথেষ্টই কষ্টকর। আর্মেনিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী আজেরবাইজানের জনসংখ্যা ১ কোটি এবং এর জিডিপি প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার; যা আর্মেনিয়ার তিন গুণেরও বেশি। দুই দেশের জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির আকারের এই পার্থক্য সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করাকে যথেষ্টই প্রভাবিত করেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর হিসেবে আর্মেনিয়ার সেনাবাহিনীতে রয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার সেনা। ইউনিটগুলি বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে; ১৬টা রাইফেল রেজিমেন্ট, ১টা আর্টিলারি ব্রিগেড, ১টা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্রিগেড, ২টা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র রেজিমেন্ট, ১টা আর্টিলারি রেজিমেন্ট, ১টা এন্টি ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, ৩টা ট্যাঙ্ক ব্যাটালিয়ন, ৪টা আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন, এবং আরও বেশকিছু ইউনিট। আর্মেনিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে একত্রে যুদ্ধ করছে নাগোর্নো কারাবাখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া ‘আর্তসাখ রিপাবলিক’এর সেনাবাহিনী। এই বাহিনীতে রয়েছে আরও প্রায় ২৫ হাজার সেনা এবং প্রায় ৩০ হাজার রিজার্ভিস্ট। নিশ্চিত করা না গেলেও আর্তসাখের বাহিনীতে প্রায় ৩’শ ট্যাঙ্ক, ২’শ আর্মার্ড ভেহিকল এবং ৩’শ আর্টিলারি রয়েছে বলে দাবি করে আর্মেনিয়রা।

রাশিয়া নাগোর্নো কারাবাখের সংঘাতে উভয় পক্ষকেই অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ বা ‘সিপরি’র হিসেবে ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সালের মাঝে আর্মেনিয়া বেশকিছু অস্ত্র কিনেছে; যার মাঝে রাশিয়াই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী। এই অস্ত্রগুলির মাঝে রয়েছে,

১) ২০১৬ সালে রাশিয়ার সরবরাহকৃত ৪টা ‘ইস্কান্দার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার এবং ২৫টা ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা প্রায় ৪’শ থেকে ৫’শ কিঃমিঃ পর্যন্ত। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ‘ইস্কান্দার’ ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে আর্মেনিয়রা আজেরবাইজানের তেলের স্থাপনাগুলির উপর হামলা করতে সক্ষম হবে।

২) ২০১৭ সালের মাঝে রাশিয়ার সরবরাহকৃত ৬টা ‘বিএম-৯ এ৫২ স্মার্চ’ ৩০০মিঃমিঃ রকেট লঞ্চার। এগুলির পাল্লা প্রায় ৯০ কিঃমিঃ পর্যন্ত। ২০০৭ সালে বেলারুশ সরবরাহ করে ১০টা ১২২ মিঃমিঃএর ‘ডি-৩০’ কামান। ২০১০ সালে মন্টিনেগ্রো থেকেও একই মডেলের ১৬টা কামান আসে। ১৯৯৯ সালে চীন থেকে আসে ৪টা ‘ডব্লিউএম-৮০’ ২৭৩ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড রকেট লঞ্চার।

৩) ২০১০ সালের মাঝে সরবরাহকৃত ২টা ‘এস ৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ‘সিপরি’ বলছে যে, আর্মেনিয়ার কাছে সরবরাহকৃত ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ‘৫ভি৫৫ইউ’ ভার্সনের, যেগুলির পাল্লা দেড়’শ কিঃমিঃ। এর সাথে কমপক্ষে ১’শ ৪৪টা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়া। ২০১৭ সালের মাঝে রাশিয়ার সরবরাহকৃত ‘৯কে৩৩৩ ভার্বা’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। কাঁধ থেকে ছোঁড়া স্বল্পপাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা সাড়ে ৬ কিঃমিঃ। ২’শটা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হয়। ২০১৩ সালের মাঝে রাশিয়া সরবরাহ করে ৫ কিঃমিঃ পাল্লার ২’শ ‘ইগলা এস’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১৬ সালে আরও ২’শ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হয়। ২০১৯ সালে রুশরা সরবরাহ করে কমপক্ষে ২টা ‘টর এম১’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা এবং এর সাথে ৫০টা ‘৯এম৩৩৮’ ক্ষেপণাস্ত্র। ১২ কিঃমিঃ পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ট্যাঙ্ক চ্যাসিসের উপর বসানো। তবে আর্মেনিয়ার মিডিয়া ‘আজাতুতইয়ুন’ বলছে যে, প্রধানমন্ত্রী নিকল পাশিনিয়ান তার ফেইসবুক পেইজে ২০১৭ সালের মে মাসেই এই ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ঘোষণা দেন।

৪) ২০১৭ সালে রাশিয়া সরবরাহ করে সাড়ে ৫ কিঃমিঃ পাল্লার ১’শটা ‘৯এম১৩৩ করনেট-ই’ ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ‘করনেট’ রুশদের ডেভেলপ করা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মাঝে সবচাইতে সক্ষমগুলির একটা।

৫) ২০১৯ সালে রুশরা সরবরাহ করা শুরু করে ‘সুখোই এসইউ-৩০এসএম’ ফাইটার বিমান। এই বিমানগুলি আর্মেনিয়ার বিমান বাহিনীকে আজেরবাইজানের বিমান বাহিনী থেকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেল।

৬) ২০০৪ সালে স্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আর্মেনিয়া ১০টা রুশ নির্মিত ‘সুখোই এসইউ-২৫’ গ্রাউন্ড এটাক বিমান কেনে।

৭) ইউক্রেনের কাছ থেকে ২০০৪ সালে ২টা ‘এল-৩৯সি আলবাট্রস’ ট্রেনিং জেট বিমান কেনে। ২০১১ সালের মাঝে আরও ৪টা বিমান পায় আর্মেনিয়া।

৮) ২০১৯ সালে আর্মেনিয়া ১৫ কিঃমিঃ পাল্লার ৪টা ‘অসা’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনে। এর সাথে ছিল ১’শ ২০টা ‘৯এম৩৩’ ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলির উৎস নিশ্চিত হওয়া না গেলেও রাশিয়া থেকেই এগুলি এসেছে বলে বলছে ‘সিপরি’।

খেয়াল করলে বোঝা যাবে যে, আর্মেনিয়া তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাঝে বিমান প্রতিরক্ষাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। ‘সুখোই-৩০’ বিমান এবং দূরপাল্লার ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে আর্মেনিয়া আকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। একইসাথে ২০১৬ সাল থেকে বিপুল সংখ্যক স্বল্প পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করে তারা। এছাড়াও দূরপাল্লার আর্টিলারি এবং এন্টি ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে ক্রয়কৃত আস্ত্রের মাঝে। এগুলি ছাড়াও আর্মেনিয়া রাশিয়া থেকে ‘ইনফাউনা’ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যন্ত্র কিনেছে, যা কিনা তারা ২০১৬ সালের জাতীয় দিবস প্যারেডে দেখায়। এই যন্ত্রের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের রেডিও যোগাযোগ জ্যামিং করা সম্ভব। এর বাইরেও আর্মেনিয়রা নিজেরাই ‘থান্ডার’ নামে একটা রেডিও জ্যামার তৈরি করে ২০১৮ সালে ইয়েরেভানে একটা প্রতিরক্ষা মেলায় ডিসপ্লে করে। আর্মেনিয়ার সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘আরমেন প্রেস’ বলছে যে, এই জ্যামার ২০ কিঃমিঃ দূরত্বে শত্রুর রেডিও জ্যামিং করতে পারবে। সিনিয়র লেফটেন্যান্ট হোভানেস খেলাঘাতিয়ান বলেন যে, ২০১৬ সালে আজেরবাইজানের সাথে সীমান্ত যুদ্ধে এই জ্যামার নাগোর্নো কারাবাখে মোতায়েন করা হয় এবং তা ব্যাপক সফলতাও পায়। ২০১১ সালে আর্মেনিয়া সামরিক প্যারেডে নিজস্ব ডিজাইনের ‘ক্রুংক’ সার্ভেইল্যান্স ড্রোন ডিসপ্লে করে। প্রায় ৫ ঘন্টা আকাশে ওড়ার সক্ষমতা রয়েছে এটির। আর্তসাখ সেনাবাহিনীকেও এই ড্রোন সরবরাহ করা হয়েছে।

২০১৮ সালে আজেরবাইজানের রাস্তায় প্যারেডে তুর্কি ‘এসওএম বি-১’ আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্রুজ মিসাইল। এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ব্যবহার করে আজেরবাইজানের বিমানগুলি শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরত্ব রেখেই আড়াই’শ কিঃমিঃ দূরের অতি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করলো।



আজেরবাইজানে অস্ত্র কেনার হিড়িক

অন্যদিকে ‘সিপরি’র হিসেবে ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সালের মাঝে আজেরবাইজান বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কিনেছে। সরবরাহকারীদের মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাশিয়া, ইস্রাইল, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, বেলারুশ এবং ইউক্রেন।

আজেরবাইজান যা কিনেছে, তার মাঝে রয়েছে -

১) ট্যাঙ্ক কেনা হয় ৩’শ ৬০টা...

রাশিয়া - ২০০৭ সালে কেনা ৬২টা ‘টি-৭২এম১’ ট্যাঙ্ক; ২০১৫ সালের মাঝে কেনা ১’শটা ‘টি-৯০এস’ ট্যাঙ্ক;

ইউক্রেন - ২০০৬ সালে কেনা ৪৫টা ‘টি-৭২এম১’ ট্যাঙ্ক;

বেলারুশ - ২০০৬ সালে কেনা ৬০টা ‘টি-৭২এম১’ ট্যাঙ্ক; ২০১৩ সালের মাঝে কেনা হয় আরও ৯৩টা;

২) আর্টিলারি কেনা হয় ৬’শ ৯২টা...

বেলারুশ থেকে ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে ১২টা ‘২এস৭ পিয়ন’ ২০৩ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড কামান কেনা হয়; ২০১৯ সালের মাঝে ১০টা ‘বি২০০বিএম পলোনেজ’ ৩০০ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড রকেট; ২০১৭ সালে ২৬টা ‘২এ৩৬’ ১৫২ মিঃমিঃ কামান; ২০১০ সালে ৩০টা ‘ডি-৩০’ ১২২ মিঃমিঃ কামান কেনা হয়।

বুলগেরিয়া থেকে ২০০২ সালে ৩৬টা ১৩০ মিঃমিঃ ‘এম-৪৬’ কামান কেনা হয়।

চেক রিপাবলিক থেকে ২০১৮ সালের মাঝে ৩০টা ১২২ মিঃমিঃ ‘আরএম-৭০’ সেলফ প্রপেল্ড রকেট কেনা হয়।

স্লোভাকিয়া থেকে ২০১৮ সালের মাঝে কেনা হয় ৩৬টা ১৫২ মিঃমিঃ ‘ডানা’ সেলফ প্রপেল্ড কামান।

ইস্রাইল থেকে ২০০৬ সালে ৬টা ‘লিংক্স’ সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি রকেট লঞ্চার কেনা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে ৫০টা ‘এক্সট্রা’ গাইডেড রকেটও কেনা হয়। ২০১০ সালে কেনা হয় ৫টা ১৫৫ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি কামান ‘এটমোস ২০০০’। ২০১১ সালের মাঝে কেনা হয় ১০টা ১২০ মিঃমিঃ ‘কারডম’ সেলফ প্রপেল্ড মর্টার। ২০১৮ সালের মাঝে কেনা হয় ৪টা ‘লোরা’ সেলফ প্রপেল্ড রকেট লঞ্চার; সাথে কেনা হয় ৫০টা রকেট। একই বছর কেনা হয় ১০টা ‘স্যান্ডক্যাট স্পিয়ার’ ১২০ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড মর্টার।

রাশিয়া থেকে ২০১৪ সালের মাঝে কেনা হয় ১৮টা ‘২এস১৯ এমএসটিএ-এস’ ১৫২ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড কামান; ১৮টা ‘২এস৩১ ভেনা’ ১২০ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড কামান; ১৮টা বিএম৯ এ৫২ স্মার্চ’ ৩০০ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড রকেট লঞ্চার। ২০১৭এর মাঝে কেনা হয় ৩৬টা ‘টিওএস-১’ ২২০ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড রকেট লঞ্চার।

তুরস্ক থেকে ২০১৩ সালের মাঝে কেনা হয় ৩০টা ১০৭ মিঃমিঃ রকেট লঞ্চার ‘টি-১০৭’; ২০১৪ সালের মাঝে কেনা হয় ৪০টা ‘টি-১২২’ রকেট লঞ্চার; ২০১৬ সালের মাঝে কেনা হয় ৩০০ মিঃমিঃএর ২০টা ‘টি-৩০০’ রকেট লঞ্চার; এর সাথে সরবরাহ করা ১’শ ৮টা ৩০০ মিঃমিঃ ‘টিআরজি-৩০০’ গাইডেড রকেট। এগুলির পিছনে খরচ হয় প্রায় ২’শ ৪৪ মিলিয়ন ডলার।

ইউক্রেন থেকে ২০০২ সালের মাঝে কেনা হয় ৭২টা ‘টি-১২ ২এ১৯’ ১০০ মিঃমিঃ কামান। ২০০৫ সালে কেনা হয় ১২টা ‘বিএম৯ এ৫২ স্মার্চ’ সেলফ প্রপেল্ড রকেট; ২০০৬ সালে কেনা হয় ৮৫টা ‘এম-৪৩’ ১২০ মিঃমিঃ মর্টার; ২০০৭ সালে কেনা হয় ৫৫টা ‘ডি-৩০’ ১২২ মিঃমিঃ কামান; ২০০৮ সালের মাঝে কেনা হয় ৩টা ‘২এস৭ পিওন’ ২০৩ মিঃমিঃ কামান; ২০১০ সালের মাঝে কেনা হয় ৫৪টা ‘২এস১’ ১২২ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড কামান; একই বছরে কেনা হয় ১৬টা ‘২এস৩’ ১৫২ মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড কামান।

৩) আর্মার্ড ভেহিকল কেনা হয় ৬’শ ৪৯টা...

২০১০ সালের মাঝে রাশিয়া থেকে কেনা হয় ৭০টা ‘বিটিআর-৮০এ’ এপিসি; ২০১৫ সালের মাঝে কেনা হয় ১’শ ১৮টা ‘বিএমপি-৩’ ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল; ২০১৮ সালের মাঝে কেনা হয় ৭৬টা ‘বিটিআর-৮২এ’ ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল।

২০১১ থেকে ২০১৫এর মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কেনা হয় ৮৫টা ‘ম্যারডার’ এবং ৬০টা ‘ম্যাটাডোর’ এপিসি।

২০১১ সালে তুরস্ক থেকে কেনা হয় ৩৫টা ‘কোবরা’ এবং ৩৭টা ‘শোরল্যান্ড’ এপিসি।

ইউক্রেন থেকে ২০০৭ সালে কেনা হয় ১৮টা ‘বিটিআর-৮০’ এপিসি; ২০১০ সালের মাঝে কেনা হয় ১শ ৫০টা ‘বিটিআর-৭০’ এপিসি।

৪) বিমান প্রতিরক্ষা

ইস্রাইলের কাছ থেকে ২০১৬ সালে একটা ‘বারাক এলআর’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনা হয়। এর সাথে ছিল ১’শ কিঃমিঃ পাল্লার ৪০টা ‘বারাক-৮’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১৫০ কিঃমিঃ পাল্লার ৪০টা ‘বারাক-৮ ইআর’ ক্ষেপণাস্ত্র; ২টা ‘ইএলএম ২২৮৮’ এয়ার সার্চ রাডার। স্পেন থেকেও কেনা হয় ‘লানজা এলটিআর-২৫’ এয়ার সার্চ রাডার। ইউক্রেন থেকে ২০০৮ সালে কেনা হয় ১৮টা ‘স্ট্রেলা-৩’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১৩ সালে কেনা হয় ’৮০কে৬এম’ এয়ার সার্চ রাডার।

রাশিয়া থেকে ২০১১ সালে ৩’শ মিলিয়ন ডলার খরচে কেনা হয় ২টা ‘এস-৩০০পিএমইউ-২’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং তাতে ব্যবহারের জন্যে কেনা হয় ২’শ ‘৪৮এন৬’ ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা দেড়’শ কিঃমিঃএর বেশি। ২০১৩ সালের মাঝে কেনা হয় স্বল্প পাল্লার ২’শ ‘ইগলা-এস’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার এবং ১ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১৪ সালের মাঝে কেনা হয় ২টা ‘৯কে৩৭ বুক-১এম’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর সাথে কেনা হয় ৪৫ কিঃমিঃ পাল্লার ১’শটা ‘৯এম৩১৭’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৪২ কিঃমিঃ পাল্লার ১’শটা ‘৯এম৩৮’ ক্ষেপণাস্ত্র।

২০১৬ সালে আজেরবাইজানের ‘আজাদ সিস্টেমস কোম্পানি’তে ইস্রাইলি প্রযুক্তি সহায়তায় ‘জারবা’ লোইটারিং সুইসাইড ড্রোন তৈরির উদ্ভোধন করেন আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিইয়েভ। ড্রোনের ব্যবহার আজেরবাইজানের সামরিক সক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।



৫) আকাশ সক্ষমতা

২০০৬ সালে ইউক্রেন থেকে ১২টা ‘এল-৩৯সি’ প্রশিক্ষণ বিমান কেনা হয়। ২০০৬ থেকে ২০১১ সালের মাঝে ইউক্রেন থেকে কেনা হয় ১৬টা ‘মিগ-২৯’ ফাইটার বিমান। ২০০৭ সালে মিগগুলিতে ব্যবহারের জন্যে কেনা হয় ৪৩টা ‘আর-২৭’ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১০ সালের মাঝে ইউক্রেন থেকে ১২টা ‘এমআই-৩৫পি’ এটাক হেলিকপ্টার কেনা হয়। এই হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়ার জন্যে ৪’শ ‘স্কিফ’ এবং ‘ব্যারিয়ার’ এন্টি ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্রও কেনা হয়। বেলারুশ থেকে ২০১২ সালের মাঝে কেনা হয় ১১টা ‘সুখোই এসইউ-২৫’ গ্রাউন্ড এটাক বিমান।

২০১৮ সালে সামরিক প্যারেডে আজেরিরা তুরস্কের তৈরি ‘এসওএম বি-১’ আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ডিসপ্লে করে। ২’শ ৩০ কেজি ওয়ারহেডের এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে খুব সম্ভবতঃ আজেরবাইজানি ‘মিগ-২৯’ এবং ‘সুখোই-২৫’ যুদ্ধবিমান থেকে ছোঁড়ার জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের মাঝে ১০টা ক্ষেপণাস্ত্র ডেলিভারি করা হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ব্যবহার করে আজেরবাইজানের বিমানগুলি শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরত্ব রেখেই আড়াই’শ কিঃমিঃ দূরের অতি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করলো।

রাশিয়া থেকে ২০১৪ সালের মাঝে ৩’শ ৬০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয় ২৪টা ‘এমআই-২৪/৩৫এম’ এটাক হেলিকপ্টার। ২০১৫ সালের মাঝে কেনা হয় ৬৬টা ‘এমআই-১৭’ এসল্ট হেলিকপ্টার। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ‘ভেক্টর’ টারেট ক্রয় করে সেগুলিকে ইউক্রেনের সহায়তায় ‘এমআই-২৪’ এটাক হেলিকপ্টারগুলিকে আপগ্রেড করা হয়।

ইস্রাইলের কাছ থেকে ২০০৮ সালে ৩০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয় ১২ ঘন্টা ওড়ার সক্ষমতার ৪টা ‘এরোস্টার’ সার্ভেইল্যান্স ড্রোন; ২০১৩ সালের মাঝে কেনা হয় ৫২ ঘন্টা ওড়ার সক্ষমতার ৫টা হেরন সার্ভেইল্যান্স ড্রোন; ২০ ঘন্টা ওড়ার সক্ষমতার ১০টা ‘হার্মিস-৪৫০’ ছোট সার্ভেইল্যান্স ড্রোন; এবং ১৮ ঘন্টা ওড়ার সক্ষমতার ৫টা ‘সার্চার’ ছোট সার্ভেইল্যান্স ড্রোন। ২০১৬ সালের মাঝে ডেলিভারি দেয়া হয় ৫০টা ‘হারপ’ লোইটারিং সুইসাইড ড্রোন। ২০১৭ সালের মাঝে কেনা হয় ৭ ঘন্টা ওড়ার সক্ষমতার ১০টা ছোট ‘অরবিটার-৩’ সার্ভেইল্যান্স ড্রোন। ২০১৮ সালের মাঝে কেনা হয় ১’শটা ‘স্কাই স্ট্রাইকার’ লোইটারিং সুইসাইড ড্রোন। ৩৬ ঘন্টা ওড়ার সক্ষমতার ২টা ‘হার্মিস-৯০০’ সার্ভেইল্যান্স ড্রোনও কেনা হয়। ২০১৯ সালের মাঝে কেনা হয় ১’শ ‘অরবিটার-১কে’ লোইটারিং সুইসাইড ড্রোন। ‘জেরবা’ নামে এই সুইসাইড ড্রোনগুলি ২০১৯ সাল থেকে আজেরবাইজানের ‘আজাদ সিস্টেমস কোম্পানি’র ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ নাখচিভান ছিটমহলে সামরিক সরঞ্জাম পরিদর্শন করছেন। আজেরবাইজানের সাম্প্রতিক সামরিক কর্মকান্ড দেশটা নেতৃত্বকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। এই আন্মবিশ্বাস নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধক্ষেত্রকে আবারও ফুঁস তুলতে পারে। তবে এই যুদ্ধের সম্ভাবনা ওঠানামা করবে তুরস্ক এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার উপর।



আজেরবাইজানের সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি

প্রায় সাড়ে ৩’শ ট্যাঙ্ক, প্রায় ৭’শ আর্টিলারি এবং প্রায় সাড়ে ৬’শ আর্মার্ড ভেহিকল কেনার মাধ্যমে আজেরবাইজান তার সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর প্রকাশ করা ‘দ্যা মিলিটারি ব্যালান্স ২০০৩-২০০৪’এর হিসেব অনুযায়ী আজেরবাইজানের সেনাবাহিনীতে সদস্যসংখ্যা ছিল ৫৬ হাজার। মোট ২৩টা মোটর রাইফেল ব্রিগেডের মাঝে এই সেনাদেরকে অর্গানাইজ করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের হিসেবে সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৫৭ হাজার। ২০১৭ সালের মিলিটারি ব্যালান্সেও সদস্যসংখ্যা প্রায় একইরকম ছিল। কিন্তু ইউনিটগুলিতে বেশকিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। ৪টা ব্রিগেডকে মেকানাইজড ব্রিগেডে পরিবর্তন করা হয়েছে; আর্টিলারি ব্রিগেডের সংখ্যা ১টা থেকে ২টাতে উন্নীত করা হয়েছে। সাড়ে ৬’শ ট্যাঙ্কের সাথে প্রায় ৪’শ সেলফ প্রপেল্ড কামান কেনা হয়। বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিটগুলির মাঝেও অনেকগুলিই ছিল মেকানাইজড ইউনিটের সাথে ব্যবহারের জন্যে মোবাইল ইউনিট। এই মেকানাইজড ব্রিগেডগুলি আজেরবাইজানের সেনাবাহিনীর আক্রমণে যাবার সক্ষমতাকে অনেকগুণে বাড়িয়েছে।

ইস্রাইলের ‘বারাক-৮’ এবং রাশিয়ার ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি আজেরবাইজানের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিকে রক্ষার জন্যে মোতায়েন করা হতে পারে। অপরদিকে মধ্যম ও স্বল্প পাল্লার ‘বুক’ ও ‘ইগলা এস’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শত্রুপক্ষের ড্রোনগুলির বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হতে পারে।

বিরাট পরিবর্তন এসেছে আজেরবাইজানের আকাশ সক্ষমতায়। ইস্রাইলের তৈরি সার্ভেইল্যান্স ড্রোনগুলির সাথে সুইসাইড ড্রোনগুলি যুক্ত হওয়ায় তা আজেরবাইজানকে আকাশ নিয়ন্ত্রণের এক ধরণের সক্ষমতা দিয়েছে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৬ সালের এপ্রিলের যুদ্ধে ইস্রাইলের তৈরি ‘হারোপ’ সুইসাইড ড্রোন ব্যবহার করে একটা আর্মেনিয় বাস ধ্বংস করা হয়, যেখানে ৭ জন নিহতের মাঝে ছিল কয়েকজন মধ্যম সাড়ির অফিসার। টার্গেট করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করার জন্যে ড্রোন ব্যবহৃত হওয়ায় ড্রোন ঠেকাবার জন্যে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়া উভয়েই উঠেপড়ে লেগেছে। ‘ফ্লাইট গ্লোবাল’ বলছে যে, ২০১৬ সালের যুদ্ধে উভয় পক্ষই খুব সম্ভবতঃ এন্টি ড্রোন ইলেকট্রনিক জ্যামিং সিস্টেম ব্যবহার করেছে। আজেরবাইজান তুরস্ক থেকে ‘এসওএম বি-১’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ফলে দেশটার পুরোনো মিগ এবং সুখোই বিমানগুলি নতুন ভূমিকা পেয়েছে। আর্মেনিয়ার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলি এখন এই ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালের মাঝে।

আজেরবাইজানের সাম্প্রতিক সামরিক কর্মকান্ড দেশটার নেতৃত্বকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। আজেরবাইজানের ‘রিপোর্ট নিউজ এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সক্ষমতার দিক থেকে আজেরবাইজানের সামরিক বাহিনী বর্তমানে বিশ্বের সেরা সামরিক বাহিনীগুলির একটা। রুশ সমর বিশ্লেষক আন্দ্রেই ফ্রোলভের কথায়, ১৫ বছরের আগের আজেরি সেনাবাহিনীর তুলনায় বর্তমানের সেনাবাহিনী বলতে গেলে আলাদা একটা বাহিনী।

আর্মেনিয় ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সাথে আজেরি মুসলিমদের দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। তবে সোভিয়েতদের রেখে যাওয়া উদ্ভট বাউন্ডারিগুলিই নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের বর্তমান দ্বন্দ্বের সূচনা করেছে। আর্মেনিয়ার নেতৃত্বের মাঝে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের প্রভাব যথেষ্ট থাকায় এই দ্বন্দ্বকে ধর্মীয় রঙে দেখেছে অনেকেই। সোভিয়েত সামরিক বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণেই ১৯৯০এর দশকে আর্মেনিয়া সামরিক দিক থেকে আজেরিদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে তুরস্কের মাঝ দিয়ে তেলের পাইপলাইন চালু হবার পর তেল বিক্রির অর্থের উপর নির্ভর করে আজেরবাইজান তার সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে থাকে। আজেরবাইজানের এই তেল মূলতঃ যায় ইউরোপে। মার্কিন ‘এনার্জি ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশন’এর হিসেবে ২০১৭ সালে আজেরবাইজানের রপ্তানি করা ৭৩ শতাংশ তেলই যায় ইউরোপে। অন্যদিকে ২০০৮ সালে জর্জিয়াতে রুশ হামলার পর আজেরিরা তুরস্ককে কৌশলগত বন্ধুর হিসেবে দেখতে থাকে। আজেরিরা তাদের নতুন কেনা অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলিকে তুর্কিদের সাথে মহড়া দিয়ে কার্যক্ষম একটা সামরিক বাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৬ সালের চার দিনের যুদ্ধে আজেরিরা তাদের নতুন প্রযুক্তি, বিশেষ করে ড্রোন ব্যবহারে বেশ দক্ষতা দেখায়। এখন তুরস্কও সিরিয়ার ইদলিবের অভিজ্ঞতা এবং সেখানে সফলতা পাওয়া প্রযুক্তিগুলি আজেরবাইজানকে সরবরাহ করছে। এতে ককেশাসে সামরিক ব্যালান্সে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। আজেরবাইজান যদি সম্ভাব্য যুদ্ধে জয় পাবার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে যায়, তাহলে নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধক্ষেত্র আবারও ফুঁসে উঠতে পারে। তবে এই যুদ্ধের সম্ভাবনা ওঠানামা করবে তুরস্ক এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার উপর।

Saturday 13 June 2020

করোনাভাইরাস রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে কমাবে না বাড়াবে?

১৩ই জুন ২০২০
     
রাশিয়ার জাতীয় দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান। করোনাভাইরাসের লকডাউন তুলে নেবার পর রাশিয়ায় এটাই প্রথম বড় অনুষ্ঠান।
১২ই জুন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মস্কোতে জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে পতাকা উত্তোলন করেন। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে গত ৯ই মের পর থেকে পুতিন প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আসলেন। করোনাভাইরাসের কারণে রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী প্যারেড ২৪শে জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। রাশিয়াতে মহামারি ঠেকাতে বলবত করা লকডাউন এখন উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। ১লা জুলাই পুতিন রাশিয়ার সংবিধান পরিবর্তনের জন্যে গণভোট ডেকেছেন। অভিযোগ রয়েছে যে, গণভোটে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে জনগণকে শপিং ভাউচার দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির মাঝে রাশিয়া খুব খারাপ সময় পার করছে। ৫ লক্ষ ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে; যার মাঝে কমপক্ষে ৬ হাজার ৭’শ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ যে, রুশ সরকার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করছে না। জনগণের একটা বড় অংশ সরকারি সাহায্যের উপর বেঁচে আছে। বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন রাস্তায় মানুষকে খাবার সরবরাহ করছে। ভ্লাদিমির পুতিনের জনপ্রিয়তা গত দুই দশকের মাঝে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এমন অবস্থাতেই পুতিন গণভোট ডেকেছেন। এই গণভোটে অনুমোদন পেলে ২০২৪ সালে পুতিনের বর্তমান ছয় বছরের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে তিনি আরও দুই বার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। অর্থাৎ কাগজে কলমে হলেও ৬৭ বছর বয়স্ক পুতিন ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার সুযোগ পাবেন।

করোনাভাইরাসের লকডাউনও যেন যথেষ্ট ছিল না। মার্চ মাসে রাশিয়া এবং সৌদি আরব তেলের বাজারে অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যার কারণে করোনা দুর্যোগে চাহিদা কমে যাওয়ার পরও ব্যাপকভাবে সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ তেলের বাজারে রেকর্ড দরপতনের পর রুশ অর্থনীতি ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে। তেল বিক্রির উপর রাশিয়ার জিডিপির ৩০ শতাংশ নির্ভরশীল। অথচ তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণে নেই রাশিয়া। এই বাস্তবতাই রাশিয়াকে বিপদে ফেলেছে। ‘সিএনবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে কাতারের জ্বালানি মন্ত্রী সাদ আল-কাবি বলেন যে, রাশিয়া এবং সৌদি আরবের তেলের বাজারের প্রতিযোগিতা একটা বড় ভুল ছিল। আর একারণে এখন কেউ উৎপাদনেই যেতে পারছে না।

তবে এত দুর্যোগের মাঝেও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে ঝরে পড়তে চাইছে না পুতিনের রাশিয়া। লিবিয়া এবং সিরিয়াতে রুশ ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা রয়েছে। ২৯শে মে মার্কিন সামরিক বাহিনীর আফ্রিকা কমান্ডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গ্রগরি হ্যাডফিল্ড বলেন যে, তারা তথ্য পেয়েছেন যে রুশরা লিবিয়াতে ১৪টা ফাইটার বিমান মোতায়েন করেছে। মার্কিনীরা বলছে যে, লিবিয়াতে এই বিমানগুলি মোতায়েনের মাধ্যমে রাশিয়া ইউরোপের দক্ষিণ দিক থেকে ইউরোপকে হুমকিতে ফেলতে পারে। বিমানগুলি রাশিয়া থেকে সিরিয়া হয়ে লিবিয়া পৌঁছায়। তবে রাশিয়াকে চাপে রাখার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে অনেকগুলি কার্ড রয়েছে। ১১ই জুন মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের জন্যে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনা পাস করা হয়।

‘মিলিটারি টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার সীমানার কাছাকাছি বল্টিক সাগরে ন্যাটোর বার্ষিক নৌ মহড়া ‘ব্যালটপস ২০২০’তে নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ১১ই জুন রুশ বল্টিক ফ্লিটের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, কয়েক ডজন রুশ ‘সুখোই ২৪’, ‘সুখোই ২৭’ এবং ‘সুখোই ৩০’ যুদ্ধবিমান একই সময়ে পাল্টা এক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। রাশিয়া বারংবারই তার সীমানার কাছাকাছি ন্যাটোর সামরিক মহড়াকে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে বলে বলছে। শুধু বল্টিকেই নয়; রাশিয়া চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহড়ার জবাব সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায় দিতে। ১০ই জুন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ আমেরিকান এরোস্পেস ডিফেন্স কমান্ড’ বা ‘নোরাড’এর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, মার্কিন বিমান বাহিনীর বিমান আলাস্কা থেকে মাত্র ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে রুশ বিমান বাহিনীর ৫টা বিমানকে বাধা দেয়। এরপর আরও তিনটা রুশ বিমান আলাস্কার ৩২ নটিক্যাল মাইলের মাঝে চলে আসে। তবে ‘নোরাড’ বলছে যে, রুশ বিমানগুলি আন্তর্জাতিক আকাশ সীমাতেই অবস্থান করছিলো। এছাড়াও বল্টিক সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং রাশিয়ার ত্রিমুখী উত্তেজনা চলছে গ্যাস পাইপলাইন তৈরি নিয়ে। রাশিয়া আশেপাশের সকল দেশকে বাইপাস করে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন তৈরি করছে জার্মানি পর্যন্ত, যা রাশিয়ার অর্থনীতির জন্যে অতি জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে, রুশ গ্যাসের উপর জার্মানির নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাক। এই লক্ষ্যে মার্কিন কংগ্রেস এই প্রকল্পে অংশ নেয়া কোম্পানিগুলির উপর অবরোধ দেয়ার জন্যে আইন পাস করছে। ১২ই জুন জার্মান অর্থ মন্ত্রণলায়রের এই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জার্মান পত্রিকা ‘ফ্রাঙ্কফুরটার আলেমাইন জাইটুং’ বলে যে, মার্কিন অবরোধ জার্মান কোম্পানি ছাড়াও সরকারি সংস্থাগুলিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

বল্টিক সাগর ছাড়াও গত পহেলা মে মার্কিন এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনী নরওয়ের উত্তরে আর্কটিকের কাছাকাছি নৌ মহড়ায় অংশ নেয়। এরও আগে মার্চের শুরুতে ব্রিটিশ নেতৃত্বে নরওয়েতে ১৬ হাজার সৈন্যের বড়সড় সামরিক মহড়া শুরু হয়। ‘দ্যা ব্যারেন্টস অবজারভার’ বলছে যে, শূণ্যের ২০ ডিগ্রি নিচের তাপমাত্রায় অনুষ্ঠিত দুই সপ্তাহের এই মহড়ার নাম ছিল ‘এক্সারসাইজ কোল্ড রেসপঞ্জ ২০২০’। এই মহড়া শেষ হতে না হতেই জবাব হিসেবে রাশিয়া তার সামরিক শক্তিকে ব্রিটেনের আশেপাশে মোতায়েন করে। একসাথে ৭টা রুশ যুদ্ধজাহাজ কয়েকদিন ধরে ইংলিশ চ্যানেলের আশেপাশে দিয়ে ঘোরাঘুরি করে। এর জবাবে ব্রিটিশ রয়াল নেভি একত্রে ৯টা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। এছাড়াও ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, রুশ বিমান বাহিনীর বোমারু বিমানগুলি শেটল্যান্ড আইল্যান্ডের উত্তরে এসে হাজির হয়। ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের ‘টাইফুন’ ফাইটার বিমান রুশ বিমানগুলিকে বাধা দেয়।

‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় ব্যারেন্টস সাগর, বল্টিক সাগর, কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়াকে ব্যাতিব্যস্ত রাখতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন। তবে পুতিনের রাশিয়াও এর জবাব দিতে চাইছে বিভিন্নভাবে। এবং একইসাথে লিবিয়া এবং সিরিয়াতেও সে তার অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে। কিন্তু করোনা দুর্যোগ এবং তেলের বাজারে মন্দার মাঝে দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে রাশিয়া এই প্রতিযোগিতাকে কতদূর এগিয়ে নিতে পারবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ।

Monday 8 June 2020

ক্যারিবিয়ানে কানাডার কি স্বার্থ রয়েছে?

০৯ই জুন ২০২০
  
ভেনিজুয়েলাতে মাদুরোর বিরুদ্ধে মিশন যে ব্যর্থ হবে, তা যদি সকলেই আগে থেকেই জানে, তাহলে এই মিশন কেন বাস্তবায়িত হলো? এই মিশনের নেতা গুডরোর স্বার্থই বা কি ছিলো? আর এক্ষেত্রে তার যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার নাগরিকত্ত্বের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব আছে কিনা?

মে মাসের শুরুতে ভেনিজুয়েলার সরকার বলে যে, তারা প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছে। তারা বলে যে, সমুদ্রপথে কলম্বিয়া থেকে আসা কিছু ভাড়াটে সেনাকে তারা হত্যা করেছে এবং কিছু সেনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দু’জন মার্কিন নাগরিককে তাদের পাসপোর্ট এবং অন্যান্য পরিচয়পত্রসহ টেলিভিশনে দেখানো হয়। এরা হলেন ৪১ বছর বয়সী এইরান ব্যারি এবং ৩৪ বছর বয়সী লিউক ডেনমান। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, এরা উভয়েই মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের প্রাক্তন সদস্য ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত ‘সিলভার কর্প’ নামের একটা নিরাপত্তা কোম্পানির মালিক জরডান গুডরো দাবি করেন যে, এই মিশন তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা। তিনি আরও দাবি করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ভেনিজুয়েলার নেতা হুয়ান গুয়াইদোর সাথে চুক্তি মোতাবেক তিনি এই অপারেশনে যান। তবে গুয়াইদো তাকে পারিশ্রমিক দেননি বলেও বলেন তিনি। ভেনিজুয়েলার টেলিভিশনে দেখানো মার্কিন সেনারা দাবি করেন যে, মিশনে যাবার সময় তারা তাদের সাথে গুয়াইদোর স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রও নিয়ে গিয়েছেন। মাদুরো দাবি করেন যে, মিশন চালানো ব্যক্তিরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তা বাহিনীর লোক। গুয়াইদো এবং ট্রাম্প প্রশাসন উভয়েই এই মিশনের সাথে জড়িত থাকার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে। ‘ভোক্স’ ম্যাগাজিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন স্পেশাল ফোর্সের সদস্য এফরাহিম মাত্তোস বলেন যে, পুরো বিষয়টা এতটাই হাস্যকর যে, এটা কখনোই কাজ করার কথা নয়। এটাকে তিনি বদ্ধ উন্মাদের কাজ বলে উল্লেখ করেন। ‘আল জাজিরা’র এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা হয় যে, এই মিশন যে ব্যর্থ হবে, তা যদি সকলেই আগে থেকেই জানে, তাহলে এই মিশন কেন বাস্তবায়িত হলো?

কে এই জরডান গুডরো? ১৯৭৬ সালে গুডরো কানাডার ক্যালগারিতে জন্ম নেন। কলেজ শেষ করে তিনি কানাডার সামরিক বাহিনীতে ঢোকেন। তবে পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং ২০০১ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীতে নাম লেখান। তিনি সেখানে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যও হয়ে যান। ‘১০ম স্পেশাল ফোর্সেস গ্রুপ’এর সার্জেন্ট ফার্স ক্লাস পদ পান তিনি। তিনি বিভিন্ন সামরিক মিশনে অংশ নেন এবং ২০১৪ সালের অগাস্টে একটা প্যারাসুট দুর্ঘটনার পর ২০১৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। অবসরের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন। ২০১৮ সালে তিনি ‘সিলভার কর্প’ নামের একটা নিরাপত্তা কোম্পানি চালু করেন। ২০১৮ সালের ২৬শে অক্টোবর নর্থ ক্যারোলিনার শারলোটসভিলে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের নিরাপত্তার কাজও করেন তিনি, যা ছবিতে দেখাও যায়। মাদুরো এই ব্যাপারটাকেই টার্গেট করেছেন।

এই অদ্ভূত ঘটনার পর প্রশ্ন আসছে যে, এই মিশনের উদ্দেশ্যই কি ছিলো ব্যর্থ হওয়া? গুয়াইদো যদি অর্থায়ন না করে থাকেন, তাহলে কেই বা অর্থায়নই করেছে? এখানে গুডরোর স্বার্থই বা কি ছিলো? কানাডার নাগরিক হওয়াতে ব্যাপারটা আরও ঘনীভূত হয়েছে। আর ভেনিজুয়েলার সাথে কিউবার ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে এখানে কিউবার কোন ভূমিকা আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো, গুডরো সরাসরি ব্যাপারটাকে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই আঘাত করেছেন কিনা? আর এক্ষেত্রে তার যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার নাগরিকত্ত্বের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব আছে কিনা? মধ্য আমেরিকা, তথা ক্যারিবিয় অঞ্চলে কানাডার কর্মকান্ডের ইতিহাস দেখলে অনেক কিছুই হিসেব থেকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার আড়াই’শ বছরের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার ইতিহাসটাই এখন আলোচনায় চলে আসছে।
   
১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘সারাটোগা’ পানামা খাল পারি দিচ্ছে। এই খাল যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলকে যোগ করেছে। এই খাল তৈরি করার পর যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানের নিরাপত্তা নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ক্যারিবিয়ানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তারা।

পানামা খাল ও এর নিরাপত্তা

১৭৭৬ সালে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয় প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। ঊনিশ শতকের শুরুতে দক্ষিণ আমেরিকায় অনেকগুলি দেশ ব্রিটিশ সহায়তায় স্পেন থেকে আলাদা হয়ে যায়। এই সময়েই ১৮২৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে ইউরোপিয় শক্তিরা যদি আমেরিকায় কোন স্বাধীন দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টাকে নিজের স্বার্থবিরুদ্ধ মনে করবে। ১৮৫০ সাল নাগাদ জেমস মনরোর এই চিন্তাটা ‘মনরো ডকট্রাইন’ নামে পরিচিতি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্মের সময় শুধুমাত্র আটলান্টিক উপকূলের ১৩টা রাজ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম দিকে তার স্থলভাগ বৃদ্ধি করতে থাকে। ১৮৪৬ সাল নাগাদ ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত মার্কিন নিয়ন্ত্রণ পৌঁছে গেলে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তৃতি পূর্বে আটলান্টিকের উপকূল থেকে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপকূলকে সমুদ্রপথে যুক্ত করার চিন্তাটা শক্তিশালী হতে থাকে। এর আগেই ১৮২৬ সালে স্পেন থেকে নতুন আলাদা হয়ে যাওয়া ‘গ্র্যান কলম্বিয়া’র নেতৃবৃন্দের সাথে মার্কিন কর্মকর্তারা মধ্য আমেরিকায় একটা খাল তৈরির প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। এই খালের মাধ্যমে আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করা যাবে। তবে গ্র্যান কলম্বিয়ার নেতা সিমন বলিভার এই প্রস্তাবে রাজি হননি। ১৮৪৬ সালে ‘গ্র্যান কলম্বিয়া’ থেকে আলাদা হয়ে তৈরি হওয়া ‘নিউ গ্রানাডা’র (পরবর্তী কলম্বিয়া) সাথে মার্কিনীরা এক চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র পানামা যোযকের স্থানে আটলান্টিক উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত ৭৭ কিঃমিল লম্বা একটা রেললাইন তৈরি করে। ১৮৫৫ সালে এই রেললাইন উন্মুক্ত হয়। এই সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূল থেকে জাহাজ পানামা পর্যন্ত যেত। এরপর রেললাইনের মাধ্যমে মানুষ প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত গিয়ে আরেকটা জাহাজে উঠে ক্যালিফোর্নিয়া যেত। ফরাসীরা এই রেললাইনের সমান্তরালে একটা খাল তৈরি করার চেষ্টা শুরু করে ১৮৮১ সালে। তবে ১৮৯৪ সাল নাগাদ তারা ব্যর্থ হবার পর যুক্তরাষ্ট্রের সামনে কোন ইউরোপিয় বাধা থাকে না। ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপে কলম্বিয়া থেকে পানামা আলাদা হয়ে যায় এবং পানামার সাথে খাল খননের জন্যে মার্কিন সরকার একটা চুক্তি করে। এই চুক্তি মোতাবেক ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মাঝে পানামা খাল তৈরি করে। এখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের উপর। এই খালের নিরাপত্তা দিতে খালের পূর্বদিকে ক্যাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ভাবতে শুরু করে।

পানামা খাল তৈরি করার আগেই যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো উপসাগর এবং ক্যারিবিয়ান সাগরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমে কিউবা থেকে শুরু করে এই পূর্বে ত্রিনিদাদ টোবাগোর মাধ্যমে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সমাপ্তি। মেক্সিকো উপসাগর এবং ক্যারিবিয়ান সাগরকে খাঁচার মতো ঘিরে রেখেছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। এই ভৌগোলিক বাস্তবতায় পানামা খাল দিয়ে যাতায়াত করা জাহাজগুলিকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল পৌঁছাতে হলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যাওয়া প্রণালিগুলি পার হয়ে যেতে হবে। কিন্তু ঊনিশ শতকের শুরুতে এই দ্বীপগুলির সবগুলিই ছিল ইউরোপিয় শক্তিদের হাতে। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের মানুষেরা কিউবাকে কিনে নেবার প্রস্তাব দিলেও সেটা উত্তরের মার্কিনীদের বিরোধের কারণে সফল হয়নি। দ্বীপগুলির মাঝে সবচাইতে বড় দ্বীপ কিউবাতে স্প্যানিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের উস্কে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৮৯৪ সাল নাগাদ বাণিজ্যের জন্যে কিউবা স্পেনের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই বেশি নির্ভরশীল ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থ রক্ষায় ১৮৯৮ সালে স্পেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। চার মাসের এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্পেনের কাছ থেকে ক্যারিবিয়ানের দ্বীপ পুয়ের্তো রিকো দখল করে নেয়। কিউবাকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় স্প্যানিশরা। একইসাথে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফিলিপাইন এবং গুয়ামকে দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

এছাড়াও পুয়ের্তো রিকো এবং ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের মাঝে অবস্থিত ডেনমার্কের অধীনে থাকা ড্যানিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছিল। ১৮৫০এর দশকেই মার্কিন কর্মকর্তারা ডেনমার্কের কাছ থেকে এই দ্বীপগুলি কিনে নিতে চাইছিল। তবে মার্কিন সিনেট একমত হতে না পারায় এই ক্রয় সম্ভব হয়নি। এরপর ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সালের মাঝে আরও একবার দীপগুলি কেনার কথা আসলে ড্যানিশ পার্লামেন্টের একমত না হতে পারার কারণে প্রকল্প ভেস্তে যায়। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯১৬ সালে ডেনমার্কের যখন জার্মানির হাতে চলে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন ২৫ মিলিয়ন ডলারে দ্বীপগুলি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। এই চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট সেন্ট ক্রই, সেন্ট জন এবং সেন্ট থমাস দ্বীপ পেয়ে যায়। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পুয়ের্তো রিকো এবং এই দ্বীপগুলির মাঝ দিয়ে প্রায় ৪০ কিঃমিঃ প্রস্থের সমুদ্র প্রণালী পুরোপুরিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসে।
  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ত্রিনিদাদে ‘ওয়ালার’ বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন ‘বি-২৪’ এন্টি-সাবমেরিন বোমারু বিমান। অস্ত্র সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে মার্কিনীরা ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ দ্বীপগুলিতে ৯৯ বছরের জন্যে ঘাঁটি লীজ পেয়ে যায়। ব্রিটেনের উপর জার্মানির চাপ যখন সর্বোচ্চ, তখনই যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে ঘাঁটিগুলি আদায় করে নেয়।

ডেস্ট্রয়ারের বিনিময়ে ব্রিটিশ ঘাঁটি

ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও দৃঢ় হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে। ১৯৪০ সালে জার্মান সৈন্যরা যখন ফ্রান্সের মাঝ দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তখন মার্কিন সরকার যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ফিলিপ কারএর মাধ্যমে লন্ডনের কাছে প্রস্তাব পাঠায়, যাতে কানাডার আটলান্টিক উপকূলের নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং ক্যারিবিয়ানে ত্রিনিদাদ এবং বার্মুডায় ব্রিটিশ বিমান ঘাঁটিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিজ দেয়ার করা বলা হয়। ২৭শে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সহায়তার বিনিময়ে এই ঘাঁটি দিতে রাজি হন। ব্রিটিশরা আটলান্টকে জার্মান সাবমেরিনের হাত থেকে ব্রিটিশ সমুদ্র বাণিজ্য রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নৌবাহিনীর কিছু পুরোনো ডেস্ট্রয়ার চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র তাতে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়নি। অবশেষে অগাস্টের শেষে যখন ব্রিটেন জার্মানির দ্বারা একেবারেই কোণঠাসা হয়ে যায়, তখন দুই দেশ সমঝোতায় পৌঁছায়। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৫০টা ডেস্ট্রয়ার লাভ করে। আর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূলে ৪টা বিমান ঘাঁটি এবং ক্যারিবিয়ানে বার্মুডা, এন্টিগা, বাহামা, ব্রিটিশ গায়ানা, জামাইকা, সেন্ট লুসিয়া এবং ত্রিনিদাদে বিমান ও নৌঘাঁটি ৯৯ বছরের জন্যে লীজ পায়। আর এই লীজের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রকে কোন অর্থ দিতে হবে না! এর মাধ্যমে এক শতকের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলে।

ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির মাঝে বাহামা, জামাইকা, এন্টিগা, সেন্ট কিটস এন্ড নেভিস, ডমিনিকা, সেন্ট লুসিয়া, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো এবং গায়ানাকে ব্রিটিশরা স্বাধীনতা দেয়। ১৯৬০এর দশক থেকে ১৯৮০এর দশকের মাঝে এই উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। তবে দ্বীপগুলি অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম ছিল না। ব্রিটিশদের অধীনে থাকা এই অঞ্চলগুলিতে ইংরেজি ছিল অফিশিয়াল ভাষা। মূলতঃ এই ইংরেজি ভাষাভাষি অঞ্চলগুলিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের প্রতিযোগিতা চলছে। তবে বাকি দ্বীপগুলি নিয়েও চলছে প্রতিযোগিতা; যেমন একসময় স্প্যানিশদের অধীনে থাকা কিউবা ও ডমিনিকান রিপাবলিক; এবং ফরাসীদের অধীনে থাকা হাইতি। এই দ্বীপগুলিতে যথাক্রমে স্প্যানিশ ও ফরাসী ভাষা চলে। প্রভাব বিস্তারের খেলায় কোন দ্বীপই বাদ যাচ্ছে না।
   
অনেকেই মনে করছেন যে, হাইড্রোকার্বন এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে আবারও পরিবর্তন করবে। তবে চিনি, মদ, কফি, কলা, বক্সাইট, পর্যটন, ব্যাংকিং, টেক্সটাইল বা হাইড্রোকার্বন কোনটাই ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার গভীর সম্পর্কের মূল কারণ নয়। ক্যারিবিয়ানে শক্ত অবস্থানে থাকার কারণেই কানাডা এখানকার ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছে। আর এই শক্ত অবস্থানের ভিত্তি রাজনৈতিক। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মাঝেই কানাডার প্রভাব বিস্তারের বীজ নিহিত।

ক্যারিবিয়ানের অর্থনীতিতে কানাডা

ষোড়শ শতক থেকেই ক্যারিবিয়ানে ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকেরা আখের চাষ শুরু করে চিনি উৎপাদন শুরু করে। সেখানকার বাসিন্দাদের নির্মূল করে ফেলার পর চিনি শিল্পে কাজ করাতে ইউরোপিয়রা আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস নিয়ে আসে। চিনি শিল্পের সাথে মদও উৎপাদিত হতো। কলা, কোকোয়া, কফি এবং তামাকও যুক্ত হয় অর্থকরী ফসল হিসেবে। তবে সকল খাদ্যশস্যই আমেরিকার মূল ভূখন্ড থেকে আসতে হতো। মোটামুটিভাবে ঊনিশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত চিনির ব্যবসা ভালোভাবে চললেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আখ এবং বীট চাষ শুরু হওয়ায় চিনির মূল্যে ধ্বস নামে এবং ক্যারিবিয়ানের ভাগ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকার ফরাসী উপনিবেশগুলির সাথে ক্যারিবিয়ানের ফরাসী উপনিবেশগুলির বেস বাণিজ্য চলছিল। বর্তমান কানাডার আটলান্টিক উপকূলে নোভা স্কোশিয়ার সাথেই মূলতঃ এই বাণিজ্য চলছিল। ১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ সালের মাঝে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটেন ফ্রান্সের কাছ থেকে পুরো উত্তর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এর ফলশ্রুতিতে নোভা স্কোশিয়ার সাথে নয়, বরং বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের বন্দরগুলির সাথে ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। ১৭৭৬ সালে ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র আলাদা হয়ে গেলেও ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই হতে থাকে। ১৮৬০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত কানাডার বণিকেরা ক্যারিবিয়ানের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির কিছুটা চেষ্টা করেন। তবে উৎপাদন বেশি এবং পণ্যের ভিন্নতার কারণে মার্কিনীরাই ক্যারিবিয়ানে এগিয়ে থাকে। শুল্ক বাধা উঠিয়ে দেবার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ানের দ্বীপগুলিতে তার প্রভাব বাড়াতে থাকে। ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্যের উপর নির্ভর করে কানাডায় বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে।

১৯৫০এর দশক থেকে জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের উপদেশে ক্যারিবিয়ানে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন শুরু হয়। ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপ দেশে জিডিপির ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। ‘ক্যারিবিয়ান ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন’এর বরাত দিয়ে ‘ক্যারিবিয়ান জার্নাল’ বলছে যে, ২০১৯ সালে ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে ৩ কোটি ১৫ লক্ষ পর্যটক ভ্রমণ করে। এদের মাঝে প্রায় ৩ কোটি পর্যটকই লাক্সারি ক্রুজ লাইনারে চড়ে ক্যারিবিয়ানে আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৫৫ লক্ষ পর্যটক আসলেও প্রায় ৩৪ লক্ষ পর্যটক নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কানাডা। নিজস্ব জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি কানাডিয় নাগরিক ক্যারিবিয়ানে ভ্রমণ করে থাকে।

তবে এখানকার কিছু দেশের অর্থনীতি অন্য সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। হাইতির অর্থনীতির বেশিরভাগটাই রেডিমেড গার্মেন্টস রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। জামাইকার অর্থনীতিতে আবার এলুমিনিয়ামের কাঁচামাল বক্সাইট খনির গুরুত্ব অনেক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এলুমিনিয়ামের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবার পর ১৯৫০এর দশক থেকে জামাইকাতে বক্সাইট খনি উত্তোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত সকল এলুমিনিয়ামের প্রায় ৪০ ভাগ উৎপাদন করেছিল কানাডা। তাই জামাইকার বক্সাইট খনিতে কানাডার আগ্রহ ছিল সবচাইতে বেশি। কানাডা বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম এলুমিনিয়ান উৎপাদনকারী দেশ। নিজেদের এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির উপর ভিত্তি করে কানাডা এই অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে নিজের দেশে বক্সাইটের খনি না থাকায় কানাডিয়রা একসময় ১৯৭০এর দশক পর্যন্ত জামাইকার উপরেই নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে কানাডা তার বেশিরভাগ বক্সাইট ব্রাজিল এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আনে। তবে জামাইকা এখনও কানাডার সবচাইতে কাছের বক্সাইট খনি। তাই কানাডার কাছে এখানকার খনির কৌশলগত গুরুত্ব অনেক।

ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর অর্থনীতিতে পর্যটনের চাইতে তেল গ্যাস উত্তোলনের গুরুত্ব অনেক। সেখানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ছাড়াও পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিতে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে। একসময় এমোনিয়া এবং মিথানল রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে চলে যায় তারা। তবে ত্রিনিদাদ ছাড়াও ক্যারিবিয়ানের অন্যত্রও শুরু হয়েছে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের হিড়িক। পেট্রোলিয়াম জিওসায়েন্স বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘জিওএক্সপ্রো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই মুহুর্তে ক্যারিবিয়ান তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠছে। কিউবা, ডমিনিকান রিপাবলিক, বাহামা, জামাইকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো এই অঞ্চলের সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে ত্রিনিদাদে যেসব খাতে কানাডিয়দের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, সেগুলির তালিকা দেয় হয়েছে; যার মাঝে প্রথমেই রয়েছে নিরাপত্তা; তারপর শিক্ষা, অবকাঠামো, এবং সবশেষে হাইড্রোকার্বন।

অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্তও কানাডার ব্যাংকগুলি ক্যারিবিয়ানে খুবই শক্ত অবস্থানে ছিল। ১৮৮২ সালে কানাডার সাথে ক্যারিবিয়ানের বাণিজ্যের উপর ভর করে কানাডার ব্যাংকগুলি ক্যারিবিয়ানে তাদের সাবসিডিয়ারি খুলতে শুরু করে। বিংশ শতকে ব্রিটিশরা ক্যারিবিয়ান ছেড়ে যেতে থাকলে কানাডার কোম্পানিগুলি তাদের স্থান নিতে থাকে। আর কানাডার সরকার এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে কানাডার কোম্পানিগুলিকে সহায়তা দিতে থাকে। ‘আইএমএফ’এর এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ক্যারিবিয়ানের সকল ব্যাংকের সকল সম্পদের ৬০ শতাংশ কানাডার তিনটা ব্যাংকের হাতে। ‘ফিনানশিয়াল পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০০৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধ্বসের পর ক্যারিবিয়ানের মূল ব্যবসা পর্যটনে যখন মন্দা দেখা দেয়, তখন ক্যারিবিয়ানের লোকাল ব্যাংকগুলি আর্থিক সমস্যায় পরে যায়। অথচ এর মাঝেও কানাডিয়ান ব্যাংকগুলি বিশাল অংকের মুনাফা করে। আর এই ব্যাংকগুলির বার্ষিক প্রতিবেদনে অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন এমনভাবে করা হয়, যাতে ক্যারিবিয়ানে কোথায় কিভাবে এই মুনাফা করা হয়েছে, তা যেন বোঝা না যায়। এই ব্যাংকগুলির মুনাফার উৎস খুব সম্ভবতঃ অফশোর ব্যাংকিং। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি, যারা নিজেদের আয়ের উৎস লুকিয়ে রাখতে চান, তারাই ক্যারিবিয়ানে এসব ব্যাংকের অর্থ গচ্ছিত রাখেন। তবে ২০১৮ সাল থেকে কানাডিয়ান ব্যাংকগুলি এই অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছে, যার কারণ এখনও পরিষ্কার নয়।

অনেকেই মনে করছেন যে, হাইড্রোকার্বন এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে আবারও পরিবর্তন করবে। তবে চিনি, মদ, কফি, কলা, বক্সাইট, পর্যটন, ব্যাংকিং, টেক্সটাইল বা হাইড্রোকার্বন কোনটাই ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার গভীর সম্পর্কের মূল কারণ নয়। কানাডার অর্থনীতির তুলনায় ক্যারিবিয়ানের অর্থনীতি খুবই ছোট। কানাডার জিডিপি যেখানে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৭’শ বিলিয়ন ডলার; সেখানে পুরো ক্যারিবিয়ানের সকল দেশ মিলে জিডিপি ৩’শ বিলিয়নেরও কম। ক্যারিবিয়ানে শক্ত অবস্থানে থাকার কারণেই কানাডা এখানকার ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছে। আর এই শক্ত অবস্থানের ভিত্তি রাজনৈতিক। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মাঝেই কানাডার প্রভাব বিস্তারের বীজ নিহিত।
  
২০১৯ সালে ‘ক্যারিকম’এর সরকার প্রধানদের বৈঠক। ‘ক্যারিকম’এর সাথে সম্পর্ক গভীর করা মাধ্যমে কানাডা ক্যারিবিয়ানে, বিশেষ করে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে তার রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রেখেছে।




ক্যারিবিয়ানের রাজনীতিতে কানাডা

১৮৬৭ সালে উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ অঞ্চলগুলিকে কানাডিয়ান কনফেডারেশনের মাঝে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে বেশকিছু ক্যারিবিয় দ্বীপ কানাডিয়ান কনফেডারেশনের অংশ হবার জন্যে চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টাগুলির কিছু বেশিদূর আগায়নি; আবার কিছু ক্ষেত্রে এগুলিকে অনেকে বাস্তবসম্মতই মনে করেছে। ১৮৮২ সালে জামাইকাকে কানাডার অংশ করার একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল, যা খুব দ্রুতই ভেস্তে যায়। বারবাডোসও চেয়েছিল কানাডার অংশ হতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন তার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপনিবেশগুলিকে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের অধীনে ছেড়ে দেয়। একইসাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সরকার চাইছিল যে, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, ক্যারিবিয়ান এবং ফকল্যান্ডস আইল্যান্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিকে কানাডার অধীনে দিয়ে দিতে। কানাডার ব্যবসায়ীরা এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। ব্যবসায়ী হ্যারি ক্রো কানাডার সরকারে নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করান, যেখানে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জকে কানাডার অংশ করলে কি কি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, তার একটা তালিকা তৈরি করা হয়। এতে বলা হয় যে, প্রায় ৩ লক্ষ বর্গ কিঃমিঃ এলাকার সাথে কানাডা প্রায় ২৩ লক্ষ জনসংখ্যা পাবে; যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয় অঞ্চল থেকে যে পণ্য সুবিধা পাচ্ছে, কানাডাও সেটা পেতে পারে; এতে কানাডার নৌশক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে; ঐ অঞ্চলে কানাডায় তৈরি পণ্যের বাজার নিশ্চিত হবে; আর বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্যে একটা পুরষ্কার হতে পারে এই দ্বীপগুলি। কিন্তু কানাডাতে উপনিবেশের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্যে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা সম্ভব না হওয়ায় এই প্রকল্প সফল হয়নি।

১৯১১ সালে বাহামা দ্বীপপুঞ্জও কানাডার অংশ হতে চেয়েছিল, যা কানাডিয়রা বাতিল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০এর দশকে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফেডারেশন’ নামে একটা রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির প্রচেষ্টা চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল যে, দ্বীপগুলিকে একত্রিত করে একটা কাঠামোর অধীনে এনে এরপর ব্রিটেন বা কানাডার সাথে রাজনৈতিকভাবে একত্রীকরণের চেষ্টা করা। ১৯৬২ সালে এই প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় যখন সবচাইতে বড় দ্বীপ জামাইকা এবং ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো ফেডারেশন থেকে বের হয়ে যায়। ১৯৬০ এবং ১৯৭০এর দশকে বেশিরভাগ দ্বীপই আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন থেকে আলাদা হয়ে যায়। কানাডার সাথে যুক্ত হবার সর্বশেষ প্রচেষ্টা করে টুর্কস এন্ড কাইকোস দ্বীপপুঞ্জ। ১৯৭০এর দশকে তারা কানাডার সাথে যুক্ত হবার চেষ্টা শুরু করে। তবে ১৯৮৭ সাল নাগাদ তা ভেস্তে যায়। এরপর ২০০৩ সালে কানাডা থেকে নতুন আরেকটা প্রচেষ্টা চালানো শুরু হয়। ২০০৯ সালের মাঝে সেই প্রচেষ্টাও বানচাল হয়ে যায়। তবে যদিও কানাডা ক্যারিবিয়ানের দেশগুলিকে নিজের সাথে একত্রিত করতে চায়নি, তথাপি ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার গভীর সম্পর্কের কারণে কানাডাকে ক্যারিবিয়ান থেকে আলাদা করা কঠিন। কানাডার জনগণকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে ‘পরিষ্কার’ রাখার জন্যেই হয়তো কানাডা ক্যারিবিয়ানের দেশগুলির সাথে আইনগত সম্পর্ক গড়েনি। তবে মুখে ক্যারিবিয়ান থেকে দূরে থাকার কথা বললেও কাজে কানাডা ক্যারিবিয়ানের অংশ হিসেবেই চিন্তা করেছে।

১৯৬৬ সালে কানাডায় ক্যারিবিয়ান দেশগুলির নেতাদের নিয়ে এক বৈঠক ডাকে কানাডা। এরপর ১৯৭৩ সালে ক্যারিবিয়ানের ইংরেজি ভাষাভাষি চারটা প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ ‘ক্যারিবিয়ান কমিউনিটি’ বা ‘ক্যারিকম’ নামের একটা সংস্থা গঠন করে; এরা হলো জামাইকা, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, গায়ানা এবং বার্বাডোস। ১৯৭০ এবং ১৯৮০এর দশকে স্বাধীনতা পাওয়া ক্যারিবিয়ানের সকল ইংরেজি ভাষাভাষি দ্বীপ দেশ এতে যোগ দেয়। ১৯৯৫ সালে ডাচ ভাষার সুরিনাম এবং ২০০২ সালে ফরাসী ভাষাভাষি হাইতিও এতে যোগ দেয়। বর্তমানে ১৫টা দেশ এর সম্পূর্ণ সদস্য; ৫টা ব্রিটিশ উপনিবেশ এসোসিয়েট সদস্য; আর ৮টা অবজারভার দেশের মাঝে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অধীন পুয়রতো রিকো, ৩টা ডাচ উনপিবেশ; আর মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলা। ক্যারিবিয়ানের একমাত্র দেশ হিসেবে ডমিনিকান রিপাবলিক এই সংস্থার অবজারভার দেশ। ১৯৭৯ সালে কানাডা এবং ‘ক্যারিকম’এর মাঝে বাণিজ্য এবং সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কানাডা এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করারও প্রতিশ্রুতি দেয়।

কানাডার সহায়তায় ১৯৬৯ সালে ‘ক্যারিবিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনও এই ব্যাঙ্কে প্রায় ৯ শতাংশ মালিকানা রয়েছে কানাডিয়দের; ৯ শতাংশ রয়েছে ব্রিটেনের; সাড়ে ৫ শতাংশ করে রয়েছে ইতালি, জার্মানি এবং চীনের; প্রায় ১০ শতাংশ রয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির; আর বাকিটা রয়েছে ক্যারিবিয় দেশগুলির। এছাড়াও ক্যারিবিয়ানে কানাডার বিভিন্ন সংস্থা যথেষ্ট গভীর সম্পর্ক রেখে চলেছে; যার মাঝে রয়েছে ‘ক্যানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ‘কানাডিয়ান ট্রেড কমিশনার’, ‘আটলান্টিক কানাডা কোঅপারেশন এজেন্সি’, ‘ট্রান্সপোর্ট কানাডা’, ‘কানাডিয়ান রেডিও টেলিভিশন এন্ড টেলিকিউমিকেশন্স কমিশন’, ইত্যাদি। কানাডার ‘ভানটেজ এয়ারপোর্ট গ্রুপ’এর অধীনে ক্যারিবিয়ানে জামাইকা এবং বাহামা দ্বীপপুঞ্জে দু’টা বিমানবন্দর রয়েছে। এছাড়াও ‘অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস’, ‘ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’, ‘প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন’ এবং ‘প্যাসিফিক এলায়েন্স’এর মাধ্যমে কানাডা ক্যারিবিয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখে।


  
২০১৬ সালে ‘অপারেশন ক্যারিবে’তে অংশ নেয়া রয়াল কানাডিয়ান নেভির যুদ্ধজাহাজ ‘সাসকাচুয়ান’, ‘এডমন্টন’ এবং মার্কিন কোস্ট গার্ডের জাহাজ ‘হ্যাডক’। এই অপারেশনে মাদক বিরোধী অভিযানে অংশ নেবার মাধ্যমে কানাডা ক্যারিবিয়ানে তার সামরিক অবস্থানকে ধরে রাখছে। একইসাথে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় তারা যুক্তরাষ্ট্রকে একা ছেড়ে দেয়নি।

ক্যারিবিয়ানের সাথে কানাডার সামরিক সম্পর্ক

১৭৪৫ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত দু’শ বছরের বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ রয়াল নেভি উত্তর আমেরিকায় তাদের অবস্থান অব্যাহত রাখে। এই অবস্থানের মূল ঘাঁটি ছিল কানাডার আটলান্টিক উপকূলের নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্স। হ্যালিফ্যাক্সে ঘাঁটি ছিল ১৯০৫ সাল পর্যন্ত। আরেকটা ঘাঁটি ছিল বার্মুডাতে; যা ১৯৫১ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিল। তবে ১৮১৯ সালে উত্তর আমেরিকায় মূল ব্রিটিশ ঘাঁটি হ্যালিফ্যাক্স থেকে বার্মুডায় স্থানান্তর করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর হুমকিকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্যে প্রস্তুতি নেয়া। ১৯১০ সালে রয়াল কানাডিয়ান নেভির জন্মের পর হ্যালিফ্যাক্সের নৌঘাঁটি কানাডার কাছে হস্তান্তর করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে কানাডার নৌবাহিনীর হাতে ছিল মাত্র ১১টা যুদ্ধজাহাজ এবং ১৮’শ নাবিক। বিশ্বযুদ্ধের মাঝে কানাডার কাছে ব্রিটিশরা পুরো উত্তর পশ্চিম আটলান্টিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে দেয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষে কানাডার হাতে ছিল ৪’শ ৩৪টা যুদ্ধজাহাজ এবং ৯৫ হাজার নাবিক।

বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ক্যারিবিয়ানে কানাডার সামরিক উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ১৯৫০এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোন বছর সম্ভবতঃ পাওয়া যাবে না, যখন ক্যারিবিয়ানে কানাডার সামরিক উপস্থিতি ছিল না। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে ক্যারিবিয়ানে তাদের মিশনগুলির বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

১৯৫০ থেকে ১৯৭৪

- ১৯৫১ সালে ঘুর্নিঝড়ে আক্রান্ত জামাইকায় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীকে ত্রাণসামগ্রী দিয়ে সহায়তা দেয় রয়াল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্স।

- রয়াল কানাডিয়ান নেভির জাহাজগুলি নিয়মিতই ক্যারিবিয়ান টহল দিচ্ছিল। এমনই এক সময়ে ১৯৫৭ সালের মার্চে কানাডার একটা ডেস্ট্রয়ারকে ব্রিটিশ উপনিবেশ সেন্ট লুসিয়ায় জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয়। সেন্ট লুসিয়ায় চিনি এবং কলা চাষে ব্যবহৃত শ্রমিকরা ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কানাডার ডেস্ট্রয়ার ‘মিকম্যাক’এর ক্রুদেরকে শহরে মোতায়েন করা হয় এবং ফলশ্রুতিতে ধর্মঘট এড়ানো যায়।

- ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ বেলিজে ঘুর্নিঝড়ের তান্ডবের পর রয়াল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- ১৯৬৩ সালে হাইতিতে রাজনৈতিক গোলযোগের সময় সেখানে মাত্র ৩ ঘন্টার মাঝে রয়াল কানাডিয়ান নেভির ডেস্ট্রয়ার ‘সাসকাচুয়ান’কে প্রেরণ করে। সেখানে সর্বদা নিজেদের জাহাজ টহলে রাখার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে নিজেদের জাহাজ প্রেরণ করে।

- ১৯৬৬ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ এন্টিগাতে রয়াল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের বিমানে করে স্কুলের সরঞ্জামাদি পাঠানো হয়।

- ১৯৭২ সালে গায়ানাতে বিমান বাহিনীর বিমানে করে স্কুল বাসও প্রেরণ করা হয়। ১৯৭৪এ টুর্কস এন্ড কাইকোসেও স্কুলের সরঞ্জাম পাঠানো হয়।

- ১৯৭২ সালে কানাডা ভেনিজুয়েলার কাছে ২০টা ‘এফ-৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রি করে।

- সেবছর নিকারাগুয়াতে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে সেখানে কানাডা বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণ পাঠায়। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪এ হাইতিতেও বিমান এবং যুদ্ধজাহাজে করে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়।
  
হাইতিতে কানাডার সৈন্য। ১৯৯০এর পুরো দশক জুড়েই হাইতির রাজনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে সেখানে মার্কিন এবং জাতিসংঘের সেনা মোতায়েন থাকে। কানাডা সবসময় এই মিশনের সাথে ছিল। এই মিশনের বদৌলতে ক্যারিবিয়ানে কানাডার সামরিক উপস্থিতি স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। এই মিশনকে ব্যবহার করে আশেপাশের দেশগুলিতেও কানাডা প্রভাব বিস্তার করেছে।


১৯৭৪ থেকে ১৯৯৯
- ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেন গ্রেনাডাকে স্বাধীনতা দেয়ার পর সেখানে বিশৃংখলা শুরু হলে কানাডা সেখানে নৌবাহিনীর দু’টা ডেস্ট্রয়ার প্রেরণ করে। ১৯৭৪ সালে হন্ডুরাসে বিমানে করে ঘুর্নিঝড় পরবর্তী ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- ১৯৭৬ সালে গুয়াতেমালায় ভূমিকম্পের পর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠায় কানাডা।

- ১৯৭৭ সালে গায়ানাতে কানাডার বিমান বাহিনীর বিমানে করে দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়।

- ১৯৭৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্টএ আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের পর সেখানে কানাডা সামরিক মেডিক্যাল দল এবং বিমান বাহিনীর বিমান প্রেরণ করে। একই বছর নিকারাগুয়ায় গৃহযুদ্ধের মাঝে বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করা হয়।

- ১৯৮৩ সালে গ্রেনাডাতে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের সময় কানাডাও সেখানে সামরিক পরিবহণ বিমান প্রেরণ করে।

- ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে হাইতিতে নির্বাচনের আগে উত্তেজনা শুরু হলে সেখানে নৌ মহড়ার আড়ালে ৭টা হেলিকপ্টার সহ তিনটা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয়। বিমান বাহিনীর পরিবহণ বিমানও প্রস্তুত রাখা হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে জামাইকাতে ঘুর্নিঝড় আঘাত করার পর সেখানে বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয় এবং সামরিক সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

- ১৯৮৯ সালে হাইতি, জামাইকা, ডমিনিকান রিপাবলিক এবং সেন্ট লুসিয়াতে বছরজুড়ে বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হয়। সেবছরের সেপ্টেম্বরে মন্টসেরাতে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর কানাডার সামরিক সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

- ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত মধ্য আমেরিকার কোস্টারিকা, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং নিকারাগুয়ায় জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সেনা মোতায়েন রাখে কানাডা।

- ১৯৯০ সালে কানাডা হাইতির নির্বাচনের সময় সেখানে সেনা সদস্য মোতায়েন করে।

- ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত জাতিসংঘ মিশনে হন্ডুরাসে কানাডার সেনাসদস্যরা মোতায়েন থাকে।

- ১৯৯২ সালের শুরুতে হাইতির রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে সেখানে হস্তক্ষেপ করে মার্কিন এবং ফরাসীদের সহায়তায় সেখানকার বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার উদ্দেশ্যে চারটা যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুত করে। পরে অবশ্য এই অপারেশন বাস্তবায়িত করা হয়নি।

- ১৯৯৪এর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধীনে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্যে কানাডার তিনটা যুদ্ধজাহাজ হাইতির উপকুলে মোতায়েন করা হয়। ১৯৯৫এর মার্চে সেখানে ৫’শ সেনা মোতায়েন করা হয়। ১৯৯৬এর মার্চে সেখানে সামরিক সদস্যের সংখ্যা সাড়ে ৭’শ করা হয়। ১৯৯৭এর নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে কানাডার সামরিক বাহিনীর প্রায় ৭’শ সদস্য মোতায়েন থাকে। ২০০০এর মার্চ পর্যন্ত কানাডার সামরিক উপস্থিতি ছিল সেখানে। ১৯৯৩এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৪এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাইতির উপকূলে কানাডার নৌবাহিনী জাহাজ মোতায়েন থাকে। পুরো অপারেশনে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিলেও কানাডা সেখান থেকে কখনোই সরে আসেনি।

- হাইতিতে কানাডার সেনাদের জন্যে সাপ্লাই দেয়ার সময়ে কানাডার সামরিক বিমানগুলি ১৯৯৫এর জুনে কোস্টা রিকাতেও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যায়। সেবছরের সেপ্টেম্বরে ত্রিনিদাদেও ত্রাণসামগ্রী পাঠায় তারা। সেবছরের সেপ্টেম্বরে এন্টিগা এন্ড বারবুডাতে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর সেখানে কানাডার কোস্ট গার্ডের জাহাজে করে সামরিক সহায়তা পাঠানো হয়।

- ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত গুয়াতেমালায় জাতিসংঘ মিশনের অধীনে কানাডা সেখানে সামরিক অফিসারদের মোতায়েন রাখে।

- ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে হন্ডুরাসে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর সেখানে কানাডার সামরিক সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

- ১৯৯৯ সালে হাইতি এবং সেন্ট লুসিয়াতে বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী এবং এম্বুল্যান্স পাঠানো হয়।

২০০১ থেকে ২০০৮

- ২০০১ সালের জানুয়ারিতে এল সালভাদরে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর কানাডার বিমান বাহিনীর বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- বেলিজে ঘুর্নিঝড় আঘান হানার পর ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিমান বাহিনীর বিমানে করে সেখানে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়।

- ২০০৪এর ফেব্রুয়ারিতে হাইতিতে সহিংসতা বেড়ে গেলে কানাডার বিমানবাহিনীর বিমানে করে সেখান থেকে বিদেশী নাগরিকদের বের করে আনা হয়। এরপর সেখানে জাতিসংঘের অধীনে প্রায় ৫’শ কানাডিয়ান সামরিক সদস্যকে মোতায়েন করা হয়। এর বেশিরভাগ সেনাকেই ফেরত আনা হলেও সেখানে কিছু উচ্চপদস্থ কানাডিয়ান সামরিক কর্মকর্তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে রেখে দেয়া হয়।

- ২০০৭ সালের অগাস্টে ঘুর্নিঝড় আঘাত হানার পর জামাইকাতে কানাডার সামরিক বিমানে করে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়া হয়।

- ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে হাইতিতে ঘুর্নিঝড়ে আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে ক্যারিবিয়ানে মাদক নির্মূল অভিযানে মোতায়েনকৃত কানাডার নৌবাহিনী ফ্রিগেট ‘সেন্ট জন’কে সেখানে ত্রাণ সহায়তা দেবার জন্যে পাঠানো হয়।

এই মিশনগুলির মাঝে ১৯৫০এর দশক থেকে ১৯৮০এর দশক পর্যন্ত কানাডার সামরিক মিশনগুলি সংখ্যায় ছিল কম এবং বেশিরভাগই ছিল ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার বা ব্রিটিশ উপনিবেশে শান্তি রক্ষা করার মিশন। ১৯৯০এর দশকে সামরিক মিশনগুলির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় হাইতি। দুর্যোগের কারণে ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার মিশন এর মাঝেই চলেছে। বিভিন্ন দেশে নিজেদের নাগরিক সরিয়ে নেবার কথা বলে বহুবার সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবে প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্রের মিশনের সাথে কানাডা যুক্ত ছিল।

২০০৬ সালের নভেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ানে নতুন মিশন শুরু করে কানাডা। ‘অপারেশন ক্যারিবে’ নামের মাদক চোরাকারবারি বন্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করা এই মিশনে ২০১০ সাল থেকে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১২ সাল থেকে মার্কিন ‘অপারেশন মারটিলো’র অধীনে ন্যাস্ত করা হয় কানাডার মিশনকে। চুক্তি অনুযায়ী কানাডার জাহাজে মার্কিন কোস্ট গার্ডের সদস্যারা থাকবে; তারাই সরাসরি মাদক চোরাকারবারিদেরকে ধরবে। কানাডা এক্ষেত্রে শুধু লজিস্টিক্যাল সুবিধা দেবে। এল সালভাদরের কমালাপা বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন নেতৃত্বে কানাডা ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান মোতায়েন করে। মিশন শুধু ক্যারিবিয়ানেই সীমাবদ্ধ নয়; মিশনের অনেকটা টহল পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার পশ্চিম উপকূলেও চলছে। এই মিশনের অধীনে কানাডা অত্র অঞ্চলে নিয়মিত তাদের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রাখছে।
  
‘এক্সারসাইজ ট্রেইড উইন্ডস’ ২০১৯এ কানাডার সাথে অংশ নিচ্ছে ক্যারিবিয়ান সামরিক সদস্যারা। এই মহড়াকে ব্যবহার করে কানাডা জামাইকাতে ‘অপারেশনাল সাপোর্ট হাব’ বা ‘ওএসএইচ’ তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে অতি দ্রুততার সাথে কানাডা থেকে সৈন্য, রসদ, অস্ত্র এবং অন্যান্য সাপ্লাই নিয়ে যাবে; এবং সেখান থেকে পুরো ক্যারিবিয়ানের যেকোন স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে।

জামাইকায় সামরিক সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রতিবছর কানাডা ‘এক্সারসাইজ ট্রেইড উইন্ডস’ নামের মহড়ায় অংশ নেয়। এই মহড়ার লক্ষ্য হিসেবে প্রথমেই বলা হচ্ছে অপরাধ দমন; এরপর রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। এই মহড়াকে কেন্দ্র করেই ২০১৬ সাল থেকে কানাডিয়ানরা জামাইকাতে একটা স্থায়ী ‘অপারেশনাল সাপোর্ট হাব’ বা ‘ওএসএইচ’ তৈরি শুরু করে। এই হাবের মাধ্যমে পুরো ক্যারিবিয়ানে কানাডিয়ানরা যেকোন সময় তাদের সামরিক কর্মকান্ড চালাতে পারবে। এর মাধ্যমে তারা অতি দ্রুততার সাথে কানাডা থেকে সৈন্য, রসদ, অস্ত্র এবং অন্যান্য সাপ্লাই নিয়ে আসতে পারবে; এবং সেখান থেকে পুরো ক্যারিবিয়ানের যেকোন স্থানে নিয়ে যেতে পারবে। ২০১৮ সালের অগাস্টে এই হাব অপারেশনে আসে। জামাইকার সাথে কানাডার সামরিক সম্পর্ক সবচাইতে গভীর। ১৯৬৫ সাল থেকে জামাইকার এক হাজার ৬’শ ৬০ জন সামরিক সদস্য কানাডায় প্রশিক্ষণ পেয়েছে। আর জামাইকাতে কানাডা বেশ কয়েকটা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করেছে, যেখানে পুরো ক্যারিবিয়ানের সকল দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ নেয়।

১৯৯৩ সাল থেকে জামাইকাতে চালু রয়েছে ‘ক্যারিবিয়ান জুনিয়র কমান্ড এন্ড স্টাফ কোর্স ফ্যাসিলিটি’। ২০০৬ সালে তৈরি করা হয় ‘ক্যারিবিয়ান মিলিতারই এভিয়েশন স্কুল’। ২০০৮ সালে তৈরি করা হয় টেকনিক্যাল ট্রেনিং স্কুল। ২০০৯ সালে তৈরি হয় ‘ক্যারিবিয়ান কাউন্টার টেররিজম ট্রেনিং সেন্টার’। ২০১২ সালে শুরু হয় ‘ক্যারিবিয়ান মিলিটারি ম্যারিটাইম ট্রেনিং সেন্টার’। ২০১৭ সালে তৈরি হয় ‘ডিরেক্টোরেট অব ট্রেনিং এন্ড ডকট্রাইন’। ২০১৮ সালে চালু হয় ‘ক্যারিবিয়ান স্পেশাল ট্যাকটিকস সেন্টার’।
  
২০১৬ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কিউবা ভ্রমণ। কিউবার ব্যাপারে কানাডার নীতি সর্বদাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতির উল্টো। ক্যারিবিয়ানে প্রভাব বিস্তারের খেলায় ব্রিটিশ সময় থেকেই কানাডা যুক্তরাষ্ট্রকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবার সাথে সম্পর্ক ধরে রাখার ব্যাপারটাও সেই একই চিন্তার অংশ।


কিউবার সাথে সম্পর্ক

কিউবার সাথে কানাডার বাণিজ্য চলছে অষ্টাদশ শতক থেকেই। তবে রাষ্ট্র হিসেবে কানাডা এবং কিউবার মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৪৫ সালে। পুরো ক্যারিবিয়ানে কিউবাতেই কানাডিয়ানরা প্রথম দূতাবাস খোলে। ১৯৫৯ সালে কিউবাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর মাত্র দু’টা দেশ কিউবার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখে; এর একটা মেক্সিকো; অন্যটা কানাডা। কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন ডিফেনবেকার ঘোষণা দেন যে, আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তিনি কিউবার সাথে সম্পর্ক রাখবেন। একই বছরের এপ্রিলে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো কানাডা সফরও করেন। ডিফেনবেকারের সরকার সকলকে বার্তা দেয় যে, কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হুবহু নকল করে চলবে না। ১৯৬৩ সালে ডিফেনবেকার নির্বাচনে হেরে যাবার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোও কানাডার পররাষ্ট্রনীতিকে মার্কিন প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার কথা বলেন। পিয়েরে ট্রুডো বর্তমান প্রধানন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বাবা। ১৯৬০ এবং ১৯৭০এর দশকে কিউবার সাথে বাণিজ্যের ব্যাপারে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাংঘর্ষিক নীতি অনুসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে থাকা কিউবার অর্থনীতিতে কানাডার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কিউবার ট্যুরিস্ট বোর্ডের বরাত দিয়ে ‘ট্রাভেল পালস কানাডা’ বলছে যে, ২০১৯ সালে কিউবাতে ১১ লক্ষের বেশি কানাডিয়ান ভ্রমণ করেছে। এই সংখ্যা কিউবায় ভ্রমণ করা সকল পর্যটকের প্রায় এক চতুর্থাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ১৯৯৬ সালে পাস করা ‘হেলমস বারটন এক্ট’ বাস্তবায়নের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র কানাডার উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই আইনের ‘টাইটেল ৩’এ বলা হয় যে, কিউবাতে মার্কিন নাগরিকদের সম্পদ কিউবার সরকার বাজেয়াপ্ত করে থাকলে মার্কিন নাগরিকেরা কিউবায় সেই সম্পদের বর্তমান ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। এই আইনের প্রতিবাদে কানাডার হাইজ অব কমন্সে ‘গডফ্রে মিলিকেন বিল’ নিয়ে আসা হয়, যার মাধ্যমে বলা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মের সময় যেসকল ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন এবং কানাডায় পালিয়ে এসেছিলেন, তাদের বাজেয়াপ্ত সম্পদ তাদের উত্তরসুরীরা পাবার জন্যে চেষ্টা করতে পারবে। কানাডার প্রতিবাদের কারণে ‘হেলমস বারটন এক্ট’এর ‘টাইটেল ৩’ ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করে দেয়া হয়। ২০১৯এর ২৭শে এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, ‘টাইটেল ৩’ এখন কার্যকর করা হবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ৩রা মে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কিউবার প্রধানমন্ত্রী মিগেল দিয়াজ কানেলের সাথে ফোনে কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফাভাবে ‘টাইটেল ৩’ কার্যকর করার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ট্রুডো কিউবাতে কানাডার জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবেন বলে বলেন।

ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কানাডা যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেই যাবে

জরডান গুডরোর ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বছরে ট্রাম্পের জন্যে সুখকর কোন খবর নয়। এর মাত্র ক’দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ব্যাপারে ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসে পাস করা আইন বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দেয়। এর কিছুদিন পরেই ২৫শে মে ইরান থেকে তেল নিয়ে আসা ট্যাঙ্কার ভেনিজুয়েলায় প্রবেশ করে। এই ঘটনাগুলি ট্রাম্প প্রশাসনকে নির্বাচনের বছরে হিস্প্যানিক ভোটারদের সামনে দুর্বল করতে পারে। গুডরোর কানাডার নাগরিকত্ব ক্যারিবিয়ানে প্রায় আড়াই’শ বছরের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময় থেকেই কানাডা ক্যারিবিয়ানে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলিকে ছেড়ে দেবার পর কানাডা ব্রিটিশ কমনওয়েলথের নীতিই ধরে রেখেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেছে। প্রথমে অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পর্কের সূচনা হলেও বর্তমান কানাডা ক্যারিবিয়ানের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং ক্যারিবিয়ানের ছোট দ্বীপ দেশগুলিই কানাডার উপর নির্ভরশীল। ব্রিটিশদের প্রাক্তন উপনিবেশে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবেই দেখেছে। একারণেই কানাডা ক্যারিবিয়ানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে সর্বদা ব্যস্ত থেকেছে। ঔপনিবেশিক শক্তি হবার তকমা নিতে না চাইলেও ক্যারিবিয়ানকে কানাডা নিজের মনে করেই দেখেছে। কানাডা আলাদা কোন জাতীয়তাবাদী শক্তি নয়। বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রবাহে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর কৌশলের মাঝে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকেই ব্রিটেনের আত্মার অংশ হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে। আদর্শিক দিক থেকে একই সূত্রে গাঁথা এই দেশগুলি তো এক সুরেই কথা বলবে। প্রশান্ত মহাসাগরে যেমন অস্ট্রেলিয়াকে ব্রিটেনের হাত হিসেবে দেখতে চাইছেন তারা, তেমনি আমেরিকা মহাদেশে কানাডাকে তারা দেখতে চাইছেন অগ্রগামী অবস্থানে। ভেনিজুয়েলা এবং কিউবার সাম্প্রতিক ইতিহাস ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে দুর্বল করে। আর এই সুযোগটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিলে অবাক হবার কিছু নেই। ক্যারিবিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের উঠানেই চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে।